Friday, July 5, 2024
Homeভৌতিক গল্পনিশীথিনী - বৈশালী দাশগুপ্ত নন্দী

নিশীথিনী – বৈশালী দাশগুপ্ত নন্দী

কবিতা লিখে হালে পানি না পেয়ে অগত্যা স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় বসেছিলাম। এ যখনকার কথা, তখনও স্কুলের মাস্টারমশাই হওয়ার পরীক্ষায় কাউন্সেলিং নামক কর্মক্ষেত্র স্বনির্বাচনের পদ্ধতি চালু হয়নি। সুতরাং অনিচ্ছাসত্ত্বেও পরীক্ষায় বসার ফল হাতেনাতে পেয়ে গেলাম। শেষের দিকে র‍্যাঙ্ক করার সুবাদে কিনা জানি না, চাকরি হল জেলার বেশ শেষের দিকেই। অর্থাৎ একটা বেশ জঙ্গুলে জায়গা, উঁচু নিচু পাথুরে রাস্তা, খানাখন্দ এবং গোটা চল্লিশ বাড়ি ঘেরা একটি সদ্যনির্মিত স্কুল। জায়গাটার নাম ইচ্ছে করেই গোপন রাখছি। আমার পরেও তো ওই স্কুলে শিক্ষক লাগবে। শিশুগুলোর কি দোষ? ওদের কেন পড়াশুনা থেকে বঞ্চিত করি? তবে জায়গার বর্ণনা শুনে কেউ যদি স্কুলটিকে চিনে ফেলেন ও সেখানে চাকরি নিতে অসম্মত হন, তবে সে দোষ আমার নয়।

বললাম বটে বাড়ি, কিন্তু ওগুলিকে কুঁড়েঘর বলাই যুক্তিযুক্ত, আর স্কুলে আমিই প্রথম ও একমাত্র শিক্ষক। বলাই বাহুল্য, গোটা গ্রাম প্রথমদিন আমাকে দেখতে এসেছিল। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সেক্রেটারি বিধু মণ্ডল ও আরও কয়েকজন সদস্যের উৎসাহে ও চেষ্টায় স্কুল তৈরি হয়েছিল। কাজেই তাঁদের মধ্যে বেশ একটা মাতব্বর গোছের ভাব দেখতে পেলাম। এখানকার লোকেরা অধিকাংশই জঙ্গলের কাঠকুটো কুড়িয়ে বা দু-মাইল দূরের ইটভাটায় কাজ করে দিন চালায়। পড়াশুনো প্রায় কেউই জানে না। হংসমধ্যে বকযথা এইট ফেল বিধুবাবু এতকাল ছেলেমেয়েদের পড়াতেন। ইতিমধ্যে আমি এসে পড়ায় তিনি কতটা খুশি আর কতটা রুষ্ট হলেন, তা ভালো বোঝা গেল না। তবে এটুকু আমি বুঝে নিলাম যে, জলে থেকে কুমীরের সঙ্গে বিবাদ না করে বরং ভাব করে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই প্রথম থেকেই বিধুবাবুর কাছে সারেন্ডার করলাম। কিছুই বুঝি না হাবভাব করে তাঁর কাছ থেকে স্কুলের কাজকর্ম বুঝে নিতে শুরু করলাম। তিনি কীভাবে কাজগুলি করতেন, তা শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে মুখে অবাক বিস্ময়ের ভাব ফুটিয়ে তুললাম! কখনো বা ‘কীভাবে যে সব করব, আপনি দয়া করে পাশে থাকবেন’ জাতীয় কথা বলে তাঁর মন জয় করার চেষ্টা করলাম, এবং এরকম ঘণ্টাখানেক চলার পর মনে হল আমি কিছুটা সফল হয়েছি। বিধুবাবুর মুখে একটু আত্মপ্রসাদের হাসি ফুটে উঠল। তিনি মাঝে মাঝেই পিছনে দাঁড়ানো ভিড়ের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে বোঝাতে চাইলেন, ‘দেখলে তো, কলকাতার পড়ালেখা জানা মাস্টারও আমার চেয়ে বেশি জানে না। তিনি যতই গর্বে ফুলতে লাগলেন, ততই আমার অভীষ্ট সিদ্ধ হতে শুরু করল।

সমস্যা হল অন্য জায়গায়। কর্মক্ষেত্র থেকে আমার বাড়ির দূরত্ব এতটাই যে, সেখানে যেতে এরোপ্লেন ছাড়া আর সবকিছুই চড়তে হত। দিনে আসা যাওয়ায় প্রায় সাত আট ঘণ্টা লেগে যেত। এভাবে মাসখানেক কাটানোর পরে আমার শারীরিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে শুরু করল। নিজেই বুঝতে পারছিলাম, এভাবে বেশিদিন চলবে না। বাধ্য হয়ে কথাটা পাড়লাম বিধুবাবুর কাছে। স্কুলের কাছাকাছি যদি কোন মোটামুটি থাকার মতো জায়গা পাই, তাহলে সেখানে মোটঘাট নিয়ে চলে আসতাম। আর নিজের কাজ চালাবার মতো রান্না আমি নিজেই করতে পারব। আমার প্রস্তাব শুনে বিধুবাবু কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন, “বলেন কী, কলকাতার লোক আপনি, এই জঙ্গলে থাকবেন কী করে!”

আমি মৃদু হেসে তাঁকে জানালাম যে, আমার কোনও উপায় নেই। চাকরিটা আমার নিতান্তই প্রয়োজন। আর নতুন পরিবেশে থাকতে আমার বেশ ভালোই লাগবে। আমার কথা শুনে বিধুবাবু তখনকার মতো কিছু না বলে চলে গেলেন। সেদিনই স্কুল ছুটির কিছুক্ষণ আগে আবার এলেন। বললেন,”অনেক ভাবলাম, বুঝলেন? এখানে আপনার থাকার মতো জায়গা বলতে আছে শুধু সরকারি গেস্টহাউস। সেই কবে ওষুধের বিরাট কারখানা হবে বলে সরকারি বাবুরা যাওয়া আসা শুরু করেছিলেন। তাঁদের থাকার জন্য তৈরি হয়েছিল গেস্টহাউসখানা। তাও প্রায় বছর পনেরো তো হবেই। তারপর কী সব সমস্যায় কারখানাও আর হল না, এমনি আর কে এই জায়গায় আসবে বলুন। তাই সেই থেকে পড়েই রয়েছে। ধুলোবালি, ইঁদুর ছুঁচোর উৎপাত। সাপও থাকতে পারে।”

আমি বললাম, “সে কী, সরকারি গেস্টহাউস, দেখাশোনার লোক নেই?” “আছে একজন। মোতি। দিনরাত হাঁড়িয়া গিলে পড়ে থাকে। সরকারি মাইনেটুকু পায়। তাই দিয়ে সংসার চলে। ব্যাস, এই। দেখাশুনা মানে চাবিটা ওর কাছে আছে।”

“আমাকে একটু নিয়ে যাবেন মোতির কাছে?”

“আমি বলি কি, আমার বাড়িতে একটা ঘর একটু সাফসুতরো করে দিই, আপনি ওখানে থাকুন।”

বিধুবাবু বললেন ঠিকই, কিন্তু চিরদিন স্বাধীনভাবে চলতে অভ্যস্ত আমার এ প্রস্তাব ঠিক গ্রহণযোগ্য লাগল না। প্রথম প্রথম কিছু না বললেও তারপরই আস্তে আস্তে শুরু হবে নানা ঝামেলা। রান্নার ঝাঁঝ কেন আসছে, বাথরুমে কেন জল বেশি খরচ হচ্ছে, সবচেয়ে বড়ো কথা আমি এখানে থাকলে তিতির মাঝেমধ্যে আসবেই। তাহলে তো খণ্ডযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। এটাও আমার আর একটা কারণ নিরিবিলিতে থাকতে চাওয়ার। সরকারি গেস্টহাউসটা আমি যেতে আসতে দেখেছি। ততটা খারাপ মনে হয়নি, যতটা বিধুবাবু বলছেন। তাই ওটা পাওয়ার জন্য আমি মনে মনে পাগল হয়ে উঠেছিলাম। গ্রামে ঢোকার মুখে নির্জন আগাছায় ঢাকা গেস্টহাউসটা যেন আমাকে ডাকছিল। মোতিকে মাস গেলে কিছু টাকা দিলেই মনে হয় ও অরাজি হবে না। আর এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় কোনও সরকারি আমলা বা মন্ত্রী থাকতে আসবেন বলে তো মনে হয় না। বিধুবাবুর প্রস্তাব এককথায় নাকচ করে দিয়ে দশ মিনিট আগেই স্কুলে ছুটি দিয়ে দিলাম। বেরিয়ে পড়লাম মোতির উদ্দেশ্যে বিধুবাবুর সঙ্গে।

মোতিকে তার বাড়িতেই পাওয়া গেল। সরকারি কর্মচারী বলে কথা। বাড়িঘর বেশ ভালো মানের হলেও মোতির চেহারা দেখে ভক্তি এল না। ভর বিকেলবেলাতেও তার দু’চোখ রক্তজবার মতো লাল। সোজা হয়ে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে না-পেরে দাওয়ার ওপরে ধপ করে বসে বিধুবাবুর কাছে সব শুনল। শুনে টুনে আমার দিকে একবারও না তাকিয়ে বলল, “মাহিনেমে পাঁচশো রুপিয়া দেনা পড়েগা।”

আমি যেন হাতে চাঁদ পেলাম। অত বড়ো গেস্টহাউসের ভাড়া মাসে মাত্র পাঁচশো। নেশার ঘোরে বলছে না তো? আবার নেশা কাটলে অন্য কথা বলতে পারে। যাই হোক, আর দেরি করলাম না। পকেট থেকে দুশো টাকা বের করে ওর হাতে গুঁজে দিলাম। বললাম, “এটা অ্যাডভান্স। মাস গেলে আরও পাঁচশো করে পাবে। কিন্তু বাড়িটা একটু পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখতে হবে।”

অপ্রত্যাশিতভাবে দুশো টাকা পেয়ে মোতির নেশায় লাল চোখদুটো চকচক করে উঠল। বলল, “চিনতা মাত কর না মাস্টারবাবু, উও মেরা আউরত সব কর দেগি।”

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বিধুবাবুর দিকে তাকালাম। উনি বললেন, “মোতির বউ। খুব ভালো মেয়ে।” আমি আশ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। পরের সপ্তাহেই পাকাপাকিভাবে ওখানে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম।

এবার একটু তিতিরের প্রসঙ্গে আসি। তিতির আমার প্রেমিকা, আমার বান্ধবী, আমার কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা। ওর সঙ্গে আমার পরিচয় সেই প্রাইমারি স্কুলে। তারপর থেকে অদ্ভুতভাবে হাইস্কুলে, কলেজে সবজায়গায় আমরা একসঙ্গে পড়েছি। কলেজে আমার অনার্স ছিল বাংলায়, তিতিরের ছিল ইংরেজি। এছাড়া আর কোনও পার্থক্য ছিল না আমাদের মধ্যে। আমার কবিতার সবচেয়ে বড়ো শ্রোতা, সমঝদার ও সমালোচক তিতিরই। আজ অবধি আমার কোনও কবিতা ও ভালো বলেনি। খালি বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ে আর বলে, ‘আরও ভালো করতে হবে।’ কিন্তু আমি জানি এটা ওর মনের কথা নয়। কারণ অন্য কেউ আমার কবিতার প্রশংসা করলে ওর মুখে চোখে যে দীপ্তি ফুটে ওঠে, তা একমাত্র মনের খুব কাছে না থাকলে সম্ভব হত না। ও যে আমাকে ভালোবাসে, এটাও আমি এভাবেই বুঝেছিলাম। এখন আমরা একটা ফ্ল্যাটে একসঙ্গে থাকি। আমার স্কুলের কাছে থাকার সিদ্ধান্তটাও তিতিরেরই নেওয়া। ওই আমাকে একদিন বলল, “তুই তো ওখানে গিয়ে থাকতে পারিস।”

এর আগে আমি এ কথা ভাবিনি তা নয়। কিন্তু তিতিরের কথা ভেবেই পিছিয়ে গেছি। ওকে ছাড়া থাকা আর নিঃশ্বাস না-নেওয়া যে একই কথা। তাই ওর মুখে এ কথা শুনে প্রথমে আমার খুব অভিমান হল। তারপর তিতির আমাকে বোঝাল, “দ্যাখ অনি, পরের বছর আমিও পরীক্ষায় বসব, কোথায় চাকরি পাব আমরা কেউ জানি না। তবে চাকরি যখন আমি করবই, তখন যেখানেই পাই, সেখানেই যাব। তখন তো আমাদের আলাদা থাকতে হতেও পারে। তাহলে এখনই নয় কেন? এতটা যেতে আসতে তোর শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এ আমি কিছুতেই দেখতে পারব না। তাছাড়া প্রতি মাসে তুই বাড়িতে আসবি, নয়ত আমি যাব তোর ওখানে ছেলেমানুষি করিস না। ওখানেই থাকার জায়গা দ্যাখ।”

এই কথার পরে আর যুক্তি চলে না। তিতির এখন একটা স্কুলে পার্ট-টাইম পড়ায়। ও যেভাবে চাকরি পাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তাতে হয়তো পরের বছর লেগেও যাবে। আর তিতির যা স্বাধীনচেতা মেয়ে, তাতে পৃথিবীর শেষ স্টেশনে হলেও ও চাকরি ছাড়বে না। ওর এই গোঁ-এর পরিচয় আমি আগেও পেয়েছি। বাবা মারা যাওয়ার পর যখন মা, দিদি সবাই আমার কবিতা লেখার বিরুদ্ধে চলে গেল, তখন একমাত্র তিতিরই আমার পাশে ছিল। চাকরির চেষ্টা না করে আমি কেন কবিতা লিখে সময় নষ্ট করছি, আমার মতো হাজার হাজার কবি ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছে, অকালকুষ্মাণ্ড ছেলে ইত্যাদি নানা বাক্যবাণে প্রতিদিন বিদ্ধ হতাম আমি। যদিও ওপরের সবগুলিই আমার জানা কথা, তাও রোজ হয় মা, নয় দিদির মুখে এগুলি শুনে শুনে ক্লান্ত লাগত। দিদি রোজ শ্বশুরবাড়ি থেকে আসত শুধু আমাকে এই কথাগুলো বলার জন্য। কখনো কখনো জামাইবাবুও আসতেন সঙ্গে। আইটি সেক্টরের বড়ো চাকুরে জামাইবাবু পোকামাকড় দেখছেন, এমন দৃষ্টিতে তাকাতেন আমার দিকে। দিদি একদিন মাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল ওর কাছে। মা চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলেন। যদিও জানতাম, দিদির ছেলের আয়া হিসেবে মায়ের অ্যাপয়েন্টমেন্ট হল, তাও মুখে কিছু বলতে পারিনি। তখনও তিতির আমাকে সান্ত্বনা দিত। বলত, “চেষ্টা করে যা অনি, দেখবি একদিন তোর কবিতার বই ছেপে বেরোবে। সবাই চিনবে তোকে। আর আমি গর্ব করে বলব, বিখ্যাত কবি অনির্বাণ সিংহের স্ত্রী আমি।” কিন্তু আর আমি অপেক্ষা করিনি। এরপরেই স্কুল সার্ভিসে বসা ও চাকরি। চাকরি পেয়েই উঠে এসেছিলাম তিতিরের ফ্ল্যাটে। তিতিরের বাবা-মা নেই। জন্মের সময় মা এবং ইলেভেনে পড়ার সময় বাবাকে হারায় তিতির। সেইজন্যই এত স্বাধীনচেতা ও আত্মনির্ভরশীল তিতির। ওর বাবা ওর জন্য প্রচুর টাকা রেখে গিয়েছিলেন। তাই অভাবে পড়তে না হলেও একটা সতের-আঠারো বছরের মেয়ের একা বাস করা খুব সহজ ছিল না। এই সময়গুলোতে ওর পাশে ছিলাম আমি। ওর কোনও আত্মীয় ওর খোঁজ করেনি। যে দু-চারজন করেছিল, কিছুদিনের মধ্যেই তাদের লক্ষ্য যে তিতিরের টাকা, তা বুঝে তিতির নিজেই তাদের কাটিয়ে দেয়। আমি তিতিরের ফ্ল্যাটে উঠে আসার পর চারপাশে অনেক কথা শুনেছি। প্রতিবেশিদের, আত্মীয়দের। দিদি তো একদিন উজিয়ে এসে যা নয় তাই শুনিয়ে গেল আমাকে আর তিতিরকে। আর যাওয়ার সময় আমাদের বাড়ির চাবিটা নিয়ে গেল। শুনেছি বাড়িতে দিদি ভাড়া বসিয়েছে। আমার তাতে কোনও আগ্রহ নেই। আমি আর তিতির বেশ আছি। বিয়ে হয়তো কখনো করব, কিন্তু কোনও প্রয়োজন এখনও বোধ করিনি। তিতির বলে, “কেন, বিয়ে করলে তুই কি আমাকে এখনকার চেয়ে বেশি ভালোবাসবি? এই বেশ ভালো, যখন ইচ্ছে করবে না, চলে যাবি আমাকে ছেড়ে। বিয়ের বন্ধন থাকলেই তিক্ততা নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। সে আমি সইতে পারব না। তার চেয়ে এই ভালো।” তাই আমরা বিয়ে করিনি।

চার পাঁচ দিন হল আমি সরকারি গেস্টহাউসে উঠে এসেছি। মোতির বউ বেশ সাফসুতরো করে দিয়েছে ঘরদুটো। একটা ঘরের কোণেই আমার রান্নার ব্যবস্থা করেছি। কারণ রান্নাঘরটা গেস্টহাউসের পিছনদিকে। রান্নাঘরের পিছনে বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে ঝোপজঙ্গল ও তারপরে একটা বুজে আসা খাল। সাপখোপের উপদ্রব হতে পারে ভেবে রান্নাঘর আর ব্যবহার করি না। আর রান্নাই বা করি কী! দুবেলা দুটো ভাতে ভাত, বড়োজোর একটা ডিমসেদ্ধ, এর জন্য ঘরের কোণই যথেষ্ট। এখানে আমার আর একটা সুবিধা হয়েছে। আমার কবিতা লেখার অভ্যেসটার গোড়ায় বেশ জল ঢালা যাচ্ছে। দিনে সাত আট ঘণ্টা আসা-যাওয়া করে অভ্যেসটা প্রায় চলেই যাচ্ছিল। এখানে থাকতে শুরু করার পর থেকে শুধু সময় আর সময়। তবে অসুবিধা একটাই, তা হল ঘরদোর পরিষ্কার করা, গুছিয়ে রাখা আর বাসন মাজা। এই কাজগুলো আমি পারি না বলে ফ্ল্যাটে রান্না আমি করতাম আর তিতির এগুলো করত। কিন্তু এখানে এসে ভারী বিপদে পড়েছি। ভাবছি বিধুবাবুকে বলব একটি কাজের মহিলা জুটিয়ে দিতে। অবশ্য এই দরিদ্র জায়গায় তা জোটানো কোনও বড়ো ব্যাপার না। স্কুল থেকে দুপুরে গেস্টহাউসে এসে ভাত খেয়ে যাই। তাই ছুটির পর শুধু চায়ের পালা। সেদিন স্কুল থেকে ফিরে খুব ক্লান্ত লাগছিল। গরমটাও পড়েছে বেশ। এখানে কারখানার হাইপে ইলেকট্রিকের পোস্ট বসানো হয়েছিল। কিন্তু কারখানার মতো ইলেকট্রিকও সুদূরপরাহত থেকে গেছে। তাই সন্ধের পর হ্যারিকেন ও হাতপাখাই ভরসা। আমি অবশ্য সঙ্গে ছয় ব্যাটারির টর্চ রাখি। রাতবিরেতে বাথরুমে যেতে কাজে লাগে।

ক্লান্তিতে কখন যেন চোখে ঘুম জড়িয়ে এসেছিল। প্রচণ্ড গরমে ঘামতে ঘামতেও হাতপাখা নাড়ার যেন ইচ্ছেটুকু হচ্ছিল না। হঠাৎ একটা খুটখাট শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘরে হ্যারিকেন জ্বলছে। যদিও আলোটা কমানো তবু তাতেই বোঝা যাচ্ছে হ্যারিকেনের চিমনিটা ঝকঝক করছে। এই কাজটি যে আমি করিনি, তা বেশ ভালোই জানি। একদিন হ্যারিকেন জ্বালিয়ে তার চিমনিতে যে পরিমাণ ভুষোকালি জমেছিল, তা পরিষ্কার করা আমার কাজ নয়। আজই ভেবেছিলাম, এ কাজ করার চেয়ে সপ্তাহে একবার করে চিমনি পালটে নেওয়া অনেক সহজ। তাছাড়া আমি যখন এসে শুয়েছি, তখনও দিনের আলো রয়েছে। হ্যারিকেন জ্বালানোর দরকার হয়নি। তবে এটা কে করল? ঘুমচোখে এসব ভাবতে ভাবতেই চোখে পড়ল, ঘরের মধ্যে একটা মূর্তি ঘোরাফেরা করছে। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। তারপর হঠাৎ মনে হল, বিধুবাবু কি কোনও কাজের মহিলাকে পাঠালেন? আজই সবে বলেছিলাম। হতে পারে উনিই পাঠিয়েছেন। না হলে আর কে হবে? বিছানায় উঠে বসলাম। গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম, “কে? কে আপনি?”

মূর্তিটা এক মুহূর্ত একটু থমকে গেল। তারপর একহাত ঘোমটার তলা থেকে নুপুরের মতো সুরেলা কণ্ঠ বলে উঠল, “জি কমলি! মোতি কি বিবি।”

ওঃ, মোতির বউ! বিধুবাবু তাহলে ওকেই পাঠিয়েছেন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ঘুম ভাঙার পর থেকেই খেয়াল করছিলাম, কমলির উপস্থিতি সারা ঘরে একটা সুগন্ধ সঞ্চার করেছে।

কমলি দেখলাম বেশ খাটিয়ে মেয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার ঘরবাড়ি ঝকঝকে করে এক বালতি জল ভরে রেখে দেখলাম স্টোভ জ্বালানোর বন্দোবস্ত করতে লাগল। আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, “তুমি রান্নাও করবে?”

একহাত ঘোমটার হ্যাঁ বাচক ওঠানামায় বুঝলাম আমি ঠিকই ভেবেছি। বিধুবাবুর সঙ্গে ওর টাকাপয়সার কথা বলে নিতে হবে। রাতের রান্না করে চলে গেল কমলি। আর রাতে খেতে বসে, রান্না ভালো করি বলে আমার যে গর্ব ছিল, তা কমলির রান্না মুখে দিতে দিতে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেল।

শনিবার সকাল থেকেই তিতিরের জন্য মন কেমন করতে লাগল। স্কুল ছুটির পর কোনওক্রমে বাড়ি ফিরে দু-চারটে জামাকাপড় নিয়ে রওনা হয়ে গেলাম কলকাতা। যদিও জানি, প্রতি সপ্তাহে এভাবে যাওয়া হবে না। কারণ সদ্য তৈরি স্কুল বলে তার প্রচুর কাজ বাকি রয়েছে। নানা চিঠিপত্র লিখে অনুদান জোগাড় করা, পরের বছর যাতে আরও শিক্ষক পাওয়া যায় সেজন্য রিকুইজিশন পাঠানো, টয়লেট গ্রান্ট আদায় ইত্যাদি কাজ রবিবারেই করে রাখতে হয়। সারা সপ্তাহ তো বিচিত্র বিষয়ের ক্লাস নিয়েই কেটে যায়। ছাত্রসংখ্যা যদিও মোটে সাতষট্টি, তবু স্কুলটাকে কেমন যেন ভালো লেগে গিয়েছিল। স্কুলটা বড়ো করার জন্য একটা দায়িত্ব অনুভব করছিলাম।

কলকাতায় এসে যেন ভুলেই গিয়েছিলাম মাত্র একদিন পরেই আবার ফিরে যেতে হবে। তিতিরকে আদর করে, ওর সুগন্ধি চুলের মধ্যে মুখ গুঁজেই যেন জীবন কেটে যাবে— এমনই মনে হচ্ছিল। সোমবার ভোরে যখন রওনা হলাম, তিতির ছলছল চোখে কথা দিল, ওর স্কুলের পরীক্ষা শেষ হলেই ও আমার কাছে যাবে।

সোমবার গেস্টহাউসে না ঢুকে সরাসরি স্কুলে পৌঁছে গেলাম। বাড়িতে গিয়ে রান্না করে স্কুলে যাওয়ার মতো সময় ছিল না। দুপুরটা কিছু খেলাম না। কী খাব, সেই চিন্তা করতে-করতে ছুটির পর গেস্টহাউসে ফিরলাম। চাবি দিয়ে তালা খুলে ঘরে ঢুকতেই তাজ্জব! সেই সুগন্ধ! যেন কোথাও ফুল ফুটেছে! এক তীব্র আবেশ আমার মনকে বিবশ করে তুলল। তারপর দেখলাম, ঘরের এক কোণে ভাত, ডাল, সবজি রান্না করে চাপা দিয়ে রাখা। ধরে দেখলাম তখনও গরম। অর্থাৎ কিছুক্ষণ আগেই রান্না হয়েছে। অর্থাৎ কমলি এসে রান্না করে দিয়ে গেছে। কিন্তু চাবি তো আমার কাছে। তবে? অনেক ভেবে মনে হল, মোতির কাছে নিশ্চয়ই ডুপ্লিকেট চাবি আছে। তা হলেও, আমি যে আজ ফিরব, তা কমলি কীভাবে জানল? অবশ্য আমি তো সকালেই স্কুলে গেছি। তাই হয়তো জানতে পেরেছে। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে আমি কিছুটা নিশ্চিন্ত মনেই হাত ধুয়ে খেতে বসলাম। সেদিন মাঝরাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল। এখানে মশার বড়ো উৎপাত। তাই মশারি খাটিয়ে শুতে হয়। রাতের দিকে একটা ঠান্ডা হাওয়া দেয়। তাই ঘুমটুকু হয়। ঘুমের মধ্যে একটা রিনরিনে শব্দে চটকা ভেঙে গেল। কয়েকমুহূর্ত সময় লাগল এটা বুঝে নিতে যে, আমি কলকাতার ফ্ল্যাটে নেই, এবং এটা তিতিরের চুড়ির শব্দ নয়। যেই না এ কথা মনে আসা, হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফিয়ে গলার কাছে চলে এল। ধড়মড় করে উঠে বসার চেষ্টা করলাম। আর সেটা করতে গিয়েই অন্ধকারে সয়ে-আসা চোখে বুঝতে পারলাম, মশারির ভেতরে আমি একা নই। কেউ বসে আছে আমার পাশে। তারই হাতের চুড়ির রিনরিনে শব্দে আমার ঘুম ভেঙেছে। আর পুরোপুরি জেগে উঠে টের পেলাম, শুধু চুড়ির শব্দ নয়, একটা অসহ অথচ মাতাল করা সুঘ্রাণ আমাকে বিবশ করে ফেলছে। জানি না এ কোনও ফুলের গন্ধ কিনা! ভালো করে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম, কে এই নারী? মাঝরাতে এভাবে পরপুরুষের বিছানায় কেন তার আগমন? সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কোনও প্রশ্ন করার আগেই নারীমূর্তির মুখ নেমে এল আমার মুখের কাছে। আয়ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে আমার দিকে। জ্বালানি বাঁচানোর জন্য রাতে হ্যারিকেনটা কমিয়ে রাখি। এখন মনে হচ্ছে, বাড়ানো থাকলেই ভালো হত। আধবোজা আলোয় নারীমূর্তিকে যতটা রহস্যময়ী মনে হচ্ছে, ততটাই আকর্ষণীয়। এটুকু বুঝছি, একটা ফর্সা মুখ, বড়ো বড়ো কাজলটানা চোখ, আর… আর সেই মাদকতাময় সুগন্ধ। মন থেকে আশ্চর্যভাবে প্রাথমিক ভয়টা কেটে যেতে লাগল। তার বদলে জেগে উঠতে শুরু করল আমার ভিতরকার পুরুষ। মনের অবচেতনে কেউ যেন বলে দিল, এ আর কেউ নয়, কমলি, মোতির স্ত্রী। তার শরীরের গন্ধ তার পরিচয় দিচ্ছে। বাৎস্যায়নের পদ্মিনীর মতো পদ্মগন্ধী নারী কমলি। এ গন্ধ কোনও সুগন্ধি বা তেলের গন্ধ নয়। এ গন্ধ তার শরীরের। আমার কী হল জানি না, দু’হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিলাম ওকে। মনে কোনও ভয়, কোনও অপরাধবোধ কাজ করল না। তিতিরের কথা মনে হল না। মনে হল না, আমি একজন শিক্ষক! সম্মান হারানোর ভয়ও আমাকে নিরত করতে পারল না। কীভাবে সেই রাত কেটেছিল, সকাল হয়েছিল, মনে পড়ে না। শুধু মনে আছে, যখন ঘুম ভাঙল, বিছানায় আমি একা ছিলাম। কেবল একটা মৃদু সুগন্ধ প্রমাণ দিচ্ছিল রাতের মাদকতার।

সকালে উঠে রাতের কথা একে একে মনে পড়ল ঠিকই, তিতিরের জন্য খারাপও লাগছিল। কিন্তু নিজের পরিবর্তনে নিজেই আমি অবাক হয়ে গেলাম। সারাটা দিন আমার কেটে গেল রাতের প্রতীক্ষায়। একবারও মনে হল না, কে সেই নারী? সে কি কমলি? যদি তাই হয়, তবে রাতের আঁধারে সে আমার বিছানায় কেন? এর পরিণাম কী হতে পারে? স্কুলে পড়ানোয় মন দিতে পারলাম না। কাজকর্ম শিকেয় উঠল। ছুটির পর উৎকণ্ঠা নিয়ে ঘরে এলাম। সে আসবে তো? সন্ধেবেলায় কাজে এল না কমলি। যত সময় গড়াতে লাগল, আমার দেহ জ্বরতপ্ত মানুষের মতো কাঁপতে লাগল। রাতে খেলাম না কিছু, শুয়ে ঘুম এল না। এ প্রতীক্ষার কি কোনও শেষ নেই? এমন অনুভূতি জীবনে এই প্রথমবার। তিতিরকে তো আমি ভালোবেসেছি। বহুবার তিতিরের সঙ্গেও হয়েছে দেহবিনিময়। কিন্তু এ এক অন্য অনুভূতি। হয়তো বা প্রাপ্য বস্তু গ্রহণ ও অপ্রত্যাশিত অপ্রাপ্য বস্তু লাভ — দুইয়ের মধ্যেকার পার্থক্যই আমাকে এই অনাস্বাদিতপূর্ব অনুভূতি দিয়েছে। এপাশ ওপাশ করতে করতে ভাবছি, আর সে আসবে না। হয়তো ক্ষণিকের বিচলন তাকে আমার কাছে এনেছিল, ভুল বুঝতে পেরে সে ফিরে গেছে নিজের বাসায়। ভাবতে ভাবতেই দরজায় শব্দ! আজ আমার দরজা আমি শুধু ভেজিয়ে রেখেছি। পাছে ছিটকিনি তার আসার পথে বাধা সৃষ্টি করে। তবে আমার মন জানত, কোনও বাধাই তার কাছে বাধা নয়। গতরাতে ভিতর থেকে ছিটকিনি দেওয়া ছিল। তাও সে যখন এসেছিল, তখন সে আসবেই। আমার যুক্তিবুদ্ধিত্যাগী মন কোনও প্রশ্ন তুলল না। সে রাতেও সে এল। তীব্র মাদকতা ছড়িয়ে দিয়ে গেল আমার স্নায়ুতন্ত্রে!

এই ধারাবাহিকতা চলতে লাগল। আমি যেন ডুবে গেলাম। তিতিরের খবর নিইনি দু-সপ্তাহ হতে চলল। এর মধ্যে তিতিরের দুটো চিঠি এসেছে। উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। মাইলখানেক দূরের পোস্ট অফিসে টেলিফোন আছে। তিনদিন পর পর সেখান থেকে ফোন করতাম তিতিরকে। গ্রামে টেলিফোন সংযোগ নেই। মোবাইলের ব্যবহার তখন তত ছিল না। থাকলেও কলকাতার বুকে। এসব গণ্ডগ্রামে মোবাইলের টাওয়ার পাওয়া ছিল অসম্ভব। কিন্তু তিনদিনের জায়গায় তেরোদিন কেটে গেছে তিতিরকে ফোন করিনি। চোদ্দদিনের মাথায় দুপুরে বাড়িতে খেতে এসে দেখি তিতির বারান্দায় বসে। আমি একটু বিরক্তই হলাম। মনে হতে লাগল, এটা তিতিরের অমার্জনীয় অপরাধ।

ঘরে ঢুকে তিতির আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার বুকে মাথা রেখে বারবার মুখ ঘষতে লাগল। আমার অবাধ্য হাতদুটো একবারের জন্যও ওকে স্পর্শ করল না। পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। তিতির যেন কিছু একটা অনুমান করল। চোখভরা বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে মুখ তুলে চাইল, তারপর ছিটকে সরে গেল। ওর চোখে টলটলে জল, খানিকটা বুঝি নেমেও এল গাল বেয়ে। আমার কোনও হেলদোল হল না। কঠিন গলায় বললাম, “তুমি কেন এসেছ? আমি তো তোমাকে ডাকিনি।”

এত কঠিন কথা আমি বলতে চাইনি তিতিরকে। আমার তিতির, যাকে আমি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবেসেছি, তাকে এভাবে আঘাত করার শক্তি আমি কোথায় পেলাম, তা বলতে পারি না। কিন্তু আমি তখন মদের চেয়েও তীব্র এক নেশায় চুর। বাইরের পৃথিবী আমার কাছে মিথ্যে। এক হ্যালুসিনেশন ও ইল্যুশনের জগতে আমার বাস। আজ বুঝি। কিন্তু তখন এ চিন্তা আমার ধারে কাছেও আসেনি। তিতির খাটের ওপর রাখা ভ্যানিটি ব্যাগটা টেনে নিয়ে সটান বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে। তখন বেলা প্রায় তিনটে। ছটার আগে কোনও ট্রেন নেই ফেরার। সে ট্রেনও প্রায়শই লেট থাকে। কীভাবে তিতির কলকাতায় পৌঁছবে অত রাতে, তার নিরাপত্তার কথা কিছুই মাথায় এল না। শুধু নিশ্চিন্ত হলাম। একরাশ নিশ্চিন্ততা আর অপেক্ষা।

মাস দুয়েক চলেছিল আমার ঘরে কমলির অভিসার। হঠাৎ যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই আসা বন্ধ করল সে। আমার দিনগুলো যেন রাতের মতো অন্ধকার হয়ে গেল। রাতগুলোয় শূন্যতার বিস্তার। একদিন, দুদিন, পাঁচদিন, এক সপ্তাহ-রোজ রাত জাগি তার অপেক্ষায়। দরজা খুলে রাখি হাট করে। ভেজানো দরজার পাল্লাও যেন তার সামনে ভুল করেও কোনও বাধা সৃষ্টি না করে! এর মধ্যে বিধুবাবু বেশ কয়েকবার জানতে চেয়েছেন, আমার শরীর ভালো আছে কিনা। আমি নাকি ক্রমশ রোগা হয়ে যাচ্ছি। একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা দেখে নিজেও চমকে উঠেছিলাম। চোখের নীচে একরাশ কালি, গাল ঢুকে গেছে। পরনের পাঞ্জাবিটা ঢলঢল করছে। যেন দু-সাইজ বড়ো। না, তাতে আমার বিন্দুমাত্র ভয় হয়নি। বরং রাগ হয়েছিল আয়নাটার ওপর। ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম উঠোনে। ব্যস, আমার ঘরে আর কোনও আয়না নেই। চুল আঁচড়ানো বা দাড়ি কাটার মতো কাজগুলো হাতের আন্দাজে করে নিই।

বিধুবাবুকে কমলির মাইনের কথাও আর জিজ্ঞেস করা হয়নি। ও চাইলে আমি আমার পুরো মাইনেই ওর হাতে তুলে দিতে পারি। কিন্তু কোনওদিন সে টাকা চায়নি। অবশ্য আমাদের মধ্যে কথাই বা হত কোথায়! সেই প্রথমদিন সে নিজের পরিচয় দিয়েছিল। সেই শেষ। আর শুনিনি তার গলা। আর এখন তো তার দেখাই মিলছে না। মনে মনে অধৈর্য হয়ে উঠলাম। ঠিক করলাম, মোতির বাড়িতে যাব। কিন্তু মোতির বলিষ্ঠ চেহারা আর রক্তজবার মতো চোখ মনে পড়লেই যেন মনের জোর হারিয়ে ফেলি। তাই বিধুবাবুকে ডেকে পাঠালাম। বিধুবাবু হন্তদন্ত হয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী হয়েছে মাস্টারমশাই? শরীর খারাপ?”

এই এক হয়েছে, যা বলি, তাতেই একই প্রশ্ন সবার মুখে—শরীর খারাপ? মনটা তেতো হয়ে গেল। মুখে যতদূর সম্ভব ভদ্রতা বজায় রেখে বললাম, “না। বলছিলাম যে, মোতির বউ কিছুদিন ধরে কাজে আসছে না।”

বিধুবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, “মোতির বউ!”

“হ্যাঁ, আপনিই তো ওকে পাঠিয়েছিলেন। ভালোই কাজকর্ম করছিল, হঠাৎ আসা বন্ধ। দু-মাস ধরে মাইনেও নেয়নি। কী ব্যাপার জানাতে পারেন?”

“কিন্তু মাস্টারমশাই, আমি তো মোতির বউকে পাঠাইনি কাজ করতে! হ্যাঁ, আপনি একবার বলেছিলেন বটে লোকের কথা। কিন্তু তারপর আপনিও কিছু আর বললেন না, আমিও ভুলে গেছি। কী ব্যাপার মাস্টারমশাই?”

ব্যাপার যে কী, তা কি ছাই আমিই বুঝছি? কেউ পাঠায়নি, কমলি নিজেই এসেছিল, নিজেই চলে গেল। কিন্তু কেন? বিধুবাবুকে আর কিছু বললাম না। মনে মনে স্থির করলাম সন্ধের পর মোতির বাড়িতে যাব। সেইসময় মোতির নেশাটা জমে ওঠে। কমলির সঙ্গে মন খুলে কথা বলা যাবে।

সেদিন স্কুল ছুটির পর সন্ধের অন্ধকার নেমে আসতেই ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পাড়াগাঁ, সন্ধে নামার আগেই রাস্তাঘাট শুনশান হয়ে যায়। কাজেই আমাকে দেখারও কেউ নেই। দু-একটা কুঁড়েঘর থেকে কচি গলায় পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমারই ছাত্রছাত্রী হবে। কোনওদিকে নজর না করে এগিয়ে গেলাম। অন্ধকারে মোতির বাড়িটা ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কাছাকাছি একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করতে থাকলাম। বাইরের দাওয়ায় বোধহয় মোতি হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে। নেশা ধরেছে খুব। কোনও হুঁশ নেই মনে হচ্ছে। কী করব বুঝে উঠতে পারলাম না। আশেপাশের দু-চারটি বাড়ি থেকে টিমটিমে লম্ফের আলো বেরিয়ে এসে অন্ধকারকে যেন আরও জমাট করে তুলেছে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক কান ফাটিয়ে দিচ্ছে। জঙ্গলের দিক থেকে মাঝে মাঝে শেয়ালের ডাকও ভেসে আসছে। কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম জানি না, পনেরো মিনিটও হতে পারে, আধঘণ্টাও হতে পারে। হঠাৎ মোতির বাড়ির দরজা খুলে গেল। ঘোমটা টানা এক নারীমূর্তি হাতে মাটির প্রদীপ নিয়ে বেরিয়ে এল। মোতি যেখানে শুয়ে, সেখানে কয়েকমুহূর্ত থামল। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল উঠোনের তুলসীমঞ্চের দিকে। প্রদীপটি সযত্নে তুলসীমঞ্চে বসিয়ে দিল। হাতজোড় করে কপালে ঠেকাল।

আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। আমার জীবন দুর্বিষহ করে তুলে এই নারী সতী সাবিত্রীর মতো তুলসিতলায় প্রদীপ দিচ্ছে! আমাকে দিয়ে শখ মিটে গেছে। এখন কি অন্য কোনও পুরুষের প্রতীক্ষা? চরিত্রহীনা নারী! হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে বেরিয়ে এলাম গাছের পিছন থেকে। চেপে ধরলাম তার হাত। পাগলের মতো ঝাঁকাতে লাগলাম তাকে ধরে, “বল বল, কেন তুমি আমাকে ত্যাগ করেছ? কী অন্যায় করেছি আমি? বল বল কমলি।”

আমার বজ্রমুঠি থেকে নিজেকে ছাড়াতে দু-বার ঝটকা মারল সে। তারপর ঘোমটা তুলে ধরল। চিৎকার করে ডাকতে লাগল, “আরে কোই হ্যায়? কোই তো বাচাও। ডাকু, ডাকু।”

ততক্ষণে আমি ওর হাত ছেড়ে দিয়েছি। দিনের পর দিন যে শরীরকে আমি নিজের বুকে অনুভব করেছি, সেই তন্বী তো এ নয়। এই নারী বেশ মোটার দিকেই। গায়ের রংও শ্যামলা। সবচেয়ে বড়ো কথা তার শরীরের গন্ধ! কোথায় সে সুঘ্রাণ? এর গা থেকে ঘাম আর রান্নার গন্ধ মেলানো একটা উৎকট গন্ধ ভেসে আসছে। এ তো কমলি হতে পারে না! আমি সব ভুলে মোতির দরজার সামনে গিয়ে “কমলি, কমলি” বলে চিৎকার করতে শুরু করলাম।

ইতিমধ্যে চেঁচামেচিতে আশেপাশের বাড়ি থেকে লোকজন বেরিয়ে এসেছে। তাদের কারো হাতে লাঠি, কারো বা বেলন, খুন্তি ইত্যাদি। কিন্তু বেরিয়ে এসে ডাকুর বদলে তাদের পরম শ্রদ্ধেয় মাস্টারবাবুকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। মোতিও নেশা চটকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। আমি দরজায় ধাক্কা মেরে ভিতরে ঢুকে গেলাম। কমলির নাম ধরে বারবার চিৎকার করতে লাগলাম। কিন্তু কোথায় কমলি! শূন্য ঘরের নিস্তব্ধতা আমার মনের শূন্যতার প্রতীক হয়ে খাঁ খাঁ করতে লাগল। ইতিমধ্যে কারা যেন বিধুবাবুকে ডেকে এনেছে। আমি টলতে টলতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসামাত্র বিধুবাবু আমাকে ধরে ফেললেন। উনি ধরে না ফেললে আমি হয়তো পড়ে যেতাম। কারণ অতিরিক্ত উত্তেজনায় কিছুক্ষণের জন্য আমার সবকিছু ব্ল্যাকআউট হয়ে গিয়েছিল।

জ্ঞান যখন এল, তখনও আমি মোতির বাড়ির দাওয়ায় শুয়ে আছি। অনেকগুলি লন্ঠন আর মশালের আলোয় চারিদিক আলোকিত। বেশ ক’টি মুখ আমার উপরে ঝুঁকে আছে। কিন্তু সেই মুখ কোথায়, যাকে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি? উঠে বসার চেষ্টা করতেই কয়েকজন মিলে আমাকে বসতে সাহায্য করল। কিছু দূরে মোতি দাঁড়িয়ে পাগলা ষাঁড়ের মতো ফুঁসছে। হয়তো বা অন্যরা তাকে আমায় আঘাত করা থেকে বিরত করেছে। না হলে ওর হাতে আজ আমার সাক্ষাৎ মরণ ছিল। মোতির বউকে দেখছি না। আশেপাশের বাড়ির কোনও মহিলা হয়তো তাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেছে। বিধুবাবু সস্নেহে বললেন, “কী হয়েছে মাস্টারমশাই? শরীর খারাপ?”

এবার আর কথাটা তেমন খারাপ লাগল না। বরং একটা অবলম্বন পেলাম যেন। আস্তে আস্তে ওঁকে সব বললাম, রেখে ঢেকে যতটুকু বলা যায়। সব শুনে তিনি বললেন, “কী নাম বললেন মাস্টারমশাই? কমলি? কিন্তু মোতির বউ-এর নাম তো গুলাবি। আবার আপনিই বা এ নাম জানবেন কী করে! কমলি তো…”

“চুপ করলেন কেন বিধুবাবু? কমলি তো কি?”

“চলুন মাস্টারমশাই। আমার বাড়ি চলুন। আজ আর আপনার গেস্টহাউসে ফিরে কাজ নেই। আজ রাতটা আমার বাড়িতেই থাকবেন। কাল সকালে দেখব আপনার জন্য কোনও থাকার ব্যবস্থা করা যায় কিনা।”

বিনাবাক্যব্যয়ে বিধুবাবুর সঙ্গে তাঁর বাড়িতে এলাম। চোখে মুখে ঠান্ডা জল দিয়ে বসলাম। বিধুবাবু হাতপাখার বাতাস করতে লাগলেন। এতক্ষণে যেন একটু ধাতস্থ লাগল নিজেকে। বিধুবাবুকে কিছু বলার দরকার হল না। ঘুমের মধ্যে যেন কথা বলছেন, এভাবে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন, “মোতির প্রথমপক্ষের স্ত্রী ছিল কমলি। সাত বছর বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও কোনও সন্তান হয়নি তার। গ্রামগঞ্জ তো, এজন্য প্রতিবেশীরা কম কথা বলেনি তাকে। মোতির তো কাজই ছিল রোজ রাতে বাড়ি ফিরে কমলিকে পেটানো। অমন সুন্দর মোমের পুতুলের মতো মেয়ে, ধীরে ধীরে পোড়া কাঠের মতো হয়ে যেতে লাগল। এখন তো মনে হয় দোষটা মোতিরই। না হলে দ্বিতীয় বউয়েরও ছেলেপুলে হবে না কেন!” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু সময় নিলেন বিধুবাবু। তারপর বললেন, “সে সময় গ্রামে কারখানা তৈরির কথা চলছে। ওষুধের কারখানা হবে, অনেক লোকের চাকরি হবে, এই আনন্দে সবাই মশগুল। মোতি ওই গেস্টহাউসের কেয়ারটেকারের চাকরি পেল। তখন একজন সরকারি বাবু এলেন গেস্টহাউসে। কমলি তাঁর রাঁধাবাড়ার কাজ করত। জল তুলত, বাসন মাজত। জানি না কীভাবে, কার উৎসাহে তাদের দু’জনের মধ্যে এক অবৈধ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মোতি রোজ রাতে মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়লেই কমলি বেরিয়ে পড়ত বাড়ি থেকে। চলে যেত গেস্টহাউসে, ওই বাবুর কাছে। কিছুদিন এরকম চলার পর বাবুর একদিন কাজ শেষ হল। কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেলেন এখান থেকে। এরমধ্যে মোতির কানে এ খবর গেছে। সে স্ত্রীকে একদিন বেধড়ক মারল। একদিকে সরকারিবাবুর বিশ্বাসঘাতকতা, মুখপুড়ি হয়তো ভেবেছিল উনি তাকে বিয়ে করে এই নরক থেকে নিয়ে যাবেন। অন্যদিকে স্বামীর প্রচণ্ড মার। সহ্য করতে পারেনি কমলি। সেদিন রাতে গেস্টহাউসে গলায় দড়ি দেয় সে। পরে পুলিশ এসে তার দেহ নিয়ে যায়। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে জানা যায়, কয়েক সপ্তাহের গর্ভবতী ছিল কমলি। মা হওয়া ভাগ্যে ছিল না মেয়েটার।”

পরদিন সকালে বিধুবাবুর সঙ্গে গেস্টহাউসে গিয়ে আমার জিনিসপত্র নিয়ে কলকাতা চলে আসি। আর ওখানে নয়। বিধুবাবু বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও ওখানে থাকতে আর মন চাইছিল না। তিতিরের কথা খুব মনে পড়ছিল। কলকাতা থেকেই পোস্টে আমার রেজিগনেশন লেটার পাঠিয়ে দিই। টাকাপয়সা কিছু এখনও বাকি আছে। তবে না পেলেও ক্ষতি নেই। তিতিরকে সব বলেছি। ও কতটা বিশ্বাস করেছে জানি না, তবে ক্ষমা করেছে আমাকে। পরেরবার দু’জনে একসঙ্গে পরীক্ষায় রসব। কিন্তু বাড়ি থেকে যাতায়াত করা গেলে তবেই চাকরি নেব। নইলে আবার ফিরে যাব আমার কবিতার জগতে।

পরিশিষ্ট

এ গল্পের একটা পরিশিষ্ট আছে। মাঝে মাঝে বৃষ্টির দিনে একা ব্যালকনিতে বসে যখন কবিতা লিখি, হঠাৎ হঠাৎ শুনতে পাই কাচের চুড়ির রিনরিন, কখনো বা দমকা হাওয়ার সঙ্গে এক অজানা ফুলের গন্ধ আমার নাকে এসে ঝাপটা মারে। তিতিরকে আদর করতে করতে কখনো কখনো গুলিয়ে যায় স্থান-কাল-পাত্র। এমনই এক বর্ষার দিনে কলকাতার রাস্তা দিয়ে নিজের মনে হেঁটে যেতে যেতে চমকে উঠেছিলাম রাস্তার উলটোদিকে একহাত ঘোমটা টানা এক দেহাতি মহিলাকে দেখে। কাচের চুড়ি পরা ফর্সা হাতদুটো শরীরের দু’দিকে অসহায় ঝুলে আছে। ফুটপাতে আমার দিকেই মুখ করে দাঁড়ানো সে। শরীরের স্ফীত মধ্যভাগ বলে দিচ্ছে, সে সন্তানসম্ভবা। আশপাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকেদের দেখে মনে হল না, তারা আদৌ তাকে দেখতে পাচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত। তারপর আর দেখতে পেলাম না তাকে। শুধু পদ্মিনী নারীর পদ্মগন্ধে ভরে গেল আমার ঘ্রাণ। জানি না আর কেউ এ গন্ধ পেয়েছে কিনা, আর কেউ তাকে দেখেছে কিনা! ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরেছিলাম সেদিন। ও কি সত্যিই কমলি, না আমার চোখের ভুল? ওই সন্তান কার? তবে কি বেঁচে থাকতে যে ইচ্ছা তার পূর্ণ হয়নি, মৃত্যুর পর সেই মাতৃত্বের স্বাদ দেওয়ার জন্য আমাকে ধন্যবাদ দিতে এসেছিল সে? তাও সম্ভব?

Inspire Literature
Inspire Literaturehttps://www.inspireliterature.com
Read your favourite inspire literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments