Friday, July 5, 2024
Homeকিশোর গল্পপটলার অদৃশ্য বন্ধু - শক্তিপদ রাজগুরু

পটলার অদৃশ্য বন্ধু – শক্তিপদ রাজগুরু

পটলা খবরের কাগজটা কিছুক্ষণ পড়ার পরই সেটাকে আশমানে ছুড়ে দিয়ে গর্জে ওঠে—ধ্যাৎ তে তে রি কা। সব ফোন টোয়েনটি! ই-ইন্ডিয়ার কী হল বল তো !

পটলা ইদানীং ইন্ডিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই চিন্তিত। মাঝে মাঝে পটলার মাথায় এক-একটা চিন্তা এসে সেঁদিয়ে যায়। আর তখন কিছুদিন পটলা সেইটার পিছনেই পড়ে। একটা হেস্তনেস্ত না করে ছাড়ে না ।

ইদানীং পটলার মাথায় ঢুকেছে অন্যায়ের প্রতিকার করতেই হবে। তাই নিয়ে সে মায় রবীন্দ্রনাথের কবিতাও আওড়ায় ।

“অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে,

তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।”

এই নিয়ে স্কুলের পরীক্ষাতেও এবার দারুণ ‘এসে’ লিখেছে। বাংলার টিচার মদনবাবুও বলেন, দারুণ লিখেছ বিদ্যুৎ (পটলার ওইটা নাকি ইস্কুলের নাম) এবার তোমাদের ক্লাব থেকেও সমাজের কোণে কোণে জমে ওঠা অন্যায়গুলোকেই দূর করার চেষ্টা কর।

পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের আমরা ক’জন সভ্যই ক্লাবের মাথা। হোঁৎকা, গোবর্ধন অবশ্য আমাদের বাহু। অর্থাৎ শক্তি, বুদ্ধি দেয় ওরাই। ফটিক গাইয়ে-টাইপের ছেলে, স্কুলের পরীক্ষাটা কোনোমতে টপকায় মাত্র। তার ধ্যান জ্ঞান ওই সঙ্গীত। তাও আজকের কিছুই না জেনে হেলেদুলে গিটার বাজিয়ে জীবনমুখী টাইপের গান নয়। ওকে বলে ফটিক—ফক্কিবাজি রে। গান হচ্ছে কালোয়াতি গান। ভারতের রাগসঙ্গীতই আসল ।

তাই ভোর থেকেই ক্লাবের ঘরে এসে গলা সাধতে থাকে, বিকট স্বরে এমন সাপট তান মারেই যে, কাক চিলও এমুখো হয় না।

হোঁৎকা অবশ্য খেতে পেলেই খুশি, ‘সব করে দেবে’ পটলার বাবা-কাকার বিরাট কারখানা; ঠাকুমার তো অনেক সম্পত্তি, একটা বাজারই ওদের। টাকার অভাব নেই। আর পটলা ওই বনেদি বাড়ির একমাত্র কুলপ্রদীপ।

সুতরাং সেই আমাদের ক্লাবের কামধেনু কাম ট্রেজারার। আর হোঁৎকা এবার সেক্রেটারি; গোবর্ধনের মামার বিরাট কুমড়োর ব্যবসা। কুমড়ো, চালকুমড়ো এসবের ওরা হোলসেলার । তারকেশ্বর, বর্ধমান, বনগাঁ অঞ্চলের সব কুমড়ো ট্রাকবন্দী হয়ে আসে ওদের গুদামে এক-একটা খোলের সাইজ, কোনোটা ফুটবলের মতও। ওই কুমড়োর সংস্পর্শে থেকে গোবর্ধনও কুমড়োর মত ফুলে উঠছে। ওদের পাশে পটলা, আমি আর ফটকে তো স্রেফ এইটুকু।

কিন্তু পটলার কর্তৃত্বই বেশি। তাই পটলার ওই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এখন আমরাও যোগ দিয়েছি। আর করার মত একটা কাজও হাতের কাছে পাকা ফলের মত টপ করে খসে পড়েছে।

এদিকে বেশ কিছু তেলকল গজিয়ে উঠেছে। ছোট বড় মাঝারি সাইজের তেলকল এখন এদিকে-ওদিকে চলছে।

হরষিতবাবু এই অঞ্চলের লিডার। লোকটা কয়েক বছর আগে রাসমণি বাজারে একটা মনোহারি দোকান দিত। দোকান ওই নামেই। বাজারের ফড়ে, ব্যাপারীদের নিয়ে মাঝে মাঝে মিটিং মিছিল করত।

আর এদিকের নেতা বসন্তবাবুর বয়স হয়েছে, ওই বসন্তবাবুর সঙ্গেই ঘুরত। সৎ মানুষ বসন্তবাবু। তিনি এখানের পথঘাট, জল নিকাশি ব্যবস্থা এসবের অনেক উন্নতি করেছেন। জনসাধারণের সঙ্গে দেখা করে তাদের সুখদুঃখের খবর নিতেন; হরষিত তখন বসন্তবাবুর ছায়া ।

তারপরের বারেই কোনো জাদুমন্ত্রবলে হরষিতবাবুই ভোটে জিতে বসন্তবাবুকে হটিয়ে নিজেই এখানের এম-এল-এ হয়ে গেল। আর বাজারের ফড়েদের, স্থানীয় কিছু মস্তানকেও দেখা গেল তার মিছিলে। তেলিয়া মস্তান হরষিতের পাশে এসে ফিট হয়ে গেল।

হরষিতবাবু নেতা হয়ে বসল। পরের বার ভোটের সময় দেখা গেল তার বুথে ওই তেলিয়ার দলই সর্বেসর্বা। বীরদর্পে মোটরবাইক হাঁকিয়ে ঘুরছে তেলিয়া। তার দলবল সাধারণ ভোটারদের ভোটের বাক্সের ধারে কাছে এগোতে দিল না, জিতলেন হরষিতবাবুই।

এখন হরষিতবাবুর বিশাল বাড়ি, দু-তিনটে গাড়ি। সর্বদাই ব্যস্ত, দেখা মেলে না তাঁর। গাড়িতে চড়ে ঘোরেন। এলাকার পথঘাট-এর কাজও হয় না। বর্ষার চার মাস এলাকার বেশিটা জলে ডুবে থাকে ।

সারা বাজারের বাইরে রাস্তাতেও বাজার এসে বসেছে। পুলিশ দেখে মাত্র। তেলিয়ার দলের দৈনিক রোজগার এখন কয়েক হাজার টাকা, এর অর্ধেক নাকি হরষিতবাবুর। বাকি ভাগ করে নেয় তেলিয়ার দল। পুলিশদেরও প্রণামী ঠিক দেয়। সাধারণ মানুষ ওদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।

বাজারের দোকানদার সাহুজির ছিল একটা রেশনের দোকান। কোনো রন্ধ্রপথে সেই সাহুজি এখন হরষিতবাবুর খুব কাছের লোক হয়ে গেছে। তার ছেলে এখন হরষিতের সেক্রেটারি। ব্রিজভূষণ সাহুর কনট্রাকটারি ব্যবসা। পথঘাট মেরামতের কনট্রাক্ট সেই-ই পায়। লাখ লাখ টাকার কাজ। পথেঘাটে দু-চার ঝুড়ি খোয়া পড়ে মাত্র। ড্রেনের নর্দমার পাঁক দু-একদিন তোলা হয়। মানুষজন আশান্বিত হয়। এবার পথঘাট মেরামত হবে। জলনিকাশি ড্রেনও তৈরি হবে। কিন্তু কোথায় কী? আর কিছুই হয় না।

সেদিন বৃদ্ধ প্রমথবাবু রিকশা উলটে পড়ে হাত ভাঙলেন। আমরাই তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম; হরষিতবাবুর কাছে আমরাই ক্লাবের পক্ষ থেকে রাস্তার ব্যাপারে বলতে গেলাম। তিনি বলেন, সে কী! রাস্তা তো নতুন হয়ে গেছে। বারো লাখ টাকা পেমেন্টও হয়ে গেছে। আমি তদন্ত করছি।

ওই পর্যন্তই। পটলা বলে দ্-দ্যাখ দুর্নীতি ক্-কাকে বলে! উত্তেজিত হলে পটলার জিভের ব্রেক ফেল করে আলটাকরায় সেট হয়ে যায়। উত্তেজিত হওয়ারই কথা।

হোঁৎকা তার দেশজ ভাষায় বলে—হালা চোরের দুনিয়া হইগেছে গিয়া। পটলা বলে, এখনও কিছু করবি না! সায়লেন্ট থাকবি? প্রতিবাদ করতেই হবে।

আমরাও ভাবছি কথাটা। তাই সেদিন বেশ কিছু ছেলেদের নিয়ে খেলার মাঠের দাবিতে মিছিল করতে জনসাধারণও এগিয়ে আসে।

প্রমথবাবু, বাংলার টিচার মদনবাবু, কুলেপাড়ার কিছু ছেলেও আমাদের পাশে আসে। একটা মাঠ বেওয়ারিশ পড়ে ছিল, সেখানেই সকলে খেলত। হঠাৎ ওই ব্রিজমোহনের লোক এসে ইট-এর লরি খালাস করতে গেলে সকলে বাধা দিই ।

সেই রাতেই আমাদের ক্লাবঘরটাই জ্বালিয়ে দেয় কারা। দরমার ঘর পুড়ে ছাই। ফুটবল, ক্যারামবোর্ড সব সাফ। আর তেলিয়াই এসে বলে, ওসব আন্দোলন করলে ফিনিশ করে দেব।

অর্থাৎ ওই হরষিতের দল চায় না আমরা কিছু করি। ওদের সব অন্যায় জুলুম আমাদের মুখ বুজে সহ্য করতে হবে। হোঁৎকা গর্জে ওঠে—মাঠ জবর দখল করবা? মগের মুলুক ? তেলিয়া জিন্স-এর প্যান্টের পকেট থেকে চেম্বার বের করে বলে, এটা দেখেছিস! বাঁচতে যদি চাস, মুখ বুজে থাকবি। না হলে কড়াক্ পিং–ব্যস, খেল খতম।

আমরা চমকে উঠি। ওই শয়তানের দল যে সমাজের এত গভীরে গেড়ে বসেছে তা জানা ছিল না। তবু মনের অতলে একটা যন্ত্রণাই ফুটে ওঠে।

এরপর দেখা যায় ওই তেলকলের ব্যবসা। শোনা যায় ও সবই নাকি হরষিতবাবু আর ব্রিজভূষণেরই। ট্রাক, ঠেলাগাড়িতে সরষের তেলের ড্রাম চালান যায়

আর ওই সাহুজির দোকান থেকেও মিলের এক নম্বর পবিত্র সরষের তেলও বিক্রি হয়। সেবার, হঠাৎ সাত নম্বর বস্তি, ওদিকের পাড়ার বেশ কিছু লোক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল। বমি দাস্তু জ্বর, নানা উপসর্গ। একেবারে মড়ক লাগার মত অবস্থাই। ক্লাব থেকে আমরাই তাদের হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, পাড়ার মানুষরাও এগিয়ে এলেন। তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা

হল।

কারণও ধরা পড়ল, বিষাক্ত সরষের তেল থেকেই এসব হয়েছে। আর ওরা সেই তেল কিনেছে ওই সাহুজির দোকান থেকেই।

সারা এলাকার মানুষকে নিয়ে দোকানে গেলাম আমরা। পটলা বলে, প্রতিকার চাই। মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলবে না। দোকান বন্ধ করে সাহুজি নাকি বর্ধমান চলে গেছে। পুলিশ এসে লাঠি চালায় শান্তিরক্ষার জন্য। আমাদেরও হাতে মাথায় লেগেছে। হরষিতবাবুও এসে বলে, পুলিশ তদন্ত করছে। দোষীর শাস্তি হবেই।

পটলা বলে—কিছুই হবে না।

হোঁৎকা শোনায়—রাস্তার লাখ লাখ টাকা চুরি হইল, কী তদন্ত করছেন?

—চোপ! গর্জে ওঠে হরষিতবাবু।

তেলিয়া বলে—দেবো ফিনিশ করে!

সরে আসি। আজ মনে হয় সমাজের সর্বত্র এই অন্যায়, চুরি-অবিচারই চালাবে ওরা গায়ের জোরে, আর তাই মুখ বুজে দেখতে হবে আমাদের।

রাত নেমেছে। এদিকে এখনও গাছগাছালি কিছু আছে। ক্লাবঘরটা নেই, ধ্বংসস্তূপ আমাদেরও আজ পুলিশ দিয়ে পিটিয়েছে হরষিত। সাহুজির ছেলে ব্রিজমোহনের দল, তেলিয়া
তো শেষ করতেই চায় আমাদের। পটলা বলে, তবু থামব না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেই

হবে।

হঠাৎ একটা পিক্‌ পিক্‌ শব্দ শুনে চাইলাম সকলে। ঝোপের বুকে জোনাকি জ্বলছে, হঠাৎ ওই ম্লান আলোগুলো যেন একটি দেহের রূপ নেয়। চোখের সামনে দেখি একটা মূর্তি স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। আমরা হতবাক! মূর্তিটা বলে, ভয় পেয়েছ, না?

পরনে বিচিত্র আকারের পোশাক। মাথায় একটা টুপির মত, তাতে একটা টিকির মত কী উঠে আছে।

সে-ই বলে, তোমাদের ক’দিন ধরেই দেখছি সকলের ভালো করতে চাও, অন্যায়ের প্রতিকার করতে চাও। তবে এত সহজে ভেঙে পড়লে তো চলবে না !

আমাদের দিকে নীলাভ চোখ মেলে বন্ধুর মতই চেয়ে থাকে সে। শুধোই, তোমার নাম কী? আমাদের দেখেছ বলছ, এখানে কোথায় থাক? তোমাকে তো দেখিনি কখনও ? হাসে সে। বলে, আমি নিজে দেখা না দিলে আমাকে কেউ দেখতে পায় না। তোমাদের খুব ভালো লেগেছে। সত্যিই ভালো ছেলে তোমরা, তাই নিজে থেকে দেখা দিয়ে পরিচয় করতে এলাম।

বললাম—তুমি কোথায় থাক?

আমার কথায় বলে সে, সর্বত্র। সব জায়গাতেই আমার গতি অবাধ। আমি তোমাদের পাশের গ্রহেরই মানুষ, তোমাদের ভালো লাগল, এসে গেলাম।

হোঁৎকা বলে, আর কী হইব। আমাগোর করনের আর কিছুই নাই। পটলা বলে, ক্লাবঘর তো জ্বালিয়ে দিয়েছে ওই তেলিয়ার দল। ওদের বিরুদ্ধে কথা বলি তাই ৷

পিক্ পিক্ করে বলে অচেনা বন্ধু—আরও বলবে, ওদের সকলের মুখোশই খুলে দেবে। আমি জানাই—ওরা শেষ করে দেবে অচিন মানুষ ।

সে বলে, ধ্যুস। আমিও এখন থেকে তোমাদের ক্লাবের সভ্য হয়ে গেলাম। কাল সকালে এসো—ঠান্ডা মাথায় আলোচনা করে যা করার করব। রাজি?

হঠাৎ এমনি একজনকে পেয়ে যাব, ভাবিনি। এটা তেলিয়াদের কোনো প্ল্যান কি না বুঝতেও পারি না। বন্ধুটিকে আর দেখাও যায় না। চারদিক শুনশান, সে কোথায় হাওয়া হয়ে গেছে। হোঁৎকা বলে, কেসখান কী রে?

পটলা আশাবাদী। তাই সে বলে—নিশ্চয়ই কোনো মহান আত্মা। দেখবি এবার, একটা কিছু হবেই।

গোবর্ধন-এর দেহটাই বড়, বুদ্ধি সেই অনুপাতে বেশ কমই। বলে সে, ম্যাজিক ট্যাজিক নয় তো রে !

পরদিন ভোরেই এসেছি সবাই ক্লাবের মাঠে। ভোরের আলো তখনও ফোটেনি। গাছগাছালি ঘেরা মাঠে পাখিদের কলরব ওঠে। দেখে চমকে উঠি-পোড়া দরমার ঘরখানার চিহ্নমাত্র নেই, রাতারাতি সেখানে গড়ে উঠেছে সুন্দর ক্লাবঘর। আগের থেকেও সুন্দর । ফুটবল, ক্যারাম সবই এসেছে। মায় ফটিকের হারমোনিয়ামটাও এসে গেছে একেবারে নতুন হয়ে।

হোঁৎকা বলে, এ কী রে ?

পটলার তোলামি বেড়ে গেছে। বলে সে, ম-ম্যাজিক নাকি রে?

ফটিক নতুন হারমোনিয়াম পেয়ে খুশিতে ফেটে পড়ে। হারমোনিয়ামে বাজাতে থাকে খুশির সুর।

পিক্‌ পিক্! সেই বিচিত্র শব্দে চাইল ওরা। হলঘরের কোণে হঠাৎ তার ছবিটা ফুটে ওঠে। দেখা যায় সেই মূর্তিটাকে।

কী গো, খুশি ? চমকে উঠি—তুমি!

হাসে সে, তোমাদের দুঃখ দেখে করে দিলাম এসব।

তুমি অনেক কিছুই করতে পারো? আমার কথায় সেই অচিন মানুষ বলে–তা ঠিক পারি না, তবে তোমাদের ইচ্ছা যদি সত্যিই থাকে কিছু করার, সেটা আমি করতে পারি। আসলে মানুষের ইচ্ছা হলেই আর তাতে অনেকের ভালো হলে তবেই সে কাজ করা যায়।

হোঁৎকা কী ভাবছে। পটলা বলে, তাহলে সমাজের বুকে লোভী মানুষদের অন্যায়ের প্রতিকার করা যায় ?

নিশ্চয়ই যায়। তবে আন্তরিকতা চাই-ই। পিক্ পিক্ করে জানায় কথাটা সেই বন্ধু।

হঠাৎ কাদের গর্জনে চাইলাম আমরা। তেলিয়া মস্তানের দল ভেবেছিল জায়গাটার দখল তারা পেয়ে যাবে। ব্রিজমোহন সাহু আর হরষিতবাবু এখানে বিল্ডিং কমপ্লেক্স করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করবে আর তেলিয়ার দলও পাবে লাখকয়েক টাকা। কিন্তু মাঠে ঘর উঠতে দেখে তারাও এবার শাবল, গাঁইতি, লোক লশকর নিয়ে এসে হাজির।

তেলিয়া গর্জে ওঠে—ঘর কে বানিয়েছে এখানে? অ্যাই পটলা—

দেখছি ওদের! গর্জে ওঠে তেলিয়া—ভেঙে দে, জ্বালিয়ে দে এসব। পটলা বলে, না, একদম এগোবে না।

তেলিয়া সপাটে একটা চড় মারে পটলার গালে। ছিটকে পড়ে সে। হোঁৎকাও এবার একটা ঘুষি মারে তেলিয়াকে। শীর্ণ তেলিয়ার জোর নেই, তবু সেই মস্তানের সর্দার। হোঁৎকার ঘুষিতে সে ঘুরে পড়ে, আর তেলিয়ার অন্য একটা চ্যালাকে তখন ধরেছে গোবর্ধন। ছেলেটা কোমর থেকে ছুরি বের করে গোবরার হাতেই মেরেছে। রক্ত ঝরছে-এবার তেলিয়ার দল ঘিরে ফেলে আমাদের। তেলিয়া পকেট থেকে চেম্বার বের করে বলে—এতে পাঁচটা গুলি আছে, তোদের পাঁচটাকে খতম করে আগুন জ্বালিয়ে ক্লাবঘরের সঙ্গে তোদের পুড়িয়ে ছাই করে দেব। ব্রিজমোহনবাবু, হরষিতদার দলের সঙ্গে টক্কর দিবি পিঁপড়ের দল?

আমরা সামনে ওই মৃত্যুদূতকে দেখছি। এবার গুলিই চালাবে হয়তো ওই শয়তানরা। হঠাৎ দেখি তেলিয়ার পিছনে সেই অদৃশ্য বন্ধুকে। সে এসে একটা লাথি কষে তেলিয়ার পিছনে । আর ছোট ওই অদৃশ্য মানুষের লাথির যে এত জোর, তা জানা ছিল না। তেলিয়া কর্নার কিক্ করা বলের মত কাত মেরে শূন্যে উঠে গিয়ে ওপাশের দেওয়ালে প্রচণ্ড বেগে মাথা ঠুকে চিৎপাত হয়ে কাটা কলাগাছের মত ছিটকে পড়ে, হাত থেকে ছিটকে পড়েছে রিভলভারটি। হোঁৎকা সেটা তুলে নিয়েছে। তেলিয়ার দলের মধ্যে মন্টার চেহারাটা বুনো মোষের মত, তেমনি শক্তিশালী সে। তার নেতার ওই অবস্থা দেখে পটলার টুটিই ধরতে আসে, শেষ করবে পটলাকেই। কিন্তু নিমেষের মধ্যে আমাদের অদৃশ্য বন্ধু এবার মন্টার গালে লাফ দিয়ে উঠে একটা চড় কষাতে ওই মোষের মত দেহটা ক্লাবঘরের মাঝে বোঁ বোঁ করে দুটো পাক দিয়ে বসে পড়ে, আর ফুঁ দিতে একটা দাঁতই ছিটকে পড়ে। যন্ত্রণায় ককিয়ে ওঠে মন্টা।

আমরা অবাক! তেলিয়া ততক্ষণে ঝেড়েঝুড়ে উঠেছে, তার ইজ্জতের সওয়াল—এবার তেড়ে আসছে, হঠাৎ অদৃশ্য বন্ধু রিভলভারটা তুলে নেয়, আর তেলিয়া শূন্যপথে ওই ভাসমান রিভলভারটাই দেখে তার দিকে তাক করা। মানুষজন নেই। রিভলভারটা সজীব হয়ে উঠেছে।

আঁতকে ওঠে সে। আর তারপরেই সিধে দৌড় দেয়। মন্টার সামনের দুটো দাঁত ভেঙে গেছে। দলের বাকিরাও তাদের দলপতিকে ওইভাবে ল্যাজ তুলে দৌড়তে দেখে তারাও দৌড়লো। পিছু পিছু অন্যরা।

আমরা তো হাসছি।

এবার অদৃশ্য বন্ধু বলে ওঠে—কী, নমুনা দেখলে তো? অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে সাহস হবে এবার?

আমরাও বুঝেছি আমাদের অদৃশ্য বন্ধুর শক্তির পরিমাণ। আজ তেলিয়াদের ওই দুর্দশা দেখে আমরা বলি—এইবার হবে বন্ধু।

—তাহলে কাজে নেমে পড়ো। আমি তোমাদের সঙ্গে থাকব ।

ওদিকে ব্রিজমোহন তখন তেলিয়াদের ওই দুর্দশা দেখে গর্জাচ্ছে—এই তোদের মুরোদ! ক’টা ছেলেকে সাপ্‌টে নিতে পারলি না?

তেলিয়া বলে—সাংঘাতিক কাণ্ড ।

মণ্টার দাঁত ভেঙে মুখটা ছোট হাঁড়ির মত ফুলে উঠেছে। ব্রিজমোহনের ঘরে বসে আছে হরষিতবাবু আর থানার দারোগা ভুজঙ্গবাবু। ইয়া বিড়ালের ল্যাজের মত একজোড়া পুরুষ্টু গোঁফ।

ব্রিজমোহন বলে—হরষিতদা, কুছু করেন। ওদিকে পিতাজি তো বাড়ি থেকে নিকালতে পারছে না। বলছে বৃন্দাবন গেছে। পাবলিক লোক মিলের দু’নম্বরী পোড়া মোবিল মেশানো তেল খেয়েছে—

ভুজঙ্গ দারোগা বলে—ওসব রিপোর্ট হামি সামলে লিবে। হাসপাতালের ডাক্তারদের সাথে বন্দোবস্ত করিয়ে লিন। উরা রিপোর্ট বদলে দেবে।

ব্রিজমোহন এবার সিন্দুক খুলে কয়েক তাড়া নোট বের করে দেয় হরষিতবাবুকে। এক বাণ্ডিল নোট দেয় দারোগাবাবুকেও। বলে, যা করার করেন আপনারা। পিতাজিকে অ্যারেস্ট করবেন না।

দারোগা বলে—আরও কিছু চাই। তাহলেই সব ব্যবস্থা পাক্কা হয়ে যাবে। কোনো ভয় নেই । হরষিতবাবুও টাকাটা ব্যাগে পুরে বলে, তাই করো ব্রিজমোহন। সব কাজ ঠিকঠাক হয়ে যাবে।

সারা এলাকার মানুষ মিছিল করে প্রতিবাদ জানায়। সরষের তেলের দাম এক লাফে পঞ্চাশ টাকা থেকে আশি টাকায় উঠল কেন? ভেজাল তেল বিক্রি করে এত মানুষকে মেরেছে, পঙ্গু করেছে সাহুজি। তার বিচার চাই। আমরা এই মিছিল করছি, প্রতিবাদ মিছিল। দেখি নেতা হরষিতবাবুও এসেছে দলবল নিয়ে। তিনিও বলেন, দারুণ কাজ করেছ। এত বড় নিষ্ঠুর কাজের বিচার চাই। দোষীকে শাস্তি দিতেই হবে ।

হরষিতবাবুও দারুণ ওজস্বিনী ভাষায় লেকচার দেয়, নিদারুণ অমানবিক কাজ এই তেলে ভেজাল দেওয়া, খাদ্যে ভেজাল-এর তদন্ত করতেই হবে। তোমরা এসো আমার ওখানে, এ নিয়ে কথা হবে।

ওদিকে হরষিতবাবুই এবার হাসপাতালের কোনো কর্তাকে তুষ্ট করে আগেকার রিপোর্টও বদলে ফেলেছে। ওই লোকগুলো ভেজাল তেল খেয়ে অসুস্থ হয়নি। অপুষ্টির জন্যই এটা হয়েছে।

আর করপোরেশনের টেস্ট যেখানে হয়, এর মধ্যে সেখানে সাহুজির দোকানের তেলের আসল নমুনার শিশি বদলে ভালো তেলের নমুনাই দেওয়া হয়েছে। সেই ভেজাল তেলের সিল করা শিশি হরষিতবাবু এনে নিজের ঘরেই লুকিয়ে রেখেছে।

হরষিতবাবুর দু’দিকে দুই মূর্তি। আমাদের সামনে জনদরদি সমাজসেবী, আর সাহুজির ছেলে ব্রিজমোহনের কাছে অন্য মানুষ। ভেজাল তেল-এর ব্যাপারে সেদিন আমরা গেছি হরষিতবাবুর কাছে।

ব্রিজমোহনও রয়েছে। পটলা বলে,—সাহুজিকে অ্যারেস্ট করার কী হল? এত বড় অন্যায় করে লোকটা পার পেয়ে যাবে?

হরষিত জানে আমরাই এই ব্যাপার নিয়ে জোর আন্দোলন শুরু করেছি। খবরের কাগজের সহকারী সম্পাদক নরেনবাবু থাকেন আমাদের পাড়াতেই, তাঁকে বলে সব কাগজে খবরটা ছাপানো হয়েছে। দু-একজন রিপোর্টারও এর মধ্যে খবর সংগ্রহ করেছে যে, সাহুজি—বৃন্দাবন যায়নি। তার খালধারের নতুন বিশাল বাড়িতেই রয়েছে।

পুলিশের দারোগাও নাকি সেটা জানে। তাই আমরা তাকে অ্যারেস্ট করবার জন্যই বলি হরষিতবাবুকে। হরষিতবাবু বলে, সে তো এখানে নেই ।

পটলা বলে, ওই নতুন বাড়িতেই আছে। পুলিশের দারোগাও জানে, তবু ধরছে না। হরষিতবাবু বলেন, শোনো পটল, তোমাদের ক্লাব ওখানেই থাকবে, তোমরা এ নিয়ে আর গোলমাল করো না ।

পটলা বলে, কী বলছেন স্যার! এত বড় ক্রিমিন্যাল-সমাজবিরোধী সে।

ব্রিজমোহন গর্জে ওঠে—চোপ! হরষিতদা যা বলছেন তাই করো। না হলে—

না হলে? আমিই শুধোই।

এবার তেলিয়া মণ্টাদের দেখা যায়। ওরা সেদিনের অপমানটাকে ভোলেনি। ব্রিজমোহন বলে ওদের—

ওদের সবকটাকে আটকে রাখ। রাতের অন্ধকারে মুখ বেঁধে গাড়িতে তুলে নে গিয়ে, খতম করে মাঝ গাং-এ ফেলে দিবি। খুব বেড়েছে।

ওরাও তৈরি ছিল।

আমরাও প্রমাদ গনি। অবশ্য ফটিক এর মধ্যে বাথরুমে গিয়েছিল। সেখানে র‍্যাকের ওপর রাখা সেই করপোরেশনের ধরা ভেজাল শিশিটা দেখে সে জামার তলে নিয়ে এসেছে।

ফটিকও ভয় পায়! ওটা ধরতে পারলে ব্রিজমোহন তাদের শেষ করে দেবে।

আমরাও অবাক হই। হরষিতবাবু যে কতবড় শয়তান, সেটাও বুঝেছি এবার। কিন্তু এবার ওর জালেই পা দিয়েছি আমরা।

ওরা ধরবে এইবার। আমি বলি—

হরষিতবাবু, এবারের মত ছেড়ে দেন।

হরষিত বলে, শত্রুর শেষ রাখতে নেই, তাই তোমাদের ছেড়ে দেওয়ার উপায় আর নেই নিয়ে যা ওদের।

আমাদের করার কিছুই নেই, আমরা পাঁচজন। ওদিকে ব্রিজমোহনের টেবিলে ডাক্তারের নতুন রিপোর্ট যেটা আদালতে হাজির করতে পারলে সাহুজি এতগুলো মানুষকে মারার পরও বিনা দোষে বেঁচে যাবে

কিন্তু ওসব প্রমাণ হাতে পাওয়ার উপায় নেই। এবার ওদের সব জেনে ফেলেছি বলেই ওরা আমাদেরও শেষ করে দেবে।

দাঁতভাঙা মণ্টা এবার ধরে ফেলেছে আমাদের দলের সর্দার হোঁৎকাকে। গোবর্ধনকে ধরেছে দু’জন, সে তবু ছাড়াবার চেষ্টা করছে। হরষিতবাবুই রিভলভারের বাঁট দিয়ে গোবর্ধনের কপালে মারতে রক্ত পড়তে থাকে।

আমি ফটকে পটলাও এবার প্রমাদ গনি, বাঁচাবার কেউ নেই। হঠাৎ দেখি মণ্টার মোষের মত দেহটাকে আমাদের সেই অদৃশ্য বন্ধু এসে একটা লাথিতে ভলিবলের মত শূন্যে তুলে টেবিলের ওদিকে আস্ফালনরত হরষিতবাবুর ঘাড়েই ছিটকে ফেলেছে, আর ওই বিশাল দেহের ওজনে ছিটকে পড়ে হরষিতবাবু মণ্টার দেহের নীচে। আর্তনাদ করে, পরক্ষণেই তেলিয়ার দুটি হাত ধরে শূন্যে তুলে ওকে নিক্ষেপ করেছে ব্রিজমোহনের ঘাড়ে। দু’জনে মেঝেতে ছিটকে পড়ে। তেলিয়ার আর একটা চ্যালা ব্যাপারটা বুঝতে না পেরেই পটলার দিকে ছেড়ে আসে হাতের ন্যাপলাটা বের করে। অদৃশ্য বন্ধু সেটাকে তুলে সোজা দরজা পার করে বাগানের জলের চৌবাচ্চায় ছুঁড়ে ফেলে।

হরষিত, মন্টা কিন্তু এর মধ্যে ঠেলে উঠে হোঁৎকার দিকে রিভলভার তাক করেছে, কিন্তু একটা অদৃশ্য লাথিতে হরষিতবাবু ছিটকে পড়ে, রিভলভার গেল কোনদিকে, হরষিতের বাঁ হাতটাই নড়বড় করছে।

এবার ব্রিজমোহন ভয়ে ঠক্‌ঠক্ করে কাঁপছে। দেখে তারা, টেবিলে রাখা সেই মূল্যবান মিথ্যা রিপোর্টখানা যেন হাওয়ায় উড়ে উড়ে যাচ্ছে। ওরা এখন ওটার জন্যই ছুটছে ওই উড়ন্ত কাগজের পিছনে। হাওয়া নেই—তবু এদিক-ওদিকে উপরে-নীচে উঠছে-নামছে রিপোর্টটা। ব্রিজমোহন চিৎকার করে দৌড়য় তার দলবল নিয়ে, ‘পাকড়ো, পাকড়ো।’ কিন্তু সেটা ঘর থেকে বারান্দা, সেখান থেকে বাগানে যায়। ওরাও ছুটছে ওর পিছনে। তারপর দূরে বিলীন হয়ে যায় । ওরা হতাশ হয়ে বসে পড়ে। হরষিতবাবু নড়বড়ে হাত নিয়েই দৌড়য়—‘ধর’।

এই অবস্থায় আমরাও কেটে পড়ি। ওদের নজর তখন ওই নৃত্যরত কাগজের দিকে। পটলাদের বাড়িতে এবার এসে হাজির হয়েছি আমরা। পটলাও এর মধ্যে দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক নরেশবাবুকেও খবর দিয়েছে। পটলার কাকার বন্ধু নরেনবাবু, তিনিও এসেছেন। তিনি এলাকার মানুষ, জানেন ওই ভেজাল তেলের ব্যাপারটা, তাই কাগজে বিশদভাবেই রিপোর্ট করেছেন, আর তাই উপর মহলে এ নিয়ে জল ঘোলা হয়েছে। আজ নরেনবাবু ফটিকের আনা সেই ভেজাল তেলের সরানো নমুনা আর অদৃশ্য বন্ধুর আনা সেই মিথ্যা রিপোর্টটা দেখে চমকে ওঠেন।

এত বড় জাল জোচ্চুরি ঘটতে চলেছে? সর্বনাশ!

এসব আলমারিতে রেখে দাও, আর সাহুজি এখানেই আছেন?

হ্যাঁ।

নরেনবাবু বলেন—আজই পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করছি। ওই দারোগারও ব্যবস্থা করতে হবে। পুলিশ বিভাগের কলঙ্ক ওরা, ওদের মুখোশ খুলে দিতেই হবে। সাবধানে থাকবে।

এবার চাকা গড়িয়েছে ওই অদৃশ্য বন্ধুর জন্যই। সেও এসে জুটেছে। পটলা বলে, অন্যায়ের প্রতিকার হবেই।

কিন্তু এমনি হবে, তা ভাবিনি ।

হরষিতবাবু, ব্রিজমোহনের দলের হাত অনেক লম্বা। পুলিশ ওদের হাতে। তাই এবার ওদের রিপোর্টটা উড়ে গায়েব হয়ে যেতে ওরা ভেবেছে এসব আমাদেরই কাজ। তাই নিজেরা বাঁচার জন্য এবার থানায় আমাদের নামেই কড়া করে ডায়েরি করিয়েছে। আমরা ওদের বাড়ি গিয়ে ওদের উপর চড়াও হয়ে মারপিট করে ওদের মালপত্র লুট করে এনেছি। ভুজঙ্গ দারোগাবাবু এবার সেই ডায়েরি পেয়ে দলবল নিয়ে এসেছে।

নরেনবাবু অবাক হন—সে কী! এই ছেলেরা যাবে ব্রিজমোহনবাবুর বাড়িতে ডাকাতি করতে?’

পটলার বাবা-কাকারা এখন নেই। তাঁরা ব্যবসার কাজে বাইরে।

দারোগা বলে—ডাকাতিই নয়, জখমও করেছে। চলো থানায়। এখন থেকেই এতবড় সাহস তোমাদের? চলো।

নরেনবাবুর কোনো কথাই শোনে না ভুজঙ্গ। আমাদের ক’জনকে হাতে পেয়ে নিয়ে গিয়ে থানায় আটকে রেখেছে।

হোঁৎকা বলে—দ্যাখ পটলা, পরোপকার করার ঠ্যালা এখন বোঝ !

ফটিক বলে—শেষে জেলে যেতে না হয় !

গোবরার কুমড়ো মামা, পটলার কাকা সকলেই এসেছে। দারোগা বলে, ছাড়ব না। হঠাৎ দেখা যায় আমাদের সেই অদৃশ্য বন্ধুকে। হাসছে সে পিক্‌ পিক্ করে। পটলা বলে—হাসছ তুমি?

বন্ধু বলে-ভয় নেই। একটু সবুর করো।

ওদিকে খেতেও দেয়নি কিছু। হোঁৎকার খিদে পেলে মাথাখারাপ হয়ে যায় বন্ধু বলে, তোমরা ওইদিকে বসো। ওদিকে কেউ নেই, দেখি খাবার কী পাই?

তারপরেই আর দেখা যায় না তাকে। ওদিকে ব্রিজমোহন, হরষিতবাবু এসে এবার শাসায়—

ছাড়বেন না ওদের। মার্ডার করত আমাদের।

ওদের তড়পানি চলছে। দেখি অদৃশ্য বন্ধু এর মধ্যে আমাদের জন্য খাবারও এনেছে। গরম পুরি-তরকারি-সন্দেশ। বলে, চট্ করে খেয়ে নাও ।

হঠাৎ ওর সেই মাথার খাড়া করা ছোট এরিয়ালে আলো জ্বলে ওঠে। বলে, আসছি।

তার কিছুক্ষণ পরই দেখি বিরাট কাণ্ড ঘটে যায় থানায়। নরেনবাবুর সঙ্গে খোদ পুলিশ কমিশনার সাহেবই এসে হাজির। সঙ্গে হাতকড়া বাঁধা সাহুজি। যাকে পুলিশ এতদিন ধরে খুঁজেই পায়নি।

সাহুজি এতদিন ওই বড় বাড়িটাতে নিরাপদেই ছিল। ভুজঙ্গের পুলিশ তাকে বিরক্ত করেনি। তারা রিপোর্ট দিয়েছে, সাহুজি এখানে নেই ।

কিন্তু আমাদের হামলার পর ব্রিজমোহন, হরষিত দু’জনেই সাবধান হতে চেয়েছিল। ওরা টের পেয়েছে আমরা সাহুজির খবর জানি। আর সেটা কাগজে তো বের হয়ে যাবে। তখন সাহুজিকে পুলিশ অ্যারেস্ট করতে বাধ্য হবে। তাই ওরাই এবার সাহুজিকে গাড়িতে করে পাচার করেছিল। দিল্লির ফ্লাইটের টিকিটও কাটা ওর নামে। একবার বের করে নিয়ে যেতে পারলেই ব্যস !

নিয়ে যেতেও পারত, কিন্তু তার আগেই নরেনবাবু গিয়ে খোদ পুলিশ কমিশনারকেই সব কথা বলেন, আর নির্দোষ ছেলেরা যারা সমাজের এই ক্রিমিন্যালদের কাজে বাধা দিতে চায়, পুলিশ ওই দোষীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাদেরই গুণ্ডা মস্তান বদনাম দিয়ে জেলে পাঠাতে চায়।

তাই সাহুজিকে অ্যারেস্ট করতেই হবে। তেলিয়াই গাড়িতে তুলে মালিককে নিয়ে চলেছে। হঠাৎ দেখে গাড়ির চাকায় হাওয়া নেই। অবশ্য অদৃশ্য বন্ধুটিই সেখানে হাজির হয়ে চাকার হাওয়া খুলে দেয় ৷

তেলিয়া ড্রাইভারকেই মারতে যায়। কী করিস! জলদি চাকা লাগা। প্লেনের দেরি হয়ে যাবে।

ড্রাইভার চাকা লাগাচ্ছে। গাড়িতে কাচ তুলে বসে আছে সাহুজি। দেরি হলে বিপদ হতে পারে। চাকা লাগিয়েছে—এদিকে অদৃশ্য বন্ধু ব্যাটারির কানেকশানই খুলে রেখে দেয়। আবার ঝামেলা—তেলিয়া গর্জাচ্ছে। সেটা ঠিক করে গাড়ি স্টার্ট দেবে আবার একটা চাকার হাওয়া সশব্দে বের করছে। তেলিয়াও ভীত সন্ত্রস্ত।

এমন সময়েই এসে হাজির হয় পুলিশ ভ্যান। তেলিয়া জানে তাদের হাতের পুলিশ। কিন্তু চমক ভাঙে, এরা ভুজঙ্গের পুলিশ নয়। ওদের ঘিরে ফেলে, আর পালাবার পথ নেই। সাহুজিকে ধরে ফেলে ওরা। তেলিয়াকেও। তেলিয়াও বুঝেছে, এবার কড়া পাল্লায় পড়েছে তারা।

পুলিশ কমিশনারও বুঝেছেন; ভুজঙ্গবাবু এতদিন এতবড় একটা অপরাধীকে জেনেশুনেই ছেড়ে রেখেছিল আর মিথ্যা রিপোর্ট দিয়েছিল হেডকোয়ার্টারে। ওই ছেলেগুলোই জেনেছিল ওদের অন্যায়ের খবরগুলো। একটা দুষ্টু চক্রের অংশীদার।

তাই নিজেই এসেছেন থানায়। ভুজঙ্গ, ব্রিজমোহন হরষিতবাবু এবার সাহুজিকে দেখে চমকে ওঠে। কমিশনার সাহেব শুধোন, সেই ছেলেরা কোথায়?

—লক-আপে।

গর্জে ওঠেন কমিশনার—আসল দোষীকে লক আপে না পুরে, ছেলেরা যারা আপনাদের শয়তানির প্রতিবাদ করতে চায়, তাদেরই ধরেছেন? ছেড়ে দিন ওদের।

এর মধ্যে ছাড়া পেয়ে ফটিকই বলে, ওদের নমুনা পালটানো আর মিথ্যা রিপোর্টের কথাও। সেগুলোও এনে দেয় পটলা। আর সাহুজির গুদামেও পাওয়া যায় প্রচুর ভেজাল তেল।

ঘণ্টাকয়েকের মধ্যেই ভুজঙ্গবাবুকে ধরে ব্রিজমোহনকেও তার বাবার সঙ্গে হাজতে পোরা হল। আসামি করা হল হরষিতবাবুকেও।

সারা এলাকায় খবরটা ছড়িয়ে পড়ে। এতদিনের জমা রাগটা আজ মিছিলে ফেটে পড়ে। মিছিলের পুরোভাগে রয়েছি আমরা। গলায় মালা—যেন বীরের ভূমিকাতে নেমেছি। সঙ্গে চলেছে আর একজনও, আমাদের সেই অদৃশ্য বন্ধুও। পিক্ পিক্ করে বলে—

–কি গো কেমন লাগছে ?

—ভালোই। পটলাও আজ খুশি।

বন্ধু বলে, অন্যায়ের প্রতিবাদ প্রতিকার করো। দেখবে সত্যিই ভালো লাগবে ।

Inspire Literature
Inspire Literaturehttps://www.inspireliterature.com
Read your favourite inspire literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments