Saturday, July 6, 2024
Homeউপন্যাসকালপুরুষ - সমরেশ মজুমদার

কালপুরুষ – সমরেশ মজুমদার

Table of contents

০১. কাল রাতের বেলায় কাছাকাছি কোথাও বৃষ্টি হয়েছিল

কাল রাতের বেলায় কাছাকাছি কোথাও বৃষ্টি হয়েছিল। ভোরের ঝিরঝিরে বাতাস তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেনে ঢুকে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই একজন সেটা টের পেল। চাপা গলায় সেই অন্ধ-মুখটা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, বিষ্টি এল নাকি! ন্যাড়া হওয়ার পর সাদা কদমের চেহারা নিয়েছে মাথাটা, দড়ি পাকানো শরীরে একটা চিলতে থান, যাতে বুকের খাঁচা ঢাকতে পায়ের গোড়ালি বেরিয়ে যায়, কাঠির মত হাত বাড়িয়ে দেখতে চাইল জলের ফোঁটা পড়ে কিনা। সামনেই একটা বাঁধানো টিউবওয়েল। তার তলায় পা ছড়িয়ে বসে দাঁত মাজছিল একটি যুবতী। যতক্ষণ না সরু গলির শেষে ঈশ্বরপুকুর লেনের মুখে একটা সাইকেল এসে দাঁড়াবে ততক্ষণ ওর দাঁত পরিষ্কার হবে না। যুবতী বলল, ওমা, কি করছ হাত বাড়িয়ে?

বিষ্টি এল নাকি লা?

ধুস, আকাশে মেঘ নেই তো বৃষ্টি আসবে কোত্থেকে!

তবে যে ঠাণ্ডা বাতাস পেলাম, ভিজেভিজে।

যুবতী ঠোঁট ওল্টালো। তারপর দাঁত মাজতে মাজতে গলির শেষপ্রান্ত দেখে চাপা গলায় বলল, আঃ, বুক খুলে বসে আছ কেন? ব্যাটাছেলে আসছে।

পড়ে যাওয়া থানের আঁচল বুকে জড়িয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কে যায়?

যে গেল সে জবাব দিল না।

ঠাসঠাস বাঁকা টিন আর ভাঙ্গা টালির তলায় যে ঘরগুলো সেখানে এখনও সকাল নামেনি। ঠাণ্ডা বাতাসেরা ভুল করেই বোধ হয় এই সরু পথে ঢুকেছিল। সাধারণত তারা এর অনেক উঁচু দিয়ে সূর্যের কাছাকাছি ঘরগুলোয় খেলা করে। বেলগাছিয়া ব্রিজ ছাড়িয়ে এই এলাকাটার নাম বস্তি। দরিদ্রের ঘনবিন্যস্ত কুটীরশ্রেণী। বসতি শব্দটি সংকুচিত হয়ে অনেক কিছু গুটিয়ে দিয়েছে। আড়াই শো ঘরের দেড় হাজার বাসিন্দার একটাই ঠিকানা, তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেন।

এখন, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এই গত চার ঘণ্টাই তিন নম্বরে কোন শব্দ নেই। সেই নির্জনে বসে দাঁত মাজতে মাজতে যুবতী আড়চোখে বুড়ির দিকে তাকাল। চার বছর পার হলে একশ হবে। এখন আর মেয়েছেলে বলে মনে হয় না। গলার স্বরেও না। চোখেও দ্যাখে না অনেকদিন। সে বলল, রাতে ঘুমাওনি?

বুড়ি ঘাড় কাৎ করল, ঘুমুবনি কেন লা? তোর মত শরীরের জ্বালায় জ্বলি নাকি আমি!

যুবতীর চোখ ছোট হল, আমি জ্বলি তোমাকে কে বলল?

জ্বলিস! নইলে রোজ এত ভোরে দাঁত মাজার ধুম কেন? ব্যাটাছেলে দেখলে আমায় বুক ঢাকতে বলিস কেন?

ওমা, মেয়েছেলে বুকে আঁচল দেবে না?

যদ্দিন ছিল তদ্দিন দিয়েছি। দু কুড়ি বছর ধরে দিয়েছি।

তাহলে আর বেঁচে আছ কেন?

মর মাগী, আমি মরতে যাব কোন দুঃখে?

ওমা, এখনও বাঁচার ইচ্ছে? এতদিন বেঁচেও শখ গেল না?

না গেল না। কালকের দিনটা দেখব না? রোজ রাত্তিরে শোওয়ার সময় বলি, হে ভগবান, কালকের দিনটা দেখিয়ে দিও। কে যায়? বুড়ি কান খাড়া করল।

যুবতী আগন্তুককে দেখে চাপা গলায় বলল, নারাণকাকা।

যে আসছিল তার কাছে গলিটা যেন ফুরোচ্ছিল না। এই না-রাত না-দিনের সময়টায় এখন একটা বিছানা খুঁজছিল সে। বুড়ি আবার চেঁচাল, কোন নারাণ?

লোকটা কোনরকমে সামনে এসে দাঁড়াল, আমি নারায়ণ। বিষ্ণুর আর এক নাম নারায়ণ। লোকটার গলার স্বর জড়ানো, বিরক্ত।

ওমা তুমি! একটু দাঁড়াও বাবা। বুড়ি রক থেকে হড়বড়িয়ে নামল। তারপর শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে গিয়ে লোকটাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল। লোকটা দুটো হাত শূন্যে ঘোরালো আশীর্বাদের ভঙ্গীতে। তারপর ময়লা জামা আর খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে ভেতরে চলে গেল।

মাটি ছেড়ে উঠে বুড়ি বলল, রোদ ওঠেনি তো রে?

যুবতীর কপালে ভাঁজ পড়েছিল। এবার খিঁচিয়ে উঠল, ওই মাতালটাকে প্রণাম করে তোমার কি পুণ্যিলাভ হল? সারা রাত বাইরে ফুর্তি করে আসে, মেয়ে বউকে খেতে দেয় না আর তাকে তুমি প্রণাম করছ! দেখলে গা জ্বলে যায়।

মদ খাক আর রাঁড়ের বাড়ি যাক আমার কি লা? ওর শরীরে বামুনের রক্ত আছে তাই প্রণাম করলাম। সাইকেলের ঘন্টি বাজছে না? বুড়ি কান খাড়া করল।

যুবতীর আঙুল ততক্ষণে থেমে গেছে। ঈশ্বরপুকুর লেনের যে অংশটা এখান থেকে দেখা যায় সেখানে একটা সাইকেল এসে দাঁড়িয়েছে। সাইকেলের সামনে-পেছনে খবরের কাগজ স্তুপ করা। লম্বা এক যুবক সাইকেল থেকে নেমে কয়েক পা হাঁটতেই যুবতীর চোখের আড়ালে চলে গেল। তাড়াতাড়ি কলের জলে মুখ ধুয়ে যুবতী হেলতে দুলতে গলির মুখে গিয়ে দাঁড়াল। এখনও ঈশ্বরপুকুর লেনের দোকানপাট খোলেনি। নরম ছায়া ছড়িয়ে আছে রাস্তায়। দুটো বাস পাশাপাশি যেতে পারে ঈশ্বরপুকুর লেনে। যুবতী জানে বাঁ দিকের মুদির দোকানের পরেই নিমুর চায়ের দোকান। যুবক সেখানেই গেছে। নিমুর চায়ের দোকান খুলেছে ঘণ্টাখানেক আগে। এই সময় কিছু ঘুম-না-হওয়া বুড়ো দোকানের ভেতরে বসে রাজনীতির কথা বলে। উনুনে ফুটন্ত জলের ড্রাম বসিয়ে নিমু অবিরত চা করে যাচ্ছে। এই একঘণ্টায় নিমুর খদ্দের ঠিকে-ঝিয়েরা। বুড়োগুলো কথা বলে আর তাদের দ্যাখে। যুবক নিমুকে কাগজ দেওয়া মাত্র বুড়োদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। এককাপ চা নিয়ে যুবক গম্ভীর মুখে মুদির দোকানের সামনে চলে আসে, তারপর আরাম করে চুমুক দেয়।

যুবতী যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানে চায়ের দোকানের খদ্দেরদের নজর যায় না। এই ভোরে রাস্তায় তেমন লোক নেই। যুবতী মিষ্টি গলায় বলল, আজ দেরি হল যে?

যুবক বলল, দেরি করে ভ্যান এল, লোডশেডিং ছিল কাগজের অফিসে!

যুবতী জিজ্ঞাসা করল, কাশিটা কেমন আছে?

যুবক চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, না মরলে যাবে না।

আঃ, বাজে কথা বলো না। আজ বিকেলে আসবে?

কোথায়?

দর্পণায়।

কি বই?

কি যেন নামটা, মিঠুন আছে!

দূর! ওসব ভাল্লাগে না। মিত্রায় চল।

ওখানে তো কি একটা খটমট বই হচ্ছে!

তামিল ছবি। হেভি সেক্সি। টিকিট কেটে রাখব। ছ’টায়।

যুবতী কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় বাজুতে তেঁতুলের খোলার স্পর্শ পেয়ে চমকে ফিরে দেখল বুড়ি পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। কোঁচকানো শুকনো গালে কেমন যেন ভিজে ভিজে হাসি জড়ানো, ফোকলা মুখে জিভটা নড়ল, একটু চা খেতে ইচ্ছে করছে লা, ওকে বল না!

যুবতী খুব বিরক্ত হল। কিন্তু বুড়ি তার হাত ছাড়ছে না। বাধ্য হয়ে সে বলল, নিমুর দোকান থেকে একটা চা এনে দাও তো?

কে খাবে? যুবক বিস্মিত, সে বুড়িকে দেখতে পায়নি।

যুবতী বলল, ঘাটের মড়া, মোক্ষ বুড়ি!

যুবক ঠোঁট উল্টে কাপের চা শেষ করে নিমুর দোকানের রকে রেখে আর এককাপ চা নিয়ে আসতেই মোক্ষবুড়ি আঁচলের তলা থেকে একটা টিনের গ্লাস বের করল। যুবক তাতে চা ঢেলে দিতেই বুড়ি বলল, বেঁচে থাকো বাবা, তাড়াতাড়ি বিয়েটা হোক।

যুবতী ঝাঁঝিয়ে উঠল, ঠিক আছে, এবার বিদায় হও।

মোক্ষদা বুড়ি আর দাঁড়াল না। চায়ের গ্লাসটা দুহাতে ধরে ভাঙ্গা মাজা নিয়ে টুক টুক করে সরু গলি দিয়ে চলে গেল ভেতরে। যুবক একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, বিকেলে আসার সময় লক্ষ্য রাখিস কেউ ফলো করছে কিনা!

যুবতী ভ্রূ-কুঞ্চন করল, কে ফলো করবে?

তুই জানিস।

ইস! আমি অত সস্তা না?

তিন নম্বরের মেয়েদের আমার জানা আছে।

ছাই জানো!

ও হ্যাঁ, শোন। তোদের এখানে একটা মাস্টারনি থাকে না?

হ্যাঁ। কেন?

ওদের স্কুলে লোক নেবে। কেরানির চাকরি। জিজ্ঞাসা করবি? আমি পি ইউ পাশ। যুবক কথাটা বলে আর দাঁড়াল না। চায়ের দাম চুকিয়ে সাইকেলে উঠে প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, তোর বাপ আসছে!

চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে যুবতী দেখল গলির ভেতরে যে মানুষটাকে দেখা যাচ্ছে তার চোখ আকাশের দিকে। পঞ্চাশ বছর বয়স, স্টেট বাসের ড্রাইভার। এই গলি দিয়ে বের হতে হতে অন্তত দশবার আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে নমস্কার করবে। যুবতী আবার ঘাড় ঘুরিয়ে দূরে মিলিয়ে যাওয়া সাইকেলটাকে দেখে নিষ্পাপ মুখ করে ভেতরে ঢুকল।

মুখোমুখি হতেই বাপ বলল, এখানে কি করছিস?

এমনি!

এমনি মানে? এই ভোরে রাস্তায় কি দরকার? আমি মরে গেছি, না? সেই হকারটা এসেছিল?

কে আবার আসবে?

আবার মুখে মুখে কথা! যা, ভেতরে যা। নিজে সাততাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠিস আমাকে ডেকে দিতে পারিস না। বাপ আর দাঁড়ালো না।

যুবতী ঠোঁট বেঁকিয়ে চলে যাওয়া শরীরটার দিকে তাকিয়ে বলল, শালা!

সেই সময় গলির ভেতরে মোক্ষদা বুড়ির পরিত্রাহি চিৎকার ছড়িয়ে পড়ল। যুবতী দেখল দুহাতে কপাল চাপড়াচ্ছে বুড়ি আর তার সামনে দাঁড়িয়ে ওর ছোটভাই ন্যাড়া। দিদিকে দেখতে পেয়েই ন্যাড়া দৌড়ে এল, বাবা চলে গেছে? যুবতী ঘাড় নাড়তেই ন্যাড়া ছুটে গেল বাইরের দিকে। বুড়ি তখনও সমানে চিৎকার করে কাঁদছে। একটু একটু করে বিভিন্ন ঘর থেকে মেয়েরা বেরিয়ে গোল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বুড়ি দুপা সামনে ছড়িয়ে মাথা নাড়ছে আর বলছে, ওলাওঠা হোক, মার দয়া হোক ছোঁড়ার। সক্কাল বেলায় একটু চা খাব ভেবেছিলাম, ছোঁড়াটা ফেলে দিয়ে গেল! তোমরা বিচার করো, আমার কি হবে গো?

দশ বছরের ন্যাড়ার অবাধ্যতা নিয়ে দু-একজন যখন মন্তব্য করছে তখন যুবতীর মা বেরিয়ে এল, ঘর ছেড়ে। বোঝা যায় বিছানা থেকেই ন্যাড়ার নাম শুনে ছুটে এসেছে, কি হল?

আমার চা ফেলে দিল তোমার ছেলে! বুড়ি ককিয়ে উঠল।

চা! তুমি চা পেলে কোথায়? কে কিনে দিল?

তোমার মেয়ের ভাতার। ওই যে সাইকেলে আসে!

যুবতীর মনে হল তার দম বন্ধ হয়ে যাবে। গুঞ্জনরত ভিড়টা আচমকা যেন জমে গেল। যুবতীর মা আগুনচোখে মেয়েকে দেখল। তারপর চিৎকার করে বলল, মুখ সামলে কথা বল, আমার মেয়ে তেমন নয়।

ওমা, আমি বানিয়ে বলছি নাকি। সে ছুঁড়ি কোথায়, তাকেই জিজ্ঞাসা কর না!

অন্ধচোখে বুড়ি যেন চারদিকে যুবতীকে খুঁজতে লাগল।

যুবতীর মা সোজা হয়ে দাঁড়াল, এ্যাই, এদিকে আয়!

যুবতীর কপালে ভাঁজ পড়ল। গোল হয়ে দাঁড়ানো মানুষেরা এবার গুনগুন করতে লাগল। প্রত্যেকের দৃষ্টি যুবতীর দিকে। যুবতী কি করবে বুঝতে পারছিল না। মায়ের ভীষণা মূর্তি তাকে সংকুচিত করে রেখেছিল। কিন্তু সে এগিয়ে যাওয়ার আগেই ছুটে এল মা। রোগা শরীরটা ক্ষিপ্তভঙ্গীতে আছড়ে পড়ল মেয়ের ওপর। একহাতে চুলের ঝুঁটি ধরে টানতে টানতে সবার সামনে দিয়ে ঘরের মধ্যে নিয়ে গেল মা তাকে। মাটিতে শুয়ে থাকা এক ভাই এক বোন চটপট উঠে বসে দেখল দিদি সমানে মার খেয়ে যাচ্ছে। মায়ের গলা যেন চিরে যাচ্ছে উত্তেজনায়, বল, সত্যি কথা বল, রোজ দাঁত মাজতে যাস তোর ভাতারের সঙ্গে দেখা করতে? পিরীত? তোর দড়ি জোটে না! মানুষটা গলায় রক্ত তুলে খাটছে আর তুমি ফুর্তি করছ। কত বড় বংশের মেয়ে তুমি তা জানো? ওই কাগজওয়ালা ছোঁড়াটার কথা ন্যাড়া বলেছিল কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনি। তোকে আমি পেটে ধরেছিলাম কি জন্যে? বল, সত্যি কথা বল!

যুবতী চুপচাপ মার খাচ্ছিল। যুবতীর মা উত্তেজনায় শেষ পর্যন্ত দম হারিয়ে মাটিতে বসে পড়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করলে দরজায় একটা মূর্তি এসে দাঁড়াল, অ বউমা, ওকে মের না।– যুবতী কাঁদছিল না। পাথরের মত দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। মোক্ষদা বুড়ি আবার বলল, মাথা গরম করো না বউমা।

যুবতীর মা এবার মুখ তুলল, না, মাথায় বরফ দেব!

মোক্ষদা বুড়ি বলল, ছেলেটা তো খারাপ না। আমায় চা খাওয়ালো!

সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠল যুবতীর মা, বেরিয়ে যান, চলে যান সামনে থেকে। এত খেয়েও নোলা যায় না! ঘটকি হতে এয়েছে। বেরিয়ে যান সামনে থেকে।

মোক্ষদা বুড়ি বলল, ওমা, ভাল কথা বলতে এলাম উল্টে চোখ রাঙাচ্ছে! এটা তোর বাপের জায়গা যে বেরিয়ে যেতে বলছিস? ঘটকিগিরি, বেশ করেছি ঘটকিগিরি করে। মেয়ের শরীর ভারী হচ্ছে, সে তো পিরীত করবেই। ট্যাঁক তো ফাঁকা, কে তোর মেয়েকে বিয়ে করতে আসবে। কথাগুলো বলতে বলতে বুড়ি সরে গেল দরজা থেকে। থর থর করে কাঁপছিল যুবতীর মা। তার বন্ধ চোখ থেকে জল গড়িয়ে আসছিল। মাটিতে বসা একটা সরু গলা চিৎকার করে উঠল, দিদি মা পড়ে যাচ্ছে।

যুবতী সঙ্গে সঙ্গে সম্বিত ফিরে পেয়ে দৌড়ে মাকে জড়িয়ে ধরল। তার বুকের মধ্যে মায়ের ছোট্ট শরীরটা থরথরিয়ে কাঁপছিল। যুবতী ব্যাকুল গলায় ডাকল, মা, মাগো!

যুবতীর মা একটু একটু করে চোখ মেলে মেয়েকে দেখল। যুবতী দুহাতে তাকে জড়িয়ে রেখেছে। হঠাৎ মেয়ের বুকে মুখ রেখে হু হু করে কেঁদে উঠল মা। কিন্তু তারপরেই যুবতী অনুভব করল মায়ের শরীর শিথিল হয়ে যাচ্ছে। ভয়ে চিৎকার করে উঠল সে। তারপর মাটিতে শুইয়ে দিয়ে এক ছুটে বাইরে বেরিয়ে এল। যে ভিড়টা একটু আগে জমেছিল তা এখন গলে গেছে। কি করবে ভেবে না পেয়ে সে সামনের বন্ধ দরজায় আঘাত করল।

কাপড় পাল্টানো হয়ে গিয়েছিল। বদ্ধ ঘরটায় একটা বাসী গন্ধ চাপ হয়ে রয়েছে। দেওয়ালে টাঙানো চৌকো আয়নায় এখন তার সিঁথি। একটু একটু করে চুল পাতলা হয়ে চওড়া হচ্ছে সিঁথিটা। ছোট্ট কপালটাও বেশ বড় হতে চলল। একফোঁটা সিঁদুর সিথিতে বোলানো মাত্রই দরজায় শব্দ হল। মাধবীলতা ভ্রূ কুঁচকে দরজাটাকে দেখল। তারপর ঘরে চোখ রাখল। কিন্তু এবার শব্দের সঙ্গে ব্যাকুল গলা, ও বউদি, বউদি।

দরজা খুলতেই মাধবীলতা দেখতে পেল ওপাশের ঘরের একটি মেয়ে কান্না কান্না মুখে দাঁড়িয়ে। দেখা মাত্রই বলল, বউদি, একটু আসুন, মা কেমন করছে!

কেন কি হয়েছে? মাধবীলতা অবাক হল।

জানি না, চিৎকার করতে করতে কেমন নেতিয়ে পড়ল।

মাধবীলতা আড়চোখে প্রায়ান্ধকার ঘরের দিকে তাকিয়ে চটপট বেরিয়ে এল। যুবতীর নাম অনু। অনুপমা। কিন্তু ওর চেহারায় এমন একটা ভোঁতা উগ্রতা আছে যা সে পছন্দ করে না।

ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে মাধবীলতা দেখল অনুপমার মা মাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। ঠোঁট বন্ধ, হাত ছড়ানো, মুঠো খোলা। দ্রুতপায়ে কাছে এসে বুকে হাত রাখল, নাকের তলায় আঙুল দিয়ে দেখল নিঃশ্বাস পড়ছে। প্রথমেই তার মনে হল স্মেলিং সল্ট দরকার। তারপরেই চিন্তাটাকে বাতিল করে বলল, জল নিয়ে এস, আর একটা পাখা।

অনুপমা দ্রুত জিনিসগুলো কাছে আনতে মাধবীলতা মুখে জল দিয়ে বাতাস করল কিছুক্ষণ। তারপরে ঠিক সাহস না পেয়ে বলল, আমার ভাল লাগছে না, তুমি মোড়ের ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনতে পারবে?

হুকুম পাওয়া মাত্র অনুপমা ছুটল। এর মধ্যেই চিৎকার চেঁচামেচিতে দরজায় বেশ ভিড় জমে গেছে। বাচ্চা দুটো তখনও বিছানার ওপর পাথরের মত বসে তাদের মাকে দেখছিল। এই ঘরে জানলা বলতে যেটুকু ফাঁক তাতে হাওয়া ঢোকে না। একখানা তক্তাপোশও নেই, চারদিকে হাঁ করা অভাব। মাধবীলতা বলল, আপনারা একটু সরে দাঁড়ান ভাই, হাওয়া আসতে দিন।

মেয়েরা একটু নড়ল কিন্তু সরল না। ওরা সবাই অনুপমার মাকে ছেড়ে এখন মাধবীলতাকে দেখছে। এই বস্তিতে অনেক বছর হয়ে গেল কিন্তু ওকে সবাই মাস্টারনি ছাড়া অন্য পরিচয়ে জানে না। বড়ঘরের মেয়ে, একটু বেশী দেমাক, কারো ঘরে যায় না, প্রয়োজন ছাড়া এ বস্তির কারো সঙ্গে কথা বলে না। কৌতূহল যেমন আছে তেমনি একটু ঈর্ষাও আছে ওর সম্পর্কে। সেই মাস্টারনি আজ অনুর মাকে হাওয়া করছে–এ দৃশ্য দেখার লোভ সামলাতে পারছে না ওরা। এই সময় মোক্ষবুড়ির গলা শোনা গেল, কি হয়েছে, একটু সর না লা, দেখি কি হল?

ছিয়ানব্বই বছরের বুড়িকে জায়গা দিতে হয় না, সে নিজেই করে নেয়। একে সরিয়ে ওর ফাঁক গলে দরজায় এল বুড়ি, অ বউমা! মধ্যবয়স্কা একজন বলল, অনুর মা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে!

সেকি! কি করে হল? মোক্ষদা বুড়ি চমকে উঠল।

আর একজন ফোড়ন দিল, আজ ঝগড়া করেছিলে খেয়াল নেই?

আমি করেছিলুম না ও করেছিল? হাতড়ে হাতড়ে বুড়ি ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। তারপর অনুর মায়ের শরীর ঠাওর পেয়ে মুখে গলায় হাত বুলিয়ে বলল, দাঁতকপাটি লেগে গেছে। মৃগী। কে বসে এখানে?

মাধবীলতা বৃদ্ধার দিকে অপলক তাকিয়েছিল। দিন রাতে একে ঝগড়াটি ছাড়া অন্য ভূমিকায় সে দ্যাখেনি। কিন্তু অনুর মায়ের গালে কপালে হাত বুলিয়ে দেওয়ার সময় একদম অন্য মানুষ বলে মনে হচ্ছিল তার।

সে নিচু গলায় জবাব দিল, আমি সামনের ঘরে থাকি।

আঃ, নাম নেই নাকি লা? দাঁড়াও, দাঁড়াও, গলার স্বরটা কেমন ঠেকল! অ! তুমি সেই মাস্টারনি না? তা তুমি এখানে কি করে এলে? শুনেছি তোমার নাকি ভারি দেমাক, মাটিতে পা পড়ে না! তোমার ছেলে বাপু ঠিক উল্টো!

মাধবীলতা বলল, আমার কথা থাক।

কি এই সময় বাইরে বেশ গুঞ্জন উঠল। অনুপমা ভিড় সরিয়ে ডাক্তারকে ঘরে নিয়ে এল। সাত সকালে লুঙ্গির ওপর পাঞ্জাবি পরে চলে এসেছেন ভদ্রলোক। নাড়ি দেখে, বুকের শব্দ মেপে, চোখের পাতা টেনে মাথা নাড়লেন ডাক্তার, প্রায়ই ফিট হয়?

প্রশ্নটা মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে। মাধবীলতা অনুপমাকে দেখল। অনুপমা ঘাড় নেড়ে না বলল। মাধবীলতা জবাব দিল, না। আজকে এক্সসাইটমেন্ট থেকে এরকম হয়েছে।

ডাক্তার বললেন, ভাল বুঝছি না। একে এখনই হাসপাতালে নিয়ে যান।

সঙ্গে সঙ্গে একটা চাপা আর্তনাদ বের হল অনুপমার মুখ থেকে। আর তখনই ভিড় ঠেলে ন্যাড়া এসে দাঁড়াল দরজায়, কি হয়েছে?

অনুপমা চিৎকার করে উঠল, মা অজ্ঞান হয়ে গেছে। ডাক্তার বলছে হাসপাতালে নিয়ে যেতে।

ন্যাড়া বলল, বাপ শালা টাকা দিল না। বলল হাত খালি। তারপরে দৌড়ে চলে গেল চোখের সামনে থেকে।

ডাক্তারবাবু বললেন, আমার টাকাটা!

মাধবীলতা অনুর দিকে তাকাল। অনু বলল, টাকা নেই। বাবা বাজারের টাকা পর্যন্ত দিয়ে যায়নি।

ডাক্তারবাবু বোধ হয় এর মধ্যেই মাধবীলতাকে চিনতে পেরেছিলেন। তার দিকে তাকিয়ে বেজার মুখে বললেন, প্রথম কল তো শুধু-হাতে হয় না।

মাধবীলতা ঠোঁট কামড়াল। তারপর বলল, এদের অবস্থা তো দেখতে পাচ্ছেন। আপনি এখন যান, পরে আপনার সঙ্গে দেখা করব।

আজকের মধ্যেই টাকাটা পাঠিয়ে দেবেন। এই জন্যেই ভোরবেলায় বস্তিতে আসি না।’ গজর গজর করতে করতে ডাক্তার চলে গেলেন। একটু পরেই বস্তির চার-পাঁচটি ছেলে এসে অনুর মাকে তুলে নিয়ে গেল বাইরে। মাধবীলতা দেখল একটা প্রাইভেট কার এ করে অনুর মাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল ওরা। অনুপমাও সঙ্গে গিয়েছে। বিস্মিত গলায় পাশে দাঁড়ানো একটা মেয়েকে মাধবীলতা জিজ্ঞেস করল, গাড়িটা কার?

মেয়েটি ঠোঁট ওল্টালো, জানি না। বিনু গাড়িটাকে ধুতে এনেছিল। বিনুর বাবুর গাড়ি বোধ হয়।

মাধবীলতার খেয়াল হল ঈশ্বরপুকুর লেনের তিন নম্বরের সামনে রোজ অনেক প্রাইভেট কার এবং ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকে। তিন নম্বরের অনেকেই ড্রাইভিং জানে।

ঘরে ফিরতে ফিরতে সে দেখল অনুদের দরজা হাট করে খোলা। বাচ্চা দুটো এখন গলির মুখে। কি মনে করে দরজাটা বন্ধ করে দিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। মোক্ষবুড়ি পাশ ফিরে শুয়ে রয়েছে। হাতের ওপর মাথা রেখে। বুড়ির শুকনো গালের চামড়া ভিজিয়ে জল পড়েছে মাটিতে। ওর পায়ের শব্দ পেয়ে সেই অবস্থায় জিজ্ঞেস করল বুড়ি, কে এল?

আমি, মাধবীলতা।

অ, মাস্টারনি! শোন, অনুর মা আর ফিরবে না।

চমকে উঠল মাধবীলতা। অদ্ভুত সিরসিরে, মধ্যাহ্নের তপ্ত হাওয়ার মত শোনাচ্ছে বুড়ির গলা। সে রেগে গিয়ে বলল, ছিঃ, একি বলছেন।

ঠিক বলছি লা। এটাকেও আমি খেলাম। এত নোলা আমায় কেন দিলে ভগবান! এত খেয়েও কেন পেট ভরে না! পাথরের শায়িত মূর্তির মুখ থেকে যেন ছিটকে আসছিল শব্দগুলো। দ্রুত নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল মাধবীলতা। শব্দ করে দরজা বন্ধ করে হাঁপাতে লাগল দাঁড়িয়ে। বালিসে হেলান দিয়ে আধা-বসা অনিমেষ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে তোমার?

অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালো মাধবীলতা। কানের ভেতর শব্দের গরম হলকা রয়ে গেছে এখনও। ঠিক যেন মৃত্যু টেনে টেনে তোলা, গভীর কুয়োয় ডোবা বালতির মতন। একটা বড় নিঃশ্বাস বুক উজাড় করে দিল সে। তারপর মাথা নাড়ল, সামনের ঘরের বউটাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল।

কেন?

ঝগড়া করতে করতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। তারপর দ্রুত আয়নার সামনে এসে চুলে চিরুনি বুলিয়ে নিল।

অনিমেষ বলল, বেঁচে যাবে তো?

মাধবীলতা আলনা থেকে ব্যাগ ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, জানি না। এসব আমি আর সহ্য করতে পারি না। বড্ড দেরি হয়ে গেছে। রোজ রোজ লেট হলে আর চাকরি থাকবে না। তোমার চা করে দিতে পারছি না। খোকাকে বল, নিমুর দোকান থেকে যেন এনে দেয়।

তুমিও তো খেলে না!

স্কুলে গিয়ে খাব। নবাবটাকে ডেকে তোল। এত বড় ছেলের ঘুমুবার সময় কোন হুঁস থাকে। আমি চললাম। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে মাধবীলতা বেরিয়ে গেল।

অনিমেষ বন্ধ দরজাটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তারপর ধীরে নিজের পা দুটো প্রসারিত করার চেষ্টা করল। ডান পা কোনদিনই সোজা হবে না। শুকিয়ে লিকলিকে হয়ে গেছে সেটা। অনেক চেষ্টার পর বাঁ পায়ে সামান্য জোর এসেছে। বাঁ পা-টাকে আস্তে আস্তে ভাঁজ করার চেষ্টা করল সে। কিন্তু অর্ধেক আসার পরই চিনচিনে ব্যথাটা শুরু হল। নিঃশ্বাস ফেলল অনিমেষ। এখন এটাকে বেশী নাড়াচাড়া করতে ভয় লাগে।

বিছানার পাশে রাখা ক্রাচটাকে টেনে নিল সে। ডান বগলের নিচে সেটাকে রেখে শরীর বেঁকিয়ে খাট থেকে ধীরে ধীরে নামল। কাল রাত্রে বেশ গরম গিয়েছে। ঘামে গেঞ্জি চিটচিট করছে। পরনের খুলে আসা লুঙ্গির গিটটাকে শক্ত করল সে। তারপর একটু একটু করে উঠে দাঁড়াল। সারাদিনের প্রথমবার এই ওঠা বড় কষ্টকর। কিছুক্ষণ সময় লাগে সামলে নিতে। তবু ভাগ্য বলতে হবে, একেবারে নুলো হয়ে পড়ে থাকতে হচ্ছে না। মাধবীলতা যখন তাকে জেল থেকে এনেছিল তখন তো এটুকু শক্তিও ছিল না। মানুষের কোলে চেপে আসতে হয়েছে তাকে।

ঠুক টুক করে বাইরে এল অনিমেষ। এখনও রোদ ওঠেনি। আকাশে বেশ মেঘ আছে। অনিমেষ মনে করতে পারল না মাধবীলতা ছাতা নিয়ে গিয়েছে কিনা। সামনের ঘরের দরজা বন্ধ। এই বস্তির অধিকাংশ মানুষের সঙ্গে মাধবীলতার আলাপ নেই কিন্তু খোকার আছে। সে রয়েছে মাঝখানে, যেচে কেউ কথা বললে সে উত্তর দেয়। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র পাঁচ ঘণ্টা এখানে শান্তি থাকে, শব্দ বাজে না। এখানে পড়ে থাকা ছাড়া অনিমেষের কোন উপায় নেই। স্কুলের চাকরিতে মাইনে ঠিকমতন পাওয়া যায় না। তার ওপর ডাক্তার দেখাতে দেখাতে প্রচুর ধারের বোঝা চেপেছে মাথায়। অনিমেষের মনে হয় সে বোঝা এ-জীবনে নামবে না।

টিউবওয়েলের সামনে এখন বিরাট লাইন। অনর্গল চেঁচামেচি হচ্ছে। মুখ ধোয়া দরকার কিন্তু সুযোগ পাবে বলে মনে হচ্ছে না। ওপাশে একটা গঙ্গাজলের কল আছে। সি এম ডি এ থেকে পাকা পায়খানা করে দিয়ে গেছে তার পাশে। কয়েক পা এগিয়ে অনিমেষ দেখল সেখানেও বেশ ভিড়। হয় খুব ভোরে নয় বেশ বেলায় এসব চেষ্টা না করলে বিপদে পড়তে হয়।

জল দরকার?

অনিমেষ দেখল অবিনাশ হাতে বালতি নিয়ে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সামনের উনুনের কারখানাটা অবিনাশের। ঘর থেকে বেরিয়ে ওইখানে রোজ সে কিছুক্ষণ বসে। ঘাড় নাড়ল অনিমেষ, হ্যাঁ, মুখ, ধোব।

তা নিয়ে নিন। বাঁ হাতের মগটা বালতিতে ডুবিয়ে অবিনাশ বাড়িয়ে ধরল। তাড়াতাড়ি তাই দিয়ে মুখ ধুয়ে অনিমেষ বলল, বাঁচালেন।

কে কাকে বাঁচায়। অবিনাশ কারখানার দিকে চলে গেল।

অনিমেষ ঘরে ফিরে এসে খাটের ওপর বসল কিছুক্ষণ। এইবার ছেলেটার ঘুম ভাঙানো দরকার। ঘরের একপাশে মাদুরের ওপর চিৎ হয়ে পড়ে আছে ছেলেটা। মাধবীলতা ঠিকই বলেছে, শোওয়া বড্ড খারাপ। অনিমেষ ডাকল, খোকা, খোকা ওঠ।

ওপাশ থেকে কোন সাড়া এল না। অনিমেষ মাটিতে বসে দুহাতে ভর দিয়ে ছেলের কাছে এগিয়ে গিয়ে গায়ে হাত রেখে বলল, এই খোকা, এবার ওঠ। বেলা হয়ে গেছে!

পনের বছরের মুখটা বিরক্তিতে ভাঙচুর হল। উপুড় হয়ে শুতে শুতে বলল, ফোট তো, ন্যাকড়াবাজি করো না।

০২. ঠাস ঠাস করে ঘুমন্ত ছেলের গালে

ঠাস ঠাস করে ঘুমন্ত ছেলের গালে চড় মারল অনিমেষ। কথাটা কানে ঢোকা মাত্রই মাথা ঝিমঝিমিয়ে উঠেছিল, বুকের ভেতর দম আটকানো ভাব এবং সমস্ত শক্তি জড়ো হয়েছিল হাতের কবজিতে। অনিমেষের খেয়াল ছিল না তার হাঁটুর নিচে দুটো অকেজো পা, সে টলছিল রাগে এবং ঘেন্নায়।

আচমকা আঘাত খেয়ে ধড়মড়িয়ে উঠল অর্ক। বিস্ময় এবং ক্রোধ একই সঙ্গে তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছিল। তারপরই একটু ভয়ের ছায়া পড়ল সেখানে, গালে হাত রেখে পাথরের মত বসে রইল সে। প্রচণ্ড জ্বলুনি শুরু হয়েছে গালে। অনিমেষ চাপা গলায় বলল, বল, আবার বল কথাটা।

অর্ক আধাভাঙ্গা স্বরে বলল, কি কথা?

যে কথাটা একটু আগে বলেছিস!

এইবার হকচকিয়ে গেল অর্ক। ঠিক কি কথাটা মুখ থেকে বেরিয়েছে সে মনে করতে পারছিল না। আঙ সাঙ কিছু বলে ফেলেছে নাকি! নিশ্চয়ই, তা নইলে বাবা তাকে মারতে যাবে কেন? একটু ধাক্কা দিলেই তো চিৎপটাং হবে কিন্তু তবু বাবাকে এখন আমজাদের মতন দেখাচ্ছে। সে খুব নিরীহ গলায় বলল, মাইরি বলছি, কি বলেছি মনে পড়ছে না।

অনিমেষের চোখে যে ক্রোধের ফণাটা উঁচিয়ে উঠেছিল তা বিস্ময়ে মাথা নোয়ালো। ছেলে কথাটা বলেছে ঘুমের ঘোরে, জেগে উঠে মনে না পড়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু ওই ভঙ্গীতে বিশেষ শব্দগুলো ব্যবহার করার অভ্যেস না থাকলে অত স্বচ্ছন্দে ঘুমের মধ্যেও বলতে পারত না। অথচ সে ছেলের মুখে কোনদিন এইরকম কথাবার্তা শোনেনি। তার মানে ও যখন বাইরে থাকে তখন অনর্গল এইসব কথাবার্তা বলে, ঘরে ফিরলেই সচেতন হয়। ওদের সঙ্গে যখন কথা বলে তখন নিশ্চয়ই বানিয়ে বানিয়ে বলে!

ছেলের মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল সে। ওর খুব কষ্ট হচ্ছিল। ধীরে ধীরে সরে এল খাটের কাছে। পায়া ধরে উঠে বসল ওপরে। তারপর চোখ বন্ধ করল। অর্ক মাদুরের ওপর বসে বাবাকে দেখল। তারপর সেখান থেকেই জিজ্ঞাসা করল, আমি কি খিস্তি করেছি?

অনিমেষ দাঁতে দাঁত চাপল। সে নিজে কি কখনও বাবার সামনে দাঁড়িয়ে খিস্তি শব্দটা উচ্চারণ করতে পারত? অথচ এই ঘরে বসে অনর্গল যখন সারাদিন ধরে অশ্লীল গালাগালি শুনে যেতে হচ্ছে ছেলে বউ-এর সামনেই তখন খিস্তি কথাটার ধারটাই ভোঁতা এবং নিরীহ হয়ে গেছে। অনিমেষের মনে পড়ল ছেলেবেলায় জলপাইগুড়িতে ওরা বড়দের সামনে শালা শব্দটা বলা মহাপাপ বলে মনে করত। পরে সেটাই কথার মাত্রা হয়ে দাঁড়াল। বাক্যকে জোরদার করতে শালা স্বাভাবিক হিসেবে ব্যবহৃত হতে লাগল। এখন এই বস্তিতে বসে শালার বিকল্প হিসেবে আর একটি দু-অক্ষরের শব্দ শুনছে। অবলীলাক্রমে ছেলেরা এখন পুরুষাঙ্গের চলতি নামটিকে একটু ভেঙে শালার প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করছে চেঁচিয়ে। কোন অপরাধবোধ নেই। অর্কও তাই করে কিনা কে জানে!

অর্ক তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সে ঘাড় নাড়ল, না।

তাহলে হাত চালালে কেন?

যা বলেছিস তা আমি মরে গেলেও বলতে পারতাম না। কারণ

কিন্তু কথাটা কি? ঘাড় শক্ত হচ্ছিল অর্কর।

ন্যাকড়াবাজি মানে কি?

অর্ক যেন বিস্মিত হল। তারপর ওর হালকা গোঁফের তলায় হাসি খেলে গেল, যা বাব্বা, ন্যাকড়াবাজি খারাপ কথা নাকি! ন্যাকড়াবাজি মানে বিলা করা।

‘বিলা?

ওফ বিলা–বিলা হল। অর্ক মানেটা হাতড়াচ্ছিল।

ঠিক আছে। অনিমেষ তাকে থামিয়ে দিল, আমি আর শুনতে চাই না।

মা চলে গেছে? অর্ক হঠাৎ সজাগ হল।

হ্যাঁ।

মা শুনেছে?

না।

তুমি মাকে এসব কথা বলো না।

কেন? তুই তো খারাপ কথা বলিসনি বলছিস।

তা হোক, মা বুঝতেই চাইবে না। বলবে না তো?

অনিমেষ উত্তর দিল না। বিছানার ওপর উঠে এসে বালিশটা ঠিক করতে লাগল। তারপর তোশকের তলা থেকে একটা টাকা বের করে সামনে রাখল, নিমুর দোকান থেকে চা নিয়ে আয়।

কেন? মা চা করে যায়নি?

না।

কেন?

সে তোর জেনে কি হবে? যা বলছি তাই কর!

অর্ক উঠে দাঁড়াল। মাথায় এখন ও অনিমেষের সমান। শুধু ডাল ভাত খেয়ে ছেলেটার স্বাস্থ্য বেশ চমৎকার হয়েছে। অনিমেষের নিজের কখনও অমন মাসল ছিল না। দেখে বোঝা যায় না ওর বয়স এখনও পনের হয়নি।

গামছা টেনে নিয়ে ঘর ছেড়ে যাওয়ার সময় অর্ক জিজ্ঞাসা করল, দ্যাখো তো, গালে দাগ হয়ে গেছে কিনা?

অনিমেষ তাকাল, তারপর মাথা নাড়ল।

হেভি জ্বলছে।

একটু বাদেই অর্ক মুখ ধুয়ে এসে কেটলি আর টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেল। এত দ্রুত এই ভিড়ের মধ্যে জল পায় কি করে কে জানে! অনিমেষ বাবু হয়ে বসল। আজ সকালটাই বিশ্রী হয়ে গেল। না, তবু কিছু হল, অন্যদিন তো কিছুই হয় না। সে ঘরের মেঝের দিকে তাকাল। অর্ক মাদুরটা তোলেনি, চিটচিটে বালিশটা চেপ্টে রয়েছে। খাটের এপাশের মেঝেতে মাধবীলতা শোয়। সেই জায়গাটা পরিষ্কার। অনিমেষ ঠিক করল মাধবীলতাকে বলবে ঘটনাটা। ছেলেটা পাল্টে যাচ্ছে, খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। এখনই যদি কিছু না করা যায় তাহলে আর সামলানো যাবে না। এই বস্তির বেশীর ভাগ ছেলেই ক্লাস ফোরের পরই পড়াশুনা ছেড়ে দেয়। অর্ক যাদের সঙ্গে মেশে তারা কেউ স্কুলে যায় না। ফুটপাথে বসে তাস খেলে, কেউ কেউ মদ খাওয়া ধরেছে। এদের সঙ্গে অর্ককে মিশতে বারণ করেও সক্ষম হয়নি অনিমেষ। মাধবীলতাও হার মেনেছে।

একবার প্রমোশন হয়নি অর্কর। এবং এ খবরটা বেশ চেপে গিয়েছিল সে। মাধবীলতা জানতে পেরে ক্ষেপে আগুন হয়ে গিয়েছিল। অতবড় ছেলেকে বেধড়ক মেরেছিল সেদিন। কিন্তু সবই প্রায় নিঃশব্দে। ঘরের কথা বাইরের লোককে জানতে দিতে চায় না মাধবীলতা। তারপর ছেলেটা একটু পাল্টেছিল। নিয়ম করে বই নিয়ে বসত, প্রয়োজন হলে অনিমেষকে জিজ্ঞাসা করত। কিন্তু আবার যে কে সেই। অনিমেষ লক্ষ্য করেছে সেই ঘটনার পর থেকেই মাধবীলতা ছেলের ব্যাপারে কেমন গুটিয়ে যাচ্ছে। বাধ্য না হলে সে অর্কর সঙ্গে কথা বলে না। টিউশুনি সেরে মাধবীলতা বাড়ি ফেরে রাত সাড়ে নটায়। এইসময় ঘরে থাকার কথা অর্কর। কিন্তু একটা না একটা ছুতোয় ঠিক বেরিয়ে যায় ও। কাঁহাতক রোজ রোজ মাধবীলতার কাছে নালিশ করা যায়। কিন্তু আজ বলা উচিত। কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিল না অনিমেষ।

চা নিয়ে ঘরে ঢুকল অর্ক, অনুর মা-টা মনে হয় টেঁসে যাবে!

অনুর মা? টেঁসে যাওয়া শব্দটা কানে কটু করে বাজল। আর বোধহয় সাজানো কথা বলছে না অর্ক।

তুমি মাইরি কাউকেই চেন না। আমাদের উল্টোদিকের ঘর। তুমি সারাদিন কান বন্ধ করে থাক নাকি? কাপে চা ঢেলে এগিয়ে দিল অর্ক, তারপর কৌটো থেকে দুটো থিন এরারুট বিস্কুট।

অনিমেষের মনে পড়ল যাওয়ার আগে মাধবীলতাও এরকম খবর দিয়েছিল। কিন্তু ঘরের দরজা বন্ধ করে হাঁফাচ্ছিল মাধবীলতা, কেন? মৃত্যু অবধারিত জেনে?

চায়ে চুমুক দিতে দিতে অর্ক বলল, আজ স্কুলে যাওয়া হল না!

কেন? ভ্রূ কুঁচকালো অনিমেষ।

সবাই হাসপাতালে যাচ্ছে, রক্তফক্ত দিতে হতে পারে!

তুই যাচ্ছিস?

বাঃ যাবো না! প্রেস্টিজ থাকবে পাড়ায়? অর্ক যেন খুব অবাক হয়েছে অনিমেষের কথায়। কাপটা মাটিতে রেখে আলনা থেকে রঙিন শার্টটা টেনে নিয়ে গায়ে চড়াল। তারপর হাফপ্যান্টের বোতামে হাত দিতেই অনিমেষ মুখ ফেরালো। এতবড় ছেলের কোন লজ্জাবোধ নেই। পেছন ফিরে স্বচ্ছন্দে প্যান্ট পাল্টায়। কেমন পশুর মত ব্যাপার।

আমি যাচ্ছি। চল্লিশটা পয়সা আমার কাছে থাকল। অর্ক বেরিয়ে গেল। চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে থমকে গেল অনিমেষ। ওকে পুরো টাকাটা দেওয়া উচিত হয়নি। কক্ষনো বাকি পয়সা ফেরত দেয় না।

একটু একটু করে নয়, হঠাৎই ছেলেটা পাল্টে গেল। অথচ আটবছর আগে প্রথম দিন যখন ওকে দেখেছিল তখন এক তাল নরম মাটি ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি। এক তাল মাটি যা দিয়ে ইচ্ছে মতন মূর্তি গড়া যায়। তিল তিল করে মাধবীলতা ওকে নিজের মনের মত গড়ে তুলে তার হাতে ছেড়ে দিয়েছিল। প্রথম দিনেই চমৎকার ভাব হয়ে গিয়েছিল ওদের। যেন জন্মাবার পর সাতটি বছর ছেলে অপেক্ষা করেছিল তাকে দেখবার জন্যে। বলেছিল, পুলিসদের আমি বড় হলে মারব, তুমি ভেবো না।

অনিমেষের মজা লেগেছিল, কেন?

ওরা তোমার পা ভেঙে দিয়েছে, তোমাকে এতদিন আটকে রেখেছিল। আমি ওদের কিছুতেই ছাড়ব না। সেই কচি গলাটা এখনও কানে বাজে। এই অন্ধঘরে বাঁচার একমাত্র আনন্দ ছিল অর্ক। মাধবীলতা যেন একটা সূর্যকেই তার কোলে তুলে দিয়েছিল। কখন যে সেই সূর্যে গ্রহণের নোংরা ছায়া লাগল কে জানে! তার দুটো পা সারিয়ে তুলতে মাধবীলতা নিঃশেষ হয়ে গেল। পাগলের মত এ ডাক্তার সে ডাক্তার করেছে, অকাতরে পয়সা ঢেলেছে ধার করে। এখন কেমন শক্ত হয়ে গেছে ও, চট করে মনের কথা বলার মনটাই মরে গেছে। আর সেই ফাঁকে বদলে গেল অর্ক। অনিমেষ মাথা নাড়ল, সে-ই দায়ী। কাদার তালটা যে বাইরের আঁচে শক্ত হয়ে ঢেলা পাকিয়ে যাচ্ছে টের পায়নি সে। এখন মূর্তিগড়া হল না বলে আফসোস করে কি হবে। ফোটো তো, ন্যাকড়াবাজি করো না! স্বরটা মনে পড়তেই হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল অনিমেষ। একা, ঘরে বসে।

টিফিনের ঘন্টা যেন কানে মধু ঢেলে দিল। খাতাপত্র গুটিয়ে মাধবীলতা উঠে দাঁড়াল। আজ থার্ড পিরিয়ডের পর থেকেই মাথাটা ঘুরছে। পড়াতে মোটেই ইচ্ছে করছিল না। মেয়েদের পুরোনো পড়া লিখতে দিয়ে চুপচাপ বসেছিল। আজও যথারীতি দেরি হয়েছে স্কুলে আসতে। সকাল থেকে এক কাপ চা পর্যন্ত পেটে পড়েনি। ক্লাসকাপ্টেনকে বলে এল খাতাগুলো সংগ্রহ করে টিচার্সরুমে পৌঁছে দিতে। ঝিমুনি লাগছিল ওর, বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখল হেডমিসট্রেসের বেয়ারা সুদীপ তার দিকে এগিয়ে আসছে, দিদি, আপনাকে ডাকছেন বড়দি।

মাথা ঝাঁকালো মাধবীলতা। তারপর একটু এগিয়ে হেডমিসট্রেসের ঘরে ঢুকল। সৌদামিনী সেনগুপ্তার কে নামকরণ করেছিলেন তা নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা হয়েছে। ওরকম বিশাল শরীর আর স্ফীত মুখের দিকে তাকালে নামটা কিছুতেই মনে পড়ে না। এই স্কুলটাকে গড়ে তোলার পেছনে ভদ্রমহিলার অবদান প্রশ্নাতীত। কিন্তু সেটাই হয়েছে কাল, স্কুলটাকে তিনি নিজস্ব সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছেন। বিয়ে করার সময় পর্যন্ত নাকি পাননি।

বসবার অনুরোধের জন্যে অপেক্ষা করল না মাধবীলতা, ডেকেছেন?

মুখ তুলে ঠোঁটটাকে ছুঁচোর মত করে চশমার ফাঁক দিয়ে কিছুক্ষণ দেখে সৌদামিনী বললেন, অসুবিধেটা কি হচ্ছে?

মানে?

এখন তো আর মাইনেপত্র তিনচারমাস বাকি থাকে না। মাসের মাইনে মাসেই পেয়ে যাচ্ছ।

তাহলে? মাধবীলতার মনে পড়ল ওদের সবচেয়ে জুনিয়ার টিচার নীপা ঠাট্টা করে বলে, বড়দি দাঁড়কাকের গলা ছিনতাই করেছেন।

কি বলছেন বুঝতে পারছি না।

বোঝা উচিত ছিল। তুমি আজও পনের মিনিট লেট!

পাশের বাড়িতে একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল।

অজুহাত খুঁজে পেতে তোমাদের কষ্ট হয় না। তোমাকে আমি অনেকবার বলেছি এ জিনিস বেশীদিন চলতে পারে না। সিনিয়র টিচাররা এরকম করলে জুনিয়াররা তো সাপের পাঁচ পা দেখবে। তাছাড়া পড়ানোর ব্যাপারেও তুমি খুব কেয়ারলেস হচ্ছ!

আমি?

ইয়েস। ড্রয়ার থেকে একটা খাতা বের করে সামনে ধরলেন সৌদামিনী, এই মেয়েটিকে তুমি একশ তে পঞ্চাশ দিয়েছ। অথচ ওর পাওয়া উচিত চল্লিশ। গার্জেন এসে কমপ্লেন করে গেছে তুমি মেয়েটির ভুল ডিটেক্ট করোনি। স্কুলের বদনাম হয়ে যাচ্ছে! মাধবীলতা খাতাটা টেনে নিয়ে দেখল, বেশ কয়েকটা বানান ভুল নজরে এল। অত খাতা একসঙ্গে দেখতে গেলে কিছু কিছু গোলমাল হয়েই যায়। কিন্তু এ বিষয়ে সে নিজে খুব সজাগ। তাহলে এটা হল কি করে?

সৌদামিনী বললেন, আমি এখনই কমিটির কানে কথাটা তুলতে চাই না। আমাকে যেন দ্বিতীয়বার না বলতে হয়। যাও।

মাধবীলতা উঠে দরজার দিকে যেতেই সৌদামিনী বললেন, তোমার শরীর কি অসুস্থ? মুখ চোখ ওরকম কেন?

না, কই কিছু হয়নি তো!

খাওয়া দাওয়া করছ!

হ্যাঁ।

স্বামী কি করছে?

ওই আর কি, আছেন।

সৌদামিনী মাথা নাড়লেন, কতকাল আর স্যাক্রিফাইস করবে? ওই ব্যাটাছেলে জাতটার জন্যে নিজেকে শেষ করাটা গাধামি। নচ্ছার জাত একটা। শরীরের যত্ন নিও। ওইটেই আসল। টিচার্স রুমে এসে ধপ করে চেয়ারে বসল মাধবীলতা। খাতাপত্র টেবিলে রেখে শরীর এলিয়ে চোখ বন্ধ করল। উল্টো দিকে বসেছিল নীপা, জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে লতাদি?

চোখ বন্ধ করেই মাথা নাড়ল সে, কিছু না।

তোমাকে খুব সাদা দেখাচ্ছে!

বুড়ো বয়সে ফরসা হচ্ছি বোধহয়।

কি যে ঠাট্টা কর! একবার ডাক্তার দেখাও।

ওমা কেন? মাধবীলতা চোখ খুলে হেসে ফেলল।

তোমার ওপর দুজন নির্ভর করে আছে। একটা কিছু হয়ে গেলে!

দূর! আমাকে যমেও ছোঁবে না। চা দিয়েছে?

দিচ্ছে! কি ব্যাপার? এরকম কথা কখনো বল না তুমি! আজ কিছু হয়েছে মনে হচ্ছে ঝগড়া করেছ?

ঝগড়া আবার কার সঙ্গে করব। এই জানিস, আমাদের পাশের ঘরের একটা বউ সেরেফ ঝগড়া করে অজ্ঞান হয়ে হাসপাতালে চলে গেল। বউটার শরীরে এক ফোঁটা মাংস নেই। আর একটা থুথুরে বুড়ি বলল, ওকে আমি খেলাম। শিউরে উঠল মাধবীলতা কথাগুলো বলতে বলতে। নিচের ঠোঁট দাঁতে চাপল সে।

নীপা ঝাঁঝিয়ে উঠল, ওই জায়গাটা তুমি ছাড়ো তো! আমাদের পাড়ায় একটা ফ্ল্যাট এখনও খালি আছে। তুমি নেবে?

কে টাকা দেবে?

বেশী ভাড়া না। তিনশ। দেড়খানা ঘর, সব সেপারেট। আমার বাবার বন্ধু। সেলামি নেবে না, তিনমাসের ভাড়া অ্যাডভান্স।

মাধবীলতা ক্লান্ত চোখে তাকাল। ও কত মাইনে হাতে পায় তা নীপা জানে কিন্তু কত টাকা বাড়িতে নিয়ে যায় সে খবর জানলে এই প্রস্তাব দিত না। নীপা তাকিয়ে আছে দেখে বলল, দুবছর পরে যদি বাড়িটা খালি থাকে তাহলে বলিস।

নীপা একটু আহত হল। তারপর নিঃশ্বাস ফেলে বলল, যাই বলো, তুমি বস্তিতে থাকবে এটা একদম মানায় না।

মাধবীলতা হাসল, আমাকে কিসে মানায় রে?

নীপা বোধহয় রেগে গেল, জানি না। তারপর চেঁচিয়ে বলল, সুধাদি, চা দিয়ে যাও, জলদি।

লম্বা টিচার্স রুম এখন ভরা। দু’তিনটে দলে সবাই গল্প করছে। একটা অলিখিত শ্রেণীভেদ আছে এখানে। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মাধবীলতা ভাবল বিস্কুট চাইবে কিনা! এখন দুটো বিস্কুট চল্লিশ পয়সা। না, থাক। শুকনো জিভে চা বেশ আরাম দিল। ঠিক তখুনি দরজায় সুপ্রিয়া কর দেখা দিল। এই স্কুলে মেয়েদের যেমন য়ুনিফর্ম আছে টিচারদেরও সাদা শাড়ি পরে আসতে হয়। সুপ্রিয়া করকেও মানতে হচ্ছে নিয়মটা, কিন্তু তার সাদা শাড়িতে যা জেল্লা বের হয় তাতে চোখ ধাঁধিয়ে যায় সবার। সুপ্রিয়ার চাকরি করতে আসা শখের, সময় কাটানোর জন্যে। স্বামী বিরাট চাকরি করেন, কোলকাতায় দুটো প্রকাণ্ড বাড়ি। এক ছেলে দার্জিলিং-এ পড়ে। গাড়ি ছাড়া এক পা হাঁটে না সুপ্রিয়া। ওকে দেখেই মুখ নামালো মাধবীলতা। সে নিজেও জানে এটা এক ধরনের কমপ্লেক্স কিন্তু কিছুতেই কাটাতে পারে না। বিনা সুদে তাকে আট হাজার টাকা ধার দিয়েছিল সুপ্রিয়া। কোনদিন তাগাদা করেনি, কাউকে জানায়নি, এমনকি ব্যবহারেও প্রকাশ করেনি। তবু ওকে দেখলেই অস্বস্তি হয় মাধবীলতার। অনিমেষের পায়ের জন্যে নেওয়া টাকাটা জলের মত খরচ হয়ে গেল। একদম উপকার হয়নি বলা যায় না। এক পায়ে কোনরকমে উঠে দাঁড়িয়েছে শেষপর্যন্ত। অনেকদিন শোধ করতে পারেনি কিছু। এখন প্রতি মাসে চারশো করে দিচ্ছে। তিনশো টাকায় সংসার চালাতে হয়। প্রভিডেণ্ড ফাণ্ড কো-অপারেটিভ থেকে কাটাকুটির পর ওই অঙ্কটাই হাতে থাকে। অবশ্য সুপ্রিয়া কর হাতে হাতে টাকা নেয়নি। বলেছিল, আমি বরং ব্যাঙ্কে একটা অ্যাকাউন্ট খুলছি নতুন করে। তুমি চারশো করে প্রতিমাসে জমা দিও, রেকারিং। মাধবীলতা তাই দেয়।

সুপ্রিয়া কর এসে নীপার পাশে বসতেই সে বলল, নতুন শাড়ি মনে হচ্ছে?

হ্যা গো! জাপানী।

তুমি বেশ আছ সুপ্রিয়াদি। সারা পৃথিবীকে গায়ে চাপাও।

ওইটেই তো শখ। কেন নজর দিচ্ছ! তারপর ব্যাগ খুলে বড় প্যাকেট বের করল সুপ্রিয়া। কাল তোমাদের দাদার জন্যে বানিয়েছিলাম। ও খুব খেতে ভালবাসে তো। খেয়ে দ্যাখো তো কেমন হয়েছে!

এক খণ্ড বড় কেক তুলে দিল সুপ্রিয়া নীপার হাতে। তারপর একটা খণ্ড এগিয়ে ধরল মাধবীলতার দিকে।

মাধবীলতার অস্বস্তি আরও বেড়ে গেল। নিত্যনতুন বাড়ি থেকে খাবার এনে সুপ্রিয়া টিচার্সদের খাওয়ায়। অথচ সে কোনদিন কিছু আনতে পারে না। কেকটা না নেওয়া অত্যন্ত অভদ্রতা হবে। মনে মনে ঠিক করল, টাকাটা শোধ হয়ে গেলে সে একদিন সবাইকে খাওয়াবে। কেকটা হাতে নিতেই খুব সুন্দর গন্ধ নাকে এল। কিসমিস কাজু চোখে পড়ল। মাধবীলতার মনে হল, অনিমেষ কিংবা অর্ক অনেকদিন এসব জিনিস খায়নি। বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠল ওর। টেবিলের তলায় হাতটা আপনা আপনি নেমে গেল। তারপর একটা ছোট্ট টুকরো গালে ফেলে বলল, সুন্দর হয়েছে।

সুপ্রিয়া খুশি হল। নীপা কিছু বলতেই সুপ্রিয়া ওর দিকে ঘুরে বসে কথা বলতে লাগল। মাধবীলতা সর্তকভঙ্গীতে সবার চোখ এড়িয়ে কেকটাকে ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে মুখ নাড়তে লাগল এমন ভঙ্গীতে যেন সে খেয়ে যাচ্ছে। দাঁতের কোণে যে টুকরোটা পড়েছিল তার মিলিয়ে যেতে সময় লাগেনি। কাপের তলানিটা গালে ঢেলে ব্যাগ নিয়ে মাধবীলতা টয়লেটে চলে এসে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর ব্যাগ থেকে কাগজ বের করে কেকটাকে মুড়ে সযত্নে আবার রেখে দিল। মনটা এখন শান্ত হয়ে গেল ওর। বেশ ভাল লাগছে।

.

ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে ঈশ্বরপুকুর লেনে ঢুকল মাধবীলতা। ডাক্তারখানার সামনে আসতেই শক্ত হল শরীর। তারপর ধীরে ধীরে উঠে এল বারান্দায়। ভদ্রলোকের পসার বেশ ভাল। ওকে দেখে আর একজনের পেট টিপতে টিপতে জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার?

আজ সকালে আপনাকে বলেছিলাম! মানে ওদের অবস্থা বুঝতেই পারছেন। আপনি যদি সামনের মাস অবধি অপেক্ষা করেন তাহলে মাইনে পেয়ে আমি না হয় দিয়ে দেব। এক নিঃশ্বাসে বলে গেল মাধবীলতা।

দিতে হবে না। পিলে বড় হয়েছে তোমার। ডাক্তার রোগীকে বললেন।

দিতে হবে না?

না। পেশেন্ট মারা গেলে আমি টাকা নিই না।

চমকে উঠল মাধবীলতা। বউটা মরে গেছে? কোনদিন কথা বলেনি কিন্তু আজ সকালেই তো ওর হৃৎস্পন্দন শুনেছিল সে। মোক্ষবুড়ির কথাই সত্যি হল? টলতে টলতে রাস্তায় নেমে এল সে।

গলির মুখে বেশ ভিড়। সবাই উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যে বউটি মোক্ষবুড়িকে ফোড়ন কেটেছিল তাকে দেখতে পেল মাধবীলতা। চোখাচোখি হতেই বউটি ঘোমটা টেনে বলল, অনুর মা মরে গেছে। এখনই নিয়ে আসবে।

মাধবীলতা মাথা নামাল। তারপর ভারী পায়ে গলির মধ্যে ঢুকল। অনুদের দরজা খোলা। আড়চোখে তাকিয়ে মোক্ষবুড়িকে দেখতে পেল সে। জবুথবু হয়ে বুড়ি বসে আছে দরজায়। তার ঠিক পাশে পাথরের মূর্তির মত বাচ্চাদুটো গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে। ছেঁড়া হাফপ্যান্ট আর খালি গায়ে চোখ তুলে ওরা মাধবীলতাকে দেখল। সরল অবোধ দৃষ্টি। মোক্ষবুড়ি বলল, কে যায়?

মাধবীলতা বলল, আমি।

কে? অ, মাস্টারনি?

হ্যাঁ।

সে এল না আর, শুনেছ?

হ্যাঁ।

বড়ঘরের মেয়ে ছিল লা, মরে বেঁচে গেল।

আমি যাচ্ছি।

দাঁড়াও দাঁড়াও, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। আচ্ছা, হাসপাতালের খাটে আজকাল গদি থাকে তো, নরম গদি, তুমি জানো?

মাধবীলতা আর দাঁড়াল না। প্রায় দৌড়েই সে নিজের ঘরের সামনে পৌঁছে গেল। ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখল অনিমেষ শুয়ে আছে, অর্ক নেই। বোধহয় স্কুলে গেছে। ঘাড় বেঁকিয়ে সে দেখল রান্না হয়নি। মাধবীলতা চাল আলু আর ডিম বের করে রেখেছিল স্টোভের পাশে তেমনি রয়েছে। অনিমেষ আজকাল সকালে ওগুলো ফুটিয়ে রাখে।

খাটের পাশে দাঁড়িয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, রাঁধো নি??

মাথা নাড়ল অনিমেষ, না।

খোকা খেয়ে যায়নি স্কুলে?

স্কুলে যায়নি। হাসপাতালে গেছে।

চট করে মেজাজটা গরম হয়ে যাচ্ছিল মাধবীলতার, অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালো, তুমি কেন যেতে দিলে?

অনিমেষ স্ত্রীর দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল।

কিছু খেয়েছ?

চা।

আর কিছু?

না।

তোমার জন্যে একটা জিনিস এনেছি।

কি?

কেক। খুব ভাল। অর্ধেকটা তুমি খাও, আর ওর জন্যে রেখে দাও।

অনিমেষ উঠে বসল, আমার শরীর খারাপ, খাব না।

কি হয়েছে?

পেট গোলমাল করছে।

মাধবীলতা স্বামীর মুখের দিকে তাকাল, পেট গোলমাল করলে কি চোখ দিয়ে জল পড়ে?

মানে?

চোখের কোণে জলের দাগ শুকিয়ে আছে।

আমি বলছি খাব না, ব্যাস। অনিমেষ সকালের ক্রোধটাকে টেনে তুলল, তুমি খাও আর তোমার ছেলেকে দাও।

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, তুমি এমন করো না, আমি তো আর কিছু চাই না, শুধু তুমি একটু বোঝ আমাকে।

তারপর ধীরে ধীরে কেকটাকে নিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে। অনুদের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মোক্ষবুড়ি বলল, কে যায়?

মাধবীলতা দেখল বাচ্চাদুটো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, কিছু খেয়েছিস?

দুটো বাচ্চা পুতুলের মত মাথা নাড়ল, না।

মোক্ষবুড়ি বলল, অ তুমি! তা কে খেতে দেবে বল ওদের?

এই নে খা। কেকটাকে দুটো ভাগ করে বাচ্চাদুটোর হাতে তুলে দিতেই তারা চকচকে চোখে সেটাকে দেখেই মুখে পুরল।

মোক্ষবুড়ি জিজ্ঞাসা করল, কি দিচ্ছ লা?

কেক।

কেক! ওমা, ওতে তো ডিম আছে। অশুচের সময় ডিম খেতে নেই। ফেলে দে, ফেলে দে মুখ থেকে। হাত বাড়িয়ে বাচ্চাদুটোর মুখ ধরতে চাইল বুড়ি। মাধবীলতা স্তব্ধ হয়ে দেখল, বাচ্চাদুটো দ্রুত গিলে ফেলছে কেক দুটো, যত দ্রুত সম্ভব। ব্যর্থ মোক্ষবুড়ি মাথা চাপড়াতে লাগল, এখনও মা পোড়েনি তোদের, ডিম খেয়ে নিলি? রাক্ষস, সব রাক্ষস!

০৩. বেলা দুটো নাগাদ ঈশ্বরপুকুর লেন

বেলা দুটো নাগাদ ঈশ্বরপুকুর লেন চনমনিয়ে উঠল। বস্তির সরু সরু গলিতে ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল। পিলপিল করে স্ত্রীলোক এবং শিশুরা বেরিয়ে আসছে বাইরে। অনুর মাকে যেন শব্দের রথে চাপিয়ে নিয়ে আসছে ছেলেরা। দশ বারোটা কণ্ঠ থেকে ছিটকে উঠছে হরি বোল। ট্রাম রাস্তা থেকে জানান দিতে দিতে আসছে ওরা। সেই ডাকে ঘরে থাকা তিন নম্বরের বাসিন্দাদের পক্ষে অসম্ভব।

খাঁটিয়াটা নামানো হল গলির মুখে। দলটার অনেক পেছনে আসছিল অনুপমা, বোধহয় তাল রাখতে পারছিল না ওদের চলার সঙ্গে। মিনিট খানেক বাদেই ভিড় সরিয়ে মায়ের বুকের ওপর আছড়ে পড়ল, ওমা, মা গো, কেন চলে গেলে গো!

তিন নম্বরের এক বউ বলল, সতী সাবিত্রী ছিল, মরার সময় একটুও কষ্ট পায়নি। আর একজন বলল, অনুর ছোট ভাই দুটোকে নিয়ে এস, শেষবার মাকে দেখে নিক।

অনুপমা কান্না থামাচ্ছিল না। মায়ের শরীরের ওপর বারংবার আছড়ে পড়ছিল সে। হঠাৎ ন্যাড়া চেঁচালো, এই দিদি, তোর বুক দেখা যাচ্ছে!

ন্যাড়া দাঁড়িয়েছিল মায়ের পায়ের পাশে। আলুথালু অনুপমার বুকের আঁচল সরে গিয়েছিল অনেকক্ষণ। ভোর বেলায় অন্তর্বাস পরা ছিল না, সেই অবস্থায় হাসপাতালে ছুটেছিল! এখন চাপাচাপিতে বোতাম ছিঁড়েছে ওপরের, অনেকটা দেখা যাচ্ছে যা কিনা শোকের সময় লোকে খেয়াল করে না। কিন্তু ন্যাড়া দেখতে পেল, লোকগুলো মাকে দেখার নাম করে দিদির বুকের দিকে তাকিয়ে আছে। সে সহ্য করতে পারছিল না। তাই আর একবার চিৎকার করল, এই দিদি!

এবার অনুপমা সম্বিত ফিরে পেয়ে আঁচলটা টানল কিন্তু কান্না থামাল না। এই সময় পেছনে মোক্ষবুড়ির কনকনে গলা বাজল, এই হাভাতের দল, মচ্ছব দেখতে এয়েছে না মড়া দেখছে না। আমাদের ঠাকুর দেখছে, সর সর, আমায় যেতে দে। জমাট ভিড়টাকে যেন ছুরির মত কাটল শব্দগুলো। তার ফাঁক দিয়ে ঘুর ঘুর করে বুড়ি এসে দাঁড়াল খাটের পাশে। বুড়ির লিকলিকে হাত বাচ্চা দুটোকে ধরে রয়েছে। তাদের মাকে শুয়ে থাকতে দেখল তারা। একটা চাদরের ওপর মাথা কাত করে শুয়ে আছে অনুর মা। আর একটা সাদা চাদর তার গলা অবধি টানা। মোক্ষবুড়ি খাটিয়ার পাশে হাঁটু ভেঙ্গে বসল। তারপর হাতড়ে হাতড়ে বউটির চিবুক স্পর্শ করল, যাও বউ মা, যাও। কিন্তু আমার যে যেতে ইচ্ছে করে না! কর্তা গেল, ছেলে গেল, নাতিরা দুবেলা লাথি মারে তবু থাকতে ইচ্ছে করে! কর্তাকে গিয়ে আমার কথা–। বুড়ি বিড়বিড় করছিল। হঠাৎ অনুপমা মাকে ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বুড়ির ওপর, তোমার জন্যে, তোমার জন্যে মা মরেছে। হাতে পায়ে ধরে চা খেয়ে আবার চুকলি কাটতে গিয়েছিলে। মানুষটাকে রাগিয়ে দিয়ে মেরে ফেলল রে!

অনুপমার ভরা স্বাস্থ্যের তলায় পড়ে মোক্ষদা বুড়ি চিঁ চিঁ করছিল। সঙ্গে সঙ্গে হই হই শব্দ উঠল। কয়েকটা হাত দ্রুত টেনে সরিয়ে আনল অনুপমাকে। সে আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে। প্রথমে মনে হয়েছিল মোক্ষবুড়ি উঠবে না। একজন টেনে তুলে বসিয়ে দিতে মোক্ষবুড়ি চেঁচিয়ে উঠল, ওরে তোরা আমায় এই খাটিয়ায় শুইয়ে দে, বউমার সঙ্গে আমিও চলে যাই।

তিন নম্বরের তাবৎ মানুষ কথাটা শুনে হ্যাঁ হ্যাঁ করে হেসে উঠল। শুধু নিমু চা-ওয়ালা চেঁচিয়ে উঠল, তোরা কি রে, একটা জ্বলজ্যান্ত মড়ার সামনে দাঁড়িয়ে হাসছিস।

মোক্ষবুড়ি বলল, ওর মাথায় সিঁদুর দাও সকলে, পুণ্যবতী ছিল লা।

এই সময় একটি কালো প্যান্ট আর লাল গেঞ্জি পরা ছেলে এসে ন্যাড়াকে ডাকল, এই ন্যাড়া শোন!

ন্যাড়া ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখল, কি?

তোর বাপ খবর পেয়েছে?

জানি না। ন্যাড়া মাথা ঝাঁকাল।

নিমু বলল, যাচ্চলে। মা মরল আর বাপকে খবর দিসনি?

ন্যাড়া খিঁচিয়ে উঠল, আমি টাইম পেলাম? সকাল থেকে শালা কিছু খাইনি মাইরি। দিদিটা তো শুধু কেঁদেই যাচ্ছে।

নিমু বলল, ডিউটি থেকে তো আসার সময় হল। ভোর বেলায় যেতে দেখেছিলাম। তোমরা আর একটু অপেক্ষা কর ওর জন্যে।

লাল গেঞ্জি ন্যাড়ার হাত ধরল, এদিকে আয়।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও ন্যাড়া ওর সঙ্গে জটলা থেকে বেরিয়ে এল। রাস্তার উল্টো দিকে শিব মন্দিরের পাশের রকে বসে শুয়ে শরীর এলিয়ে রয়েছে তিন নম্বরের কয়েকজন। ওরা ন্যাড়ার চেয়ে বয়সে ঢের বড়। হাসপাতাল থেকে ডেডবডি এনে জিরোচ্ছে সবাই। ন্যাড়াকে ওদের সামনে নিয়ে গিয়ে লাল গেঞ্জি বলল, নে কি বলবি বল।

খুরকি পা নাচাতে নাচাতে বলল, তোর মায়ের জন্যে শ্মশানে যাচ্ছি, বাড়ির ভাত তো চোট হয়ে গেল। আমাদের খাওয়ানোর জন্যে মাল নিচ্ছিস তো?

মাল? টাকা?

হ্যাঁ রে।

আমার কাছে টাকা নেই।

আর জি কর থেকে বডি কাঁধে বয়ে নিয়ে এসে অর্কর ঘাড় টনটন করছিল। কথাটা শুনে বলল, সে কি রে? টাকা না হলে সৎকার হবে কি করে?

ন্যাড়া বলল, বাপ তো বাজারের টাকাই দিয়ে যায় নি আজ।

খুরকি বলল, তোর দিদির কাছে আছে কি না দ্যাখ!

ন্যাড়া আবার ফিরে গেল ভিড়ের মধ্যে। অনুপমা মায়ের পায়ের ওপর মাথা রেখে পড়েছিল। ন্যাড়া গিয়ে তার পাশে বসল, এই দিদি, তোর কাছে টাকা আছে? মাকে পোড়াতে লাগবে!

নিস্তেজ অনুপমার কানে টাকা শব্দটা প্রবেশ করল। সে ওই অবস্থায় মাথা নাড়ল, না! সেইসময় গুঞ্জন উঠল। ঈশ্বরপুত্র লেনের মুখে অনুর বাবা হরিপদকে দেখা যাচ্ছে। অলস পায়ে যেন ঝিমোতে ঝিমোতে আসছে লোকটা। মাটিতে চোখ রেখে যেন কিছু ভাবতে ভাবতে হাঁটছে। সঙ্গে সঙ্গে তিন নম্বরের বাসিন্দারা চুপ করে গেল। এখনই একটা নাটক অভিনীত হতে যাচ্ছে, পর্দা উঠছে যেন। আর একটু কাছে এসে ভিড়টাকে দেখে হরিপদ থমকে দাঁড়াল। এরকম ভিড় এই রাস্তায়। ব্যাণ্ড পার্টি গেলে হয়, ঠাকুর গেলে হয় আবার বর এলেও। সে বেশী গা না করে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিল কিন্তু নিমু তাকে থামাল, ও হরিপদ। একটু দাঁড়াতে হবে যে!

ভিড়ের জন্যে বোধহয় খাটিয়াটা নজরে পড়েনি হরিপদর, চোখ তুলে জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার? আমি কেন?

নিমু যেন একটু ইতস্তত করল, তোমাকে তো পাওয়া যায় না, বাস নিয়ে ঘুরছ তাই খবরটা দেওয়া হয়নি। তোমার বউ আজ সকালে, মানে ইয়ে, মরে গেছে।

হরিপদ যেন বুঝতেই পারল না কথাটা, মরে গেছে মানে?

নিমু ততক্ষণে ওর কাঁধে হাত রেখেছে, শরীর খারাপ করছিল, ছেলেরা হাসপাতালে নিয়ে গেল। ওই তো, এইমাত্র নিয়ে এসেছে ওরা।

মুহূর্তে জড়ভরত হয়ে গেল মানুষটা। থপথপ পায়ে এগিয়ে গেল দ্বিভক্ত ভিড়ের মধ্যে দিয়ে। অনুপমা মুখ তুলে তার পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাবা গো বলে। হরিপদ শীতল চোখে স্ত্রীকে দেখছিল। এত বছর ধরে যে শরীরটা তাকে সুখ দিয়ে গেছে সেটা নিঃসাড়ে পড়ে আছে খাটিয়ায়। হরিপদর ঠোঁট নড়ল, মরে গেল!

নিমু সঙ্গে ছিল। বলল, হার্টের অসুখ ছিল নাকি?

হরিপদ ঘাড় নাড়ল, জানি না। বাজারের টাকা দিইনি আজ। নিজের সঙ্গেই কথা বলছিল সে। এমনকি পায়ের ওপর আঁকড়ে থাকা মেয়ের অস্তিত্ব যেন টের পাচ্ছিল না।

নিমু বলল, আর ভেবে কি হবে। তবে কিনা তোমার বউ একটুও কষ্ট পায়নি। এরকম যাওয়া খুব ভাগ্য হলে হয়।

পায়ের ওপর পড়ে থাকা মেয়েকে সরিয়ে আরও কয়েকটা পা এগিয়ে গেল হরিপদ। তারপর ধীরে ধীরে স্ত্রীর মুখের সামনে উবু হয়ে বসে পড়ল। তার একটা হাতের ওপর খোঁচা খোঁচা দাড়িময় গাল, একদৃষ্টে সে স্ত্রীর মুখ দেখতে লাগল। বন্ধ চোখের পাতা, ঠোঁট ঈষৎ খোলা-হরিপদর মাথার ভেতরটা হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল।

হই হই করে ছুটে এল সবাই। ধরাধরি করে নিমুর চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে নিয়ে গেল ওরা হরিপদকে। মাথাটা ঝট করে পড়েছিল খাটিয়ার ওপর, ঠিক বউএর মুখের সামনে। সেখানটা কেটে গেছে। অজ্ঞান হরিপদকে নিয়েই এখন সবাই ব্যস্ত। ন্যাড়া সমস্ত ব্যাপারটা দেখল। তারপর ধীরে ধীরে উল্টো ফুটের রকে চলে এল; দিদির কাছেও টাকা নেই।

খুরকি বলল, চল রে, এ শালার মড়া পোড়াতে কে যাবে!

যাকে বলল সে শরীরটা দুমড়ে মুচড়ে বলল, তোর বাপের কাছে পয়সাকড়ি নেই? জিজ্ঞাসা করেছিস?

ন্যাড়া বলল, বাপ বাজারের টাকাই দেয়নি আজ। তার ওপর অজ্ঞান হয়ে আছে এখন।

খুরকি বলল, নক্সা! খেতে দেয় না আর মরে গেলে নক্সা মারায়। আবে কিলা, বডিটাকে হাপিস করতে কত মাল লাগবে রে?

কিলা বলে যাকে সম্বোধন করেছিল সে একমনে মশলা মিশিয়ে কাগজটা পাকাচ্ছিল। বলল, দেড়শ।

খুরকি বলল, ফোট। এত লাগবে কেন?

কিলা বলল, শ্মশান তো চিনিস না? সোনাগাছির চেয়েও হারামি। একটা না একটা ফ্যাকড়া বের করবেই। আমি মাইরি আটানব্বইটা বডি পার করলাম, আমাকে শেখাস না।

বলতে বলতে কিলার সিগারেট পাকানো হয়ে গিয়েছিল। পাশের ছেলেটি অনেকক্ষণ থেকেই দেশলাই বের করে তাক করেছিল, এবার ফস করে আগুন জ্বেলে হাতের আড়ালে ধরল। কিলার সিগারেট ধরতেই একটা কটু গন্ধ বের হল। খুরকি বলল, আমাকে দে।

কিলার কানে কথাটা যাবে না তা সবাই জানে। চোখ বন্ধ করে একটানে অর্ধেকটা কমিয়ে তবে সে সেটাকে হাত বদল করবে! সবাই এখন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে, শুধু অর্ক ন্যাড়াকে দেখছিল। একটা খাটো ময়লা সাদা কাপড়ের হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরে কিলাকে দেখছে। মা মরে যাওয়ার পর এক ফোঁটা কাঁদেনি। ওপাশের জটলাটা একটু একটু করে হালকা হচ্ছে। মড়ার আকর্ষণ বোধহয় বেশীক্ষণ থাকে না। কিন্তু বডিটাকে পোড়ানো দরকার। আজ অবধি কখনও শ্মশানে মড়া নিয়ে যায়নি সে। এরকম চান্স ছাড়া যায় না। অর্ক রক ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, একবার পার্টি অফিসে গেলে হয় না?

খুরকির কপালে ভাঁজ পড়ল, কেন?

অর্ক বলল, সৎকারের টাকার জন্যে?

খুরকি মুখ বেঁকালো, আমি যাব না। সতীশটা এক নম্বরের হারামি। যদি পার্টি না করত অ্যাদ্দিনে ওর পেট টানতাম।

কিলা চোখ খুলল। হাতের সিগারেটটা পাচার করে দিয়ে বলল, চল রে অক্ক! আমি যাব। সতীশের বাপ দেবে টাকা। পার্টির জন্যে জান লড়িয়ে দিয়েছি আর এখন দেবে না বললেই হল!

খুরকি ছাড়া সবাই উঠল। সিগারেটটা এখন খুরকির হাতে। এপাড়ায় সবাই জানে কিছুদিন আগে খুরকির সঙ্গে সতীশের খিচু হয়ে গেছে। ফালতু কেসে তুলে নিয়ে গিয়েছিল বড়বাবু। বেধড়ক পেঁদিয়েছিল লক আপে পুরে। খুরকির মা তখন ছুটেছিল সতীশের কাছে। সতীশ থাকে তিন নম্বরেই, একটু ভেতরের দিকে। সি পি এমের লোকাল সেক্রেটারি। নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক। বিয়ে থা করেনি, কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ আর পাজামা পরে খুব সিরিয়াসলি পার্টি করে। খুরকির মাকে সতীশ নাকি বলেছিল, সমাজবিরোধীদের সঙ্গে পার্টির কোন সম্পর্ক নেই। আপনার ছেলে খুর চালায় তা সবাই জানে। আমি গেলে পার্টির ইমেজ খারাপ হবে। খুরকির মা নাকি খুব কেঁদেছিল কিন্তু সতীশ কথা শোনেনি। বলেছিল, কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশ, সমাজবিরোধীদের প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। তখন খুরকির মা গিয়েছিল নুকু ঘোষের কাছে। একসময়, কংগ্রেসের আমলে নুকু ঘোষ ছিল এপাড়ার সর্বেসর্বা। সি পি এম ক্ষমতায় আসার পর থেকে নুকু ঘোষের দিন গিয়েছে। কিন্তু পাড়ায় ওর জনপ্রিয়তা ছিল সেটা যায়নি। নুকু ঘোষ বলেছিল, কেন? আমার কাছে কেন? কমরেড সতীশ কি বলল?

খুরকির মা ঘটনাটা বলেছিল। শুনে নুকু ঘোষ নাকি খুব হেসেছিল। বলেছিল, কেন, কিলাটা সমাজবিরোধী নয়? গাঁজা খায়, সিনেমায় টিকিট ব্ল্যাক করে। তা ওকে যখন ধরে তখন সতীশ ছাড়াতে যায় কেন? খুরকির ওপর সতীশের নিশ্চয়ই কোন কারণে খার আছে। কিন্তু তোমার ছেলে কি আমার কথা শুনবে?

খুরকির মা মাথা নেড়েছিল, হ্যাঁ শুনবে।

ছাই শুনবে। এসব হারামির বাচ্চাদের আমার জানা আছে। আমরা পাওয়ারে না আসা অবধি শুনবে না। অলরাইট, আমি দেখছি, ছাড়া পেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলল। তা নুকু ঘোষ কিন্তু কথা রেখেছিল। সেই লালবাজার থেকে বড়বাবুকে বলিয়ে ছাড়িয়ে এনেছিল খুরকিকে। খুরকি বলেছিল, সতীশের পেট টানবে। তাই এখন সে পার্টি অফিসে যাবে না তা বলাই বাহুল্য।

ঈশ্বরপুকুর লেনের শেষপ্রান্তে পার্টির অফিস। সামনে একটা লাল ফ্ল্যাগ ঝুলছে। এই ভর দুপুরেও দরজা খোলা। ভেতরে মেঝেয় সতরঞ্চির ওপর দুটো ছেলে ঘুমুচ্ছে। কিলা চেঁচালো, সতীশদা!

ওর উচ্চারণ জড়ানো, গাঁজা টানবার পরই গলার স্বর ভারী হয়ে যায়। ছেলেদুটোর ঘুম ভাঙ্গছে না। অর্ক বলল, নেই বোধহয়। হয়তো অফিসে গিয়েছে।

কিলা মাথা নাড়ল, সতীশদা সাতদিনে একদিন অফিসে যায়। সোমবার। তুই গিয়ে ওদের তোল তো!

অর্ক এক লাফে রকে উঠে ঘরে ঢুকল। তারপর ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞাসা করল, এই, সতীশদা কোথায় রে?

দুজনেরই একসঙ্গে ঘুম ভাঙ্গল। অর্ক একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল। পাশ ফিরে থাকায় সে বুঝতে পারেনি। কর্পোরেশন স্কুলের রঘুমাস্টার আর হরি মিষ্টান্নের কারিগরটা শুয়েছিল। দুজনেই তার চেয়ে বয়সে দ্বিগুণ। অথচ এদের সে তুই বলে ফেলেছে। রঘু মাস্টার বলল, সতীশ নেই।

নেই মানে? কোথায় গিয়েছে?

হরি মিষ্টান্নের কারিগর বলল, খেতে। ভজনদের বাড়িতে।

কিলা চেঁচিয়ে উঠল, চলে আয় অক্ক। ওটা শালা সতীশদার ফুলটুসের বাড়ি। ওখানেই যাই।

রঘু মাস্টার ঘাড় বেঁকিয়ে কিলাকে দেখল। কিলা বলল, আরে রঘু, তুই শালা চুকলি খোর?

না। রঘু মাস্টার দ্রুত মাথা নাড়ল।

কথাটা মনে রাখিস।

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে অর্ক বলল, সতীশদার বোনের সঙ্গে রঘু মাস্টারের বিয়ে হবে।

বিলু বলল, কথা ছিল সেরকম কিন্তু এখন পাখি উড়ে গেছে।

অর্ক রেগে গেল, যা! যা জানিস না তা বলিস না। আমি শালা নিজের চোখে দেখেছি রঘু মাস্টার তানুদিকে চুমু খাচ্ছে!

কিলা থমকে দাঁড়াল, তুই নিজের চোখে দেখেছিস?

হা। একদিন অনেক রাত্তিরে। সতীশদার ঘরে। কেউ ছিল না তখন। আমি পেছন দিয়ে যেতে যেতে শব্দ শুনে জানলার ফাঁক দিয়ে দেখলাম। অর্ক বলল।

কিলা ঘুরে দাঁড়াল, আমি শালা রঘুটাকে খুন করব। আমি কথা বললে উত্তর দেয় না আর ও শালা চুমু খায়!

বিলু খপ করে কিলার হাত ধরল, এখন মাপ করে দাও ওস্তাদ। পরে এ নিয়ে ভাবা যাবে। ন্যাড়ার মা ওদিকে শুয়ে আছে।

কিলা সামান্য টলল। ওর চোখ এমনিতেই বেশ লাল, এখন যেন রক্ত ঝরছে। বিলু ওর হাত ধরে টানতে সে আবার ফিরল। ওরা দল বেঁধে পাশের সরু গলিটায় ঢুকে পড়তেই দেখল সতীশ আসছে। হ্যাণ্ডলুমের পাঞ্জাবি, পাজামা এবং কাঁধে ব্যাগ। ওদের দেখে সতীশ থমকে দাঁড়াল, কি ব্যাপার?

কিলা সবাইকে সরিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, মাইরি সতীশদা, তুমি বল আমি ছিপিএম করি কি করি না?

সতীশ বিরক্ত হল, কি বলছিস বল!

কিলা হাত নাড়ল, না আগে তোমাকে বলতে হবে। খুরকি নুকু ঘোষের গেঞ্জি হয়েছে আর আমি? আমি ছিপিএমের জন্যে জান লড়িয়ে দিয়েছি, কিনা বল? ওই শালা রঘু মাস্টার কি করেছে?

সতীশ একটু অবাক গলায় বলল, রঘু মাস্টারের কথা আসছে কেন?

কিলা বোধহয় এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে যে উত্তেজনাটা বেশী হয়ে গিয়েছে। সে বিলুকে বলল, বল না বে।

বিলু বলল, তোমাকে খুঁজতে গিয়েছিলাম পার্টি অফিসে। রঘু মাস্টার হেভি রঙ নিল। যাক ছেড়ে দাও এসব কথা। ন্যাড়ার মা মরে গেছে, বডি নিয়ে এসেছি পাড়ায়। কিন্তু পোড়াবার মাল নেই।

সতীশ বলল, আমি কি করব?

কিলা হাত নেড়ে অর্ককে দেখাল, অক্ক বলল তোমার কাছে আসতে।

সতীশ মুখ ফিরিয়ে অর্ককে দেখল। তারপর হেসে বলল, তোমার কি করে মনে হল আমার কাছে এলেই টাকা পাওয়া যাবে?

অর্কর এসব কথা ভাল লাগছিল না। লোকটা মাইরি সোজাসুজি কিছু বলছে না। সতীশ তাকিয়ে আছে দেখে সে বলল, আপনি ছাড়া অন্য কারো কথা মনে পড়ল না তাই।

সতীশ খুশি হল, ঠিক আছে। আমাদের এলাকায় কেউ মারা গেলে, অবশ্যই কিছু দায়িত্ব আমরা নেব। শোষিত মানুষের পাশে না দাঁড়ালে আমাদের সমস্ত কাজই বৃথা যাবে। কিন্তু মুশকিল হল আমার কাছে তো টাকা বেশী নেই। সমীরকে তো সন্ধ্যের আগে পাওয়া যাবে না। এক কাজ কর। তুমি এই টাকাটা রাখ।

পাঞ্জাবির ভেতরের পকেট থেকে দুটো দশ টাকার নোট বের করে সতীশ অর্কর হাতে দিল। অর্ক টাকাটা ধরে বলল, কিন্তু সন্ধ্যে অবধি তো ন্যাড়ার মাকে রাখা যাবে না! সতীশ মাথা নাড়ল, হ্যাঁ ঠিকই। আমাদের যা ফাণ্ড তা সমীরের কাছেই থাকে। তোমরা জানো আমি টাকা পয়সা হাতে রাখি না। এক কাজ কর। পাড়ার সম্পন্ন মানুষদের কাছে সামান্য চাঁদা তুলে নাও। এরকম ইস্যুতে কেউ না বলবে না। যদি তাতেও টাকা না ওঠে কারো কাছ থেকে ধার নিয়ে নিও সমীর এলে আমি ব্যবস্থা করব।

সতীশের সঙ্গেই ওরা গলি থেকে বেরিয়ে এল। এই ব্যবস্থাটা সবারই যেন মনের মতন হয়েছে। সতীশ বলল, অর্ক, তোমার নামটি কিন্তু ভারী সুন্দর।

কিলা বলল, তুমি মাইরি মাল না খেয়ে আনসান কথা বল। অক্ক মানে তো অক্কা পাওয়া। সুন্দর হল? ফোট।

অর্ক হেসে ফেলল, যা বে! অর্ক মানে হল সূর্য! সান।

.

সতীশ পার্টি অফিসে ঢুকে গেলে ওরা তিন নম্বরের সামনে চলে এল। ন্যাড়ার মাকে ঘিরে তখনও কিছু বউ এবং বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে। খুরকি ওদের দেখে উঠে দাঁড়াল রক থেকে, কি বে, সতীশ মাল দিল?

কিলা মাথা নাড়ল, কুড়কুড়ি ছেড়েছে। বলল, পার্টির নাম করে চাঁদা তুলতে।

খুরকির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। যদিও একটু আগে কিলার সিগারেট তাকে আচ্ছন্ন করেছে তবু অতিরিক্ত কলজের জোরেই বলল, সাবাস। চল মাইরি খেপ ধরি।

ঠিক হল তিন নম্বরের কোন ঘরে খাওয়া হবে না। কিলা বলল, চাঁদা তুলতে গেলে রসিদ চাইবে না? বিলু ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিল, দুব্বে, চাঁদা বলবি কেন? ডোনেশন নেব।

দলটা ক্রমশ বড় হচ্ছিল। একগাদাকুচো জুটে গেছে সঙ্গে। কিলা সেদিকে তাকিয়ে খেপে গেল, আরে, তোরা বাড়ি যা! পেছন পেছন এলে চামচিকে সেদ্ধ করে দেব।

বাচ্চাগুলো সরলো সামান্য, কিন্তু ভয় পেল না। বিলু বলল, থাকনা ওরা, দেখতে ভাল লাগবে। বেশ বড় দল হলে ওজন বাড়ে।

প্রথম আক্রমণটা হল নিউ তরুণ ডেকরেটর্সের ওপর। নিউ তরুণের মালিকের ব্যবসা এখন ভাল। দুপুরের খাওয়া সেরে ভদ্রলোক সবে তাঁর ঈশ্বরপুকুর লেনের দোকানে এসে বসেছেন এমন সময় ওরা হাজির হল। ছেলেগুলোকে তিনি চেনেন। প্রত্যেকটা পুজোয় চাঁদা দিতে হয়। ক্যানসারের মত এখন পুজোর সংখ্যা বাড়ছে।

নিরীহ মুখ করে বললেন, কি চাই ভাই?

কিলা বলল, ন্যাড়ার মা টেসে গেছে, তাই ডোনেশন চাই।

হকচকিয়ে গেলেন ভদ্রলোক, ন্যাড়ার মা?

কিলা ডাকল, আব্বে ন্যাড়া, এদিকে আয়।

ভিড় ঠেলে ন্যাড়া সামনে এসে দাঁড়াল। ভদ্রলোক ছেলেটিকে দেখলেন। সামান্য বয়স কিন্তু এর মধ্যেই মুখের চোয়াল চোয়াড়ে হয়ে গেছে। মাতৃবিয়োগের কোন চিহ্ন অভিব্যক্তিতে নেই।

ডোনেশন কেন?

পোড়াতে হবে না? বডি পচবে? একি ধুর মাইরি। কিলা অবাক গলায় বলল। ভদ্রলোকের মুখে রক্ত জমল। অর্ক তখন এগিয়ে এল, বুঝতেই পারছেন ওদের টাকা পয়সা নেই। সকারের জন্যে যে খরচ হবে তাই পাড়ার লোকদের কাছে চাইছি। সতীশদা বলে দিয়েছেন।

কথাটা শুনে মুখ বিকৃত করে ভদ্রলোক পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা পাঁচটাকার নোট বের করে বলল, এ ভাই ঠিক হচ্ছে না। তোমরা পাড়ার ছেলে তাই না বলতে পারি না। কিন্তু রোজ রোজ যদি আস।

খুরকি বলল, নক্সা মারাবেন না। রোজ রোজ কে আসে বে?

অর্ক টাকাটা তুলে নিয়ে বলল, চল।

কার বাইরে বেরিয়ে এসে কিলা বলল, এশালা অক্কটা মাইরি পাঁচ টাকায় ছেড়ে দিল! এর পর থেকে তুই একদম কথা বলবি না।

অর্ক টাকা রাখছিল। ঘুরে ঘুরে ঘন্টাখানেকের মধ্যে শ দেড়েক উঠে গেল। এর মধ্যে শুধু হরিনাথ দের বাড়িতে বেশ ঝামেলা হয়েছিল। অর্ক বলল, মাল তো উঠে গেছে এবার চল।

খুরকি বলল, কত উঠেছে?।

দেড়শো।

ওটা তো পোড়াতেই যাবে। এতগুলো শ্মশানযাত্রী খাবে তার টাকা? চল সেক্রেটারির বাড়িতে যাই। শালা কংগ্রেসী।

পাড়ার একমাত্র স্কুলের সেক্রেটারি ব্রজমাধব পাল এ পাড়া থেকেই এককালে কংগ্রেসের কাউন্সিলার ছিলেন। অতুল্য ঘোষ পার্টি ছাড়ার পর থেকে তিনিও রাজনীতি করেন না। স্কুলটাকে খুব ভাল চালাচ্ছেন ভদ্রলোক। বাপের প্রচুর বাড়ি আর পয়সা থাকায় এখন কোন কাজকর্ম করতে হয় না। বিরাট কোলাপসিবল গেটের সামনে দাঁড়াল ওরা। দারোয়ানকে বলল, পালবাবুর সঙ্গে দেখা করব।

দারোয়ান বলল কি চাই?

কিলা খিঁচিয়ে উঠল, তোর বাপের বিয়ে দেব! যা বলছি তাই কর।

খুরকি চাপা গলায় বলল, কিলা, মুখ সামলে, আমার পার্টির লোক।

বিলু বলল, ছোড় গুরু। ও এখন পার্টি করে না।

দারোয়ান ফিরে এল। পেছন পেছন নেমে এলেন ব্রজমাধব পাল। বিশাল শরীর। গিলেকরা পাঞ্জাবি আর চওড়া পাড় ধুতি পরে থাকেন সব সময়। ফসা মুখটা যেন ঈষৎ বিরক্ত, কি চাই?

ডোনেশন! বিলু বলল।

ডোনেশন? কি জন্যে?

খুরকি এগিয়ে গেল গেটের কাছে, স্যার আমি খুরকি।

কি নাম বললে?

খুরকি।

এরকম নাম কোন মানুষের হয়? বাপ মা রেখেছিল? কিলা চেঁচিয়ে উঠল, বাপ মা তুলে কথা বলবেন না! খুরকি ধমকালো, অ্যাই চুপ কর। ও আমাদের পার্টির লোক না স্যার! আমাকে চিনতে পারছেন না? সেই যে একবার নুকুদা আমাকে নিয়ে আপনার কাছে গিয়েছিল!

কবে বল তো?

সেই যে যেবার ছিপিএমরা আপনাদের স্কুলে বোমা মেরেছিল!

হ্যাঁ হ্যাঁ। ও, আচ্ছা তুমিই সেই? তা কি ব্যাপার?

এই যে ন্যাড়া, ওর মা ঝপ করে মরে গেছে। তাই আপনার কাছে এসেছি। কিছু টাকা কড়ি যদি দেন! খুরকির গলা খুব নরম শোনাচ্ছিল।

মড়া পোড়ানোর টাকা? ওতে তো তোমরা চোলাই গিলবে! ভদ্রলোক মুখ বিকৃত করে পিছু ফিরলেন।

সঙ্গে সঙ্গে কিলা চেঁচিয়ে উঠল, আবে খানকির ছেলে, তাতে তোর বাপের কি?

ব্ৰজমাধব পাল চটপট ঘুরে দাঁড়ালেন, কে বলল কথাটা? কে? জুতিয়ে মুখ ভেঙ্গে দেব হারামজাদা। আমার সঙ্গে ইতরামি? তোদের মত ইতর নিয়ে কত কারবার করেছি এককালে! কে বলল?

বাঘের মত ব্ৰজমাধবের গর্জনে সবাই চুপসে গেল। অর্ক চট করে সরে গেল আড়ালে। ব্রজমাধব ওর স্কুলের সেক্রেটারি, মায়ের সঙ্গে বেশ আলাপ আছে। খুরকি দুহাত তুলে বলল, ও স্যার আমাদের অ্যান্টি পার্টি! ওর কথা ছেড়ে দিন।

ছেড়ে দেব? তুমি বলছ কি! আমি খানকির ছেলে? অত বড় স্কুলটাকে চালাই আমি। প্রতিবছর চারপাঁচজন স্টার পায় আর আমাকে গালাগালি দিচ্ছে!

বিলা বলল, তা স্যার আপনি তো গবমেন্টের অর্ডার মানছেন না।

কি মানছি না?

আপনি স্কুলে ইংরেজি পড়াচ্ছেন। শালা দেশটাকে সাহেবদের চাকর করে দিতে চাইছেন। এটা কি ঠিক হচ্ছে? যেন বেশ ফাঁদে ফেলে দিয়েছে এমন ভঙ্গীতে কথা বলল বিলা।

বেশ করেছি। আমি ইংরেজি বলে কোন সাবজেক্ট রাখিনি। জেনারেল নলেজ হিসেবে আমি যা খুশি পড়াতে পারি! এ বিষয়ে তোদর সঙ্গে কথা বলব না। প্রচণ্ড উত্তেজিত দেখাচ্ছিল ব্ৰজমাধবকে।

খুরকি নরম গলায় বলল, স্যার রাগ করবেন না।

এসব শুনে কেউ চুপ করে থাকতে পারে না।

ছেড়ে দিন। ওরা সব অ্যান্টি পার্টি!

ওদের নিয়ে এসেছ কেন তুমি?

কি করব! এক বস্তিতেই থাকি! কিন্তু আপনি কিছু না দিলে আমার মুখ থাকে না। বেইজ্জত হয়ে যাব।

ব্ৰজমাধব ভাল করে খুরকিকে দেখলেন। তারপর বললেন, তুমি কাল সকালে নুকুকে নিয়ে আমার কাছে এসো।

আচ্ছা স্যার। কিন্তু—

কোন শ্মশানে নিয়ে যাবে?

নিমতলা!

ওখানে তো ইলেকট্রিক আছে! ঠিক আছে, ছেলেটার মায়ের নামটা আমাকে বলে যাও। তোমরা বডি নিয়ে গেলে ওরা পোড়াবার চার্জ নেবে না। আমি লোক পাঠিয়ে ব্যবস্থা করব।

প্রচণ্ড হতাশ হল মুখগুলো। শেষপর্যন্ত বিলু বলল, পুরো টাকাটাই ফিরি হয়ে যাবে?

ব্ৰজমাধব বললেন, বললাম তো! তোমাদের হাতে টাকা দেব না। নাম কি ওর মায়ের?

খুরকি ন্যাড়াকে বলল, আবে, তোর মায়ের নাম কি?

ন্যাড়া মাথা নাড়ল। একটু ভাবল, তারপর বলল, পুরো নাম জানি না, বাপ তো পুনি বলে ডাকত।

ব্রজমাধব বললেন, বাঃ, ছেলে হয়ে মায়ের নাম জানে না! হাসপাতালে কি নাম লিখিয়েছ?

বিলুর মনে পড়ল সেটা লিখিয়েছে অনু, অনুপমা। কাগজটা তার কাছেই আছে। পকেট থেকে সার্টিফিকেট বের করে সে অর্কর দিকে বাড়িয়ে দিল, পড় তো নামটা।

অর্ক পড়ল, অন্নপূর্ণা!

০৪. অনুর মা এখন ফুলের বিছানায়

অনুর মা এখন ফুলের বিছানায় শুয়ে আছে। শ্যামবাজারের মোড় থেকে অর্ক ফুল কিনে এনেছিল কিন্তু একটু আগে নুকু ঘোষ বিরাট একটা মালা পাঠিয়ে দিয়েছে। খাঁটিয়ার চারপায়ে ধূপ জ্বলছে। সারাদিন রোদে পুড়ে যদিও অনুর মায়ের মুখ কালো তবু এত সাদা ফুলে তাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। অর্ক আর বিলু গিয়েছিল ফুল আনতে, আসার আগে পাঞ্জাবীর দোকান থেকে রুটি আর কষা মাংস খেয়ে এসেছে। দারুণ খেতে। অর্ক এই প্রথমবার খেল। ব্যাপারটা ওরা চেপে গেছে অন্যদের কাছে। অর্ক দেখল, ক্যাশিয়ার হবার বেশ মজা আছে, চট করে কেউ হিসেব জিজ্ঞাসা করে না। ওরা যখন অনুর মাকে সাজাচ্ছিল তখন মাধবীলতা গলি থেকে বেরিয়ে এল। চারটের সময় টিউশনিতে যায় সে পাইকপাড়ার ইন্দ্র বিশ্বাস রোডে।

সারাদিন ছেলে ঘরে ফেরেনি। দুপুরের রান্না করা ভাত হাঁড়িতেই পড়ে আছে। অপেক্ষা করে করে অনেক বেলায় খেয়েছে মাধবীলতা। অনিমেষ বলেছিল, মৃতদেহ ম্যানেজ করা খুব ঝামেলার ব্যাপার, আজকের দিনটা আর কিছু বলো না ওকে।

মাধবীলতা অনিমেষের দিকে তাকিয়েছিল, তোমার ছেলে তুমি বুঝবে, আমার কি!

অনিমেষ এই রকম কথাবার্তা সহ্য করতে পারে না। এক ধরনের নিরাসক্তির আড়ালে তীব্র খোঁচা থাকে যা হজম করা মুশকিল। সে বলল, ছেলে কিন্তু তোমার, তুমি অনিচ্ছা করলে ও আসতো না।

মাধবীলতা চমকে মুখ ফেরাল। তারপর কিছুক্ষণ অনিমেষের দিকে তাকিয়ে রইল। অনিমেষের অস্বস্তি হল এবার। আঘাতটা দিতে যত আনন্দ হচ্ছিল দিয়ে দেবার পর ততই বিস্বাদ লাগল। হঠাৎ ওর মনে হল তার দিকে তাকিয়ে আছে বটে কিন্তু মাধবীলতা তাকে দেখছে না। ওর দৃষ্টি হঠাৎ শূন্য হয়ে গিয়েছে। অবশ্য খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিল মাধবীলতা। কিন্তু এ প্রসঙ্গে আর একটিও কথা বলল না।

অর্ক দুপুরে বাড়িতে খেতে যায়নি এ রকমটা এর আগে হয়নি। দুপুর থেকেই অর্ক এ নিয়ে অস্বস্তিতে ছিল। কিন্তু সঙ্গীরা কেউ যখন খেতে যাচ্ছে না তখন সে যায় কি করে! স্বাস্থ্যের কারণেই হোক কিংবা ক্লাস নাইনে পড়ছে বলেই ওরা ওকে দলে নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ওদের প্রত্যেকের বয়স ওর চেয়ে পাঁচ থেকে দশ বছর বেশী। খিদে পেয়েছে বলে বাড়িতে যাওয়া তাই প্রেস্টিজের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শ্যামবাজার থেকে বিলুর সঙ্গে খেয়ে এসে শরীরটা ঠাণ্ডা হলেও মন হয়নি। এই নিয়ে মায়ের মুখোমুখি হতেই হবে অর্ক জানে। এইসময় সে শিবমন্দিরের পাশের রকে বসে মাধবীলতাকে বেরিয়ে আসতে দেখল। ফুল দিয়ে সাজাবার পর আবার ভিড়টা জমেছে। মাধবীলতা সেদিকে না তাকিয়ে ট্রাম রাস্তার দিকে চলে গেল।

মড়ার পাশে হরিপদ বসেছিল। অনুপমাও আর কাঁদছিল না। জ্ঞান ফেরার পর হরিপদ কারো সঙ্গে কথা বলছিল না। কিলা চেঁচিয়ে বলল, চল বে, আর দেরি করে লাভ নেই।

সঙ্গে সঙ্গে সাজসাজ পড়ে গেল। অর্ক ঠিক করেছিল এবার সে কাঁধ দেবে না। সকালবেলায় যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গিয়েছে। চারজনের কাঁধে অনুর মা ওপরে উঠতেই খুরকি শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করল, বল হরি আবে হরি বল্। সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিল অন্যান্যরা, বল বল্ হরি বল্।

কিল্লা এবার লাফিয়ে পড়ল সামনে। শরীরটাকে বেঁকিয়ে চুরিয়ে হাঁটু ভেঙ্গে চিৎকার করল, হ্যারি হ্যারি বোল্ বল, চল বে চল্ চল্। এই চিৎকার বল্লমের মত উড়ে যাচ্ছিল চারপাশে। ঈশ্বর পুকুর লেন দিয়ে ওরা যখন এই রকম ভঙ্গী নিয়ে শব্দ করতে করতে বের হচ্ছে তখন আশে পাশের বাড়ির সামনে ভিড় জমে গেছে। অর্ক পাশে পাশে হাঁটছিল। কিলা তাকে বলল, লে বে, তুই স্লোগান দে। অর্ক একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি স্লোগান দেব?

আরে ওই একটা ছাড়া তো অন্যকথা বলা যাবে না।

দ্রুত হাঁটতে হচ্ছে বলে অর্ক প্রথমটায় কাঁপা গলায় বলল, হরি বোল। কিন্তু বলেই বুঝল ঠিক হল না। ওই মড়া নিয়ে যাওয়ার স্পীডের সঙ্গে এইরকম করে বললে চলবে না। ওরা এখন ঠিক ট্রাম রাস্তার মাঝখান দিয়ে যাচ্ছে। ফলে পেছনের গাড়িগুলো হাঁটিহাঁটি করে আসছে। আর জি কর ব্রিজ থেকে নামবার সময় অর্ক খুঁজে পেল। দলের সামনে ছুটতে ছুটতে সে চেঁচাল, ব হরি হরি বল্। একটা সুর এবং তালে শব্দচারটি উচ্চারিত হওয়ায় কিলা সেই ছন্দে কোমর এবং বুক দোলাতে লাগল। ক্রমশ সেটা সংক্রামিত হয়ে গেল পুরো দলটায়। এমন কি যে চারটে ছেলে কাঁধ দিয়েছিল তাদের একজন চেঁচিয়ে উঠল, আবে গাণ্ডুরা, আমি নাচব না? খুরকি ন্যাড়াকে বলল, যা বে, তুই নিজের মাকে কাঁদ দে, কোয়াকে ছেড়ে দে।

ন্যাড়া খিঁচিয়ে উঠল, আমি ছোট না? চারটে কাঁধ সমান হবে? ন্যাড়া কথা বলতে বলতে শরীর দোলাচ্ছিল অর্কের স্লোগানের ছন্দে। ততক্ষণে দলটা এসে গেছে শ্যামবাজারের মোড়ের কাছে। সুভাষ বোসের মূর্তির সামনে হঠাৎ কোয়ারা খাঁটিয়া নিচে নামিয়ে রেখে টুইস্ট শুরু করে দিল। সেই ভর বিকেলে পাঁচ রাস্তা ধেয়ে ছুটে আসা অজস্র গাড়ি বাধ্য হল দাঁড়িয়ে পড়তে। ফুটপাথে ভিড় জমে গেল। ট্রাফিক পুলিসগুলো দাঁত বের করে হাসতে লাগল ব্যাপারটা দেখে। পনের জন ছেলে উত্তাল নেচে যাচ্ছে মড়ার খাঁটিয়া নামিয়ে। তাদের ঠিক পেছনে একটি প্রৌঢ় খোঁচা দাড়ি নিয়ে সাদা চোখে তাকিয়ে। যেন সামনে কি হচ্ছে সে দেখতেই পাচ্ছে না। তার গা ঘেঁষে একটি যুবতী মেয়ে গায়ে শাড়ির আঁচল জড়িয়ে ডানদিকের হোর্ডিং-এর পোস্টার দেখছে। সেখানে মিঠুন এইরকম নাচের ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে। এর মধ্যে স্লোগানটা একটু পাল্টেছে। অর্কর মুখ থেকে বিলুর মুখে পৌঁছে গিয়ে সেটা তীব্র স্বরে উচ্চারিত হচ্ছে, হ্যারি বোল্ ডিস্কো বোল হ্যারি কিসকো। পনেরটা শরীর এখন নেতাজীর সামনে উত্তাল, সেগুলো অবিশ্বাস্য দক্ষতায় ভাঙ্গছে, বুক এবং শুকনো নিতম্ব চরকির মত ঘুরছে।

এই সময় একটা মোটর বাইক শব্দ করে এসে থামল সামনে। বৃহৎ চেহারার এক সার্জেন্ট চেঁচিয়ে উঠল, এই শালা শুয়ারের বাচ্চারা, মড়া তোল। চকিতেই অনুর মা আবার কাঁধে উঠে গেল। যদিও নৃত্য এবং স্লোগান থামল না তবু সেই গতিতেই দলটা মোড় পেরিয়ে ভূপেন বোস অ্যাভিতে ঢুকে গেল। অবিরত গাড়ির হর্ন বাজছে পেছনে, সার্জেন্ট ট্রাফিকের জট ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পাতাল রেলের খোঁড়াখুঁড়িতে ভূপেন বোস অ্যাভিন্যকানা হয়েছিল, এদের মিছিল সেখানে ঢুকে পড়ায় ট্রাফিক পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। একটা অ্যাম্বুলেন্স নড়তে পারছিল না এক চুল। মুখ বের করে ড্রাইভার চেঁচিয়ে উঠল, ও দাদারা একটু ছেড়ে দিন, স্ট্রোক কেস নিয়ে যাচ্ছি।

কিলা বলল, নিয়ে যেতে হবে না, খাঁটিয়ায় শুইয়ে দে।

.

নিমতলায় যখন ওরা পৌঁছাল তখন সন্ধ্যে পেরিয়ে গেছে। দুটো পা ভারী হয়ে উঠেছিল অর্কর, গলা প্রায় ভেঙ্গে গেছে। মড়া নামিয়ে রাখতেই কটু গন্ধ নাকে এল। নিমতলায় এই প্রথম আসা। ওর। বিলু বলল, আবে অক্ক, চল দেখে আসি আমরা ক’লম্বর!

নম্বর?

তুই শালা বিয়ে করতে এসেছিস নাকি যে এলি আর ঢুকিয়ে দেবে? চল বে?

শ্মশানের ভেতরে ঢুকল ওরা। দাউ দাউ করে চিতা জ্বলছে দুটো। তাদের ঘিরে শ্মশানযাত্রীরা বিহ্বল চোখে তাকিয়ে। অর্ক দুটো পা দেখতে পেল, চিতা থেকে বেরিয়ে আছে, তখনও পোড়েনি। ওর শরীরটা গুলিয়ে উঠল। কটু গন্ধটা যে মড়া পোড়ার তা বুঝতে অসুবিধে হল না আর। ইলেকট্রিক চুল্লির ওখানে বেশ ভিড়। মড়া যেমনভাবে এসেছে তেমনভাবে সুযোগ পাবে পুড়তে। বিলু বলল, তাড়াতাড়ি আমাদের নাম লেখা নইলে মড়া পচবে।

ভিড়ের মধ্যে অর্ক এগোচ্ছিল। এই সময় কানে এল, তাড়াতাড়ি পোড়াবেন? সে মুখ ফিরিয়ে দেখল একটা শুড্যা চোরের মত তাকে দেখছে। এ শালা নির্ঘাৎ দালাল। সে হাত নাড়ল, ফোর্ট।

ঠিক তক্ষুনি একজন ভদ্রলোক লোকটাকে ডাকল, এই যে ভাই, হবে?

আপনাকে বলেচি তো একস্ট্রা তিরিশ ছাড়তে হবে। এসব লাইনে অনেক খরচ, ভাগ বাঁটোয়ারা আছে। লোকটা রোয়াবের সঙ্গে বলল।

ওটা কুড়ি কর।

দূর মাইরি, আপনি ভদ্রলোকের ছেলে?

মানে?

নিজের বাপকে পোড়াবেন তবু দর কষাকষি করছেন। কুড়ি আর তিরিশে পার্থক্যটা কি? আপনার চান্স আসতে আরো চার ঘণ্টা লেগে যাবে। আর এর মধ্যে যদি কোন এম এল এর রেফারেন্স এসে যায় তো হয়ে গেল! রাজি হলে আধঘণ্টার মধ্যে তুলে দেব। দালালটা বলল।

গোলমাল হবে না তো?

সে রিস্ক আমার। তারপর গলা নামিয়ে বলল, দুটো জেনুইনের পর একটা ফলস ঢোকানো আছে আপনাদের জন্যে।

ঠিক আছে।

মালটা ছাড়ুন তাহলে।

আগে দিতে হবে?

হ্যাঁ, তাই নিয়ম।

অর্ক আর দাঁড়াল না। ভিড় ঠেলে টেবিলের সামনে পৌঁছাতে অসুবিধে হচ্ছিল। সে কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে চিৎকার করল, সোরে যান মোশাই। এর মধ্যেই সে জেনেছে যে এইভাবে কথা বললে, দারুণ কাজ হয়। কিলা কিংবা খুরকির মত তার উচ্চারণ সঠিক হয় না বটে তবু কাজ দেয়। এখানেও তাই হল। খুব হেক্কড় নিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, অনেকক্ষণ বসে আছি, কত দেরি হবে?

এখানকার লোকগুলো বোধহয় ঘাটা-পড়া, এইসব কথায় অভ্যস্ত। মুখ তুলে দেখল না পর্যন্ত, বলল, নাম লিখিয়েছেন?

কিসের নাম?

আট ঘণ্টার আগে হবে না। ফাস্ট কাম ফাস্ট সার্ভ।

হঠাৎ অর্কর মনে পড়ল ব্রজমাধব পালের কথা। সে বলল, খাতা খুলে দেখুন ব্রজবাবু নাম লিখিয়ে গিয়েছে।

কে ব্রজবাবু? ওসব নাম বললে কোন কাজ হবে না। পাবলিক এতক্ষণ কষ্ট করে দাঁড়িয়ে আছে আর এখানে ব্রজবাবু। বলতে বলতেই যেন কিছু মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গীতে চোখ তুলল লোকটা, কি বললেন নামটা!

ব্রজমাধব পাল

দ্রুত খাতাটা টেনে নিয়ে লোকটা নামগুলোয় চোখ বুলিয়ে বলল, ডেডবডির নাম কি?

অন্নপূর্ণা

এবার লোকটা খিঁচিয়ে উঠল, এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? ডেকে ডেকে গলা ভেঙ্গে গেল কেউ সাড়া দিল না। আপনার পরে এসে বডি উঠে গেছে আর–। যাক, এর পরে আপনারা, বডি নিয়ে আসুন আর সার্টিফিকেটটা দিন।

হাসপাতালের কাগজটা হাতে তুলে দিয়ে অর্ক বলল, টাকা পয়সা তো সব দিয়ে দেওয়া হয়েছে,?

হ্যাঁ। সে জ্ঞান দেখছি টনটনে।

অর্ক বেরিয়ে আসছিল এমন সময় আর একটা লোক চেঁচিয়ে উঠল, কি ব্যাপার মশাই, আমরা কি আঙ্গুল চুষতে এসেছি?

খাতা-সামনে লোকটা বলল, মানে?

এইমাত্র শালা ওদের বডি নামাতে দেখলাম আর আপনি আগে তুলে দিচ্ছেন?

আপনি কখন বডি নামাতে দেখেছেন জানি না কিন্তু আমার খাতায় তিন ঘণ্টা আগে নাম উঠে গেছে। আমি সেটাই দেখব।

তাহলে তো পেসেন্ট হাসপাতালে গেলেই এখানে নাম লেখাতে হবে।

তাই করবেন।

ঠিক আছে, দেখি ওই মড়া কি করে পোড়ে! এ্যাই পঞ্চু! লোকটা চেঁচিয়ে ডাকতেই একটা মাস্তান-দেখতে ছেলে এগিয়ে এল, কি দাদা! লোকটা তাকে ফিসফিসিয়ে কিছু বলতেই মাস্তানটা এগিয়ে এল অর্কর সামনে, আবে, আগে এদের বডি পুড়বে তারপর অন্য কথা। আমার নাম পঞ্চু।

কে পঞ্চু! অর্কর মাথায় আগুন জ্বলে উঠল।

তোর বাপ।

সঙ্গে সঙ্গে হাত চালালো অর্ক। ডান হাতের পাঞ্জার পাশ দিয়ে তীব্র আঘাত করল পঞ্চুর চোয়ালে। কিছুটা হড়কে গিয়ে ঝট করে ছুরি বের করল পঞ্চু। অর্ক সেটা দেখতে পেয়েই দৌড়াতে শুরু করল সামনে। বিকট আওয়াজ করে পঞ্চু পেছনে আসছে। মুহূর্তেই ওর দলের ছেলেরা হ্যা হ্যা করে যোগ দিল ওর সঙ্গে।

অনুর মায়ের শরীরটার কাছে পৌঁছেই অর্ক চেঁচিয়ে উঠল, কিলা, শালারা আসছে!

ওরা বসেছিল। ডাকটা শুনেই তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। দলটাকে দেখে থমকে দাঁড়াল পঞ্চুরা। শুধু পঞ্চু চেঁচাল, আবে, এগিয়ে আয়, কোন বাপ তোকে বাঁচায় দেখি!

খুরকির হাতে খুর এসে গিয়েছে এর মধ্যে। সে এক পা এগিয়ে জিজ্ঞাসা করল, পঞ্চু না?

আবে খুরকি! পঞ্চুর গলা পাল্টে গেল।

র‍্যালা নিচ্ছিস কেন বে? খুরকি খুরটা নাচাচ্ছিল।

আরে ওস্তাদ, তোমার পার্টি নাকি ও?

হ্যাঁ।

শালা আমার গায়ে হাত চালিয়েছে।

খুরকি টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে। কিলা বলল, বেশ করেছে। পঞ্চু বলল, না ওস্তাদ, এর বদলা আমি নেব। নিমতলায় এসে আমার গায়ে হাত তুলে ফিরে যাবে এমন মাল আজও পয়দা হয়নি।

দুটো হাত দুপাশে ছড়িয়ে বুক চিতিয়ে খুরকি বলল, লে শালা বদলা নে। দেখি কোন খানকির ছেলে এদিকে আসে।

পঞ্চু একমুহূর্ত ভাবল। তারপর বলল, কিন্তু বিচারটা ঠিক হল? তুমি মাইরি লাইনের ওস্তাদ তুমি ঠিক বিচার করলে?

ওদের মধ্যে হাত দশেকের ব্যবধান। অন্যান্য শ্মশানযাত্রীরা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছে। খুরকি পঞ্চুকেই জিজ্ঞাসা করল, কেন হাত তুলেছিল?

পঞ্চু জবাব দিল, ওই বডি তোমাদের তা জানতাম না। আমাদের বডি আগে এসেছে আর ও শালা ম্যানেজ করে প্রথমে পোড়াতে যাচ্ছে দেখে বলতেই হাত তুলল।

অর্ক উত্তেজিত ছিল। পঞ্চু তাড়া করার সময় সে সত্যি ভয় পেয়েছিল। এখন খুরকির প্রতাপ দেখে সে অনেকটা সাহস ফেরত পেয়েছিল। চিৎকার করে বলল, মিথ্যে কথা। আমি ওর নাম জিজ্ঞাসা করতে বলেছিল ও নাকি আমার বাপ।

বলেছিলি? খুরকি জিজ্ঞাসা করল।

এতো আমরা বলেই থাকি! তাই বলে হাত তুলবে?

ঠিক করেছে, শোধবোধ হয়ে গিয়েছে। তুই মিটমাট করবি কিনা সেটাই বল? খুরকির মুখ বিকৃত হল।

পঞ্চু সেদিকে তাকিয়ে যেন হাল ছাড়ল, ঠিক আছে ওস্তাদ। তোমার কথায় আমি ছেড়ে দিলাম। কিন্তু আর কোনদিন যদি পাই তো দেখিয়ে দেব এ তোমায় বলে রাখছি।

ওরা চলে গেলে খুরকি বলল, হারামি!

কিলা বলল, ঝাড়লি না কেন?

খুরকি মাথা নাড়ল, শালার সঙ্গে জেলে ছিলাম না?

এইবার অর্ক বলল, চল, বডি নিয়ে চল।

সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেল সবাই। হই হই করে অনুর মাকে ইলেকট্রিক চুল্লির কাছে নিয়ে যাওয়া হল। কিলা জিজ্ঞাসা করল, ব্রজটা টাকা দিয়েছে এখানে?

অর্ক মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

তোর কাছে মাল আছে?

গুণে দেখিনি।

দ্যাখ বে।

অর্ক পকেট থেকে টাকা বের করে বলল একশ বিশ। কিলা হাত নাড়ল, যা বাব্বা, তিরিশ টাকা হাপিস!

বিলু বলল, এ শালা কি বে! ফুল কিনতে হল, ফুলের দাম জানিস? কোনদিন কিনেছিস?

কিলা বিহ্বল চোখে অনুর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ফুল শালা এত দামী!

চুল্লিতে ঢোকাবার সময় অনুপমা ছাড়া আর কেউ কাঁদল না। হরিপদ মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। অর্ক দেখল কোয়া অনুর কাঁধে হাত রেখে খুব সান্ত্বনা দিচ্ছে। কোয়ার দাঁড়ানোর ভঙ্গীটা খুব খারাপ। সে চেঁচিয়ে ডাকল, অ্যাই কোয়া?

সেইভাবেই দাঁড়িয়ে কোয়া বলল, কি বে?

ওর লাভার আছে।

কথাটা কানে যাওয়া মাত্র অনুপমা কোয়ার শরীরের কাছ থেকে ছিটকে সরে গিয়ে মায়ের জন্যে কাঁদতে লাগল। কোয়া এগিয়ে এল অর্কর কাছে, তুই মাইরি কথাটা বলার আর সময় পেলি না। বেশ লাইন হচ্ছিল।

এই সময় বিলু বলল, আর তো কিছু করার নেই। অ্যাই ন্যাড়া, তুই তোর বাপদের নিয়ে ফিরে যাস। অক্ক, তুই ওকে দশটা টাকা দে।

কেন?

ডোমরা চাইতে পারে।

অর্ক পকেট থেকে দশটা টাকা বের করে এক মুহূর্ত কি ভেবে ন্যাড়াকে এড়িয়ে হরিপদর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। হরিপদ পাথরের মূর্তির মত বসে আছে। তার উপস্থিতিতেও কোন সাড়া নেই। অর্ক বুঝল হরিপদকে টাকা দিলে কাজ হবে না। ন্যাড়া পেছন থেকে বলল, আমাকে টাকা দিতে বলল, আমাকেই দাও।

অর্ক হাত নাড়ল, ফোট! তারপর একা দাঁড়ানো অনুর সামনে গেল, এই টাকাটা নাও।

অনুর মুখ ফোলা, চোখ লাল। অর্ককে দেখতে পেয়ে যেন স্বস্তি পেল। বলল, কেন?

আমরা যাচ্ছি। যদি কোন দরকার লাগে তুমি খরচ করবে, ন্যাড়াকে দিও না। টাকাটা অনুর হাতে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই অর্কর চোখে পড়ল দূরে একটা লোক কাউকে খুঁজতে খুঁজতে এদিকে আসতেই ওদের দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়াল। এখন এমন ভান করে দাঁড়িয়ে আছে যেন এদিকে কোন মনোযোগ নেই ওর। লোকটাকে চিনতে পারল সে। অনুর লাভার! ঈশ্বরপুকুরে থাকে না তবে কাগজ দেয়। সে বলল, আর তোমার চিন্তা নেই, পেছন দিকে তাকিয়ে দ্যাখো!

অনু একটু অবাক হয়ে পেছন ফিরে দেখল। তারপর লোকটাকে চিনতে পেতেই আবার সজোরে কেঁদে উঠল। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, আরে, আবার কি হল?

ওকে চলে যেতে বল, ও যেন না আসে। অনু কাঁদছিল।

কেন? কিছুই বুঝতে পারছিল না অর্ক।

মা মরার আগে ওকে চায়নি, ওর জন্যেই মা মরেছে! অনুর কান্না থামছিল না।

অর্কর মেজাজ গরম হয়ে গেল। সে বলল, ফোট তো! মরা মানুষের কথার কোন দাম আছে নাকি! আজব চিজ মাইরি। বলে হন হন করে এগিয়ে গেল লোকটার দিকে। অনুকে কাঁদতে শুনে মুখ ফিরিয়েছিল লোকটা এবার অর্ককে দেখে চোখ নামাল। অর্ক বলল, আমরা কাটছি, আপনি কেসটা টেক আপ করুন।

বিলু বোধহয় পুরো ব্যাপারটা দেখেছিল। অর্ক কাছে আসতে আফসোসের গলায় বলল, যাঃ শালা! আগে জানলে দশ টাকা ছাড়তাম না!

কেন? অর্ক হতভম্ব।

ন্যাড়ার জামাইবাবু খরচা করবে, আমরা কে বে? নারে কোয়া?

কোয়া জিজ্ঞাসা করল, শালাকে ঝাড়ব?

অর্ক চেঁচিয়ে উঠল, না!

কোয়া চমকে গেল, কি বে, চেঁচাচ্ছিস কেন?

অর্ক কিছু বলল না। সে নিজেই বুঝতে পারছিল না কেন এমন করে চেঁচিয়ে উঠল। এই সময় কিলা ডাকতেই ওরা ওইদিকে এগিয়ে গেল। এর মধ্যে দলটা ছোট হয়েছে। বোধহয় খুরকি আর কিলা কিছু ফালতু মালকে ফুটিয়ে দিয়েছে। তারা ফিরে গিয়েছে ঈশ্বরপুকুরে। অর্ক দেখল শ্মশান ছেড়ে ওরা নদীর ধার দিয়ে বাগবাজারের দিকে এগোচ্ছে। ওর দুটো পায়ে বেশ ব্যথা করছিল এবং খিদেও পেয়ে গেছে এতটা পরিশ্রমের ফলে। সে বলল, বাসে ওঠ, আর হাঁটতে পারছি না।

বাস কি বে, ট্যাক্সি বল! কোয়া উত্তর দিল। সঙ্গে সঙ্গে অর্কর মনে পড়ল ওর পকেটে এখনও প্রচুর টাকা অতএব ট্যাক্সিতে চড়া যেতে পারে।

কথাটা শুনে খুরকি কিলাকে বলল, এ শালারা কি ধুর মাইরি! নিমতলায় এসেও পেসাদ না নিয়ে ফিরে যাবে! সে কিলার কাঁধে হাত রেখে হাঁটছিল। কিলা বলল, আমাদের অক্কবাবু বড় ভাল ছেলে। ওর মা তো মাস্টারনি, তাই!

অর্ক পেছন থেকে কথাটা শুনে চোখ কুঁচকে তাকাল। মাকে নিয়ে কোন রসিকতা করছে নাকি? কিন্তু খুরকি কথাটার জবাব না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলল, আবে অক্ক, তুই ভদ্রলোক?

অর্ক বলল, তুই কি?

আমি ফালতু আদমি, খুর চালাই। তবে এক নম্বর, ভদ্রলোকেরা দু নম্বর হয়। তুই?

জানি না।

জানতে হবে। নইলে না ঘাটকা না ঘরকা থেকে যাবি। যেই পঞ্চু তাড়া করবে অমনি লেজ গুটিয়ে পালাবি!

পঞ্চুর নামটা শুনতে পাওয়া মাত্র ভেতরে ভেতরে গুটিয়ে গেল অর্ক। পঞ্চুর গালে সে হাত চালিয়েছিল ঠিক কিন্তু ও মাল বের করতেই তার মনে হয়েছিল পালানো ছাড়া বাঁচবার পথ নেই। কেন? কেন সে রুখে দাঁড়াল না। পঞ্চু তো খুরকির মত রোগা, গায়ের জোরে তার সঙ্গে পারতো না। তবে? তবু অপমানটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছিল ওর, তোরা পালাস না? সেবার হেমির পার্টি পাড়ায় চার্জ করেছিল যখন তখন তোরা হাওয়া হয়েছিলি না?

খুরকি বলল, সে ওদের কাছে যন্তর ছিল, দলে ভারী ছিল তাই।

অর্ক হাসল, সে কথাই বলছি। সব সময় রুখে দাঁড়ালে বিপদে পড়তে হয়, মোকা দেখে লড়, তাই না বিলু?

বিলু বলল, এসে গেছি।

এদিকের রাস্তায় আলো জ্বলে না বোধহয়। কিছু হোগলার ছাউনি আছে নদীর গা ঘেঁষে। খুরকি একটা লোককে ডাকতেই সে অন্ধকার ছুঁড়ে উঠে এল। তার সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলে ওরা রাস্তা পেরিয়ে একটা গলির মুখে চলে এল। এখন রেডিওতে নাটক হচ্ছে। আশে-পাশের বাড়িগুলোয় আলো জ্বলছে না। বোধহয় লোডশেডিং। অর্ক দেখল চাঁদ উঠেছে। এ এমন চাঁদ যার কোন জ্যোৎস্না নেই। মোক্ষবুড়ির বুকের মত। কেউ দুবার তাকায় না।

ভাঁড়ে ভাঁড়ে মাংস আর শাল পাতায় রুটি এসে গেল। সেই লোকটাই নিয়ে আসছিল। খুরকি বলল, অক্ক, ওকে চব্বিশ টাকা দিয়ে দে।

কিলা বলল, চব্বিশ কেন রে?

আটজনের রুটি-মাংস, ওই টাকায় তোর নাং দেবে? লোকটা দাঁড়িয়েছিল। আবছা আলোয় অর্ক দেখল লিকলিকে লোকটা মড়ার মত চোখে তাকিয়ে আছে। সে তাড়াতাড়ি টাকাটা দিয়ে দিতেই লোকটা অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। অর্ক বলল, তোদের মাইরি যা টেস্ট, যা টাকা ছিল তাতে ভাল রেস্টুরেন্টে খেতে পারতাম।

ওরা রকে বসে খাচ্ছিল। কথাটা শুনে কিলা খিকখিক করে একটু হাসল। মাংসটা রেঁধেছে ভাল তবে বড্ড ছিবড়ে। খাওয়া শেষ হতেই খুরকি সিটি মারল। তারপর বলল, অক্ক, দশটা টাকা দে।

আবার কি?

মধু খাব বে, নইলে এখানে আসে কেউ। মাল!

টাকাটা হাত বদল হল। তারপরেই একটা স্ত্রীলোক চারটে গ্লাস আর বোতল নিয়ে এল। অর্ক দেখছিল। খাওয়ার পর হাত ধোওয়া হয়নি। এই জিনিস ওদের খেতে দেখেছে সে অনেকবার। তিন নম্বরের সামনে শিবমন্দিরের পেছনে বসে এটা নিত্য খাওয়া হয়। সে সঙ্গে থেকেছে কিন্তু কোনদিন খায়নি। কেন খায়নি সেটা ভাবা বৃথা! টপাটপ মেরে দিচ্ছিল ওরা। চারজন খেয়ে গ্লাসগুলো অন্য চারজনের হাতে তুলে দিচ্ছিল।

বিলু বলল, তুই তো কখনও খাসনি, আজ টেস্ট কর।

অর্ক হাসল, মাতাল হয়ে যাব না তো?

না বে। আমরা আছি কি করতে?

অন্ধকারে ঢোক গিলল অর্ক। তারপর উৎকট গন্ধযুক্ত তরল পদার্থ গলায় ঢেলে দিল। বুক জ্বলছে, গা গোলাচ্ছে। পিচ করে এক দলা থুতু ফেলল সে। বিলু হাসল, দ্যাখ মাইরি খুরকি, অক্কর মুখটা দ্যাখ!

দাঁতে দাঁত চেপে অর্ক বলল, আর এক গ্লাস দে।

০৫. উঠে দাঁড়াতে গিয়ে অর্ক দেখল

উঠে দাঁড়াতে গিয়ে অর্ক দেখল শরীর নড়বড়ে, দুটো হাঁটু যেন অকেজো হয়ে গিয়েছে। চোখের দৃষ্টি বারংবার ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছে। আর পেটের ভেতরে জমে থাকা যাবতীয় তরল এবং গলিত পদার্থ পাক খেয়ে ঢেউ-এর মত গলা অবধি উঠে আবার নেমে যাচ্ছে। যতক্ষণ বসেছিল ততক্ষণ এসব এমন করে টের পায়নি। দু’তিন গ্লাস খাওয়ার পর বেশ মজা লাগছিল। একমাত্র খুরকি আর কিলা ছাড়া বাকিরা বেশ আলতু ফালতু বকছিল। সেই স্ত্রীলোকটি অন্ধকার থেকে বোতল আনছিল আর শুড্যাটা টাকা নিয়ে যাচ্ছিল। প্রথম প্রথম হিসেব ছিল ঠিকঠাক, কত টাকা খরচ হচ্ছে মনে রাখতে পারছিল কিন্তু তারপরেই সব গুলিয়ে গেল। এখন পকেটে টাকা আছে কিন্তু কত আছে তা সে জানে না। শরীরের সমস্ত শক্তি যখন আচমকা মরে গেল তখনও তার ভাবতে কোন কষ্ট হচ্ছিল না। অন্যদের থেকে যে তার বুদ্ধি সাফ এটুকু জেনে সে খুশি হচ্ছিল। কিন্তু উঠে দাঁড়াতেই লোডশেডিং-এর মত সেটুকু হারিয়ে গেল। এখন মাথার ভেতরে কিছু নেই, একটা ঢেউ-এ ভাসছে যেন সে। কেউ যেন তাকে টানছে, অর্ক মুখ ফিরিয়ে দেখবার চেষ্টা করল, কে বে?

গলার স্বর নিজের কাছেই অচেনা মনে হল। কেমন মোটা এবং জড়ানো।

খুরকি বলল, এদিকে আয়।

কেন বে?

খুরকিও টলছিল। মুখের সামনে হাত নেড়ে বলল, ভেগে পড়ি চল। এ শালারা আউট হয়ে গিয়েছে। কথাটা শেষ করেই খুরকি ওর বাজু ধরে টানতেই অর্ক হাঁটতে লাগল। গঙ্গার দিকে নয়, বিপরীত দিকের গলিতে ওরা ঢুকে পড়েছে। চারধার ঘুটঘুটে অন্ধকার। কয়েক পা যাওয়া মাত্র পেছন থেকে ডাক ভেসে এল, আবে অক্ক, ফুটছিস কেন?

খুরকি দাঁড়িয়ে পড়ল, অ্যাই কিলা, তোকে ডাকব ভেবেছিলাম কিন্তু একদম ভুলে গিয়েছি। এসো দোস্ত, আমরা তিনজনে যাই।

কিলা ততক্ষণে ওদের পাশে এসে পৌঁছেছে, একদম বাতেলা করবি না, আমি ওয়াচ করছিলাম। তুই মুরগিকে নিয়ে হাওয়া হবি আমি জানতাম; ছোড় ইয়ার, আমার নাম কিলা।

খুরকি অর্ককে ছেড়ে কিলাকে জড়িয়ে ধরল, না দোস্ত, তোকে ব্যাণ্ডেজ করতে পারি আমি? হাত মেলাও গুরু, দোস্তি হয়ে যাক।

অর্ক দেখল ওরা অনেকক্ষণ ধরে করমর্দন করল। কিলা কাকে মুরগি বলল? তাকে? অর্ক ঠিক ভেবে পাচ্ছিল না। তাকেই কি? কিন্তু সে কোন ঝামেলায় গেল না। পকেটে এখনও কিছু টাকা আছে। এগুলোকে সামলাতে হবে। দুটো হাত পকেটে ঢুকিয়ে দিল অর্ক।

গলিটা এঁকেবেঁকে একসময় ট্রাম রাস্তায় উঠে এল। এখন চারপাশের দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। তার মানে, অর্ক বুঝল, বেশ রাত হয়ে গেছে। তার নিজের হাতে ঘড়ি নেই। সে কিলাকে জিজ্ঞাসা করল, টাইম কত বে?

কি হবে টাইম জেনে?

বাড়ি যাব।

তোর নেশা হয়েছে অক্ক! তুই শালা মাতাল

কোন খানকির ছেলে আমাকে মাতাল বলে? চিৎকার করে উঠল অর্ক, জানিস আমি ভদ্রলোকের ছেলে। আমি বাড়ি যাব।

কিলা বলল, বাড়িতে ঢুকলে তোর মা কি বলবে তোকে? আদর করে চুমু খাবে? বাবা মাল খেয়েছ, এসো হামি খাও। চুক চুক! জিভ দিয়ে শব্দ করল সে।

আর তখনই ভয়টা মনে ঢুকে পড়ল অর্কর। সেকি সত্যি মাতাল হয়ে গেছে? সত্যি মা কি ওকে দেখেই বুঝতে পারবে? হঠাৎ কেমন ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করল ওর। মা শালা তাকে ঠিক প্যাঁদাবে, হয়তো বাড়ি থেকে বের করে দেবে। বাপ শালা নুলো কিন্তু রাগলে চোখ জ্বলে। পুলিসকে প্যাঁদাতো তো এককালে! না, এখনই বাড়ি যাওয়া উচিত হবে না। কিন্তু সত্যি সে মাতাল? ফিস ফিস করে জিজ্ঞাসা করল সে খুরকিকে।

খুরকি বলল, ঠিক হ্যায়, পরীক্ষা হয়ে যাক তুই মাতাল কিনা? মাতাল হলে আমরা বাড়ি যাব না এখন, না হলে ফিরে যাব। ঠিক আছে?

অর্ক ঘাড় নাড়ল।

খুরকি এগিয়ে গেল ট্রাম রাস্তার উপর। এখন দুপাশে ফাঁকা। গাড়ি কিংবা বাস চলছে না। তবে রিকশাঅলারা খুব ছোটাছুটি করছে। খুরকি চেঁচাল, এই কিলা, তুই ওদিকে দাঁড়া। লাইনটার ওপরে।

একটা ট্রাম লাইনের এপাশে খুরকি ওপাশে কিলা দাঁড়াল। ঠিক হল ট্রাম লাইনের ওপর পা ফেলে অর্ক হেঁটে আসবে। যদি ওর পা লাইনের বাইরে পড়ে তাহলে প্রমাণ হবে সে মাতাল। কিলা আর খুরকি দুপাশে বসে এর বিচার করবে।

আমি মাতাল হইনি। এই লাইনের ওপর হেঁটে যাওয়া জলের মত সোজা। অর্ক কিলার সামনে লাইনে পা দিল। তাকে হাঁটতে হবে দশ হাত, যেখানে খুরকি দাঁড়িয়ে টলছে। কিলা চেঁচাল,রেডি। স্টার্ট।

অর্ক পা ফেলল। এই পা কি তার নিজের? অনেক চেষ্টার পর লাইনেই পা পড়ল তার। পেছনের পা টেনে আনতে সাহস পাচ্ছিল না সে কিন্তু এগোতে হলে ওটাকে আনতেই হবে। স্থির হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চোখের দৃষ্টিকে স্বচ্ছ করার চেষ্টা করল অর্ক। আর সেই সময় কানের কাছে। আচমকা ঢং ঢং শব্দ বেজে উঠল তারস্বরে। অর্ক কোনক্রমে পেছন ফিরে তাকাল। দৈত্যের মত দুই জ্বলন্ত চোখে একটা ট্রাম ঠিক পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে কখন। ড্রাইভার ঘণ্টা বাজাচ্ছিল, এবার। চিৎকার করে সরে যেতে বলল। এটা বোধহয় শেষ ট্রাম।

খুরকি চেঁচাল, আয় বে, হেঁটে আয়। হাঁটি হাঁটি পা পা! ট্রামের ড্রাইভার যেমন চেঁচাচ্ছে, যাত্রীরাও মুখ বের করে গালাগাল দিচ্ছে। অর্ক পা ফেলল, ঠিক আছে কিন্তু তারপরই সে লাইনের বাইরে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ওরা দুজন চিৎকার করে হাততালি দিয়ে উঠল। অর্ক কিছু বোঝার আগেই গায়ে হাওয়ার ঝটকা লাগল। বিদ্যুৎচমকের মত ট্রামটা তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

তুই শালা মাতাল, ঠিক আছে। খুরকি কাছে এল।

মাতালের কাছে টাকা রাখতে নেই, ছিনতাই হয়ে যায়। কিলা হাত পাতল, টাকাগুলো দে।

পা ফেলতে না পারার জন্যে নয়, ট্রামটার ছুটে যাওয়া শরীর অর্ককে খুব নার্ভাস করে দিয়েছিল। হাত পা অবশ হয়ে গিয়েছিল তার। সে কথাটা শোনামাত্রই সতর্ক হবার চেষ্টা করল, কিসের টাকা?

আরে চাঁদু, এখন বলে কিসের টাকা! বিলা হচ্ছে? ছাড়!

দু’ পকেটে হাত ঢুকিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াল অর্ক, কি বলছিস?

কিলা ওর কাঁধে একটা থাবড়া মারল আস্তে করে, বিকেলবেলা অতগুলো মুরগি কাটলাম ন্যাড়ার মাকে দেখিয়ে, সেই মালগুলো দে বে?

কি করবি? ওটা তো ন্যাড়ার মায়ের টাকা!

একি মাইরি, মাতাল না হরিদাস পাল? হেসে গড়িয়ে পড়ল কিলা, যার নামের টাকা সে তো কখন ফোট হয়ে গেছে, এতক্ষণে ছাই পর্যন্ত নেই। দেবে, আর কথা বলতে ভাল লাগছে না।

অর্ক বুঝতে পারছিল কিলার দাবি না মিটিয়ে সে পারবে না। তবু সে খুরকির দিকে তাকাল। খুরকি এক দৃষ্টিতে ওদের দেখছিল। এবার নীরবে মাথা নাড়ল, কার বাপের টাকা বে?

সঙ্গে সঙ্গে কিলা ঘুরে দাঁড়াল, মানে?

কার বাপের টাকা যে তুই নিবি?

খবরদার খুরকি, বাপ তুলে কথা বলবি না। এ টাকা আমার, সতীশদা আমাকে তুলতে বলেছে। কিলা এগিয়ে যাচ্ছিল খুরকির দিকে। কিন্তু কাছে যাওয়ার আগেই থমকে দাঁড়াল সে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টলতে লাগল। খুরকির হাতে তখন একটা চ্যাপ্টা খুর, খুরটাকে তুলে সে পরম স্নেহে চুমু খাচ্ছে। কিন্তু দৃষ্টি কিলার ওপর নিবদ্ধ।

কিলা চেঁচিয়ে উঠল, খুরকি! মাল সরা!

খুরকি উত্তর দিল না কথাটার। একটু হেসে বলল, অক্ক, টাকাটা আমাকে দে!

কিলা দুটো হাত দুপাশে বাড়িয়ে বুক চিতিয়ে বলল, না বে, ও টাকা আমার। সতীশদা না বললে ওই টাকা আমরা তুলতাম না। সতীশদা আমার পার্টির লোক তাই টাকা আমার।

খুরকি হাসল, তোর সতীশের মুখে আমি–ফোট। অক্ক, টাকাটা দে।

অর্ক বুঝতে পারছিল একটা কিছু গোলমাল হতে যাচ্ছে। রাস্তাটা এখন একদম ফাঁকা। সে এদের থামাতে চাইল, মাইরি খুরকি, তুই এত চালাক আর এটুকু বুঝিস না কেন বে?

কি বুঝি না?

নিজেদের মধ্যে গোলমাল করলে মুশকিল হয়।

নিজেদের মধ্যে মানে? ও শালা সতীশের জাঙ্গিয়া

কিলা সঙ্গে সঙ্গে বলল, তুই বে নুকু ঘোষের গেঞ্জি।

ঠিক সেইসময় দূরে একটা গাড়ির শব্দ ভেসে এল। শব্দটা শুনে খুরকি, চকিতে মুখ ফিরিয়ে চিৎকার করল, ভাগ, গিরধর আসছে।

কথাগুলো মিলিয়ে যাওয়ার আগেই সে ঢুকে গেল পাশের গলিতে। কিলা এগিয়ে আসা গাড়িটাকে ভাল করে দেখে সুড়ুৎ করে সরে গেল।

অর্ক প্রথমে বোঝেনি এরা কেন পালাচ্ছে। কত গাড়ি তো রাস্তা দিয়ে গিয়েছে, এটার কি বিশেষত্ব! তবু ওর মনে হল এই গাড়ি থেকে কোন বিপদ আসতে পারে। কিন্তু সে দৌড়াতে গিয়ে বিফল হল। শরীরের ওপর কোন অধিকার নেই যেন তার। এক পলকে চোখে পড়ল সামনেই একটা রক, রকের একটা দিকে উঁচু দেওয়াল। হুড়মুড় করে সে ওই দেওয়ালের গায়ে শুয়ে পড়তেই একটা লোক চি চি করে উঠল, কে রে, মরে গেলাম, চেপে দিল রে, উঁহু হু। জড়ানো গলায় অর্ক ধমক দিল, চুপ, পেট ফাঁসিয়ে দেব। শোনামাত্রই লোকটা চুপ করে গেল।

অর্ক দেখল সারা শরীরে ছেঁড়া বস্তা চাপিয়ে একটা ভিখিরী টাইপের বুড়ো ওর পাশে শুয়ে জুলজুল করে দেখছে। হঠাৎ ওর বমি পেল। কয়েক গ্লাস বাংলা মদ খেয়ে যা হয়নি এই লোকটির পাশে শুয়ে তাই হল। দাঁতে দাঁত চেপে বমিটাকে সামলাচ্ছিল অর্ক। আর তখনই গাড়িটা এসে দাঁড়াল পাশের রাস্তায়।

ভ্যান থেকে দুতিনজন পুলিস নামল লাফিয়ে। একজন বলল, মনে হচ্ছে শালারা গলিতে ঢুকেছে। ঢুকে দেখব?

মাতাল ফাতাল হবে, ছেড়ে দে।

মাতাল হলে পালাবে কেন?

টর্চের ভারী আলো পড়তে লাগল গলিতে। দেওয়ালের গায়ে। আর তারপরেই দ্রুত ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল। পুলিসগুলো গলির মধ্যে ঢুকে গেছে। অর্ক দেওয়ালের আড়ালে উপুড় হয়ে শুয়ে অনেক কষ্টে বমি সামলাচ্ছিল। এইসময় আলো এসে পড়ল রকের ওপর আর সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার, কে ওখানে?

অর্ক ভিখিরীটার পেটে খোঁচা মারল। ভিখিরীটা বলল, আমি। সরু নাকি গলা। চি চি করছে। সার্জেন্ট চিৎকার করল, নেমে আয়।

ভিখিরীটা উঠবে কিনা ঠাওর করতে পারছিল না কিন্তু অর্ক আবার খোঁচা মারতেই উঠে বসল। তারপর ঘষটে ঘষটে পাঁচিলের আড়াল ছেড়ে নেমে এল ফুটে। সার্জেন্ট তার মুখে টর্চ ফেলে হতাশ হল, যা শালা! আর শোওয়ার জায়গা পাস না?

চি চি করে ভিখিরীটা বলল, এখানেই তো শুই।

তখনই গলি থেকে পুলিসগুলো বেরিয়ে এল, সার, মাল পেয়েছি। এ শালার কাছে খুর ছিল।

সার্জেন্ট এগিয়ে গেল ভিখিরীকে ছেড়ে, এসো চাঁদু, নাম কি?

খুরকির গলা শোনা গেল, মাইরি, আমরা কিছু জানি না, কিছু করিনি আমরা।

করিস নি তো ভাগছিলি কেন? হেভি টেনেছে মনে হচ্ছে। এখানে কি করছিলি? সার্জেন্ট জিজ্ঞাসা করল।

আমরা শ্মশান থেকে আসছি। ভ্যান দেখে ভয় লাগল।

তোর কাছে খুর কেন?

কুড়িয়ে পেয়েছি স্যার।

সার্জেন্ট জিজ্ঞাসা করল, তোর নাম কি?

কিলা। শ্মশান থেকে বাড়ি যাচ্ছিলাম।

তোল শালাদের ভ্যানে। সার্জেন্ট ফিরে যাচ্ছিল। কিলা চিৎকার করল, খুরকিকে তুলুন আমাকে না।

খুরকি? ওর নাম খুরকি?

হ্যাঁ।

আরে এ তো সেই বেলগাছিয়ার মাল। চমৎকার। তুমি কে হে নবাব? তোমাকে তুলব না কেন?

আমি পার্টি করি।

আচ্ছা! বেকায়দায় পড়লে সবাই ওই কথা বলে। ও কি করে? কংগ্রেস?

হ্যাঁ।

তোল ওদের।

একটু বাদেই ভ্যানটা চলে যেতেই ওয়াক ওয়াক করে বমি তুলল অর্ক। এবং যতক্ষণ না শেষ জলটুকু পেট থেকে বের হল ততক্ষণ স্বস্তি পেল না। সে শব্দ শুনে ছুটে এসেছিল ভিখিরীটা, চি চি করে চেঁচিয়ে উঠল, হায় বাপ! আমার বিছানার বারোটা বাজাল। তোমাকে আমি বাঁচালাম আর তুমি আমার সব্বনাশ করলে!

অর্ক উঠে বসেছিল। খুব অবসন্ন লাগলেও শরীর শান্ত হয়েছে এতক্ষণে। সে দেখল রকটা ভেসে গেছে। কোনরকমে নিচে নেমে পকেট থেকে একটা আধুলি বের করে ভিখিরীটার সামনে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে মুখ চোখ পাল্টে গেল লোকটার, বলল, একটা টাকা দাও, তোমাকে বাঁচালাম।

আবার পকেটে হাত ঢুকিয়ে নোট বের করল অর্ক। না, একটাকা তার কাছে নেই। শেষপর্যন্ত দুটো টাকার নোটই এগিয়ে দিয়ে সে ট্রাম রাস্তার ওপর এসে দাঁড়াল। কেউ কোথাও নেই। পুলিস ভ্যানটা কিলাদের নিয়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। সে পিছু ফিরে গলির দিকে তাকাল। ওটা নিশ্চয়ই ব্লাইণ্ড লেন, না হলে ওদের ধরল কি করে!

হঠাৎ সমস্ত শরীরে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল অর্কর। ভাগ্যিস সে গলির মধ্যে যেতে পারেনি তাহলে এতক্ষণ তাকেও ভ্যানে বসতে হত। মা কি থানায় আসতো? না। বাবা? না। শালা মুখ দেখানো যেত না মায়ের কাছে। কিন্তু এত রাত্রে একা একা বেলগাছিয়ায় ফিরবে কি করে সে? বমি হয়ে যাওয়ার পর শরীরটাও আর ঠিক নেই। তাছাড়া এত রাত্রে এই অবস্থায় বাড়ি যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার।

অর্কর খেয়াল ছিল না সে উল্টো দিকে হাঁটছে। হঠাৎ তার মনে পড়েছে যে পকেটে এখন অনেক টাকা আছে, অনেক। ওই ভ্যানটা না এলে টাকাগুলো আর তার পকেটে থাকতো না। কিন্তু এখন সে-ই এর মালিক। ওরা যদি পরে জিজ্ঞাসা করে তাহলে বলে দেবে ছিনতাই হয়ে গিয়েছে। কিংবা নেশার ঝোঁকে পড়ে গেছে। ওদের কতদিন আটকে রাখবে? যত বেশী দিন রাখে ততই মঙ্গল।

বিডন স্ট্রীটের মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল অর্ক। মোড়ের মাথায় একটা সাদা অ্যাম্বাসাডার দাঁড়িয়ে আছে। আর ড্রাইভিং সিটে বসে একটা লোক হাত বের করে তাকে ডাকছে। তাকেই কি? অর্ক আশে পাশে তাকাল। কেউ নেই। সে আবার সামনে তাকাল। লোকটার মতলব কি? পুলিস নয়তো? পুলিসরা কি সাদা অ্যাম্বাসাডারে থাকে? সে ফুটপাথের ওপর উঠে দাঁড়াল। তখন লোকটা দরজা খুলে রাস্তায় পা দিল। অর্ক দেখল লোকটার পা টলছে, ওপরের শরীরটা নড়বড়ে, কোনরকমে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে। যাঃ শালা! লোকটা মাতাল! তাহলে ওর কাছে যাওয়া যায়। অন্তত এই রাত্রে একা একা কোলকাতায় ঘোরার চেয়ে ভদ্রমাতালের সঙ্গ ঢের ভাল। অর্ক পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। এতক্ষণে তার নেশাটা আর নেই বললেই চলে, চোখের দৃষ্টি বেশ সহজ। লোকটার কাছে গিয়ে অর্ক দেখল এ যে সে মাতাল নয়। ঝকঝকে সাদা শার্ট আর টাই, প্যান্টটাও বেশ দামী। কাছাকাছি হতেই ওকে খুঁটিয়ে দেখল লোকটা। দুটো ঠোঁট শক্ত করে চেপা, মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তিনবার দেখে লোকটা বলল, হু আর যু? কে তুমি?

আমি অর্ক।

অর্ক। অর্ক মানে কি? রাতদুপুরে অর্ক? ইয়ার্কি পেয়েছ? তুমি শুকতারা, না হল না, সপ্তর্ষি, নো নট কারেক্ট, তুমি কালপুরুষ। কথাটা খুঁজে পেয়ে যেন খুশি হল লোকটা।

ডাকছিলেন কেন?

ডেকেছি, আমি? ও হ্যাঁ। তুমি কি গুণ্ডা না ছিনতাইবাজ?

কেন?

লজ্জা পেও না, বলে ফেল। আমার কাছে কিছু নেই, সব মিস তৃষ্ণা নিয়ে নিয়েছে। তৃষ্ণাকে চেন? চেন না? ওই যে পার্কটা ওর ওপাশে থাকে। তা ডেকেছিলাম কেন? হ্যাঁ, তুমি আমার গাড়িটাকে একটু ঠেলে দেবে? এই গাড়িটা বাস্টার্ড।

অর্ক বুঝতে পারল। কিন্তু লোকটা কোন দিকে যাচ্ছে? সে বলল, উঠে পড়ুন, আমি ঠেলে দিচ্ছি।

গুড ভেরি গুড। দরজা খোলা রেখেই লোকটা আবার স্টিয়ারিং-এ গিয়ে বসল। গাড়ির পেছনে চলে এল অর্ক। তারপর প্রাণপণে ঠেলতে লাগল গাড়িটাকে। একটু একটু করে নড়তে নড়তে গড়ালো চাকাগুলো। তিন চারবার চেষ্টা করে ইঞ্জিনটা চালু হল। অর্ক ভেবেছিল লোকটা স্পীড তুলে বেরিয়ে যাবে কিন্তু একটু এগিয়ে ব্রেক কষল, এই যে মাই বয়, কাম হিয়ার।

অর্ক এগিয়ে গেল। লোকটা বলল, তোমার নাম কি যেন?

অর্ক।

আবার অর্ক! কালপুরুষ। ইয়েস কালপুরুষ, আমি ভাল করে চোখে দেখতে পাচ্ছি না। তুমি জানো আমি কে?

না।

বিলিতি ডিগ্রি আছে আমার, য়ুনিভার্সিটির ফার্স্ট বয়, ইয়ার্কি মের না। আই অ্যাম নট এ পাতি মাতাল। বিলাস সোম।

আপনি কোনদিকে যাবেন?

লেকটাউন। হোয়াই? লেকটাউন! তাহলে তো বেলগাছিয়া দিয়ে যেতে পারে। সে ঝুঁকে জিজ্ঞাসা করল, আমি বেলগাছিয়ায় যাব, নিয়ে যাবেন?

নো, এতরাত্রে অচেনা অজানা একটা কালপুরুষকে লিফট দিয়ে যদি খুন হয়ে যাই, নো নেভার। লোকটা গাড়িটা ছেড়ে দেবার উপক্রম করল। অর্ক মরিয়া হয়ে চেঁচাল, শুনুন, যাবেন না। আমি আপনাকে খুন করতে যাব কেন? তাছাড়া আমার কাছে কোন অস্ত্র নেই।

পেটে গোঁজা আছে।

নেই, দেখুন। জামা তুলে দেখাল অর্ক।

তুমি ড্রিঙ্ক করেছ?

করেছিলাম।

হুইস্কি?

না, বাংলু।

যা বাব্বা! তুমি তো ছুপা রুস্তম। ছোলা উইদ বাংলু। তাহলে উঠে এসো বাবা, তুমি আমাকে গাইড করবে। মাথা নাড়ল লোকটা।

সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটাকে আধ পাক ঘুরে অর্ক সামনের সিটে উঠে বসল। লোকটা বেশ জোরে গাড়ি চালাতে লাগল। ট্রাম রাস্তার ওপর ভীষণ বেঁকেচুরে যাচ্ছিল, ওপাশ থেকে কিছু এলেই ধাক্কা লাগবে। অর্ক চেঁচিয়ে উঠল, এত জোরে চালাবেন না, আস্তে আস্তে।

লোকটা কোন উত্তর দিল না। মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করছিল আবার যেন কোনক্রমে শক্তি জড়ো করে উঠে বসছিল। দুটো পুলিস কনস্টেবল ব্যাপারটা দেখে চিৎকার করে উঠল। লোকটা তাদের সামনে দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে গেল গাড়ি। অর্ক ওর হাত ধরতে গিয়ে সামলে নিল। যে কোন মুহূর্তে অ্যাক্সিডেন্ট ঘটবে কিন্তু হাত ধরলে এখনই। সে অনুনয় করতে লাগল গাড়িটাকে থামাবার জন্যে। লোকটা হঠাৎ হা হা করে হেসে উঠল, স্পীড মোর স্পীড। আরো জোরে ছুটে যাও। ফাঁক দি টাইম, সময় ডিঙ্গিয়ে যাও।

লোকটা হাসছিল আর পাগলের মত মাঝে মাঝে স্টিয়ারিং থেকে হাত তুলে লাফিয়ে উঠছিল। অর্ক একবার বাইরের দিকে তাকাল। বাড়িগুলো কাছে আসছে আর সরে যাচ্ছে। এই অবস্থায় দরজা খুলে লাফিয়ে পড়লে বাঁচতে হবে না। অথচ আজ বেঁচে থাকার কোন উপায় নেই। এত দ্রুতগতি যে ওর সমস্ত শরীর সিরসির করছিল। বাগবাজার দিয়ে গাড়িটা সোজা আর জি করের মুখে আসতেই আচমকা লাফিয়ে উঠল গাড়িটা। অর্কর মনে হল যে শূন্যে উড়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ধপাস করে সিটে আছড়ে পড়তেই সে ব্রেকে হাত দিল। তিন নম্বরের সামনে দাঁড়ানো গাড়িগুলোর চেহারা দেখে ওর এটুকু জানা ছিল। কিন্তু গাড়ির গতি এত বেশী যে সঙ্গে সঙ্গে দুপাক ঘুরে গেল গাড়িটা। ঘুরে দড়াম করে ধাক্কা মারল পাশের দেওয়ালে। অনেকটা ঘষটে গিয়ে গাড়িটা যখন স্থির হল তখন চারপাশে হই চই পড়ে গিয়েছে। ফুটপাথের ঘুমন্ত মানুষগুলো জেগে উঠে চিৎকার শুরু করে দয়েছে। অর্ক আচমকা আঘাতে মুখ থুবড়ে পড়েছিল লোকটার ওপরে। লোকটার একটা হাত সামনের কাঁচ ভেঙ্গে বেরিয়ে গেছে। মুখটা ড্যাসবোর্ডের ওপরে, শরীর ঝুলছে। কোনক্রমে নিজেকে তুলতে গিয়ে অর্ক দেখল লোকটার বুক পকেট থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে একটা কিছু তার মুখের ওপর ঝুলছে। হাত দিয়ে টেনে নিতে সে দেখল একটা চকচকে হার

ততক্ষণে মানুষজন ছুটে এসেছে। দরজা খুলে ওরা প্রথমে লোকটাকে নামাল। তারপর অর্ককে। অর্কর কনুই এবং কপালে খুব যন্ত্রণা হচ্ছিল কিন্তু রক্ত পড়ছিল না। লোকটা এখন একদম অজ্ঞান। সাদা শার্ট দ্রুত রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছে। লোকগুলো বলল, মরেনি মরেনি। ওরা ওকে কাঁধে তুলে নিল, অর্ককেও ছাড়ল না। অর্ক যত বলে তার কিছু হয়নি তবু শুনল না। এই সময় অর্কর খেয়াল হল ওর হাতের মুঠোয় হারটা ঝুলছে। কোনরকমে সে ওটাকে পকেটে ঢুকিয়ে রাখল।

পাশেই আর জি কর হসপিটাল, পৌঁছাতে দেরি হল না। এমার্জেন্সিতে পৌঁছাতেই লোকটাকে দ্রুত ভেতরে নিয়ে গেল ওরা। অর্ককে ফার্স্ট এইড দিয়ে নাম ধাম জিজ্ঞাসা শুরু করল। লোকটার নাম সে জানে না বলতে গিয়েই আচমকা খেয়াল হল। সে বলল, বিলাস সোম, ইঞ্জিনিয়র, লেকটাউনে থাকেন। তারপর ভেবে নিয়ে জানাল, ব্রেক ফেল করায় অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। নিজের নামধাম ঠিকঠাক বলার পর ওর খেয়াল হল এখনই না হসপিটাল থেকে বাড়িতে খবর দেয়। কিন্তু সেরকম কোন চেষ্টাই দেখা গেল না। যারা পৌঁছাতে এসেছিল তারা ফিরে গেলে সে একা বসে রইল কিছুক্ষণ হাতে মাথায় প্লাস্টার লাগিয়ে। হসপিটালের একজন এসে বলল, পুলিসকে খবর দিয়েছি, তুমি ওর বাড়িতে খবর দিয়ে দাও। কণ্ডিশন সিরিয়াস। ভদ্রলোক ড্রাঙ্ক ছিলেন।

অর্ক মাথা নাড়ল। তারপর ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল বাইরে। কনুইটা কনকন করছে। খোলা আকাশের তলায় আসতেই ঠাণ্ডা বাতাস লাগল। এখন শেষ রাত। কেউ তাকে বাধা দিচ্ছে না। কেউ জিজ্ঞাসা করেনি তার সঙ্গে লোকটার কি সম্পর্ক! হঠাৎ ওর মনে হল, এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া উচিত। যত তাড়াতাড়ি। লোকটা যদি মরে যায় তাহলে পুলিস নিশ্চয়ই তাকে ধরবে। অথচ সে কিছুই জানে না। নিজের নাম ধাম ঠিকঠাক বলার জন্যে খুব আফসোস হচ্ছিল তার।

এইসময় দুটো লোক তার দিকে এগিয়ে এল। একজন একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ আর চাবির রিং এগিয়ে দিয়ে বলল, গাড়িটা গ্যাছে তবু লক করে দিলাম। এই নিন।

অর্ক নিঃসাড়ে হাত বাড়াল। তারপর মাথা নাড়ল। লোকগুলো যেন পবিত্র কর্ম করেছে এমন ভঙ্গীতে চলে গেল। অর্ক দেখল রিং-এ দুটো চাবি। ব্যাগটার মধ্যে কয়েকটা কাগজপত্র এবং বিলাস সোমের ড্রাইভিং লাইসেন্স। লেকটাউনের ঠিকানাটা রয়েছে সেখানে। পকেটে ঢুকিয়ে রাখতে গিয়ে ও হারটার স্পর্শ পেল। নিশ্চয়ই দামী হার অথচ লোকটা বলেছিল তার কাছে কিছু নেই। লোকটা কি তাকে ভয় পেয়েই জোরে গাড়ি চালাচ্ছিল!

ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে আসছিল অর্ক। ভোর হচ্ছে। নিচে মালগাড়ির ইঞ্জিন চলতে শুরু করেছে। হারটাকে ঝেড়ে দেওয়া যায়। কেউ টের পাবে না। হঠাৎ খুব আনন্দ হতেই সে চুপসে গেল। ভদ্রলোক তাকে বলেছিল, ছুপা রুস্তম। কেন? এইজন্যেই কি?

পাড়ার মোড়ে সকাল হওয়া আবধি বসে রইল সে। ক্রমশ পৃথিবীটা আলোকিত হলে মাধবীলতা বেরিয়ে এল গলি থেকে। এই ভোরের আলোয় মাকে দেখল অর্ক। মাথা ঝুঁকে পড়েছে, খুব ক্লান্ত পায়ে হাঁটছে। পরনের শাড়িটা আধময়লা, ব্যাগটা বুকের কাছে ধরা। কোনদিকে না তাকিয়ে মাধবীলতা ট্রাম স্টপে গিয়ে দাঁড়াতেই অর্ক গলিতে ঢুকে পড়ল।

নিমুর দোকানের সামনে বেশ ভিড়, সে চুপচাপ তিন নম্বরে পা বাড়াল, অনুদের ঘর বন্ধ। মোক্ষ বুড়ি জিজ্ঞাসা করল, কে যায়? সাড়া দিল না অর্ক। নিজেদের ঘরের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিঃশ্বাস ফেলল। খুব ভয় করছিল তার। কাল সকাল থেকেই সে ঘরের বাইরে। এরকম কখনো হয় নি। বাবা নিশ্চয়ই খুব রেগে আছে।

সে দরজা ঠেলে ঢুকতেই দেখল অনিমেষ বিছানায় বসে, কোথায় ছিলি?

মড়া পোড়াতে গিয়েছিলাম।

সেখানেই থেকে গেলি না কেন?

অর্ক কোন জবাব দিল না। হাত বাড়িয়ে গামছা নিয়ে ফের যখন বের হতে যাচ্ছে তখন অনিমেষ চিৎকার করল, কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন?

চাপা দাঁতে অর্ক বলল, যাকে দেবার তাকে দেব। তুমি আমাকে খাওয়াও না পরাও যে জিজ্ঞাসা করছ?

০৬. কল-পায়খানা নিয়ে অর্ক

কল-পায়খানা নিয়ে অর্ককে ঝামেলায় পড়তে হয় না। লাইন দিয়ে অপেক্ষা করার ধাত তার নেই। ইদানীং লাইনভাঙ্গা নিয়ে কেউ মুখে কিছু বলে না, তিন নম্বরের কয়েকজনের ক্ষেত্রে এটাই স্বাভাবিক বলে সবাই মেনে নেয়। এর ওপর আজ ওর মাথা এবং কনুইতে প্লাস্টার বাঁধা থাকায় স্বাভাবিকভাবে সে অগ্রাধিকার পেল। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়ার পর ঘরে ফেরার সময় অর্ক অনুকে দেখতে পেল। অনুদের ঘরের দরজা এখন খোলা। অনুর বাবা ঘরের মেঝেতে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে, দুটো ভাইকে নিয়ে অনু দরজায় ঠেস দিয়ে বসে। ন্যাড়া নেই। অনুর মুখ পাথরের মত, কি ভাবছে বোঝা মুশকিল।

যেতে গিয়েও অর্ক দাঁড়াল, কাল কখন ফিরেছ?

অনু মুখ তুলল, এগারটা। তারপরই সে দেখতে পেল, কি হয়েছে কপালে?

অ্যাকসিডেন্ট।

অনু বলল, তোর মা কাল অনেকবার খুঁজতে এসেছিল।

ও। তুমি কি বললে?

তোরা তো অনেক আগেই শ্মশান থেকে চলে এসেছিলি।

হুম। অর্ক বুঝল মায়ের কাছে আর মিথ্যে বলা যাবে না। অনুপমার ওপর তার খুব রাগ হয়ে গেল। সে বেশ শক্ত কথা বলতে যাচ্ছিল এমন সময় অনুর ভাই বলে উঠল, দিদি, খিদে পেয়েছে।

অনু ঝাঁঝিয়ে উঠল, কতবার বলব আমার কাছে পয়সা নেই।

বাচ্চাটার মুখ দেখে জিভ সামলে নিল অর্ক, কিছু খাওনি?

মাথা নাড়ল অনু, বাবার কাছেও পয়সা নেই।

পকেটে হাত ঢুকিয়ে টাকাগুলো বের করল অর্ক। কাল মাল খাওয়ার পরও প্রচুর টাকা ওর কাছে রয়েছে। একবার মনে হল পুরোটাই অনুর হাতে তুলে দেওয়া উচিত। এ টাকা ন্যায্যত ওদেরই। কিন্তু পরক্ষণেই আর একটা মন রাশ টেনে ধরল। সে দুটো দশ টাকার নোট অনুর দিকে বাড়িয়ে ধরল, এটা রাখ।

বিস্মিত অনুপমা ওর মুখের দিকে তাকাতে অর্কর অস্বস্তি হল, ধরো ধরো, ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে কি হবে। নোট দুটো অনুপমার কোলে একরকম ফেলে দিয়েই সে ঘরে ঢুকল।

অনিমেষ তেমনি বসে আছে খাটের মাঝখানে। গামছা দড়িতে ঝুলিয়ে দেওয়ালে লটকানো আয়নায় চুল আঁচড়াতে গিয়ে আড় চোখে বাবাকে দেখল অর্ক। এই মুখ সে কখনও দ্যাখেনি। ঠোঁট টেপা, চোখ বন্ধ। ওই মুখের দিকে তাকিয়ে অর্কর মনে হল তখন ওইভাবে কথাটা বলা ঠিক হয়নি। আসলে বাবা তখন এমন টিকটিক করছিল যে–! অর্ক একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করল, চা খেয়েছ?

অনিমেষ জবাব দিল না। অর্ক ঘরের কোনায় তাকিয়ে বুঝল স্টোভ জ্বালানো হয়নি, মা আলু ডিম বের করে দিয়ে যায়নি আজ। সে আবার জিজ্ঞাসা করল, তোমার জন্যে চা আনবো?

না।

কেন? চা খাওনি তো।

অনিমেষ ছেলের দিকে মুখ ফেরালো, তোর সঙ্গে কথা বলতে আমার প্রবৃত্তি হচ্ছে না। আমাকে একটু একা থাকতে দে।

সারাদিনই তো একা আছ।

এবার অনিমেষ উত্তেজিত হয়ে উঠল, তার গলার শিরা ফুলে উঠছিল, কি করতে চাস তুই? আমাকে মেরে ফেলবি? ফ্যাল, আমি আর সহ্য করতে পারছি না।

বাবার এইরকম মূর্তি দেখে অর্ক একটু ঘাবড়ে গেল, যাব্বাবা, এরকম করছ কেন? আমি তোমাকে কি বলেছি?

কি বলেছিস? আশ্চর্য, তুই কি বলেছিস তা জিজ্ঞাসা করছিস?

হ্যাঁ, আমি তো অন্যায় কিছু বলিনি?

অনিমেষ এবার হতভম্ব চোখে ছেলের দিকে তাকাল। অর্ক চোখে চোখ রাখল না, আমাদের সংসারে রোজগার করে মা, সে কথাই বলেছিলাম। এটা কি মিথ্যে কথা?

আফসোসে বিছানায় চাপড় মারল অনিমেষ, তারপর যেন নিজেকেই বলল, না, সত্যি কথা।

তাহলে এত রেগে যাচ্ছ কেন?

কি বলবে অনিমেষ? কানাকে কানা কিংবা অন্ধকে যে অন্ধ বলতে নেই সেই কৃপা চাইবে? নিজের ছেলেকে বোঝাবে এগুলো সৌজন্যে বাধা উচিত! না, করুণা নয়। তাহলে সে এত দুঃখিত হল কেন কথাটা শুনে, কেন রাগে অন্ধ হল? বাবা হিসেবে ছেলের কাছে সে কি চেয়েছিল?পুরোনো মূল্যবোধ? অর্ক তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কথা খোঁজার চেষ্টা করল, আমি রোজগার করতে পারি না কেন?

তোমার পায়ের জন্যে।

তবে?

কি তবে?

তাহলে আমি তোদের খাওয়াবো কি করে?

ওটা কোন কথা হল না। তুমি তো তবু দাঁড়াতে পারো, হাঁটতে পারো ক্রাচ নিয়ে, দু পা নেই এমন লোকও রোজগার করে আজকাল।

অর্ক নির্বিকার মুখে বলল। ঈশ্বরপুকুর লেনের মুখে ট্রাম রাস্তার গায়ে একটা লোকের সিগারেটের দোকান আছে যার দুটো পা নেই, লোকটার কথা বলার সময় ভেবে নিল সে।

অনিমেষ বলল, ঠিক আছে। তুই যখন বলছিস তখন নিশ্চয়ই চেষ্টা করব কিছু রোজগার করতে। আসলে তোর মা কখনো চায়নি যে আমি এই শরীর নিয়ে কিছু করি। ভালই হল, তুই মুখের ওপর সত্যি কথাটা বললি।

অর্ক বলল, এত যদি বুঝতে পারছ তাহলে রাগ করলে কেন?

সে তুই বুঝবি না।

কেন?

বুঝলে একথা বলতিস না।

অর্ক কাঁধ নাচাল। তারপর কেটলিটা তুলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। অনিমেষ লক্ষ্য করল আজ চা নিয়ে আসতে যাওয়ার সময় অর্ক তার কাছে পয়সা চাইল না। ও পয়সা পেল কোত্থেকে তা সে ভেবে পাচ্ছিল না।

অর্কর কপাল এবং কনুই-এর প্লাস্টার অনিমেষ দেখেছে। ও দুটো কেন কিংবা কি করে হল তা জিজ্ঞাসা করেনি। প্রচণ্ড অপমানে সাময়িক অন্ধ হয়ে গিয়েছিল সে। এখন মনে হল কথাটা। মড়া পোড়াতে গিয়ে কারো কপালে আঘাত লাগে না। কাল মাঝরাতে মাধবীলতা খবর পেয়েছিল ওরা দল বেঁধে শ্মশান ছেড়ে চলে গিয়েছে। একথাও শুনেছে ওখানকার এক মাস্তানের সঙ্গে অর্কর ঝামেলা বেধেছিল। খবরটা নিয়ে এসে মাধবীলতা মাটিতে ধপ করে বসে বলেছিল, একি আমাদের ছেলে?

এমন একটা বিষাদ জ্বালা এবং অপমান ছিল স্বরে যা একমাত্র মায়েদের গলাতেই আসে বলে মনে হয়েছিল অনিমেষের। সে নিজে খবরটা শুনে উত্তেজিত হয়েছিল, সেকি! ওর কিছু হয়নি তো?

মাধবীলতা মুখ ফিরিয়েছিল, মানে?

অনিমেষ বলেছিল, খোকা তো কখনও মারামারি করেনি, ওই ছেলেদের বিশ্বাস নেই।

মাধবীলতা বলেছিল, আজকাল আর কেউ একা একা মারামারি করে না, দল বেঁধে করে। তোমার ছেলে যাদের সঙ্গে রয়েছে তারা অনেকেই জেলের ভাত খেয়েছে। ওর কিছু হবে না।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কারা আছে সঙ্গে? বিলু?

একা বিলু কেন হবে? খুরকি, কোয়া, কিলা। নামগুলো দেখে বুঝতে পারছ না চরিত্র কি? কোন ভদ্রছেলের এরকম নাম হয়? তোমার ছেলের প্রাণের বন্ধু এরাই। মাধবীলতা নিঃশ্বাস ফেলল।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, আমি বুঝতে পারি না ও কি করে ওদের সঙ্গে মেশে। রুচি পর্যন্ত হারিয়ে গেল এখানে থেকে? অথচ ওকে আমরা ছেলেবেলায় যা শিখেছি তাই শিখিয়েছিলাম।

মাধবীলতা উঠল, যা হবার তাই হয়েছে। আজ রাত্রে ও ফিরলে আমি ঢুকতে দেব না।

সেই সময় অনিমেষের মনে পড়েছিল আজ সকালে অর্ক ঘুমের ঘোরে তাকে কি বলেছিল। কথাটা মাধবীলতাকে বলতে গিয়েও পারল না সে। নিজের কষ্টের বোঝ ওর কাঁধে চাপিয়ে কুঁজো করে কি লাভ। কিন্তু কাল সারারাত ওরা ঘুমুতে পারেনি। অনিমেষ প্রতি মুহূর্তে আশা করেছিল দরজায় শব্দ হবে। তার পর একসময় ভোর হল, মাধবীলতা উঠল। নির্লিপ্তের মত কাপড় পাল্টে স্কুলে চলে গেল। বেচারা আজ এত অন্যমনস্ক ছিল যে চায়ের কথাও খেয়াল ছিল না। অথচ আজ সকালে ছেলে যখন ফিরল তখন তার কোন অন্যায় বোধ নেই। ওই বয়সে জলপাইগুড়ির বাড়িতে সারারাত না ফেরার কথা সে চিন্তাও করতে পারত না। অনিমেষ অনেক চেষ্টায় নিজেকে সংযত স্থির করছিল। না, মাথা গরম করে কোন ফল হবে না।

চা নিয়ে অর্ক ঘরে ঢুকল। নিমুর দোকানে আজ তাকে সবাই খাতির করেছে। কপাল এবং হাতের প্লাস্টার দেখে অনেকেই অনেক রকম কল্পনা করছিল কিন্তু সে সত্যি কথাটা বলেনি। মারপিট যে হয়েছিল এ বিষয়ে সবাই নিঃসন্দেহ কারণ কিলা আর খুরকি এখনও পাড়ায় ফেরেনি। দু-একজন তাকে জিজ্ঞাসা করলেও সে এড়িয়ে গেছে।

কাপে চা ঢেলে বাবার দিকে এগিয়ে দিতেই সে প্রশ্নটা আবার শুনল, কি হয়েছে তোর কপালে?

কিছু না।

কিছু না মানে? সত্যিকথা বলতে তোর অসুবিধে হয় কেন?

অসুবিধে হচ্ছে কে বলল?

মুখে মুখে তর্ক করছিস। কেউ শখ করে ওসব শরীরে লাগায় না।

চায়ে চুমুক দিয়ে অর্ক বলল, অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল।

অ্যাকসিডেন্ট? কি করে? চমকে উঠল অনিমেষ।

শ্মশান থেকে ফেরার সময়। অর্ক মুখ তুলে বাবাকে দেখল। তার পকেটে এখনও লাইসেন্স এবং হার রয়েছে। বাবাকে বলবে নাকি সব কথা? ধুস, বললেই নানান ফ্যাচাং তুলবে। কিন্তু একজন চাই যার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করা দরকার। এসবের প্রয়োজন হতো না যদি হসপিটালে নিজের ঠিকানাটা সে না দিত। সে আবার বাবার দিকে তাকাল।

তুই মিথ্যে কথা বলছিস।

মিথ্যে কথা?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই কারো সঙ্গে মারামারি করেছিস। তোর মা ঠিকই বলেছে, গুণ্ডাদের সঙ্গে মিশে মিশে।

কি আঙ সাঙ বলছ। আমি বলছি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে আর তুমি সেটা বিশ্বাস করছ না। খেপে গেল অর্ক।

না। কোন প্রমাণ আছে?

আর জি কর হসপিটালে যাও তাহলে জানতে পারবে। তারপর দ্রুত পকেট থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স আর হারটা বের করে বলল, আমি মিথ্যে বলছি, না?

এগুলো কি? অনিমেষ বিস্ময়ে জিনিসগুলো দেখল।

ওই ভদ্রলোকের জিনিস।

কোন ভদ্রলোক?

অর্ক বাবার দিকে তাকাল। যাচ্চলে। রেগে গিয়ে যা বলেছে এখন আর তা থেকে ফেরার পথ নেই। ঠিক আছে, বলেছে যখন তখন পুরোটাই বলবে। হঠাৎ তার মাথায় আর একটা চিন্তা খেলে গেল। গতরাত্রে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল বলে সে বাড়িতে ফিরতে পারেনি এটা যদি বাবাকে ভাল করে বোঝানো যায় তাহলে মায়ের মেজাজ ঠাণ্ডা করা যাবে। সে এই সুযোগ ছাড়ল না।

যার গাড়িতে আমি আসছিলাম। গাড়িটা আর জি কর-এর কাছে এসে প্রচণ্ড অ্যাকসিডেন্ট করেছে। আমার তেমন কিছু হয়নি কিন্তু ওঁর অবস্থা খুব খারাপ। অর্ক খুব বাঁচিয়ে বলার চেষ্টা করছিল।

অনিমেষকে খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিল এখন। ছেলের হাত এবং মুখের দিকে ভাল করে লক্ষ্য করে সে নিঃসন্দেহ হল আঘাত তেমন নয়। মারামারি করলে কনুইতে লাগাবে কেন। কিন্তু অর্ক কি করে সেই ভদ্রলোকের গাড়িতে উঠল।

ভদ্রলোকের নাম কি?

বিলাস, লেক টাউনে থাকে।

তুই চিনলি কি করে?

চিনি না তো।

চিনিস না তাহলে গাড়িতে উঠলি কি করে?

অর্ক চটপট নিজের মাতাল হওয়ার প্রসঙ্গটা বাদ দিল। বলল, নিমতলা থেকে ফেরার সময় আমি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম। সামনে একটা গোলমাল বাধায় ওরা যে যার সরে পড়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে বিডন স্ট্রীটে এসে দেখি এক ভদ্রলোক-এর গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে। আমাকে ঠেলতে বললেন। গাড়ি স্টার্ট হলে জিজ্ঞাসা করলেন আমি কোথায় যাব? বেলগাছিয়া শুনে গাড়িতে উঠতে বললেন। তারপর গল্প করতে করতে আসছিলাম আমরা। হঠাৎ একটা গাড়ি সামনে এসে পড়ায় অ্যাকসিডেন্ট হয়ে গেল। রাস্তার লোকজন আমাদের আর জি করে নিয়ে গিয়েছিল। ওখানেই সারা রাত ছিলাম।

কথাগুলো বলতে বলতে অর্ক লক্ষ্য করছিল বাবার মুখের চেহারা বেশ নরম হয়ে আসছে। তারপর একটু ভেবে বলল, কাউকে দিয়ে যে তোমাদের খবর পাঠাব তারও কোন উপায় ছিল না।

অনিমেষ বলল, অজানা অচেনা লোকের গাড়িতে ওঠা ঠিক নয়। কিছু হলে তো আমরা খবরও পেতাম না। এখন কেমন লাগছে?

মাথাটা একটু ভার ভার লাগছে। অর্ক সত্যি কথাটাই বলল।

অনিমেষ বলল, খোকা, এদিকে আয়।

গলার স্বর হঠাৎ পাল্টে গেল বলে অর্ক অবাক হল। ওরা যে মাল খেয়েছিল সে খবর বাবা জানে নাকি। তাহলে তো পুরোটাই ভেস্তে যাবে। সে চোখ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল, কেন?

কাছে আয় বলছি।

ভয় এবং সন্দেহ নিয়ে অর্ক বিছানার কাছে এল। অনিমেষ খাটের একটা কোণ দেখিয়ে বলল, ওখানে বস।

কি বলবে বল না। অর্ক বসল কিন্তু গলার স্বর পাল্টাল না।

তোকে আমি আমার দাদুর কথা বলেছি, আমার বাবার কথা, তোর মায়ের কথা এমন কি যে জন্যে আমি নিজের কেরিয়ারের কথা না ভেবে আন্দোলনে নেমেছিলাম, সেই সব। তোর মনে কি একটুও রেখাপাত করেনি?।

কেন?

তুই আমাদের ছেলে, তোর পেছনে এই সব ঘটনা আছে, এগুলো ভাবলেই মানুষ নিজেকে স্থির করে, কিন্তু…’

কি বলবে বলতো?

অনিমেষ ছেলের দিকে তাকাল, ওই কিলা খুরকিদের সঙ্গ তোকে ছাড়তে হবে খোকা।

কেন?

তুই আবার প্রশ্ন করছিস? সত্যি কি তুই কিছু বুঝতে পারিস না। তোর সঙ্গে ওদের যে কোন মিল নেই তাও অনুভব করিস না?

অর্ক মাথা নাড়ল, তোমরা ওদের পছন্দ কর না বলে এসব বলছ।

কেন পছন্দ করি না?

ওরা বেশী পড়াশুনা করেনি, আড্ডা মারে তাই।

মোটেই না। ওদের মধ্যে কোন সুস্থ বোধ নেই তাই।

সেটা কি ওদের দোষ?

কার দোষ তা বিচার করে তোর কি হবে? তুই পড়াশুনার সুযোগ পাচ্ছিস, মন দিয়ে তাই কর।

অর্কর ঠোঁটের কোণ ভাঙ্গল, তারপর?

অনিমেষ এই প্রশ্নটা আশা করেনি। সে ছেলের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, তারপর শিক্ষিত হয়ে যেটা ভাল লাগবে তাই করবি। তখন আমরা তোকে কিছু বলতে যাব না। এই বয়সে কতগুলো হুলিগানের সঙ্গে আড্ডা মেরে মারামারি করে নিজেকে নষ্ট করবি কেন? ওদের দেখতে পাসনা? মদ খায় আর সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক করে। আর একটু বয়স হলে কি হবে।

মদ তো শিক্ষিত লোকরাও খায়।

খায় কিন্তু সবাই খায় না। যারা খায় তারা সেটাকে মানাতে পারে। তোর মতন বয়সে আমি এসব ভাবতে পারতাম না।

তুমি বস্তিতে থাকতে না। তাছাড়া, তুমি শিক্ষিত হয়ে শেষ পর্যন্ত কি করছ? কত বি এ এম এ বেকার বসে আছে। ওই তো প্রণবদা, এম এ পাশ, চাকরি পায়নি বলে রকে আড্ডা দেয়।

ঠিকই। আমরা চেষ্টা করেছিলাম এই ব্যবস্থাটাকে ভাঙ্গতে। হাজার হাজার ছেলে আন্দোলনে নেমেছিল। পুলিসের গুলিকে তোয়াক্কা করেনি। আমাদের আফসোস যে আমরা পারলাম না। কিন্তু একটা সান্ত্বনা যে আমরা তো চেষ্টা করেছিলাম। তুই আমাদের সঙ্গে তাদের তুলনা করছিস? হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল অনিমেষ।

অর্ক মাথা নাড়ল, দূর। শেষ পর্যন্ত তোমার সঙ্গে একটা বেকার লোকের কোন পার্থক্য নেই। যে থার্ডের মধ্যে আসতে পারেনি তার সঙ্গে লাস্টের কি তফাত? তোমরা, মা, দিনরাত বল বলে আমি পড়ি নাহলে আমার পড়তে একটুও ভাল লাগে না।

ভাল লাগে না?

না। অশোক কি করেছিল, রবীন্দ্রনাথের প্রার্থনা কবিতাটা মুখস্থ করে আমার কি হবে?

তোর কি ভাল লাগে?

জানি না।

না। জানি না বললে চলবে না। খোকা, তুই অন্তত বারো ক্লাসটা পাশ কর তারপর যা ইচ্ছে করবি। অনিমেষ অনুনয় করল।

অর্ক প্রতিবাদ করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত মাথা নাড়ল। সেটা হ্যাঁ কি না তা বোঝা গেল না। তারপর বলল, আসলে তোমরা এই বস্তির ছেলেদের ঘেন্না কর।

ঘেন্না করি?

হ্যাঁ। নইলে মা ওদের সঙ্গে মেশে না, কথাও বলে না। তুমি শুধু উনুন সারাই-এর দোকান ছাড়া কোথাও যাও না, কেন?

এদের সঙ্গে আমাদের মনের সঙ্গে মেলে না তাই, ঘেন্না নয়।

কেন মেলে না? আমার বন্ধুদের বাবা মা তো খিস্তি করে না।

তুই এখন বুঝবি না। ক

তোমার ওই এক কথা, তুই বুঝবি না। বোঝার জিনিস কেন আমি বুঝব না? সেদিন কোয়া বলছিল ওরা নাকি উদ্বাস্তু। ওদের পাকিস্তানে অনেক কিছু ছিল। বাবা মা এখানে পালিয়ে আসার পর কোয়া হয়, তাই ও কিছু দ্যাখেনি। ওর বাবা মা নাকি এখনও আফসোস করে কিন্তু কোয়া করে না। কেন করে না সেটা আমি বুঝতে পারি না? অর্ক উঠল। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়াতে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, ফাক্ দি টাইম কথাটার মানে কি?

অনিমেষের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। এই বস্তির ছেলেদের মুখ থেকে ছিটকে আসা অশ্রাব্য গালাগালি বাধ্য হয়ে দিনরাত তাকে শুনতে হয় কিন্তু এই ইংরেজি খিস্তিটি তো অর্কর জানার কথা নয়। সে নিজেকে সংযত করল অনেক কষ্টে। তারপর সূত্র খোঁজার জন্যে জিজ্ঞাসা করল, কেন?

কাল রাত্রে সেই ভদ্রলোক গাড়ি চালাতে চালাতে কথাটা বলেছিল। আমি মানে বুঝতে পারিনি।

ও। কথাটা গালাগালি। কিন্তু সেই লোকটা বলল কেন

জানি না। নিজের মনেই বলছিল। কি গালাগালি?

খুব নোংরা।

খিস্তি?

হ্যাঁ।

যাঃ

এসব নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না। তুই আজ স্কুলে যেতে পারবি? শরীর কেমন লাগছে?

ঘুম পাচ্ছে খুব।

বেশ, তাহলে আজ স্কুলে যেতে হবে না। মানটান করে ঘুমিয়ে নে।

অনিমেষের কথাটা বেশ মনঃপূত হল অর্কর। সত্যি ওর শরীরে এখন অবসাদ, মাথা ঝিমঝিম করছে। কিন্তু একটা কথা সে বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও করল না, ফাঁক দি টাইম কি ধরনের খিস্তি। কিলারা যা বলে সেই রকম কি? তাই যদি হয় তাহলে শিক্ষিত মানুষের সঙ্গে কিলার প্রভেদ নেই। কিন্তু ততক্ষণে অনিমেষ খাট থেকে ক্র্যাচ নিয়ে নেমে পড়েছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘরের কোণে গিয়ে তরকারির ঝুড়িটা তাক থেকে নামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুই বরং স্নান করে খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়। আমি স্টোভ ধরিয়ে দিচ্ছি।

অর্ক বলল, এখন কেউ ভাত খায় নাকি? মা আসার আগে রান্না করো। কথাটা বলেই ওর খেয়াল হল মাধবীলতার কথা। মাকে বাবা যদি ম্যানেজ করে তাহলে ভাল হয়। কিন্তু সরাসরি কথাটা বলতে আটকালো ওর। তবে এতক্ষণে এটুকু বোঝা যাচ্ছে বাবা নিশ্চয়ই মাকে তার হয়ে বলবে। অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল শুনলে মা কিছু না-ও বলতে পারে।

শোওয়ার তোড়জোড় করছিল অর্ক। ক্র্যাচ বগলে নিয়ে দরজা ভেজিয়ে বেরিয়ে গেল অনিমেষ। মাদুর পেতে চিৎ হয়ে শুতেই খুব আরাম বোধ হল। আঃ, কতদিন যেন শোয়নি সে। প্যান্টটা ছাড়তেও ইচ্ছে করছে না। গত সকাল থেকে এটা পরে আছে সে। শালা, কাল অল্পের জন্যে জান যায়নি। আর একটু বেকায়দায় পড়লে চোট হয়ে যেত। মাতাল হয়ে লোকটা ইংরেজিতে খিস্তি করছিল কেন? বিলাস সোম। নামটা দারুণ। কিন্তু এতক্ষণে হাওয়া হয়ে যায়নি তো? মরে গেলে খবর পাবে কি বাড়ির লোকজন? লেক টাউন বিরাট জায়গা, পুলিস বের করতে পারবে খুঁজে? হসপিটাল থেকে বলেছিল খবর দিতে। দামী হার আর লাইসেন্সটার কথা মনে পড়ল ওর। তড়াক করে উঠে বসে সে খাটের ওপর থেকে সেগুলোকে নিজের কাছে নিয়ে আনল। হারটা বেশ ভারী। লকেটটা কিসের বুঝতে পারল না তবে বেশ দামী বলে বোধ হল। চেপে গেলে কেমন হয়! সে তো আর এই মালটা চুরি করেনি। লোকটার পকেট থেকে আপনিই তার হাতে চলে এসেছিল। তাছাড়া লোকটা যদি টেসে যায় তাহলে কেউ জানতেও পারবে না। শুধু তখন উত্তেজনার মাথায় বাবাকে এটা দেখিয়ে ফেলেছে সে। অবশ্য বাবাকে বলে দেওয়া যাবে যে হার সে ফেরত দিয়ে এসেছে। অর্ক ঠিক করল, দুপুরবেলায় একবার হসপিটালে গিয়ে খোঁজ নেবে লোকটা বেঁচে আছে কিনা, সেই বুঝে কাজ করা যাবে।

দরজায় কড়া নড়ে উঠতেই চমকে গেল অর্ক। দ্রুত হারখানা পকেটে ঢুকিয়ে রাখল সে। কে এল? হসপিটাল থেকে তাকে খুঁজতে আসেনি তো! সে দ্রুত চোখ বোলালো চারধারে, হারখানা কোথায় লুকিয়ে রাখা যায়? আর তখনই ডাক শুনতে পেল, অক্ক।

গলাটা চেনা কিন্তু ধরতে পারল না অর্ক। দ্বিতীয়বার ডাকটা কানে আসতেই সে সাড়া দিল, কে?

বাইরে থেকে ঠেলতেই দরজা খুলে গেল। অর্ক দেখল বিলু এসে দাঁড়াল দরজায়। উঠে বসল অর্ক, কি বে?

বিলুর দুই হাত কোমরে। ওর দিকে তাকিয়ে বলল, এর মধ্যেই ডানা গজিয়ে গেল তোর অক্ক। আমাকে ল্যাং মারতে চাস?

মানে?

মানে টানে বুঝি না, টাকা দে। হাত পাতল বিলু ঘরে ঢুকে।

কিসের টাকা?

শালা আমি তোমার কাছে মারাতে এসেছি? ন্যাড়ার মায়ের টাকা তোর কাছে কত আছে তার হিসেব আমি জানি। টাকাটা দে টিকিট তুলতে হবে নটার সময়। অধৈর্য হচ্ছিল বিলু।

অর্ক উঠে দাঁড়াতেই বিলু প্লাস্টার দেখতে পেল, কি হয়েছে বে তোর। ঝাড়পিট করেছিস?

না। অ্যাকসিডেন্ট। খুব জোর বেঁচে গেছি।

খুরকি কিলা কোথায়?

পুলিস তুলে নিয়ে গিয়েছে। টাকাটার জন্যে ওরা মারপিট শুরু করেছিল। বিশ্বাস কর বিলু, আমি তখন এমন আউট হয়ে গিয়েছিলাম যে ওরা যখন আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল আমি টের পাইনি।

কি করে অ্যাকসিডেন্ট হল?

গাড়িতে। এক ভদ্রলোককে ধরে বাড়িতে ফিরছিলাম। সেই লোকটা হাসপাতালে শুয়ে আছে। এই দ্যাখ লোকটার ড্রাইভিং লাইসেন্স।

মরে গেছে?

জানি না।

বাড়িতে খবর দিয়েছিস?

না। খবর দিতে বলেছিল, দিইনি। লেক টাউনে বাড়ি

দুর বে। তুই শালা বুদ্ধ। কত টাকা আছে তোর কাছে?

যা ছিল তার থেকে কুড়িটা টাকা ন্যাড়ার দিদিকে দিয়েছি। পকেট থেকে টাকাটা বের করে গুনল অর্ক। তারপর অঙ্কটা বলে জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু তোকে আমি এই টাকা দেব কেন?

টাকাটা দেখার পর বিলুর চেহারাটা বদলে গেল। সে বলল, বাইরে চল, তোর সঙ্গে কথা আছে।

না আমি বাইরে যাব না আমি ঘুমাব।

ফোট ঘুমাবার সময় অনেক পারি।

ঘরে কেই নেই।

তোর বাপ শালা উনুনের কারখানায় বসে আছে।

কি করবি বল না?

শোন, খুরকি কিলা ওই টাকা চাইবেই। আমরাও কিছু কমতি না। ওরা আসার আগেই টাকাটা খাঁটিয়ে দুজনে রোজগার করে নিই চল। ফিফটি ফিফটি।

কিভাবে?

বললাম না, টিকিট তুলব। আজ অ্যাডভান্স দেবে সিনেমার। সুপার হিট ছবি। খুরকির সঙ্গে লাইন আছে হলের। খুরকি যদি না আসতে পারে আমরা ওর মালটা নিয়ে নেব।

খুরকি কিছু বলবে না?

ওতো আজ না এলে কিছুই পেত না তবু আমরা দশ বিশ দিয়ে দেব। দু টাকা পঁয়তাল্লিশ আট টাকায় যাচ্ছে। চল, আর দেরি করিস না।

দূর। আমি ব্ল্যাক টল্যাক করতে পারব না।

তাহলে মালটা ছাড়।

তোকে দেব কেন?

ওসব নকশা ছাড় গুরু। হয় দাও নয় চল।

ঠিক আছে, কিন্তু আমি সামনে যাব না

আচ্ছা।

জামা গলিয়ে ও যখন বের হচ্ছে তখন বিলু বলল, আ বে, ওই লাইসেন্সটা সঙ্গে নে।

কেন?

লেক টাউনে যাব। লোকটার বাড়িতে খবর দিয়ে আসি চল

অর্ক বিলুর দিকে তাকাল তারপর ওটা নিয়ে নিল পকেটে। দরজা ভেজিয়ে উনুনের কারখানার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় অর্ক অনিমেষকে দেখতে পেল। ঘুমন্ত ছেলেকে উঠে আসতে দেখে অনিমেষের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছিল। যেতে যেতেই অর্ক বলল, লোকটা মরে যেতে পারে তাই ওর বাড়িতে খবর দিতে যাচ্ছি।

বাবার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যে ও মুখ ফেরাল না। ঈশ্বরপুকুর লেনে পা দিয়ে সে গম্ভীর গলায় বলল, ফাক্ দি টাইম।

বিলু অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল, কি বলছিস বে?

অর্ক হাসল, তুই বুঝবি না। এটা ইংরেজি খিস্তি।

০৭. বেলগাছিয়া থেকে সেকেণ্ড ক্লাস ট্রামে

বেলগাছিয়া থেকে সেকেণ্ড ক্লাস ট্রামে চেপে ওরা হাতিবাগানে চলে এল। এতক্ষণে অর্কর শরীর ম্যাজম্যাজ করছে, দুচোখ ভারী। মনে মনে বিলুর ওপর ভীষণ চটে যাচ্ছিল ও। হাতিবাগানে নেমে বিলু বলল, ওস্তাদ, পেটে একটু চা ঢেলে নিই চল।

প্রথম প্রথম এই ওস্তাদ কিংবা গুরু সম্বোধনে অস্বস্তি হত অর্কর। পরে বুঝেছে ওগুলো কথার মাত্রা, কোন মানে না করেই বলা হয়। দুই অক্ষরের যে শব্দটি পুরুষাঙ্গের পরিচয় তাও ওরা ব্যবহার করে অসাড়ে। কোন মানে হয় না কিন্তু কথা বলার সময় ওই ব্যবহার বেশ জোর আনে। কথাটা কখনও ব্যবহার করতে পারেনি অর্ক। জিভে যেন আটকে যায়। ও বিলুর দিকে তাকাল। ওদের দলটায় বিলুকেই সবচেয়ে বুদ্ধিমান বলে মনে হয়। চট করে রাগে না কিন্তু কাজ গোছাতে পারে। বাবা চায় না এদের সঙ্গে সে মেশে। শুধু খিস্তি করা ছাড়া বিলুর আর কোন দোষ নেই। অন্তত খুরকি কিংবা কিলার থেকে বিলু অনেক ভাল। এদের সঙ্গে সে মিশছে বছর তিনেক। গত বছর থেকে ঘনিষ্ঠ। হাঁটতে হাঁটতে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, তুই কখনও জেল খেটেছিস?

বিলু আচমকা প্রশ্ন শুনে বেশ অবাক গলায় বলল, কেন বে?

এমনি জিজ্ঞাসা করছি।

থানায় গিয়েছিলাম তিনবার, কোর্টে যেতে হয়নি।

ম্যানেজ করেছিলি?

ম্যানেজ না করলে চলে গুরু?

বাঁদিকের একটা গলির মুখে ভাঁড়ের চায়ের দোকান। তার বেঞ্চিতে বসল ওরা। চায়ে চুমুক দিয়ে ভাল লাগল অর্কর। ও হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, তোর দেশ কোথায় ছিল বে?

পাকিস্তান।

দূর বে, বাংলাদেশ বল।

বাবা বলে পাকিস্তান; ওসব দিয়ে কি দরকার?

না, জিজ্ঞাসা করছি। তুই দেখেছিস?

ফোট! আমি শালা এখানে পয়দা হয়েছি। তবে বাবা হেভি গুল মারে, এই ছিল তাই ছিল। মাইরি জন্মাবার পর কোন দিন খাঁটি ঘি-এর লুচি খাইনি।

কথাটা অর্কর মনে লাগল। সে কি নিজে কখনও খেয়েছে? নিচু গলায় বলল, আমাদের দেশ মাইরি পাকিস্তানে ছিল না কিন্তু আমিও খাইনি। একদিন খেলে হয়।

চায়ের দাম মিটিয়ে দিল অর্ক। এখন শরীর একটু ভাল লাগছে। সিনেমা হলটার সামনে এসে ওর চক্ষুস্থির হয়ে গেল। বিরাট ভিড়। এখন সবে নটা বাজে বোধহয় কিন্তু কমসে কম হাজারখানেক লোক জটলা পাকাচ্ছে। মেয়েদের লাইনটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে অনেকদূর। ছবিটার কথা অর্ক শুনেছে অনেকদিন কিন্তু অভ্যেস নেই বলে দেখতে আসার ইচ্ছে হয়নি। হলের কোলাপসিবল দরজা বন্ধ। ছেলেদের লাইনে জোর মারপিট শুরু হয়েছে। পাঁচ ছয়টা ছেলে লাইন ম্যানেজ করছে। ওদের সামনে একটা ছেলেকে বেধড়ক পেটালো ওরা। জামা ছিঁড়ে ছেলেটা লাইন ছেড়ে চলে গেল। হঠাৎ মেয়েদের লাইনে চিৎকার শুরু হল। অর্ক দেখল একটা রোগা মতন মেয়ে একজন মহিলার চুলের মুঠি চেপে ধরে টানছে। মহিলাটি মোটাসোটা তবু সেই চেহারায় দুহাতে মেয়েটি আঁচড়াতে চেষ্টা করছে। লাইনের অন্যান্য মেয়েরা তারস্বরে চিৎকার করছে। এদের ব্যাপার দেখে ছেলেদের মারামারি থেমে গেল। সেই মাস্তান ছেলেরা এদের সামনে এসে জোর হাততালি দিতে লাগল। একজন আবার হেঁড়ে গলায় শোলের ডায়লগ বলতে লাগল। অবিকল আমজাদ খান। মেয়ে দুটোর কোন হুঁস নেই। তারা মাটিতে পড়ে গিয়েও পরস্পরকে ছাড়ছে না। এইসময় একটা পুলিস ভ্যান সামনে এসে দাঁড়াতেই বিলু বলল, খেল শুরু হল।

একজন অফিসার ভ্যান থেকে নেমে চিৎকার করলেন, অ্যাই চোপ! কেউ মারামারি করবে না। মারামারি করা খুব খারাপ।

আমজাদ খান সেই গলায় বলল, খুব খারাপ স্যার, কিন্তু ওরা খুব লড়ে যাচ্ছে।

ঠিক তখনি কোলাপসিবল গেট ফাঁক হতেই প্রথমে ঢোকার জন্যে তাড়াহুড়ো লেগে গেল। অর্ক দেখল রোগা মেয়েটা চটপট মাটি ছেড়ে দৌড়ে গেল লাইনের মধ্যে। মোটাসোটা মহিলা তড়িঘড়ি লাইনে ঢুকে গেলেন। এতক্ষণের অত উত্তেজক মারামারির কোন মূল্য থাকল না। অর্ক বিলুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, টিকিট পাবি কি করে?

পেয়ে যাব।

যা বে! আমি মরে গেলেও ওখানে ঢুকব না। দ্যাখ দ্যাখ পুলিশ লাঠি চার্জ করছে। শালা, বড় হলে পুলিশ হতে হবে।

তুই হতে পারবি, তোর ফিগার আছে। দু’হাত ভরে দুই নম্বর লুটবি। লে বে, টাকাটা বের কর।

টিকিট কোথায়?

তুই আমাকে অবিশ্বাস করছিস অক্ক। এ লাইনে অবিশ্বাস করলে কোন কাজ চলে না। ব্যবসা হয় বিশ্বাসের ওপরে।

অত্যন্ত অনিচ্ছায় পকেট থেকে টাকাগুলো বের করল অর্ক। বের করবার সময় হারখানার কথা মনে পড়ায় সে চট করে দেখে নিল সেটা পকেটেই আছে। বিলুকে হারখানার কথা কিছুতেই বলা যাবে না। টাকাটা হাতে নিয়ে গুণে ফেলল বিলু। তারপর দশটা টাকা অর্কর হাতে দিয়ে বলল, এটা রাখ, ভাগাভাগি করে নেব।

কেন?

তুই শালা ধুর নাকি বে! টিকিটগুলো ক্যাশ না করা পর্যন্ত হাওয়া খাব নাকি? অক্ক, আজ থেকে আমরা হলাম পাটনার, মনে রাখিস।

অর্ককে সেখানেই দাঁড় করিয়ে বিলু হলের দিকে চলে গেল। অর্ক দেখল লাঠি চার্জের পর লাইন বেশ শান্ত হয়েছে। ছয়জন ছেলে আর চারজন মেয়েকে এক একবারে কোলাপসি গেটের ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে টিকিটের জন্যে। বিলু সামনের ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলে অর্কর মন খুঁতখুঁত করতে লাগল। টাকাটা নিয়ে বিলু হাপিস হয়ে যাবে না তো! যদি হয় তাহলেও অর্কর কিছু বলার নেই। কারণ টাকাটা ন্যাড়ার মায়ের আর সে-ই নিজে কাল রাত্রে ছাই হয়ে গেছে। কিন্তু টাকাটা অনেকক্ষণ পকেটে ছিল, বিলু কি ঢপ দেবে!

মিনিট পনের বাদে ফিরে এল বিল। অর্ক খুশি হল, পেলি?

না পাটনার। ওই চায়ের দোকানে বসতে বলল।

চায়ের দোকানে কেন?

ওখানেই লেনদেন হবে।

সিনেমা হাউস ছাড়িয়ে একটু এগোতেই একটা জীর্ণ চায়ের দোকান চোখে পড়ল অর্কর। গোটা আটেক তাদের বয়সী ছেলে সেখানে বসে আছে। বিলুর সঙ্গে ঢুকে অর্ক একটা বেঞ্চিতে বসতেই মন্তব্য কানে এল, এরা খোঁচড় নাকি বে?

হলে হবে। কোন খানকির বাচ্চা নাক গলালে লাস পড়ে যাবে!

উত্তরটা শুনে কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল অর্কর। সে বিলুর দিকে তাকাতেই বিলু চোখ মারল। তারপর বলল, দেশলাই আছে?

অর্ক মাথা নাড়ল না।

একটা চারমিনার দুই আঙ্গুলে গুঁজে বিলু চারপাশে তাকাল। তারপর যে ছেলেটি লাশ ফেলবে বলেছিল তার দিকে তাকিয়ে বলল, ওস্তাদ, আগুন আছে?

প্রচণ্ড কালো, মুখ চোখ ভাঙ্গা, লাল জামা পরা ছেলেটা বিলুর দিকে তাকাল। অর্ক দেখল ছেলেটা বেশ বিরক্তি সত্ত্বেও পকেট থেকে দেশলাই বের করে খুব জোরে ছুঁড়ে দিল বিলুর দিকে। ছোঁ মেরে সেটাকে লুফে নিয়ে বিলু সিগারেটটা ধরাল মন দিয়ে। তারপর বেঞ্চি ছেড়ে উঠে গেল লাল জামার কাছে, ওস্তাদ, পহেলে পুছোঁ কৌন হ্যায় উসকি বাদ বাত বোলো। সেমসাইড গোল হয়ে যাচ্ছে।

ছেলেটার মুখ আরও কঠিন হল, কি চাই এখানে?

চা খেতে এসেছি।

লাল জামা হাঁক দিল, গণা, ওদের চা দে খেয়ে ফুটে যাক।

বিলু মাথা নাড়ল, আবার সেমসাইড হচ্ছে ওস্তাদ।

লাল জামা ঘুরে বসল, মানে?

অমাদা বলেছে এখানে বসতে।

অমাদা বলেছে! লাল জামার মুখ থেকে কথাটা বের হতেই অন্যান্যরা নড়ে চড়ে বসল। অর্ক বুঝল কেউ তাদের ভাল চোখে দেখছে না।

লাল জামা বলল, আরে, আমি সাফ বলে দিচ্ছি। নতুন পার্টি ঢোকাতে চাইলে হেভি কিচাইন হয়ে যাবে।

বিলু বলল, আমরা নতুন নই।

নতুন নই! হা হা করে হেসে উঠল লাল জামা, এ খোমা অ্যাদ্দিন কোন গাদিতে ঝুলিয়েছিলে চাঁদ!

আমি আসতাম না, আমার দোস্ত আসতো, খুরকি।

খুরকি? অর্ক লক্ষ্য করল ছেলেটার মুখের চেহারা পাল্টে গেল আচমকা। সে বিলুর মুখের দিকে চোখ ছোট করে দেখতে লাগল।

বিলু হাসল, খোমা দেখে নাও ওস্তাদ। অনেক খেলেছ এতক্ষণ। খুরকি আমাদের পাঠিয়েছে ওর মাল নিয়ে যেতে। আপত্তি আছে?

লাল জামা বলল, খুরকি কোথায়?

শরীর খারাপ।

ওকে বলো মানাদা ডেকেছে। ও শালা মানাদাকেও টপকেছে। মানাদাই এই হলের সঙ্গে প্রথম বন্দোবস্ত করেছিল, আমরা এখনও মানাদাকে হিস্যা দিই।

বিলু বলল, বলব। কিন্তু আর কি সেমসাইড হবে?

ঠিক আছে। কিন্তু দশটার বেশী টিকিট।

এক কুড়ি। আমাদের সঙ্গে বাতচিত হয়ে গেছে। যে যার করে খাও গুরু। বিলু ফিরে এল অর্কর পাশে। অর্ক বিলুকে এতক্ষণ অবাক হয়ে দেখছিল। রোগা ক্ষয়াটে চেহারা নিয়ে বিলু কি রোয়াবে কথা বলে গেল এতক্ষণ। সে কি নিজে এরকম পারত! ও দেখল সবাই এবার তার দিকে তাকাচ্ছে। ঠোঁট বেঁকিয়ে কিলার ভঙ্গীতে অর্ক চেঁচাল, কি বে, চা কি বাগানে পয়দা হচ্ছে এখনও?

গলার স্বর এবং ভঙ্গী অনেকটাই কিলার মত মনে হল অর্কর। ওপাশ থেকে সাড়া এল, দিচ্ছি।

হঠাৎ বাইরে দুদ্দাড় করে মানুষজন ছুটতে লাগল। ওরা দোকানে বসেই দেখল পুলিস লাঠি। উঁচিয়ে তাড়া করেছে। লাল জামার কাছে একজন এসে বলল, টিকিট নেই বলে কাউন্টার বন্ধ করে দিয়েছে বলে পাবলিক রঙ নিচ্ছে।

অর্ক চা খেতে খেতে অনুভব করল ওর শরীরের সেই ম্যাজম্যাজানি ভাবটা আর নেই, এমনকি ঘুমও পাচ্ছে না। ঠিক তখনই আবে অমাদা এসে গেছে এসো ওস্তাদ ইত্যাদি হাঁকডাকে ভরে গেল দোকান। অর্ক দেখল একটি আধবুড়ো লোক চায়ের দোকানে ঢুকে সন্ত্রস্ত ভঙ্গীতে চারধারে তাকিয়ে নিয়ে বলল, বাইরে পুলিস প্যাঁদাচ্ছে।

লাল জামা বলল, যুগ যুগ জীও গুরু। যত প্যাঁদাবে তত লাভ।

অমাদা মাথা নাড়ল, ঠিক। আজ আরও চারআনা বেশী লাগবে।

সঙ্গে সঙ্গে লাল জামা ছুটে এল, কি কিচাইন করছ অমাদা, তোমার সঙ্গে মানাদা রেট ঠিক করে গিয়েছে, এখন বেশী চাইলে দেব কি করে?

অমাদা হাত নাড়ল, দর আবার কি! রোজ রোজ যেমন কমছে বাড়ছে তেমন চলবে। আজকের যা ডিম্যাণ্ড তাতে চারআনা বেশী পড়বে।

কথাটা শেষ করে অমাদা দোকানের খদ্দেরদের মুখ ভাল করে দেখল, মারপিট হচ্ছে যখন রাস্তায় তখন ঝাঁপটা বন্ধ করে দে। বাইরের কেউ এখানে নেই তো?

লাল জামা মাথা নাড়ল, না। কিন্তু তুমি খুরকিকে মাল দিচ্ছ কেন?

অমাদা বলল, কে খুরকি?

বেলগাছিয়ার খুরকি।

ওরে বাবা, ওকে না দিলে উপায় আছে! খুরকি যেন কাঁদের পাঠিয়েছে এখানে? অমাদা একটা বেঞ্চিতে বসতেই কয়েকজন সরে গিয়ে তাকে জায়গা করে দিল। বিলু হাত তুলল।

তাকে দেখে নিয়ে অমাদা টিকিট বিতরণ শুরু করল। অর্ক দেখল গোছ গোছ টিকিট হাত বদল হয়ে যাচ্ছে। সাধারণত নিচু আর মাঝারি শ্রেণীর টিকিট অমাদা এনেছে। তবে চার আনা বেশী দিতে হচ্ছে বলে অনেকে যত টিকিট নেবে ভেবেছিল তত নিতে পারছে না। বিলু বেশ কিছু টিকিট ম্যানেজ করে আদ্ধেক অর্ককে দিল, এগুলো শুক্রবার পর্যন্ত তোর কাছে রেখে দে। কেউ যেন টের না পায়।

তোর কাছে রেখে দে না।

না বে, বাইরে বের হলেই খোঁচড় ধরতে পারে। একজনকে ধরলে আর একজনের মাল বেঁচে যাবে।

চোখের সামনে দোকানটা সাফ হয়ে গেল। যে যার টিকিট নিয়ে এক এক করে বেরিয়ে পড়েছে। অমাদা টাকাগুলো থলিতে পুরে বিড়ি ধরাল,একটা ডবল হাফ দাও।

বিলু অর্ককে ইশারা করে বেরিয়ে পড়ল। কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট এতক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে বিলু বলল, এ হপ্তার খরচটা ম্যানেজ হয়ে গেল অক।

কি করে বিক্রি করবি?

শো শুরু হবার পনের মিনিট আগে আসব। ততক্ষণে অন্য শালাদের টিকিট শেষ হয়ে যাবে। চারটাকা নাফা রাখব দেখিস।

পুলিস যদি ধরে!

আমার ওপর ভরসা কর ওস্তাদ। তোকে তো বলেছি আমি এখনও শ্বশুরবাড়ি যাইনি। চ, সটকাট করি।

নলিনী সরকার স্ট্রীট দিয়ে কেন যাচ্ছে প্রথমে ধরতে পারেনি অর্ক, পরে খেয়াল হল লেক টাউনের কথা। এইসব উত্তেজনার মধ্যে অর্ক বিলাস সোমের কথাটা ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু লেক টাউনে গিয়ে কি হবে? লোকটা যদি মরে যায় তাহলে পুলিস কি তাকে ঝামেলায় ফেলতে পারে? ওর আর একবার আফসোস হল নিজের ঠিকানাটা হসপিটালে দেওয়ার জন্যে।

হঠাৎ বিলু বলল, তোদের অ্যাকসিডেন্টটা ঠিক কোথায় হয়েছিল?

আর জি করের মুখে।

পুরো ঘটনাটা বল তো!– বিলুর দিকে তাকাল অর্ক। না, হারের কথা বলবে না সে। ওটা আছে জানলেই শালা ভাগ বসাবে। নিজে যদিও জানে না কোথায় কার কাছে হারখানা বিক্রি করা যায়, তবু ভাগীদার চায় না। সে। প্রায় সবটাই খুলে বলার পর বিলু বলল, পার্টি মালদার বলে মনে হচ্ছিল?

বাঃ, নিজের গাড়ি আছে, টাই পরে যখন।, তার মানেই যে মাল আছে তা নাও হতে পারে। চল বাড়িতে গিয়ে দেখব।

সাতচল্লিশ নম্বর বাসে চেপে ওরা লেকটাউনে চলে এল। বাসে উঠেই বিলু বলেছিল, কেমন আছ ওস্তাদ!

কণ্ডাক্টর ওদের বয়সী একটা ছেলে, কাঁধ অবধি চুল, ভাঙ্গা চোয়াল, ঘাড় নেড়েছিল, কিলার খবর কি?

কাল থেকে হাপিস।

কি ব্যাপার?

ঠিক জানি না।

ওরা টিকিট দিল না, কণ্ডাক্টরও চাইল না। দরজায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো বিলু। এখন গাড়ি প্রায় ফাঁকা। কয়েকটা টান দিয়ে সে সিগারেটটা কণ্ডাক্টরকে দিয়ে দিল। অর্ক দেখল বাসের কিছু লোক তাদের দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু কিছু বলছে না।

লেকটাউনে নেমে বিলু বলল, ঠিকানাটা কি পড়!

পকেট থেকে লাইসেন্সটা বের করে অর্ক ঠিকানা পড়ল। জয়া সিনেমার পেছনের রাস্তায় ওদের যেতে হবে। অর্ক বলল, গিয়ে কোন লাভ হবে না। পুলিস নিশ্চয়ই ওদের খবর দিয়েছে। বিলু বলল, তা তো দিতেই পারে। কিন্তু তোর কাজ তুই করবি চল, বলা যায় না কি থেকে কি হয়।

নম্বর মিলিয়ে বাড়িটাকে খুঁজে পেতে দেরি হল না। দোতলা ঘিয়ে রঙের বাগানওয়ালা বাড়ি। সুন্দর দেখতে। গেটে লেখা, কুকুর হইতে সাবধান। অর্ক বলল, কুকুর আছে।

যা বে!

হ্যাঁ, লেখা আছে, দ্যাখ না।

বিলু চোখ বোলালো, আমি তাহলে ঢুকছি না। ওরে শালা, বড়লোকের কুত্তা খুব হারামি হয়।

অর্ক হেসে ফেলল ওর ভয় দেখে, তাহলে চল ফিরে যাই।

তোর তো ভয় নেই, তুই ঢোক না।

কি বলব?

যা ঘটনা তাই বলবি। প্রথমে মাল খেয়েছিল বলবি না, ওটা আমাদের ইস্ক্রু হবে। যা বে। কুকুরটাকে বাঁধতে বলে আমায় ডাকবি।

বিলু গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। নুড়ি দিয়ে সাজানো প্যাসেজে পা দিতেই মেঘ গর্জন করে উঠল যেন। অর্ক থমকে গিয়েছিল। সতর্ক চোখে সে দেখল বারান্দার গায়ে জানলার গ্রিলের ফাঁকে বিরাট একটা কুকুর ছটফট করছে তাকে দেখে, ক্রমাগত ডেকে যাচ্ছে। এগোবে কিনা বুঝতে পারছিল না অর্ক, পেছন থেকে বিলু সাহস দিল, কিছু হবে না, এগিয়ে যা। হারামিটা বেরুতে পারবে না।

অর্ক আরো খানিকটা এগোতেই ভেতর থেকে একটি মেয়ের গলা ভেসে এল, সাট আপ ম্যাক, হোয়াটস দ্য প্রব্লেম!

গলা শুনে ম্যাক আরও উত্তেজিত হল। দুটো পা গ্রিলের ওপর তুলে দিয়ে দাঁতগুলো বের করে চেঁচিয়ে যাচ্ছে সমানে।

তারপরেই নীল ম্যাক্সি পরা একটি মেয়ে এসে দাঁড়াল গ্রিলের পাশে। কুকুরের বিশাল মাথায় হাত রেখে অত্যন্ত বিরক্ত চোখে অর্ককে দেখে জিজ্ঞাসা করল, কি চাই?

মেয়েটি মোটেই লম্বা নয়। কিন্তু শরীরে বাড়াবাড়ি রকমের যৌবন। চোখ মুখের অভিব্যক্তিতে যে সফিস্টিকেশন তার সাক্ষাৎ কোনদিন পায়নি অর্ক। হঠাৎ সে আবিষ্কার করল তার জিভ শুকিয়ে গেছে, কথা বলতে পারছে না। মেয়েটি আবার জিজ্ঞাসা করল, কি চাই, চাঁদা?

মাথা নাড়ল অর্ক। তারপর কোনরকমে বলল, বিলাস সোম।

ড্যাডি বাড়িতে নেই। ওঃ, ম্যাক, চলে এস। মেয়েটি চলে যাচ্ছিল, অর্ক তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আপনারা কোন খবর পাননি?

কি খবর?

ওঁর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে!

অ্যাকসিডেন্ট? ও মাই গড! মা, মা, তাড়াতাড়ি এস! চিৎকার করতে করতে মেয়েটি ছুটে গেল ভেতরে। এবং কি আশ্চর্য, কুকুরটাও হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল। অর্ক বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিলুর দিকে তাকাল। বিলু রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। হঠাৎ অর্কর মনে হল, বিলুটা অত্যন্ত কুৎসিত দেখতে। এই বাড়িতে একদম মানাবে না। ভেতরে একটি ঈষৎ খসখসে কণ্ঠ বাজল, কত আজে বাজে লোক আসে সব কথা বিশ্বাস করতে হবে!

এইসময় গ্রিলের আড়ালে একজন মধ্যবয়সিনী এসে দাঁড়ালেন। হাতহীন জামা এবং কাঁধ ছোঁওয়া চুল। মুখে এই সকালেও বেশ প্রসাধন। ভ্রূ কুঁচকে অর্ককে জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে?

অ্যাকসিডেন্ট। কাল রাত্রে

তুমি কে?

আমি ওঁর সঙ্গে ছিলাম।

তুমি বিলাসের সঙ্গে ছিলে?

হ্যাঁ। মানে আমাকে উনি লিফট দিচ্ছিলেন।

ইমপসিল। বিলাস কাউকে লিফট দেয় না। তাছাড়া অ্যাকসিডেন্ট হলে পুলিস খবর দিত। তোমার সাহস তো খুব, আমি যদি এখন তোমাকে পুলিসে ধরিয়ে দিই। ধমকে উঠলেন মহিলা।

বিশ্বাস করুন, আমি মিথ্যে কথা বলছি না। এই দেখুন, ওঁর ড্রাইভিং লাইসেন্স। এখান থেকেই ওঁর ঠিকানা পেয়েছি। পকেট থেকে সেটা বের করে গ্রিলের ফাঁক গলিয়ে মহিলাকে দিল।

লাইসেন্স হাতে নিয়ে মহিলা একটু নার্ভাস হলেন। তিনি অর্কর কপাল এবং হাতের দিকে তাকালেন, এটা তুমি কোত্থেকে পেলে?

গাড়িতে ছিল। পরে পেয়েছি।

কোথায় থাক তুমি?

বেলগাছিয়াতে।

মহিলা চিৎকার করে কাউকে ডাকলেন, দরজা খুলে দে।

খানিক বাদেই একটা বুড়ো চাকর দরজা খুলে দিতে মহিলা বললেন, ভেতরে এসো।

অর্ক ঘরে ঢুকতেই কুকুরটা সাঁৎ করে তার সামনে চলে এল। মহিলা বললেন, সোফায় বসো। ওঠার চেষ্টা করলে ম্যাক তোমাকে ছিঁড়ে খাবে। আমি থানায় ফোন করে তোমার কথা বলছি।

অসহায় অর্ক সোফায় বসতেই কুকুরটা তার সামনে পেছনের পা ভেঙ্গে বসল। মহিলা ততক্ষণে রিসিভার তুলেছেন। সেই মেয়েটি ডিভানে বসে আছে, চাকরটা দরজায়।

লাইন পাওয়া মাত্র মহিলা কথা বললেন, হ্যালো, আমি লেকটাউন থেকে বলছি। আমার নাম সুরুচি সোম। বিলাস সোম আমার স্বামী। কি বললেন? আমাকে খুঁজছেন। অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে! কখন? আর জি করে! কি আশ্চর্য, এতক্ষণ খবর দেননি কেন? ঠিকানা ছিল না এটা মানতে হবে? ভাগ্যিস একটি ছেলে খবর দিল এসে। কণ্ডিশন ভাল নয়, আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।

টেলিফোন রেখেই মহিলা মেয়েটির দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন, সু তোমার ড্যাডির অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। এক্ষুনি যেতে হবে।

মেয়েটি চিৎকার করে উঠল মুখে হাত চাপা দিয়ে। মহিলা বললেন, ডোন্ট বি সিলি। তুমি ভেতর থেকে আমার ব্যাগটা এনে দাও। আর নবীন, তুমি জলদি ট্যাক্সি ডেকে আন।

অর্ক হতচকিত হয়ে ব্যাপারটা দেখছিল। মহিলা এবার ওকে জিজ্ঞাসা করলেন, বিলাস কি ড্রাঙ্ক ছিল?

হ্যাঁ।

কোত্থেকে তোমাকে লিফট দিয়েছে?

বিডন স্ট্রীট।

কথাটা শুনেই মুখ বিকৃত করলেন মহিলা, ওঃ, দ্যাট বিচ। শিক্ষা হয় না পুরুষগুলোর। সেই স্ট্রীট গার্লটার কাছেই গিয়েছিল। তোমাকে ও লিফট দিল কেন? ঠিক আছে, যেতে যেতে শুনবো।

ঘরখানার দিকে তাকিয়ে অর্কর মনে হল, এরা কি সুন্দর ঘরে থাকে, কি সাজিয়ে গুছিয়ে। কিন্তু বিচ শব্দটার মানে কি?

০৮. সত্যি কথা বল

সত্যি কথা বল, কি করে অ্যাকসিডেন্ট হল? সুরুচি সোম কেটে কেটে উচ্চারণ করলেন। অর্ক তখনও পেছন দিকে তাকিয়ে। বিলুর মুখ হাঁ হয়ে রয়েছে। ওরা গেট পেরিয়ে ট্যাক্সিতে যখন উঠেছিল তখন যেন কিছুটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল বিলু। রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে জুলজুল করে দেখছিল। অর্কর মনে হয়েছিল বিলুকে ডাকা দরকার। এক সঙ্গে যখন এসেছে তখন ওকে ফেলে রেখে যাওয়া উচিত নয়। কিন্তু সুরুচি সোমের পেছনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ মন মোচড় খেল। বিলুর মুখ চোখ এবং পোশাক সুরুচি পছন্দ করবেন না। সত্যি বলতে কি বিলুকে এই প্রথম অর্কর খুব খারাপ লাগছিল। এই বাড়ি এবং এই পরিবারের সঙ্গে বিলু কিছুতেই মানায় না। ওকে ডাকলে সুরুচি যে অবাক এবং বিরক্ত হবেন এটুকু বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না অর্কর।

ট্যাক্সিটা চলতে শুরু করা মাত্র খারাপ লাগল অর্কর। সে নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করছিল এটা তার দোষ নয়। সুরুচি এত দ্রুত ট্যাক্সিতে উঠলেন এবং এমন গম্ভীর হয়েছিলেন যে তার কিছু করার সুযোগ ছিল না। সে শেষবার দেখল বিলু দৌড়ে রাস্তার মাঝখানে চলে এসে দুটো হাত শূন্যে নাড়ছে। এই সময় সুরুচি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, কি হল, শুনতে পাচ্ছ না?

অর্ক ফিরে তাকাল। সুরুচি দুটো বড় চোখে ওকে দেখছেন। দৃষ্টিতে এখনও সন্দেহ। অর্ক কোনরকমে বলল, হয়ে গেল।

হয়ে গেল মানে? তুমি কোথায় থাকো?

আমি? বেলগাছিয়ায়।

কি কর?

পড়ি।

বাবা কি করেন?

কিছু না।

তোমার মতন ছেলেকে ও লিফট দেবে বিশ্বাস হচ্ছে না। অন্য কোন গোলমাল আছে। তাছাড়া অ্যাকসিডেন্টে তোমার কিছু হল না আর বিলাস হাসপাতালে?

অর্কর মুখ ফসকে বেরিয়ে এল, যাঃ শালা! অ্যাকসিডেন্ট কি আমার ইচ্ছেয় হয়েছে? বাক্যটি বলা মাত্র বুঝতে পারল সুরুচির সামনে এ ধরনের কথা বলা ঠিক হয়নি। কারণ শোনামাত্র ভদ্রমহিলার মুখ আচমকা থেবড়ে গিয়েছে। বিস্ফারিত চোখে তিনি এখন অর্ককে দেখছেন। যেন এক দলা নোংরা ওঁর গায়ে কেউ ছুঁড়ে দিয়েছে এমন বসার ভঙ্গী। গলার স্বর জড়িয়ে গেল তাঁর, তুমি, তুমি আমাকে শালা বললে? স্কাউন্ট্রেল।

অর্ক একটু সংকুচিত হয়েছিল কিন্তু শেষ শব্দটি কানে যাওয়া মাত্র সে মাথা তুলল। ওটা যে ইংরেজি গালাগাল তা অনুমানে বুঝতে পারছে, বলার ধরনে সেটা স্পষ্ট। কেউ যদি তাকে গালাগাল দেয় তবে তার কি দরকার ভদ্রতা করার। সে চোয়াল শক্ত করে বলল, তখন থেকে আপনি ন্যাকড়াবাজি করছেন। গাড়ি চালাচ্ছিলেন উনি মাল খেয়ে তাই অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। শালা আমারই জান কয়লা হয়ে যেত আর একটু হলে। তবু আমি যেচে আপনাদের খবর দিতে এলাম আর আপনি।

ন্যাকড়াবাজি! ন্যাকড়াবাজি মানে কি?

সুরুচির মুখের চেহারা আচমকা যেন সহজ হয়ে আসছিল। মুখের যে পেশীগুলো এতক্ষণ টান টান ছিল তা শিথিল হয়ে এল।

অর্কর মনে পড়ল ন্যাকড়াবাজি কথাটা শুনে বাবাও মানে বুঝতে পারেনি। এরা মাইরি কোন জগতের মানুষ? কথা বললেও বুঝতে পারে না? সে তো আর ইংরেজি বলছে না। সুরুচির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সে বাইরে তাকিয়েই দত্তবাগানের মোড়টাকে দেখতে পেল। পাইকপাড়া দিয়ে না ঘুরে ট্যাক্সি সোজা পাতাল রেলের রাস্তা দিয়ে আর জি কর যাচ্ছে।

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উত্তর না পেয়ে সুরুচি বললেন, তোমার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে তুমি ভদ্রঘরের ছেলে নও!

অর্ক কাঁধ নাচাল, যান যান, কোঠাবাড়ির লোক কত ভদ্র তা জানা আছে। কোঠাবাড়ি কথাটা বিলু প্রায়ই ব্যবহার করে।

কোঠাবাড়ি! সুরুচি ঢোক গিললেন, তুমি কোথায় থাক?

তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেন। ওই যে বস্তিটা দেখলেন, ওখানে। গাড়িটা তখন ব্রিজে উঠছে।

ও। তাই তোমার মুখের ভাষা এরকম।

আবার কিচাইন করছেন আমি কোন খারাপ কথা বলিনি।

বলনি? তোমার সে বোধই নেই।

আমার মাথা গরম করে দিচ্ছেন আপনি। একটু আগে কে ইংরেজিতে গালাগাল দিল, আমি?

আমি দিয়েছি? ও, স্কাউণ্ডেল, স্কাউণ্ডেল মানে জান?

ওইটাই তো আপনাদের সুবিধে। আমরা মানে বুঝি না আর আপনারা টপ করে ঝেড়ে দেন। এই যেমন, ফাক্ দি টাইম।

সঙ্গে সঙ্গে সুরুচির কান থেকে যেন গরম হাওয়া বেরুতে লাগল, মুখ চোখ ছাড়ানো তরমুজ। ঠোঁট দাঁতে চেপে উচ্চারণ করলেন, কি বললে?

আমি বলিনি। কাল রাত্রে উনি গাড়ি চালাতে চালাতে বলছিলেন! কথাটার মানে কি?

সুরুচি রাগতে গিয়ে না হেসে পারলেন না। ট্যাক্সি তখন আর জি করের দরজায়। সেদিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, না বলে চলে যেও না, তোমার সঙ্গে আমার দরকার আছে।

অর্ক অবাক হয়ে গেল। সুরুচি সোম যে এত তৎপর হতে পারেন তা ওঁর চেহারা দেখে মনে হয়নি। একে জিজ্ঞাসা করে ওকে ধমকে তার কাছে গলে গিয়ে শেষ পর্যন্ত বিলাস সোমের শরীরের অবস্থা জেনে নিলেন। এখন রোগীদের সঙ্গে দেখা করার সময় নয়। কিন্তু সুরুচি সেটাও ম্যানেজ করলেন। করে এসে বালিকার ভঙ্গীতে অর্ককে বললেন, জানো ওর জ্ঞান ফিরে এসেছে। কয়েকটা কথাও বলেছে। ওরা বলছে আর কোন ভয় নেই। অর্কর প্রতিক্রিয়া জানার জন্যে এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে ছুটলেন সুরুচি আবার ভেতরে।

লোকটা বেঁচে গেল? অর্ক চারপাশে তাকাল। কেউ তার দিকে লক্ষ্য করছে না। এই ভরদুপুরে হাসপাতালটায় একটা সিরসিরে হাওয়া বইছে। সে কি ফেঁসে গেল! ফেঁসে যাবার আর কি আছে! হার পায়নি বললে কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। ওটা পকেটে না থাকলে ভাল লাগত। মুখের ওপর মিথ্যে কথা বলতে পারবে তো সে? হঠাৎ বিলুর ওপর তার রাগ হল। মাল কামানোর জন্যে বিলু তাকে যদি লেকটাউনে নিয়ে না যেত তাহলে এই নকশায় পড়তে হত না। আর কোথায় মাল? ওই জিনিসের কাছ থেকে মাল খসাবে সে সম্ভাবনা নেই। যত সব বাতেলা।

কিন্তু এখন কেটে যাওয়া ঠিক কাজ হবে না। যদি হারখানার কথা ওঠে তাহলে ওরা নিশ্চয়ই তাকেই সন্দেহ করবে। কিন্তু সে যদি সঙ্গে সঙ্গে থাকে তাহলে অবিশ্বাস করার কোন কারণ থাকবে না। অর্ক একটু এগিয়ে একটা বেঞ্চিতে বসল। এবং বসা মাত্রই তার খিদে পেয়ে গেল। এখন পকেটে যা আছে তাতে বেশ ভাল খাওয়া যায়। আজ সকালে কিছুই খাওয়া হয়নি, কাল রাত্রেও, দূর, ওটাকে খাওয়া বলে নাকি!

এই সময় সুরুচি হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন। দু পাশে মুখ ফিরিয়ে প্রথমে তাঁর কপালে ভাঁজ এবং ঠোঁটের কোণে বিরক্তি ফুটছিল কিন্তু বেঞ্চির ওপর চোখ পড়ামাত্র তিনি উজ্জ্বল হলেন। দ্রুত কাছে এসে বললেন, তোমার নাম কি যেন?

অর্ক।

ও বাবা, দারুণ তো। শোন, তুমি একবার আমার সঙ্গে এস।

বিলাস তোমাকে ডাকছে।

কেন?

বাঃ, আমি জানবো কি করে? প্রথমে তো তোমাকে মনেই করতে পারছিল না, তারপর একটু একটু করে খেয়াল হয়েছে। আর হ্যাঁ, তুমি ওর সামনে ওই সব শ্ল্যাং বলো না।

স্ল্যাং?

হ্যাঁ।

স্ল্যাং মানে কি?

খারাপ কথা।

আপনি আমাকে ধুর পেয়েছেন নাকি?

ধুর! ধুর মানে কি?

অর্ক অবাক গলায় বলল, আপনি আমাকে ঢপ দিচ্ছেন।

দুটো কাঁধ নাচালেন সুরুচি, ও! আমার বলতে ইচ্ছে করছে, কি কথা বলিস তুই, আমি যে তোর ভাষা বুঝিনে! শোন, তোমার এই কথাগুলো আমি পরে লিখে নেব। কিন্তু তুমি বিলাসের কাছে গিয়ে ওই সব শব্দ একদম ব্যবহার করবে না। বিলাস যখন ড্রাঙ্ক থাকে তখন ও সব কিছু সহ্য করে কিন্তু নর্মাল অবস্থায় হি ইজ এ ডিসেন্ট ম্যান। কাম অন।

এই শব্দগুলো অর্কর পরিচিত। স্কুলে পড়তে গিয়ে আর যাই হোক ইংরেজি গালাগালগুলো শেখা যায় না। সে সুরুচির পেছন পেছন ভেতরে ঢুকল। লম্বা করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় একজন নার্স ওদের দেখে কিছু বলতে যাচ্ছিল, সুরুচি মধুর হাসলেন, তখন যে বললাম ভাই, জাস্ট এ মিনিট।

একটা কেবিনের পর্দা সরিয়ে সুরুচি ঢুকলে অর্ক অনুসরণ করল। বিলাস সোম খাটে শুয়ে রয়েছেন। মাথা ব্যাণ্ডেজে ঢাকা, হাত এবং কাঁধে চোট লেগেছে। মাথার পেছনে বেশ কয়েকটা নল ঝুলছে। বিলাস শীতল চোখে অর্ককে দেখলেন। অর্কর মনে হল, এই লোকটাকে সে চেনে না। অন্তত গত রাত্রে যাকে গাড়ি চালাতে সে দেখেছিল, এ সে নয়। তার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। সুরুচি প্রথম কথা বললেন, এ তোমার সঙ্গে গাড়িতে ছিল? বিলাস অর্কর মুখ থেকে চোখ সরায়নি একবারও। এবার খুব দুর্বল গলায় বলল, বোধহয়।

আর য়ু নট শিওর?

বিলাস উত্তর দিলেন না কিন্তু চোখও সরালেন না। সুরুচি চকিতে ঘাড় ঘোরালেন, ওঁর চোখে সন্দেহ চলকে উঠল। তারপর চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, এ যেচে আমার বাড়িতে খবর দিতে গিয়েছিল, তুমি চিনতে পারছ না?

পারছি।

ও। তাই বল! নিঃশ্বাস ফেললেন সুরুচি।

আমার কণ্ডিশন কিরকম? খুব দুর্বল গলা বিলাসের।

ফাইন।

কবে ছাড়বে?

জিজ্ঞাসা করিনি। নিশ্চয়ই দু’ পাঁচদিন রাখবে।

আমি চলে যেতে চাই। দরকার হলে বণ্ড সই করে। ইটস এ হেল। মুখ বিকৃত করলেন বিলাস।

কিন্তু যাব বললে কি যাওয়া যায়? অ্যাকসিডেন্ট করার আগে তোমার ব্যাপারটা ভাবা উচিত ছিল।

ড্যাম ইট! ভেবেচিন্তে অ্যাকসিডেন্ট করলে ঈশ্বর এতক্ষণে আমাকে শান্তিতে রাখতেন।

আমার সঙ্গে থাকা মানে তোমার অশান্তি তা জানি। চেঁচিয়ে না বললেও চলত। তুমি কাল রাত্রে কোথায় গিয়েছিলে জানি। সুরুচি সোম হিসহিসিয়ে উঠলেন।

বিলাস সোমের দৃষ্টি ক্ষণিকের জন্য স্ত্রীর ওপর পড়েছিল, চট করে অর্কর ওপর সরে এল। তারপর চোখ বন্ধ করলেন তিনি। বেশ বড় নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল তাঁর বুক থেকে, ডাক্তারের কাছে খোঁজ নিয়ে দ্যাখো আমায় কবে ছাড়বে। অনেক কাজ পড়ে আছে।

সুরুচি সোম অনেক চেষ্টায় নিজেকে সংযত করলেন। তারপর ঘুরে দরজার দিকে যেতে যেতে ডাকলেন, এসো অর্ক।

ঘরে ঢোকা অবধি অর্ক একটাও কথা বলেনি। এই ওষুধের গন্ধ-চাপা ঘরে এতক্ষণ যে ঘটনা ঘটল সেটা ওর কাছে সিনেমা সিনেমা মনে হচ্ছিল। সুরুচি বেরিয়ে যেতে সে তাঁকে অনুসরণ করার জন্য পা বাড়াতে যেতেই দেখল বিলাস সোম নিঃশব্দে দু চোখে ইশারা করে তাকে ডাকছেন। ডাকটা এত স্পষ্ট যে অর্কর বুক ছ্যাঁত করে উঠল। কি ব্যাপার, ডাকছে কেন! এখন এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। সে পায়ে পায়ে বিছানার পাশে চলে এল। বিলাস সোম বললেন, কাল তুমিই ছিলে, না?

হ্যাঁ। বিডন স্ট্রীট থেকে উঠেছিলাম।

আমার কিছু মনে নেই। তোমাকে তুললাম কেন?

আপনার গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছিল, আমি ঠেলেছিলাম।

ওফ। তুমি কি ওকে কিছু বলেছ? আমি কি তোমাকে কিছু বলেছি, এই যেমন কোথায় গিয়েছিলাম।

না।

তুমি কিছু বলনি?

শুধু আপনার নেশা হয়েছিল–

সেটা না বললেও সবাই বুঝতে পারে। আমার গাড়ি কোথায়?

জানি না। বোধহয় খালের পাশেই আছে।

গাড়ির ভেতরটা দেখেছ?

না।

আমার হার?

চট করে গলা শুকিয়ে গেল অর্কর। সে যেন আর কথা বলতে পারছে না। শক্ত হয়ে দাঁড়াল সে।

আমার হার ও পেয়েছে?

না। মুখ ফসকে বেরিয়ে আসা মাত্র নিজেকে লাথি মারতে ইচ্ছে করছিল ওর।

বিলাস সোমের মুখ উজ্জ্বল হল, ওটা তোমার কাছে আছে?

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল সে। হ্যাঁ।

গুড। আপাতত রেখে দাও। তুমি কি কর?

পড়ি।

কোন স্কুলে?

নাম বলল অর্ক। একি করল সে? হারখানা যে তার পকেট আছে তা বলে ফেলল? কিন্তু লোকটা বউ-এর কাছে চেপে যাচ্ছে কেন? নিশ্চয়ই গোলমাল আছে কিছু

তুমি ওটা তোমার কাছে রেখে দাও। আমাকে এরা যেদিন রিলিজ করবে তার পরদিন আমার সঙ্গে বাড়িতে গিয়ে দেখা করবে। আমার বাড়ি তো তুমি জানো?

হ্যাঁ।

তোমার ঠিকানা কি?

তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেন। বেলগাছিয়ায়।

কি! ওটা তো বস্তি। তুমি বস্তিতে থাকো?

হ্যাঁ।

মাই গুডনেস! চোখ বন্ধ করলেন বিলাস। আর তখনই সুরুচি আবার প্রবেশ করলেন। বিলাসের বিছানার পাশে অর্ককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওঁর মুখে বিস্ময় ফুটল। কিন্তু গলার স্বরে সেটা বোঝালেন না তিনি, দিন চারেক থাকতেই হবে। ওরা রিস্ক নিতে রাজি নয়। এতক্ষণ তুমি কথা বলছ জানলে আর দেখা করতে দেবে না। আমি বিকেলে আসব। চলে এসো অর্ক।

এবার ডেকে নিজে বেরিয়ে গেলেন না। অর্কর দরজা পর্যন্ত যাওয়া অবধি অপেক্ষা করে তবেই পা বাড়ালেন। অর্কর মনের মধ্যে তখন অনেকগুলো ঢেউ তোলপাড় করছিল। হারখানা হাতছাড়া হয়ে গেল!

বাইরের বারান্দায় এসে সুরুচি বললেন, ও তোমাকে কি বলছিল?

অর্ক সুরুচির দিকে তাকাল, তারপর মাথা নাড়ল, কিছু না।

তুমি মিথ্যে কথা বলছ।

বেশ করছি। এবার আমাকে যেতে দিন।

তুমি, তুমি এইটুকু ছেলে।

আমি বাচ্চা নই। আপনাদের কারবার আপনারা বুঝে নিন। এই সব পিনিক আমার ভাল লাগে না।

সুরুচি বললেন, না, তুমি যাবে না। আমি অফিস থেকে ঘুরে আসছি অন্তত ততক্ষণ এখানে থাকো।

সুরুচি ওঁর মাথায় মাথায় কিন্তু এই বয়সেও স্বাস্থ্য চমৎকার বলে অর্কর নিজেকে ছোট লাগছিল। সুরুচির শরীরে অনেক রকম নরম নরম ব্যাপার আছে যা মাধবীলতার নেই। এদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে জব্বর কিচাইন হচ্ছে– সুরুচির পেছন দেখতে দেখতে অর্ক মাথা নাড়ল। হারখানা যখন দিয়ে দিতেই হচ্ছে তাহলে লোকটাকে বাঁশ দিলে কেমন হয়! সুরুচিকে বলবে নাকি! বোঝাই যাচ্ছে হারখানার কথা সুরুচি জানে না। না, মাথা নাড়ল অর্ক। লোকটা বিছানায় শুয়ে যে ভাবে কথা বলছিল তাতে ওর ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। বরং সেরে উঠে যখন বাড়ি যাবে তখন হারখানা দেবার সময় কিছু মাল খিচে নেওয়া যাবে। ব্যাপারটা এইভাবে ভাবতেই অর্কর মন প্রফুল্ল হল। দোকানে গিয়ে হার বিক্রি করার কোন অভিজ্ঞতা তার নেই। সে সব করতে গেলে কাউকে সঙ্গে নিতেই হতো। দোকানদার নিশ্চয়ই রশি টানতো, ঢপ খেতে বেশী সময় লাগত না, তার ওপর বখরা দিতে হত সঙ্গীকে। আর এই ব্যবস্থায় কোন ঝামেলা থাকল না। যার জিনিস তার কাছেই যাচ্ছে মাঝখান থেকে পকেটে মাল আসবে। অন্তত চুরির বদনাম গায়ে লাগবে না।

বেশ হালকা হয়ে সামনে তাকাতেই অর্কর বুক ধক করে উঠল। বিলু আসছে। ভাঙ্গা এবং চোয়াড়ে মুখ এখন শক্ত। সামনে এসেই বলল, লাইন করেছ গুরু?

কিসের লাইন?

যা বে! আমাকে দেওয়াল ধরে দাঁড় করিয়ে তুমি ট্যাক্সিতে উঠলে কি ওই বুড়ির সঙ্গে পেরেম করতে? কত মাল দেবে?

মাল দেবে কেন?

কেন দেবে না? ওর স্বামী অ্যাকসিডেন্ট করে তোকে চোট দিয়েছে। তার দাম দিতে হবে না?

অর্ক বলল, দূর! ও আমি চাইতে পারব না।

যাঃ শালা। তাহলে আমরা লেকটাউনে গেলাম কেন? প্রচণ্ড হতাশ দেখাচ্ছিল বিলুকে। তবু তারই মধ্যে সে আড়চোখে অর্ককে দেখছিল, গুরু, আমাকে নকশা দেখাচ্চ না তো!

অর্ক মাথা নাড়ল, না। লোকটার অবস্থা খারাপ। এ সময় অন্য কিছু বলা যায়, তুই বল?

ও তোর পিরীতের নাঙ না কি বে! ওই যে আসছে, আমি সরে যাচ্ছি, তুই মাল চা। বিলু সট করে সরে একটা থামের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল।

সুরুচি এসে বললেন, আজ সারাদিন ওয়াচে রাখবে। মাথার এক্সরে হয়েছে। বিকেলে রিপোর্ট পাওয়া যাবে। তুমি বিকেলে আসতে পারবে।

কেন?

সুরুচি তাকালেন, আমাকে যদি একটু সাহায্য কর। আমি বুঝতে পারছি না ওকে নার্সিংহোমে ট্রান্সফার করব কিনা? বাড়িতে আর দ্বিতীয় কোন পুরুষ নেই।

আপনার আত্মীয়স্বজন।

না ভাই, আমাদের আত্মীয়স্বজন কেউ কাছাকাছি থাকেন না।

ঠিক আছে।

তুমি আসবে?

দেখি?

ওফ। তোমরা সরাসরি কথা বলতে পারো না। চল, তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাই। ওই তো একটা ট্যাক্সি খালি হল! ধরো, ধরো ওকে।

অর্ক একটু দৌড়ে গিয়ে ট্যাক্সিটাকে থামাল। সুরুচি কাছে আসা মাত্র সে বিলুকে দেখতে পেল। থামের আড়াল থেকে বিলু বেরিয়ে এসেছে। সুরুচি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়েছেন। একটু ইতস্তত করে সে চট করে গাড়িতে উঠে পড়ল। এখন বিলুর সঙ্গ তার মোটেই ভাল লাগছে না। চোয়াড়ে ভাঙ্গা মুখে বিলু শুধু মালের কথা বলে যাবে। তার লাগল চোট আর ও কামাবে মাল। নিজেকে মুরগি বলে ভাবতে ইচ্ছে করছে না মোটেই। তাছাড়া সুরুচির কাছাকাছি হলেই অদ্ভুত একটা সুবাস নাকে আসে, শরীর জুড়িয়ে যায়। সেটা তাদের বস্তিতে কারো শরীর থেকে বের হয় না। ওটা হয়তো সেন্ট কিংবা কে জানে, বড়লোকদের সুখী মানুষদের রক্ত মাংস থেকেই বেরিয়ে আসে।

ট্যাক্সিটাকে চলতে দেখে বিলু ছুটে আসছিল। কিন্তু গাড়ির গতির সঙ্গে তাল রাখতে পারল না। খুব মজা লাগছিল অর্কর। সে লক্ষ্য রাখছিল ব্যাপারটা সুরুচির চোখে পড়ে কিনা! কিন্তু ভদ্রমহিলা নিজের চিন্তায় এতটা ডুবে ছিলেন পেছন দিকে তাকাননি।

সারাটা পথ সুরুচি একটাও কথা বললেন না। পেছনের সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন। বেলগাছিয়ার মোড় পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে অর্ক চেঁচিয়ে উঠল, দাঁড়ান, ট্যাক্সি থামান। চল গাড়িটা থামতেই দরজা খুলে নামল অর্ক। সুরুচি মুখ বার করে জায়গাটা দেখলেন, এখানে থাকো?

হ্যাঁ। ওই গলির মধ্যে।

চলুন।

ট্যাক্সিটার চলে যাওয়া দেখল অর্ক। তারপর অলস পায়ে গলির মধ্যে ঢুকল। এখন নিশ্চয়ই বারোটা বেজে গেছে কারণ মোড়ের লণ্ড্রী বন্ধ। তার মানে মা এসে গিয়েছে। শরীরটা আচমকা শিথিল হয়ে এল ওর। গতকাল থেকে মায়ের সঙ্গে দেখা হয়নি তার। তিন নম্বরের সামনে আসতেই হাঁক শুনতে পেল, আ বে অক্ক।

ঘাড় ঘুরিয়ে চমকে উঠল সে, খুরকি আর কিলা শিবমন্দিরের রকে বসে আছে। দুজনের দৃষ্টি এদিকে। ওরা কখন ছাড়া পেল কে জানে কিন্তু দুজনেই দারুণ মাঞ্জা দিয়েছে। অর্ক হাসবার চেষ্টা করল, কখন এলি?

ওরা উত্তর দিল না কথাটার, খুরকি বলল, তোমার আশায় বসে আছি গুরু। শুনলাম কাল নাকি অ্যাকসিডেন্ট করেছিলে!

হ্যাঁ!

সকাল থেকে চিড়িয়া ফুরুত হয়েছিলে এদিকে আমরা শালা খাবি খাচ্ছি। মালটা দাও।

কিসের মাল? অর্ক রাস্তা পেরিয়ে এসে শিবমন্দিরের রকে পা তুলে দাঁড়াল।

পাবলিকের মাল কাল তোর কাছে রেখেছিলাম।

কত আছে?

সে আমি জানি না, আছে তাই জানি।

তাহলে আমি যা বলব তাই বিশ্বাস করতে হবে। দশ আছে।

দশ! দুজনেই একসঙ্গে চমকে উঠল।

পকেট থেকে দশটা টাকা বের করে দেখাল অর্ক।

বাকি টাকা?

কিসের বাকি! অর্ক চোয়াল শক্ত করল।

খুরকি তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। ওর হাত কোমরে। অর্ক জানে কোমরের কাছে একটা খোপে খুরকি খুর রাখে। কিন্তু সে একটুও ঘাবড়াবার লক্ষণ দেখাল না, রঙবাজি ছেড়ে দাও গুরু। যেভাবে বসেছিলে সেইভাবে না বসলে কোন কথা হবে না।

খুরকির মুখ বিস্ময়ে থেবড়ে গেল। অর্ককে এই ভঙ্গীতে কথা বলতে কেউ দ্যাখেনি আগে। কিলা খুরকির হাত ধরে টানল। অর্ক খুরকির দিকে তাকিয়ে বলল, কি বে, কানে শিবু ঢুকেছে?

ধীরে ধীরে খুরকি রকে কিলার পাশে বসতেই অর্কর মনে হল সে এই প্রথম জিতে গেল। কিন্তু সেই আনন্দের প্রকাশ তার মুখ চোখে এল না, আমি একা হাঁড়ি চাটতে চাই না। যে টাকা কাল বেঁচেছিল তা দিয়ে ব্ল্যাকের টিকিট কেনা হয়েছে। ব্যবসা হবার পর চারজনে সমান ভাগ হবে। ঠিক আছে?

খুরকির মুখে এবার হাসি ফুটল। কিলা বলল, চারজন কেন?

বাঃ বিলু কি ভোগে যাবে?

কথাটা বলে আর দাঁড়াল না অর্ক। বড় পা ফেলে রাস্তা পেরিয়ে তিন নম্বরের খাঁজে ঢুকে পড়ল। নিজেকে এখন বেশ লম্বা চওড়া মনে হচ্ছে। কিন্তু ন্যাড়াদের ঘরের সামনে এসে সে আরার গুটিয়ে যেতে লাগল। মাধবীলতা যদি তাকে, যদি কেন নিশ্চয়ই ঝাড়বে! সে দেখল অনু তাদের ঘরের মেঝেতে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। আর একটু ঘুরতেই নিজেদের আধভেজানো দরজা নজরে এল। প্রায় নিঃশব্দে দরজার সামনে দাঁড়াতেই মাধবীলতার গলা কানে এল অর্কর, এটা সুপ্রিয়ার বই, পরশু ফেরত দিতে হবে। দুবার পড়েছি তবু পড়তে ইচ্ছে করল।

কি বই? অনিমেষের গলা শুনল অর্ক। অত্যন্ত নিস্পৃহ।

পথের পাঁচালি।

০৯. অর্ক দরজা ঠেলতেই মাধবীলতা

অর্ক দরজা ঠেলতেই মাধবীলতা মুখ তুলল। প্রথমে বিস্ময় ফুটে উঠল চোখে তারপর মুখখানা শক্ত হয়ে গেল। মায়ের এই পরিবর্তন দেখা মাত্র অর্কর ঘাড় টান হল। বুকের ভেতর যে তিরতিরে ভয় ডালপালা মেলছিল প্রাণপণে সেটাকে রুখতে চাইছিল সে।

মাধবীলতার দুটো চোখ এখন জ্বলছে, হিসহিসে গলায় ছিটকে এল প্রশ্ন, কোথায় গিয়েছিলি?

ভয়টা চট করে বড় হচ্ছে টের পেতেই অর্কর গলা চড়া হল, কেন, বাবা বলেনি তোমাকে?

আমি তোকে প্রশ্ন করছি, তুই জবাব দে। মেঝেতে বসা মাধবীলতা সশব্দে সামনে নামিয়ে রাখা ভাতের সসপ্যানটা সরিয়ে দিল এক পাশে।

অ্যাকসিডেন্টের খবর দিতে গিয়েছিলাম। কাল রাত্রে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল, অল্পের জন্যে বেঁচে গিয়েছি। শেষের দিকে গলাটা নেমে এসেছিল অর্কর, যতটা নামালে যে শুনছে তার মন নরম হয়।

কাল সারাদিন, সারাদিন কোথায় ছিলি?

অনুর মাকে পোড়াতে গিয়েছিলাম। তুমি মাইরি এমন বাতেলা করছ যেন কিছুই জানো না। অর্ক খানিকটা বিস্ময়েই হাত নাড়ল।

কি বললি? একটা বিকট চিৎকার ছিটকে এল মাধবীলতার মুখ থেকে। উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল সে। মায়ের এই মূর্তি দেখে আচমকা কুঁকড়ে গেল অর্ক। জিভ জড়িয়ে গেল, কোনরকমে বলল, কি আবার বললাম!

সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষের দিকে ঘুরে দাঁড়াল মাধবীলতা, তুমি শুনতে পেয়েছ? এই তোমার ছেলে যাকে আমি! দাঁতে ঠোঁট চাপল সে! তারপর গোঙানির গলায় বলল, তুই বেরিয়ে যা, আমি তোর মুখ দেখতে চাই না।

এরকম একটা বাক্যের জন্যে প্রস্তুতি চলছিল অর্কর মনে। কানে ঢোকা মাত্র চ্যালেঞ্জের ভঙ্গীতে বলল, কেন?

মাধবীলতা প্রশ্নটা শুনে প্রথমে স্তম্ভিত তারপরেই প্রাণ ফিরে পেয়ে ছুটে গেল দরজার কাছে। হাত বাড়িয়ে হিড়হিড় করে ছেলেকে টেনে নিয়ে এল ঘরের মধ্যে। অর্ক কিছু বোঝার আগেই দুহাতে চড় মারতে লাগল ওর গালে মাথায় বুকে। বিস্ময়ের ধকলটা কাটিয়ে ওঠা মাত্র অর্ক হাত তুলে। আঘাত বাঁচাবার চেষ্টা করতেই মাধবীলতা আর্তনাদ করে উঠল। জোরে মারতে গিয়ে বেকায়দায় অর্কর কনুইএর হাড়ে তার লোহার নোয়া বেঁকে চামড়ায় মুখ বসিয়েছে। অন্য হাত তখনও অর্ককে খামচে ধরে ছিল।

নিজেকে বাঁচাতেই সেই হাতটাকে টেনে সরিয়ে দিতে মাধবীলতা পিছু হঠে খাটের ওপর গিয়ে পড়ল। অর্ক দেখল মায়ের কবজির ওপর এক বিন্দু রক্ত টলটল করছে।

অনিমেষ এতক্ষণ চুপচাপ কথাবার্তা শুনে যাচ্ছিল। খাটের ঠিক মাঝখানে খালি গায়ে বসে সে রক্তের ফোঁটাকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে উঠল, তুই মায়ের গায়ে হাত তুললি?

আমি মাকে মেরেছি? অর্ক ঘাবড়ে গেল যেন।

চোখের সামনে ঠেলে ফেলে দিলি আবার মিথ্যে কথা! হঠাৎ মাধবীলতা অনিমেষের দিকে মুখ ফেরালো, দোহাই, চুপ করো!

ও তোমাকে, ও তোমাকে–অনিমেষ যেন কথা খুঁজে পাচ্ছিল না।

তুমি চুপ করো। আমি যদি একা থাকতাম তাহলে ও কখনই এরকম হতো না।

তার মানে? আমি আসার পর থেকে ও পাল্টেছে?

হ্যাঁ, সেটাই ঘটনা। তুমি তো এখন শালগ্রামশিলা, তোমাকে আর কি বোঝাব। মাধবীলতা তর্জনী দিয়ে রক্তের ফোঁটা মুছে নিল

আচ্ছা! অনিমেষের কণ্ঠস্বর এখন খ্যানখেনে, আমি যে তোমার বোঝা সে কথাটা এতদিনে মুখ ফুটে বললে!

বোঝা ছিলে না, ক্রমশ বোঝা বানিয়ে নিচ্ছ নিজেকে!

হ্যাঁ, এখন তো আমার অনেক দোষ হবে। আমি হাঁটতে পারি না, কাঁড়ি কাঁড়ি পয়সা রোজগার করি না, তোমার ঘাড়ে বসে খাচ্ছি কথা তো শোনাবেই। অনিমেষের বুক বাতাস শূন্য হল।

এসব কথা আমি বলিনি। তুমি নিজে ভাবছ

আর বলতে কি বাকি রাখলে! আমি তো তোমার কাছে আসতে চাইনি, তুমিই ছুটে গিয়েছিলে আমাকে আনতে। আঃ!

মাধবীলতার চিবুক বুকে গিয়ে ঠেকেছিল। সেই অবস্থায় সে মাথা নাড়ল, এমনভাবে বলোনা, আমি তো তোমাকে কিছুই বলতে চাইনি। সব জেনে শুনেও তুমি একথা বলতে পারলে! মাধবীলতা দেখল কবজির চামড়া আবার ভিজে ভিজে দেখাচ্ছে। এখন আর রক্ত ফোঁটা হয়ে ফুটছে না। তিরতিরে হয়ে চামড়ায় ছড়িয়ে পড়ছে।

সে উঠল। তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, স্নান করে নাও। খেয়েদেয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলব।

গলার স্বর এবং বলার ভঙ্গী যে এখন একদম পাল্টে গেছে সেটা বুঝতে অসুবিধে হল না অর্ক কিংবা অনিমেষের। খানিক আগের সেই আক্ষেপে জর্জরিত উত্তেজনা এখন শামুকের মত মুখ লুকিয়েছে। হঠাৎ অত্যন্ত শান্ত কিন্তু কঠিন পাথরের মত হয়ে গেছে মুখের চেহারা। গলার স্বরে যে শীতলতা ফিরে এসেছে তাকে একটুও পছন্দ করে না অর্ক। এত উত্তেজনা কিংবা রাগারাগি যা কিনা। এই বস্তির আর পাঁচটা ঘরের মত স্বাভাবিক সেটা কিছুতেই মেলে না মায়ের এই পরিবর্তনের সঙ্গে। কিন্তু অর্ক বুঝতে পারে যে ঝড় আসছে এবং সেই ঝড়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানো অসম্ভব।

মাধবীলতা জামাকাপড় গামছা এবং বালতি নিয়ে ঘর থেকে বের হবার সময় সামান্য দাঁড়িয়ে আবার পা বাড়াল। ওর হাতে নিজের এবং অনিমেষের ময়লা কাপড় অর্ককে খুলে দিতে বলতে গিয়ে সামলে নিল সে। এতদিন ওর যাবতীয় জামা প্যান্ট গেঞ্জি মায় আণ্ডারওয়ার পর্যন্ত সে কেচে দিত। আজ থেকে আর নয়। দরজার বাইরে পা দিয়ে সে চারপাশে একবার তাকাল। না, কোন ভিড় জমেনি। অর্থাৎ তাদের ঘরের কথা কাউকে আকর্ষণ করেনি। একটু চিৎকারে যদি খেয়োখেয়ির গন্ধ থাকে তাহলে বস্তির মানুষ মাছির মত ভনভন করে। আজ হয়নি এটুকুই শান্তি। ১ এত বছরে একটা অভ্যেস হল না মাধবীলতার। এই বস্তির আর পাঁচটা মেয়ের মত খোলামেলা হয়ে স্নান করতে আটকে যায় তার। প্রথম দিকে সি এম ডি এ যখন মেয়েদের স্নানের জায়গা আলাদা করে দেয়নি তখন কয়েক মগ মাথায় ঢেলে বুকে গামছা জড়িয়ে ঘরে ফিরে কাপড় ছাড়তে। তারপর অভ্যেস করেছিল অন্ধকার থাকতে ওঠার। কেউ জাগবার আগেই শরীরের প্রয়োজনগুলো চুকিয়ে ঘরে স্থির হয়ে বসা। খুব কষ্ট হত, কোন কোন দিন বেলায় ঘুম ভাঙ্গলে আর গায়ে জল ঢালা হত না। সে সময় মাধবীলতার প্রায়ই শ্রীশ্রীমায়ের কথা মনে পড়ত। বছরের পর বছর ওই মুরগির খাঁচার মত ঘরে দিন রাত বন্দী হয়ে থাকতেন তিনি। দিনের বেলায় প্রাকৃতিক কাজ করার কোন উপায় ছিল না। অন্ধকার থাকতে তাঁকে যেতে হত গঙ্গায়। প্রাতঃকৃত্য করে স্নান সেরে আবার সারাদিনের মত ঢুকতেন খাঁচায়। কষ্ট হয়নি তাঁর? নিয়মটা ভাঙ্গতে ইচ্ছে হয়নি? কোন বই-এ সে খবর পায়নি মাধবীলতা। তবে শ্রীশ্রীমায়ের কথা ভাবলে তখন মনে জোর আসতো। সে একরকম আনন্দ যার খবর আগে জানা ছিল না।

অনুদের দরজার সামনে দিয়ে নীরবে চলে এল মাধবীলতা। ওই দরজার দিকে তাকাতেই শরীর কুঁকড়ে উঠল। গতকালও সেই মহিলা ওখানে ছিলেন। মৃত্যু স্থির। শুধু জীবন তার কাছ থেকে পিছলে পিছলে সাময়িক সরে যেতে চায়। ওই ঘরে সেটা হল না। হয় না।

কল খুলে বালতিটা পেতে দিতেই জলের শব্দ ধক্ করে উঠল। তারপর নিঃসাড়ে শব্দের বয়ে বয়ে যাওয়া। মাধবীলতা মাথা নাড়ল, না মরতে ইচ্ছে করে না একটুও। তাছাড়া এখন মরলে ওই ধারগুলো শুধবে কে? কিন্তু কেন বেঁচে থাকা? আমি কেন বাঁচবো? মাধবীলতা মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল। মেঘ নেই, নীল নেই, একটুও চোখের আরাম নেই। শুধুই ক্যাটকেটে শূন্য। যতই ওপরে যাও কোন স্পর্শ নেই কিংবা গন্ধ। ঠিক জীবনের মত। আগামীকালটার জন্য কেন অপেক্ষা করব তা জানি না। ঘুম ভেঙ্গে আজ যা করেছি তা কাল কেন পুনরাবৃত্তি করব? কোন উত্তর নেই। তবু মরে যেতে ইচ্ছে করে না। কেন যে করে না।

রবিবার ছাড়া এই সময়টা কলতলা খালি থাকে। জামাকাপড় কেচে স্নানের ঘরে ঢুকল সে। সি এম ডি এ মাথায় একটা ছাদ আর চারপাশে পাঁচ ফুট দেওয়াল তুলে দিয়েছে। অল্প বয়সী মেয়েরাই এটাকে ব্যবহার করে। মাধবীলতার বয়সী যারা তারা বাইরেই স্নান সারে। পঁয়ত্রিশ পেরিয়ে গেলে ওদের লজ্জাবোধ কমে আসে। আসা যাওয়ার পথের পাশে ওই কলের সামনে বসে উদোম পিঠে সাবান ঘষতে কারো কোন সঙ্কোচ হয় না। দরজা বন্ধ করে মগে জল নিতেই মাধবীলতার শরীর আচমকা থরথরিয়ে কেঁপে উঠল। বুকে চিনচিনে ব্যথা, নিঃশ্বাসে চাপ আর তারপরেই হাউ হাউ কান্নাটাকে দাঁতে দাঁত চেপে সামলালো সে। ঠোঁট দুটো কাঁপছে, কাঁধ পিঠ, দুই চোখ ঝাঁপসা। মগের জল পড়ে গেল বালতিতে এবং মাটিতে। বন্ধ স্নানের ঘরের মেঝেতে বসে পড়ল মাধবীলতা। নিজের শরীরটা এখন স্পর্শে এক, কাঁপুনিটা ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। আর তখনই। দরজায় কেউ ধাক্কা দিল। এত দ্রুত কান্নাকে লুকোন যায় না। কিন্তু ত্রস্ত হল মাধবীলতা। শরীর উজাড় করে আসা কান্নাকে প্রাণপণে শরীরেই ফেরত পাঠাল।

.

জামাটাকে একটানে খুলে অর্ক বাবার দিকে তাকাল। অনিমেষ এখন পাথরের মূর্তির মত বসে আছে। অর্ক খাটের সামনে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুমি মা-কে বলনি কিছু?

অনিমেষ উত্তর দিল না। বোধহয় প্রশ্নটা তার কানে ঢোকেনি। অর্ক এবার সামান্য গলা তুলল, বাবা!

এবার অনিমেষ চেতনায় ফিরল। চকিতে ছেলের দিকে তাকাতেই তার কপালে ভাঁজ পড়ল। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে অর্ক তৃতীয়বার প্রশ্ন করতে সাহস পেল না। ময়লা জামা প্যান্ট নিয়ে দ্রুত পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

এখন অনিমেষ এই ঘরে একা, দরজা হাট করে খোলা। আমি শালগ্রামশিলা! কি আশ্চর্য। আমি সেই অনিমেষ মিত্র যে উত্তাল আন্দোলনে একসময় শামিল হয়েছিল সে নেহাতই জড়ভরত। কে কবে কি করেছিল তা নিয়ে বিচার করে কি হবে, সত্যি যা তা সব সময়েই সত্যি। এখন সে প্রকৃত অর্থেই দায় ছাড়া কিছু নয়। যেটা স্বাভাবিক সেটাকেই মেনে নেওয়া উচিত।

কথাটা গতকাল ছেলের মুখে শুনেও তার চৈতন্য হয়নি। এখন পৃথিবীর অনেক হাত-পা কাটা মানুষ রোজগার করে। সে কেন পারবে না? একটা সিগারেটের দোকান বা ওইরকম কিছু করলে নিশ্চয়ই চালাতে পারবে। অনিমেষ চোখ বন্ধ করে নিজের দোকান করা দেখল। সঙ্গে সঙ্গে একধরনের হীনতাভাব তাকে আচ্ছন্ন করল। একটা সিগারেটের দোকানের মালিক হওয়ার জন্যে কি সে স্কটিশে ভরতি হয়েছিল? অতদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিল? বিরাট একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল বুক থেকে। অথচ গতকাল ছেলের মুখে সেই পঙ্গু লোকটার দোকান করার গল্প শোনার পর থেকে নিজের রোজগারের কথা মনে হলেই সিগারেটওয়ালা ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছে না। আচ্ছা, দুটো হাত এবং মস্তিষ্ক দিয়ে আর কি করা যায়?

এই ঘরে অনেক দিন কেটে গেল। কত বছর? হিসেবের দরকার নেই, অর্ককে দেখলেই তো বোঝা যায়। চুপচাপ নিঃসঙ্গ কাটিয়ে যাওয়া! নিঃসঙ্গ? অনিমেষ নিজের ঠোঁট নিজেই কামড়ালো। কেন মাধবীলতা ছিল না? অর্ক ছিল না? ছিল, তবু এই মুহূর্তে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে কেন? এই বস্তির ঘরে আসার পর থেকে মাধবীলতা বারংবার তাকে অনুরোধ করেছে। জলপাইগুড়ির চা বাগানে চিঠি দিতে। যে কোন মেয়েই বোধহয় প্রথমে শ্বশুর শাশুড়ির সংস্পর্শ কামনা করে। কিন্তু প্রবলভাবে আপত্তি করেছিল অনিমেষ। না, শরীরের এই অবস্থায় কাউকেই নিজের অস্তিত্ব জানাতে চায় না সে। বাবার সঙ্গে তার আবাল্য যে ফাঁক ছিল সেটা তখন আরও বড় হয়ে গিয়েছে। ছোটমায়ের কথা মনে পড়ত কিন্তু নিজের শরীর নিয়ে কারো দ্বারস্থ হওয়া মানে তাকে বিব্রত করা, মাধবীলতা যেচে যা কাঁধে নিয়েছে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার কোন যুক্তি ছিল না। তাই এই বস্তির ঘরে এক ধরনের স্বেচ্ছা নির্বাসনে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে পড়ল সে। তখন মনে হত, যদি কখনও শরীর আগের সুস্থতা ফিরে পায় তাহলে সবাইকে নিয়ে জলপাইগুড়িতে বেড়াতে যাবে। এ নিয়ে মাধবীলতার সঙ্গে নানান গল্প হত, সেই গল্প শোনার জন্যে অর্ক কান খাড়া করে থাকতো। একটু একটু করে সে জেনে গিয়েছিল তার ঠাকুরদা-ঠাকুমা যে জায়গায় থাকেন তার নাম স্বৰ্গছেঁড়া। তার একজন বড়দিদা আছেন যিনি চমৎকার পায়েস রাঁধতে পারেন। সেখানে চারধারে যতদূর তাকানো যায় শুধু সবুজের ভিড়, চায়ের বাগান এবং খেলার মাঠ। এক সময় অর্ক বায়না ধরতা সেখানে যাওয়ার জন্যে, অনেক কষ্টে ভোলাতে হত তাকে। একটু বড় হওয়ার পর আর ওসব কথা বলতো না সে,এ নিয়ে আলোচনাও হত না এই ঘরে। সেই সময় অর্ক তো সারাক্ষণই তার কাছে থাকতো। সেই শিশু অবিরাম প্রশ্ন করতে কেন সে হাঁটতে পারে না? প্রথম প্রথম এড়িয়ে যেত। কিন্তু একা থাকতে থাকতে মানুষের মন নিশ্চয়ই দুর্বল হয়ে পড়ে নইলে শুধু কথা বলতে পারার নেশায় কেন সে একে একে সব কথা ওই ছোট্ট ছেলেটাকে বলত? কি করে এই দেশ স্বাধীন হল, কংগ্রেসের রাজত্ব, তার কলকাতায় আসার রাতের ঘটনা, আহত হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকা, সি পি এমে যোগ দেওয়া এবং শেষ পর্যন্ত নকশাল আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার গল্প শোনাতো সে ছেলেকে। কথাগুলোর অর্থ ধরতে পারতো না অর্ক কিন্তু বারংবার শুনতে চাইতো। আর একই কথা দিনের পর দিন বলতে একটুও ক্লান্তিবোধ করত না অনিমেষ। প্রথম দিকে মনে হত এই সব ঘটনা আর তার সমালোচনা ওই শিশুর মনে নিশ্চয়ই ছাপ রাখছে। এগুলো থেকে ভবিষ্যতে সে পথ চিনে নিতে পারবে। কিন্তু ক্রমশ অর্কর আকর্ষণ বাড়লো সেইসব অংশের ওপর যেখানে অ্যাকশন আছে। সেই ঘটনাগুলোই বারংবার শুনতে চাইতো।

আর একটু বড় হয়ে একদিন স্কুল থেকে ফিরে অর্ক তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, বাবা, তুমি মানুষ মারতে?

মানষ মারতাম? অনিমেষ অবাক, কে বলল?

শুনেছি। বল না, কটা মানুষকে মেরেছ তুমি?

কে বলেছে তোকে এসব কথা?

আমার ক্লাসের একটা ছেলে। নকশালরা নাকি দুমদাম মানুষ মারতো। তাই নকশালদের পুলিশ মেরেছে। তাই?

অনিমেষের খুব রাগ হয়ে যেত। এইসব অপপ্রচার থেকে শিশুদের মুক্ত করা দরকার। ও তখন অর্ককে নিয়ে পড়তো, খুব বিশদভাবে ওকে নকশাল আন্দোলনের লক্ষ্য বোঝাতো। কিন্তু সেটা শুরু করলেই ছটফটানি আরম্ভ হত অর্কর। কিছুতেই কোন গভীর কথাবার্তা পছন্দ হত না তার।

কিন্তু মাধবীলতা বলল সে একা থাকলে অর্ক নাকি এমন হত না। কথাটা কি সত্যি? অনিমেষ ভাবছিল। সে তো অর্ককে বুকে আঁকড়ে রেখেছিল। কখন কোন ফাঁকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে জলের মতন মুঠো থেকে বেরিয়ে গেল তা টের পায়নি। কিন্তু তার চেষ্টায় তো কোন ফাঁকি ছিল না। মাধবীলতা এর থেকে বেশি কি পারতো? কিন্তু না, আর নয়, এবার বেরোতেই হবে। পা-দুটো যখন আর কখনই সারবার নয় তখন বাইরের পৃথিবীটাকে একটু দেখা দরকার। অনিমেষের মনে জেদ এল, সে এবার থেকে রোজগার করবে, যেভাবেই হোক।

.

স্নান সেরে বাইরে বেরিয়ে এল মাধবীলতা। এখন ওর মুখ বেশ শান্ত। সৌন্দর্য চলে যেতে যেতে যেটুকু রয়ে গেছে তাতেই তাকে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়। সে দেখল বারোয়ারি কলতলায় অর্ক খাটো প্যান্ট পরে গায়ে জল ঢালছে। অর্ক কল দখলে রাখায় কয়েকজন অপেক্ষা করে আছে। সেই কালো লম্বা মেয়েটা হাঁ করে অর্কর শরীর দেখছে। মেয়েটা মোটেই ভাল নয়। হাব ভাব ভঙ্গীতেই সেই ভাল না হওয়াটা স্পষ্ট। মাধবীলতা মুখ ফিরিয়ে নিল। এই বস্তিতে কেউ নিজে ঠিক না থাকলে ঠিক রাখা মুশকিল। খামোকা চেষ্টা করে কি লাভ।

ঘরের সামনের প্যাসেজটায় একটা তার টাঙানো রয়েছে। কাঁচা কাপড় মেলতে এসে মাধবীলতা বিব্রত হল। একটুও জায়গা খালি নেই। অথচ কলঘরে যাওয়ার আগে এত কাপড় এখানে ছিল না। এটা অদ্ভুত একরকম জেদাজেদি। সে কলঘরে গিয়েছে মানেই ফিরে এসে কাঁচা কাপড় মেলবে। এটা জেনেই কেউ না কেউ তাড়াতাড়ি তার দখল করে রেখেছে। মাধবীলতার নজরে পড়ল অর্কর শার্ট এবং প্যান্ট তারের একপাশে ঝুলছে। টপটপ করে জল ঝরছে সেগুলো থেকে। ধোয়ার পর যে জলটা নিংড়োতে হয় সে বোধ পর্যন্ত নেই। কিন্তু আজ যে হঠাৎ নিজেই নিজের জামা কাপড় নিজে কাঁচল। যদিও মাধবীলতা মুখ ফুটে তখন বলেনি তবু এখন খারাপ লাগছিল। জীবনে বোধহয় আজই প্রথম ছেলেটা এই পরিশ্রম করল।

কাপড়গুলো সরিয়ে সরিয়ে খানিকটা জায়গা বের করে মাধবীলতা নিজের কাঁচা কাপড়গুলো মেলে দিল। ছড়াতে না পারলেও শুকিয়ে যাবে। ব্রেসিয়ারটা চট করে তারে ঝুলিয়ে ব্লাউজ দিয়ে চাপা দিল সে। নিজের অন্তর্বাস প্রকাশ্যে মেলে ধরতে রুচিতে বাধে তার। অথচ এই বস্তিতে এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। কদিন আগে অর্কর প্যান্টের গায়ে অনুর ময়লা ব্রেসিয়ার নেতিয়ে ছিল, দেখে মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছিল তার।

ঘরে ঢুকে কয়েকটা ক্লিপ নিয়ে সে আবার বেরিয়ে এল। অনিমেষ যে তখনও খাটে বসে আছে টের পেয়েও তাকায়নি। ক্লিপ গুলোয় জামাকাপড় আটকে ঘরে ফিরতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল মাধবীলতা। তারপর অর্কর জামাটা নামিয়ে জল নিংড়ে আবার মেলে দিল। প্যান্টটা নামাতে নামাতে দেখল অর্ক স্নান সেরে দ্রুত পায়ে ফিরছে। ওর হাতে প্যান্ট দেখে যেন আঁতকে উঠল। ছেলেটা। প্রায় দৌড়ে এসে বল্ল, আমার প্যান্ট তুমি ধরো না, ছেড়ে দাও বলছি।

কেন? খুব অবাক হল মাধবীলতা।

একটু তোতলালো অর্ক, তুমি তো কাচোঁনি, আমি কেচেছি।

কেমন কেচেছিস তা তো দেখতেই পাচ্ছি। জলটা যে নিংড়োতে হয় তা জানিস না। মাধবীলতা ঈষৎ মুচড়ে জল ঝরাচ্ছিল।

অর্কর খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। মায়ের হাত থেকে প্যান্টটা কেড়ে নিতে পারলেই যেন সে বেঁচে যায়। প্রথমে প্যান্টটাকে মাধবীলতার হাতে দেখে সে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। এখন অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত রাখছিল সে। মাধবীলতার বিস্ময় বাড়ছে। ছেলে ওইরকম চোখে প্যান্টের দিকে তাকাচ্ছে কেন? শুধু নিজে কেচেছে এই অহঙ্কারে তাকে স্পর্শ করতে দিতে চায় না, তাই? সে প্যান্টটাকে ঝাড়তেই অর্ক ছোঁ মেরে প্যান্টটা নিয়ে বলল, আমার প্যান্ট আমি মেলব। এখন থেকে কাউকে আমার কাজ করতে হবে না।

মাধবীলতা হাসল, ভাল। চৈতন্য উদয় হলেই ভাল।

মা ঘরে ঢুকে গেলে অর্ক দ্রুত হাত ঢোকাল ভেজা প্যান্টের পকেটে। আঙ্গুলের ডগা যে ভেজা কাগজটাকে তুলে নিয়ে এল সেটা যে দশ টাকার নোট তা বুঝতে অসুবিধে হল না। অন্য পকেটে হাত চালালো সে। কিছুই নেই। আবার তন্নতন্ন করে পকেট দুটো দেখে সে পাথর হয়ে গেল। হারখানা নেই।

অবশ ভাবটা কাটতেই সে চকিতে মাটিতে চোখ রাখল। পুরো প্যাসেজটা তন্ন তন্ন করে খুঁজতে খুঁজতে অনুর গলা শুনল সে, কি হারিয়েছে?

সে চোখ তুলে সন্দেহের গলায় জিজ্ঞাসা করল, কেন?

হারিয়েছে মনে হচ্ছে তাই। অনু যে অবাক হয়েছে বোঝা গেল।

অর্ক জবাব দিল না। ওর মাথা ঘুরছিল। ভারী দামী সোনার হার। একটা লকেটও ছিল। সেটা কি হীরের? রাগের মাথায় নিজের জামাপ্যান্ট নিয়ে কলতলায় গিয়ে জলে ডুবিয়েছিল সে। এমন বেহুঁশ যে খেয়ালেই ছিল না হারোনার কথা। নিজের পাছায় নিজেরই লাথি মারতে ইচ্ছে করছিল তার। এই একটু আগে স্নান শেষ করার পর খেয়াল হতেই ছুটে আসছে সে। মায়ের হাতে প্যান্ট দেখে বুক কেঁপে উঠেছিল। আচ্ছা, মা কি হারখানা দেখে সরিয়ে ফেলেছে?

প্যান্টটাকে তারের ওপর ছুঁড়ে ফেলে সে ঘরে ঢুকল। মাধবীলতা তখন চুল আঁচড়াচ্ছে। অর্ক শক্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি আমার প্যান্টের পকেট থেকে কিছু নিয়েছ?

আমি?

হ্যাঁ!

না তো! কি ছিল?

নাওনি?

কি বলছিস তুই? তোর প্যান্টে এমন কি থাকতে পারে যে আমি নিতে যাব? মাধবীলতা ছেলের মুখ দেখে অবাক হয়ে গেল।

অর্ক এবার বিব্রত হল। মা যদি না নিয়ে থাকে তবে কোথায় গেল? শেষ কখন সে হারখানা দেখেছিল মনে করার চেষ্টা করল!

কি ছিল তোর পকেটে? এবারের প্রশ্ন অনিমেষের।

অর্ক প্রথমে বাবা তারপর মাকে দেখল। সত্যি কথাটা বলবে নাকি? ওরা বিশ্বাস করবে? উঁহু করবে না। বলবে লেকটাউনে খবর দিতে যখন গিয়েছিল তখন হারখানা দিয়ে আসেনি কেন? অথচ এমনভাবে দুজনে তাকিয়ে আছে যে একটা জবাব দেওয়া দরকার। সে মাথা নেড়ে বলল, টাকা ছিল।

মাধবীলতা চাপা গলায় বলল, টাকা! টাকা কোত্থেকে পেলি তুই? তোর বাঁ হাতে ওটা কি? অর্ক মুঠোটা তুলতেই ভেজা কোঁচকানো দশ টাকা স্পষ্ট হল। অনিমেষ বলল, ওই তো। ভিজে গেল কি করে?

মাধবীলতা বলল, তুই টাকা পেলি কোথায়?

তোমার কি দরকার বলতে গিয়ে সামলে নিল অর্ক, কাল শ্মশান থেকে ফিরে ওরা রাখতে দিয়েছিল।

কারা?

বিলুরা। অনুর মাকে পোড়াবার জন্যে চাঁদা তুলেছিল।

কথাটা শুনে মাধবীলতা বিরক্ত হল আরও, যার টাকা তাকে ফেরত দিসনি কেন? খেয়ে উঠেই দিয়ে আসবি।

অনিমেষ বলল, টাকাটা কার তাই তো সমস্যা, না অর্ক?

মাধবীলতা বলল, ওসব আমার জানার দরকার নেই, টাকাটা তোর কাছে রাখবি না। কিন্তু হাতে টাকা নিয়ে তুই খুঁজে বেড়াচ্ছিস?

অর্ক আর কথা বাড়াল না। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। নিশ্চয়ই রাস্তায় পড়ে যায়নি। জামাপ্যান্ট পাল্টাতে পাল্টাতে ওর মনে হল বিলাস সোম যদি সেরে উঠে তার কাছে হারখানা ফেরত চায় সে কি জবাব দেবে? কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না। কেউ না। হারখানা খুঁজে বের করতেই হবে, জান কসম!

১০. কথাগুলো কানে ঢুকছিল না অর্কর

কথাগুলো কানে ঢুকছিল না অর্কর। খাওয়া শেষ হওয়ার পর মাধবীলতা ওকে নিয়ে পড়েছিল। প্রাণপণে বোঝাবার চেষ্টা করছিল ছেলেকে। এই বস্তির আর পাঁচটা পরিবারের মত তারা নয়। পৃথিবীতে সবকিছু নষ্ট হয়ে যেতে পারে কিন্তু রুচিবোধ, ভদ্রতা এবং মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ক্ষমতা যেন লোপ না পায়। ওর বাবা এই দেশটাকে নতুনভাবে গড়তে চেয়েছিল। কোটি কোটি মানুষ যাতে পেটভরে খেয়ে সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশে বাঁচতে পারে সেই স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু বড় দাম দিতে হয়েছে তাকে। সে নিশ্চয়ই প্রতিদিন এটা দেখছে। মাধবীলতা অবশ্য নিজের পরিশ্রমের কথা ছেলের কাছে বলল না। যেন এ এমন ঘটনা যা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়াও লজ্জার। তাদের দুজনের আশাভরসা অর্ক। ওর জন্যেই বেঁচে থাকা যায়। একবছর না হয় পরীক্ষার ফল খারাপ হয়েছে কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। বাইরের হৈ চৈ থেকে মন সরিয়ে এনে অর্ক পড়াশুনা করুক। মাধবীলতা কিছুদিন বাদেই এখান থেকে উঠে একটু ভদ্রপাড়ায় চলে যাবে। তখন আর অসুবিধে হবে না অর্কর। যতদূর পড়তে চাইবে অর্ক মাধবীলতা তাকে পড়াবে। বই-এর জগতে একবার ঢুকে পড়লে মনে হবে পৃথিবীতে এর চেয়ে আরাম কিছুতেই নেই। অর্ক এমন কিছু ভবিষ্যতে করুক যাতে তাকে নিয়ে ওরা গর্ববোধ করতে পারে, পাঁচজনকে সে বলতে পারে অর্ক তার ছেলে।

মাঝে মাঝে মন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছিল অর্ক। মায়ের কথা তাকে শুনতে হচ্ছে কিন্তু হারখানা ছাড়া অন্য কিছু সে ভাবতে পারছে না। ভাত খেয়ে মুখ ধোওয়ার সময় সে কলতলাটাও ভাল করে দেখে এসেছে। না, কোথাও হার নেই। তাহলে? এইসময় মাধবীলতা তাকে জিজ্ঞাসা করল, কি হল! আমি যা বলছি তা কানে ঢুকছে?

আমার পড়াশুনা করতে ভাল লাগে না। অর্ক মুখ ফেরাল। যেন দম বন্ধ হয়ে গেল মাধবীলতার। এতক্ষণ ধরে বোঝাতে বোঝাতে যে শান্তির ছায়াটুকু জমছিল মুহূর্তেই তা উধাও হল। তবু সে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করল, কি ভাল লাগে?

জানি না।

জানি না বললে চলবে না। তোকে স্পষ্ট বলতে হবে তুই কি করতে চাস। বস্তির ওই লুম্পেনগুলোর সঙ্গে আড্ডা মারলে চলবে?

লুম্পেন? লুম্পেন মানে কি?

মাধবীলতা হতাশভঙ্গীতে অনিমেষের দিকে তাকাল। অনিমেষ এতক্ষণ ছেলের দিকে তাকিয়েছিল। বলল, পড়াশুনাকে ভালবাসতে হবে।

কি হবে পড়ে? আজকাল কেউ পড়াশুনা করে বড় হয় না।

কি করে হয়?

তাহলে বি. এ. পাশ করে সুদীনদারকে আড্ডা মারত না। মাদার ডেয়ারির দুধ বেচে যে লোকটা সেও নাকি বি. এ. পাশ। তুমিও তো পড়াশুনা করেছ, কি বড় হয়েছ বল? অর্ক সোজাসুজি মাধবীলতাকে প্রশ্ন করল। মাধবীলতার মুখ টানটান, কিন্তু কি করলে বড় হয় এখনও বলিসনি।

আমি জানি না। পড়াশুনা করলে যদি বড় হওয়া যেত তাহলে এত হাজার হাজার ছেলে পড়ছে সব বড় হয়ে যেত। সতীশদাকে পাড়ার সবাই খাতির করে সি পি এমের নেতা বলে। ক্লাশ টেন অবধি পড়েছে, সবাই জানে। সতীশদা একদিন মন্ত্রী হয়ে যাবে, তখন? অর্ক উঠে দাঁড়াল।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাচ্ছিস?

কাজ আছে।

কাজ? তোর আবার কাজ কি! শোন, তোকে একটা কথা স্পষ্ট বলে দিচ্ছি। আমি চাই না যে তুই বারো ক্লাশ পাশ করার আগে আমার অবাধ্য হবি। তারপর তুই যা ইচ্ছে কর আমি দেখতে যাব না। কিন্তু এখন থেকে ওই নোংরা ছেলেগুলোর সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করতে হবে। একজন ছাত্রের যা যা করা দরকার তুমি তাই করবে। সন্ধ্যে হবার আগেই বাড়িতে ফিরবে। এসব যদি না করতে পারিস তাহলে আমাকে স্পষ্ট বলে দে।

অর্ক মায়ের মুখের দিকে তাকাল। কেন জানে না ওই মুখের দিকে তাকালে তার বুকের ভেতরটায় কেমন ভয় হয়। সে জানে তাদের বাঁচানোর জন্যে মা সারাদিন পরিশ্রম করে যাচ্ছে। কিন্তু পড়াশুনা করে যে কিছু হয় না এই কথাটা মা বোঝে না কেন? বরং কিলার কথাটা সত্যি, মুরগি ধর আর জবাই কর নইলে তুমি ভোগে যাবে।

ঠিক তখনই দরজায় শব্দ হল, মাস্টারনি!

মোক্ষবুড়ির গলা। মাধবীলতার কপালে ভাঁজ পড়ল। অর্ক এরকম সুযোগ ছাড়ল না। চট করে ঘুরে দরজার পাল্লা খুলে জিজ্ঞাসা করল, কি চাই?

বুড়ি তখন দরজার গোড়ায় উবু হয়ে বসেছে, মাস্টারনি নেই?

মাধবীলতা বুড়িকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করল, আছি, কি দরকার?

তোমাদের খাওয়া দাওয়া এখনও হয়নি, না?

হয়ে গেছে।

হাড়িতে কি দুমুঠো আছে?

কেন?

কাল থেকে কিছু খাইনি আমি। পেটে বড় জ্বালা ধরেছে লা। ডুকরে উঠল বুড়ি। অন্ধ চোখ দুটো ভাঁজ করা হাঁটুর ওপর স্থির।

বাড়ির লোক খেতে দেয় না?

সে তো কাল শ্মশান থেকে ফেরেনি।

মাধবীলতা অর্কর দিকে তাকাতে চট করে সে দরজা পার হল, আমি স্কুল থেকে ঘুরে আসছি। দুদিনে কি পড়াল—। আর দাঁড়াল না সে। অনুদের ঘর পেরিয়ে কলতলায় এসে আবার থমকে দাঁড়াল। কিলা যদি কাল থেকে ঘরে না ফিরে থাকে তাহলে কোত্থেকে অত মাঞ্জা দিল! কিলার মা নেই, বাপটা খুব শুড্যা। বুড়িটাকে খেতে দেয় না বোধহয়। অর্কর চোখ ঘুরছিল। কলতলার ইটের খাঁজগুলো সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। অনেক ভেবেচিন্তে সে নিশ্চিত হয়েছে যে হারখানা এই কলতলায় পড়েছে। নিশ্চয়ই কোন শালা হজম করেছে মালটাকে।

এর মধ্যে অনেকের চোখেই পড়ে গেছে যে অর্ক কিছু খুঁজছে। কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করতে আরম্ভ করল।

এ শালা এক ঝামেলা। বলাও যাবে না আবার চাপলে মুরগি। সে গম্ভীর গলায় বলল, স্নান করার সময় পকেট থেকে একটা টাকা পড়ে গেছে। গোল টাকা।

সঙ্গে সঙ্গে কয়েক জোড়া চোখ টাকাটাকে খুঁজতে লাগল। অর্ক মনে করতে চেষ্টা করছিল তার স্নানের সময় কে কে ছিল। ওপাশের ঘরের একটা বাচ্চা মেয়ে দাঁড়িয়েছিল তখন। খালি গায়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল চুষছিল। মনে হতেই অর্ক পাশের সরু গলি দিয়ে এগোল। ঘরের দরজায় মেয়েটা দাঁড়িয়ে আঙ্গুল চুষছে। অর্ক তাকে জিজ্ঞাসা করল, এই, তখন স্নানের সময় আমার পকেট থেকে যেটা পড়েছিল সেটা কে নিয়েছে দেখেছিস?

খুব দ্রুত ঘাড় নাড়ল মেয়েটা, না। হতাশ হল অর্ক। আর কে ছিল? তখনই ওর মনে সেই কালো মেয়েটির মুখ ভেসে উঠল। কি বলে ও নাকি লাইনের। রোজ বিকেলে সেজেগুঁজে ঈশ্বর পুকুর লেন থেকে বেরিয়ে যায়। সবাই জানে ঝুমকি নার্সিংহোমে আয়ার কাজ করে। কিলা বলে, ফোট, ওসব নকশা। আমি নিজের চোখে দেখেছি খদ্দেরের সঙ্গে রিকশায় যেতে। এরপরে আর কথা চলে না। মেয়েটার মুখ চোখ দেখে বিশ্বাস করতে অবশ্য ইচ্ছে হয় না অর্কর। কিছুদিন আগে সে কিলাদের সঙ্গে খান্না সিনেমার সামনে দাঁড়িয়েছিল। তখন বিকেল। একটা মেয়েকে দেখিয়ে কিলা বলেছিল, এ শালী রাণ্ডি। রকে বসে এইসব শব্দগুলো ভালমতন বুঝে গেছে অর্ক। ও দেখল একটি মাঝবয়সী মেয়ে হেলে দুলে যাচ্ছে। মুখে খসখসে সাদা পাউডার, কাজল চোখ ছাড়িয়ে অনেকটা ডানা মেলেছে। সে চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করেছিল, কি করে বুঝলি?

কিলা হেসেছিল। তারপর বলেছিল, কোথায় ঢোকে দ্যাখ! অর্ক দেখেছিল রাস্তা পার হয়ে মেয়েটা চাপা ঘরগুলোর খাঁজে ঢুকে গেল। সেখানে বিভিন্ন বয়সের কুৎসিত চেহারার আরও কিছু মেয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। কিলা বলেছিল, এটা খুব খারাপ ঠেক ওস্তাদ, সীতাপতি আর গণপতিদের মন্দির। অর্ক জিজ্ঞাসা করেছিল, তারা কে?

হো হো করে হেসেছিল কিলা, দুই ভাই।

পরে অবশ্য বিলুর মুখে সীতাপতি আর গণপতির ব্যাখ্যা জেনেছে অর্ক। ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। বিলু অবশ্য গোপনে তাকে আর একটা খবর জানিয়েছিল, খুরকিকে নাকি সীতাপতি ধরেছিল, অনেক কষ্টে ছাড়িয়েছে। তারপর থেকে খুরকিকে দেখলেই ওই কথাটা মনে পড়ে। কেমন একটা অস্বস্তি হয়, কথা বলে কিন্তু একটা ব্যবধান রেখে দিতে চায়।

দ্রুত পা চালালো অর্ক। ঝুমকির বাবা দরজায় বসে বিড়ি ফুকছিল। তিনবার নিমতলায় যেতে যেতে যায়নি বুড়ো। শরীরের সব কটা হাড় দেখা যায়। হাড়ের ওপর একটা চামড়া টাঙানো। মুখেও এক চিলতে মাংস না থাকায় কঙ্কালের মত দেখায়। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ঝুমকি আছে?

মাথা নাড়ল বুড়ো, না, ডিউটিতে গেছে।

শোনামাত্র সন্দেহ পাক খেল, ও তো বিকেলে যায়।

আজ তাড়াতাড়ি গেল।

কোথায় ডিউটি? এই সময় ঝুমকির মা ভেতর থেকে দরজায় এসে দাঁড়াল, কেন, কি দরকার?

দরকার আছে। অর্ক চোয়াল শক্ত করল।

কাল সকালে এসো। বলে গেছে ফিরতে রাত হবে।

ওসব আমি জানি না। ডিউটিটা কোথায় বলে দিন।

জবরদস্তি নাকি?

সে যদি বলেন তবে তাই। ভাল মুখে বলছি এখনও!

ঝুমকির বাবার এবার কাশি উঠল। বিড়ির ধোঁয়া গলায় আটকে যাওয়ায় শরীরের খামচা কাঁপতে লাগল থরথর করে। দুটো চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে, মুখে গোঁ গোঁ শব্দ। সেই অবস্থায় হাত নেড়ে বউকে ইশারা করছিল বলে দিতে। তারপর একটু সামলে নিয়ে ঘ্যাসঘেসে গলায় বলল, মেয়ে গেছে কাজ করতে, বললে দোষ কি?

ঝুমকির মা মুখ ঘোরাল, ধম্মতলায় আয়ার চাকরি।

ধর্মতলার কোথায়?

জানি না। কি একটা সিনেমার সামনে, গোব না কি যেন?

গ্লোব?

ওইরকম। তা ওখানে ওর খোঁজে কেউ গেলে মালিক খুব রাগ করে। এমন কি দরকার তা বুঝছি না।

অর্ক কথাটার জবাব না দিয়ে নিমুর দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। শিবমন্দিরের রক এখন ফাঁকা। নিমুর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দুজন চা খাচ্ছে। কি করা যায়? ঝুমকি যে হারখানা নিয়েছে তার কোন প্রমাণ নেই। কিন্তু আজ এত তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বের হল কেন? এতেই মনে হচ্ছে ডালমে কুছ কালা হ্যায়। ধর্মতলায় খুব বেশী যায়নি অর্ক। গ্লোব সিনেমাটা কোথায় মনে করতে চেষ্টা করল সে। বিলুটাকে সঙ্গে নিলে কাজ হত কিন্তু শালা হিস্যা চাইবে। তাছাড়া নার্সিংহোমের নামটা সে জানে না। গিয়ে খুঁজে পাবেই বা কি করে? কিন্তু হার পেয়েছে বলে যদি ঝুমকি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায় তাহলে ওটা ফর্সা করেই বাড়িতে ফিরবে। সেক্ষেত্রে এখানে বসে আঙ্গুল চুষে কি লাভ। অর্ক ঠিক করল সে যাবে, জায়গাটা মোটেই চেনা নয় কিন্তু চিনে নিতে কতক্ষণ। হন হন করে বড় রাস্তার দিকে যেতে যেতে ওর মনে হল খুরকির মত একটা কিছু সঙ্গে রাখা দরকার। মনের জোর বাড়ে, কাজও দেয়। কি রাখা যায়?

.

চওড়া সিঁথিতে সিঁদুর পরতে পরতে মাধবীলতা বলল, ছেলেটাকে ফেরাতেই হবে, আমি কিছুতেই হেরে যাব না।

অনিমেষ শুয়ে শুয়ে মাধবীলতাকে দেখছিল। কথা বলল না।

আয়নার মুখের দিকে তাকিয়ে মাধবীলতা বলল, দু’বছর, মাত্র দুই বছরে ও এতখানি পাল্টে গেল কি করে বুঝতে পারি না।

অনিমেষ নিচু গলায় বলল, পরিবেশ।

মাধবীলতা ঘুরে দাঁড়াল। পরিবেশ খারাপ তো আগাগোড়াই ছিল। ভাবলে কুল পাই না, আমাদের ছেলে।

এবার অনিমেষের গলার সুর পাল্টালো, তুমি একা থাকলে হয়তো এরকম হতো না। আমিই দায়ী।

শরীর শক্ত হয়ে গেল মাধবীলতার। দাঁতের তলায় এক চিলতে ঠোঁট চলে এল। অপলকে অনিমেষকে দেখল সে। তারপর ধীরে ধীরে খাটের পাশে এসে হাত রাখল অনিমেষের বুকে, তুমি আমাকে কি মনে কর? যন্ত্র!

মানে?

আমি কখনো ভুল করব না, আমার রাগ অভিমান কিছু থাকবে না? চুপচাপ মুখ বুজে সব সহ্য করে যাব? আমি তো আর পাঁচটা মেয়ের মতনই, তুমি কেন বোঝ না? শেষের দিকে মাধবীলতার গলা ধরে এল।

দুহাতে মাধবীলতার হাত টেনে নিল অনিমেষকে বলল আমার শরীর গিয়েছে। কিন্তু বোধটুকু তো শেষ হয়নি।

মাধবীলতা বুক উজাড় করে নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, আমাদের যেমন করেই হোক এখান থেকে চলে যেতে হবে।

কি করে সম্ভব?

জানি না। দরকার হলে আরও টিউশনি করব।

অনিমেষ উঠে বসল, তুমি মরে যেতে চাও?

মাধবীলতা হাসল, না, আমার কপালে মরণ নেই!

কথাটা শোনা মাত্র অনিমেষ গম্ভীর হল। তারপর বলল, আমি ভাবছি কিছু রোজগারের চেষ্টা করব। এইভাবে আর বসে থাকা যায় না।

মাধবীলতার কপালে ভাঁজ পড়ল, তার মানে? এই শরীর নিয়ে তুমি বাইরে বের হবে? অসম্ভব।

অনিমেষ বলল, কেন, আমি তো এখন অনেকটা ভাল আছি।

মাধবীলতা দৃঢ় গলায় বলল, না, ওসব চিন্তা তোমাকে করতে হবে না।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, বোকামি করছ, সময়ের সঙ্গে তাল মেলাও।

মাধবীলতা বলল, কি ভাবে রোজগার করবে তুমি?

জানি না। যাহোক কিছু। সামান্য আয় হলে সংসারের উপকার হবে। এসব নিয়ে তুমি ভেব।

মাধবীলতা ভারী পা ফেলে আয়নার সামনে চলে এল, এই অবস্থায় তুমি টাকার জন্যে ছুটছ–এটা আমার লজ্জা!

লতা!

মাধবীলতা চমকে তাকাল। অনেকদিন পরে এই ডাক। অনিমেষ বলল, তুমি একটুও রক্ত মাংসের নও।

তোমার মাথা।

জামাকাপড় পরা হয়ে গেলে মাধবীলতার একটা কথা মনে পড়ল, জানো, কাল সুপ্রিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করছিল কত বছর বিয়ে হয়েছে? তা আমি বললাম আঠারো বছর।

সে কি?

কেন, অবাক হওয়ার কি আছে। তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছি সেদিনই তো বিয়ে হয়ে গেছে।

পারো বটে। অনিমেষ হাসল, দিনগুলো কি দ্রুত চলে যাচ্ছে। জেল থেকে যখন এলাম তখন খোকার বয়স সাত। আর এই আট বছরে ওকে দেখায় কুড়ি। আচ্ছা, আমি কি খুব বুড়ো হয়ে গেছি! অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকাল।

মাধবীলতা ঠোঁট টিপে হাসল, আমাকে দেখে বুড়ি মনে হয়?

মোটেই না।

তোমার ন্যাবা হয়েছে। বাঙালি মেয়েকে চল্লিশে বুড়ি দেখাবে না তো কি! যাক, অনেক দেরি হয়ে গেছে। খোকা ফিরলে পড়তে বসতে বলবে। আমি তাড়াতাড়ি ফিরব।

তড়িঘড়ি টিউশনি বেরিয়ে গেল মাধবীলতা। তিন নম্বরে তখন প্রচণ্ড শব্দ। হাজারটা মানুষ একসঙ্গে চিৎকার করে কথা বলছে। শব্দ না করে এখানে কেউ থাকতে পারে না। তারপর সন্ধ্যের শুরু থেকে হয় উনুনে আগুন দেওয়া। গলগল করে ধোঁওয়া ঢোকে ঘরে। দুটো স্ত্রীকণ্ঠে কদাকার চিৎকার উঠছে। অশ্লীল শব্দগুলো কি সহজে ওদের জিভে উঠে আসছে। অনিমেষ কান খাড়া করল। একজন অন্যজনকে গালাগাল করছে গতরের দেমাকের জন্যে। তার স্বামীর কি দোষ যদি কেউ গতর দেখিয়ে ডাকে। যাকে বলা হচ্ছে সেও ছাড়ছে না। যে বউ স্বামীকে ধরে রাখতে পারে না তার এত গলার জোর কিসের।

অনিমেষ বিছানা ছেড়ে মাটিতে পা দিল। তারপর ক্রাচে ভর দিয়ে হ্যাণ্ডলুমের পাঞ্জাবিটা গলিয়ে নিল। দরজায় তালা দিয়ে অনিমেষ টুক টুক করে গলি দিয়ে এগিয়ে চলে। বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। সেই স্ত্রীলোকদুটি ওকে দেখে একবার থমকে গিয়েই পুরোদমে শুরু করল। অনুদের বাড়ির সামনে হরিপদ চুপচাপ বসে আছে। দুটো শিশু মাতৃবিয়োগের চিহু নিয়ে বাপের দুপাশে বসে আছে। অনিমেষ কথা বলতে গিয়ে সামলে নিল। কি কথা বলবে সে। সান্ত্বনা দেবে? কোন মানে হয় না।

অবিনাশের উনুনের কারখানায় সেদিনের মত কাজ সবে শেষ হয়েছে। কারিগররা জামা পরছিল। অনিমেষ ভেতরে ঢুকে বেঞ্চিতে বসল। এক চালায় কারখানা। নিচে টিন পেটাই এবং উনুনের কাঠামো তৈরি হয়। সেগুলোকে চালার ওপরে নিয়ে গিয়ে মাটি লাগিয়ে রোদ্দুরে রেখে দেয় আর একদল। ভাল রোজগার অবিনাশের। আটজন লোক কাজ করে এখানে। অবিনাশ নিজেও খাটে। এককালে ওর পরিবার এই বস্তিতেই ছিল। এখন উল্টাডাঙ্গায় বাড়ি ভাড়া নিয়েছে সে। বছর তিনেক আগে আলাপ হওয়ার পর অবিনাশ বলেছিল, আপনার মত শিক্ষিত লোক এখানে থাকবে ভাবাই যায় না। মাঝে মাঝে পায়ের ধুলো দেবেন, কথা বলে সুখ পাব।

সেই থেকে এখানেই রোজ একটু বসে অনিমেষ। চারটে নাগাদ আসে আবার ছটায় ফিরে যায়। কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে কথা বলে অবিনাশ, চা খাওয়ায়। আর সেদিনের খবরের কাগজটা পড়া হয়ে যায় অনিমেষের। আজ একটু দেরি হয়ে গেল অনিমেষের। আর আসামাত্রই লোডশেডিং।

অবিনাশ ওকে দেখে ইতস্তত করে বলল, কি ব্যাপার, আজ একটু বিলম্ব হয়ে গেল দেখছি।

অনিমেষ ক্রাচদুটো পাশে রাখতে রাখতে বলল, হ্যাঁ। আর সেইসঙ্গে লোডশেডিং নিয়ে এলাম।

অবিনাশ মাথা নাড়ল, জন্ম মৃত্যু বিবাহ এবং লোডশেডিং কখন হবে তা কি কেউ বলতে পারে! তা আমার আজকের কাজ শেষ।

এই অন্ধকারে কাগজ পড়া যাবে না। অবিনাশ একটা ভুষো মাথা হ্যারিকেন অনেক কসরৎ করে জ্বাললো। কারখানার লোকজন চলে গেলে নিজের জায়গায় বাবু হয়ে বসে বলল, তা বলুন মিত্তির মশাই।

আবছা আলোয় অনিমেষ লোকটাকে দেখল। সবসময়েই মনে হয়েছে বেশ সহৃদয়। তবু সে একটু ইতস্তত করছিল।

অবিনাশ জিজ্ঞাসা করল, কিছু বলবেন মনে হচ্ছে!

হ্যাঁ। অনিমেষ গুছিয়ে নিল, কি ভাবে বলব ভাবছি।

কি ব্যাপার?

মানে আমার একটা কাজ দরকার।

কাজ? কি কাজ?

যাহোক কিছু। এভাবে বেকার বসে আর থাকা যাচ্ছে না। আপনার কথা মনে পড়ল, যে কোন উপায় যদি বলে দেন!

অ। চাকরির কথা বলছেন?

হ্যাঁ।

বাজার তো খুব খারাপ। চাকরি পাওয়া সত্যিই মুশকিল। তাছাড়া আপনি কি ধরনের চাকরি চাইছেন!

যে কোন চাকরি। আমার কোন পছন্দ অপছন্দ নেই। যাতে কিছু টাকা আসে তাতেই চলবে।

একটা কিছু না জানলে–।

আমি কিছুই জানি না। তবে চেষ্টা করতে পারি।

দেখুন মিত্তিরবাবু, আমার তো চাকরি দেবার ক্ষমতা নেই তবে একটা কোম্পানিকে জানি আমি তাদের বলতে পারি। তবে ওই পা নিয়ে যাওয়া আসা করতে পারবেন তো?

আমি এখন সব পারবো। কথাটা বলে অনিমেষ হাসবার চেষ্টা করতেই বাইরে একটা বিকট শব্দ উঠল। সঙ্গে সঙ্গে দুটো বোমা ফাটার শব্দে কানে তালা লাগার যোগাড়। লোকজন সব পড়ি কি মরি করে বস্তির মধ্যে ঢুকে পড়ছে। তারপরেই চারপাশ চুপচাপ। অবিনাশ লাফিয়ে দরজার কাছে গিয়ে ঝাঁপটা টেনে দিল। আর তখনই গলা শোনা গেল, আরে খানকির বাচ্চারা বেরিয়ে আয় শালা। এক বাপের পয়দা হ’স তো সামনে এসে দাঁড়া। যাদের উদ্দেশে এই আহ্বান তাদের কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। দ্বিতীয় গলা বাজল, আবার যদি আমাদের পাড়ায় দেখি তাহলে তিন নম্বর জ্বালিয়ে দেব বলে দিয়ে গেলাম। কয়েক সেকেণ্ড শব্দহীন কাটল। তারপরেই ঈশ্বরপুকুর লেনে হই হই পড়ে গেল। যারা এসেছিল তারা ততক্ষণে চলে গিয়েছে। এবার বিভিন্ন বয়সী মানুষ নিমুর চায়ের দোকানের সামনে গলা তুলে প্রতিবাদ জানাচ্ছে ঘটনার। যে বেশী চিৎকার করছে সে তত দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হচ্ছে। বেপাড়ার ছেলে এসে পাড়ায় মাস্তানি করে গেল, মা বোন তুলে কথা বলে গেল, খুরকি কিলা বিলু কোথায়। তিন নম্বরের উচিত এর জবাব দেওয়া।

অনিমেষ বলল, ঝাঁপটা খুলে দিন, হাওয়া আসুক।

অবিনাশ মাথা নাড়ল, না মশাই, এসব চুল্লদের বিশ্বাস নেই। হারামির জোঁক এক একটা।

অনিমেষ নিঃশ্বাস ফেলল, আচ্ছা আপনার কারখানায় কিছু করা যায় না?

কি করবেন? এখানে তো টিন পেটাই আর উনুন বানাতে হয়।

তাই যদি করি! একটা জায়গায় বসে টিন পেটাতে ঠিক পিরবো।

ধুৎ, ওসব আপনাকে মানায় নাকি! আপনি শিক্ষিত মানুষ, পাঁচজনে কি বলবে! তাছাড়া কাজটাকে যত সহজ ভাবছেন তা নয়।

আবছা আলোয় অবিনাশ কান খাড়া করে বলল, এসো। ঝাঁপে শব্দ হয়েছিল মৃদু, অনুমতি পাওয়া মাত্র লিকলিকে রোগা একটা লোক সুড়ুৎ করে ঝাঁপ সরিয়ে ঢুকে পড়ল। ময়লা ধুতি পাঞ্জাবি এবং বেশ কালো শরীরটা প্রায় অন্ধকারে অনিমেষের দিকে তাকাল। অনিমেষ লোকটাকে কখনও দ্যাখেনি। অবিনাশ ডাকল, এসো জনার্দন। উনি মিত্তির মশাই, খুব বড় নকশাল ছিলেন, পুলিশ দুটো পা খেয়ে নিয়েছে। তা মিত্তির মশাই। কথাটা শেষ করল না অবিনাশ কিন্তু বোঝা গেল এবার সে অনিমেষকে উঠে যেতে বলছে। জনার্দন বলল, পাঁচমিনিট বসে যাওয়া মঙ্গল। কারণ বাইরের হাওয়া ভাল নয়।

অবিনাশ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, তাই নাকি! তাহলে উঠবেন না, একটু বসুন। মানে, এইসময় আপনি তো কখনও আসেন না তাই সঙ্কোচ হচ্ছিল।

কেন, কিসের সঙ্কোচ?

সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর এই সময় জনার্দন আসে। দুই বন্ধুতে মিলে তিনচার গ্লাস খাই। না খেলে শরীর খাটতে পারে না। আপনি ভদ্রলোক, আবার কি ভাববেন। হেঁ হেঁ করে হাসল অবিনাশ।

তাতে কি হয়েছে, আপনারা খান আমি চলি। অনিমেষ উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু অবিনাশ এবার বাধা দিল, না না বসুন। একবার যখন আড় ভেঙ্গে গেছে তখন আর উঠতে হবে না। কই জনার্দন বের কর। জনার্দনের হাতে কাপড়ের ব্যাগ ছিল। তা থেকে বাংলা মদের বোতল বের হল। অবিনাশ গ্লাস পেছনের তাক থেকে পেড়ে বলল, মিত্তির মশাই একটুখানি—।

না না। আমার ওসব চলে না। জনার্দন বলল, না খাওয়াটা এক ধরনের নেশা। খুব শক্ত নেশা। আমি খাই না কোন শুয়োরের বাচ্চা আমাকে খাওয়াতে পারবে না, এই নেশা খাওয়ার নেশার চেয়ে কম নয়।

গ্লাসে ঢালতে ঢালতে অবিনাশ বলল, তা কম দিন তো হল না। কুড়িবছর তো বটেই। আমরা দু বন্ধুতে প্রত্যেকদিন খেয়ে যাচ্ছি।

একটা গ্লাস শেষ করে জনার্দন বলল, মিত্তির মশাই-এর কি করা হয়? মানে চাকরি বাকরি–।

অবিনাশ বলল, অসুস্থ মানুষ কাজ পাবেন কোথায়! এই তো একটু আগে আমাকে বলছিলেন চাকরির কথা। কিন্তু যা বাজার।

অনিমেষ বলল, চাকরি না হোক ব্যবসা পেলে তাই করি।

জনার্দন জিজ্ঞাসা করল, কিসের ব্যবসা?

অনিমেষ হাসল, ভাবিনি। এক জায়গায় বসে করা যায়, এমন যাহোক কিছু। কোন দোকানঘর সস্তায় পেলে।

অবিনাশ আঁতকে উঠল, সস্তা? ওই তো, নিমুর দোকানের পাশের রকটা শুনলাম দুহাজার সেলামিতে একজন নিচ্ছে। তিন ফুট বাই চার ফুট। একশ টাকা ভাড়া।

জনার্দন কিছুক্ষণ লক্ষ্য করল অনিমেষকে, একটা কাজের কথা মনে পড়ল। ব্যবসাও বলতে পারেন। এক জায়গায় বসে বসে কাজ। মাসে পাঁচ ছ’শ হবেই। দেশলাই জ্বেলে বিড়ি ধরাল সে।

অনিমেষ উদগ্রীব হল, নিশ্চয়ই পারব। বলুন কি কাজ?

জনার্দন অবিনাশকে বলল, তোমার ছোট কেতোকে মনে আছে? ও মরার পর এই বস্তিতে ভাল লোক পায়নি খাঁ সাহেব। আমি বললে হয়ে যাবে।

অবিনাশ মাথা নাড়ল, ও কাজ কি উনি করবেন?

কাজের আবার লজ্জা কি! কাগজ পেন্সিল নিয়ে বসে যাবেন, মাল নেবেন নম্বর লিখে নেবেন। আবার গ্লাস তুলে নিল জনার্দন।

অনিমেষ বলল, ঠিক বুঝলাম না। ঢকঢক করে অনেকখানি গলায় ঢালল জনার্দন। তারপর বাঁ হাতের পিঠে মুখ মুছে বলল, এই বস্তিতে ছোট কেতোর খুব ভাল বাজার ছিল। একটা ভাল জায়গা বেছে নিয়ে বসে যান। খাঁ সাহেবের লোক আপনাকে ছোট সিলিপের খাতা দিয়ে যাবে। পাবলিক এসে আপনার কাছে নম্বর বললে কার্বন রেখে লিখে দেবেন, পয়সা নেবেন। সন্ধ্যেবেলায় খাঁ সাহেবের লোক সাইকেলে এসে আপনার কাছ থেকে রসিদ আর টাকা নিয়ে যাবে। যার কপালে আছে সে পাবে। মাঝখান থেকে আপনি কমিশন ছাড়বেন। খাঁ সাহেবের দারুণ সুনাম, একটা পয়সা মারেন না। আরে মশাই এই করেই খাঁ সাহেব কলকাতায় তিন-তিনটে বার, বিরাট ট্র্যান্সপোর্ট কোম্পানি আর হোটেল খুলে বসেছে।

নম্বরটা কিসের?

উফ! আপনি কি কোন খবর রাখেন না! দো তিন হাজারি অফিসাররা খেলছে, কলেজের মেয়েরাও বাকি নেই। দুরকম আছে। রেস। কলকাতা বম্বে ব্যাঙ্গালোর মাদ্রাজে খেলা হয়। পাবলিক ঘোড়ার নম্বর লিখিয়ে পয়সা দেবে। জিতলে পেমেন্ট পাবে। আর দু নম্বর হল সাট্টা। নম্বর মেলাও আর রুপিয়া লেও। বিনা পরিশ্রমে রোজগার করবেন মশাই। মোটা পেমেন্ট পেলে পাবলিক কিছু দিয়ে যাবে আপনাকে, খাঁ সাহেবের কাছ থেকে কমিশন পাচ্ছেনই। রাজি থাকেন তো বলুন।

জনার্দন কথা শেষ করলে ভারী গলায় অবিনাশ বলল, পুলিসকে দিতে হবে তো কিছু?

জনার্দনের গলা জড়িয়ে আসছিল, সে ব্যাপারটা খাঁ সাহেবের। অবিনাশ হাসল, মান লজ্জা ভয় তিন থাকতে নয়। আরে মশাই আগে হল পেট। চাঁদির জুতো মারলে সব শালা চুপ করে থাকে। এই ধরুন আমার কথা। পেটে বিদ্যে নেই, বস্তিতে থাকতাম, উনুন বেচি। এখন মালকড়ি কামিয়ে ফেলাটে ফ্যামিলি রেখে মেয়েকে ইংলিশ স্কুলে পড়াচ্ছি। মিত্তির মশাই, জায়গা আমি ঠিক করে দেব আপনি তিন নম্বরের পেন্সিলার হয়ে যান।

১১. দুচারটে বোম পড়লেই

দু’চারটে বোম পড়লেই ঈশ্বরপুকুর লেনের তিন নম্বর আশ্চর্যরকম ঠাণ্ডা হয়ে যায়। ক্রাচ বগলে নিয়ে অবিনাশের ঝাঁপ সরিয়ে গলিতে নেমে অনিমেষ দেখল চারধার ফাঁকা। অবিনাশ অবশ্য তখনও তাকে বের হতে নিষেধ করেছিল কিন্তু অনিমেষের আর ওই বদ্ধ ঘরে বসতে ইচ্ছে করছিল না। খানিকটা মদ পেটে যাওয়ার পর ওদের কথাবার্তায় তার প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। গা ঘিনঘিন করছিল। জনার্দন এখন অবলীলাক্রমে অশ্লীল শব্দ বলে যাচ্ছে। ঝাঁপ সরাবার আগে অবিনাশ বলেছিল, তাহলে কাজটা কাল থেকেই শুরু করে দিন। খাঁ সাহেবের সঙ্গে কথাবার্তা পাকা করে নাও জনার্দন।

অনিমেষ মাথা নেড়েছিল, না। ছেড়ে দিন।

জনার্দন তার লাল চোখ ছোট করেছিল, একি কথা?

পেন্সিলার হওয়ার চেয়ে আত্মহত্যা করা আমার পক্ষে অনেক স্বস্তির। আপনারা আমাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন কিন্তু বেশ্যাবৃত্তি করতে পারব না।

অবিনাশ চেঁচিয়ে উঠেছিল, ওসব বড় বড় বুলিতে পেট ভরবে?

অনিমেষ বলেছিল, এ আপনি বুঝবেন না।

গলিতে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করল অনিমেষ। কথাগুলো মাধবীলতাকে বলাও যাবে না। চমকে উঠে বলবে, তুমি ওই কথাঅতক্ষণ ধরে শুনলে? অবিনাশ অবশ্য তার ভালর জন্যেই নিজের গণ্ডীতে যা সহন তাই বলেছে। ওর কি দোষ!

অনিমেষ অন্ধকার ঘরগুলোর দিকে তাকাল। তারপর টুক টুক করে গলির মুখের দিকে এগোল। এখনও মাধবীলতা ফেরেনি। ইন্দ্র বিশ্বাস রোড এমন কিছু দূরে নয়। সেখান থেকে পড়িয়ে ফিরতে এত রাত হয় কেন? মেজাজ বিগড়ে ছিল, এখন বেশ রাগ হল। সে এই গলির বন্ধ ঘরে দিনের পর দিন পড়ে আছে আর মাধবীলতা কেমন ড্যাং ড্যাং করে বিশ্বচরাচরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কয়েক পা এগোতেই খ্যানখেনে গলাটা কানে এল, কে যায়?

অনিমেষ বাঁ দিকে তাকাল। তারপর চাপা গলায় বলল, আমি।

আমিটা কে? নাম রাখেনি নাকি বাপ মা?

অনিমেষ।

অনি অ। মাস্টারনির বর?

প্রথম শব্দটি কানে যাওয়া মাত্র অনিমেষের সমস্ত শরীরে যেন বিদ্যুতের ছোঁওয়া লাগল। অনি। অনেক অনেকদিন বাদে এই ডাকটা শুনল সে। মুহূর্তেই মনের সব বিস্বাদ কিংবা জ্বালা মিলিয়ে গেল। ও নিচু গলায় জবাব দিল, হ্যাঁ।

তা এখানে কি করতে এয়েছ? তুমি নুলো মানুষ, চারপাশে গোলমাল হচ্ছে, আসা উচিত হয়নি। মোক্ষবুড়ি একই স্বরে কথাগুলো বলে যাচ্ছিল। অনিমেষ আবার সচেতন হল। নুলো মানুষ। শালা এই বুড়িও তাকে করুণা করছে! সে কথা না বলে এগিয়ে গেল রাস্তার দিকে। মোক্ষবুড়ি সেটা বুঝতে পেরেই চেঁচিয়ে উঠল, আমার নাতিটাকে চেন? কি গো, ওকে দেখলে পাঠিয়ে দিও। মাস্টারনির বর, শুনতে পাচ্ছ?

অনিমেষ দাঁতে দাঁত চাপল। তার পরিচয় এখন মাস্টারনির বর, নুলো। চমৎকার। সে ঈশ্বরপুকুর লেনটাকে দেখল। একদম ফাঁকা হয়ে রয়েছে রাস্তা। নিমূর চায়ের দোকানের ঝাঁপ বন্ধ। হাঙ্গামাটা বেশ জব্বর ধরনের মনে হচ্ছে। অনিমেষ আরও কয়েক পা এগোল। এ পর্যন্ত কখনই আসে না সে কিন্তু আজ তার কোন অসুবিধে হচ্ছে না। অবশ্য থাই-এর কাছে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে তা খুবই সামান্য। মিছিমিছি ভয় পেয়ে অ্যাদ্দিন ঘরে আটকে ছিল। অনিমে বুঝতে পারছিল না সে ট্রামবাসে উঠতে পারবে কিনা। কিন্তু বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে অনেকটা নিশ্চয়ই হাঁটতে পারবে।

একটা কাজ চাই। একটু আগে জনার্দনরা যে কাজের কথা বলল সেটা সে করতে পারবে না। কেন পারবে না? অনিমেষ নিজেকেই প্রশ্ন করল। নিশ্চয়ই শয়ে শয়ে লোক এই কাজ করে। তাহলে সে করতে পারবে না কেন? মাধবীলতা কি বলবে সেই সঙ্কোচে? নাকি সেই অনিমেষ যে এককালে অনেক বিরাট আদর্শের কথা মাথায় রাখত, এই দেশে সশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে নিজেকে বিরাট বলে ভেবেছিল সেই কি ছি ছি করে উঠল। সব কিছু ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছে বার, শুধু অসহায় চোখে চারধার দেখে যাওয়া ছাড়া যার অন্য কোন ভূমিকা নেই তার এত উঁচু নাক হবে কেন? ওসব আদর্শ রুচিফুচি মাথায় কেন যে পোকার মত কুটকুট করে? এই যে হাজার হাজার ছেলে বিপ্লবের আশায় প্রাণ দিল, তার মতন অগুনতি মানুষ বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে রইল তাতে এই দেশের কোন পরিবর্তন হয়েছে? সাধারণ মানুষের মনে বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনা আসা দূরের কথা, সামান্য ঢেউ পর্যন্ত ওঠেনি। বরং আগের চেয়ে মানুষ এখন নিজের আখের গোছাতে বেশী ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। সেরেফ বোকামি, ওইসব আদর্শের নামে বাছবিচার করে নাক সিটকানো মানে আত্মহত্যা করা। কেউ তোমার মুখে খাবার তুলে দেবে না, যে দেবে সে করুণা দেখাবে। মনে মনে একটা প্রতিরোধ গড়ে তুললেও অনিমেষ বুঝতে পারছিল সে হেরে যাচ্ছে। ওই ছাঁচটাকে এই জীবনে ভাঙ্গা যাবে না। হয়তো এটা সুস্থ থাকার অহঙ্কার। সবই তো গেছে শুধু এটুকু আঁকড়ে যদি বাকি জীবনটা চলে যায় তো যাক। ( ঠিক এইসময় মাধবীলতাকে দেখতে পেল অনিমেষ। খুব ত্রস্ত পায়ে ট্রাম রাস্তার দিক থেকে আসছে। দেখতে দেখতে অনিমেষের চোখে মুগ্ধতা নামল। বাঃ, এখনও তো ওকে বেশ মিষ্টি দেখায়। প্রতিদিন ওই ছোট্ট ঘরের সীমাবদ্ধতায় এই রূপ চোখেই পড়েনি। ক্লান্ত, বয়সের সামান্য আঁচড় সর্বাঙ্গে কিন্তু মাধবীলতার এমন কিছু এখনও অবশিষ্ট রয়েছে যা অনিমেষের নিজের নেই, এক ফোঁটাও নেই।

তাকে দেখা মাত্র মাধবীলতা যেন আঁতকে উঠল, তুমি!

অনিমেষ হাসার চেষ্টা করল, এলাম।

এতটা এসেছ কেন? এইজন্যে আবার ভুগতে হবে। মাধবীলতা সামনে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ওর এই ব্যস্ততা দেখে অনিমেষ ছোট চোখে তাকাল, ওকে কি সারাজীবন শুইয়ে রাখতে চায় মাধবীলতা? একটু আগের নরম ভাবটা চট করে মিলিয়ে যাচ্ছিল। তাই সে বলল, না, আমার কোন অসুবিধে হচ্ছে না। বেশ তো চলে এলাম।

পায়ে লাগছে না?

এমন কিছু না।

কিন্তু তুমি খুব রিস্ক নিয়েছ!

কেন ভাবছ এত! আমারটা আমি বুঝি না?

কথাটা শোনামাত্র মাধবীলতা চট করে মুখ তুলে অনিমেষকে দেখল। দেখে হাসল, তাহলে তো ভালই।

কথা ঘোরানোর জন্যে অনিমেষ বলল, একটু আগে এখানে খুব গোলমাল হয়ে গেছে। বোম ফেটেছে।

মাধবীলতা বলল, রাস্তা দেখে তাই মনে হচ্ছে। খোকা পড়ছে?

মাথা নাড়ল অনিমেষ, এখনও ফেরেনি।

সেকি! পাড়ায় ছিল গোলমালের সময়ে?

জানি না।

উফ। আমি যে কি করি! আজ বাড়ি ফিরুক, একটা হেস্তনেস্ত করে তবে ছাড়ক। মাধবীলতা গর্জে উঠল যেন।

সে তো রোজই করছ। এভাবে হবে না।

কিভাবে হবে?

সেটাই তো জানি না। তাছাড়া কি হওয়াতে চাও সেটা জানো?

কি আবার? ও পড়াশুনা করুক, শিক্ষিত হয়ে নিজেরটা বুঝে নিক, এছাড়া আর কি চাইব আমি?

তারপর? তারপর আর একটা ভেড়া হয়ে পালে ঢুকে যাক। পাশ করে বেকার হয়ে বসে থাকুক কিংবা সামান্য কেরানি হয়ে সন্তান উৎপাদন করে বংশ রাখুক–এই তো? ও যখন আমাকে এইসব প্রশ্ন করে আমি নিজেই জবাব দিতে পারি না। তুমি ওকে যে পথে নিয়ে যেতে চাও তার সুস্থ পরিণতি কি তা যখন জানো না তখন আর এই নিয়ে হেস্তনেস্ত করে কি লাভ। লতা, আমাকে একটু ট্রাম রাস্তা পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবে?

মাধবীলতা চমকে উঠল, তুমি যেতে পারবে?

চল না।

মাধবীলতা ইচ্ছের বিরুদ্ধে যেন রাজি হল। ফুটপাথ ধরে অনিমেষের পাশে হাঁটতে হাঁটতে সে কথাগুলো ভাবছিল। অনিমেষ একটু আগে যা বলল তা সত্যি। কিন্তু কোন মা চাইবে তার সন্তান বকে যাক, একটা গুণ্ডা তৈরি হোক! সামনে কোন ভবিষ্যৎ নেই জেনে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে? অসুস্থ হওয়ার পর থেকে রাজনীতির কথা একদম বলে না অনিমেষ। তার রাজনীতি নিয়ে। কখনও মাথা ঘামায়নি মাধবীলতা। কিন্তু একটা কথা সে বোঝে, মরে যেতে তো একদিন হবেই তাই বলে আজকে আমি বেঁচে আছি এটা মিথ্যে? অসুখ করলে ওষুধ খাবে না?

.

ধর্মতলায় মাত্র কয়েকটা জায়গা চেনা অর্কর। ঈশ্বরপুকুর লেন থেকে বেরিয়ে শ্যামবাজার পর্যন্ত মনে হয় ওটা নিজের এলাকা কিন্তু এখানে এলেই বেশ অস্বস্তি হয়। তার ওপর বিকেল বেলায় এত মানুষের ভিড় যে তাল রাখা মুশকিল। তাই রাস্তাটাকে খুঁজে বের করতে বেশ সময় লেগে গেল।

নিচে ঝকঝকে দোকান পাট, ফুটপাথ ঘেঁষে রিকশার লাইন, অর্ক সাইনবোর্ড দেখে বুঝতে পারল এটাই নার্সিংহোম। ব্যাপারটা সত্যি জেনে একটু ভরসা হল এখন। কিন্তু ভেতরে নিশ্চয়ই অনেক লোক রয়েছে; তাদের কি বলবে সে? হারখানার কথা তো চেঁচিয়ে বলা যাবে না। ওকে দেখে যদি আসে? যদি ব্যস্ত আছে বলে কাটিয়ে দেয়? অর্ক অস্বস্তিতে পড়ল। তারপর মনে মনে কয়েকটা অজুহাত তৈরি করে নিয়ে সামনে পা বাড়াল। বড় চওড়া সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এসেই নার্সিংহোমের গেটটা দেখতে পেল সে। ওপরে লাল ক্রশের ভেতরে আলো জ্বলছে। অর্ক দরজায় আসতেই একটা দারোয়ান গোছের লোক জিজ্ঞাসা করল, কি চাই?

একজনকে ডেকে দিতে হবে। কথাটা বলেই অর্ক বুঝতে পারল কেমন হুকুমের সুর এসে গেল গলায়। ঈশ্বরপুকুর লেনে যেভাবে কথা বলে এখানে সেভাবে বলা চলবে না। লোকটার চোখের দৃষ্টিতে স্পষ্টতই বিরক্তি। তবু জিজ্ঞাসা করল, কাকে?

ঝুমকি।

ঝুমকি। একটু একটু করে রহস্যের হাসি হাসল লোকটা, ওই নামে এখানে কেউ নেই। অন্য কোথাও যাও ভাই।

এবার বেশ অসহায় হয়ে পড়ল অর্ক। ঝুমকি যদি এখানে না থাকে তাহলে হারখানা আর ফেরত পাওয়া যাবে না। জায়গাটা মোটেই ভুল করেনি সে, ঝুমকি যদি বাড়িতে মিথ্যে কথা বলে আসে তাহলে অবশ্য।

এইসময় একজন নার্স খুব দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, ডাক্তার সেন এসেছেন?

দারোয়ান মাথা নাড়ল, না। মহিলা চলে যাচ্ছিল, দারোয়ান তাকে ঠাট্টার গলায় বলল, ঝুমকি বলে কেউ আছে নাকি?

মহিলা ঘুরে দাঁড়াল, কে ঝুমকি?

অর্ক এবার এগোল, এখানে কাজ করে শুনেছি।

কি কাজ? নার্স না আয়া?

আয়া। কথাটা সেরেফ অনুমানের ওপর বলে ফেলল অর্ক।

এই নামে তো কোন আয়া নেই ভাই। অন্তত এখানে নেই।

ও। অর্ক হঠাৎ শূন্য হয়ে গেল। আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোন মানে হয় না। হয়তো তার মুখ দেখে মহিলার মনে কোন ছায়া পড়ল, কোত্থেকে আসে বল তো?

বেলগাছিয়া। বেশী বয়স নয়।

বেলগাছিয়া? কি রকম দেখতে?

ঝুমকিকে কি ভাবে বর্ণনা করবে অর্ক। কালো, রোগাটে তবে মুখখানা ভাল আর খুব দুর্নাম আছে, এই তো। যেটুকু পারল খুঁটিয়ে বলল সে। মহিলা সব শুনে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, এরকম একটা মেয়ে এখানে কাজ করছিল কিছুদিন। তবে তার নাম ঝুমকি নয়। কিন্তু তার সঙ্গে তোমার কি দরকার?

এবার যেন একটু আলো দেখতে পেল অর্ক। চটপট সাজানো অজুহাত জানালো সে, আমি ওদের পাশের ঘরে থাকি। আজ বিকেলে মাসীমা, মানে ঝুমকির মায়ের শরীর খুব খারাপ হয়েছিল। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে। ঝুমকির বাবা এই ঠিকানায় আমাকে খবর দিতে পাঠালেন।

ওমা, তাই?

হ্যাঁ। মুখখানা যতটা সম্ভব বিমর্ষ করল অর্ক।

আচ্ছা, তুমি এসো আমার সঙ্গে। মহিলা তাকে ডেকে ভেতরে চলে যেতে অর্ক অনুসরণ করল। সেই হাসপাতাল-হাসপাতাল গন্ধ। আরো কয়েকজন নার্স ব্যস্ত হয়ে হাঁটাচলা করছে। মহিলাকে অনুসরণ করে অর্ক একটা ঘরের সামনে দাঁড়াল। তিনজন বিভিন্ন বয়সী আয়া বাচ্চা কোলে নিয়ে গল্প করছে। মহিলা জিজ্ঞাসা করল, মালতীদি, বেলগাছিয়া থেকে একটা কালো মেয়ে এখানে কদিন ছিল তোমার মনে আছে?

যাকে বলা হল তার বয়স হয়েছে। শরীর বেশ স্থূলা। চোখ ঘুরিয়ে বলল, তা আর মনে নেই। বন্ধ ঘড়ি পরে থাকত!

মহিলার এবার মনে পড়ল, হ্যাঁ হ্যাঁ।

পৃথুলা বলল, তা তাকে প্রয়োজন?

মহিলা অর্ককে দেখাল, এই ছেলেটি ওর পাশের ঘরে থাকে। বাড়িতে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। এখানে সে আর কাজ করে না তাও জানায়নি।

পৃথুলা বলল, কাজ করল আর কোথায়! কাজ জানে যে করবে? অ্যাকসিডেন্ট কার হয়েছে?

মায়ের। অর্ক উত্তর দিল, বেশীক্ষণ বাঁচবে না।

অ। তারপর ইশারায় মহিলাকে কাছে ডাকল পৃথুলা। অর্ক বুঝল কিছু গোপনীয় কথাবার্তা হবে। একটু বাদে মহিলা বেরিয়ে এসে বলল, শোন ভাই, তুমি যাকে খুঁজছ এ সে নাও হতে পারে। কারণ নামটা মিলছে না। বেলগাছিয়া থেকে এসে যে এখানে ছিল তার নাম লতিকা দাস। ঝুমকির পদবী কি দাস?

জানে না অর্ক, তবু মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

এ লাইনে অনেকে নাম পাল্টায়। তাই সঠিক হবে কি না জানি না। আমি খুব কম দেখেছি। মালতীদির কাছে শুনলাম সে নাকি আর আয়ার কাজ করছে না। নাচ শিখছে। মহিলা ঠোঁট টিপে হাসল।

নাচ? অর্ক হতভম্ব।

হ্যাঁ। সত্যি কি না তুমি একবার গিয়ে দেখতে পার। অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে যখন তখন খবর দেবার চেষ্টা করো। মহিলা ওকে ঠিকানাটা বলে দিল। চৌরঙ্গী লেন। অর্ক কখনও ওদিকে যায়নি।

রাস্তায় নেমে অর্ক বুঝতে পারছিল না কি করবে। চারধারে এখন ঝকঝকে আলো। সন্ধ্যে ঘনিয়ে রাত নেমেছে। আজ একটু তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরলে ভাল হত। মায়ের সঙ্গে দুপুরে কথাবাতার পর এটুকু সে করবে ঠিক করেছিল। কিন্তু হারের সন্ধান না পেলে ফিরবে কি করে? যা হয় হোক, আর একদিন না হয় বাড়িতে ঝামেলা হবে কিন্তু হারখানার জন্যে শেষ চেষ্টা করবে সে।

কিন্তু ঝুমকি কি করে লতিকা দাস হবে? তার ওপর নাচ, ভাবাই যায় না। অর্কর মনে হল পুরোটাই ভুল হয়ে যাচ্ছে। তিন নম্বরের মেয়ে চৌরঙ্গী লেনে নাচ শিখতে আসবে কেন? আর নাচ শিখলে কি টাকা পাওয়া যায়? খানিকক্ষণ দোনামনা করে অর্ক চৌরঙ্গী লেনের উদ্দেশে পা বাড়াল।

জিজ্ঞাসা করে করে গ্লোব সিনেমার পেছনের রাস্তায় চলে এসে অর্কর মনে হল জায়গাটায় মানুষজন তেমন নেই। মাঝে মাঝে দু’একটা রিকশা কিংবা ট্যাক্সি ছুটে যাচ্ছে। বিচিত্র চেহারার দুজন সাহেব হই হই করতে করতে চলে গেল। আলো কম রাস্তায়। নম্বর মিলিয়ে অর্ক যখন হাঁটছে তখন একটা লোক অন্ধকার কুঁড়ে সামনে এসে দাঁড়াল, স্কুল গার্ল? ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ?

অর্ক হতভম্ব। কোনরকমে বলল, মানে?

লোকটা বোধহয় ততক্ষণে অর্ককে বুঝতে পেরেছে। চোখ কুঁচকে আমজাদ খানের মতন মুখ করে জিজ্ঞাসা করল, কি চাই এখানে?

ভঙ্গী দেখে অর্কর মেজাজ গরম হল। কিন্তু লোকটার চেহারা বিশাল এবং পাড়াটা তার সম্পূর্ণ অজানা।

লোকটা আবার বলল, আব্বে, কি চাই?

এবার সত্যিই ঘাবড়ে গেল অর্ক। কোনরকমে বলতে পারল ঘটনাটা। বাড়িতে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে বলে সে খবর দিতে এসেছে। এপাড়ার কিছুই সে চেনে না। কোন বাড়ি তাও জানে না। বোধহয় দয়া হল লোকটার কারণ কোন কথা না বলে সে অর্ককে নিয়ে খানিকটা পথ এগিয়ে চিৎকার করল, হ্যায় বিল, বিল।

একটু বাদেই বিরাট চেহারার একটা কালো কুচকুচে কোক চুরুট মুখে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। নিচের লোকটা বলল, হেয়ার ইজ এ চিকেন ফর য়ু।’ বলে অর্ককে একটা দরজা দেখিয়ে দিল।

অর্ক বুঝতে পারছিল জায়গা মোটেই সুবিধের নয়। কিন্তু এখান থেকে ফেরার কোন উপায় নেই। শক্ত হবার চেষ্টা করতে করতে সে দরজা পেরিয়ে ডান দিকে একটা সিঁড়ি দেখতে পেল। সিঁড়িতে আলো নেই। ওপরে উঠতেই দরজা খুলে সেই কালোলোকটা চুরুট মুখে এসে দাঁড়াল কি ব্যাপার?

কাঁপা গলায় অর্ক আবার গল্পটা বলল।

লতিকা দাস? ঘড়ঘড়ে গলায় জিজ্ঞাসা করল লোকটা। অর্ক শুনতে পাচ্ছিল ভেতর থেকে উদ্দাম বাজনা ভেসে আসছে। পুরুষ ও নারীকণ্ঠে তার তালে উল্লাস উঠছে।

ও এখানে আছে তা কে বলল?

অর্ক তখন নার্সিংহোমের কথা জানাল।

খুব অসুস্থ?

হ্যাঁ।

তোমাকে চেনে ও?

হ্যাঁ।

কাম ইন। ইঙ্গিতে ভেতরে আসতে বলে লোকটা চিৎকার করল, ডরোথি, ডরোথি?

একজন প্রৌঢ়া মেমসাহেব ভেতরের দরজায় এসে দাঁড়াল, হাই! কান্ট দে ওয়েট অ্যানাদার ফাঁইভ মিনিটস?

লোকটা বলল, না সে ব্যাপার নয়। মিস ডি-কে এখনই ডেকে দাও। খুব জরুরী দরকার, বাড়ি থেকে লোক এসেছে।

মেমসাহেব বলল, সেকি! ঠিকানা জানল কি করে?

সেটা পরে হবে। পাঠিয়ে দাও।

মেমসাহেব চলে যেতে লোকটা পাশের আর একটা ঘরের দিকে তাকিয়ে বলল, আর পাঁচমিনিট অপেক্ষা করুন স্যার, নাচের কোর্স শেষ হয়ে এসেছে। নাইট ইজ টু ইয়ং।

পায়ের শব্দ শুনে ঘাড় ফেরাতেই পাথর হয়ে গেল অর্ক। একি ঝুমকি? চকচকে একটা কালো প্যান্ট শরীর চেপে হাঁটুর এক ইঞ্চি নিচে শেষ হয়েছে। এক পিস কাপড়ের একটা কলার তোলা জামা নাভির অনেক ওপরে আচমকা থেমে গেছে। চুল চুড়ো করে বাঁধা। ঘরে ঢুকেছিল প্রায় নাচতে নাচতে, কিন্তু ঢুকেই চমকে উঠল। যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।

লোকটা কড়া গলায় বলল, একে চেন?

ঠোঁট বেঁকাল ঝুমকি। বোধহয় প্রথমে ভেবেছিল অস্বীকার করবে তারপর হয়তো মন পাল্টাল, মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

ও বলছে তোমার বাড়িতে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। আমি তোমাদের প্রত্যেককে বলে দিয়েছি যে প্রাইভেট প্রবলেম যেন এখানে না আসে। ও তোমার ঠিকানা পেল কি করে?

আমি জানি না। ঝুমকির গলা কাঁপছিল

লোকটা বিরক্তিতে কাঁধ নাচাল; এরকম ঘটনা আর যেন না ঘটে। কথাটা বলে লোকটা ভেতরে চলে যেতেই ঝুমকি সাপের মত মাথা তুলল, কেন এসেছ?

তোমার মায়ের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। হাসপাতালে আছে। অম্লানবদনে কথাগুলি বলল অর্ক।

মা! মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে গেল ঝুমকি, কখন? কি হয়েছে?

তুমি চলে আসার পরই। তোমার বাবা খবর দিতে নার্সিংহোমে পাঠিয়েছিলেন, সেখান থেকে এখানে। দেখতে চাও তো তাড়াতাড়ি চল

অর্কর কথা শেষ হওয়ামাত্র ঝুমকি একছুটে ভেতরে চলে গেল। যাক, কাজ হয়েছে, অর্ক অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত রাখছিল। এখান থেকে বের না করে ঝুমকিকে কোন প্রশ্ন করা ঠিক হবে না। সে পেছন দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেল দেওয়াল জুড়ে বিরাট বিরাট ফটোগ্রাফ। খাটো পোশাক পরে নাচের ভঙ্গীতে কয়েকটা মেয়ে পাশাপাশি। তাদের শরীরের প্রায় সবটাই দেখা যাচ্ছে। তলায় লেখা আছে, মিস টি, মিস এন, মিস পি.এইসব। ঝুমকির ছবি এখানে নেই। এটা কি তাহলে নাচের স্কুল? ঝুমকি এত পয়সা খরচ করে এখানে নাচ শিখতে আসে? কিছুতেই মাথায় ঢুকছিল না ব্যাপারটা। ঝুমকিকে লোকটা কি বলে সম্বোধন করল যেন, ও হাঁ, মিস ডি। ঈশ্বর পুকুর লেনের ঝুমকি এখানে মিস ডি হয়ে গেল কি করে?

এইসময় ভেতরের ঘর থেকে একটা মেয়ে পরীর মত উড়তে উড়তে বেরিয়ে এসে পাশের ঘরে ঢুকে হেসে ভেঙ্গে পড়ল। চকচকে রঙিন পোশাক এক পলকের জন্যে অর্কর সামনে চলকে উঠেছিল। সে চট করে পেছনটা দেখে নিল, ছবির একজনই বোধহয় ওই ঘরে গেল যেখানে পুরুষ রয়েছে। তবে ছয়জনের কোন জন তা বুঝতে পারল না অর্ক। এইসময় ঝুমকি বেরিয়ে এল। কমদামী প্রিন্টেড শাড়ি, লাল ব্লাউজ, তিন নম্বরে এই পোশাকে অনেকবার দেখেছে অর্ক।

সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে ঝুমকি পরিষ্কার হিন্দিতে চেঁচিয়ে কাউকে রিকশার কথা বলল। অর্ক বলল, চল। রিকশা কি হবে?

ঝুমকি মাথা নাড়ল, এ পাড়ায় হেঁটে যাওয়া নিষেধ আছে।

অর্ক আবার ঝুমকিকে দেখল। মুখে চোখে এখন প্রসাধন একটুও নেই। অ্যাকসিডেন্টের খবর পেয়ে খুব ঘাবড়ে গেছে বোঝা যাচ্ছে।

একটু বাদেই নিচ থেকে একজন চেঁচিয়ে উঠল, রিকশা।

ওরা নিচে নেমে এল। সামনেই একটা রিকশা দাঁড়িয়ে। প্রথমে ঝুমকি উঠল, তারপর অর্ক। রিকশাওয়ালা সামনের পর্দা ফেলে দিয়ে হ্যাণ্ডেল তুলে নিল। ঠুন ঠুন করে রিকশাটা খানিকএগিয়ে ডানদিকে বাঁক নিল। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, এদিকে কোথায় যাচ্ছে?

ঠিক যাচ্ছে। ও জানে। ট্রাম রাস্তা। তারপর সামান্য ঘুরে ঝুমকি অর্কর হাত চেপে ধরল, তোমার পায়ে পড়ি পাড়ার কাউকে বলো না আমি এখানে আসি।

অর্ক হাত ছাড়াবার চেষ্টা করল, কেন?

না। এমনিতে লোকে নানান কথা বলে, আমি আর টিকতে পারব না। আর একটা বছর, তারপর আমি আর কাউকে কেয়ার করব না। তুমি কাউকে বলবে না, কথা দাও। ঝুমকি মিনতি করতে লাগল।

তুমি এখানে কি কর?

নাচ শিখি। ক্যাবারে ড্যান্স।

পয়সা লাগে না?

লাগে। সে তুমি বুঝবে না।

অর্ক তাকাল ঝুমকির মুখের দিকে। অন্ধকারে ঠিকঠাক বোঝা যাচ্ছে না। তারপর ঘেন্নাজড়ানো গলায় জিজ্ঞাসা করল, ওটা কি খানকিবাড়ি?

কথাটা শোনামাত্র ঝুমকি চাবুক-খাওয়ার মত রাস্তার দিকে মুখ ঘোরাল। আর তারপরই অর্ক বুঝতে পারল ঝুমকি কাঁপছে। কাঁপুনিটা যে কান্না থেকে তা বুঝতে অসুবিধা হল না।

অনেকটা পথ আসার পর সেই অবস্থায় ঝুমকি বলল, এখন তোমরা আমাকে যা ইচ্ছে বল, সামনের বছর থেকে আমি মিস ডি হয়ে যাব। তখন-তখন।

মিস ডি আবার কি নাম?

জবাব দিল না কথাটার ঝুমকি। রিকশা যখন ট্রামরাস্তার কাছাকাছি এসে গেছে তখন মুখ ফিরিয়ে বলল, অর্ক, তুমি তো পাড়ার অন্য ছেলেদের মত নও, তুমি কথা দাও কাউকে বলবে না।

অর্ক বলল, কেন, আমি কি আলাদা?

হ্যাঁ আলাদা, তোমার চেহারা, তোমার মা বাবা, সব আলাদা। আমাকে বাঁচতেই হবে যেমন করেই হোক। একবার নাম হয়ে গেলে–। ওরা বলে আমি খুব ভাল নাচছি। কালো শরীরের খুব বাজার আছে বাইরে। তদ্দিন তদ্দিন। ঝুমকি তাকাল, ভিক্ষে চাওয়ার মতন।

ঠিক আছে। কাউকে বলব না। কিন্তু একটা জিনিস চাই। অর্ক বলল।

কি-কি? হারখানা। যেটা আজ কলতলা থেকে কুড়িয়ে নিয়েছ। কাটা কাটা গলায় কথাটা বলা মাত্র রিকশাওয়ালা ঠক করে রিকশা-নামিয়ে রাখল।

১২. এক লাফে রিকশা থেকে নেমে

এক লাফে রিকশা থেকে নেমে দাঁড়াল অর্ক। ঝুমকি পাথরের মত বসে আছে। ওর দৃষ্টি হিলহিলে, অর্ককে যেন সর্বাঙ্গে চাটছে।

আমার মায়ের অ্যাকসিডেন্ট হয়নি? তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর ঝুমকির।

না। আমি তোমার কাছে হার চাইতে এসেছি।

তুমি, তুমি আমাকে ভড়কি দিয়েছ? গলা চড়ায় উঠছিল, সামলে নিল ঝুমকি। ফ্রি স্কুল স্ট্রীটের এই মুখটায় দাঁড়ানো ধান্দাবাজ মানুষেরা এবার এদিকে তাকাল।

চিল্লাচ্ছ কেন? মালটা বের কর। অনেকক্ষণ পর অর্ক যেন কথাগুলো ফিরে পেল। সে আড়চোখে দেখছিল লোকগুলো একটু একটু করে বাড়ছে। নেহাতই ভেডুয়া মাকা, ওদের মধ্যে কোন মাস্তান নেই।

ঝুমকি রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মেটালো। তারপর হন হন করে ট্রাম স্টপের দিকে এগিয়ে গেল। দ্রুত পা চালালো অর্ক। এতক্ষণে তার স্থির বিশ্বাস হয়ে গেছে ঝুমকি হার নিয়েছে। নাহলে নিশ্চয়ই অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করত, কিসের হার? সে ঝুমকির পাশে গিয়ে বলল, আমার সঙ্গে নকশা করে কোন লাভ হবে না। তোমাকে যখন খুঁজে বের করেছি তখন ওটা আমি নিয়ে যাব দাঁড়াও।

পেছন পেছন এলে আমি চেঁচাবো। চাপা গলায় বলল ঝুমকি।

চেঁচাও। তারপর পাড়ায় ঢুকতে হবে। নিমতলায় পুরো বডি যাবে না, হেঁচুয়া করে ছেড়ে দেব। গর্জে উঠল অর্ক।

হেঁচুয়া? ফ্যাকাশে মুখে তাকাল ঝুমকি।

চিল্লাও না, চিল্লাও! কোন ভাতার তোমাকে বাঁচাবে পাড়ায় ঢুকলে? আমার মাল ঝেড়ে দিয়ে আবার রঙ নিচ্ছে! অর্কর কথা শেষ হওয়ামাত্র একজন মধ্যবয়সী লোক এগিয়ে এল, কি হয়েছে, অ্যাই?

অর্ক ঘুরে দাঁড়াল। পেট মোটা, নাদুস-নুদুস। সে হাত নাড়ল, কি দরকার আপনার, এখান থেকে ফুটুন।

অ্যাঁ, এইটুকুনি ছেলে আবার রঙবাজি হচ্ছে! তারপরেই গলা পাল্টে ঝুমকিকে বলল, ওকি তোমাকে ভয় দেখাচ্ছে?

লোকটার পেছনে এখন আরও কিছু জুটেছে। ঝুমকি তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, না। এটা আমাদের ব্যাপার।

অ। লোকটা যেন চুপসে গেল। তারপর মুখ বিকৃত করে ফুটপাথের ভিড়ের মধ্যে উঠে অন্যদের চাপা গলায় শোনাল, প্রসটিটিউট।

সঙ্গে সঙ্গে অর্ক ঘুরে দাঁড়াল, সেই ধান্দায় তো এসেছিলেন। এখন সুবিধে হল না বলে। আর একবার বলুন ভুঁড়ি ফাঁসিয়ে দেব।

লোকটা তোতলাতে লাগল, কি–কি? তারপর প্রায় দৌড়ে চলে যেতে লাগল উল্টোদিকে।

আর সঙ্গে সঙ্গে ভিড় ফাঁকা হয়ে গেল। এই সময় ঘন্টা বাজিয়ে এক নম্বর ট্রাম চলে এল সামনে। ঝুমকি উঠতে যাচ্ছিল। অর্ক দ্রুত তার সামনে চলে এসে মাথা নাড়ল, হার না দিয়ে যাওয়া চলবে না।

কিসের হার? এতক্ষণে ঝুমকি কথা বলল। ওর চোখ এবার অর্কর মুখের ওপর স্থির।

কিসের হার মানে? কলতলা থেকে যেটা কুড়িয়ে পেয়েছ!

ওটা যে তোমার তার প্রমাণ কি?

আবার নকশা হচ্ছে? আমি প্রমাণ দিলে মিস ডি হওয়া বেরিয়ে যাবে! অর্কর চোয়াল শক্ত হল।

তোমার হার? বাড়িতে জানে?

না! হঠাৎ কেমন অসহায় বোধ করল অর্ক। ওই বাড়ি শব্দটাই যেন তাকে ঈষৎ শীতল করে দিল। ঝুমকি যদি মাকে গিয়ে বলে তাহলে হাজারটা ঝামেলা বাধবে। নিজের অজান্তেই গলার স্বর নরম হয়ে এল অর্কর, ওটা আমার পরিচিত একজনের হার। তাকে ফেরত দিতে হবে। না দিতে পারলে আমি বিপদে পড়ব।

কার?

তুমি চিনবে না। খুব বড়লোক।

বড়লোক তোমাকে হার দিতে যাবে কেন?

দেয়নি কিন্তু আমি যে নিয়েছি তা জানে। ঝুমকি, তুমি হারটা ফেরত দাও। প্রায় অনুনয়ের গলায় বলল অর্ক।

আমার কাছে নেই।

কার কাছে আছে?

আমি জানি না। কথাটা শেষ করে বুকের ভেতর থেকে একটা রুমাল বের করল ঝুমকি। বেশ মোটা-সোটা গিট বাঁধা, তিনশ টাকা পেয়েছি। ইচ্ছে করলে এটা নিতে পারো। মিথ্যে কথা বলছি না, তিনশ টাকা দিয়েছে। হাত বাড়িয়ে রুমালের পুঁটলিটা এগিয়ে ধরল ঝুমকি।

তুমি, তুমি বিক্রি করে দিয়েছ? প্রায় ককিয়ে উঠল অর্ক।

ঝুমকি মাথা নাড়ল, বিক্রি না, বন্দক। আমি কি জানতাম ওটা তোমার হার। কলতলার ইটের কোণে পড়েছিল। টাকাটা নেবে?

পাগলের মত মাথা নাড়ল অর্ক, না, না, টাকা দিয়ে আমার কি হবে? হার না পেলে, হার না পেলে! অর্কর চোখ জ্বলছিল, কার কাছে বন্দক রেখেছ?

তাকে আমি চিনি না। মিস টি-র চেনা লোক।

মিষ্টি?

দূর! মিষ্টি কেন, মিস টি, তৃষ্ণা পাল। আমাদের ওখানে নাচ শিখে এখন খুব নাম করেছে। শোননি?

অর্ক পাগলের মত মাথা নাড়ল, এক্ষুনি চল ওর কাছে।

অসম্ভব। আমাকে টাকা দিয়ে ও প্রোগ্রামে চলে গিয়েছে। ডায়মণ্ডহারবারে হোল নাইট প্রোগ্রাম। কাল সকালে ফিরবে। তখন যেতে পারি।

অর্ক ঝুমকির চোখে চোখ রাখল, সত্যি কথা বলছ?

হ্যাঁ।

কোথায় থাকে?

আগে যাদবপুরে থাকত, এখন চিৎপুরে। নম্বরটা বলল সে। কাল অবধি অপেক্ষা না করে উপায় নেই। অর্ক ছোঁ মেরে ঝুমকির হাত থেকে রুমালটা নিয়ে নিল, কাল সকালে আমার হার চাই।

ঝুমকি নীরবে মাথা নাড়ল। এই সময় আর একটা ট্রাম এগিয়ে আসতে অর্ক লাফ দিয়ে উঠে পড়ল। একদম ফাঁকা ট্রাম। ঠিক ড্রাইভারের পিছনের সিটে গিয়ে জানলার ধারে বসল অর্ক। ঝুমকির দিকে আর তাকায়নি সে। কিন্তু ঝুমকিও একই ট্রামে উঠে লেডিস সিটের দিকে না গিয়ে সোজা এগিয়ে অর্কর পাশে বসে পড়ল। বিরক্ত হল অর্ক কিন্তু কিছু বলল না প্রথমে। ট্রামটা যখন ওয়েলিংটন ঘুরে বউবাজারের দিকে ছুটছে তখন ঝুমকি বলল, তুমি কি হারখানার বেশী দাম পাবে?

চমকে উঠল অর্ক, মানে?

ঠোঁট ওল্টালো ঝুমকি, মালটা তো বেচে দিতেই হত।

কে বলল?

জানি বাবা জানি। খুরকি আমার কাছে একবার একটা আংটি সাতদিন রেখে একশ টাকায় ঝেড়ে দিয়েছিল। অবশ্য আমাকেও দশ টাকা দিয়েছিল খুরকি। সত্যি বলতে কি ওর দিল আছে।

তোমার সঙ্গে যে খুরকির এত ভাব তা জানতাম না তো!

এককালে ভাব ছিল। তখন এইসব লাইন চিনতাম না

এখন চিনলে কি করে?

মালতীদি নিয়ে এল, তারপর কপাল। তবে এক বছর পরে আমি আর ওপাড়ায় থাকব না! খুরকির মত দশটা কুকুর তখন আমার পা চাটবে। ফোকটে অনেক দিয়েছি। ঠোঁট কামড়ালো ঝুমকি, আমাকে কিছু দেবে তো?

অর্ক অবাক গলায় বলল, কেন?

বা রে, মালটা ঝেড়ে দিয়ে কামাই করিয়ে দিলাম যে!

অর্ক হিসহিসিয়ে উঠল, তোর বাপের জিনিস যে ঝেড়েছিস! কাল সকাল দশটায় ট্রাম রাস্তায় চলে আসবি। বলে, উঠে পড়ল। দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে গেল ঝুমকিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে। কণ্ডাক্টর হাত বাড়িয়েছিল, কিন্তু অর্ক ইশারায় ঝুমকিকে দেখিয়ে দিয়ে নেমে পড়ল চলন্ত ট্রাম থেকে। নকশা! মনে মনে খিস্তি করল অর্ক! শেয়ার চাইছে, ফোট। কিন্তু আর একটু থাকলে টিকিটটা কাটতে হত।

তিনবার ট্রাম পাল্টে অর্ক শ্যামবাজারের মোড়ে যখন পৌঁছে গেল তখন রাত নটা। অন্যদিন হলে এখান থেকে হেঁটেই ফিরতো কিন্তু আজ পকেটে টাকা আছে। আর জি কর পুলের তলায় রাত নটায় হাওয়া খারাপ হয়ে যায়। সে দেখল কালীবাড়ির সামনে শেয়ার ট্যাক্সি লোক ডাকছে। দেখে দেখে পাঁচজন উঠে বসা ট্যাক্সিতে উঠল সে। সঙ্গে সঙ্গে ট্যাক্সি চলতে শুরু করল। আর জি কর হাসপাতালের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ওর বুক ধক করে উঠল। লোকটা বেঁচে আছে কিনা কে জানে। ভগবান যদি মেরে ফেলে তো পাঁচ টাকার ভোগ দেবে সে। ব্রিজের ওপর থেকে গাড়ি নামা শুরু করলে ও খুব অবাক হয়েছে এমন ভাব করে বলল, আপনি ডানলপে যাচ্ছেন না?

ট্যাক্সিওয়ালা ঘাড় নাড়ল, না। নাগেরবাজার।

আরে! আমি ডানলপে যাব।

সঙ্গে সঙ্গে অন্য পাঁচজন যাত্রী বলে উঠল, ভুল ট্যাক্সিতে উঠেছে, নামিয়ে দিন বেচারাকে। ইস্, কতটা দূর ফিরতে হবে।

ট্যাক্সিওয়ালা বেলগাছিয়ার মোড়ে গাড়ি থামাল, না দেখে ওঠো কেন? আমি একটা প্যাসেঞ্জার লস করলাম, একটা টাকা দিয়ে যাও।

অর্ক দরজা খুলতে খুলতে বলল, এত রাত্রে আমি চিনতে পারিনি। কি যে–।

অন্য যাত্রীরা হাঁ হাঁ করে উঠল, আপনি মশাই কসাই নাকি! ঠিক পেয়ে যাবেন প্যাসেঞ্জার সামনে। চলুন, চলুন। এই যে ভাই, উল্টোদিকের স্টপ থেকে বাস ধরে শ্যামবাজারে ফিরে যাও।

ট্যাক্সিটা চলে যাওয়া অবধি অর্ক কোনরকমে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর আনন্দে একটু নেচে নিল, জোর ঢপ দেওয়া গেল। পা বাড়াবার আগে রুমালটা ভাল করে দেখে নিল সে। একটা মাল রাখা দরকার সঙ্গে, নাহলে যে কোন দিন ফুটকুড়ি হয়ে যেতে পারে। ঈশ্বরপুকুর লেনের মুখে। আসতেই ও দাঁড়িয়ে পড়ল। খুরকি সেই দুটো লোকের সঙ্গে যাচ্ছে। কিলার কাছে শুনেছে যে ওই লোক দুটো ওয়াগন নিয়ে কারবার করে। খুরকি যেদিন ওয়াগনের কারবার করতে যায় সেদিন পাড়ার কারো সঙ্গে মেশে না। কারবার হয়ে যাওয়ার পর দশ দিন এদিকে আসে না। আজ তাহলে ওদের মশলা আছে। কিলা ওদের সঙ্গে নেই অথচ কিলাকে খুরকি কথা দিয়েছিল এবার যাওয়ার সময় ওকে পার্টনার করবে।

ঈশ্বরপুকুর লেনে ঢুকতেই কিচাইন। সাদা রঙের একটা প্রাইভেট রেশনের লরির সামনে আটকে গেছে। পেছনে দু’তিনটে রিকশা, ঠেলা মিলে জোর ঝামেলা। এইসব মোকা কাজে লাগায় বিলুরা। রেশনের লরির কাছ থেকে কিছু পাওয়া যায় না কিন্তু প্রাইভেট যদি অচেনা হয় তাহলে তাকে কিছু ছাড়তেই হবে। অর্ক দ্রুত এগিয়ে গিয়ে দেখল পাড়ার চারটে ছেলে ড্রাইভারের সঙ্গে ঝামেলা করছে। পেছনের সিটে এক ভদ্রলোক হেলান দিয়ে অলস চোখে ওদের দেখছেন। এত চেঁচামেচিতেও যেন ওঁর কিছু এসে যাচ্ছে না। গিলেকরা পাঞ্জাবি আর ধুতি লোকটার কুচকুচে কালো চুলের প্রৌঢ় শরীরটার সঙ্গে চমৎকার মানিয়েছে। অর্ক এক নজরেই বুঝতে পারল পার্টি হেভি মালদার। কিন্তু এই ছেলেগুলো রুই মাছকে পুঁটি বানিয়ে ছেড়ে দেবে। সে এক হাতের ধাক্কায় রিকশাকে সরিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, কি হয়েছে, কি হয়েছে?

একজন জবাব দিল, প্রাইভেট রং সাইডে ঢুকেছে।

অর্ক ড্রাইভারের দিকে ঝুঁকে বলল, কি ব্যাপার?

আর ড্রাইভার পেছনে মুখ ফিরিয়ে বলল, সা, হাম বোলাথা আপ মৎ আইয়ে। ইয়ে বহুৎ খতরনাক যায়েগা হ্যায়।

ভদ্রলোক একটু বিচলিত না হয়ে বললেন, লরিওয়ালাকে বল বাঁ দিকে গাড়িটাকে সরিয়ে নিতে।

অর্কর মনে হল এই লোকটা খুব সহজে মুরগি হবে না। একটু বাজিয়ে দেখা দরকার। সে খুব মাতব্বরের মত বলল, এই রাস্তা বেশীদূর যায়নি। আপনি কোথায় যাবেন?

আমি এখানেই যাব।

ঈশ্বরপুকুর লেনের এপাশটায় অনেকগুলো কোঠাবাড়ি, সেখানে ভদ্রলোকরা থাকেন। এই নিয়ে অবশ্য কিলারা প্রায়ই ঝগড়া করে, কি, কোঠাবাড়িতে থাকেন বলেই ভদ্রলোক হয়ে গেছেন, তাই না? মেরে বাপকে হিজড়ে করে দেব। তা এই লোকটা কি সেই রকম কারো কাছে যাচ্ছে যারা ওদের চিৎকার কানে গেলেই ভয়ে জানলা বন্ধ করে, রাস্তা দিয়ে হাঁটে চোরের মতন চোখ নামিয়ে। বোধহয় ব্রজমাধবের বাড়িতে যাচ্ছে। তবু সে যাচাই করার জন্যে জিজ্ঞাসা করল, কত নম্বর? বা ভদ্রলোক পাঞ্জাবির পকেট থেকে দুধের চেয়ে সাদা রুমাল বের করে নাক মুছলেন, তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেন।

চোখ কুঁচকে গেল অর্কর। এত রাত্রে এই রকম মাল তো কখনই তিন নম্বরে আসে না। কোন কোন মালিক ড্রাইভার খুঁজতে আসে, কিন্তু সে তো সকালবেলায়।

সে আর একটু ঝুঁকে প্রশ্ন করল, কত নম্বর বললেন?

তিন। তুমি কি কানে কম শোন? ওই লরিটাকে সরিয়ে নিতে বল।

তিন নম্বরে কার কাছে যাবেন?

কেন, তোমার কি দরকার? খুব বিরক্তি গলায়।

আমিও তিন নম্বরে থাকি।

এবার ভদ্রলোক একটু নরম হলেন, ও, তাহলে ভালই হল! তুমি একটু দ্যাখো তো, বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে। হাত বাড়িয়ে লরিটাকে দেখিয়ে দিলেন ভদ্রলোক।

এর আগে ড্রাইভার নেমেছিল। কিন্তু তার কথা লরিওয়ালা শুনছে না। পাড়ার ছেলেদের সমর্থন পাচ্ছে সে। অর্ক চটপট ভেবে নিল প্রাইভেটকে হাত করতে হবে। তিন নম্বরের যার কাছেই যাক

কেন এই পথেই বের হতে হবে। সে কয়েক পা এগিয়ে ছেলেদের বলল, সরে যা, কেস জণ্ডিস। তারপর ইশারায় লরিওয়ালাকে ব্যাক করতে বলল। মিনিট তিনেক লাগল রাস্তা পরিষ্কার হতে। ভদ্রলোক বললেন, তুমি একটু উঠে আসবে ভাই? আমি তো চিনি না।

অর্ক এইটেই চাইছিল। সে গাড়ির দরজা খুলে সিটে শরীর রাখল। পাড়ার ছেলেরা যে তাকে ঈর্ষার চোখে দেখছে বুঝতে পেরে সে কার্নি মারল। তারপর ভদ্রলোকের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারল এরকম লোকের সঙ্গে সে কোনদিন কথা বলেনি। এমনকি বিলাস সোমও এর কাছে কিছু না। ওঁর শরীর থেকে যা খুশবু বের হচ্ছে তা যে অত্যন্ত মূল্যবান বুঝতে অসুবিধে হবার নয়। যা ভেবেছিল তার চেয়ে অনেক বেশী বয়স ভদ্রলোকের। কিন্তু এমন মাঞ্জা দিয়েছে যে। প্রাইভেট ততক্ষণে অনেকটা এগিয়েছে। ভদ্রলোক অলস চোখে বাইরে তাকিয়েছেন। নিমুর চায়ের দোকান দেখতে পেয়ে অর্ক বলল, এই যে এসে গেছি। সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভার প্রায় নিঃশব্দে গাড়ি থামাল। এ নিমুর দোকানে তখন ধোওয়া-মোছা চলছে। পাশের সিগারেটের দোকানে গ্যাঁক গ্যাঁক করে বিবিধ ভারতী বাজছে। ভদ্রলোক মুখ বাড়িয়ে তিন নম্বরের চেহারা দেখলেন। বিস্ময়ের অভিব্যক্তি ওঁর চোখে। বললেন, মাই গড, এটাই তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেন? ঠিক বলছ?

হ্যাঁ। আপনি কার ঘরে যাবেন? দরজা খুলতে খুলতে জিজ্ঞাসা করল অর্ক। গাড়িটাকে দেখে ফুটে দাঁড়ানো কয়েকজন উৎসুক চোখে তাকাচ্ছে। ভদ্রলোক বললেন, কার ঘর জানি না ভাই,

আমি অনি, অনিমেষ মিত্রকে খুঁজছি।

হাঁ হয়ে গেল অর্ক। বাবাকে খুঁজছে লোকটা! কে এ? এই এত বছরে কোন মানুষকে সে বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসতে দ্যাখেনি। এরকম বড়লোক বাবার খোঁজ করতে আসবে কেন? অর্ক কিছুই ঠাওর করতে পারছিল না। তাকে চেয়ে থাকতে দেখে ভদ্রলোক আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি চেন?

অর্ক ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। ভদ্রলোক এবার দরজা খুলে নিচে নামলেন। চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলেন পরিবেশটার চেহারা। তারপর ড্রাইভারকে বললেন, কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর।; ততক্ষণে অর্ক অনেকগুলো সম্ভাবনার কথা ভেবেছে। বাবা এককালে নকশাল ছিল। এই লোকটাও কি তখন বাবার সঙ্গী ছিল? না, তা হতে পারে না। নকশালদের পুলিশ খুব প্যাঁদাতো, এই লোকটা কোনদিন ঝাড় খেয়েছে বলে মনেই হয় না। কিছুদিন আগে ও মাকে বলতে শুনেছে, জানো, সুদীপ মন্ত্রী হয়েছে।

সুদীপ? বাবা মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করেছিল।

আঃ, সুদীপকে, তোমার মনে নেই? য়ুনিভার্সিটিতে য়ুনিয়ন করত। খুব একরোখা ছিল। মা বলেছিল।

তাই নাকি! সুদীপকে ওরা মিনিস্ট্রিতে নিয়েছে?

বাবা এবং মায়ের কথা থেকে অর্ক বুঝতে পেরেছিল ওই মন্ত্রীটাকে ওরা দুজনেই চেনে। অতএব দু’একটা ভদ্রলোকের সঙ্গে বাবার পরিচয় থাকতেই পারে। কিন্তু কি ধান্দায় তারা এত রাত্রে তিন নম্বরে দেখা করতে আসবে? এইটেই মাথায় ঢুকছিল না ওর।

ভদ্রলোক বললেন, অনিমেষ এখন হাঁটতে পারে?

অর্ক বলল, ক্রাচ নিয়ে পারে।

গলিতে ঢুকল অর্ক, পেছনে খুশবু ছড়ানো ভদ্রলোক। ওঁর চেহারা দেখতে অনেকেই দাঁড়িয়ে পড়েছে। শুধু মোক্ষবুড়ি চেঁচিয়ে উঠল, কে যায়?

অর্ক জবাব দিল, না, কিন্তু ভদ্রলোক মোক্ষবুড়ির দিকে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়েও দাঁড়ালেন না। অনুদের দরজা বন্ধ। হঠাৎ, এতক্ষণ বাদে, অর্কর মনে হল এই ভদ্রলোক আসায় আজ সে বেঁচে গেল। দুপুরে মা যা বলেছে তারপরে আজ রাত্রে দেরিতে ফেরার কোন কৈফিয়ৎ দেওয়া যেত না। এই ভদ্রলোক যদি খুব বড় কেউ হয় তাহলে নিশ্চয়ই ওরা একে নিয়ে মেতে থাকবে।

ভেজানো দরজা খুলতেই অর্ক দেখল মা চেয়ারে বসে বই পড়ছে, বাবা বিছানায় গুটিয়ে শুয়ে রয়েছে। শব্দ হতেই মাধবীলতা মুখ তুলল বই থেকে। ছেলেকে দেখামাত্র চোখের দৃষ্টি পাল্টে গেল, কোথায় ছিলি?

অর্ক চোখেমুখে ইঙ্গিত করল এখন রাগারাগি করো না, হাসপাতালে গিয়ে আটকে পড়েছিলাম। বাবাকে ডাকো।

কেন? মাধবীলতার গলার স্বর শক্ত।

এক ভদ্রলোক বাবাকে খুঁজতে এসেছেন। গাড়ি নিয়ে। কথা বলতে বলতে অর্ক ঘরে ঢুকেছিল। একটা একশ পাওয়ারের বাল্ব ঝুলছিল ঘরে। অনিমেষ সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিল, কারণ এইসব কথার কোন প্রতিক্রিয়া তার মধ্যে দেখা গেল না। চোখের পাতা বন্ধ। মাধবীলতা এবার বিস্মিত ভঙ্গীতে উঠে দাঁড়াল। খাটের ওপর বই রেখে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে ভদ্রলোককে দেখতে পেল। ষাটের আশেপাশে বয়স, গিলেকরা পাঞ্জাবি এবং ধুতি, চকচকে জুতো পরা লোকটি খুব স্মার্ট। সে অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল, কাকে খুঁজছেন?

অনিমেষ এখানে থাকে?

হ্যাঁ।

ওকে ডেকে দেওয়া যেতে পারে?

মাধবীলতা ঘাড় ফিরিয়ে অনিমেষকে দেখল। মড়ার মত ঘুমুচ্ছে। ট্রাম লাইন অবধি ক্রাচ নিয়ে হেঁটে শরীর কাহিল হয়ে পড়েছে, তাছাড়া মনও খুব বিক্ষিপ্ত ছিল। অবিনাশদের প্রস্তাবের কথা সে বলেছে মাধবীলতাকে। শুনে আঁতকে উঠেছিল মাধবীলতা, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? আর কক্ষনো তুমি এমনি করে কাজ খুঁজে বেড়াবে না!

এখন অনিমেষকে ডাকতে মায়া লাগছিল মাধবীলতার। সে আবার মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনার নামটা?

আমি অনিমেষের কাকা!

মাধবীলতা চমকে উঠল। সে জানে না কেন, সমস্ত শরীর তার রোমাঞ্চিত হতে লাগল। সে চট করে আঁচলটা মাথায় তুলে নিল, আপনি, আপনি ছোটকাকা?

হ্যাঁ। আমি ওর ছোটকাকা, প্রিয়তোষ মিত্র। ও কোথায়? মাধবীলতা দ্রুত এগিয়ে প্রিয়তোষকে প্রণাম করল।

আহা, থাক থাক, প্রিয়তোষ সরে দাঁড়াতে গিয়েও পারলেন না। মাধবীলতার হঠাৎ খুব আনন্দ হচ্ছিল। এই প্রথম সে অনিমেষের নিকট আত্মীয় কাউকে দেখছে। আর তখনই দুপ করে আলো নিভে গেল। কেউ একজন চেঁচিয়ে বলল কোন ঘর থেকে জ্যোতিবাবু চলে গেলেন!

মাধবীলতার মনে হল সমস্ত পৃথিবীটা তার সঙ্গে শত্রুতা করছে। এই মানুষটা প্রথম যখন এল তখনই আলো নিবল! রোজই অবশ্য ঠিক দশটায় লোডশেডিং হয় তাই বলে এখনই দশটা বাজতে হবে? সে বলল, আপনি একটু দাঁড়ান, আমি আলো জ্বালছি।

দ্রুত ঘরে ঢুকে সে হ্যারিকেন খুঁজতে খুঁজতে অন্ধকারেই উঠে এল ছেলের কাছে, যা, প্রণাম কর। তোর ছোটদাদু। তারপরেই আবার হ্যারিকেন জ্বালাতে ছুটল। মিটমিটে আলো ঘরে ছড়ালে সে হ্যারিকেনটাকে টেবিলের ওপর রেখে অনিমেষের কাছে চলে এল, অ্যাই, শোন, শুনছ?

চাপা গলার ডাকে অনিমেষ নড়েচড়ে উঠল, আলো নেই?

না। তাড়াতাড়ি ওঠ।

কেন? অনিমেষের চোখে বিস্ময়। সদ্য ঘুম ভাঙ্গার পর সে আবছা আলোয় মাধবীলতাকে অন্যরকম দেখছিল।

ছোটকাকা এসেছেন। কথা বলতে বলতে মাধবীলতা ঘরের দিকে তাকাচ্ছিল। সর্বত্র অলক্ষ্মীশ্রী। অমন মানুষকে বসানো যায় না। দ্রুত হাতে সবচেয়ে ভাল বিছানার চাঁদরটা বের করে খাটের ওপর পাততে পাততে বলল, সরো, সরে এস, এটাকে পাততে দাও, আঃ, বসে আছ কেন?

অনিমেষ তখনও অন্ধকারে, কে এসেছে বললে?

ছোটকাকা। তোমার ছোটকাকা।

গভীর কুয়োর তলা থেকে ভুস করে অনিমেষ ওপরে উঠে আসছিল, কোনরকমে বলল, ছোটকাকা? বলে নেমে দাঁড়াল ক্রাচে ভর করে।

হ্যাঁ। চাঁদর ঠিক করে মাধবীলতা দরজায় গিয়ে ডাকল, আসুন।

বাইরে তখন উঁকিঝুঁকি চলছে প্রিয়তোষকে কেন্দ্র করে। এরই মধ্যে মাধবীলতা লক্ষ্য করেছে যে বলা সত্ত্বেও অর্ক বাইরে গিয়ে প্রিয়তোষকে প্রণাম করেনি।

প্রিয়তোষ দরজায় দাঁড়িয়ে চমকে উঠলেন, একি? অনি!

অনেকদিন বাদে অনিমেষ লজ্জা পেল। খালি গা, কোমরের নিচ থেকে লুঙ্গি এবং দুই বগলে ক্রাচ নিয়ে যে অভ্যেস হয়েছে এতদিনে তা চট করে বেমানান মনে হল। তবু সে সহজ হবার চেষ্টা করল, কবে এলে তুমি?

একথার জবাব দিলেন না প্রিয়তোষ। যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না এমন ভঙ্গীতে তাকিয়ে ছিলেন। মাধবীলতা চেয়ারটা এগিয়ে দিল, বসুন।

প্রিয়তোষ সেদিকে একদম লক্ষ্য না করে বললেন, এ আমি কখনও কল্পনাও করতে পারিনি। কি হয়েছিল?

অনিমেষ হাসল, কি আবার হবে! বসো।

প্রিয়তোষ চেয়ারটা টেনে নিয়ে ধীরে ধীরে বসতেই মাধবীলতা হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগল। প্রিয়তোষ হাত নাড়লেন, না না, হাওয়া করতে হবে না।

যা গুমোট গরম আপনি বসতে পারবেন না।

অনিমেষ আবার জিজ্ঞাসা করল, কবে এলে?

তিনদিন হল। সুদীপের কাছে তোর খবর পেলাম। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আর তোর খবর ও জানত না। জেলে গিয়ে জানতে পারলাম তুই দীপক নামের একটি ছেলের বাড়িতে গিয়েছিস। তার ঠিকানা পেয়ে সুবিধে হল। দীপকের বাড়িতে গিয়ে অবশ্য ঝামেলা হয়েছিল।

প্রিয়তোষ থামতে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কেন?

দীপক তোর সঙ্গে জেলে ছিল। বছর পাঁচেক হল সে মারা গেছে। তার ঠাকুমা পাগল হয়ে গেছেন, মা-ও অ্যাবনর্মাল। অনেক কষ্টে এই ঠিকানা পেয়ে এলাম। প্রিয়তোষ অনিমেষকে খুঁটিয়ে দেখছিলেন।

দীপক মারা গেছে! সেই বোবা-হাবা ছেলেটা! অনিমেষ চোখ বন্ধ করল। তারপর নিজেকে ফিরিয়ে আনতেই জিজ্ঞাসা করল, তুমি সোজা মস্কো থেকে এখানে এলে?

না। ন্যুয়র্ক থেকে। আমার কথা থাক, আগে তোর কথা আমি শুনতে চাই।

১৩. প্রিয়তোষের দিকে তাকিয়ে

প্রিয়তোষের দিকে তাকিয়ে অনিমেষ বলল, কেমন লাগছে?

ঘাড় নাড়লেন প্রিয়তোষ, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এরা কারা?

প্রশ্নটা শোনামাত্র মাধবীলতার হাত একটু স্থির হয়েই আবার সচল হল। অনিমেষ লক্ষ্য করল পাখার হাওয়ার বেগ এখন কম। সে বলল, এটা বোঝা উচিত ছিল।

প্রিয়তোষ মাধবীলতার মুখের দিকে তাকালেন, তোমরা বিয়ে থা করেছ কিন্তু এই খবরটা দাদাকে দাওনি কেন? ওঁরা তো কিছুই জানেন না।

মাধবীলতা কোন উত্তর দিল না কিন্তু তার হাত এবার স্থির হল। প্রিয়তোষ অনিমেষের দিকে তাকালেন। হ্যারিকেনের আলোয় অনিমেষকে আরও বেশী রোগা দেখাচ্ছে। অনিমেষ বলল, বাবার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে?

হ্যাঁ। আমি ওখানেই শুনলাম তুই জেলে গিয়েছিলি। দাদা সেই খবর পেয়ে মাঝে মাঝেই জেলে এসে খোঁজ খবর করত।

তাই নাকি! অনিমেষ হাসবার চেষ্টা করল, আমার সঙ্গে দেখা হয়নি কখনও।

ইচ্ছে করেই নাকি করেনি। ভেবেছিল তুই রিলিজড হলে জলপাইগুড়িতে ফেরত নিয়ে যাবে। কিন্তু তারপরেই ওই ঘটনাটা ঘটল।

কি ঘটনা?

তুই কিছুই জানিস না?

না।

জেল থেকে বেরিয়ে কোথায় ছিলি?

এখানে, এই ঘরে।

আশ্চর্য! দাদা প্যারালাইজড হয়ে রয়েছে। ডানদিকটায় কোন সেন্স নেই। চা বাগানের চাকরি ছেড়ে এখন জলপাইগুড়ির বাড়িতে রয়েছে। লাঠি নিয়ে কোনরকমে বাথরুম বারান্দায় যেতে পারে।

অনিমেষ হোঁচট খেল। বাবা-! বাবার কথা ভাবলেই চোখের সামনে একটাই দৃশ্য ভেসে ওঠে। সন্ধ্যের অন্ধকার যখন তিরতিরিয়ে স্বর্গছেঁড়ার মাঠে ছড়িয়ে যেত তখন সাইকেলের ঘন্টি বাজাতে বাজাতে বাবা ফিরতো বাড়িতে, হাফ প্যান্ট আর শার্ট পরে। সাইকেল রেখে আলতো আঙ্গুলে অনিমেষের চুল এলোমেলো করে ভেতরে চলে যেত! এখন সেই মানুষ অর্ধেক অবশ শরীরে পড়ে আছে অথচ সে কিছুই জানে না।

অনিমেষ কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, পিসীমা?

দিদির শরীর খুব খারাপ, বেশীদিন বাঁচবে না। তুই তো ওদের চিঠি দিতে পারতিস। এই বস্তির ঘরে থাকার কোন মানে হয়?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, না। আমি আর কারো দায় হয়ে থাকতে চাই না।

মাধবীলতা চকিতে অনিমেষকে দেখল তারপর ইশারায় অর্ককে ডেকে বাইরে চলে গেল। অর্ক এতক্ষণ ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছিল। মা ডাকামাত্র সে বেরিয়ে এল। মাধবীলতা দ্রুতগলায় বলল, দুটো সন্দেশ আর রসগোল্লা নিয়ে আয়।

অর্ক মাথা নাড়ল, এখন পাড়ার দোকান বন্ধ। সেই মোড়ে যেতে হবে।

তাই যা। আমি টাকা দিচ্ছি। আবার ঘরে ঢোকার জন্যে মাধবীলতা পা বাড়াতে অর্ক বাধা দিল, আমার কাছে টাকা আছে।

কোথায় পেলি টাকা? সন্দেহের সুর ফুটে উঠল মাধবীলতার গলায়।

পেয়েছি। কিন্তু এই লোকটাকে এত খাতির করছ কেন?

ওইভাবে কথা বলবি না। তোর ছোট দাদু উনি, মনে রাখিস। তুই প্রণাম করেছিস?

না। মাধবীলতা দাঁতে দাঁত চাপল, তুই এত অবাধ্য! লজ্জা লজ্জা, যা প্রণাম কর।

অর্ক গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মাধবীলতা ওর হাত ধরে ঘরের দিকে টানতেই সে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, তোমাকে ছাড়া আর কাউকে আমি প্রণাম করতে পারব না। তারপর দ্রুত বেরিয়ে গেল। মাধবীলতা পাথর, অন্ধকার প্যাসেজে দাঁড়িয়ে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাচ্ছিল সে। না পেতে পেতে যখন অভ্যেস হয়ে যাচ্ছে তখন ছোট্ট একটা পাওয়া এমন করে যে কেন নাড়িয়ে দেয়।

মাধবীলতা ঘর ছেড়ে যাওয়ামাত্র প্রিয়তোষ জিজ্ঞাসা করলেন, তুই বিয়ে করেছিস কবে?

অনিমেষ হিসেব করার চেষ্টা করে মুখ নামাল, অনেকদিন।

সন্তানাদি?

ওই তো দেখলে, এখানে দাঁড়িয়েছিল।

অতবড় ছেলে তোর? চমকে উঠলেন প্রিয়তোষ।

পনের বছর বয়স।

।আমি ভাবতে পারছি না। তোর শ্বশুরবাড়ি কোথায়?

কোলকাতাতেই, কিন্তু আমাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই।

তোদের চলছে কি করে?

ও স্কুলে পড়ায়। প্রিয়তোষের মুখচোখে এবার বিস্ময় ফুটে উঠল, শিক্ষিতা মেয়ে? তোর সঙ্গে পড়ত নিশ্চয়ই?

হ্যাঁ।

এইসময় মাধবীলতা দরজায় এসে দাঁড়াল। মুখ যদিও অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না তবু অনিমেষের মনে হল ওর কিছু হয়েছে। প্রিয়তোষ মাধবীলতাকে বললেন, না, তোমাকে আর হাওয়া করতে হবে না। তুমি বরং আমার সামনে এসো। হাত দিয়ে খাট দেখিয়ে দিলেন তিনি।

মাধবীলতা আলোর সামনে এলে প্রিয়তোষ বললেন, আমি তোমাদের সব কথা জানি না। কিন্তু মনে হচ্ছে তুমি অন্য জাতের মেয়ে। কি নাম তোমার?

মাধবীলতা।

বাঃ, সুন্দর। তুমি যা রোজগার কর তাতে এর চেয়ে একটু ভাল পরিবেশে থাকা যায় না?

যেত। কিন্তু এত ধার হয়ে গিয়েছে।

ধার! কেন?

অনিমেষ বলল, ওসব কথা ছেড়ে দাও। এই পাদুটো কখনই সারবে না অথচ ও সারাবেই। অসম্ভবের পেছনে ছোটার কোন মানে হয়?

সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়তোষের মুখ শক্ত হল, সেটা তোর খেয়াল ছিল না?

আমার? অনিমেষ বিস্মিত হল।

বিপ্লব করবি, এই দেশে সেটা যে অসম্ভব তা জানতিস না?

অনিমেষ পূর্ণ-দৃষ্টিতে ছোটকাকাকে দেখল, এ বিষয়ে তোমার সঙ্গে আমি আলোচনা করতে চাই।

প্রিয়তোষ যেন নিজেকে ফিরে পেলেন, আমরা অন্যের সমালোচনা করি কিন্তু নিজের ত্রুটি দেখতে পাই না। এটা যদি বুঝতিস তাহলে আজ এই অবস্থা হত না।

অনিমেষ নিচু গলায় বলল, সেটা তুমি অনেক আগেই বুঝেছিলে।

তার মানে? চমকে উঠলেন প্রিয়তোষ।

আমি তোমার কাছেই প্রথম মার্কসের নাম শুনেছিলাম।

এই সময় মাধবীলতা বলে উঠল, ওসব পুরোনো কথা এখন তুলছ কেন?

প্রিয়তোষের কিছুটা সময় লাগল সুস্থির হতে। অনিমেষের কথায় একটা স্পষ্ট খোঁচা ছিল তা তিনি জানেন। পুরানোকথার সূত্র ধরে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের কত টাকা ধার আছে?

আছে, একসময় শোধ করে দেব। মাধবীলতা অঙ্কটা বলতে চাইল না।

কিন্তু এই পরিবেশে বাস করলে তোমাদের ছেলে মানুষ হতে পারবে না।

মাধবীলতা বলল, জানি। কিন্তু এর বেশী কিছু করার সঙ্গতি আমার নেই।

তোমরা জলপাইগুড়িতে ফিরে যেতে পার। চেষ্টা করলে ওখানকার স্কুলে তোমার কাজ হতে পারে। পরিবেশ আর পরিস্থিতি পাল্টে যাবে।

দেখি। এতে দেখাদেখির কি আছে?

ধার শোধ না হওয়া পর্যন্ত এখানকার চাকরি ছাড়া সম্ভব নয়।

বেশ তো, আমাকে বল কত টাকা দরকার?

এবার অনিমেষ উত্তর দিল, যে প্রয়োজনে নিজের বাবা মায়ের কাছে হাত পাতেনি সে তোমার সাহায্য নেবে এটা ভাবছ কেন?

ও। প্রিয়তোষ নড়েচড়ে বসলেন। তারপর মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে বললেন, তাহলে তোমার ছেলেকে ওখানে পাঠিয়ে দাও। আমাদের বংশের মুখ চেয়ে এটা কর। গাড়িতে বসে যা দেখেছি তা আমার ভাল লাগেনি।

কি দেখেছ? অনিমেষের বুকের ভেতর অস্বস্তি।

লরির সামনে আমার গাড়ি আটকে গিয়েছিল বলে পাড়ার ছেলেরা ঝামেলা করার চেষ্টা করছিল। আমি লক্ষ্য করছিলাম ওরা কতটা বাড়ে। এই সময় তোর ছেলে এল। কথাবার্তায় বুঝলাম পাড়ার ছেলেদের ওপর ওর বেশ কর্তৃত্ব আছে। কথা বলার ধরনটাও ভাল লাগল না। রকবাজ ছেলে আগেও দেখেছি, কিন্তু এবার এসে যে শ্রেণীর ছেলেদের দেখছি তাদের আগে দেখিনি।

মাধবীলতা নিচু গলায় বলল, এই জ্বালায় তো জ্বলছি। আসলে ওর বয়সের তুলনায় চেহারাটা বড় কিন্তু বুদ্ধিসুদ্ধি একটুও পাকেনি।

এইসময় অর্ককে দরজায় দেখতে পেয়ে মাধবীলতা চট করে উঠে দাঁড়াল। তারপর ছেলের হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেটটা নিয়ে প্রিয়তোষের পেছনে চলে গিয়ে প্লেটে সাজাতে বসল। মাধবীলতা দেখল দুটো করে নয়, অনেক বেশী মিষ্টি নিয়ে এসেছে অর্ক। অন্তত দশ টাকার তো হবেই। এত টাকা ও পেল কোথায়? তারপরেই মনে পড়ল দুপুরে ওর হাতে টাকা ছিল। মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালো মাধবীলতা। হঠাৎ খেয়াল হল অর্ক নিজে থেকে বাড়তি মিষ্টি এনেছে সেটাও অভিনব।

প্রিয়তোষ অর্ককে দেখলেন, তোমার নাম কি?

অর্ক।

বাঃ চমৎকার নাম। কি পড়ছ?

জিজ্ঞাসা করামাত্র মা এবং বাবার চোখ যে তার ওপর পড়ল সেটা টের পেয়ে একটু সংকুচিত গলায় উত্তর দিল অর্ক।

এখানকার ছেলেদের সঙ্গে মিশতে তোমার ভাল লাগে?

কেন লাগবে না?

এরা কি তোমার মত পড়াশুনো করে?

না।

তাহলে?

তাহলে কি?

প্রিয়তোষ আবার পূর্ণদৃষ্টিতে অর্ককে দেখলেন। এই সময় মাধবীলতা প্লেটটা প্রিয়তোষের পাশের টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল। প্রিয়তোষ সেদিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন, এসব করতে গেলে কেন?

কিছুই তো করিনি। মাধবীলতার কণ্ঠস্বর নরম।

আমার ব্লাডসুগার চারশোতে উঠেছিল। মিষ্টি বিষের সমান। হ্যাঁ অনিমেষ, তোর নিজের কি করার ইচ্ছে?

বুঝতে পারছি না। কিছু তো করতেই হবে।

প্রিয়তোষ উঠলেন, আমি আরও দিন দশেক এখানে আছি।এর মধ্যে তুই চিন্তাভাবনা করে নে। এখানে আমাদের মত মানুষ বাঁচতে পারবে না। আর বউমা, তোমাকে যা বললাম, ভেবে দ্যাখো। ওর জন্যে যা করছ তার তুলনা নেই কিন্তু তোমার অসুস্থ শ্বশুর কি দোষ করল। তারপর অর্কর দিকে তাকিয়ে হাসলেন, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।

অর্ক একটু উদ্ধতভঙ্গীতে তাকাল। প্রিয়তোষ বললেন, কাল বিকেল তিনটে নাগাদ আমার হোটেলে ওকে পাঠিয়ে দিও বউমা।

অনিমেষ মনে করার চেষ্টা করল, কোন হোটেল যেন?।

এবার আমি পার্ক হোটেলে উঠেছি। পার্ক স্ট্রীটে। রিসেপসনে আমার নাম বললেই হবে। ঘর ছেড়ে যাওয়ার ভঙ্গী করে আবার দাঁড়ালেন প্রিয়তোষ। তারপর মাধবীলতার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি তো তোমাদের কথা জানতাম না। আমাদের বংশের নতুন বউ প্রণাম করল অথচ শুধু হাতে বউ-এর মুখ দেখে যাব তা হয় না। কিন্তু।

মাধবীলতার গলার স্বর কাঁপল, আপনি আশীর্বাদ করুন তাতেই হবে। তাছাড়া আমি তো আর নতুন বউ নই।

আমি তো তোমাকে প্রথম দেখলাম। আমাদের বংশের নিয়ম তুমি জানবে কি করে? প্রিয়তোষ বাঁ হাতের কড়ে আঙ্গুল থেকে আংটিটা খুললেন, যদিও আমার আঙ্গুল সরু তবু তোমার হবে কিনা জানি না। পুরোনো জিনিস বলে কিছু মনে করো না।

মাধবীলতা একদৃষ্টে প্রসারিত হাতটিকে দেখল। আঙ্গুলের ডগায় আংটি থেকে আলো ঠিকরে বার হচ্ছে। খুব দামী পাথর নিঃসন্দেহে। সে অনিমেষের দিকে তাকাল, অনিমেষের মুখ মাটির দিকে।

প্রিয়তোষ বললেন, আশীবার্দ প্রত্যাখ্যান করলে অপমান করা হয়।

শেষপর্যন্ত মাধবীলতা মাথা নাড়ল, আপনি এসেছেন এই আমার সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ পাওয়া।

প্রিয়তোষ ধীরে ধীরে হাত নামিয়ে আংটিটাকে পকেটে ফেলে দিলেন। তারপর অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বললেন, যাওয়ার আগে জানাস।

মাধবীলতা অর্ককে ইশারা করল এগিয়ে দিতে।

অন্ধকার গলিতে পা ফেলতে প্রিয়তোষের অসুবিধে হচ্ছিল। একটা চাপা ঘেমো গন্ধ যেন বাতাসে ভাসছে। অর্ক বলল, আপনি আমার হাত ধরুন।

প্রিয়তোষ মাথা নাড়লেন, ঠিক আছে, তুমি সামনে হাঁটো।

ঈশ্বরপুকুর লেনে অবশ্য অন্ধকার নেই। রাস্তার আলোর তলায় এখন জোর তাসের আড্ডা বসে গেছে। প্রিয়তোষের ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে রাখায় ওপারে যেতে হবে। অর্ক গাড়ি অবধি পেছন পেছন এল। দরজা খুলে প্রিয়তোষ বললেন, কাল ঠিক সময়ে চলে এসো আমি অপেক্ষা করব।

ঠিক তখনই একটা চিৎকার ভেসে এল, আরে অক্ক, মাল খেয়ে আমাদের ঢপ দিয়ে ফুটে গেলি, এখন দেখি কোন খানকির বাচ্চা তোকে বাঁচায়!

চকিতে পিছু ফিরে তাকিয়ে অর্ক দেখল কোয়া ফুটপাথে টলছে। দুটো পা কখনই স্থির থাকছে না। আচমকা মুখে রক্ত জমল। সে আড়চোখে দেখল প্রিয়তোষ বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। খুব লজ্জা লাগছিল অর্কর। এবং এই প্রথম ওইসব খিস্তি শুনে তার লজ্জাবোধ হল। প্রিয়তোষ জিজ্ঞাসা করলেন, ছেলেটি কে?

এখানে থাকে। অর্কর মনে হচ্ছিল প্রিয়তোষ যত তাড়াতাড়ি চলে যান তত ভাল।

তোমার বন্ধু? প্রিয়তোষ আড়চোখে ওকে দেখলেন।

মাথা নাড়ল অর্ক, না।

তাহলে ওই ভাষায় ওকে কথা বলতে দিচ্ছ কেন?

ওরা ওইরকম কথাই বলে

ততক্ষণে কোয়া এগিয়ে এসেছে কাছে। জড়ানো গলায় সে চিৎকার করল, চলে আয় বে! মাল না পেলে আমি আজ ছাড়ছি না।

হঠাৎ অর্কের মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। সে কয়েক পা এগিয়ে প্রচণ্ড জোরে কোয়ার গালে চড় মারল। মাটিতে পড়ে গিয়েও কোয়া সমানে খিস্তি করে যাচ্ছিল। দৃশ্যটা দেখে ফুটপাথে লোক দাঁড়িয়ে পড়েছে। অর্ক কোয়াকে উপেক্ষা করে বলল, আপনি যান।

প্রিয়তোষের মুখে হাসি ফুটল, খুশি হলাম। কাল দেখা হবে।

গাড়িটা ট্রাম রাস্তার দিকে চলে যাওয়ার পর অর্ক কোয়াকে কলার ধরে টেনে দাঁড় করাল, কি বলছিস বল!

টলতে টলতে কোয়া বলল, তুমি আমাকে মারলে গুরু! আমার গায়ে হাত তুললে?

বেশ করেছি।

না গুরু। এর বদলা হবে। আমার গায়ে হাত তুলে কেউ-কেউ! জড়িয়ে গেল গলা। অর্ক বলল, বাড়ি যা।

আগে বদলা চাই।

ঠিক আছে বাড়ি যা।

গুরু তুমি কথা দাও বদলা নেবে।

ঠিক আছে, বাড়ি যা।

এবার কোয়া অর্ককে জড়িয়ে ধরল, সব শালা হারামি, শুধু তুই ছাড়া। কথাটা শুনে হেসে উঠল দর্শকরা। অর্ক কোয়াকে নিয়ে গলির মধ্যে ঢুকল। কিন্তু গলিতে পা দেওয়ামাত্র জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিল কোয়া। সে কিছুতেই আর এগোবে না। অনেক বোঝানোর পর অর্ক ওকে ছেড়ে দিয়ে পা বাড়াল। কোয়া আবার টলতে টলতে গলি ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

ঘরে ঢুকে অর্ক দেখল মা চেয়ারে বসে বাবার সঙ্গে কথা বলছে। অর্ককে দেখামাত্র ওদের কথা থেমে গেল। অনিমেষ আচমকা প্রশ্ন করল, হ্যাঁ রে, সেই ভদ্রলোক কেমন আছেন এখন?

কোন ভদ্রলোক? অর্ক বুঝতে পারল না।

যাঁর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল, লেকটাউন না কোথায় থাকেন বলেছিলি।

ভাল। কথাটা বললেও অর্ক খুব দুর্বল হয়ে পড়ল। সে জানে না বিলাস সোম এখনও বেঁচে আছে কি না। একবার খোঁজ নেওয়া খুব দরকার ছিল। আর তখনই তার হারখানার কথা মনে পড়ল। যে করেই হোক সেই মেয়েটার কাছ থেকে হারখানা উদ্ধার করতেই হবে।

মাধবীলতা বলল, তোর ছোটদাদু কি বলে গেলেন শুনেছিস?

কি ব্যাপারে?

জলপাইগুড়িতে যাওয়ার ব্যাপারে। আমি ভাবছি সেই ভাল, তুই আগে জলপাইগুড়িতে চলে যা, আমরা পরে এদিকটা সামলে যাব।

কেন?

ওখানে আরও ভাল থাকতে পারবি।

দূর! ওখানে তোমাকেই কেউ চেনে না আমাকে চিনবে কেন?

মাধবীলতা এতক্ষণ তরল গলায় কথা বলছিল। এই বাক্যটি শোনামাত্র সে শক্ত হল। অর্ক তো ঠিকই বলছে। তার পরিচয় কি? অনিমেষের স্ত্রী? অথচ ওই বাড়ির লোক তাকে এত বছরে চোখেই দ্যাখেনি। অনিমেষ নিজে তার পরিচয় না করিয়ে দিলে কেউ স্বীকার করতেই চাইবে না। এত করেও সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে, পিতা স্বামী এবং সন্তান ছাড়া মেয়েদের আলাদা কোন ভূমিকা নেই, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব। সমস্ত শরীরে অসহ্য জ্বলুনি কিন্তু কিছু করার নেই। সে অনিমেষের দিকে তাকাল। ভাবখানা এমন, হায়, তোমরা এদেশে বিপ্লব আনতে গিয়েছিলে অথচ তোমাদের ঘরগুলো সব অন্ধ সংস্কারে ঠাসা এই খেয়াল কি কখনও করেছ!

কথাটা অনিমেষের কানেও কট করে বেজেছিল। হঠাৎ ওর চোখের ওপর একটা ছবি ভেসে উঠল। জ্যাঠামশাই যেদিন জেঠিমাকে নিয়ে নিঃসম্বল অবস্থায় জলপাইগুড়ির বাড়িতে এসেছিল চোরের মতন সেদিন ওরা কেউ জেঠিমাকে চিনতো না। কৌতূহল ছিল কিন্তু সেই সঙ্গে অবজ্ঞামেশানো দূরত্ব কম ছিল না। আজ মাধবীলতাকে নিয়ে এত বছর পরে জলপাইগুড়ির বাড়িতে ফিরলে সবাই কি ওকে মেনে নিতে পারবে? নতুন যে তাকে গ্রহণ করার জন্যে একটা মন সবসময় উগ্রীব থাকে কিন্তু দীর্ঘসময় যে জুড়ে বসেছে তাকে মানতে অনেক অসুবিধে।

মাধবীলতা বলল, না। তবু তোমাকে যেতে হবে। এখানে থাকলে আমি তোমাকে মানুষ করতে পারব না। আজ কিছুক্ষণের জন্যে এসেও ওই মানুষটা তোমার স্বরূপ বুঝে গেছেন। এতদিন কেউ আমাদের ওখানে যেতে বলেনি কিন্তু এখন উনি যখন বলছেন তখন আর বাধা কি! কথাটা শেষ করে সে অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি বল?

অনিমেষ গম্ভীর মুখে বলল, দেখি! কথাটা শোনামাত্র মাধবীলতার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি চলকে উঠল। আর তখন অর্ক বলল, লোকটা অ্যাদ্দিন আসেনি কেন?

অনিমেষ মুখ তুলল, লোকটা নয়, উনি আমার কাকা। এতদিন বিদেশে ছিলেন। বয়স্ক লোকের সম্পর্কে যখন কথা বলবে তখন সমীহ করে বলতে শেখ।

অর্ক খোঁচা খেয়ে হজম করল, উনি ছিলেন না কিন্তু আর যাঁরা ছিলেন তাঁরাও তো খবর নিতে পারতেন। এখন ডাকলেই যেতে হবে?

মাধবীলতা বলল, তোমাকে এই নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। আমি দেখতে চাই তুমি নিজেকে শুধরে নিয়েছ।

আর তখনই দপ করে আলো জ্বলে উঠল। পুরো বস্তিটায় একটা চাপা উল্লাস উঠল। মাধবীলতা বলল, যাও, হাতমুখ ধুয়ে এসো। কদিন তো একেবারে বই-এর সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। খেয়ে দেয়ে আমি যতক্ষণ খাতা দেখব ততক্ষণ তুমি পড়বে।

অর্ক মাথা নাড়ল, আমার ঘুম পাচ্ছে।

মাধবীলতা বলল, কোন কথা শুনতে চাই না। সারাদিন টো টো করার সময় খেয়াল থাকে না? মনে করো না চেহারায় বড় হয়ে গিয়েছ বলে সাপের পাঁচ পা দেখেছ। যাও।

অর্ক উঠল। তারপর দরজার দিকে যেতে যেতে চাপা গলায় বলল,তুমি মাইরি মাঝে মাঝে ঠিক মাস্টারনি হয়ে যাও।

অর্ক বেরিয়ে যাওয়ামাত্র অনিমেষ হাসিতে ভেঙ্গে পড়ল। বালিস বুকে চেপে সশব্দে হেসে উঠল সে। মাধবীলতা গম্ভীর গলায় বলল, চমৎকার! তারপর সামান্য হাসল, আর কত কি শুনব! তুমি তখন এমনি করে হেসো।

আজ রবিবার। ভোরবেলা থেকে যেন একটা ঝড়ের মধ্যে কাটাল অর্ক। ছুটির দিনেও মায়ের সাতসকালে ওঠা চাই। কলঘরের কাজ সেরে চা বানিয়ে তাকে ডেকে তুলেছে। তারপর বাধ্য করেছে বই নিয়ে বসতে। ছোটবেলা থেকে চিৎকার না করে পড়ার অভ্যেস হয়েছে অর্কর। মা বলে ওটা নাকি ফাঁকিবাজি। সে পড়ছে কিনা তা আর কেউ টের পাবে না। পড়তে পড়তে অর্কর মনে। হচ্ছিল ওগুলো পড়ার কোন মানে হয় না। কবে কে কখন যুদ্ধ করেছিল, কে কি রকম ভাল শাসক ছিল তা এখন তার জেনে কি লাভ! ওসব যাদের দরকার তারা পড়ুক। পড়তে পড়তে ওর নজর। ছিল ঘরের কোণে রাখা খালি দুধের কৌটোর দিকে। ওর মধ্যে কাল রাত্রে এক ফাঁকে টাকাগুলো লুকিয়ে রেখেছে। বইপত্তর গোটালো অর্ক।

মাধবীলতার খাতা দেখা হয়ে গিয়েছিল। উনুনে এখন সুজি ফুটছে। ছেলেকে উঠতে দেখে বলল, কি হল?

আর পড়তে ইচ্ছে করছে না।

কেন? এটুকু পড়লে হবে?

হবে।

মাধবীলতা চকিতে ছেলের দিকে তাকাল, মুখে মুখে তর্ক করছিস?

তর্ক করছি না তো। আমার এখন পড়তে ভাল লাগছে না। অর্ক বইপত্র টেবিলে রেখে দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই দেখল অনু এদিকে আসছে। তাদের ঘরে এই বস্তির কেউ খুব প্রয়োজন ছাড়া আসে না। সে একটু অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল, কি চাই? অনু বোধ হয় অর্ককে ঘরে আশা করেনি। একটু থতমত হয়ে বলল, না, কিছু না। তারপর ফিরে যাওয়ার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল।

তুমি কিছু বলবে?

থাক, পরে আসব।

ভেতর থেকে মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কে রে?

অর্ক উত্তর দিল, অনু। কিছু বলতে এসে ফিরে যাচ্ছে।

মাধবীলতা এবার দরজায় চলে এল, তুই ভেতরে যা।

অর্ক ঘরে ঢুকে গেলে অনু এগিয়ে এল মাধবীলতার কাছে। মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার?

একটু ইতস্তত করে অনু বলল, বউদি, একটা উপকার করবেন?

কি?

আপনাদের স্কুলে লোক নিচ্ছে?

আমাদের স্কুলে? মাধবীলতা অবাক হল, টিচার?

না। অফিসের কাজ করবার লোক।

জানি না, কেন বল তো?

আমার চেনাশোনা একজন দরখাস্ত করেছে, তাই।

মাধবীলতা বলল, দ্যাখো, আমি প্রথমত জানি না কোন ক্লারিকাল স্টাফ নেবে কিনা! আর নিলেও ও-ব্যাপারে আমার কোন হাত নেই।

অনু মাথা নাড়ল, কিন্তু আপনাদের স্কুল যখন তখন সবার সঙ্গে আপনার নিশ্চয়ই চেনাজানা আছে। একটু চেষ্টা করলে হয়তো কাজটা হয়ে যাবে।

মাধবীলতা দেখল অনুর মুখে আকুতি স্পষ্ট। সে জিজ্ঞাসা করল, কে দরখাস্ত করেছে?

অনু এবার ঢোক গিলল, আমার পরিচিত একজন।

তোমার বাবা চেনেন তাকে?

নিঃশব্দে মাথা নাড়ল অনু, না।

মাধবীলতা মনে মনে হাসল, হায় রে! সেই এক ভুল, মেয়েগুলো এমনি করেই মরে! তারপরেই সে নিজেকে সংশোধন করার চেষ্টা করল, এভাবে না মরেও যে মেয়েদের কোন উপায় নেই।

তোমাদের আত্মীয় নয় যখন তখন এত চিন্তা করছ কেন?

এবার অনু তাকাল তারপরেই মুখ নামিয়ে নিয়ে বলল, ওর একটা কাজ না হলে আমার কোনদিন বিয়ে হবে না বউদি।

মাধবীলতা এবার যেন ছোট্ট ধাক্কা খেল। এই মেয়েটিকে সে অনেকদিন থেকে দেখছে। নেহাত অশিক্ষিত নির্বোধ এবং শরীরে বেড়ে ওঠা মেয়ে বলেই মনে হত। ও যে জীবনের চরম সত্য এত নগ্নভাবে জেনে গেছে তা ভাবতে পারেনি মাধবীলতা। তার বলতে ইচ্ছে করছিল, চাকরি হয়ে যাওয়ার পর সেই ছেলে ওকে বিয়ে নাও করতে পারে। কিন্তু ওর মনে সন্দেহের কাঁটাটা ঢুকিয়ে দিয়ে কি লাভ! সে হাসল, ঠিক আছে, তুমি একটা কাগজে ছেলেটির নাম ঠিকানা লিখে দিয়ে যেও। আমি কথা দিতে পারছি না তবে যাঁরা চাকরি দেবেন তাঁদের অনুরোধ করব। অনুপমার চলে যাওয়া পর্যন্ত মাধবীলতা ওর দিকে তাকিয়ে ছিল; হঠাৎ শুনল, সরো।

ও দেখল অর্ক সেজেগুজে বের হচ্ছে। বিরক্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাচ্ছিস?

হাসপাতালে।

এত ঘন ঘন হাসপাতালে যাওয়ার কি দরকার?

বাঃ, লোকটা বেঁচে আছে কিনা দেখব না?

মাধবীলতা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল অনিমেষ সেই একই ভঙ্গীতে মুখের ওপর পথের পাঁচালি রেখে শুয়ে আছে। সে গম্ভীর গলায় বলল, সুজি খেয়ে যা।

খাওয়ার মোটেই ইচ্ছে ছিল না অর্কর। খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মাকে এড়ানোর জন্যে ও গরম সুজিতে হাত দিল। অনিমেষের জন্যে প্লেটে ঢালতে ঢালতে মাধবীলতা বলল, তুই দাঁড়া, আমি তোর সঙ্গে যাব। অর্কর গলায় যেন আচমকা সুজি আটকে যাচ্ছিল, কোন রকমে বলল, তুমি যাবে মানে?

বাঃ, তোর মা হিসেবে আমারও তো দেখতে যাওয়া উচিত।

দূর! ওরা খুব বড়লোক, ওখানে তুমি গিয়ে কি করবে?

বড়লোক তো কি হয়েছে? তুই রোজ যাচ্ছিস কেন?

অর্ক দেখল, এইভাবে কথা বললে সে মায়ের সঙ্গে পেরে উঠবে না। তাই কথা চাপা দেবার জন্যে বলল, বেশ, আমি গিয়ে দেখে আসি কেঁসে গেল কিনা তারপর তুমি যেও।

মাধবীলতাকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চটপট ডিশ নামিয়ে অর্ক বেরিয়ে এল বাইরে। ওর হঠাৎ খেয়াল হল, সকাল থেকে বাবার গলা শোনা যায়নি। কাল রাত্রে বুড়োটা আসার পর থেকেই যেন বাবার হঠাৎ পরিবর্তন হয়ে গেছে।

ট্রামরাস্তায় চলে এসে চারপাশে তাকাল অর্ক। না, ঝুমকি এখনও আসেনি। ওর বাড়িতে খোঁজ নিয়ে এলে ভাল হত। ঘড়ি-হাতে একটা লোককে সময় জিজ্ঞাসা করে অর্ক সমস্যায় পড়ল। পনের মিনিট দেরি হয়ে গিয়েছে। ঝুমকি কি ঠিক সময়ে এসে চলে গেছে? তার জন্যে অপেক্ষা করেনি? অর্ক কি করবে বুঝতে পারছিল না এমন সময় ন্যাড়াকে দেখতে পেল। মাতৃদায়ের কোন চিহ্ন নেই। শরীরে। তবে গা খালি। সিগারেটের দোকানের সামনে মাটিতে পোঁতা বেঞ্চিতে বসে বিড়ি খাচ্ছে লুকিয়ে। সে চিৎকার করল, এই ন্যাড়া?

ন্যাড়া চকিতে বিড়িটাকে হাতের আড়ালে সরিয়ে মাথা নাড়ল, কি?

কয়েক পা এগিয়ে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ঝুমকিকে দেখেছিস? আবার মাথা নাড়ল ন্যাড়া। তারপর ধোঁয়া ছেড়ে বলল, একটু আগে চার নম্বর ট্রামে উঠেছে। চার নম্বর। তার মানে চিৎপুরেই গেছে। ঠিকানাটা মনে করার চেষ্টা করল অর্ক। পনের মিনিট অপেক্ষা করতে পারল না, আচ্ছা হারামি! ডান দিকে তাকাল সে, একটাও ট্রাম নেই। ট্রাম ছাড়া চিৎপুরে যাওয়া অসম্ভব। অস্বস্তিতে খানিকটা এগোতেই টালা পার্কের দিক থেকে আসা একটা। ট্যাক্সি থেকে কেউ যেন চেঁচিয়ে কিছু বলল। অর্ক দেখল ট্যাক্সিটা একটু এগিয়ে থেমে গেছে। এর পেছনের জানলায় সুরুচি সোমের মুখ, হাত নেড়ে ডাকছেন।

দৌড়ে এল অর্ক এবং এসেই ওর বুক ধক করে উঠল। না এলেই পারত। সুরুচি বললেন, কি ব্যাপার, তোমার কোন খবর নেই কেন?

এমনি।

বাঃ, বেশ ছেলে যা হোক। এদিকে ও তো তোমার জন্যে হেদিয়ে মরচে। দুবেলা জিজ্ঞাসা করছে তুমি এসেছ কিনা!

আতঙ্কিত গলায় অর্ক জানতে চাইল, উনি কেমন আছেন?

ভাল। মনে হচ্ছে আজ বিকেলে ছেড়ে দেবে। উঠে এসো

মাথা নাড়ল অর্ক, না। খুব জরুরী কাজে যাচ্ছি। বিকেলে যাব।

ঠিক যাবে তো? একদিনের আলাপে বিলাস দেখছি তোমাকে খুব পছন্দ করেছে। আমি ওকে বলব তুমি আসছ।

ট্যাক্সিটা চলে গেলে অর্ক অবশ হয়ে গেল। বিকেলে তার পার্ক হোটেলে যাওয়ার কথা, মনে ছিল না। কিন্তু লোকটা সুস্থ হয়ে গিয়েছে। আর কোন উপায় নেই, যেমন করেই হোক হারখানা ফেরত চাই। অন্যমনস্ক অর্ক হঠাৎ দেখল একটা চার নম্বর ট্রাম সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। দুস মরিয়া হয়ে হ্যাণ্ডেল ধরার জন্যে সে ছুটল।

১৪. গলির ভেতরটায় তেমন মানুষজন নেই

গলির ভেতরটায় তেমন মানুষজন নেই। দুধারে বেশ পুরোনো ধরনের বাড়ি। কেমন ঘুম ঘুম ভাব। নম্বর মিলিয়ে হাঁটতে গিয়ে অসুবিধেয় পড়ল অর্ক। তিন-এর পরেই আঠাশের এক। কয়েকজন বয়স্ক লোক এক জায়গায় গুলতানি করছিল। অর্ক তাদের সামনে গিয়ে নম্বরটা জিজ্ঞাসা করল।

বাঁক ঘুরেই ডানহাতি লাল বাড়ি। ওদের মধ্যে যে সবচেয়ে বুড়ো সে কথাটা বলল। অর্ক পা বাড়াতেই আবার প্রশ্ন হল, কার ঘরে যাবে?

অর্ক ভাবল উত্তর দেবে না। তারপরেই মত পাল্টালো। বেপাড়ায় ঢুকে কোনরকম রোয়াবি দেখানো উচিত হবে না। কিন্তু কোন মেয়ের নাম বলা কি ঠিক হবে? অথচ উপায়ও তো নেই। সে নরম গলায় বলল, ওখানে মিস টি বলে একজন আছে, তাকে খবর দিতে হবে।

কি খবর?

চটপট মিথ্যে কথা বলল সে, ফাংশনের। ঝুমকি বলেছিল মিস টি এখন চারধারে নেচে বেড়ায়।

ফাংশন? বুড়ো মুখ বিকৃত করল, এই শালা এক কায়দা হয়েছে। পাড়ার মেয়েরাও এইভাবে বেহাত হয়ে যাবে, তোরা দেখিস!

কি করবে বল, দিনকাল এখন অন্যরকম! আর একজন আফসোসে মাথা নাড়ল।

তাই বলে এরকম চললে আমাদের পেটে হাত দিয়ে বসতে হবে।

অর্ক তখনও দাঁড়িয়ে আছে দেখে দ্বিতীয় লোকটি বলল, তুমি যাও ভাই, ফাংশন করো। শেষ কথাটা এমন একটা টিপ্পনি ছিল অন্যান্যরা হেসে উঠল।

বাঁক নিতেই লাল বাড়িটা চোখে পড়ল। একটা বুড়ি ঝাঁটা আর বালতি হাতে সদর দরজায় দাঁড়িয়ে কারো মুণ্ডপাত করছে। দোতলা বাড়িটা খুব পুরোনো বলে মনে হচ্ছে না। অর্ক ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে যেতেই বুড়ি মুখ থামিয়ে হাঁ করে তার দিকে তাকাল, ওমা, এটা আবার কে রে? কি চাই?

অর্ক নম্বরটা যাচাই করতে চাইল। বুড়ির গলা আবার গৰ্গনে হল, লম্বরে কি দরকার! গোটা সোনাগাছি জানে এটা বীণাপাণির বাড়ি। এই সাতসকালে কি ধান্দায় এয়েচ বল তো ছোঁড়া?

একজনের সঙ্গে আমার দরকার আছে। অর্ক বিরক্ত হল বুড়ির চিৎকারে।

আরে বাবা এখানে কেউ দরকার ছাড়া আসে? মন্দির শ্মশান সোনাগাছি, প্রয়োজনে হাজির আছি। ঘুরে এসো নদের চাঁদ। দিন ফুরোলে সন্ধ্যে হলে গায়ে গতরে বা একটু বাড়লে। এই এচোড় বয়সে ভর সকালে কে তোমাকে নাড় খাওয়াবে গোপাল? ঝেটিয়ে ফুটুনি বের করে দেব, যা ভাগ। আচমকা গলা সপ্তমে উঠল বুড়ির।

অর্ক গম্ভীর গলায় বলল, আপনি এইভাবে কথা বলছেন কেন?

কি ভাবে? কথা বলাও তোর কাছে শিখব নাকি! যখন যৈবন ছিল তখন কত বড়বড় বাবু এসে কান পেতে থাকতো দুটো মধু শুনবে বলে।

এইসময় আর একটি গলা শোনা গেল, ও মাসী, ধমকাচ্ছো কাকে?

এই দ্যাখোদিকিনি! গোঁফ উঠেছে কি ওঠেনি এখনই তা দেবার শখ। এগারটার সময় প্রয়োজন মেটাতে এসেছে, আর সময় পেল না। এটা হাসপাতাল নাকি? গেলেই ওষুধ লাগিয়ে দেবে। বুড়ি সদরে জল ঢেলে দিয়ে দ্রুত হাতে ঝটা চালাতে লাগল। জলের ছিটে লাগছে দেখে লাফিয়ে সরে দাঁড়াল অর্ক। তখনই সে মধ্যবয়সিনীকে দেখতে পেল। মোটাসোটা, গোল মুখ, চোখ এখনও ফুলো, মাথার চুল পিঠময় ছড়ানো। ঠোঁটে পানের শুকনো দাগ,কথা বলার সময় লালচে দাঁত দেখা গেল, কি চাই?

এই কি মিস্ টি? অর্ক মনে মনে মাথা নাড়ল। দূর! ওই শরীরে নাচ হয়? মিসদের যে সব ছবি বিজ্ঞাপনে সে দেখেছে এ তার ধারে কাছে যায় না। কিন্তু বুড়ির চেয়ে মহিলা অনেক ভদ্র। সে বুড়িকে এড়িয়ে কাছে এসে বলল, উনি আমাকে মিছিমিছি আজে বাজে কথা বলছেন। আমি।

চট করে ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে ইঙ্গিত করল মহিলা, তারপর ইশারায় ভেতরে ঢুকতে বলল। বুড়ির গলা তখন চিরে যাচ্ছে, ছ্যা ছ্যা, এত পয়সার লোভ, ভর সকালে ঘরে তুললি? এক কাপ চা খেতে চাইলে ঘুরিয়ে নাক দেখাস। আজ আমি কোন কথা শুনছি না। দুটো টাকা না দিলে কুরুক্ষেত্র করব।

একতলার ভেতরে বাঁধানো উঠোন। তার ধার ঘেঁষা বারান্দা দিয়ে মহিলার পেছন পেছন পা ফেলতেই অবাক হয়ে গেল সে। বিভিন্ন বয়সের মেয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁত মাজছে কাপড় কাঁচছে উঠোনের কলে। অর্ককে দেখতে পেয়েই একজন কি টিপ্পনি কাটতেই সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ল। একটি কালো মেয়ে বেসুরো গলায় চিৎকার করল, আ গিয়া মেরে লাল, কর দিয়া কামাল।

এসব যে তার উদ্দেশ্যেই বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। হঠাৎ কেমন অসহায় বোধ করতে লাগল অর্ক। এটা যে খারাপ মেয়েদের বাড়ি তাতে আর সন্দেহ নেই। খান্না সিনেমার সামনে দাঁড়ানো মেয়েদের সে দেখেছে। এই বাড়িতে মিস টি থাকে এবং ঝুমকি তার কাছে এসেছে, কি আশ্চর্য! একটা বাচ্চা মা মা বলে কাঁদতে কাঁদতে আর একজনের আঁচল ধরল। তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে অর্ক প্রবল নাড়া খেল। খুরকিরা প্রায়ই বলে, খানকির বাচ্চা! ওই উদোম বাচ্চাটিকে দেখে সে কথা কি বলা যায়?

ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে মহিলা বলল, এসো। তারপর ঘরে ঢুকে মেঝেয় পাতা বিছানা গুটিয়ে নিতে লাগল। অর্ক দেখল, এক চিলতে ঘরের দেওয়ালে শিব ঠাকুরের ছবি। বিছানা বাদ দিলে পা ফেলার যেটুকু জায়গা তাতেই কুঁজো আর হাঁড়ি কুঁড়ি তূপ করে রাখা। চ্যাপ্টা বালিস ফোলাতে ফোলাতে মহিলা বলল, দাঁড়িয়ে রইলে কেন, বসো ভাই। নইলে এক্ষুনি ফ্যান চলে যাবে।

অর্ক দেখল দেওয়ালের কোণে একটা ছোট্ট ফ্যান আটকানো। শব্দ করে তার ব্লেড ঘুরছে। মহিলা বলল, কি গো, ঘর পছন্দ হচ্ছে না?

অর্ক পেছন ফিরে মেয়েগুলোকে দেখল। তারা আর এদিকে নজর দিচ্ছে না। সে বলল, আমি অন্য একজনকে খুঁজছিলাম।

অন্য একজন? সঙ্গে সঙ্গে মহিলার মুখ কালো, কেন আমি কি ফ্যালনা?

এখানে মিস টি বলে কেউ আছেন?

ও! তুমি তাহলে আমার এখানে বসবে না? ওই মাগীর কাছে এসেছ? মুরোদ আছে ওর কাছে ঘেঁষার? হিসহিসিয়ে উঠল মহিলা

আপনি এসব কি বলছেন? প্রায় আর্তনাদ করে উঠল অর্ক!,

ন্যাকা! পাঁচজনে দেখল তুমি আমার ঘরে এসেছ। এখন চলে গেলে ইজ্জত থাকবে? উঠে দাঁড়াল মহিলা।

আপনি বিশ্বাস করুন আমার অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। আমি খুব প্রয়োজনে এখানে এসেছি। মিনতি করল অর্ক।

ওসব বাজে কথা রাখ। আমার বউনি হয়নি এখনও। এখন তোমাকে ছেড়ে দিলে দিনটাই নষ্ট হয়ে যাবে। প্রয়োজন! বুড়ি ঠিকই বলেছিল।

অর্ক কি বলবে বুঝতে পারছিল না। শেষতক বলে বসল, মিস টি-এর সঙ্গে কথা না বললে আমার জেল হয়ে যেতে পারে!

জেল! শব্দটা শোনামাত্র মুখের চেহারা পাল্টে গেল মহিলার। বড় বড় চোখে অর্কর দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, এর মধ্যে পুলিশের ব্যাপার আছে নাকি?

নীরবে মাথা নাড়ল অর্ক, হ্যাঁ।

একটু বিব্রত হল মহিলা। তারপর হাত বাড়িয়ে বলল, দশটা টাকা দাও।

কেন? ভীষণ অবাক হল অর্ক।

ঘরে না বসলে দিতে হবে। কঠিন মুখে জানাল মহিলা।

অর্ক বুঝল এর হাত থেকে কোনমতে পরিত্রাণ নেই। সে পকেটে হাত ঢুকিয়ে সন্তর্পণে টাকার গোছা থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে প্রসারিত হাতে ফেলে দিল। তৎক্ষণাৎ পেছনে জলতরঙ্গ বেজে উঠল প্রথমে, তারপর দু’তিনটে সিটি এবং উদ্ভট চিৎকার। মেয়েরা হাততালি দিচ্ছে।

মহিলা টাকাটায় চুমু খেয়ে বলল, ওই সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে ডান দিকের ফেলাট। বলে টাকাটাকে পাখার মত করে হাওয়া খেতে লাগল। একজন চেঁচিয়ে উঠল, শোভাদি, বেশ টুপি পরালে সাত সকালে!

চোখ ঘুরিয়ে দোতলা দেখিয়ে শোভা বলল, দুধ দুইতে এলে তো ভাই একটু আধটু চাঁট সইতেই হবে।

মেয়েটি বলল, ওমা! মেমসাহেবের ঘরে নাকি?

তাই তো বলছে।

একটু আগে আর একজন ওপরে উঠল। হবু মেমসাহেব!

অর্ক ততক্ষণে সিঁড়িতে পা রেখেছে। কিন্তু শেষ সংলাপ তার কান এড়ায়নি। যে উঠেছে তাকে এরা পছন্দ করছে না। সে কি ঝুমকি? হবু মেমসাহেব, হাসি পেল অর্কর। তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেনে ঝুমকিকে কেউ মেমসাহেব বলে চিন্তাও করতে পারবে না। ধর্মতলায় না গেলে সে নিজেও বিশ্বাস করত না। দোতলায় উঠেই ডান দিকে একটা কোলাপসিবল গেট। ভিতরে তালা ঝুলছে। তার পেছনে কাঠের বন্ধ দরজা। বাঁ দিকের বারান্দা খালি। অর্ক দেখল কোলাপসিবল গেটের ফাঁকে কলিং বেলের বোতাম, টিপতেই যেন বাজ ডাকল। দরজার গায়ে সুন্দর অক্ষরে লেখা মিস টি।

তিরিশ সেকেণ্ড পরে কাঠের কপাট খুলল। একটি আধবুড়ো লোক মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি চাই?

মিস টি আছে? দ্রুত মাথা নাড়ল লোকটা, না, নেই।

যাচ্চলে! ঝুমকি বলেছিল ফাংশনে গিয়েছে কিন্তু সকালেই ফিরে আসার কথা। লোকটা এবার দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছে দেখে সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আচ্ছা, ঝুমকি, মানে মিস ডি এসেছে? আমি একটা ফাংশনের জন্যে এসেছি।

এবার বুড়োর মুখ নরম হল। কাঠের দরজাটাকে আধভেজিয়ে ভেতরে চলে গেল লোকটা। ব্যাপার-স্যাপার দেখে অর্কর মনে হচ্ছিল নিচে যাদের দেখে এল তাদের সঙ্গে এই ঘরের বাসিন্দাদের প্রচুর পার্থক্য আছে। এত পাহারা, সতর্কতা!

দরজায় এসেই চমকে উঠল ঝুমকি, তুমি!

সঙ্গে সঙ্গে মুখচোখে ক্রোধ ফুটে উঠেছিল অর্কর, কিন্তু পেছনে বুড়োটাকে দেখতে পেয়ে সামলে নিল, দেরি হয়ে গিয়েছিল।

তৃষ্ণাদি এখনও ফেরেনি। ঝুমকি যে তাকে কাটাতে চাইছে তা স্পষ্ট।

জানি। আমি অপেক্ষা করব।

ঝুমকি খুব অস্বস্তিতে পেছন ফিরে বুড়োর দিকে তাকাল। তারপর সামনে মুখ ফিরিয়ে বলল, কোন সুবিধে হবে না।

সেটা আমি বুঝব। যা কথা ছিল তাই কর।

অগত্যা নিতান্ত উপায় নেই বলেই যেন ঝুমকি বুড়োকে বলল, খুলে দাও, তৃষ্ণাদির সঙ্গে দেখা করে যাবে।

বুড়ো লোকটার বোধহয় অর্ককে ঢুকতে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু ঝুমকি দ্বিতীয়বার ইশারা করায় বাধ্য হল তালা খুলতে। কাঠের দরজা পেরিয়ে একটা ভারী পদা দেওয়াল থেকে ও দেয়ালে চলে গেছে। তার ফাঁক দিয়ে ঝুমকির পেছন পেছন অর্ক যে ঘরে এল সেখানে সূর্যের আলো ঢোকে না। নীলচে দুটি বাল্ব দু কোণে জ্বলছে। পায়ের তলায় বেশ পুরু কার্পেট, এক কোণে ছয় জন বসতে পারে এমন সোফা। ঘরের অনেকটাই খালি।

ঝুমকি ইঙ্গিত করতেই অর্ক সোফায় আরাম করে বসল। এই ফ্ল্যাটের মালিক বেশ মালদার বোঝা যাচ্ছে। ভেতরে আর একটা ঘর রয়েছে যে ঘরে সূর্যের আলো ঢোকে। বুড়োটা ভেতরে চলে গিয়েছে। ঝুমকি দাঁড়িয়েছিল বেশ জড়সড় হয়ে। অর্ক বলল, তুমি আমাকে কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলে নইলে দশ মিনিট অপেক্ষা করতে পারতে।

ঝুমকি বলল, না, তুমি ঠিক সময়ে আসনি। তাছাড়া আমি চাইনি তুমি এখানে আসো।

কেন? তুমি আসতে পারো, আমার বেলায় কি দোষ।

জায়গাটা খারাপ।

তুমি এসেছ কেন?

আমি তো খারাপ, পাড়ায় ভাল হয়ে থাকি।

অর্ক এবার আড়ষ্ট হল। ওর জানাশোনা কেউ নিজেকে কখনও খারাপ বলেনি। হাত উল্টে সে বলল, জেনেশুনে খারাপ হওয়ার কি দরকার?

হাসল ঝুমকি, নইলে শুধু হাওয়া খেয়ে বাঁচতে হয়। আর কদিন যাক, এই তৃষ্ণাদির মত নাম হয়ে গেলে কোন চিন্তা থাকবে না। তুমি এই জায়গার কথা পাড়ায় গিয়ে কাউকে বলো না।

অর্ক হাসল, যদি বলে দিই?

ঝুমকি বলল, জানি না কি হবে। হয়তো তখন আর কাউকেই কেয়ার করব না।

অর্ক খুঁটিয়ে দেখল ঝুমকিকে। আর পাঁচটা মেয়ের সঙ্গে ওর কোন তফাত নেই। এই বাড়ির নিচের তলায় যারা রয়েছে তাদের দিকে তাকালেই মনের মধ্যে কিরকম যেন হয়। কেমন নির্লজ্জ বেলেল্লাপনা ওদের হাবভাবে। ঝুমকি তার ধারে কাছেও যায় না। কিন্তু তবু ঝুমকি বলছে ও খারাপ। কথাটা মনে আসতেই সে সরাসরি জিজ্ঞাসা করল, খারাপ মানে কি?

হাসল ঝুমকি, তুমি দেখতেই বড়, বয়স হয়নি। তারপর গম্ভীর মুখে জানাল,আমি পয়সা নিয়ে ব্যাটাছেলেদের শরীর দিই।

রোজ?

না। সপ্তাহে দুদিন। নাচ শেখা হয়ে গেলে এই ছ্যাঁচড়ামিটা ছেড়ে দেব।

তখন কি করবে?

কেন নাচব! হোটেলে, থিয়েটার হলে, বিজ্ঞাপন দ্যাখোনি? ওতে এখন খুব ভাল পয়সা।

শরীর দেবে না?

ভাল দাম পেলে অন্য কথা তৃষ্ণাদি প্রাইভেট নাচের জন্যে হাজার টাকা নেয়। হোটেলে নাচলে মাসে দুহাজার মাইনে। কেউ যদি রাত কাটাতে চায় তৃষ্ণাদির সঙ্গে তাকে বেশ মাল ছাড়তে হয়। তৃষ্ণাদি আমায় শেখাচ্ছে।

হবু মেমসাহেব। কথা মনে পড়ায় এখন উগরে দিল অর্ক, নাম হলে তুমি আর আমাদের পাড়ায় নিশ্চয়ই থাকবে না। তা তোমার তৃষ্ণাদির তো অনেক পয়সা, এই খানকিপাড়ায় থাকে কেন?

সে তুমি বুঝবে না।

বোঝালেই বুঝব।

অন্য পাড়ায় বড় বাড়ি পাওয়ার খুব ঝামেলা। তাছাড়া নাচগান হলে পাড়ার লোক পিছনে লাগে। পুলিশ এসে হিস্যা চায়। এখানে সব ধরাবাঁধা ব্যাপার। মাঝে মাঝেই নিচতলায় পুলিশ আসে রেড করতে কিন্তু ওপর তলায় ওঠে না। তৃষ্ণাদির এখানে বাজে খদ্দের কক্ষনো ঢুকবে না। যারা আসে তারা খুব নামী-দামী লোক। এপাড়ায় থাকলে, কাউকে পরোয়া না করলেই চলে। শুধু পুলিশ আর পাড়ার গুণ্ডাকে টাকা দিলেই হল।

কথা বলতে বলতে কানখাড়া করেছিল ঝুমকি শেষ করে পাশের ঘরে ছুটে গেল। এখন অর্ক ঘরে একা। নীলচে আলোয় সে ঘরখানার দিকে তাকাল। তারপর উঠে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। সোফার পেছনে একটা দেওয়াল আলমারি। নানান রকম জিনিস রয়েছে সেখানে। সব শখের ব্যাপার। হঠাৎ ওর চোখ আটকে গেল ছয় ইঞ্চি লম্বা একটি ধাতব বস্তুর ওপর। ওটা কি? সন্তর্পণে কাঁচ সরিয়ে জিনিসটাকে বের করে আনল সে। ইস্পাতের ওপর মসৃণ হাড় বসানো হাতল। দুপাশে দুটো বোতাম। একটা টিপতেই সরু ফলা বেরিয়ে এল ইঞ্চি পাঁচেক। মুখটা সামান্য বাঁকানো কিন্তু প্রচণ্ড ধার। বোতাম টিপতেই ওটা লুকিয়ে গেল হাতলের আড়ালে। অন্য বোতামটা টিপতেই ডট পেনের মুখ বেরিয়ে এল, ডটার সমেত।

এইসময় পায়ের শব্দ পাওয়া মাত্র অর্ক জিনিসটাকে পকেটে ঢুকিয়ে দিল। দারুণ জিনিস পাওয়া গেল। এইরকম একটা মালের সন্ধানে ছিল সে এতদিন, এটা সঙ্গে রাখলে মনের জোর অনেক বেড়ে যাবে।

ভেতরের দরজায় তখন ঝুমকি দাঁড়িয়ে আছে। বোধহয় অর্ককে দেখে ওর মনে কিছু সন্দেহ জেগেছিল, চোখাচোখি হতেই বলল, তৃষ্ণাদি এসেছে।

চট করে সোফায় গিয়ে বসল অর্ক। না জিনিসটা পকেটের ভেতর কোন অসুবিধে করল না। ঝুমকির চোখে তখনও সন্দেহ লেগে ছিল, তুমি কি করছিলে?

কিছু না।

শোন, তোমার পায়ে পড়ি, তৃষ্ণাদির সঙ্গে কোনরকম ঝামেলায় যেও না। ফাংশন করে এলে তৃষ্ণাদির মাথা খুব গরম থাকে।

মাল কামালে তো মানুষের মাথা ঠাণ্ডা হওয়া উচিত।

আর তখনই সেই বাজ ডাকার শব্দ হল। বুড়ো লোকটা ছুটে এল ভেতর থেকে। ঝুমকি ওর পিছু নিল। গলা পেল অর্ক, ঘুমুচ্ছিলে? গণ্ডা গণ্ডা টাকা দিচ্ছি কি মুখ দেখতে? ট্যাক্সি এলে মাল নামাতে যেতে পারো না। এই যে, তুমি যখন উদয় হয়েছ তখন কি করছিলে?এত করে বলেছি নিচের তলায় সব ডাইনিরা নখ বের করে আছে তবু তোদের হুঁশ হয় না।

কথা শেষ হওয়ামাত্র যিনি ঝড়ের মত পদা সরিয়ে ভেতরে ঢুকলেন তাকে দেখে চমকে গেল অর্ক। হাতির দাঁতের মত গায়ের রঙ, মাঝারি উচ্চতায় ছিপছিপে শরীরে আটকে আছে জিনসের প্যান্ট আর ঢিলে ফুলশার্ট। হাঁটতে হাঁটতে উঁচু হিল জুতো ছুঁড়ে ফেলল ঘরের দু দিকে, মাথার টানটান চুল পাছার ওপর নাচছে এবং অর্ক অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ পেল আচমকা। অর্ক যে ঘরে বসে আছে সে খেয়াল নেই, সটান ঢুকে গেল পাশের ঘরে। যেটুকু দেখা গেল তাতেই অর্কর মনে হল মেমসাহেব একেই বলে। নিচের মেয়েগুলো কিংবা ঝুমকির সঙ্গে এর আকাশপাতাল তফাত। বরং বিলাস সোমের মেয়ে যদি—। না। মাথা নাড়ল অর্ক। বিলাস সোমের মেয়ের মধ্যেও এই ঝিলিক নেই। ঝিলিক শব্দটা ভাবতে পেরে নিজেরই মজা লাগছিল। বুড়ো লোকটা ততক্ষণে। জুতোজোড়া কুড়িয়ে নিয়ে ভেতরে ছুটেছে। ঝুমকি ভারী পায়ে ভেতরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। তারপরেই সংলাপ শুরু হল।

কখন এসেছিস?

একটু আগে।

হঠাৎ?

এমনি।

না। এমনি আসার মেয়ে তুমি নও। কাল তো অত টাকা নিয়ে গেলি আজ আবার কি দরকার? আমি তোকে বলেছি একা একা এখানে আসবি না। পেছন পেছন মাতালগুলো ছুটবে। এই বেশ্যাপাড়ায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। ও হ্যাঁ, এসেছিস ভাল করেছিস। পরশু রাত্রে বজবজে একটা ফাংশন আছে। আর একজনকে নিয়ে যেতে হবে। তুই যাবি?

যাব।

কাল দুপুরে বাদল আসবে, মিউজিক-এর সঙ্গে রিহার্সাল দিবি।

আচ্ছা।

দুশো টাকা কম দিয়েছে। হারামির ঝাড় সব। নাচ শুরু করতে না করতেই হামলে পড়ে। শরীরটার আর কিছু বাকি নেই। পুতুলের মত দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

তৃষ্ণাদি!

কি হল? ন্যাকামি করবি না! আমার মেজাজ গরম আছে।

একজন তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে!

কে কোথায়?

বাইরের ঘরে। আমার পাড়ার ছেলে।

ছেলে। পাড়ার ছেলেকে এখানে এনেছিস? আমার সঙ্গে তার কি দরকার?

ওই হার–।

কি হার?

যেটা কাল তোমাকে দিয়েছি।

তার জন্যে তো টাকা দিয়েছি। আমি নেই আর ছোঁড়া এনে তুলেছিস। কোথায় গেল বুড়ো, পই পই করে বলেছি আমি না থাকলে দরজা খুলবে না। উফ! আর তারপরেই অসম্ভব উত্তেজিত একটি মূর্তি ঝুমকিকে সরিয়ে দিয়ে এই ঘরে ঢুকল। এতক্ষণ তৃষ্ণা পালের কথার ঝাঁঝ পাচ্ছিল অর্ক এখন পুরো শরীরটাকেই তার ধারালো বলে মনে হল। ইতিমধ্যে প্যান্ট শার্ট দূর হয়ে হাত কাটা ঢোলা সেমিজের মত ম্যাক্সি অঙ্গ ঢেকেছে। হাঁটুর সামান্য নিচেই তার শেষ। দুটো সুডৌল হাত আর নিটোল পা শঙ্খিনীর মত শরীর কাঁপাচ্ছে। তীক্ষ্ণ চোখে অর্ককে দেখে তৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করল, কি চাই?

অর্ক প্রথমে ভেবেছিল উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করবে। কিন্তু প্রশ্ন করার ধরন দেখে মত পাল্টালো। সোফায় হেলান দিয়েই বলল, হার।

তুমি কে?

ঝুমকির পাড়ায় থাকি।

কি নাম?

অর্ক।

অর্ক? এরকম নাম কখনও শুনিনি। এই হার তোমার?

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল অর্ক।

কিন্তু এটা আমি কিনে নিয়েছি। বুকের ওপর থেকে আঙ্গুলের ডগায় লকেটটা তুলে নিল তৃষ্ণা, একবার কিনে নিলে আর তো ফেরত দিই না।

ওটা ঝুমকি বন্ধক রেখেছে, টাকাটা ফেরত দিচ্ছি।

না। আমি বন্ধকের কারবার করি না। যা নিই একেবারেই নিয়ে নিই। কিন্তু এই হার তুমি পেলে কোথায়? লকেটটাকে ঠোঁটে চেপে তৃষ্ণা হাঁসের মত এগিয়ে এল সামনে। তারপর উল্টোদিকের সোফায় পা তুলে শরীরের ভর রেখে দাঁড়াল। হঠাৎ অর্কর কান লাল হয়ে গেল। এরকম বিশাল, বাঁধ উপচে পড়া বুক সে কখনও দ্যাখেনি। সোফার ওপরে পা তোলা থাকায় সেদিকেও তাকানো যাচ্ছে না। তৃষ্ণা মুখ ফিরিয়ে ঝুমকিকে বলল, তুই ভেতরে যা। আমি ডাকলে তবে আসবি। ঝুমকি আড়ালে চলে যেতে আবার প্রশ্নটা শুনতে পেল অর্ক, তুমি এই হার কোথায় পেয়েছ?

অর্ক বুঝতে পারছিল সে একটা ফাঁদের দিকে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। একটু মরিয়া হয়েই বলল, পেয়েছি। এখন আমার হার। ওটা ফেরত দিন।

মিথ্যে কথা। তুমি এই হার চুরি করেছ।

মুখ সামলে কথা বলবেন। আমি চোর নই। ফুঁসে উঠল অর্ক।

চুপ করো। এখানে মাস্তানি দ্যাখাতে এস না। আমি ইচ্ছে করলে–! যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব দাও।

আমি কারো চাকর নই। উঠে দাঁড়াল অর্ক, বেশী বাতেলা না করে মালটা খুলে দিন। তারপর পকেট থেকে ঝুমকির দেওয়া টাকাগুলো বের করে ছুঁড়ে দিল টেবিলের ওপর।

চোখ ছোট করে ওকে দেখল তৃষ্ণা, তুমি খুব ছোট। নইলে এতক্ষণে কথা বন্ধ করে দিতাম। আমি তুড়ি বাজালে এই গলির গুণ্ডারা কুকুরের মত ছুটে আসে। এই হার তুমি চুরি করোনি?

না।

কোথায় পেয়েছ?

বলব না।

এই হার তোমার?

হ্যাঁ।

কি লেখা আছে এর লকেটের ভেতরে?

এইবার হোঁচট খেল অর্ক। অ্যাকসিডেন্টের পর কখনও ভাল করে হারখানা সে দেখার সুযোগ পায়নি। ভেতরে কি লেখা আছে তা ওর জানা সম্ভব নয়।

যা ইচ্ছে লেখা থাকতে পারে, তার মানে এই নয় যে আমি চুরি করেছি!

তৃষ্ণা হাসল। তারপর ধমকের গলায় ডাকল, এদিকে এসো!

অর্ক বিরক্ত চোখে তাকাল

এদিকে আসতে বলছি।

এবার আর অপেক্ষা করতে পারল না অর্ক। ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে দাঁড়াল। যত কাছে যাচ্ছিল সেই মিষ্টি গন্ধটা তত বাড়ছিল। গলা তুলে তৃষ্ণা বলল, লকেটটা দ্যাখো, এই হারখানা?

মুখ নামিয়ে তাকাতেই নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম। হলদে মাখনের দুই গোল বলের ভাঁজে যে হার এবং তার লকেট সেটা চিনতে ভুল হল না। কোনরকমে মাথা নাড়ল সে, হ্যাঁ।

তৃষ্ণা মাথাটা পেছনে হেলিয়ে লকেটটায় চাপ দিতেই ওটা খুলে গেল। সিরসিরে গলা কানে এল, বুকের দিকে তাকাতে হবে না, লকেটে কি লেখা আছে?

অর্ক পড়ল, তৃষ্ণা পাল। পড়ামাত্র বোবা হয়ে গেল অর্ক। মিস টি-এর গলায় যে হার সেটা যদি বিলাস সোমের হার হয় তাহলে ওর লকেটে কি করে তৃষ্ণা পাল লেখা থাকবে। সঙ্গে সঙ্গে সন্দেহটা এল; নামটা হার পাওয়ার পরে লেখানো হয়নি তো? মালটা নিজের করে নেওয়ার এটা কায়দাও হতে পারে। সে ঠোঁট কামড়ালো, এটা তো আপনি কাল রাত্রেও লেখাতে পারেন।

তাই? যেন মজা পেয়েছে কথা শুনে এমন ভঙ্গী তৃষ্ণার।

হার দিন, আমি চলে যাব।

মাথা নাড়ল তৃষ্ণা, চলে যাবে মানে? তোমাকে আমি পুলিশে দেব। খপ করে হাত ধরল তৃষ্ণা, তারপর ঠেলে অর্ককে বলল, বসো এখানে চুপ করে।

ক্রমশ একটা ভয় অর্ককে আচ্ছন্ন করে ফেলল। সে চাপা গলায় বলল, আপনি আমায় বিপদে ফেলবেন না, এই হার বিলাসবাবুর।

বিলাস! বিলাসকে তুমি চেন?

একদিন আলাপ হয়েছিল। উনি জানেন হারখানা আমার কাছে আছে। পকেট থেকে পড়ে যাওয়ায় ঝুমকি কুড়িয়ে আপনার কাছে বন্ধক রেখেছে।

তৃষ্ণা ওর মুখের দিকে তাকাল কিছুক্ষণ। তারপর চেঁচিয়ে ডাকল, ঝুমকি! পেছনের দরজায় ঝুমকি আসতেই তৃষ্ণা বলল, ওঘর থেকে তো সব গিলছিস, এ যা বলছে সত্যি?

হা। ঝুমকি উত্তর দিল।

যা।

ঝুমকি চলে যাওয়ার পর তৃষ্ণা ওর চোখে চোখ রাখল, বিলাস তোমাকে কেন হার দিতে যাবে?

আর তখনই অর্ক প্রবল নাড়া খেলো। সেদিন রাত্রে মাল খেয়ে গাড়িতে বিলাস সোম যার নাম বলেছিল সেও তো তৃষ্ণা। এই বাড়ি থেকে বেশী দূরে ওঁর গাড়ি খারাপ হয়নি। যা শুনে মিসেস সোম ফুঁসে উঠেছিলেন স্ট্রীট গার্ল বলে। বিলাস সোমের সম্বন্ধে একটা খারাপ ইঙ্গিত ফুটে উঠেছিল ওঁর গলায়। এবং হাঁ, মনে পড়ছে, হাসপাতালে শুয়েও এই হারখানার ব্যাপার বিলাস চেপে যেতে চেয়েছিলেন ওঁর স্ত্রীর কাছে। অর্কর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, আপনিই তৃষ্ণা?

আমি তৃষ্ণা মানে?

বিলাসবাবু সেদিন আপনার কথা বলেছিলেন।

কবে?

দিনটা বলল অর্ক। তারপর জুড়ে দিল, ওঁর স্ত্রী আপনার ওপর খুব চটা!

সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটল মুখের। তৃষ্ণা দ্রুত তার পাশে এসে বসল, তুমি বিলাসের বউকে চেন?

মাথা নাড়ল অর্ক, হাঁ। তৃষ্ণা এখন ওর গা ঘেঁষে বসে। হারটা বুকের ওপর নেতিয়ে, আচ্ছা, ওর বউকে কি রকম দেখতে?

ভাল। বড়লোকের বউরা যেমন দেখতে হয়।

আঃ। আমার চেয়েও ভাল কিনা তাই বল!

অর্ক আর একবার দেখল তৃষ্ণাকে। কিন্তু সে নিজেও ঠিক ঠাওর করতে পারল না কে বেশী সুন্দরী। কিন্তু যে সামনে বসে আছে তাকে বেশী সম্মান দেওয়াই ভাল, উনি একটু মোটা, আপনার মত ফিগার….

ওকে থামিয়ে দিল তৃষ্ণা, ঠিক আছে। বিলাস তোমাকে কেন হার দিয়েছিল সেটা বলো।

আমাকে না দিয়ে ওঁর কোন উপায় ছিল না।

বউ-এর ভয়ে? কাওয়ার্ড। দোকান থেকে ডেলিভারি নিয়ে আমাকে দিতে এসেছিল সেদিন। অথচ ঘরভর্তি লোক তখন। বসে বসে নেশা করে হারখানা নিয়ে চলে গেল। কত সাধলাম দিল না। বলল, যেদিন তোমাকে একা পাবো সেদিনই পরিয়ে দেব। আর বাইরে বেরিয়েই তোমাকে দিয়ে দিল? আসুক এবার। বউকে এত ভয়!

অর্ক তাকাল। তারপর মৃদুস্বরে বলল, আপনি আমার একটা উপকার করবেন?

কি?… তৃষ্ণা তখনও ফুঁসছিল।

একটা কাগজে লিখে দেবেন ওঁকে যে হারখানা পেয়েছেন।

ঠোঁটে হাসি ফুটল তৃষ্ণার, বেশ। ঠিক জবাব হবে। তারপর উঠে দেওয়াল আলমারি থেকে কাগজ নিয়ে ক’লাইন লিখে অর্ককে দিয়ে দিল। অর্ক পড়ল, তুমি না দিলেও আমার জিনিস ভগবান পাইয়ে দিয়েছেন। হারখানা সত্যি সুন্দর। তুমি না খুলে নিলে খুলব না। তৃষ্ণা।

চিঠিটা পড়ার পর অর্ক অনেক চেষ্টা করে নিজেকে সামলালো। না, অ্যাকসিডেন্টের খবরটা সে দিতে পারবে না। তাছাড়া উনি যখন ভাল হয়ে উঠেছেন তখন আর দিয়েই বা লাভ কি! তার হাত ধরে তৃষ্ণা বলল, তুমি রাগ করো না ভাই, আমি তো জানতাম না তাই তোমাকে আঘাত দিয়েছি। বড় মাথা গরম আমার!

১৫. অর্ক যেন অনেক কিছু জেনে ফেলল

এই ক’দিনে অর্ক যেন অনেক কিছু জেনে ফেলল। রকের আড্ডায় অথবা স্কুলের বন্ধুদের মুখে। এসব ব্যাপারে অনেক গল্প শুনলেও সেগুলো ছিল ভাসা ভাসা। নিজের চোখে দেখার পর মনে। হচ্ছিল ওর বয়স এখন অনেক বেশী।

আজ তৃষ্ণা পালের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিডন স্ট্রীটের মোড়ে এসে একটা পানের দোকানের আয়নায় নিজেকে দেখল। যতই শরীরটা বড় দেখাক মুখের মধ্যে তার ছাপ একটুও পড়েনি। অথচ ও এখন যাদের সঙ্গে মেশে তারা কত না বড় বড় ব্যাপার স্যাপার করে থাকে। তৃষ্ণা পালের লেখা চিঠিটা বের করে আর একবার পড়ল সে। মেয়েটা নিশ্চয়ই কষ্ট পায়। নাহলে এইসব কি করে লিখল। বিলাস সোম ওর কাছে আসে কেন? অত বড় ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষিত মানুষ, সুন্দরী মেয়ে বউ থাকতে এই খারাপ পাড়ায় হার দিতে আসার কি দরকার? সেই রাতে হার না দিয়ে চলে গিয়েছিল বিলাস, সেটাও কি কষ্ট পেয়ে? বিলাসের বউ এই মেয়েটার কথা অনুমান করে জ্বলে উঠেছিল, হাসপাতালে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করেছিল, স্বামীর দুর্ঘটনার কথা শুনে ট্যাক্সিতে আসবার সময় হেসেও ছিল! এসবই কি কোন কষ্ট থেকে? এসব নিয়ে একবার ভাবতে শুরু করে অর্ক দেখল সব কিছুর চেহারা পাল্টে যাচ্ছে। কোনদিন সে এভাবে চিন্তা করেনি। আজ যত ভাবছে তত যেন গিট খুলে গিয়েও জট পাকিয়ে যাচ্ছে। ঝুমকির চেহারা ভাল। বস্তিতে যখন থাকে তখন একটু আলাদা বলে চোখে পড়ে। সেই ঝুমকি পাড়ায় বলে আয়ার কাজ করে অথচ নাচ শিখতে যায় চৌরঙ্গী লেনে, শরীর বেচে, সোনাগাছিতে এসে তৃষ্ণা পালের কাছে তালিম নেয়। এসব কি ওকে দেখে কখনও কেউ অনুমান করতে পারবে? ও তো আয়ার কাজ করতে পারতো। কেন করেনি? তাহলে ওরও নিশ্চয়ই কোন কষ্ট আছে। কষ্টটা কি সেটা অর্ক এই মুহূর্তে ধরতে পারল না! খুরকি কিলা কিংবা বিলুর কোন কষ্ট নেই। যে কোন উপায়ে মাল যোগাড় করে বেশ মেজাজে থাকে। শুধু কোন বড় পার্টির সঙ্গে কিচাইন হলে অথবা পুলিসের ঝামেলা এলে ওরা খুব চিন্তায় পড়ে কিন্তু কষ্ট পায় না। হঠাৎ অর্কর মনে পড়ল, একদিন ট্রামরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে কিলা বলেছিল, দুনিয়ার সব হেমা মালিনী রেখাদের কারা পায় জানিস?

কারা! ধর্মেন্দ্র, অমিতাভ।

দূর বে। যারা অনেক পড়াশুনার পরে বড় বড় চাকরি করে, ব্যবসা করে তারা।

আমরা শালা ফেকলু, কেমন করে তাকায় দেখিস না? যেন থুতু ফেলছে। কথাটা যখন শুনেছিল তখন হাসি পেয়েছিল অর্কর। কিন্তু এখন, মনে পড়ার পর, মাথা নাড়ল সে।,কিলাদেরও কষ্ট আছে। খুব বড় না হতে পারার কষ্ট। লোকের কাছে উপেক্ষা পাওয়ার কষ্ট। তবে এটা বুঝতে পেরেই যেন বুঝতে দিতে চায় না ওরা। এর পরেই মা এবং বাবার মুখ মনে পড়তেই ও রাস্তার রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়াল। ওদের সব কষ্ট তো তার জন্যেই। ও যদি খুব পড়াশুনা করত, কিলাদের সঙ্গে না মিশত তাহলে মা বাবার কোন কষ্ট থাকতো না। কিন্তু পড়াশুনা করতে যে তার একদম ভাল লাগে না! পড়াশুনা করেও তো বিলাস সোমের মত কষ্ট দিতে হবে, পেতে হবে। তাছাড়া কিলাদের সঙ্গে মিশছে বলেই সে গুণ্ডা হচ্ছে না। কেউ রোয়াবি করলে দল থাকলে বদলা নেওয়া যায়। হয় দল নয় ক্ষমতা–এই দুটোর একটা থাকা চাই। মা-বাবার কষ্ট দূর করা যায় কি করে তাহলে? তখনই অর্কর মনে হল শুধু তার জন্যেই কি মা-বাবার কষ্ট? মা কেন। তাকে নিয়ে ছেলেবেলায় একা একা ছিল? কেন মাঝ রাত্রে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতে? তখন তো সে ছোট্ট, খুবই ছোট্ট? বাবা কেন জেলে গিয়ে শরীর নষ্ট করে এল? যে জন্যে বাবা জেলে গিয়েছিল সেটা সে শুনেছে। অনেক বড় বড় কথা বাবা বলেছে তাকে। এই দেশটাকে পাল্টে দিতে চেয়েছিল নকশালরা। বাবা তার জন্যে এখনও কষ্ট পায় এবং আজ অর্কর মনে হল এসব কাজ করে বাবা মাকে কষ্ট দিয়েছে। আর যে উদ্দেশ্যের জন্যে বাবা এই কষ্ট দিল তা হল না বলে নিজেও কষ্ট পাচ্ছে। তার মানে কোন মানুষই কষ্ট ছাড়া বেঁচে নেই। সে নিজে কি কষ্ট পায়? দূর শালা। অর্ক হাসল। তার আবার কষ্ট কিসের? না, ঠিক হল না। দুটো ভাল শার্ট এবং প্যান্টের জন্যে তার কষ্ট আছে। এটুকু ভাবতেই আরও অনেক চাহিদার কথা মনে এল তার। তার মানে এই যে, যা চাওয়া যায় তা না পেলেই কষ্ট হয়।

এতখানি ভাবতে পেরে সে নিজেই অবাক হয়ে গেল। সে কি বেশ বড় হয়ে গেল? নাহলে একটার পর একটা ভাবার নেশা কি করে এল! আচ্ছা, কোনরকমে বারো ক্লাশটা পাশ করলে কেমন হয়? তাতে যদি মা একটু শান্তি পায় তো পাক। দিনে দু ঘন্টা বই নিয়ে বসলে বারো ক্লাশ পাশ করা যাবে? চেষ্টা করলে মন্দ হয় না।

রেলিং ছেড়ে ট্রাম স্টপের দিকে এগোল অর্ক। বিলুকে কি বলবে সে সোনাগাছিতে এসেছিল?, তাহলেই পাঁচটা প্রশ্ন উঠবে। ওই অতগুলো মেয়েকে দেখে বিলুরা নিশ্চয়ই খুব রসিকতা করত। কিন্তু তার একটুও ভাল লাগেনি। ওদের বাড়িঘর নেই, মা বাবা নেই, শুধু শরীর বিক্রি করে ভাত-কাপড় কিনছে। কিন্তু কাউকেও তো দুঃখী বলে মনে হল না। মাথা নাড়ল অর্ক, কোন মানুষের দুঃখ কি বাইরে থেকে বোঝা যায়? একটু আগেই তো এসব নিয়ে সে ভেবেছে। কিন্তু, অর্কর মনে এক ধরনের সঙ্কোচ এল। কিন্তু, ওই মেয়েদের দেখে তার ভয় লাগছিল কেন? ভয়টা চাপা, এখন টের পাচ্ছে। এমনকি যে ঝুমকিকে বাইরে সে তড়পায় তাকে দেখেও ওইরকম একটা কিছু হচ্ছিল!

ট্রামের হ্যাণ্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে অভ্যেস মত সে কণ্ডাক্টরকে খুঁজল। একদম প্রথম দিকের আসনের সামনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটছে লোকটা। আধবুড়ো, টাক আছে। খুব খেকুরে হয় এই ধরনের লোক। ভাড়া না দিলে হেভি কিচাইন করবে। অবশ্য ওর দরজায় আসতে আসতে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া যাবে। নিশ্চিন্ত হতে গিয়ে নিজের মনেই হেসে ফেলল অর্ক। আজ তো সে স্বচ্ছন্দেই ভাড়া দিয়ে দিতে পারে। তৃষ্ণা পালের সামনে যে টাকা সে ছুঁড়ে দিয়েছিল সেটা বেরোবার আগে জোর করে তৃষ্ণা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। যদি ঝুমকিকে কিছুটা ভাগ দিতেও হয় তাহলে এমন কিছু কম থাকবে না। রোজ তো ট্রামবাসের টিকিট ফাঁকি দেয় আজ সে রাজার মত টিকিট কাটবে। চট করে গেট ছেড়ে ওপরে উঠে এল অর্ক। বেশ ভিড়। সামনের দিকে না গিয়ে পেছনের হ্যাণ্ডেল ধরে দাঁড়াল সে। এদিকটাও কমতি নেই। লেডিস সিটের সামনে যত শুড্যাগুলো আঠা হয়ে থাকে। আজ বিকেলে সেই পার্ক স্ট্রীট ছুটতে হবে। যদি মাকে বলে কাটানো যায় তত ভাল। হয়। বাবার ছোটকাকাকে তার মোটেই পছন্দ হয়নি। দেখা করলে নিশ্চয়ই জ্ঞান দেবে খুব। এদিকে বিলাস সোমের বউ বলে গেল আজ বিকেলে একবার হাসপাতালে যেতে। কিন্তু লোকটা তাকে খোঁজ করছিল কেন? সেদিন তো স্পষ্টই বলল, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে অর্ক যেন দেখা। করে। তাহলে এখন তাকে কি জন্যে দরকার। চুপচাপ কেটে পড়লে কেমন হয়! দূর! এখন আর বিলাস সোমকে সে ভয় করে না। তৃষ্ণার চিঠি পকেটে আছে, বিলাস নিশ্চয়ই আর ঝামেলা করতে চাইবে না।

এই সময় বি, কে, পাল অ্যাভিন ছাড়িয়ে গ্রে স্ত্রীটে পড়ল ট্রামটা। আর তখনই একটা অস্ফুট শব্দ কানে এল। খুব চাপা কিন্তু আচমকা। অর্ক লেডিস সিটের দিকে ঝুঁকে দেখল একটি মেয়ে সিট ছেড়ে দরজার দিকে এগোতে গিয়েও যেন পারছে না। শব্দটা ওরই গলা থেকে বেরিয়েছে কিনা বুঝতে পারল না অর্ক। কিন্তু এবার মেয়েটি বলল, সরে যান, নামব।

যান না। যে বলল তার বয়েস একুশ বাইশ। কথাটা বলে সে সামান্য দোলাল শরীর, যেন সরে যাচ্ছে এমন ভান করল কিন্তু সরল না। ওই জায়গাটায় বেশ ভিড়। সবাই রড ধরে ঊর্ধ্বনেত্র হয়ে রয়েছে। মেয়েটি সেই ভিড় বাঁচিয়ে কোন মতে বের হবার চেষ্টা করল। বেরুতে গেলে তাকে ওই ছেলেটির শরীর ঘেঁষে আসতে হচ্ছে। অর্ক দেখল, ছেলেটির বাঁ হাত সামান্য উঠে মানুষের শরীরের। আড়ালের সুযোগ নিয়ে মেয়েটির বুকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ তার মুখচোখের ভঙ্গীতে একটুও পরিবর্তন নেই। মেয়েটি সেটা অনুভব করে যেন পাথর হয়ে গেল। এর মধ্যে পেছন থেকে নামবার তাড়া আসছিল। অতএব না এগিয়ে কোন উপায় নেই, মেয়েটি প্রাণপণে নিজের শরীরটাকে ছোট করে নিয়ে পা ফেলতেই ছেলেটির হাত ছোবল মারল। এতটার জন্যে প্রস্তুত ছিল না অর্ক। মেয়েটিও দ্বিতীয়বার অস্ফুট শব্দ করে যখন মরিয়া হয়ে বেরিয়ে আসছে তখন বাঁ হাত বাড়িয়ে ছেলেটার শার্টের কলার চেপে ধরে ভিড় থেকে হিড় হিড় করে টেনে এনে অত্যন্ত উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞাসা করল অর্ক, কি করছেন?

একটুও না ঘাবড়ে ছেলেটা বলল, কি করছি মানে? কলার ধরেছেন কেন? ও ডান হাতে প্রচণ্ড জোরে ঘুষি মারতেই ছেলেটা চট করে মুখ সরিয়ে নিল। ইতিমধ্যে ট্রামটা দাঁড়িয়েছিল। মেয়েটি নেমে যেতে ছেলেটি অর্কর হাত ছাড়িয়ে নিচে লাফিয়ে পড়ল। ঘুষিটা ঠিক মারতে পারেনি বলে আফসোস হচ্ছিল অর্কর কিন্তু ওকে নামতে দেখেই ভেতরে একটা জিদ এসে গেল। ছেলেটা নিশ্চয়ই এখন ওই মেয়েকে জ্বালাবে। কথাটা মনে হওয়ামাত্র অর্ক দ্রুত ট্রাম থেকে নেমে পড়ল। ছেলেটা হয়তো আশা করেনি অর্ক ট্রাম থেকে নেমে আসবে, তাই দেখামাত্র বেশ উল্লসিত হল। চিৎকার করে কয়েকজনকে ডাকতে লাগল হাত পা নেড়ে। সম্পূর্ণ বোধশূন্য হয়ে অর্ক দৌড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ছেলেটার ওপর এবং প্রথম সুযোগেই ঘুষিটা চালালো মুখ লক্ষ্য করে। দরদরিয়ে রক্ত গড়িয়ে আসতেই দুহাতে ছেলেটার কাঁধ ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আর ট্রামে বাসে মেয়েদের বুকে হাত দিবি? বদমায়েস লোচ্চার, তোর বাড়িতে মা বোন নেই? ই সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে ভিড় জমে গেল। গ্রে স্ট্রীট চিৎপুরের এই সংযোগস্থলে সব সময়েই মানুষের জটলা। অনেকেই জিজ্ঞাসা করতে লাগল, কি হয়েছে, কি ব্যাপার? অর্ক ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়ে ব্যাপারটা বলতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। উল্টো পিঠের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে মেয়েটি ওদের দেখছে মুখে হাত চাপা দিয়ে। সে কাঁধ ঝাঁকাল, দূর, ওসব কথা বললে লোকগুলো মেয়েটার দিকে তাকাবে, কি দরকার! সে দেখল ট্রামটা আর ধারে কাছে নেই। ছেলেটা মাটি ছেড়ে উঠে দৌড়ে গেল একটা চায়ের দোকানের দিকে। এখন পেছনে কোন ট্রাম নেই। অর্ক ঘাড় ঘোরালো, না মেয়েটি চলে গিয়েছে। দু’ চারজন তখনও দাঁড়িয়ে ছিল, একজন জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে ভাই? অর্ক দেখল লোকটা বৃদ্ধ, ভাল মানুষ গোছের। নিতান্ত অনিচ্ছায় অর্ক বলল, মেয়েদের বেইজ্জত করছিল।

বেইজ্জত! আরে ব্বাপ। কোথায়?

ট্রামে।

ট্রাম শব্দটা শোনার পর লোকটার উত্তেজনা যেন কমে এল, ও ট্রামে! ট্রামে আবার কি হবে। তা করেছিলটা কি?

অর্ক ঝাঁঝিয়ে উঠল, বুঝতে পারেন না একটা মেয়েকে কিভাবে বেইজ্জত করা যায়?

দ্বিতীয়জন বলল, নিশ্চয়ই খিস্তিখাস্তা করছিল।

প্রথমজন বলল, তাহলে অমন করে মারা ঠিক হয়নি। নিশ্চয়ই গায়ে হাতটাত।

অর্ক বিরক্ত ভঙ্গীতে বলল, আপনারা ফুটুন তো।

সেই মুহূর্তে ওর চোখে পড়ল ছেলেটা ফিরে আসছে। একা নয়, সঙ্গে আরও চারজন আছে। অর্ক বুঝল ঝামেলা হবে। সে দেখল খুব দ্রুত ভিড় গলে যাচ্ছে। এখন পালানোর কোন মানে হয় না। পালালেই ওদের জোর বাড়বে। কিন্তু পাঁচজনের সঙ্গে একা কি করে লড়বে? অর্ক চট করে পকেটে হাত দিল। হ্যাঁ, একদম ভুলে গিয়েছিল, পকেটে সেই মাল রয়েছে। তৃষ্ণা পালের দেওয়াল আলমারি থেকে ঝাড়া ডট পেনের মত দেখতে অস্ত্র এখন ওকে বেশ শক্তি যোগাচ্ছিল।

ছেলেটা চিৎকার করল, ওই যে ওই শালা!

একদম সামনে চলে এলেও অর্ক এক চুল নড়ল না। এটা বোধহয় ওরা আশা করেনি। ছেলেটা চেঁচাল, আমার রক্তের বদলা নেব। দলের একজন জিজ্ঞাসা করল, এই, ওর গায়ে হাত তুলেছিস কেন?

অর্ক বুঝল উত্তর দিয়ে কোন লাভ নেই। তবু চোখের ইশারায় ছেলেটাকে দেখিয়ে বলল, ওকে জিজ্ঞাসা কর। মেয়েছেলের সম্মান না রাখতে জানলে ওরকম রক্ত বের হবে।

আহত ছেলেটা তেড়ে এল, এবং পলকেই অর্ক দেখল তাকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। আক্রান্ত হবার আগেই আক্রমণ করল সে। প্রচণ্ড জোরে লাথি মারল আহত ছেলেটির পেটে। কঁক করে একটা শব্দ বের হল, পেটে হাত চেপে বসে গেল সে। কিন্তু ততক্ষণে বাকি চারজন ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওর ওপর। বেধড়ক ঘুষি এবং লাথি পড়তে লাগল ওর শরীরে। আঘাতের চোটে ফুটপাথে গড়িয়ে পড়ল অর্ক। তখনই ওই অবস্থায় পকেট থেকে দ্রুত কলমটা বের করে চাপ দিতেই চকচকে ফলা বেরিয়ে এল। যারা উল্লসিত হয়ে মারছিল তারা আচমকা থেমে গেল। জিনিসটা কি না বুঝলেও ওটা যে ভয়ঙ্কর কিছু অনুমান করে দাঁড়িয়ে পড়ল চারজন।

টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল অর্ক। তার জামা ছিঁড়েছে, জিভে নোনা স্বাদ। সে ফ্যাসফেসে গলায় বলল, আয় শালারা আয়। তৎক্ষণাৎ চারটে ছেলেই উল্টোদিকে দৌড় দিল। কিন্তু প্রথমটি এখনও মাটিতে বসে। অর্ক ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে যেতেই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল ছেলেটা, আমি আর করব না, আর মেয়েদের গায়ে হাত দেব না। ওর একটা চোখ তখন অর্কর হাতের ওপর স্থির। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, তুই রোজ হাত দিস?

প্রথমে উত্তর দিল না ছেলেটা। কিন্তু অর্ক সামান্য ঝুঁকতেই সে দ্রুত মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। অর্ক অবাক হয়ে গেল। এর জামা-কাপড় এবং মুখের মধ্যে বেশ ভদ্র ভদ্র ছাপ আছে। তখনও পেটে হাত চেপে ছিল ছেলেটা, কেমন একটা ঘেন্না হল অর্কর। এই প্রথম কোন মানুষের দিকে তাকিয়ে ওর এই রকম অনুভূতি হল। তারপরেই খেয়াল হল কলমের ফলা ততক্ষণে অনেকের নজরে পড়ে গেছে। চট করে বোতাম টিপে সেটাকে গুটিয়ে ফেলে পকেটে রেখে জামার হাতায় মুখ মুছল অর্ক। হাতটা লালচে লালচে দেখাচ্ছে। মুখ ধুতে পারলে বেশ ভাল হত। সে যখন রাস্তা পার হয়ে চায়ের দোকানের দিকে যাচ্ছে তখনই চোখ পড়ল। মোটাসোটা একজন ভদ্রমহিলা, সুন্দর চেহারার একজন ভদ্রলোক আর সেই মেয়েটা দ্রুত এগিয়ে আসছে। অর্ক কিছু বোঝার আগেই ভদ্রমহিলা ওর দুই হাত জড়িয়ে ধরল, তোমার কাছে আমি ঋণী হয়ে থাকলাম বাবা, তুমি আমার ইজ্জত বাঁচিয়েছ। বেঁচে থাক বাবা, তোমার মত ছেলে ঘরে ঘরে জন্মাক। কথাটা শুনেই আমি ছুটে আসছি। উনি মানা করছিলেন, গুণ্ডা বদমায়েসদের মারামারির মধ্যে তুমি যেও না। কিন্তু জানলা দিয়ে দেখলাম ওরা তোমাকে মারছে। আমার মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে তুমি মার খাচ্ছ এ আমি সহ্য করতে পারলাম না। দীর্ঘজীবী হও বাবা। এক নাগাড়ে গড় গড় করে বলে যাচ্ছিলেন মহিলা। অর্ক এত বিহ্বল হয়ে পড়েছিল যে কিছু বলার মত অবস্থায় ছিল না। এবং তখনি ওদের ঘিরে ভিড় জমে উঠল। ও ভদ্রলোক বললেন, আমি পুলিসে ফোন করেছি।

ভদ্রমহিলা বললেন, পুলিস ছাই করবে। কেউ যদি প্রতিবাদ না করে তাহলে তো এমন হবেই। সবাই বলে দিনকাল খারাপ কিন্তু তোমার মত ছেলে, আহা রক্ত পড়ছে, তুমি দাঁড়িয়ে দেখছ কি, ওকে একটা ডাক্তারখানায় নিয়ে যাও।

এই সময় হই হই শব্দ উঠল। যারা ভিড় করেছিল তারা চেঁচাচ্ছে, পেটে হাত দিয়ে পড়ে থাকা ছেলেটা এবার দৌড়ে পালাচ্ছে। ভদ্রলোক বললেন, যেতে দাও ওকে। তুমি চলো ওই ডাক্তারখানায়।

অর্কর খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। সে ঘাড় নাড়ল, না, দরকার নেই।

ভদ্রমহিলা প্রতিবাদ করলেন, এই অবস্থায় তোমাকে ছেড়ে দেওয়া যায় না। কোন কথা শুনতে চাই না, তুমি ডাক্তারখানায় চল। মোটাসোটা ফরসা পাকা চুলের মহিলার দিকে তাকিয়ে অর্ক আর না বলতে পারল না।

ডাক্তারখানা পর্যন্ত ভিড় সঙ্গে ছিল। ডাক্তারবাবু সামান্য ফাস্টএইড দিয়ে বললেন, তেমন কিছু হয়নি।

এদিকে ভদ্রমহিলা তখন অনর্গল তার প্রশংসা করে যাচ্ছেন। ভদ্রলোক এখন চুপচাপ। ভিড় সরে গেছে ফুটপাথ থেকে। অর্কর ক্রমশ অস্বস্তি বাড়ছিল। সে বলল, আমি যাই। তখনই প্রথম। মেয়েটি কথা বলল, রাস্তায় ওরা কিছু করবে না তো!

অর্ক মেয়েটিকে দেখল, না। যারা ভয় পায় তারা কিছু করে না।

ভদ্রমহিলা বললেন, তবু তোমার একা যাওয়া উচিত হচ্ছে না। কোথায় বাড়ি?

বেলগাছিয়ায়। আমার কিছু হবে না।

তার কি ঠিক আছে! তুমি বরং একটা ট্যাক্সি ডেকে ওকে পৌঁছে দিয়ে এস।

ভদ্রমহিলার এই প্রস্তাব যে ভদ্রলোকের পছন্দ হল না সেটা অর্ক বুঝতে পারল। সে দ্রুত প্রতিবাদ করল, এসবের কোন দরকার নেই, আমি একাই যেতে পারব।

ভদ্রমহিলা বললেন, বেশ তাহলে অন্তত কিছুক্ষণ আমাদের বাড়িতে জিরিয়ে যাও। ওহো, আমি তো তোমার নামই জিজ্ঞাসা করিনি। কি নাম তোমার?

অর্ক, অর্ক মিত্র।

বাঃ, কি সুন্দর নাম।

ভদ্রলোক বললেন, এখানে ভিড় বাড়ানো উচিত হচ্ছে না। বাড়িতে চল

ওঁরা অর্ককে কিছুতেই ছাড়লেন না। এখন ভরদুপুর। অর্ক বুঝতে পারছিল বেশী দেরি হলে বাড়িতে আর একটা ঝামেলা হবে। কিন্তু এই ভদ্রমহিলার এত প্রশংসা এবং আন্তরিক ব্যবহারকে এড়িয়ে যেতেও পারছিল না সে।

তিন চারটে বাড়ির পরই দোতলায় ওঁরা থাকেন। সুন্দর সাজানো ঘর। নিজের ছেঁড়া পোশাকের জন্যে বেডের সোফায় বসতে অস্বস্তি হচ্ছিল অর্কর। ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি পড়?

নিজের ক্লাসটা বলল অর্ক। এবং সেটা বলতে গিয়ে সে এই প্রথম লজ্জা পেল। এক বছর যদি নষ্ট না হত! ভদ্রমহিলা বললেন, এই হল আমার মেয়ে, ঊর্মিমালা তোমার ক্লাশেই পড়ে। বাগবাজার মাল্টিপারপাসে।

অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও অর্ক কিছু খেল না। ভদ্রমহিলা কথা আদায় করলেন যে সে আর একদিন আসবে। তার ঠিকানা লিখে নিলেন ভদ্রলোক। দরজা অবধি এগিয়ে দিলেন ওঁরা। ঊর্মিমালা নিচু গলায় বলল, সাবধানে যাবেন।

খালি ট্রামে জানলার ধারে বসেছিল অর্ক। হাতিবাগান ছাড়িয়ে ট্রামটা ছুটে যাচ্ছে। কপাল এবং গালে ব্যাণ্ডেজ লাগানো হয়েছে। সামান্য চিনচিন করছে জায়গাগুলো। এইভাবে একা কোনদিন মারামারি করেনি সে। এবং এই প্রথম মারামারি করলে যে মানুষের আদর ভালবাসা পাওয়া যায় তা সে জানল। কিলা কিংবা খুরকিদের কেউ পছন্দ করে না, ভয় পায়, ভালবাসে না। কিন্তু ভাল কাজের জন্যে মারামারি করলে এক ধরনের আনন্দ হয় তাই বা কি সে জানতো!

অর্ক ভাবছিল এই কয়দিনে দুটো পরিবারের সঙ্গে তার আলাপ হল। বিলাস সোমের পরিবারের চেয়ে ঊর্মিমালাদের বেশী ভাল লেগেছে তার। অনেক ঘরোয়া, অনেক কাছের। ও রকম বাড়িতে থাকলে সে বাবা এবং মা ওই রকম ব্যবহার এবং কথা বলতে পারত। এবং তারপর ঊর্মিমালার মুখটা চোখের ওপর উঠে এল যেন। অত মিষ্টি মুখের মেয়ে সে কখনও দ্যাখেনি। মাথায় অর্কর চেয়ে ইঞ্চি ছয়েক ছোট হবে কি হবে না, লম্বা বেণী মোটা হয়ে অনেকটা নেমে গেছে, ডিমের মত মুখ, ঘাড় লম্বা, ছিপছিপে শরীরের রঙ শ্যামলা। কিন্তু দুই সূর তলায় কি শান্ত টানা চোখ। তার চেনাশোনা কোন মেয়ের চেহারার সঙ্গে ঊর্মিমালার মিল নেই। না, ঠিক হল না, অর্ক ভেবে দেখল, মায়ের সঙ্গে যেন কোথাও ওর মিল আছে। কোথায়? নাক, চোখ, কপাল কিংবা চেহারায়? না মোটেই না। তাহলে তার এ রকমটা মনে হল কেন? তারপরেই হেসে ফেলল সে, মিলটা খুঁজে পেয়েছে। দুজনের তাকানোর ভঙ্গীটা এক। মা যখন খুব অবাক হয় তখন অমন ঘাড় বেঁকিয়ে তাকায়। তাছাড়া মায়ের দিকে তাকালে শরীর ছাড়িয়ে আর একটা চেহারা অনুভব করা যায়। কথাবার্তা, হাত-পা নাড়া, হাঁটাচলা মিলে মিশে সেই চেহারাটা গড়ে দেয়। অর্কর মনে হল ঊর্মিমালারও সেই চেহারাটা আছে। এ রকম অনুভূতি আর কাউকে দেখে তার হয়নি। এবং তখনই সেই সঙ্কোচটা ফিরে এল। আজ সকাল থেকে যত সে ভাবছে তত অনেক কিছু মাথার মধ্যে পরপর এসে যাচ্ছে। এভাবে এর আগে কখনও চিন্তা করেনি সে। আর সেটা করতে গিয়েই মনে হচ্ছে ঊর্মিমালার চেয়ে সে কোথাও যেন ছোট, কিছুতেই সমান সমানও হতে পারছে না।

আর জি কর ব্রিজে ট্রাম উঠতেই আশেপাশে একদম খালি হয়ে গেল। অর্ক পকেট থেকে কলম বের করল। কি নিরীহ চেহারা, কেউ দেখলেও বুঝতে পারবে না। এদিক দিয়ে স্বচ্ছন্দে লেখা যাবে। কিন্তু বোতামটা টিপলেই সাপের জিভের মত ছিটকে বেরিয়ে আসে ধারালো ফলা। আচ্ছা, ঊর্মিমালার মা যদি দেখতে পেতেন জিনিসটা তাহলে কি অত ভাল ভাল কথা বলতেন? ঊর্মিমালা নিশ্চয়ই বাবা-মাকে নিয়ে ছুটে আসতো না। নিজের অজান্তেই বুক থেকে বাতাস বেরিয়ে এল। ছেঁড়া জামাটাকে ম্যানেজ করতে চেষ্টা করল অকারণ।

এখন করকরে দুপুর। পাড়া তবু জমজমাট। ফুটপাথে ব্রিজের আড্ডা বসে গেছে। তিন নম্বরের যাবতীয় লোক ছুটির দিনে এই নেশায় ডুবে থাকে। কিলা কিংবা খুরকিদের চোখে পড়ল না। বিলুও ধারে কাছে নেই। অর্ক আর দাঁড়াল না। চুপচাপ গলির ভেতরে ঢুকে পড়ল সে। মোক্ষবুড়ি দ হয়ে উনুনকারখানার ছায়ায় বসে রয়েছে। অনুদের ঘরের দরজা বন্ধ। বাঁক নিতেই মাধবীলতার মুখোমুখি হয়ে গেল অর্ক। দরজায় চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল মাধবীলতা। আচমকা ছেলের ওপর চোখ পড়তেই কপালে ভাঁজ পড়ল। নিঃশব্দে দরজা পেরিয়ে ঢুকতেই মাধবীলতা ঘুরে দাঁড়াল, কোথায় গিয়েছিলি?

হাসপাতালে। মিথ্যে কথা মনে করে বলল অর্ক।

কি হয়েছে? মাধবীলতার গলা চাপা কিন্ত তীব্র।

কিছু না।

প্রচণ্ড জোরে একটা চড় পড়ল অর্কর গালে, কিছু না! গুণ্ডামি লোচ্চামি করে এসে আবার মিথ্যে কথা বলা হচ্ছে। ওঃ, ভগবান। দ্যাখো, তুমি ছেলের চেহারা দ্যাখো। জামাকাপড় ছিঁড়ে মুখে ব্যাণ্ডেজ লাগিয়ে এসে বলছেন কিছুই নাকি হয়নি। দু হাতে মুখ ঢেকে খাটের ওপর বসে পড়ল মাধবীলতা।

চেয়ারে বসে পথের পাঁচালি পড়ছিল বোধহয় অনিমেষ। অর্ক ঘরে ঢোকামাত্র সে বই ছেড়ে অপলক তাকিয়েছিল। মাধবীলতার কথা শেষ হওয়ামাত্র সে চোখ বন্ধ করল। আচমকা মার খেয়ে অর্ক প্রথমে খুব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তারপরেই সে নিজেকে সংযত করল, তুমি আমাকে মিছিমিছি মারলে!

মিছিমিছি! মাধবীলতা ফুঁসে উঠল। অর্ক মাকে এমন ভীষণ চেহারায় কখনও দ্যাখেনি, আমি মিছিমিছি বলছি? তোকে, তোকে খুন করতে পারলে আমার হয়তো শান্তি হতো। আঃ। এত করে বোঝালাম, এত অনুরোধ করলাম সব ভস্মে ঘি ঢালা হল! সেই তুই ওই লুম্পেনগুলোর সঙ্গে গিয়ে মারামারি করে এলি! ছিঃ

আমি ওদের সঙ্গে ছিলাম না।

ছিলি না? অর্ক, আমি আর মিথ্যে কথা শুনতে চাই না।

হঠাৎ অর্কর বুকের ভেতর হু হু করে উঠল। মায়ের এই কঠোর মুখ, ঘেন্না জড়ানো উচ্চারণ তাকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলছিল। এই ঘরের দুটো মানুষই তাকে যে এক ফোঁটা বিশ্বাস করে না এটা বুঝতে পারা মাত্রই সমস্ত এলোমেলো হয়ে গেল তার। ঠিক তখন অনিমেষ শান্ত গলায় বলল, ও কি বলতে চায় শোনা যাক।

কি বলবে? একগাদা মিথ্যে কথা শোনাবে। আমার আর মুক্তি নেই।

অর্ক শরীর থেকে জামাটা খুলে মাটিতে ফেলে দিল। তারপর আলনা থেকে একটা শার্ট টেনে নিয়ে বলল, তাহলে আমি চলে যাই!

কোথায় যাবি? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

আমাকে যখন তোমরা বিশ্বাস করতে পারছ না তখন।

ছেলের এই রকম গলার স্বর এর আগে শোনেনি মাধবীলতা। চট করে মুখ তুলে দেখল অর্ক দাঁতে ঠোঁট চেপে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

দাঁড়া। আদেশ অমান্য করার চেষ্টা করেও পারল না অর্ক। পেছন ফিরেই দাঁড়াল।

কোথায় যাচ্ছিস?

তা দিয়ে তোমাদের কি দরকার?

বেশ। কিন্তু মনে রাখিস। মাধবীলতাকে কথা শেষ করতে দিল না অনিমেষ, লতা, আমাকে বলতে দাও। তুই আমার প্রশ্নের উত্তর দিসনি!

কি প্রশ্ন? অর্কর শরীর কাঁপছিল।

কোথায় গিয়েছিলি, কি হয়েছিল?

আমি তো মিথ্যে কথা বলব।

মিথ্যেটাই বলে যা

অর্ক সামান্য দ্বিধা করল, আমি বিডন স্ট্রীটে গিয়েছিলাম একজনের সঙ্গে দেখা করতে।

বিডন স্ট্রীটে? ওখানে তোর কি দরকার? মাধবীলতা অবাক হল।

ওকে শেষ করতে দাও। অনিমেষ বলল।

ফেরার সময় দেখলাম ট্রামে লেডিস সিটের দিকে একটা ছেলে খুব খারাপ কাজ করছে। মেয়েটা নামছিল আর ছেলেটা ভিড়ের সুযোগে ওর গায়ে হাত দিচ্ছিল। তাই দেখে আমার মাথা গরম হয়ে গেল। আমি ছেলেটাকে টেনে এনে মারলাম। মেয়েটা নেমে যেতেই দেখি ছেলেটাও ওকে অনুসরণ করল। আমার ভয় হল হয়তো রাস্তায় নেমে ছেলেটা মেয়েটাকে বেইজ্জত করবে। আমি নামতেই ছেলেটা যা-তা কথা বলছিল। তখন আবার আমি তাকে মারতে সে দলবল নিয়ে আমাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওরা ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। কোন রকমে কথাগুলো শেষ করল অর্ক।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, মেয়েটার বয়স কত?

আমাদের বয়সী। ওর মা বাবা খবর পেয়ে আমার কাছে ছুটে এসেছিল।

অর্ক মায়ের দিকে তাকাল। মাধবীলতার মুখে বিস্ময়; তুই সত্যি কথা বলছিস?

অর্ক আর পারল না। দ্রুত এগিয়ে খাটে বসে থাকা মাধবীলতার পায়ের সামনে বসে কেঁদে ফেলল, তোমরা আমাকে এত অবিশ্বাস কর কেন?

তুই মেয়েটাকে বাঁচিয়েছিস? সত্যি! মাধবীলতার চোখ বন্ধ, গলার স্বর এখন অন্য রকম, শরীর স্থির।

হ্যাঁ, তুমি বিশ্বাস কর। ইচ্ছে হলে ওর মা বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে পার আমার সঙ্গে গিয়ে! আমি কি অন্যায় করেছি?

আর তখনি ভেঙ্গে পড়ল মাধবীলতা। দুহাতে ছেলেকে আঁকড়ে ধরল সে।

অর্কর মুখ চোখ মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, তুই ঠিক করেছিস। তুই ঠিক করেছিস। ওর দুই চোখ উপচে জল, মুখে তৃপ্তির ছবি।

১৬. খাওয়া দাওয়া শেষ করতেই

খাওয়া দাওয়া শেষ করতেই দুপুর গড়িয়ে গেল। শেষ পাতে দই দেখে একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল অর্ক। কাল রাত্রের নিয়ে আসা মিষ্টিও ছিল সঙ্গে। এসব সচরাচর তাদের বাড়িতে হয় না। পরিবেশন করার সময় মাধবীলতাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। রবিবারের মেনু ডিমের ঝোল, একটা তরকারি আর ভাত। দুটো ডিম নিয়ে এসে একটা পুরো অর্কর জন্যে বাকিটা দুজনে আধাআধি। এটা এখন নিয়মের মত। সে বাড়ি ফেরার আগেই করে রেখেছিল নিশ্চয়ই কিন্তু দই কখন এল? হয়তো যখন কল-পায়খানায় গিয়েছিল তখনই মা নিয়ে এসেছে। খেতে বসে অর্ক আড়চোখে মায়ের দিকে তাকিয়েছিল, মাকে আজ অন্যরকম লাগছে।

অনিমেষ আর অর্ক পাশাপাশি বসে, মাঝখানে খাবার, উল্টো দিকে মাধবীলতা। বাঁ হাতে হাঁড়ি থেকে এক হাতা ভাত তুলে ছেলের থালায় ঢেলে দিয়ে মাধবীলতা বলেছিল, অনেকদিন আমরা মাংস খাইনি, না? সামনের রবিবার আনিস তো খোকা!

অনিমেষ খেতে খেতে মুখ তুলে তাকিয়েছিল, তারপর হেসে বলেছিল, মাংসের দাম কত জানো? মাধবীলতা নিজের পাতে খাবার নিয়ে অন্যমনস্ক গলায় বলেছিল, কত আর হবে। একদিন তো খাবো!

অর্ক বলেছিল, রবিবার খুব লাইন পড়ে ঠাকুরের দোকানে।

মাধবীলতা এক গালে ভাত রেখে জবাব দিয়েছিল, খুব ভোরে উঠিস।

অর্কর হঠাৎ মনে হয়েছিল আজ ঘরের চেহারাটা একদম বদলে গিয়েছে। এত শান্তির ছাপ ওই মানুষগুলোর মুখে সে কি কখনো দেখেছে? কি করে এমন হল? মায়ের কাছে আত্মসমর্পণ করার পর থেকেই এই ঘরটা অন্যরকম হয়ে গেল। তার মানে খুব অল্প পেলেই মানুষ তার কষ্ট ভুলে যেতে পারে। তাই তো? মাধবীলতা ঝুঁকে দই-এর ভাঁড়টা বাঁ হাতে যখন আনছিল তখন অর্ক দেখতে পেল মায়ের ডান দিকের জামা অনেক খানি ফেঁসে গিয়েছে। পাঁজরের চামড়া দেখা যাচ্ছে। সে আচমকা বলে বসল, তুমি ছেঁড়া জামা পরেছ কেন?

চকিতে আঁচল টেনে ঢেকে ঢুকে ঠোঁট কামড়ে মাধবীলতা বলল, ছেঁড়া কোথায়? বলে অনিমেষকে আড়চোখে দেখে নিল।

তুমি জানো তুমি ছেঁড়া জামা পরেছ। অর্ক দই দিয়ে ভাত মাখছিল।

ঠিক আছে, তুই আমাকে নতুন জামা যখন কিনে দিবি তখন আর পরব না। আর ভাত নিবি? তুমিও একটু নাও। মাধবীলতা প্রসঙ্গ ঘোরাতে চেয়েছিল।

অর্ক সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষকে সজাগ করেছিল, বাবা আর নিও না তাহলে মা না খেয়ে থাকবে।

অনিমেষ হয়তো নিতে চাইছিল কিন্তু কথাটা শোনামাত্র ঢেকুর তুলে বলেছিল, আমার পেটে আর এক ফোঁটা জায়গা নেই।

মাধবীলতা হেসে ফেলল। তারপর খেতে খেতে বলেছিল, কাঁকুড়গাছিতে সরকারি ফ্ল্যাট নাকি পাওয়া যাচ্ছে। বিয়াল্লিশ টাকা ভাড়া।

অনিমেষ শব্দ করেছিল গলায়, দূর। ওই টাকায় পাখির খাঁচাও পাওয়া যায় না।

মাধবীলতা বলেছিল, তবু আমি একবার দেখে আসব। আমাদের একজন টিচারের নাকি হোল্ড আছে। আচ্ছা, সুদীপকে বললে ও ব্যবস্থা করে দিতে পারে না?

কে সুদীপ? অনিমেষের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। এই সময়টাই তার কাছে খুব পীড়াদায়ক। মাধবীলতা একটা মগে জল আর খালি সসপ্যান এগিয়ে দিত ওর মুখ ধোওয়ার জন্যে। কিন্তু ইদানীং সেটা নিজের কাছেই বিশ্রী ঠেকে। এখন পাতে ডান হাত ধুয়ে নিয়ে খাট ধরে সোজা হয়ে ক্রাচে ভর করে বাইরে যেতে হয় কুলকুচি করার জন্যে। মাধবীলতা বলেছিল, ওঃ, তুমি এত ভুলে যাও। য়ুনিভার্সিটির সুদীপ মন্ত্রী হয়েছে। তুমি বললে নিশ্চয়ই শুনবে।

অনিমেষ হেসেছিল, তুমি সত্যি অদ্ভুত।

মানে?

যার পকেটে একটা টাকা থাকে সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাঁড়ের চা খায়, চিনে বাদাম ছাড়িয়ে খেতে খেতে হাঁটে। তার পকেটে এক লক্ষ এলে সে আর কখনই ভাঁড় হাতে নিতে পারে না। তুমি কোন ধনী মানুষকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাদাম খেতে দেখেছ? এটা তার দোষ নয়। পরিবেশ কিংবা ক্ষমতাই তাকে এমন আচরণ করায়। সুদীপ যদি কিছু করে তাহলে অনুকম্পাবশত করবে। তোমার সেটা ভাল লাগবে?

মাধবীলতার খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। ছেলে বসে আছে দেখে বলেছিল, তুই বসে আছিস কেন, যা হাত ধুয়ে আয়।

অর্ক জিজ্ঞাসা করেছিল, তোমাদের বন্ধু মন্ত্রী?

অনিমেষ মাথা নেড়েছিল, পরিচিত, ওকে বন্ধু বলে না। এতে অবাক হবার কিছু নেই।

উনি নকশাল ছিলেন?

এবার মাধবীলতা এবং অনিমেষের চোখাচোখি হয়েছিল, অনিমেষ হেসেছিল, না।

মাধবীলতা একটু অবাক হয়েছিল, তোর তাহলে ওসব মনে আছে।

কেন থাকবে না। তবে সি পি এম করলে বাবা এতদিনে মন্ত্রী হয়ে যেত, না!

বলে উঠে হাত ধুতে চলে গেল অর্ক।

কি বুঝছ? ছেড়ে দাও এসব। মাধবীলতা বলল, যেকথা বলছিলে, আমার এখন যা চাই তা আদায় করে নিতে হবে। ওসব চক্ষুলজ্জা নিয়ে অনেক দূরে সরে থেকেছি। কেউ যদি আমার আড়ালে কিছু বলে তাতে কি এসে যায় যদি কাজ হয়? আমার সামনে না বললেই হল। আমি আর ওসব কেয়ার করি না।

অনিমেষ চমকে উঠেছিল, তুমি খুব বদলে যাচ্ছ।

.

বদলে যাচ্ছে কি না তা মাধবীলতা জানে না কিন্তু এখন মেঝেতে পাতা শীতলপাটিতে শুয়ে মনে হল এতদিনে যা যা ও করে এসেছে সব ঠিক করেনি। শুধু সয়ে যাওয়ার কোন মানে হয় না। কেউ আমার রুচির মূল্য না দিলে অভিমানে সরে থাকার কোন যুক্তি নেই। আজকে একটুর জন্যে বিরাট ভুল হয়ে যাচ্ছিল। অন্তত আজকের দিনে অর্ক কোন অন্যায় করেনি তবু সেই একই অভিমানে ওকে বোঝার চেষ্টা সে প্রথমে করেনি। তার পরেই ওর স্নেহ প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর ছেলেটা কেমন বদলানো ব্যবহার করছে। অন্তত এই মুহূর্তে ওর বই নিয়ে বসা স্বাভাবিক নয়। অর্কর পিঠের দিকে তাকাল মাধবীলতা। খালি পিঠ, পরিষ্কার এবং ভরাট। ছেলেটা সত্যি বড় হয়ে গেল। পড়ার কথা সে বলেনি। পাটিতে গড়াগড়ি দিতে দিতে বই টেনে নিয়েছে। মাধবীলতার মনে হল ওরও কিছু দোষ আছে। আমরা কতগুলো নিয়ম নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছি রুচি এবং শোভনতার দেওয়াল দিয়ে। আমরা চাই সবাই তার মধ্যে আটকে থাকুক। অন্যথা হলেই সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল বলে ভয় পাই। কিন্তু আজ সামান্য আদর এবং স্নেহের স্পর্শ পেতেই ছেলেটার একরোখা ভাবটা চলে গেল। হয়তো সাময়িক, হয়তো আজ বিকেল পর্যন্ত এটা থাকবে কিন্তু তাও তো হল।

দরজায় শব্দ হল। বই মুড়ে রেখে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কে?

একজন ডাকছে। গলাটা ন্যাড়ার বলে মনে হল অর্কর। উঠে দরজার দিকে পা বাড়াতে গিয়ে সে মায়ের দিকে তাকাল। মাধবীলতার চোখ এখন তার দিকে। অনিমেষ খাটে শুয়ে রয়েছে চোখ বন্ধ করে, ঘুমোয়নি যে তা নড়াচড়ায় বোঝা যাচ্ছে। অর্কর অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু সেই সঙ্গে মনে হল কিলা খুরকিরা এলে ন্যাড়া একজন ডাকছে বলত না। অতএব এই ডাকে সাড়া দেওয়া মানে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে যাওয়া নয়। সে মাধবীলতাকে বলল, কে ডাকছে দেখে আসি।

মাধবীলতা কোন কথা বলল না কিন্তু তার ঠোঁটে যে হাসি ফুটছিল তাকে কোনমতে সামলালো। অন্য সময় হলে অর্ক এই দ্বিধা দেখাতো না। দরজা খুলে অর্ক বলল, কেউ নেই। তারপর কয়েক পা হেঁটে অনুদের বাড়ির সামনে এসে ফিরে যাচ্ছিল। শালা, হারামিরা এইভাবে ভড়কি দিয়ে মজা পায়। কিন্তু তার সঙ্গেই যে কেউ বাতেলা করতে সাহস পাবে! অর্ক চারপাশে তাকাল। ঠিক তখন অনুপমা সেজেগুঁজে দরজা খুলে মাটিতে পা রাখল। চোখাচোখি হতে কেমন একটা লাজুক লাজুক হাসি হেসে এগিয়ে গেল রাস্তার দিকে। ওর ছোট্ট ভাইগুলো ড্যাবডেবিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে দিদির যাওয়া দেখতে লাগল। ওপাশ থেকে ন্যাড়া চিৎকার করে উঠল, তোমাদের একজন ডাকছে।

অর্ক দেখতে পেল। একটা পাঁচিলের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে ন্যাড়া বিড়ি খাচ্ছে। খালি গা কিন্তু অশৌচের চিহ্ন রয়েছে। হঠাৎ অর্কর মনে পড়ল, ওদের মা নেই। কিন্তু অনুপমার সাজগোজ দেখে কেউ সে কথা বলবে না। অমন সেজে ও কোথায় গেল! অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কোথায়?

বাইরে, চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

নিমুর চায়ের দোকানের সামনে আসামাত্র ড্রাইভারটাকে চিনতে পারল অর্ক। এই লোকটাই গতরাত্রে এসেছিল। গাড়ি পাল্টে গিয়েছে কিন্তু লোক একই। সে জিজ্ঞাসা করল, আমাকে খুঁজছেন?

মাথা নেড়ে লোকটা জানাল, সাহেব তাদের নিয়ে যাবার জন্যে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। আর বার বার বলে দিয়েছেন যেন অর্ক তার মাকে সঙ্গে নিয়ে যায়। খুব জরুরী দরকার। ফেরার জন্যে চিন্তা করতে হবে না।

অর্ক খুব অবাক হল। বাবার ছোটকাকা এত ভদ্রলোক! কিন্তু মাকে নিয়ে যেতে বলছে কি জন্যে! সে লোকটাকে দাঁড়াতে বলে পিছু ফিরছিল এমন সময় চায়ের দোকান থেকে ডাক ভেসে এল, আবে অক্ক!

এই সময় নিমুর দোকান ফাঁকা থাকে। নিমুর ছেলে চা বানাচ্ছে। পেছনের বেঞ্চিতে আধশোয়া হয়ে বিলু তার দিকে তাকিয়ে। বিলুকে দেখেই বুকের ভেতর খচ করে উঠল। সে জিজ্ঞাসা করল, কি বলছিস?

এদিকে এস দোস্ত।

অর্ক ঈষৎ বিরক্ত হয়ে দোকানে উঠে বলল, তাড়াতাড়ি বল, কাজ আছে।

সে তো দেখতেই পাচ্ছি। গাড়িটা কার? লেকটাউনের মাগীটার?

অ্যাই বিলু, মুখ সামলে কথা বল!

যাঃ বাবা। এতেই দিল বাম্প করল! ওই মেয়েছেলেটাকে পেয়ে সেদিন আমাকে কি হাম্পুটাই না দিলি। ভদ্রলোকের ছেলে ভদ্রলোকের সঙ্গেই মিশে যায়, তাই না?

বিলু উঠে বসল, তোকে আমি দোস্ত ভেবেছিলাম।

আমি তাই আছি। অনেক সময় উপায় থাকে না। অর্ক ওকে শান্ত করার জন্যে বলল।

মাল খিচেছিস?

কার কাছ থেকে?

হাসপাতাল পার্টির কাছ থেকে।

না। আমি আর যাইনি। তারপর জুড়ে দিল, হয়তো অ্যাদ্দিনে কেঁসে গেছে।

না। দিব্যি বেঁচে আছে। ওর বউটা মনে হয় খুব কান্নি খায়। আমি আজ হাসপাতালে গিয়েছিলাম তোর খোঁজে। বিলু হাসল।

আমি যাইনি সে তো দেখেছিস। যাক, আমি তোর সঙ্গে পরে দেখা করব, লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। অর্কর ভাল লাগছিল না। বিলু যখন হাসপাতালে গিয়ে বিলাস সোমের খোঁজখবর নিয়েছে তখন ওকে বিশ্বাস নেই।

গাড়িটা কার?

আমার ছোটদাদুর।

আই বাপ! তোরা এত বড়লোক।

আমরা নই। বাবার ছোটকাকার গাড়ি ওটা। এর আগে কোনদিন দেখিনি। তুই খোঁজ নিলে দেখবি তোরও কোন না কোন আত্মীয় খুব বড়লোক কিন্তু তাতে তোর কি এসে গেল। অর্ক চটজলদি কথাগুলো বলে গেল।

দুর বে। আমার সব বড়লোক আত্মীয় পাকিস্তানে, অ্যাদ্দিনে হয়তো তারা মিয়া সাহেব হয়ে গিয়েছে। টিকিটগুলো দে। হাত বাড়াল বিলু।

কিসের টিকিট? বলেই মনে পড়ে গেল অর্কর। সেই সিনেমার টিকিটগুলো। কোথায় রেখেছিল সে। দুটো জায়গা তার বাছা আছে ঘরে। সে মাথা নাড়ল, দিয়ে যাচ্ছি। তুই তো এখানে আছিস।

বিলু বিস্মিত ভঙ্গী করল, সেকি রে! তুই আমাকে বিশ্বাস করে ছেড়ে দিবি? যদি টিকিট ঝেড়ে দিয়ে হাওয়া হয়ে যাই।

সে তোর ধর্ম। কথাটা বলে ফিরে আসছিল অর্ক, খপ করে বিলু ওর হাত চেপে ধরল, গুরু, এত বড় কথা যখন তুমি বললে তখন আর আমার কোন রাগ নেই। তোমার সঙ্গে একটা জরুরী কথা আছে। ন্যাড়ার মায়ের শ্রাদ্ধ লাগাতে হবে। কিলা চাইছে ও সেকেটারি হবে, আমি সেটা চাইছি না। তুমি হবে?

কিসের সেক্রেটারি?

বাঃ, চাঁদা তুলতে হবে না? ন্যাড়াদের তো পয়সা নেই। চাঁদা তুলে ফাণ্ড করতে হবে, শ্রাদ্ধের আগে চব্বিশ ঘণ্টা কীর্তন লাগাতে হবে। হেভী খরচ। কিলা সেকেটারি হলে আমরা ভোগে যাব। তুমি যদি আমার সঙ্গে হাত মেলাও তাহলে কিলাকে ফুটিয়ে দিতে পারব। বিলুর গলা খুব আন্তরিক।

ঠিক আছে, পরে কথা বলব।

পরে নয়। আজ বিকেলেই মিটিং।

ঠিক আছে।

হাত ছাড়িয়ে অর্ক গলিতে ঢোকার মুহূর্তে আড়চোখে দেখল ড্রাইভারটা তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। বিলুর কথা কি ওর কানে গিয়েছে? কে জানে?

খবরটা শোনামাত্র মাধবীলতা উচ্চারণ করল, সেকি!

হ্যাঁ। খুব জরুরী দরকার বলছে।

আমার সঙ্গে আবার কি দরকার!

তা জানি না। গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ড্রাইভার। মাধবীলতা অনিমেষের দিকে তাকাল, কি ব্যাপার বলো ত?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, কি করে বলব। ছোটকাকাকে বোঝা খুব মুশকিল।

আমি কি করব?

যা ভাল বোঝ। অনিমেষ হাসল।

বাঃ, তোমার ছোটকাকা, তুমি বলবে না? তাছাড়া ওসব হোটেল মোটেলে আমার যাওয়া অভ্যেস নেই। অস্বস্তি হয়। তার চেয়ে খোকা তুই গিয়ে জেনে আয়। এই সমাধানটা মাধবীলতার নিজেরই ভাল লাগল।

হঠাৎ অর্কর মনে হল মায়ের সঙ্গে রাস্তায় বের হলে বেশ হয়। অনেক, অনেকদিন সে মায়ের সঙ্গে কোথাও যায়নি। আজ যখন এই রকম সুযোগ এসেছে। সে বলল, কিন্তু ওঁর বোধহয় তোমার সঙ্গেই দরকার। আমি তো সঙ্গে আছি, তুমি চল।

দূর পাগল। তেমন প্রয়োজন হলে তিনিই আসতেন। মাধবীলতা শেষ করতে চাইল।

না মা, তুমি চল। বেশ ঘোরা যাবে গাড়ি করে। আবদারে গলা অর্কর।

মাধবীলতা কৃত্রিম বিস্ময়ে অনিমেষকে বলল, দ্যাখো, বুড়োধাড়ীর কাণ্ড।

অনিমেষ বলল, বলছে যখন, যাও না ঘুরেই এসো

সেকি?

সেকি বলছ কেন? অনেক দিন, অনেকদিনই বা বলি কেন, কোনদিনই তো কোথাও বেড়াতে গেলে না! অর্ক সঙ্গে আছে, চিন্তা করার কিছুই নেই।

অনিমেষের কথা শেষ হওয়ার আগেই মাধবীলতার মুখে সিঁদুর জমছিল। এত বছর ধরে শুধু ঘর দোকান আর স্কুল ছাড়া অন্য কোন জীবন যে তার নেই এটা নিজেরই খেয়াল ছিল না। অথচ অনিমেষ সেই কথাটা মনে করেছে জানতে পেরে–একে কি আনন্দ বলে, কে জানে, তাই হল। অন্যদিকে তাকিয়ে মাধবীলতা বলল, তোমাকে ফেলে আমি বেড়াতে যাব, অদ্ভুত কথা।

তুমি বেড়াতে যাচ্ছ ভাবছ কেন? প্রয়োজনে যাচ্ছ। অনিমেষ বোঝাল।

ছেলেমানুষী কর না।

অর্ক বুঝতে পারছিল বাবাকে ফেলে মা যাবে না! সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আচ্ছা মা, বাবাও তো আমাদের সঙ্গে যেতে পারে?

মাধবীলতার যেন খেয়াল হল, ও, হ্যাঁ, তাই তো! তুমি তো মোড় অবধি ক্রাচ নিয়ে হেঁটেছিলে। তুমি গেলে আমি যেতে পারি।

মাধবীলতার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকাল অনিমেষ, তুমি পাগল হয়েছ। আমার মত বিকলাঙ্গ মানুষ বাড়ির বাইরে যাবে!

চমৎকার। তুমি ক্রাচ নিয়ে গলিতে গিয়ে গাড়িতে উঠবে আর হোটেলের সামনে নামবে। আমরা তো আছি।

তারপর সিঁড়ি ভাঙ্গবো কি করে?

সিঁড়ি ভাঙ্গতে হবে কেন? লিফট নেই? অতবড় হোটেলে লিফট না থেকে পারে? না, আর আপত্তি করো না। এত বছর ধরে তুমি তো বন্দী হয়েই আছ, আজ যখন সুযোগ এসেছে তখন আর আপত্তি করো না। আমি তো রোজ নানান কাজে বাইরে যাচ্ছি, তোমার তো তাও হয় না।

অনিমেষ ক্রমশ বোধ করছিল আকর্ষণ তীব্র হচ্ছে। এই ঘর এবং গলিতে দিনের পর দিন আটকে থেকে সে একসময় ক্লান্ত হয়েছিল এবং এখন আর সে বোধ বেঁচে নেই বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু অর্ক এসে বলা মাত্র সে মনে মনে বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিল। ছোটকাকা শুধু মাধবীলতাকে যেতে বলেছে? ওঁর তো তার কথাই আগে বলা উচিত ছিল। হয়তো ভেবেছেন সে হাঁটতে পারবে না কিন্তু ভদ্রতাও তো এটাই করতে বলে। তার মানে ছোটকাকা তাকে বাতিলের দলে ফেলে দিয়েছেন। অভিমান, এতক্ষণ যা ছিল চাপা, তা তীব্র হল, উনি তোমাকে যেতে বলেছেন লতা, আমাকে নয়। তাই আমার যাওয়া অশোভন।

মাধবীলতা বলল, তুমি যে যেতে পার তা বোধহয় ওঁর মনে আসেনি।

সেই জন্যেই আমার যাওয়া উচিত নয়।

তাহলে তুই একা ঘুরে আয় খোকা।

অর্ক বুঝতে পারছিল আবার পরিস্থিতি পাল্টে যাচ্ছে। সে মাথা নাড়ল, তোমরা দুজনেই চল। ড্রাইভার তো ঠিকঠাক নাও বলতে পারে।

অনিমেষ যেন চট করে কথাটা ধরল, কেন, ড্রাইভার তোকে শুধু মাকে নিয়ে যেতে বলেনি? এতে ঠিক বেঠিকের কি আছে?

শুধু মাকে নিয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু বলেনি। অর্ক সত্যি কথা বলতে পেরে খুশি হল, বলেছিল মায়ের সঙ্গে খুব দরকার। তার মানে শুধু মাকে নিয়ে যেতে হবে, তা নয়।

মাধবীলতা বলল, ওই তো! তুমি মিছিমিছি ভাবছ। চল, সবাই মিলে ঘুরে আসি। তোমাদের দুজনকে নিয়ে আমি কখনও বেড়াতে যাইনি।

মাধবীলতা যে মুখ করে তার দিকে তাকাল তা অনেকদিন দ্যাখেনি অনিমেষ। মুহূর্তেই সব অভিমানের ধুলোয় যেন ঝড়ের ছোঁয়া লাগল, বেশ, যখন বলছ।

সাদা হ্যাণ্ডলুমের পাঞ্জাবি আর পাজামা অনিমেষের পরনে। দুই বগলে ক্রাচ। এত পরিষ্কার জামাকাপড়ে আজ ওকে খুব রোগা দেখাচ্ছে। হাত দুটো শরীরের তুলনায় বড় বেশী ভারী। মাধবীলতা সাদা ব্লাউজের সঙ্গে সাদা শাড়ি মিলিয়েছে। অবশ্য পুরো সাদা নয়, মাঝে মাঝে হালকা নীলের নকশা রয়েছে। এখনও খোঁপা বেঁধে পরিষ্কার মুখে সিদুরে-টিপ পরলে ওকে চমৎকার দেখায়। অনিমেষ ঠাট্টা করল, তোমার টিপের আঠা ঠিক আছে তো?

বাঃ, এটা নতুন। কেন, খারাপ লাগছে?

সাদা প্যান্টের ওপর লাল গেঞ্জিশার্ট পরে অর্ক চুল আঁচড়াচ্ছিল, বলল, দারুণ।

মাধবীলতা হাত তুলল, ইয়ার্কি হচ্ছে মায়ের সঙ্গে, না?

অর্ক হেসে উঠল, বাঃ, তুমি সুন্দরী, এটা তো সত্যি কথা।

আবার?

বাবা, বলো তো! এই বস্তিতে মায়ের চেয়ে সুন্দরী আর কেউ আছে?

অনিমেষ কিছু বলার আগেই মাধবীলতা বলল, ও, তুই বুঝি এই সব দেখে বেড়াস আজকাল। অনেক গুণ হয়েছে দেখছি। চল, তোমরা বাইরে যাও, আমি আসছি।

অনিমেষ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অর্কর পাশাপাশি ঈশ্বরপুকুর লেনে বেরিয়ে এল। অর্ক লক্ষ্য করল এখনও মোক্ষবুড়ি গলিতে বসেনি। কিন্তু আর যত বউঝি ইতস্তত ছড়িয়ে ছিল তারা অবাক হয়ে অনিমেষকে দেখছে। তাদের চোখে যে ব্যাপারটা নতুন তাই বিস্ময়ের। এর ওপর যখন মাধবীলতা খোঁপা ঘোমটায় ঢেকে ওদের পেছনে চলে এল তখন বিস্ময় আরও বাড়ল। অর্কর মনে হচ্ছিল, পাবলিক যেন সিনেমা দেখছে। মাধবীলতা বলল, অত তাড়াতাড়ি পা ফেলা ঠিক নয়।

অনিমেষ কিছু বলতে যাচ্ছিল এই সময় চিৎকারটা তীরের মত ওদের বিদ্ধ করল। আর এই প্রথম অর্কর মনে হল এই শব্দগুলো মা-বাবার সামনে শোনা যায় না। চিৎকার করছিল ন্যাড়া। মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে শরীর বেঁকিয়ে শব্দগুলো ছুঁড়ছিল, কোন শালা খানকির বাচ্চা তোমার দোকানে আর চা খায়, অমন চায়ের কাপে আমি তার পরেই অনিমেষদের দেখতে পেয়ে যেন বাকি শব্দ গিলে ফেলল সে। ওদিকে নিমু তখন আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, মেরে তোর হাড় ভেঙ্গে দেব বদমাস ছেলে। মা মরার পর বিনিপয়সায় চা দিয়েছিলাম বলে জমিদারি পেয়েছ? আজ পয়সা চেয়েছি বলে খিস্তি হচ্ছে। শালা সেদিনের মাল আজ খিস্তি করছে!

ন্যাড়ার ছেড়ে দেওয়া শব্দগুলো কানের পর্দায় গম গম করছে। অর্ক ছুটে গিয়ে চাপা গলায় বলল, এই ন্যাড়া, মুখ খারাপ করবি না!

ন্যাড়া শরীর মোচড়ালো, যা বে। আমার সঙ্গে লাগলে আমি ছেড়ে দেব না।

ন্যাড়া! রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল অর্কর। পেছন থেকে মাধবীলতার চাপা গলা সে শুনতে পেল, আঃ, কি হচ্ছে!

অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে অর্ক ওদের নিয়ে গাড়িটার সামনে চলে আসতেই ড্রাইভার দরজা খুলে দিল। অত্যন্ত সাবধানে অনিমেষকে গাড়িতে ভোলা হল। দুই হাতে ভর দিয়ে পেছনের আসনে অনিমেষ ঠিকঠাক বসলে ক্রাচ দুটো তুলে দিয়ে মাকে উঠতে বলে পেছন ফিরে তাকাল। ছোটখাটো ভিড় জমেছিল সেটা যত না ন্যাড়ার বচন শুনতে তার চেয়ে এদের যাত্রা দেখতে। বিলু নেমে এসেছিল দোকান থেকে। মাকে আড়াল করে পকেট থেকে টিকিট বের করে ওর হাতে চালান করে দিল অর্ক, সবগুলো আছে। তুই যা ইচ্ছে তাই করিস। আমি এর মধ্যে নেই। কথাটা বলেই সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসতেই ড্রাইভার ইঞ্জিন চালু করল। গাড়ি যখন ন্যাড়ার। পাশ দিয়ে যাচ্ছে তখন অর্ক মুখ বের করে বলল, দাঁড়াও, ফিরে আসি, তোমার হচ্ছে।

সঙ্গে সঙ্গে মাধবীলতা বলল, মানে? তুই ওকে বলার কে?

বাঃ, তাই বলে তোমাদের সামনে খারাপ কথা বলবে!

আমাদের তো বলছে না।

কিন্তু শুনতে হচ্ছে তো। ওকে আমি শিক্ষা দেব।

ঠাস করে চড় মারবো। এখন আমরা সঙ্গে আছি বলে খুব গায়ে লাগছে না? দিনরাত রকে বসে যখন ওগুলো বমি করিস তখন খেয়াল থাকে না কারো না কারো মা বোন এসব শুনছে। এখন বোঝ কেমন খারাপ লাগে। ন্যাড়াকে মারবি, তোর ওই গুণ্ডা বন্ধুদের মুখ বন্ধ করতে পারবি? কিছু বলতে হবে না ন্যাড়াকে। নিজেকে ঠিক রাখ, তাই যথেষ্ট।

অর্ক গুম হয়ে বসেছিল। মায়ের প্রত্যেকটা কথাই যে সত্যি তা বুঝতে পেরে আরও অসহায় লাগছিল। গাড়ি তখন বেলগাছিয়া ব্রিজে উঠে এসেছে। ডান দিকে তাকিয়ে অনিমেষ বলে উঠল, ওইটে কি? পরেশনাথের মন্দির, না?

মাধবীলতা বলল, হ্যাঁ। তার পরে হেসে বলল, অ্যাই রামগরুড়ের ছানা, এদিকে তাকা।

অর্ক গম্ভীর হতে গিয়ে হেসে ফেলল, তুমি নিজেকে রামগরুড় বলছ।

হাসিটা বিস্তারিত হল, বাঃ, মাথায় বুদ্ধি আছে দেখছি।

১৭. শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড়

শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড় ছাড়াতেই অনিমেষ অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল, ওখানে কি হচ্ছে, পাতাল রেলের রাস্তা?

মাধবীলতা বলল, হ্যাঁ। সমস্ত পথটাই খুঁড়ে একা হয়ে গেছে। চট করে দেখলে চিনতে পারা যায় না। বলতে না বলতে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। অর্ক মুখ বের করে দেখল রাজবল্লভ পাড়া পর্যন্ত ঠাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাড়িগুলো। সে ড্রাইভারকে বলল, ডানদিকের রাস্তাটা ধরুন। মনি কলেজের সামনে দিয়ে। লোকটা অজানা পথে গাড়ি নিয়ে যেতে নারাজ, একবার সেদিকে তাকিয়ে বিরক্ত মুখে বসে রইল। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, এত রাস্তা তুই চিনলি কখন?

অর্ক জবাব দিল না। মাধবীলতা বলল, এই রাস্তায় ঢোকা আমাদের ভুল হয়েছে। সোজা সার্কুলার রোড দিয়ে গেলে সুবিধে হত। কথাটা শুনে ড্রাইভার ঘাড় নাড়ল। সে-ও ভুল বুঝতে পেরেছে। অনিমেষ চারপাশে তাকিয়ে দেখছিল। কি দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে শহরটা। এই পথে একদিন সে নিজেও ঘুরে বেড়িয়েছে অথচ এখন আর সে-পথটাকে চেনা যাবে না। রাস্তার একটা দিক বন্ধ করে বিরাট বিরাট যন্ত্র দিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে সশব্দে। সামনের গাড়ির ড্রাইভার দরজা খুলে মাটিতে নেমে চিৎকার করে উঠল, পাতাল রেল হচ্ছে গুষ্টির পিণ্ডি হচ্ছে! শালা টাকা ঝাড়বার কল। এখন দাঁড়িয়ে থাক এখানে।

ওদের গাড়ির ড্রাইভার মুখ বাড়িয়ে বলল, ঠিক বলেছেন দাদা। এর চেয়ে সার্কুলার রেল হলে কত ভাল হত। বিধান রায় তাই চেয়েছিলেন।

চাইবেন না কেন? উনি তো আর নাড়ি-টেপা ডাক্তার ছিলেন না। সামনের ড্রাইভারটি জানাল। অনিমেষ দেখল, এরা দুজনেই বয়স্ক। দুজনেই পাতাল রেল প্রকল্পকে অপছন্দ করছে। যে কোন পরিবর্তনে বয়স্কদের সমর্থন দেরিতে পাওয়া যায়। অথচ এই পথের তলা দিয়ে যখন পাতাল রেল ছুটবে তখন এই মানুষগুলোই গর্ব করে বলবে, ওঃ, কি কষ্টই না করেছিলাম আমরা সেদিন। কথাটা ভাবতেই অনিমেষের বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠল। নতুন কোন উদ্যোগ মেনে নিতে পারেনি বলেই এই দেশের মানুষ সাতষটির আগে যেমন ছিল এখনও তেমনই রয়েছে। শুধু ওই উদ্যোগটাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারলে নিশ্চয়ই এমনটা হত না। অনিমেষ দেখতে পেল একটি লোক মনি কলেজের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে গাড়িদের আটকে-পড়া দেখছে। খুব মজা পেয়েছে যেন। হঠাৎ অনিমেষের মনে হল লোকটকে সে চেনে। অনেক বছর পার হয়ে গেলেও একটুও পাল্টায়নি। শুধু মুখের গড়ন আরও গোল হয়েছে। না, তার ভুল হয়নি। ওই দাঁড়ানোর ভঙ্গী, ওই আকৃতি এবং ধুতি পরা দেখে ভুল হবার কথা নয়। সে উত্তেজিত হয়ে হাত নাড়ল। কিন্তু যার উদ্দেশ্যে হাত নাড়া তার নজর অন্যদিকে। অনিমেষের খুব আফসোস হচ্ছিল। এখান থেকে চেঁচিয়ে ডাকলে শোনা যাবে না। মাধবীলতা বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি হল? চেনা কেউ? বলে উঁকি দিয়ে দেখবার চেষ্টা করল।

চিনতে পারছ! অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকাল। মাধবীলতা তখনও ঠিক লোকটিকে বুঝে উঠতে পারছে না। অনিমেষ চাপা গলায় অর্ককে বলল, চট করে নেমে ফুটপাথ থেকে ওই লোকটিকে ডেকে নিয়ে আয় তো। দেখিস, গাড়ি না ছেড়ে দেয়। ভাগ্যিস জ্যামে আটকালাম।

অর্ক দরজা খুলে প্রায় দৌড়ে গেল ফুটপাথ ধরে। এদিকের ফুটপাথ এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে পাতাল রেল-ওয়ালারা। অনিমেষ দেখল অর্ক মনি কলেজের সামনে গিয়ে চারপাশে তাকাচ্ছে। তারপর গাড়ির দিকে মুখ করে জানতে চাইল কাকে বলবে? অনিমেষ হাতের ইশারা করতেই অর্ক উল্টো মুখ করে দাঁড়ানো লোকটাকে ডাকল, শুনুন।

লোকটা চশমার আড়ালে চোখ বড় করে ওর দিকে তাকাতেই অর্ক হাত নেড়ে গাড়িটা দেখাল, আপনাকে ডাকছে।

আমাকে ডাকছে? গাড়ি থেকে?

অনিমেষ দেখল ওরা এগিয়ে আসছে। ড্রাইভার শেষ পর্যন্ত আশা ছেড়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। কেউ একজন চেঁচিয়ে উঠল, ভোর হয়ে যাবে বাড়ি ফিরে যান। অনিমেষ মাধবীলতাকে বলল, কি আশ্চর্য, এখনও চিনতে পারছ না? সঙ্গে সঙ্গে মাধবীলতার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। একটা আন্তরিক হাসিতে দুটো ঠোঁট দীর্ঘতর, ওমা পরমহংস!

ততক্ষণে গাড়ির পাশে এসে চোখ ছোট করে পরমহংস এদের দেখছে। অনিমেষ হাত বাড়াল, কেমন আছিস? বলতে বলতেই তার খেয়াল হল য়ুনিভার্সিটিতে সে ওকে তুমি বলত। কিন্তু এখন তুই বলতে খুব ভাল লাগল।

প্রায় লাফিয়ে উঠল পরমহংস, আই বাপ! গুরু তুমি বেঁচে আছ! ওর কথা বলার ভঙ্গী দেখে মাধবীলতার হাসি বাঁধ ভাঙল। অনিমেষ ওর হাত জড়িয়ে ধরে বলল, থাক, চিনতে পারলি শেষ পর্যন্ত। কিন্তু আমি মরতে যাব কোন দুঃখে।

এবার একটু আমতা আমতা করল পরমহংস, আমি সেরকমই শুনেছিলাম। আঃ, কদ্দিন বাদে দেখা হল! আরে বাবা, আপনিও সঙ্গে আছেন। ওঃ, আজ কার মুখ দেখে উঠেছি আমি। এই সময় একসঙ্গে অনেকগুলো হর্ন বাজতে থাকল। সামনের গাড়িগুলো এবার নড়ছে। ড্রাইভার দৌড়ে এসে দরজা খুলতেই অনিমেষ বলল, উঠে আয়, উঠে আয়।

পরমহংস বলল, কি আশ্চর্য, আমি উঠব কেন? সে অর্কের দিকে তাকাল। মাধবীলতা মুখ বের করার চেষ্টা করে বলল, আগে উঠুন তারপর ভাবা যাবে কেন উঠবেন, উঠে পড়ুন।

তখন আর দ্বিধা করার সময় ছিল না। সামনের গাড়ি অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। অর্ক দৌড়ে ড্রাইভারের পাশে জায়গা নিতে পরমহংস তাকে অনুসরণ করল। গাড়ি চলতে শুরু করলে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, তোর হাতে এখন কোন কাজ আছে? কোথাও যাচ্ছিলি?

হ্যাঁ। ছাত্র পড়াতে যাচ্ছিলাম। ছেড়ে দে এসব কথা, আজ আমি ডুব মারছি। বলে উল্টো দিকে ঘুরে বসল সে, তোরা মাইরি একদম বুড়িয়ে গেছিস। তোর তো মুখচোখে পঞ্চাশ বছর আর, তোকেও তুই বলচি, আপনি টাপনি বলতে পারব না, হ্যাঁ তুইও বুড়ি হতে চলেছিস। অথচ লাস্ট যখন দেখেছিলাম তখন কি ছিলি মাইরি, শালা য়ুনিভার্সিটি কেঁপে যেত।

অনেক অনেকদিন বাদে মাধবীলতা ব্লাস করল, যাঃ, কি অসভ্য।

অসভ্য মানে? ইয়ার্কি। বিখ্যাত নকশাল নেতা অনিমেষ মিত্তির যদি তোকে তুলে না নিত তাহলে অ্যাদ্দিনে। পরমহংস পাছে বেফাঁস কিছু বলে বসে তাই মাধবীলতা দ্রুত বলে উঠল, কি হচ্ছে কি, সামনে কে বসে আছে জানো? তারও সম্বোধন আপনি থেকে কখন তুমিতে পৌঁছে গেছে।

পরমহংস একটু সোজা হবার চেষ্টা করে অর্ককে দেখল। তারপর চোখের ইশারায় জিজ্ঞাসা করল, কে? মাধবীলতা হাসল, পুত্র।

অ। পরমহংসের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল, এত বড় ছেলে তোর? অসম্ভব। এই যে ভাই, কি নাম তোমার বল তো?

অর্ক মিত্র। অর্ক ঠিক বুঝতে পারছিল না তার বিরক্ত হওয়া উচিত কিনা।

মিত্র? ওরা যা বলছে তা ঠিক? চোখ সরাচ্ছিল না পরমহংস।

ঠোঁট টিপে অর্ক মাথা নাড়ল। সঙ্গে সঙ্গে পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল এমন ভঙ্গী করল পরমহংস, এটা কি করে হল?

অনিমেষ হাসল, বিয়ে করেছিস? কথা ঘোরানো দরকার।

আমি? খ্যাপা! শুধু হংস নই পরমহংস। জলটুকু ফেলে দিয়ে দুধ গিলে নিই। যা রোজগার করি নিজেরই পেট ভরে না তো বিয়ে। পরমহংস যখন কথা বলছিল তখন অর্ক দেখছিল ওঁর দাঁত বেশ উঁচু, এমনিতেই মনে হয় হাসি হাসি মুখ। পরমহংস বলল, কিন্তু ব্যাপারটা কি বল তো? এই গাড়িতে তোকে কখনও দেখব ভাবিনি। কিনলি কবে?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, এটা আমার গাড়ি নয়।

যাচ্চলে! তাহলে এটা কার গাড়ি?

আমার ছোট কাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমরা ওঁর কাছে যাচ্ছি।

ও। তাহলে আমাকে নিয়ে যাচ্ছিস কেন?

ছোট কাকার সঙ্গে দেখা করার কথা অর্ক আর ওর মায়ের। আমি বাইরে তোর সঙ্গে বসে গল্প করব। অনিমেষ ওকে আশ্বস্ত করতে চাইল।

বাইরে মানে? কারও বাড়িতে গিয়ে।

বাড়ি না, হোটেল। পার্ক হোটেল।

উরে ব্বাস। নামিয়ে দে নামিয়ে দে, অতবড় হোটেলে আমি যেতে পারব না। তোর ছোট কাকা পার্ক হোটেলে থাকে। সেই কাকা নাকি রে যার সিগারেট আমাদের খাইয়েছিলি। তখনও তো হোটেলে থাকত। পরমহংস মনে করার চেষ্টা করছিল। অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ সেই কাকাই। তবে এবার তিনি ওদের সঙ্গে কথা বলবেন। আমার পক্ষে হাঁটাচলা অসম্ভব তাই।

বোধহয় এতক্ষণ উত্তেজনায় পরমহংসর চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল, এবার সে ক্রাচটাকে দেখতে পেল। সে আর একটু ঝুঁকে অনিমেষের পায়ের দিকে তাকাল। পাজামা পরা সত্ত্বেও একটা পায়ের অস্তিত্ব যে নেই তা বুঝতে অসুবিধে হল না। এসব দেখার সময় ওর মুখ গম্ভীর হয়ে আসছিল।

তারপর অদ্ভুত চোখে অনিমেষের মুখের দিকে তাকাল। সেই হাসিখুশি ভাবটা এখন উধাও হয়ে গিয়েছে। ঠোঁট কামড়ে ধরেছে পরমহংস। অনিমেষ হাত বাড়িয়ে ওর হাত ধরল, এখন এসব অভ্যাস হয়ে গেছে রে।

পুলিস? কোন রকমে প্রশ্নটা উচ্চারণ করল পরমহংস। মাধবীলতা তখন জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে। অনিমেষের মনে হল অনেকদিন বাদে একটা উষ্ণ আত্মীয়তার স্পর্শ পাচ্ছে সে। পরমহংসের মুখ এখন মাধবীলতার দিকে, বিয়ের আগেই পুলিস এই অবস্থা করেছিল?

মাধবীলতা ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, না। বিয়ের পরে।

অনিমেষ একবার সেদিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল, ছেড়ে দে এসব কথা। একটা লোক হাঁটতে পারল কি পারল না তাতে পৃথিবীর কিছু যায় আসে না।

একদম ফালতু, একদম ফালতু কারণে তুই নিজের জীবনটা দিলি অনিমেষ। তোদের নকশাল আন্দোলনে দেশের কি হাল পাল্টেছে বল। পরমহংসের গলাটা ধরে এল, অবশ্য আবার দ্যাখ, এখন তো আমরা সমস্ত শরীরে বিকলাঙ্গ হয়ে বাস করছি চলছি ফিরছি কেউ দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু আমাদের হাত পা মেরুদণ্ড সব বেঁকানো। তোর হয়তো শুধু পা দুটো গিয়েছে কিন্তু মনে মনে সান্ত্বনা পাস যে একদিন প্রতিবাদ করেছিলি। কিন্তু আমি তো তাও পাই না। সারা দিন রাত কেঁচো হয়ে আছি। বাবার অফিসে ঢুকেছিলাম, সেখানে কোন প্রমোশন নেই। চারধারে জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়ছে, বাস ট্রামে ওঠা যাচ্ছে না কিন্তু ভাড়া দ্বিগুণ হচ্ছে। আর এসবের প্রতিবাদ করলেই বলা হবে সমাজ বিরোধী। তোকে বলব কি, আমারই রকে বসে আমার ভাইপো যে খিস্তি করে তা আমাকেই মুখ বুজে শুনতে হয়। প্রতিবাদ করার সাহস হয় না ওদের চেহারা দেখে। কেমন ক্ষয়াটে বাবরি চুল। এসব বিকলাঙ্গ না হলে কেউ সহ্য করে?

অনিমেষ তো বটে মাধবীলতাও অবাক হয়ে পরমহংসর কথাগুলো শুনছিল। য়ুনিভার্সিটির সেই হাসিখুশি ছেলেটা যে ক্রিকেটের পরিভাষায় জীবন নিয়ে ঠাট্টা করত, রাজনীতি থেকে সযত্নে সাত হাত তফাতে থাকাটা শ্রেয় বলে মনে করত সে কি উপলব্ধি থেকে এই কথাগুলো বলছে! আবার ঘাড় ঘোরাল পরমহংস, তুই ওটা ছাড়া একদম হাঁটতে পারিস না, না?

না। এটা নিয়েও খুব বেশিদূর নয়। তুই এখন কোথায় আছিস?

সেই পৈতৃক ভবনেই। তুই?

বেলগাছিয়ায়।

ঠিকানাটা বল। অ্যাদ্দিন জানতাম না, এখন যখন জানলাম তখন যোগাযোগটা থাক। আমি শুনেছিলাম তোকে নাকি নর্থ বেঙ্গলে পুলিস মেরে ফেলেছে। তোদের যে বিয়ে হয়ে গেছে, এতবড় ছেলে হয়েছে তা কি করে জানব বল। ঠিকানা কি?

তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেন। ওটা বেলগাছিয়া ট্রাম ডিপোর কাছে একটা বস্তি। ওখানে গিয়ে আমাকে না খুঁজে অর্ককে খুঁজলে তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবি। জানি না খোঁড়া লোক বললে কেউ দেখিয়ে দেবে কিনা। অনিমেষ কথাটা শেষ করা মাত্র অর্ক মুখ ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকাল।

তোরা বস্তিতে আছিস? পরমহংস অবাক হয়ে গেল।

একটা ভাল ফ্ল্যাট দেখে দাও না। দেড়খানা ঘর হলেই হবে। বেশি ভাড়া দিতে পারব না। আমি স্কুলে পড়াই, সেই আয়ে চলে আমাদের। মাধবীলতা অনুরোধ করতেই অনিমেষ হেসে উঠল।

মাধবীলতা অপ্রতিভ মুখে জিজ্ঞাসা করল, হাসলে কেন?

অনিমেষ বলল, অনেকদিন আগে আমি পরমহংসকে ওই রকম গলায় বলেছিলাম, আমাকে একটা টিউশনি যোগাড় করে দাও না, যা মাইনে দেবে দিক! বেচারাকে আবার আজ শুনতে হল ফ্ল্যাট দেখে দিতে হবে। তুই সেদিন জিজ্ঞাসা করেছিলি অবস্থা খুব টাইট? আজ জিজ্ঞাসা করলেও একই উত্তর শুনবি, হ্যাঁ।

পরমহংস কিছু বলার আগেই মাধবীলতা বলল, ঠিক আছে, দরকার নেই।

পরমহংস বলল, কোলকাতায় চাকরি পাওয়া যত সোজা ফ্ল্যাট তত নয়। যদি রাইটার্সে ধরাধরি করার কেউ থাকে তাহলে সরকারী ফ্ল্যাট পাওয়া যায়। ওহো জানিস কি সুদীপ এখন মন্ত্রী হয়েছে। য়ুনিভার্সিটিতে অ্যাসিস্টেন্ট জি এস ছিল, চুরুট খেত! মাইরি কি কপাল। অথচ ওর চেয়ে বিমান কি শার্প ছিল, সেই বিমানের এখন আর পাত্তা নেই। সুদীপকে বলবি?

আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

ঠিক আছে, তুমি একটা দরখাস্ত লিখে দিও, আমি ওটা নিয়ে যাব। অত আদর্শ টাদর্শ নিয়ে থাকলে চলে না। দাঁড়াও। দেড়খানা ঘর হলেই হবে? আমাদের পাড়ার এক ভদ্রলোক সল্ট লেকে উঠে যাচ্ছে। বাড়িওয়ালি যদি হেভি সেলামি চায় তো হয়ে গেল। দেখি। পরমহংস এবার অর্কর দিকে তাকাল, তুমি কি পড়ছ?

ক্লাস নাইন।

ও, তাই বল। তোমার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল বোধহয় কলেজে টলেজে পড়ছ। আমার অবশ্য ভুল হয়েছে, তোমার অত বয়েস হতেই পারে না। আরে, আমরা যে পার্ক স্ট্রীটে চলে এসেছি। গাড়ি তখন পার্ক হোটেলে ঢুকছে। গলি দিয়ে ঠিক সদর দরজার সামনে পৌঁছে ড্রাইভার দরজা খুলে দিল। মাধবীলতা নিচে পা রেখে জিজ্ঞাসা করল, তুমি নামবে না? অনিমেষ বলল, ওকে জিজ্ঞাসা কর তো আমাদের পৌঁছে দেওয়ার হুকুম পেয়েছে কি না?

ড্রাইভার কথাটা শুনতে পেয়েছিল, বলল, হ্যাঁ সাব।

অনিমেষ বলল, তাহলে আর কষ্ট করে কি হবে। পরমহংস, তুই বরং পেছনে চলে আয়, ওরা ঘুরে আসুক। তুমি ভাই গাড়িটাকে কোন নিরিবিলি জায়গায় রেখে দাও।

পরমহংস পেছনের সিটে বসতে বসতে বলল, তাই ভাল। আমার আবার এসব জায়গায় এলেই কেমন অস্বস্তি হয়।

মাধবীলতার হাঁটতে সঙ্কোচ হচ্ছিল। হোটেলে যারা ঢুকছে বের হচ্ছে তাদের দিকে তাকালেই বোঝা যায় তারা কোন তলার মানুষ। অর্কর অবশ্য সে ধরনের কোন প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল না। সে। আগ্রহ নিয়ে চারধারে চোখ বোলাচ্ছিল। সামনেই রিসেপশন। ওরা সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই এক ভদ্রলোক ওপাশ থেকে বললেন, ইয়েস।

ঠিক দু মিনিট পরে ওরা নির্দিষ্ট ঘরের দরজায়। মাধবীলতা লক্ষ্য করছিল অর্ক একটুও আড়ষ্ট নয়। এই ঝকঝকে হোটেলের কোন কিছুই যেন ওর কাছে ভীতিকর নয়। বরং সে নিজে অসুবিধে বোধ করছিল। দরজার কাছে এসে মনে হচ্ছিল যার সূত্রে এই ভদ্রলোকের কাছে আসা সেই রইল নিচে গাড়িতে বসে আর ওরা উঠে এল।

দরজা খুলে প্রিয়তোষ বললেন, এসো এসো। আমার এমন কয়েকটা জরুরী কাজ রয়েছে যে আজ তোমাদের ওখানে যেতে পারলাম না, ফলে তোমাকেই ডেকে আনলাম বউমা, তুমি কিছু মনে। করো না। ওই সোফায় বসো।

প্রিয়তোষ হাত বাড়িয়ে দেখিয়ে দিতেই মাধবীলতা সন্তর্পণে বসল। অর্ক দেখল কি নরম যেন ডুবে যাচ্ছে শরীর। এই ঘরটাই এত তরিবত করে সাজানো যে চোখ টেরা হয়ে যায়। প্রিয়তোষ বললেন, ব্যাপারটা কি জানো, আমি এদেশে থাকি না, বয়সও হচ্ছে। কবে চট করে চলে যাব কে বলতে পারে তাই তোমাদের সঙ্গে কয়েকটা বিষয়ে আলোচনা করতে চাইছি।

মাধবীলতা আঁচলটা আর একটু টেনে বসল, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। প্রিয়তোষ উল্টোদিকের সোফায় শরীর এলিয়ে বসলেন, বউমা তোমাকে বুদ্ধিমতী বলে আমার মনে হয়েছে। তবে সেই সঙ্গে কিছুটা, কিছুটাই বা বলি কেন প্রচণ্ড ইমোশনাল। আমি তোমার সব কথা আজ সকালেই জেনেছি। আমাদের বংশ তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।

মাধবীলতা মুখ নামাল, এসব কথা বলছেন কেন?

বলছি তার প্রয়োজন আছে। তুমি শুনেছ কিনা জানি না, জলপাইগুড়ি শহরে আমাদের যে বাড়ি বাবা করে গিয়েছিলেন সেটার দাবি নিয়ে অনেকেই সোচ্চার হয়েছে। আমি যখন গেলাম তখন অনিমেষের জ্যাঠামশাই আমাকে ধরেছিল যাতে আমি আমার অংশ তার নামে লিখে দিই। ওদের ধারণা অনিমেষকে পুলিস মেরে ফেলেছে অতএব দাদা মারা গেলে পুরো সম্পত্তি ওরাই পাবে। কিন্তু আমি ঠিক করেছিলাম দিদিকে আমার অংশ দিয়ে দেব যাতে তাঁকে কেউ হেনস্থা না করতে পারে। এখানে এসে যখন তোমাদের সন্ধান পেলাম তখন মনে হচ্ছে, ভালই হল। তোমরা যদি ওখানে চলে যাও তাহলে সমস্ত ব্যাপারটার একটা সুরাহা হয়। আমি আমার অংশ তোমার নামে লিখে দিচ্ছি এবং বিশ্বাস করছি যে তুমি দিদিকে দেখাশোনা করবে। প্রিয়তোষ একনাগাড়ে কথাগুলো বলে মাধবীলতার মুখের দিকে তাকালেন।

মাধবীলতা বলল, আপনার জিনিস আপনি দিতে যাবেন কেন?

ওই যে বললাম। তাছাড়া ওখানে তো আমি কখনও থাকতে যাব না

তা হোক। আমি এই দায়িত্ব নিতে রাজি নই।

কেন? তুমি দিদির দায়িত্ব নিতে রাজি নও?

আমি সেকথা বলিনি। ওঁর সেবা করার সুযোগ পাওয়া আমার ভাগ্যের কথা। আপনাদের ছেলের কাছে আমি সব শুনেছি। কিন্তু কোন সম্পত্তি আমি নিতে পারব না। আমাকে ক্ষমা করবেন।

কেন?

মাধবীলতা হাসল মুখ নিচু করে কিন্তু জবাব দিল না। প্রিয়তোষ খানিকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন তারপর নিজের মনে বললেন, তুমি আমাকে সত্যি অবাক করলে। তোমরা কি খাবে চা না কফি? কফিই বলি। রিসিভার তুলে রুম সার্ভিসকে হুকুমটা জানিয়ে প্রিয়তোষ অর্কর দিকে তাকালেন, তোমরা যে পরিবেশে থাকো তাতে ওর উন্নতি করা খুব মুশকিল। শুধু ওর জন্যেই তোমাদের জলপাইগুড়িতে চলে যাওয়া উচিত। ওখানে আর যাই হোক এখনও পড়াশুনার আবহাওয়া আছে।

মাধবীলতার মনে তখন কফি ঘুরছে। অনিমেষকে নিচে রেখে এই ঘরে বসে ওরা কফি খাবে? কিন্তু উনি এমন ভঙ্গীতে বললেন যে মুখের ওপর না বলতে পারা গেল না। সে প্রিয়তোষের কথার উত্তরে বলল, দেখি কি করা যায়!

দেখাদেখি নয়, যত তাড়াতাড়ি পারো চলে যাও। আমি তোমাদের কথা আজই দাদাকে লিখে দিয়েছি।

ও যদি যেতে রাজি হয়।

রাজি হবে না কেন? তোমার ওপর সমস্ত বোঝা চাপিয়ে দিতে ওর সঙ্কোচ হয় না? বাই দি বাই, তোমার মা-বাবা কোথায় থাকেন?

মাধবীলতা ঠোঁট কামড়ালো। তারপর স্পষ্ট উচ্চারণ করল, আমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই। আমাকে ওঁরা মেনে নিতে পারেন নি।

তুমি তো দারুণ মেয়ে! প্রিয়তোষ গর্বিত ভঙ্গীতে বললেন, তোমার জন্যে আমি খুব খুশি। অনিটা সত্যিই ভাগ্যবান।

কফি এল। মাধবীলতা ভেবেছিল তাকেই হাত লাগাতে হবে কিন্তু এখানকার বেয়ারাগুলো বোধহয় খুবই কেতাদুরস্ত। কফিতে চুমুক দিয়ে প্রিয়তোষ বললেন, এবার তাহলে চলি। আমি মনে মনে যা ঠিক করেছি তা তোমার কথায় আরও জোর পেল দ্যাখো বউমা, সারাজীবন আমি বাইরে বাইরে। বাবার জন্যে ইচ্ছে হলেও আমি কিছু করতে পারিনি। শুনেছি শেষ বয়সে ওঁকে খুব অর্থকষ্টে কাটাতে হয়েছে। জলপাইগুড়িতে গিয়ে দেখে এলাম ওঁদের অবস্থাও ভাল নয়। দাদার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়, দিদি অশক্ত, বউদিকে আমি আগে দেখিনি। এই অবস্থায় বড় কিছু করার ব্যাপারে আমার দ্বিধা ছিল। তোমাকে দেখার পর অনিকে ফিরে পাওয়ার পর এবং এই শ্রীমানকে আবিষ্কার করে মনে হচ্ছে আমি আমার বংশের প্রতি কিছুটা কর্তব্য করে যাই। আমার যা ঋণ তা এবার শোধ করার সুযোগ দাও।

অর্ক কফি শেষ করে ফেলেছিল, মাধবীলতার হাতের কাপ নড়ে উঠল। সে ধীরে কাপটা নামিয়ে রাখল। প্রিয়তোষ বোধহয় সেটা লক্ষ্য করেন নি। নিজের সঙ্গে কথা বলছেন এমন ভঙ্গীতে বললেন অনেক তো হল, এবার পেছনে তাকানো যাক। বউমা মানুষের জীবনে একটা সময় থাকে যখন শুধুই সামনে তাকানো। তাকাতে তাকাতে হঠাৎ যখন মনে হয় এই যে পেছনটাকে আমি ফেলে এলাম সেটা কি রকম দেখি তখনই বুঝবে সামনে আর তাকানোর কিছু নেই। আর বোধহয় আমার ভারতবর্ষে আসা সম্ভব হবে না। তাই, আমি এখানে আমার যা আছে তা তোমার আর তোমার ছেলের নামে ট্রান্সফার করে যেতে চাই। মোটামুটি দু লক্ষ টাকার মত হবে। শুধু ওই টাকায় তুমি আমার বুড়ি দিদি আর দাদাকে দেখো, এই ছেলেটাকে মানুষ করো।

মাধবীলতা বুঝল অর্ক চমকে উঠেছে। এই বৃদ্ধ এখন এক দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে। সেই দৃষ্টিতে আত্মসমর্পণ পরিষ্কার। একটুও দানের অহঙ্কার নেই। দু লক্ষ টাকা। মাধবীলতা অর্কের দিকে তাকাল। কি আশ্চর্য! ছেলে মুখ নামিয়েছে। প্রিয়তোষ মিনতি করলেন, বউমা তুমি আবার না বল না। এই বুড়োর অনুরোধ রাখ।

মাধবীলতা খুব সতর্ক গলায় কথা বলল, ওঁর সঙ্গে কথা বলে দেখি।

কার সঙ্গে? অনির সঙ্গে? ওর সঙ্গে কথা বলে কি হবে। একটা বিকলাঙ্গ মানুষ তোমাকে কি যুক্তি দিতে পারে?

না। মাধবীলতা প্রায় স্থানকাল ভুলে গেল, এভাবে বলবেন না।

প্রিয়তোষ বললেন, তুমি কেন বুঝতে চাইছ না অনিমেষের নিজে থেকে কিছু করার সামর্থ্য নেই। তুমি যা করবে ও তাই মেনে নেবে।

মাধবীলতা উঠে দাঁড়াল, আপনি এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? আপনার চলে যাওয়ার দিন তো এখনও আসেনি।

আসেনি কিন্তু আসবে। তাছাড়া আমাকে ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করতে হবে। এই টাকায় আমাদের একমাত্র উত্তরাধিকারী মানুষ হবে।

মাধবীলতা বলল, আপনাকে আমি জানাবো। আর অর্কর কথা যদি বলেন তাহলে বলি, আমি যদি নিজের রোজগারে ওকে মানুষ না করতে পারি তাহলে ওই টাকা ওকে অমানুষ হতে দ্রুত সাহায্য করবে। আমরা চলি।

দরজায় এসে প্রিয়তোষ শেষবার বললেন, তুমি হ্যাঁ বলে যাও।

মাধবীলতা হাসল, আপনি গুরুজন। আপনার মুখের ওপর এত কথার পর না বলতে বাধে। কিন্তু দোহাই, আমার পায়ের তলা থেকে মাটি কেড়ে নেবেন না! আপনি তো জানেন আমি খুব ইমোশনাল, এটুকু নিয়েই বেঁচে থাকি।

লিফটে নয়, সিঁড়ি ভেঙ্গে ওরা নিচে নেমে এল। নামতে নামতে প্রচণ্ড বিস্ময়ে অর্ক বলল, তুমি দু লাখ টাকা ছেড়ে দিলে মা, কেন?

মাধবীলতা বলল, তোর বাবাকে জিজ্ঞাসা কর।

তুমিই বল না। ওই টাকা থাকলে তোমাকে আর কষ্ট করতে হতো না, আমরা অনেক ভাল জায়গায় থাকতে পারতাম। অর্ক মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল সেই মুখ থমথম করছে।

ড্রাইভার ওদের পথ চিনিয়ে গাড়ির কাছে নিয়ে গেল। অনিমেষ আর পরমহংস পেছনের সিটে বসে গল্প করছে। ওদের দেখে পরমহংস ঠাট্টা করল, ওঃ, এত দেরি করলে, খুব খেয়েছ মনে হচ্ছে। আমাদের এক ভাঁড় চা জোটেনি।

মাধবীলতা অনিমেষের মুখোমুখি হল, উনি জলপাইগুড়ির বাড়ির অংশ লিখে দিতে চান।

সেকি! না, না, তুমি রাজি হওনি তো! অনিমেষ আঁতকে উঠল।

উনি অর্ক এবং তোমার বাবা মায়ের জন্যে আমাকে দু লক্ষ টাকা দিতে চান। আমি এড়াতে চেয়েছিলাম শেষ পর্যন্ত।

তুমি পাগল হয়েছ লতা! শেষ পর্যন্ত দান নেবে? অনিমেষের গলায় অবিশ্বাসের সুর।

মাধবীলতা পরমহংসকে বলল, এই যাও না, একটা ট্যাক্সি ডেকে আনো। তোমাকে আমি ভাঁড়ের চা খাওয়াবো কথা দিচ্ছি। এদের গাড়িটা আর আটকে রাখা উচিত নয়।

অর্ক অবাক হয়ে মায়ের মুখ দেখছিল। এত সুন্দর, দুর্গার মত মা কি করে দেখতে হয়ে গেল?

১৮. সাত দিন বিছানায় পড়ে ছিল অর্ক

সাত দিন বিছানায় পড়ে ছিল অর্ক। পার্ক হোটেল থেকে ফিরে আসার রাত্রেই তেড়ে জ্বর এল সেই সঙ্গে মাথায় যন্ত্রণা। অনিমেষের তক্তাপোশে বিছানা করে দেওয়া হয়েছিল ওকে। জ্বরটা বেড়ে গিয়েছিল মাঝ রাত্রে, তখন কিছুই করার ছিল না। অনিমেষ আর মাধবীলতা অসহায় চোখে দেখেছিল গায়ে গতরে বেড়ে ওঠা বেপরোয়া ছেলেটা শিশুর মত কষ্ট পাচ্ছে। সারারাত জলপট্টি আর মাথায় বাতাস করে করেও যখন জ্বর কমানো গেল না তখন মাধবীলতা ভয় পেল। যে ছেলেটা বিকেলেও হাসিখুশিসুস্থ হয়ে ওদের নিয়ে কলকাতা দর্শন করে এল সেই ছেলের মাঝ রাত থেকে এই অবস্থা হয় কি করে! পাড়ার ডাক্তারবাবু এসেছিলেন সকালে। অনেকক্ষণ দেখেশুনে কয়েকটা ট্যাবলেটের নাম লিখে দিয়ে বলেছিলেন, ভয়ের কিছুই নেই। মনে হয় এতেই জ্বর কমে যাবে। কিন্তু জ্বর কমল পাঁচ দিনের মাথায়। আর এই পাঁচ দিন অনবরত কথা বলে গেছে অর্ক। সেসব কথার সূত্র এবং অর্থ বোঝেনি মাধবীলতা শুধু একটি বাক্য ছাড়া, দু লাখ টাকা ছেড়ে দিলে? মাধবীলতা এবং অনিমেষ খুবই অবাক হয়েছিল-যখন প্রথম বাক্যটি কানে আসে। জ্বরের ঘোরেও অর্ক এই কথা বলায় বোঝা যাচ্ছে যে ওর মনে বিস্ময় চেপে বসেছে। ছেলের মাথায় জলপট্টি দিতে দিতে মাধবীলতা বলেছিল, তোমার ছেলে বেশ বিষয়ী দেখছি!

অনিমেষ ছেলের অসুখের সময় নতুন করে আবিষ্কার করল তার কিছুই করার নেই। ছেলেটা যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে, জ্বরে মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে কিন্তু সে উপশম করতে পারছে না। এমনকি পাঁচ মিনিটের বেশী পাখা দোলাতে গেলে হাত কনকন করে। তাছাড়া মাধবীলতা ক্রমাগত বলে গেছে, তুমি সরো তো, কিছু করতে হবে না তোমাকে, একজন পড়েছে আর একজন পড়লেই সোনায় সোহাগা হবে আমার। অনিমেষ জানে মাধবীলতা তার অক্ষমতাকে ঢেকে রাখতে চাইছে। সত্যি বলতে কি, এই ছুতোটাকে সে নিজেও গ্রহণ করেছে। অনিমেষ তাই শুধু নজর রাখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না। আর এই সময় নিজের ছেলেবেলার কথা বড় মনে পড়ে যায়। শৈশবে বাবার সঙ্গে তার দূরত্ব ছিল অনেক। শুধু তার কেন, পরিচিত বন্ধুদেরও দেখেছে বাবার সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। মা পিসী দাদু তখন তার জগৎ জুড়ে ছিল। বাবা সেই সংসারের একজন সদস্য মাত্র কিন্তু সন্তানের সঙ্গে নিজস্ব কোন যোগ নেই। যেন ছেলের সঙ্গে আলাদা করে ঘনিষ্ঠতা করা সে সময়ে বাবার কাছে অস্বস্তির ছিল। দাদুর সামনে বাবা তাকে কোলে নিয়ে বা গলা জড়িয়ে ধরে গল্প করছে এমন দৃশ্য কল্পনা করাও যায় না হয়তো সে-সময় বাবার সেটা ইচ্ছে থাকলেও করতে লজ্জা পেত। একান্নবর্তী পরিবারে স্ত্রী এবং সন্তানের প্রতি ভালবাসার প্রকাশ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের চোখে যদি অন্যরকম মনে হয় এই সঙ্কোচে বাবা থাকতো নিজের জগতে। সন্তান একটু বড় হয়ে তাই বাবাকে দূরের মানুষ বলেই ভেবে নিত। ছেলেবেলায় অনেক বন্ধুকে অনিমেষ বাবাকে আপনি বলতে শুনেছে। কিন্তু এখন তো বাবা বন্ধুর মত, কিংবা এত কাছাকাছি যে সন্তানের সঙ্গে তার কোন আড়াল নেই। অর্কর সঙ্গে তার সেইরকম সম্পর্ক গড়ে উঠতে উঠতে কেন যেন উঠল না। শুধু তার শারীরিক অপটুতা? না। অনিমেষ এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত। হয়তো ছেলের জীবনের প্রথম কয়েকটা বছর তার কাছে অজানা থাকায়, ওর তিলে তিলে বড় হওয়া দেখতে না পাওয়ায় একটা ফাঁক তৈরি হয়েই রয়েছে মনের গভীরে। যেটা তাকে স্বচ্ছন্দ করে না। মাধবীলতা বলল অনিমেষের ছেলে বেশ বিষয়ী। দু লাখ টাকার জন্যেই শোকগ্রস্ত হল নাকি অর্ক! তোমার ছেলে কথাটায় যে একটু ঠাট্টা মেশানো তা বোঝে অনিমেষ। কিন্তু জ্বরের ঘোরে যে দুলাখ দুলাখ করে যাবে ছেলে তা ভাবতে পারেনি সে। পাঁচ দিন বাদে যখন অর্কর জ্বর নামল তখন অনিমেষ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, আজ কোন কথা শুনবো না, তোমাকে সারাদিন ঘুমুতেই হবে।

ওমা, ঘুমুতে যাব কেন? পাঁচ দিন প্রায় জেগে থাকা মাধবীলতার মুখ আজকের শান্তিতে স্নিগ্ধ। অনিমেষ আর কথা বলেনি। যে মেয়ে পাঁচ দিনের প্রতিটি ঘন্টা ছেলের সেবা করে গেছে সে যদি একথা বলে তাহলে আর কি করার আছে!

কিছুক্ষণ বাদে অনিমেষ উঠে এল খাটে। এই ক’দিন মাটিতে ওর বিছানা হয়েছিল। অর্ক চোখ খুলে নির্জীব ভঙ্গীতে শুয়ে আছে। বাবাকে খাটে উঠতে দেখে হাসবার চেষ্টা করল। অনিমেষ ওর পাশে নিজের শরীরটাকে কোনমতে তুলে গুছিয়ে বসে জিজ্ঞাসা করল, কিরে, খিদে পাচ্ছে?

অর্ক মাথা নাড়ল। না। অনিমেষ বলল, কি করে জ্বর বাধালি বল তো! এই কদিন কোন হুঁশই ছিল না তোর! এর মধ্যে পরমহংস দুদিন খোঁজ নিয়ে গেছে।

পরমহংসের নাম শুনে আবার হাসি ফুটল অর্কর মুখে। ওকে যে ছেলের পছন্দ হয়েছে তা প্রথম দিনেই টের পেয়েছিল এরা। দুদিনই বেশ কিছু ফল দিয়ে গেছে পরমহংস। আপেলগুলো এখন শুকোচ্ছে। অনিমেষ বলল, অত টো টো করে সারাদিন ঘুরতিস সহ্য হবে কেন? এখন আর বাইরে বের হওয়া চলবে না। এই সময় তার চোখে পড়ল মাধবীলতা কাপড় পাল্টে নিয়েছে ঘরের কোণে। আলনার ওপাশে ছোট্ট একটা আড়াল এই উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করে মাধবীলতা। আঁচল ঠিক করতে করতে আয়নার সামনে আসতেই অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, তুমি বের হচ্ছ নাকি?

হ্যাঁ। ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই ঘুরে আসব। তুমি এই ট্যাবলেটটা ওকে আধঘন্টা বাদে মনে করে খাইয়ে দিও। টেবিলের ওপর রাখা ট্যাবলেটটাকে দেখাল মাধবীলতা।

তুমি কোথায় যাচ্ছ? অনিমেষ ভ্রূ কুঁচকে তাকাল।

স্কুলে। দ্রুত হাতে চুল ঠিক করছিল মাধবীলতা।

সে কি! তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? পাঁচ দিন ধরে অমানুষিক পরিশ্রম করে তুমি স্কুলে যাচ্ছ? আমি বলেছি তুমি আজ রেস্ট নেবে। তাছাড়া এই বেলায় তুমি স্কুলে গিয়ে কি করবে? অনিমেষ বেশ জোরেই কথাগুলো বলল।

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, স্কুলে আমাকে যেতেই হবে। বলছি তো যাব আর আসব।

কি এমন রাজকর্ম আছে যে যেতেই হবে। আমি বলছি তুমি যাবে না।

অবুঝ হয়ো না। এত সামান্য ব্যাপার নিয়ে উত্তেজিত হচ্ছ কেন?

অনিমেষের মুখে চোখে ক্রোধ স্পষ্ট এবং শেষে সেটা হতাশায় রূপান্তরিত হল। সে হাত নেড়ে বলল, তুমি যদি আমার কথা না শুনতে চাও তাহলে ছেলে অবাধ্য হবেই।

মাধবীলতার হাত মাথার ওপর থেকে ধীরে ধীরে নেমে এল। তার চোখ অনিমেষের ওপর স্থির। ঠোঁট শক্ত। কথাটা বলে অনিমেষ ভেজানো দরজার দিকে মুখ ফিরিয়েছে। সে যে কিছুই দেখছে না তা বোঝা যায়। অর্ক বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কথাটা কানে যাওয়া মাত্র। এই ঘরে হঠাৎ কোন শব্দ নেই।

মাধবীলতার হাত আবার সচল হল। চুল আঁচড়ে, মুখ মুছে ব্যাগটা তুলে নিল হাতে। তারপর তক্তাপোশের পাশে এসে ছেলের মাথায় হাত রাখল। জ্বর নেই নিশ্চিত হয়ে অনিমেষের দিকে তাকাল, আমি কি করব বল তো?

মুখ না ফিরিয়ে অনিমেষ ঝাঁঝিয়ে উঠল, যা করছ তাই করো। সেজেগুঁজে স্কুলে যাও। সংসারের জন্যে খেটেখুটে উনি নিজেকে শেষ করে ফেলেছেন! আমি বুঝি না তোমার উদ্দেশ্য?

কি বোঝ? মাধবীলতার গলায় হাসির মিশেল। সেটা টের পেয়ে অনিমেষের জ্বালা স্পষ্ট হল, এই কষ্ট করে তুমি মনে মনে খুব আনন্দ পাও। একটা ভাঙ্গা সংসারকে একা টেনে বেড়াচ্ছ, এই ভাবনা তোমাকে আরও কষ্ট করতে অনুপ্রেরণা দেয়। স্যাডিস্ট অ্যাপ্রোচ। ইনডাইরেক্টলি তুমি বুঝিয়ে দাও আমরা অপদার্থ, তুমি না থাকলে আমরা ভেসে যেতাম। আর এই বুঝিয়ে দিতে পারাটাই তোমার আনন্দ। নিজেকে চাবুক মেরে যেমন অনেকের আনন্দ হয়।

তাই? মাধবীলতার কণ্ঠ এবার স্থির।

অবশ্যই। নইলে যে মানুষ পাঁচদিন এক ফোঁটাও ঘুমোয়নি সে এখন ঘটা করে স্কুলে যায় হাজার নিষেধ সত্ত্বেও। কেন, আজ না গেলে কি তোমার চাকরি চলে যেত? যে দেখবে সেই বুঝতে পারবে তোমার শরীর ঠিক নেই। তারা আহা উঁহু বললে তোমার শুনতে ভাল লাগবে! অনিমেষ স্ত্রীর দিকে তাকাল।

এতক্ষণে সত্যি ক্লান্ত দেখাল মাধবীলতাকে। ধীরে ধীরে সে বসে পড়ল তক্তাপোশের ওপর। কিছুক্ষণ সময় ব্যয় করে যেন শক্তি সঞ্চয় করল। তারপর নিচু গলায় বলল, আমার কাছে আর মাত্র পাঁচটা টাকা পড়ে আছে।

পাঁচ টাকা, পাঁচ টাকা মানে? হতভম্ব হয়ে গেল অনিমেষ।

কদিনে যে খরচ হল সেটা তো হিসেবে ছিল না। এখনও মাইনে পেতে দেরি আছে। সংসারের খরচ ছাড়াও ওর ওষুধ কিনতে হবে না? স্কুলে না গেলে টাকার ব্যবস্থা কোত্থেকে হবে। তুমি তো অনেক কিছু বুঝে গেছ! হয়তো ঠিকই বুঝেছ কিন্তু এই মুহূর্তে হাতে কিছু টাকার দরকার। মাধবীলতা কেটে কেটে শব্দগুলো উচ্চারণ করল। অনিমেষের মনে হল এবার তার নিজের গালে চড় মারা উচিত। ক’দিনে যে প্রচুর খরচ হয়েছে এ কথাটা একবারও মনে পড়েনি। আর টাকার ব্যবস্থা করতে হলেও মাধবীলতাকেই যেতে হবে এটাই এখন সত্যি। সে নিজে চেষ্টা করলেও এক পয়সা ধার পাবে না। অবিনাশের কাছে আগে হলে হাত পাতা যেত কিন্তু সেই পেন্সিলারের কাজ প্রত্যাখ্যান করার পর আর ওর ওখানে যায় নি সে। নিজেকে আর একবার অসহায় কীটের মত মনে হচ্ছিল তার। এইসময় দরজায় কেউ শব্দ করল। মাধবীলতা দ্রুত নিজেকে সংযত করে বলল, কে?

আমি। মেয়েলি গলা। মাধবীলতা একটু বিরক্ত হয়ে উঠে দরজা খুলে বলল, কি ব্যাপার?

অনু বলল, আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে। মাধবীলতা একবার পেছনের দিকে তাকিয়ে দরজা ভেজিয়ে বাইরে গেল। আর তখনই অর্ক বলে উঠল, বাবা! অনিমেষ মুখ তুলে তাকাল। ওর বুকে এক ধরনের যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ছিল। তবু ছেলের ডাকে উত্তর দিল, কি?

আমি একটা কথা বলব তুমি সেটা মাকে বলবে না, বল!

অনিমেষের কপালে ভাঁজ পড়ল। অর্কর বলার ভঙ্গী একদম অচেনা। এত আন্তরিক গলায় ওকে কথা বলতে ইদানীং শোনেনি সে। ওর মনে হল অর্ক এই মুহূর্তে মাধবীলতার চেয়ে তাকেই কাছের মানুষ বলে মনে করছে। নইলে মায়ের কাছে গোপন করে তাকেই কিছু বলতে চাইবে কেন। সে বলল, কি?

আগে বল বলবে না।

ঠিক আছে। অনিমেষ নিজেকে গুরুত্ব দিতে চাইল।

আমার কাছে টাকা আছে। ওই যে টেবিলের ওপর আমার যে পড়ার বই তার নিচেরটা খুলে দ্যাখো পাবে। তুমি টাকাটা নিয়ে মাকে দাও। আর কক্ষনো বলবে না আমি দিয়েছি। অর্কর দুর্বল গলায় উত্তেজনা।

তুই কোত্থেকে টাকা পেলি? অনিমেষ চমকে উঠল।

পেয়েছি। তুমি তাড়াতাড়ি কর। মা ঘরে আসার আগেই টাকাটা বের করে নাও। নইলে—, অর্ক হাঁপাতে লাগল। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দ্রুত হাত চালাল অনিমেষ। একটু ঝুঁকলেই টেবিলটার নাগাল পাওয়া যায়। তাড়াহুড়োতে বইগুলো এলোমেলো হল কিন্তু নিচেরটা খুলতেই টাকাগুলো হাতে এসে গেল। অনেকগুলো নোট, অঙ্কটা কত হবে বুঝতে না পেরে সে হতভম্ব-গলায় বলল, কোত্থেকে পেয়েছিস।

পরে বলব। তুমি যা হোক কিছু বলে দাও। অর্ক চোখ বন্ধ করল। আর তখনই মাধবীলতা ঘরে ঢুকল, ঢুকে বলল, বেচারা!

কি হয়েছে? অনিমেষের কণ্ঠস্বর কাঁপছিল। মাধবীলতা ছেলের দিকে তাকিয়ে কথা ঘোরাল, এমন কিছু নয়। যাক, আমি ঘুরে আসছি।

অনিমেষ বলল, শুধু ধার করার জন্যে স্কুলে না গেলেই হবে।

মানে? আমি আর কি জন্যে যাচ্ছি।

তাহলে যেও না।

বাঃ, ধার না করলে চলবে কেন? বিকেলেই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।

এই টাকাগুলো রাখো। অনিমেষ বিছানা থেকে তুলে টাকাগুলো মাধবীলতার দিকে বাড়িয়ে দিল। প্রচণ্ড বিস্ময় ফুটে উঠল মাধবীলতার মুখে। সে একবার টাকা আর একবার স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাশে গলায় বলল, কে দিল?

দিয়েছে কেউ। কত আছে গুনে দ্যাখো।

যে দিয়েছে সে তোমাকে গুনে দেয়নি? মাধবীলতার চোখে সন্দেহ।

দিয়েছে তবে টাকা নেবার সময় গুনে নেওয়া উচিত।

মাধবীলতার মাথায় বোধহয় কিছু ঢুকছিল না। সে এবার ছেলের দিকে তাকাল। চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে অর্ক। এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই অর্কর কোন ভূমিকা নেই। তাছাড়া অত টাকা ছেলে পাবেই বা কোথায়! নোটগুলো দেখে মনে হচ্ছে পরিমাণ কম নয়। সে অনিমেষকে বলল, ম্যাজিক শিখেছ নাকি?

কেন?

ঘরে বসে টাকা বানাচ্ছ!

বানাচ্ছি কে বলল! ধরো এগুলো!

কিন্তু তুমি কার কাছ থেকে পেয়েছ না বললে টাকা নেব না আমি। ও বুঝেছি, অবিনাশের কাছ থেকে ধার করেছ, না?

অবিনাশ? না, না। আমি তো এখন আর ওখানে যাই না। সত্যি কথাটা বলে ফেলল অনিমেষ। একটা বিশ্বাসযোগ্য বানানো গল্প মনে মনে হাতড়াচ্ছিল সে। কিন্তু মাধবীলতার মুখের দিকে তাকিয়ে কোনটাকেই যুতসই বলে মনে হচ্ছিল না। সে অর্কর নাম বলবে না অথচ একটা যুক্তি খাড়া করা খুব দরকার। ভেতরে ভেতরে অসহায় হয়ে পড়েছিল অনিমেষ। মাধবীলতার গলায় এবার সমাধানের সুর, আচ্ছা! এতক্ষণে বুঝলাম। তুমি পরমহংসের কাছে পেয়েছ। না, না, এটা ঠিক কাজ করোনি। এতকাল বাদে দেখা হতেই টাকা ধার করলে, ও মনে মনে কি ভাবল কে জানে। তাছাড়া শোধ দিতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, সেটাও একটা সমস্যা হয়ে থাকল। নেবার আগে আমাকে বলতে পারতে। হাতের ব্যাগ টেবিলে রেখে মাধবীলতা টাকাগুলো নিয়ে গুনতে শুরু করল।

অনিমেষ যেন মুক্তি পেল। মাধবীলতাই যখন পরমহংসের নামটা বলে দিল তখন এর চেয়ে নিরাপদ অজুহাত আর কি আছে। সে উদাস গলায় বলল, পরমহংস আমার কলেজ জীবনের বন্ধু।

গোনা শেষ হলে মাধবীলতা বলল, এত টাকা? এত টাকা নেওয়ার কি দরকার ছিল! কবে শোধ দিতে হবে বলেছে?

না। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আর তুমি যেন গায়ে পড়ে ওকে এসব বলতে যেও না। বেচারা লজ্জা পাবে। ওর নাম তুমি জানো এটা ও কিছুতেই চাইবে না। ফেরত দেওয়ার ব্যাপারটা আমি বুঝে নেব। অম্লান বদনে মিথ্যে কথা বলতে বলতে অনিমেষের খেয়াল হল অর্ক নিশ্চয়ই কান খাড়া করে এসব শুনছে। বাবা যে চমৎকার মিথ্যে বলতে পারে এমন ধারণা করার সুযোগ সে নিজেই দিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ওর কাছে কথা রাখতে হলে এছাড়া যে উপায় নেই সেটুকু বুঝবে না?

টাকাগুলো তুলে রাখতে রাখতে মাধবীলতা বলল, তোমার ছেলে দু লাখ দু লাখ বলে চেঁচাচ্ছিল আর তোমাকে সামান্য কটা টাকার জন্যে হাত পাততে হচ্ছে। একেই বোধহয় কপালের ফের বলে।

অনিমেষ যেন এবার একটু স্বাভাবিক হতে পেরে বেঁচে গেল, কেন, দু লাখ নিতে পারলে না বলে আফসোস হচ্ছে নাকি?

আমি যদি হ্যাঁ বলতাম তাহলে এই সংসারের চেহারাটা বদলে যেত। কারো কাছে সামান্য প্রয়োজনে ধার করতে হত না। তোমাদের কাউকেই আর কষ্ট করতে হোতো না। অথচ তখন আমি কিছুতেই হ্যাঁ বলতে পারলাম না। কেউ যদি শোনে কাল দু লাখ টাকায় না বলে আজ দুশো টাকা ধার করতে ছুটি তাহলে পাগল বলবে। এই কদিন ধরে খোকা যখন জ্বরের ঘোরে টাকার কথা বলত তখন মনে হতো আমি কি ভুল করেছি? পাঁচজনে শুনলে বলবে বাড়াবাড়ি, গল্প উপন্যাসে হয়, কিন্তু আমি যে কিছুতেই তখন হ্যাঁ বলতে পারলাম না। তোমাকে যখন নিচে নেমে এসে বললাম তখন খুব ভয় করছিল। তুমি যদি না বলেছি বলে রেগে যাও তাহলে আমি কি করব? তোমার কথায় জোর পেলাম। কিন্তু সত্যি বল তো, আমি না বলেছিলাম কেন? মাধবীলতা চোখ তুলল।

অন্যের টাকা কেন হাত পেতে নেবে, তাই।

না গো। তোমাকে বিকলাঙ্গ না বললে হয়তো আমি না বলতে পারতাম না।

ভাত খাওয়ার পর অর্ককে আর আটকে রাখা গেল না। তবে এই কদিনে একটা বিশ্বাস মাধবীলতার এসেছে, অর্ক বুঝতে শিখেছে। ও অন্তত খুরকি কিলাদের সঙ্গে নিজেকে বিশ্রীভাবে জড়াবে না। বিশ্বাসটা দৃঢ় হয়েছিল যখন অনুর মায়ের শ্রাদ্ধের পর বিলু ওকে ডাকতে এল। অর্ক তখনও ভাত খায়নি কিন্তু একটু একটু হাঁটাচলা করছে। কদিনের অসুখে ওকে বেশ রোগা দেখাচ্ছে এবং কিছুটা লম্বা। স্কুল থেকে ফেরার পথে মুসুম্বি এনেছিল। বড্ড দাম কিন্তু অর্কর এখন এসব খাওয়া উচিত। পরমহংসের টাকা ফুরোবার আগেই মাইনে হাতে এসে যাবে, এই ভরসা। অনুদের ঘরের পাশ দিয়ে কয়েক পা এগোতেই বিলুকে দেখতে পেল মাধবীলতা। বিলু আর অর্ক।

সঙ্গে সঙ্গে যে বিরক্তিটা এল সেটা চেপে রাখার প্রয়োজন মনে করেনি মাধবীলতা। ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ওরা কথা বলছিল। তাকে দেখে দুজনেই চুপ করে গেল। মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

অর্ক জবাব দিল, বিলুর সঙ্গে কথা বলছি।

সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু তোর এখন গায়ে রোদ লাগানো উচিত নয়। তারপর বিলুকে বলেছিল, না রে, আমি এর মধ্যে নেই। তাছাড়া আমার শরীর খারাপ, ওসব ঝামেলায় যেতে পারব না।

বিলু বলেছিল, কি যে বলিস, অসুখ যেন আর কারো হয় না। এত বড় শ্রাদ্ধ হয়ে গেল, কিলা একাই সব নাফা হাপিস করল। তুমি সঙ্গে থাকলে আমি ওর বারোটা বাজিয়ে দিতাম। একটু ফিট হয়ে নাও তারপর সতীশদার সঙ্গে মোকাবিলা করব।

অর্ক বলেছিল, না, আমি পার্টি ফার্টির মধ্যে নেই।

বিলু হেসেছিল, আমরা কেউই নেই। কিন্তু পার্টি পেছনে থাকলে অনেক কাজে সুবিধে হয়। ঠিক আছে, বিকেলে রকে আয়।

অর্ক বলেছিল, না। তুই যা, আমি এখন বের হব না।

ঘরে ফিরে এলে অর্ককে জিজ্ঞাসা করেছিল মাধবীলতা, ও কি বলতে এসেছিল রে? এর মধ্যে, তোর অসুখের সময়েও একদিন এসেছিল।

কিলার সঙ্গে ঝামেলা হয়েছে তাই বলতে এসেছিল।

কিসের ঝামেলা?

শ্রাদ্ধের টাকাপয়সা নিয়ে। ছেড়ে দাও এসব কথা। ওঃ, তুমি আবার আজ মুসুম্বি এনেছ? তোমাকে সেদিন মানা করলাম না?

এখন শরীর সারাতে হলে এসব খেতেই হবে। আর শোন, ওইসব ফালতু ঝামেলায় তুমি যেও না। মাধবীলতা প্রসঙ্গ টানল।

কে যাচ্ছে!

ছেলের বলার ভঙ্গীতে মাধবীলতার বিশ্বাস বাড়ল। অনিমেষ বলেছিল, ও তোমার মেয়ে নয় যে জোর করে ঘরে আটকে রাখবে।

অতএব অর্ক আবার ঘর ছেড়ে বের হল। বের হয়েই শুনল খুরকিকে নাকি আর দেখা যাচ্ছে না। কিলার সঙ্গে সতীশদার সম্পর্ক এখন ভাল নেই। কদিন আগে পুলিশ নাকি আচমকা সিনেমা হলগুলোতে রেইড করে ব্ল্যাকারদের ধরে নিয়ে যায়। ওই দলে কিলাও ছিল। খবরটা জানার পরও নাকি সতীশদা থানা থেকে ওকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করেনি। পুলিশ কিলার ডানহাত ভেঙ্গে দিয়েছে। প্লাস্টার করা হাত নিয়ে সতীশদার কাছে গিয়েছিল কিলা। এই নিয়ে একটু হামলা করার চেষ্টায় ছিল সে। পাড়ায় সি পি এমের জন্যে সে জান লড়িয়ে দিয়েছে অথচ কেউ তাকে ছাড়াতে যায়নি বলে চেঁচামেচি করেছিল। কিন্তু সতীশদা তাকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, সে যদি সমাজবিরোধী কাজকর্ম থেকে বিরত না থাকে তাহলে পার্টি তাকে আশ্রয় দেবে না। এমনিতেই তার জন্যে নাকি পার্টির ইমেজ পাবলিকের কাছে খারাপ হয়ে গিয়েছে। সি পি এম পার্টি গুণ্ডা পুষতে রাজি নয়। কিলা শাসিয়েছে যে সে সতীশদাকে দেখে নেবে। ও যদি নুকু ঘোষকে একবার হ্যাঁ বলে তাহলে ঈশ্বরপুকুরে সি পি এমের বারোটা বাজিয়ে দিতে বেশীক্ষণ সময় লাগবে না।

অর্ক দেখল, ঈশ্বরপুকুরের সামনে একটা মঞ্চ তৈরি হয়েছে। কোয়া বলল, আজ মাইরি ফাটাফাটি কাণ্ড হবে।

অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার? ওরা শিবমন্দিরের রকে বসেছিল। খুরকি তো নেই কিলাও আজ আসেনি। বিলু বলল, খুব জোর হাওয়া পাল্টে যাচ্ছে গুরু, এখন শুধু তাকে তাকে থাকতে হবে। গত পাঁচদিন ধরে শ্যামবাজারের কোন হলে ব্ল্যাক হয়নি, ভাবতে পারা যায় না।

একটু বাদেই শ্লোগান দিতে দিতে কয়েকটা ছোট মিছিল হাজির হল মঞ্চের সামনে। মাইকে অবিরাম হ্যালো হ্যালো চলছিল। কে একজন পেছনে ফেস্টুন টাঙিয়ে দিল, সমাজবিরোধীদের হামলার প্রতিবাদে জনসভা। বক্তৃতা শুরু হল। প্রথমে সি পি আই-এর একজন স্থানীয় নেতা বললেন, বন্ধুগণ, আমরা এমন একটা সময়ে আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি যখন জনপ্রিয় বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত ক্রমশ সীমা ছাড়াচ্ছে, বামফ্রন্ট সরকারের প্রগতিমূলক কাজকর্ম যাতে জনসমর্থন না পায় তার জন্যে একটি বিশেষ সংবাদপত্র সচেষ্ট। তাদের রাজনৈতিক সংবাদদাতা সুযোগ পেলেই আমাদের উদ্দেশ্যে গালাগাল দিয়ে থাকেন। এদের আপনারা চেনেন। তাই সুযোগ-সন্ধানীদের সম্পর্কে নতুন কিছু বলার নেই। যেহেতু আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বাস করি তাই এদের মেনে নেওয়া ছাড়া আমাদের অন্য কোন উপায় নেই। আমরা সরকার গঠন করেছি। কোন সংবাদপত্রের দয়ায় নয়। জনসাধারণ আমাদের হাতে এই মহান দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন। সম্প্রতি আমরা আর একটি জিনিস লক্ষ্য করছি। পাড়ায় পাড়ায় কিছু বেপরোয়া গুণ্ডা বদমাস ক্রমশ মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। তাদের অসামাজিক ক্রিয়াকলাপের পেছনে কার মদত আছে তা আজ পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই জনসাধারণ এই লুম্পেনদের ভয় পান। পুলিসকে কিছু বললে কাজ হয় না। কেন হয় না তাঁরাই জানেন। এইসব সমাজবিরোধীরা এখন বামফ্রন্টের সুনাম নষ্ট করার জন্যে তৎপর হয়েছে। এদের স্পর্ধা এত বেড়ে গেছে যে এরা আমাদের একজন স্থানীয় নেতাকে শাসাতে ভয় পায় না। আমরা জানি ওরা কোত্থেকে এই সাহস পাচ্ছে। ওদের হাতে গোপন অস্ত্র আছে। কিন্তু আমি মনে করিয়ে দিতে চাই যে আমরা দুর্বল নই। আপনাদের কাছে আমাদের আবেদন আপনারা এইসব সমাজবিরোধীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় সমাজবিরোধীদের চিহ্নিত করুন। তাদের বর্জন করুন।

প্রচণ্ড হাততালির মধ্যে দ্বিতীয় বক্তা বলতে উঠলেন। অর্করা চুপচাপ শুনছিল। বিলু বলল, কিলার কেস গিলে হয়ে গেল।

অর্ক শিবমন্দির ছেড়ে চুপচাপ উঠে এল। এসব তার ভাল লাগছে না। আজ বাড়ি থেকে বের হবার সময় সে লুকনো জায়গা থেকে চিঠিটা বের করে এনেছে। বিলাস সোমের মুখ কয়েকদিন থেকেই অহরহ মনে পড়ছে তার। যদি হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে যান তাহলে নিশ্চয়ই এখনও বাইরে বের হবার মত শক্তি পাননি। ওকে যেদিন যেতে বলেছিলেন তারপর অনেকদিন চলে গিয়েছে। নিশ্চয়ই মনে মনে উতলা হচ্ছেন বিলাস সোম। ব্যাপারটা ওঁকে জানিয়ে দেওয়া উচিত। হারখানা হারিয়ে সে নিশ্চয়ই অন্যায় করেছে কিন্তু সেটা খুঁজে পাওয়ার জন্যে চেষ্টার ত্রুটি করেনি সে। এবং এই চিঠি পেয়ে বিলাস সোমের অবশ্যই কিছু বলার থাকবে না। মনের ভেতর যে ভারটা জমেছে সেটা হালকা হয়ে যাওয়াই ভাল।

মোড় অবধি আসতেই মনে হল শরীরটা ঝিমঝিম করছে। শরীর যে এত দুর্বল হয়ে পড়েছে তা। টের পায়নি সে। একটা পানের দোকানের পাশের রকে একটু বসল অর্ক। কপালে এর মধ্যেই ঘাম জমেছে। আশ্চর্যজনকভাবে সে অসুখে পড়ল। এরকম জ্বর তার কখনও আসেনি। জ্বরের মধ্যে নাকি অনর্গল প্রলাপ বকে গেছে। এখন তাই রকে এসেও সেটা অদ্ভুত ঠেকছে। দু লাখ টাকার কথা নাকি বারংবার বলেছে সে। বাবাকে বিকলাঙ্গ বলায় মা এককথায় ওই দু’ লাখ টাকা ছেড়ে দিয়ে এল। এই যুক্তি মায়ের মুখে শুনলেও এখনও মানতে পারছে না অর্ক। মা অনেক আগে থেকেই টাকাটা নেবে না ঠিক করেছিল। কেন? মা অন্যের কৃপা কেন নিতে চায় না? সবাই যখন ম্যানেজ করার চেষ্টা করে, হাতিয়ে নিতে চায় তখন মা নির্বিকার হয়ে ছেড়ে দিয়ে এল। এই জিনিসটা কিছুতেই বুঝতে পারছে না অর্ক। তাদের সংসারে সবচেয়ে খাটতে হচ্ছে তো মাকেই। পাঁচদিন তার জন্যে কষ্ট করে সেই মাকেই তো ধার করতে ছুটতে হচ্ছিল। চেনাশোনা কারো সঙ্গে মায়ের এই আচরণের মিল খুঁজে পাচ্ছে না অর্ক।

কিন্তু তবু মা যখন বাবার হাত থেকে টাকাটা নিয়ে খানিকটা প্রতিবাদ করেও নিশ্চিন্ত হয়ে বসল তখন তার খুব ভাল লেগেছিল। মনে হয়েছিল মাকে যদি সে প্রতি মাসে অনেক অনেক টাকা এনে দিত তাহলে মা বোধহয় আর চিন্তা করত না। কিন্তু তারপর বাবাকে বোঝাতে তার প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। মায়ের সামনে মেনে নিলেও একা পেলেই বাবা জিজ্ঞাসা করছিল, সে কোথায় টাকা পেয়েছে। সমস্ত ঘটনা মরে গেলেও সে বলতে পারতো না। শেষ পর্যন্ত অনেক ভেবেচিন্তে মিথ্যে কথাটা বলেছিল। লেকটাউনের সেই ভদ্রলোকের স্ত্রী তার চিকিৎসার জন্যে এই টাকাটা দিয়েছিল, কারণ আইন আদালত হলে ওরা অপদস্থ হতো। এই মিথ্যে কথাটা বিশ্বাস করেছিল বাবা। কারণ তারপরেই বলেছিল, ছি ছি, এভাবে টাকা নেওয়া তোর উচিত হয়নি। তোর তো কিছুই লাগেনি আর ভদ্রলোক গাড়িতে তুলে উপকারই করতে চেয়েছিলেন। তোর মা জানলে খুব কষ্ট পাবে। আরঅ্যাদ্দিন টাকাটা নিজের কাছে রেখেছিলি কেন? মাথা নিচু করেছিল সে, জবাব দেয়নি। বাবা সেটাকে হয়তো লজ্জা বলে ভেবেছিল। বলেছিল, মা টাকাটা ফেরত দিলেই তুই ভদ্রলোককে দিয়ে আসবি। এভাবে টাকা নেওয়া অন্যায়। আমাকে আবার পরমহংসকে বুঝিয়ে দিতে হবে যাতে আবার তোর মায়ের কাছে বেফাঁস না বলে বসে। কি যে করিস তুই, এভাবে ওর কাছে মিথ্যে বলতে ইচ্ছে হয় না।

রকে বসে এসব কথা ভাবছিল অর্ক। এইসময় একটা সাতচল্লিশ নম্বর সামনে এসে দাঁড়াল। সে ধীরে ধীরে পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল। মাঝারি ভিড় এখনও, যেটা টালাপার্কে গেলেই হালকা হয়ে যাবে। মাঝামাঝি জায়গায় রড ধরে দাঁড়াতেই সে খুরকিকে দেখতে পেল। জানলার ধারের একটা সিটে বসে দুলছে। খুব খারাপ চেহারা হয়ে গেছে এখন। চুল উস্কোখুস্কো, মনে হয় কদিন ঘুমোয়নি। ডাকতে গিয়েও ডাকল না অর্ক। কারণ ততক্ষণে পাকপাড়ায় বাস থেমেছে। আর স্টপেজে দাঁড়ানো লোকগুলোর মধ্যে থেকে একজন বাসের জানলার দিকে তাকিয়ে একছুটে দরজার হ্যাণ্ডেল ধরল। অর্ক বুঝল একটা কিছু হবে। সে একটু আড়াল খুঁজতে চাইল। কিলা ততক্ষণে খুরকির সামনে।

১৯. কিলাকে দেখা মাত্র

কিলাকে দেখা মাত্র খুরকির মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। আর সেই সময় কিলা খ্যাসখেসে গলায় বলল, তোর সঙ্গে আমার দরকার আছে।

খুরকির বিস্ময়ভাব খুব দ্রুত কেটে গিয়ে ঠোঁটে হাসি ফুটছিল, আব্বে কিলা, বহুদিন পরে দেখা হল গুরু! পাড়ার হালচাল কেমন?

কিলা তখনও একদৃষ্টিতে খুরকির মুখের দিকে তাকিয়ে। তার চোখ খুরকির হাতের ওপর স্থির, নেমে আয় খুরকি মাটিতে দাঁড়িয়ে হিস্যাটা বুঝে নিই।

কিসের হিস্যা? খুরকির হাত চট করে কোমরের কাছে চলে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে কিলা। চিৎকার করে উঠল, খবরদার, হাত তোল, নইলে জান নিয়ে নেব।

চিৎকার শুনে বাসের লোকজন এত ঘাবড়ে গেল যে সঙ্গে সঙ্গে ওই জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেল। যত যাত্রী সব দুপাশে চলে গিয়ে জুলজুল করে ওদের দেখতে লাগল। বাসটা এতক্ষণ ফাঁকাই ছিল কিন্তু এখন দুপাশে ভিড়ের চাপ বাড়ল। কোনরকমে অর্ক ভিড় বাঁচিয়ে একটু সরে এসে ওদের দেখতে লাগল। এখন চেষ্টা করলেও খুরকিরা ওকে দেখতে পাবে না।

.

খুরকি খুব ধীরে ধীরে হাত তুলে উঠে দাঁড়াল। ওর পাশে যে লোকটা বসেছিল সে হুড়োহুড়িতে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। খুরকিকে খুব রোগা এবং কাহিল দেখাচ্ছিল। সে কিলার মুখের দিকে তাকিয়ে শক্ত চোয়ালে বলল, এসব নকশার মানে কি?

নকশা? তুই অ্যাদ্দিন কোথায় ছিলি?

তাতে তোর দরকার কি?

সতীশদাকে কে বলেছে আমি কংগ্রেসের লাড়ু খাচ্ছি?

সে সতীশকে জিজ্ঞাসা কর, আমি কি জানি।

তুই জানিস না? আমি তোর সঙ্গে ওয়াগনের কারবারে গিয়েছিলাম।

তোকে নিলে তো তবে যাবি।

বাসটা তখন বেশ জোরে ছুটছে। স্টপেজে দাঁড়াচ্ছে কি দাঁড়াচ্ছে না! একজন কণ্ডাক্টর সাহস করে দু’পা এগিয়ে এল, গুরু বাসের মধ্যে এসব কেন করছ, পাবলিক দেখছে। সঙ্গে সঙ্গে কিলা গর্জে উঠল, হ্যাতেরি তোর পাবলিক, পাবলিকের ইয়ে করি আমি!

কথাটা শেষ হওয়া মাত্র কণ্ডাক্টর নিজের দরজায় চলে এল। কিলা কথাটা বলার সময়েও কিন্তু খুরকির দিক থেকে দৃষ্টি সরায়নি। এবার হিসহিসে গলায় বলল, আমাকে সরিয়ে তুই সিপিএমে ঢুকতে চাস?

খুরকি কাঁধ নাচাল, কোন কথা বলল না। এইসময়ে দূরে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধ মিনমিনে গলায় বললেন, কি হচ্ছে ভাই বাসের মধ্যে? কি সেইসময় ভুলটা করে ফেলল। রাগের মাথায় যেই সে মুখ ফিরিয়েছে অমনি খুরকির হাতে খুর উঠে এসেছে। চোখের কোণে সেটাকে দেখতে পেয়ে কিলা এক পা পিছিয়ে গিয়ে চিৎকার করে উঠল, খুর নামা খুরকি, জান চলে যাবে, কোন ভেড়ুয়া তোকে বাঁচাতে আসবে না। খুরকি হাসল। এখন যেন সে অনেকটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে। তার আঙ্গুলে বিশ্বাসী কুকুরের মত খুরটা লেজ নাড়ছে। হাত নেড়ে সে বলল, ফুটে যা, নইলে এটা আমার হাতে থাকবে না।

আর তখনই কিলার হাত মাথার ওপরে উঠে এল। অর্ক কিছু বোঝার আগেই কিলা প্রচণ্ড আর্তনাদ করে বাসের সিটের ওপর গড়িয়ে পড়তে পড়তেই কিছু একটা ছুঁড়ে দিল। খুরকির চিৎকার পর্যন্ত শোনা গেল না কারণ বাস কাঁপিয়ে তখন বিস্ফোরণটা বেজেছে। ড্রাইভার প্রাণপণে ব্রেক কষেছে রাস্তার পাশে গাড়ি নামিয়ে। যাত্রীরা সবাই হুড়মুড়িয়ে গাড়ি থেকে নামতে লাগল। অর্ক দেখল কিলা বাসের মেঝেয় গড়াগড়ি খাচ্ছে। রক্ত গলগলিয়ে বের হচ্ছে ওর পেট থেকে। আর খুরকি। অর্ক নিচে নেমে চোখ বন্ধ করল। এত বীভৎস দৃশ্য সে জীবনে দ্যাখেনি। হই হই করে দত্তবাগানের লোকজন ছুটে আসছিল বাসটার দিকে। মোড়ে দাঁড়ানো দুটো ট্রাফিক পুলিস ঘন ঘন হুইল বাজাচ্ছে ভিড় সরাতে। তখন আর বিস্ফোরণের ধোঁয়া নেই কিন্তু একটা কটু গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। অর্ক একটু দুরে সরে গিয়ে দাঁড়াল। পুলিস দুটো পাবলিককে বাসের ভেতর উঠতে দিচ্ছে।

কিন্তু ভেতরের দৃশ্য দেখবার জন্য পাবলিক যেন ছটফট করছে। খুরকি নেই, এটা পরিষ্কার। এক সেকেণ্ডেই হাওয়া হয়ে গেল একটা জীবন। কিলার পেটে অনেকখানি খুর টেনেছে খুরকি। নেমে আসার মুহূর্তেও মনে হয়েছিল বেঁচে আছে। এখনও আছে কিনা কে জানে। কিলা পেটো ছুঁড়েছিল অত কাছে দাঁড়িয়ে? পেটোটা কি ওর গায়েও লেগেছে? এতদিন তিন নম্বরে বহুৎ ঝামেলা হয়েছে, পেটো পড়েছে কিন্তু কখনও কোন লাস পড়তে সে নিজের চোখে দ্যাখেনি। হাতাহাতি মারামারিতে ভোগে যেতে যেতেও কি করে যেন কারোরই কিছু হয় না। কিন্তু এখানে হল। তিন নম্বরে নিশ্চয়ই খবরটা পৌঁছে যাবে হাওয়ায়। কিলা যদি মরে যায়! চোখের সামনে অর্ক মোক্ষবুড়ির মুখ দেখতে পেল। আর তখনই একটা পুলিস ভ্যান আর অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়াল বাসের পাশে। অর্ক শুনল লোকজন মুখে মুখে নানান গল্প তৈরি করছে। তার মধ্যে যে গুজবটা খুব প্রবল হল সেটা হচ্ছে এরা দুজনেই কুখ্যাত ব্যাঙ্ক ডাকাত। মানিকতলায় যে ব্যাঙ্ক ডাকাতি হয়ে। গেছে তারই ভাগ নিয়ে ঝগড়া এবং এই পরিণতি। অর্কর কোন অনুভূতি হচ্ছিল না এসব শুনে। কিলাকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হল। ওর দুটো হাত ঝুলে পড়েছে, শরীর স্থির। খুরকির জন্যে অপেক্ষা না করে অ্যাম্বুলেন্স দ্রুত আর জি করের দিকে চলে গেল। অর্কর সামনে দাঁড়ানো লোকটা বলে উঠল, কি দেখলাম মশাই, জীবনে ভুলব না, পুরো বডিটা পোড়া কিমা হয়ে গিয়েছে। এঃ।

বিরাট ট্রাফিক জ্যাম হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। পুলিস ভিড় সরিয়ে রাস্তা হালকা করছিল। অর্ক ভিড় থেকে সরে গেল। হঠাৎ সে বুঝতে পারল খুরকি মরে গেছে কিংবা মরে যাবে অথচ তার একটুও কষ্ট হচ্ছে না। কতদিন এক সঙ্গে আড্ডা দিয়েছে, নানান ফন্দী এটেছে কিন্তু খুরকি অথবা কিলা তাকে এখন একটুও টানছে না। এমনকি সে যে ওদের ভাল করে চেনে একথাও তো কাউকে বলল না। আপাতত ওদের হদিস যে কেউ জানছে না তাও তার খেয়ালে নেই। তার মানে এই যে ওদের দুজনকে সে কখনই ঠিক বন্ধু বলে গ্রহণ করেনি। ওর হঠাৎ মনে হল খুরকি এবং কিলার এরকম একটা ব্যাপার পাওনা ছিল, পেয়ে গেল। এটি এখান থেকে লেকটাউন খুব বেশী দূর নয়। কিন্তু আর হাঁটতে ইচ্ছে করছিল না অর্কর। আর একটা সাতচল্লিশ নম্বরে উঠে ও খালি জায়গা দেখে বসে পড়তেই কণ্ডাক্টর জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে দাদা?

অর্ক বলতে গিয়েও ঘাড় নাড়ল, জানে না। লোকটা বলল, তিনটে মাডার হয়েছে শুনলাম। বহুৎ খারাপ হয়ে গেল দিনকাল। অর্ক দেখল লোকটা বুড়ো এবং খুবই নিরীহ চেহারার। কিন্তু মারামারির আগে কি বলেছিল খুরকি সতীশদার কাছে লাগিয়েছে যে সে কংগ্রেসের চামচে হয়ে গেছে। অভিযোগ সত্যি না মিথ্যে তা আর প্রমাণিত হবে না কিন্তু তাতে কিলা এত খছে গেল কেন? তারপরই অর্কর কাছে কয়েকটা ব্যাপারই স্পষ্ট হল। না সত্যি, খুরকি নিশ্চয়ই চুকলি খেয়েছিল। কিলা যে সিপিএমের হয়ে কাজকর্ম করে বলে রং নিত সেটা সহ্য করতে পারত না। খুরকি। প্রায়ই বলত, আমাদের দিন এলে শালাকে জবাই করব। আবার সামনাসামনি খুব গুরু গুরু বলে খাতির করত। কি যে লোকাল থানায় একটু আধটু সুবিধে পায় তাতেই খুরকির রাগ। খুরকি ক’দিন পাড়ায় আসেনি। ওয়াগন ভাঙ্গার কাজ হলেই ও এরকম হাওয়া হয়ে যায়। সেটা এমন কিছু অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এবার টিকিট ব্ল্যাক করতে গিয়ে কিলা যখন ধরা পড়ল তখন সতীশদা তাকে ছাড়াতে যায়নি। কেন যায়নি? খুরকি কি তার আগেই সতীশদাকে বিগড়ে দিয়েছিল কিলা সম্পর্কে! এছাড়া আর কোন কারণ খুঁজে পেল না অর্ক। আর থানা থেকে বেরিয়ে কিলা পার্টি অফিসে গিয়ে ঝামেলা করে এল সতীশদার সঙ্গে। ততক্ষণে কিলা ভেগে চলে গিয়েছে। এই যে মিটিং হচ্ছে সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে জোট বেঁধে দাঁড়ানোর জন্যে তা কিলাকে কেন্দ্র করে এবং কিলা কংগ্রেসের হয়ে লাড্ড খাচ্ছে এটা জানতে পেরেই। অর্ক চুপচাপ মাথা নাড়ল। সব শালা স্বার্থের ব্যাপার। কিলা নিশ্চয়ই জানতো খুরকি এই চুকলিবাজিটা করেছে। সেটা জেনেছে বলেই খুরকিকে দেখে অমন মরিয়া হয়ে গিয়েছিল ও। এখন তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেনে আর কোন বড় রংবাজ রইল না।

বিলাস সোমের বাড়ির সামনে একটা ঝকমকে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ঘিয়ে রঙের দোতলা বাড়িটার সব ঘরেই সুন্দর পর্দা। বাগানের মুখের গেটের গায়ে কুকুর সম্পর্কিত বিজ্ঞপ্তিটা আজও চোখে পড়ল। তারপর গেট খুলে নুড়ি দিয়ে সাজানো প্যাসেজে পা রাখল। কুকুরটার নাম কি যেন? ম্যাক। ওই রকম বিশাল চেহারার সঙ্গে নামটা যেন খাপ খেয়ে গেছে। ধমকের স্বরে ওকে ডাকলেই চুপ মেরে যায়। আজ গ্রিলের ফাঁকে ম্যাকের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। বোধহয় বাড়িতে লোকজন এসেছে বলে কুকুরটাকে অন্য কোথাও সরিয়ে রাখা হয়েছে। দরজা বন্ধ। অর্ক একটু ইতস্তত করছিল, এইসময় গেট খুলে আর একজন ঢুকল। ঢুকেই প্যাসেজ দিয়ে বাড়ির অন্যপাশের ছোট দরজার দিকে যেতে যেতে তাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, কি চাই?

অর্ক লোকটাকে চিনতে পারল। একহাতে দুটো খাবারের প্যাকেট নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এই বাড়ির চাকর। কি যেন নাম, নলিন? সে হাসল, আমাকে চিনতে পারছেন?

লোকটা ঘাড় নাড়ল, না। অর্ক একটু ঘনিষ্ঠ হবার ভঙ্গীতে বলল, আপনার নাম নলিন তো? আমাকে মনে পড়ছে না? আমি সেদিন এসেছিলাম।

লোকটা বিরক্ত-গলায় বলল, আমার নাম নবীন। কাকে চাই?

বিলাসবাবু আছেন? অর্ক বিনীত গলায় প্রশ্ন করল।

বাবু অসুস্থ। বিছানায় শুয়ে আছে। কি নাম?

আমার নাম অর্ক। আমি আপনার বাবুর অ্যাকসিডেন্টের খবর নিয়ে সেদিন এসেছিলাম। বিলাসবাবুর স্ত্রী আমার সঙ্গে ট্যাক্সিতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। অর্ক বিশদভাবে বোঝাবার চেষ্টা করল।

এবার লোকটার মুখে হাসি ফুটল, অ বুঝতে পেরেছি। মেমসাহেব আজ সকালে আমাকে আপনার কাছে যেতে বলেছিলেন। ভালই হল। কিন্তু এখন যে মেমসাহেবের অনেক বন্ধুবান্ধব এসে গিয়েছে। দাঁড়ান, আমি ভেতরে গিয়ে খবরটা নিই। ওপাশের দরজা দিয়ে সুড়ং করে ঢুকে গেল নবীন। অর্ক শুনল ভেতরে বেশ সুন্দর বাজনা শুরু হল। ইংরেজি গানের সুরে, খুব মিষ্টি। মিনিট দুয়েক বাদেই নবীন ফিরে এল, আসুন, এইদিক দিয়ে আসুন।

পাঁচিলের পাশ দিয়ে যে প্যাসেজটা ভেতরে চলে গেছে যেটা টয়লেটের পাশের হোট্ট সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠেছে, নবীন তাকে নিয়ে সেদিক দিয়েই ভেতরে ঢোকাল। দুপাশে কয়েকটা ঘর, সম্ভবত স্টোর কিচেন এইসব। তার পাশ দিয়ে একটা সরু সিঁড়ি দোতলায় চলে গেছে। সেই সিঁড়ির গায়ে কুকুরটাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। বিশাল চেহারাটা পথ জুড়ে রয়েছে। বাড়ির পেছন দিক বলেই বোধহয় এপাশে লোকজন নেই। নবীন বলল, আসুন।

ম্যাক তখন কান খাড়া করে মুখ তুলেছে। অর্কর মনে হল তার শরীর অসাড় হয়ে আসছে। সেটা বুঝতে পেরে নবীন বলল, কোন ভয় নেই, চলে আসুন, ও কিছু বলবে না। একবার যাকে দেখেছে তাকে কামড়ায় না। এই ম্যাক, ম্যাক তুই চিনতে পারছিস না। জিভ দিয়ে একটা মেহজ শব্দ বের করে সে চেনটা টেনে ধরতেই অর্ক দ্রুত পাশ কাটিয়ে ওপরে উঠে এল। দোতলায় চলে এসে নবীন বলল, আপনি এই ঘরে বসুন, মেমসাহেব এখনি আসবেন।

অর্ক বলল, কিন্তু আমার যে বিলাসবাবুর সঙ্গে দরকার।

বাবু ওপাশের ঘরে আছেন। মেমসাহেব এসে নিয়ে যাবেন। ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে নবীন ছুটল। বাধ্য হয়ে অর্ক সেই ঘরে ঢুকল। এটা নিশ্চয়ই কারোর পড়ার ঘর। কারণ প্রচুর বইপত্র চারপাশে ছড়ানো। অর্ক একটা বই হাতে নিল। ইংরেজি। বেটসি। ওপরে যে মেয়েটির ছবি তার বুকের অনেকটাই দেখা যাচ্ছে। তার গায়ে ইংরেজিতে লেখা সু। অর্ক বইটা রেখে দিল। আচ্ছা, ওরা তাকে পেছনের দরজা দিয়ে ঢোকালো কেন? সামনের দরজা দিয়ে ঢোকানোই তো স্বাভাবিক ছিল। মিসেস সোম কি তার সঙ্গে পরিচয় আছে এটা ওই বন্ধুবান্ধবদের দেখাতে চান না? সম্মানহানি হবে? অর্কর মেজাজ খুব গরম হয়ে গেল। যদিও এই পথটুকু ভাঙ্গতেই তার মাথা ঝিমঝিম করছে, শরীর কাহিল হয়ে পড়েছে তবু মনে হল এখনই তার উঠে যাওয়া উচিত।

এইসময়ে সেই বিদেশী গন্ধটা নাকে এল এবং পরক্ষণেই, দরজায় মিসেস সোম। ও মা, কি সৌভাগ্য। এতদিনে আসার সময় হল!

অর্ক রাগতে গিয়েও রাগতে পারল না। মিসেস সোমকে এখন খুব সুন্দরী দেখাচ্ছে। হালকা কলাপাতা রঙা জমির ওপর গাঢ় সোনালী চওড়া পাড়ের সিল্ক শাড়ি, যেন শরীর নিকিয়ে জ্যোতি বের করে এনেছে। গায়ের কালো ব্লাউজ এত সংক্ষিপ্ত যে ঘিয়েরঙা চামড়া আর একটা রঙের মাদকতা ছড়াচ্ছে। অর্ক হাসল।

সুরুচি সোম বললেন, কি মুশকিল ভাই, আজ আবার আমার কিছু বন্ধু এসে হাজির। নিচে যা হল্লা হচ্ছে না, তোমার সঙ্গে জমিয়ে গল্প করব তার উপায় নেই। কিন্তু তোমাকে এত রোগা দেখাচ্ছে কেন?

অসুখ হয়েছিল। অর্কর নিঃশ্বাস সুগন্ধে ভারী হয়ে এল।

ইস! আমি তো ভেবে ভেবে সারা, ছেলের আবার কি হল? কাছে দাঁড়িয়ে অর্কর চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন সুরুচি সোম পরম স্নেহভরে। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল তার। চটপট বলল সে, উনি কেমন আছেন?

কে, বিলাস? ফাইন। খুব চটপট রিকভারী করছে। ডাক্তার বলেছে একমাস বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে, ড্রিঙ্ক করা চলবে না। খুব জব্দ হয়েছে। তুমি ওর সঙ্গে দেখা করবে?

কিন্তু আর একদিন এসো। এই ধরো সকাল সকাল- মিসেস সোমের কথা শেষ হওয়া মাত্র দরজায় আর একজন এসে দাঁড়ালেন। অর্ক দেখল ভদ্রমহিলা মধ্যবয়সিনী, বেশ মোটাসোটা কিন্তু পোশাকে খুব আধুনিকা। মুখে যথেষ্ট প্রলেপ থাকা সত্ত্বেও একটা রুক্ষতা ছড়িয়ে আছে।

কি ব্যাপার? মিসেস নোম একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন যেন একে দেখে।

হঠাৎ কোথায় পালালে তাই দেখতে এলাম। এ কে? চোখের ইশারায় অর্ককে দেখিয়ে দিলেন মহিলা।

ও হল, ও হল–সুরুচি সোম ভেবে পাচ্ছিলেন না কি বলবেন।

মেয়ের বন্ধু? অর্কর দিকে তাকালেন ভদ্রমহিলা।

না, না, সুয়ের সঙ্গে ওর আলাপ নেই। আসলে ও আমাদের খুব পরিচিত।

আই সি! খুব হ্যাণ্ডসাম। তোমার আত্মীয় নয়?

না, না।

তা নিজের কাছে লুকিয়ে রেখেছ কেন, আমাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দাও। আমরা এমন কিছু বুড়ো হয়ে যায়নি যে ইয়ংদের সঙ্গে মিশতে পারব না। চোখ ঘুরিয়ে দুই কাঁধ নাচালেন মহিলা।

বিব্রত হয়ে পড়েছেন মিসেস সোম। তারপর অর্ককে দেখিয়ে বললেন, এ আর ইয়ং হল কোথায়, এখনও বাচ্চা ছেলে বলা যায়।

বাচ্চা ছেলে? তাহলে আমার চোখে ছানি পড়েছে ভাই। দেখি নাক টিপলে দুধ বের হয় কিনা! ভদ্রমহিলা একপাও এগোলেন না কিন্তু বলার ভঙ্গীটা এমন মজার যে হেসে ফেলল অর্ক। মিসেস সোম কিন্তু হাসলেন না। তবে এবার পরিচয় করিয়ে দিলেন, শানুদি, এ হল অর্ক। বিলাসের সঙ্গে পরিচয় আছে। অ্যাকসিডেন্টের সময় ওর গাড়িতে ছিল। খুব ভাগ্য যে বেঁচে গেছে। আর অর্ক না থাকলে বিলাসের খবর জানতে পারতাম কখন তা কে জানে।

আচ্ছা! খুব ইন্টারেস্টিং। তুমি বিলাসের সঙ্গে গাড়িতে ছিলে?

অর্ক মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়ল। মিসেস সোম বললেন, অর্ক, ইনি হলেন শানুদি। আমাদের খুব বন্ধু। ল্যান্সডাউনে থাকেন। পরিচিতি দেবার পর শানুদি মুখটা সামান্য নামিয়ে ওর দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে থাকলেন। ওই রুক্ষ মুখেও কিছুটা পেলব ব্যাপার যেন আনতে চাইছেন মহিলা। অর্কর খেয়াল হল। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার কোন প্রশ্নই ওঠে না, সে উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করল। শানুদি সেটা গ্রহণ করেছেন এমনভাবে মাথা নেড়ে বললেন, বাঃ, চমৎকার ফিগার! আমার চেয়েও লম্বা? তোমাকে ভাই তুমি বলছি। কোথায় থাকো?

বেলগাছিয়ায়।

অ। কি কর? পড়ছ?

হ্যাঁ।

নাচতে পারো?

নাচ? না, না।

আই সি, গান গাইতে পারো?

না।

তাহলে কি পার?

এইসময় মিসেস সোম হেসে ফেললেন, শানুদি, ও কিছু চেপে যাচ্ছে। আমার বিশ্বাস ও খুব ভাল নাচতে পারে। তবে সেটা পাবলিক ড্যান্স। আর ওর একটা ল্যাঙ্গুয়েজ জানা আছে যার অনেক শব্দের মানে আমি নিজেই জানি না। শুনলে রাগ হয় আবার মজাও লাগে।

ওমা, তাই? গালে হাত রাখলেন শানুদি! তাহলে তো তোমাকে ছাড়ছি না। সুরুচি, ওকে নিচে নিয়ে চল, বেশ জমবে।

মিসেস সোম যেন বাধ্য হয়ে রাজি হলেন। বললেন, চল অর্ক নিচে আমাদের আরও দুজন বন্ধু আছেন, আলাপ করবে চল।

এইসময় নবীন এসে দাঁড়াল, মেমসাহেবরা আপনাদের ডাকছেন। শানুদি ব্যস্ত হয়ে বললেন, সুরুচি, আমি এগোচ্ছি, তুমি ওকে নিয়ে এস। খুব অবাক হয়ে যাবে সকলে। ব্যস্ত হয়ে শানুদি চলে গেলেন।

মিসেস সোম নবীনকে বললেন, প্রত্যেককে খাবার দিয়েছ?

হ্যাঁ, মেমসাহেব।

ঠিক আছে, তুমি যাও। নবীন চলে গেলে মিসেস সোম বললন, চল, নিচে যাই। এরা খুব বড়লোক, প্রচুর জানাশোনা। তবে তুমি বেশী মিশো না এদের সঙ্গে। ওই যে শানুদিকে দেখলে, অল্প বয়সী ছেলে দেখলে মুণ্ড না চিবিয়ে ফেলা পর্যন্ত তাঁর শান্তি নেই। তোমাকে আমার কাছে দেখেছে, এখন না নিয়ে গেলে সবাইকে বলে বেড়াবেন আমিও–। চল।

বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ অর্ক দাঁড়িয়ে পড়ল, উনি কোন ধরে আছেন? আমি একটু দেখা করেই চলে যাব।

স্পষ্ট বিরক্তি বোঝালেন মিসেস সোম। তারপর সামনের পর্দাঝোলা ঘরটাকে দেখিয়ে বলনে, ওই ঘরে। দেখা করেই সোজা নিচে চলে আসবে। আর যদি দ্যাখো ঘুমিয়ে আছে তাহলে একদম কথা বলবে না।

অর্ক ঘাড় নাড়তেই মিসেস সোম নিচে নেমে গেলেন। পর্দা সরিয়ে মুখ বাড়াতেই নীলচে আলোর ঘরটাকে দেখতে পেল। ওপাশের জানলার গায়ে যে খাট সেখানে বিলাস সোম শুয়ে আছেন। এর মধ্যে মশারি টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর মাথার পাশে একটা ইজিচেয়ারে বসে একজন নার্স বই পড়ছেন। অর্ককে দেখে নার্স মুখ তুলতেই অর্ক জিজ্ঞাসা করল, উনি কি ঘুমাচ্ছেন?

নার্স কিছু বলার আগেই বিলাস বললেন, না। কে?

অর্ক ধীরে ধীরে বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল। হালকা নীল নাইলনের মশারি যত স্বই হোক কেমন একটা অস্বস্তির আড়াল থাকে। ভেতরের মানুষ যে সুবিধে পায় বাইরে যে দাঁড়ায় সে তা পায় না। তবু অর্ক বিলাস সোমের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি অর্ক। আপনার অ্যাকসিডেন্টের সময় ছিলাম।

ও! তুমি! তোমার তো অনেক আগে আসার কথা ছিল। বিলাস কথা বলতে বলতে নার্সের দিকে তাকালেন, আপনি একটু বাইরে ঘুরে আসুন। ওর সঙ্গে আমার কিছু কথাবার্তা আছে।

নার্স বললেন, আপনার বেশী কথা বলা নিষেধ আছে। তারপর ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। তার চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে হাত বাড়ালেন বিলাস সোম, কই, দাও।

বিছানার সঙ্গে প্রায় মিশে গেছেন ভদ্রলোক। মুখ চুপসে রয়েছে। মাথায় এখনও ব্যাণ্ডেজ এবং চুলগুলো ছেটে দেওয়া হয়েছে। অর্ক বলল, আপনি কবে সুস্থ হয়ে উঠবেন?

আরও দিন পনের। আমার যন্দুর মনে পড়ছে তুমি আমাকে সেদিন বলেছিলে যে হারখানা তুমি পেয়েছ? বলনি? বিলাস সোম জিজ্ঞাসা করলেন।

অস্বীকার করার কোন কারণ নেই। অর্ক বলল, হ্যাঁ।

এবার মুখে হাসি ফুটল বিলাস সোমের। আমি কদিন থেকে ভাবছিলাম সেদিন কি আমি ভুল বুঝেছি! তুমি যদি অস্বীকার কর তাহলে আমার কিছুই করার থাকবে না। তুমি তিন নম্বর ঈশ্বর পুকুর লেনের বস্তিতে থাকো?

হ্যাঁ।

তোমাকে দেখে তো ভদ্রলোকের ছেলে বলে মনে হয়।

বস্তিতে যারা থাকে তারা ভদ্রলোক নয় একথা আপনাকে কে বলল?

অবস্থা খারাপ হলে কেউ ওখানে থাকতে পারে। আমি তোমাকে আঘাত করতে চাইনি। যাক, হারখানা এনেছ?

না।

সেকি! আন নি কেন?

ওটা যার হার তিনি নিয়ে নিয়েছেন।

কে নিয়েছে? কার হার ওটা? তুমি সুরুচিকে দিয়েছ? প্রশ্নগুলো করার সময় উত্তেজিত হয়ে পড়লেন বিলাস সোম।

না। অর্ক তাড়াতাড়ি বলল, এই নিন চিঠি। তৃষ্ণা পালের লেখা সেই চিঠিটা বের করে মশারি ফাঁক করে বিলাস সোমের হাতে দিল সে।

খুব অবাক হয়ে গেলেন বিলাস। তারপর ভাঁজ খুলে বললেন, এ কার চিঠি? তুমি ওই আলোটা জ্বেলে দাও।– অর্ক খাটের পাশে ঝোলা সুইচটা টিপতেই বেডল্যাম্প জ্বলে উঠল। এবার চিঠিটা পড়লেন বিলাস। অর্ক দেখল পড়া শেষ করে বিলাস সোম ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে শুয়ে রইলেন। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি ওকে চিনলে কি করে? হারখানাই বা ও পেল কোথায়?

অর্ক খানিক ইতস্তত করল। তারপর মনে হল এই অসুস্থ মানুষটাকে সব কথা খুলে বলে দেওয়াই ভাল। সে ধীরে ধীরে সমস্ত ঘটনাটা বলল।

বিলাস সোমের মুখে এখন বিস্ময়। তারপর নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি আমার কাছে কিছু চাও? সঙ্কোচ করো না।

না, না। অর্ক প্রতিবাদের ভঙ্গিতে বলল।

অদ্ভুত। যার হার তার কাছেই যখন সেটা পৌঁছে গিয়েছে তখন! কিন্তু এসব কথা কাকে কাকে বলেছ তুমি?

আমি কাউকেই বলিনি।

গুড, বিলাস সোমের মুখে হাসি ফুটল, এই ঘরে তোমায় কে নিয়ে এল?

আপনার স্ত্রী।

সুরুচি তোমাকে নিয়ে এল? স্ট্রেঞ্জ! ওর তো নিচে গেস্ট এসেছে!

হ্যাঁ। শানুদি আমাকে নিচে যেতে বলেছেন।

শানুদি! তার সঙ্গেও আলাপ হয়েছে। বয়-ইটার। খুব সাবধানে ওর সঙ্গে মিশবে। মেশার দরকারই বা কি! এ বাড়ির একটা পিছন-দরজা আছে, সেইটে দিয়ে তুমি চলে যাও। আমি তোমার সঙ্গে পরে যোগাযোগ করব। বিলাস সোম চিঠিটাকে ভাঁজ করে নিলেন।

আমি চলে গেলে উনি রেগে যাবেন না? অর্ক ইতস্তত করল।

সেটাও একটা কথা বটে। ঠিক আছে, তুমি নিচে যাও। আর হ্যাঁ, তুমি তো আমার জন্যে অনেক করলে, এ খবরটাও যেন সুরুচি জানতে না পারে। আর, তুমি কি ওর কাছে যাবে? বিলাসের গলায় সঙ্কোচ।

না।

ও। তবে তোমাদের বস্তিতে যে মেয়েটি থাকে তাকে দিয়ে তৃষ্ণাকে একটা খবর পাঠিয়ে দিও। আমি একটু সুস্থ হলেই ওর সঙ্গে দেখা করব। এরা আমার ঘরে টেলিফোনটাকেও রাখেনি। আমি তোমার ঋণ শোধ করব, বুঝলে! বিলাস সোম হাত বাড়াচ্ছিলেন ওর দিকে এমন সময় নার্সের সঙ্গে নবীন ঘরে ঢুকল, বাবু, মেমসাহেব ওঁকে নিচে যেতে বলেছেন।

বিলাস ঘাড় নেড়ে চোখ বন্ধ করলেন। অর্ক লক্ষ্য করল নবীন একে বাবু বলছে কিন্তু মিসেস সোমকে মেমসাহেব। কেন? এই পার্থক্য কেন?

অর্ক নবীনের পেছন পেছন বাইরে বেরিয়ে আসতেই নার্স তার জায়গায় ফিরে গেল। অর্ক নবীনকে বলল, তোমার বাবু তো এখন ভাল হয়ে গেছে।

নবীন মাথা নাড়ল, কোথায় আর ভাল। পিঠের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিল যে। অপারেশন হয়েছে তবে কোনদিন খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারবেন না বলে শুনেছি।

অর্ক স্তম্ভিত হয়ে গেল। বিলাস সোম কি এ খবর জানেন না? নিশ্চয়ই অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু উনি এমনভাবে কথা বললেন যেন পনের দিন বাদেই বাইরে বের হচ্ছেন! অর্ক এর কোন মানে বুঝতে পারছিল না।

সিঁড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে নবীন ফিরে গেল। এই সিঁড়িটা বেশ চওড়া। বাঁক ঘোরার আগেই কানে বাজনার শব্দ আসছিল। খুব দ্রুত তালে বাজনা বাজছে। যে বাড়ির কর্তা অমন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে সে বাড়িতে এত বাজনা কি করে বাজছে! অর্কর মাথায় কিছুই ঢুকছিল না। এ বাঁক ঘুরতেই ঘরটাকে দেখতে পেল। আর মানুষগুলোকে। বাজনার তালে তালে তিনজন বয়স্কা মহিলা নাচার চেষ্টা করছেন মুখে শব্দ করে। ওকে দেখা মাত্র শানুদি চিৎকার করে সঙ্গীদের থামতে বললেন, স্টপ, স্টপ। গেজ, হু ইজ কামিং!

২০. চারজোড়া চোখ তখন অর্কর ওপর

চারজোড়া চোখ তখন অর্কর ওপর স্থির। চারটে বয়স্কা শরীরের কাপড় আলুথালু ও প্রত্যেকটা মুখে কড়া প্রসাধন। একমাত্র মিসেস সোম ছাড়া কেউ দেখতে ভাল নন কিন্তু উগ্রতা দিয়ে সেটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা প্রকট। ঘরের কোথাও স্টিরিওতে উদ্দাম ঢেউ উঠছে বিদেশী সুরের। এই বাড়িতে যে একজন মানুষ অসুস্থ হয়ে শুয়ে রয়েছে তা যেন কারো মনেই নেই।

এ গুড কালেকশন! রোগামতন একজন মহিলা ভুরু তুললেন যাঁর বুকের আঁচল মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। মিসেস সোম ঠোঁট ছোট করলেন, তোমরা ভুল করছ। বিলাসের সঙ্গে গাড়িতে ছিল, আমাকে খবর দিয়েছে, এইটুকুই সম্পর্ক!

যে ভদ্রমহিলা ওপরে গিয়েছিলেন তিনি হাত নাড়লেন, আঃ, তোমাকে আর অজুহাত দেখাতে হবে না। তুমি যা বলেছ তা যদি সত্যি হয় তাহলে বেশ এনজয় করা যাবে। ডাকো ওকে।

মিসেস সোম এবার হাসলেন, এসো অর্ক। এরা তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান। ইনি মিসেস গুপ্তা, মিসেস চ্যাটার্জী আর এর সঙ্গে তো তোমার আলাপ করিয়ে দিয়েছি।

ভদ্রমহিলা চোখ ঘুরিয়ে বললেন, আমাকে শানুদি বলে ডেকো। আঃ, ওরকম ক্যাবলার মত দাঁড়িয়ে আছ কেন? অ্যাই, স্টিরিওটা কমিয়ে দাও তো! আমরা সবাই বিলাসের ভাল হয়ে ওঠা সেলিব্রেট করছি, বুঝলে?

উনি তো ভাল হয়ে ওঠেননি! অর্কর মুখ ফসকে বেরিয়ে এল। শানুদি কাঁধ নাচিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে সুরুচির দিকে তাকালেন। সুরুচি এমন ভাবে হাসলেন যেন কোন শিশুর মুখে চপল বাক্য শুনলেন। ওই এক বাতিক হয়েছে, বিলাস-এর বদ্ধ ধারণা ও ভাল হয়নি। যে কাছে যাবে তাকেই একথা বোঝাবে। আচ্ছা তোমরা বল, যে মানুষটার জীবনের কোন আশাই ছিল না, ডাক্তাররাও হাল ছেড়ে দিয়েছিল সে আবার বাড়ি ফিরে এসেছে বই পড়ছে পাঁচটা কথা বলছে–এটা ভাল হয়ে ওঠা নয়? হ্যাঁ, এখনই হাঁটাচলা করতে পারবে না কিন্তু, ছয়মাস বাদে আর একটা অপারেশন হয়ে গেলেই সেটা পারবে।

মিসেস গুপ্তা বললেন, পুরুষমানুষ যতক্ষণ ঘরের বাইরে যেতে না পারছে ততক্ষণ নিজেকে অসুস্থ ভাবে।

শানুদি বললেন, বিলাস ড্রিঙ্ক করছে?

সুরুচি যেন আঁতকে উঠলেন, ওমা, এখনই ড্রিঙ্ক করবে কি?

শানুদি এগিয়ে গিয়ে সোফায় বসলেন, একটু একটু করে দিতে পারো। লোকটা মদ খেতে তো খুব ভালবাসতো। তাছাড়া ওর লিভারে যখন কিছু হয়নি তখন অল্প দিতে পারো। তাহলে দেখবে নিজেকে আর অসুস্থ ভাববে না বিলাস। ওমা, এ ছেলে যে ক্যাবলার মত দাঁড়িয়েই রইল।

মিসেস গুপ্তা এগিয়ে এসে অর্কর হাত ধরলেন, এসো ভাই, ক্যাবলাই ভাল, ওইসব ছুঁচোমুখো স্মার্ট ফড়িংদের আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না। বাইরেই যত ভড়ং ভেতরটা ফাঁপা।

মিসেস চ্যাটার্জী ঘাড় নাড়লেন, যা বলেছ। এরা বরং অনেক ফ্রেস। মাটির জিনিস টাটকা হবেই।

মিসেস গুপ্তা অর্ককে শোফায় বসিয়ে দিলেন। শানুদি বললেন, ওকে একটু ইজি হতে দাও। স্টিরিওটা বাড়িয়ে দাও সুরুচি। তারপর হাত বাড়িয়ে একটা সাদা বোতল টেনে নিলেন। অর্ক দেখল বোতলটার গায়ে ইংরেজিতে ভোদকা লেখা রয়েছে। ওটা যে মদ তা বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। খুরকিদের শিবমন্দিরে রকে বসে অনেক বোতল খেতে দেখেছে সে। তবে সেগুলোর চেহারা অন্যরকম, বিটকেল গন্ধ ছাড়ে। এই যে শানুদি গ্লাসে ঢেলে নিলেন সে কোন গন্ধই পেল না। না দেখলে কে বলবে ওটা জল নয়। ওপাশে আবার বাজনা উত্তাল হয়েছে। মিসেস গুপ্তা এসে ওর পাশে বসলেন, কোথায় থাকো তুমি?

বেলগাছিয়ায়। অর্ক মহিলার দিকে তাকাল। গলার লাল শিরা দেখা যাচ্ছে। চামড়ায় যেন কুঞ্চন এসেছে। কিন্তু তার ওপর পুরু মেকআপ থাকায় চট করে বোঝা যায় না। সেই মেকআপ নামতে নামতে বুকের জামার তলায় চলে গেছে। অর্কর মনে হল এরা বোধহয় সর্বাঙ্গে মেকআপ করেন। কত পাউডার খরচ হয় রোজ কে জানে।

এখান থেকে খুব দূরে? মিসেস গুপ্তার চোখ টানটান। গলার স্বর বেশ মিষ্টি। অর্কর মনে হল মাধবীলতার চেয়ে অনেক বড়, বয়সে।

না, বেশী দূরে নয়।

খুব ঘন ঘন আসো তুমি এ বাড়িতে?

না। আজ দ্বিতীয়বার এলাম।

ওমা, সুরুচির মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়নি?

না।

তুমি খুব ভাল ছেলে! গুড বয়! আঙ্গুলের ডগা দিয়ে অর্কর চিবুকে টোকা দিলেন মিসেস গুপ্তা। সঙ্গে সঙ্গে শানুদি প্রতিবাদ জানালেন, উঁহু। ডোন্ট ক্রশ দ্য লাইন। মিনিমাম একটা সৌজন্য রাখতে হবে, কি বল সুরুচি! তোমরা কেউ ড্রিঙ্ক নিচ্ছ না যে!

মিসেস চ্যাটার্জী হাত নাড়লেন, চারটে নিয়েছি। আর না।

শানুদি ফুঃ জাতীয় শব্দ করলেন জিভে তারপর এক চুমুকে গ্লাসের বাকি তরল পদার্থ গলায় ঢেলে উঠে দাঁড়ালেন, আমার ভীষণ নাচতে ইচ্ছে করছে।

অর্ক তাঁর বিশাল নিতম্বের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল। মিসেস সোম চোখ ফেরাতেই বলল, এবার আমি যাই!

সুরুচি যেন বুঝতে পারলেন, তুমি যাবে? বেশ তো।

যাবে মানে? ওর জন্যে আমরা এতক্ষণ নষ্ট করলাম আর ও চলে যাবে? তাছাড়া ওর সেইসব কথাবাতাই তো শুনলাম না এখনও। মিসেস গুপ্তা প্রতিবাদ করলেন, তুমি বসো, আমি বলছি বসো।

অর্ক কোনরকমে বলল, কিন্তু আমি এখানে কি করব?

মিসেস গুপ্তা বললেন, কিছু করতে হবে না তোমাকে। আগে বল, আমাদের তোমার ভাল লাগছে কি না? খুব খারাপ মানুষ আমরা?

না, আমি সেকথা বলিনি। আসলে আমার খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে।

দেরি হয়ে যাচ্ছে? একদিন নাহয় হ’ল। তাছাড়া আমাদের সঙ্গে গাড়ি আছে। তোমাকে পৌঁছে দেওয়া যাবে। বসো তুমি। হাত ধরে জোর করে বসিয়ে দিলেন মিসেস গুপ্তা। অর্ক কি করবে বুঝতে পারছিল না। ওদিকে বাজনা উত্তাল হয়েছে। শানুদি তাঁর বেঢপ শরীর নিয়ে নাচার চেষ্টা করছেন ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। অর্কর মনে হল এরকম কুৎসিত দৃশ্য জীবনে দ্যাখেনি সে। তিন নম্বরের কোন ছেলে নাচ শেখে না কিন্তু তারা এর চেয়ে অনেক ভাল নাচতে পারে। পুজোর সময় বা কোন মিছিলে বিলু কোয়া যা নাচে তা এর চেয়ে ঢের সুন্দর। শানুদি শরীর কাঁপাবার চেষ্টা। করছেন আর বাকি তিনজন খুব হাততালি দিচ্ছেন। হঠাৎ শানুদি ঘুরে বললেন, বাঃ, আমি একা একা নাচব নাকি? তোমরা কেউ এসো, কাম অল। হাত নাড়লেন শানুদি।

মিসেস গুপ্তা মাথা নাড়লেন, ও গড! আমি পারব না।

আমিও। মিসেস চ্যাটার্জী চোখ বন্ধ করলেন, বড় হাই হয়ে গেছি।

সুরুচি সোম বললেন, বেশ তো নাচছে, নাচো না।

না। একা নেচে সুখ নেই। শানুদি টলতে টলতে এগিয়ে এলেন, এই ছেলে, তুমি নাচতে পারো না? এসো নাচি।

অর্ক বলল, আমি পারি না। আর আপনিও নাচ জানেন না। সঙ্গে সঙ্গে গালে হাত দিলেন শানুদি, ওমা! একি বলে গো! জানো আমি এককালে কত প্রাইজ পেয়েছি নাচের জন্যে। আর একবার বললে তোমার গালে আমি একটি চড় মারবো।

আর সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা বিগড়ে গেল অর্কর। চোয়াল শক্ত করে বলল, মুখ সামলে কথা বলবেন। এসব বাতেলা অন্য লোককে দেখাবেন।

মিসেস গুপ্তা প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়লেন ওর গায়ে, কি বললে, কি বললে?

অর্ক চেষ্টা করল ওঁকে ঝেড়ে ফেলতে, সরুন তো।

শানুদি তখন চোখে চোখ রেখেছেন, খুব মাস্তান বলে মনে হচ্ছে?

অর্ক ফুঁসে উঠল, মাস্তানি তো আপনি করছেন। ওরকম রংবাজি আমার সঙ্গে দেখাতে আসবেন না। চড় মারা অত সস্তা নয়।

তুমি কি বলতে চাও?

কিছুই চাই না। অনেক বাতেলা করেছেন এবার ছেড়ে দিন আমাকে। অর্ক কথা শেষ করা মাত্রই শুনল হাসির ঝড় উঠল ঘরে। মহিলারা হেসে এ ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ছেন। অর্কর রাগ চট করে মিলিয়ে গেল। সে হতভম্বের মত এদের দেখতে লাগল। কোত্থেকে কি হল সে বুঝতে পারছে না। তার মধ্যেই শানুদি চেঁচিয়ে উঠলেন, ফাইন, ফাইন।

মিসেস সোম কোনরকমে হাসি থামিয়ে বলে উঠলেন, কি! ঠিক বলেছি কিনা। আমার তো সেদিন কথাবার্তা শুনে চোখ কপালে উঠেছিল।

কি যেন বলেছিল তোমাকে? মিসেস গুপ্তা দম নিতে নিতে জিজ্ঞাসা করলেন!

ন্যাকড়াবাজি। তখন থেকে আপনি ন্যাকড়াবাজি করছেন। অর্কর গলা নকল করে লাইনটা বলার চেষ্টা করতেই আবার হাসির হুল্লোড় উঠল। তার মধ্যেই শানুদি অর্কর পাশে এসে বসলেন, কথাটার মানে কি ভাই?

কি কথা?

ওই যে, মুখে হাত চাপা দিলেন শানুদি, ন্যাকড়াবাজি!

ন্যাকড়াবাজি মানে বিলা করা।

বিলা করা? আবার খিল খিল হাসির ফোয়ারা ছিটকালো। এবং তখনই রহস্যটা বুঝতে পারল অর্ক। ওরা তার মুখে তিন নম্বরের শব্দগুলো শুনে খুব মজা পাচ্ছে। তার মানে, তাকে উত্তেজিত করার জন্যেই শানুদি তখন চড় মারার কথা বলেছিল? সুরুচি কি ওর ভাষা নিয়ে আগেই এদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন? নিশ্চয়ই!

শানুদি বললেন, তোমাকে তো ছাড়ছি না ভাই। আমাদের এসব কথা শেখাতে হবে। তারপর মিসেস চ্যাটার্জীর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলেন, আমি আবার ন্যাকড়াবাজি শব্দটার মানে অন্যরকম ভাবছিলাম।

তুমি একটা যা তা–। মিসেস চ্যাটার্জী ব্লাশ করার চেষ্টা করলেন।

আহা! তোমরা যেন ভাবোনি! তা ভাই বিলা কথাটার মানে কি?

অর্ক হঠাৎ আবিষ্কার করল এদের কাছে তার মূল্য বেশ বেড়ে গেছে। তিনজনেই তাকে ঘিরে বসে আছে। মিসেস সোম সামান্য দূরে। একবার তিন নম্বরের শিবমন্দিরে একজন সাধু এসেছিল। সেই সাধুর পায়ের তলায় তিন নম্বরের বুড়িগুলো এইরকম ভঙ্গীতে একটু কৃপা পাওয়ার জন্যে বসে থাকতো। নিজেকে এখন সেই সাধুটার মত মনে হচ্ছিল তার। এই সুযোগটা ছাড়া যায় না। সে গম্ভীর গলায় বলল, ঢ্যামনাগিরি করা।

আবার হাসি ছড়ালো। মিসেস গুপ্তার শরীর কাঁপতে কাঁপতে অর্কর কোলের ওপর পড়ে যেতেই শানুদি তাঁকে খোঁচা দিলেন, অ্যাই, অমন করো না। প্রথম দিনেই ছেলেটাকে ঘাবড়ে দিচ্ছো! ওঠো ওঠো।

মিসেস গুপ্তা কোনরকমে উঠে বসতেই অর্ক হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। মিসেস চ্যাটার্জী শিক্ষার্থীর ভঙ্গীতে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা ভাই, কেউ যদি খুব ঝামেলা করে, তোমাকে ডিস্টার্ব করে তাহলে সেটাকে কি বলবে?

অর্ক একটু চিন্তা করল। কিলা-খুরকিদের ভাষাগুলো মনে করার চেষ্টা করল। দুজনেই শালা মায়ের ভোগে চলে গেছে এখন! তারপর গম্ভীর গলায় বলল, ঝামেলা করা মানে কিচাইন করা।

কিচাইন। মিসেস চ্যাটার্জী শব্দটা দুতিনবার আওড়ে নিয়ে বেশ গর্বের গলায় বললেন, আজই কর্তার মুখের ওপর বলতে হবে ডোন্ট মেক কিচাইন উইদ মি। শব্দটার মধ্যে বেশ জোর আছে, না?

প্রায় একঘণ্টা ধরে ওই ঘরে হাসির তুবড়ি ফাটলো। অর্ক ততক্ষণে ব্যাপারটা কবজা করে নিয়েছে। এই প্রৌঢ়া মহিলারা রকের ভাষা শুনে নিজেরাই কিলবিল করছে। অর্ক যতটা জানে ততটাই ওদের প্রশ্নের উত্তরে বলে যাচ্ছিল। ক্রমশ প্রশ্নগুলো নরনারীর প্রেম এবং শারীরিক সম্পর্কের ধার ঘেঁষে চলে এল। এর অনেক শব্দ অর্ক জানে না। কিন্তু সে বুঝতে পেরেছিল যে অজ্ঞতা দেখালে এরা খুব হতাশ হবেন। অতএব যা মনে আসে তাই বলে যেতে লাগল সে। শেষ পর্যন্ত শানুদি বললেন, ওঃ ফাইন। দারুণ জমেছিল আজ। সুরুচি তুমি কিন্তু খুব স্বার্থপরের মত এতবড় একটা অ্যাসেট লুকিয়ে রেখেছিলে। আর ওকে ছাড়া হচ্ছে না।

মিসেস গুপ্তা বললেন, এর পরের দিন আমার বাড়িতে এসো সবাই। অর্ক, তুমিও আসবে। তোমাকে বাদ দিয়ে আমি পার্টির কথা ভাবতেই পারছি না।

মিসেস চ্যাটার্জী বললেন, আমার ওখানে করে আসছ?

শানুদি বললেন, আরে বাবা হবে হবে। অর্ক তো পালিয়ে যাচ্ছে না। আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। গ্র্যাণ্ড হয়।

মিসেস গুপ্তা সন্দিগ্ধ গলায় প্রশ্ন করলেন, কি আইডিয়া?

আমরা তো সামনের মাসে দার্জিলিং-এ যাচ্ছি, অর্ক চলুক না আমাদের সঙ্গে। খুব জমবে তাহলে। ও থাকলে আমাদের আরও অনেক উপকার হবে, তাই না? শানুদির গলা অন্যরকম শোনাল।

ফাইন, ফাইন। চিৎকারগুলো শানুদিকে সমর্থন করল। কিন্তু মিসেস সোম মাথা নাড়লেন, তোমরা একটা ব্যাপার কিন্তু একদম ভাবছ না। বাড়ি থেকে পারমিশন না পেলে ও বেচারা যাবে কি করে।

শানুদি বলল, সেটা ও নিশ্চয়ই ম্যানেজ করতে পারবে। জোয়ান ছেলে বলে কথা। কিগো তুমি ম্যানেজ করতে পারবে না?

দেখি।

দেখাটেখা চলবে না। তোমাকে আমাদের সঙ্গে যেতেই হবে। যদি দরকার হয়, আমি গিয়ে তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলব। শানুদি জানালেন।

মিসেস গুপ্তা জিজ্ঞাসা করলেন, কে কে আছে বাড়িতে?

মা আর বাবা।

চমৎকার! তুমি কখনও কলকাতার বাইরে গিয়েছ?

না।

আঃ দারুণ! একদম ফ্রেস ফ্রম সয়েল। ও সুরুচি! তুমি একটা দারুণ ডিসকভারি করেছ। মিসেস গুপ্তা পুলকিত হলেন।

কিন্তু ওর পড়াশুনা। মিসেস সোমের আপত্তিটা স্পষ্ট।

সাত দিন না পড়লে এমন কি মহাভারত অশুদ্ধ হবে? এই যে তোমার মেয়ে স্কুলের সঙ্গে বাইরে গেছে, ওর পড়াশুনা খারাপ হয়ে যাবে? শানুদি প্রতিবাদ জানালেন।

তখনই পার্টি ভেঙে গেল। প্রত্যেকেই অর্ককে ঠিকানা টেলিফোন নম্বর দিলেন। অর্ক নিজের ঠিকানাটা বলতে কেউ চিনতে পারল না। কিন্তু সবাই প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিল যেন অর্ক আগামী সপ্তাহে শানুদিকে টেলিফোন করে।

মিসেস সোম ওদের গেট অবধি এগিয়ে দিতে গেলেন। অর্ক লক্ষ করছিল প্রত্যেকেরই নেশা হয়েছে। খুব জোরে কথা বলছে সবাই। গাড়ির কাছে এসে মিসেস গুপ্তা বললেন, শানুদি, আমি অর্ককে কথা দিয়েছি বাড়িতে পৌঁছে দেব, তুমি রাস্তাটা জেনে নাও।

শানুদি ঠাট্টার গলায় বললেন, ওবাব্বা! এর মধ্যেই গোপনে গোপনে কথা শুরু হয়ে গেছে! তা কোনদিক দিয়ে যেতে হবে ভাই?

অর্ক বলল, টালা পার্ক বেলগাছিয়া দিয়ে।

গড়। ওটা তো খুব খারাপ রাস্তা। ভি আই পি ছাড়া এদিকে আসা যায় না। ওকে বরং একটা ট্যাক্সি ধরিয়ে দিই। শানুদি খুব অসন্তুষ্ট গলায় কথাগুলো বলতেই মিসেস গুপ্তা ঠোঁট বাঁকালেন, আহা! একদিন না হয় গেলে তাতে তোমার গাড়ি খারাপ হয়ে যাবে না। অর্ককে আমি কথা দিয়েছি না?

অর্ক বলল, আমার জন্যে আপনারা ভাবছেন কেন? আমি ঠিক ফিরে যাব। মিসেস গুপ্তা দরজা খুলে বললেন, তোমাকে পাকামি করতে হবে না, বসো তো। তারপর চাপা গলায় শানুদির কানে কিছু বলতেই তাঁর মুখের চেহারা পাল্টে গেল, ও, তাই বল। তোমার মাথায় খেলেও বাবা। ঠিক আছে, ওঠো তোমরা।

শানুদি স্টিয়ারিং-এ বসলেন, মিসেস চ্যাটার্জী তাঁর পাশে। পেছনে মিসেস গুপ্তার সঙ্গে অর্ক। গাড়িতে উঠেই মিসেস গুপ্তা বললেন, শানুদি, তুমি ঠিক আছে?

মিসেস সোমের দিকে হাত নেড়ে শানুদি গাড়ি চালু করলেন, আমি আর যাই করি না কেন বিলাসের মত একটা কাণ্ড করব না। বিলাস যে মেয়েটার সঙ্গে অ্যাটাচড তার এলেম আছে।

মিসেস চ্যাটার্জী ঠোঁট বেঁকালেন, সুরুচি বলল সে নাকি স্ট্রীট গার্ল!

শানুদি মাথা নাড়লেন, ওই তো মুশকিল। এই পুরুষজাতটার কোন রুচির বালাই নেই। দেখে দেখে ঘেন্না ধরে গেল ভাই।

লেক টাউন থেকে বেরিয়ে গাড়িটা তখন যশোর রোডে উঠে বাঁ দিকে বাঁক নিয়েছে। হঠাৎ মিসেস গুপ্তা বললেন, অর্ক, তুমি বিলাসের প্রেমিকাকে দেখেছ? খুব সুন্দরী কি?

আচমকা প্রশ্নে অর্ক কি বলবে বুঝতে না পেরে শেষ পর্যন্ত মাথা নাড়ল, না, আমি কাউকে দেখিনি। সঙ্গে সঙ্গে ওর হাত জড়িয়ে ধরলেন মিসেস গুপ্তা, না, তুমি মিথ্যে কথা বলছ। অ্যাকসিডেন্টের সময় বিলাসের সঙ্গে তুমি ছিলে। বিলাস নিশ্চয়ই সেই মেয়েটার কাছ থেকে ড্রাঙ্ক হয়ে ফিরছিল।

অর্ক বলল, আপনি বিশ্বাস করুন আমি মাঝ রাস্তায় গাড়িতে উঠেছি।

গাড়ি চালাতে চালাতে শানুদি বললেন, এটা বিশ্বাসযোগ্য পয়েণ্ট নয়। এই যে আমি গাড়ি চালাচ্ছি, এখন কেউ আমাকে হাত দেখালে আমি তাকে গাড়িতে তুলে নেব? অসম্ভব।

ওঁর গাড়ি রাস্তায় খারাপ হয়ে গিয়েছিল, তখন আলাপ। অর্ক বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করল। মিসেস গুপ্তা ওর হাতে মৃদু চপেটাঘাত করলেন, কিন্তু সুরুচি বলেছে তোমার সঙ্গে বিলাসের নাকি একটা গোপন আঁতাত আছে।

অর্ক কথা বলল না! ওর খুব ক্লান্তি লাগছিল। সে চেষ্টা করল মিসেস গুপ্তার হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিতে। কিন্তু ভদ্রমহিলা যেন সাঁড়াশির মত তাকে ধরে রেখেছেন। হঠাৎ মিসেস চ্যাটার্জী সামনের সিট থেকে ঝুঁকে পড়লেন, উঁহু, ওটা ঠিক হচ্ছে না। আমরা যা করব তা একসঙ্গেই করব, কন্ট্রাক্টটা ভুলে গেলে চলবে না।

এবার মিসেস গুপ্তা যেন লজ্জা পেয়েই হাত ছেড়ে দিলেন। অর্ক ব্যাপারটা বুঝতে পারল না। তবে ওর মনে হচ্ছিল এই তিনজন মহিলার মধ্যে কোন গোলমেলে ব্যাপার আছে। এই সময় শানুদি হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন, আমার পার্স!

মিসেস চ্যাটার্জী উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, তুমি আনোনি?

গাড়িটাকে একপাশে দাঁড় করিয়ে শানুদি বললেন, একদম ভুলে গিয়েছি। ওটা সুরুচির বাড়িতে পড়ে আছে। কি হবে এখন?

কি আর হবে, মিসেস গুপ্তা বললেন, বাড়ি ফিরে ওকে ফোন করে দিও।

মাথা নাড়লেন শানুদি, পার্সে দশ হাজার টাকা আছে। কোন কারণে যদি ওটা না পাওয়া যায়। তাহলে বিপদে পড়ব। কাল সকালেই টাকাটা দরকার। বলতে বলতে গাড়ি ফেরালেন উনি। অর্ক ভাবল এবার তাকে নামিয়ে দিতে বলবে। কিন্তু গাড়ি তখন খুব জোরে ফিরছে। বড় জোর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ফিরে আসবে। সে পেছনের সিটে গা এলিয়ে দিতে মিসেস গুপ্তার ফিসফিসানি শুনতে পেল, তুমি কাল বিকেলে আমাকে ফোন করবে, খুব দরকার আছে। এই ধরো, তিনটে নাগাদ। ভেরি গুড বয়!

অর্ক কোন উত্তর দিল না। ওর মনে হচ্ছিল এরা যেন ঠিক সুস্থ মানুষ নন। বিলাস সোমের বাড়ির সামনে গাড়িটা ফিরে এল। শানুদি দরজা খুলতে খুলতে বললেন, সুরুচি আবার আমায় না ভুল বোঝে!

মিসেস চ্যাটার্জী বললেন, হ্যাঁ, ভাবতে পারে তুমি ওকে অবিশ্বাস করছ।

অর্ক বলল, আপনারা বসুন, আমি নিয়ে আসছি। শানুদি বললেন, সেই ভাল, আমরা দুজনেই যাই চল।

গেট খুলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে অর্ক বুঝল শানুদি অতগুলো টাকার জন্যে তাকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। প্যাসেজ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শানুদি বললেন, তুমি কি ব্যায়াম করো? অর্ক ঘাড় নাড়ল, না।

বাঃ, তা সত্ত্বেও এত সুন্দর ফিগার তোমার! শানুদির গলায় প্রশংসা শুরু হতেই দপ করে আলো নিবে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ভুষো কালির মত অন্ধকার নামল চারধারে। শানুদি বিব্রত হয়ে বললেন, যাঃ, লোডশেডিং! কি হবে!

অর্ক বুঝতে পারল শানুদি অন্ধকারে হাঁটতে পারছেন না। ভদ্রমহিলা বোধ হয় চোখে খুব কম দ্যাখেন। অবশ্য ততক্ষণে ওরা বারান্দার কাছে চলে এসেছিল। সে হাত বাড়িয়ে বলল, আমাকে ধরে উঠুন।

ওঃ, অর্ক, থ্যাঙ্কস। প্রায় তাকে জড়িয়ে ধরে শানুদি ওপরে উঠে এলেন। তারপর আন্দাজে দরজার পাশে হাত বুলিয়ে কলিং বেলের বোতামে চাপ দিয়ে বললেন, ওঃ, এখন তো এটাও বাজবে না। তারপর খুব মৃদু আওয়াজ করলেন দরজার গায়ে। ওপাশে কোন সাড়া না পাওয়া যাওয়ায় শব্দটা এবার জোরে করলেন কিন্তু তাতেও কোন ফল হল না, একি বাবা, আমরা বেরিয়ে যাওয়ামাত্র এরা ঘুমিয়ে পড়ল নাকি!

অর্ক নিজেও দু’তিনবার দরজায় শব্দ করল কিন্তু ভেতর থেকে কোন সাড়া এল না। শানুদি বললেন, কি করা যায় বল তো?

অর্ক বারান্দা থেকে নেমে এল। এবার সে পাশের দরজাটা দেখতে পেল। ওই দরজা দিয়ে নবীন তাকে ঢুকিয়েছিল। এগিয়ে গিয়ে সামান্য ঠেলতেই বোঝা গেল পাল্লাদুটো ভেজানো ছিল। সে শানদিকে বলল, আপনি এখানে অপেক্ষা করুন আমি এই দরজা দিয়ে ভেতরে যাচ্ছি। + শানুদি বোধ হয় আপত্তি করছিলেন কিন্তু তার জন্যে অপেক্ষা করল না অর্ক। ছোট্ট গলি দিয়ে সে পেছনের বারান্দায় চলে এল। সমস্ত বাড়িতে এখন ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। বন্ধ দরজায় আঘাত করতে নবীনের গলা পাওয়া গেল, কে? কে ওখানে?

আমি অর্ক। একটু আগে এসেছিলাম, দরজা খোল।

নবীন খুব অবাক হয়ে দরজা খুলতেই অর্ক দেখল ওর হাতে একটা মোমবাতি জ্বলছে। অর্ক বলল, বাইরের দরজায় অনেকক্ষণ ধাক্কা দিয়েছি, শুনতে পাওনি?

না তো। ওখানে বেল না বাজালে এদিক থেকে শোনা যায় না।

শানুদি একটা পার্স ফেলে গেছেন, ওটা দাও।

নবীন ওকে আলো দেখিয়ে তিন চারটে ঘর পার করে যেখানটায় নিয়ে এল সেখানেই ওরা বসেছিল। প্রথমে দেখতে পায়নি অর্ক। তারপর সোফার পাশে পার্সটাকে খুঁজে পেল সে! বেশ ভারী, ভেতরে টাকা গজগজ করছে। সে জিজ্ঞাসা করল, তোমার মেমসাহেব কোথায়?

ওপরে।

একবার ডাকো, বলে যাই।

আপনি যান না, ওপরে উঠে ডান হাতি ঘর। ওদিকের দরজা খোলা রয়েছে, আমি বন্ধ করে আসি। নবীন ওপরে উঠতে চাইল না।

অর্ক ওর হাত থেকে মোমবাতি নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কুকুরটা?

ওই পাশে বাঁধা আছে, কোন ভয় নেই।

মোমবাতির আলোয় সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল অর্ক। সমস্ত বাড়িটা নিস্তব্ধ। ডান দিকের ঘরের দরজায় আসতেই কিছু একটা শব্দ কানে এল। খুব মৃদু একটা কান্নার আওয়াজ। একটানা কিন্তু চাপা। অর্ক ঘরের ভেতর দু’পা এগিয়েই চমকে উঠল। একটা বিশাল বিছানার মাঝখানে মিসেস সোম উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। কান্নার দমকে তাঁর পিঠ উঠছে নামছে। সমস্ত শরীরে এক ইঞ্চি সুতো নেই। এই অন্ধকার চিরে মোমবাতির যে আলো তাঁর নগ্নদেহে পড়েছে তাতে তাঁকে অন্য গ্রহের মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। কাঁদতে কাঁদতে মহিলা এমন অন্ধ হয়ে গিয়েছেন যে কোন কিছুই তাঁর খেয়াল নেই। এমন কি এই যে সে মোমবাতি নিয়ে ঘরে ঢুকেছে তাও টের পাচ্ছেন না।

লজ্জা নয়, অর্কর খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। সে বুঝতে পারছিল এই মুহূর্তে সুরুচি সোমকে ডাকা অন্যায় হবে। পা টিপে টিপে বেরিয়ে এলেও কান্নার সুরটা যেন কানে লেগেই রইল। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে সে নিচে নেমে আসতেই চমকে উঠল। অন্ধকারে ভূতের মত নবীন সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে। একটু বিস্মিত গলায় নবীন প্রশ্ন করল, এত তাড়াতাড়ি নেমে এলেন?

অর্ক খুব অবাক হয়ে লোকটার দিকে তাকাল। এই আবছা অন্ধকারে নবীনের মুখ ভাল করে বোঝা না গেলেও সে অনুমান করতে পারছে ও খুশি হয়নি। সে বিরক্ত গলায় প্রশ্ন করল, আমার খুব দেরি হবে বলে ভেবেছিলে নাকি?

মুখ নামাল নবীন। তারপর অপরাধীর গলায় বলল, যা দেখেছেন তা কাউকে বলবেন না বাবু। ওই মেমসাহেবদেরও বলবেন না।

এবার অর্ক বুঝতে পারল লোকটা সব জানে। জেনে শুনেই ও তাকে ওপরে পাঠিয়েছিল। সে জিজ্ঞাসা করল, তোমার মেমসাহেব কি রোজ এরকম করে?

মাথা নাড়ল নবীন, বাবু হাসপাতাল থেকে ফেরার পরেই। সারা রাত কাঁদে। মেমসাহেবকে ঘরে একা ঢুকতে দেন না বাবু। এসব কথা কাউকে বলবেন না যেন!

হঠাৎ অর্কর মনে হল তার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। চার ধারের মানুষগুলো কি অদ্ভুত। সেজেগুঁজে থাকলে তাদের ভেতরের চেহারাটাকে একদম বোঝা যায় না। বাইরে যে তিনজন অপেক্ষা করছে তাদেরও হয়তো এরকম চেহারা আছে। এসব বুঝতে গেলে কোন কূল পাওয়া যাবে না। সে অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠল, দরজাটা খুলে দাও, আমি বেরিয়ে যাব।

২১. তিনটে শরীর উদ্দাম নেচে যাচ্ছে

তিনটে শরীর উদ্দাম নেচে যাচ্ছে। তাদের লম্বা লম্বা চুল কিন্তু সরু লিকলিকে লেজের মত ঝাঁপটা মারছে সমানে। মোক্ষাবুড়ির মত চুপসে যাওয়া বুক, ডাইনিদের মত মুখ আর বিশাল বিশাল নখ নিয়ে নাচতে নাচতে ঘিরে ধরেছে তাকে। স্পষ্ট সে শুনতে পাচ্ছে ওরা হাসছে, যেন হাসির সুরে বলছে, পেয়েছি পেয়েছি। কোথাও একটা বাজনা বাজছে খুব দ্রুত লয়ে। হিলহিলে সাপের মত তিনজনের হাত কাঁপতে কাঁপতে নেমে এল নিচে। ক্রমশ গলা লক্ষ্য করে সেগুলো এগিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল অর্ক। দম বন্ধ হয়ে আসছে, নিঃশ্বাস নেবার জন্যে পৃথিবীতে যেন আর বাতাস নেই। সে ধড়মড় করে উঠে বসার চেষ্টা করল কিন্তু শরীর এক ইঞ্চি উঠতে পারল না। বুকের ভেতর যেন একটা ভারী কিছু চেপে বসেছে এবং অর্ক সেটাকে কিছুতেই নড়াতে পারছে না। প্রচণ্ড চেষ্টার পর সে কোনরকমে যখন উঠে বসল তখন সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছে। নিঃশ্বাস ভারী। অন্ধকারে চারপাশে তাকিয়েও বুঝতে সময় লাগল যে এখন ঘরের মেঝেয় শুয়ে। ওপাশে মা আর খাটের ওপর বাবা। সামান্য নাক ডাকার শব্দ হচ্ছে খাট থেকে। অন্য সময় এই শব্দটায় ঘুম আসতে চায় না কিন্তু এখন খুব আরাম লাগল। যেন একটা পরিচিত অবলম্বন স্থিত হবার জন্যে।

দুহাতে মুখ মুছল অর্ক। আর তখনই মাধবীলতার গলা ভেসে এল, কি হয়েছে? অর্ক কথা বলার চেষ্টা করেও পারল না। এখনও তার শরীর কাঁপছে। মাধবীলতা আবার জিজ্ঞাসা করল, উঠে বসলি কেন? স্বপ্ন দেখছিলি?

অর্ক মুখ ফেরালো। তারপর কোনরকমে বলতে পারল, মা

মাধবীলতা অবাক হল। এই গলা স্বাভাবিক নয়, আবছা অন্ধকারেও ছেলেটাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। সে দ্রুত ব্যবধান কমিয়ে ছেলের পাশে এসে বসে জিজ্ঞাসা করল, কিরে, কি হয়েছে? বলে ওর কাঁধে হাত রাখল।

অর্কর উত্তেজনা ততক্ষণে কমে এসেছে। সে ঘাড় নাড়ল, কিছু না।

কিছু না তো অমন করছিলি কেন? স্বপ্ন দেখছিলি?

হ্যাঁ।

মাধবীলতা হেসে ফেলল। এতবড় ছেলেটা একদম শিশুর মত ভঙ্গী করছে। একটু ঠাট্টার গলায় জিজ্ঞাসা করল, কি স্বপ্ন? ভূত প্রেতের?

ততক্ষণে অর্ক চেতনা ফিরে পেয়েছে। কিন্তু সেই দমবন্ধ-হওয়া অনুভূতিটাকে সে তখনও যেন। টের পাচ্ছিল। স্বপ্নটার কথা মাকে বলা যায় না। কিন্তু এই যে মা তার কাঁধে হাত রেখে এত আন্তরিকভাবে কথা বলছে এটাকেও হারাতে চাইছিল না সে। ওর মনে হল অসুখের সময় ছাড়া সুস্থ অবস্থায় মা অনেকদিন তার কাছে এমনভাবে আসেনি। সে মায়ের পাশে বালিশটাকে নিয়ে এসে শুয়ে পড়ে বলল, তুমি আমার পাশে শোও। মাধবীলতা এবার সত্যিই বিস্মিত হল, কেন?

আমার খুব ইচ্ছে করছে। অর্ক একটা হাত মায়ের কোলে রাখল। মাধবীলতার মুখে এক মুহূর্ত কোন কথা এল না। হঠাৎ অর্ক এত ছেলেমানুষ হয়ে গেল কি করে তা সে বুঝতে পারছিল না। বুকের মধ্যে যে আবেগটা একটু একটু করে শুকিয়ে যাচ্ছিল সেটা এখন যেন প্রাণ ফিরে পেল! অর্ক আবার ডাকল, শোও না। মাধবীলতা ছেলের মাথায় হাত রেখে বলল, শুতে পারি যদি তুই একটা প্রতিজ্ঞা করিস!

কি প্রতিজ্ঞা। চিৎ হয়ে শাওয়া অর্ক একটুও নড়ল না।

তুই কখনও আর ওইসব খারাপ কথা বলবি না। ওগুলো শুনলেই আমার বমি পায়।

অর্ক সিটিয়ে গেল। মায়ের মুখ থেকে এইরকম কথা সে এই মুহূর্তে আশা করেনি। কোনদিন। খিস্তি করবো না এমন প্রতিজ্ঞা সে কিভাবে করবে? বিলু কোয়াদের সঙ্গে কথা বলতে গেলেই ওগুলো আপনা থেকেই জিভে চলে আসে। তাছাড়া ওরা যখন খিস্তি দিয়ে কথা বলবে তখন চুপ করে থাকা যায় না। সে একটু ভেবে নিয়ে মাধবীলতাকে বলল, চেষ্টা করব।

উঁহু! ওরকম ঘোরানো কথা আমি শুনতে চাই না। তোকে স্পষ্ট বলতে হবে। ১১ অর্ক অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকাল। এখন একা শুতে ভয় ভয় করছিল এটা ঠিক কিন্তু মা তার পাশ থেকে উঠে যাক এটা সে কিছুতেই চাইছিল না। সে যদি প্রতিজ্ঞা করার পরও ভুল করে বলে বসে! তৎক্ষণাৎ ওর চোখেতিন বুড়ির নৃত্যদৃশ্যটা ভেসে এল। শিউরে উঠে অর্ক চোখ বন্ধ করল। তারপর মাধবীলতার শরীরে মুখ রেখে বলল, আমি জেনেশুনে আর খারাপ কথা বলব না। মা।

নিজের বালিশ অর্কর পাশে রেখে শুয়েছিল মাধবীলতা। খাটের ওপরে অনিমেষ নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। আজকাল ঘুমালেই নাক ডাকে অনিমেষের। শুধু সেই শব্দে ফের ঘুম আসছিল না তা নয়, মাধবীলতা আর একটা নতুন জিনিস আবিষ্কার করল। অর্ক সামান্য বড় হবার পরেই তার একা শাওয়া অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। চোখের সামনে ছেলেটাকে বড় হতে দেখেছে সে। কিন্তু এভাবে পাশাপাশি আর শোয়নি। অর্কর শরীর থেকে এক ধরনের পুরুষালি গন্ধ বের হচ্ছে। ছেলেটা তার পেটে হাত রেখে শুয়েছিল। যতটা না ওজন তার চেয়ে অস্বস্তিতে সে বলেছিল, হাতটা সরা পেটে লাগছে। অর্ক যেন খানিকটা অনিচ্ছায় হাত সরিয়ে তার গা ঘেঁষে শুয়েছে এখন। মাধবীলতার হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল। যে ছেলেকে সে পেটে ধরেছে, এত কষ্ট করে বড় করেছে তার পাশেও সে স্বচ্ছন্দে শুয়ে থাকতে পারছে না কেন? কেন এত অস্বস্তি হচ্ছে? সেটা কি ছেলে একটা আস্ত পুরুষমানুষ হয়ে গেছে বলে? কথাটা ভাবতে গিয়েই হেসে ফেলল মাধবীলতা নিঃশব্দে। অর্ক যখন শিশু ছিল তখন ওর সামনে জামাকাপড় পাল্টাতে একটুও সঙ্কোচ হতো না তার। কিন্তু এখন তো মরে গেলেও পারবে না। এই শোওয়ার অস্বস্তিটা বোধ হয় সেই একই কারণে।

মায়ের গা-ঘেঁষে শুয়ে অর্ক সেই মিষ্টি গন্ধটাকে টের পেল। কোন পাউডার সেন্টের গন্ধ নয়, ছেলেবেলায় মায়ের শরীর থেকে অদ্ভুত একটা গন্ধ বেরিয়ে তার নাক জুড়ে থাকতো। গন্ধটা ক্রমশ বুক ভরিয়ে দিচ্ছিল তার। কিন্তু চোখ বন্ধ করে পড়ে থেকেও কিছুতেই আর ঘুম আসছিল না। হঠাৎ তার মনে হল স্বপ্নের তিন বুড়িকে সে চিনতে পেরেছে। মিসেস সোমের তিন বান্ধবী যখন। নাচছিলেন তখন তাঁদের ওই রকমই দেখাচ্ছিল। ওই তিনজনই স্বপ্নে ডাইনি হয়ে গিয়েছে। বুকের ভেতর আবার দমদম করে উঠতেই মাকে ছুঁয়ে সে শান্ত হল। কিন্তু তখনই শরীর গুলিয়ে উঠল ওর। ওই তিনজন প্রৌঢ়া মহিলা কি কুৎসিত ভঙ্গীতেই না নাচছিলেন। তাছাড়া ওঁদের ভাবভঙ্গীর মধ্যে একটা কিছু রহস্য ছিল। তাকে গোপনে যেতে বলছিলেন কেন? গা ঘিনঘিন ভাবটা বেড়ে গেল অর্কর। ওই মহিলারা কেউ ভাল নয়। অথচ ওদের সঙ্গে থাকার সময় এটা একবারও তেমন করে মনে হয়নি তার। এই স্বপ্নটা দেখার পরে মনে হচ্ছে ওরা তাকে ব্যবহার করতে চায়। এই তিনজন মহিলা মায়ের মত নয়। এমন কি মিসেস সোমও। তা না হলে অন্ধকার বাড়িতে একা বিছানায় শুয়ে কাঁদছেন প্রায় বিবস্ত্র হয়ে অথচ পাশের ঘরেই বিলাস সোম অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন।

ওই তিনজন যার বন্ধু সে কিছুতেই ভাল হতে পারে না। অর্কর মনে হল সে যেন একটা মুরগি আর। তিনটে শেয়াল তার তিন পাশে বসে জিভ কাটছে। কিছুদিন আগে বিলু একটা সিনেমার গল্প বলেছিল। সেটা এইরকম। বুড়ি মেয়েরা নাকি অল্পবয়সী ছেলেদের খেয়ে ফেলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। একসময়। ব্যাপারটা যত ভাবছিল তত গা-বমি ভাবটা বাড়ছিল। তারপর একসময় আর না পেরে উঠে বসল।

মাধবীলতা ছটফটানিটা টের পাচ্ছিল। ছেলে উঠে বসতেই জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে?

বাইরে যাব। অর্ক চট করে উঠে দরজা খুলে অন্ধকারে বেরিয়ে গেল। মাধবীলতা এরকম আচরণে অবাক হয়ে তাড়াতাড়ি কাপড় সামলে বেরিয়ে এল ঘর ছেড়ে। এবং তখনই সে বমির শব্দ শুনতে পেল। অনুদের বাড়ি পেরিয়ে আসতেই দেখতে পেল নর্দমার ধারে দাঁড়িয়ে অর্ক বমি করছে। তবে মুখ থেকে কিছুই বের হচ্ছে না সামান্য জল ছাড়া। মাধবীলতা দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ছেলেকে ধরল। সে এর মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিল না। স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে ছেলেটা পাশে শুতে বলল। বেশ আবদেরে ভঙ্গীতে শুয়েই ছিল এতক্ষণ। হঠাৎ এভাবে ছুটে এসে বমি করছে কেন? এবার সামান্য কিছু উঠল।

অর্ককে হাঁপাতে দেখে মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, আর হবে?

চোখ বন্ধ অর্কর। মুখটা ওপরে তুলে শেষ পর্যন্ত মাথা নাড়ল, না। মাধবীলতা বলল, ঘরে চল। ওহো একটু দাঁড়া। কল থেকে অসাড়ে জল পড়ছিল। মাধবীলতা আঁজলা করে তাই তুলে ছেলের মুখে ঘাড়ে বুলিয়ে দিল। তারপর ধরে ধরে নিয়ে এল ঘরে।

অনিমেষ তখনও ঘুমাচ্ছে। ছেলেকে শুইয়ে দিয়ে পাখা নিয়ে এল মাধবীলতা। মৃদু বাতাস করতেই আবার বমির দমক এল। মাধবীলতা দ্রুত একটা খালি কৌটো ওর মুখের কাছে এগিয়ে ধরতেই সেটা ব্যবহার করল অর্ক। মাধবীলতা ওর বুকে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে গিয়ে মনে হল গা-টা গরম গরম। সে অর্কর মুখের ওপর ঝুঁকে বলল, কিছু খেয়েছিলি বাইরে? অর্কর কষ্ট হচ্ছিল খুব। সে মাথা নাড়ল, না।

মাধবীলতা উঠে আলো জ্বাললো। তারপর নিজের মনেই বিড়বিড় করল, অসুস্থ শরীর তবু বেরুনো চাই। কটা দিন ঘরে বসে থাকলে পৃথিবীটা যেন আর চলছিল না।

অর্ক কিছুতেই গা গুলানি ভাবটাকে এড়াতে পারছিল না। চোখ বন্ধ করলেই তিনটি বীভৎস বুড়ি অশ্লীলভাবে নৃত্য শুরু করে দেয় চোখের পাতায়। আর তখনই বমি বমি বোধটা বেড়ে ওঠে। মাধবীলতা পাশে বসে বলল, কেমন লাগছে? বমি পাচ্ছে মা। অর্ক দুহাতে মাধবীলতাকে আঁকড়ে ধরল।

মাধবীলতা অসহায় চোখে ছেলের দিকে তাকাল। হঠাৎ অর্ক যেন ছোট্টটি হয়ে গিয়েছে। সেই পুরুষালি গন্ধ এবং শরীরের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে আলাদা হওয়া ব্যাপারটা এখন যেন উধাও। সে ছেলের শরীর হাতের বন্ধনে রেখে বলল, একটু ঘুমাবার চেষ্টা কর বাবা, আমি হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু পরমুহূর্তেই অর্কর শরীরটা আবার কেঁপে উঠল, বমি পাচ্ছে মা।

মাধবীলতা কৌটোটা এগিয়ে দিল, কিন্তু কিছুই বের হল না। এবার প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেল মাধবীলতা। অর্কর হাত এবং পা কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে অথচ শরীরে উত্তাপ। সে অনিমেষকে ডাকল, শুনছো! এই একটু উঠবে?

অনিমেষ ঘুমভাঙ্গা মাত্র উত্তেজনাটা ঠাহর করতে পারল না। কটা বিরক্তিসূচক শব্দ উচ্চারণ করামাত্র মনে হল মাধবীলতার গলাটা অন্যরকম লাগছে। সে ফ্যাসফেসে গলায় বলল, কি হয়েছে?

ছেলেটা কেমন করছে! তুমি দ্যাখো, আমি ডাক্তারকে ডেকে আনি। মাধবীলতা শাড়িটাকে ঠিকঠাক করে নিচ্ছিল।

কটা বাজে?

জানি না। দুটো তিনটে হবে হয়তো।

এত রাত্রে তুমি একা বাইরে যাবে, পাগল হয়েছ?

কে যাবে?

কেন, খোকার কি হয়েছে?

বমি করছে বারবার আর হাত পা কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে।

সেকি! অনিমেষ হাত বাড়িয়ে ক্রাচ টেনে নিল, তোমার যাওয়া ঠিক হবে না, আমি যাচ্ছি। ঠিক কোন জায়গায় বলে দাও।

মাধবীলতা চমকে উঠল, তুমি যাবে? পাগল!

আঃ, বোকামি করো না। আমি যখন ট্রাম রাস্তা পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারছি তখন পাড়ার ডাক্তারকে ডেকে আনতে নিশ্চয়ই পারব। অনিমেষ টলতে টলতে মেঝেতে দাঁড়াল।

অনিমেষের গলায় যে জেদ তা মাধবীলতাকে দ্বিধায় ফেলল। বলল, তুমি কি পারবে?

কথা বাড়াচ্ছ শুধু শুধু। রাস্তায় এখন গাড়ি নেই অতএব মুশকিল কি আছে। আমি এখানে থাকলে খোকাকে ভাল করে দেখতেও পারব না। তোমারই থাকা উচিত।

বেশ অনিচ্ছাতেই মাধবীলতা ডাক্তারের বাড়িটা বুঝিয়ে দিল অনিমেষকে। দরজা পেরিয়ে বাইরে যাওয়ার মুহূর্তে অনিমেষ শুনল ছেলে ঘরের মধ্যে বলছে, বমি পাচ্ছে, মা।

ঠুক ঠুক করে সরু গলি দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে অনিমেষ তিন চারবার দাঁড়ালো। কোমরে খচ খচ করছে। বেশ চিনচিনে ব্যথা। এটা আবার এল কোত্থেকে? দাঁড়ালে টের পাওয়া যাচ্ছে না, হাঁটলেই হচ্ছে। গলিতে একটাও মানুষ নেই। তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেন এখন ঘুমাচ্ছে। গলির মুখে কেউ একজন বসে আছে। একটা গোল পুঁটুলির মত। অনিমেষ পাশে আসা সত্ত্বেও সে মুখ তুলল না। মোক্ষাবুড়ি। কে যায় প্রশ্নটা আজ শুনতে পেল না অনিমেষ। নাতি মারা যাওয়ার পর থেকেই বুড়ি দিনরাত এরকম আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে থাকে গলিতে। অনিমেষ ফুটপাথে উঠে এল। খাঁ খা করছে ঈশ্বরপুকুর লেন। এই দৃশ্য কখনও চোখে পড়েনি তার। রাস্তায় আলোগুলোকে বিবর্ণ দেখাচ্ছে। চায়ের দোকানটাও বন্ধ শুধু তার বাইরে গুঁড়ো কয়লা চাপা দেওয়া উনুনটা একটা লালচে আভা ছড়াচ্ছে। ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটু গা ছমছম করলেও অনিমেষের বেশ ভাল লাগছিল। হঠাৎ মনে হল, সমস্ত পৃথিবীটাই যদি এইরকম নিঃসঙ্গ, নির্জন হত। অনেক, অনেকদিন পরে স্বৰ্গছেঁড়া চা বাগানের নদীর ধারটার কথা মনে হল আজ।

বন্ধ দরজায় তিন, চারবার আওয়াজ করেও কোন সাড়া পাওয়া গেল না। অনিমেষ এবার সজোরে কড়া নাড়ল। শব্দটা নিস্তব্ধ রাত্রে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল অনিমেষের। যেন ঈশ্বরের দরজায় বারংবার মাথা ঠুকেও তার দয়া পাওয়া যাচ্ছে না। সে এবার চিৎকার করল মরিয়া হয়ে, ডাক্তারবাবু। এ কোন সাড়া নেই। অনিমেষ আবার চিৎকার করার পর ওপরের একটা ঘরে আলো জ্বলল, কে? জানলায় একজন মহিলা এসে দাঁড়ালেন। পেছনে আলো থাকায় মহিলার মুখ দেখতে পাচ্ছিল না অনিমেষ। অনেকদিন বাদে এমন গলা খুলে চিৎকার করার পর বুকের ভেতরটা কেমন যেন হালকা হালকা লাগছে। সে গলা তুলে বলল, ডাক্তারবাবুকে ডেকে দেবেন?

কি হয়েছে? ওর শরীর ভাল নেই।

আমার ছেলে খুব অসুস্থ। একবার যদি দয়া করে আসেন। অনিমেষ বিনীত হল।

মহিলা জানলা থেকে সরে গেলেন। তারপর মিনিট দুয়েক জানলা ফাঁকা। অনিমেষ ভেবে পাচ্ছিল না সে কি করবে। লোকটা যদি না যায় তাহলে জোর করার তো কোন উপায় নেই। এই সময় খালিগায়ে লুঙ্গিপরা এক ভদ্রলোক জানলায় এসে দাঁড়ালেন, কি হয়েছে?

হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে, শরীর গরম আর খুব বমি করছে। ওপর দিকে মুখ তুলে অনিমেষ নিবেদনের ভঙ্গীতে জানাল। এইসময় মহিলা আবার ডাক্তারের পাশে এসে দাঁড়ালেন। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় বাড়ি?

তিন নম্বরে।

ওঃ, বস্তি! ডাক্তারের প্রতিক্রিয়া খুব সহজেই বোঝা গেল। বোধ হয় কোন অজুহাত দেখাতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই মহিলা বলে ফেললেন, খোঁড়া লোকটা নিশ্চয়ই খুব বিপদে পড়ে এসেছে। তোমার যাওয়া উচিত।– লুঙ্গির ওপরে পাঞ্জাবি চাপিয়ে ডাক্তার বেরিয়ে এলেন, রোগী আপনার কে হয়?

ছেলে। অনিমেষ চেষ্টা করছিল ডাক্তারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে। কিন্তু একটু জোর পড়তেই চিনচিন ব্যথাটা শুরু হল। সে দাঁড়িয়ে যেতেই ডাক্তার মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি হল? অনিমেষ দেখল ডাক্তার তার পায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন?

কিছু না, চলুন।

হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?

হ্যাঁ, সামান্য।

কি করে হল এরকম? আপনাকে কখনও এ পাড়ায় দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। অনিমেষ হাসবার চেষ্টা করল কিন্তু মুখে কিছু বলল না। নিজের ঘরের দরজা অবধি আসতেই ঘেমে নেয়ে গিয়েছিল অনিমেষ। ঘরে ঢুকে মাধবীলতাকে বলল, ডাক্তারবাবু এসেছেন। তারপর খাটে প্রায় এলিয়ে বসল। শরীরটার যে কিছুই অবশিষ্ট নেই সেটা বোঝা যাচ্ছে। মাধবীলতা ডাক্তারকে অর্কর কাছে নিয়ে এল। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে বলুন? মাধবীলতা যা যা ঘটেছিল সবই বলল। ডাক্তার নাড়ি দেখলেন। অর্কর জ্বর বেশ বেড়েছে। ঘোরের মধ্যে মাঝে মাঝেই বলছে, বমি পাচ্ছে, মা। ডাক্তার সেটা শুনে জিজ্ঞাসা করলেন, কখন শেষবার বমি করেছে? ওই কৌটোটা দেখি।

ও যখন আপনাকে ডাকতে গেল তার একটু আগে। তারপর এক কথা মাঝে মাঝে বলছে কিন্তু আর বমি করছে না। মাধবীলতা কৌটোটাকে দেখালো। ডাক্তার বললেন, কিছুই তো বের হয়নি। বাইরে কিছু খায়নি বললেন না?

হ্যাঁ। তাই বলেছে। মাধবীলতা উদগ্রীব হয়ে তাকাল। কিছুক্ষণ পরীক্ষা করার পর ডাক্তার বললেন, এখন তো কোন ওষুধের দোকান খোলা পাবেন বলে মনে হচ্ছে না। শ্যামবাজারের মোড়ে–না, থাক। ওটা বোধ হয় খোলা থাকে না। আমি দুটো ট্যাবলেট দিয়ে যাচ্ছি। দু ঘণ্টা পর পর দুটো দেবেন। মনে হয় জ্বরটা কমবে। এভাবে কিছু না শুনে রোগ ঠাহর করা মুশকিল। কাল সকালে খবর দেবেন। ওষুধ বের করে সামনে রেখে ডাক্তারবাবু উঠলেন। মাধবীলতা ব্যাকুল গলায় জিজ্ঞাসা করল, কোন ভয় নেই তো ডাক্তারবাবু?

ডাক্তার মাথা নাড়লেন, মনে হয় না। পেটে উইণ্ড জমেনি। প্রেসার ঠিক আছে। মাথায় জলপট্টি দিয়ে যান যতক্ষণ জ্বর না কমে। এর আগে আপনি এই ছেলের জন্যে ওষুধ নিতে গিয়েছিলেন না? ডাক্তারবাবুর কপালে ভাঁজ।

হ্যাঁ। মাধবীলতা নিচু গলায় বলল।

এ যে আপনার ছেলে তা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা, আমি আসছি।

একটু দাঁড়ান। মাধবীলতা ব্যাগ থেকে টাকা বের করে এগিয়ে ধরল, এতে হবে?

ঠিক আছে। ডাক্তারবাবু পা বাড়াচ্ছিলেন মাধবীলতা কথা বলল, কিছু মনে করবেন না, ওকে আমার ছেলে বলে ভাবতে আপনার কষ্ট হচ্ছে কেন?

ডাক্তারবাবু থতমত হয়ে গেলেন। তারপর কোনরকমে বললেন, এই বস্তিতে আপনাকে বেমানান লাগে কিন্তু ওকে এই বস্তির ছেলে বলেই মনে হয়। কিছু মনে করবেন না।

বমি পাচ্ছে, মা। অর্ক বিড়বিড় করল।

মাধবীলতা ছুটে এল ওর কাছে। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, তুই ঘুমিয়ে পড়। ডাক্তারবাবু ওষুধ দিয়ে গেছেন, ওষুধ খেলেই সেরে উঠবি।

দরজা থেকে ডাক্তারবাবু ফিরে এলেন, ওসব চাপা দেওয়ার কোন দরকার নেই। আপনি উঠুন। একটা ছোট বালতিতে জল আর তোয়ালে নিয়ে আসুন। ব্যাগটাকে মাটিতে রেখে হাঁটু গেঁড়ে বসলেন ভদ্রলোক। মাধবীলতা এতটা আশা করেনি। সে চকিতে অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাড়াতাড়ি বালতি আর গামছা নিয়ে ফিরে এসে দেখল ডাক্তারবাবু অর্কর শরীর থেকে সমস্ত চাপা সরিয়ে ফেলেছেন। এমন কি গেঞ্জিটা পর্যন্ত নেই। গামছাটা ভাল করে জলে ডুবিয়ে সেই ভেজা গামছা দিয়ে অর্কর বুক-গলা- মাথা মুছিয়ে দিতে লাগলেন ডাক্তার। মাধবীলতা বলল, আমাকে দিন, আমি করছি। ডাক্তার ঘাড় নেড়ে বললেন, ওষুধটা গুড়ো করে একটা কাপে জল মিশিয়ে আনুন!

জলে গোলা ট্যাবলেট খুব সাবধানে বেঁহুশ অর্কর জিভে ঢেলে দিলেন ডাক্তার। তারপর আধ ঘণ্টা ধরে শুধু জলেভেজা গামছা দিয়ে শরীর মুছে দেওয়া চলল। অনিমেষ ততক্ষণে কিছুটা স্থির হয়েছে। ও দেখছিল এই ঘরে দুটো মানুষ সমানে পরিশ্রম করে যাচ্ছে। তার নিজের ছেলে যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে অথচ সে কোন কাজেই লাগছে না। এখন আর পায়ের ব্যথাটা নেই। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে ওটা চলে যাচ্ছে। সে বলল, এবার আমাকে দাও, আমি হাওয়া করি খোকাকে।

পাখা বন্ধ না করে মাধবীলতা বলল, তুমি পারবে না, কষ্ট হবে।

পারব। নিজের অজান্তে গলাটা চড়ে গেল অনিমেষের। অবাক চোখে মাধবীলতা ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে। বলে পাখাটা মাটিতে রেখে সরে বসল।

ক্রাচে ভর করে নিচে নামল অনিমেষ। তারপর শরীরটাকে টেনে নিয়ে এল অর্কর মাথার কাছে এসে পাখা তুলে নিল হাতে।

ডাক্তারবাবু এবার উঠলেন, মনে হচ্ছে আর চিন্তার কোন কারণ নেই। এখন অঘোরে ঘুমুবে ও যাহোক, কাল সকালে খবর দেবেন।

এইসময় বিড় বিড় করে উঠল অর্ক। তারপর পাশ ফিরে শুতে শুতে কিছু বলল। অনিমেষ তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়ল ওর দিকে, কষ্ট হচ্ছে? কিছু বলছিস?

অর্কর চোখ বন্ধ। সেই অবস্থায় ঠোঁট কাঁপল, বমি পাচ্ছে, মা। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল আস্তে আস্তে। ওর মুখ এখন বেশ শান্ত। মাধবীলতা ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বলল, ওই এক কথা ডাক্তারবাবু, অথচ বমি করছে না।

ডাক্তারবাবু হাসলেন। তারপর চলে যাওয়ার আগে বললেন, ভালই তো, বমি করুক। বমি করলে সব সাফ হয়ে যায়।

ঝড় বয়ে গেল যেন সারারাত ধরে। ওরা দুজনে ছেলের পাশে চুপচাপ বসে। মাধবীলতা বলেছিল অনিমেষকে, তুমি এবার শুয়ে পড়, আমি দেখছি।

না, ঘুম আসবে না। অনিমেষ কাটিয়েছিল অনুরোধটা। মাধবীলতাকে সে আর হাওয়া করতে দেয়নি। অনিমেষের মুখের দিকে তাকিয়ে মাধবীলতা বলল, তুমি কষ্ট করলে আমি আরামে ঘুমুতে পারব? কি মনে হয় তোমার।

হাত থামিয়ে অনিমেষ বলেছিল, মুশকিল তো এইটেই। সমস্ত কষ্টের ইজারা যেন তুমি নিয়ে বসে আছ। যা কিছু ঝামেলা তা তুমি যেন জোর করে সামলাবে। আসলে দুঃখের মধ্যে না থাকলে তোমার আজকাল খারাপ লাগে। লোকে শুনলে বলবে মেয়েটা কত কষ্ট পাচ্ছে, আহা, এত দুঃখ চোখ চেয়ে দেখা যায় না।

মাধবীলতা হেসে বলল, তাহলে লোকের মুখ চেয়ে এখন তুমি খোকাকে বাতাস করছ?

আমি তাই বলেছি? অনিমেষ উগ্র হতে গিয়েও পারল না।

মাধবীলতা হাত বাড়িয়ে অর্কর কপাল স্পর্শ করল। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, এসবে আমার কষ্ট হয় না। তুমি ঠিকই বলেছ। কত মেয়ের তো কতরকম শখ থাকে। আমার ধরো এইটেই। তোমাদের জন্যে কিছু করছি। একটু আগে ডাক্তারবাবু বলে গেলেন খোকাকে নাকি আমার ছেলে বলে ভাবতে পারেননি। আচ্ছা, আমার ছেলে কিরকম হলে মানাতো?

মুশকিল! কে কি বলল তাই নিয়ে ভাবছ কেন?

ভাবিনি। মাধবীলতা অন্যমনস্ক হয়ে বলল। তারপর হঠাৎ মনে পড়ায় হেসে বলল, খোকা আমাকে কথা দিয়েছে যে আর কখনও খারাপ কথা বলবে না।

অনিমেষ অবাক হল, কখন কথা দিল?

প্রথম রাত্রে। তখন ও ভালই ছিল।

হঠাৎ?

কি জানি একটা স্বপ্ন দেখে খুব ভয় পেয়ে আমাকে শুতে বলেছিল পাশে। তারপরই আমার মনে হয় ও কোন মানসিক আঘাত পেয়েছে।

মানসিক আঘাত? প্রেম ট্রেম?

দূর! অন্য কিছু। কি সেটা তাই ধরতে পারছি না। এবার পাখাটা দাও। হাত বাড়ালো মাধবীলতা। অনিমেষ সত্যিই আর পারছিল না। এবার নিঃশব্দে পাখাটা দিয়ে দিল। মাধবীলতা বলল, তাহলে কষ্ট করতে দিলে শেষ পর্যন্ত। হঠাৎ একটা আবেগ অনিমেষকে কাঁপিয়ে দিল। সে দুহাতে মাধবীলতাকে বুকে টানবার চেষ্টা করল। মাধবীলতা একটু হকচকিয়ে গেল প্রথমটা। তারপর একটু জোরেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ছি! খোকা রয়েছে না এখানে?

অনিমেষ একটু অপরাধীর চোখে ঘুমন্ত অর্ককে দেখল। অঘোরে ঘুমাচ্ছে এখন। চোখ বন্ধ, ঠোঁটে তৃপ্তির ছাপ। এতবড়, অসুস্থ ছেলের সামনে এরকম করা উচিত হয়নি বুঝতে পেরে সে মাথা নিচু করে শরীরটাকে খাটের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। মাধবীলতার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ মাধবীলতা তার বুকের ওপর হাত রাখল, রাগ করলে?

না। অনিমেষ কোনরকমে জবাব দিল।

মাধবীলতা একবার অনিমেষের বুকে মাথা রেখেই চট করে সরে এল। এসে ছেলেকে ধীরে ধীরে বাতাস করতে লাগল।

২২. দিন সাতেক বাদে সুস্থ হল অর্ক

দিন সাতেক বাদে সুস্থ হল অর্ক। এই সাতদিনের প্রথম দুদিন ঠিক চেতনায় ছিল না। তারপরে এত দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে মাধবীলতার ঘর থেকে বের হওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়াল। এই সময়ে ছেলেকে একটু একটু করে অন্যরকম হয়ে যেতে দেখল সে। কথা যতটা সম্ভব কম বলে, আনমনে চেয়ে থাকে, বোঝা যায় কিছু ভাবছে এবং জিজ্ঞাসা করলে শুধু ম্লান হাসে। এর মধ্যে দুদিন বিলু এসেছিল ওকে ডাকতে। উঠে বাইরে যাওয়ার সামর্থ্য ছিল না। মাধবীলতাকে বলেছিল, বলে দাও আমি ঘুমুচ্ছি, শরীর খারাপ।

দ্বিতীয়দিন মাধবীলতা ঈষৎ চমকেছিল। বিলুকে আজ এড়িয়ে যাচ্ছে অর্ক সেটা বুঝে ধন্দে পড়েছিল। এড়িয়ে যাওয়ার কোন কারণ নেই। এখন সে বেশ স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারে, ঘরের ভেতর হাঁটাচলা ছাড়া কল-পায়খানায় যাচ্ছে। তাহলে? বিলুকে বিদায় করে মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করেছিল, কি ব্যাপার?

অর্ক প্রশ্নটা যেন ধরতে পারেনি এমন ভঙ্গীতে তাকাল।

বন্ধুর সঙ্গে দেখা করছিস না কেন? বন্ধু শব্দটা ইচ্ছে করেই বেঁকিয়ে বলল সে।

ভাল লাগছে না। অর্ক চোখ বন্ধ করল।

তুই কি ভাবিস বল তো দিন রাত?

কিছু না। অর্ক এড়িয়ে গেল।

এই ব্যাপারটা অস্বস্তিতে ফেলল মাধবীলতাকে। যে ছেলে দিনরাত বাইরে পড়ে থাকত সে সুস্থ হয়েও ঘর ছেড়ে বের হচ্ছে না। দু’দুবার অসুস্থতার জন্যে স্কুল কামাই হয়ে গেছে, আগেও ঠিক মত যেত না হয়তো, এভাবে চলতে দেওয়া উচিত নয়। যদিও সুস্থ হবার পর অর্ক বইপত্তর নিয়েই পড়ে থাকে কিন্তু এটা ওর স্বাভাবিক জীবন নয়। এর মধ্যে বস্তিতে যে ঘটনাটা ঘটল তা নিয়েও ওকে একটুও চিন্তা করতে দেখল না মাধবীলতা। অনুপমাকে পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া যাচ্ছে না মানে নিরুদ্দেশ নয়, সে ইচ্ছে করেই চলে গেছে। কালীঘাটে বিয়ে সেরে সেই হকার ছেলেটির সঙ্গে উধাও হয়ে গিয়েছে। শুনে অর্ক হেসে বলল, বেঁচে গেল।

চমকে উঠেছিল মাধবীলতা। চোখাচোখি হয়েছিল অনিমেষের সঙ্গে। এত বড় সত্যি কথাটা ছেলের মুখ দিয়ে কি সহজে বেরিয়ে এল! শেষ পর্যন্ত তাকে মাধবীলতাই ঠেলেঠুলে বাইরে পাঠাল। স্কুলে যেতে হবে, ভদ্র বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে হবে এবং স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে হবে। ছেলের জন্যে ওর নিজেরও স্কুলে যাওয়া হয়নি অনেকদিন। এভাবে ছুটি পাওয়া আর সম্ভব নয়। অর্ক অবশ্য এখন বাধ্য হয়ে বেরুচ্ছে কিন্তু তার দিনরাতের সেই আড্ডাটা উধাও হয়ে গিয়েছে।

খুরকি এবং কিলার মৃত্যুর পর তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেন হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। অশ্লীল কথাবার্তা চিৎকার করে ক’দিন কেউ বলছে না। পেটো পড়েনি এই ক’দিন। শুধু রাত বিরেতে কয়েকটা বুড়ো মাতাল এখনও চেঁচায়। বিলু ছাড়া অনেককেই পুলিস তুলে নিয়ে গিয়েছিল। বেধড়ক পিটিয়ে জানতে চেয়েছিল খুরকি-কিলার সঙ্গে কি সম্পর্ক ছিল এদের। সতীশের কাছে ছুটে গিয়েছিল ওদের আত্মীয়রা। সতীশ কিন্তু সরাসরি না বলে দিয়েছে, অসম্ভব। সমাজ বিরোধীদের আমি কখনই সমর্থন করব না। পার্টি এইসব ছেলেদের জন্যে ও সি-কে বলা পছন্দ করবে না। তাছাড়া দুটো সমাজবিরোধী মরেছে, দেশ বেঁচেছে। আপনাদের ছেলেরা দিনরাত লাল চোখে মাস্তানি করবে, ওদের ছাড়িয়ে আনলে সাধারণ মানুষ আমাদের বিরুদ্ধে যাবে।

সতীশ যে এরকম কথা বলবে তিন নম্বরের বাসিন্দারা ভাবতে পারেনি। চিরকাল যে পার্টি ক্ষমতায় থাকে তারাই থানা থেকে ছাড়িয়ে আনে। জানি ভোট দেওয়া, মাঝে মাঝে পোস্টার মারা থেকে অনেক কাজ এরা পার্টির জন্যে চিরকালই করে আসে। আজ সতীশ এক কথায় বলে দিল সাহায্য করবে না! যাঁদের ছেলে তাঁদের লাগল কিন্তু তিন নম্বরের বেশীর ভাগ মানুষ খুশি হল। অবিনাশ একদিন সতীশকে একা পেয়ে বলেই ফেলল, আচ্ছা সতীশ, ওদের আজীবন থানায় আটকে রাখা যায় না? কিংবা ধরো, হাত পা ভেঙ্গে ছেড়ে দিল। এ সতীশ মাথা নেড়েছিল, পাগল হয়েছেন! কোন আইনে ওসব করবে। তার চেয়ে আপনারা সবাই নাগরিক কমিটিতে আসুন। আমরা সবাই একজোট হলে ওরা চুপ করে যেতে বাধ্য হবে।

অবিনাশ ঢোক গিলে বলেছিল, নাগরিক কমিটি মানে তো তোমাদের পার্টি!

না কক্ষনো না। সতীশ প্রতিবাদ করেছিল, এই এলাকার সমস্ত সুস্থ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে নিয়ে আগাদের নাগরিক কমিটি।

অবিনাশ মাথা চুলকেছিল, তোমাকে যে কথাটা বললাম তা যেন কাউকে বলে ফেল! সতীশদের নাগরিক কমিটি যখন সমাজবিরোধীদের উৎখাতের জন্যে আলোচনা শুরু করেছে তখন নুকু ঘোষকে ঘন ঘন নিমুর চায়ের দোকানে আসতে দেখা গেল। সি পি এম ক্ষমতায় আসার পর নুকু ঘোষের আর পাত্তা পাওয়া যেত না খুব একটা। এবার এই ঘটনার পর জমিয়ে আড্ডা মারতে দেখা গেল তাকে। থানা থেকে ছাড়া পাওয়া ছেলেরা এখন নুকু ঘোষের সঙ্গে আড্ডা মারে। কোয়াকে নুকু ঘোষের ডান হাত বলছে সবাই। তারপরেই একটা কাণ্ড হয়ে গেল। নুকু ঘোষের নেতৃত্বে একটা মাঝারি মিছিল ঈশ্বরপুকুর লেনে শ্লোগান দিতে দিতে চারপাক খেল। মিছিলের প্রথমেই থানা ফেরত ছেলেগুলো। তারপর যারা, তাদের চেনে না ঈশ্বরপুকুরের বাসিন্দারা। প্রত্যেকের চোয়াড়ে চেহারা, কারো কারো মুখে অতীতের কাটা দাগ। কোয়া চিৎকার করছিল, পুলিসের কালো হাত ভেঙ্গে দাও, গুঁড়িয়ে দাও। প্রকৃত সমাজবিরোধী দূর হঠো হঠো। সমাজবিরোধী কারাদেশের শত্রু যারা।

আবহাওয়াটা আবার গরম হয়ে গেল। এবং দেখা গেল নাগরিক কমিটির সেই সক্রিয় ভাবটা কেমন যেন আচমকা থিতিয়ে এসেছে। সতীশকে কয়েকদিন একটু মনমরা হয়ে যাওয়া আসা করতে দেখা গেল। কানাঘুষায় শোনা গেল সতীশ নাকি এইভাবে থেমে যাওয়াটা সমর্থন করেনি। এই কারণে বেশ ঝামেলায় পড়েছে। সে নাকি সরাসরি বলেছিল, এলাকার সমাজবিরোধীদের না। সরাতে পারলে আমরা জনসমর্থন পাব না। আপনারা একটা জিনিস ভেবে দেখছেন না, আমরা এত বছর ক্ষমতায় আছি কিন্তু এখনও সাধারণ নাগরিকদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারিনি। ভদ্রপল্লীতে প্রকাশ্যে চোলাই মদ বিক্রি হচ্ছে, সমাজবিরোধীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা খাচ্ছে এবং পুলিস জেনে শুনে চুপ করে রয়েছে। আমরা যদি এলাকার মানুষকে এর বিরুদ্ধে একত্রিত না করতে পারি তাহলে পার্টির পেছনে জনসমর্থন থাকবে কেন? পার্টির একজন নেতা উত্তর দিয়েছিলেন, এলাকার মানুষ তাঁদের সমস্যা নিয়ে জোট বেঁধে এগিয়ে আসুন, আমরা তাঁদের সমর্থন করব। কোন ব্যক্তিবিশেষের অসুবিধে দেখার মত সময় পার্টির নেই।

সতীশদা বোঝাতে চেয়েছিলেন, চোলাই-এর দোকান যে বাড়ির সামনে হয়েছে অসুবিধে তাদেরই বেশী কিন্তু এটা সামাজিক অপরাধ। আমরা মার্কসিজমে বিশ্বাস করি কিন্তু জনসাধারণের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলি, এটা ঠিক নয়। সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করার দায়িত্ব আমাদের, কোন কালেই তারা নিজেরা সংগঠিত হয় না।

সতীশদার এই ভাষ্য নাকি ওপর তলার নেতাদের পছন্দ হয়নি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটা সামগ্রিক প্রতিবাদ কর কিন্তু সরাসরি খুঁচিও না–এই নীতি নাকি সতীশদাও পছন্দ করেন নি। অন্তরঙ্গদের বলেই ফেলেছিলেন, এর চেয়ে পার্টি যদি বিরোধী দল হয়ে থাকতো তাহলে আমরা বেশী কাজ করতে পারতাম। শোনা যাচ্ছে, সতীশদার বিরুদ্ধে একটা ব্যবস্থা নেবার কথা উঠেছিল। কিন্তু এই এলাকায় সতীশদার কাজকর্ম এবং জনসংযোগের কথা ভেবে সেটা থেমে গেছে। এসব খবর চাপা থাকেনি। নুকু ঘোষের দল বুঝে গেছে যে সতীশকে একটু-আধটু আওয়াজ দিলে পার্টি খুব একটা প্রতিরোধ করবে না। একদিন রাত্রে কোয়া মাল খেয়ে সতীশদাকে ঝেড়ে খিস্তি করে গেল তিন নম্বরের সামনে দাঁড়িয়ে। খুরকি-কিলা মারা যাওয়ার পর সেই প্রথম প্রকাশ্যে খিস্তি করা হল। দল বেঁধে বেরিয়ে এসে মানুষ সেগুলো বেশ জম্পেশ করে শুনল। মাঝে মাঝে কেউ অবশ্য বলছিল, এই কোয়া বাড়ি যা। কিন্তু সেটা যেন কোয়ার উৎসাহ আরো বাড়িয়ে দেওয়ার জন্যে বলা। সেই সময় পুলিসের একটা জিপ ওখান দিয়ে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। কোয়ার তখন এমন অবস্থা যে পুলিসকেও চিনতে পারছে না। মজা-দেখার ভিড় হাওয়া হয়ে গেলেও কোয়া থামছিল না। ওকে সিপাইরা তুলে নিয়ে গেল থানায়। কিন্তু পরদিনই হাসতে হাসতে ফিরে এল পাড়ায়। পাড়ার লোক বুঝে গেল ব্যাপারটা। এখন কিছুদিন কোয়াই এখানকার রাজত্ব চালাবে।

স্কুল থেকে ফিরছিল অর্ক। মোড়ের মাথায় সতীশদার সঙ্গে দেখা। সতীশ ওকে দেখে যেন অবাক হল, কি খবর তোমার, আজকাল পাড়ায় দেখতে পাই না।

অর্ক এড়িয়ে যাবে ভেবেছিল, না পেরে বলল, অসুখ করেছিল।

হ্যাঁ, খুব খারাপ হয়ে গেছে চেহারা। বাড়ি থেকে বের হও না বুঝি?

হ্যাঁ। আমি যাচ্ছি।

না। দাঁড়াও। তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। সতীশদা চারপাশে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা চল, পার্টি অফিসে বসে কথা বলি।

পার্টি অফিসে? অর্ক একটু অবাক এবং অস্বস্তি মেশানো গলায় বলল।

হ্যাঁ। তোমার আপত্তি আছে? কেউ নেই ওখানে এখন।

অতএব সতীশদার সঙ্গে অর্ককে পার্টি অফিসে ঢুকতে হল। মিষ্টির দোকানের কারিগর ছাড়া এসময় কোন লোক ছিল না সেখানে। তাকে বিদায় করে সতীশদা ঢালাও সতরঞ্জির ওপর বাবু হয়ে বসে বলল, তুমি এসব সমর্থন কর?

কি সব?

এই দিনরাত খিস্তি খেউড়, রকে বসে তাস খেলা আর মাল খাওয়া?

না।

কোয়া তোমার বন্ধু ছিল। তুমি জান কোয়া এখন নিজেকে পাড়ার মাস্তান ভাবছে?

আমি এখন পাড়ার কোন খবর রাখি না।

কেন?

আমার এসব ভাল লাগে না।

কিন্তু সামাজিক মানুষ হিসেবে তুমি দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পার না। সমাজ যেমন তোমাকে কিছু দেবে তেমনি তোমার কাছ থেকেও কিছু আশা করবে। আমি চাই তুমি এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করবে।

কি করতে বলছেন আমাকে?

বস্তির মানুষকে বোঝাবে যে এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করা দরকার। বলবে একজন অন্যায় করবে এবং দশজন তা মেনে নেবে না।

হঠাৎ অর্কর মুখ থেকে বেরিয়ে এল, দুর, এসব কেউ শুনবে না।

শুনবে না কেন?

জ্ঞান দিলে মানুষ তা শুনতে চায় না। ভাবে বড় বড় কথা বলছে। যতক্ষণ তাদের খাওয়া পরায় হাত না পড়ছে ততক্ষণ এসবে পাবলিকের কিছু যায় আসবে না। তাছাড়া আপনাদের দেখলেই সবাই ভাবে ভোট চাইতে এসেছেন। এই যে আমাদের পাড়ার একটা মেয়ে হাওয়া হয়ে গেল, কেন গেল ভেবে দেখেছেন? আর একটা মেয়ে রোজ শরীর বিক্রি করতে যায়, কেন যায় তা আপনারা জানেন না? কি করেছেন তার?

উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে গিয়ে অর্কর দুর্বলতা বেড়ে গেল। কপালে ঘাম জমছিল ওর। সতীশদা কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, এই জন্যেই তো তোমার মত ছেলেকে আমাদের চাই। পার্টির ভেতরে থেকে পার্টির সমালোচনা করা দরকার। আমি চাই তুমি নিয়মিত পার্টি অফিসে আসবে।

অর্ক মাথা নাড়ল, আমার এসব ভাল লাগে না।

কেন? তুমি গরীব পরিবারের ছেলে। দেশের আশীভাগ মানুষ ভাল করে খেতে পায় না, কেন তুমি তাদের পাশে দাঁড়াবে না?

অর্ক সতীশদার দিকে তাকাল, তার জন্যে তো আপনারা আছেন।

নিশ্চয়ই। কিন্তু আমরা কে? তোমরা আমাদের পাশে এসে না দাঁড়ালে আমরা কিছু করতে পারব? তুমি ভেবে দ্যাখো; এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে না। না পার্টি অফিস থেকে বেরিয়ে আসা মাত্র বিলুর সঙ্গে দেখা হবে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বিলুর চোখ কপালে উঠল, আই বাপ গুরু, তুমি লালু হয়ে গেলে!

লালু? হতভম্ব হয়ে গেল অর্ক।

তাই বলি! বেশ কিছুদিন তোমার পাত্তা নেই! বাড়িতে গেলে বলে অসুস্থ আর এদিকে তলায় তলায় জব্বর লাইন করে নিয়েছ! সাবাস। বিলু এগিয়ে এসে অর্কর কাঁধে হাত রাখল।

কেউ কাঁধে হাত দিলে বেশ অস্বস্তি হয় অর্কর। হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল, কি আজেবাজে কথা বলছিস?

আজেবাজে? চেপে গিয়ে কি হবে বল। আমরা হলাম জিগরি দোস্ত। ধান্দাটা কি? তুমি শালা সি পি এম হয়ে গেলে? বিলু অবিশ্বাসী হাসল

কেন, সি পি এম হলে অন্যায়টা কি? অর্কর মনে হঠাৎ এক ধরনের প্রতিরোধ করার ইচ্ছে জন্মাল।

কি আর হবে। কোয়া ফক্কা হয়ে যাবে। তুমি তিন নম্বরের শের বনে যাবে। একটু লাইন টাইন জোরদার করতে পারলে বড় চিড়িয়া মারতে পার।

আমি যদি সি পি এম হই তাহলে তিন নম্বরে খিস্তি করা চলবে না আর মাল খাওয়া বন্ধ করতে হবে। বুঝলি! অর্ক বিলুর দিকে তাকাল।

হাঁ হয়ে গেল বিলু, যা ব্বাবা। তাহলে তুমি ফুটে যাবে গুরু। ও দুটোকে বাদ দিয়ে তিন নম্বরদুটো দিন থাকতে পারবে না। ওই যে দাড়িওয়ালা সাহেবটা, মোড়ের মাথায় ছবি আছে দেওয়ালে আঁকা, কি যেন নাম?

মার্কস।

হ্যাঁ, ওই সাহেব এলেও পারত না। এসব করতে যেও না গুরু। সি পি এম হয়েছ, সরের ওপর ওপর হেঁটে বেড়াবে, দুধের মধ্যে ডুববে না।

অর্ক হেসে বলল, তুই তো দারুণ কথা বলতে পারিস। আর তখনই ওর নজরে পড়ল তিন নম্বরের সামনে দাঁড়িয়ে একজন বেঁটে মতন লোক এদিক ওদিকে তাকাচ্ছে। তারপরেই চিনতে পেরে সে বিলুকে বলল, আমি যাচ্ছি পরে দেখা হবে।

বিলু কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু অর্ক দাঁড়াল না। হন হন করে কাছে পৌঁছে একটু হেসে জিজ্ঞাসা করল, আপনি?

পরমহংস ঘুরে দাঁড়িয়ে ওকে দেখে যেন মাটি পেল, আরে এই যে, কেমন আছ? অর্ক গোলগাল মানুষটির দিকে স্মিত চোখে তাকাল। ওর হাবভাব, চেহারা এবং গায়ের রঙের মধ্যে বেশ বাঙালি বাঙালি ভাব আছে।

ভাল। আপনি কি আমাদের বাড়িতে এসেছেন?

হ্যাঁ, আর কোন চুলোয় আসব? তোমার বাবা কেমন আছে?

ভাল। আসুন। অর্ক পরমহংসকে নিয়ে গলির ভেতরে ঢুকল। মোক্ষবুড়ি সেই একই রকম ভঙ্গীতে পাথরের মত বসে আছে। কিলা মারা যাওয়ার পর থেকে জোর করে ঘরে নিয়ে না গেলে বুড়ি ওখান থেকে ওঠে না, কথাও বলে না। এক হাতে ধুতির কোঁচা তুলে সাবধানে পা ফেলে পরমহংস বলল, বস্তিটা খুব ডেঞ্জারাস, না?

মানে? অর্ক অবাক হয়ে ফিরে তাকাল।

সব ধরনের মানুষ থাকে এখানে মনে হচ্ছে।

হ্যাঁ। এদিকে বাঙালি বেশী, ওপাশে বিহারীরা।

এরকম একটা জায়গা খুঁজে পেলে কি করে?

আমি তো ছোটবেলা থেকেই এখানে আছি।

ওরা অনুদের বাড়ির পাশ ঘুরে আসতেই মাধবীলতার মুখোমুখি হয়ে পড়ল। মাধবীলতা তখন টিউশনি করতে বের হচ্ছিল। পরমহংসকে দেখে সমস্ত মুখ উদ্ভাসিত হল, কি সৌভাগ্য আপনি, মনে ছিল তাহলে?

খুব অপ্রস্তুত হয়েছে এমন ভান করে পরমহংস বলল, এটা কি ঠিক হল? দশ নম্বর ব্যাটসম্যানকে বাম্পার দেওয়া নিষেধ, আইনে নেই। বুঝতে পারল না মাধবীলতা, তার মানে?

পরমহংস হেসে পাশ কাটালো কথাটার, কর্তা কোথায়?

ঘরে। আসুন আসুন। মাধবীলতা আবার দরজার দিকে ফিরে গেল।

আপনি কোথাও বের হচ্ছিলেন বলে মনে হচ্ছে? পরমহংস জিজ্ঞাসা করল! মাধবীলতা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, পড়াতে। তারপর দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, এই কে এসেছে দ্যাখো। ভেতর থেকে অনিমেষ চেঁচিয়ে বলল, আয়।

পরমহংস দরজায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল। ওর মুখে একটা ছায়া নেমে আসছিল কিন্তু খুব দ্রুত সেটাকে সরিয়ে দিয়ে বলল, না দেখে ডাকলি?

দেখার দরকার নেই। জীবনের মাঠে না নেমে খেলার সব পরিভাষা একমাত্র তোর মুখেই শুনে আসছি। অতএব ভুল হবার কথা নয়। অনিমেষ বাবু হয়ে বসে বইটাকে সরিয়ে রাখল এক পাশে।

আমি হলাম নন প্লেয়িং ক্যাপ্টেন। তারপর মাধবীলতার দিকে একটা ঢাউস প্যাকেট কাঁধের ব্যাগ থেকে বের করে এগিয়ে দিয়ে বলল, সোজা অফিস থেকে আসছি, এগুলো বিতরণ করলে খিদেটা মেটে।

মাধবীলতা রাগ করতে গিয়েও পারল না, কেন আমরা বুঝি খাওয়াতে পারতাম না অই হাতে করে প্যাকেট আনতে হল। গরীব, তবে এতটা বোধহয় নয়। পরমহংস অনিমেষের দিকে ঘুরে বলল, ভাই, তোর বউ-এর মুখে খুব ধার তো! আমি কোথায় নতুন বউ-এর মুখ দেখব বলে প্যাকেটটা আনলাম, আরে বাবা খালি হাতে তো আসতে পারি না।

মাধবীলতা প্রতিবাদ করতে গিয়ে হেসে ফেলল, আপনি না, যাচ্ছেতাই।

যা ইচ্ছে আমি তাই। গুড। প্যাকেটটা ধরিয়ে দিয়ে পরমহংস সোজা অনিমেষের পাশে খাটের ওপর গিয়ে বসল।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কি খবর বল?

আমার আবার খবর কি, খাচ্ছি দাচ্চি ঘুরে বেড়াচ্ছি। তোরা কেমন আছিস?

আর বলবেন না। মাধবীলতা প্যাকেটটা খুলছিল, এই যে শ্রীমান, আমাদের নাম ভুলিয়ে ছেড়েছিল। সাতদিন ধরে নড়তে পারি নি, এত অসুখ।

কি হয়েছিল?

ওইটেই ধরা যায় নি। সুস্থ শরীরে শুয়ে বলল, বমি পাচ্ছে। বমি করার চেষ্টা করেও হল না তেমন। ব্যাস, তারপর খুব জ্বর, বেহুঁশ হবার মত অবস্থা আর সারাক্ষণ ভুল বকে যাওয়া, বমি পাচ্ছে বমি পাচ্ছে। মাধবীলতা প্যাকেটটা খুলে গালে হাত দিয়ে বলল, হায়, এত কি এনেছেন?

সেকথায় কান না দিয়ে পরমহংস তখন দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ানো অর্ককে বলল, এমন কিছু দেখেছ যাতে বমি পায় মানুষের?

অর্ক হেসে ফেলল। পরমহংসের বলার ধরনটাই ওকে হাসাল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে হল লোকটা খুব বুদ্ধিমান। অর্ক জবাব দিল না।

খাবার শেষ করে পরমহংস বলল, আপনাকে তো বেরোতে হবে?

একটু দেরি করে গেলে কোন অসুবিধে হবে না।

মাধবীলতা চায়ের জল বসিয়ে জবাব দিল। অর্ক বইপত্র রেখে খাবার হাতে নিয়ে খাটের একপাশে বসেছিল। তার দিকে তাকিয়ে পরমহংস বলল, নাও, এবার তৈরি হও।

তৈরি? কিসের জন্যে? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

বাসা বদল করতে হবে। তোমাদের জন্যে একটা ভাল আস্তানা পেয়েছি।

পরমহংসের কথা শেষ হওয়ামাত্র মাধবীলতা উল্লসিত গলায় বলল, সত্যি?

ইয়েস ম্যাডাম। আমি ভাবতে পারছি না আপনারা কি করে এইরকম নরকে রয়েছেন। দুজন শিক্ষিত মানুষ কেন চিরকাল বস্তিতে পড়ে থাকবে? এই প্রথম পরমহংসকে সত্যি সত্যি উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। উত্তেজনাটা আন্তরিক।

অনিমেষ জবাব দিল, তুই জানিস না সব ঘটনা তাই একথা বলছিস। আমার চিকিৎসার জন্যে ও শেষ হয়ে গিয়েছিল।

তোর চিকিৎসা তো জেল থেকে বেরিয়ে আসার পরে শুরু হয়েছে। তার আগে? আপনি এই বস্তির খবর পেলেন কি করে তাই আমার মাথায় ঢুকছে না।

মাধবীলতা নিচু গলায় বলল, সে অনেক কথা। আমি আগে একটা বাড়িতে ওয়ানরুম ফ্ল্যাট নিয়ে ছিলাম। বলতে পারেন এখানে আসতে বাধ্য হয়েছি। এসে দেখলাম আর যাই হোক এখানে মানুষ অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলায় না। এটা আমার খুব জরুরী ছিল।

পরমহংস বলল, এসব আমার মাথায় ঢোকে না। যা হোক, এখানে আর আপনাদের থাকা চলবে না। আমি সব ব্যবস্থা করে এসেছি।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করেল, কি ব্যবস্থা?

শোভাবাজারে একটা বাড়ি পেয়েছি। দেড়খানা ঘর, রান্নাঘর তবে বাথরুমটা শেয়ার করতে হবে আর এক ভাড়াটের সঙ্গে। তারাও স্বামী স্ত্রী এবং কোন বাচ্চা নেই। আমার বাড়ি থেকে বেশী দূরেও নয়। পরমহংস জানাল।

সত্যি? মাধবীলতার মুখে খুশি ছড়িয়ে পড়ল।

যাচ্চলে। এটাকে কি আপনি ওয়াইড বল ভাবছেন নাকি?

মানে? মাধবীলতা বুঝতে পারল না।

অনিমেষ হেসে বলল, ওটা ক্রিকেটের পরিভাষা।

মাধবীলতা চায়ের জল নামিয়ে বলল, সত্যি আপনি পারেন। কিন্তু কত ভাড়া দিতে হবে তা বললেন না তো?

একশ পচাত্তর।– অনিমেষ এবং মাধবীলতা মুখ চাওয়াচায়ি করল। মাধবীলতার দম যেন বন্ধ এমন গলায় বলল, আর?

আর তিন মাসের অ্যাডভান্স, নো সেলামি। বাড়িওয়ালা আমার বিশেষ পরিচিত। এখন বল তোমরা কবে দেখতে যাবে। যা করবে এই সপ্তাহের মধ্যে করবে। অবশ্য করাকরির কিছু নেই, তোমাদের যেতেই হবে। পরমহংস দৃঢ় গলায় বলল।

অনিমেষ বলল, সাতদিনের মধ্যে? আর একটু সময় পাওয়া যাবে না?

কেন? সময়ের দরকার কি? পরমহংস খিঁচিয়ে উঠল, বাড়ি আমি দেখেছি, অপছন্দ হবার কোন কারণ নেই। অন্য ভাড়াটে কোন ঝামেলা করবে না। সাতশ টাকা দিয়ে পজিশন নিয়ে নাও।

সাতশো? অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকাল।

চায়ের কাপ পরমহংসের হাতে তুলে দিতে দিতে মাধবীলতা বলল, ঠিক আছে। ওতে কোন অসুবিধে হবে না। আমি আর খোকা কাল বিকেলেই দেখতে যাব।

পরমহংস চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আজ যেতে পারবেন?

আজ? আমি তো টিউশনিতে যাব ভেবেছিলাম। না, কালই যাব।

অনেক কামাই হয়ে গেছে ওর অসুখের জন্যে। ওঃ, সত্যি আপনি আমাদের খুব উপকার করলেন। এখন কলকাতার বুকের ওপর এই ভাড়ায় বাড়ি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। মাধবীলতা নিশ্চিন্ত গলায় বলল।

আপনি ভাগ্যবতী। পরমহংসের মুখ নির্বিকার।

মাধবীলতা হেসে ফেলল, যা বলেছেন।

এই বস্তি ছেড়ে চলে যেতে হবে। অর্ক বুঝতে পারছিল না সে খুশি হবে কিনা। মাধবীলতা পরমহংসকে বসতে বলে পড়াতে চলে গেছে। অনিমেষ আর পরমহংস গল্প করছিল। অর্ক মুখ হাত পা ধোওয়ার জন্যে কলতলায় আসতেই থমকে দাঁড়াল। বলল, কি চাই?

তৃষ্ণাদি তোমাকে ডেকেছে।

কেন? আমার সঙ্গে কি দরকার?

আমি জানি না।

আমি যাব না। আমার সময় নেই।

ঠিক আছে, বলে দেব। মেয়েটা চলে যাচ্ছিল অর্ক পিছু ডাকল, শোন। একটু দাঁড়া।

প্রায় দৌড়ে ঘরে ফিরে এল অর্ক। পরমহংস এবং অনিমেষ ওর দিকে একবার তাকিয়ে আবার কথা বলতে লাগল। নিজের বই-এর তাক থেকে সেই কলমটা বের করে সে বাইরে চলে এল। তারপর ঝুমকির হাতে তুলে দিয়ে বলল, এটা ওকে ফিরিয়ে দিবি।

কি এটা?

ছুরি। আমি ওটা না বলে এনেছিলাম। এখন আর দরকার নেই। কথাটা শেষ করে অর্ক মুখে জলের ছিটে দিল আঁজলা করে।

২৩. সন্ধ্যে পার হয়ে গেলে

সন্ধ্যে পার হয়ে গেলে এই ঘরে অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করছিল। মাধবীলতা রান্না শেষ করে খাটের ওপর বাবু হয়ে বসেছিল। অনিমেষ বালিশে কনুই রেখে একটু তফাতে। নিচে দেওয়ালে হেলান দিয়ে অর্ক বই মুখে। সন্ধ্যের মুখেই পরমহংস চলে গিয়েছে। কথা হয়েছে আগামীকাল বিকেলে মাধবীলতা এবং অর্ক গ্রে স্ট্রীট চিৎপুরের মুখে পরমহংসের সঙ্গে দেখা করে বাড়ি দেখতে যাবে। পছন্দ হলে কালকেই পাকা কথা হয়ে যাবে।

অনিমেষ মাধবীলতার মুখের দিকে তাকাল। একটু যেন অন্যরকম দেখাচ্ছে এখন! একটা চাপা। খুশির জ্যোতিতে মাখামাখি চিবুক, ঠোঁটের কোণ, চোখের কোল। সে কথা তুলল, তাহলে আমাদের বস্তিজীবন শেষ!

দাঁড়াও। না আঁচালে বিশ্বাস নেই।

না। পরমহংস যখন নিজে থেকে বলে গেল তখন নিশ্চিন্ত থাকতে পার।

কিন্তু এত সস্তায় কলকাতায় ফ্ল্যাট পাওয়া যায়? কি জানি। অবশ্য অন্য রকম মানুষ এখনও আছে। সেদিন একটা ঘটনা শুনলাম স্কুলে। আমার এক কলিগের হাসব্যাণ্ড তিন কাঠা জমি কিনবেন বলে কলকাতা চষে বেড়াচ্ছেন কিন্তু কিছুতেই দরে পেরে উঠছেন না। ছ’ মাসের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে ওঁদের। এই সময় ভদ্রলোক খবর পেলেন লেক টাউনে একজন জমি বিক্রি করবে। যেহেতু ওখানকার জমির দর সত্তর আশী হাজার কাঠা তাই ওপথে মাড়ালেন না ভদ্রলোক। দিন পনের বাদে দমদম পার্ক থেকে একটা জমি দেখে ফেরার পথে কি মনে করে লেক টাউনে নামলেন উনি। কিনতে পারবেন না তবু জমিটা না হয় চোখেই দেখা যাক, এইরকম ভাব। গিয়ে শুনলেন জমিটা দিন পাঁচেক আগেই বিক্রি হয়ে গিয়েছে। যাঁর জমি তিনি বৃদ্ধ! স্ত্রী মারা গেছেন। দুই ছেলে বিদেশে থাকে, তারা বুড়ো বাবাকে সেখানে নিয়ে যেতে চায়। অতএব এখানকার সব সম্পত্তি বিক্রি করে দিচ্ছেন ভদ্রলোক। তিন কাঠা দেওয়াল-ঘেরা জমি, রাস্তার গায়ে। খুব ক্যাজুয়ালি উনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কি রকম দরে দিলেন?

দর? বৃদ্ধ নাকি মাথা নেড়েছিলেন, দর আবার কি? যে দরে কিনেছিলাম সেই দরেই দিয়েছি। পাঁচ হাজার পার কাঠা। আমি তো আর জমি নিয়ে ব্যবসা করতে বসিনি যে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা চাইবো? তাছাড়া টাকা নিয়ে আমি করবই বা কি? শুনে আমার কলিগের হাসব্যাণ্ডের এত আফসোস হচ্ছিল যে ভদ্রলোক দু’রাত ঘুমোতেই পারেননি। মাধবীলতা ঘটনাটা বলে হাসল, তাহলে বোঝ, এখনও অন্য রকম মানুষের অস্তিত্ব আছে পৃথিবীতে। এই বাড়িওয়ালাও বোধ হয় সেইরকম।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, আসলে পরমহংসের বিশেষ পরিচিত বলে আমরা এত কমে পাচ্ছি। নইলে আট দশ হাজার সেলামি চেয়ে বসত।

মাধবীলতা মুখ ফিরিয়ে অর্ককে দেখল। শোভাবাজারে গেলে এবার ওর পড়াশুনার দিকে ভাল করে নজর রাখতে হবে। একটা বছর নষ্ট হয়েছে, কুসঙ্গে পড়ে মন বেশ অনেকখানি বিক্ষিপ্ত হয়েছে। স্কুলের ধরা বাঁধা নিয়মে ফিরে যাওয়া বেশ মুশকিল। কিন্তু ছাত্র হিসেবে অর্ক বুদ্ধিমান, ধরিয়ে দিলে চটপট বুঝে ফেলে। মাধবীলতার মাথায় অন্য একটা পরিকল্পনা এল। কিন্তু এখন নয়, শোভাবাজারে গিয়ে সেটা চিন্তা করা যাবে। আর তখনই অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ওর স্কুলের কি করবে?

সেটাই ভাবছি। এখন, এই বছরের মাঝখানে কোন স্কুলে ওকে নেবে না। তা শোভাবাজার এমন কিছু দূরে নয়, যাতায়াত করবে। মাধবীলতা অন্যমনে বলল।

অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, কিন্তু কিভাবে ম্যানেজ করবে?

মানে? মাধবীলতা চোখ তুলল।

কদিনে বেশ ভাল খরচ হয়েছে, অ্যাডভান্সের টাকা দেবে কি করে? তাছাড়া মাসে মাসে একশ পঁচাত্তর, কি করে পারবে?

সে হয়ে যাবে। সুপ্রিয়ার লোনটা শেষ হয়ে গেলে আর চিন্তা করতাম না। যাহোক করে হয়ে যাবে। তুমি এ নিয়ে ভেবো না।

আমি একটা উপায় ভেবেছি।

শোভাবাজার তো মোটামুটি ভদ্র এলাকা। আমি যদি বাড়িতে বসে টিউশনি করি। এই ধরো সাধারণত যা রেট তার চেয়ে কম নিলে মনে হয় ছাত্রছাত্রী পাওয়া যেতে পারে। প্রথম প্রথম অসুবিধে হবে কিন্তু, কিন্তু তুমি আমাকে হেলপ করো।

তুমি পড়াবে? মাধবীলতার মুখ থেকে বেরিয়ে এল।

হ্যাঁ। আরে বাবা এম-এ পর্যন্ত তো পড়েছিলাম, পড়িনি?

এবার মাধবীলতার মনে হল অনিমেষ ঠিকই বলছে। এইভাবে ঘরে বসে থাকলে শরীর এবং মন দ্রুত ভেঙ্গে পড়বে। তার চেয়ে একটা কাজ নিয়ে থাকলে ওরও সময়টা ভাল কাটবে, মনও ব্যস্ত থাকবে আর যদি তা থেকে কিছু আসে তাহলে সংসারের সাশ্রয় হবে। মাধবীলতা হাসল, বেশ।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আজকাল টিউশনির রেট কি রকম?

মাধবীলতা জোরে হেসে উঠল। অনিমেষ কিঞ্চিত অপ্রস্তুত চোখে তার দিকে তাকাল। অর্কও ঘাড় ফিরিয়েছে। হাসতে হাসতে মাধবীলতা হাত নাড়ল, তোমার জন্যে নয়, কথাটা শুনে আমার আর একটা কথা মনে পড়ল। শ্যামবাজারে যে মেয়েটি বাড়ির রান্নাবান্নার কাজ করে সে পায় পঞ্চাশ টাকা। বালিগঞ্জ আলিপুরে তার দক্ষিণা দুই আড়াইশো! তাই শুনে একজন টিচার বলেছিল, চল ভাই, আমরা দল বেঁধে সাউথের স্কুলে চাকরি খুঁজি, চার পাঁচগুণ মাইনে বেড়ে যাবে নির্ঘাৎ।

হাসি সংক্রামিত হল। এবং তার মধ্যেই অর্ক বলে উঠল, আমাদের ক্লাশের একটা ছেলেকে ইংরেজির স্যার পড়ান, মাসে দুশো নেন, সপ্তাহে দুদিন।

অনিমেষ বলল, অত চাই না, বাড়িতে এসে পড়লে আমি যদি ষাটও নিই তাহলে তিনজনেই বাড়িভাড়াটা উঠে আসবে। কি বল?

মাধবীলতা হাত নাড়ল, আচ্ছা, তুমি কি! যখন কল্পনাই করছ তখন বেশ বড় করে কল্পনা করতে পার না? এই ধরো তুমি প্রত্যেকটা ছাত্রের কাছ থেকে দেড়শ করে নেবে, সকাল বিকেলে দশজন করে ছাত্র তিন দিন পড়বে। তার মানে চল্লিশজন মাসে। অর্থাৎ তোমার ইনকাম মাসে ছয় হাজার টাকা। আমাকে আর চাকরি করতে হবে না, ঝি চাকর রেখে পায়ের ওপর পা তুলে সংসার করব।

অর্ক ফুট কাটল, গাড়ি কিনবে না?

ওটা তোর টাকায় কিনব। মাধবীলতা ছেলের দিকে তাকিয়ে কপট গলায় বলল, পড়াশুনা বাদ দিয়ে আমাদের কথা শোনা হচ্ছে?

এই সময় বাইরে কেউ ডেকে উঠল, অর্ক, অর্ক আছ?

ওরা তিনজনেই দরজার দিকে তাকাল। বয়স্ক কণ্ঠস্বর এবং বেশ ভদ্র। অর্ক এক লাফে দরজার কাছে পৌঁছে পাল্লা খুলল। সতীশদা দাঁড়িয়ে।

তোমার বাবা আছেন অর্ক?

হ্যাঁ। কি ব্যাপার? বেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল অর্ক। এই বস্তির কেউ কখনও কোন প্রয়োজনে অনিমেষের সঙ্গে দেখা করতে আসে না। কারণ সেই প্রয়োজনটাই কারো হয় না। সতীশদার সঙ্গে বিকেলে দেখা হয়েছিল। তখনও এই বাড়িতে আসার কথা বলেনি।

ওঁর সঙ্গে আমার কথা ছিল। উনি কি শুয়ে পড়েছেন?

ভেতর থেকে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কে রে?

অর্ক মুখ ফিরিয়ে বলল, সতীশদা তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।

মাধবীলতা খাট থেকে নেমে বলল, নিয়ে আয়, বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস কেন? আসুন। বাইরে চটি ছেড়ে সতীশদা ঘরে ঢুকতে মাধবীলতা চেয়ারটা বাড়িয়ে দিল। যেন দুজনকেই একসঙ্গে নমস্কার করল সতীশদা, আমাকে বোধহয় আপনারা চিনবেন না।

মাধবীলতা বলল, আপনাকে দেখেছি, নাম শুনেছি আলাপ হয়নি।

সতীশ হাসল, সেটা অবশ্য আমার দোষ। আমি অনিমেষবাবুর কথা ভাসা ভাসা শুনেছিলাম। ভেবেছিলাম, আমার আসা হয়নি।

মাধবীলতা বলল, গেল ভোটের সময় অবশ্য আপনার দলের ছেলেরা এসেছিল। আমি অবশ্য জানি না আপনি কি শুনেছেন।

অনিমেষের এই ধরনের কথাবার্তা পছন্দ হচ্ছিল না। সে বলল, বসুন। সতীশ বসল। তারপর অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি জানি না, আমাদের সম্বন্ধে আপনার ধারণা কি রকম।

কি রকম মানে? অনিমেষ সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করল।

আমি আমাদের দলের কাজকর্মের কথা বলছি।

ও। দেখুন, আমি ইনভ্যালিড লোক। ঘর থেকে বের হতে কষ্ট হয়। খবরের কাগজ পড়ে আর এদের কথাবার্তা শুনে যেটুকু ধারণা করা সম্ভব তার বেশী হতে পারে কি করে! অনিমেষ সতীশের মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিল। হঠাৎ ও কেন এল তা বোধগম্য হচ্ছিল না।

হ্যাঁ, আমি আপনার শরীরের কথা শুনেছি আপনি কি একেবারেই চলাফেরা করতে পারেন না? গলিতে তো বের হন।

ওইটুকুই! বাতিলের দলে ফেলতে পারেন।

সতীশ একটু ভাবল, খবরের কাগজ যে সব সময় সত্যি কথা লিখবে তা আমরা আশা করতে পারি না। তাছাড়া আপনি জানেন, এদেশের খবরের কাগজগুলো বুর্জোয়া মালিকদের সম্পত্তি। ওরা আমাদের সমর্থন করবে এ আশা করা অন্যায়। তাই কাগজ পড়ে আপনার সঠিক ধারণা নাও হতে পারে।

অনিমেষ হেসে বলল, আপনারা তো অনেক বছর ক্ষমতায় এসেছেন, তা একটা স্বাধীন সত্যনিষ্ঠ কাগজ বের করতে পারছেন না কেন?

চেষ্টা চলছে। কিন্তু এতদিনের যে সিস্টেম তা রাতারাতি পাল্টানো যাবে কি করে! মানুষ একবার যাতে অভ্যস্ত হয়ে যায় তা থেকে সরে আসতে চায় না। আমাদের সামাজিক জীবনে এমন অনেক কাণ্ড করি যার কোন মানে নেই, কোনও উপকার হয় না তবু অভ্যেস করে যাই। এই যেমন ধরুন, তারকেশ্বরে জল নিয়ে হেঁটে যাওয়া। আপনি বোঝাতে গেলে হই হই পড়ে যাবে, ধর্মে হাত দিচ্ছেন বলে। প্রচণ্ড খরার সময় যদি বলি তারকেশ্বরে না গিয়ে হাঁড়িতে জল বয়ে বর্ধমান বীরভূমের মাটিতে ঢেলে দাও তাহলে কেউ শুনবে না। ভেবে দেখুন, লক্ষ লক্ষ হাঁড়ির জল খরার মাটিতে পড়লে পরের বছর বাজারে চালের অভাব হত না। আসলে ওই অভ্যেস, সংস্কার। এর মধ্যে আমরা, যারা কিছু করতে চাই তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যাঁরা সমালোচনা করছেন তাঁরা তো কিছুই করছেন না। সতীশ কথা শেষ করে ঝোলা ব্যাগটাকে কোলের ওপর টেনে নিল।

অনিমেষ বলল, এসব কথা আমাকে বলছেন কেন আমি বুঝতে পারছি না। কারণ আপনার সাহায্য আমাদের প্রয়োজন।

আমার সাহায্য? হেসে উঠল অনিমেষ, আপনি সুস্থ তো?

ঠিক বুঝলাম না! সতীশের মুখে ছায়া ঘনালো।

আমার মত একটা বাতিল অথর্ব মানুষকে আপনি সাহায্য করতে বলছেন! ব্যাপারটা কি হাস্যকর শোনাচ্ছে না? অনিমেষ মুখ ফেরালো।

সতীশ হেসে ফেলল এবার, আপনি অযথা নিজেকে ছোট করছেন। আপনার শরীর সুস্থ নয় কিন্তু বোধবুদ্ধি তো একটা সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশী, সেই কারণেই আপনার সাহায্য আমাদের প্রয়োজন।

কি করে বুঝলেন? অনিমেষের গলায় ব্যঙ্গ স্পষ্ট।

কারণ আপনি আঘাত পেয়েছেন, নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন। অনেক কিছু দিয়ে আপনি অভিজ্ঞ হয়েছেন। আমি শুনেছি আপনি নকশাল আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। মার্কসিজমে বিশ্বাস করতেন। এখন এভাবে নিজেকে ফুরিয়ে না ফেলে আমাদের পাশে দাঁড়ান।

অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকাল। মাধবীলতা একপাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ শুনছে। সতীশ একটু থেমে আবার বলল, বস্তি এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা আমরা পাল্টাতে পারিনি। এখানকার ছেলেদের আচার আচরণ কথাবার্তা মাঝে মাঝে অসহনীয় হয়ে ওঠে। পার্টির সঙ্গে সামাজিক মানুষের এখনও বেশ দূরত্ব রয়ে গেছে। সেইটে দূর করতে চাই।

অনিমেষ অলস গলায় বলল, আপনার কথা শুনলাম, ভেবে দেখব।

সতীশ খানিকটা সন্দিগ্ধ চোখে অনিমেষকে দেখল। তারপর একটু ইতস্তত করে বলল, আপনার কাছে আর একটা ছোট্ট অনুরোধ আছে

বলুন।

আজ ন’টা নাগাদ একবার আমাদের পার্টির অফিসে আসতে হবে। বেশী দূর নয়, আপনি যদি বলেন আমরা রিক্শা করে নিয়ে যেতে পারি।

কথাটা শুনে মাধবীলতা অবাক হয়ে বলল, এই রাত্রে?

হ্যাঁ, ন’টার সময়, বেশী রাত তো নয়।

অনিমেষ বলল, কেন, আমাকে পার্টি অফিসে যেতে বলছেন কেন?

সতীশ এবার নড়েচড়ে বসল, আজ রাত্রে একজন মন্ত্রী কয়েকটা ব্যাপারে কথা বলবেন বলে পার্টি-অফিসে আসবেন ঠিক ছিল। উনি যদিও পাশের এলাকার এম এল এ কিন্তু ওঁকে আমাদের প্রয়োজন আছে। হঠাৎ খানিক আগে আমাকে খবর দিয়েছেন যে উনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। আপনার সমস্ত হদিস দেখলাম উনি জানেন।

প্রচণ্ড অবাক হয়ে গেল অনিমেষ; কোনরকমে বলতে পারল, কে?

সুদীপবাবু। নামটা শোনামাত্র অনিমেষ চকিতে মাধবীলতাকে দেখল। মাধবীলতার মুখেও বিস্ময়। অনিমেষ যেন নিজেকেই জিজ্ঞাসা করল, সুদীপ আমার সঙ্গে দেখা করতে চায় কেন?

আমি জানি না। সতীশ উঠে দাঁড়াল, আপনারা কি সহপাঠী ছিলেন?

না। তবে য়ুনিভার্সিটিতে এক সঙ্গে য়ুনিয়ন করতাম।

আচ্ছা! সতীশের গলায় বিস্ময়।

মাধবীলতা এবার কথা বলল, মন্ত্রীমশাই ওঁর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন, এটা খুব আনন্দের কথা কিন্তু ওর পক্ষে তো যাওয়া সম্ভব নয়।

কেন? সতীশ ঘুরে দাঁড়াল।

দিনের বেলায় অন্য কথা, রাত্রে হাঁটা অসম্ভব ওঁর পক্ষে।

হাঁটতে বেশী হবে না, গলির মুখ পর্যন্ত গেলেই চলবে।

না আমি কোন ঝুঁকি নিতে চাই না।

আপনারা কি ইচ্ছে করেই যেতে চাইছেন না?

দেখুন, মন্ত্রীমশাই যদি ওঁকে বন্ধু মনে করেন তাহলে নিজেই আসতে পারেন।

মন্ত্রী এখানে আসবেন? সতীশের গলায় উম্মা।

কেন? আমরা মানুষ নই?

এভাবে কথা বলছেন কেন? এরকম বস্তির মধ্যে কোন ভি আই পি নিয়ে এলে রিস্ক বাড়ে। কার কি মতলব আছে আমরা জানি না। সেরকম কিছু হয়ে গেলে সামলাবে কে? সতীশ বোঝাতে চাইল।

মাধবীলতা আর কথা বলল না। অনিমেষ সতীশকে বলল, আপনি এক কাজ করুন। সুদীপ এলে বলবেন আমার পক্ষে অতদূর যাওয়া সত্যিই কষ্টকর। নিতান্ত বাধ্য না হলে আমি যেতে চাই না। ওর দরকার যদি খুব বেশী হয় তাহলে চিন্তা করা যেতে পারে।

কথাটা বোধহয় সতীশের পছন্দ হল। সে ঘাড় নেড়ে বলল, বেশ, তাই বলব। চলি তাহলে, আমার আগের প্রস্তাবটা ভেবে দেখবেন। চলি অর্ক।

সতীশ বেরিয়ে যাওয়া মাত্র অর্ক এগিয়ে এসে খাটে বসল, বাবা, মন্ত্রী তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে কেন?

আমি কি করে বলব? অনিমেষ হাত ওল্টালো।

মাধবীলতা বলল, তুমি আবার ঝুলিয়ে রাখলে কেন। সোজাসুজি না বলে দিলেই হত। কি দরকার না জানালে যাবে কেন?

অনিমেষ তখন অন্য চিন্তা করছিল। ওর মনে হল, সতীশ যে এসে তার কাছে সাহায্য চাইছে। সেটার পেছনে হয়তো সুদীপ আছে। কিংবা এমনও হতে পারে, সুদীপের বন্ধু ভেবেই সতীশ তাকে খানিকটা খাতির করে গেল। কথাটা বলতে গিয়েও সে মাধবীলতাকে বলতে পারল না। সতীশ এসে তাকে কিছুক্ষণের জন্যে এই দুজনের কাছে মূল্যবান করে দিয়ে গেছে। পেছনে লুকানো কোন কারণকে টেনে বের করে ধরলে সেই বড়ত্বটা মুছে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। হঠাৎ অর্ক বলে উঠল, কাল থেকে পাড়ায় আমাদের প্রেস্টিজ বেড়ে যাবে। মন্ত্রী বাবার সঙ্গে দেখা করেছে শুনলে অনেকের হিংসে হবে।

মাধবীলতা সে কথায় কান না দিয়ে বলল, তুমি কি পার্টি অফিসে যাবে?

তুমি কি বল?

এবার হেসে ফেলল মাধবীলতা, বাঃ, আমি কি বলব? আমি রাজনীতির কিছু বুঝি? কথাটা, ওই রাজনীতি শব্দটা যেন অনিমেষের কানে ঠং করে বাজল। হয়তো মাধবীলতা খুব সরল মনে শব্দটাকে ব্যবহার করেছে। কিন্তু অনিমেষের ফেলে আসা দিনগুলোকে যেন মুহূর্তেই নড়িয়ে দিয়ে গেল। সেই সি পি এমের হয়ে নির্বাচনী প্রচার করা, য়ুনিভার্সিটিতে ছাত্র ফেডারেশন করা এবং মোহমুক্ত হয়ে নকশাল আন্দোলনে যোগ দেওয়ার ছবিগুলো চোখের ওপর ভাসতে লাগল। সেই সময় সুদীপদের ও মনেপ্রাণে ঘৃণা করত! ওইভাবে হাত পা গুটিয়ে নিরাপদ দূরত্বে বাস করে আগুন পোয়ানো তাদের কাছে সুবিধাবাদীর নামান্তর ছিল। উগ্র-আন্দোলনের ঝাঁঝে ওরা তখন এমন মশগুল ছিল যে যে কোন নরম ব্যাপারকেই নস্যাৎ করে দিতে বাধতো না। ওই মুহূর্তে বিপ্লবই একমাত্র পথ ছিল। অর্থাৎ সুদীপের রাজনীতির থেকে তার রাজনীতি বিপরীত মেরুতে অবস্থান করত। কিন্তু তারপর, ঘরটা যখন হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ল, পায়ের তলা থেকে যখন বালি ঝুরু ঝুরু সরে গেল, মুখ থুবড়ে পড়ল সব উত্তেজনা তখন আর কোন রাজনীতি সে আঁকড়ে ধরতে পারে? যে ভুলগুলো হয়েছিল তা শুধরে নতুন উদ্যমে কিছু করার মত শক্তি তার নেই। হয়তো মাধবীলতা রাজনীতি বলতে তার নতুন উপলব্ধির কথা বোঝাতে চাইল, কিন্তু সত্যি উপলব্ধিটাই স্পষ্ট হয়নি তার কাছে। আমরা ভুল করেছিলাম। কিন্তু ভুল শুধরে নিতে গেলে যে যোগ্যতা থাকা দরকার, যা যা করা দরকার তা করার ক্ষমতা আমাদের নেই। অন্তত অনিমেষের নেই। অতএব সেই উপলব্ধি থেকে কোন সঠিক পথ বেরিয়ে আসছে না। সুতরাং এমন উপলব্ধি তো মূল্যহীন হয়ে পড়ছে। তাই এই মুহূর্তে তার কোন রাজনীতি থাকতে পারে না। অনিমেষ চোখ বন্ধ করল, যেতে পারব না তো বলে দিলাম, সুদীপের যদি গরজ থাকে তাহলে সে নিজেই আসবে।

দিনটা ছিল ছুটির। বিকেল তিনটে নাগাদ মাধবীলতা অর্ককে নিয়ে বের হল। যেতে আসতে বড় জোর ঘন্টা দুয়েক। গলির মুখেই সতীশের সঙ্গে দেখা, দাদা আছেন?

মাধবীলতা বলতে যাচ্ছিল কোথায় আর যাবেন কিন্তু বলল, হ্যাঁ।

কাল এত রাত হয়ে গেল যে খবর দিতে পারিনি। সুদীপবাবু একটা গোলমাল মেটাতে কলকাতার বাইরে যেতে বাধ্য হয়েছেন, আমাদের অফিসে আসতে পারেননি।

ও। মাধবীলতা ছোট্ট শব্দটি উচ্চারণ করল। তারপর মাথা নেড়ে এগিয়ে গেল। সতীশ অর্কর দিকে তাকিয়ে হাসল, তুমি আসছ তো?

দেখি। অর্ক জবাবটা দিয়ে মায়ের পাশে যাবার জন্য পা বাড়াল। এই সময় ঈশ্বরপুর লেনের ঝিমুনি কাটেনি। ফুটপাথে যারা দিবানিদ্রা দিচ্ছিল তারা সবে উঠে বসেছে। চিৎকার চেঁচামেচি এখন কম।

ডিপো থেকে বের হওয়া একটা চার নম্বর ট্রামে ওরা উঠে বসল। একদম ফাঁকা ট্রাম। মাধবীলতা উঠে পেছন দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল অর্ক তাকে ডাকল, মা, সামনে এসে বসো। বলে নিজে একটা অবল সিটের জানলার ধারে বসে পড়ল। মাধবীলতা একটু ইতস্তত করে শেষমেষ অর্কর পাশে এসে বসল, ওদিকে তো লেডিস সিট ফাঁকা ছিল। এখানে বসা মানে আর একজন ভদ্রলোককে অসন্তুষ্ট করা।

অর্ক বলল, এটা কি জেন্টস সিট? সবাই বসতে পারে।

মাধবীলতা হাসল, ওগুলো তর্ক করার জন্যে বলা। লেডিস সিট খালি থাকলে এখানে বসাটা অশোভন।

অর্ক বলল, ছাড়ো তো, তোমার না সব কিছুতেই বেশী বেশী। মাধবীলতা আড় চোখে ছেলের দিকে তাকাল। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের মত কথা বলল অর্ক। যেভাবে বসে আছে তাতে আর কিশোর বলে মনে হয় না। কিন্তু কথা বলার ধরনটা তার ভাল লাগল না। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে টিকটিক করাও ভাল দেখায় না, ভালও লাগে না।

পরমহংস দাঁড়িয়ে ছিল। মাধবীলতা ট্রাম থেকে নেমে দেখল মেঘ করেছে আকাশে। ওদের দেখা মাত্র পরমহংস ছুটে এল, রাইট টাইমে এসে গেছ। চল, খুব বেশী দূরে নয় এখান থেকে।

মাধবীলতা স্মিত হেসে বলল, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছো?

না, না। পাঁচ মিনিট।

পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে পরমহংস অর্ককে বলল, তোমার মনে হচ্ছে আমাকে ঠিক পছন্দ হয়নি। অবশ্য আমাকে কারোরই পছন্দ হয় না।

অর্ক তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না, না, অপছন্দ হবে কেন?

তাহলে চুপ করে আছ কেন? কথা বল। চুপ করে থাকাটা খুব বিচ্ছিরি। গোল মুখটা তো দাঁতের জন্যে সবসময় হাসি হাসি দেখায়, পরমহংস এই মুহূর্তে হাসছে কিনা বুঝতে পারল না অর্ক। কিন্তু এই বেঁটেখাটো মানুষটাকে তার বেশ ভাল লেগে গেল। বাবার বন্ধু কিন্তু উচ্চতায় তার বুকের কাছাকাছি। কিন্তু এরকম হাসিখুশি মানুষ সে এই প্রথম দেখল।

পরমহংস মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে বলল, এদিকে কখনও এসেছ?

না। মাধবীলতা মাথা নাড়তে গিয়ে মনে করল প্রথম দিন পরমহংস দেখা হওয়া মাত্র উজ্জল তাকে তুই বলে ফেলেছিল। কিন্তু তারপর আবার তুমিতে উঠে এসেছে সে।

খারাপ জায়গা নয়। আগে অবশ্য খুব বোমাবাজি হত। এখনও হয় তবে সেটা কোথায় হয় না। একটু এগিয়ে গেলেই গঙ্গা পাবে। ডুবটুব দিতে পারো।

না, বাবা, আমার পুণ্যি করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।

এই বাড়ি। পরমহংস পড়িয়ে গেল আচমকা। তারপর চিৎকার করে ডাকতে লাগল, মুকুন্দদা, মুকুন্দদা।

কিছুক্ষণ বাদেই এক ভদ্রলোক চোখে চশমা আঁটতে আঁটতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন, ওঃ, দাঁড়াও, আসছি।

বাড়িটা বেশ পুরোনো। বহুদিন রঙ করা হয়নি। কিন্তু দেখলেই বোঝা যায় মজবুত। ভেতরে ঢুকে দেখেশুনে পছন্দ হয়ে গেল মাধবীলতার। রান্নাঘরটায় ভাল ব্যবস্থা আছে, তিনটে তাক। ঘরগুলো খুব বড় নয় কিন্তু কোন অসুবিধে হবে না। রোদ আসে বোঝা যাচ্ছে।

বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের নাম মুকুন্দ দাস। বললেন, পরমহংসের কাছে আমি সব শুনেছি। আপনাদের মত ভাড়াটে আমি খুঁজছিলাম। বেশী টাকা নিয়ে অন্য ঝামেলায় পড়তে চাই না। ওপাশের মিত্তিরবাবুদের সঙ্গে আপনাদের কল পায়খানা শেয়ার করতে হবে। ওরাও ভাল মানুষ, কোন অসুবিধে হবে না।

মাধবীলতা বলল, ওঁদের দেখলাম না।

খিদিরপুরে গিয়েছে। আপনারা কবে আসছেন?

পরমহংস বলল, কবে আবার, মাস শেষ হলেই চলে আসবে।

মুকুন্দবাবু ইতস্তত করলেন, ব্যাপারটা হল খালি আছে জেনে অনবরত মানুষ আসছে, বেশী দেরি করলে ঠেকাতে পারব না। আপনি টাকাটা দিয়ে রসিদ নিয়ে যান।

মাধবীলতা সঙ্কোচে পড়ল। সে পরমহংসের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, আমাকে দুদিন সময় দেবেন?

পরমহংস হেসে উঠল, ও নিয়ে চিন্তা করতে হবে না তোমাকে। মুকুন্দদা, কাল সকালে অফিসে যাওয়ার সময় আমি তোমাকে টাকা দিয়ে যাব।

ঠিক আছে। আমি রসিদ করে রাখব। কি নামে হবে?

পরমহংস বলল, কার নাম দেবে, তোমার না–।

মাধবীলতা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ওর নামেই হবে। তারপর মুকুন্দর দিকে তাকিয়ে বলল, অনিমেষ মিত্র।

২৪. ফেরার পথে অর্ক জিজ্ঞাসা করল

ফেরার পথে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, পরমহংসকাকু, আপনাদের বাড়িটা কোথায়?

পরমহংস একটু থমকে দাঁড়াল, বেশী দূরে নয়, মিনিট কয়েক। যাবে? জিজ্ঞাসা করেই মত পাল্টালো, না, থাক। গিয়ে দরকার নেই।

মাধবীলতা হেসে ফেলল, কি ব্যাপার?

ওটা তো আমার বাড়ি নয়। একখানা ঘর আমার বরাদ্দ। তাতে বুড়ো আঙ্গুল থেকে মাথার চুল পর্যন্ত সব ঠাসা আছে। তার চেয়ে–। পরমহংস কোথায় বসবে ভাবছিল।

মাধবীলতা বলল, এবার একটা বিয়ে করে ফ্যালো। এরপর আর বউ জুটবে না।

পরমহংস চশমার ফাঁকে কৌতুকের চোখে তাকাল, এখনই জুটবে তাই বা কে বলল?

না। চল্লিশে এসে দেখছি ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের অনেক মেয়েরই বিয়ে হয়নি। একটু চেষ্টা করলেই ভাল পাত্রী খুঁজে পেতে পারি। করব?

খ্যাপা।

উড়িয়ে দিচ্ছ কেন?

দ্যাখো, এই বেশ আছি। খাচ্ছি দাচ্ছি বগল বাজাচ্ছি। যাকে বিয়ে করব সে এসে একটার পর একটা ভ্যারাইটিস বল করে যাবে আর আমি প্রতিটি বলে আউট হব।

মানে?

এই ধরো, মিষ্টিমুখে খসাবে মানে স্পিন ছাড়বে। একটু অভিমান অর্থাৎ ইয়ার, চোখ রাঙালে বাম্পার আর কিছুই যেটায় বুঝতে পারব না সেটা গুগলি!

ওর বলার ধরন এবং হাত নাড়া দেখে মাধবীলতা শব্দ করে হেসে উঠেছিল, অর্কও! দুপাশের কেউ কেউ মুখ তুলে তাকিয়েছিল সেই শব্দ শুনে। মাধবীলতা একটু লজ্জা পেয়ে বলল, সব ব্যাপারে তোমার ফাজলামি।

মোটেই নয়। আমার উচ্চতা দেখছ? তোমাদের বাতিল করা বাতাস আমি টানি। যে মেয়েকে তুমি পছন্দ করবে তাকে নিশ্চয়ই আমার চেয়ে ছোট কিংবা সমান হতে হবে। এবার আমাদের ফসলের কথা ভাবো, উঃ, দেশটা ক্রমশ লিলিপুটে ছেয়ে যাবে। নো, ইম্পসিবল। দেশের প্রতি আমার নিশ্চয়ই কর্তব্য আছে। অত্যন্ত গম্ভীর মুখে কথাগুলো বলল পরমহংস কিন্তু ততক্ষণে মাধবীলতার মুখে সিঁদুর জমেছে। অর্ক হাসি চাপতে চাপতে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়েছে। মাধবীলতা ইশারায় অর্ককে দেখিয়ে বলল, কি হচ্ছে কি?

পরমহংস বলল, নাথিং রং। যোল বছর হলে বন্ধু হয়ে যায় ছেলেমেয়ে।

মাধবীলতা প্রতিবাদ করল, ওর এখনও ষোল হয়নি।

হয়নি হবে। তাছাড়া শ্লোকটা লেখা হয়েছিল আদি যুগে। তখন যোলতে প্রাপ্তবয়স্ক ভাবা হতো। যুগের সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাদের চিন্তাভাবনা করার শক্তি এত বেড়েছে যে এখন ওটাকে যোল থেকে নামিয়ে আনা যায়। আমার এক ভাইপো আছে, মাত্র চার বছর বয়স। রোজই বেরুবার সময় জিজ্ঞাসা করে, কাকু কি আনবে? তা আমি কাল ঠাট্টা করে বললাম, খুব সুন্দরী রাজকন্যা, তোর বউ।শুনে ভাইপো খুব গম্ভীর মুখে বলল, না কাকু বউ এনো না। আমি তো চাকরি করি না।

চোখ বড় করল পরমহংস, বোঝ!

মাধবীলতা বলল, সত্যি, আজকালকার বাচ্চারা খুব পাকা হয়ে গিয়েছে।

পরমহংস হাত নাড়ল, অতএব অর্ককে আমরা প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে ভাবতে পারি।

কথা বলতে বলতে ওরা ট্রামরাস্তার ওপরে চলে এসেছিল। আসা মাত্র অর্কর মনে পড়ল সেদিনের ঘটনাটা! ছেলেগুলো তাকে এখানেই মেরেছিল। চিৎপুর আর গ্রে স্ট্রীটের মোড়। পরমহংস বলল, চল, কোথাও গিয়ে চা খাওয়া যাক।

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, তার চেয়ে আমাদের ওখানে চা খাওয়াবো।

দূর। অদূরে চা খেতে যাব কেন? একটু এগোলেই ভাল দোকান আছে।

মাধবীলতা ইতস্তত করছিল। সেটা বুঝতে পেরে পরমহংস বলল, উঃ, তুমি দেখালে বটে! এক কাপ চা খাবে তাও বোধহয় অনিমেষের কথা ভাবছ। চল অর্ক। অতএব আর আপত্তি টিকলো না। অর্ক মুখ ফিরিয়ে পরমহংসের সিথি দেখতে পাচ্ছিল। বেঁটেখাটো মানুষ কিন্তু হাঁটে বেশ আত্মমর্যাদার সঙ্গে। পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, তুমি এদিকে আগে এসেছ?

অর্ক ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ। বলতে বলতে সে বাড়িটাকে দেখতে পেল। ওর মনে হল যে ঘটনার পর থেকে মায়ের ব্যবহারে পরিবর্তন ঘটেছে সেই ঘটনা ওই বাড়িটার জন্যে ঘটেছিল। এবং তারই সঙ্গে সে মেন সিরসিরে আকর্ষণ অনুভব করছিল। ঊর্মিমালাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল খুব। সে মুখ নামিয়ে মাধবীলতাকে বলল, মা, ওই বাড়িতে ঊর্মিমালারা থাকে।

মাধবীলতা চট করে মুখ তুলে ছেলেকে দেখল। ঊর্মিমালা নামটা শুনে সে কিছুই বুঝতে পারছিল না প্রথমটায়। অর্ক আবার বলল, সেই যে, যে মেয়েটাকে ট্রামে বিরক্ত করেছিল বলে আমার সঙ্গে মারামারি হয়েছিল!

ও। মাধবীলতা মুখ ফিরিয়ে বাড়িটাকে দেখল।

তুই কি পরে ওখানে গিয়েছিলি?

না।

পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার?

মাধবীলতা এড়িয়ে যেতে চাইছিল, পারল না। সব শুনে সপ্রশংস চোখে অর্কর দিকে তাকাল, সাবাস। এই তো চাই, পুরুষের মত কাজ করেছিস। আমরা মাইরি পথে ঘাটে ভেডুয়ার মত চলাফেরা করি। প্যাঁদাবি, বদমাইসি করতে দেখলেই ধরে প্যাঁদাবি। তুই নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ পড়িসনি। আমাকে পড়তে হয়েছিল এম এ পড়তে গিয়ে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, অন্যায়ের ছুরির কোন বাঁট থাকে না। যে মারে সে নিজেও রক্তাক্ত হয়। তোর সম্পর্কে আমার ধারণাটা বেড়ে গেল রে।

মাধবীলতা বলল, থাক, আর হাওয়া করো না তুমি, একেই মা মনসা।

অর্ক বলল, আমি কি মহিলা যে মনসার সঙ্গে তুলনা করছ?

পরমহংস বলল, কারেক্ট। কিন্তু সেই ঘটনার পর ওদের কিছু হয়নি তো?

মানে? অর্কর চোখ ছোট হল।

তুই তো মেয়েটাকে বাঁচিয়ে গেলি কিন্তু তারপরে ওরা এসে ওদের কোন ক্ষতি করেনি তার ঠিক কি! একবার খোঁজ নিলে হয়। কথাটা শেষ করে পরমহংস অর্কর দিকে নিরীহ ভঙ্গীতে তাকাল। সেটা দেখতে পায়নি মাধবীলতা, বলল, কিছুই অসম্ভব নয়। এই সব ছেলেদের কাজকর্ম বোঝা মুশকিল। এই নিজের ছেলেকেই তো এক সময় আমি বুঝে উঠতে পারতাম না।

পরমহংসের সামনে মায়ের এই রকম কথা বলা পছন্দ হচ্ছিল না অর্কর। পরমহংস বলল, যা অর্ক, একবার চট করে ঘুরে আয়, আমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছি।

আর তখনই অস্বস্তি হল অর্কর। সে গিয়ে কি জিজ্ঞাসা করবে? আপনারা কেমন আছেন তাই দেখতে এলাম? কেমন ক্যাবলা ক্যাবলা শোনাবে না সেটা। কিন্তু সেই সঙ্গে আকর্ষণটাও তীব্রতর হচ্ছিল। ডিমের মত মুখ, লম্বা মোটা বেণী, দুই ভুরুর তলায় কি শান্ত টানা চোখ। আর তখনই মাধবীলতা বলল, তাড়াতাড়ি আসবি।

খুব আড়ষ্ট পায়ে অর্ক এগোচ্ছিল। মায়েদের সঙ্গে যত ব্যবধান বাড়ছে বাড়িটার সঙ্গে সেটা তত কমছে। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এসে কলিং বেলে হাত রাখা মাত্র দরজা খুলে গেল। একটি অল্পবয়েসী মেয়ে, সম্ভবত কাজের লোক, জিজ্ঞাসা করল, কাকে চাই?

অর্কর গলায় তখন রাজ্যের জড়তা। কোনরকমে বলল, ওঁরা আছেন?

কার কথা বলছেন?

মাসীমা। এছাড়া কোন সহজ উত্তর অর্কর মুখ থেকে বের হল না।

কি নাম আপনার? মেয়েটির চোখে তখনও সন্দেহ।

অর্ক, অর্ক মিত্র। দরজার দুটো পাল্লা ভেতর থেকে একটা চেনে আটকানো থাকায় ইঞ্চি দেড়েকের বেশী ফাঁক হচ্ছে না। বাইরে থেকে ঠেললেও খোলা যাবে না। মেয়েটি চলে যাওয়ায় কিছু বাদেই পায়ের শব্দ শুনতে পেল। এবং তারপরেই ওই দেড় ইঞ্চি ফাঁকের মধ্যে একশ সূর্য যেন হেসে উঠল। ঊর্মিমালা যে দৌড়ে এসেছে তা বোঝা যাচ্ছে। সমস্ত মুখ হাসিতে উজ্জ্বল। একটা হালকা কমলা রঙের মিডি পরনেএবং তার হাতা কনুই-এর সীমা ছাড়িয়ে নেমে সামান্য ছড়ানো। চটপটে হাতে শেকল খুলে সে ডাকল, আসুন।

অর্কর ভাল লাগছিল। এরকম ভাল লাগার মুহূর্ত তার জীবনে কখনও আসেনি। বুকের মধ্যে যেন কানায় কানায় ভরা একটা নিটোল দীঘির জল দুলছে।

সে কোনরকমে মাথা নাড়ল, না। মাসীমা নেই?

আহা, আগে ভেতরে আসুন তো পাল্লা দুটো সরিয়ে দিয়ে একপাশে দাঁড়াল ঊর্মিমালা! অর্ক ইতস্তত করে বলল, কোন বিপদ হয়নি তো?

কিসের বিপদ? দুই ভুরুর তলায় যে চোখ দুটো ছায়া পড়ল।

ওই ছেলেগুলো আর আসেনি তো? অর্ক জানতে চাইল।

এবার সুন্দর হাসল ঊর্মিমালা, কেন, আপনি সেদিন বললেন যে, যারা ভয় পায় তারা কিছু করে! না, আর কিছু হয়নি। এবার আসুন।

মাথা নাড়ল অর্ক, না, আজ হবে না। আমি চলি?

ও, শুধু এইটুকু জানবার জন্যে এসেছেন? ঊর্মিমালার মুখ পলকেই অন্ধকার।

হ্যাঁ। অর্ক ঘুরে দাঁড়াল।

কোন দরকার ছিল না এইভাবে দয়া দেখাতে আসবার

অর্ক চমকে উঠে মুখ ফেরাতেই অন্ধকারটাকে দেখতে পেল। ও তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আজকে বসতে পারব না কারণ আমার মা আর এক কাকু নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি কাউকে দয়া দেখাতে আসিনি।

ওমা, তাই? এবার প্রচণ্ড বিস্ময় ঊর্মিমালার মুখে, ওঁরা নিচে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? কি আশ্চর্য! ওঁদের নিয়ে এলেন না কেন?

বাঃ, এ বাড়ির কাউকে কি ওঁরা চেনেন?

আপনি চেনেন তো।

আমি তো মাত্র একদিন এসেছি।

ও! শব্দটা ঠোঁট থেকে বের হওয়ার সঙ্গে ঊর্মিমালার চোখ অর্কর মুখ ছুঁয়ে গেল; তারপর শান্ত গলায় বলল, চলুন।

অর্ক অবাক হল, আরে, আপনি কোথায় যাবেন?

ঊর্মিমালা ঘাড় ঘুরিয়ে কাজের মেয়েটিকে ডাকল, আমি এক্ষুনি আসছি, তুমি এখানে দাঁড়াও, দরজা খোলা রয়েছে। চলুন।

প্রায় বাধ্য ছেলের মত অর্ক ঊর্মিমালার পাশাপাশি নিচে নেমে এল। হাঁটার সময় একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে আসছিল, মিষ্টি কিন্তু মোটেই তীব্র নয়। সে আড়চোখে দেখছিল ঊর্মিমালাকে। কেমন স্বপ্নের মত দেখতে। গায়ের রঙ শ্যামলা কিন্তু কি নরম। এ মেয়ে ফরসা হলে মোটেই মানাত না।

নিচে নামমাত্র মাধবীলতারা ওদের দেখতে পেল। এবং সেই তাকানো দেখে ঊর্মিমালারও বুঝতে অসুবিধে হল না। অর্ক কিছু বলার আগেই ঊর্মিমালা এগিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে সেই ফুটপাথে দাঁড়ানো মাধবীলতার পা স্পর্শ করল। সঙ্গে সঙ্গে মাধবীলতা আপত্তি করে উঠতে গিয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরল, বাঃ, কি সুন্দর মেয়ে। কি যেন তোমার নামটা?

ঊর্মিমালা মুখার্জী। মাধবীলতার হাতের বাঁধন আলগা হতেই ঊর্মিমালা নামটা বলে পরমহংসের পায়ের দিকে হাত বাড়াতেই সে তিড়িং করে লাফ দিয়ে সরে গেল, আরে আরে কি সর্বনাশ। চেনা নেই জানা নেই হুটহাট প্রণাম করতে আছে? ওর ভঙ্গী দেখে ঊর্মিমালা হেসে ফেলল, আপনি তো ওর কাকা!

মাই গড! সেটাও জেনে বসে আছ? এ একদম বডিলাইন থ্রো। এড়াবার কোন উপায় নেই। পরমহংস কথাটা বলে হাসতে লাগল। অর্ক দেখছিল দুই ফুটপাথের অনেকগুলো চোখ এখন এইদিকে। মাধবীলতাকে প্রণাম করাটা যত না চোখে পড়েছে পরমহংসের লাফানো এবং চিৎকার অনেকের নজর কেড়েছে। এবার ঊর্মিমালা এগিয়ে এসে মাধবীলতার হাত ধরল, আসুন।

কোথায়? মাধবীলতার চোখ যেন কপালে উঠল।

আমাদের বাড়িতে।

না গো, আজ নয়। বাড়িতে অনেক কাজ ফেলে এসেছি।

তা থোক। আমি কোন কথা শুনব না। আপনি এলে আমার ভাল লাগবে। মাধবীলতা মেয়েটির মুখ দেখল। এরকম নিষ্পাপ মুখ আজকাল সচরাচর দেখা যায় না। স্কুলে তো অজস্র মেয়ে দেখল, তাদের অনেকের মুখে এই বয়সে কেমন যেন একটা পাকামির ছাপ পড়ে। অধিকাংশই কপালের পাশের চুল কাটে, গালে ব্রণর দাগ এবং মুখের ভেতর একটা খসখনে চালাকি ছড়ানো থাকে। এই মেয়ের সর্বাঙ্গে এমন একটা স্নিগ্ধতা আছে যা মনটাকেই মিষ্টি করে। যেন বাধ্য হয়েই যাচ্ছে এমন ভঙ্গীতে সে বলল, বেশীক্ষণ বসব না কিন্তু।

ঊর্মিমালার পাশাপাশি যখন মাধবীলতা ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে তখন অর্ক দেখল পরমহংস সেখানেই দাঁড়িয়ে। সে ইশারা করতেই পরমহংস মাথা নাড়ল, সে যাবে না। অর্ক একটু গলা তুলে বলল, মা, পরমহংস কাকু।

মাধবলতা ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি হল?

পরমহংস নির্বিকার মুখে জবাব দিল, তুমি গেলে কারো ভাল লাগবে, আমাকে তো কেউ যেতে বলেনি। আমি কি ফেক?

কথাটা শুনে অর্ক হেসে উঠল। আর ঊর্মিমালা এগিয়ে এল পরমহংসের কাছে, আমার অন্যায় হয়ে গেছে।

সঙ্গে সঙ্গে পরমহংস মুখটা বিকৃত করল, দূর! এ মেয়ে দেখছি রসিকতাও বোঝে না। একেবারে গোবরঠাসা। চল চল।

মাধবীলতা হেসে বলল, তোমার কোনটা ঠাট্টা কোনটা নয় তা আমিই বুঝতে পারি না তো এ বেচারা বুঝবে কি করে বল!

ঊর্মিমালা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করল, না, না, আমি বুঝতে পেরেছিলাম।

পরমহংস হাঁ হয়ে গেল, বুঝতে পেরেছিলে? তা বুঝেও ক্ষমা চাইলে কেন?

মাথা নিচু করে ঊর্মিমালা বলল, না হলে আপনি যে আসতেন না!

অ্যা। পরমহংস চোখ বড় করল, তার মানে তুমি আমাকে ঠাট্টা করেছ?

মুখে কিছু বলল না, কিন্তু দ্রুত মাথা নেড়ে না বলে ঊর্মিমালা বাকি সিঁড়ি দৌড়ে শেষ করে দরজায় পৌঁছে গিয়ে বলল, আসুন।

পরমহংস হাত উল্টে অর্ককে বলল, এক্কেবারে ইনিংসে হারলাম রে। মাধবীলতা ভেতরে ঢুকেই বলল, তোমার মা কোথায়?

মা বাথরুমে ছিল, নিশ্চয়ই বেরিয়ে পড়েছে এতক্ষণে, আপনারা বসুন আমি দেখে আসছি। হাত দিয়ে সোফা দেখিয়ে দিয়ে ঊর্মিমালা ভেতরে চলে গেল।

সোফায় সবাই বসলে মাধবীলতা বলল, বেশ মেয়েটি তাই না? পরমহংস গম্ভীর মুখে বলল, ভাগ্যিস তোমার মেয়ে হয়নি।

মানে? মাধবীলতার কপালে ভাঁজ পড়ল।

তাহলে সে এর ডুপ্লিকেট হয়ে যেত।

যাঃ। মাধবীলতার মুখ লালচে, কি যে বল না!

অর্ক হাসি চেপে ঘরের জিনিসপত্র দেখছিল। এসব দেখলেই তার খুব অস্বস্তি হয়। জন্ম ইস্তক বই-এর সুন্দর আলমারি, দামী সোফা, দেওয়ালে নানান সুদৃশ্য বস্তু সে নিজেদের ঘরে দ্যাখেনি। হঠাৎ একটু হালকা লাগল তার। নতুন বাড়িতে চলে এলে একটা ঘর অন্তত এরকম করে সাজাতে হবে। নতুন বাড়িতে চলে এলে একদিনে হবে না কিন্তু একটু একটু করে তো সাজানো যায়। হঠাৎ মাধবীলতার কণ্ঠস্বর কানে এল, কি দেখছিস?

অর্ক মুখ ফেরালো, কি সুন্দর সাজানো, না?

হুম। মাধবীলতা মুখ নামাল, আমার খুব সঙ্কোচ হচ্ছে। এভাবে হুট করে চলে আসাটা, এরা কি ভাববেন কে জানে!

বলতে বলতে ঊর্মিমালা যাঁকে নিয়ে এল তাকে দেখে ভাল লাগল মাধবীলতার। মোটাসোটা গিন্নিবান্নি চেহারা, বেশ মা মা ভাব আছে! মাধবীলতা উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করল, দেখুন তো মিছিমিছি এসে আপনাকে বিরক্ত করলাম। আপনার মেয়ে কিছুতেই ছাড়ল না

নমস্কার ফিরিয়ে দিয়ে ভদ্রমহিলা হাত ধরলেন মাধবীলতার, ওমা, তাতে কি হয়েছে। আপনারা এসেছেন এ তো আমার পরম সৌভাগ্য। মেয়ে আমার ঠিক কাজ করেছে। আমি ক’দিন থেকে ওঁকে বলছি ছেলেটার খোঁজ নাও, বিপদ-আপদ হতে পারে, তা ওঁর আর সময় হয় না। মাধবীলতা হেসে বলল, বিপদ ওর হয়নি আমাদের হয়েছিল।

সেকি! কি ব্যাপার?

বাবু খুব অসুখ বাধিয়েছিলেন। বেশ ভুগেছেন। ভদ্রমহিলা হাসলেন। তারপর বললেন, তামার নাম মণিমালা, আপনাকে কি বলে ডাকব?

মাধবীলতা। ইনি আমাদের খুব বন্ধু, পরমহংস! পরমহংস হাত তুলে নমস্কার করে বলল, আমি আর অর্কর বাবা সহপাঠী ছিলাম! ভদ্রমহিলা নমস্কার ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, এদিকে কোথায়?

মাধবীলতা বলল, ও এদিকেই থাকে, শোভাবাজারে। একটা বাড়ির খবর পেয়ে আমাদের দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল।

তাই নাকি? পছন্দ হয়েছে?

হ্যাঁ।

আপনার কর্তা আসেন নি? মাধবীলতা কিছু বলার আগেই পরমহংস বলে উঠল, অনিমেষের পক্ষে এখন হাঁটাচলা করা একটু মুশকিল! একটা অ্যাকসিডেন্টের পর থেকেই ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে পারে না। মানে ট্রাম বাসের ব্যাপারটা।

ওহো! মণিমালার গলায় বিষাদ। মাধবীলতা লক্ষ্য করল কথাটা শুনেও মণিমালা কি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল জিজ্ঞাসা করলেন না। কিন্তু সে মনে মনে পরমহংসের কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে পড়ল। প্রথমত, সে বলেছে অনিমেষ তার সহপাঠী ছিল। সেইসঙ্গে যদি মাধবীলতার নামও জুড়ে দিত তাহলে ওদের বিবাহটা মণিমালার কাছে স্পষ্ট হয়ে যেত। অবশ্য তাতে কিছুই যায় আসে না মাধবীলতার কিন্তু অনর্থক মানুষকে জানিয়ে কি লাভ। দ্বিতীয়ত, অনিমেষকে পুলিস এরকম করেছে, সে নকশাল ছিল, এ সব গল্প না করে যে পরমহংস অ্যাকসিডেন্ট বলে এড়িয়ে গেল সেটাও তার বেশ স্বস্তি। এবং মণিমালাও যে কৌতূহল প্রকাশ করলেন না সেটাও ওর বেশ ভাল লাগল। মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, ঊর্মির বাবা কোথায়?

হাতিবাগানে গিয়েছে। খবর পেয়েছে ওখানে এক ভদ্রলোকের বাড়িতে অতুলপ্রসাদের নিজের গলার রেকর্ড আছে তাই টেপ করে নিয়ে আসবে। গানবাজনার খবর পেলে একদম পাগল হয়ে যায়! মণিমালা হাসলেন।

মাধবীলতা বলল, বাঃ, খুব ভাল শখ। তা তুমিও নিশ্চয়ই গাও?

ঊর্মিমালা হেসে মাথা নাড়ল। মণিমালা যে সোফায় বসেছিলেন তার পেছনে দাঁড়িয়েছিল সে। মায়ের সঙ্গে মেয়ের চেহারার বিন্দুমাত্র মিল নেই।

মণিমালা বললেন, ওর শখ ছবি আঁকা। পাশ করে উনি আর্ট কলেজে ভর্তি হবেন, বি. এ. এম. এ. পাশ করবেন না। সেদিন আঁকার স্কুল থেকে ফেরার সময় ওই কাণ্ড হল। আমি সাধারণত ওকে একা ছাড়ি না 1 দিনকাল খারাপ, রাস্তায় এত বাজে মানুষের ভিড়। ওই একদিন একা গেল আর অমন কাণ্ডটা ঘটে গেল। আপনার ছেলে না থাকলে কি হত কে জানে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা যেন জঙ্গলের রাজত্বে বাস করছি।

পরমহংস নিচু গলায় বলল, জঙ্গলও এর চেয়ে ভাল। মাধবীলতা বলল, আচ্ছা, এবার আমরা উঠি।

মণিমালা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলেন, সেকি! প্রথম এসেই মুখে কিছু না দিয়ে চলে যাবেন?, তা কিছুতেই হবে না।

মাধবীলতা বলল, তাতে কি হয়েছে? সে পরে একদিন হবে খন!

মণিমালা বললেন, না পরে টরে নয়। সামান্য তো চা। ওটুকু না খেয়ে গেলে আমার মেয়ের বিয়ে হবে না।

মাধবীলতা তাই শুনে শব্দ করে হেসে ফেলতেই ঊর্মিমালা লজ্জা পেয়ে ভেতরের ঘরে চলে গেল! পরমহংস সোফায় গা এলিয়ে বলল, তাহলে বসেই যাও। মিস্টার মুখার্জীর সঙ্গেও দেখা হতে পারে। তাছাড়া আমরা চা খেতেই তো যাচ্ছিলাম। আমারটায় কম চিনি দেবেন।

মণিমালা সম্মতি জানিয়ে চায়ের ব্যবস্থা করতে উঠে গেলে মাধবীলতা পরমহংসর দিকে তাকিয়ে বলল, এটা কি হল?

কিছুই না। চারটে চায়ের দাম বেঁচে গেল।

আশ্চর্য! তোমার কোন চক্ষুলজ্জা নেই। কিন্তু মিষ্টি কম দিতে বললে কেন?

শুধু চা কি থাকবে? সঙ্গে দুটো মিষ্টি নিশ্চয়ই দেবে। চায়ে যারা চিনি কম খায় তারা মিষ্টি ভালবাসে, এটা নিশ্চয়ই ভদ্রমহিলা জানেন। পরমহংস হাসতে হাসতে কথাটা শেষ করল। আর তখনই আধভেজানো দরজায় একটি সুন্দর চেহারার প্রৌঢ় এসে দাঁড়ালেন। তাঁর কপালে ভাঁজ পড়েছিল। ঘরের মধ্যে কয়েকজন অচেনা মানুষকে দেখলে যেমন হয়। তারপরেই অর্ককে চিনতে পেরে বলে উঠলেন, আরে, তুমি কখন এসেছ। আমি একটা চিঠি দিয়েছি, পেয়েছ?

না। অর্ক বিস্মিত। ভদ্রলোক সত্যি তাকে চিঠি দিয়েছেন। তারপর সে বলল, আমার মা আর কাকু। উনি ঊর্মিমালার বাবা।

মাধবীলতা এবং পরমহংস দাঁড়িয়ে নমস্কার করতেই ভদ্রলোক নমস্কার করে হাঁ হাঁ করে উঠলেন, কি আশ্চর্য, দাঁড়ালেন কেন, বসুন-বসুন। আমার কি সৌভাগ্য যে আমার এখানে আপনাদের পায়ের ধুলো পড়ল। সত্যি আপনি রত্নগর্ভা। এমন ছেলের মা হতে পারাটা কম নয়।

মাধবীলতা চকিতে অর্কর দিকে তাকাল। দেখল, অর্কর মুখ গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। সে বলল, ও এমন কিছু করেনি।

না, না, কি বলছেন আপনি! আজকাল পথেঘাটে কোন অন্যায় দেখলে কেউ প্রতিবাদ করে? সবাই নিজের গা বাঁচিয়ে সরে যায়। বাট হি ডিড ইট। কিন্তু ওরা কোথায়? আপনারা একা বসে আছেন, ঊর্মি, ঊর্মি–

ভদ্রলোক গলা তুলে ডাকলেন। মাধবীলতা বলল, আহা, আপনি ব্যস্ত হবেন না। ওঁরা এইমাত্র ভেতরে গেলেন।

এই সময় ঊর্মিমালা ফিরে এল, ডাকছ বাবা?

হা। এরা বসে আছেন তোমরা সবাই ভেতরে কেন?

মা ছিলেন তাই।

কি আশ্চর্য! মা তো কোন কাজে ভেতরে যেতেই পারেন। তুমি তোমার আঁকা ছবি অর্ককে দেখিয়েছ? অর্ক, যাও দেখে এসো। ও বেশ ভাল আঁকে।

ভদ্রলোক অর্ককে বললেন। রত্নগর্ভা শব্দটি শোনার পর থেকেই অর্কর মনে একধরনের অপরাধবোধ এসেছিল। কথাটা সত্যি নয় তা সে যেমন জানে মাধবীলতাও তেমন জানে। অথচ অর্ক দেখল মা কোন প্রতিবাদ না করে তার দিকে চোখ তুলে তাকাল। সেই চোখ যেন অর্ককে বলল, শোন, কথাটা শোন, নীলবর্ণ শেয়াল। আর ওটা বোঝামাত্র অর্কর মুখ কালো হয়ে গিয়েছিল। নিজেকে খুব ছোট বলে মনে হচ্ছিল। ঊর্মিমালা যতই ভাল আঁকুক তার কি যায় আসে। সে চুপ করে রইল। পরমহংস বলল, কি রে যা!

অতএব অর্ককে উঠতে হল। পাশের ঘরে ঊর্মিমালার পেছন পেছন উপস্থিত হয়ে দেখল ঘরটা ছিমছাম। একটা খাট আর বইপত্তরে ঠাসা। এটা যে ঊর্মিমালার ঘর বুঝতে অসুবিধে হয় না।

ঊর্মিমালা বলল, আমি মোটেই ভাল আঁকি না। বাবা বাড়িয়ে বলেছে।

অর্ক জবাব দিল না। ও দেওয়ালে টাঙানো একটি যুবকের ছবি দেখছিল। দুটো উজ্জ্বল বড় চোখ, মুখে সামান্য দাড়ি, গায়ের রঙ অসম্ভব ফসা। এত সুন্দর অথচ ব্যক্তিত্ববান পুরুষটির সঙ্গে এই বাড়ির কি সম্পর্ক তা সে ঠাওর করতে পারছিল না

ঊর্মিমালা তখন হাঁটুগেড়ে বসে একটা ছোট আলমারি থেকে ছবি বের করছে। ওর চওড়া পিঠ, সরু কোমর এবং মাঝারি নিতম্বের দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল সে। আবার মনের শিকড় ধরে টানাটানি শুরু হয়ে গেল। না, তাকে ভাল হতেই হবে। আজ ওই রত্নগর্ভা শব্দটি যদি পরিহাসের মত মায়ের কাছে শোনায় তাহলে কেন সেটা আগামীকাল সত্যি করতে পারবে না? ঊর্মিমালার কাছে সে কিছুতেই হেরে যাবে না। মেয়েটাকে দেখলেই মনে হয় ও সবকিছুতেই তার চেয়ে এগিয়ে আছে। অর্কর চোখ আবার দেওয়ালের দিকে ফিরে গেল। ওই যুবকটির সঙ্গে ঊর্মিমালার কোন মিল নেই। কিন্তু সে জিজ্ঞাসা করল, এটা কার ছবি?

ছবিগুলো টেবিলের ওপর রেখে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে ঊর্মিমালা নরম গলায় বলল, রবীন্দ্রনাথ।

২৫. প্রচণ্ড অবিশ্বাসে অর্ক

যাঃ, হতেই পারে না। প্রচণ্ড অবিশ্বাসে অর্ক ছবিটার দিকে ফিরে তাকাল।

ঊর্মিমালা অবাক, হতে পারে না মানে? ওটা রবীন্দ্রনাথের ছবি বিশ্বাস হচ্ছে না? এতক্ষণে অবশ্য অর্কর খেয়াল হয়েছে। রবীন্দ্রনাথেরও তো অল্প বয়স ছিল। সেই সময় তিনি কি রকম দেখতে ছিলেন সেটা সে জানে না। সাধারণ সাদা দাড়িওয়ালা এক বৃদ্ধের কথাই রবীন্দ্রনাথ শুনলে মনে ভাসে। সে আর একটু এগিয়ে প্রশংসার চোখে বলল, এতো সুন্দর দেখতে ছিলেন! আমি ভাবলাম–।

অর্ককে থেমে যেতে দেখে ঊর্মিমালা জিজ্ঞাসা করল, কি ভাবলেন?

এ বাড়ির কোন ছেলে হয়তো, কোন আত্মীয়।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের সবার আত্মীয়। ঊর্মিমালা পরিষ্কার হাসল।

সবার মানে?

যারা ভালবাসতে চায় ভালবাসা পেতে চায় তাদের সবার। আপনি গীতবিতানের গানগুলো আলাদা করে পড়েছেন? ঊর্মিমালা কেমন ভারী গলায় প্রশ্ন করল। হঠাৎ অর্কর মনে হল সে আবার ছোট হয়ে যাচ্ছে। ঊর্মিমালা পড়াশুনা এবং বোধে যে তার চেয়ে অনেক বড় তা আর। একবার প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে অন্যরকম প্রতিক্রিয়া হল তার। সে রবীন্দ্রনাথ পড়েনি তো কি হয়েছে?কত লোক তো কত কিছু পড়ে না। একটা এরোপ্লেন কিভাবে চালাতে হয় ঊর্মিমালা কি জানে? শোলের আমজাদ খাঁর পুরো ডায়ালগ কি ও বলতে পারবে? রাস্তাঘাটে লক্ষ লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের কয়জন রবীন্দ্রনাথের একটা পুরো কবিতা মুখস্থ বলতে পারবে? সে মাথা নেড়ে বলল, নাঃ, পড়ার বই-এর বাইরে রবীন্দ্রনাথের কোন বই আমি পড়িনি। ওসব পড়তে আমার ভাল লাগে না। নির্মল তরুণ ঊষা, শীতল সমীর, শিহরি শিহরি উঠে শান্ত নদী নীর। সকালবেলার এইসব বর্ণনা এখন আমরা পড়ে কি করব। যাদের কোন কাজ নেই তারা ওইসব পড়ে।

ঊর্মিমালা হেসে ফেলল। এক মুহূর্ত ভাবল, তারপর বলল, তাহলে আমার আঁকা ছবি দেখে কি করবেন। যাদের কোন কাজ নেই তারাই ছবি আঁকে

অর্ক বুঝতে পারল তার কথা ঊর্মিমালা ভালভাবে নেয়নি। সে হেসে বলল, দূর! ছবি তো বিক্রি হয়। সেদিন কাগজে বেরিয়েছে কার একটা ছবি কয়েক লক্ষ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ওটা অকাজ হবে কেন?

তাই? আর যারা সেই ছবি কিনে দেওয়ালে টাঙায় তারা কি পায়?

কি পাবে আর! দেখে ভাল লাগে তাই কেনে।

তাহলে স্বীকার করছেন মানুষ তার ভাল লাগার জন্যে অনেক পয়সা খরচ করতে পারে। ভাল লাগার তাহলে দাম আছে বলছেন?

বাঃ, ভাল লাগার দাম থাকবে না? তবে আমার যেটা ভাল লাগে তা আমার মার নাও লাগতে পারে, তাই না?

নিশ্চয়ই, আবার আপনার বাবার লাগতে পারে। কিন্তু জন্তু-জানোয়ারদের শুধু খাওয়া আর ঘুমানোই ভাল লাগে এবং এ ব্যাপারে তাদের সবার মত এক। তাদের মনের খুব পার্থক্য নেই। আমাদের আছে।

নিশ্চয়ই। অর্ক ভেবে পাচ্ছিল না ঊর্মিমালা কি বলতে চাইছে।

তাই কারো কথা শুনলে আমাদের ভাল লাগে! অসুখ হলে মা যখন কপালে হাত বোলায় তখন ভাল লাগে। সেটা কোন কাজে লাগছে? না, আমার মনটাকে তৃপ্তি দিচ্ছে। আমরা যখন কষ্ট পাই তখন কেউ সান্ত্বনা দিলে ভাল লাগে। ওতে কি কাজ হয়? না, আমার মনটা আরাম পায়। এসব মানেন তো? বড় বড় চোখে তাকাল ঊর্মিমালা।

হুঁ। মাথা নাড়ল অর্ক।

রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়লে আমি মনে জোর পাই, আমার অনেক সময় কষ্ট হয় দুঃখ হয় আবার খুশি লাগে। আমার চারপাশের মানুষকে আমি অন্যরকম চোখে দেখতে পাই। আমার কাছে তার দাম নেই?

অর্ক দেখল ঊর্মিমালা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এইভাবে ভেবে কেউ তার সঙ্গে কখনও কথা বলেনি। সে মাথা নাড়ল, আছে, কিন্তু আমার তো নাও থাকতে পারে।

এবার হেসে ফেলল ঊর্মিমালা, সামান্য শব্দ হল, বলল, যে মানুষ কখনও গান শোনেনি, ফুল দ্যাখেনি তাকে সেসব বললে হয়তো একই গলায় বলবে ওসবের কি দাম? কিন্তু যদি ভুলেও একবার কোন গান তার কানে যায় তাহলে বলতে বলতে ঊর্মিমালা চকিতে তাকাল, আমার মনে হচ্ছে আপনি আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন!

অর্ক মাথা নাড়ল, না। আমার পড়ার বইতে রবীন্দ্রনাথের যেসব কবিতা আমি পড়েছি তা শুধুই বর্ণনা। ওইসব পড়ে এরকম কিছুই মনে হয়নি।

আপনি গল্পের বই কবিতার বই পড়েন না?

কয়েকটা ডিটেকটিভ বই পড়েছি। আর হ্যাঁ, কিছুদিন আগে মা একটা বই এনেছিল, পথের পাঁচালি, কয়েক পাতা পড়েছিলাম।

পড়েছিলেন? কেমন লেগেছে?

ভাল্লাগেনি। শুধু বর্ণনা আর গ্রামট্রামের ব্যাপার মা বাবার ওই বইটাকে আবার খুব ভাল লাগে। কি জানি!

আপনি পড়ার সময়ের বাইরে কি করেন?

অর্ক হাসল, আগে আড্ডা মারতাম। পাড়ার রকে।

আপনার সহপাঠীদের সঙ্গে?

না। ওরা কেউ পড়াশুনা করে না। অবশ্য এখন আর রকে বসতে ভাল লাগে না।

ঊর্মিমালা একটা নিঃশ্বাস ফেলল যেটা অর্কর কান এড়াল না। তারপর ছবিগুলো টেবিল থেকে তুলে বলল, আমি তো তেমন আঁকতে পারি না, তবু দেখুন। প্রথম ছবিটা উঁচু করে ধরল সে। অর্ক দেখল, একটা বড় রাস্তা তাতে ট্রাম চলছে। দুপাশে বড় বড় বাড়ি দাঁড়িয়ে একটা ঘুড়ি উড়ছে। পরের ছবি একটি ভিখারিনী হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আর তার ভেঁড়া আঁচলের আড়ালে একটা ন্যাংটো ছেলে মুখ লুকিয়ে আছে। তৃতীয়টি একটি নদীর ছবি। আকাশে মেঘ এবং একটা হালভাঙ্গা নৌকো মাঝ নদীতে ভাসছে। কোন মাঝি বা যাত্রী নেই। নৌকোটার দিকে তাকালেই মনটা কিরকম হয়ে ওঠে। চতুর্থ ছবিটি দেখে থতমত হয়ে গেল অর্ক। বড় রাস্তা, একটা ট্রাম সদ্য স্টপেজ ছেড়ে যাচ্ছে এবং তার পেছনের ফুটপাথে তিনটি গুণ্ডা ধরনের লোক একটি ছেলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মারছে। বেশ কিছুটা দূরে নিরাপদে দাঁড়িয়ে কতগুলো লোক দৃশ্যটা উপভোগ করছে। ছবিটা থেকে চোখ তুলতেই ঊর্মিমালা মাথা নামাল। আর এই সময় দরজায় ঊর্মিমালার মা এসে দাঁড়ালেন, কিরে, ওকে এখানে আটকে রেখেছিস কেন? এসো বাবা, সামান্য কিছু মুখে দাও।অর্ক মহিলার। দিকে তাকাল, তারপর বসবার ঘরে চলে এল। সেখানে টেবিলের ওপর কয়েকটা প্লেটে খাবার দেওয়া হয়েছে। মাধবীলতা চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে ঊর্মিমালার বাবার কথা শুনছিল। পরমহংসর হাতে প্লেট, তার মুখ চলছে। ঊর্মিমালার বাবা বলছিলেন,অতুলপ্রসাদের নিজের গলার রেকর্ড। একটা বিশাল সূর্যের ঠিক পাশে দাঁড়িয়েও উনি এখনও আমাদের কাছে বেঁচে আছেন, ক্ষমতা না। থাকলে এরকমটা হতে পারে না। ওঁর গলাটিও ভারী মিষ্টি।

পরমহংস মিষ্টিটা মুখে নিয়ে বলল, রবীন্দ্রনাথের চেহারার সঙ্গে কিন্তু গলাটা একদম মানায় না। ওরকম বিশাল চেহারার কণ্ঠস্বর মেয়েদের মত।

আপনি ভুল করছেন। ঊর্মিমালার বাবা পরমহংসকে থামিয়ে দিলেন, ওঁর গলা মোটেই মেয়েদের মত ছিল না। ওরকম তেজোদীপ্ত কণ্ঠস্বর খুব কম পুরুষের দেখা যায়। এমনিতেই বুড়ো বয়সে রেকর্ডিং হয়েছিল তার ওপর অযত্নে ওই হাল হয়েছে। আকাশবাণীর রেকর্ড শুনলে ভুল। ধারণা হতে বাধ্য। আমি একবার শান্তিনিকেতনে গিয়ে কবির গলায় আবৃত্তির রেকর্ড শুনেছি। সম্পূর্ণ আলাদা। কি স্বরক্ষেপণ, কি উদাত্ত কণ্ঠ।

ঊর্মিমালার মা বললেন, তুমি একটু চুপ করো তো! নাও অর্ক, তুমি খাও, আপনি যে হাত গুটিয়ে বসে আছেন। না বললে শুনব না।

মাধবীলতা বলল, আমি শুধু চা খাব। এগুলো তুলে নিন।

কেন? না না, ওসব চলবে না। ঊর্মিমালার মা আপত্তি করলেন।

খুব অবেলায় খেয়েছি আজ। এমনিতেই আমার লিভার ভাল নয়। এখন খেলে অম্বল হয়ে যাবে আর আমি চা নিচ্ছি।

ঊর্মিমালার বাবা বললেন, জোর করছ কেন, শরীরকে কষ্ট দিয়ে খেয়ে কি দরকার। আপনি চা খান।

অর্ক দেখল ঊর্মিমালা এসে বাবার পেছনে দাঁড়িয়েছে। চোখাচোখি হতেই ঠোঁটের কোণে ভাঁজ পড়ল। ওটা কি হাসির! হঠাৎ ঊর্মিমালা মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনার পথের পাঁচালি খুব ভাল লাগে, না?

হ্যাঁ। মাধবীলতা অবাক হল।

আমারও। ঊর্মিমালা বলল, আমি কেঁদে ফেলেছিলাম।

ঊর্মিমালার বাবা বললেন, মানুষমাত্রই কাঁদবে। কেউ প্রকাশ্যে কেউ মনে মনে।

মাধবীলতা বলল, ওটা আমার প্রিয় বই। কিন্তু তুমি জানলে কি করে?

ঊর্মিমালা অর্ককে দেখাল, তখন শুনলাম। মাধবীলতা এবার ছেলের দিকে বিস্ময়ে তাকাল। তার ভাল লাগা বা মন্দ লাগার খবর কখনও ও রেখেছে বলে মনে হয়নি। তাছাড়া, পথের পাঁচালি যে তার ভাল লাগে একথা কখনও জানায়নি অর্ককে। তারপরেই খেয়াল হল অনিমেষের সঙ্গে কখনো কথা হয়েছিলো হয়তো যেটা ও শুনেছে। হেসে বলল, তুমি বুঝি খুব পড়?

ঊর্মিমালার মা বললেন, ওই তো জ্বালা। স্কুল থেকে এসে বই মুখে নিয়ে বসে আছে নইলে রঙ তুলি।

মাধবীলতা বলল, খুব ভাল। আমার ইনি আবার মুখ্যুসুখ্যু লোক। বই পত্তরের ধার ঘেঁষে চলেন। আচ্ছা, আজ আমরা চলি। খুব ভাল লাগল আপনাদের সঙ্গে আলাপ হয়ে।

ঊর্মিমালার মা বললেন, আবার কবে আসবেন?

মাধবীলতা বলল, আমরা তো আপনাদের পাড়ায় চলে আসছি। একটু গুছিয়ে বসলে আমি খবর দেব। তখন আপনাদের আমার ওখানে আসতে হবে। বেশী দূরে নয়।

ঊর্মিমালার মা বললেন, নিশ্চয়ই যাব।

ওরা দরজা ছাড়িয়ে কয়েক পা এগোতে মাধবীলতা বাধা দিল, না, না, আপনাদের আসতে হবে না, কি আশ্চর্য।

ঊর্মিমালার মা বললেন, অর্কর বাবাকে বলবেন এখানে এলে আমরা গিয়ে ওঁর সঙ্গে আলাপ করে আসবো। উনি কি কখনই সুস্থ হবেন না?

মাধবীলতা চোখ তুলে তাকাল। হঠাৎ যেন শূন্য হয়ে যাচ্ছিল দৃষ্টি। খুব দ্রুত নিজেকে ধাতস্থ করে বলল, জানি না।

ঊর্মিমালা কিন্তু ফুটপাথ অবধি নেমে এল। মাধবীলতা তাকে বলল, তোমাকে আমার খুব ভাল লাগল। আর হ্যাঁ, যত পার বই পড়বে। পৃথিবীতে এত বই আছে যে না পড়লে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। যতদিন মাথার ওপরে অন্য চাপ না আসছে ততদিন সুযোগ ছেড়ো না। কথাগুলো বলতে বলতে সে আর একবার ছেলের দিকে তাকাল। অর্কের নজর তখন দূরের বাসস্টপের দিকে। সেখানে সেই তিনটে ছেলে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। সেই তিনজন যারা তাকে মারতে এসেছিল। হঠাৎ একটা সিরসিরানি ভয় তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। আজ তার সঙ্গে সেই কলম-ছুরি নেই। এবং মা সঙ্গে রয়েছে। মাধবীলতা তখন বলছিল, এলাম।

অর্ক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ঊর্মিমালা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল কিন্তু তার চোখ ওর দিকে। মাধবীলতা এবং পরমহংস তখন হাঁটতে শুরু করেছে। অর্ক কোনরকমে বলল, চলি। নিজের গলার স্বর নিজের কানেই বেসুরো ঠেকল।

ঊর্মিমালা হেসে বলল, চলি বলতে নেই।

অর্ক দ্রুত পা চালিয়ে মায়ের পাশে চলে এল। ওরা যেদিকে যাচ্ছে সেদিকেই ছেলে তিনটে।

এখনও ওরা এদিকে নজর দেয়নি কিন্তু এবার দেখতে বাধ্য হবে। ওরা যদি আজ ঝামেলা করতে চায় তাহলে সে কি করবে? একা তিনজনের সঙ্গে হাতাহাতি করা মুশকিল এবং সবচেয়ে বড় কথা মা রয়েছে সঙ্গে। মাকে কি ওদের কথা বলবে? ছেলে তিনটে নির্ঘাৎ এপাড়ার এবং এখানে বাড়িভাড়া নেওয়ায় এদের সঙ্গে প্রায়ই তার দেখা হবে। অর্ক খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছিল।

মাধবীলতা তখন বলল, এরা কিন্তু সত্যি খুব ভদ্রলোক। পরমহংস বলল, হ্যাঁ। তবে একটু বেশী বেশী ভদ্রলোক। এতটা এখন বড় একটা দেখা যায়। এমন ব্যবহার করলেন যেন আমরাওঁদের কত বড় আত্মীয়। আর এইটেই আমার কাছে খটকা লাগছে।

মাধবীলতা হাসল, দিন দিন এমন অবস্থা হয়েছে যে আমরা আর কোন ভাল জিনিসকে ভাল মনে গ্রহণ করতে পারি না। তোমার দোষ নেই, এইটেই এখন আমাদের অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। ওখানে বসে একসময় আমারও তাই মনে হচ্ছিল। সন্দেহ করার বোগ আমাকেও ধরেছে।

পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, তাই মিষ্টি খেলে না?

যাঃ, মাধবীলতা সলজ্জ হাসল, আমার খেতে ভাল লাগে না।

এইবার তিনটে ছেলে একসঙ্গে বাঁ দিকে মুখ ফেরাতেই অর্ক সিটিয়ে গেল। ওর মনে হচ্ছিল মা সঙ্গে না থাকলেই ভাল হত। মায়ের উপস্থিতি যে তাকে দুর্বল করে দিচ্ছে এটা বুঝেই সে নিজেকে জোর করে শক্ত করতে চাইল। হঠাৎ মাধবীলতা ওকে কিছু বলবার জন্যে মুখ ফেরাতেই অবাক হল, একি কি হয়েছে তোর?

কিছু না। এবং ওটা বলবার পরই অর্ক স্থির করল ওরা যদি আক্রমণ করে তাহলে সে ছেড়ে দেবে না। তিনজনেই অর্ককে চিনতে পেরেছে। একজন মুখ খুলতে যাচ্ছিল কিন্তু তৎক্ষণাৎ আর একজন বলল, এই, না!

এই সময় অর্ক শুনল পরমহংস বলছে, কিরে, এখানে কি করছিস?

দলের একজনের মুখ একটু কাঁচুমাচু হল। অর্ক চিনতে পারল, এই লোকটাই তাকে মারতে এসেছিল রাস্তা পেরিয়ে। ট্রামের অপরাধীটি ওর পাশে দাঁড়িয়ে, কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায়। যাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল সে জবাব দিল, এই এমনি গল্প করছি। পরমহংস মাধবীলতাকে বলল, এ হচ্ছে আমার জ্যাঠতুতো দাদার ছেলে। খুব হেল্পফুল। লোক্যাল ট্যালেন্ট বলতে পার। সুবীর, এরা হল আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুর স্ত্রী এবং ছেলে। ওরা আমাদের পাড়ায় বাড়ি নিয়ে উঠে আসছে।

অর্ক দেখল লোকটার মুখ ফুটো বেলুনের মত হয়ে যাচ্ছে। যদিও বয়সে পরমহংসের চেয়ে অনেক ছোট তবু চেহারায় লোক লোক হয়ে গিয়েছে।

সুবীর কিছুটা জড়তা নিয়ে বলল, আমাদের পাড়ায়?

হ্যাঁ, ওই গলিটায়।

মাধবীলতা বলল, ভালই হল ভাই। তুমি যখন ওর ভাইপো তখন আমাদেরও। যদি আপদে বিপদে দরকার হয় তাহলে সাহায্য করো।

সুবীর ঘাড় নাড়ল, নিশ্চয়ই। পরমহংস আর কথা বাড়াল। রাস্তা পেরিয়ে এদিকের ট্রামস্টপেজে চলে এল। অর্কর খুব হাসি পাচ্ছিল। ও বুঝতে পারছিল ওরা এখন নিষ্ফল আক্রোশে এদিকে তাকিয়ে আছে। যতই রাগ থাক আর ওদের কিছু করা সম্ভব নয়। ভাগ্যিস পরমহংসকাকু সঙ্গে ছিল নইলে কিন্তু পরমহংসকাকুর ভাইপো এ পাড়ার ভাল মস্তান। কাকার ব্যবহার এবং চেহারা দেখে ভাইপোর এই স্বরূপের কথা ভুলেও কল্পনা করা যায় না। সে হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠতেই মাধবীলতা বলল, কিরে, হাসছিস কেন? একটু আগে দেখলাম মুখচোখ কাঠ হয়ে গেছে আবার এখন হাসি হচ্ছে, মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি!

মাথা খারাপ হবে কেন? অর্ক আবার হাসল। মাধবীলতা একবার ভ্রূকুটি করে মুখ ফিরিয়ে নিল। নাঃ, অর্ক ভাবল, এসব কথা মা কিংবা পরমহংসকাকাকে বলা যাবে না। হয়তো এপাড়ায় এলে পরমহংসকাকার ভাইপোর সঙ্গে আলাপ হয়ে যেতেও পারে। তবে কিছুতেই ওই ট্রামের অপরাধীটির সঙ্গে সে কথা বলবে না। এক নম্বরের নোংরা লোকটা।

একটা বেলগাছিয়ার ট্রাম আসছিল। মাধবীলতা পরমহংসকে বলল, চল

যাবো? কোথায় যাবো? পরমহংস আঁতকে উঠল।

আমাদের ওখানে চল। তোমাকে দেখলে ও খুশি হবে।

আর একদিন হবে, আজ নয়। আমি অবশ্য ট্রামে উঠছি, হাতিবাগানে নামব। ওঠ ওঠ। প্রায় তাড়া দিয়ে পরমহংস ওদের ট্রামে তুলল। বেশ ফাঁকা ট্রাম। মাধবীলতা মেয়েদের জায়গায় বসল। সেখানে আর কোন মহিলা না থাকায় অর্ক মায়ের পাশে বসল কিন্তু পরমহংস দাঁড়িয়ে রইল। মাধবীলতা তাকে বলল, কি হল, বসো।

পরমহংস ঘাড় নাড়ল, মাথা খারাপ। এর পরে একটি মহিলা উঠবেন আর আমাকে সুড়সুড় করে সিট ছেড়ে দিতে হবে। যেচে কেউ গলাধাক্কা খায়!

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, কিন্তু তুমি চললে কোথায়?

পরমহংসের উঁচু দাঁতের সামনে থেকে ঠোঁট সরে গেল। গোল মুখটি লজ্জা মেশানো হাসিতে উদ্ভাসিত হল। বলল, সিনেমায়।

অ্যাাঁ, কি সিনেমা?

প্যার কা তুফান!

মাধবীলতা যেন মুখ বন্ধ করতে ভুলে গেল। অর্ক অবাক চোখে এখন পরমহংসকে দেখছে। মাধবীলতা কোনরকমে সামলে নিয়ে বলল, তুমি হিন্দী সিনেমা দ্যাখো?

পরমহংস মাথা নাড়ল, সপ্তাহে একবার, ছুটির দিন। ওই একটি নেশা। অন্যদিন অফিস থেকে তাস খেলে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায় বেশ। এই ছুটির দিনটাই কাটতে চাইতো না তাই এই ব্যবস্থা করে নিয়েছি। তিন দিন আগে অ্যাডভান্স কেটে রাখি। ফার্স্ট ক্লাশ চলে যায়।

মাধবীলতা বলল, আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না। তুমি হিন্দী সিনেমা প্রত্যেক সপ্তাহে দেখতে পারো? বাংলা দ্যাখো না?

বাংলা? ওরে বাপ, নেভার। বাংলা ছবি কোন ভদ্রলোক দ্যাখে না। শালা সেই প্যানপাননি, গল্পের মাথাআগা নেই, একটা ভাল অ্যাকট্রেস নেই যে বসে থাকব, ফটোগ্রাফি যাচ্ছেতাই। তার ওপর যদি ইনটেলেকচুয়াল ডিরেক্টার হয় তো দফারফা। আঁতুড়ঘরের ঘুম এসে যাবে চোখে। সাধ করে পয়সা নষ্ট আর যন্ত্রণা পেতে কে যাবে বল? তার চেয়ে হিন্দী ছবি দ্যাখো। কি পাবে না, দারুণ দারুণ দৃশ্য, হিট গান, ফাঁইটিং, আর রাজকন্যেদের মত সুন্দরী, কি করে সময় কেটে যায় টের পাই না। কথা শেষ করে পরমহংস সামান্য ঝুঁকে বাইরেটা দেখল। ট্রামটা তখন হাতিবাগানে বাঁক নিচ্ছে। মাধবীলতা দ্রুত বলে উঠল, তোমার আজ সিনেমা দেখা চলবে না।

অ্যাঁ? পরমহংস অবাক হয়ে তাকাল।

হ্যাঁ। আজ আমাদের ওখানে গিয়ে আড্ডা মারবে।

কিন্তু

কিন্তু কিন্তু নয়। তোমার তো সময় কাটানো নিয়ে কথা।

তাহলে, আমার জলজ্যান্ত চার পয়ষট্টি নষ্ট করে দেবে?

ও তো দেখলেও নষ্ট হতো।

মোটই নয়। ওটা দেখে বাড়ি গেলে চমৎকার ঘুম আসতো।

আমি কিছু জানি না। যা ভাল বোঝ কর।

মাইরি, এই তো মুশকিলে ফেললে। এখন এটা নিয়ে কি করি?

পকেট থেকে একটা সবুজ টিকিট বের করে দেখাল পরমহংস। একটি মধ্যবয়সী লোক ট্রাম থেকে নামবে বলে দাঁড়িয়েছিল এবার সে মাথা বাড়িয়ে বলল, দাদা, টিকিটটা কি প্যার কা তুফানের?

হ্যাঁ। পরমহংস বিমর্ষভঙ্গীতে মাথা নাড়ল।

চট করে ভেতরে চলে এল লোকটা। ওর হাতে তখন পাঁচ টাকার নোট। সেটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, সকালে হাউসফুল দেখে গিয়েছি, এখন ফ্লাইং টিকিট ধরতে এসেছিলাম। কপালে ছিল বলে আপনার দেখা পেলাম। টাকাটা গছিয়ে দিয়ে টিকিটটা হাতিয়ে নিয়ে লোকটা দরজার দিকে এগোল। পরমহংস এমন হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল যে অসাড় চোখে চেয়ে রইল। ট্রামটা যখন সিনেমা পাড়া ছাড়িয়ে যাচ্ছে তখন ওর খেয়াল হল, আরে, লোকটা যে পঁয়ত্রিশ পয়সা ফেরত পাবে! কি আশ্চর্য

মাধবীলতা হেসে উঠল, এ মা তুমি টিকিট ব্ল্যাক করলে?

মুখ ভেটকে পরমহংস কণ্ডাক্টরকে ভাড়া দিতে দিতে বলল, যাই হোক, লোকটা আমায় তোমাদের বাড়িতে যাওয়ার ভাড়া দিয়ে গেল। যাচ্ছি যখন তখন বেশ ভাল করে খাওয়াতে হবে।

কি খাবে বল?

কড়া করে পেঁয়াজ ভেজে তেল মাখা মুড়ি আর লঙ্কা। পরমহংস চোখ বুজে বলল।

.

ট্রাম থেকে নেমে মাধবীলতা ইঙ্গিতে অর্ককে কাছে ডাকল। তারপর হাঁটতে হাঁটতেই একটা পাঁচ টাকার নোট ওর হাতে দিয়ে চাপা গলায় বলল, তেলেভাজা আর মুড়ি নিয়ে আয়। অর্কর মাথায় কিছুতেই আসছিল না যে ঊর্মিমালার বাড়িতে অত খেয়েও কি করে পরমহংসকাকুর আবার খিদে পাচ্ছে। ওই বেঁটে খাটো মানুষটির পেটে কত খিদে কে জানে! তার নিজের তো একটুও খেতে ইচ্ছে করছে না।

ট্রাম ডিপোর ঠিক উল্টো দিকে চমৎকার তেলেভাজা ভাজে। মাধবীলতা এবং পরমহংস ঈশ্বরপুকুরে ঢুকে গেলে অর্ক তিনজনের মত তেলেভাজা আর মুড়ি কিনে নিল সেখান থেকে। তারপর গলির মধ্যে ঢুকতেই অশ্লীল খিস্তি শুনতে পেল। কয়েক পা এগোতেই নজরে এল একটা রকের ওপর দু’পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে কোয়া সামনের বাড়ির দিকে তাকিয়ে বাপ বাপান্ত করে যাচ্ছে। কোয়ার ঠিক পাশেই এ পাড়ার কয়েকটা ছোঁকরা হাসি হাসি মুখ করে বসে আছে। এদের বোধহয় হাতেখড়ি দিচ্ছে কোয়া। অর্ককে দেখেও কোয়া তোয়াক্কা না করে চেঁচালো, টেংরি ভেঙ্গে দেব। কোঠাবাড়িতে বাস করছে বলে মাথা কিনে নিয়েছে! রকে বসেছি বলে ইংরেজিতে গালাগালি দিচ্ছে। বেরিয়ে আয় শালারা।

অর্ক বুঝতে পারল কোয়া তাকে ইচ্ছে করেই চিনতে পারছে না। খুরকি-কিলা মারা যাওয়ার পর কোয়া এখন ঈশ্বরপুকুরের এক নম্বর হতে চাইছে। এরকম দু-একটা কেস করতে পারলেই হয়ে যাবে। হাতে তেলেভাজা তাই মেজাজটা গরম হয়ে গেলেও কোনরকমে নিজেকে সামলালো অর্ক। সে ঠাণ্ডা গলায় বলল, কি হয়েছে?

রকে বসেছি বলে ননসেন্স বলল। ইংরেজিতে গালাগালি। আমরা নাকি এখানে বসে খিস্তি করছি। তুই যা, আমি এটা বুঝে নেব। কাঁধ ঝাঁকিয়ে শেষ কথাটা বলে কোয়া আবার ওপরের দিকে তাকাল।

অর্ক আর দাঁড়াল না। ফালতু ঝামেলায় এখন জড়াতে ইচ্ছে করছে না। হন হন করে তিন নম্বরের সামনে আসতেই একটা ছোট জটলা দেখতে পেল। ওকে দেখে নিমু বলে উঠল, ওই যে, ওর বাবা, ওর সঙ্গে যান।

অর্ক দেখল একটা লোক সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে। তাকে দেখে জিজ্ঞাসা করল, অনিমেষ মিত্র আপনার বাবা? অর্ক মাথা নাড়ল।

টেলিগ্রাম আছে। চলুন।– হতভম্ব হয়ে গেল অর্ক। তাদের টেলিগ্রাম করবে কে? গলিতে পা দিয়ে দেখল মোক্ষবুড়ি পাথরের মত বসে আছে। ঘরের দরজা খোলা। অর্ক অনিমেষকে ডাকল, বাবা, তোমার টেলিগ্রাম এসেছে।

লুঙ্গি পরে খাটের ওপর অনিমেষ বসেছিল। চমকে উঠে বলল, টেলিগ্রাম?

হঠাৎ যেন চারধার শব্দহীন হয়ে গেল!

২৬. মাধবীলতা ততক্ষণে দরজায়

মাধবীলতা ততক্ষণে দরজায়, হাত বাড়িয়ে বলল, দিন।

সইসাবুদ করিয়ে টেলিগ্রামটা দিয়ে লোকটা চলে গেল। অনিমেষ এক টানে খামের মুখটা ছিড়লো। তারপর লেখাগুলোর দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাধবীলতার দিকে বাড়িয়ে দিল। এইসময় পরমহংস বলে উঠল, কি ব্যাপার?

অর্ক মাধবীলতার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। উঁকি মেরে সে পড়তে পারল ফাদার সিরিয়াসলি ইল, কাম শার্প।

মাধবীলতা নিচু গলায় বলল, কি করবে?

অনিমেষ দরজার দিকে তাকিয়েছিল। তখন বাইরে ছায়া ঘন হয়ে এসেছে। কিংবা বলা যায় রাতের ছায়া পড়েছে। সেদিকে তাকিয়ে অনিমেষ কোন উত্তর দিল না। মাধবীলতার হাত থেকে পরমহংস টেলিগ্রামটা নিয়ে শব্দ করে পড়ল, ফাদার সিরিয়াসলি ইল, কাম শার্প। ছোট মা। ছোট মা কে?

অনিমেষ জবাব দিল না। মাধবীলতা বলল, ওর মা।

তুই জানতিস কিছু? মানে, এই অসুস্থতার ব্যাপারে?

অনিমেষের বোধহয় কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। ও তখন একদৃষ্টিতে ছায়াকে আঁধার হয়ে যেতে দেখছিল। মাধবীলতা বলল, কিছুদিন আগে ছোটকাকার মুখে শুনেছিলাম যে উনি অসুস্থ, প্যারালিসিস।

সেইসময় হঠাৎ স্টোভে চাপানো কেটলি থেকে শব্দ বের হতে লাগল। সোঁ সোঁ শব্দটা যেন অনিমেষকে ধাক্কা মারতেই সে চেতনায় ফিরে এসে বলল, টেলিগ্রামটা দেখি। পরমহংস ওটা অনিমেষকে দিল, দিয়ে বলল, কি করবি?

অনিমেষ অন্যমনস্ক গলায় বলল, কি করব! আমি কি করতে পারি। তারপর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে টেলিগ্রামটাকে দেখতে লাগল। পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, কি দেখছিস?

ভাবছি আমার ঠিকানাটা পেল কোথায়? ওহহ! ছোটকাকা, ছোটকাকা দিয়েছে। তাহলে। অনিমেষ আবার চোখ বন্ধ করল। কদিন দাড়ি কামায়নি অনিমেষ। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে মুখ ছেয়ে গিয়েছে। ইদানীং চিবুকের কাছে সাদা হয়েছে। দাড়ি না কামালে অনিমেষকে খুবই বয়স্ক দেখায়। এবং তাই মুহূর্তে বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল। পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, কত বয়স হয়েছে ওঁর?

অনিমেষ বন্ধুর দিকে তাকাল। হয়তো মনে করার চেষ্টা করল তারপর বলল, ষাট তো হয়েই গেছে অনেকদিন।

মাধবীলতা ইতিমধ্যে চায়ের জল নামিয়েছে, পাতা ভিজিয়ে কাপ ঠিক করেছে। অর্কর নিয়ে আসা তেলেভাজা একটা থালায় ঢেলে সে এগিয়ে ধরল পরমহংসের সামনে, নাও।

পরমহংস চমকে উঠল, ও বাবা, এত কে খাবে! তাছাড়া আমার এখন খেতে ভালও লাগছে না।

কেন? খেতে চাইলে এখন না বললে শুনবো কেন? মুড়িটা দিচ্ছি, তাও খেতে হবে। কেনার পর নষ্ট হতে দেব না আমি। মাধবীলতার কণ্ঠস্বর শুনে চমকে তাকাল পরমহংস। থমথম করছে মুখ। তারপর নিচু গলায় সে বলল, এই টেলিগ্রামটা।

তোমার মুড নষ্ট করে দিল? যার নামে টেলিগ্রাম এল সে কি করব কি করতে পারি বলে হাত পা ছড়িয়ে বসে রইল আর তোমার ভাবনায় খিদে উড়ে গেল! চমৎকার। মাধবীলতা থালাটাকে সরিয়ে মেঝেতে শব্দ করে রেখে অর্ককে জিজ্ঞাসা করল, তুই খাবি?

অর্ক মাথা নাড়ল, পরে খাব, এখন খিদে নেই। মাধবীলতা উল্টো দিকে মুখ করে চা ঢালছিল। অর্ক এগিয়ে এসে খাটের ওপর পড়ে থাকা টেলিগ্রামটা তুলে নিল। অনিমেষ হঠাৎ ওর হাত থেকে টেলিগ্রামটা নিয়ে আর একবার চোখ বোলালো, এটাকে সত্যি ভাবার কোন কারণ নেই।

সেকি! পরমহংস চমকে উঠল, জলপাইগুড়ি থেকে তোকে ঠাট্টা করে ওটা পাঠাবে নাকি! কি যে বলিস!

আমার ছোটকাকাকে বিশ্বাস নেই। যখনই আসেন তখনই একটা কিছু গোলমাল পাকিয়ে যান। ওঁর এখন ইচ্ছে আমরা জলপাইগুড়ির বাড়িতে গিয়ে থাকি। তাতে মা বাবা এবং পিসীমাকে দেখাশোনা করা যাবে। তাছাড়া হয়তো ওঁর মনে পিসীমা সম্পর্কে যে বিবেকবোধটা খোঁচা মারে তা আমরা ওখানে গেলে শান্ত হয়ে যাবে। এইজন্যেই যদি টেলিগ্রামটা করা হয়? অনিমেষ যুক্তিগুলো খাড়া করে মাধবীলতার দিকে তাকাল। তখনও মাধবীলতার চা করা শেষ হয়নি। ওর পিঠের দিকে তাকিয়ে অনিমেষের হঠাৎ মনে হল এবার যেন ভাঙ্গনের টান লেগেছে মাধবীলতার শরীরে। ঘাড়ের পাশে ওই ভাঁজগুলো তো আগে ছিল না, পিঠটাকেও এত সরু কখনও মনে হয়নি।

পরমহংস বলল, জানি না ভাই। তবে যদি সত্যি হয়? জেল থেকে বের হবার পরে তুই নিজেও কোন যোগাযোগ রাখিসনি?

অনিমেষ বলল, না। তারপরেই তার খেয়াল হল এই প্রশ্নের উত্তর সে আগেও দিয়েছে। জেলখানায় যাওয়ার আগেও তো মহীতোষের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক ছিল না। তখন নকশাল আন্দোলনে এত সক্রিয় যে সম্পর্ক রাখার সময়ও ছিল না। সেসময় সম্পর্ক রাখা মানে বাবাকে। বিব্রত করা কিংবা পুলিসের হাতে ধরা পড়া। আর জেল থেকে বেরিয়ে এখানে আসার পর তার মনে হয়েছিল এতদিন বাদে স্ত্রী পুত্র নিয়ে পঙ্গু হয়ে বাবার কাঁধে ভর করার কোন যুক্তি নেই। এসব নিয়ে সে এখন আর ভাবে না। অথচ ঘনিষ্ঠ কেউ বারে বারে এ প্রশ্ন করবে। প্রথমদিকে মাধবীলতা করেছিল, ছোটকাকা করেছে এবং পরমহংসও করছে। অর্ক কখনই অভিযোগ করেনি কিন্তু ছেলেবেলায় জানতে চাইত। হয়তো মাধবীলতা তাকে বুঝিয়েছে, কি বুঝেছে সে-ই জানে।

চায়ের কাপ সামনে রাখল মাধবীলতা তারপর জিজ্ঞাসা করল, মুড়ি মাখব না?

পরমহংস হাসবার চেষ্টা করল, দাও, তেলেভাজা খাচ্ছি, মুড়ি মাখতে হবে না।

অনিমেষ দেখল মাধবীলতা চায়ে চুমুক দিয়ে একটা তেলেভাজা তুলে নিল। তার সামনেও চায়ের কাপ রাখা হয়েছে কিন্তু কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে খেতে। অথচ না খাওয়ারও কোন যুক্তি নেই। পরমহংস দ্বিতীয় বেগুনি নিয়ে বলল, আমার মনে হয় খোঁজ নেওয়া উচিত!

মাধবীলতা মুখ তুলল, কিসের?

টেলিগ্রামটা ঠিক না বেঠিক?

মাধবীলতা বলল, বেঠিক ভাবলে অনেক দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার সুবিধে হয়।

পরমহংস বলল, এরকম করে বলো না।

আমি অন্যায় কিছু বলছি না। ওই বাড়ির একমাত্র ছেলে ও। য়ুনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে ও যে আদর্শটাকে শ্রেয় মনে করেছে তাতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সেসময় উত্তেজনা এত বেশী ছিল যে কারো কাছে অনুমতি চাওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। জেলে গিয়ে যখন সেই উত্তেজনায় ভাটা পড়ল, যখন বুঝল শারীরিক সক্ষমতা নেই তখন রক্ত দুর্বল হতে বাধ্য। সেসময়ে মনে হয়েছে আর কখনও ও বাবা মা পিসীমার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। বাড়ির ছেলে হিসেবে ও কোন কর্তব্য করতে পারবে না। শুধু ওদের কথা কেন, আমাকেও এড়াতে চেয়েছিল ও। জেলখানায় পরিচিত একটা ছেলের বাড়িতে গিয়ে উঠেছিল তাই। ভেবেছিল আমার ঘাড়ে পঙ্গু হয়ে পড়ে থাকার বোঝা বাড়াবে কেন? আমার তো কোন উপকারই করতে পারবে না। আমি নির্লজ্জের মত সেখান থেকে জোর করে না নিয়ে এলে কোনদিন আসতো? আসলে এই এড়িয়ে যাওয়া ক্ষতি করতে নয়। নিজের অক্ষমতার অভিমান ওর এত বেশী যে প্রিয়জনদের কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে চায়। একটানা কথাগুলো বলতে বলতে মাধবীলতার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছিল। শেষে নিচের ঠোঁট কামড়ে উঠে দাঁড়াল। ঝট করে গামছাটা টেনে নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। পরমহংস কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে রইল। তার সেই হাসিখুশি মেজাজটা হঠাৎ যেন উধাও হয়ে গেছে। অনিমেষের দিকে তাকাতেই সে ম্লান হাসল, কি জানি, হয়তো ও ঠিকই বলছে।

পরমহংস বলল, দ্যাখ এসব তোদের নিজস্ব ব্যাপার, আমার কিছু বলা সাজে না। তবে আমার মনে হচ্ছে তোদের একবার জলপাইগুড়িতে যাওয়া উচিত।

অসম্ভব। আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অনিমেষ কথাটা ছুঁড়ে দিল।

অসম্ভব কেন?

তুই ক্ষেপেছিস? আমার যা শরীর তাতে ট্রেনে উঠব কি করে? অনিমেষ প্রস্তাবটাকে সরাসরি বাতিল করে দিল। এতক্ষণ অর্ক চুপচাপ কথাবার্তা শুনছিল। বাবার বাবা খুব অসুস্থ এবং তাকে দেখবার জন্যে বাবাকে যেতে বলা হয়েছে। জলপাইগুড়ি অনেক দূরে। সেখানে শুধু পাহাড় আর চায়ের বাগান আছে। বাবার কাছে এবং স্কুলে যা শুনেছে তাতে তার কোন আকর্ষণ বোধ হয় না। যদিও বাবা খুব রঙ চড়িয়ে সেইসব বর্ণনা করত। বাবার এক পিসীমা আছে যিনি নাকি দারুণ পায়েস রাঁধেন। কিন্তু জন্মাবার পর সে শুধু মাকে দেখেছে, তার কিছু পরে বাবাকে। এছাড়া আর কোন আত্মীয়স্বজনকে সে চোখে দ্যাখেনি। কাকা জ্যাঠা তার থাকার কথা নয় কারণ সে শুনেছে বাবার কোন ভাইবোন ছিল না। অবশ্য এই সেদিন বাবার কাকা এসেছিল। কিন্তু আর কাউকে তো সে চেনে না। এই সুযোগে একবার জলপাইগুড়িতে গিয়ে দেখে এলে হয় সবাইকে। সে কথা বলতে যাচ্ছিল এই সময় মাধবীলতা ঢুকল। এইটুকু সময়ের মধ্যে যেন সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলেছে সে। নিজেকে, মুখের সেই থমথমে ভাবটা নেই। হাবভাবে যে উত্তেজনা এসেছিল সেটি উধাও। ঘরে ঢুকে গামছাটা রেখে খুব শান্ত গলায় বলল, জলপাইগুড়ির ট্রেন কখন ছাড়ে?

অনিমেষ কিছুটা বিরক্ত কিছুটা অবাক চোখে মাধবীলতাকে দেখল। প্রশ্নটা পরমহংসর দিকে তাকিয়ে তাই সে জবাব দিল, জলপাইগুড়ি অবধি ট্রেন আছে কিনা জানি না তবে সব ট্রেনই নিউ জলপাইগুড়ি যায়। দার্জিলিং মেইল, কামরুপ এক্সপ্রেস। কিন্তু ট্রেনের খোঁজ করছ কেন?

কখন ছাড়ে ওগুলো?

সন্ধ্যেবেলায়।

আমরা জলপাইগুড়িতে যাব। মাধবীলতার গলায় সামান্য উত্তেজনাও নেই।

এবার অনিমেষ কথা বলল, আমরা মানে?

আমাদের সংসারে আমরা বলতে কি বোঝায় তা তুমি জানো না? চেয়ার থেকে কাপড় সরিয়ে মাধবীলতা ধীরে ধীরে সেখানে বসল। কথাটা বলার সময় অনিমেষের দিকে যে তাকাল না সেটা লক্ষ্য করছিল অর্ক।

আমাকে বাদ দিয়ে ভাব। অনিমেষের গলা একরোখা শোনাল।

কেন?

আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। এবার আর উত্তেজনাটা চাপা থাকল না।

মাধবীলতা এবার সরাসরি তাকাল, বেশ। তাহলে এ প্রসঙ্গ এখানেই শেষ হোক।

অর্ক হঠাৎ কথা বলে উঠল, মা, গেলে হতো, তাই না?

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, না। যার পরিচয় নিয়ে আমরা যাব সে যদি না যায় তাহলে গিয়ে কি লাভ। আমাদের তো কেউ চিনবে না ওখানে। কথাগুলো বলার সময় অদ্ভুত একটা বিষাদের ছায়া নামল গলায়।

তারপর সব চুপচাপ! এই ঘরের চারজন মানুষ কোন কথা বলছে না। এইসময় পৃথিবীর সব নিস্তব্ধতাকে খান খান করে একটি কণ্ঠস্বর তীব্র হয়ে উঠল, সেই খানকির ছেলেটা কোথায়? আমি তাকে শেষ করে ফেলব আজ। অ্যাই, কোথায় গেছে সেটা বল। আর তখনই কয়েকটি শিশু যেন। চিৎকার করে কেঁদে উঠল। মুহূর্তেই হইচই পড়ে গেল বস্তিতে। অর্ক তড়াক করে দরজায় চলে এসেছিল। এখান থেকেই সে অনুর বাবাকে দেখতে পেল। ওই শীর্ণ হতাশ চেহারার নির্জীব মানুষ এখন প্রচণ্ড খেপে বাচ্চা দুটোকে পিটিয়ে যাচ্ছে। বস্তির মানুষরা ভিড় করে দেখছে কিন্তু কেউ কথা বলছে না। অর্ক দৌড়ে গেল সামনে তারপর অনুর বাবাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল, মারছেন কেন, ওরা মরে যাবে এভাবে মারলে।

অনুর বাবা বাধা পেয়ে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও আমাকে। এই বংশ নির্বংশ করে ফেলব আমি। তিনি চলে গেলেন ড্যাংডেঙ্গিয়ে, মেয়ে ভেগে গেল ভাতারের সঙ্গে। আমি কি করব? আমি এই সাপগুলোকে দুধকলা খাওয়াবো একটু ফণা গজালেই ছোবল খাওয়ার জন্যে? হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল অনুর বাবা। অর্ক সেই প্রৌঢ়ের শরীরটাকে ধরে ঘরের ভেতর নিয়ে গেল। অনুর বাবা কাঁদতে কাঁদতে অর্ককে জড়িয়ে ধরে বলল, ওরে, তোরা আমাকে মেরে ফ্যাল। দে ছুরি চালিয়ে। আমি বেঁচে যাই।

অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে? এরকম করছেন কেন?

অনুর বাবা কান্নার দমকে কোন জবাব দিতে পারল না। তাকে মাটিতে বসিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে অর্ক দেখল বাচ্চা দুটো দরজায় দাঁড়িয়ে এদিকে তাকিয়ে আছে। অর্ক ওদের জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে

বড়টা বলল, দাদা মাল খেয়েছে। সরু কচি গলায় অদ্ভুত শোনাল শব্দটা।

মাল খেয়েছে? অর্ক অবাক। ন্যাড়া তো এখনও বাচ্চা।

মাল খেয়ে থালা গ্লাস ঝেড়ে দিয়েছে। ছোটটার গলা আরও সরু!

হতভম্ব হয়ে বাচ্চা দুটোর দিকে তাকিয়েছিল অর্ক। ন্যাড়া মাল খাওয়ার জন্যে যে অবাক হওয়া তার চেয়ে অনেক বেশী এই বাচ্চাদুটোর মুখে ‘মা’আর ঝেড়ে দেওয়া শব্দ শুনে। সে ধীরে ধীরে নিজেদের ঘরের দিকে ফিরে এল। যারা ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল তারা হতাশ হল। একজন বলে উঠল, থামিয়ে দিয়ে যেন কত উপকার করল!। চিৎকার করে মনের কষ্ট বের করছিল সেটা সহ্য হল না!

নিজেদের দরজায় দাঁড়াতেই পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে?

ন্যাড়াটা মদ খেয়েছে।

সেকি! মাধবীলতা চমকে তাকাল, হায়, ভগবান!

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, বাচ্চা দুটোকে মারছিল কেন?

অর্ক সরল গলায় কথাটাকে আবৃত্তি করল, বড় হয়ে ছোবল মারবে সেই ভয়ে!

এই ঘরে আর কথা জমল না। খানিকক্ষণ বাদে পরমহংস বলল, আজ উঠি। তোমরা তাহলে এক তারিখে ওখানে চলে যাচ্ছ।

ওখানে যাচ্ছি মানে? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

ওহহ তোকে তো কিছুই বলা হয়নি। মাধবীলতার বাড়িটা অপছন্দ হয়নি। আমি টাকা পয়সা মিটিয়ে দিচ্ছি। তোরা এক তারিখে শিফট করবি।

মাধবীলতা বলল, তোমার কাছে ঋণ বেড়ে যাচ্ছে পরমহংস।

দূর! সামান্য কটা টাকা। শোধ করে দিলে ঋণ থাকবে না

শুধু এটা কেন? আগেরটাও তো দেওয়া হয়নি।

আগেরটা? পরমহংস অবাক হয়ে মাধবীলতার দিকে তাকাল।

বাঃ, অর্কর অসুখের সময় যেটা দিয়েছ সেটা ভুলে গেলে? খুব বেশী টাকা হয়ে গেছে মনে হচ্ছে! কথাটা বলে মাধবীলতা মুখ নামাতেই অর্ক প্রাণপণে ইশারা করল পরমহংসকে চুপ করতে। পরমহংস কিছুতেই বুঝতে পারছিল না। হঠাৎ অনিমেষ বলল, কিন্তু বাড়িটাকে কদিন ধরে রাখা যাবে রে?

ধরে রাখা? এই বাজারে বাড়ি ধরে রাখা যায়?

কিন্তু আমরা যদি জলপাইগুড়িতে যেতাম?

জলপাইগুড়িতে যাচ্ছিস না যখন তখন ও প্রশ্ন উঠছে কেন? আর যদি যেতিস তাহলে অ্যাডভান্স করে ভাড়া দিয়ে গেলে তাদেরই থেকে যেত। পরমহংস কথা শেষ করে অর্কর দিকে তাকাল। অর্ক এখন মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে এমন ভঙ্গীতে যেন পরমহংস বের হলে সে এগিয়ে দেবে। পরমহংস ঠিক করল মাধবীলতার কথাটার ব্যাখ্যা তখনই জেনে নেবে সে অর্কর কাছে।

অনিমেষ পরমহংসকে ডাকল, তুই এখনই যাস না, একটু বস।

মাধবীলতা পরমহংসর দিকে তাকিয়ে বলল, আর বসে কি হবে! তোমার সন্ধ্যেটা আমি নষ্ট করলাম, কিছু মনে করো না। এরকম একটা অবস্থা হবে জানলে নিশ্চয়ই ডেকে আনতাম না। বেশ হিন্দী ছবি দেখতে আরাম করে, রাত্রে ঘুম হতো।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, হিন্দী ছবি দেখিস নাকি?

পরমহংস খানিকটা বিব্রত ভঙ্গীতে বলল, ছেড়ে দে ও কথা। কি বলছিলি বল! তারপর ঘুরে মাধবীলতাকে বলল, তোমরা কি রোজ এরকম ঝগড়া কর?

ঝগড়া? ও মা, কোন দুঃখে ঝগড়া করতে যাব? মাধবীলতা যেন কষ্ট করে হাসল।

পরমহংস কাঁধ নাচিয়ে ফিরে এসে খাটে বসল, এই জন্যেই শালা বিয়ে করলাম না।

কি জন্যে? তোমরা তোমাদের খেয়াল-খুশিমত যা হুকুম করবে মেয়েদের তা মেনে নিতে হবে? তোমাদের নিজস্ব পছন্দ যদি অন্যায়ও হয় তাহলে তার প্রতিবাদ যে মেয়ে করবে সে-ই খারাপ হয়ে যাবে? তোমরা কম্যুনিজমের কথা বল, অফিসে গিয়ে বিপ্লবের বুলি আওড়াও অথচ বাড়িতে ফিরে এসে তোমরা এক একজন হিটলার কিংবা মুসোলিনীর চেয়ে কম ডিক্টেটর হও না। মেয়েদের পান থেকে চুন খসলেই তারা তোমাদের কাছে ঝগড়াটে হয়ে যায়! মাধবীলতার গলার স্বর চাপা কিন্তু তার ঝাঁঝ অত্যন্ত কড়া। পরমহংস সঙ্গে সঙ্গে হাত জোড় করল, ক্ষমা চাইছি, ওরে বাবা, এইসব ভেবে বলিনি আমি। ওর গলার স্বরে ঠাট্টা ছিল এবং তারই জের টেনে বলল, তোমরা নিজেদের খুব ছোট ভাব। অথচ দ্যাখো, তোমাদের আমরা কত উঁচু আসনে বসিয়েছি। জগৎ-জননী তো মেয়েদের বলা হয়। এমনকি কালীর পায়ের তলায় শিব।

মাধবীলতা এবার হেসে ফেলল, ওটাও তো বিরাট ভাঁওতা। তোমরা জানো মেয়েরা খেপে গেলে সর্বনাশ হবে। আর তাদের পায়ের তলায় পড়লে আর যাই হোক লজ্জিত না হয়ে পারবে না তাই সেই সুযোগটা নাও। নিয়ে আবার বিক্রম দেখাও। বলতে বলতে হঠাৎ তার মনে হল অর্ক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এইসব কথা গিলছে। সে ঝাঁঝিয়ে বলল, অ্যাই, তুই হাঁ করে কি শুনছিস?

অনিমেষ বলল, অর্ক, তুই দাঁড়া। হ্যাঁ পরমহংস, আমরা যদি কাল জলপাইগুড়িতে যাই তাহলে তুই সাহায্য করতে পারবি?

হাঁ হয়ে গেল পরমহংস, জলপাইগুড়িতে যাবি?

মাথা নাড়ল অনিমেষ, মুখে কিছু বলল না। কথাটা শুনে অর্কও চমকে গেল। হঠাৎ যে বাবা মত পাল্টে জলপাইগুড়ি যাওয়ার কথা বলবে তা সে কল্পনাও করেনি। শুধু মাধবীলতার কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সে একই ভঙ্গীতে বসে রইল।

পরমহংস বলল, কিন্তু আগামীকালের রিজার্ভেশন পাওয়া খুব মুশকিল হবে। আমি যেবার দার্জিলিং গিয়েছিলাম সেবার মাসখানেক আগেই টিকিট কেটেছিলাম। শুনেছি ব্ল্যাকে টিকিট পাওয়া যায়!

না, ব্ল্যাকে টিকিট কিনব না। রিজার্ভেশন ছাড়া যাওয়া যায় না?

অসম্ভব। বাসে যাওয়া যায়। রকেট বাস। ওভারনাইট জার্নি। কিন্তু তোর পক্ষে সারারাত বসে থাকা কি সম্ভব হবে?

এবার মাধবীলতা কথা বলল। যেন এতক্ষণ যেমন কথাবার্তা এই ঘরে হয়েছে তা তার কানেই ঢোকেনি কিংবা সে নিজেও কোন কথা বলেনি এমন ভঙ্গীতে সহজ গলায় পরমহংসকে বলল, বাসে ওর পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।

পরমহংস বলল, ঠিক আছে আমি দেখছি। টিকিট যদি পাই তাহলে কাল বিকেল চারটে নাগাদ চলে আসব।

ট্রেন কটায়? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

সন্ধ্যেবেলায়। সঠিক সময় জেনে আসব। তোরা রেডি থাকিস।

শোন। তুই চারটে টিকিট কাটিস।

চারটে? কেন?

তুই সঙ্গে যাবি।

অসম্ভব। তোর মাথা খারাপ হয়েছে? বলা নেই কওয়া নেই যাবি বললেই হল? এমন কথা বলছিস যার কোন মানে হয় না।

আমরাও তো বলে কয়ে যাচ্ছি না!

তোদের কথা আলাদা। তোদের বাড়িতে বিপদ, বিপদের সময় মানুষের কোন যুক্তি কাজ করে। আর আমার অফিসে ছুটি পাওয়ার সমস্যা আছে।

ছুটি যদি ম্যানেজ করতে পারিস?

পরমহংস খানিকটা অসহায় ভঙ্গিতে মাধবীলতাকে বলল, দ্যাখো তো, এরকম করে বলার কোন অর্থ হয়? কত বছর তোমরা ওখানে যাওনি, সেখানকার কি অবস্থা তোমরা জানো না, আমাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার কোন মানে হয়?

মাধবীলতা বলল, আমি কিছু বলব না। নিজেদের স্বার্থের জন্যে তোমাকে টেনে নিয়ে যেতে আমার খারাপ লাগবে। তাছাড়া ওখানকার কাউকে আমি চিনি না।

অর্ক বলল, পরমহংসকাকু, আপনি গেলে বাবার সুবিধে হত।

সুবিধে হত? মানে?

আমার একার পক্ষে ওঁকে ওঠানো নামানো।

ও। সে অন্য প্যাসেঞ্জারদের বললে নিশ্চয়ই সাহায্য করবে। আগে টিকিট পাই কিনা তাই দেখি। আমার এক বন্ধু আছে ইস্টার্ন রেলের পি আর ও অফিসে কাজ করে। তাকে ধরলে যদি ভি আই পি কোটায় টিকিট বের করে দিতে পারে, দেখি। পরমহংস উঠল।

মাধবীলতা বলল, দাঁড়াও।

পরমহংস বোধহয় চিন্তায় ছিল। অন্যমনস্ক হয়ে তাকাল। মাধবীলতা খাটের তলায় হাত ঢুকিয়ে একটা সুটকেস টেনে বের করে টাকা গুনল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এখানে বেশী নেই, বাকিটা কাল তোমাকে দেব।

পরমহংস হাত বাড়িয়ে টাকাগুলো নিল। তারপর অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বলল, তোর শেষপর্যন্ত সুমতি হয়েছে দেখে ভাল লাগল। কাল চারটে নাগাদ আসব। রেডি থাকিস।

মাধবীলতা দরজা অবধি এগিয়ে দিয়ে বলল, টিকিট না পেলেও খবর দিও। তৈরি হয়ে থেকে না যাওয়া হলে ভাল লাগে না। সে ইশারা করতেই অর্ক পরমহংসর সঙ্গী হল।

গলিটা কোনরকমে পেরিয়ে এসে পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার বল তো অর্ক? তোমার মা—

অর্ক বলল, এর আগে মায়ের হাতে টাকা ছিল না। সেইসময় বাবা মাকে টাকা দিয়ে বলেছিল আপনার কাছ থেকে নিয়েছে। মা তাই জানে।

আচ্ছা! লুকোচুরির কি দরকার ছিল?

আসলে বাবার হাতে তো টাকা থাকার কথা নয়, তাই।

টাকা ও কোত্থেকে পেল?

আমি দিয়েছিলাম।

তুমি?

হ্যাঁ। আমি একটা কাজ করে টাকা পেয়েছিলাম। মা জানে না।

কি কাজ?

এক ভদ্রলোককে বাঁচিয়েছিলাম। উনি কৃতজ্ঞ হয়ে দিয়েছিলেন।

সেকি! না না, এভাবে টাকা নেওয়া তোমার উচিত হয়নি।

জানি। আমরা ঠিক করেছি টাকাটা তাঁকে ফিরিয়ে দেব।

গুড। পরমহংস এবার হালকা হল।

.

দরজা থেকে ঘুরে দাঁড়াতেই মাধবীলতা দেখল অনিমেষ তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই অনিমেষ বলল, তুমি কিছু বললে না?

কি বলব?

লতা এদিক এসো।

কেন?

এসো না। অনিমেষের গলায় আবেদন।

মাধবীলতা একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে খাটের পাশে এসে দাঁড়াতে অনিমেষ খপ করে তার হাত ধবল, তুমি আমার ওপর রাগ করেছ?

কি করছ? ছাড়ো, কেউ এসে পড়তে পারে। মাধবীলতা মৃদু আপত্তি জানাল। অনিমেষ বলল, আগে উত্তর দাও।

কি বলব বল।

অনিমেষ ম্লান হেসে বলল, তুমি আমাকে একটুও বোঝ না!

বুঝি না?

না। আমি কেন যেতে চাইছিলাম না তুমি জানো? আমি পঙ্গু, ওদের কিছুই করতে পারব না এ তো সত্যি কিন্তু আর একটা কথা মনে হল। ওরা যদি তোমাকে সসম্মানে না নেয়, যদি তোমাকে অবহেলা করে আমি সহ্য করতে পারব না। অনিমেষ হাত ছেড়ে দিল।

মাধবীলতা হেসে বলল, পাগল!

অনিমেষ অবাক হল, মানে?

আর একটু কাছে এসে মাধবীলতা এক মুহূর্ত অনিমেষের কপালে হাত রেখে দাঁড়াল। তারপর অদ্ভুত গলায় বলল, কপালে যাই থাক না কেন মেয়েদের একবার শ্বশুরবাড়িতে যাওয়া উচিত। ওখানে না গেলে নিজেকে বউ বলে–। কথাটা বলতে বলতে থেমে গেল মাধবীলতা। তারপর মুখ নামিয়ে বলল, এসব মেয়েলি ব্যাপার, তুমি বুঝবে না।

২৭. ছুটির দরখাস্ত লিখতে গিয়ে

ছুটির দরখাস্ত লিখতে গিয়ে মাধবীলতা দ্বিধায় পড়ল। দিন পনের ছুটি চাইতে গেলে সঠিক কারণ দেখাতে হবে। জলপাইগুড়িতে যাচ্ছে, শ্বশুর খুব অসুস্থ, এইটুকু লিখতে যে জড়তা ছিল তা মাধবীলতা ঝেড়ে ফেলতে পারল শেষ পর্যন্ত। জড়তা আসার কারণ এতকাল যাদের সঙ্গে কাজ করছে তারা জানে সে বাপের বাড়ি এবং শ্বশুরবাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন। দু’একজন আরো বেশী জানে, অনিমেষের সঙ্গে তার পরিবারের কোন যোগাযোগ নেই এবং মাধবীলতা একাই সব দায় বহন করছে। আজ এতদিন বাদে বউ শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে এটা সহকর্মীদের কাছে আলোচনার ব্যাপার হবে। এবং হলও তাই। দরখাস্ত দেওয়ার মিনিট পনের পরেই সৌদামিনী সেনগুপ্তা ডেকে পাঠালেন। ঘরে ঢোকামাত্র চোখ তুললেন, কি হল? মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল মাধবীলতা। দরখাস্ত না ভূত দেখছেন বোঝা যাচ্ছে না। সে বলল, আমাকে ছুটি দিতে হবে।

তা তো বুঝলাম। কিন্তু তুমি শেষ পর্যন্ত সারেণ্ডার করলে, বিস্ময় স্পষ্ট প্রধান শিক্ষিকার গলায়। মাধবীলতার মানে হল কণ্ঠস্বরে কিছুটা আফসোসও আছে।

সারেণ্ডার কেন বলছেন? ওঁর যাওয়ার খুব প্রয়োজন, তাই—

কি হয়েছে?

ব্যাগ থেকে টেলিগ্রামটা বের করে দিল সে। সৌদামিনী পড়লেন। তারপর নিজের মনেই বললেন, মৃত্যু মানুষকে দুর্বল করে দেয়! কিন্তু তুমি যদি অ্যাকসেপ্টেড না হও, ধরো ওরা যদি জোর করে তাদের পঙ্গু ছেলেকে আটকে রেখে দেয়? তাহলে তুমি কি করবে?

মাধবীলতা বলল, এসব কিছু হবে না।

কিন্তু কিছুক্ষণ বাদেই টিচার্সরুমে ঢুকে নীপা চেঁচিয়ে উঠল সবার সামনে, এই, তুমি খবরটা চেপে গিয়েছিলে? শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছ?

সঙ্গে সঙ্গে সবকটা মুখ তার দিকে ফিরতেই সে লজ্জা পেল। এই লজ্জা কেন আসে তা বোঝা মুশকিল কিন্তু মেয়ে হয়ে জন্মালে এই লজ্জাটুকুই খুব আনন্দের হয়। তবু মুখ গম্ভীর করল মাধবীলতা, আর নাটক করো না। যোল বছরের ছেলেকে নিয়ে আমি যেন নতুন বউ যাচ্ছি, কি যে বলল! ওঁর বাবা খুব অসুস্থ, দেখতে চেয়েছেন, না গিয়ে উপায় নেই।

নীপা পাশে বসে বলল, যাক মরণকালে চৈতন্য হয়েছে তাহলে!

মাধবীলতা সঙ্গে সঙ্গে মুখ খুলল, ছি! এভাবে বলো না।

নীপার কথাটা ভাল লাগল না, বাজে কথা বলো না। এত বছর ধরে ছেলে, ছেলের বউ,নাতির খবর রাখল না, আজ বিপদের সময়, আমি হলে যেতাম না।

সুপ্রিয়া বললেন, নীপা, তোমার তো বিয়ে হয়নি, তুমি বুঝবে না।

আর যাই হোক, সবাই তার দিকে নতুন চোখে এই যে তাকিয়ে আছে সেটা স্বস্তি দিচ্ছিল না ওকে। টিচার্সরুম ছেড়ে সে সোজা অফিসে চলে এল। আজ স্কুলে এসেই দরখাস্ত করেছিল টাকার জন্যে। হাত একদম খালি, নতুন জায়গায় যাচ্ছে, সেখানে অসুস্থ লোক, কিরকম খরচ হবে তা কে জানে।

যা চেয়েছিল তা পাওয়া গেল না স্কুল থেকে। ফলে সুপ্রিয়া করের কাছ থেকে আবার ধার করতে হল। এখন তিনজনের যাওয়া আসায় চারশ বেরিয়ে যাবে। আর পরমহংস যদি যায় তাহলে ওর ভাড়াটাও দেওয়া উচিত। দেড় হাজার টাকা ব্যাগে নিয়ে যখন মাধবীলতা বাড়িতে ফিরল তখন বেলা একটা। টাকাটার জন্যে সুপ্রিয়ার বাড়িতে যেতে হয়েছিল তাকে। এসে দেখল অর্ক স্কুলে গিয়েছে, অনিমেষ চিৎ হয়ে শুয়ে কি ভাবছে। স্টোভের পাশে ভাত তরকারি নামানো। ঘর অগোছানো। অনিমেষ মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, এত দেরি হল?

মাধবীলতা বলল, হয়ে গেল। সে দেখল কোনরকম গোছগাছ হয়নি। যাওয়ার কোন প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে না। সে ব্যাগটা টেবিলে রেখে চেয়ারে শরীর ছেড়ে দিয়ে আঁচলে মুখ মুছল। তারপর স্পষ্ট গলায় জিজ্ঞাসা করল, তোমার কি ইচ্ছে?

কিসের? অনিমেষ চোখ বন্ধ করল।

সকালে বের হবার আগে বলে গেলাম শুনতে পাওনি!

ও। আরে দ্যাখো পরমহংস টিকিট পায় কিনা। অত সোজা নয়, গেলেই যেন রিজার্ভেশন পাওয়া যাবে। কাগজে অত লেখালেখি হচ্ছে দ্যাখোনি!

যদি পায়?

আগে পাক! তাছাড়া এভাবে ভিখিরির মত যাওয়ার কোন মানে হয় না।

তোমার বাবা যেতে বলেছেন!

বলেছেন কিন্তু কাল থেকে তোমাকে বোঝাতে পারছি না আমি গিয়ে কি করব। কোনরকম আর্থিক কায়িক সাহায্য করার ক্ষমতা আমার নেই। আমার মুখ দেখলেই ওঁর সব অসুখ সেরে যাবে? ভেবেচিন্তে কথা বল।

পরিশ্রম আমি করতে পারি, অর্ক পারে। আর টাকার জন্যে চিন্তা না করলেই হবে। হাজার খানেক টাকা ওখানে খরচ করতে পারব।

অনিমেষ চোখ খুলল, তুমি আবার ধার করলে?

মাধবীলতা উত্তর দিল না। চেয়ার ছেড়ে উঠে আলনার দিকে এগিয়ে গেল। এই সময় অনিমেষ অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল, খুব অন্যায় করেছ। আজ বাদে কাল তোমাকে নতুন বাড়ির টাকা দিতে হবে সে খেয়াল আছে?

নতুন বাড়িতে যাওয়ার চেয়ে এইটে বেশী জরুরী।

আশ্চর্য! তুমি বাড়িটা ছেড়ে দেবে?

পেরে না উঠলে ছেড়ে দিতে হবে।

অনিমেষ কিছুক্ষণ মাধবীলতার পিঠের দিকে তাকিয়ে বলল, নিজের সর্বনাশ করে অন্যের উপকার করতে যাওয়ার কোন যুক্তি নেই।

এবার মাধবীলতা ঘুরে দাঁড়াল। এইসব কথা যে তাকে আলোড়িত করছে তা তার মুখের অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট। ভাঙ্গা গলায় সে বলল, আমাকে তোমার খুব হাংলা মনে হচ্ছে, না?

এই সময় দরজায় ছায়া পড়ল। প্রশ্নটা করেই মাধবীলতা দেখল অর্ক দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে সংবরণ করতে যেটুকু সময় লাগল তাতেই মাধবীলতার মনে হল এর চেয়ে মরে যাওয়া ভাল ছিল। যে মুখভঙ্গীতে সে কথাগুলো উচ্চারণ করেছে তা কি ছেলের চোখে পড়েছে, মাধবীলতা নিশ্চিত ছিল না। কিন্তু তৎক্ষণাৎই সে বলতে পারল, কিরে, এত তাড়াতাড়ি চলে এলি?

বা রে। যদি যেতে হয় গোছগাছ করতে হবে না? অর্ক বইপত্র টেবিলে রেখে অনিমেষকে জিজ্ঞাসা করল, একি, তোমার এখনও স্নান হয়নি?

আমার আজ স্নান করতে ইচ্ছে করছে না। শরীরটা ঠিক নেই। অনিমেষ উঠে বসল, তাছাড়া যাব যাব করে নাচলেই হয়ে যাবে? তোমার স্কুল নেই? এক বছর নষ্ট হয়েছে তবু খেয়াল হচ্ছে না?

অর্কর কপালে ভাঁজ পড়ল। সে মাধবীলতার দিকে একবার তাকিয়ে আবার অনিমেষকে দেখল, আমার জন্যে চিন্তা করতে হবে না।

মানে? আঁতকে উঠল যেন অনিমেষ।

আমি আর স্কুল করব না।

স্কুলে পড়বে না? কি অশ্বডিম্ব করবে?

এক্সটারনাল ক্যাণ্ডিডেট হিসেবে ফাইন্যাল দেব সামনের বছরেই। আমার যদি এক বছর নষ্ট না হত তাহলে ওই সময়েই পাশ করতাম।

অনিমেষের যেন চিন্তাভাবনা এসব ঢুকছিল না। এই সময় মাধবীলতা বলল, যা স্নান করে আয়।

অর্ক বলল, মা; তোমরা যাবে না?

তোর বাবার ইচ্ছে নয়।

বাবা তো কোথাও যেতে চায় না। কিন্তু নিজের বাবা মরে যাচ্ছে আর তা শুনে দেখতে যাবে না, আশ্চর্য! অর্ক নিচু গলায় বললেও কথাগুলো অনিমেষের কানে সরাসরি চলে এল। সে চিৎকার করে উঠল, তুমি ছেলেটাকে তাতাচ্ছ কেন? আমি যাব না স্পষ্ট করে বলেছি?

আমি তাতাচ্ছি! মাধবীলতা যেন জমে গেল।

বাঃ, বাবার ইচ্ছে নয় বলার কি দরকার? আমি তোমাকে নেগেটিভ দিকটা দেখাচ্ছিলাম। এতে ভবিষ্যতে সুবিধে হয়! তুমি চট করে কথাটাকে।

আমি তোমাকে বলেছি যে তুমি যা চাও তাই হবে।

আমি কি চাইব? অনিমেষ মুখ তুলে দরজার বাইরে তাকাল, আমার কিছু চাওয়ার নেই।

তারপর খুব দ্রুত স্নান খাওয়া সারা হয়ে গেল। ঘরের বাইরে গিয়ে এক বালতি জলে মাথা ধুয়ে নিল অনিমেষ। তারপর খাওয়া শেষ করে খাটের ওপর উবু হয়ে বসে দেখল ছেলেতে মিলে গোছগাছ করছে। একটা সুটকেসে সব ধরে গেল কিন্তু এতদিন অব্যবহারে ডালাটা ঠিক বসছে না। অর্ক অনেক কসরৎ করেও ওটাকে বাগ মানাতে পারছিল না। শেষে বলল, এসব আর চলে না।

মাধবীলতা বলল, একটা নতুন সুটকেসের দাম কত জানিস?

অর্ক মুখ তুলে বলল, আমরা ওখানে কদ্দিন থাকব?

জানি না। তবে বেশীদিন তো থাকা যাবে না।

বিছানাপত্র নেবে না?

ছেলের প্রশ্নটা শুনে মাধবীলতা হতভম্বের মত খাটের দিকে তাকাল। ওইসব নিয়ে রাস্তাঘাটে বের হওয়া যায় না। জলপাইগুড়ির বাড়িতে তাদের জন্যে বিছানাপত্র পাওয়া যাবে কিনা তাও সে জানে না। অনিমেষকে জিজ্ঞাসা করেও তো কোন লাভ নেই। সে মাথা নাড়ল, নাঃ। যদি দরকার হয় ওখান থেকে কিনে নেব। বড় শহর, সব পাওয়া যায়, আগে থেকে বয়ে নিয়ে গিয়ে কি হবে।

গায়ের জোরে শেষ পর্যন্ত সুটকেসটা বশ মানল। একটা সুটকেস আর একটা হাতব্যাগ। চারটে বাজতে যেন খুব দেরি হচ্ছে আজ। এই ঘরে তালা দিয়ে যেতে হবে। দামী জিনিসপত্র বলতে কিছুই নেই তবু যা আছে ফিরে আসার পর তা পাওয়া দরকার। মাধবীলতা বলল, ন্যাড়ার বাবাকে একটু বলবি? আমরা যখন থাকব না তখন যেন এদিকটা দ্যাখে।

দূর! ওকে বলে কি হবে। অর্ক মাথা নাড়ল, দাঁড়াও দেখছি। অর্ক মাঝে মাঝেই অনিমেষকে দেখছিল। বাবা যে কোন কথা বলছে না এটা লক্ষ্য করছিল। সে বুঝতে পারছিল জলপাইগুড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে বাবার নেই; মায়ের আছে। তারও এতদিন কোন ইচ্ছে হত না, হঠাৎ এখন হচ্ছে। কেন হচ্ছে সে জানে না।

বাইরে বেরিয়ে এসে ও চারপাশে তাকাল। গলির মুখে মোক্ষবুড়ি বসে আছে। আজকাল কোন সাড়াশব্দ করে না। শরীরটা আরও শুকিয়ে শুধু হাড়ের গায়ে চামড়া আটকে আছে। সেই চিৎকার করা গালাগাল এই গলিতে আর ভাসে না। অর্ক দেখল ন্যাড়া আসছে। খুব কায়দা দেখানো শার্ট পরেছে। এরকম মূল্যবান শার্ট ও কোত্থেকে পেল কে জানে!

অর্ক বলল, এই ন্যাড়া, শোন! ন্যাড়া যেন বিরক্ত হল। কাঁধ নাচিয়ে বলল, ঝটপট বল, টাইম নেই। অর্কর মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল। ওইটুকুনি পুঁচকে কথা বলছে ঠিক কোয়ার ভঙ্গীতে। ওর সঙ্গে ঝামেলা করে লাভ নেই। সে নিজেকে ঠাণ্ডা করে বলল, আমরা সাতদিন এখানে থাকব না। ঘরটাকে দেখিস।

থাকবে না? কোথায় যাবে?

আমাদের দেশে। কথাটা বলার সময় বেশ আরাম লাগল অর্কের।

যা বাবা। তোমারও দেশ আছে? চাবি দাও।

কিসের চাবি?

ঘরের।

চাবি নিয়ে কি করবি?

ওখানেই তাস খেলব তাহলে আর কোন ভয় নেই।

দেখার হলে দূর থেকে দেখিস। আমি এসে যদি দেখি গোলমাল হয়েছে তাহলে কেস খুব খারাপ হয়ে যাবে। ফোট। অর্ক হাত নাড়ল। এবং তখনই দূরে পরমহংসকে দেখতে পেল। খুব হন্তদন্ত হয়ে আসছে। ন্যাড়া অর্কর হাত নাড়ার সময় সরে গিয়েছিল এবার চিৎকার করে বলল, দেখতে বলছ দেখব কিন্তু আমি কোন জিম্মা নিচ্ছি না।

পরমহংস ততক্ষণে এসে গেছে কাছে। বলল, এখানে দাঁড়িয়ে?

এমনি। টিকিট পেয়েছেন?

মাথা নাড়ল পরমহংস, চল, ঘরে চল বলছি। মা আছে?

হ্যাঁ।

পরমহংস খুব তাড়াহুড়ো করে হেঁটে চলল আগে আগে। খাটো এবং মোটা শরীর ধুতি এবং পাঞ্জাবিতে এই ছুটে যাওয়া মানাচ্ছিল না। ন্যাড়ার পাশ দিয়ে পরমহংস চলে যাওয়ার পর সে চোখ নাচাল অর্কর দিকে তাকিয়ে। অর্ক উত্তর দিল না কিন্তু বুঝতে পারল এবার ন্যাড়ারা পরমহংসের পেছনে লাগবে। মা মারা যাওয়ার পর খুব দ্রুত ছেলেটা যেন মিনি-মাস্তান হয়ে উঠেছে। সে গম্ভীর গলায় ন্যাড়াকে বলল, আমার কাকা, ফালতু ঝামেলা করবি না।

পরমহংসকে দেখে মাধবীলতা উদ্বেগ নিয়ে বলল, টিকিট পাওয়া যায়নি? পরমহংস অনিমেষের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল, মাইরি, জব্বর একখানা বউ যোগাড় করেছিস। নিজের ধান্দা ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না। আমি শালা এত খেটেখুটে এলাম, কোথায় বসতে বলবে চা খাওয়াবে তা নয়। কথা বলবার সময় পরমহংস যে মুখভঙ্গী করছিল তাতে নিশ্চিন্ত হল মাধবীলতা। বলল, চায়ের জল বসিয়েছি। ট্রেন ক’টায়?

সাতটা। শিয়ালদায়। পরমহংস চেয়ারে পা ঝুলিয়ে বলল, তোমাদের জিনিসপত্র গোছানো হয়ে গিয়েছে?

পরমহংস পকেট থেকে তিনটে টিকিট বের করল, করে অনিমেষের হাতে দিল, ভি আই পি কোটা থেকে বার করিয়ে এনেছি। নিউ জলপাইগুড়ি পর্যন্ত কাটা আছে। ওখান থেকে ট্রেন পেলে এক্সটেণ্ড করে নিস।

অনিমেষ বলল, ট্রেনেই যেতে হবে। কিন্তু ওভারব্রিজ পেরোতে হলে হয়ে গেল। কি যে করব বুঝতে পারছি না। তুই যাবি না?

তিনটের বেশী পাওয়া গেল না। বলেই মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে হাত তুলল, অনেস্টলি বলছি। তাছাড়া না পেয়ে ভালই হয়েছে। অফিসে ছুটির ঝামেলা ছিল। হাতেও বেশী পয়সাকড়ি নেই। মাইনে পেলে না হয় একটা কথা ছিল।

অর্ক এর মধ্যে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল, বলল, আপনি ইচ্ছে করলে যেতে পারতেন। আমি নাহয় রিজার্ভেশন ছাড়াই যেতাম। ও পরমহংস মাথা নাড়ল, না রে। অনেক সময় ইচ্ছে থাকলেও যাওয়া যায় না। তোমরা একজন অসুস্থ মানুষের কাছে যাচ্ছ। ওখানে গিয়ে তোমাদের কাজকর্ম শেষ হলে আমাকে জানিও তখন না হয় ঘুরে আসা যাবে।

মাধবীলতা বুঝল পরমহংস ঠিকই বলছে। ইচ্ছে থাকলেও এই সময়ে যাওয়াটা যে শোভন নয় তা পরমহংস বুঝেছে। অনিমেষকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সুবিধে হবে বলেই সে এতক্ষণ জোর করছিল।

ঠিক হল পরমহংস বাড়িওয়ালাকে বলেকয়ে ওরা না ফেরা পর্যন্ত সামলে রাখবে, যদি হাতছাড়া হবার উপক্রম হয় তাহলেই অ্যাডভান্স ভাড়া দিয়ে দেবে। তিনটে টিকিটের দাম দিয়ে দিল সে পরমহংসকে। মাধবীলতা পাশের ঘরগুলোর মানুষকে কদিন দেখাশোনার জন্যে বলতে বেরিয়ে গেলে পরমহংস অনিমেষকে জিজ্ঞাসা করল, তুই মুখ গোমড়া করে আছিস কেন?

ভাল লাগছে না। অনিমেষ মাথা নাড়ল, এভাবে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।

পরিস্থিতির সঙ্গে মানাতে হয় রে।

বুঝলাম। কিছু রাজত্বের লোভে বেরিয়ে এসেছিলাম এখন ভিখিরির মত ফিরতে কারো ইচ্ছে হয়?

থাক! একমাত্র তুই ওখানকার সব জানিস, তোর ভরসায় এরা যাচ্ছে, তাই তোর শক্ত হওয়া উচিত। এত ভাবপ্রবণ হবার কোন মানে হয় না। আর হ্যাঁ, আমার কাছে শপাঁচেক টাকা আছে। দরকার হলে নিতে পারিস। পরমহংস পকেটে হাত দিল। অনিমেষ চিন্তা করল একটু, তারপর মাথা নেড়ে বলল, দরকার নেই।

পরমহংস বলল, সঙ্কোচ করিস না। দ্যাখ।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, আর বোঝা বাড়িয়ে কি হবে। ও যা নিয়েছে তাতেই হয়ে যাবে। এ পরমহংস আর জোর করল না। তারপর পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে অর্ককে দিল, এটা রেখে দিও সঙ্গে। যদি প্রয়োজন মনে করো তাহলে আমায় লিখো। অর্ক দেখল সাদা কাগজটায় পরমহংস আগে থেকেই নিজের ঠিকানা লিখে এনেছে।

পৌনে ছ’টা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্রাম রাস্তার কাছে আসতেই অর্ক কোয়াকে দেখতে পেল। সে এসেছিল ট্যাক্সির খোঁজে। কলকাতা থেকে প্রথমবার সে বাইরে যাবে,আ বে অক্ক! তোর সঙ্গে কথা আছে।

অর্ক মুখ ফেরাল। এই বিকেলেই কোয়া রঙিন হয়ে আছে। এরই মধ্যে কোয়ার যে অবস্থা পাল্টেছে তা ওর পোশার্ক দেখলেই বোঝা যায়। তার মানে খুরকি-কিলা ভোগে যাওয়ার পর কোয়া এখন রাজত্ব করছে। সে হাত নাড়ল, এখন আমার সময় নেই।

সময় নেই? কোয়া যেন হতবুদ্ধি হয়ে গেল। অর্ক ততক্ষণে ট্যাক্সির দর্শন পেয়েছে। বেলগাছিয়া থেকে বেরিয়ে সেটা একটা চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্ক ছুটল। শিয়ালদার নাম শুনে ট্যাক্সিওয়ালা মাথা নাড়ল, না দাদা, ওদিকে যাব না। হেভি জ্যাম।

কিন্তু আমাদের স্টেশনে যেতে হবে। আমার বাবা ইনভ্যালিড, ট্যাক্সি ছাড়া যাব কি করে? চলুন না। অর্ক প্রায় অনুনয় করল।

না মশাই, অন্য ট্যাক্সি দেখুন।

ঠিক সেই সময় চিৎকারটা ভেসে এল। কোয়া উন্মত্তের মত চিৎকার করতে করতে এগিয়ে আসছে! কি! আমাকে ধক! বল শালা খানকির বাচ্চা তুই আমাকে গুরু বলবি কিনা?

সঙ্গে সঙ্গে অর্কর সমস্ত শরীরে আগুন জ্বলে উঠল। রাস্তার লোকজন এখন হাঁ করে কোয়াকে দেখছে। ট্যাক্সিওয়ালাও যেন ভয় পেয়ে গেল, যাঃ শালা! কি ঝামেলায় পড়া গেল! বলে ইঞ্জিন চালু করতে যেতেই অর্ক ওর কাঁধ চেপে ধরল। লোকটা থতমত হয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করতেই অর্ক ঘুরে দাঁড়াল। কোয়া আজ সামনে, সমানে খিস্তি করে যাচ্ছে। তার বক্তব্য, সে এখন ঈশ্বরপুকুরের এক নম্বর, সবাই তার বশ মেনেছে, বিলু হাওয়া হয়ে গেছে কিন্তু অর্ককে তার বশ্যতা স্বীকার করে সঙ্গে থাকতে হবে। এসব বলতে বলতে কোয়া হাত বাড়াল অর্কর কলারের দিকে। কিন্তু ওর শরীর টলছে। বোধ হয় মাথাও কাজ করছে না। অর্ক খুব ধীর মাথায় একটা ঘুষি মারল। কোয়ার বাঁ দিকের চোয়ালের নিচে। মারটা খাওয়া মাত্র কোয়ার কথা বন্ধ হয়ে গেল। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সে টলতে লাগল কয়েক সেকেণ্ড তারপর কাটা গাছের মত লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। অর্ক ঘুরে দাঁড়াল। রাস্তায় নোকজন যে হাঁ করে তাকিয়ে আছে তার দিকে তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে সে ট্যাক্সিওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করল, তাহলে যাবেন না?

বসুন। ড্রাইভার পেছনে ঝুঁকে দরজার লক খুলে দিতে অর্ক নিঃশব্দে উঠে বসল। তারপর বলল, ওই গলিতে চলুন। সঙ্গে জিনিসপত্র আছে।

ট্যাক্সিওয়ালা বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ না করে গাড়ি ঘোরাল। অর্ক একবারও পেছন ফিরে তাকাল। কোয়া নিশ্চয়ই তাকে ছাড়বে না। দেখা যাবে, ফিরে এসে দেখা যাবে। ওর শরীরে তখনও উত্তেজনা ছিল। এই প্রথম কেউ তাকে ওই বিশ্রী গালাগালটা দিল। কোয়া যদি না পড়ে যেত তাহলে সে একটাতেই থেমে যেত না। পড়ে যাওয়ামাত্র কেমন একটা ঘেন্না হল।

সুটকেস ব্যাগ ভোলা হলে অনিমেষকে নিয়ে পরমহংস বেরিয়ে এল বস্তি থেকে, পেছনে মাধবীলতা। পুরো বস্তিটাই এখন ভেঙ্গে পড়েছে ফুটপাথে। প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল অর্ক। তারা এখান থেকে চিরকালের মত উঠে যাচ্ছে না আবার ফিরে আসবে এটাই সবার চিন্তা। অনিমেষকে যখন ধরাধরি করে গাড়িতে তোলা হচ্ছে তখন একটা কান্না ছিটকে উঠল। জনতা অবাক হয়ে দেখল গলির মুখে পুঁটলির মত বসে থাকা মোক্ষবুড়ি কাঁদছে। একটা গোঙানি, টানা টানা। অর্ক দাঁড়িয়ে পড়ল। মোক্ষবুড়ি তো আজকাল কোন কথাই বলে না। তাদের সঙ্গে ওর কোন সম্পর্কই তৈরি হয়নি, তাহলে কাঁদছে কেন?

বস্তির দু-একজন মহিলা ঠাট্টা করল, ও দিদিমা কাঁদছ কেন?

বুড়ির গলা ভাঙ্গা এবং বসা। তবু বুঝতে অসুবিধে হল না কথাগুলো, চলে গেল, সবাই চলে গেল, আমি কবে যাব? তিনি।

তুমি আবার কোথায় যাবে? একজন হেসে উঠল।

বুড়ি সে কথায় কান দিল না, তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে না, অ মাস্টারনি, আমাকে এখন কে খেতে দেবে, দুপুরে আমি কার কাছে খাব। হায় ভগবান, এত খেয়েও কেন নোলা যায় না। শব্দগুলো বিকৃত হয়ে একটা সুরের মধ্যে ডুবে গেল।

অর্ক চট করে মুখ ঘুরিয়ে মাধবীলতার দিকে তাকাল। মা ওই বুড়িকে রোজ দুপুরে খেতে দিত? স্কুলের দিন হলে আলাদা কথা কিন্তু ছুটির দিনেও সে ব্যাপারটা টের পায়নি কখনো।

এখন বস্তির সমস্ত মানুষ খানিকটা বিস্ময়ে ট্যাক্সির দিকে তাকিয়ে আছে। অনিমেষ বসেছিল তার পাশে মাধবীলতাও উঠে পড়েছে। পরমহংস সামনের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে। প্রত্যেকেই যে এখন মাধবীলতাকে দেখছে সেটা স্পষ্ট। মাধবীলতার চেহারাটা যেন সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছিল। সে চট করে হাতের ব্যাগটা খুলে একটা দশ টাকার নোট বের করে অর্ককে ডাকল, এটা ওকে দিয়েই চলে আয়। আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

অর্ক আদেশ পালন করল। ভিড়টা দুপাশে সরে গেল। অর্ক মোক্ষবুড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, এই নাও, মা দিল।

মোক্ষবুড়ি কেঁদেই যাচ্ছে এবং অর্কর কথা তার কানে ঢুকল না। অর্ক অস্বস্তি নিয়ে চারপাশে তাকাল। তারপর ঝুঁকে মোক্ষবুড়ির হাতে টাকাটা গুঁজে দিয়ে সটান ফিরে এল। ওদের গাড়ি যখন তিন নম্বর ছেড়ে যাচ্ছে তখনও গোঙানিটা ভেসে ছিল বাতাসে তারপর কানের পর্দায় আঠার মত সেঁটে গেল। পরমহংস বলল, লুকিয়ে দান করা হয় বুঝি!

মাধবীলতা কোন উত্তর দিল না। অনিমেষ বলল, আমিই জানতাম না।

মাধবীলতা এবার একটু নড়ে চড়ে বসল, থাক এসব কথা। একটা জিনিসের কথা আমি একদম ভুলে গিয়েছি। ট্রেনে খাবার পাওয়া যাবে? পরমহংস বলল, দার্জিলিং মেলে খাবার পাওয়া মুশকিল। বর্ধমান স্টেশন থেকে কিনে নিতে পারো। তবে সঙ্গে নিলে ভাল করতে।

গাড়ি ছাড়ার আগে যদি সময় পাওয়া যায়–। মাধবীলতা অর্কর দিকে তাকাল, তুই শিয়ালদা থেকে কিছু কিনে আনিস।

অর্কর হতভম্ব ভাবটা এখন কমেছিল। সে বলল, কি কিনব?

রাত্রে যা খাবি। শুকনো কিছু নিস। পাউরুটি মাখন আর মিষ্টি।

তোমার তো কাঁচা রুটি খেলে অম্বল হয়। অনিমেষ বলল।

পরমহংস হাত নাড়ল, ঠিক আছে, আমি দেখছি।

দেখছি মানে? মাধবীলতা প্রতিবাদ করল, তোমার টাকায় আমরা খাব না।

কাঁচুমাচু ভঙ্গী করল পরমহংস, আমি যে এতবড় নরাধম তা জানতাম না।

অনিমেষ আর মাধবীলতা হেসে উঠল। কিন্তু অর্ক তখনও চেয়ে ছিল মাধবীলতার দিকে। ওর হঠাৎ মনে হল, কোয়ারা বোধ হয় ওদের মাকে কখনও দ্যাখেনি।

.

অনিমেষকে তুলতে খুব অসুবিধে হল। প্লাটফর্ম থেকে গাড়ির মেঝেতে ওর নিজের পক্ষে কিছুতেই ওঠা সম্ভব নয়। গাড়ির দরজাটা এক মুহূর্তের জন্যে খালি পাওয়া যাচ্ছে না। যত লোক যাচ্ছে তার দ্বিগুণ লোক যেন তুলতে এসেছে। শেষ পর্যন্ত একটা কুলির সাহায্যে অনিমেষকে ওপরে তুলল অর্ক। থ্রিটিয়ারের পাশাপাশি তিনটে আসন ওদের দখলে। জানলার পাশে ক্রাচ দুটোকে রেখে অনিমেষ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, দ্যাখো তো কি ঝকমারি।

ঝকমারি ভাবলেই ঝকমারি নইলে কিছুই নয়। তোমরা বসো আমি এখনি ঘুরে আসছি। পরমহংস কথাটা বলে গাড়ি থেকে নেমে গেল। অর্কর বেশ মজা লাগছিল। চারধারে যাত্রীদের চিৎকার, কুলিদের হাঁকাহাঁকি। এই প্রথম সে ট্রেনে উঠল। জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখে সে বাইরে বেরিয়ে এল। প্লাটফর্মে এখন বেশ শোরগোল। মাইকে অবিরাম ঘোষণা চলছে। এই ট্রেন তাদের কলকাতা থেকে নিউ জলপাইগুড়িতে নিয়ে যাবে। একটু এগিয়ে গিয়ে সে কামরাটার মুখোমুখি দাঁড়াল। সামনে পত্রিকার স্টল, চায়ের দোকান। হঠাৎ তার নজর পড়ল জানলায়। অনিমেষ গালে। হাত দিয়ে বসে আছে। খানিক তফাতে মাধবীলতা চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে রয়েছে। মায়ের দিকে তাকিয়ে অর্কর বুকের ভেতরটা নড়ে উঠল। মাধবীলতার ভঙ্গী এমন যে খুব কষ্ট না পেলে মানুষ অমনভাবে চোখ বন্ধ করতে পারে না। অর্ক ঠিক বুঝতে পারছিল না মা ওইভাবে রয়েছে। কেন? সে দ্রুত জানলার কাছে চলে এসে ডাকল, মা!

মাধবীলতা প্রথমে শুনতে পায়নি। একটুও নড়ল না মুখ। অনিমেষ তার হাত ছুঁয়ে বলল, তোমাকে ডাকছে!

মাধবীলতা যেন চমকে উঠল। বলল, কি রে?

অর্ক তখনই আবিষ্কার করল সে কি বলবে তা জানে না। মাধবীলতা আবার জিজ্ঞাসা করল, কি?

খোলা চোখের কোলের দিকে তাকিয়ে অর্ক প্রচণ্ড ধাক্কা খেল। দু ফোঁটা শিশিরের কণা সেখানে জমে আছে। এবং এই জমে থাকার কথা মাধবীলতা নিজেই জানে না। অর্ক বুঝল তাকে কিছু বলতে হবে, এইমাত্র। সে একটা পানওয়ালাকে আসতে দেখে বলে ফেলল, পান খাবে?

পান? মাধবীলতার মুখে বিস্ময় স্পষ্ট।

অনিমেষ হেসে বলল, তোর মা কি পান খায়!

সঙ্গে সঙ্গে মাধবীলতা মাথা নাড়ল, না না খাব। ভাল করে একটা পান সাজতে বল তো। জর্দা দিয়ে।

অনিমেষ বলল, জর্দা?

মাধবীলতা হাসল, হ্যাঁ। একটু নেশা লোক না। বলতে বলতেই তার খেয়াল হল গালের ওপর দিয়ে কিছু গড়িয়ে পড়ছে। আর তখনই ট্রেনটা হুইসল দিয়ে উঠল।

২৮. ওই দ্যাখো পাহাড়

অনিমেষ বলল, ওই দ্যাখো পাহাড়। হিমালয়। বলে হাত তুলে মাধবীলতাকে সামান্য ঠেলল। মাঝের বাঙ্কে মাধবীলতা চোখ খুলে শুয়েছিল। একটু শীত শীত লাগছে, উপুড় হয়ে জানলার বাইরে ফ্যাকাশে আলো দেখতে পেল। আর তখনি ওপরের বাঙ্ক থেকে তড়াক করে লাফিয়ে নামল অর্ক। নেমে জিজ্ঞাসা করল, কোথায়?

মাঝের বাঙ্কটা টাঙানো থাকায় অনিমেষ নিচে কাত হয়ে শুয়েছিল। মাথাটা জানলার শিকে হেলানো, দৃষ্টি বাইরে। অর্কর প্রশ্নে চোখের ইশারা করল। অর্ক জানলায় ঝুঁকে এল! মাঠ, দূরের রাস্তা পেরিয়ে দিগন্তের ওপরে আকাশের গায়ে ঝাঁপসা রেখা, সেটা পাহাড় কিনা তা বুঝল না। বুঝল না কিন্তু রোমাঞ্চিত হল। এবং সেই আবেগে জিজ্ঞাসা করল, জলপাইগুড়ি কি পাহাড়ী শহর?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, না। তবে জলপাইগুড়ি জেলায় পাহাড় আছে। মাধবীলতা নেমে এল। অনিমেষ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, রাত্রে ঘুমাওনি?

মাথা নাড়ল মাধবীলতা, নাঃ, ঘুম এল না। কই, কোথায় পাহাড়, দেখি?

অর্ক বলল, একটু দাঁড়াও, এটাকে নামিয়ে দিই। বাবা, তুমি সরে এস খানিকটা, হ্যাঁ। শেকল খুলে দেওয়ার পর ওরা তিনজন আরাম করে পাশাপাশি বসল। ট্রেনটা তখন হু হু করে ছুটে যাচ্ছে! অদ্ভুত একটা হিম বাতাস বইছে পৃথিবীতে। যেন খুব আরামের নিঃশ্বাস শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। সকাল এখনও হয়নি। দূরের গাছের মাথাগুলোয় কালো ছোপ মাখানো। অনেক দূরের আকাশের গায়ে এখন পাহাড়ের অস্তিত্ব স্পষ্ট। ওরা তিনজনে খানিকক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে থাকল বাইরে। শেষ পর্যন্ত অনিমেষই কথা বলল, এই রকম দৃশ্য কতকাল দেখিনি! মাধবীলতা মাথাটা পেছনের কাঠে হেলিয়ে দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। ওর ঠোঁট সামান্য কাঁপল কিন্তু কোন কথা বলল না। অর্ক খুব নিচু গলায় বলল, আমি কোনদিন দেখিনি।

কথাটা শুনেই অনিমেষ চমকে তাকাল ছেলের দিকে। তারপর ম্লান হেসে বলল, দেখবি কি করে! কলকাতায় এসব দেখা যায় না। এবং এই সময় তার খেয়াল হল সে অর্কর চেয়ে ভাগ্যবান। পনেরো বছর অন্ধকূপে বাস করেছে বলে যে হতাশা আসছিল তা মুহূর্তেই সরে গেল। ওর মনে হল, জীবনে পাইনি পাইনি করেও কিছু পেয়েছে যা অর্ক এখনও পেল না। পরবর্তী জীবনে অর্ক যাই পাক না কেন সেই সোনার ছেলেবেলাটাকে কখনই পাবে না। এ ব্যাপারে সে অনেক ধনী।

কামরায় এতক্ষণ স্থিরঘুম ছিল, এবার শব্দ শোনা যেতে লাগল। সামনের তিনটি বাঙ্কে তিনজন। যাত্রীই ঘুমে কাদা। একটা অলস আবহাওয়া এখানে।

মাধবীলতা উঠল। ব্যাগ থেকে তোয়ালে আর পেস্ট বের করে অনিমেষের দিকে তাকাল, বাথরুমে যাবে না?

অনিমেষ বলল, থাক। রানিং ট্রেনে সুবিধে হবে না।

মাধবীলতা বলল, খোকা তোমাকে ধরুক। ওখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে কটা বাজবে জানি না ততক্ষণ বাসিমুখে বসে থাকবে?

অনিমেষ বলল, ঠিক আছে, তুমি ঘুরে এস আগে।

মাধবীলতা চলে গেলে অর্ক দেখার সুবিধের জন্যে অনিমেষের পাশে এসে বসল। অনিমেষ বলল, চেয়ে দ্যাখ, এদিকের গাছপালা মাঠের চেহারা একদম আলাদা। যত এগোবি তত প্রকৃতির চেহারা পাল্টাবে, মানুষেরও।

অর্ক চট করে কোন পার্থক্য বুঝতে পারছিল না। কিন্তু হঠাৎ সে দু’দিন ধরে ভাবা প্রশ্নটা এখন করে বসল, তুমি কেন আসতে চাইছিলে না বাবা?

অনিমেষ অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকাল, একটু ভাবল, তারপর বলল, তুই বুঝবি না।

তুমি বললে নিশ্চয়ই বুঝব। আমি ছোট নই।

অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, না। তুই যদি সত্যি বড় হয়ে থাকিস তাহলে ওখানে গিয়ে বুঝতে পারবি আমি কেন আসতে চাইছিলাম না। আমাকে কিছু বলতে হবে না। আমার বাবার সঙ্গে চিরদিনই দূরত্ব ছিল কিন্তু তাই বলে তাঁর অসুস্থতার খবর পেয়েও আসব না এমন অবস্থা নয়। তবু আমার দ্বিধা হচ্ছিল। কেন হচ্ছিল সেটা ওখানে গিয়ে তোকে বুঝে নিতে হবে।

অর্ক অনিমেষকে দেখল। তারপর নিচু স্বরে বলল, আমাদের সঙ্গে ওরা কেমন ব্যবহার করবে কে জানে। কোনদিন দ্যাখেনি তো।

অনিমেষ বলল, যাই করুক, তুই যেন কখনও খারাপ ব্যবহার করিস না। যা করতে বলবে তা বিনা প্রতিবাদে করবি। মনে রাখিস, মানুষ তার ব্যবহার দিয়েই মানুষকে আপন করে নেয়। আর একটা কথা, তোর ওই রকের ভাষা যেন ওখানকার কেউ শুনতে না পায়।

অর্ক প্রতিবাদ করল, কি আশ্চর্য। আমি কি তোমাদের সঙ্গে রকের ভাষায় কথা বলি? তোমার কি মনে হয় না আমি ঠিক আগের মত নই!

অনিমেষ মাথা নাড়ল কয়েকবার। সেটা অর্কর কথাকে মেনে নেওয়া বলেই মনে হল। তারপর বলল, কলকাতার পথেঘাটে যেসব কথা শুনতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি জলপাইগুড়িতে সেটা চূড়ান্ত অশ্লীল। ওই ভাষায় ওখানে কেউ কথা বলার কথা ভাবতেও পারে না। জানি না এর মধ্যে কোন পরিবর্তন হয়েছে কি না! তুই তো কখনও ওই পরিবেশে থাকিসনি তাই বললাম।

এই সময় সামনের সিটের ভদ্রলোক আড়মোড়া ভেঙ্গে বললেন, ডালখোলা চলে গেছে? অনিমেষ ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল।

সঙ্গে সঙ্গে লোকটা ‘আই বাপ’ বলে তড়াক করে উঠে বসতে গিয়ে মাথায় ধাক্কা খেলেন। ওপরের বাঙ্কার কথা খেয়াল ছিল না তাঁর। হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ভেরি ব্যাড সিস্টেম।

অর্ক আর কথা বলতে পারল না। কিন্তু ওর মনে একটা চিন্তার উদয় হল। সে চিরকাল বস্তিতে থেকে এসেছে বলে কি বাবা তার সম্পর্কে ভয় পাচ্ছে? তার আচার ব্যবহারে কি বস্তির ছাপ আছে? অদ্ভুত একটা জ্বালা এবং হতাশাবোধ এল। কিন্তু এই নিয়ে বাবার সঙ্গে তর্ক করার পরিবেশ যে এটা নয়। এই সময় মাধবীলতা ফিরে এল পরিষ্কার হয়ে, এসেই বলল, তাড়াতাড়ি যাও, এখনও সবাই ঘুম থেকে ওঠেনি। ভিড় হয়ে গেলে বিপদে পড়বে।

অনিমেষ ক্রাচ দুটো আঁকড়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। সমস্ত শরীর টলছে। দ্রুত ছুটে যাওয়া ট্রেনের কামরা তাকে ভারসাম্য রাখতে দিচ্ছে না। সে মাথা নাড়ল, না, আমি পারব না। মাধবীলতারও তাই মনে হয়েছিল। এমনি সমান মাটিতে ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটা এক জিনিস আর ছুটন্ত গাড়িতে আর এক জিনিস। একটু অভ্যেস না থাকলে হয় না। কিন্তু অর্ক ছাড়তে নারাজ। অনিমেষের যে পা একটু ওজন সইতে পারে সেদিকের ক্রাচ রেখে দিয়ে অর্ক বলল, তুমি আমাকে ধরে চল।

এভাবে যাওয়া সম্ভব হল। একদিকে অর্ক অন্যদিকে ক্রাচে ভর দিয়ে অনিমেষ এগিয়ে গেল। এখনও এই দেশে খোঁড়া কিংবা অন্ধ মানুষকে সবাই মমতা দেখায়, ফলে ওদের পক্ষে বাথরুমের দরজায় পৌঁছাতে অসুবিধে হল না। অর্ক লক্ষ্য করল চারধারে বিছানাপত্র গুটিয়ে মানুষেরা তৈরি হচ্ছে।

পরিচ্ছন্ন অনিমেষকে আসনে ফিরিয়ে দিয়ে এবার অর্ক পেস্ট নিয়ে গেল। বাথরুমের সামনে এর মধ্যেই লাইন পড়ে গেছে। ঠিক বস্তির মত। কাল রাত্রে শিয়ালদায় এই মানুষগুলো কি ভীষণ ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল নিজের নিজের আসন দখল করার জন্যে। সারা রাত সেই অপরিচিত পরিবেশে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে একটু বাদেই চিরকালের মত ছেড়ে চলে যাবে। অর্কর মনে হল এই লোকগুলো সে সব কথা ভাবছে না। হঠাৎ তার খেয়াল হল তাকে ডিঙ্গিয়ে একটা মোটা লোক এগিয়ে গেল। সে খুব ভদ্র গলায় বলল, আপনার আগে আমি আছি। আপনি পেছনে যান।

লোকটা তার দিকে না তাকিয়ে বলল, আমি আগে ছিলাম, আছি।

লোকটা বেমালুম মিথ্যে কথা বলছে। অর্কর মাথার ভেতরটা চিনচিন করে উঠল। সে ডান হাত বাড়িয়ে লোকটার কাঁধ স্পর্শ করল, এই যে!

লোকটা একটু বিরক্তি নিয়ে মুখ ফেরাতেই অর্ক চোখ স্থির রেখে বলল, পেছনে যান। লোকটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, পেছনে যান, মাস্তানি হচ্ছে? বললেই যেন আমাকে পেছনে যেতে হবে। লাটের বাট এসেছে। হুঁ।

এই সকালে লোকটা যেরকম কুৎসিত মুখভঙ্গী করল তাতে অর্ক আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ওর গলার মধ্যে বসে যেন খুরকি কথা বলে উঠল, আব্বে, খুব নকশা হচ্ছে?

তৎক্ষণাৎ লোকটার মুখের চেহারা পাল্টে গেল। চোয়াল ঝুলে গেল যেন, চোখও বড়। এবং চোরের মত সুড়ৎ করে সামনে থেকে পেছনে চলে এল লোকটা। তারপর ফিসফিস করে বলল, একই ট্রেনে যাচ্ছি, কেউ আগে কেউ পরে, এ তো হবেই।

লোকটার ভাবভঙ্গী দেখে হাসি পেয়ে গেল অর্কর। রাগটা যেমন এসেছিল আচম্বিতে তেমনি মিলিয়ে গেল। সে খিস্তি করেনি কিন্তু বলার ধরন দেখেই গুটিয়ে গেল লোকটা। এক নম্বরের ভেড়ুয়া। তারপরেই মনে হল এ নিশ্চয় কলকাতার লোক নয়। এই রকম গলার কথা শুনতে কলকাতার লোক অভ্যস্ত। কিন্তু এখন আর কথা না বলাই বুদ্ধিমানের কাজ তবু কৌতূহল চাপতে পারল না সে, আপনি কোথায় থাকেন?

আমি? আলিপুরদুয়ারে। কেন?

অর্ক আর জবাব দিল না। সে খুশি হল কারণ তার ধারণাই ঠিক। ওর মনে হল বাবা-মা যাই বলুক এই পৃথিবীতে গায়ের অথবা গলার জোর না দেখালে কেউ খাতির করবে না, সব সময় অন্যায়কে মেনে নিতে হবে।

চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে উজ্জ্বল মুখে অনিমেষ বলল, আর মিনিট দশেকের মধ্যে নিউ জলপাইগুড়ি এসে যাবো।

কি করে বুঝলে? মাধবীলতা চুল ঠিক করছিল।

আমি বুঝতে পারব না? অনিমেষের গলায় একটু অহমিকা। সেটা লক্ষ্য করে মাধবীলতা হাসল। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, হাসলে কেন?

নাঃ। তারপরই ওর গলা পাল্টে গেল, আমার খুব ভয় করছে।

ভয় করছে? অনিমেষ অবাক হল।

আমাকে কিভাবে নেবেন ওঁরা? নতুন বউও নয়, একেবারে পনেরো ষোল বছরের ছেলে সমেত পুত্রবধূ।

আমার জন্যে তো তুমিই ব্যস্ত হয়েছিলে! এত যদি ভয় তাহলে এলে কেন?

অনিমেষ মুখ ফিরিয়ে নিল। খাবার আছে আর? খিদে পেয়েছে!

কাল ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগে পরমহংস সন্দেশ আর রুটি দিয়ে গিয়েছিল। পরিমাণে প্রচুর, এখনও তার কিছু রয়েছে। মাধবীলতা একটা বড় সন্দেশ বের করে অনিমেষের হাতে দিল। দিয়ে বলল, পরমহংসের মত বন্ধু হয় না।

আর তখনই দূরের ঘরবাড়ি এবং অনেকগুলো রেল লাইন চোখে পড়ল। অনিমেষ যেন এক বুক নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, এসে গেছি।

নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে ওরা চারপাশে তাকাল। মাধবীলতা বলল, তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। আগে সবাই বেরিয়ে যাক তারপর না হয় যাওয়া যাবে। অর্ক তুই জিজ্ঞাসা করে আয় জলপাইগুড়ি যাওয়ার কোন ট্রেন আছে কিনা। তারপর অনিমেষকে বলল, তুমি তো অনেক দিন আসোনি, ভুল করতেও পার।

অনিমেষ দুটো ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্টেশনটাকে তার একদম অচেনা মনে হচ্ছে। তার স্মৃতিতে জলপাইগুড়িতে যে ট্রেনটা যায় সেটা এখান থেকে নটার আগে ছাড়ে না। নিয়মটা যদি এখনও চালু থাকে তাহলে ঘণ্টা দুয়েক চুপচাপ বসে থাকতে হবে।

অর্ক একটা কালো কোর্ট-পরা লোককে জিজ্ঞাসা করল কয়েক পা এগিয়ে। লোকটা তড়িঘড়ি করে বলল, বাসে চলে যান। স্টেশনের বাইরে মিনিবাস পাবেন। না হলে রিকশা নিয়ে জলপাইগুড়ির মোড়ে গেলে সব পাবেন। ট্রেনের জন্যে বসে থাকবেন না। কাল থেকে গোলমাল চলছে।

অর্ক বলল, আজ কি ট্রেন যাবে না?

এই সময় মাইকে ঘোষণা করা হল কামরূপ এক্সপ্রেস দেরিতে আসছে। লোকটা ছাড়া পাওয়ার জন্যে বলল, কামরূপে চলে যান। জলপাইগুড়ি রোডে নেমে রিকশা নেবেন। অর্ককে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে লোকটা হাওয়া হয়ে গেল।

দার্জিলিং মেলের প্যাসেঞ্জাররা ততক্ষণে প্লাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। অর্ক ওভারব্রিজের দিকে তাকাল। অনিমেষের পক্ষে ওই উঁচুতে ওঠা সম্ভব নয়। সে ফিরে এসে বলল, এখনই যে ট্রেনটা আসবে সেটায় যাওয়া যাবে।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কোন ট্রেন? জলপাইগুড়িতে কোন দূরের গাড়ি যায় না।

অর্ক প্রতিবাদ করল, রেলের লোক বলল যাবে!

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, নে ব্যাগটা তোল, একটু চা খাই।

বাক্স-দোকান থেকে চা বিস্কুট খাওয়া শেষ হতেই ট্রেনটা এসে পড়ল পাশের প্লাটফর্মে। চিৎকার চেঁচামেচি শেষ হলে অর্ক গিয়ে জেনে এল ওই ট্রেন জলপাইগুড়ি শহরের পাশ ছুঁয়ে যাবে। সেখান থেকে খুব সহজেই শহরের মধ্যে যাওয়া যায়। অনেক লোক নিউ জলপাইগুড়িতে নেমে যাওয়ায় ট্রেনটা বেশ খালি হয়ে গেল। কামরূপ এক্সপ্রেসে খুব ধীরেসুস্থে ওরা অনিমেষকে তুলল। প্লাটফর্ম উঁচু থাকায় এখন আর কুলির সাহায্য দরকার হল না, অর্ক একাই পারল। গুছিয়ে বসে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, দ্যাখো তো আমাদের টিকিট কতদূর পর্যন্ত! মনে হচ্ছে নিউ জলপাইগুড়ি লেখা ছিল।

মাধবীলতা বলল, ওখানে যখন যাচ্ছি তখন অন্য জায়গা কেন হবে?

ব্যাগ খুলে টিকিট বের করে চোখের সামনে ধরে অস্ফুটে বলল, ওমা, সত্যি তো, এ যে নিউ জলপাইগুড়ি লেখা। কি হবে?

অনিমেষ বলল, জলপাইগুড়ি পর্যন্ত টিকিট কাটতে হবে। অর্ক, দ্যাখ তো পারিস কিনা টিকিট কাটতে?

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, এখান থেকে কত ভাড়া?

অনিমেষ হাসল, কতকাল আসিনি, আমার তো ভুলও হতে পারে। একটা মানুষের সঙ্গে বহুদিন বাদে দেখা হলে তার মনের অনেকটাই অচেনা হয়ে যায় আর এ তো রেলের ভাড়া, বছরে বছরে পাল্টায়। কুড়ি টাকা দাও, ওতে হয়ে যাবে বোধহয়।

টাকা নিয়ে অর্ক আবার প্লাটফর্মে নামল। টিকিটঘর কোনদিকে? সে একটা কুলিকে জিজ্ঞাসা করতেই জবাব পেল, ওভারব্রিজসে যাইয়ে, একদম বাহার। অর্ক যখন ওভারব্রিজের ওপরে ঠিক তখন ওর চোখে পড়ল রঙিন ছোট ছোট কামরা নিয়ে ছোট ইঞ্জিন দাঁড়িয়ে আছে ওপাশে। দার্জিলিং-এর গাড়ি বোধহয়। এখান থেকে দার্জিলিং কতদূর! সে ডানদিকের আকাশে তাকাতেই চমকে গেল। অনেক দূরে পাহাড়ের গায়ে সাদা সাদা চুড়ো, আবছা, কিন্তু বোঝা যায়। ওগুলো কি। বরফ? আর তখনি নিচের ট্রেনটা হুইল বাজিয়ে নড়ে উঠল। অর্ক মুখ নামিয়ে দেখল ট্রেনটা চলা শুরু করেছে। জীবনের শ্রেষ্ঠ দৌড়টা দিল সে। ট্রেনটা তখন প্লাটফর্মের অর্ধেক ছেড়ে গেছে। অর্ক বুঝতে পারছিল না কোন কামরাটা ওদের! এবং এই সময় মাধবীলতার গলা শুনতে পেল। দরজায় দাঁড়িয়ে তার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকছে। একটার পর একটা কামরা সরে যাচ্ছে সামনে থেকে, মায়ের চেহারাটা আরও দূরে চলে যাচ্ছে। অর্ক মরিয়া হয়ে আবার দৌড়াল এবং শেষ পর্যন্ত কামরার হাতলটা ধরে উঠে পড়তেই মাধবীলতা তাকে জড়িয়ে ধরল। অর্ক তখন জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে, চোখ বড় হয়ে গিয়েছে। মাধবীলতা সেই অবস্থায় বলল, ভয়ে আমার বুক হিম হয়ে গিয়েছিল।

অনিমেষ বলল, ওকে টিকিট কাটতে পাঠানো ভুল হয়ে গিয়েছিল। ট্রেনটা যে চট করে ছেড়ে দেবে ভাবতে পারিনি।

একটু সুস্থ হয়ে অর্ক বলল, মা, ছোট ট্রেন দেখে এলাম।

অনিমেষ বলল, ওগুলো দার্জিলিং-এ যায়।

মাধবীলতার মুখ উজ্জ্বল হল এখন, একবার দার্জিলিং-এ গেলে বেশ হয়, না?

অনিমেষ ম্লান হাসল, বেশ তো, তোমরা দুজন না হয় ঘুরে এস।

ততক্ষণে ট্রেনটা দুপাশে মাঠঘাট রেখে ছুটে চলেছে। অনিমেষ বাইরে তাকিয়ে আবার উদাস হল, এদিকের স্টেশনগুলোর নাম খুব অদ্ভুত। বেলাকোবা, আমবাড়ি-ফালাকাটা।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কতক্ষণ লাগবে?

এক ঘণ্টার বেশী লাগা উচিত নয়। অনিমেষ খুব বিজ্ঞের মত বলল।

পরের স্টেশনটা আসতে অর্ক উঠে গিয়ে দরজায় দাঁড়াল! এখন বুকের ভেতরটা ঠাণ্ডা কিন্তু উত্তেজনাটার ছায়া মনে রয়ে গেছে। মায়ের শরীরটা কিভাবে দ্রুত চোখের সামনে থেকে দূরে চলে যাচ্ছিল। যদি সে ট্রেনটা না ধরতে পারত! একটু ঝামেলা হত কিন্তু সে তো আর হারিয়ে যেত না!

এই সময় ট্রেনটা ছাড়ল আর একজন টিকিট চেকার উঠে এল। খুব নিরীহ চেহারার ভদ্রলোক। কিন্তু ওঁকে দেখে অর্কর খেয়াল হল ওদের এই পর্বের টিকিট কাটা হয়নি। বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণ করলে জরিমানা এবং জেল দুই হতে পারে–এরকম একটা বিজ্ঞাপন কোথায় যেন দেখেছিল। সে পেছন ফিরে তাকাল, মা এবং বাবাকে এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না। চেকার দরজায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। অর্ক ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিল। ওর মনে হল টিকিট না থাকার কথা চেকারকে আগেই বলা দরকার। সে সরাসরি বলে ফেলল, শুনুন, আমরা কলকাতা থেকে আসছি। জলপাইগুড়িতে যাব।

ভাল কথা। জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনে নেমে যেও। এক মিনিট থামে। ভদ্রলোক নির্বিকার ভঙ্গীতে বললেন।

কিন্তু আমাদের টিকিট ছিল নিউ জলপাইগুড়ি পর্যন্ত। ওখানে দৌড়ে গিয়েও আমি টিকিট কাটতে পারিনি।

কই দেখি টিকিট?

আমার মা বাবার কাছে আছে, নিয়ে আসব?

থাক, ছেড়ে দাও।

আমাদের টিকিটটা–।

বলেছ এই ঢের! কজনই বা বলে? আমার কাছে রসিদ বই নেই না হলে টিকিট কেটে দিতাম। আর জলপাইগুড়ি রোডে কেউ চেক-ফেক সাধারণত করে না। যদি করে তখন বলবে মিত্তিরবাবুর সঙ্গে কথা হয়েছে। কথা শেষ। ভদ্রলোক ঠিক তেমনি চুপচাপ সিগারেট খেতে লাগলেন। অর্ক ফিরে এসে অনিমেষকে ঘটনাটা বলল। অনিমেষ যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না, সত্যি বলছিস?

হ্যাঁ। বললেন টিকিট কাটতে হবে না।

একটু ইতস্তত করে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, তোর কাছে টাকা চায়নি?

না তো। বললেন রসিদ নেই তাই টিকিট কাটতে পারবেন না।

সে তো বুঝলাম, এমনি টাকা চাইল না?

না।

অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকাল, আমার সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। ভারতবর্ষে এরকম মানুষ তাহলে এখনও আছে, অদ্ভুত ব্যাপার।

মাধবীলতা বলল, ভদ্রলোকের সঙ্গে কাগজপত্র নেই বলে গা করেননি।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, উঁহু। এই লোকটা ব্যতিক্রম। ভাবতে পারছি না।

পাশে বসা একজন যাত্রী এইবার কথা বললেন, মিত্তিরবাবু ঘুষ খান না।

অর্ক লোকটির দিকে তাকাল। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে উঠেছেন, খুব দীন দশা। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আপনি ওঁকে চেনেন?

চিনব না? রোজ এই লাইনে যাতায়াত করি।

মাধবীলতা ঠাট্টার গলায় বলল, বাটিরা ভাল মানুষ হয় মনে হচ্ছে।

বাটি?

তাই তো! নর্থ বেঙ্গলের লোক বাঙাল আর ঘটি মিশিয়ে।

অনিমেষ হেসে ফেলল। তারপরই উত্তেজিত গলায় বলল, ওই দ্যাখো চা গাছ। গাড়িটা তখন চা বাগান চিরে চলেছে। মাধবীলতা আর অর্ক অবাক হয়ে দেখতে লাগল চায়ের গাছ। অনিমেষ বলল, এ আর এমন কি! আমাদের স্বর্গছেঁড়া চা বাগানে যদি যাও তাহলে চোখ জুড়িয়ে যাবে।

অর্ক বলল, সেখানে যাবে বাবা?

তখনি অনিমেষের খেয়াল হল স্বর্গছেঁড়ায় এখন কারো থাকার কথা নয়। মহীতোষ জলপাইগুড়িতে চলে এসেছেন। সেই বাগানের কোয়াটার্সে নিশ্চয়ই এখন অন্য লোক রয়েছে। সমস্ত ছেলেবেলাটা জুড়ে যে স্বৰ্গছেঁড়া অটুট ছিল আজ সেখানে গিয়ে দাঁড়াবার কোন সুযোগ নেই। এতদিনে স্বৰ্গছেঁড়ায় কোন হোটেল হয়েছে? কে জানে! সে মুখে বলল, দেখি!

নিউ জলপাইগুড়ি রোডের প্লাটফর্ম এত নিচুতে যে অনিমেষের পক্ষে নামা অসম্ভব। সহযাত্রীটি বলেছিলেন ট্রেন এখানে এক মিনিটের বেশী থামে না। তাড়াহুড়ো করে জিনিসপত্র নামিয়ে অর্ক অনিমেষকে প্রায় কোলে করে নিচে নিয়ে এল। এবং তখনই ট্রেনটা ছেড়ে দিল। শব্দটা মিলিয়ে গেলে অনিমেষ মাধবীলতাকে বলল, লাঠি দুটো দাও। তারপর ম্লান হাসল, আমার দেশের মাটিতে আমি তোর কোলে চেপে নামলাম। ওকে খুব বিষণ্ন দেখাচ্ছিল।

মাধবীলতা ক্রাচ এগিয়ে দিয়ে উজ্জ্বল চোখে চারপাশে তাকাচ্ছিল। একটা মাঝারি কিন্তু ন্যাড়া স্টেশন। কোন মানুষজন নেই, দোকানপাট নেই। এমন কি বাইরে তাকালে শুধু মাঠ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। সে অর্ককে বলল, দ্যাখ স্টেশনের কি অবস্থা! একদম মরুভূমি।

অনিমেষ সামলে নিয়েছিল এর মধ্যেই। এতক্ষণ ট্রেনে সে একরকম ছিল। কিন্তু জলপাইগুড়িতে পা দেওয়ামাত্র বুকের ভেতর কেমন করে উঠেছিল। নিজেকে সংযত রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় সে বলল, আসলে এটা জলপাইগুড়ির আসল স্টেশন নয়। শহরটাও অন্যদিকে। চল, আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ কি!

অর্ক অবাক হয়ে দেখল গেটে কোন লোক নেই যে তাদের কাছে টিকিট চাইবে। চমৎকার! এই এতটা পথ তারা দিব্যি বিনা টিকিটে চলে এল? বাইরে দুটো রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। বাকিরা যাত্রী নিয়ে রওনা হয়ে গিয়েছে। অনিমেষকে রিকশায়তুলতে এবার রিকশাঅলার সাহায্য দরকার হল। আর এসব যত হচ্ছে তত মেজাজ খিঁচড়ে যাচ্ছে ওর। মাধবীলতা পাশে উঠে বসতেই চাপা গলায় বলল, এই জন্যে আসতে চাইনি।

কেন, আমাদের তো কোন অসুবিধে হচ্ছে না। তুমি মিছে ভাবছ!

রিকশা দুটো সরু পিচের রাস্তা দিয়ে মিনিট দশেক ছুটে এল দুপাশে মাঠ আর চাষের ক্ষেত রেখে। তারপর সামান্য কিছু ঘরবাড়ি যাদের শহুরে বলে মনে হয় না। অর্ক জিনিসপত্র নিয়ে আগের রিকশায় যাচ্ছিল! সে কোনদিন কলকাতার বাইরে আসেনি এবং ততক্ষণে তার মনে হল জলপাইগুড়ি নেহাতই একটা গ্রাম। অথচ বাবা এই শহর নিয়ে কত না কথা বলত! হঠাৎ তার চোখে পড়ল একটা বিশাল ন্যাড়া সিমেন্টের গেট। তার ফাঁক দিয়ে দূরে প্রাসাদ দেখা যাচ্ছে। এরকম বাড়ি কলকাতাতেও কম দেখা যায়। সে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, বাবা, এটা কি?

অনিমেষ চেঁচিয়ে জবাব দিল, ওটা জলপাইগুড়ির রাজবাড়ি। এখানে এককালে বিরাট মেলা বসত। এখন তো রাজারা নেই, মেলা হয় কিনা কে জানে।

রিকশাঅলা বুড়ো। খানিকটা যাওয়ার পর লোকটা বলল, এটা রায়কত পাড়া। অর্ক এবার ধারণাটা পাল্টালো। না, সত্যিই শহর। যদিও বেশীর ভাগই একতলা বাড়ি কিন্তু আর গ্রাম বলে মনে হচ্ছে না। রিকশাঅলা নিজের মনে বলে যাচ্ছে, ওইটে জেলখানা, ওই রাস্তায় দিনবাজার। আর তখনই পেছনের রিকশাঅলা চেঁচিয়ে ওদের থামতে বলল। অর্ক মুখ ঘুরিয়ে দেখল মাধবীলতা তাকে হাত নেড়ে ডাকছে। সে রিকশা থেকে নেমে এগিয়ে যেতেই মাধবীলতা বলল, দ্যাখ তো এখানে মিষ্টির দোকান আছে কিনা! তাহলে সন্দেশ কিনে আন। সে ব্যাগ খুলতে যেতেই অর্ক বলল, আমার কাছে তো টাকা আছে, টিকিটের জন্যে দিয়েছিলে।

খোঁজ করে করে একটা নদীর ওপর দিয়ে ওপারে গিয়ে সে সন্দেশ কিনে আনল। জায়গাটায় বেজায় ভিড়। রিকশা আর সাইকেলে ঠাসাঠাসি। ও ফিরে আসার সময় নদীটাকে দেখল। ছোট্ট মজা নদী শহরটার মধ্যে দিয়ে গেছে। এই জায়গাটা খুব ঘিঞ্জি। বাবার বর্ণনার সঙ্গে মিলছে না। মায়ের হাতে প্যাকেট দিতে গিয়ে শুনল, তুই রাখ।

মাধবীলতা হঠাৎ আবিষ্কার করল সে কেমন জড়োসড়ো হয়ে যাচ্ছে। অনিমেষের পাশে বসে আছে রিকশার স্বল্প পরিসরে কিন্তু গায়ে যেন জোর নেই। সে টের পাচ্ছিল যে শরীর ঘামছে। অনিমেষ বলল, এটা সদর হাসপাতাল। এরপরেই হাকিমপাড়া, আমরা এসে গেছি।

এসে গেছি শুনে মাধবীলতার হাত কেঁপে উঠল। ডান হাত কাঁপছে, অলক্ষণ। অনিমেষ চারপাশে উদগ্রীব চোখে তাকাচ্ছিল। একটাও চেনা মুখ দেখতে পাচ্ছিল না। হাকিমপাড়া চিরকালই নির্জন, শান্ত। হঠাৎ সে আবিষ্কার করল তার মধ্যে আর কোন উত্তেজনা নেই, যেন যা হবার তা হবে এইরকম একটা মানসিকতায় সে পৌঁছে গেছে। রিকশাঅলাকে নির্দেশ দিল সে বাড়িটার কাছে পৌঁছে যেতে। এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে দরজা বন্ধ। অজস্র গাছগাছালিতে বিরাট বাড়িটা ছেয়ে আছে। দীর্ঘদিন চুনকাম না করানোয় একটা স্যাঁতসেঁতে ভাব দেওয়ালে। অর্ক এবং রিকশাঅলা অনিমেষকে ধরে ধরে নামাল। ক্রাচ দুটো বগলে নিয়ে অনিমেষ বলল, ওই বাড়ি!

অর্ক তাকাল। গাছপালার ফাঁকে যে বাড়িটা দেখা যাচ্ছে সেটা তাদের বাড়ি! এত বড়! অনিমেষ শান্ত গলায় বলল, তুই এগিয়ে গিয়ে নক কর, আমরা ভাড়া মিটিয়ে আসছি।

মিষ্টির বাক্স, সুটকেস আর ব্যাগ দু হাতে তুলতে তুলতে অর্ক দেখতে পেল-মায়ের আঁচল মাথায় উঠে যাচ্ছে। মুখ ভরতি ঘাম, খুব ভীরু বউ-এর মত মাধবীলতাকে দেখাচ্ছে।

মায়ের এই রূপ সে কখনও দ্যাখেনি।

২৯. লোহার গেটে কোন প্রতিরোধ নেই

লোহার গেটে কোন প্রতিরোধ নেই, ঠেলতেই খুলে গেল। অর্ক দেখল সমস্ত দরজা, জানলা বন্ধ, কোন মানুষের অস্তিত্ব নেই। একফালি জমিতে প্রচুর ফুলের গাছ, বেশীর ভাগই গাঁদা কিন্তু তাতেই মৌমাছিরা শব্দ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সংকুচিত পায়ে সে বাগানটা পেরিয়ে বারান্দায় উঠে এল। ওদিকে আর একটা পুরোনো বাড়ি কিন্তু তার চেহারা খুবই সঙ্গীন।

অর্ক পেছন ফিরে তাকাল। রিকশাঅলারা রিকশা ঘুরিয়ে নিচ্ছে। বাড়ির দরজা অবধি ওগুলো। আসতে পারে না রাস্তাটার জন্যে। অনিমেষ এবার এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে, ওর পেছনে মাধবীলতা। অর্ক ঘুরে দরজার কড়া নাড়ল। শব্দটা মিলিয়ে গেল কিন্তু কোন সাড়া এল না। দ্বিতীয়বার একটু জোরেই আওয়াজ করল সে। কিন্তু সেটাতেও অবস্থার কোন তারতম্য হল না।

অর্কর মনে হল এই বাড়িতে কোন মানুষ নেই। ততক্ষণে অনিমেষরা গেটের সামনে এসে। দাঁড়িয়েছে। জিনিসপত্র বারান্দাতেই রেখে অর্ক এগিয়ে এল তাদের কাছে, কেউ সাড়া দিচ্ছে না।– অনিমেষ তখন বাড়িটার দিকে নিষ্পলক তাকিয়েছিল। প্রশ্নটা শুনে চমকে উঠল, ঊ! ও, বোধহয় এদিকে কেউ নেই। তুই এক কাজ কর। ওই যে ছোট বাড়িটা দেখছিস ওর গা ঘেঁষে একটা ছোট্ট পথ আছে। ওখানে গিয়ে ডাক।

মাধবীলতা চাপা গলায় বলল, প্রত্যেককে প্রণাম করবি।

অর্ক হাসল। তারপর এগিয়ে গেল ছোট বাড়িটার দিকে। এদিকটায় বোধহয় কেউ আসা যাওয়া করে না। আগাছায় পথ ঢেকে গেছে। বাড়িটার এদিকে তারের নিচু বেড়া তারপর নানান গাছের ভিড়। অর্ক খানিকটা যাওয়ার পর সরু পথটার শেষে একটা টিনের দরজা দেখতে পেল। সেটাতে আওয়াজ করতে গিয়ে মনে হল ঠেললেই খুলে যাবে। হয়তো ভেতর থেকে শেকল ঠিক মতন দেওয়া ছিল না তাই অর্ক সহজেই উঠোনটায় চলে এল। এক চিলতে বারান্দা তারপর অনেকটা খোলা জমি। সেই জমিতে ইতস্তত কিছু গাছ আর টাঙানো তারে কাপড় শুকোছে। অর্ক একটু দাঁড়াল। ওপাশে বড় বাড়িটার লম্বা বারান্দা দেখা যাচ্ছে কিন্তু কাউকেই চোখে পড়ল না। কাপড় যখন শুকোচ্ছে তখন নিশ্চয়ই মানুষ আছে। সে একটু গলা তুলে জিজ্ঞাসা করল, কেউ আছেন!

সঙ্গে সঙ্গে খনখনে গলায় তীব্র চিৎকার ভেসে এল, কে? বাড়ির মধ্যে কে? কথা নেই বার্তা নেই হট করে চলে এসেছে। কে ওখানে?

গলার স্বরে অর্ক সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আমি কড়া নেড়েছিলাম।

কড়া নেড়েছিলাম! কি মিথ্যে কথা রে বাবা। কড়া নাড়ল আর আমরা কেউ শুনতে পেলাম না! কানের মাথা খেয়েছি নাকি সবাই। তা কি চাই? কথা বলতে বলতে তিনি ছোট ঘরের অন্ধকার ছেড়ে বেরিয়ে আসছিলেন বাইরে। বারান্দায় আসতেই অর্ক দেখল ছোট্ট রোগা শরীর, গায়ে একটা ধুতি জড়ানো, সমস্ত মুখে বার্ধক্যের ভাঁজ, সাদা কালোয় মেশানো এক গুছি চুল এবং দাঁতহীন চুপসানো গালের এক বুড়ি পিট পিট করে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। আর তার পরেই যে ঘটনাটা ঘটল তার জন্যে মোটেই প্রস্তুত ছিল না অর্ক। হঠাৎ বৃদ্ধা চিৎকার করে উঠলেন। ওইটুকুনি। শরীর থেকে অদ্ভুত একটা আওয়াজ বের হল যা কোনদিন কোন মানুষের গলায় শোনেনি অর্ক। তারপর প্রায় দৌড়ে চলে এলেন বৃদ্ধা, এসে দুহাতে অর্ককে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন, অ্যাদ্দিন কোথায় ছিলি? এত পাষাণ কেন তুই? ও অনিবাবা, আমাকে একদম ভুলে গেলি? আমি যে তোর কথা রোজ ভাবি আর কেঁদে মরি। তুই কী, তুই কী? কান্নার সঙ্গে জড়ানো শব্দগুলো উচ্চারণ করছেন আর অর্কর বুকে মাথা ঠুকছেন। অর্ক এত বিহ্বল হয়ে পড়েছিল যে প্রথমে কোন কথা বলতে পারল না। সে হঠাৎ আবিষ্কার করল তার সমস্ত শরীর কাঁপছে। একজনের কান্না যেন তার বুকের মধ্যে জোর করে ঢুকে পড়ছে। বৃদ্ধার মাথা তার বুকের অনেক নিচে কিন্তু সেই অবস্থায় তিনি দুহাত বাড়িয়ে ওর মুখ স্পর্শ করলেন, অনিবাবা, তুই শেষ পর্যন্ত ফিরে এলি? আমি জানতাম তুই ফিরে আসবি, একদিন আসতে হবেই। তারপরেই যেন সম্বিত ফিরে পেয়ে বুক ফাটিয়ে চিৎকার করলেন, ও ছোট বউ, ও ছোট বউ, এদিকে এস, কে এসেছে দেখবে এস।

ঠিক তখনই খুব কাছ থেকে একটি স্বর ভেসে এল, তুমি কে?

অর্ক দেখল বড় বাড়ির বারান্দায় একজন মাঝবয়সী মহিলা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার মুখ। শক্ত, চোখ যেন পরীক্ষা করছে। প্রশ্নটা তিনিই করলেন।

বৃদ্ধা হেসে কেঁদে একসা হলেন, ওমা, একে চিনতে পারছ না। হায় কপাল! এ যে অনি, অনি এসেছে। আমি বলেছিলাম টেলিগ্রাম পেয়েই ছুটে আসবে, দ্যাখো, তাই হল কিনা দ্যাখো।

মহিলা বললেন, না। এ অনিমেষ নয়। আপনি খেয়ালই করছেন না ওর বয়স কত। আপনি সব ভুলে গেছেন। ওর চেহারায় অনিমেষের শুধু একটু আদল আছে। তুমি কি? প্রশ্নটা করতে গিয়ে থেমে গেলেন উনি।

বৃদ্ধার হাত তখনও অর্ককে জড়িয়ে, সেই অবস্থায় বিস্ময়ে তিনি তাকালেন। অর্ক বুঝতে পারছিল ওঁর হাতদুটো একটু একটু করে শিথিল হয়ে যাচ্ছে। অর্ক এবার নিচু হয়ে বৃদ্ধাকে প্রণাম করে মহিলার দিকে এগিয়ে গেল প্রণাম করতে। মহিলা বোধহয় দ্বিধায় ছিলেন প্রণাম গ্রহণ করবেন কিনা কিন্তু তার আগেই অর্ক সেটা সেরে বলল, আমার নাম অর্ক। আমরা এইমাত্র কলকাতা থেকে আসছি। বাবা মা বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। ওদিকে কড়া নেড়ে সাড়া না পেয়ে আমি এদিক দিয়ে ঢুকেছিলাম।

এবার মহিলার গলার স্বর পাল্টে গেল। কেমন যেন বিস্ময় আর অবিশ্বাস মিশে গেল তাতে, তুমি, তুমি অনিমেষের ছেলে? এত বড়!

বৃদ্ধাও যেন হতভম্ব, কি বলল? ও অনির ছেলে?

মহিলা মাথা নাড়লেন, তাই তো বলছে। তিনি খুঁটিয়ে অর্ককে দেখছিলেন। বৃদ্ধা তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এলেন অর্কর সামনে। তারপর পেছনে মাথা হেলিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন, প্রিয় তো সেরকমই বলল। কিন্তু আমার চোখের মাথা গেছে ছোট বউ, আমি কেন অনি বলে ভুল করলাম। ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই মনে হল উঠোনে অনিবাবা দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এতবড় ছেলে কখন হল?

প্রশ্নটা শুনে অর্ক হেসে ফেলল তারপর বলল, বাবা মা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।

এবার একটা পরিবর্তন চোখে পড়ত অর্কর। তার কথা শুনেই দুজনে যেন কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেলেন। এদের একজন যে বাবার পিসীমা এবং অন্যজন যে ছোটমা তা সে বুঝতে পেরেছে। এর মধ্যেই বৃদ্ধাকে তার খুব ভাল লাগছিল, এই প্রথম কেউ তাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা ঠুকেছে। সেই তুলনায় ছোটমা একটু গম্ভীর, একটু আলাদা আলাদা। কিন্তু তার কথা শোনামাত্র দুজনে কেমন হয়ে গেল কেন?

মহিলা নড়লেন, তারপর ভেতরের দিকে পা বাড়াতে যেতেই বৃদ্ধা তাকে ডাকলেন, ছোট বউ, আমি কি বলেছিলাম মনে নেই?

ও! ছোট বউর মনে পড়ে যাওয়াটা বোঝা গেল। তারপর বললেন, এখন আর ওসবের কি দরকার?

তোমার যদি ইচ্ছে না হয় তাহলে থাক। আজ বাবা বেঁচে থাকলে।

ঠিক আছে, আপনার কথাই হবে, আসুন।

বড় বাড়ির একটা ভেজানো দরজা খুলে ভেতরে চলে গেলেন মহিলা। বৃদ্ধা তাঁর ছোট শরীর নিয়ে তাঁকে দ্রুত অনুসরণ করলেন। অর্ক ব্যাপারটা বুঝতে পারছিল না। ওরা যেন ইশারায় কিছু বললেন। সে বড় বাড়ির বারান্দায় উঠে এল। এবং তখনই মহিলার চাপা গলা শুনতে পেল, এখনি ওঁকে কিছু না বলা ভাল।

কাকে? মহীকে? বৃদ্ধার গলা স্বাভাবিকভাবেই উঁচু, বাঃ, ছেলে আসছে এতদিন পরে বউ নিয়ে, মহীকে বলবে না?

বলব। আমি আগে বলব। এখন ওঁর উত্তেজিত হওয়া ঠিক হবে না।

অ। তুমি শাঁখটা নাও, প্রদীপ জ্বেলে দাও, পান সুপুরি আবার কোথায় গেল, হাতের কাছে সব রেখেছিলাম। বৃদ্ধার নিজের মনে বলে যাওয়া কথা বারান্দায় দাঁড়িয়ে অর্ক স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল। এদিকটা অনেকখানি জমি! এই বাড়ি এই জমি বাগান সব তার ঠাকুদার! অর্কর বুকের ভেতরটা কেমন করছিল। তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেনের ছবিটা এখানে এসে কি বীভৎস লাগছে। কিন্তু বাবার পিসীমা প্রথমে তাকে জড়িয়ে ধরে যেরকম করেছিলেন ওই মহিলা আসার পর সেটা যেন উধাও হয়ে গিয়েছে। তার সঙ্গে এরা দুজন অপরিচিত মানুষের মত ব্যবহার করছে এখন। অবশ্য সে নিজেও তো ওঁদের সঙ্গে তার বেশী কিছু করতে পারেনি। হঠাৎ অর্কর মনে হল মিষ্টির প্যাকেটটা বাইরের বারান্দায় না রেখে সঙ্গে নিয়ে এলে হতো। আর এই সময় অদ্ভুত সুরে একটি পাখি সামনের আমগাছে বসে ডেকে উঠল, ডাকতেই থাকল। তাতে, তিত আর তখনই শঙ্খ বেজে উঠল। অর্ক চমকে তাকাল দরজাটার দিকে। তারপর শব্দটা মিলিয়ে যাওয়ার আগেই বৃদ্ধা একটা কুলো এবং ডালায় অনেক কিছু সাজিয়ে পায়ে পায়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন, পেছনে মহিলা, হাতে শঙ্খ। ওরা অর্কর দিকে না তাকিয়ে বারান্দার শেষপ্রান্তে চলে গেলেন। তারপর ডানহাতি একটা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন। অর্ক এবার অনুমানে কিছু বুঝতে পারল। সে দৌড়ে ওঁদের পেছনে চলে এল। একটা ছোট ঘর পেরিয়ে আর একটা বড় ঘরের মধ্যে ঢুকে বন্ধ দরজার সামনে বৃদ্ধা তাঁর হাতের জিনিসগুলো সাবধানে নামিয়ে রেখে মহিলাকে ইশারা করলেন। মহিলা ইঙ্গিতে দরজাটা খুলতে বলতেই বৃদ্ধা চট করে খিল নামিয়ে দিয়ে অনেক দূরে সরে এলেন, ঠিক অর্কর সামনে। তারপর নিজের মনেই বললেন, শুভকাজে বিধবার থাকতে নেই। শাঁখ বাজাও তারপর বরণ করো।

এক হাতে শাঁখ বাজাতে বাজাতে অন্য হাতে দরজার পাল্লা খুললেন মহিলা। বন্ধ ঘরে শাঁখের আওয়াজ কয়েকগুণ বেড়ে গেল। আর তখনি অর্কর কানে একটা গোঙানি ভেসে এল। কেউ যেন প্রাণপণে কিছু বলতে চেষ্টা করছে কোথাও। বৃদ্ধা অর্কর দিকে মুখ ফিরিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন, মহী, কথা বলতে পারে না। শব্দ হচ্ছে বলে এরকম করছে।

.

দরজা খুলে যেতে ঘরে দাঁড়িয়ে অর্ক বারান্দাটা দেখতে পেল। তাদের জিনিসপত্র মিষ্টির প্যাকেট এবং একটা ক্রাচ চোখে পড়ল। মহিলা শাঁখ বাজাতে বাজাতে দু’পা এগিয়ে গিয়ে থেমে গেলেন। অর্ক দেখল পাথরের মত মনে হচ্ছে তাঁর মুখ। শঙ্খ নেমে এল নিচে, তারপর অন্যহাতে মুখ চাপা দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি শব্দ করে। বৃদ্ধা বাইরের কিছুই বোধহয় দেখতে পাননি, মহিলার কান্নায় বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বললেন, আঃ, পরে কেঁদো। বরণের সময় কান্নাকাটি কেন? বরণ কর বরণ কর! শাঁখ নিচে নামানো হল এবং বোধহয় বৃদ্ধার কথায় শক্তি খুঁজে পেলেন মহিলা। বরণডালা তুলে নিয়ে পায়ে পায়ে বেরিয়ে গেলেন। আর তখনই ওরা অনিমেষের গলা শুনতে পেল, এখন এসবের কি দরকার ছিল? বাবা কেমন আছে??

আছে। এসো তোমরা। মহিলার গলা শুনতে পেল, আহা থাক।

অনিমেষ বলল, আমি প্রণাম করতে পারি না।

এসো, ভেতরে এসো।

মহিলা বরণডালা নিয়ে শাঁখ তুলে ঘরের মধ্যে ফিরে আসতেই বৃদ্ধা চট করে সরে গেলেন ওপাশে। সেখানে একটা খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসলেন। বারান্দায় ক্রাচের শব্দ হল। তারপরেই দরজায় অনিমেষ। সরাসরি বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে অনুযোগের ভঙ্গীতে বলল, উঃ, অনেকক্ষণ বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলে।

সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধার মুখ কুঁচকে গেল। ছোট চোখে তিনি অনিমেষকে দেখলেন। তারপর ইশারায় মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কে?

অর্কর হাসি পাচ্ছিল। বুড়ি ভাল করেই জানে তার সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে। তবু এমন ভঙ্গী করছে। ততক্ষণে মাধবীলতা এগিয়ে গেছে। অনিমেষের পাশ কাটিয়ে ঝুঁকে হেমলতাকে প্রণাম করল। হেমলতা তার মাথায় হাত রাখলেন, রেগে বিড় বিড় করে কিছু বললেন নিজের মনে এবং সেটা করতে করতেই তাঁর শরীর কাঁপতে লাগল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার সামনে তাকালেন, তুমি অনিমেষ?

হ্যাঁ। অনিমেষ অবাক হল, কেন, তুমি চিনতে পারছ না?

নীরবে মাথা নাড়লেন হেমলতা। তারপর ছোটমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সত্যি এ অনিমেষ? সত্যি?

ছোট বউ তখন একদৃষ্টিতে অনিমেষের পায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। শেষে ঘাড় নেড়ে বললেন, দাঁড়িয়ে কেন, বসো।

একটা বেতের চেয়ার এগিয়ে দিলেন তিনি। অনিমেষের সত্যি কষ্ট হচ্ছিল দাঁড়াতে। বসতে পেরে বেঁচে গেল। সে লক্ষ্য করছিল পিসীমাকে প্রণাম করার পর মাধবীলতা কেমন সিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখন পর্যন্ত কেউ তার সঙ্গে কথা বলেনি। সে-তুলনায় অর্ককে খুব স্বাভাবিক লাগছে। তার মনে পড়ল তখন বাবার কথা জিজ্ঞাসা করেও সে ছোটমার কাছ থেকে কোন উত্তর পায়নি। তাছাড়া এত বছর পরে এখানে এসে নিজেকেই কেমন অপরিচিত ঠেকছে, এই মানুষগুলোর সঙ্গে যেন অনেক যোজন দূরত্ব বেড়ে গিয়েছে। তবু আবহাওয়া সহজ করার জন্যে সে সক্রিয় হল, কি আশ্চর্য! আমি কি বদলে গিয়েছি পিসীমা?

হেমলতা নীরবে মাথা নাড়লেন, হাঁ।

আর তখনি পাশের ঘরে আবার গোঙানি শুরু হল। সেই জান্তব শব্দে অনেক কষ্ট মেশান। অনিমেষ চমকে উঠল, কে?

ছোটমা বললেন, তোমার বাবা।

বাবা? বাবা কথা বলতে পারেন না?

না।

অনিমেষ উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু ছোটমা বাধা দিলেন, না, এখনই যেও না। তোমাকে দেখলে উত্তেজিত হয়ে পড়বেন। মনে হচ্ছে আঁচ করেছেন কিছু। আমি বললে তবে যেও। তারপর একটু থেমে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি একেবারেই হাঁটতে পারো না?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, এ’দুটো ছাড়া পারি না।

এবার হেমলতা খাট থেকে নেমে এলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, ছোট, ওদের হাতমুখ ধুয়ে নিতে বল, আমার অনেক কাজ পড়ে আছে। বলে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন পাশের দরজা দিয়ে।

ছোটমা এবার মাধবীলতার দিকে তাকালেন, তুমি আমার কাছে এস।

মাধবীলতার মাথা মাটির দিকে, কপালের প্রান্ত পর্যন্ত ঘোমটা। এরকম পরিস্থিতিতে এগিয়ে যাওয়া সত্যি কষ্টকর কিন্তু তার কোন অন্য উপায় ছিল না।

ছোটমা মাধবীলতার হাত ধরলেন, এতদিন আসোনি কেন?

মাধবীলতা মুখ তুলে একবার দেখল। সে বুঝতে পারছিল হঠাৎ তার শরীরের প্রতিটি রক্তকণিকায় একটা কাঁপন শুরু হয়েছে। ছোটমা আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি চাকরি কর?

নিঃশব্দে হ্যাঁ বলল মাধবীলতা।

তুমি ওকে স্বার্থপরের মত আগলে রেখেছিলে কেন? কেন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দাওনি? শুনেছি তুমি একটা বস্তির ঘরের অন্ধকারে ওদের নিয়ে থাকো। তোমার কেন মনে হল আমরা জানতে পারলে ওকে তোমার কাছ থেকে কেড়ে নেব? এক নয় দুই নয়, এতগুলো বছর। ছোটমা চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নিলেন।

মাধবীলতার শরীরে যে কাঁপুনি জন্মেছিল সেটা আচমকা থেমে গেল। কিছুটা বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল ওর মুখ, কি বলবে বোধহয় স্থির করতে পারছিল না। সে অসহায় চোখে অনিমেষের দিকে তাকাল। ছোটমার মুখে এই সব কথা শুনে অনিমেষ বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল। মাধবীলতার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই অনিমেষ নড়ে উঠল, এসব কি বলছ তুমি? ও আমাকে কেন আটকে রাখবে? আমি কি বাচ্চা ছেলে? এরকম কথা তোমাদের মাথায় কে ঢুকিয়েছে জানি না তবে মিছিমিছি ওকে দোষ দিচ্ছ।

ছোটমা অবিশ্বাসী চোখে অনিমেষকে দেখলেন। তারপর মুখ ফিরিয়ে বললেন, আমি এখানে রয়েছি, ওখানে কি হচ্ছে আমি জানব কি করে? যা কানে এল তাই বললাম। তারপর একটু দ্বিধাগ্রস্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার নাম মাধবীলতা?

মাধবীলতা ঠোঁট কামড়ে ছিল আলতো করে, এবার ছেড়ে দিল মাথা নাড়ার সঙ্গে।

এ তো তোমাদের ছেলে! কি নাম তোমার?

অর্ক। চুপচাপ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে এতক্ষণ কথা শুনছিল অর্ক।

ঠিক আছে। আমাকে এখন ওঁর কাছে যেতে হবে। তোমরা জিনিসগুলো নিয়ে এই ঘরে এসো। পাশের ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে ছোটমা বললেন, এই ঘরে তোমরা থাকবে। ওপাশে যে ছোট ঘরটা আছে সেখানেও থাকতে পার। এদিকের বাথরুম পায়খানায় আজ যেও না। ওপাশে উঠোন ছাড়িয়ে যেটা আছে সেটা ব্যবহার করো। তারপরেই খেয়াল হল অনিমেষের দিকে তাকিয়ে, তুমি কি একা ওসব পারো?

অনিমেষ গম্ভীর গলায় বলল, চেষ্টা করতে হবে।

ছোটমা কেমন একটা হাসি হাসলেন, অ্যাদ্দিন যদি চেষ্টা না করে থাকো আজ আর সেটা শুরু করতে হবে না। এদিকে কমোট আছে, দেখি, তোমার বাবার কি অবস্থা। আগে তো ওদিকে গিয়ে মুখ হাত পা ধোও। আমি আসছি।

ছোটমা উল্টোদিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। এই ঘরে চারটে দরজা।

অনিমেষ নীরবে মাথা নাড়ল। তারপর ক্রাচে ভর করে উঠে দাঁড়াল, চল ঘর দখল করা যাক। অর্ক, জিনিসপত্রগুলো ও-ঘরে নিয়ে চল।

দখল শব্দটা কানে যাওয়া মাত্র অবাক হয়ে তাকাল মাধবীলতা। অনিমেষের মুখের এই শব্দটা কানে কট করে লাগল। তাছাড়া একটু আগে শোনা অভিযোগগুলো এখনও ছুঁচের মত বিধছে। যদিও অনিমেষ বোঝাবার চেষ্টা করেছে কিন্তু এখানকার সবাই তার সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে তা বোঝা গেল। অনিমেষ ওই ঘরে ঢুকে গেল দেখে তাকেও যেতে হল।

ঘরটি বড়। একটি বিছানা এবং তিনটি জানলা। ঘরের একপাশে আলনা আর একটি চেয়ারও আছে। অনিমেষ সেটিতে শরীর রেখে বলল, সুটকেস খাটের তলায় ঢুকিয়ে দে। ঘরটা বেশ ভাল তাই না?

অর্ক হাসল, চমৎকার। যত দেখছি তত আমাদের তিন নম্বরের কথা মনে পড়ছে। এই বাড়িতে তুমি ছিলে?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, হুঁ। কিন্তু তখন কমোট ছিল না এ বাড়িতে।

অর্ক ওপাশের দরজা দিয়ে উঁকি মারল, বাঃ, এই ঘরটাও ভাল। আমি এখানেই থাকব বাবা।

ওখানে খাট আছে?

আছে। অর্ক ঘরটায় ঢুকে গেল।

অনিমেষ দেখল মাধবীলতা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে বুঝতে পারল এবং বলল, এই, একটু মুখ হাত ধোওয়ার ব্যবস্থা করো। সারা রাত জার্নি করে এলাম আর এভাবে বসে থাকতে ভাল লাগছে না।

আমি কি করব? মাধবীলতা নিচু গলায় বলল।

এই দ্যাখো, ওসব কথায় কান দিচ্ছ কেন? প্রথম পরিচয়ে মানুষ অনেক রকম রি-অ্যাক্ট করে, ঘনিষ্ঠতা হলে সেসব আর কেউ মনে রাখে না। তাছাড়া, এই সব ভেবেই তো আমি আসতে চাইছিলাম না।

তাহলে এবার অন্তত আমিই তোমাকে ধরে নিয়েছি তা জানিয়ে দিও।

অর্ক ফিরে এল এই ঘরে, মা, দাদুর সঙ্গে দেখা করতে দিচ্ছে না কেন?

মাধবীলতা ঘাড় নাড়ল, আমি জানি না।

একবার দেখে আসব?

না। ওঁরা যা চান না তা করবি না। তুই কি ভেতরে গিয়েছিলি?

হ্যাঁ, অনেক খোলা মাঠ আছে, বাগান আছে। চল দেখবে।

মাধবীলতা অনিমেষকে বলল, আমি ভেতরের বারান্দাটা দেখে আসি।

সুটকেস থেকে একমাত্র তোয়ালেটি বের করে সে অর্ককে বলল, আয়।

মাঝের ঘর পেরিয়ে ওরা যে ঘরটায় ঢুকল তাতে জিনিসপত্র ঠাসা। অর্ক বলল, ওপাশে ঠাকুর ঘর। ছোটমা তো বাবার সৎমা, তাই না?

মাধবীলতা চাপা গলায় ধমকালো, চুপ কর।

বারান্দায় বেরিয়ে এসে মাধবীলতার চোখ জুড়িয়ে গেল। সত্যি বড় বাগান। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে অনেকদিন কেউ যত্ন করেনি। পাখি ডাকছে অনেকগুলো, একসঙ্গে। কুয়োতলার পাশেই বাথরুমটা নজরে এল। অর্ক বলল, মা আমাকে তোয়ালেটা দাও আমি চটপট সেরে নিচ্ছি।

মাধবীলতা বলল, তুই এক বালতি জল ওই বারান্দায় নিয়ে রাখতে পারবি? তোর বাবা বোধহয় সিঁড়ি ভেঙ্গে এতটা নামতে পারবে না।

অর্ক ঘাড় নাড়ল তারপর বাথরুমে ঢুকে গেল।

মাধবীলতা চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল বাগানে। একটা শালিক রাজেন্দ্রাণীর ভঙ্গীতে হেঁটে এসে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখল। হঠাৎ মাধবীলতার বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল। যেন সমস্ত কলজে নিংড়ে ফেলছে কেউ। অনেক কষ্টে কান্নার ফোয়ারাটাকে সামলালো সে। খুব একা লাগছে, ভীষণ নিঃসঙ্গ। হাতের তেলোয় চোখ মুছল সে। কতদিন পরে কান্না এল, অথচ বুক খুলে কাঁদাও গেল না। সে কুয়োতলায় এসে দাঁড়াতেই বাঁ দিকের রান্নাঘর চোখে পড়ল। বড় বাড়ির তুলনায় এ নেহাতই নগণ্য। রান্নাঘরের দরজা খোলা। কয়েক পা এগোতেই কথা শুনতে পেল সে। একদম দরজার কাছেই চলে এসেছিল মাধবীলতা। ঘরের মধ্যে দুজন কথা বলছেন। একজন যে হেমলতা তা বুঝতে অসুবিধে হল না, বুঝলি, অনি ছেলেবেলায় লুচি খেতে ভালবাসতো। আমার তো ঘি নেই একটু ডালডা পড়ে আছে, তাই দিয়ে ভেজে দি। ছেলেটা এখন খেতে পায় কিনা কে জানে! চেহারা তো হয়েছে হাড়জিরজিরে। হাঁ করে তাকিয়ে দেখছিস কি? বাড়িতে বউ এল, নতুন বউ, আমাদের অনির বউ, কিন্তু কিভাবে এল? আজ যদি মাধুরী থাকত তাহলে? ডুকরে উঠলেন হেমলতা। মাধবীলতা দরজায় ততক্ষণে পাথরের মত দাঁড়িয়ে। এখান থেকে সরে যাওয়া উচিত; দুজন মানুষের নিভৃত আলাপ শোনা অবশ্যই অপরাধ। কিন্তু সে পা ফেলতে পারছে না কেন? হেমলতা সামলে নিয়েছেন, তুই বউ দেখেছিস? ধেড়ে বউ। বিরাট বড় ছেলে আছে। ছোটখাটো ছেলেমানুষ বউ হলে শিখিয়ে পড়িয়ে নেওয়া যায়। একে পোষ মানাবে কে? শিক্ষিতা মেয়ে, এম এ পাশ। প্রিয় যাওয়ার আগে বলে গেল না?

আর তখনই অর্ক বাথরুম থেকে বের হল। বেরিয়ে মাকে দেখতে পেয়ে বলল, আমি এই জামা প্যান্ট ছেড়ে ফেলছি, স্নানের সময় কেচে দেব। তোয়ালে বাথরুমে রইল। তারপর এক বালতি জল নিয়ে উঠোন পেরিয়ে বড় বাড়ির বারান্দায় রেখে ভেতরে চলে গেল।

কে? ওখানে কে দাঁড়িয়ে? রান্নাঘরের ভেতর থেকে চিৎকার করে উঠলেন হেমলতা। মাধবীলতা চমকে উঠে দ্রুত চলে যাওয়ার কথা ভেবেও পারল না। পিসীমা বুঝতেই পারবেন সে এখানে দাঁড়িয়েছিল। নিচু গলায় সে সাড়া দিল, আমি।

আমি? এদিকে এসো, দরজায় এসে দাঁড়াও। ধমকে উঠলেন হেমলতা।

পা ভারী হয়ে গেল কিন্তু আদেশ অমান্য করার উপায় নেই। দরজায় পৌঁছে অবাক হয়ে গেল সে। উনুনের পাশে হেমলতা ময়দা মাখছেন আর তার মুখোমুখি বসে আছে একদম সাদা একটা বেড়াল। হেমলতা কি এতক্ষণ ওর সঙ্গে কথা বলছিলেন? পিট পিটিয়ে মাধবীলতাকে আবিষ্কার করে হেমলতা বললেন, ও, তুমি। ওখানে কি করছিলে?

বাথরুমে যাব, তাই।

বাথরুমে? এ বাথরুমে কে আসতে বলল তোমাদের?

উনি বলতে গিয়েই থমকে গেল সে। তারপর বলল, ছোটমা।

কেন, ওদিকে তো বাথরুম রয়েছে। তার যা পায়ের অবস্থা এখানে আসতে পারবে? তাছাড়া জল ধরা আছে, ছোঁয়াছুঁয়ি হলে আমার ভাল লাগবে না। তোমার নাম মাধবীলতা?

হ্যাঁ।

তোমার শাশুড়ির নাম জানো?

হ্যাঁ

এদিকে এসো। বলেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি। মাধবীলতা অবাক হয়ে গেল। কথাবার্তা যে খাতে চলছিল আচমকা যেন পাল্টে গেল। সে এক পা এগিয়ে বলল, আমার ট্রেনের জামাকাপড়, বাসি।

ও। এখনও ছাড়োনি কেন? এয়োস্ত্রীর বেশীক্ষণ বাসি কাপড়ে থাকতে নেই তা জানো না। মা বাবা নেই?

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, আছেন। গত

অনি যায় তাদের বাড়িতে?

না।

কেন?

মাধবীলতা মুখ ফেরাল। যা সত্যি তাই বলাই ভাল। সে হেমলতার দিকে আবার তাকাল, বিয়ের পর থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই।

ওমা! সেকি কথা। হেমলতা আর্তনাদ করে উঠলেন! শ্বশুরবাড়ি বাপের বাড়ি দূরে ঠেলে দিয়ে ছিলে এতদিন?

আমি ঠেলে দিইনি। ওঁরাই যোগাযোগ রাখেননি।

তুমি অনিকে খুব ভালবাসো, তাই না?

আর সঙ্গে সঙ্গে মাধবীলতার চিবুক বুকের ওপর নেমে গেল। এতগুলো বছরে যে গোপন সত্যটা তার একদম একার ছিল, যার মুখোমুখি সে কোনদিন হয়নি আজ এই বৃদ্ধা হঠাৎ তাকে যেন টেনে এনে সেখানে দাঁড় করিয়ে দিল। এতক্ষণের হীনম্মন্যতাবোধ যা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরছিল তা এই প্রশ্নের সঙ্গে মিশে গিয়ে কাঁপিয়ে দিল। ঠোঁট কামড়েও এবার নিজের চোখের জল আর শরীরের কাঁপুনি থামাতে পারল না সে।

হেমলতা হতভম্ব। তারপর ধীরে ধীরে মাধবীলতার সামনে এসে দাঁড়ালেন, বোকা মেয়ে, কাঁদবার কি আছে, বলতে পারছ না ভালবাসি!

মাধবীলতা আর পারল না, কান্নার দমক সামলাতে মাটিতে হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়ল। হেমলতা ত্রস্তে ওর দুই কাঁধ ধরে টেনে তুলতে চেষ্টা করলেন, ওঠো ওঠো, আরে এমন করে না, নতুন বউ প্রথম দিন বাড়িতে পা দিয়ে কাঁদলে অমঙ্গল হয়। ওঠো।

মাধবীলতার যে সামান্য চেতনা ছিল তাতেই সে সরে যেতে চাইল, আমাকে ছোঁবেন না, আমি এখনও বাসি।

দূর পাগলি। হেমলতা তাঁর ছোট্ট শরীর দিয়ে মাধবীলতাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর হঠাৎ পাগলের মত নিজেই মাধবীলতার শরীরে মাথা ঠুকতে লাগলেন, এতদিন কেন আসিসনি, কেন, কেন?

৩০. অনিমেষ চুপচাপ বসেছিল

মাধবীলতা অর্ককে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর অনিমেষ চুপচাপ বসেছিল চেয়ারে। এই বিশাল বাড়ির কোথাও কোন শব্দ নেই। এমন কি মাঝে মাঝে যে গোঙানিটা শোনা যাচ্ছিল সেটাও আপাতত স্তব্ধ। অনিমেষের হঠাৎ অস্বস্তি শুরু হল। এত নির্জনতা সহ্য করা যায় না। তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেনে দীর্ঘকাল থেকে নার্ভগুলো যাতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল তাতে এই ব্যতিক্রম সহ্য করা মুশকিল। অনিমেষ চোখ বন্ধ করল।

কোথায় যেন সুর কেটে গেছে। এই বাড়ি তৈরি হবার আগে থেকেই সে এখানে ছিল। শৈশব থেকে যৌবনের শুরু পর্যন্ত যেখানে কাটিয়েছে সেখানে এসে এই কয়েক মুহূর্তেই বুঝতে পারছে একটা বিরাট ফাঁক তৈরি হয়ে গেছে। পিসীমা তার সঙ্গে এমন নির্লিপ্ত ব্যবহার কোনদিন করেনি। পিসীমাকে আবেগহীন অবস্থায় সে কখনও দ্যাখেনি। এতগুলো বছরে পিসীমার চেহারার পরিবর্তন হয়েছে। বার্ধক্য ওঁর সারা শরীরে এমন ছাপ মেরেছে যে সেই পরিচিত চেহারাটাকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু মনেরও এমন পরিবর্তন হবে? এত সংযত, অনিমেষ এল অথচ তাঁর কোন বিকার নেই। যে পিসীমা তাকে অনিবাবা ছাড়া কথা বলতেন না তিনি ওরকম নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে পারলেন! আর ছোটমা! এ কোন ছোটমাকে দেখছে সে? মনে আছে, মহীতোষ যখন দ্বিতীয়বার বিবাহ করেছিলেন তখন তাঁর মধ্যে তো বটেই, ছোটমার মনেও এক ধরনের কুণ্ঠা কাজ করত। অনিমেষের সঙ্গে ব্যবহারেও ছোটমা সেই দুর্বলতা প্রকাশ করতেন। কিসে অনিমেষের ভাল লাগে তার সন্ধানে তৎপর থাকতেন সে সময়। কোনদিন মুখের ওপর কড়া কথা বলেননি। আর আজ এই মহিলাকে কঠোর, বুদ্ধিমতী এবং নিষ্ঠুর স্বভাবের মনে হল। সঙ্গে সঙ্গে আর একটা অপরাধবোধ অনিমেষের মনে মেঘের মত ধেয়ে এল। ছোটমা যখন মাধবীলতাকে আক্রমণ করছিলেন তখন বেচারা একটাও জবাব দেয়নি, কিন্তু সে কি করছিল? তার তো তুমুল প্রতিবাদ করা উচিত ছিল। নাকি এই বাড়িতে পা দেওয়ামাত্রই তারও একটা গোপন পরিবর্তন ঘটে গেছে, আচমকা সে নিজেকে এই বাড়ির মানুষ বলে ভাবতে আরম্ভ করেছে। সবই হয়তো ঠিক কিংবা পুরোটাই বেঠিক তবে সময় যে সম্পর্কের গায়ে অনেক ফুটো তৈরি করে দেয় এটা বোঝা গেল। অনিমেষ হঠাৎ সেই পুরোনো কালের অবেগটাকে বুকের মধ্যে আবিষ্কার করে চোখ বন্ধ করল।

কাছাকাছি কোথাও একটা ‘বউ কথা কও’ এমনভাবে ডেকে উঠল যে অনিমেষ চমকে উঠল। কতদিন বাদে সে পাখির ডাক শুনতে পেল। সে ঘরটার দিকে তাকাল। বোধ হয় তারা আসতে পারে ভেবেই এটাকে ভদ্রস্থ করা হয়েছে। কিন্তু তারা তো নাও আসতে পারত! তাহলে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে এঁরা নিশ্চয়ই আশা ছাড়েননি। এই ঘরে সে আগে কখনও থাকেনি। সেসময় নতুন বাড়ির এপাশটা ভাড়াটেদের দখলে ছিল। হঠাৎ দাদুর জন্যে অনিমেষের মনে ঢেউ উঠল। এই বাড়ি দাদু যেন রক্ত দিয়ে তৈরি করেছিলেন!

কিন্তু অবাক কাণ্ড, এরা কি বাবাকে না জানিয়ে তাকে টেলিগ্রাম করেছিলেন? ছোটকাকার কাছে জানা গিয়েছিল বাবার স্ট্রোক হয়েছে এবং শয্যাশায়ী। একটু আগে যে শব্দ কানে এসেছে তাতে বোঝা যাচ্ছে তিনি কথাও বলতে পারেন না। অথচ সে এতদূর থেকে অনেক দিনের পরে এল কিন্তু ছোটমা মাঝখানে দেওয়াল দিয়ে রাখছেন। স্ট্রোকের রুগী যদি উত্তেজিত হয় তাহলে খারাপ কিছু হতে পারে, অনিমেষ এইভাবে সমস্ত ব্যাপারটাকে মেনে নিতে চাইছিল কিন্তু পারছিল না।

এই সময় অর্ক ফিরে এল। তারপর সুটকেস খুলে একটা পাজামা বের করে পাশের ঘরে যেতে যেতে বলল, ওপাশের বারান্দায় তোমার জন্য জল দিয়েছি। তারপর একটু থেমে বলল, দারুণ বাড়ি, না? বোঝা যায় তোমরা এককালে বেশ বড়লোক ছিলে।

কোনকালেই ছিলাম না।

যাঃ। বড়লোক না হলে এত বড় বাড়ি তৈরি করা যায়?

যায়। একটা মানুষ তার সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে এই বাড়ি করে শেষ পর্যন্ত ভিখিরি হয়ে পড়েছিলেন। বাড়িটা করতেই তাঁর তৃপ্তি ছিল। অনিমেষ ধীরে ধীরে কথাগুলো বলল।

তোমার দাদু, না? ভদ্রলোক খুব বোকা ছিলেন, তাই না? পাজামার দড়ি বাঁধতে বাঁধতে ঘর থেকে বেরিয়ে এল অর্ক। আর সঙ্গে সঙ্গে উন্মত্তের মত চেঁচিয়ে উঠল অনিমেষ, চুপ কর! বোকা ছিলেন! যাঁকে চেন না জানো না তাঁর সম্পর্কে এমন কথা বলতে লজ্জা করল না। ননসেন্স! অনিমেষের শরীরে আচমকা ক্রোধ জন্মেই ছড়িয়ে পড়ল।

হতভম্ব হয়ে গেল অর্ক, কি আশ্চর্য! তুমি রেগে গেলে কেন?

চমৎকার! একটা সৎ সরল মানুষকে তুই ব্যঙ্গ করবি আর আমি চুপ করে থাকব!

আমি তো ব্যঙ্গ করিনি। তুমি বললে সব টাকা এই বাড়ির পেছনে শেষ করে দিয়েছেন উনি, এত বড় বাড়ি না করে কিছু টাকা রাখতে তো পারতেন। আমি তাই বোকামি বলেছি। আমি ভুল বলেছি?

নিশ্চয়ই! অনিমেষের উত্তেজনাটা কমছিল না, যে ব্যাপারটা বুঝিস না সে ব্যাপারে কখনও কথা বলবি না। তাছাড়া দাদুকে নিয়ে এসব কথা আমি শুনতে চাই না।

অনিমেষ মুখ তুলে দেখল অর্কর ঠোঁটে অদ্ভুত ধরনের হাসি চলকে উঠেই মিলিয়ে গেল। সে বলল, তোমাকে ধরব?

না। আমি একাই যেতে পারব। জামাটাকে খুলে রাখল অনিমেষ। এক রাত্রেই গেঞ্জিটা ঘেমো গন্ধ ছাড়ছে। খালি গায়ে বেশ আরাম লাগছিল। ক্রাচ দুটোয় ভর দিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। তারপর অর্কর দিকে তাকিয়ে সোজা বড় ঘরে চলে এল। ঘরের মেঝে এত মোলায়েম যে ক্রাচ ফেলতে হচ্ছে সাবধানে। ভেতরের বারান্দায় চলে আসতে ওর জ্যাঠামশাই-এর কথা মনে পড়ল। ও তখন স্কুলে পড়ে। জ্যাঠামশাই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলেন অনেকদিন। তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করতে চেয়েছিলেন দাদু। কেউ তাঁর কোন খোঁজ খবর করতে চায়নি। জ্যাঠামশাই-এর ব্যবহারই আত্মীয়স্বজনদের তাঁর সম্পর্কে নিস্পৃহ রেখেছিল! তবু সেই নিরুদ্দিষ্ট অবস্থাতেও জ্যাঠামশাই দাদুকে জ্বালাতেন। অনিমেষ ক্রমশ তাঁর চেহারা ভুলেই যাচ্ছিল। সেই জ্যাঠামশাই একদিন দাদুর অনুপস্থিতিতে এ বাড়িতে ফিরে এলেন। একা নয় পরিবার সমেত। তখন জেঠীমা যে আচরণ করেছিলেন, জ্যাঠামশাই নিজেকে বাড়ির লোক প্রমাণ করার জন্যে যে দুর্বল কথাবার্তা বলছিলেন তা আজ অনিমেষের মনে পড়ল। জ্যাঠামশাইয়ের পুরোনো বউকে সেদিন মেনে নিতে পারেননি হেমলতা। আজ তিনি কিভাবে মাধবীলতাকে মানতে পারেন? জ্যাঠামশাই-এর মত কোন অপরাধ সে করেনি কিন্তু এখন যেন মনে হচ্ছে ভূমিকার খুব বেশী পার্থক্য নেই। নেই তো, জ্যাঠামশাই তাঁর বৃদ্ধ বাবা এবং দিদির জন্যে কিছুই করেননি। তার বিরুদ্ধেও তো যে কেউ ওই এক অভিযোগ করতে পারে।

অর্ক লক্ষ্য করছিল ওই চিৎকারের পর বাবা কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছে। এতটা পথ হেঁটে এল কিন্তু ঠিক নিজের মধ্যে নেই। এমন কি বারান্দায় এসে বাগানের দিকে চেয়ে আছে। সে ডাকল, বাবা, মুখ ধোবে না? অনিমেষ ফিরে এল চেতনায়। প্রচণ্ড আফসোস হচ্ছে। কি হল এখানে এসে? এইসব যন্ত্রণার মধ্যে জোর করে তাকে টেনে নিয়ে এল মাধবীলতা। এই বাড়ি এবং ওই মানুষগুলোর প্রতি সে কোন কর্তব্যই তো করতে পারবে না। মগে জল তুলে অর্ক ঢেলে দিচ্ছিল। অনিমেষ এক হাতে মুখ ধুয়ে নিল, গলায় বুকে জল দিল। তারপর গামছা কিংবা তোয়ালের জন্যে অর্কর দিকে তাকাল। অর্কর ততক্ষণে মনে পড়েছে। নতুন ভোয়ালেটা সে ওপাশের বাথরুমে রেখে এসেছে। মা যদি এতক্ষণে ঢুকে পড়ে তাহলে ওটা– সে বলল, দাঁড়াও, দেখছি।

সেই সময় ছোটমা যে পেছনের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন তা ওরা লক্ষ্য করেনি। অর্ক বারান্দা থেকে নামবার আগেই ছোটমা বললেন, গামছা চাই? এইটে নাও। বারান্দার এক কোণে দড়িতে টাঙানো গামছা টেনে নিয়ে তিনি অনিমেষের হাতে দিলেন, তোমার বাবা যেতে বললেন!

বাবাকে বলেছেন?

হ্যাঁ। তুমি এসেছ শুনে অদ্ভুত চোখে তাকালেন। তারপর চুপচাপ হয়ে গেলেন। শুধু বললেন, ওকে ডেকে দাও। আমি বলেছি, হাত মুখ ধুয়ে আসছে।

চলুন, যাচ্ছি। অনিমেষ গামছাটা ফিরিয়ে দিয়ে ক্রাচ ঠিক করে নিল।

দাঁড়াও। আমি বলিনি তুমি তোমার বউ আর ছেলেকে নিয়ে এসেছ।

বলেননি?

না। তোমার কাকা আমাদের সব ঘটনা বলেছে কিন্তু ও শুধু জানে তুমি বিয়ে করে কলকাতায় আছ। যদি বলার দরকার মনে কর তুমিই বলবে।

অনিমেষ হাসল। তারপর ছোটমার পাশ কাটিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। চলার সময় ওর শরীরটা ওঠানামা করে ক্রাচের জন্য। অর্কর মনে হল বাবা বেশ শক্ত-মানুষের মত কথা বলছে। এই বাড়িতে এখন যে নাটকটা চলছে সেটাকে ধরতে পেরেছে। বাবাকে কি এখন দাদু খুব গালাগাল করবে? ছোটমাকে তার ভাল লাগছে না। কেমন কাঠ কাঠ কথাবার্তা। তারপরেই খেয়াল হল দাদু তো কথা বলতে পারেন না। ওই যে গোঙানিটা একটু আগে শোনা যাচ্ছিল সেটা তো দাদুর। তাহলে আর গালাগাল করবে কি করে? কৌতূহলী হয়ে সে অনিমেষের অনুসরণ করল।

মাঝখানের ঘরে এসে ছোটমা বললেন, একটু দাঁড়াও, চা খেয়ে যেও।

কেন?

তোমার সঙ্গে আমার কয়েকটা কথা আছে।

সেটা তো পরেও বলা যায়।

যায়। আচ্ছা–। ছোটমা এগিয়ে গেলেন পাশের ঘরের দিকে। অনিমেষ একবার নিজের শরীরের দিকে তাকাল। খালি গায়ে অস্বস্তি হচ্ছিল, একটা কিছু পরার কথা চিন্তা করেই বাতিল করল। আজকাল দুই হাত এবং বুক আগের তুলনায় বেশী পেশীযুক্ত হয়ে গেছে, খারাপ লাগে।

ছোটমার পেছন পেছন ডাইনিং রুমে চলে এল অনিমেষ। দাদু খুব শখ করে এই ঘরটা তৈরি করেছিলেন। পাথরের টেবিল আর সিমেন্টের চেয়ার মাঝখানে, বেসিন আর তারের বিরাট জানলা যাতে হাওয়া আসতে পারে খাওয়ার সময়। অনিমেষ দেখল ডাইনিং টেবিলের ওপর নানানরকমের কৌটো বোঝাই করা রয়েছে। বোঝা যাচ্ছে ওটা ব্যবহার করা হয় না।

ডাইনিং রুমের পাশের ঘরের পর্দা সরিয়ে ছোটমা অনিমেষকে ইঙ্গিত করলেন। আর তখনই অনিমেষের শরীরটা কেমন ভারী হয়ে গেল। সে ধীরে ধীরে দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। একটা বড় খাটে মহীতোষ শুয়ে আছেন। দরজায় দাঁড়ালে তাঁর মুখ দেখা যায় না কিন্তু শরীরের অনেকটাই চোখে পড়ে। ছোটমা চাপা গলায় বললেন, উত্তেজিত হলে তর্ক করো না।

অনিমেষ একটু অবাক হল। যে কথা বলতে পারে না সে তর্ক করবে কি করে? ছোটমা দরজা থেকে নড়লেন না। অনিমেষ ক্রাচের শব্দ তুলে ধীরে ধীরে খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই অবাক হয়ে গেল। এ কে? তার বাবা, মহীতোষ? চোখ বন্ধ, মুখময় সাদাকালোয় মেশানো দাড়ি, চোখের তলা ফোলা, খুবই শীর্ণ শরীর কিন্তু পেটটা বেশ উঁচু। চিৎ হয়ে পড়ে আছেন। মাথার পাশে একটা ঘণ্টা, ডান দিকে। এই মানুষটিকে সে চেনে না, তার স্মৃতির সঙ্গে কোন মিল নেই। মহীতোষ একটুও নড়ছেন না, অনিমেষ যে ঘরে এসেছে তাও টের পাননি।

অনিমেষ নিঃশব্দে খাটের পাশে বসল। বসে দরজার দিকে তাকাল। ছোটমা নির্জীব চোখে চেয়ে আছেন সেখানে দাঁড়িয়ে। তাঁর পেছনে ডাইনিং রুমে অর্ক। অনিমেষ আবার তার বাবার দিকে তাকাল। পেটের খানিকটা ওপর থেকে পা অবধি চাঁদরে ঢাকা দেওয়া আছে। ওর মনে হল মহীতোষ বোধ হয় ঘুমাচ্ছেন। আর তখনি চোখ খুললেন মহীতোষ। একটা পানসে দৃষ্টি সরাসরি অনিমেষের মুখের ওপর পড়ল। প্রথমে কোন প্রতিক্রিয়া হল না, তারপর কপালে ভাঁজ পড়তেই দৃষ্টিটা পাল্টে গেল। মুখ খুলে গেল এবং একটা গোঙানি ছিটকে এল। একদম অস্পষ্ট নয়, অনিমেষের মনে হল মহীতোষ জিজ্ঞাসা করছেন, কে, কে? গোঙানিটা শুনেই বুকের ভেতরটা ধক করে উঠেছিল। অনিমেষ চট করে ডান হাত মহীতোষের পায়ের ওপর রাখল। মহীতোষের দুটো চোখ বিস্ফারিত, মুখ হাঁ হয়ে গিয়েছে। যেন খুব অবাক হয়ে গিয়েছেন তিনি। চোখ ঘুরিয়ে এবার কাউকে খুঁজতে চেষ্টা করলেন। গোঙানিটা আবার শুরু হতে ছোটমা দরজা ছেড়ে ওঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন। অনিমেষ দেখল ছোটমাকে দেখতে পেয়ে মহীতোষ যেন কিছুটা শান্ত হলেন। তারপর ওঁর ডান হাত সামান্য ওপরে উঠে অনিমেষের দিকে নির্দেশ করল। ছোটমার মুখে কোন স্পন্দন নেই, অনুত্তেজ উচ্চারণ, অনিমেষ।

হাতটা ধীরে ধীরে বিছানায় নেতিয়ে পড়ল। মহীতোষের দুটো চোখের দৃষ্টি স্থির, অনিমেষের মুখের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকলেন। অনিমেষ আবার কেঁপে উঠল। কোন খুনের আসামী অথবা বিশ্বাসঘাতকের দিকে মানুষ কি এইভাবে তাকায়? একটুও ভালবাসা নেই, আগ্রহ নেই, এমন কি সামান্য করুণাও নেই! মহীতোষের মুখ একটু বেঁকে রয়েছে, বাঁ দিকটা প্রাণহীন কিন্তু চোখ বেশ সজাগ। উনি বাঁ চোখে দেখতে পাচ্ছেন কিনা বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু অনিমেষ ওই চাহনি সহ্য করতে পারছিল না। অথচ এখান থেকে উঠেও যাওয়া যায় না, বসে থাকাও কষ্টকর। আবার গোঙানি শোনা গেল, এবার যেন খুব কষ্ট করে গোঙানি থেকে শব্দগুলো আলাদা করতে পারলেন মহীতোষ, তুমি এলে!

ছোটমা মুখ ফিরিয়ে নিলেন। নিয়ে ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। অনিমেষ শেষ পর্যন্ত কথা বলতে পারল, কেমন আছ, বাবা?

আর তখনি মহীতোষের দু চোখের কোণে জলবিন্দু জেগে উঠল, উঠে বিস্ফারিত হওয়ায় গড়িয়ে পড়ল দুই গাল বেয়ে। অনিমেষ অসহায় চোখে কান্নাটাকে দেখল। এবং সে আবিষ্কার করল তার গলায় কোন শব্দ আসছে না, শরীর কাঁপিয়ে একটা কান্না বুকের মধ্যে পাক খাচ্ছে। এবং সেই মুহূর্তে সে জানলায় অর্ককে দেখতে পেল। দেখে প্রাণপণে আবেগটাকে প্রশমিত করার চেষ্টা করল। তারপর অন্য রকম গলায় বলল, বাবা!

মহীতো চোখ বন্ধ করলেন। জমে থাকা জল উপচে এল গালে। এইভাবে চোখের জল দেখতে পারা যায় না। অনিমেষের ইচ্ছে করছিল কাছে গিয়ে সেটা মুছিয়ে দেয়। কিন্তু খাটের এক পাশ থেকে উঠে অন্য পাশে যেতে তাকে যে পরিশ্রম করতে হবে সেটা ইচ্ছে নষ্ট হয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।

মহীতোষ চোখ খুললেন, তারপর জড়ানো খুবই অস্পষ্ট গলায় কিছু বললেন। অনিমেষ এবার তার একবিন্দুও বুঝতে পারল না। সে জিজ্ঞাসা করল, কি বলছেন?

মহীতোষ আবার উচ্চারণ করলেন কিন্তু এবার সেটা গোঙানি হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত তাঁর ডান হাত উঠল, উঠে অনিমেষের ক্রাচদুটো দেখাল।

অনিমেষ এবার মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, আমি হাঁটতে পারি না।

সেটা শোনামাত্র মহীতোষ অদ্ভুত ম্লান হাসলেন। তাঁর শরীর সামান্য কাঁপল। তিনি আবার কথা। বলতে চেষ্টা করলেন। অনিমেষ কিছুই বুঝতে পারছিল না। মহীতোষও সেটা ধরতে পেরেছিলেন। তিনি হঠাৎ জোরে চিৎকার শুরু করে দিলেন। এই গোঙানিটাই অনিমেষরা ওপাশের ঘরে বসে প্রথম শুনতে পেয়েছিল। শব্দ করছেন আর মুখ ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকাবার চেষ্টা করছেন। অনিমেষ ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে তড়িঘড়ি বলে উঠল, আপনি শান্ত হন, ওরকম করবেন না। আপনার শরীর খারাপ হবে।

এই গোঙানি অর্ককে দরজা থেকে ঘরের মধ্যে টেনে এনেছিল। সে অবাক হয়ে বৃদ্ধকে দেখছিল। আর একবার মুখ ফেরাতেই মহীতোষ অর্ককে দেখতে পেলেন। আচমকা তাঁর চিৎকার থেমে গেল। হতভম্বের মত তিনি অর্ককে দেখতে লাগলেন। অনিমেষ লক্ষ্য করল মহীতোষের শরীর স্থির হয়ে গিয়েছে। তাঁর চোখ অর্কর মুখের ওপর স্থির, একবার ফিরে এল অনিমেষের ওপর। অনিমেষ বলল, আমার ছেলে।

এইসময় ছোটমা হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলেন, কি হয়েছে? খুব উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল তাঁকে। ঘরে ঢুকে অর্ককে দেখে তাঁর মুখ গম্ভীর হল।

ছোটমার উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্র মহীতোষ যেন পাল্টে গেলেন। আবার গোঙানির স্বরে কি একটা বলতে বলতে ডান হাত ছোটমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। ছোটমা সামান্য বিরক্ত-গলায় বললেন, হ্যাঁ, তাতে কি হয়েছে? তুমি তো জানো ওর ওপর পুলিস অত্যাচার করেছিল, সেই থেকে হাঁটতে পারে না। আর এ হল অনির ছেলে।

অর্ক দেখল বৃদ্ধ তার দিকে আবার তাকাচ্ছেন। ওই গোঙানি কিংবা জড়ানো স্বরের অর্থ তারা বুঝতে পারেনি কিন্তু ছোটমার কাছে তা অস্পষ্ট নয়। সে কি প্রণাম করবে? শায়িত মানুষকে প্রণাম করা ঠিক হবে? মহীতোষ আবার কিছু বললেন। ছোটমা ঘাড় ঘুরিয়ে সেটার তর্জমা করে দিলেন, তোমাকে কাছে ডাকছেন।

অর্ক এগিয়ে গেল। মহীতোষের ডান পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি হাতের ইশারায় বসতে বললেন খাটের ওপর। অর্ক অনিমেষের দিকে একবার তাকিয়ে আলতো ভঙ্গীতে বিছানায় বসল। মহীতোষ আবার শব্দ করতেই ছোটমা বললেন, তোমার নাম জিজ্ঞাসা করছেন।

অর্ক।

মহীতোষের চোখ ছোট হল, তিনি ছোটমার দিকে তাকালেন। ছোটমা বললেন, ও বলছে ওর নাম অর্ক। মহীতোষের ঠোঁটে এবার হাসি ফুটল। তাঁর ডান হাত এবার অর্কর হাতের ওপর উঠে এল। শীতল হাত। মহীতোষ আবার কিছু বলতে চাইলেন কিন্তু একমাত্র গরীব শব্দটি ছাড়া ওরা অন্য কিছু বুঝতে পারল না।

অনিমেষ এবার ছোটমাকে জিজ্ঞাসা করল, ওঁর চিকিৎসা ঠিক মত হচ্ছে?

যেটুকু সম্ভব। ওষুধে আর কি হবে! পরে এসব কথা বলা যাবে। ছোটমা যেন প্রসঙ্গটা এই সময়ে আর বাড়াতে চাইছিলেন না।

ঠিক তখন হেমলতার গলা পাওয়া গেল। চিৎকার করে ছোটমাকে ডাকছেন। ছোটমা বললেন, দেখা তো হয়ে গেল। এবার চল, বোধ হয় দিদি তোমাদের খেতে ডাকছেন।

অনিমেষ বলল, এদিকের বাথরুমটা ব্যবহার করা হয়?

হ্যাঁ।

খাট থেকে নেমে এল অনিমেষ। বগলে ক্রাচ দুটো খুঁজে হাঁটতে গিয়ে তার চোখ আবার মহীতোষের ওপর পড়ল। মহীতোষের চোখে সেই ছবিটা আবার ফিরে এসেছে। অনিমেষ মাথা নিচু করে বাইরে বেরিয়ে এল। ওপাশের বাথরুমে পৌঁছাতে কয়েকটা পা-মাত্র কিন্তু সেটাকেই দীর্ঘ মনে হচ্ছিল। ভেতরে ঢুকে অনিমেষ কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে রইল। এমন করে নিজেকে তার কখনও অপদার্থ মনে হয়নি। মহীতোষের দৃষ্টিটা যেন তার সমস্ত সত্তাকে ফালা ফালা করে দিয়েছে। কি করলে অনিমেষ? এতদিন ধরে তুমি কি করলে?

.

ছোটমা অর্ককে ডাকলেন, চল।

মহীতোষ মাথা ঘুরিয়ে স্ত্রীকে দেখে আবার কিছু বলতে চাইলেন, অর্ক তার কিছুই বুঝতে পারল। একটু বিব্রতভঙ্গীতে ছোটমা বললেন, এসেছে। দিদির কাছে আছে। একটু বাদেই আসবে, চা খেয়ে নিক।

অর্ক এবার বুঝল। এই বৃদ্ধটিকে তার খারাপ লাগছিল না। শুধু কথা বুঝতে পারা যায় না, এই যা। বাবার বাবা। কতকাল পরে দুজনের দেখা হয়েছে কিন্তু উনি কোন কথাই বলতে পারলেন না। সে ছোটমার সঙ্গে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। হাঁটতে হাঁটতে ছোটমা জিজ্ঞাসা করলেন, কোন ক্লাশে পড় তুমি?

অর্ক উত্তর দিতেই ফের প্রশ্ন, কত বয়স তোমার?

এবার জবাবটা শুনে ছোটমা বিস্মিত চোখে তাকালেন কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। অর্কর মনে হল ভদ্রমহিলা তাদের ঠিক মেনে নিতে পারছেন না। বারান্দার দিকে যেতে যেতে ছোটমা বললেন, দ্যাখো তো, তোমার মা হাত মুখ ধুয়ে এসেছে কিনা! এলে রান্নাঘরে আসতে বলো।

অর্ক ওদের জন্যে নির্দিষ্ট ঘরটিতে এসে দেখল কেউ নেই। বাড়িটা কেমন খাঁ খাঁ করছে। সে আবার বেরিয়ে এল। ভেতরের বারান্দায় পা দিয়ে দেখল ছোটমা রান্নার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন, এ কি, এখনও বাথরুমে যাওনি?

হেমলতার গলা পাওয়া গেল, ওমা তাই তো, কথা বলতে বলতে খেয়ালই নেই। আমার আবার কথা বলতে আরম্ভ করলে হুঁশ থাকে না। এই জন্যে বাবা আমাকে কম কথা শোনাতো? চিরকাল তো এই বাড়িতে দাসীবৃত্তি করে গেলাম, যে পারে সেই কথা শোনায়। যাও যাও, বাথরুম থেকে ঘুরে এস।

অর্ক দেখল মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে ওপাশের বাথরুমের দিকে চলে গেল। এইবার ছোটমার চাপা গলা কানে এল অর্কর, আপনার স্বভাব গেল না।

কেন? আমি আবার কি করলাম!

চেনা নেই শোনা নেই যে আসছে তার কাছেই এমন সব কথা বলেন! আচ্ছা, আপনাকে কি এ বাড়ির দাসী করে রাখা হয়েছে? আপনি বলতে পারলেন?

দাসী ছাড়া আর কি! মেয়েছেলে হয়ে জন্মানো মানেই তো দাসীবৃত্তি করা। হয় বাপের নয় ছেলের, স্বামী বা ভায়ের। কিন্তু এই মেয়েটা মনে হয় বেশ ভাল, অনির খুব পছন্দ আছে। হেমলতা স্বচ্ছন্দে বললেন।

এটুকু সময়ের মধ্যে বুঝে গেলেন মেয়েটা ভাল!

তা ঠিক। মানুষের মনের মধ্যে কি আছে তা ওপর থেকে কি করে বুঝব! মুখ দেখে তো তাই মনে হল। তবে ওদের অবস্থাও ভাল না।

কি করে বুঝলেন?

গায়ে এক ফোঁটা সোনা নেই। নতুন বউ বাড়ি এল গয়না ছাড়া।

নতুন বউ আবার কোথায়? অত বড় ছেলে যার।

ওঃ, ছেলেটা কিন্তু অবিকল অনির মত হয়েছে। আমি তো প্রথমবার দেখে চমকে উঠেছিলাম। সেই স্কুল-পাশ করা অনি যেন এসে দাঁড়িয়েছে। আর আমাদের অনিকে কিন্তু আমি চিনতেই পারিনি। মনেই হয় না সেই অনি। আজ বাবা বেঁচে থাকলে।

আবার কাঁদতে শুরু করলেন?

আর কি করব! এখন তো শুধু এই কান্নাটুকুই আছে?

আপনি সরুন, আমি ভেজে দিচ্ছি।

এইভাবে কথা শোনা উচিত নয়। অর্ক সরে আসতে গিয়ে দেখল হেমলতা রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন। অর্ক ইচ্ছে করেই বারান্দা থেকে বাগানে নামল! সে যেন কিছুই শুনতে পায়নি।

হেমলতা তাকে দেখে এগিয়ে এলেন, দাদুর সঙ্গে দেখা হয়েছে?

মাথা নাড়ল অর্ক। হ্যাঁ।

কথা বলতে পারে না। এক পাশ পড়ে গিয়েছে। যা বলে তা ওই ছোট বুঝতে পারে ভাল, আমিও সব পারি না। ছোট বউ কে বুঝতে পারছ? তোমার ছোটদিদিমা। বড়দিদিমা অনেক বছর আগেই স্বর্গে গিয়েছে, তার নাম ছিল মাধুরী। তোমার বাবা কোথায়?

ভেতরে।

তুমি তো বাবার দাদুকে দ্যাখোনি, এই বাড়ি উনি করেছেন! খুব রাগী লোক ছিলেন। তবে তোমার বাবাকে খুব ভালবাসতেন। হেমলতা হাসলেন।

এই সময় মাধবীলতা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল ভেজা জামাকাপড় নিয়ে। হেমলতা তাই দেখে বললেন, এইখানে মেলে দে, এই তারে।

অর্ক একটু অবাক হল। এর মধ্যেই মাকে ইনি তুই বলছেন? ওর খুব ভাল লাগল বৃদ্ধাকে। সে কি বলে ডাকবে? ঠাকুমা!

মাধবীলতা ঘোমটা বাঁচিয়ে কাপড় মেলে দিল। অর্ক দেখছিল, মাকে আজ একদম অন্যরকম দেখাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে হেমলতা জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁরে, তোর এত বড় ছেলে কবে হল? কত বয়স ওর?

মাধবীলতা আড়চোখে ছেলেকে দেখে বলল, পনের পার হয়ে গেল।

ও বাবা! এত বড়!

এই সময় ছোটমা বেরিয়ে এলেন, অর্ক, তোমার বাবাকে ডেকে নিয়ে এসো। জলখাবার খাবে।

হেমলতা বললেন, খোঁড়া মানুষ এখানে আসতে পারবে কি! ওরটা ঘরেই পাঠিয়ে দিলে হয়। যাও, বাবাকে বল, খাওয়ার ঘরে গিয়ে বসতে।

অর্ক চলে গেলে মাধবীলতা বলল, আমাকে দিন আমি নিয়ে যাচ্ছি। ছোটমা অর্কর চলে যাওয়া দেখছিলেন, পনের ষোল বছর বলে একদম মনে হয় না। ওর জন্মসাল কবে?

মাধবীলতা উত্তর দিল। তাতে পনের যে পেরিয়ে গেছে তা বোঝা গেল।

তখন তো অনি এম এ পড়ত। কি বলছ তুমি?

না। তখন পড়া ছেড়ে দিয়েছিলো। আমার এম এ পরীক্ষা হয়ে গিয়েছিল। মাধবীলতার খুব সঙ্কোচ হচ্ছিল, সে জুড়ে দিল, আমি তখন চাকরি করি, ও জেলে ছিল।

হেমলতা জিজ্ঞাসা করলেন, জেলে থাকলে বিয়ে হল কখন?

জেলে যাওয়ার আগে।

তোমার বাবা বিয়ে দেননি নিশ্চয়ই। ছোটমা প্রশ্ন করলেন।

না।

তোমরা নিজেরাই বিয়ে করেছিলে?

মাধবীলতা মাথা নিচু করল।

সই করে বিয়ে করেছিলে তাহলে? ছোটমার গলায় কি সন্দেহ।

মাধবীলতা ক্রমশ জড় হয়ে পড়ছিল। কোন রকমে বলল, না।

তাহলে? ছোটমার গলার স্বর সিরসিরে।

এইবার হেমলতা চেঁচিয়ে উঠলেন, ও বুঝেছি। কালীঘাটের বিয়ে। বাবার কাছে শুনেছি কালীঘাটে গেলে পুরুত ঠাকুরের সামনে বিয়ে দিয়ে দেয়।

ওই বিয়ে তো আইনসিদ্ধ নয়। ছোটমার গলা এবার শক্ত।

তাই নাকি? হেমলতা যেন অবাক হয়ে গেলেন! তাহলে কি হবে?

ছোটমা বললেন, ভেবে কি করবেন? কপালে যা লেখা আছে তাই মানতে হবে। আপনি কি কখনও ভাবতে পেরেছিলেন অনি খোঁড়া হবে? কথাটা শেষ করে রান্নার ঘরে ঢুকে গেলেন ছোটমা। মাধবীলতা পাথরের মত দাঁড়িয়েছিল। এই সময় দু হাতে দুটো থালায় খাবার নিয়ে ছোট মা বেরিয়ে আসতেই মাধবীলতার চেতনা ফিরল। সে এগিয়ে এল থালা দুটো নেওয়ার জন্যে। কিন্তু ছোটমা তার দিকে লক্ষ্য না করে সোজা বারান্দায় উঠে ঘরের দিকে এগোতে থাকলেন। মাধবীলতা থমকে গেল। ওর মনে হল ছোটমা যেন ইচ্ছে করেই খাবারের থালা তার হাতে দিলেন না।

খাওয়ার টেবিল থেকে জিনিসপত্র নামিয়ে অর্ক একা বসেছিল। ছোটমা সেখানে থালা দুটো রেখে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার বাবা কোথায়?

ঘরে। অর্ক লুচিগুলোর দিকে তাকাল।

ছোটমা আবার বড় ঘরটা পেরিয়ে অনিমেষদের জন্যে নির্দিষ্ট ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন। অনিমেষ চুল আঁচড়াচ্ছিল। ছোটমা বললেন, খাবার দিয়েছি।

যাচ্ছি। অনিমেষ চিরুনি রাখল।

একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি, তোমাদের কি কালীঘাটে বিয়ে হয়েছিল?

অনিমেষ অবাক হয়ে তাকাল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, না তো!

৩১. অনিমেষ হো হো করে হেসে উঠল

অনিমেষ হো হো করে হেসে উঠল। যেন খুব মজার কথা শুনছে এমন ভঙ্গীতে বলল, আপনাদের মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?

ছোটমা একটু থিতিয়ে গেলেন। কিন্তু সন্দেহটা স্পষ্টই প্রকাশ করলেন এবার, তোমরা কালীঘাটে গিয়ে মালাবদল করোনি?

কথা বলার সময়েই অনিমেষ ঠাওর করতে চাইছিল ছোটমা এসব কথা বললেন কেন? মাধবীলতার সঙ্গে কি এ বিষয়ে কোন আলোচনা হয়েছে। কি বলেছে সে? আর যাই হোক মাধবীলতা কালীঘাটের বিয়ের কথা নিশ্চয়ই বানিয়ে বলতে যাবে না। সে হাসিহাসি মুখেই বলল, এসব কে শোনালো?

যেই শোনাক আমি তোমার মুখেই সত্যি কথাটা শুনতে চাই।

ছোটমার মুখ দেখে এবার অনিমেষের মনে হল ব্যাপারটা আর হাসিঠাট্টার মধ্যে নেই। কিন্তু সেই সঙ্গে তার মনটা তেতো হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ তাদের বিয়ে নিয়ে এদের এত চিন্তার কি প্রয়োজন? সে ধীরে ধীরে খাটের ওপর বসল, কালীঘাটের বিয়েতে আপনার আপত্তি আছে?

হ্যাঁ আছে। ওটা কোন বিয়েই নয়।

অনিমেষ এবার মুখ তুলল সরাসরি, না, আমাদের কালীঘাটে বিয়ে হয়নি। ওসব খুব ছেলেমানুষী।

ছোটমার বুক থেকে যেন একটা রুদ্ধ বাতাস বেরিয়ে এল, কিন্তু তোমার বউ যেন সেরকমই—। কোথায় বিয়ে হয়েছিল?

অনিমেষ বলল, এসব কথা নিয়ে আর আমি আলোচনা করতে চাই না। আমাদের বিয়ে হয়েছে অতবড় ছেলে রয়েছে, ব্যাস, সেটাই শেষ কথা। কোথায় হয়েছে কিভাবে হয়েছে তা এত বছর বাদে জেনে লাভ কি!

ছোটমার মুখ এবার গম্ভীর, আমি চেয়েছিলাম তোমার জ্যাঠামশাই আর তুমি যেন এক না হয়ে যাও। ভগবান!

মানে? অনিমেষ ঈষৎ চমকালো।

তোমার জ্যাঠামশাই কোথায় কিভাবে বিয়ে করেছিলেন এ বাড়ির কেউ তা জানেন না। তোমার দাদু কখনই তাঁর সেই বিয়েকে মানেননি তাই ওদের জায়গা হয়নি এখানে। এখন তো সম্পত্তি নিয়ে মামলা চলছে। তোমার কাকার সঙ্গে তিনি দেখা করেছিলেন। তোমার বিয়ের কথা নাকি তিনি জেনেছেন। আর তারপর থেকে বলে বেড়াচ্ছেন একটা অজাত কুজাতের মেয়েকে ধরে এনে ঘরে তুলেছ তুমি। তাঁর বেলায় যদি শাস্তি দেওয়া হয় তাহলে তোমাকে কেন খাতির করা হবে। কথাগুলো বলতে বলতে ছোটমার চোখ জলে ভরে গেল।

অনিমেষ মুখ ফেরাল, আমি তো তোমাদের খাতির চাইনি।

এভাবে কথা বলতে পারছ? তোমার মনে কি একটুও দয়ামায়া নেই। শুনেছি তুমি মানুষ খুন করতে–।

মানুষ খুন করতাম! কে বলল?

শুনেছি। তুমি খুন করেছ বলেই পুলিশ তোমার এই অবস্থা করেছে।

হয়তো। তা জেনেশুনে আমাকে ডেকে আনলে কেন? এত বছর তো আমি তোমাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ করিনি। আমি আমার মত ছিলাম। বাবা অসুস্থ এই টেলিগ্রাম পাঠিয়ে আসতে বললে কেন?

আমি কি ভেবেছি তুমি এত দূরে সরে গেছ? এত! খাবারের থালাটাকে ঘরে রেখে ছোটমা বেরিয়ে গেলেন। অনিমেষ সেই যাওয়াটা দেখল। খিদে পেয়েছে, অনর্থক এসব নিয়ে মাথা গরম করার কোন মানে হয় না। অনিমেষ খাবারের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল, সে কি সত্যি পাল্টে গেছে? এরকম পরিস্থিতিতে সে কি আগে খেতে পারত? জ্যাঠামশাই হলে কিছু গায়ে মাখতো না। অবলীলাক্রমে খেয়ে নিত। সত্যি তো, দুজনের ক্ষেত্রে দুরকম শাস্তি হবে কেন?

.

মাধবীলতা একটা লুচি ভেঙে কোনরকমে গলা দিয়ে নামিয়েছিল। তার সামনে বসেছিলেন হেমলতা। জিজ্ঞাসা করলেন, কি হল, আর খাবে না?

আর ভাল লাগছে না পিসীমা।

কেন?

মাধবীলতা মুখ নামাল। সত্যি, তার শরীর গোলাচ্ছিল। সেই কষ্টটাই খোলামনে বলল সে। সঙ্গে সঙ্গে সরল গলায় হেমলতা শুধালেন, ওমা, বাচ্চাকাচ্চা হবে নাকি তোমার?

ভূত দেখার মত চমকে উঠল মাধবীলতা। সোজা হয়ে বসে বলল, না, না।

তাহলে গা গোলাচ্ছে কেন? খেয়ে নাও। কখন ভাত হবে কে জানে!

মাধবীলতা এই বৃদ্ধার দিকে তাকাল। মানুষটির যে গল্প সে অনিমেষের মুখে শুনেছে তার সঙ্গে কোন অমিল নেই। এত সরল এবং সহজেই কাছের মানুষ করে নেওয়ার ক্ষমতা আজকাল খুব কম লোকের থাকে। কিন্তু ছোটমার বর্ণনার সঙ্গে এখনকার চেহারা এবং চরিত্র মোটেই মিলছে না। বিয়ে নিয়ে উনি এমন নাছোড়বান্দা হলেন যে কিছুতেই সেটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে না সে। হেমলতার মুখের দিকে তাকিয়ে মাধবীলতার এবার মনে হল ছোটমা অন্যায় কিছু করেননি। ওঁদের তো কৌতূহল থাকতেই পারে। হাজার হোক অনিমেষ এ বাড়ির একমাত্র ছেলে। সম্পর্ক না রাখলেও আজ যখন এঁরা ওকে চোখে দেখতে পাচ্ছেন তখন—হঠাৎ মাধবীলতার মনে হল সে অন্যায় করেছে। জেল থেকে বের হবার পর অনিমেষকে জোর করে ধরে রাখার কোন কারণ ছিল না। শুধু তাকে ভালবাসার জন্যে অনিমেষকে এতবছর ধরে বস্তির ওই ঘরে কষ্ট পেতে হয়েছে। এতবড় বাড়ি, এই সুন্দর বাগান যার, তাকে ওই অন্ধকূপে আটকে রাখার কোন মানে হয় না।

হেমলতা চা ঢালতে ঢালতে বললেন, আমাদের বাড়িতে অনেকদিন বাদে আজ চা হল। এই চা পাতাগুলো অনেক পুরোনো। কেমন হবে কে জানে। আমি বাবা চা বাগানে জন্মেও ভাল চা বানাতে পারি না।

মাধবীলতা দ্বিতীয় লুচিটি মুখে দিয়েছিল, জিজ্ঞাসা করল, আপনারা চা খান না বুঝি!

না। মহী তো শুয়েই আছে। ছোট বউ খায় না। আমার অভ্যেস নেই।

তাহলে আমাদের জন্যে মিছিমিছি করতে গেলেন কেন?

ওমা, আমরা খাই না বলে তোমরা খাবে না কেন? তোমার ছেলে চা খায়?

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, ওর তেমন ঝোঁক নেই।

তাহলে ওকেও দিই একটু। হ্যাঁ গো, কালীঘাটের বিয়েতে কি কি হয়?

মাধবীলতা গম্ভীর হতে গিয়েও হেসে ফেলল, পিসীমা, বিশ্বাস করুন, আমি ওই ব্যাপারে কিছুই জানি না। কালীঘাটে আমাদের বিয়ে হয়নি।

সে কি কথা! তখন যে ছোটবউ বলল?

উনি বললেন, কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই…। মাধবীলতা কথা শেষ করল না। কারণ ছোটমা এসে দাঁড়িয়েছিলেন দরজায়। তাঁকে দেখে হেমলতা বললেন, এই ছোট, অনি কালীঘাটে গিয়ে বিয়ে করেনি।

শুনলাম। চা হয়েছে?

হ্যাঁ। এই যে। লোকে যে কেন মিছিমিছি বদনাম ছড়ায়।

লোকে নয়, আপনার ভাই।

ওঃ, কি বদমাস, কি বদমাস। জানো, বাড়ির জন্যে মামলা করছে আবার মাঝে মাঝে এসে কথা শুনিয়ে যাচ্ছে।

একটা থালায় দুটো কাপ তুলে নিয়ে ছোটমা বললেন, মুখে এসব বলছেন আর তিনি এলে তো ভিজে কাদা হয়ে যান। তারপর চা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন বড় বাড়ির দিকে। আর সঙ্গে সঙ্গে ডুকরে কেঁদে উঠলেন হেমলতা, কী করব! নিজের ভাই হাজার হলেও। মুখের ওপর খারাপ কথা বলতে পারি না যে। ভগবান যে আমাকে আর কত যন্ত্রণা দেবেন কে জানে!

মাধবীলতা কি করবে বুঝতে পারছিল না। হেমলতাকে কাঁদতে দেখে ওর শরীরের অস্বাভাবিকতা যেন চট করে মিলিয়ে গেল। সে শুধু বলতে পারল, পিসীমা কাঁদবেন না।

হেমলতা আঁচলে মুখ চোখ মুছতে মুছতে বললেন, কোথায় কাঁদছি! আর তারপরেই খুব স্বাভাবিক গলা বেরিয়ে এল তাঁর, কি রান্না হবে জানি না।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, খানিকটা ভেবেই, আপনাদের বাজার কে করেন?

কে আর করবে? একে ধরে ওকে ধরে আনাতে হয়। বাজার তো অনেক দূর। বাবা বেঁচে থাকতে নিজেই করতেন। শেষের দিকে আর পারতেন না। তখন থেকে পাশের এক নেপালি ছোঁড়াকে ধরে আনানো হয়। আর বাজারই বা কি। আলু পটল কুমড়ো। মহীতোষ ব্যাঙ্ক থেকে যে সুদ পায় তাতেই চালাতে হয়। মাসে সাতশ টাকা। মাছ মাংস ডিম তো এ বাড়িতে হয় না। তার ওপর মামলার খরচ আছে। হেমলতা এখন একদম স্বাভাবিক। একটু আগের ডুকরে কেঁদে ওঠার সঙ্গে এই চেহারা একদম মেলে না। মাধবীলতা ওই ছোট্ট পাখির মত শরীরটার দিকে অপলক তাকিয়েছিল। কথাটা শুনেই তার মাথায় চিন্তাটা ঢুকে পড়ল। অর্ককে পাওয়া দরকার। কিন্তু এ বাড়ির অনেকটাই তার এখনও অচেনা। সে ছেলে কোথায় গিয়ে বসে আছে কে জানে! তাছাড়া প্রথম দিনেই আগ বাড়িয়ে কিছু করতে গেলে এঁদের সেটা কেমন লাগবে তাও সে বুঝতে পারছে না।

হেমলতা বললেন, তাড়াতাড়ি চা খাও, ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। মহীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।

.

একা একা খাবারগুলো শেষ করতে করতে অর্ক ভাবছিল, জায়গাটা অদ্ভুত। কোথাও কোন শব্দ নেই শুধু পাখির ডাক ছাড়া। কি করে যে ওঁরা এখানে থাকেন তা সে বুঝতে পারছিল না। এই বাড়িতে সে বেশীদিন থাকতে পারবে না। পাশের ঘরের দিকে তাকাল অর্ক। দাদুর কোন শব্দ শোনা যাচ্ছে না। মানুষটা বিছানায় পাথরের মত পড়ে আছেন। এরকম বেঁচে থাকার কি মানে? কিন্তু লোকটা বোধহয় ভাল। ওঁর হাতটা কিন্তু খুব ঠাণ্ডা। এইসময় ছোটমা চা নিয়ে এলেন। সামনে রেখে বললেন, তোমার স্কুল এখন খোলা?

হ্যাঁ। অর্ক চায়ের দিকে তাকাল। চায়ের বদলে ওটাকে দুধ বলাই ভাল। ও বুঝতে পারছিল না এরা তাকে ছোট ভেবে ওইরকম চা দিচ্ছেন কিনা।

ছোটমা অর্ককে দেখছিলেন। লম্বা, মুখের আদলে কিশোর অনিমেষ আছে কিন্তু কেমন যেন একটা চোয়াড়ে চোয়াড়ে ভাব। তাকানো স্বাভাবিক নয়। মাথার চুলে কেমন একটা যেন অস্বস্তিকর ব্যাপার আছে। চা খেয়ে অর্ক বলল, আমি বাড়িটা ঘুরে দেখতে পারি?

কথা না বলে ছোটমা ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ। অর্ক যেন বেঁচে গেল। ছোটমা দাঁড়িয়ে রইলেন সেখানেই। অর্ক কিছুক্ষণ আগে একটা সিঁড়ি দেখতে পেয়েছিল। ডানদিকের কোনায় সেই সিঁড়ি বেয়ে সে ওপরে উঠতে লাগল।

অনেককাল বোধহয় কেউ এখানে পা দেয়নি। পুরু ধুলো, পাখির ময়লা ছড়িয়ে আছে। এটা ছাদে ওঠার সিঁড়ি। সিঁড়ির মুখের দরজাটা বন্ধ। বেশ চাপ দিয়ে সেটাকে খুলে পা বাড়াতেই অর্ক অবাক হল। এত বড় ছাদ! বাড়িটার ভেতরে ঢুকলে বোঝা যায় না যে এত বড়। তার পরেই নজরে এল দুপাশের সবুজ গাছপালা। মাথার ওপর এখন কড়া রোদ। অর্ক ছাদের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। ওপাশে একটা ফাঁকা মাঠ, মাঠের গায়েই বাঁধ। আর বাঁধের ওপারে নদী। বিশাল নদী। কিন্তু জল খুব অল্প। যতদূর নজর যায় শুধু বালি আর বালি। তাহলে ওটাই তিস্তা নদী। আর এই প্রথম জায়গাটাকে ভালবেসে ফেলল অর্ক। তার মনে হল ঊর্মিমালা যদি এখানে আসতো তাহলে দেখে দেখে সুন্দর ছবি আঁকতে পারত। ঊর্মিমালার মুখটা মনে পড়তেই অর্ক একটু থতিয়ে গেল। হঠাৎ ঊর্মিমালা চোখের সামনে এল কেন? সে ধীরে ধীরে ছাদের কিনারায় গিয়ে দাঁড়াতেই মাধবীলতাকে দেখতে পেল। নিচের বাগান, বাগানের এপাশে রান্নার ঘরের দরজায় মাধবীলতা দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ চোখ পড়তেই সে বিস্মিত হল। তারপর দ্রুত হাত নেড়ে ছেলেকে নিচে ডাকল। মায়ের ভঙ্গীতে এত চাপা-দ্রুততা ছিল যে অর্ক চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল, কেন?

সেই সময় রান্নারঘর থেকে হেমলতা বেরিয়ে এলেন। মাধবীলতার দৃষ্টি অনুসরণ করে চোখের ওপর হাতের আড়াল রেখে অর্ককে দেখলেন, কে? তোমার ছেলে না? ওখানে কি করছে? একা একা ছাদে বেড়ানো ঠিক নয়। নেমে আসতে বল।

মাধবীলতা যতটা সম্ভব নিচুগলায় বলল, নেমে আয়।

অর্ক বুঝতে পারছিল না সে কি অন্যায় করেছে। হেমলতা তখন মাধবীলতার হাত ধরলেন, ওহো, একদম খেয়াল ছিল না। চলো, চলো, মহীর সঙ্গে দেখা করবে চলো। বাড়ির বউ বাড়িতে এসে শ্বশুরের সঙ্গে কথা বলল না, এ কি রকম ব্যাপার। ছোটবউ ছোটবউ–। মাধবীলতার হাত ধরে টানতে টানতে হেমলতা বড় বাড়ির দিকে এগিয়ে চললেন।

অর্ক ছাদের মাঝখানে চলে এল। ঘুঘু ডাকছে কাছাকাছি। ওটা যে ঘুঘুর ডাক সে অনুমানে বুঝেছে। ওদের ক্লাশের একটি ছেলে গালে হাত চাপা দিয়ে নানান পাখির গলা নকল করতে পারে। পাখিটাকে দেখবার জন্যে সে ছাদের উল্টোদিকে চলে এল। বিরাট কাঁঠালগাছটার আড়ালে বসে ডাকছে পাখিটা। অর্ক ঠাওর করতে পারছিল না। সে মুখ ফেরাতেই থমকে গেল। ওপাশে একটা কাঠের বাড়ি। বাড়িটার কুয়োতলা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেখানে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে মাথায় বালতি থেকে জল ঢালছে। একটা ভেজা সায়া সেঁটে আছে নিচের শরীরে, ওপরে খুব ছোট সাদা ব্লাউজ। অর্কর মনে হল মেয়েটা বাঙালি নয়। স্বাস্থ্যবতী এবং প্রচণ্ড ফর্সা মেয়েটার মুখ নাক কেমন থ্যাবড়া। ফসা বলেই শরীরের সঙ্গে লেপ্টে যাওয়া ভিজে কাপড়ের দিকে তাকাতে সঙ্কোচ হচ্ছিল অর্কর। কিন্তু সে চোখ ফেরানোর আগেই মেয়েটি তাকে দেখতে পেল। তার হাত থেমে গেল, চোখে বিস্ময়। এই বাড়ির ছাদে যে কোন পুরুষ দাঁড়িয়ে থাকবে তা সে কল্পনা করেনি। কিন্তু তার বিস্ময়ের ঘোর কাটবার আগেই অর্ক সরে এল। দরজার দিকে যেতে যেতে আর হঠাৎ মনে হল। মেয়েটা আবার এ বাড়িতে নালিশ করবে না তো! সে তো জেনেশুনে ছাদের কোণে যায়নি, হঠাৎই চলে গিয়েছিল। একথা এরা বিশ্বাস করবেন তো!

অনিমেষ খাবার খেয়ে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই ছোটমাকে দেখতে পেল। ছোটমা এখন তার পায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন অদ্ভুত চোখে। সে সেটা উপেক্ষা করে সরাসরি জিজ্ঞাসা করল, টেলিগ্রামটা কে করেছিল?

ছোটমা যেন অবাক হলেন। তারপর স্বাভাবিক গলায় বললেন, আমি।

কেন?

এসে বুঝতে পারছ না কেন?

না। বাবা অসুস্থ, ইনভ্যালিড। কিন্তু এখনই কোন বিপদের সম্ভাবনা নেই। টেলিগ্রামে তুমি সেই মিথ্যে কথাটা জানিয়েছিলে। আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে আমাদের তোমরা ঠিক মেনে নিতে পারছে না। বাবার অসুস্থতা যখন এমন নয় তখন এভাবে আমাদের ডেকে আনলে কেন? এত বছর যখন কেটে গেল।

ছোটমা আপনমনে বললেন, তুমি কেমন পাল্টে গিয়েছ!

আশ্চর্য! প্রত্যেকটা দিনই তো মানুষের চেহারা একটু একটু করে পাল্টে দিয়ে যায়। মনের কি দোষ। আর এসে দেখলাম তোমরাও তো কম বদলে যাওনি। এইভাবে তাড়াহুড়ো করে টেনে আনার সঙ্গে ব্যবহারের মিল পাচ্ছি না।

ছোটমা যেন কথাটা কিভাবে বলবেন ভাবতে পারছিলেন না। এবার অনিমেষের কথা শেষ হওয়ামাত্র তিনি সরাসরি বলে ফেললেন, আমি আর পারছি না। অনেকদিন, অনেকদিন তো তোমাদের এই সংসারটাকে বইলাম। আমার যখন বিয়ে হয়েছিল তখন তো তুমি যথেষ্ট বড়। এত বছর ধরে আমি কি পেয়েছি? তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে সেসব কথা। আমার কথা কখনও ভেবেছ?

অনিমেষ সত্যি অবাক হয়ে গেল। ছোটমার মুখে এমন প্রশ্ন সে আশা করেনি।

ছোটমা যেন হতাশায় মাথা নাড়লেন, এখন এই বাড়িতে একজন অথর্ব হয়ে শুয়ে রয়েছেন আর একজন বয়সের ভারে কখন কি বলছেন ঠিক নেই। একটাও পুরুষ নেই যার ওপর নির্ভর করতে পারি। ব্যাঙ্ক থেকে যে সামান্য কটা টাকা সুদ পাই তা ওঁর চিকিৎসার পেছনেই চলে যায়। কিভাবে খাচ্ছি, বেঁচে আছি তা আমিই জানি। আমি কেন এই দায় একা বইবো? তুমি এই বাড়ির ছেলে, তোমার কোন কর্তব্য নেই? তোমার জ্যাঠা মামলা করছেন তাও আমাকে সামলাতে হচ্ছে। আমি আর পারছি না, একদম পারছি না। ছোটমার গলার স্বর জড়িয়ে গেল।

ঠিক সেইসময় হেমলতা মাধবীলতাকে টানতে টানতে ওই ঘরে ঢুকলেন, এই যে ছোটবউ, বাড়ির নতুন বউ-এর সঙ্গে শ্বশুরের কেউ পরিচয় করিয়ে দিল না, এ কেমন কথা। এ্যাঁ? চল, আমি তোমায় নিয়ে যাচ্ছি।

বিব্রত মাধবীলতা নরম গলায় বলল, হাতটা ছাড়ুন, আমি যাচ্ছি।

ও হ্যাঁ। বেশ বেশ, চল। শোন, প্রণাম করবে না। শুয়ে থাকা মানুষকে প্রণাম করতে নেই। দূর থেকে নমস্কার করো।

হেমলতার পেছন পেছন যাওয়ার সময় মাধবীলতা একবার আড়চোখে অনিমেষের দিকে তাকাল। অনিমেষের কোন প্রতিক্রিয়া হল না। মহীতোষের ঘরের দরজায় গিয়ে হেমলতা গলা তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, ও মহী, মহী! ঘুমুচ্ছিস নাকি?

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে অর্ক দাঁড়িয়ে গেল। দাদুর দরজায় মা এবং দিদা দাঁড়িয়ে। দিদা এমন ভঙ্গীতে ডাকছেন যেন দাদুর কিছুই হয়নি। হেমলতাকে সে এই প্রথম দিদা বলে ভেবে নিল।

ঘরের ভেতর একটা গোঙানি উঠলে হেমলতা বললেন, না, ও এখন ঘুমোয়নি। এসো। মহী, দ্যাখ কে এসেছে! আমি প্রণাম করতে নিষেধ করেছি। শুয়ে থাকলে প্রণাম করতে নেই। এ বাড়ির বউ রে! অনির বউ।

মাধবীলতা ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর মুখ তুলে তাকাতেই মহীতোষকে দেখতে পেল। মানুষটা অসুস্থ, খুবই অসুস্থ। দুটো চোখের তলা ফোলা, মুখ বাঁকানো। শরীর স্থির। শুধু ডান হাতটা একটু উঠে আছে। মাধবীলতা বুঝতে পারছিল না তার কি করা উচিত। পিসীমা নিষেধ করেছেন প্রণাম করতে। নমস্কার করাটা তার খুব সাজানো বলে মনে হচ্ছিল। মহীতোষের দুটো চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। মাধবীলতা চোখ নামিয়ে নিল। পিসীমার গলা শোনা গেল, খুব সুন্দর বউ হয়েছে না মহী? এম এ পাশ! স্কুলে চাকরি করে। আমাদের অনিকে ও বাঁচিয়েছে। বড় ভাল মেয়ে। অনির জন্যে নিজের বাবা মার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। এরকম প্রেম দেখা যায় না।

মাধবীলতার মনে হল এর চেয়ে মরে যাওয়া ঢের আনন্দের ছিল। পিসীমা যে শ্বশুরের সামনে এই ভাষায় কথা বলবেন সে ঘুণাক্ষরে আঁচ করেনি। আর এত জোরে বলছেন যে কারো কান এড়াবে না। অথচ তার কিছুই করার নেই। এই মুহূর্তে কোন কথা বলা শোভন নয়। হেমলতার কথা শেষ হওয়ামাত্র মহীতোষের মুখ থেকে গোঙানি বের হল। হেমলতা দুপা এগিয়ে ঝুঁকে মুখের কাছে কান নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি বলছিস? বউ পছন্দ হয়েছে? তারপর মাধবীলতার দিকে মুখ ফিরিয়ে সরল গলায় বললেন, আমি কিছু বুঝতে পারি না ও কি বলে। কানে কম শুনি তো। ছোটবউ সব বুঝতে পারে। ও ছোট বউ, ছোট বউ! চিৎকার করলেন হেমলতা।

মাধবীলতা দেখল মহীতোষের মুখের কোণ বেয়ে একটা লালার ধারা বেরিয়ে এসেছে। তার মনে হল ওটা মুছিয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু কি দিয়ে দেবে? তাছাড়া দিতে গেলে পিসীমা কিভাবে নেবেন তাও জানা নেই। এইসময় ছোটমা দরজায় এসে দাঁড়ালেন, কি বলছেন?

হেমলতা মহীতোষকে দেখিয়ে বললেন, দ্যাখ তো কি বলছে!

ছোটমার ঠোঁটদুটো সামান্য বেঁকে গেল। আড়চোখে মাধবীলতাকে দেখে তিনি একটু ঘুরে মহীতোষের অন্যপাশে গিয়ে দাঁড়াতেই মহীতোষ যেন স্বস্তি পেলেন। তড়বড়িয়ে যা বললেন তার মর্ম মাধবীলতার অবোধ্য রইল। ছোটমার মুখ কিন্তু বিস্ময়ে চুরমার। তিনি হেমলতার দিকে তাকালেন। তারপর চোখ বন্ধ করে সামান্যক্ষণ দাঁড়িয়ে আনছি বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন–

হেমলতা বললেন, বাবা থাকলে খুব খুশি হতো না মহী?

মহীতোযের মুখে এখন কোন শব্দ নেই। শুধু ডানহাতটা নেড়ে মাধবীলতাকে ইশারা করলেন এগিয়ে আসতে। মাধবীলতা পাশে এগিয়ে এল। মহীতযের চোখদুটো স্থির। হেমলতা বললেন, ওর নাম হল মাধবীলতা।

মহীতোষের কপালে ভাঁজ পড়ল! তাঁর মুখ হেমলতার দিকে ঘুরে গেল সামান্য। হেমলতা যেন এবার চাহনির অর্থ ধরতে পারলেন, মাধবীলতা। মাধুরী না রে।

এই সময় ছোটমা আবার ফিরে এলেন। তাঁর হাতে একটা রঙচটা ছোট বাক্স। সেটা তিনি মহাতোষের ডান হাতে ধরিয়ে দিলেন। মহীতোযের হাতটা উঠল। ধীরে ধীরে প্রসারিত হল মাধবীলতার সামনে। মুখ থেকে গোঙানি বের হয়ে এল।

ছোটমা বললেন, তোমাকে ওটা নিতে বলছেন।

মাধবীলতার হাত কেঁপে গেল। সে বাক্সটাকে ধরতেই মহীতোষের মুখে হাসির চেষ্টা এল। হেমলতা জিজ্ঞাসা করলেন, কি আছে ওতে?

ছোটমা বললেন, হার। নতুন বউ-এর মুখ দেখবে বলে।

দেখি দেখি কোন হারটা। বাক্সটা খোল। হেমলতা উদগ্রীব হলেন।

মাধবীলতা বাক্সটা খুলতেই একটা পুরোনো আমলের ভারী হার চোখে পড়ল সবার। হেমলতা ছোটমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কার হার? তোমার?

ছোটমা মাথা নাড়লেন, না, দিদির।

ওমা, সে হার এতদিন ছিল নাকি? ভাল ভাল। দিদি কে জানো? মহীর বড় বউ, অনির মা।– এই বাড়িতেই মরে গেছে সে। বড় ভাল মেয়ে ছিল সে। ওই হার তুমি পরলে তার আত্মা সুখী হবে। আমার তো কিছুই নেই যে তোমাকে দেব। না, না আছে। দাঁড়াও। হঠাৎ যেন মনে পড়ে গেল হেমলতার। তড়িঘড়ি করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, এই ছোঁড়া আবার এখানে দাঁড়িয়ে আছে কেন? কিন্তু কথা শেষ করে আর অপেক্ষা করলেন না।

ছোটমা মাধবীলতাকে বললেন ওটা পরো তো।

মাধবীলতা দেখল অর্ক দরজায় দাঁড়িয়ে হাসছে। ওর আরও অস্বস্তি বাড়ল। মুখে বলল, এখন থাক না।

থাকবে কেন? যিনি দিলেন তিনি দেখবেন না কেমন মানাচ্ছে! ছোটমার গলার স্বর শীতল। মাধবীলতা মহীতোষের দিকে তাকাল। দুটো চোখ এখন বেশ শান্ত। সে আর উপেক্ষা করতে পারল না। হারটা খুলে গলার পরে নিল। পুরোনো ডিজাইন, ভারী হার। অনেক, অনেক দাম হবে।

ছোটমা বললেন, সধবার গলা খালি না থাকাই উচিত। ওটা খুলো না।

মাধবীলতা বলল, এত দামী জিনিস।

তা অবশ্য। ছোটমা এবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

মাধবীলতার সমস্ত শরীর সিরসির করছে। এই হার তাকে দেওয়া মানে এই বাড়ির বধূ হিসেবে মেনে নেওয়া। মহীতোষকে প্রণাম করতে ইচ্ছে করছিল তার। কিন্তু। সে এগিয়ে গেল আর একটু। তারপর আঁচলের কোণ দিয়ে মহীতোষের লালা সযত্নে মুছিয়ে দিল। মহীতোষ নিশ্চয়ই বিস্মিত হয়েছিলেন। কিন্তু মাধবীলতা আর দাঁড়াল না। ঝটপট ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল সে। পেছনে অর্ক।

অনিমেষের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে খুব লজ্জা হচ্ছিল ওর। কিন্তু বড়ঘরে যেতেই মুখোমুখি হতে হল। গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়েছিল অনিমেষ। অর্ক পেছন থেকে বলল, এখানে এসে মায়ের খুব লাভ হল।

অনিমেষের ভ্রূ কুঁচকে গেল, মানে? আর তখনই সে হারখানা দেখতে পেল, ও, কে দিল?

বাবা।

অনিমেষ মাধবীলতার মুখ দেখল। বাবা শব্দটা ওর কানে খট করে বেজেছে। কিন্তু সেকথা মুখে না বলে ও হাসবার চেষ্টা করল।

অর্ক বলল, তোমার মায়ের হার। জানো বাবা।

তাই নাকি! এ হার এতদিন ছিল? শোন, তোমার সঙ্গে কথা আছে।

মাধবীলতা হারখানা ছুঁয়েছিল খুলবে বলে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি সেটা উচিত হবে না বুঝতে পারল। অনিমেষের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার?

ঠিক আছে, পরে বলব। অনিমেষ অর্কর দিকে তাকাল।

হঠাৎ মাধবীলতার খেয়াল হল, তুই হুটহাট ছাদে উঠিস না।

অর্কর বুকটা ধড়াস করে উঠল, কেন?

পিসীমা আপত্তি করছিলেন। আর হ্যাঁ। তোকে বাজারে যেতে হবে।

বাজারে?

এখানে কোন লোক নেই। আমি টাকা দিচ্ছি তুই খোঁজ নিয়ে তাড়াতাড়ি বাজার করে আনবি। কি আনতে হবে বলে দিচ্ছি। এই শোন, পিসীমা তখন বলছিলেন একটা লোক নাকি প্রায়ই তোমার খোঁজ করতে আসে। মাধবীলতা অনিমেষকে বলল।

অনিমেষ অবাক হল, আমার খোঁজ করে?

হ্যাঁ। পিসীমা তাকে বলেছেন যে তোমাকে টেলিগ্রাম করা হয়েছে।

কে আবার? অনিমেষ তার ছেলেবেলার বন্ধুদের মুখ মনে করল। এইসময় হেমলতা দ্রুত চলে এলেন। তাঁর ছোট্ট রোগা এবং ভাঙা শরীর মাধবীলতার কাছে এসে কাঁপছিল, দ্যাখো তো, এটা পরা যায় কি না!

মাধবীলতা একটু দ্বিধাগ্রস্ত হাতে প্যাকেটটা নিল। অনিমেষ দেখল খবরের কাগজটা লালচে এবং তার ওপর জওহরলাল নেহরুর ছবি ছাপা। খুব সতর্ক হাতে প্যাকেটটা খুলতেই একগাদা ন্যাপথলিনের গুঁড়ো মাটিতে ছড়িয়ে গেল। মাধবীলতা দেখল সুন্দর কাজ করা একটা নীল রঙের বেনারসী। হেমলতা ফোকলা দাঁতে হেসে বললেন, অনেক বছর আগের শাড়ি। তখনকার দিনে দেড়শ টাকা দাম নিয়েছিল। আমি প্রত্যেক বছর রোদে দিই। এখনও ছেঁড়েনি। এটা দিয়ে আমি তোমার মুখ দেখলাম মাধবীলতা।

অনিমেষ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। পিসীমার সংগ্রহে যে এরকম একটা সুন্দর শাড়ি আছে তা সে ছেলেবেলায় জানতো না। পিসীমা আসা অবধি তার সঙ্গে কথা বলছেন না। কিন্তু এই মুহূর্তে সে মুখ বুজে থাকতে পারল না, এটা আপনার শাড়ি?

হেমলতা অনিমেষের দিকে তাকালেনই না। মাধবীলতাকে বললেন, এ তোমার নিজের শাশুড়ির বিয়ের বেনারসী। আমার কাছে ছিল। থাক থাক প্রণাম করতে হবে না। তারপর ওঁর গলা রুদ্ধ হয়ে এলো, আমার বিয়ের বেনারসী তোমাকে দেব কেন? বিধবার বেনারসী কি কাউকে দিতে আছে!

৩২. পিসীমা আর দাঁড়াননি

পিসীমা আর দাঁড়াননি।

মাধবীলতা কাপড়খানা সেই কাগজেই কোনোরকমে মুড়ে অনিমেষকে বলল, আশ্চর্য!

অনিমেষ হতভম্ব হয়ে পিসীমার যাওয়ার পথ দেখছিল। এবার নিজের মনেই বলল, কি কথা থেকে কোন কথায় চলে গেলেন।

তোমার এভাবে কথা বলা উচিত হয়নি। মানুষের সেন্টিমেন্টে আঘাত দিয়ে।

আমি আঘাত দিতে চাই নি। আগে পিসীমার সঙ্গে আমি অনেকরকম রসিকতা করতাম। গুরুজন হলেও সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর। সব পাল্টে গিয়েছে।

তুমি লক্ষ্য করেছ পিসীমা তোমার কথার জবাব দিচ্ছিলেন না?

হুঁ। অনিমেষ মাথা নাড়ল। তারপর ক্রাচ দুটো টেনে টেনে ঘরে ফিরে এল। খাটের ওপর বসে চোখ বন্ধ করল সে। মাধবীলতা টেবিলের ওপর কাপড় রেখে দিয়ে সুটকেস খুলে টাকা বের করল। তারপর একটু ভেবে অনিমেষকে বলল, তুমি বলবে? অনিমেষ বুঝতে পারছিল ওর শরীরে কাঁপুনি আসছে। পিসীমার এই ব্যবহার ওকে ছিন্ন করে ফেলবে যে কোন মুহূর্তে, চোখে যেন জল ছুটে আসছিল। মাধবীলতার কথা যেন একটু আশ্রয় দিল। সে জিজ্ঞাসা করল মুখ সরিয়ে, কি?

খোকাকে বাজারে পাঠানোর কথা তুমি বললেই ভাল হয়।

তুমি বললে দোষ কি? আমি, আমি এখনও পরের বাড়ির মেয়ে। এঁদের কি মনে হবে কে জানে।

ওকে বাজারে পাঠাচ্ছই বা কেন?

পাঠাচ্ছি কারণ পাঠানো প্রয়োজন। নাহলে ওই দুজন একে ওকে ধরে জিনিস আনাবেন। আমরা থাকতে সেটা করতে দেব কেন? মাধবীলতা অনিমেষের অবুঝপনায় বিরক্ত হল।

আচ্ছা! অনিমেষ যেন অনেকটা ধাতস্ত হল। সমস্যা যে আবেগকে দখল করতে পারে সেটা বুঝতে পেরে স্বস্তি পেল, আমি এই ব্যাপারেই তোমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম। তোমাকে কি ওরা এদের অবস্থার কথা কিছু বলেছেন?

মাধবীলতা ভাবল। তারপর মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, সুদের টাকায় কোনরকমে চলছে।

অনিমেষ বলল, আমাদের কেন টেলিগ্রাম পাঠানো হয়েছে জানো? বাবার শরীর যতটা না কারণ তার চেয়ে অনেক বেশী আমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করিয়ে দেওয়া। ছোটমা স্পষ্ট বলে গেলেন যে উনি আর এই সংসারের ভার বইতে পারছেন না।

মাধবীলতা অনিমেষের দিকে স্পষ্ট চোখে তাকিয়ে বলল, স্বাভাবিক।

আমাদের পক্ষে সেটা কিভাবে সম্ভব?

তা ওঁরা ভাবতে যাবেন কেন? এইটুকু আশা তোমার কাছে ওঁরা করতেই পারেন।

আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। অনিমেষ একটু উত্তেজিত গলায় বলল, এইসব কারণেই আমি টেলিগ্রাম পেয়েই এখানে ছুটে আসতে রাজি হইনি।

ছিঃ। এরকম এসকেপিস্টের মত কথা বল না। তুমি দেখছ না এরা কি ভাবে বেঁচে আছেন।

অনিমেষ যেন চাবুক খেল। এবং সেই মুহূর্তেই সব শীতল হয়ে গেল তার। উত্তেজনার মুহূর্তে যে কথা সে বলেছে তা যে বলার নয় এটা বুঝতে পেরেই নিজেকে অত্যন্ত ছোট বলে মনে হচ্ছিল। বিশেষত অর্কর সামনে। সে মাথা নাড়ল, আমি দুঃখিত। ঠিক এইভাবে আমি বলতে চাইনি। তোমরা আমার অবস্থাটা বুঝবে না। আমি যে কত হেল্পলেস!

মাধবীলতার গলার স্বর এবার নরম, কে বলল তুমি হেল্পলেস! তোমার ছেলে রয়েছে আমি রয়েছি। তাছাড়া–তাছাড়া।

তাছাড়া কি?

না, থাক। দ্যাখো, এরা আমাদের কতটা গ্রহণ করবেন জানি না কিন্তু আমাদের দিক থেকে যেন কোন ত্রুটি না থাকে। তুমি দেখলে না, কতবার কতবছর ধরে জমিয়ে রাখা গয়না শাড়ি আজ ওঁরা এককথায় কোন আবেগে আমাদের দিয়ে দিলেন?

গয়না, শাড়ি। অনিমেষ নিজের খেয়ালে মাথা নাড়ল। তারপর দুটো হাতে ক্রাচ খামচে ধরল, কিন্তু কিভাবে সম্ভব? তোমার স্কুল আছে, খোকার স্কুল আছে। এখানে আমরা অনন্তকাল বসে থাকতে পারি না!

না পারি না। কিন্তু আমরা আজই চলে যাচ্ছি না। এসব নিয়ে ভাবনার সময় অনেক পাওয়া যাবে। মাধবীলতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তুমিও তো এরকম ছিলে না।

অনিমেষ তাকাল, মানে?

এত সাধারণ সমস্যায় আগে কখনো আপসেট হতে না।

আমি কখনও সাংসারিক সমস্যার মুখোমুখি হইনি।

মাধবীলতা হেসে ফেলল এবার, তাহলে বোঝ,তোমাদের বাইরের সমস্যা, রাজনীতি, বিপ্লব এসবের চেয়ে আমরা মেয়েরা কত জটিল সমস্যার মধ্যে দিন কাটাই। নাও, এখন ওঠো, খোকাকে বাজারে পাঠাও।

অনিমেষ অর্কর দিকে তাকাল। এই ঘরে এতক্ষণ এত কথা হল কিন্তু ছেলে চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনেছে। ওর সামনে এসব বলা বোধহয় ঠিক হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষ ভাবনাটাকে নস্যাৎ করল। না, ও বড় হয়েছে। জীবনটাকে জানুক। লুকোচুরি করে কি হবে? সে অর্ককে জিজ্ঞাসা করল, তুই বাজারে যেতে পারবি তো?

অর্ক হাসল, হেসে মাথা নাড়ল। আর তাই দেখে অনিমেষের কেমন খটকা লাগল। ও কি তাকে ঠাট্টা করল? ওই হাসির মানে কি? মাধবীলতার মতো কি অর্ক তাকে এসকেপিস্ট ভাবছে? এসকেপিস্ট শব্দটার মানে কি অর্ক জানে! অনিমেষ উঠে দাঁড়াল, এখান থেকে বেরিয়ে রিকশা নিবি। প্রথম দিন রাস্তা চিনতে অসুবিধে হতে পারে। তাছাড়া বেলা হয়ে গেছে। বাজার আনতে দেরি হলে রান্না হবে না। তারপর মাথা ঘুরিয়ে বলল, ওঁদের রাঁধতে দিও না। মাধবীলতা হেসে ফেলল, বাঃ, এই তো বেশ সাংসারিক জ্ঞান আছে দেখছি।

অনিমেষ আর দাঁড়াল না। শরীরটাকে টেনে টেনে ভিতরের বড় বারান্দায় চলে এল। বেশ রোদ বাগানে। ওঁদের দুজনকে দেখতে পেল না সে। বারান্দা ধরে খানিকটা এগোতেই কাঁচের জানলার ভেতর দিয়ে বাঁ দিকের ঘরটা নজরে এল। ঠাকুর ঘরটা পাল্টায়নি। পিসীমা ঘর মুছছেন। অনিমেষের খুব ইচ্ছে করছিল পিসীমার সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু সে মুখ ফিরিয়ে নিতেই ছোটমাকে দেখতে পেল। ভেজা কাপড় নিয়ে বাথরুম থেকে বের হচ্ছেন। সে সিঁড়ির কাছ অবধি গিয়ে থমকে দাঁড়াল।

আপনার সঙ্গে একটু দরকার ছিল।

বল। ছোটমা বাগানে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

আমি অর্ককে বাজারে পাঠাতে চাই।

কপালে ভাঁজ পড়ল ছোটমার, কেন?

বাজারে তো কাউকে না কাউকে যেতেই হবে, ও যাক।

কি দরকার। বেচারা আজই প্রথম এল, চিনতে পারবে না। তাছাড়া আমি পাশের বাড়ির লোকটাকে খবর দিয়েছি।

চিনে নিলেই চিনতে পারবে। অর্কই যাক। বাবা কি মাছ মাংস খান?

না।

তুমি?

না। তবে তোমাদের জন্যে আনাতে পারো।

খান না মানে একদম ছেড়ে দিয়েছেন?

না,পাই না বলেই খাই না। ওকে আজ পাঠানোর কোন দরকার নেই। প্রথমদিন আমিই ব্যবস্থা করছি। ছোটমা কাপড়গুলো রোদে মেলবার জন্যে এগোতেই অনিমেষ বলল, এত পর পর ভাবছেন কেন?

পর পর? ছোটমা হাসলেন, আগে তুমি আমাকে আপনি বলতে না।

অনিমেষ হোঁচট খেল, তারপর হেসে বলল, অনভ্যাস। তাছাড়া আমি তখন ছোট ছিলাম। এতদিন না দেখাশোনায়।

ছোটমা কাপড়গুলো তারে স্তুপ করে রেখে এগিয়ে এলেন, অভ্যেস না থাকলে বুঝি সম্পর্কগুলো পাল্টে যায়? ছোটবেলায় যাকে যে চোখে মানুষ দ্যাখে বড় হয়ে আর সেই চোখ থাকে না, তাই না? হায় ভগবান! অবশ্য এখন তোমার মুখে আপনি খুব সুন্দর মানিয়ে গেছে। ছোটমা রান্নার ঘরের দিকে চলে গেলেন। অনিমেষের বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। এসব মানতেই হবে। কিছু কিছু জিনিস না মেনে উপায় থাকে না।

.

বাড়ি থেকে বেরিয়ে খুশি হল অর্ক।

বড় চমক ওই বিশাল বাড়িতে তিনজন বয়স্ক মানুষ আর বাবা মায়ের মধ্যে একধরনের চাপা উত্তাপ তাকে খুব অস্বস্তিতে ফেলছিল। বাজারের ব্যাগ আর কুড়িটা টাকা নিয়ে সে গেট খুলে চারপাশে তাকাল।

এই বাড়ি থেকে সরাসরি পিচের রাস্তা দেখা যায় না। চারধারে বাউণ্ডারী দেওয়া কাঠের বাড়ির ফাঁক দিয়ে পায়ে চলা পথ, একটা রিকশা কোনমতে ঢুকতে পারে। বড় একটা লোকজন বোধহয় এদিকে আসা যাওয়া করে না। বড় রাস্তায় এসেও মনে হল খুব ফাঁকা চারধার। বাঁদিকে একটা খেলার মাঠ আর ডানদিকে সারি সারি কাঠের বাড়ি। এখন বেশ বেলা হয়েছে। ৪ মোথার মোড়ে এসে সে একটাও রিকশা পেল না। বাজারটা কতদূরে কে জানে। অর্কর চোখে পড়ল একটা বড় গাছের তলায় সিগারেটের দোকান। সেখানে একটি ওর বয়সী ছেলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পরনে ঢোল্লা-পা সাদা প্যান্ট, একটা নীল গেঞ্জি আর মাথায় চুল অমিতাভ বচ্চনের মত ঘাড়ের কাছাকাছি। ছেলেটার স্বাস্থ্য তেমন ভাল নয়। অর্ক ছেলেটার দিকে চোখ রেখে সিগারেটঅলাকে জিজ্ঞাসা করল, বাজার কোনদিকে?

লোকটা বাবু হয়ে বসে দুলে দুলে বিড়ি বাঁধছিল। মুখে কোন শব্দ না করে মুখটা সেই অবস্থায় একবার সামনের দিকে বাড়িয়ে নামিয়ে নিল। অর্ক ডানদিকে তাকাল। ওই পথটাই বোঝাল লোকটা। মেজাজটা গরম হয়ে গেল ওর, মুখে কথা বলতে কি অসুবিধে হয়। সে ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করল, বাজার কি এখান থেকে অনেক দূরে?

ছেলেটি এবার এমন ভঙ্গীতে মুখ ফেরাল যা দেখে হাসি চাপা মুশকিল। সেইসঙ্গে কাঁধ নাচিয়ে মোটা গলায় বলল, সোজা চলে গিয়ে বাঁদিকে। এই শহরে কি নতুন?

হ্যাঁ। আজই এসেছি কোলকাতা থেকে। অর্কর মনে হল অমিতাভ বচ্চনও এইভাবে কথা বলতে পারে না। ছেলেটার একটা চোখ ছোট হয়ে গেল, ক্যালকাটা? আর ঠিক তখনই ঘটনা ঘটল। তিনটে সাইকেল ওপাশের রাস্তা দিয়ে বিদ্যুৎবেগে ছুটে এল। সিগারেটের দোকানের সামনে এসে তিনজন ছেলে লাফিয়ে নামল। অর্ক কিছু বুঝে ওঠার আগেই সদ্যপরিচিত ছেলেটি আর্তনাদ করে উঠল। আগন্তুকদের একজনের হাতে লোহার স্প্রিং দেওয়া হান্টার। ছেলেটি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছিল কিন্তু ওই হান্টারের আঘাতে তাকে ধরাশায়ী হতে হল। একজন ওর বুকের ওপর পা তুলে বলল, বল শালা, আর আমাদের পাড়ায় হিড়িক দিতে যাবি? শর্মিলার নাং হতে আর ইচ্ছে আছে?

ছেলেটা চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। মুখ যন্ত্রণায় বেঁকে যাচ্ছে, রক্ত বের হচ্ছে। অর্ক আর চুপ করে থাকতে পারল না। যে ছেলেটির হাতে হান্টার ছিল তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, কি হয়েছে?

ছেলেটা উত্তেজিত ভঙ্গীতে হান্টারটা ওর দিকে তুলে আবার পায়ের দিকে তাকাল।

অর্ক গলা তুলল, ওকে মারছেন কেন?

তোমার বাপের কি? ছেলেটা রক্তচোখে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় খুন চেপে গেল অর্কর। এক ঝটকায় হান্টারটা কেড়ে নিল সে। আর তারপরেই যেন খিরকি কিলার গলার স্বর ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, আব্বে, সামলে!

ওই মুখ স্বর এবং ভঙ্গী দেখে তিনজনেই যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। অর্ক সজোরে হান্টার চালাতেই ছেলেটা ছিটকে দূরে সরে গেল, বাপ তোলা হচ্ছে! এগিয়ে আয় বে!

সেই সময় আরও কিছু লোককে এ পথে আসতে দেখা গেল। তিনটি ছেলে আর দাঁড়াল না। তড়িঘড়ি সাইকেল তুলে যে পথে এসেছিল সে পথে চলে গেল। যাওয়ার আগে একজন বলল, ঠিক আছে, দেখা হবে।

ফোট, বেশী বকলে ভোগে চলে যাবি। অর্ক চিৎকার করে জবাব দিল। তিনটে সাইকেল চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেলে অর্ক শায়িত ছেলেটিকে দেখল। বড় বড় পা ফেলে কাছে এসে বলল, ওঠো।

ছেলেটি তড়াক করে উঠে বসল। তারপর দুহাতে মুখের রক্ত পরিষ্কার করে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল, ওরা আমাকে মেরে ফেলত, ঠিক শেষ করে দিত।

শেষ যখন হওনি তখন উঠে দাঁড়াও। অর্কর শরীর থেকে তখনও উত্তেজনা যায়নি।

ছেলেটা কাঁপতে কাঁপতে সোজা হয়ে দাঁড়াল। দু’তিনটে কালসিটে পড়েছে ঘাড়ে, গালে। তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ। খুব শ্রদ্ধার চোখে সে অর্কর দিকে তাকাল। এবার অর্ক লক্ষ্য করল ওর সেই অমিতাভ বচ্চনী ভাবটা এখন একটুও নেই।

রাস্তায় তখন মানুষের ভিড় জমে গেছে। সবাই ছেলেটা এবং অর্ককে দেখছে। অর্ক বলল, এখানে ডাক্তারখানা কোথায়?

হঠাৎ পেছন থেকে গলা পেল সে, হাসপাতাল তো সামনেই, শানুদা, আপনে হাসপাতাল চলে যান। এই যে, আপনের ব্যাগ। বাজারের পথেই হাসপাতাল। শেষের কথাটা অর্ককে উদ্দেশ্য করে। সিগারেটঅলাকে এই ভঙ্গীতে দেখে অর্ক হেসে ফেলল। উত্তেজনার সময় ব্যাগটা হাত থেকে যে পড়ে গিয়েছিল তা ওর খেয়ালে ছিল না। সে মাথা নাড়ল। লোকটা যেন তাকে সমীহ করছে। সে ব্যাপারটা উপেক্ষা করে ছেলেটিকে বলল, চল, আমি যাচ্ছি। আর তখনি তার খেয়াল হল এখনও হাতে সেই হান্টারটা রয়ে গেছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে অর্ক সিগারেট চালাকে বলল, এটা তোমার কাছে রেখে দাও। আমি না বললে কাউকে দেবে না। মনে থাকে যেন।

বাজারের ব্যাগটা নিয়ে অর্ক বলল, চল।

দাঁড়িয়ে যাওয়া মানুষগুলো এবার সিগারেটঅলাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে দেখতে পেয়ে অর্ক দ্রুত জায়গাটা ছেড়ে যেতে চাইছিল। কিন্তু ছেলেটির যেন তেমন গরজ নেই। খানিকটা এগিয়ে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, তোমার নাম কি?

শানু। ছেলেটি একবার পেছন ফিরে তাকাল। তারপর বলল, আমি এখন হাসপাতাল যাব না। কাজ আছে।

অর্ক চমকে উঠল, সে কি! এরকম কেটে গেছে ওষুধ দিতে হবে না?

অন্য জায়গায় দিয়ে নেব। হাসপাতালে গেলেই ঝামেলা হয়ে যাবে। ওরা জানতে চাইবে কেমন করে হল। ছেলেটা যে যন্ত্রণা পাচ্ছে সেটা বোঝা যাচ্ছে।

অর্ক এবার ভাল করে ছেলেটিকে দেখল। তার চেয়ে বয়সে বেশীই হবে। অথচ সে স্বচ্ছন্দে ‘তুমি’ বলে যাচ্ছে এবং আপনি শুনছে। তার মানে ছেলেটি নিশ্চয়ই তাকে ছোট ভাবছে না। এটা বুঝতে পেরে অর্কর বেশ গর্ব হল।

সে বেশ মাতব্বরের ভঙ্গীতে বলল, দ্যাখো ভাই, তোমার জন্যে তিনটে ছেলেকে আমার শত্রু করে ছাড়লাম। অতএব আমার কথা শুনতেই হবে। তুমি আমার সঙ্গে হাসপাতালে চল। ওসব কিছু হবে না।

ছেলেটি অসহায় চোখে তাকাল। এই মুহূর্তে ওকে খুব ভীরু বলে মনে হচ্ছে। তারপর বোকার মত বলে ফেলল, আপনি কোলকাতার মাস্তান, না?

মানে? অবাক হয়ে গেল অর্ক।

না, মানে, আপনি যেভাবে ওদের ধমকালেন তাতে, কিছু মনে করবেন না, আপনি না থাকলে আজ কি হত কে জানে!

এই কথাটা আর একবার বলল ছেলেটা। অর্ক গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করল, ওরা মারল কেন?

এবার কাঁধ নামল ছেলেটা, হিংসেয়। শালারা শর্মিলার কাছে পাত্তা পায় না বলে আমাকে খতম করে দেবার মতলব।

শর্মিলা কে?

মাই লাভার।

এবারের বলার ধরনটায় অর্কর মজা লাগল। সে জিজ্ঞাসা করল, ওরা কি অন্য পাড়ার ছেলে?

ছেলেটা বলল, হ্যাঁ। শর্মিলার পাড়ার মাস্তান। বহুৎ বদমাস।

শর্মিলা তোমাকে ভালবাসে?

ভালবাসবে কি করে? চান্স দিচ্ছে না তো শালারা। আমি ওর ক্লাশের একটা মেয়ের হাত দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলাম কাল বিকেলে বাঁধে বেড়াতে আসার জন্যে। ওর মাসীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল তো। কিন্তু হলে হবে কি, ওই শালারা পেছনে ফেউ-এর মত লেগে থাকে। আমি হাসপাতালে যাব না। হঠাৎ ছেলেটি দাঁড়িয়ে গেল। অর্ক দেখল ওরা একটা বড় হাসপাতালের সামনে চলে এসেছে। সে ছেলেটার হাত ধরল, আমাকে চটিও না। আশ্চর্য, তাতেই কাজ হল। ছেলেটা সুড়সুড় করে ভেতরে ঢুকে গেল। অর্কর এখন ঠিক মজা লাগছে না, বরং আত্মবিশ্বাস এসে যাচ্ছে। এই ছেলেটি তার হকুম মানছে।

মিনিট পনের বেশী সময় খরচ হল। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করেছিল, কি করে এমন হল? কেউ মেরেছে? এসব থানায় রিপোর্ট করতে হবে।

শানু অর্কর দিকে তাকাল। অর্ক মৃদু হেসে ডাক্তারকে বলল, আগে ওকে বানিয়ে দিন তারপর আপনার সঙ্গে কথা আছে।

ডাক্তারের চোখ কুঁচকে গেল এবং মুহূর্তেই মুখের রঙ পাল্টে গেল। আড়চোখে অর্ককে দেখে তিনি শানুর প্রাথমিক চিকিৎসা শেষ করলেন। অর্ক বলল, সামান্য ব্যাপার। লাভার নিয়ে রেষারেষি। এর মধ্যে দুনম্বরি কোন ব্যাপার নেই। বুঝলেন? ডাক্তার যেন আর এদের ওপর মনোযোগ দিতে চাইছিলেন না। অর্ক কারণটা বুঝতে পারল। তার গলায় বিশেষ ধরনের স্বর, দুটো শব্দ ডাক্তারকে বিব্রত করেছে। বাঃ। ট্রেনে, একটু আগে মারামারির সময় এমনকি এই ডাক্তারের কাছেও কিলা-খুরকিরা তাকে বাঁচিয়ে যাচ্ছে।

বাইরে বেরিয়ে এসে অর্ক শানুকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কোথায় থাকো?

শানু বলল, জেলা স্কুলের সামনে।

সেটা কতদূর!

ওই সিগারেটের দোকানের কাছে।

আর ওই ছেলেগুলো কোথায় থাকে?

রূপশ্রী সিনেমার পাশে আড্ডা মারে।

বাজার এখান থেকে কতদূর?

পাঁচ মিনিটও লাগবে না। চলুন আমি সঙ্গে যাচ্ছি।

দূর! দেখছ না, রাস্তার লোকজন তোমার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। তুমি বাড়ি যাও। আজ বিকেল পাঁচটার সময় ওই সিগারেটের দোকানের সামনে আসবে। অর্ক আর দাঁড়াল না। এমনিতেই অনেক বেলা হয়ে গেছে। এখন বাজার নিয়ে গেলে রান্না করতেই দুপুর শেষ হয়ে যাবে।

বাজারে গিয়ে হাঁ হয়ে গেল অর্ক। কলকাতার চেয়ে এখানে জিনিসের দাম এত বেশী সে বিশ্বাসই করতে পারছিল না। কি কিনবে বুঝে উঠতে পারছিল না সে। ছোট কই মাছের দাম পঞ্চাশ টাকা কেজি।

কোনোরকমে বাজার শেষ করে সে একটা রিকশা নিল।

মাছের দাম শুনে সে জিজ্ঞাসা করেছিল, এখানে এত দাম কেন?

লোকটা হেসে বলেছিল, বাবু বুঝি নতুন?

হ্যাঁ। লোকে এসব মাছ কেনে?

কিনবে না কেন? বাবুদের পকেটে পয়সা আছে। চা বাগানের পয়সা।

এখানে তো গরীব মানুষ আছে, তাই না?

গরীবে মাছ খায় না। টেকির শাক আর ভাত।

ঢেঁকির শাকটা আবার কি জিনিস?

লোকটা হা হা করে হেসে উঠল, সবজিপট্টিতে যান। গ্রামের লোক বিক্রি করছে। মাথাটা শুড়ের মত বাঁকানো শাক। টাকি মাছ নিয়ে যান, সস্তা। পনের টাকা কিলো। মাছ কেনা হল না। হাঁস মুরগি মিশিয়ে ডিম নিয়ে নিল গোটাকতক। তারপর রিকশায় উঠল।

দিনবাজারের পুলটা ছাড়িয়ে রিকশা নামতেই পুলিশ হাত দেখাল। ওপাশ দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। জায়গাটা বেশ জমজমাট। প্রচুর দোকান পাট আর মানুষের ভিড়। হঠাৎ অর্কর চোখে পড়ল এক ভদ্রলোক সাইকেল হাতে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। মাঝবয়সী ভদ্রলোক। ফর্সা, মোটাসোটা। একটু বেশী বয়সেও রঙ চঙা কায়দা করা শার্ট পরেছেন। মাথার কোঁকড়া চুলে সাদাটে ভাব এসেছে। যেন অর্ককে দেখতে পেয়ে খুব অবাক হয়েছেন। অস্বস্তি হচ্ছিল ওর, অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করল লোকটা কেন তাকে দেখছে? মারামারির সময় কাছে পিঠে ছিল নাকি? সে আবার মুখ ফেরাল এবং দেখল লোকটা তখনও তার দিকে তাকিয়ে আছে।

এইসময় পুলিশ হাত নামাতেই রিকশাঅলা প্যাডেল ঘোরাল। সাঁই সাঁই করে হাসপাতালের সামনে দিয়ে ছুটে গেল রিকশাটা। অর্ক পেছন ফিরে আর লোকটাকে দেখতে পেল না। সাইকেল রিকশায় এই প্রথম চড়ছে অর্ক। বেশ মজা লাগছে এখন। মনে হচ্ছে রথে চেপে যাচ্ছি।

সেই সিগারেটের দোকানের কাছে আসতেই অর্ক লোকটাকে দেখতে পেল। ফাঁকা রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখেই হাত নেড়ে চিৎকার শুরু করতে অর্ক রিকশাঅলাকে থামতে বলল। লোকটা এবার দৌড়ে এল রিকশার কাছে, ওরা আবার এসেছিল, বুঝলেন!

কারা?

ওই যাদের আপনি তাড়িয়ে দিলেন তখন। এবার ছ-সাতজন। আপনে কোথায় থাকেন, নাম কি, এইসব প্রশ্ন জিগালো।

তুমি কি বললে?

আমি তো আপনেরে চিনিই না

ওরা এসেছিল কেন?

জানি না। তবে অস্ত্রটার কথা জিগালো। আমি দেই নাই।

ভাল করেছ। অর্ক রিকশাঅলাকে চলতে বলল। বড় রাস্তা ছেড়ে মাটির রাস্তা। রাস্তায় বাঁক নেওয়ার সময় অর্ক দেখল অনেক দূরে সিগারেটঅলা তখনও দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্চয়ই দেখছে। ও সঙ্গে সঙ্গে রিকশাঅলাকে থামতে বলে নেমে পড়ল। দাম মিটিয়ে সে দাঁড়িয়ে রইল যতক্ষণ না রিকশাটা চোখের আড়ালে চলে যায়। ওকে বাড়ি অবধি নিয়ে গেলে ঠিকানাটা চাপা থাকবে না। প্রথম দিন শহরে পা দিয়েই সে একটা গোলমালে জড়িয়ে পড়েছে এ খবর মাধবীলতাকে জানতে দেওয়া ঠিক হবে না।

দরজা খুলে দিল অনিমেষ! এত দেরি হল কেন?

বাবার ভ্রূ কোঁচকানো মুখের দিকে তাকিয়ে অর্ক বলল, যা দাম!

দামের সঙ্গে দেরির কি সম্পর্ক?

অর্ক আর দাঁড়াল না। ওর হঠাৎ মনে হল এখানে আসার পর বাবা যেন বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বেশ মেজাজী। কলকাতায় চিরকাল ওই মানুষটাকে সে চুপচাপ বসে থাকতে দেখেছে। কিন্তু এখানে যেন আচমকা অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে।

ভেতরের বারান্দায় আসতেই ছোটমার মুখোমুখি হয়ে গেল অর্ক। ছোটমার মুখে হাসি ফুটল, বাজার হল?

হ্যাঁ। তবে মাছ পাইনি।

কেন?

যা আছে খুব দাম।

ইস্! প্রথম দিনেই তোমাকে কি কষ্টটাই না করতে হল। যাও, রান্নার ঘরে ওটা রেখে এসো। ছোটমার হাতে দুটো বাটি। সাবধানে সে দুটো নিয়ে তিনি ভেতরের ঘরে চলে গেলেন। অর্কর মনে হল ওতে গলা গলা কিছু রয়েছে। একটা চামচও।

রান্নারঘরের সামনে এসে অর্ক অবাক হল। ঘরে মা ছাড়া কেউ নেই। কাঠের উনুন থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। মাধবীলতা উবু হয়ে একটা লোহার নল উনুনে খুঁজে ফুঁ দিচ্ছে। বাজারের থলে নামিয়ে অর্ক ডাকতেই মাধবীলতা মুখ ফেরাল। লাল হয়ে গেছে মুখ, চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। কোনোরকমে আঁচলে মুখ মুছে মাধবীলতা হাসল, কোনদিন এই উনুন ধরাইনি তো, নাজেহাল হয়ে যাচ্ছি। এত দেরি করলি কেন?

অর্ক কাঁধ নাচাল। তারপর বলল, মাছ আনিনি।

কেন?

উরেব্বাস, যা দাম। ছোট কই মাছের কিলো পঞ্চাশ টাকা। এখানে সব বড়লোকরা থাকে, বুঝলে। আমরা এখানে থাকতে পারব না।

এরা কি করে আছেন?

কি জানি। তুমি প্রথম দিনেই রাঁধছ?

তুই এখান থেকে যা, আমায় কাজ করতে দে।

অর্ক ঘুরে দাঁড়াল, এখানকার লোকজন না কেমন ধরনের কথা বলে। ঠিক বাঙালও নয় আবার। বলতে বলতে অর্ক থেমে গেল। মাধবীলতা তখনও উনুন নিয়ে বিব্রত। অতএব তার চোখে পড়ার কথা নয়। কিন্তু অর্ক দেখতে পাচ্ছে। বাগানের পেছন দিক দিয়ে একজন ঢুকছে। আর একটু কাছে এলে ও থতমত হল। সেই মেয়েটা যাকে সে স্নান করতে দেখেছিল। নেপালি। ও এখানে এল কেন? ওদিক দিয়ে যে ভেতরে আসার দরজা আছে তাই জানতো না সে। মেয়েটা ওকে দেখতে পেয়ে গম্ভীর হতে হতে হেসে ফেলল। হাসিটাও যেন অদ্ভুত। তারপর খুব মাতব্বরের মত ভঙ্গী করে জিজ্ঞাসা করল, মাসী কোথায়?

কে মাসী? অর্কর বুক দুকবুক করছিল। তার দেখার কথাটা বলতে আসেনি তো? মেয়েটি চিৎকার করল, মাসী, ও মাসী?

ওপাশের ঠাকুরঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন হেমলতা, কিরে, চেঁচাচ্ছিস কেন?

কাঠের দামটা দাও। বাবা চাইছে।

হেমলতা মাথা নাড়লেন, এখনও মাস কাবার হয়নি, এখনই চাইছিস!

জানি না বাবা পাঠালো।

এইসময় মাধবীলতা রান্নাঘরের দরজায় এল, কি ব্যাপার পিসীমা!

হেমলতা হাত ঘুরিয়ে বললেন, ওই যে, ওর বাবা কাঠ দেয় আমাদের। মাস কাবারে দাম নেওয়ার কথা এখনই তাগাদা দিতে এসেছে। তোর বাবাকে বলিস এবারে ভিজে কাঠ দিয়েছে।

ইস আমরা কি জল দিয়ে ভিজিয়েছি। এখন দাম দেবে না যে আমি জানতাম

মেয়েটা ঘুরে দাঁড়াতেই অর্ক মাধবীলতাকে জিজ্ঞাসা করল, মা, আমার কাছে টাকা আছে, দিয়ে দেব?

বাব্বা! খুব বড়লোক দেখছি। মেয়েটি আবার মুখ ফেরাল হেমলতা তখন চিৎকার করলেন, না, না, তোমরা দিও না। ছোটবউ শুনলে খুব রাগ করবে। তুই জানিস কার সঙ্গে কথা বলছিস? ও আমাদের নাতি, এই বাড়ির ছেলে!

৩৩. প্রথমদিনেই খাওয়া শেষ করতে

প্রথমদিনেই খাওয়া শেষ করতে মাধবীলতার প্রায় চারটে বেজে গেল। অবশ্য সে একা নয়, ছোটমাও সঙ্গে ছিলেন। হেমলতার তখনও তোড়জোড় চলছিল। তাঁর রান্না নিজের। সামান্য ভাত আর দু-তিনটে মিলিয়ে একটা ঘাট। সকাল থেকে কিছু খেতে দেখেছে বলে মনে পড়ছে না মাধবীলতার। এই বিকেলে ওই সামান্য খাবার যদি রোজ পেটে পড়ে তাহলে একটা মানুষ এত বছর কোন শক্তিতে বেঁচে থাকেন তা কে জানে। মাধবীলতা সেই কথাটা ঘুরিয়ে বলতেই হেমলতা চোখ বন্ধ করলেন, খেতে পারি না। বুক জ্বলে যায়। অম্বল। বাবা বেঁচে থাকতে সরসী ডাক্তারের ওষুধ এনে দিতেন তাতে উপকার হতো।

মাধবীলতা নরম গলায় বলেছিল, এখন তার ওষুধ আনানো যায় না?

কি করে যাবে? সে ডাক্তার তো কবে মরে গেছে। রাত্তিরে তো খাই না। এই সময়ে খেলে রাত্তিরে আর খিদে পায় না। হেমলতার শুকনো ছোট্ট মুখটায় ব্যথার ছাপ মারা ছিল। কিন্তু তৎক্ষণাৎ সেটা কেটে গেল। হেমলতা উজ্জ্বল চোখে জিজ্ঞাসা করলেন, ও ছোট বউ, অনির বউ-এর হাতের রান্না কি রকম?

ছোটমার খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। ঠোঁট টিপে একবার হেমলতাকে দেখে বললেন, নতুন হাতের রান্না খেলে তো ভালই লাগে। রাত্রের রান্না তোমাকে করতে হবে না, ওটা আমিই করব।

মাধবীলতা সংকুচিত হল। তাকে রাত্রে রান্না করতে না দেওয়ার অর্থ কি ছোটমার রান্না পছন্দ হয়নি? এই বাড়িতে আসার পর সে মহীতোষ কিংবা হেমলতাকে মোটামুটি বুঝতে পারছে কিন্তু এই মহিলাকে সে ধরতেই পারছে না। হয়তো বেশী পড়াশুনা করেননি কিন্তু অদ্ভুত একটা ব্যক্তিত্ব নিয়ে কথাবার্তা বলছেন।

খেয়ে দেয়ে বড় বাড়িতে আসতে রোদ নরম হয়ে গেল। মাধবীলতা তাদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরের দরজায় এসে দেখল অনিমেষ শুয়ে আছে খাটে, অর্ক ঘরে নেই। অনিমেষ তাকে দেখামাত্র উঠে বসল, কি ঠিক করলে?

কিসের?

এই বাড়ির ব্যাপারে?

যা স্বাভাবিক তাই হবে।

যা স্বাভাবিক তা সবসময় হয়?

জানি না। তোমার বাড়ি তুমি যা বলবে তাই হবে। এখন আমার কথা বলতে ভাল লাগছে না। কাল সারারাত ঘুমইনি। তুমি এখানে শুলে আমার তো আবার শোওয়া যাবে না। মাধবীলতা চেয়ারটার দিকে তাকাল।

শুলে কেউ কিছু বলবে?

শোওয়াটা এই বাড়িতে শোভন নয়, তাই।

অনিমেষ তড়িঘড়ি বিছানা থেকে উঠে পড়ল। তারপর ক্রাচ বগলে নিয়ে বলল, অবেলায় ঘুমিয়ে পড়োনা শরীর খারাপ হবে।

মাধবীলতা ওকে উঠতে দেখে বলল, তোমাকে আমি উঠতে বলিনি।

জেদাজেদি করো না। অনিমেষ দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।

মাধবীলতা হঠাৎ সপ্রশংস গলায় বলল, বাঃ।

অনিমেষ ঘুরে দাঁড়াল, বাঃ মানে?

মাধবীলতা ঠোঁট টিপে শান্তির হাসি হাসল, এত সহজ ভঙ্গীতে কোলকাতায় তুমি খাট থেকে নামতে পারতে না। একদিনেই তোমাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে!

অনিমেষ ঠোঁট ওল্টালো। তারপর বাইরের ঘরে বেরিয়ে আসতেই খেয়াল হল খাওয়া-দাওয়ার পর অর্ককে অনেকক্ষণ দেখতে পাওয়া যায়নি। তারপরেই মনে হল, ছেলে বড় হয়েছে, সারাসময় পেছনে টিকটিক করা উচিত হবে না। ঠিক তখনই ভেতরের ঘর থেকে প্রবল গোঙানি ভেসে এল। গোঙানিটায় একটু বিপন্ন ভাব মেশানো। এর আগের গোঙানিগুলোর সঙ্গে কোন মিল নেই। অনিমেষ দ্রুত চেষ্টা করল ভেতরের ঘরে যেতে। কিন্তু ঘরের মেঝে এত পিচ্ছিল যে ক্রাচে ব্যালান্স রাখা যাচ্ছে না। গোঙানিটা শুনে মাধবীলতাও বেরিয়ে এসেছিল দরজায়। সে দেখল অনিমেষ মহীতোষের ঘরের দিকে এগোচ্ছে।

অনিমেষ মহীতোষের ঘরে ঢুকে চমকে গেল। ওঁর মাথাটা বিছানা থেকে ঝুলে পড়েছে, চোখ বিস্ফারিত; ডান হাত দিয়ে প্রাণপণে বিছানা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা চলছে। অনিমেষ কাছে আসতেই হাতটা তার ক্রাচ আঁকড়ে ধরল। অনিমেষের মনে হল সে পড়ে যাবে। বাবার শরীরের ওজন রাখা তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। সে দেখল মহীতোষের চোখদুটো এখন বিশাল এবং আকুতিমাখা। এইসময় মাধবীলতা এসে মহীতোষকে ধরতেই অনিমেষ যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। সে টলতে টলতে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে?

মাধবীলতা ততক্ষণে মহীতোষকে কোনমতে বিছানায় ঠিকঠাক আনতে পেরেছে। মানুষটার দিকে তাকালেই বোঝা যায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা পাচ্ছেন। মুখের দুপাশ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছে। হাতের কাছে কোন কাপড় নেই। মাধবীলতার মাথায় কিছুই ঢুকছিল না। অনেকটা সম্মোহিতের মত সে আঁচল দিয়ে লালা মুছিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে আপনার?

আবার গোঙানি ছিটকে এল। বুক ভীষণ কাঁপছে। মাধবীলতা অনিমেষকে বলল, তাড়াতাড়ি ছোটমাকে ডাকো!

অনিমেষ বেরিয়ে গেলে সে মহীতোষের বুকে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল পরম যত্নে। মহীতোষ কিন্তু মোটেই শান্ত হচ্ছেন না। ওঁর মুখটাকে আরও বেঁকা দেখাচ্ছিল। মহীতোষের ডান হাতটা শুধু মাধবীলতার কবজিটাকে শক্ত মুঠোয় ধরে রেখেছে। এই অসুস্থ মানুষটির শরীরে এত জোর যে মাধবীলতার সাধ্য ছিল না নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার। অথচ মহীতোষ মাধবীলতাকে দেখছেন না। একটা অবলম্বন খোঁজার চেষ্টা ওই মুঠোয়। সে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না।

এইসময় ছুটতে ছুটতে ছোটমা এলেন। একটা অস্ফুট শব্দ বের হল ওঁর মুখ থেকে। তারপর ছুটে গেলেন কোণের টেবিলের দিকে। একটা ছোট্ট শিশি থেকে দুটো ট্যাবলেট বের করে নিয়ে এসে মহীতোষের খোলা মুখের ভেতর ঢেলে দিলেন। ছোটমাকে দেখে মাধবীলতা উঠে আসার চেষ্টা করলেও পারল না। মহীতোষের হাত তার কবজি ছাড়ছে না। ছোটমা জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে?

মহীতোষ যেন খুব কষ্ট করে আওয়াজ করলেন। শোনা মাত্র ছোটমার কপালে ভাঁজ পড়ল। চট করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার?

আমি ভাল বুঝছি না। আগে আমি ওঁর সব গোঙানির মানে বুঝতে পারতাম। এখন–। শরীর নিশ্চয়ই খুব খারাপ করছে। ডাক্তারকে খবর দিতে হবে।

ডাক্তার কোথায় আছেন? আমাকে বলে দাও, আমি যাচ্ছি।

ছোটমা চকিতে মুখ তুললেন। অনিমেষের সঙ্গে চোখাচোখি হল। অনিমেষ লক্ষ্য করল ছোটমার মুখে অদ্ভুত একটা তৃপ্তি চলকে উঠল। কিন্তু ওই মুহূর্তে সে কারণটা ধরতে পারল না। ছোটমা বললেন, তুমি কি করে যাবে?

কেন? আমার যেতে কোন অসুবিধে হবে না।

একটু ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত ছোটমা অনিমেষকে ডাক্তারের বাড়ির নির্দেশ দিলেন। অনিমেষ আর দাঁড়াল না। দ্রুত বাইরের দরজা খুলে সে বারান্দায় এল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে এখন তেমন। অসুবিধে হল না। একটু ভয় ভয় করলেও শেষ পর্যন্ত সে সহজেই নেমে এল। মাটিতে পা দেওয়ামাত্র মনে হল একটা চটি থাকলে বড় ভাল হত। অন্তত যে পা মাটিতে পৌঁছাচ্ছে সেটায়। অনিমেষ গেট খুলতে খুলতে খেয়াল করতে পারল না শেষ কবে সে চটি পরেছে! জেলে গিয়ে না তার আগেই। বড় রাস্তা অবধি আসতেই শরীরে ঘাম জমল। যতটা স্বচ্ছন্দ ভেবেছিল ততটা এখনও হয়নি। একটু বিশ্রাম নিয়ে সে হাঁটতে লাগল। একপাশে খেলার মাঠ অন্য পাশে সারি সারি কাঠের বাড়ি। এই রাস্তাটা আশৈশব একই রকম আছে। অথচ একটাও পরিচিত মানুষ চোখে পড়ছে না। নাকি মানুষগুলোর চেহারাও এত বছরে এমন পাল্টে গেছে যে সে চিনতে পারছে না! রাস্তায় বিরাট গাছ এবং বিকেলের ঘন ছায়ায় একটা মায়াময় পরিবেশ তৈরি হয়েছে। অনিমেষের মনে হল অনেক অনেক বছর পরে সে মানুষের মত হেঁটে যাচ্ছে।

চৌমাথায় এসে সে দেখল অর্ক দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে একটি মুখে প্লাস্টার লাগানো একটা ছেলে। অনিমেষকে দেখে অর্ক এগিয়ে এল, কোথায় যাচ্ছ?

অনিমেষ বুঝতে পারছিল না অর্কর সঙ্গে ওই ছেলেটির আলাপ হল কি করে! ওরা বেশ ঘনিষ্ঠ ভঙ্গীতেই গল্প করছিল। এবং দূর থেকেই সে লক্ষ্য করেছে ছেলেটি সিগারেট খাচ্ছিল। অর্কর হাতে। সিগারেট নেই এটা সে দেখতে পাচ্ছে।

তুই এখানে কি করছিস?

এমনি দাঁড়িয়ে আছি। তুমি এতদূর হেঁটে এলে কেন?

ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি।

ডাক্তার? কেন কি হয়েছে?

তোর দাদুর শরীরটা ভাল নেই। অনিমেষ হাঁটতে লাগল। অর্ক তার সঙ্গে এল, আমি যাব তোমার সঙ্গে?

অনিমেষের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল অর্ককে সঙ্গে রাখতে। কিন্তু তারপরেই সে ইচ্ছেটাকে নাকচ করল, না না। আমি একাই পারব। তুই সন্ধ্যের মধ্যেই ফিরে যাস।

আমি এখনই যাব?

না, এখনই যাওয়ার দরকার নেই। অর্ককে ছাড়িয়ে এসে অনিমেষের মনে বেশ স্বস্তি হল। সে এখন একাই এসব পারবে। কারও ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে না জানলে মন ভাল হয়।

ডাক্তারকে অনিমেষ এর আগে কখনও দ্যাখেনি। ভদ্রলোক বছর চারেক জলপাইগুড়িতে এসেছেন। অল্পবয়সী, অনিমেষের চেয়ে ছোট বয়সে। শোনামাত্র তিনি ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলেন, কোন বাড়িটা বললেন?

অনিমেষ বুঝিয়ে বলতেই ডাক্তার বললেন, আমি অনেকদিন আগে ওঁকে দেখতে গিয়েছিলাম কিন্তু তারপর কেউ আমায় কোন খবর দেয়নি। আপনি রোগীর কে হন?

আমার বাবা। অনিমেষ ডাক্তারের পাশাপাশি সমান তালে হাঁটছিল। যদিও তার দুই থাই এবং কাঁধে এখন চিনচিনে ব্যথা কিন্তু সে কেয়ার করছিল না।

কিছু মনে করবেন না, আপনার নামটা জানতে পারি?

অনিমেষ মিত্র।

সেকি? ডাক্তার চমকে অনিমেষের দিকে তাকালেন। তারপর নিচু গলায় বললেন, আপনি মিসিং, আপনাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, তাই না?

অনিমেষ অবাক হল। এই লোকটা দেখা যাচ্ছে তার সম্পর্কে অনেক খবর রাখে। অথচ তাদের পরিবারের সঙ্গে যে খুব ঘনিষ্ঠতা আছে তাও মনে হচ্ছে না। সে সরাসরি জিজ্ঞাসা করল, ব্যাপারটা যদিও ঠিক সেরকম না কিন্তু, আপনি এত সব জানলেন কি করে?

আপনার কথা আমি অনেক শুনেছি। তবে স্বীকার করছি বেশ কনফিউজড ছিলাম।

ওরা বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছিল। গেট খুলে অনিমেষ বলল, আসুন। কিন্তু তৎক্ষণাৎ সে নিজের শরীরের কাছে হেরে গেল। সিঁড়ি ভাঙতে পারছে না সে। কিছুতেই পা তুলতে পারছে না ওপরে। ডাক্তার সেটা লক্ষ্য করে বললেন, আমি আপনাকে ধরব? অনিমেষ বুঝতে পারছিল হাঁ বলা দরকার কিন্তু সঙ্কোচ হচ্ছিল খুব। অথচ কারো সাহায্য ছাড়া তার পক্ষে বারান্দায় ওঠাও মুশকিল।

পানঅলার কাছ থেকে হান্টারটা নিয়ে অর্ক যখন খুঁটিয়ে দেখছিল তখনই অনিমেষ এসে পড়েছিল সেখানে। বাবার চোখ যাতে জিনিসটার ওপরে না পড়ে সেজন্যে চকিতে সেটা লুকিয়ে ফেলেছিল পেটের ওপর প্যান্টের তলায়। দাদু অসুস্থ এবং বাবা ডাক্তার ডাকতে এসেছে সুতরাং তার এখনই বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত। অথচ এখনও সন্ধ্যে হয়নি তেমন। মিনিট কুড়ি পরে ফিরলে এমন কিছু অন্যায় হবে না। সে ছেলেটাকে, যার নাম শানু, জিজ্ঞাসা করল, ওদের ঠিক তুমি চেন?

শানুর চোখ দুটো জ্বলে উঠল, কিন্তু আমরা তো মাত্র দুজন?

দুজন খুব কমতি মনে করছ কেন?

আমার এক বন্ধু আছে, ওকে ডাকব?

কোন দরকার নেই। তুমি ওদের ঠেকটা আমাকে দূর থেকেই দেখিয়ে দাও, কাছে যেতে হবে। তারপরের নকশা আমি বুঝে নেব। অর্ক হাসল।

শানু তখনও দ্বিধাগ্রস্ত, বলল, একা যাওয়া ঠিক হবে না।

অর্ক একটু জোরেই বলল, ফালতু জ্ঞান দিও না। যাবে কিনা বল।

অতএব ছেলেটি রাজি হল। পানের দোকানের পাশে তার সাইকেল রাখা ছিল। সে সেটাকে নিয়ে এসে বলল, আপনি রডে বসবেন?

অর্কর ব্যবস্থাটা ভাল লাগছিল না। সে নিজে কখনও সাইকেল চালায়নি এবং কারো সঙ্গে সাইকেলে কখনও যায়নি। পড়ে উড়ে যাওয়ার ভয় আছে তাছাড়া যে চালাবে তার ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই। এক্ষেত্রে তো অন্য কোন উপায় নেই। সে সাইকেলে বসে বলল, এখন থেকে আমাকে তুমি বলবে।

শানু হাসল। তারপরে বলল, না গেলে হতো না?

কেন?

ওই পাড়ায় ধোলাই খেতে প্রেস্টিজে লাগবে। শর্মিলা।

ধোলাই খাবে কেন?

শানু উত্তর দিল না। দক্ষ হাতে সাইকেলটা একটা সেতুর ওপর তুলে নিয়ে এল। অর্কর খুব ভয় করছিল। রডটা ওর নিতম্বে বেশ লাগছে কিন্তু সে এমন ভঙ্গী করছিল যেন কিছুই হয়নি। সে জিজ্ঞাসা করল, নদীটার নাম কি?

করলা। কদিন আগে এখানে তিনজন বন্যার জলে ডুবে গেছে।

যাঃ। এটা তো একটা খাল!

খাল না নদী সেদিন না দেখলে বোঝা যাবে না। ওইটে থানা।

অর্ক দেখল কয়েকজন অবাঙালি কানে পৈতে লাগিয়ে লোটা হাতে ঘোরাফেরা করছে। কলকাতার পুলিসের চেয়ে এদের চেহারা খুব নিরীহ। সে জিজ্ঞাসা করল, এখানকার পুলিসরা কেমন? খুব অত্যাচার করে?

মোটেই না। পুলিস কোন ঝামেলায় যায় না। কোথাও ঝামেলা হচ্ছে খবর পেয়েও পুলিস ঘণ্টাখানেক দেরি করে। ওই সময়ে যা হবার তা হয়ে গেলে তারপর পুলিস স্পটে পৌঁছাবে। আসলে কাউকে অ্যারেস্ট করলে ঝামেলা আরো বাড়ে আর গুলি করলে বোধহয় এত কৈফিয়ত দিতে হয় যে পুলিস, থানা থেকে বের হতে চায় না।

অর্ক বলল, তুমি তো অনেক জানো।

শানু হাসল, এসব কথা এখন শহরের বাচ্চারাও জানে।

সাইকেলে যত এগোচ্ছে তত মনে হচ্ছে শহরটা যেন প্রাণহীন। রাস্তায় তেমন লোকজন নেই। বাড়ি-ঘরের চেহারা এককালে ভাল ছিল বোঝা যায় কিন্তু এখন যেন অযত্নে রয়েছে। রাস্তার চেহারাও ভাল নয়। একটা মোড়ের কাছে এসে সাইকেল থামাল শানু, ওই মোড়টা ঘুরলেই ওদের পাড়া। ওরা ওখানেই বসে আড্ডা মারে।

অর্ক বলল, থামলে কেন? চল।

না, আমি যাব না। শানুর গলায় এবার স্পষ্ট জেদ।

অর্ক সাইকেল থেকে নামল। বেশ ব্যথা হয়ে গেছে পশ্চাদ্দেশ। সে পেটে হাত দিয়ে হান্টারটাকে স্পর্শ করে নিল। তারপর বলল, আমি ঘুরে আসছি। না আসা পর্যন্ত তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে। যদি না থাকো।

অর্ককে কথা শেষ শেষ করতে দিল না শানু, আমি থাকবো। তবে চটপট এসো। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না তুমি কেন ওখানে যাচ্ছ?

অর্ক কথাটার জবাব না দিয়ে এগিয়ে গেল। কয়েক পা হাঁটতেই মোড়ের মাঝখানে চলে এল সে। এখন পাতলা ছায়া নেমে গেছে পৃথিবীতে। সে সতর্ক চোখে চারপাশে তাকাতে তাকাতে হাঁটতে লাগল। এবার যে পাড়ার মধ্যে ঢুকে পড়েছে তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। তারপরেই তার নজরে পড়ল নেতাজী সংঘ সাইনবোর্ডটা। একটা চালাঘরের মধ্যে আট-দশজন গল্প করছে। এরাই কি? সে নিরীহ মুখে উঁকি দিতেই একটা ছেলে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। অর্ক হেসে ফেলল তারপর কোমর থেকে হান্টারটা বের করে ছেলেটির দিকে বাড়িয়ে ধরল, আপনার জিনিস।

এবার যেন ছেলেটি তাজ্জব। ঘরের অন্যান্যরা শব্দহীন হয়ে দৃশ্যটা দেখছে। অর্ক আবার বলল, নিন, ধরুন।

ছেলেটা এবার খপ করে অস্ত্রটা কেড়ে নিল। তারপর এক লাফে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। তার গলায় চিৎকার শোনা গেল, এই শালা তখন রংবাজি করেছিল! ওর সঙ্গী দুজনও উঠে দাঁড়াল। তৎক্ষণাৎ ঘরের মধ্যে বসে থাকা ছেলেদের একজন উঠে দাঁড়াল, দাঁড়া তোতন, আমি আগে ওর সঙ্গে কথা বলি। যে কথা বলল তার বয়স একটু বেশী, চেহারাও ভারী। তার কথার যে ওজন আছে তা বোঝা গেল। লোকটা এবার জিজ্ঞাসা করল, আপনার নাম কি?

অর্ক মিত্র। নিজের নামটা বলার সময় অর্ক দাঁড়িয়ে থাকা তিনজনের ওপর নজর রাখছিল। কথা বলতে পারার সুযোগটা যে আসবেই সে জানতো তাই এখন কিছুটা নিশ্চয়তাবোধ এসেছে। লোকটা বলল, কোন পাড়ায় থাকেন?

হাকিমপাড়ায় এসেছি। আমি কলকাতায় থাকি।

সেটা ওদের কথা শুনে বুঝতে পেরেছি। শানুকে আপনি চেনেন?

আগে চিনতাম না, তখনই আলাপ হয়েছে।

তাহলে বাঁচাতে গেলেন কেন?

অর্ক হাসল, কেউ অসহায়ভাবে মার খাবে তা দাঁড়িয়ে দেখা যায় না।

এবার লোকটা তোতন নামধারীর সঙ্গে চোখাচোখি করল। অর্ক বলল, কিন্তু এখানে কারো সঙ্গে আমার শত্রুতা করার ইচ্ছে নেই তাই ওটা ফেরত দিতে এসেছি।

আপনার সাহস তো খুব।

আমি অন্যায় করিনি তাই ভয় পাব কেন?

এই ক্লাবের কথা শানু আপনাকে বলেছে?

হ্যাঁ।

আপনি কবে এসেছেন এখানে?

আজ সকালে।

এর আগে জলপাইগুড়িতে কখনও এসেছেন?

না।

লোকটা কিছু ভাবল। তারপর বলল, তোতন, বসে পড়। আপনিও বসুন।

অর্ক মাথা নাড়ল, না, আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। আমার দাদুর খুব অসুখ। ওটা ফেরত দিতে এসেছিলাম, দেরি করলে হয়তো আপনারা ভুল বুঝতেন।

লোকটা বলল, দেখুন, এই শানু ছেলেটা খুব বাজে। ওর অভ্যাস পাড়ায় পাড়ায় মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করে বেড়ানো। শালা নিজেকে ফিল্মস্টার ভাবে। আপনি ওকে সাহায্য করেছেন না জেনে।

কিন্তু আপনারা ওকে যথেষ্ট শিক্ষা দিয়েছেন, তাই না?

কথাটার কেউ জবাব দিল না। অর্ক এবার তোতনের দিকে হাত বাড়াল, আসুন

তোতন ইতস্তত করছিল। লোকটা বলল, ঠিক হ্যায়। তোতন হাত মেলাও। এরকম সাহসী আমি খুব কম দেখেছি। তবে শানুকে বলে দেবেন যেন আর কখনও এপাড়ায় পা না দেয়।

তোতনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অর্ক বাইরে বেরিয়ে এল। লোকটাও সঙ্গে এল, আমার নাম দুলাল, জলপাইগুড়িতে কোন দরকার হলে আমাকে বলবেন। আপনি ক’দিন থাকবেন?

ঠিক নেই, দাদুর শরীরের ওপর নির্ভর করছে?

দাদুর নাম কি?

মহীতোষ মিত্র।

কোন বাড়িটা?

টাউন ক্লাব মাঠের পাশে।

কলকাতায় কোন অঞ্চলে থাকেন?

বেলগাছিয়া।

ওখানে আপনাদের টিম খুব শক্তিশালী, না?

অর্ক অবাক হল। কিসের টিম? সে তো কোন খেলাধুলা করে না। কিন্তু আন্দাজে ঘাড় নাড়ল। দুলাল বলল, ওদের মুখে আপনার ডায়লগ শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম। তা যদ্দিন এখানে আছেন মাঝে মাঝে চলে আসবেন। আড্ডা মারা যাবে।

কথা বলতে বলতে ওরা মোড়ের মাথায় চলে এসেছিল। অর্ক দেখল যেখানে শানুর দাঁড়িয়ে থাকার কথা সেখানে সে নেই। দুলালের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে সাইকেলের পথটা ধরে জোর পায়ে হাঁটতে লাগল। খানিকটা যাওয়ার পর কোন আড়াল থেকে শানু সাইকেল নিয়ে সহসা উদিত হল। তাকে দেখে অর্কর বেশ মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, কোথায় গিয়েছিলে?

বাঃ, তুমি মালগুলিকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছিলে, আমি কি করে থাকি?

সাইকেলের রডে বসে অর্ক বলল, তাড়াতাড়ি চালাও। ততক্ষণে অন্ধকার নেমে গেছে। রাস্তার ধারের আলোগুলো কোন কারণে জ্বলছে না। অর্ক বুঝতে পারছিল শানু কি হল জানবার জন্যে ছটফট করছে কিন্তু সে গম্ভীর হয়ে থাকায় সাহস পাচ্ছে না। টাউনক্লাবের পাশে এসে সে নেমে পড়ল, শোন, ওই পাড়ায় তুমি আর কখনও যেও না।

যাব না? শানুকে হতভম্ব দেখাল।

গেলে ওরা শেষ করে ফেলবে। আর পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে প্রেম করো কেন?

কোন শালা বলেছে? জিন্দিগীতে আমার শর্মিলা ছাড়া আর কেউ নেই।

আমি ওসব জানি না, ওরা যা বলেছে বলে দিলাম। আচ্ছা, এখানকার মাস্তানরা টাকা কামায়? অর্ক শানুকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করল। এ

টাকা পয়সা? না তো। শুধু পুজোর সময় চাঁদা তোলে।

পার্টি থেকে সাহায্য করে না?

না তো। শানু যেন কিছুই বুঝতে পারছে না। অর্ক মাথা নাড়ল। তারপর হন হন করে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল। এখানকার মাস্তানির সঙ্গে কলকাতার অনেক পার্থক্য। এই ছেলেগুলোর ভদ্রতাবোধ আছে, টাকার জন্যে ধান্দাবাজী নেই। খুরকি কিলা কোয়ার মত হিংস্র এবং শঠ নয়। দুলাল তোতনদের আপত্তি এটুকুই যে তাদের পাড়ার মেয়ের সঙ্গে বাইরের ছেলে প্রেম করতে আসতে পারবে না। হায়, কলকাতায় এটা নিয়ে কেউ মাথাই ঘামায় না।

মহীতোষের দ্বিতীয় স্ট্রোক হয়ে গেল। ডানদিকটা যা এতকাল সচল ছিল তাও অকেজো হয়ে গেল। এখন সমস্ত শরীর অনড়। ডাক্তার আসার আগেই মাধবীলতা সেটা বুঝতে পেরেছিল। মহীতোষের যে হাতের মুঠি তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছিল তা হঠাই নরম হয়ে খসে পড়েছিল বিছানায়। এমন কি মুখ ফেরানোর শক্তিটুকুও অবশিষ্ট রইল না। কিন্তু সেইসঙ্গে আর একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটল। মহীতোষের গলা থেকে যে শব্দ এতকাল বেরোত তা গোঙানি ছাড়া কিছু নয়। একমাত্র ছোটমা তার অর্থ বুঝতে পারতেন। দ্বিতীয় স্ট্রোকের পর সেই শব্দ আচমকা স্পষ্ট হয়ে গেল। অত্যন্ত নির্জীব কণ্ঠ কিন্তু কথা বোঝা যায়। সমস্ত শরীর স্থির, মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই, চোখের পলক পড়ছে না কিন্তু কথা বলতে পারছেন মহীতোষ।

ডাক্তার ঘণ্টাখানেক বসে থেকে অনিমেষকে নিয়ে পাশের ঘরে চলে এলেন, বুঝতেই পারছেন আমার কিছুই করার নেই। হাসপাতালে রিমুভ করেও কিছু কাজ হবে না। আমার বিস্ময় লাগছে উনি কি করে ভয়েস ফিরে পেলেন!

বাবা তাহলে কোনদিনই সারবেন না?

সত্যি কথাটা তাই। এখন যে কদিন আছেন ওঁকে শান্তিতে থাকতে দিন। এসব ক্ষেত্রে বোধটুকু থাকে না। ফলে চলে যাওয়ার আগে কোন কষ্ট মানুষ বুঝতে পারে না। এটা খুব ব্যতিক্রম। বোধ যখন আছে তখন আপনাদের ওপর চাপ পড়বে।

অনিমেষ দুহাতে মুখ ঢাকল, কোন চিকিৎসাই নেই?

ডাক্তার কোন উত্তর দিলেন না। ছোটমা পাথরের মত দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। হেমলতাকে কাছাকাছি দেখা যাচ্ছিল না। মহীতোষ যেসব ওষুধ খেতেন সেগুলো দেখে ডাক্তার আর ওষুধ পাল্টালেন না। বললেন, দিন তিনেক যাক তারপর চিন্তা করব কি করা যায়। এখন কেউ ওঁর সঙ্গে কথা বলবেন না। ওঁকে কথা বলতে দেওয়া উচিত হবে না।

ডাক্তার উঠে দাঁড়াতে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আপনার–?

ডাক্তার হাসলেন, না, না, আপনার কাছ থেকে কিছু নিতে পারব না।

আমার কাছ থেকে, কেন?

ডাক্তার সামান্য ইতস্তত করে বললেন, এ নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে, আজ আমি চলি, আপনাকে আর আসতে হবে না।

ক্রাচ নিয়ে অনিমেষ ডাক্তারের সঙ্গে বারান্দায় এল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ ডাক্তার বললেন, আপনার সঙ্গে এর মধ্যে কেউ যোগাযোগ করেনি?

কে করবে? আমি বুঝতে পারছি না।

ডাক্তার মাথা নাড়লেন। তারপর বললেন, আপনার মানসিক অবস্থা ভাল নেই বুঝতে পারছি। তবে কাল একজন আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। আর ওঁর কোন প্রয়োজন হলেই আমায় খবর দেবেন। গেট খুলে বেরিয়ে গেলেন ভদ্রলোক।

অনিমেষ ভ্রূ কুঁচকে দাঁড়িয়েছিল। লোকটার কথাবার্তা যেন কেমন অন্য সুরে বাঁধা। একটু অস্বাভাবিক। প্রতিটি কথায় অন্যকিছু ইঙ্গিত আছে। দেখা যাক, কে আসছে আগামীকাল। কেন আসছে তখনই বোঝা যাবে।

কি হবে?

পেছন থেকে প্রশ্নটা আসতেই চমকে মুখ ফেরাল অনিমেষ। ছোটমা দাঁড়িয়ে আছেন দরজায়। মুখে কোন স্পন্দন নেই। অনিমেষ বলল, দেখা যাক। তারপর মনে পড়ায় বলল, পিসীমা কোথায়?

ঠাকুর ঘরে।

অনিমেষ ধীরে ধীরে ছোটমার পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকল। তারপর যতটা সম্ভব ক্রাচের শব্দ বাঁচিয়ে ভেতরের বারান্দা দিয়ে ঠাকুর ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। এদিকটায় ঘন অন্ধকার। আলো। জ্বালানো হয়নি। সে ভেজানো দরজা ঠেলতেই দৃশ্যটা দেখতে পেল। প্রদীপ জ্বলছে ঠাকুরঘরে। অনেকরকম দেবদেবী এবং অবতারের ছবির সামনে পাথরের মত বসে আছেন হেমলতা। তাঁর দুই গাল জলে ভেজা। মাঝে মাঝে সমস্ত শরীর কেঁপে উঠছে থরথরিয়ে। অনিমেষ ধীরে ধীরে তাঁর পাশে এসে দাঁড়াল। তারপর ক্রাচে ভর করে মাটিতে বসে পিসীমার কাঁধে হাত রাখতেই তিনি চমকে তাকালেন। অনিমেষ চাপা গলায় বলল, পিসীমা।

হেমলতা এবার ডুকরে কেঁদে উঠলেন, ঠাকুর, মহীর আগে আমায় নিয়ে নাও।

অনিমেষ দুহাতে হেমলতার পাখির মত হালকা শরীর জড়িয়ে ধরল, পিসীমা।

তুই কে, ছেড়ে দে আমাকে, ছেড়ে দে। হেমলতার ক্রন্দন উচ্চতর হল।

আমি অনি। অনিমেষের গলা বুজে আসছিল।

অনি, বল তুই, সত্যি করে বল, তুই কি অনি? হেমলতা তাকে আঁকড়ে ধরলেন।

৩৪. পাপ, পাপ, মহাপাপ

পাপ, পাপ, মহাপাপ! কণ্ঠস্বর মোটেই ভরাট নয়, উচ্চগ্রামেও নয় কিন্তু একটা কনকনে শীতের হাওয়ায় জড়ানো শব্দগুলো। মাধবীলতা চমকে উঠল। শরীরের কোথাও কোন কম্পন নেই, ভূপতিত গাছের মত পড়ে আছেন মহীতোষ। অথচ শব্দগুলো বেরিয়ে আসছে স্বচ্ছন্দে। মাধবীলতা বুঝতে পারল না কার পাপ, কিসের পাপ, কোন পাপের কথা বলছেন মহীতোষ। কিন্তু তিন চার মিনিট অন্তর অন্তর তাকে ওই তিনটে শব্দ শুনতে হচ্ছে। এখন অনিমেষ বা হেমলতা ধারে কাছে নেই, ছোটমাও অনেকক্ষণ এদিকে আসছেন না।

মাধবীলতা সাহস সঞ্চয় করল, আপনি কথা বলবেন না!

চোপ! চোপ। মহাপাপ। তিনটে শব্দ পৃথক স্বরে উচ্চারিত হল।

মাধবীলতা একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মহীতোষকে লক্ষ্য করল। না, শব্দগুলোর কোন প্রতিফলন মুখে হচ্ছে না। ওর মনে হল মহীতোষ পূর্ণ চেতনায় কথা বলছেন না, কি বলছেন তাও বুঝছেন না। সে মহীতোষের মাথায় হাত রাখল, বাবা, আপনি বিশ্রাম নিন।

কে বাবা? কার বাবা? হাত সরাও। পাথরের মত মুখ থেকে শব্দগুলো ছিটকে এল।

বাবা, আপনি ঘুমোন। এখন কথা বলবেন না।

কথা বলব না! জ্ঞান দিচ্ছে! কে তুমি?

মাধবীলতা ঠোঁট কামড়ালো। সেই সঙ্গে তার মনে এক ধরনের জেদ জন্ম নিল। সে নিচু গলায় বলল, আমি আপনার বউমা।

বউমা? অ। মহীতোষ যেন আচমকাই চুপ করে গেলেন। মাধবীলতা কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ লক্ষ্য করল কিন্তু মানুষটার কোন সাড়াশব্দ পেল না। শরীর তো স্থির এবং কথাও যখন বন্ধ হয়ে থাকে তখন অস্বস্তি হয়। সে ডাকল, বাবা!

মহীতোষ জিভ নাড়লেন। এই একটি অঙ্গের সঞ্চালনে তিনি সক্ষম। কোন অলৌকিক প্রক্রিয়ায় এমন কাণ্ড ঘটল মাধবীলতা জানে না। মহীতোষ কিছু বলার আগেই ব্যাপারটা চোখে পড়ল। ডাক্তার বলেছিলেন একটা বড় অয়েলক্লথ কিনতে। নিত্য তাতে পাউডার ছিটিয়ে মহীতোষকে শুইয়ে দিতে হবে। পেচ্ছাপ পায়খানা করলে যাতে বিছানা না ভেজে এবং একনাগাড়ে শোওয়ার ফলে শরীরে ঘা না জন্মায় তারই জন্যে এই ব্যবস্থা। আজ সকালে অর্ককে দিয়ে সেরকম একটা কিনে আনা হয়েছে কিন্তু এখনও তা বিছানায় পাতা হয়নি। এখন মহীতোষ বিছানা ভাসিয়ে দিয়েছেন। চাঁদর তোষক সব চপচপে হয়ে উঠেছে। ওই মানুষটাকে একা নড়ানোর সাধ্য মাধবীলতার নেই। সে বিব্রত হয়ে তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল।

হেমলতা ঠাকুরঘরে। মাধবীলতা রান্নার ঘরের দরজায় এসে দেখল ছোটমা জ্বলন্ত উনুনের। সামনে গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। সে ডাকল, মা।

ছোটমা মুখ ফেরালেন। আর তখনই মাধবীলতার বুক ছ্যাঁত করে উঠল। এরকম বিষণ্ণ এবং নিঃস্ব চাহনি সে কখনো দ্যাখেনি। অত্যন্ত দুঃখী এবং একা মানুষের মুখ এরকম হয়। সে নিচু গলায় বলল, মা—।

কি হয়েছে? ছোটমা মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

বাবা বিছানায়—।

ওঃ, আমি আর পারছি না। আমার মরণও হয় না, ভগবান। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন ছোটমা। তাঁর ডান হাত সজোরে কপালে আঘাত করল। মাধবীলতার ভয় হল উত্তেজনার ঝোঁকে ছোটমা না আগুনের মধ্যে পড়ে যান। সে দ্রুত পায়ে রান্নার ঘরে ঢুকে বলল, মা, এমনভাবে ভেঙে পড়বেন না।

ভাঙব না? ছোটমা ফুঁসে উঠলেন, একটা মানুষ কতদিন সহ্য করতে পারে বল? দোজবরের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। এই বাড়িতে যখন এলাম তখন মস্ত বড় ছেলের মন পেতে হবে, স্বামীর সেবা করতে হবে। আর সর্বত্র আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হল মরে যাওয়া সতীন। তার মত বউ নাকি হয় না। বিয়ের পর চা-বাগানে নিয়ে যাওয়া হল আমাকে। ভাবলাম একা একা হয়তো স্বামীর মন পাব। তা তিনি আমাকে দেখে মরা বউ-এর কথা ভাবেন আর হা-হুঁতাশ করেন। মদ খান আর মা মা করেন। দিনরাত মারধর খেতাম তখন। কিন্তু ভাবতাম সব ঠিক হয়ে যাবে, আমিও মা হব। হল না, কিছুই। হল না, শুধুই ঝিগিরি করে যাওয়া। হাউ হাউ কান্নাটা ছিটকে বেরিয়ে এল। আর তখনই মাধবীলতা নাড়া খেল। তার সহকর্মীরা বলে, কখনও কখনও অনিমেষও, তার মত মহিলা নাকি হয় না। এমন আত্মত্যাগ নাকি দেখা যায় না। সেদিন সুচিত্রা বলেছিল টিচার্সরুমে, আজকের দিনে এরকম স্যাক্রিফাইস কেউ বিশ্বাস করবে না। ছাই, লোকে বাড়িয়ে বলে। অনিমেষের জন্যে সে যা করেছে তাতে এক ধরনের স্বার্থ কাজ করত। সেটা অন্ধের মত ভালবাসা। হ্যাঁ, ভালবাসা যখন অন্ধ হয়ে যায় তখন স্বার্থপরতা আসে। তারই নেশায় সে যা করার তা করেছে। কিন্তু ছোটমা তো ভালবেসে বিয়ে করেননি। তাঁকে জোর করে এই পরিবারের সঙ্গে জুতে দেওয়া হয়েছিল। কিসের স্বার্থে তিনি এইভাবে নিজেকে নিঃস্ব করে দিলেন?

আঁচলে চোখ মুছলেন ছোটমা। তারপর অন্যরকম গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ওরা কেউ নেই? অনিমেষ, অর্ক?

নিশ্চয়ই আছে। ডাকব?

হ্যাঁ। চল। আমি একা তো আর ওঁকে নাড়াতে পারব না। ছোটমা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াতেই মাধবীলতা পেছন ফিরল। এবং তখনই ছোটমা তাকে ডাকল, শোন! তুমি আমাকে পছন্দ করতে পারনি আমি জানি। আসলে মেয়েরা চট করে কোন মেয়েকে মেনে নিতে পারে না। আমিও পারিনি। তোমাকে দেখে আমার খুব হিংসে হয়েছিল তাই বিয়ের কথা তুলেছিলাম। কিছু মনে করো না।

মাধবীলতা আর দাঁড়াল না। দাঁড়াতে পারল না।

.

পরমহংসকে চিঠি লিখল অনিমেষ। এখানে আসার পর যা ঘটেছে সব জানাল। এখন এই সংসার সম্পূর্ণ অচল। মহীতোষের সেবা শুশ্রূষা করার জন্যে একটা লোক রাখা দরকার। ছোটমায়ের পক্ষে আর বোঝা টানা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। যা অবস্থা তাতে যে কোন দিন মহীতোষ কিংবা হেমলতা চলে যেতে পারেন। তাছাড়া ঘাড়ের ওপর একটা মামলা ঝুলছে, সেটার হালচাল সম্পর্কে তেমন কিছু জানা নেই। এই অবস্থায় দুটো উপায় সামনে খোলা আছে। এক, টাকা পয়সা দিয়ে লোক রাখা যাতে এদের কোন অসুবিধে না হয়। দুই, তাদের চিরকালের জন্যে এখানে এসে থাকা। দুটোই সম্ভব নয়। কারণ তাদের কোন উদ্বৃত্ত অর্থ নেই যা এখানে পাঠানো যায়। আর এখানে থাকলে মাধবীলতার চাকরি বিনা না খেয়ে মরতে হবে। এই অবস্থায় কি করা যায় তার মাথায় ঢুকছে না। এখানে এসে তার শরীর ভালই আছে। অনেক চাঙ্গা লাগছে এখানে। কলকাতার ঘিঞ্জি পরিবেশ থেকে বেরিয়ে এসে যেন নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচছে। দিনরাত আর সেইসব অশ্লীল কথার ঘিনঘিনানি গায়ে মাখতে হচ্ছে না! অর্ককেও যে ওই পরিবেশের বাইরে আনতে পেরে নিশ্চিন্ত হওয়া গেছে তাও লিখল অনিমেষ। কিন্তু ফিরতে হবেই যখন তখন আর এসব ভেবে লাভ কি! কলকাতাকে দূর থেকে রাক্ষুসীর মত মনে হচ্ছে। চিঠির শেষে জুড়ে দিল, যদি পরমহংস এখানে আসে তাহলে ওদের ভাল লাগবে। নতুন বাড়িটা যদি হাতছাড়া না হয় তাহলে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।

এতসব লেখার পর অর্কর হাতে চিঠিটা ডাকে পাঠিয়ে অনিমেষের নিজের কাজের জন্যেই খটকা লাগল। কতকাল পরমহংসের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। তিন-চারদিন সে সহানুভূতি দেখাতেই এত কথা তাকে লেখা গেল। এভাবে নিজের সমস্যা অন্য কাউকে বলতে পারার মধ্যে সুখ আছে কিন্তু কয়েক সপ্তাহ আগেও সে ব্যাপারটা চিন্তা করতে পারত না। মানুষ পরিবেশের এবং পরিস্থিতির চাপে নিজেকে পাল্টে নেয়, যে কোন জন্তুর মত, হয়তো গাছের মতও। অনিমেষ দুপুর রোদে বারান্দার চেয়ারে বসে গাছগাছালি দেখছিল। হঠাৎ তার মনে হল সরিশেখর ছোটবাড়ি থেকে লাঠি হাতে বেরিয়ে আসছেন। সে চমকে স্পষ্ট চোখে তাকাতেই দেখল একটা কলাগাছের মরা সাদা পাতা হাওয়ায় দুলছে। অনিমেষের বুক নিংড়ে বাতাস বেরিয়ে এল। দাদুকে অনেকদিন বাদে এমন করে মনে পড়ল। এই বাড়িটা দাদু বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে তৈরি করেছিলেন। কি হল? মানুষের সাধ কখনও পূর্ণ হয় না তবু মানুষ সাধ করে যায়। আজ বাবাকে যখন বিছানা থেকে তোলা হল তখন থেকেই এক ধরনের ক্ষরণ শুরু হয়ে গেছে ভেতরে ভেতরে। মানুষের মৃত অসহায় জীব আর কেউ নেই।

এইসময় গেটে শব্দ হল। অনিমেষ দেখল একজন প্রৌঢ় মানুষ বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছেন। লোকটাকে তার খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে অথচ মাথার সাদা চুল চেহারাটাকে যেন গুলিয়ে দিচ্ছে। খাকি প্যান্টের ওপর সাদা সুতির হাওয়াই শার্ট পরা মানুষটি ভেতরে পা ফেলতেই এবার স্মৃতি স্পষ্ট হল। অনিমেষ হাত বাড়িয়ে ক্লাচদুটো টেনে নিতে না নিতেই মানুষটি বারান্দার সিঁড়িতে পা ফেলে থমকে দাঁড়াল। তার চোখ এখন অনিমেষের ওপর স্থির। তারপর খুব আন্তরিক হাসি ফুটে উঠল মুখে, আমাকে চেনা যাচ্ছে?

অনিমেষ উদ্বেলিত হচ্ছিল। কিন্তু যতটা সম্ভব সতর্কতার সঙ্গে সে ঘাড় নাড়ল, জুলিয়েন না?

যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। আমার ভয় হচ্ছিল যদি পরিচয় দিতে হয়!

আসুন। অনিমেষ উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল।

জুলিয়েন বাধা দিল, আরে থাক থাক, আপনাকে উঠতে হবে না।

অনিমেষ তবু উঠল। ওপাশে পড়ে থাকা চেয়ারটাকে টেনে আনল সামনে, বসুন।

আরাম করে বসে জুলিয়েন বলল, আমাকে দেখে বেশ অবাক হয়েছেন, তাই না?

খানিকটা। ঠিক আশা করা যায়নি।

আমিও অবাক হয়েছিলাম। গতকাল যখন শুনলাম আপনি এসেছেন এবং শরীরের এই অবস্থা তখন অবাক-ভাবটা কাটলো।

সে কি! তার আগে অবাক হচ্ছিলেন কেন?

আমরা প্রথমে জানতাম আপনাকে ওরা শেষ করে ফেলেছে। এরকম খবরই আমাদের কাছে এসেছিল। বছর খানেক আগে আপনার সঙ্গে জেলে আটকে থাকা একটি ছেলে বেরিয়ে এসে খবর দিল আপনি নাকি সেই বন্দীমুক্তির আগেই রিলিজড় হয়েছেন। রিলিজড় হয়ে আপনি কোথায় গিয়েছেন তা কেউ বলতে পারেনি। আপনার বাবাও নাকি কলকাতায় গিয়ে সন্ধান পাননি। তারপর থেকেই আমরা খোঁজ নিতাম এই বাড়ির সঙ্গে কোন যোগাযোগ আপনার আছে কি না। সেটাও নেই জেনে অবাক হয়েছিলাম। সেই সময় যারা একসঙ্গে কাজ করেছি আজ তাদের অনেকের চরিত্র পাল্টে গেছে। আপনার ক্ষেত্রে সেটা ভাবতে একটু কষ্ট হচ্ছিল। তা কালকেই জানতে পারলাম আপনি এসেছেন এবং ওরা এই হাল করে ছেড়েছে। জুলিয়েন ঠোঁট মুচড়ে অনিমেষের পায়ের দিকে তাকাল। ওর চোখ ছোট হয়ে এসেছিল।

অনিমেষ এতক্ষণ চুপচাপ জুলিয়েনের কথাগুলো শুনছিল। শেষ হতেই জিজ্ঞাসা করল, কার কাছে আমার আসার খবর পেলেন?

জুলিয়েন যেন বেশ অবাক হল, সে কি! আপনি বুঝতে পারেননি?

একটু চুপ করে থেকে অনিমেষ এবার ধীরে ধীরে ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ। ডাক্তারবাবুর কথাবার্তা এতক্ষণে স্পষ্ট হয়ে গেল। জুলিয়েন এবার জিজ্ঞাসা করল, শরীর ছাড়া আপনি কেমন আছেন?

আছি এই মাত্র। আমার পক্ষে শুধু দেখে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করা সম্ভব নয়!

সে কি! কাল তো আপনিই ডাক্তারকে ডাকতে গিয়েছিলেন!

হ্যাঁ, ওইটুকুই ক্ষমতা।

মনে হচ্ছে আপনি মনে মনে খুব আপসেট হয়ে রয়েছেন।

দেখুন, এতগুলো বছর জেলখানা আর বস্তির একটা বদ্ধ ঘরে শুয়ে থেকে আমার পক্ষে আর কি করা সম্ভব! ছেড়ে দিন এসব কথা। আপনাদের খবর বলুন।

আমি ভেঙে পড়িনি। অবশ্য আমি একা নই, আমাদের দলটা বাড়ছে।

আপনি কি আগাগোড়াই বাইরে ছিলেন?

হ্যাঁ। নেপালে। সেখান থেকে বাংলাদেশে কিছুদিন আবার নেপালে। এদেশের জেলের ভাত এখনও আমার পেটে পড়েনি। জুলিয়েন হাসল।

অনিমেষ সতর্কচোখে মানুষটিকে পরিমাপ করল, আপনি কি এখনও স্বপ্ন দেখেন?

অবশ্যই। জুলিয়েনের কণ্ঠস্বর হঠাৎ জোরালো হল, স্বপ্ন দেখা ছাড়া মানুষ বেঁচে থাকতে পারে। তখন আমাদের অনেক গোলমাল ছিল। ক্ষমতা সম্পর্কে মোটেই সচেতন ছিলাম না। একটা মোষের পক্ষে হাতির সঙ্গে লড়াই করা সম্ভব নয়। কিন্তু তেমন তেমন বাইসন হলে কিছুক্ষণ লড়ে যেতে পারে। আর যদি ধূর্ত বাঘ হয় তাহলে চান্স ফিফটি ফিফটি। এটাই আমরা বুঝিনি। তাছাড়া আর একটা ব্যাপার আছে, অন্য দেশের ধার করা শ্লোগান দিয়ে আর এক দেশে বিপ্লব হয় না। এই তো এত বছর হয়ে গেল সি পি এম সি পি আই এই দেশে আন্দোলন করছে, এখন তো আমাদের মাথায় জনদরদী বামফ্রন্ট সরকার। কিন্তু আপনি জিজ্ঞাসা করে দেখুন কটা সাধারণ মানুষ ইনকিলাব শব্দটার মানে জানে? জানে না কিন্তু পাখির শেখা বুলির মত কপচায়। এতে কোন লাভ হবে না। চীনের চেয়ারম্যান কখনও আমাদের চেয়ারম্যান হতে পারে না।

অনিমেষ বলল, আমি আপনাকে ঠিক বুঝতে পারছি না।

কেন?

আপনারা ঠিক কি করতে চাইছেন? আমার কাছে কেন এসেছেন?

জুলিয়েনের একটা হাত হঠাৎ এগিয়ে এসে অনিমেষের হাতের ওপর পড়ল, আপনি আমাদের সঙ্গে আসুন। আমরা আবার নতুন করে শুরু করতে চাই, আপনি মদত দিন। তাছাড়া আর একটা ব্যাপারে আমি আপনার কাছে দায়বদ্ধ আছি।

দায়! আমার কাছে? অনিমেষ অবাক।

হ্যাঁ। স্বৰ্গছেঁড়ায় যে ঘটনাটার পর আপনার সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি সেই ঘটনাটা মনে আছে? একজনকে ব্রিজের নিচে বালিতে আমরা কবর দিয়েছিলাম!

চকিতে অনিমেষের সব মনে পড়ল। সেইরাত্রে ওরা একটি সুপরিকল্পিত ডাকাতি করেছিল। ওদের একজনের মৃত্যু হয়। প্রচুর টাকা এবং সেই মৃতদেহ নিয়ে ওরা পালিয়েছিল। তখন অস্ত্র সংগ্রহের জন্যে টাকার দরকার। তাছাড়া চিহ্নিত লোকটি প্রকৃত অর্থেই অত্যাচারী এবং শোষক ছিল। অ্যাকশনের নেতৃত্ব তার হাতেই ছিল। লোকটি মারা যায় কিন্তু ওদের একজন মদেশিয়া কমরেডকে হারাতে হয়। বাক্স ভরতি সেই টাকাগুলো জুলিয়েনের জিম্মায় ছিল। তারপর অনবরত পুলিসের সঙ্গে লুকোচুরি, জায়গা পাল্টানোর ফলে জুলিয়েনের সঙ্গে আর যোগাযোগ ছিল না। জুলিয়েন কি সেই কথাই বলতে চাইছে?

অনিমেষ বলল, সবই মনে আছে। কিন্তু তাতে আমার কাছে আপনার কি দায় রয়েছে তা আমি বুঝতে পারছি না।

টাকাগুলো এখনও যেমন ছিল তেমন রয়েছে।

তার মানে? অনিমেষ সোজা হয়ে বসল।

আমাকে পালাতে হয়েছিল। ডুয়ার্সে আপনার চেয়ে আমি বেশি পরিচিত। আমাকে ধরা পুলিসের পক্ষে খুব সহজ। তাই পালাবার আগে ব্যাগ লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলাম। জুলিয়েন হাসল।

কোথায়?

একজনের কাছে। একজন গরীব মদেশিয়া মহিলার কাছে। অবশ্য মদেশিয়াদের মহিলা বলার রেওয়াজ এখনও হয়নি। জুলিয়েন মাথা নাড়ল।

সেই মহিলা এত বছর টাকাগুলো রেখে দিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। ব্যাগটা বোধহয় খুলে দ্যাখেননি।

আশ্চর্য! অনিমেষ বিশ্বাস করতে পারছিল না। বলা হয়।

অবশ্যই। তবে এখনও তো অনেক আশ্চর্য ঘটনা পৃথিবীতে ঘটে থাকে।

সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষ জুলিয়েনকে আর একবার দেখল। একজন আদিবাসী মহিলা সতোর সঙ্গে হাজার হাজার টাকা পনের বছর পাহারা দিয়েছেন, হাত দেননি। এটা অবশ্যই আশ্চর্যজনক ঘটনা। সেই মহিলার সঙ্গে জুলিয়েনের কি সম্পর্ক তা সে জানে না। কিন্তু এতদিন বাদে তার মত একজন পঙ্গু অথর্ব মানুষের কাছে এসে সেই টাকা অটুট আছে তা জুলিয়েন জানাতে এসেছে। কি প্রয়োজন ওর? স্বচ্ছন্দে সেই টাকা হজম করে দিতে পারত ও। আর একজন জীবিত মানুষকে যেচে জানাতে আসাটা কি আরও বেশি আশ্চর্যজনক নয়?

অনিমেষ বলল, এসব কথা আমাকে বলছেন কেন?

জুলিয়েন বলল, সেদিন যারা আমাদের সঙ্গী ছিল তারা ওই ঘটনাকে ভুলে যেতে চায়। তাদের জীবনযাত্রাও পাল্টে গিয়েছে। তাছাড়া দুজন বোধহয় মরেও গিয়েছে এর মধ্যে। আপনি আছেন জানার পর আমি খোঁজ করে যাচ্ছি। ওই টাকাগুলোর একটা ব্যবস্থা করতে আপনার সম্মতি দরকার।

অনিমেষ হাসল, দেখুন, আমার কাছে টাকাগুলোর থাকা আর না থাকা সমান ব্যাপার। আপনি যা খুশি তাই করতে পারেন। আর করলেও তো সেটা আমি জানতে পারতাম না। তাই না?

জুলিয়েনের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, আপনি কি ইঙ্গিত করছেন জানি না, তবে ওইদিনের নেতৃত্ব আপনার হাতে ছিল। টাকাগুলো আমি ব্যক্তিগতভাবে খরচ করতে পারি না। সেটা এখন আপনার বোঝা উচিত।

আপনি কিভাবে খরচ করতে চাইছেন?

জুলিয়েন তার খাকি প্যান্টের ওপর হাত ঘষল। তারপর বলল, বিপ্লবের উদ্দেশ্যে ওই টাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। অথচ সবই ভেস্তে গিয়েছিল। এখন আমরা নতুনভাবে চিন্তা-ভাবনা করছি। কিছু কিছু কাজও শুরু হয়েছে তবে খুবই প্রাথমিক স্টেজে। টাকাটা আমার ইচ্ছে এই কাজে ব্যয় করা হোক।

অনিমেষ বলল, আপনারা কি কাজে নেমেছেন, তার পথ এবং উদ্দেশ্য কি আমার জানা নেই। তবে আপনার ইচ্ছে যখন তখন টাকাটা আপনি ব্যবহার করতে পারেন, আমার কোন আপত্তি নেই।

আমার ইচ্ছেটাকেই মেনে নিচ্ছেন?

হ্যাঁ। কারণ টাকাটার অস্তিত্বই আমি জানতাম না আপনি না জানালে।

জুলিয়েন অবাক হচ্ছিল, আপনি নির্দ্বিধায় টাকাটা ছেড়ে দিলেন?

অনিমেষ বলল, কি করব? ডাকাতির ভাগ চাইবো?

এভাবে বলছেন কেন?

ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্ন উঠলে তো তাই বলতে হয়। ব্যক্তিগত মালিকানার উদ্দেশ্যে কি আমরা টাকাটা সংগ্রহ করেছিলাম? করিনি। একটি মানুষের প্রাণ ওর সঙ্গে জড়িত আছে। তার সম্মানের জন্যেও আমরা কেউ ওই টাকা নিজের স্বার্থে খরচ করতে পারি না। অতএব ছেড়ে দেওয়া কথাটা উঠতেই পারে না। আপনারা যখন কিছু ভাবছেন এবং সেটা যদি সাধারণ মানুষের ভালর জন্যে হয় তাতেই ওটা খরচ করুন। তা যদি না হয় তাহলে অনুরোধ, হয় মাদার তেরেসা নয় ওইরকম কোন প্রতিষ্ঠানে দিয়ে দেবেন। ওঁরা মানুষের যা উপকার করেন একটা বড় রাজনৈতিক দল হাজার বক্তৃতার পরেও তার ক্ষুদ্রাংশ করতে পারে না। অনিমেষ ক্রাচে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল, চা খাবেন?

জুলিয়েন সজোরে মাথা নাড়ল, না। ওসব পাট শেষ করে দিয়েছি।

ওসব পাট মানে?

চা সিগারেট মদ। আপনি বসুন। ও হ্যাঁ, আপনার বাবা কেমন আছেন?

বাবার কথা আপনি–ও, বুঝতে পারছি। একইরকম আছেন। সমস্ত শরীর অসাড় শুধু বাকশক্তি ফিরে এসেছে। আপনি কি এখন জলপাইগুড়িতেই আছেন?

না। চালসায় আছি। কাল রাত্রে খবর পেয়েছি। অনিমেষ, আমি কিন্তু এখনও স্বপ্ন দেখি। আমার বয়স আপনার চেয়ে অন্তত বছর পনের বেশী হবে। তবু স্বপ্ন দেখতে আমার বাধছে না। আপনি কিন্তু আমায় এড়িয়ে যাচ্ছেন। ও অনিমেষ সেই যুবক জুলিয়েনের কথা মনে করার চেষ্টা করল। সে যখন স্কুলের ছাত্র তখনই জুলিয়েন স্বৰ্গছেঁড়া চা বাগানের শ্রমিকদের নেতৃত্ব দিচ্ছে। সেই মদেশিয়া যুবক এখন প্রৌঢ়ত্বের শেষ সীমায়। কিন্তু শরীরের গঠন এখনও মজবুত। সে জিজ্ঞাসা করল, আপনার পরিবারের খবর কি?

হঠাৎ এই প্রশ্ন? স্ত্রী মারা গেছেন আমি বিদেশে থাকতেই। ছেলেমেয়েরা যে যার নিজের মত করে খাচ্ছে। বড় হয়ে গেছে ওরা, আমার সঙ্গেও ব্যবধান বেড়েছে। আপনার তো এক ছেলে। জুলিয়েন হাসল।

হ্যাঁ। কথাটা বলার সময়ে মাধবীলতার মুখ মনে পড়ল অনিমেষের। জুলিয়েনের কথা মাধবীলতা জানে। তাকে ডেকে আলাপ করিয়ে দেওয়া খুবই সঙ্গত কাজ। কিন্তু অনিমেষের মনে যেন দ্বিধা জন্মাল। দেখা যাক, আর একটু দেখা যাক। আজ, অনেক অনেকদিন পরে জুলিয়েনের সঙ্গে দেখা হওয়ায় নিজেকে যেন আলাদা মনে হচ্ছে। এত কথা এমনভাবে অনেকদিন বলেনি সে।

জুলিয়েন প্যান্টে হাত ঘষল আবার, আপনি এড়িয়ে যাচ্ছেন?

অনিমেষ আবার চেয়ারে হেলান দিল, জুলিয়েন, আমি শেষ হয়ে গেছি।

কে বলল? কখনও না। একটা মানুষের শরীরে যতক্ষণ রক্ত চলাচল করে ততক্ষণ সে শেষ হয় না। আপনি এসব চিন্তা ছাড়ুন।

কিন্তু আমি হাঁটতে পারি না–এ দুটো ছাড়া। সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠে আসতে পারি না। পৃথিবীর সর্বত্র কেউ আমার জন্যে সমান জায়গা বিছিয়ে রাখবে না। আমার পক্ষে স্বপ্ন দেখাও বাতুলতা।

জুলিয়েন মাথা নাড়ছিল ঘন ঘন, এসব কথা আপনার মুখে একদম মানাচ্ছে না। আপনার শরীর নিশ্চয়ই অশক্ত কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশী অসুস্থ হয়ে পড়ছেন মানসিকভাবে। এইটে আপনাকে কাটিয়ে উঠতেই হবে। মনে জোর আনুন তাহলে দেখবেন অনেক কিছু সহজ হয়ে যাবে। অনিমেষ, আপনাকে আমাদের দরকার।

অনিমেষ কিছুক্ষণ মাথা ঝুঁকিয়ে বসে রইল। ওর দুই হাতের মুঠোয় চেয়ারের হাতল, চোয়াল শক্ত। একটা পা মাটিতে অন্যটা শুকনো কাঠির মত বাঁকানো। ওর এই ভঙ্গী দেখে জুলিয়েন কিছু ভাবল তারপর বলল, ঠিক আছে, আপনাকে এখনই এ ব্যাপারে কথা বলতে হবে না। আমি পরে আসব।

না, আপনি বসুন। অনিমেষ মুখ তুলল, আপনারা কি করতে চাইছেন?

আমাদের আগের ভুলগুলো আমরা শুধরে নিতে চাই।

আপনি কি এখনও বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখছেন?

নিশ্চয়ই। এই সমাজব্যবস্থা এবং এই সংবিধানে এদেশের মানুষের মুক্তি কখনই আসবে না। এদেশের গণতন্ত্র সাধারণ মানুষের জন্যে নয়।

এসব কথা তো সাতষট্টি সালের আগেও বলতাম, বলতেন।

তখন কথাটা যে বিশ্বাসে বলতাম আজ সেটা না বলার মত কোন ঘটনা দেশে ঘটেনি। যেহেতু একটা আন্দোলন পূর্ণ সাফল্য পেল না সঙ্গে সঙ্গে সব চিন্তাভাবনা ভুল–এটা হবে কেন? একটা লোক গুণ্ডা লম্পট, তার বিরুদ্ধে লড়াই করে হেরে গিয়েছি তার মানে এই নয় যে লোকটাকে ভদ্রলোক বলতে হবে। গুণ্ডা তো গুণ্ডাই রইল, তাই না!

জুলিয়েন এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, এসব কথা আপনাকে কেন বলতে হচ্ছে তা বুঝতে পারছি না।

কিন্তু জুলিয়েন, এদেশে কি বিপ্লব সম্ভব?

অবশ্যই সম্ভব। যতদিন শ্রেণীবিভাগ থাকবে, অর্থনৈতিক বৈষম্যের চূড়ান্ত ব্যবস্থা থাকবে, যতদিন গণতন্ত্রের নামে ধাপ্পাবাজী চলবে ততদিন পৃথিবীর যে-কোন দেশে বিপ্লব সম্ভব।

এসব কথা যে-সব নেতারা সাতষট্টির আগে বলতেন তাঁরাই তো এখন নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন। তখন বিধানসভা লোকসভাকে শুয়োরের খাঁচা বলতে পছন্দ করতেন যাঁরা তাঁরাই এখন সেখানে ঢোকার জন্যে তৎপর হচ্ছেন। সাধারণ মানুষ এদের চেহারা জেনে ফেলেছে। আমি জেলখানায় এও শুনেছি সাতষট্টি সালের ঘটনাটার মাধ্যমে কিছু মানুষ চেয়েছিলেন দেশের নেতৃত্ব, যারা নিবার্চনে দাঁড়ালে কখনই জিততে পারতেন না। মনে হচ্ছে কথাটা মিথ্যে নয়। সেই সময় সামান্য হইচই করে এখন তো তাঁরা রীতিমত বিখ্যাত। লোকে চোখ বড় করে বলে, উনি খুব বড় নকশাল ছিলেন। সামাজিক স্ট্যাটাসই পাল্টে গিয়েছে তাঁদের। এখনও অবশ্য সাধারণ মানুষ তাঁদের ভোট দিতে তেমন ইচ্ছুক নন কিন্তু পরের নির্বাচনে জেতার আশা সবাই করে যাচ্ছেন। তা এইসব মানুষ যখন চোখের সামনে তখন সাধারণ লোক আপনাদের বিশ্বাস করবে?

করবে। কারণ বিশ্বাস চাপানো যায় না, অর্জন করতে হয়। সাতষট্টি সালে আমরা জনগণকে বাদ দিয়ে বিপ্লবের কথা ভেবেছিলাম। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম যেহেতু মানুষ খুবই কষ্ট এবং দারিদ্র্যের মধ্যে আছে তাই বিপ্লবের ডাক দিলেই সবাই আমাদের সঙ্গে এসে হাজির হবে। কিন্তু এখন সেসব ভুল ধারণা করার মত মানসিকতা আমাদের নেই। আমরা জনসাধারণকে বোঝাবো, তাদের আস্থা অর্জন করব। জানি সবচেয়ে বড় বাধা আসবে বামপন্থী দলগুলির কাছ থেকে। সাতষট্টি সালে ওরা ক্ষমতায় ছিল না। এখন তো কংগ্রেস আর ওরা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু দিন পাল্টাবেই বলে আমার বিশ্বাস। আপনি আমাদের সঙ্গে আসুন। জুলিয়েন অনিমেষের হাত জড়িয়ে ধরল।

৩৫. মহীতোষের আবার বাড়াবাড়ি হল

সেই রাত্রে মহীতোষের আবার বাড়াবাড়ি হল। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, জিভ শক্ত। সন্ধ্যেবেলায় অর্ক ডাক্তারকে ডেকে এনেছিল। কিছুক্ষণ বসে থেকে ভদ্রলোক মাথা নেড়ে চলে গেছেন।

জলপাইগুড়িতে সন্ধ্যের পর যে বিদ্যুৎ জ্বলে তাতে মানুষের মুখই স্পষ্ট দেখা যায় না। এই বিশাল বাড়িটা তাই ছায়ামাখা। শীত শীত হাওয়া চলছে। বাড়ির গাছপালাগুলো শব্দ করছে খুব। হেমলতাকে দেখা যাচ্ছে না। ছোটমা ঘরের এক কোণে পাথরের মত স্থির। অনিমেষ লক্ষ্য করছিল এই মুহূর্তেও তিনি মহীতোষের পাশে এসে বসেননি। সেখানে মাধবীলতা, সেই দুপুর থেকে ঠায় রয়েছে। তার একটা হাত মহীতোষের বুকে আলতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। অর্ক এতক্ষণ এই ঘরে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। ডাক্তার চলে যাওয়ার পর আর কোন কথাবার্তা হচ্ছে না।

মহীতোষ অস্ফুটে কিছু উচ্চারণ করলেন। বোঝা যাচ্ছে কষ্ট হচ্ছে। বিছানার অন্য পাশে বসে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল সামান্য ঝুঁকে, বাবা, কষ্ট হচ্ছে? মহীতোষ সেকথা শুনতেই পেলেন না। তাঁরা চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। জিভ যেন সামান্য নরম হয়েছে। প্রচণ্ড চেষ্টা করছেন কথা বলতে।

মাধবীলতা ধীরে ধীরে ছোটমার কাছে উঠে এল, আপনি একটু পাশে যান।

ছোটমা মাথা নাড়লেন, কি হবে!

উনি কিছু বলবেন বোধহয়।

আমি বুঝতে পারব না।

অনিমেষের কানে কথাটা যাওয়ামাত্র সে চমকে মুখ ফেরাল। এ বাড়িতে ঢোকামাত্র সে জেনেছিল বাবাকে একমাত্র ছোটমা-ই বুঝতে পারেন। আর তখনি মহীতোষের অস্পষ্ট উচ্চারণ শোনা গেল, এসো বাবা, এসো।

মুখ অর্কর দিকে ফেরালো। সে অলসভঙ্গীতে দাঁড়িয়েছিল, এবার সচকিত হয়ে অনিমেষের দিকে তাকাল। অনিমেষ ইঙ্গিতে তাকে কাছে এগিয়ে আসতে বলল। অর্ক মাধবীলতার জায়গায় আসামাত্র মহীতোষ বললেন, বাবা, তোমার পেছনে কে? মাধুরী?

এবার উচ্চারণে জড়তা নেই বললেই চলে। অর্ক পেছন ফিরে তাকাল। আর সেই সময় ছোটমা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। এবং সেই কান্নাটাকে সঙ্গী করে ছিটকে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। মহীতোষ মাথা নাড়লেন, ঘরে এত লোক কেন? জানলায় বসে আছে সব ঝাড়ি, তুই আবার কখন এলি? বাবা, অনি কলকাতায়। আপনি বসুন বাবা। ঘোমটা দিয়ে কে দাঁড়িয়ে? মা?

মাধবীলতা আড়ষ্ট পায়ে এসে দাঁড়াল অর্কর পাশে। আর তখনই চিৎকার করতে করতে ছুটে এলেন হেমলতা। দরজায় দাঁড়িয়ে তীব্র গলায় বললেন, কোথায় বাবা, মহী আপনাকে দেখতে পাচ্ছে যখন তখন নিশ্চয়ই এসেছেন। বলুন, কেন এমন হল? কেন আমি পড়ে আছি? দুই মা গেল, মাধু গেল, আপনি ড্যাং ড্যাং করে চলে গেলেন, মহী যাচ্ছে, তাহলে আমি পড়ে থাকব কেন?এই ভূতের বাড়ি কার ভোগে লাগবে বলে বানিয়েছিলেন? বলুন। জবাব দিয়ে যান, আমি দরজা ছেড়ে নড়ছি না।

অনিমেষ হেমলতার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। পিসীমার এমন ভীষণ মূর্তি সে কখনও দ্যাখেনি। মাধবীলতার একটা হাত অর্কর কনুই আঁকড়ে ধরেছিল। তার গায়ে কাঁটা উঠেছে। অর্ক বুঝতে পারছিল না এরা কাঁদের সঙ্গে কথা বলছেন!

মহীতোষ তখন বলছেন, ওই লাল ডুরে শাড়ি পরেছে কে? মুখ দেখতে পাচ্ছি না।

ঘরে লাল শাড়ি কেউ পরে নেই। ব্যাপারটা হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে যেতেই অর্ক শিউরে উঠল। এই ঘরে এখন মরে যাওয়া মানুষেরা এসে দাঁড়িয়েছে নাকি?

অনিমেষ চাপা গলায় মাধবীলতাকে বলল, পিসীমাকে ধরো। হেমলতা তখন ঘরের প্রতিটি স্থানে সতর্ক চোখ রেখেছেন, আপনি মহীকে নিয়ে যাচ্ছেন, আমি কোথায় থাকব? আমাকে নিয়ে যান বাবা।

মাধবীলতা দরজার কাছে গিয়ে হেমলতার হাত ধরল, পিসীমা!

ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও আমাকে। বাপ না শয়তান! মহী ওর আপন হল, আমি কেউ না? বারো বছর বয়সে বিধবা হয়ে পর্যন্ত ওর দাসী হয়ে ছিলাম। কি করেছে আমার জন্যে! শোন, তোমাকে বলছি, এই পুরুষজাতটা হল বড় বেইমান, আমাদের চুষে চুষে খেয়ে আঁঠি করে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। একটুও ভাবে না। সে স্বামী হোক, ছেলে হোক আর বাবাই হোক। হাউ হাউ করে কেঁদে উঠতেই হেমলতাকে জড়িয়ে ধরল মাধবীলতা।

সারা রাত আচ্ছন্ন হয়ে রইলেন মহীতোষ। কোন সাড়া শব্দ নেই। অনিমেষ বারংবার এসে দেখে যাচ্ছিল। এ বাড়ির কেউ ঘুমায়নি। সকালবেলায় জোর করে ছোটমা পাঠালেন মাধবীলতাকে। সারারাত সে ঠায় বসে ছিল। মুখে হাতে জল দেওয়ার দরকারটাও যেন ভুলে থাকতে চাইছিল।

নিজের ঘরে অনিমেষ তখন অর্ককে বলছিল, এখানে কাছে পিঠে কোন চায়ের দোকান দেখতে পেয়েছিলি?

এদিকটায় নেই। ওদিকে একটা রাস্তা গেছে ওখানে আছে কিনা জানি না। দেখে আসব? ভোরবেলায় অর্ক খানিকটা ঝিমিয়েছিল, চোখ ফোলা।

একটা কেটলি বা ওইরকম কিছু নিয়ে যা। তোর কাছে পয়সা আছে?

আছে।

এত পয়সা পাস কোত্থেকে কে জানে। ওহো, জেলা স্কুলের কাছেই তো কয়েকটা চায়ের দোকান ছিল। এখনও আছে কিনা জানি না। ওদিকেই যা।

অর্ক গায়ে জামা গলাতেই মাধবীলতা ঘরে ঢুকল, কোথায় যাচ্ছিস?

চা আনতে।

চা আনতে? মাধবীলতা যেন অবাক হয়ে গেল। তারপর অনিমেষের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, এ বাড়িতে বাইরে থেকে চা আনিয়ে কখনও খাওয়া হয়েছে?

অনিমেষ একটু বিরক্ত হল, বাজে বকো না তো। কখনও হয়নি বলে কোনদিন হবে না এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। সবাই রাত জেগেছে তাই চা আনানো হচ্ছে।

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, থাক, আমি করে দিচ্ছি। তুই শুধু চিনি নিয়ে আয়। কালই দেখেছিলাম ওটা শেষ হয়ে গেছে।

কত আনবো? পাঁচশো? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

মাধবীলতা হাসল বিষণ্ণভঙ্গীতে, তাই আন।

অর্ক চলে গেলে অনিমেষ বলল, তুমি কিন্তু বড় বাড়াবাড়ি করছ!

মাধবীলতা সিটিয়ে গেল যেন, তারপর বলল, কিসে?

আমি এ বাড়ির ছেলে সেই কথাটা ভুলে যাচ্ছ। এখানে আমি যা করছি নিজের দায়িত্ব নিয়ে করছি। সারারাত জেগে তুমি চা তৈরি করতে যাচ্ছ, এতে প্রশংসা পাওয়া যায় নিশ্চয়ই কিন্তু কারো কারো খারাপ লাগবে তা ভাবো না কেন?

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, সত্যি, ভাবিনি।

অনিমেষকে যেন কথা বলার নেশায় পেয়েছিল, আসলে একা কষ্ট ভোগ করার একটা প্রবণতা আছে তোমার মধ্যে। পাঁচজনে শুনলে ভাববে, আহা এমন মেয়ে হয় না, সারাজীবন শুধু কষ্ট করে গেল। আমি এটাকেই বাড়াবাড়ি বলচি।

আলনায় রাখা কাপড়জামা তুলে নিয়ে মাধবীলতা বলল, ঠিক আছে। এত কথা আর বলতে হবে না। আমি চা করছি না।

অনিমেষ হাঁ হয়ে গেল, যাচ্চলে! তুমি থোকাকে চিনি আনতে বলে এখন যদি চা করব না বল তাহলে আবার ওকে পাঠাতে হয়!

তার মানে তুমি আমাকে চা করতে বলছ? মাধবীলতা এমন ভঙ্গীতে এই কথাটা বলল যে অনিমেষ মুখ ফিরিয়ে নিল। তার মনে এক ধরনের পরাজিত মনোভাব কাজ করছিল। এই সক্কাল বেলায় এত সব কথা না বললেই হতো।

মাধবীলতা বলল, শোন, এটাও বাড়াবাড়ি কিনা জানি না, তবে মনে হচ্ছে আজকের দিনটা কাটবে না। বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই ভাল। মৃত মানুষদের দেখার পর কেমন ঘোরের মধ্যে পড়ে আছেন।

অনিমেষ বলল, ডাক্তার বলেছে কিছুই করার নেই। এর পর কোন হাসপাতাল নেবে না। তাছাড়া শেষ সময়টায় আর টানাটানি করে কি হবে? ওঘরে এখন কে আছেন, তুমি চলে এলে।

ছোটমা ছিলেন। তুমি চা খেয়ে ওঘরে গিয়ে বসো। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মাধবীলতা দরজায় দাঁড়াল, আচ্ছা, কাল তোমার সঙ্গে দেখা করতে কে এসেছিল? একবার শুনলাম খুব উত্তেজিত গলায় কথা বলছ! অবশ্য বাড়াবাড়ি মনে করলে উত্তরটা দিতে হবে না।

অনিমেষ হতাশভঙ্গীতে কাঁধ নাচাল। মাধবীলতার আগে এই অভ্যেসটা ছিল না। কথায় কথায় এমন করে খোঁটা দিত না। কিন্তু হজম করল সে। দোষটা তার। তখন কথাটা না বললেই হত। সে কাঁধ নাচানোর জন্যেও আফসোস করল। এসব সময় কিছুই হয়নি এমন ভাব করা উচিত। যতটা পারে সহজ গলায় অনিমেষ বলল, ওর নাম জুলিয়েন।

জুলিয়েন! নামটা যেন শোনা শোনা মনে হচ্ছে! মাধবীলতা স্মৃতি হাতড়াচ্ছিল। এই কয়বছরে অনিমেষের মুখে শুনে শুনে ওর এখানকার পরিচিত মানুষজন এবং ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সে পরিষ্কার জেনে গিয়েছে।

অনিমেষ বলল, জুলিয়েন স্বৰ্গছেঁড়ায় প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন করতো। পরে আমাদের সঙ্গে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেয়। একটা অ্যাকশনের পরে ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল না।

জুলিয়েন। ও, সেই খৃষ্টান মদেশিয়া না কি যেন?

হ্যাঁ। মদেশিয়া। চা বাগানের পত্তনের সময় রাঁচি হাজারিবাগ থেকে ওদের পূর্বপুরুষদের ধরে এনেছিল আড়কাঠিরা। মিশনারিরা তখন খৃষ্টান করে দিয়েছিল ওদের অনেককেই। ডাক্তারবাবুর মুখে খবর পেয়ে দেখা করতে এসেছেন।

ডাক্তারবাবুর কাছে খবর পেল কি করে?

যোগাযোগ আছে।

কথাটা শোনামাত্র মাধবীলতার কপালে ভাঁজ পড়ল, কেন এসেছিল?

দেখা করতে, আবার কেন?

একজন তোমার খোঁজে কয়েকবার এসেছিল, এই কি সেই?

বোধহয়। অনিমেষের মনে হল মাধবীলতার কণ্ঠস্বর পাল্টে যাচ্ছে।

তোমাদের কি নিয়ে তর্ক হচ্ছিল?

অনিমেষের ভেতরটা আচমকা গুটিয়ে গেল। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে সব কথা বলতে হয়। হঠাৎ তার মনে হল সব কথা মাধবীলতাকে খুলে বলা এই মুহূর্তে উচিত হবে না। ওর গলার স্বর স্পষ্ট বলে দিচ্ছে যে জুলিয়েনকে পছন্দ করতে পারছে না। সে মুখ ফিরিয়ে বলল, নানান বিষয় নিয়ে। ওরা দেশের সম্বন্ধে নতুন করে ভাবনা চিন্তা করছে, এই আর কি!

মাধবীলতা এবার স্পষ্ট বলল, লোকটার সঙ্গে তুমি যোগাযোগ রেখ না।

কেন? অনিমেষ যেন কোন শিশুর আবদার শুনছে এমন মুখ করল।

আমার ভাল লাগছে না।

কেন? মাধবীলতাকে ঠাট্টার গলায় বলতে গিয়েও সুর পাল্টালো অনিমেষ, তুমি ভাবতে পারো কাল জুলিয়েন কি বলেছে? ওর কাছে আমাদের অ্যাকশনের প্রচুর টাকা গচ্ছিত ছিল। এত বছর পরে নিজে এসে সেই টাকার খবর দিচ্ছে। আমার সঙ্গে দেখা না করলে আমি কোনদিনই টাকাগুলোর কথা জানতে পারতাম না। এরকম লোককে খারাপ ভাবার কোন কারণ নেই।

অনিমেষের দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মাধবীলতা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

.

এই রাস্তায় অর্ক গতকাল হাঁটেনি। এখন সদ্য ভোর। মাটিতে রোদ নামেনি। চারধারে একটা শান্ত ছায়া ঘন হয়ে রয়েছে। ঠাণ্ডা নিঃশ্বাসের মত বাতাস বইছে। সারারাত জেগে শেষের দিকে যে ঝিমুনি এসেছিল তাতে শরীর বেঠিক হয়ে রয়েছে। তবু কয়েক পা ফেলার পর অর্কর ভাল লাগছিল।

রাস্তায় একটিও মানুষ নেই। চমৎকার সরু পিচের রাস্তা। দুদিকে গাছপালাওয়ালা বাড়ি। দোকানপাট চোখে পড়ছে না। অথচ বাবা বলল এদিকেই চায়ের দোকান ছিল। আরো খানিকটা এগোবার পর একটা বন্ধ দোকান চোখে পড়ল। ছোট্ট ঝাঁপ দেওয়া দোকান। তারপর রাস্তাটা বাঁক নিতেই সে চায়ের দোকানটাকে দেখতে পেল। টিনের দেওয়াল এবং দরমার ঝাঁপ দেওয়া। তিন চারজন মানুষ মাটিতে পোঁতা বেঞ্চিতে বসে চা খাচ্ছে। পাশাপাশি আরও চারটে দোকান আছে কিন্তু সেগুলো এখনও খোলেনি। অর্ক চায়ের দোকানটার সামনে দাঁড়াল। দোকানদারের হাত খালি হওয়ায় বিড়ি খাচ্ছিল। তার দিকে একটু উৎসুক চোখে তাকাল লোকটা। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, এখানে মুদির দোকান আছে?

আছে, কিন্তু খোলে নাই।

কখন খোলে?

টাইম হইসে। লোকটা বিড়ি মুখে রেখে কথা বলছিল। এবার তার খদ্দেররা মুখ ফিরিয়ে অর্ককে দেখল। একজন জিজ্ঞাসা করল, নতুন মনে হচ্ছে?

অর্ক ঘাড় নাড়ল।

কোন বাড়ি?

ওই দিকে। অর্ক দিক দেখাল। যে লোকটা প্রশ্ন করছিল তার গলার হনুটা বেশ বড়। চোখ গর্তে বসা এবং মুখ শুকনো। মাথায় চুলও নেই তেমন। লোক্টা নাছোড়বান্দা ধরনের, বলল, ওটা তো দক্ষিণ দিক। কার বাড়ি? কোথায় থাকা হয়? কখনও দেখিনি তাই বলছি।

আর একজন বৃদ্ধ খদ্দের ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন, আজকালকার ছোঁকরাদের প্রশ্ন করে সুখ নেই। এমন জবাব দেয় যে–। কথাটা শেষ করলেন নাক থেকে ছুঁড়ে দেওয়া বিকট শব্দ দিয়ে। অর্কর মেজাজ তেতো হয়ে যাচ্ছিল। আগে হলে এই অবস্থায় সে যা করত এখন তার বিপরীত ব্যবহার করল, আমার দাদুর নাম মহীতোষ মিত্র। আমরা কলকাতা থেকে এসেছি।

সঙ্গে সঙ্গে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল টেকো লোকটা। ওর গর্তে বসা চোখ বিস্ফারিত উত্তেজনায় গলার হনু দুটো নেচে উঠল কয়েকবার। তারপর সুড়সুড় করে এগিয়ে এল অর্কর সামনে, মহীকে দেখতে আসা হয়েছে?

লোকটার আচমকা পরিবর্তনে অবাক হয়েছিল অর্ক। এখনও চোখ জ্বলছে, ঠোঁট কাঁপছে।

সে একটু বিব্রত ভঙ্গীতে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। লোকটা জিজ্ঞাসা করল এবার, নাম কি?

অর্ক

অর্ক! হুম। অনিমেষের ছেলে? এত বড়? নিজেকেই যেন জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছে, দৃষ্টি আর অর্কর ওপর নেই। অর্ক বুঝতে পারল লোকটা তাদের চেনে। অন্তত বাবার নামটা তো স্পষ্ট বলতে পারছে। এই সময় সেই বৃদ্ধ চা শেষ করে বলল, কি হে, আপনজন মনে হচ্ছে? কবে এল?

হ্যাঁ, আপনজন। বড় আপনজন। সর্বনাশের জোঁক। কিন্তু এত বড় ছেলে কি করে হবে তাই মাথায় আসছে না। গোলমাল আছে, বহুৎ গোলমাল আছে। জোচ্চুরি!

অর্ক এবার কাঁধ ঝাঁকালো, কি যা তা বকছেন। আপনার কাছে চিনি পাওয়া যাবে? সে সরাসরি এগিয়ে দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করল।

সিনি! উঁহু, আমার ইস্টক কম আস-এ।

অর্ক হতাশ চোখে লোকটাকে দেখল। বুঝল চাঅলা চিনি দেবে না। অতএব ওই মুদির দোকান খোলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সে আবার রাস্তায় চলে এল। আসবার সময় লক্ষ্য করল টেকো লোকটাও তখনও তাকে খুঁটিয়ে দেখছে লোকটা কে? অর্কর মনে হল কিছু একটা গোলমাল আছে। তাকে সর্বনাশের জোঁক বলল কেন? আজ অবধি কখনও সে লোকটাকে দ্যাখেনি। আগে হলে এই কথাটা বলার জন্যে ওর বারোটা বাজিয়ে দেওয়া যেত। ভদ্রলোক হতে গেলে অনেক অন্যায় চুপচাপ সহ্য করতে হয়। নিশ্চয়ই কোন খার আছে। এ এখন দু তিনটি লোক রাস্তায়। আর একটু এগোতেই সে একটা বিরাট খেলার মাঠ আর স্কুল দেখতে পেল। এত বড় জায়গা নিয়ে স্কুল হয় তার ধারণায় ছিল না। রাস্তাটা চলে গিয়েছে বাঁধের দিকে। এখন লোকজন দেখা যাচ্ছে। অর্ক লক্ষ্য করল কিছু মানুষের চেহারা অন্যরকম। ঠিক বাঙালি নয়। মুখের ছাঁদটা সামান্য আলাদা। তাদের পোশাক বলে দেয় মানুষগুলো গরীব। কিন্তু বেশ সরল-ভঙ্গী। এই সময় পেছন থেকে কেউ তাকে ডাকছে বুঝতে পারল সে। মুখ ফেরাতেই দেখল টেকো মাথা হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসছে। অর্ক শক্ত হয়ে দাঁড়াল। এবার যদি লোকটা আনসান বকে তাহলে সে ঝাড়বে।

লোকটা কাছে এসে হাসল, চিনি খুঁজতে এদিকে চললে কোথায়?

অর্ক শক্ত গলায় বলল, কেন, তাতে আপনার কি দরকার?

আহা, রাগ করছ কেন? বুড়ো মানুষ, মাথার ঠিক নেই, কি বলতে কি বলে ফেলেছি, এসো এসো, আমি তোমার চিনির ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কত লাগবে?

পাঁচশো। শব্দটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল।

আড়াইশো হলে চলবে? চালিয়ে নাও। বাড়িতে চিনি নেই বুঝি? তা বেলা হলে না হয় বাড়তিটা নিয়ে যেও। লোকটি অর্কর হাত ধরল।

এই পরিবর্তনে ধাতস্থ হতে সময় লাগল অর্কর। চিনি যখন পাওয়া যাচ্ছে তখন খামোকা কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। মা চায়ের জল গরম করে বসে আছে নিশ্চয়ই। সে জিজ্ঞাসা করল, কোন দোকানে চিনি পাওয়া যাবে!

দোকান তো এখনও খোলেনি ভাই। ও আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি তোমার জন্যে।

অর্ককে নিয়ে হাঁটতে লাগল লোকটা। এবার অর্ক জিজ্ঞাসা করল, আপনি আমাদের চেনেন মনে হচ্ছে।

চিনি। হাড়ে হাড়ে চিনি। বলেই বুড়ো মানুষটা জিভ কাটলো, কিছু মনে করো না, আমার কথা বলার ধরনটাই এ রকম। এত বেফাঁস কথা বলি যে! যাক! চিনি বইকি।

আমার বাবার সঙ্গে আলাপ আছে?

তোমার বাবা? আরে ওকে তো জন্মাতে দেখেছি। তা তোমার বয়স কত হল?

পনের।

অ্যাাঁ? পনের? দেখে তো মনে হয় না।

অর্ক হাসল। তাকে যে বড় দেখায় সে জানে এবং কেউ তা বললে ভাল লাগে।

তোমার মা এসেছেন?

হ্যাঁ। দাদুর শরীর খারাপ তাই—

পনের বছরে আর আসার সুযোগ পাওনি, না?

অর্ক লোকটার দিকে তাকাল। কথাটার মধ্যে যে খোঁচা আছে তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু লোকটা এখন ভাল ব্যবহার করছে, আসল ধান্দাটা কি?

কলকাতায় তোমরা কোথায় থাকো?

বেলগাছিয়ায়। ঈশ্বরপুকুর লেনে।

সেটা কোথায়?

শ্যামবাজারের কাছে। আপনি কলকাতায় যান কি?

বেশী না। তা তোমার মায়ের বাড়ি?

না।

তোমার মামা মাসীরা কোথায়?

ওরা কেউ নেই।

হুমম।

ওরা চায়ের দোকানের সামনে এসে পড়েছিল। এখন লোকজন বেড়েছে। অর্ককে দাঁড় করিয়ে রেখে লোকটা খদ্দেরদের ডিঙ্গিয়ে দোকানদারকে কিছু বলল। মিনিট খানেক কথা চালাচালির পর একটা ঠোঙা নিয়ে এল লোকটা, দুটো টাকা দিয়ে দাও ওকে, একটু বেশী পড়ল, কি করা যাবে।

অর্ক চটপট দুটো টাকা বের করে হাতে দিচ্ছিল, কিন্তু সবেগে মাথা নাড়ল লোকটা, না না, টাকা পয়সার মধ্যে আমি নেই! যার জিনিস তাকে দাও।

খদ্দেরদের ফাঁক গলে অর্ক দোকানদারকে টাকাটা দিয়ে আসতেই লোকটা জিজ্ঞাসা করল, মহী এখন কেমন আছে?

ভাল না। ঠোঙাটার ওজন বড় জোর দুশো হবে। অর্ক বুঝতে পারছিল সে ঠকেছে কিন্তু কিছুই করার নেই। এখন আর কোথায় চিনি পাওয়া যাবে। সে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আপনার নাম জানতে পারি?

নাম? হুম। বলেই দিই। আমার নাম পরিতোষ মিত্তির। চেনা চেনা লাগছে?

অর্ক এই নামের কাউকে চিনতো না। শুধু পদবীতে সামান্য খটকা লাগল। সে মাথা নাড়ল,

কখনও শোননি? কেউ বলেনি? পরিতোষের চোখ ছোট হয়ে গেল।

না। আপনি কি আমাদের কেউ হন?

হুম। আমি তোমার বাবার জ্যাঠামশাই। এবার খেয়াল হল অর্কর। দাদুর বাড়ি নিয়ে নাকি মামলা চলছে। বাবার জ্যাঠামশাই নাকি দাদুর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। সরাসরি এসব কথা কেউ তাকে বলেনি কিন্তু মা বাবার আলোচনায় সেটা জেনেছিল সে। বাবার দাদু নাকি একে দেখতে পারতো না। তাই সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছিল। কিন্তু কত বয়স হবে লোকটার? নিশ্চয়ই সত্তরের অনেক বেশী। চেহারা দেখলে অবশ্য সেটা বোঝা যায় না। কেমন খেকুঁড়ে দেখতে। কেন তখন এই লোকটা তাকে জোঁক বলেছিল তা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু এর ওপর রাগ করা উচিত, এর সঙ্গে কথা না বলাই শ্রেয় যেহেতু মামলা করেছে কিন্তু সেটা করতেও যে সে পারছে না। অর্ক সরাসরি জিজ্ঞাসা করল, আপনি আমাদের বাড়িতে যান ?

যাই। গিয়ে দিদির সঙ্গে কথা বলি। মহীর বউটা মহাপাজী। গেলেই ট্যাঁক ট্যাঁক করে কথা শোনায়। অবশ্য কেস ফাঁইল করার পর যাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। বাড়িটা ছাড়া তো আর কিছুই নেই, ছিবড়ে হয়ে গেছে।

ইতিমধ্যে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে। মুদির দোকানটা এখনও খোলেনি। অতএব এই দেরির পেছনে খানিকটা যুক্তি আছে। অর্কর মনে হচ্ছিল লোকটার সঙ্গে কথা বলা দরকার। বাবার জ্যাঠামশাইকে ও কোন সম্মানজনক সম্বোধন করতে পারছিল না। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোথায় থাকেন?

আমি? সেনপাড়ার ভেতরে। চল্লিশ টাকায় ভাড়া আছি। তোমায় কি বলব, খেতে পাই না বাপ। এই শরীর নিয়ে তো আর কাজকর্ম করতে পারব না। তোমার ঠাকুমা বাতের রুগী। ছেলেমেয়েরা এক একটা হাড়হারামজাদা, ছোটটা বাদে। শিলিগুড়িতে থাকে। তার টাকায় বেঁচে আছি। আর মহী বাপের টাকায় তৈরি বিশাল প্রাসাদে পা নাচিয়ে আছে। আরে বাপ কি তোর একার?

উনি অসুস্থ।

হবে না? ধম্মের কল বাতাসে নড়ে। কিন্তু আমি ছাড়ছি না, ওবাড়ির ভাগ চাই।

আপনি ওখানে গিয়ে থাকবেন?

মোটেই না। বিক্রি করে দেব। বিক্রি করে শেষ কটা দিন আরামে থাকব। ও ভূতের বাড়িতে কে থাকতে যাবে।

কিন্তু শুনেছি মামলা করার অনেক খরচ। আপনি পারছেন?

না পারছি না। ধার ধোর করতে করতে চালাচ্ছি। উকিল আমার বন্ধুলোক, টাকাকড়ি নেয় না, তাই বাঁচোয়া। তোমার বাবা কি ল্যাংড়া?

অর্কর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল কথাটা শুনে। তবু সে শান্ত গলায় বলল, উনি হাঁটতে পারেন না ক্রাচ ছাড়া।

মহী মরলে তো ওকেই কেস লড়তে হবে। পারবে?

সেটা ওঁকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করুন।

পরিতোষ বলল, কিছুদিন আগে প্রিয় এসেছিল। আমেরিকায় থাকে, সাহেব মানুষ। তার মুখেই শুনলাম। তা এত করে বললাম আমায় কিছু দে, দিল না। যৌবনে একটু এধার ওধার করেছি বলে বাবা খচেছিল। তা তার জের এখনও চলবে? তোমাকে কিন্তু আমার ভাল লাগছে। তুমি কি কর?

কিছু না।

পড়াশুনা কর না?

না। আমাদের পাড়ায় একটা মাস্তানদের দল আছে, তাদের সঙ্গে মিলে ওসব করায় আর পড়াশুনা করতে ইচ্ছে হয়নি।

অ্যাঁ? তুমি মাস্তান? আঁতকে উঠল পরিতোষ।

সবাই তাই বলে। খুর চালাতে পারি। পেটো আর পাইপগানে এক্সপার্ট। গতকালই এখানকার দুটো ছেলেকে পেঁদিয়েছি। এ পাড়ায় শানু বলে একটা ছেলে আছে তাকে জিজ্ঞাসা করলে জানতে পারবেন। লাসটাকে ফেলে দেওয়া আমার কাছে জলভাত। একশ আটটা খিস্তি জানি।

তুমি, তুমি ডেঞ্জারাস। বাবা বেঁচে থাকলে তোমাকে বাড়িতে ঢুকতে দিত না। অত্যন্ত কঠোর, আদর্শবান মানুষ ছিলেন, শুধু আমার বেলায় যা কিছু ভুল হয়েছিল। তিনি তোমাকে। আঃ। পরিতোষ তার নিজের পেট খিমচে ধরল।

অর্কর খুব হাসি পাচ্ছিল। লোকটার মুখে ভয় সেঁটে বসেছে। সে আর একটু তাতিয়ে দেওয়ার জন্যে বলল, মামলা ফামলা করে কি করবেন? এত যে মাডার ফাডার হয় কেউ শাস্তি পায়? তার চেয়ে আসুন, ওসব নকশা না করে ফয়সালা করে ফেলি!

শেষ সংলাপটায় ও একটু খুরকি টান দিয়ে দিল।

নকশা? আমি নকশা করছি? এ কি ভাষা?

এখন এটাই চলে। আজ বিকেলে চলে আসুন। বাবাকে বলে রাখব। চিনির জন্যে ধন্যবাদ। অর্ক আর দাঁড়াল না। পরিতোষ যে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তা সে বুঝতে পারছিল।

গেট খুলে বাড়িতে ঢুকে অর্ক দেখল দরজাটা আধ-ভেজানো। চার ধারে পাখির ডাক আর ফুলের গন্ধ। রোদের রঙ পাল্টেছে। বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকে ওর পরিতোষের বলা ভূতের বাড়ি কথাটা মনে পড়ল। সত্যি, মনে হয় এখানে কোন মানুষ থাকে না। ওদের ঘরে উঁকি মেরে দেখল কেউ নেই। ভেতরের ঘর পেরিয়ে রান্নার ঘরের কাছে এসে দেখল উনুন জ্বলছে, কিন্তু সেটাও ফাঁকা। ঠাকুরঘরেও কেউ নেই। চারজন মানুষ এখানে নানাভাবে থাকার কথা কিন্তু কাউকে খুঁজে পেল না সে। দু তিনবার সে মা মা বলে ডাকল। তারপর আবার ভেতরের ঘরে ঢুকল। একটাও শব্দ নেই বাড়ির মধ্যে শুধু একটানা ঘুঘুর ডাক কানে আসছে। অর্ক ভেতরের দিকে ফিরল। তারপর মহীতোষের ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই দৃশ্যটা দেখতে পেল।

দাদু শুয়ে আছেন। দাদুর পায়ের কাছে বাবা বসে। মুখ নিচে নামানো। দাদুর পাশে খাটে শরীরের সামান্য অংশ রেখে ছোটমা লুটিয়ে পড়েছেন। তাঁর মুখ দাদুর বুকের ওপর। শরীরটা কাঁপছে, শব্দহীন। দাদুর মাথার পাশে খাটের বাজু ধরে দাঁড়িয়ে মা। পাথরের মত। খাটের ওপাশে ধুতির আঁচল গলায় জড়িয়ে বড়দিদা এক দৃষ্টিতে দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।

সে দরজা ছাড়াতেই যে শব্দ হয়েছিল তাতে ছবিটা ভাঙ্গল না। শুধু বড়দিদা অকম্পিত গলায় বললেন, এসো বাবা, তোমার দাদু এইমাত্র মহাপ্রয়াণ করলেন।

৩৬. মহীতোষ মারা যাওয়ার পর

মহীতোষ মারা যাওয়ার পর এই বাড়ির চেহারাটা যেন আচমকা পাল্টে গেল। ছোটমা সেই শূন্য ঘর ছেড়ে পারতপক্ষে বের হচ্ছেন না। হেমলতার পরিবর্তনটা আরও বেশী চোখে পড়ছে। যে মানুষ সব সময় বক বক করতে ভালবাসতেন তিনি একেবারেই নীরব হয়ে গেছেন। সারা দিন তাঁর নিজের কাজগুলো বার বার করে যাচ্ছেন। তিনি নিজের রান্না চিরকাল নিজেই বেঁধে এসেছেন। হঠাৎ যেন আরও বেশী স্বতন্ত্র হয়ে পড়েছেন। মাধবীলতা তিনবার প্রশ্ন করলে একবার হয়তো জবাব দেন আর কপালে ভাঁজ ফেলে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর আচরণের মধ্যে বেশ কিছু অস্বাভাবিকতা দেখা দিচ্ছে। মাঝে মাঝে একই কাজ দুবার করেন এবং অর্ককে অনিবাবা বলে সম্বোধন করছেন।

এই পরিস্থিতিতে এত বড় বাড়ির দায়িত্ব এসে পড়ল মাধবীলতার ওপর। তাকেই সমস্ত কাজকর্ম করতে হচ্ছে। এখন অবশ্য রান্নাবান্নার তেমন ঝামেলা নেই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গৃহিণীর দায়িত্ব। এড়াতে পারছে না মাধবীলতা।

মহীতোষকে দাহ করতে যাওয়ার আগে একটু চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল। সকালেই এ পাড়ায় খবরটা প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল। অনিমেষ দেখেছিল ক্রমশ বেশ ভিড় জমে গেল বাড়িতে। এদের অনেকেই মহীতোষের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত নন কিন্তু পাড়ার মানুষ মারা গেছেন এবং তাঁর আত্মীয়রা শোকগ্রস্ত বলেই এরা পাশে এসে দাঁড়ালেন। এঁদের মধ্যেই কয়েকজন যখন উদ্যোগী হয়ে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছেন ঠিক তখনই চেঁচামেচি শোনা গেল। গেট হাট করে খোলাই ছিল, সেখান থেকে বিলাপ করতে করতে ঢুকলেন পরিতোষ, ওরে তুই চলে গেলি, আমি বড় হয়ে রয়ে গেলাম আর তুই চলে গেলি। বিলাপ করছেন আর মাথায় চাপড় মারছেন।

অনিমেষ প্রথমে তাঁকে চিনতে পারেনি। একটা মানুষের চেহারা যে এত পাল্টে যায় তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। এবং চেনা মাত্র তার খেয়াল হল এই মানুষটা সারা জীবন দাদুকে জ্বালিয়েছে আর বাবার বিরুদ্ধে এই বাড়ির মালিকানা চেয়ে আদালতে মামলা ঠুকেছে। অথচ এখন ওঁর বিলাপ দেখলে সে সব কথা কারো মনে আসবে না। দ্বিতীয় চিন্তায় অনিমেষের মনে হল, হয়তো মৃত্যু সংবাদ পেয়ে মানুষটার মনে অনুশোচনা এসেছে। যে জেদ এবং ঈষা তাঁকে মামলা করিয়েছিল তা বোধ হয় ধাক্কা খেয়েছে। এই বিলাপ তারই প্রতিক্রিয়া। এ পরিতোষ তখন বারান্দায়। কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, কোথায় সে, আমাকে তার কাছে নিয়ে চল। আমি তাকে শেষবার দেখতে চাই। মহী, মহী রে। পাড়ার একটি ছেলে পরিতোষকে পথ দেখিয়ে মহীতোষের ঘরে নিয়ে যাচ্ছিল। উপস্থিত মানুষগুলো স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। একে মৃত্যু তার ওপর এই ধরনের বিলাপ আবহাওয়াকে ভারী করে তুলেছে। অনিমেষের দিকে পরিতোষ তাকাচ্ছিলেন না। অনিমেষের মনে হল হয়তো ওকে চিনতে পারেননি তিনি। সে দুহাতে ক্রাচ নিয়ে চুপচাপ দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। এখন ঘরে বেশ ভিড়। হেমলতা সেই জানলার পাশে পাথরের মত অনড় হয়ে আছেন। প্রতিবেশী মহিলারা তাঁর পাশে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে। মাধবীলতা মহীতোষের মাথার পাশে। অর্ক সামান্য দূরে। পরিতোষ ঘরে ঢুকে এমন একটা কান্নার শব্দ করলেন যে সবাই চমকে তাঁর দিকে তাকালেন। এমন কি ছোটমা মহীতোষের পায়ের ওপর থেকে মুখ তুললেন,শব্দটা করেই পরিতোষ দৌড়ে খাটের কাছে পৌঁছে গেলেন, মহী, মহী, ভাই আমার, কথা বল, একবার দাদা বলে ডাক, ও হো মহী রে!

মৃত মহীতোষের হাত জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলেন পরিতোষ। ছোটমার শরীর ধীরে ধীরে সোজা হয়ে বসল। তাঁর চোখে বিস্ময়। পরিতোষ বলছিলেন, তুই চলে গেলি, আমি অভাগা রে মহী, মায়ের স্নেহ বাবার ভালবাসা কখনও পাইনি। তবু আমি রয়ে গেলাম। আঃ ভগবান!

ঠিক তখনই হেমলতার চাপা অথচ ধারালো গলা শোনা গেল, পরি!

পরিতোষ চোখ খুললেন, কে, কে ডাকল আমাকে? মুখ ঘুরিয়ে চারপাশ দেখতে দেখতে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। তার পর জ্যামুক্ত তীরের মত ছুটে গেলেন হেমলতার পায়ের কাছে। মাটিতে সাষ্টাঙ্গে শুয়ে বললেন, ক্ষমা কর, ক্ষমা কর দিদি।

হেমলতা বললেন, উঠে দাঁড়া।

বাধ্য শিশুর মত হুকুম তামিল করলেন পরিতোষ, অনেক শাস্তি পেয়েছি দিদি। আজ মহী নেই আজ আর … আমার ছেলেরাও আমাকে দ্যাখে না।

হেমলতা বললেন, বেরিয়ে যা এখান থেকে।

পরিতোষ যেন চমকে উঠলেন, অ্যাাঁ?

এই বাড়িতে তোর ঢোকা নিষেধ আছে। আমার বাবার শেষ ইচ্ছে যাতে পালন করা হয় তা আমি দেখব। যা। হেমলতার ছোট্ট শরীরটা যেন আচমকা বিশাল হয়ে যাচ্ছিল। পরিতোষ কিছুক্ষণ স্তব্ধ ভঙ্গীতে দিদিকে দেখলেন, তুমি, তুমি কি পাষাণ? এই দিনেও ওই কথা বলছ?

হ্যা বলছি। তোর মামলা করার খবর পাওয়ার পর থেকেই মহী–।

মামলা? মরা মানুষের সঙ্গে মামলা কি! এখন মহী আমার ভাই। কথাগুলো বলতে বলতে দরজার দিকে সরে আসছিলেন পরিতোষ। এবং তখনই তাঁর চোখ পড়ল অর্কর ওপর। একটু থিতিয়ে গিয়েও তিনি হাত বাড়িয়ে অর্ককে ধরলেন, এসো, তোমার সঙ্গে একটু প্রাইভেট কথা আছে।

প্রায় টানতে টানতেই অর্ককে নিয়ে তিনি বাইরে বেরিয়ে এলেন। দরজাটা অতিক্রম করার সময় অর্ক অনিমেষের মুখের দিকে তাকাল। অনিমেষ অবাক হয়েছিল। অর্কর সঙ্গে জেঠুর সম্পর্ক সে ঠাওর করতে পারছিল না।

হলঘরে ঢুকেই পরিতোষ নিচু গলায় বললেন, দিদির মাথা শোকে খারাপ হয়ে গিয়েছে। তুমি কিছু মনে করো না। এই সময় ও-রকম হয়।

অর্ক হতভম্ব হয়ে গেল। পরিতোষ যেন তাকেই সান্ত্বনা দিচ্ছেন। ওই একঘর লোকের সামনে অপমানিত হবার ব্যাপারটা যেন কিছুই নয়। তার মনে হল এই মুহূর্তে হেমলতাকেই সমর্থন করা উচিত। আপনাকে যখন চলে যেতে বলা হয়েছে তখন চলে যান।

আরে, তুমি ব্যাপারটা বুঝতেই পারছ না। তোমার তো মাথা খারাপ হয়নি।

আপনি দাদুর বিরুদ্ধে মামলা করছেন আবার এখানে এসে কাঁদছেন!

করছেন না, করেছিলেন। বললাম না, মরা মানুষের সঙ্গে ঝগড়া করার কোন মানে হয় না। ও মামলা আমি তুলে নেব। এখন এসো সবাই মিলে মহীর সৎকারটা ভালভাবে করি। এখন নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করার সময় নয়। খুব বিচক্ষণ দেখাচ্ছিল পরিতোষকে।

অর্ক বুঝতে পারছিল না তার কি বলা উচিত। সে মুখ ফিরিয়ে অনিমেষকে দেখল। আপনি আমার বাবার সঙ্গে কথা বলুন। বাবা, এদিকে এসো।

পরিতোষ যেন খুব অবাক হলেন, তোমার বাবা? ও অনি! সে কোথায়? শুনেছি হাঁটাচলা করতে পারে না। তাঁর কথা শেষ হওয়া মাত্র অনিমেষ সামনে এসে দাঁড়াল। পরিতোষ তার দিকে। তাকিয়ে যেন চমকে উঠলেন, হায় ভগবান, তুই অনি? একি চেহারা হয়েছে তোর? আহা রে! আমাকে চিনতে পারছিস তো? আমি তোর।

চিনতে পেরেছি।

সেই এলি অনি আর একটু আগে আসতে পারলি না। বাবা গেল, মহী গেল, এই সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল। আজ মহীর মৃতদেহের সামনে বসে দিদি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। তুইও আমাকে তাড়িয়ে দিবি?

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি চান?

আমি? কিছুই চাই না। শুধু মহী যাতে ভালভাবে যেতে পারে তাই দেখতে চাই তোর শরীর ঠিক নেই, তোর ছেলে এখানে কখনও আসেনি, আমি থাকলে তোদের সুবিধে হবে রে। একটু ভেবে দ্যাখ, মহী তো আমারই ভাই।

কিন্তু দাদু আপনাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন এটা পিসীমা ভুলতে পারছেন না। তিনি এ বাড়ির সবার চেয়ে বড়। আপনি মামলা করেছেন।

আর লজ্জা দিস না। আমি আর মামলা চালাবো না রে। তোমার নামটা কি যেন, এই হয়েছে মুশকিল, কিছুতেই মনে রাখতে পারি না আজকাল।

অর্ক।

বেশ বেশ। আর সময় নষ্ট করো না। বেলা হয়ে যাচ্ছে। কিসে নিয়ে যাওয়া হবে ঠিক করেছ?

না।

ঠিক আছে চল আমি দেখছি। মহীর যেন একটুও অসম্মান না হয় দেখতে হবে। অনিমেষের আর কিছু করার ছিল না। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পরিতোষের নেতৃত্বে বেশ বড়সড় শ্মশানযাত্রীর দল তৈরি হয়ে গেল।ওই মানুষটির শোক এবং তার প্রকাশ বেশ উগ্র হওয়া সত্ত্বেও অনিমেষের মনে হচ্ছিল কোথাও বোধহয় ভুল হচ্ছে। হঠাৎ একটা ধাক্কা কাউকে আমূল পরিবর্তন করতে পারে। পরিতোষের ক্ষেত্রেও সেটা সম্ভব। তবে অর্কর সঙ্গে ওঁর পরিচয় কিভাবে হল এটা সে আঁচ করতে পারছিল না। এবং সেদিন জিজ্ঞাসা করবে ঠিক করেও শেষ পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলো।

সেই দিন থেকেই যেন এ বাড়ির প্রতিটি মানুষ অশৌচ পালন শুরু করে দিল। বিকেল হলেই এ বাড়িতে অন্ধকার এসে ঢোকে। টিমটিমে আলোগুলোকে ভূতের মত দেখায়। সন্ধ্যের পর ঠাণ্ডা পড়ছে এখানে। মেঝেতে বিছানা করে শুতে হচ্ছে। মাধবীলতা ছোটমার সঙ্গে রয়েছে। গতকাল পর্যন্ত মহীতোষের অস্তিত্ব এই বাড়িতে ছিল না বললেই চলে। মাঝে মাঝে যে গোঙানি তাও শেষ পর্যন্ত থেমে গিয়েছিল কিন্তু তখনও আবহাওয়া ভারী হয়নি। মানুষটা স্তব্ধ কিন্তু মৃত নয়, শুধু এই ধারনাই সবাইকে সচল রেখেছিল।

এখন কি করা যায় ভেবে পাচ্ছি না অনিমেষ। মাধবীলতা অনন্তকাল ছুটি পাবে না। অর্কর পড়াশুনা আছে। বড় জোর মহীতোষের কাজ পর্যন্ত ওরা এখানে থাকতে পারে। তার পর? ছোটমা এবং পিসীমাকে কার কাছে রেখে যাবে? দ্বিতীয় জনের কাছে তার নিজস্ব ঋণ শোধ করার সময় এখন। কিন্তু কি করে সেটা সম্ভব? ওদের এখান থেকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবা যায় না। পরমহংস যদি নতুন ফ্ল্যাট ধরে রাখে তবু সেখানে এরা৷ একরাতও থাকতে পারবে না। তাহলে? হঠাৎ অনিমেষের মনে হল মাধবীলতা যেচে এই সমস্যার মধ্যে তাকে ফেলে দিল। সে। নিজে এই বাড়ি এবং মানুষদের কাছ থেকে ধীরে ধীরে অনেক দূরে সরে গিয়েছিল। একসময় তার। ভুলেও জলপাইগুড়ির কথা মনে পড়ত না। ঈশ্বরপুকুর লেনের ঘরে তার নিজের ভাবনা চিন্তা করার কোন অবকাশ ছিল না। একটা জড়পদার্থের মত বাকি জীবন কাটিয়ে দেওয়া যেত। তার পরেই মনে হল, যদি আজ মহীতোষ কিংবা অর্কর কাছ থেকে কেউ তাকে অনেকদূরে কোন পরিবেশে রেখে দিয়ে আসে তাহলে কি এক সময় জলপাইগুড়ির মত ওদেরও সে ভুলে যাবে? ভুলে যেতে পারবে? অনিমেষ বুঝতে পারছিল না। কিন্তু একটা আশঙ্কা, ওর মনে তির তির করে কাঁপছিল। হয়তো সে ভুলে যাবে। এই পৃথিবীতে কোন কিছুই স্থির হয়ে থাকে না। এই মুহূর্তে মহীতোষের মৃত্যুশোক তারই বেশী করে বাজা উচিত। কিন্তু দীর্ঘ-অনুপস্থিতি শোকের ধার নষ্ট করে দিয়েছে। অথচ ছোটমা এবং পিসীমার শোক অনেক গভীর। শুয়ে অনিমেষ নিজের বুকে হাত দিল। সে কি ক্রমশ হৃদয়হীন হয়ে যাচ্ছে। কেন আর তাকে কোন কিছু তেমন করে কাঁদায় না! অনিমেষের অস্থিরতা বাড়ছিল। পাশে শুয়ে থাকা অর্কর দিকে সে তাকাল। কেমন অসহায় ভঙ্গীতে ছেলেটা এখন ঘুমুচ্ছে। এত দ্রুত পরিবর্তন কোন মানুষের হয়? এত দ্রুত! সঙ্গে সঙ্গে মনে হল তারও তো পরিবর্তন ঘটেছে। কখন তা ঘটে যায় জানা যায় না এই যা।

অনিমেষের ঘুম আসছিল না। ক্রাচ টেনে নিয়ে সে উঠল। শোওয়ার সময় মাথার পাশে যে চাঁদরটা ছিল সেটা কোনরকম জড়িয়ে নিল। তার পর ধীরে ধীরে দরজা খুলে ভেতরের ঘরে চলে এল। ঘুট ঘুট করছে অন্ধকার। এখন কত রাত কে জানে। সে চেষ্টা করেও ক্রাচের শব্দ কমাতে পারছিল না। এই বাড়িতে দরজা জানলা বন্ধ রাখলে সামান্য শব্দ অনেকগুণ বেড়ে যায়। কিন্তু তাতেও কারো ঘুম ভাঙ্গছে বলে মনে হল না। দেওয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে শেষ পর্যন্ত অনিমেষ মহীতোষের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দরজাটা ভেজানো, একটা সরু আলোর রেখা সামান্য ফাঁক গলে বেরিয়ে এসেছে। অনিমেষ হাত বাড়িয়ে নিথর হল। ছোটমা এবং মাধবীলতা খানিক দূরত্বে ঘুমিয়ে রয়েছে। ঘরের মাঝখানে একটা বড় প্রদীপ জ্বলছে। সলতেটা পুড়তে পুড়তে তেলের কাছাকাছি। শায়িত দুটো মানুষকে কেমন যেন অশরীরী বলে মনে হচ্ছে। মহীতোষের মৃত আত্মার জন্যে কি প্রদীপ জ্বেলে রাখা! অনিমেষ দরজাটা নিঃশব্দে বন্ধ করে দিল। তার কাঁপুনি আসছিল। এবং হঠাই সে বিড় বিড় করে বলল, বাবা, আমাকে ক্ষমা কর।

অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে অনিমেষ দরজা খুলে ভেতরের বারান্দায় এসে চুপ করে দাঁড়াল। এখনও চোখের ওপর প্রদীপের শেষ শিখা কাঁপছে। অথচ বাইরে চাঁদের দেওয়ালি। হিমমাখা জ্যোৎস্নায় বাগানটা ভাসছে। নাকে চোখে মুখে ঠাণ্ডা বাতাস লাগতেই সে ধাতস্থ হল। ও-পাশে পিসীমার ঘর, দাদুর পুরোনো ঘর কেমন ডুবো পাহাড়ের মত মনে হচ্ছে। সিঁড়িটার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ মাথা নাড়ল। সে কি একা নামতে পারবে? কেন পারবে না? নামতে তো তার কোন অসুবিধে হয় না। তলার ধাপে ক্রাচ রেখে অনিমেষ শরীরটাকে নামাল। তারপর বাকিগুলো অতিক্রম করলো সময় নিয়ে। এখন খালি পায়ে বাগানের মাটিতে, জ্যোৎস্নায়। দাদু। থাকতে এত আগাছা ছিল না বাড়িতে। এত বুনো ঘাস কখনও হয়নি। অনিমেষ সেই আধা-জঙ্গল ভেঙ্গে এগোচ্ছিল। তার কোন লক্ষ্য ছিল না। অথচ হঠাৎ এই বাগানে চলে এসে মন খুব হালকা হয়ে যাচ্ছিল। অনিমেষকে দেখেই একটা প্যাচা পাখায় শব্দ করে উড়ে গেল যে গাছটা থেকে সেখানে নজর গেল ওর। ওটা কি গাছ? পেয়ারা না! সেই পেয়ারা গাছটা? কত বছর একটা পেয়ারা গাছ বাঁচে? অনিমেষ দ্রুত জঙ্গল মাড়িয়ে চলে এল গাছটার তলায়। বেশ বড় ঝাঁকড়া গাছে বসে থাকা দ্বিতীয় প্যাচাটা এবার ভয় পেয়ে ডেকে উঠল কর্কশ স্বরে এবং সঙ্গীর অনুগামী হল। এবং তখনই অনিমেষের সমস্ত শরীর রোমাঞ্চিত হল। এই গাছ! সে নিচের দিকে তাকাল। ঘন ঘাস আর আগাছা ছাড়া কিছুই নেই। কিন্তু এখানে সে মাটি রেখেছিল, ভালবাসার মাটি।

অনেক অনেক বছর আগে দাদুর সঙ্গে যেদিন চিরদিনের মত স্বৰ্গছেঁড়া থেকে সে এখানে চলে এসেছিল সেদিন রুমালে করে স্বর্গছেঁড়ার মাটি এনেছিল। তার জন্মভূমির মাটি। সাত বছরের বালক সেই মাটি এই পেয়ারা গাছের তলায় রেখে প্রতিদিন দেখত আর স্বৰ্গছেঁড়ার কথা ভাবত। ভাবত এই জায়গাও স্বৰ্গছেঁড়া হয়ে গেছে কিংবা ওই মাটির দিকে তাকালেই মনে হত সে স্বৰ্গছেঁড়াতেই আছে। কিন্তু তার পর একদিনের সামান্য বৃষ্টির পর সে দৌড়ে এসে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিল একা এই বাগানে দাঁড়িয়ে। সেই মাটিটাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই মাটি সেই মাটিকে নিজের করে নিয়েছিল। তার পর থেকে মনে হত জলপাইগুড়িতে স্বৰ্গছেঁড়ার মাটি মিশে রয়েছে। মনে হলে সেই বালক খুশি হত। একটু একটু করে জলপাইগুড়িকেও তাই নিজের ভাবা গেল।

আজ এতদিন পরে সেই পেয়ারা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে এই নির্জন রাত্রে অনিমেষের মনে হল সে দিনের সমস্ত ব্যাপারটাই ছেলেমানুষী কিংবা বোকামি ছিল? ওইটুকু মাটি নিয়ে একটা ছোট্ট ছেলে কি আবেগে আক্রান্ত হয়েছিল! নিজের মনেই মাথা নাড়ল সে। কলকাতায় যাওয়ার সময় সে রুমালে মাটি বেঁধে নিয়ে যায়নি। কিন্তু কলকাতা তাকে গ্রাস করে নিল। তার শরীর থেকে একটি অদৃশ্য সিরিঞ্চ মারফৎ সমস্ত আবেগ শুষে নিল। অনিমেষের বুকের খাঁচা কেঁপে উঠল। সে মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল। শীতার্ত আকাশ। ঘোলাটে সাদা। শুধু চাঁদের শরীরে ঝকমকে আলো। কিছু কিছু তারাও আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আঃ! কতদিন পরে আকাশ দেখা গেল! হঠাৎ অনিমেষের মনের অনেকগুলো স্তরের নিচ থেকে একটা স্মৃতি ভুল করে উঠে এল। সে উদগ্রীব চোখে সেই তারাকে খুঁজতে লাগল। খুব উজ্জ্বল তারা, জ্বল জ্বল করত। আজকের আকাশে তাকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। মায়ের মৃত্যুর পর আকাশের দিকে তাকিয়ে সে প্রায়ই যে তারাটার সঙ্গে কথা বলত। মৃত্যুর আগে মা বলেছিল তাঁকে মনে পড়লেই সে যেন ওই তারাটা দ্যাখে। আজ এত বছর পরে সেই তারাটাকে খুঁজতে গিয়ে হাসি পেল অনিমেষের। হায়, তারাদেরও বয়স বাড়ে, তারাও মরে যায়।

অনিমেষ মুখ নামাতেই তার বুক ছ্যাঁত কতে উঠল। ওটা কি? সাদা, লম্বা, হাওয়ায় কাঁপছে! আধো আলো আধো জ্যোত্সায় মূর্তিটি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যাচ্ছিল। এই নির্জন বাড়িতে প্রেতাত্মারা ঘোরাফেরা করে নাকি! এই মুহূর্তে কোন ব্যাখ্যা বা প্রমাণের কথা মাথায় আসছে না! অনিমেষের দুটো হাত ক্রাচ আঁকড়ে ছিল। এবং তখনই মূর্তিটা সামান্য নড়ল। সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষ ধাতস্থ হল। চোর নম্ব তো! আজকের দিনে ওদের তো খুবই সুবিধে। কিন্তু এ বাড়িতে নেওয়ার মত কিছু নেই তা নিশ্চয়ই ওরা জানে, তবে? সাহস এল, অনিমেষ ধীরে ধীরে বারান্দার দিকে এগোল। না, চোর নয়। চোর হলে তাকে দেখে নির্ঘাৎ পালাতো। অনিমেষ আরও একটু কাছাকাছি হলে স্পষ্ট দেখতে পেল। ছোটমা। সাদা কাপড় হাওয়ায় উড়ছে। আচমকা বুকের ভেতরটা স্থির হয়ে গেল। ছোটমা এখানে কেন?

ছোটমা তার দিকে মুখ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। অনিমেষ বাগান পেরিয়ে সিঁড়ির কাছে উঠে এসে ইতস্তত করল। তার পক্ষে নামা যত সহজ ওঠা তত মুশকিল ওপরের ধাপে একটার পর একটা ক্রাচ রেখে দুহাতে ভর দিয়ে কোনরকমে শরীরটাকে টেনে তুলে বড় আনন্দ হল অনিমেষের। আঃ, সে পেরেছে। পরের দুটো ধাপ পার হতে একটু বেশী সময় লাগল কিন্তু এবার সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল সে। না, আর অন্যের ওপর নির্ভর করতে হবে না সব সময়। শুধু অনভ্যাসই মানুষকে পরনির্ভর করে তোলে। সে ধীরে ধীরে ছোটমার দিকে এগিয়ে গেল।

বারান্দার এককোণে ছোটমা দাঁড়িয়েছিলেন। সম্পূর্ণ সাদা কাপড়ে তাঁকে খুব করুণ দেখাচ্ছিল। অনিমেষ মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার?

আমি কি করব? খুব নিচু গলায় যেন নিজেকেই জিজ্ঞাসা করলেন ছোটমা।

মানে?

এবার আমি কি করব? আমার তো কোন পিছুটান রইল না। এ বাড়িতে থাকবার কোন অধিকার নেই। নিঃস্ব গলা, বাতাসের সঙ্গে মেশামেশি।

কে বলেছে এসব? অনিমেষ খুব বিস্মিত হচ্ছিল।

কেউ না। বাপের বাড়িতে কেউ নেই। দাদারা যে যার নিজের সংসারে ব্যস্ত। এখানে যিনি ছিলেন তিনিও গেলেন। সত্যি কি আমার কখনও কেউ ছিল!

অনিমেষ এবার একটু ধমকের গলায় বলল, মাঝরাত্রে এসব কি হচ্ছে। এই বাড়ি থেকে যাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি!

ছোটমা অদ্ভুত ভঙ্গীতে হাসলেন। মাথা খারাপ! হায়, সেটা হলেও তো আমি বেঁচে যেতাম। কিন্তু তুমি কি করছিলে? এই মাঝ রাত্রে একা একা ওই জঙ্গলে দাঁড়িয়ে?

অনিমেষ থতমত হয়ে গেল। তার মুখে কোন জবাব এল না। ছোটমার মুখে সেই হাসিটা আরও ধারালো হল, সেটা পাগলামো নয়? তারপরই হাসিটা শব্দময় হল, আমি না, আমি এতদিন ঝি হয়ে ছিলাম, বিনি পয়সার ঝি। আজ বাবু মারা গেল আর আমারও ঝিগিরি চলে গেল!

অনিমেষ চেঁচিয়ে উঠল, ছোটমা!

চুপ করো। আমাকে তুমি মা বল না। কি করেছ তুমি আমার জন্যে? আমি কি তোমাকে ভালবাসিনি? আমি কি তোমাকে আপন করে নিই নি? এই বাড়িতে আমি কি পেয়েছি? তোমার বাবা যৌবনে আমাকে কি দিয়েছে? কখনও ভেবেছ এ সব! কলকাতায় গিয়ে কখনও আমার কথা ভেবেছ? স্বার্থপর, স্বার্থপর, স্বার্থপর। তিন রকম উচ্চারণ যেন অনেক ঘৃণা উজাড় করে ঢেলে দিল

অনিমেষ সেই উন্মাদিনীর দিকে তাকিয়ে রইল বিস্ময়ে। তার গলায় শব্দ আসছিল না। ছোটমা তখনও মাথা নাড়ছিলেন, দেশ উদ্ধার করছেন তিনি। দিনের পর দিন আমি তোমার জন্যে মিথ্যে কথা বলে গেছি তোমার বাবার কাছে। পারলে দেশ উদ্ধার করতে? খোঁড়া হয়ে বউ-এর ঘাড়ে বসে খাচ্ছ আর দায়িত্ব নেবার ভয়ে লুকিয়ে রেখেছ নিজেকে। কথা বলো না, তুমি কথা বলো না। এখন দু’দিনের জন্যে বেড়াতে এসেছ, আমাদের দুর্দশা দেখে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে চলে যাবে। তাই না, আমি ঠিক বলছি না?

ছোটমার বড় বড় চোখের দিকে তাকিয়ে অনিমেষ মাথা নাড়ল। সেটা সমর্থনের কি প্রতিবাদের তা বোঝা গেল না। তার পর শান্ত গলায় বলল, আমার ভুলগুলো এবার আমাকেই শুধরাতে হবে ছোটমা, তুমি এমন করে কথা বল না।

চমকে মুখ তুলে তাকালেন, ছোটমা। তার পর নিজের মনেই বললেন, আমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল। আমি তোমাকে এ সব কি বললাম! ছি

অনিমেষ বলল, ঠিকই বলেছ। কিন্তু আমি জানি না আমি কি করব।

হঠাৎ যেন পাল্টে গেলেন মহিলা, তোমাকে কিছুই করতে হবে না। তুমি যেমন আছ তেমনি থাক। স্রোতে গা ভাসিয়েছ এখন কি আর স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটা যায়। আমি তোমাকে এ সব কথা বলতাম না। কিন্তু বারান্দায় এসে যেই দেখলাম তুমি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছ। একমনে তখনই মাথা খারাপ হয়ে গেল। কিছু মনে করো না।

আকাশের দিকে তাকিয়েছিলাম তো কি হল?

তুমি ভুলে গেছ। অনেকদিন আগে আমায় বলেছিলে আকাশের দিকে তাকালে নাকি তুমি দিদিকে দেখতে পাও। এ বাড়িতে পা দেওয়ার পর তোমার মৃত মা আমার পেছন ছাড়েননি। এই আজকেও বড়দি মাধুরী মাধুরী করছিলেন। মানুষটা মরে গিয়ে সারা জীবন আমার শত্রুতা করে গেল। তাই যখন দেখলাম তুমি আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছ তখন হিংসেয় বুক ফেটে গেল। অনিমেষ, আমি যখন এখনও হিংসে করছি তখন পাগল হইনি, না? যাই, তোমার বউ অনেকক্ষণ ওই ঘরে একা আছে। কিছু মনে করো না। সাদা কাপড়ে জড়ানো শরীরটা ধীরে ধীরে ভেতরে চলে গেল।

অনিমেষের কোমর টনটন করছিল। সে সাদা জ্যোৎস্নার দিকে তাকাল। প্রথমে মনে হয়েছিল ছোটমার মাথা বোধ হয় ঠিক নেই। কিন্তু এখন ওই জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে সে ঘাড় নাড়ল। ঠিকই। ছোটমা খুব সত্যি কথা বলেছে। এই সত্যগুলো তার মুখের ওপর কেউ এতকাল সরাসরি বলেনি। মাধবীলতা মুখ বুজে থেকেছে, অর্কর বোধে আসেনি। এখন কিছু একটা করা দরকার। এইভাবে বদ্ধ জলার মত পড়ে থাকার কোন মানে হয় না। স্রোত চাই, যে কোনভাবে এগিয়ে যেতে হবেই।

.

ঘুম ভাঙ্গতেই চিৎকার চেঁচামেচি কানে এল। অনিমেষ চোখ খুলতেই দেখল অর্ক উঠে বসেছে। একমাত্র খালি পা আর মাথায় তেল না দেওয়া ছাড়া অর্ককে কোন অশৌচ পালন করতে হচ্ছে না। তা দ্বিতীয়টি ইদানীং মাথায় দেয় না বলে ওর কোন অসুবিধে নেই। চেঁচামেচি শুনে অর্ক উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বাইরের দরজা খুলে বারান্দায় আসতেই দৃশ্যটা দেখতে পেল অর্ক। এই সাতসকালে পরিতোষ হাঁকডাক করে জিনিসপত্র নামাচ্ছেন। একটা ঠেলা রয়েছে গেটের বাইরে দাঁড় করানো। তার ওপর তূপীকৃত মালপত্র। অর্ককে দেখতে পেয়ে একগাল হাসলেন, তোমার ঠাকুমা এল বলে। রাতে ঘুম হয়েছিল? এই যে, মালগুলো নামাও না!

অর্ক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি করছেন?

চলে এলাম। তোমাদের কোন চিন্তা নেই। ওই পুরোনো বাড়িটায় গিয়ে উঠব। দলবদ্ধ হলে শক্তি বাড়ে। সেই গুরু শিষ্যের গল্পটা জানো তো! তা আর সবাই ঘুম থেকে উঠেছে? পরিতোষ এগিয়ে এলেন।

না। অর্ক জবাব দেওয়া মাত্র অনিমেষ বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে বলল, এ কি?

পরিতোষ বললেন, চলে এলাম। তোমার জেঠিমা আসছেন। আর যখন ঝগড়াঝাঁটি নেই তখন আলাদা থেকে লাভ কি! আমি আজই মামলা তুলে নিচ্ছি।

অনিমেষের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, আপনি পিসীমার অনুমতি নিয়েছেন?

অনুমতি? কার, বড়দির? বড়দির অনুমতি নিতে হবে?

হ্যাঁ। বাবার অবর্তমানে তিনি এই বাড়ির কর্তা।

মেয়েছেলে আবার কতা হয় নাকি?

যা বলছি তাই শুনুন। ওদের মালপত্র নামাতে বারণ করুন। এ নিয়ে কোন অশান্তি করতে চাই না আমি। আপনি পিসীমার সঙ্গে দেখা করুন।

অনিমেষের কথাগুলো পরিতোষের পছন্দ হচ্ছে না বোঝা গেল। তিনি শেষ পর্যন্ত ঘাড়, নাড়লেন, ঠিক হ্যায়, চল যাচ্ছি। কোথায় বড়দি?

অনিমেষ অর্ককে ইশারা করতে সে পরিতোষকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। ততক্ষণে ভেতরের ঘরে মাধবীলতা আর ছোটমা এসে দাঁড়িয়েছেন। ছোটমার চোখে বিস্ময় এবং বিরক্তি। অর্ক পরিতোষকে নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকলে পরিতোষ বললেন, বাবার একটা মেহগিনি কাঠের আলমারি ছিল, সেটা নেই?

অর্ক বলল, আমি এ সব জানি না।

পরিতোষ বললেন, নির্ঘাৎ হাওয়া হয়ে গেছে।

.

ভেতরের বারান্দায় আসতেই হেমলতাকে দেখা গেল। বাগানে ঘুরে ঘুরে একটা রেকাবিতে ফুল তুলে রাখছেন। তাঁর ছোট্ট শরীরটা গাছগুলোর ফাঁকে দুলছিল। মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই। তাঁকে দেখা মাত্র পরিতোষ ছুটে গেলেন, বড়দি, ও বড়দি, ক্ষমা কর, ক্ষমা কর এই অধমকে, আমি পাপী মহাপাপী।

হেমলতা অবাক হয়ে তাকালেন পরিতোষের দিকে। পরিতোষ তাঁর সামনে আগাছার মধ্যেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছেন। বোধ হয় তিনি ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলেন না। লোকটার ভণ্ডামি দেখে অর্কর মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল। সে নিজে থেকে বলল, উনি মালপত্র নিয়ে এসেছেন এখানে থাকবেন বলে। বাবা আপনার অনুমতি নিতে বললেন।

এবার হেমলতার ঠোঁট নড়ল, আমি অনুমতি দেবার কে?

তুমিই সব। তুমি বললেই হবে। আমি মামলা তুলে নেব।

হেমলতা জবাব দিলেন না। যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গীতে অন্য গাছের সামনে গিয়ে ফুল তুলতে লাগলেন। পরিতোষ উঠে দাঁড়ালেন। তার পর করুণ গলায় ডাকলেন, দিদি, বড়দি। হেমলতা সেদিকে লক্ষ্যই করছিলেন না। তাঁর ছোট্ট শরীরটা একটু একটু করে দূরে চলে যাচ্ছিল।

এই সময় বারান্দা থেকে ছোটমার গলা নেমে এল, অর্ক, এখন ওঁকে যেতে বল। তোমার দাদুর কাজ মিটে যাক তার পর তোমার বাবা ওঁর সঙ্গে কথা বলবেন। এতদিন যখন ধৈর্য ধরতে পেরেছেন আর কটা দিন নিশ্চয়ই পারবেন।

পরিতোষ চকিতে বারান্দার দিকে তাকালেন। মুখ অসহায় দেখাচ্ছিল তাকে। অর্ক তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াল, শুনলেন তো। এবার ঠেলা ফিরিয়ে নিয়ে যান।

হঠাৎ পরিতোষ চিৎকার করে উঠলেন, ঠিক হ্যায়। আমি অভিশাপ দিচ্ছি এই বাড়ি ভূতের বাড়ি হবে। কেউ বাস করতে পারবে না এখানে। তার পর হন হন করে বেরিয়ে যেতে যেতে বারান্দার · দিকে তাকিয়ে আচমকা গলা পাল্টে বললেন, বেশ বউমা, তোমার কথাই থাক। আমি কাজের পরই এ বিষয়ে কথা বলব।

৩৭. খালিপায়ে হাঁটছিল অর্ক

মাধবীলতার পাশাপাশি খালিপায়ে হাঁটছিল অর্ক। মাথায় তেল সাবান দেওয়া নিষেধ কিন্তু চিরুনি না চালিয়ে থাকা যায় না। অনিমেষকে সে প্রশ্ন করেছিল, এগুলো করে কি লাভ হয় বাবা? অনিমেষ জবাব দেওয়ার আগে মাধবীলতা বলেছিল, লাভ লোকসানের বিচার সবসময় করতে নেই, মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্যে এসব করতে হয়।

অর্ক হেসে ফেলেছিল, এসব না করলে অসম্মান করা হয় বুঝি?

মাধবীলতা বিরক্ত হয়েছিল, অত প্রশ্ন করতে হবে না তোমাকে। যা নিয়ম তা মেনে চললে সবাই খুশি হবে। তুই দাঁড়া, আমি ভেতর থেকে ঘুরে আসছি।

অর্ক বলেছিল, তাহলে সবাইকে খুশি করার জন্যে বাবা ওই পোশাক পরেছে? মৃতের প্রতি সম্মান জানানো নয়?

মাধবীলতা কাঁধ ঝাঁকালো, তারপর বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলল, যা ইচ্ছে তাই ভাবো।

অনিমেষ হাসছিল, উত্তর পেয়ে গেছিস।

অর্ক, বলল, তুমি কিছু বললে না!

অনিমেষ বলল, আমার কিছু বলার নেই। একজন মানুষ পৃথিবী থেকে চলে গেলে সব জাতই কিছু না কিছু শোকচিহ্ন ধারণ করে। আমরা হয়তো একটু বেশী করি। এই যে কদিন ধরে কৃচ্ছসাধন করে থাকা, এটা আর কিছু নয়, নিজেকে শুদ্ধ করে রাখা। শ্রাদ্ধ অবধি আত্মার মুক্তি হয় না বলে একটা বিশ্বাস আছে। তদ্দিনের জন্যে এই ব্যবস্থা।

কিন্তু কেউ মারা গেলে যদি আমার এক ফোঁটা কষ্ট না হয়, তাকে বেঁচে থাকতে যদি আমি সম্মান করি তাহলে মরে যাওয়ার পর এসব করব কেন? লোক দেখাতে?

বোধহয় তাই।

অর্ক অনিমেষকে এবার সরাসরি প্রশ্ন করেছিল, তুমিও এসব মানো?

মানি না, মেনে নিই। দ্যাখ, আমাদের সামাজিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে অনেক ফাঁকি অনেক গোঁজামিল আছে। অল্প বয়সের উত্তেজনায় সেগুলিকে নস্যাৎ করার একটা প্রবণতা আসে। তখন মনে হয় এগুলোকে ভেঙে ফেলব, অমান্য করব। কিন্তু তাতে কিছু লাভ হয় না। যেসব বিশ্বাস সমাজের ক্ষতি করে না সেগুলো মানলে যদি প্রিয়জনেরা খুশি হয় তাহলে মেনে নেওয়া ভাল। ওগুলো অস্বীকার করে যেমন বিপ্লবী হওয়া যায় না আবার স্বীকার করলেও চরিত্র নষ্ট হয় না। কথাগুলো শেষ করা মাত্র অনিমেষের খেয়াল হল এত সিরিয়স হয়ে সে কার সঙ্গে কথা বলছে? আজ পর্যন্ত অর্কর সঙ্গে কোন ব্যাপক সমস্যা নিয়ে এই ভঙ্গীতে কথা বলেনি। ও কথাগুলোর অর্থ পুরোপুরি বুঝতে পেরেছে কিনা তাতেও সন্দেহ থেকে যাচ্ছে।

অর্ক মাথা নাড়ল। তারপর ঘরের কোণে রাখা চটিটার দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু বাইরের রাস্তায় আমার খালি পায়ে হাঁটতে কষ্ট হয়। বাড়িতে চুপচাপ বসে ওইসব নিয়মগুলো মানা যায় কিন্তু।

খোঁচাটা ইচ্ছাকৃত কিনা অনিমেষ বুঝতে পারল না কিন্তু সেটা সে গায়ে মাখল না, বেশ তো, একটা রবারের হাওয়াই কিনে নে। মায়ের কাছে পয়সা চেয়ে নিয়ে যা।

মা বলেছিল। কিন্তু চামড়ার চটি পরলে নিয়ম ভাঙা হবে আর রবারে হবে না, এটা মানা যায়? অর্ক ব্যঙ্গের হাসি হাসল।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, যায় না। তবে সময়ের সঙ্গে কিছুটা অ্যাডজাস্ট করতে হয়।

যেমন, শানু বলছিল, ফিল্মস্টাররা মাথা না কামিয়ে পুরোহিতকে টাকা ধরে দেয় তাতে নাকি নিয়ম ভাঙে না। আমি আজকে এই জুতো পরে যাব।

তোর যদি ইচ্ছে হয় তো যা। এত কথা বলছিস কেন?

তোমার আপত্তি নেই তো?

শোন, যেটা ভাল মনে করবি সেটা নিঃসঙ্কোচে করবি। তোর মনে দ্বিধা আছে বলেই তুই হাজারটা কথা বলে নিজেকে শক্ত করতে চাইছিস। বেশ, তোর যদি এসব না মানতে ইচ্ছে করে তুই জুতো পরে যা, মাথায় তেল দিবি, বাজার থেকে মাছের ঝোল কিনে এনে বাড়িতে খাবি আমি আপত্তি করব না। কোন একটা মানব না আর বাকিগুলো স্বীকার করব এটা চলবে না। নিয়ম ভাঙতে গেলে তোমাকে সবকটাই ভাঙতে হবে। আমি কথা দিচ্ছি কেউ তোমাকে এ ব্যাপারে কিছু বলবে না। অনিমেষ প্রশান্তমুখে বলল।

অর্ক কিছুক্ষণ বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। সে যে দ্বিধায় পড়েছে এটা বোঝা যাচ্ছিল। বাবার কথামত সে নিয়মগুলো ভাঙতে পারে। কিন্তু তাতে এই বাড়িতে দৃষ্টিকটু ঠেকবে। সে দরজায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করেছিল, মা!

মাধবীলতা তৈরি হয়ে এল। প্রসাধনের কোন প্রশ্ন ওঠে না, এই অবস্থায় কোন মেয়ের পক্ষে বাইরে যাওয়া মুশকিল কিন্তু আজ না গিয়ে উপায় নেই। অর্কর ওপর ছেড়ে দিলে সে স্বস্তি পাবে না। তার হাতব্যাগে যেহেতু চামড়া আছে তাই কাগজের মধ্যে মুড়ে নিতে হয়েছে জিনিসটাকে।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাধবীলতা আর একবার অনিমেষকে দেখল। এখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে অনিমেষ। তার দৃষ্টি এখন এদিকেই। কাল রাত থেকে অনেক আপত্তি করেছিল সে। কিন্তু আপত্তি করলেই হয় না, সমস্যা সমাধানের কোন পথ দেখাতে পারেনি। অগত্যা এটাকে মেনে নিতেই হবে। মাধবীলতাও অনেক ভেবেছে। কোন জিনিস নতুন করে গড়া যাচ্ছে না তাই বিক্রি করতে গেলে ধরেই নিতে হয় এটার বিকল্প আসবে না। কিন্তু এ অবস্থায় চুপ করে বসেও থাকা যায় না। কলকাতা থেকে আসবার সময় যে টাকা সঙ্গে নিয়ে এসেছিল তাতে কিছুই হবে না। আর সেটা ফুরিয়ে গেলে এখানে চলবে কি করে, ফেরার ভাড়াটাই বা পাওয়া যাবে কোথায়? মহীতোষের জমানো টাকা যা থেকে সুদ আসে তাতে হাত দিতে চায়নি মাধবীলতা। গতকাল বিকেলে হঠাৎ ছোটমা তার কাছে সেই প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু সে মাথা নেড়েছিল, ওই টাকায় একবার হাত দিলে এ বাড়ির মানুষ দুজনের আর দাঁড়ানোর জায়গা থাকবে না। শেষপর্যন্ত ছোটমা দুটো সোনার কানপাশা বের করেছিলেন। গয়নাগাঁটি এক এক করে এতদিনে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে, এটি শেষ সম্বলগুলোর মধ্যে হয়তো ছিল। মহীতোষের কাজ উপলক্ষে তাও বেরিয়ে এল। মাধবীলতা ইতস্তত করলেও শেষপর্যন্ত মেনে নিয়েছিল। তবে দুটোয় মিলে বারো আনার বেশী হবে না। বারো আনা সোনা বিক্রি করলে কত পাওয়া যায়? আর তখনই তার নিজের আঙ্গুলের দিকে নজর গিয়েছিল। এটা যে সোনার আংটি তা আর খেয়ালই নেই। আঙ্গুলে চেপে বসে আছে দীর্ঘকাল। সেই বিয়ের আগে থেকেই। হেসে ফেলেছিল মাধবীলতা। বিয়ে কথাটা এত স্বাভাবিক ভাবে মনে আসে আর তখনই শান্তিনিকেতনের সেই বাড়িটার কথা মনে পড়ে যায়।

খালি পায়ে হাঁটছিল অর্ক। বলল, এটা হচ্ছে টাউন ক্লাব স্টেডিয়াম।

স্টেডিয়াম? যাঃ, এটা আবার স্টেডিয়াম নাকি? মাধবীলতার গলায় তাচ্ছিল্য।

ওপাশে লেখা রয়েছে। জায়গাটা খুব নির্জন, না মা?

হুঁ।

সেই পান-সিগারেটের দোকানটার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় লোকটা ওদের দেখে হেসে চেঁচিয়ে বলল, শানুবাবু এখনও আসেনি।

অর্ক কথা না বলে মাথা নাড়ল। মাধবীলতা অবাক হল, তোকে চেনে দেখছি শানুবাবু আবার কে?

এখানকারই একটা ছেলে। ও না সিনেমায় নামতে চায়।

চমৎকার। এখানে সিনেমা কোথায়?

এখানে কেন হবে, কলকাতায় যাবে। এই নদীটার নাম করলা।

মাধবীলতা একটা মজা নদীকে দেখল। অনিমেষ এই নদীর গল্প করত। অবশ্য তার বেশী আকর্ষণ ছিল তিস্তার ওপরে। তিস্তাটাকে দেখা হয়নি। এখানে আসার পর এই প্রথম বাড়ির বাইরে বের হওয়া। অনিমেষ সঙ্গে থাকলে ভাল লাগত। সেই কথা বলতে অর্ক হাসল, বাবা তো অনেককাল এখানে আসেনি। আমি বাবার চেয়ে এই শহরটাকে ভাল চিনে গেছি। এই রাস্তা ধরে আর একটু এগোলেই থানা, ওদিকে দিনবাজার এদিকে কদমতলা, তিনটে সিনেমা হল পড়ে এই রাস্তায়।

তিস্তা নদীটা খুব দূরে?

দুরে নয় মোটেই। এই করলা গিয়ে তিস্তায় পড়েছে। ওখানে একটা সুন্দর পার্ক করেছে, জুবিলি পার্ক। বাবা কোনদিনই সেটাকে দ্যাখেনি। আর আমাদের বাড়ির পেছন দিক দিয়ে একটু হাঁটলেই তিস্তার চরে যাওয়া যায়। তুমি তিস্তা নদী দেখবে?

ফেরার সময় খুব দেরি না হলে যাব।

তোমার খালিপায়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে না? অবশ্য এখন আর রিকশা নিয়ে কি হবে, আমরা প্রায় এসেই গেছি।

মাধবীলতা কিছু বলল না। ছেলে যে এই কদিনে শহরটাকে গুলে খেয়েছে তা সে জানতো না। এখন মনে হল এটাই স্বাভাবিক। তবে এখানে বোধ হয় বেশী বেকার ছেলে নেই। কারণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কলকাতার মত আচ্ছা এবং অশ্লীল কথা বলতে সে কাউকে দেখতে পেল না। দুপাশে এখন গিজগিজে দোকান, রিকশা আর সাইকেলে রাস্তাটা উপচে পড়ছে। অর্ক মাধবীলতাকে নিয়ে অপেক্ষাকৃত একটা ফাঁকা এলাকায় চলে এল। মাথায় বিরাট সাইনবোর্ড বলছে সোনা রূপা গহনার আদান-প্রদান করা হয়। দোকানটা মাঝারি। সামনে লোহার খাঁচা, ভেতরে দুজন লোক বসে আছে। একজন একদম রাঙামুলোর মত দেখতে, গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি, চোখে স্টেনলেসের চশমা। ওদের দেখে হেসে বলল, আসুন।

এরকম চেহারার লোক দেখলেই মাধবীলতার অস্বস্তি হয়। পুরুষমানুষের মধ্যে মেয়েলিপনা সহ্য করা যায় না। ওরা খাঁচার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই লোকটা মিষ্টি হাসবার চেষ্টা করল, বলুন কি চাই?

মাধবীলতা সামান্য ইতস্তত করল। সে গহনা বিক্রি করতে এসেছে কিন্তু কি ভাবে সেই কথা বলতে হয় তা ভাবেনি। লোকটা আবার বলল, আপনি কি ক্রেতা না বিক্রেতা? দুদলকেই আমরা আপ্যায়ন করি। অবশ্য কেউ যদি বন্ধক রাখতে চায় তাতেও আমাদের আপত্তি নেই। সঙ্কোচ করবেন না। বন্ধক রাখতে শব্দটা শোনামাত্র মাধবীলতার হুঁশ হল। বিক্রি করলে তো সারাজীবনের মত হাতছাড়া হয়ে গেল। কিন্তু বন্ধক রাখলে ভবিষ্যতে ফিরে পাওয়ার সুযোগ থাকবে। সে মাথা নাড়ল, হা, হঠাৎ খুব বিপদে পড়েছি, আমি দুটো জিনিস বন্ধক রাখতে চাই। আপনার নিয়মগুলো।

এক ভরি সোনা রাখলে যা বাজার দর তার ষাটভাগ আপনি ধার পেতে পারেন। দুবছরের মধ্যে গহনা ছাড়িয়ে নিয়ে না গেলে ওটা বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। বার্ষিক সুদ শতকরা বিশ টাকা। লোকটা হাসল।

টোয়েন্টি পার্সেন্ট! আঁতকে উঠল মাধবীলতা

ব্যাঙ্কে যান, ওরা এইটিন পার্সেন্ট চাইবে। আর খোলা বাজারে মাসেই তিন পার্সেন্টের নিচে লোন পাওয়া যায় না। দেখি গহনাগুলো। লোকটা হাত বাড়াল। মাধবীলতা একবার অর্কর দিকে তাকাল। সে ভেবে পাচ্ছিল না কি করবে। টাকার দরকার কিন্তু এইভাবে ধার নিলে দুবছরের মধ্যে শোধ করা যাবে? সে যেন নিজেকে জিজ্ঞাসা করার মত গলায় বলল, কি করব!

অর্ক মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা শুনছিল। দাদুর কাজের জন্যে ছোটমা এই গহনা বিক্রি করতে দিয়েছেন। কাল রাত্রে মায়ের সঙ্গে বাবার কথাবার্তায় এই তথ্যটি সে জেনেছে। বন্ধক রাখলে অনেক কম টাকা পাওয়া যাবে এবং ছোটমা যখন কোনদিনই শোধ করতে পারবেন না তখন মা খামোকা কেন বন্ধক রাখতে চাইছে সে বুঝতে পারছিল না। সে নিচু গলায় বলল, ঝামেলা না করে একেবারে বিক্রি করে দাও।

মাধবীলতা মাথা নাড়ল। কথাটা যে তার মনঃপূত হয়নি সেটা বোঝা গেল। আংটি আর কানপাশা বের করে সে খাঁচার ভেতরে রাখল। লোকটা জিনিসদুটো খানিকক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখল। তারপর তার সঙ্গীকে বলল, নিন, দেখুন।

দ্বিতীয় লোকটা যেন ওত পেতে বসেছিল, শোনামাত্র ছোঁ মেরে নিয়ে গেল ভেতরে। এবার প্রথম লোকটা বলল, আরে আপনারা দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন? ওই দরজাটা ঠেলে ভেতরে বসুন। ততক্ষণে জিনিসগুলো যাচাই করা হয়ে যাবে।

মাধবীলতা দেখল ডানদিকে খাঁচার একটা দরজা আছে। তবে সেটা বাইরে থেকে বোঝা যায় না যদি বন্ধ থাকে। সে এবং অর্ক দরজাটা ঠেলতেই খুলে গেল। ভেতরে একটা লম্বা গদি দেওয়া বেঞ্চি রয়েছে। ওরা দুজনে সেটার ওপর বসতেই লোকটা বলল, একটু চা হোক।

মাধবীলতা ঘাড় নাড়ল, না। লোকটা জিভ বের করল, সে কি! আপনারা প্রথম দিন এলেন, ব্যবসা শুরু হল, খালিমুখে যাবেন কেন? চা না খান, ঠাণ্ডা দিতে বলি।

মাধবীলতা শান্ত গলায় বলল, এখন আমাদের খাওয়ার ইচ্ছে নেই।

লোকটা যেন কষ্ট পেল। তারপর বলল, কেউ চলে গেছেন বুঝি।

হা। মাধবীলতার এই গায়ে-পড়া ভাবটা ভাল লাগছিল না।

কোন পাড়ায় থাক তোমরা? এবারের প্রশ্নটা অর্কর দিকে তাকিয়ে।

হাকিমপাড়া।

কোন বাড়ি? এবার মাধবীলতা জবাব দিল, এখানে আমরা থাকি না, আপনি চিনবেন না।

এবার লোকটা হেসে ফেলল, আমার প্রশ্ন শুনে আপনি বোধহয় বিরক্ত হচ্ছেন। কিন্তু আমি অকারণে জিজ্ঞাসা করছি না। আসলে কি জানেন, এই সোনাদানার বিক্রিবাটা খুব সাবধানে করতে হয়। ধরুন, আমি আপনাকে চিনি না, ঠিকানা জিজ্ঞাসা করিনি এবং আপনি একটা সোনার হার আমাকে বিক্রি করে চলে গেলেন। পরে পুলিস এসে বলল ওটা চোরাই মাল। আমাদের অবস্থাটা তখন চিন্তা করুন।

মাধবীলতা কিছু বলার আগেই অর্ক খিঁচিয়ে উঠল, চোরাই মাল? আমরা কি ওগুলো চুরি করে এনেছি মনে করছেন?

আহা, সেকথা আমি বলিনি। আমি শুধু নিয়মের ব্যাপারটা বোঝালাম। ঠিকানা এবং সামান্য পরিচয় থাকলে আমাদের সুবিধে হয়।

এই সময় দ্বিতীয় লোকটা ফিরে এসে প্রথমজনের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিস ফিস করে কিছু বলতেই প্রথমজন মাথা নাড়ল। তারপর জিনিসদুটো আঙুলে নাড়তে নাড়তে বলল, শুনুন, এই দুটো মিলে বারো আনা সোনা আছে। কোন মিশেল নেই মনে হচ্ছে। তা এখন বলুন বন্ধক রাখবেন না বিক্রি করবেন?

মাধবীলতা বিস্মিত গলায় বলল, বারো আনা? ওজনটা কি ঠিক করা হয়েছে?

কেন বলুন তো?

কানপাশাটাই তো বারো আনার ছিল।

দেখুন, আপনাদের সামনেই আমি ওজন করছি। ঠিক সেইসময় দুটি ছেলে দোকানে ঢুকল। প্রথম লোকটা তখন ওজনের তোড়জোড় করছে। ছেলেদুটো সোজা খাঁচার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে বলল, চাঁদা দিন।

চাঁদা? কিসের চাঁদা? ভেতরে ঢুকতে কে বলল? খিঁচিয়ে উঠল লোকটা।

তোর বাপের বিয়ের। হাত তোল মাথার ওপরে।

কথাটা শোনা মাত্র লোকটার মুখ হাঁ এবং চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল।

ছেলেটার হাতে তখন রিভলভার। দ্বিতীয়জন বলল, কেউ চেঁচাবেন না, নড়বেন না। গোলমাল দেখলেই গুলি চালাবো। এইসময় আরো দুজন ছেলে গেটে এসে দাঁড়াল। এরা যে একদলের বুঝতে অসুবিধে হয় না।

সিল্কের পাঞ্জাবি ফ্যাসফেসে গলায় বলল, কি চাই?

দুজনই একসঙ্গে উঠে গেল ওপরে। রিভলভার নাচিয়ে বলল, আপনার পার্টনারকে নিয়ে ওই দেওয়ালের কাছে চলে যান।

লোকটা ককিয়ে উঠল, মরে যাব, মরে যাব।

সঙ্গে সঙ্গে রিভলভারটা লোকটার কপালে আঘাত করল। দুহাতে মুখ ঢেকে লোকটা যখন সঙ্গীর পাশে দেওয়ালের গায়ে দাঁড়াল তখন তার গাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে।

ওদের একজন এগিয়ে এসে কাউন্টার থেকে চাবিটা তুলে নিল।

প্রথমে অর্কর বুকের মধ্যে একটা হিমভাব ছড়িয়েছিল। এই দোকানে ডাকাতি হচ্ছে এটা স্পষ্ট। বাইরের রাস্তায় রিকশা এবং গাড়ির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে কিন্তু খদ্দের ঢুকছে না। যারা ডাকাতি করছে তাদের বয়স পঁচিশের মধ্যে। কেউ মুখোশ পরেনি। ওরা লোহার আলমারি খুলে কিছু টাকা পেল। একজন চামড়ার ব্যাগে সেগুলোকে যখন তুলে রাখছিল তখন অর্ক লক্ষ্য করল এদের হাতে গ্লাভস রয়েছে। আর আশ্চর্যের কথা ছেলেগুলো ওদের দিকে নজরই দিচ্ছে না।

বেশ ভাল সোনার গহনা যোগাড় করে নিল ওরা। তারপর আবার কাউন্টারে ফিরে এসে ওজন-দাঁড়ির দিকে তাকাতেই কানপাশা এবং আংটিটাকে দেখতে পেল। দ্বিতীয়জন সেদিকে হাত বাড়াতেই মাধবীলতা উঠে দাঁড়াল, দোহাই, ওদুটো নেবেন না। আমাদের খুব ক্ষতি হয়ে যাবে।

প্রথমজন জিজ্ঞাসা করল, এদুটো আপনাদের?

হা, বিক্রি করতে এসেছি। ওই টাকা না হলে শ্রাদ্ধ হবে না।

দ্বিতীয়জন নির্দ্বিধায় জিনিসদুটো ব্যাগে ফেলে দিতে মাধবীলতা চিৎকার করে উঠল। প্রথমজন বলল, গয়না বিক্রি করে শ্রাদ্ধ করছে যখন তখন অবস্থা বুঝতে পারছিস, ওদুটো আর নিস না।

এইসময় দরজায় দাঁড়ানো একজন বলে উঠল, কুইক। বেরিয়ে আয়।

দ্বিতীয়জন কাউন্টার থেকে নামতে নামতে বলল, শ্রাদ্ধ করার কোন প্রয়োজন নেই। ওটা বিলাসিতা।

ওরা যখন মাধবীলতাদের সামনে এসে পড়েছে তখন বাইরে হইচই উঠল। কে একজন বলল, এখন দোকান বন্ধ, ভেতরে যাবেন না।

আর একটা গলা ভেসে এল, আমার দোকান আর তুমি বলছ বন্ধ। কি ব্যাপার হে, সরে যাও, ও সুনীত, সুনীত!

দরজায় দাঁড়ানো দুজনের একজন বেরিয়ে গিয়েছিল আগেই, দ্বিতীয়জন চিৎকার করে সঙ্গীদের বলল, কুইক। আমি চার্জ করছি। তারপরেই ছুটে চলে গেল। আর তখনই মাধবীলতা ব্যাগ হাতে ছেলেটার পথ জুড়ে দাঁড়াল, আমার জিনিসদুটো নিয়ে যেতে পারবেন না।

তখনি দুমদাম করে বাইরে বোমাফাটার আওয়াজ হল। চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রথমজন, যার হাতে রিভলভার সে ততক্ষণে দরজার কাছে। দ্বিতীয়জন চিৎকার করল, আঃ, পথ ছাড়ুন। নইলে মারা পড়বেন।

না, আমি পথ ছাড়বো না। ওদুটো দিয়ে তবে যেতে পারবেন। প্রচণ্ড জেদে কথাগুলো বলল মাধবীলতা।

ছেলেটার মুখে প্রচণ্ড রাগ ফুটে উঠল। সে তার ব্যাগটা শূন্যে তুলল মাধবীলতাকে আঘাত করবে বলে। কিন্তু সেটা নেমে আসার আগেই অর্ক তার হাত ধরে ফেলল।এবং সেই ধাক্কায় ব্যাগটা ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে। পড়ে মাটিতে ছিটকে গেল কিছু গহনা এবং নোট। ছেলেটা চকিতে সেই ব্যাগ কুড়িয়ে নিয়ে ছুটে গেল দরজার দিকে। প্রথম ছেলেটি তখন ঘরের ছাদ লক্ষ্য করে ট্রিগার টিপেছে। অর্ক এগিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। বাইরে তখনও বোমার শব্দ হচ্ছে এবং ছেলেদুটো চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেছে।

কয়েক সেকেণ্ড বাদেই হুড়মুড় করে লোকজন ঢুকতে লাগল। একজন মোটাসোটা মানুষ খাঁচার মধ্যে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে চেঁচাতে লাগল, সুনীত, সুনীত। গেছে সব গেছে, ওহো, আমার সব ডাকাতে নিয়ে গেল রে।

খাঁচার মধ্যে দাঁড়িয়ে অর্ক আর মাধবীলতা দেখল লোকটা ছুটে গেল আহত সিল্কের পাঞ্জাবির দিকে, গিয়ে ঠাস করে চড় মারল যে গালটায় রক্ত ছিল না, কেন খুলে রেখেছিলে দরজা, আঁ? পই পই করে বলেছি দরজা বন্ধ রাখতে। চাবি নিয়েছিল? ওরা চাবি নিয়েছিল?

সিল্কের পাঞ্জাবি মাথা নাড়ল। সঙ্গে সঙ্গে লোকটা মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। খাঁচার বাইরে তখন মানুষেরা উদগ্রীব হয়ে এই দৃশ্য দেখছে। ডাকাতগুলো বোমা ছুঁড়তে ছুঁড়তে পালিয়ে গেছে। কেউ ধরা পড়েনি। এই শহরের নোক নয় ওরা। এরকম আলোচনা চলছিল। ৮ সিল্কের পাঞ্জাবির মাথার ক্ষত বোধহয় বেশী নয় কারণ তার রক্তপাত আর হচ্ছিল না। সে রুমাল সেখানে চেপে এগিয়ে এসে মাটিতে পড়ে থাকা গহনা আর টাকা দেখতে পেল। পেয়ে ফিসফিস করে মালিককে কিছু বলল। সঙ্গে সঙ্গে মালিক তড়াক করে উঠে বসল। তারপর ছুটে গেল ভেতরের ঘরে। সিল্কের পাঞ্জাবি গহনা আর টাকা মাটি থেকে তুলে মাধবীলতাকে বলল, আপনারা ভেতরের ঘরে আসুন।

ভেতরের ঘরে বোধহয় গহনার কাজকর্ম হয়। কিন্তু সেখানে লোকজন নেই। সিল্কের পাঞ্জাবি তার মালিককে বলল, এরা বারো আনা সোনা বন্ধক রাখতে এসেছিলেন। আমি যখন ওজন করছিলাম তখন ডাকাতরা এল।

আর তুমি দরজা খুলে দিলে? খিঁচিয়ে উঠল মালিক। তারপর অর্কর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি ওদের সঙ্গী নও তো?

অর্ক অবাক হল। মাধবীলতা বলল, ও আমার ছেলে। হত।

যে কোন ডাকাতই একজনের ছেলে। তাতে কিছু প্রমাণ হয় না।

সিল্কের পাঞ্জাবি মাথা নাড়ল, জামাইবাবু, এখন মাথা ঠাণ্ডা রাখুন। এরা ওই দলের হলে এদের গহনা ওরা নিয়ে যেত না। ওই ব্যাগ হাতে ছেলেটাকে এরাই বাধা দিয়েছিল, মনে রাখবেন। ওরা কানপাশা আর আংটি হারিয়েছে।

হুম। মালিক চোখ ছোট করলেন, তা এখন কি করতে হবে?

সিল্কের পাঞ্জাবি বলল, পুলিস আসার আগেই এগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে। আমাদের বলতে হবে সব গহনা আর টাকা ডাকাতরা নিয়ে গেছে। এগুলো যে পড়ে গিয়েছিল বলা চলবে না। বুঝতে পেরেছেন?

আচমকা মালিকের শরীরে চাঞ্চল্য দেখা দিল। সে ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলল, গুড। সরিয়ে ফেল, সরিয়ে ফেল এগুলোকে। মহাদেবকে দিয়ে আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দাও।

সিল্কের পাঞ্জাবি সেগুলোকে টেবিলের ওপর রেখেছিল। এবার সে মাধবীলতাকে জিজ্ঞাসা করল, এর মধ্যে আপনার জিনিস আছে?

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, না। কিন্তু তখনই সে আংটিটাকে দেখতে পেল, এইটে আমার। সে আংটিটাকে তুলে নিতেই সিল্কের পাঞ্জাবি বলল, পরে ফেলুন।

মাধবীলতার আঙ্গুলের সাদা দাগ আবার ঢেকে গেল। টাকার বাণ্ডিল থেকে দেড় হাজার টাকা তুলে মালিক বলল, এই নিন আপনার কানপাশার দাম। মনে করুন বিক্রি করে দিয়েছেন। আর তার বিনিময়ে একটি অনুরোধ, পুলিস এলে বলবেন না যে এগুলো ওরা ফেলে গেছে।

মাধবীলতার হাতে টাকা, কিন্তু সে বলল, মাপ করবেন, আমি মিথ্যে বলতে পারব না। এগুলো পেয়ে তো আপনার লাভ হল, লুকোচ্ছেন কেন?

মালিক বলল, সে আপনি বুঝবেন না। সত্যি কথা বললে ওই দেড় হাজার আর আংটিটা ফেরত পাবেন না। কি চান বলুন!

মাধবীলতা বলল, দেখুন, এই দেড় হাজার আমার ন্যায্য পাওনা।

কোন প্রমাণ আছে আপনি কানপাশা আর আংটি আমাকে দিয়েছিলেন? নেই। আমি তবু আপনাকে দিচ্ছি।

এইসময় সিল্কের পাঞ্জাবি গহনা আর টাকার পুঁটলি নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতেই সামনের দরজায় পুলিস এল। প্রথমেই তারা দর্শকদের হঠিয়ে দিল দোকান থেকে। দারোগার সামনে মালিক কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।

.

প্রায় এক ঘণ্টা বাদে মুক্তি পেল ওরা। মাধবীলতাকে নিজের মুখে মিথ্যে কথা বলতে হয়নি। সিল্কের পাঞ্জাবি যে বিবরণ দিয়েছিল সেটা সত্যি কিনা তাই যাচাই করতে দারোগা মাধবীলতাকে যেসব প্রশ্ন করেছিল তাতে ব্যাগটা পড়ে যাওয়ার কথা ছিল না। শুধু তিনি এর মধ্যে একজন পুলিসকে পাঠিয়ে মাধবীলতার ঠিকানা যাচাই করে নিয়েছিলেন। সে অনিমেষকে প্রশ্ন করে জেনেছে। যে মাধবীলতা অর্ককে নিয়ে গহনা বিক্রি করতে গিয়েছে। একটা বিবরণ তৈরি করার পর দারোগা তাতে সই নিয়ে ওদের ছেড়ে দিল। বলা হল, প্রয়োজনে তাদের আবার ডাকা হবে।

রাস্তায় তখনও প্রচুর লোক। সবাই মাধবীলতা আর অর্কর দিকে তাকিয়ে। ওদের দেখতে পেয়ে ভিড় জমে যাচ্ছিল। ডাকাতির বিবরণ জানবার জন্যে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছিল সবাই। নাস্তানাবুদ হয়ে কোনরকমে মুক্তি পেয়ে ওরা একটা রিকশায় উঠতেই মাধবীলতা নেতিয়ে পড়ল। অর্ক উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে তোমার? মাধবীলতা মাথা নাড়ল, কিছু না।

রিকশাটাকে বড়রাস্তা দিয়ে যেতে বলায় সেটা এফ ডি আই স্কুলের রাস্তায় চলছিল। মাধবীলতা বলল, কি করলাম কে জানে! হয়তো অন্যায় হল।

অর্ক বলল, মোটেই অন্যায় হয়নি। আমাদের জিনিসগুলো তো হারালাম।

মাধবীলতা বলল, কি জানি।

অর্ক বলল, তুমি বেশী বেশী ভাবো।

মাধবীলতা চোখ খুলল, তাই?

অর্ক হাসল, তবে তুমি সাহস দেখিয়েছ!

হঠাৎ মাধবীলতা সোজা হয়ে বসল, হারে, তিস্তা নদীটা কোথায় বল তো?

এখন যাবে? চল। অর্ক রিকশাওয়ালাকে নির্দেশ দিল।

পোস্ট অফিসের পাশ দিয়ে সোঁ সোঁ করে রিকশা খানিকটা পথ পেরিয়ে বাঁধের কাছে চলে এল। অর্ক বলল, নেমে এস। ওই বাঁধের ওপাশেই তিস্তা। জি মাধবীলতা রোমাঞ্চিত হল। এই রোমাঞ্চ কেন তা সে জানে না। ছেলের হাত ধরে সে দ্রুত পা ফেলে বাঁধের ওপরে উঠে এসেই অবাক হয়ে গেল। বালির ওপরে ছোট ছোট চালাঘর, দূরে একটা কাঠের দোতলা দেখা যাচ্ছে। কাশ বনে হাওয়া খেলছে। কিন্তু কোথাও জল নেই। বিরাট চরটা শুকনো এবং একটি নবীন বাসভূমির আকার নিচ্ছে। মাধবীলতার মুখ থেকে বেরিয়ে এল, এই তিস্তা!

৩৮. মহীতোষের কাজ শেষ

মহীতোষের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর মাধবীলতা কথাটা তুলল।

দুপুরবেলায় এখানে ঘুঘুরা বড্ড বেশী হল্লা করে। নারকেল গাছের পাতাগুলো নরম হাওয়ায় তিরতিরিয়ে কাঁপে। আর কোন শব্দ নেই, কাঁপন নেই এ বাড়িতে। মাধবীলতার দুপুর এখন বারোটাতেই শুরু হয়ে যায়। তার মধ্যে রান্নাবান্না শেষ, খাওয়া চুকে যায়। ছোটমা আর হেমলতা এখন একসঙ্গে খান। তাঁদের উনুনে কয়লা পড়ে রোদের রঙ খোলসা হলে। খেতে খেতে ছায়া ছড়িয়ে যায় বাগানে। অবেলায় ভাত তো রাত শুরু হলে মুড়ি। পেট ভরতি আছে এই বাহানায় দিব্যি উনুন না ধরালে চলে। বিধবা হবার পর ছোটমার খাওয়ার খরচ দুম করে কমে গেছে। মাধবীলতা ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে। কিন্তু এ নিয়ে সে কোন কথা বলেনি। শোক যখন দগদগে তখন মানুষ নিজেকে যে কোন উপায়েই লোক বেশী কষ্ট দিতে ভালবাসে। সে সময় আপত্তি জানালে হিতে বিপরীত হবার আশঙ্কা বেশী সারাদিনে ছোটমা আর হেমলতার কণ্ঠস্বর শোনা যায় কিনা বলা মুশকিল। অদ্ভুত গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেদের ওঁরা। মাধবীলতা যেচে কথা বললে উত্তর দেন। মাধবীলতাকে তাই খবর রাখতে হয় ওঁদের প্রয়োজনগুলো কি এবং কখন।

অতএব সারাটা দিন চুপচাপ শুয়ে বসে থাকা। শীতের টান এসে গেছে এর মধ্যে। বিকেল তিনটেই কেমন ছমছমে হয়ে যায় চারপাশ। অনিমেষ দুপুরে ঘুমোয় না, মুখ দেখলেই বোঝা যায় আকাশ পাতাল ভাবছে। খাওয়া দাওয়ার পর অর্কর পাত্তা পাওয়া যায় না। এতদিন ছেলেটা বেকার বসে আছে। দুপুরে ঘুমোবার কথাও বলা যায় না, পড়াশুনা করার কথা বলে কোন লাভ নেই। মাধবীলতা ওর দুটো বই সঙ্গে এনেছিল, সময় পেলেই সে-দুটো গুলে খেয়েছে অর্ক। অতএব ঘুরুক সে যেখানে ইচ্ছে। আজ দুপুরে বড় বাড়ির নির্জন ঘরে বসে মাধবীলতা কথাটা তুলল, আমার ছুটি ফুরিয়ে গেল।

অনিমেষ মুখ ফেরাল, কি বললে?

মাধবীলতা আবার শব্দগুলো উচ্চারণ করল। অনিমেষ এবার জবাব দিল না, নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। তারপর স্থির দৃষ্টিতে মাধবীলতার মুখের দিকে তাকাল।

মাধবীলতা খুব সহজ ভঙ্গীতে বলল, এখানে এসেই ছুটি বাড়িয়েছিলাম। ক’দিনের জন্য। এসেছিলাম আর কতদিন থেকে গেলাম। এরপর আর ছুটি দেবে না। এখন না গেলে চাকরিটাকে খোয়াতে হয়।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, হুঁ।

মাধবীলতা আবার বলল, তাছাড়া ছুটি নিয়ে নিয়ে তো অনন্তকাল চলতে পারে না। আমাকে তো এক সময় যেতে হবেই।

অনিমেষ এবারও মাথা নাড়ল, তারপর যেন নিজেকেই জিজ্ঞাসা করল, কি করা যায়!

মাধবীলতা এবার অন্যরকম গলায় জিজ্ঞাসা করল, তুমি আমাকে কি করতে বল?

অনিমেষ যেন আরও অপ্রতিভ হল, তারপর বলল, বাস্তবকে মানতেই হবে।

মাধবীলতা বলল, আমার খুব খারাপ লাগছে এঁদের এখানে এইভাবে ফেলে যেতে। আমি বুঝতে পারি এদের কেউ নেই, বেঁচে থাকতে গেলে এদের একটা অবলম্বন দরকার। তোমার বাবা অসুস্থ ছিলেন হয়তো কিন্তু তিনি আছেন এই বোধটুকুই এদের অবলম্বন ছিল। এখন আর কেউ রইল না এখানে।

অনিমেষ বলল, আর এখান থেকে তো ওদের সরানোও যাবে না।

মাথা খারাপ। এই বাড়ি ছেড়ে ওঁরা কোথাও থাকতে পারবেন? কলকাতায় কোথায় নিয়ে গিয়ে তুলবে তুমি? ঈশ্বরপুকুরের বস্তিতে?

একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলল অনিমেষ, শোভাবাজারের বাড়িটাও হাতছাড়া হয়ে গেল। কপালটা সত্যি খারাপ।

দিন তিনেক আগে পরমহংসের চিঠি এসেছে। সেই বাড়িঅলা নাকি বেশী টাকা পেয়ে অন্য জায়গায় ভাড়া দিয়ে দিয়েছে। পরমহংস জানিয়েছে তার অফিসে নাকি এখন খুব গোলমাল চলছে। এ সময় তার পক্ষে কলকাতা ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে সে অন্য বাড়ির সন্ধানে রয়েছে। খবরটা শোনার পর সবচেয়ে বেশী মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল অর্কর। চিঠিটা নিজে আর একবার পড়ে বলেছিল তাহলে আর আমাদের ঈশ্বরপুকুর ছাড়া হল না। মন খারাপ হয়েছিল মাধবীলতারও, কিন্তু এখন এ নিয়ে হা-হুঁতাশ করে লাভ নেই। জীবনে যা ঘটবে তার মুখোমুখি হওয়াই যখন নিয়ম তখন এ নিয়ে বেশী চিন্তা করার কোন মানে হয় না।

মাধবীলতা চুপচাপ বসেছিল। অনিমেষ খাট ছেড়ে নেমে ক্রাচ দুটো টেনে নিল, ঠিক আছে, যাওয়ার ব্যবস্থা করো। এভাবে তো অনন্তকাল থাকা যায় না। আমি ভাবছিলাম তোমার জন্যে যদি এখানকার স্কুলে একটা চাকরির ব্যবস্থা করা যেত!

এখানকার স্কুলে?

হুঁ। তাহলে কোন সমস্যাই থাকতো না। ছোটমা, পিসীমা আমাদের সঙ্গে নিশ্চিন্তে থাকতে পারতেন আর আমরাও ওই বস্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারতাম। তাছাড়া, তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছ খোকা এখানে আসার পর বেশ পাল্টে গিয়েছে। বেলগাছিয়ার ওই পরিবেশে থোকা খিস্তি আর মাস্তানি ছাড়া কিছু শিখতো না। এখানকার জীবন খুব শান্ত, ও যদি এখানে পড়াশুনা করে তাহলে অনেকটা নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। না, তোমার জন্যে একটা চাকরির ব্যবস্থা করতেই হবে।

মাধবীলতা হেসে ফেলল, তোমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে যে এখনই আমার জন্যে চাকরি খুঁজতে বের হচ্ছ! আজকাল স্কুলে চাকরি পাওয়া অত সোজা নয়। এই বয়সে আর নতুন স্কুলে চাকরি হবে না।

অনিমেষ বলল, চেষ্টা করলে সব হয়। কিন্তু আমার যে তেমন কারো কথা মনে পড়ছে না। দেখা যাক, দেখা যাক।

তাহলে অর্ককে টিকিট কাটতে দিই? তুমি ওদের বুঝিয়ে বলবে।

.

সেই বিকেলে অনিমেষ ভেতরের বারান্দায় এল। একগাদা ছাতার পাখি বুনো বাগানে হুটোপাটি করছে। কতখানি খালি জায়গা নষ্ট হচ্ছে এখানে। হঠাৎ অনিমেষের মনে হল এখানে একটা ব্যবসা করলে কেমন হয়! বিরাট খাঁচা করে যদি মুরগির চাষ করা যায়! দেড় দুই হাজার টাকা কোন রকমে ব্যবস্থা করে যদি শুরু করা যায় তাহলে লেগে যেতে পারে! জলপাইগুড়িতে তো জিনিসপত্রের চাহিদা আছে। একশটা মুরগি কিনে তিন মাস অপেক্ষা করলে রোজ যদি পঞ্চাশটা ডিম পাওয়া যায় তাহলে মাসে সাড়ে সাতশ টাকা রোজগার। খরচ বাদ দিয়ে চারশোর মত থাকবে। মন্দ কি? তাছাড়া শীতকালে লোক দিয়ে আলু কপির চাষ করে ভাল টাকা পাওয়া যেতে পারে। মাধবীলতা যদি এখানকার স্কুলে চাকরি পায় তাহলে সে স্বচ্ছন্দে এসব করতে পারে। নিজেকে আর বেকার অকর্মণ্য মনে হচ্ছিল না চিন্তাটা মাথায় আসা মাত্র। ওর মনে হল কলকাতায় গিয়ে একটা জড় পদার্থ হয়ে থাকার চেয়ে এ ঢের ভাল। অবশ্য জুলিয়েন তাকে বলছে সে ইচ্ছে করলেই সক্রিয় হতে পারে। কিন্তু জুলিয়েনের নামটা মনে পড়তেই অনিমেষ যেন ধাক্কা খেল। সে মুরগি আর সবজির চাষ করছে এটা শুনলে জুলিয়েন নিশ্চয়ই হতভম্ব হয়ে যাবে! সুবিধেবাদী বলে ভাবতে শুরু করবে তাকে? এককালে যারা বিপ্লবের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের অনেকেই এখন আখের গুছিয়ে নিয়েছে। এই কাজটাকেও কি আখের গোছানোর মধ্যে ফেলবে জুলিয়েন? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই অনিমেষের হাসি পেল। সে কি জুলিয়েনকে ভয় পেতে শুরু করেছে? নাকি ওর আদর্শবাদ এবং আত্মত্যাগের কাছে নিজেকে খুব ছোট মনে হওয়ায় এই রকম বোধ হচ্ছে!

এই সময় ছোটমা ঠাকুরঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। অনিমেষকে দেখে তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ল। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, পিসীমা কোথায়?

ওঁর শোওয়ার ঘরে।

তুমি একটু ওখানে চল, তোমাদের দুজনের সঙ্গে আমার কথা আছে। অনিমেষ সহজ গলায় বলার চেষ্টা করল।

ছোটমার কপালের ভাঁজ মিলিয়ে গেল না, প্রশ্ন করলেন, কি কথা?

এসোই না। অনিমেষ সাবধানে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নেমে এল।

পিসীমার ঘরের বারান্দায় আসতেই অনিমেষের কানে সুরেলা স্বর ভেসে এল, গুরুদেব দয়া কর দীন জনে। বাল্যকালে সে যখন এই বাড়িতে একা ছিল তখন লাইনটা প্রায় প্রতিদিন শুনতে হয়েছে। হায়, এতগুলো বছর পার হয়ে গেল তবু গুরুদেব পিসীমাকে দয়া করলেন না।

সে এক হাতে দেয়াল ধরে অন্যহাতে ক্রাচ সামলে ওপরে ওঠার চেষ্টা করতেই সিমেন্টে খটখট শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে সুর গেল থেমে। হেমলতার গলা ভেসে এল, হেই হেই, আ মলো যা, গরু ঢুকল নাকি এখানে!

অনিমেষ তখন বারান্দায় উঠে পড়েছে। কলকাতায় থাকতে এইটে তার পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার ছিল। অভ্যেসে কি না হয়। দরজার কাছে পৌঁছে সে হাসল, আমি অনি, গরু কিনা তা আপনি জানেন।

তক্তাপোশের ওপরে বাবু হয়ে বসেছিলেন হেমলতা। নাকের ডগায় চশমা, সামনে ছোট্ট জলচৌকির ওপর খাতা খোলা। অনিমেষকে দেখে খুব অবাক হয়ে বললেন, ওমা তুই। এখানে কেন এলি, খোঁড়া মানুষ, পড়ে গেলে।

অনিমেষ বলল, না, এখন আর পড়ব না। অভ্যেস হয়ে যাচ্ছে। তা এই বিকেল বেলায় কি করছিলেন?

ঠাকুর নাম করছিলাম। সন্ধ্যে হয়ে গেলে তো আর কিছু ভাল করে দেখতে পাই না। এই দ্যাখ না, এখনই সব ঝাঁপসা দেখছি, তোর মুখটা কেমন অচেনা অচেনা মনে হচ্ছে হেমলতা নমস্কার করে খাতা বন্ধ করলেন।

অনিমেষের মনে পড়ল, পিসীমার নিত্যকাজ ছিল রোজ রাত্রে শোওয়ার আগে এক পাতা ঠাকুরের নাম লিখে রাখা। সে জিজ্ঞাসা করল, তাহলে আজকাল আর রাত্রে লেখালেখির কাজ করেন না?

লেখালেখি? ও মা। কি হবে লিখে? এত বছর যা লিখেছি তাই এখন এক এক করে পড়ি। যা লিখেছি তা বোধহয় সব পড়ে যেতে পারব না।

হেমলতা হেসে ফেললেন, সেই বড় বন্যায় সব তো জলের তলায় গিয়েছিল। তবু যা রয়েছে তাতেই। ঘরের কোণটা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন তিনি।

অনিমেষ এতক্ষণ লক্ষ্য করেনি। এবার চোখে পড়ল স্তূপ হয়ে থাকা খাতা। প্রতিটি পাতায় প্রত্যেকদিনের আন্তরিক ঈশ্বর-নাম লেখা হয়েছিল। আজ আর নতুন পাতা নয়, লিখে যাওয়া নামই ফিরে ফিরে দেখা।

এই সময় ছোটমা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন, কি বলবে বলে ডেকে আনলে? অনিমেষের খেয়াল হল। তারপর ঘরের মধ্যে এক পা এগিয়ে জিজ্ঞাসা করল, পিসীমা, এখানে বসব?

তক্তাপোশের সেই ধারের জিনিসপত্র সরিয়ে হেমলতা জিজ্ঞাসা করলেন, হেগো কাপড় না তো? না? তাহলে বস। কি ব্যাপার ছোট?

সেটা আপনার ভাইপোকে জিজ্ঞাসা করুন। ছোটমা দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ালেন। হেমলতার নজরে পড়তে তিনি আপত্তি করলেন, মেয়েদের ওরকম ভাবে দাঁড়াতে নেই, অকল্যাণ হয়, ঠিক হয়ে দাঁড়াও।

ছোটমা চট করে সোজা হয়ে জবাব দিলেন, আর কি কল্যাণ হবে?

অনিমেষ এতক্ষণ নিজেকে তৈরি করছিল। এবার কোন রকমে বলে ফেলল, পিসীমা অনেকদিন তো হয়ে গেল, ওর ছুটি শেষ হয়ে গিয়েছিল তাও বাড়িয়েছে কিন্তু এবার না গেলে আর চাকরি থাকবে না যে!

হেমলতা অনিমেষের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন। ছোটমা কোন কথা বলছেন না। হঠাৎ যেন সব শব্দ আচমকা মরে গেল। অনিমেষের খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। সে যেন খানিকটা জবাব দেওয়ার ভঙ্গীতেই বলল, ওকে তো চাকরি করতেই হবে। তাছাড়া অর্কর পড়াশুনা রয়েছে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।

এবার হেমলতার ঠোঁট নড়ল, আমরা কার কাছে থাকব?

খুব ধীরে ধীরে শব্দ চারটে উচ্চারিত হল কিন্তু অনিমেষ বুঝল সে ঝাঁঝরা হয়ে গেল। এই প্রশ্নের জবাব সে কি দেবে! হেমলতা এখন এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে, সে মাথা নাড়ল, আমি বুঝতে পারছি না।

কিছুক্ষণ স্তব্ধতার পর হেমলতা ছোটমাকে বললেন, তুমি কি বল?

এবার ছোটমা কথা বললেন, যেতে হবে যখন তখন যাবে। ওরা যদি না আসতো, না ধরা দিত তাহলে আপনার ভাই চলে যাওয়ার পর কার কাছে আমরা থাকতাম? আপনি ভেবে নিন ওদের সঙ্গে আমাদের দেখাই হয়নি।

ভেবে নেব? হেমলতাকে খুব জবুথবু দেখাচ্ছিল।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, এভাবে বলবেন না। আমি চেষ্টা করছি যাতে এখানে মাধবীলতার একটা চাকরি হয়, তাহলে আর সমস্যা থাকবে না।

ছোটমা বললেন, তুমি কি শুধু ওর চাকরির জন্যেই ফিরে যাচ্ছ?

অনিমেষ কোন উত্তর দেবার আগেই হেমলতা চিৎকার করে উঠলেন, তুই চলে গেলেই পরি এসে আমাকে জ্বালাবে, এ বাড়ি লিখে দাও এ বাড়ি লিখে দাও। সব যাবে, উচ্ছন্নে যাবে। তুই কেন এলি, কি দরকার ছিল তোর আসার? বেশ তো মেরে ফেলেছিলি আমাদের, নতুন করে নুনের ছিটে কেন দিতে এলি?

ওই ছোট্ট শরীর থেকে যে এমন তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে আসতে পারে তা অনুমান করা অসম্ভব। অনিমেষ হতভম্বের মত তাকাল। হেমলতা চিৎকার শুরু করা মাত্রই ছোটমা দরজা থেকে দৌড়ে ভেতরে ঢুকে তাঁকে জড়িয়ে ধরেছিলেন, একি করছেন, চুপ করুন, চুপ করুন। এভাবে বলতে আছে?

কত চুপ করব? কতদিন চুপ করে থাকব? সেই শৈশবে বিধবা হয়ে অবধি চুপ করে আছি। সারা জীবন বাপের সেবা করেছি চুপ করে। আর এই ছেলে, একে আমি–উঃ ভগবান, আর কত চুপ করতে হবে আমাকে! হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন হেমলতা।

অনিমেষের সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। নিজেকে তার খুব ছিবড়ে, অসহায় মনে হচ্ছিল। পৃথিবীর অনেক কষ্ট পাওয়া মানুষের জন্যে সে কিছু করতে গিয়েছিল, পারেনি। নিজের খুব কাছাকাছি দু’তিনজন মানুষের জন্যেও সে কিছু করতে পারছে না। এবং হঠাৎই তার মুখ থেকে শব্দগুলো বেরিয়ে এল। সে একটুও এর জন্যে তৈরি ছিল না। কোনরকম ভাবনা চিন্তা ছাড়াই

অনিমেষ বলল, আমার কথাগুলো কিন্তু আপনারা শুনলেন না।

হেমলতা ফুঁপিয়ে যাচ্ছেন সমানে, ছোটমা বললেন, তুমি কিছু মনে করো না, আসলে খুব অসহায় হলে মানুষ– তোমাদের তো যেতেই হবে, যাও।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, ঠিক এই কথা আমি বলতে চাইনি। মাধবীলতার স্কুলে আর ছুটি নেই। বেঁচে থাকার জন্যে অর্থ দরকার। আমি কোন কাজ এতদিন করতে পারিনি বলে ওর ওপর চাপ পড়েছে। তাছাড়া অর্ককে মানুষ করতে হবে। এইজন্যেই ওরা যাবে।

ওরা যাবে মানে? ছোটমার ভুরু কোঁচকালো।

মাধবীলতা আর অর্ক যাবে। আমার এখানে থাকা যা ওখানে থাকাও তা। কারো কোন উপকারে লাগতে পারছি না যখন তখন এখানে থাকাই ভাল। বাবার অসাড় শরীরের চেয়ে আমি অনেক বেশী জীবন্ত। অনিমেষ উঠে দাঁড়াল, এই হল কথা। আপনারা চিন্তা করবেন না, আমি আপনাদের সঙ্গেই আছি। অনিমেষের খুব হালকা মনে হচ্ছিল নিজেকে।

ছোটমা উঠে এলেন হেমলতাকে ছেড়ে, কি পাগলের মত কথা বলছ? ওরা কলকাতায় কার। কাছে থাকবে? তুমি এখানে পড়ে রইলে আর মেয়েটা ওখানে রইল তা কি ভাল দেখাবে?

কি আশ্চর্য কথা। অনিমেষ হাসবার চেষ্টা করল, মাধবীলতা এত বছর ওখানে আছে, ওর অসুবিধে হবে না। তাছাড়া অর্ক বড় হয়ে গেছে এখন, এই নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।

হঠাৎ হেমলতা অনিমেষকে পিছু-ডাকলেন, অনি।

এ কণ্ঠস্বর একদম অন্যরকম। একটু আগে যে বৃদ্ধ উন্মাদিনীর মত চিৎকার করছিলেন তিনি এখন হেমলতার শরীরে নেই। অত্যন্ত শান্ত, পাথরের মূর্তির মত বসে আছেন হেমলতা। অনিমেষ ফিরে তাকাতে বললেন, তুই আর কবে বড় হবি!

মানে? অনিমেষ কথাটা বুঝতে পারল না।

মেয়েটা তোকে পাগলের মত ভালবাসে। আমি ওর সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি এই পৃথিবীতে তুই হলি ওর সব। সেই মেয়েটাকে আবার কষ্ট দিবি?,

কষ্ট দিচ্ছি?

দিচ্ছিস না? তোকে ছেড়ে থাকা মানে ওর কি কষ্ট।

অনিমেষ কথাটা শেষ করতে দিল না, পিসীমা, অনেক বছর তো একসঙ্গে থাকলাম, এখন একটু আধটু ছেড়ে থাকলে খারাপ লাগবে না। তাছাড়া গরমের ছুটি পুজোর ছুটি তো রয়েছেই। আর এখানে যদি একটা চাকরি হয়ে যায় তো কথাই নেই।

অনিমেষ বারান্দা থেকে নেমে ধীরে ধীরে বাগানের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল। পাখিরা এখন গাছের মাথায়, রোদের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে ছিল এতক্ষণ এখন টুক করে তাতে ছায়া মিশল। হেমলতা এই বাগানের যে যে অংশে ফুল তুলতে যান সেটুকই পা ফেলার অবস্থায় রয়েছে। অনিমেষের খেয়ালে ছিল না সে পেয়ারা গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। এই সময় তার নজর গেল সাপটার দিকে। সরু একটা হেলের বাচ্চা ভীরু ভঙ্গীতে এগোচ্ছে। প্রথমে একটু সচেতন হয়েছিল অনিমেষ, তারপর নির্লিপ্ত হয়ে সাপটাকে দেখতে লাগল। ঘাসের ফাঁক দিয়ে একটু এগোয় আর মুখ তুলে দ্যাখে। একসময় অনিমেষের কাছাকাছি চলে এল সাপটা। তারপর সন্দেহের চোখে অনিমেষকে দেখে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিল। অনিমেষ একটুও নড়ছিল না। এই সাপ কামড়ালে মানুষ মরে না, বড় জোর সামান্য ঘা হতে পারে। সাপটা যেন নিশ্চিন্ত হল। তারপর খানিকটা এগিয়ে ক্রাচের কাছে চলে এসে ওটাকে জড়িয়ে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষের শরীরে একটা ঘিনঘিনে ঘেন্না পাক দিয়ে উঠতেই সে ক্রাচটাকে ওপরে তুলে ঝাঁকুনি দিতেই সাপটা ছিটকে শূন্যে উঠে গেল। আর তখনি অনিমেষ চমকে উঠল। নারকোল গাছের মাথায় ওপর থেকে সাঁ করে একটা কালো বড় ছায়া নেমে এল নিচে, সাপটা মাটিতে পড়ার আগেই সেটাকে ধরে ফেলে ছায়াটা উঠে গেল কাঁঠাল গাছের মাথায়। ওটা বাজ না ঈগল? কিন্তু সাপটাকে ঠোঁটে ধরে সে অনিমেষের দিকে একবার কৃতজ্ঞ চোখে তাকাল।

এই সময় অর্কর গলা শুনতে পেল অনিমেষ। তাকে ডাকছে। ভেতরের বারান্দায় এসে অর্ক তাকে দেখতে পেল, বাবা, জুলিয়েনবাবু এসেছেন।

অনিমেষ মাথা নাড়তেই অর্ক ফিরে গেল। আজ সারাদিন তিস্তার চরে ঘুরেছে অর্ক। অদ্ভুত জায়গা। জল সেই ওপার ঘেঁষে। এদিকটা পুরো চর বটে কিন্তু সবটাই খটখটে নয়। মাঝখানে ভেজা ভেজা বালি আছে। তার একটায় পা দিতে দোলনার মত দুলে উঠেছিল। অনেকটা ভেজা কাদা কাদা বালি একসঙ্গে গোল হয়ে দুলছে পা ফেললেই। বেশ মজা লাগছিল। একটু একটু করে জল উঠছিল বালি চুঁইয়ে। অথচ চারধার শুকনো খটখটে। কিন্তু একবার পা ফেলতেই ওপরের বালির আস্তরণ কেটে গিয়ে পা বসে গেল ভেতরে। অর্কর আর একটা পা তখনও ভেজা বালির বাইরে কিন্তু ডুবে যাওয়া পা থেকে মুহূর্তেই যেন সব শক্তি উধাও হয়ে গেল। কিছুতেই সেটাকে টেনে তুলতে পারছে না। তার গোটানো প্যান্টের কাপড় ভিজে গেল শেষ পর্যন্ত। অর্কর মনে। হচ্ছিল কেউ তাকে নিচ থেকে টানছে। আর সেটা মনে হতেই সে চিৎকার করে উঠেছিল।

ওই নির্জন বালির চরে কাশবন আর শুকনো বালি ছাড়া সেই চিৎকার শোনার জন্যে কারো থাকার কথা নয়। কিন্তু কাঠকুড়ানি এক মেয়ের দল সেটা আচমকাই শুনতে পেয়েছিল। আজকাল তিস্তার বুকে খুব অল্প স্বল্প কাঠ ভেসে আসে পাহাড় থেকে। তবু যদি আসে সেই আশায় এই মেয়ের। দলগুলো ওত পেতে বসে থাকে। তাদের একদল ছুটে এল অর্কর কাছে। অর্ক তখনও চিৎকার করছে আর প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছে ডুবে থাকা পা-কে টেনে তুলতে। মেয়েগুলো সেখানে পৌঁছেই হাসিতে ফেটে পড়ল। কিন্তু কেউ এগিয়ে এল না অর্ককে সাহায্য করতে। একজন তো মুখ ভেংচে বলে বসল, ঠিক আছে, মরু, মরু। তারপর দলটা চলে গেল। অর্ক হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তাকে সাহায্য করার বদলে ওরা মরতে বলে গেল কেন? কিন্তু এ ব্যাপারে বেশীক্ষণ চিন্তা করার সময় তার ছিল না। এর মধ্যে হাঁটুর অনেকখানি ওপরে বালিজল চলে এসেছে। বেশী টানাটানি করলে পা আরো নিচে চলে যাচ্ছে বুঝতে পেরে সে শরীরটাকে কোনরকমে শুকনো বালির ওপর ছড়িয়ে দিয়ে চিৎকার করতে লাগল সাহায্যের আশায়।

মিনিট কয়েক বাদে দুজন লোক কাশবন সরিয়ে চলে এল কাছে। বোঝা যায় বেশ হাঁপাচ্ছে দুজনেই। এসেই একজন বলল, ওঃ, ভেতরে ডোবেনি, আমি তো ভেবেছিলাম, ধরো হাত দুটো।

সঙ্গীটি বলল, দাঁড়ান, আগে জিজ্ঞাসা করে দেখি। তারপর অর্করকাছে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল, কোথায় বাড়ি?

অর্ক দেখল লোকটা মাঝবয়সী বাঙালি, কিন্তু ওর সঙ্গী যে তাকে তুলতে চেয়েছিল সে প্রৌঢ় এবং চেহারা দেখে মনে হয় অবাঙালি। অর্ক বাধ্য ছেলের মত জবাব দিল, হাকিমপাড়ায়।

এখানে রোজ আসো?

না, আজ প্রথম এসেছিলাম।

কেন এসেছিলে? মেয়েছেলে দেখতে?

কি যা তা বলছেন? অর্ক রেগে গেল।

লোকটা বলল, আবার মেজাজ দেখাচ্ছে দেখুন। তোমার মত ছেলেরা এখানে এসে ওই মেয়েদের বিরক্ত করে। বাবার নাম কি?

অর্ক একবার ভাবলে জবাব দেবে কি না। কিন্তু সে এখন অসহায়। এরা যদি তাকে না তোলে তাহলে। সে শান্ত গলায় বলল, অনিমেষ মিত্র। সঙ্গে সঙ্গে প্রৌঢ় লোকটি দ্রুত তার দিকে এগিয়ে এল, কি বললে? তুমি অনিমেষের ছেলে?

হ্যাঁ। আপনারা আমার সম্পর্কে মিছিমিছি বাজে কথা বলেছেন।

অর্কর গলা এবার আর শান্ত ছিল না।

প্রৌঢ় লোকটি এবার নিজেই অর্কর দুই বগলের নিচে হাত দিয়ে টানতে শুরু করতে তার সঙ্গীও যোগ দিল। অর্ককে বালির ভেতর থেকে টেনে তুলতে ওদের বেশী কসরৎ করতে হল না। নিজের পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে প্রথমে মনে হয়েছিল পায়ে কোন সাড়া নেই। প্রৌঢ় মানুষটি তার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করল, এখন কেমন লাগছে?

ঠিক আছে। অর্ক পা থেকে ভিজে বালি সরাচ্ছিল।

ওভাবে ওগুলো যাবে না, ধুয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু তুমি এখানে কি করতে এসেছিলে? এসব জায়গায় বেড়াতে আসে না কেউ। মাঝে মাঝেই এ ধরনের চোরাবালি ছড়িয়ে আছে। তাছাড়া কিছু বাজে ছেলে এখানে ঘোরা ফেরা করে। ওই মেয়েগুলো যদি যাওয়ার পথে আমাদের না বলতে তাহলে সত্যি বিপদে পড়তে। রাত্রে এখানে নেকড়ে শেয়াল এখনও বের হয়। চল, পা ধুয়ে নেবে।

সঙ্গীটি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, একে আপনি চেনেন?

এখন চিনছি। এর বাবাকে আমি, হ্যাঁ, ঠিক এই বয়সেই প্রথম দেখেছিলাম। সেই চেহারার সঙ্গে খুব মিল আছে। তুমি অনিমেষের নাম অনেকবার শুনেছ।

অর্ককে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রৌঢ় বলল।

অনিমেষ, মানে কলকাতা থেকে। সঙ্গীটি খোলসা করে বলতে চাইল না।

হ্যাঁ, ঠিকই। প্রৌঢ় লোকটি এবার অর্ককে জিজ্ঞাসা করল, তোমার নাম কি ভাই? তোমার বাবা আর আমি খুব ঘনিষ্ঠ।

অর্ক।

অর্ক। শব্দটার মানে কি?

সূর্য।

বাঃ, চমৎকার। খুব সুন্দর নাম। আমার নাম জুলিয়েন। আমি এখন কদিন ওই কাঠের বাড়িটায় আছি। ওখানে চল পা ধুয়ে নেবে। আমি এর মধ্যে একদিন তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তখন কি তোমাকে দেখেছিলাম? মনে করতে পারছি না। আজকাল সব যেন ভুল হয়ে যায়।

আমি আপনার নাম শুনেছি বাবার কাছে।

শুনেছ? জুলিয়েন হেসে ফেলল, চল, আজ তোমাদের বাড়িতে যাব। ভয় নেই, তোমার এই ডুবে যাওয়ার কথা অনিমেষকে বলব না। তবে তুমি এই চরে কখনও একা ঘুরবে না।

হঠাৎ অর্ক প্রশ্ন করল, আপনি এখন কি করেন?

আমি? কিছু না, কিছুই না। তারপর কি ভেবে বলল, একটা দেশ ওইরকম চোরাবালিতে আটকে পড়েছে, ডুবে যাচ্ছে একটু একটু করে। তুমি চেঁচাচ্ছিলে সাহায্যের আশায় কিন্তু এই দেশের মানুষগুলোর সেই শক্তিও নেই। যদি এই দেশটাকে টেনে তোলা যায় সেই পথটাই খুঁজছি ভাই।

অর্ক বেশ অবাক হয়ে জুলিয়েনের দিকে তাকাল। এই মানুষটিকে তার হঠাৎ খুব ভাল লেগে গেল।

পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে জুলিয়েনের সঙ্গে আসতে আসতে অর্কর অনেক গল্প হল। জুলিয়েন কলকাতার খবর নিচ্ছিলেন। অর্ক তার পাড়ার বাইরে কোন খবর দিতে পারছিল না। কিন্তু জুলিয়েনের কথা শুনতে শুনতে সে উত্তেজিত হয়ে পড়ছিল। বাড়িতে ঢুকে জুলিয়েনকে চেয়ার এগিয়ে দিয়ে সে ভেতরের বারান্দায় এসে অনিমেষকে ডাকল।

জুলিয়েনকে দেখে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কি খবর? হঠাৎ ডুব দিয়েছেন, ভেবেছিলাম এর মধ্যে আসবেন।

জুলিয়েন বলল, আপনার অনেক ঝামেলা গেল তাই বিরক্ত করতে চাইনি। আপনার ছেলের সঙ্গে হঠাৎ আলাপ হয়ে গেল আজ। তা এবার তো ফিরে যাওয়ার সময় হল। একদিন একটু বসা। যাক

অনিমেষ হাসল, ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? ওরা যাচ্ছে, আমি এখানেই থেকে যাচ্ছি।

জুলিয়েন বিস্মিত গলায় জিজ্ঞাসা করল, তাই?

৩৯. সন্ধ্যের পরেই টিপিস টিপিস বৃষ্টি

সন্ধ্যের পরেই টিপিস টিপিস বৃষ্টি শুরু হল। জলপাইগুড়িতে বর্ষাকাল অনেকটা সময় জুড়ে থাকলেও অন্য ঋতুতে যে বৃষ্টি হবে না একথা কেউ জোর করে বলতে পারে না। যেমন আজ হচ্ছে। জুলিয়েন চলে যাওয়ার পরেই মেঘেদের দেখতে পেয়েছিল অনিমেষ। হু হু করে ছুটে আসছে কালো দৈত্যগুলো। তারপর হাওয়া থমকে গেল, অদ্ভুত সব গন্ধ বের হতে লাগল গাছেদের শরীর থেকে আর তারপরেই টিপটিপিয়ে বৃষ্টি নামল।

আজ আবার বিজলী আলো জ্বলছে না। চারপাশে ঘুটঘুটি অন্ধকার। অনিমেষ বারান্দায় চুপচাপ বসেছিল। ওর খেয়াল নেই তিনহাত দূরে অর্ক রয়েছে। আজ জুলিয়েনের সঙ্গে যেসব আলোচনা হয়েছে তার সবই ছেলে শুনেছে। একবার ভেবেছিল ওকে চলে যেতে বলবে কিন্তু তারপরই উদাসীন হয়েছিল। এবং যখন দেখল জুলিয়েনও আপত্তি করছে না তখন আর ওকে নিয়ে মাথা ঘামায়নি। মাঝখানে একবার উঠে চায়ের কাপ বয়ে এনেছিল। অনিমেষের এতক্ষণে খেয়াল হল। মাধবীলতা একবারও বাইরে আসেনি।

এইসময় বিদ্যুৎ চমকালো। এক মুহূর্তের জন্যে সামনের বাগান, বড় আমগাছগুলো সাদা নেগেটিভ হয়ে আবার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। তারপরেই বৃষ্টির শব্দ হল। এবার ফোঁটাগুলো বড় হয়েছে।

অর্ক কথা বলল প্রথম, এইসময় এখানে বৃষ্টি হয়?!

সাধারণত হয় না কিন্তু হতে পারে, যেমন এখন হচ্ছে।

কিন্তু বিকেলে আকাশে একটুও মেঘ ছিল না।

এখানকার বৃষ্টির চরিত্র এইরকম। হঠাৎ ঝাঁপিয়ে আসে। তোর মা কোথায়?

রান্নার ঘরে। অর্ক উত্তর দিয়ে একটু ইতস্তত করল, বাবা, তুমি তাহলে এখানে থেকে যাবে?

অনিমেষ মুখ তুলে ছেলের দিকে তাকাল। অন্ধকারে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না অর্ককে। তারপর কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গী যেন আচমকা এসে গেল গলায়, থাকি, কিছুদিন থেকে দেখি এখানে! তুই বড় হয়েছিস, তোর মা তুই কলকাতায় একসঙ্গে থাকলে কোন অসুবিধে হবে না। কিন্তু এদের দেখবে কে? বল?

অর্ক এবার উঠে এল, এসে অনিমেষের চেয়ারের পাশে দাঁড়াল, আমি একটা কথা বলব বাবা?

তুমি যাও মায়ের সঙ্গে, আমি এখানেই থাকি।

তুই একা এখানে থাকবি? অনিমেষ চমকে উঠল।

আমার এখানে থাকতে ভাল লাগবে। জায়গাটা খুব সুন্দর। আমি থাকলে এদের খুব সুবিধে হবে, তাছাড়া আমার মনে হচ্ছে আমি এখানে ভালভাবে পড়াশুনা করতে পারব। তুমি রাজি হয়ে যাও। আবদারের ভঙ্গী অর্কর গলায়।

অনিমেষ মাথা নাড়ল। তারপর খোলাখুলি বলল, তুই তো এতক্ষণ বসে বসে সব শুনলি। আমার এখানে থাকার অন্য কারণও আছে।

কিন্তু তোমার চেয়ে আমি সেটা ভালভাবে করতে পারব।

মানে? অনিমেষ হতভম্ব হয়ে পড়ল।

জুলিয়েনবাবুকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তুমি তো একসময়, সেই ছেলেবেলায় বলতে, আমরা যা পারিনি তোরা সেটা করবি, আর ভুল করবি না। আমি তো এখানে থেকে জুলিয়েনবাবুর কাছে সেসব শিখতে পারি। পারি না? অর্ককে খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছিল। ওর গলায় আবেগ স্পষ্ট।

জুলিয়েনের সঙ্গে তোর কি কোন কথা হয়েছে?

হ্যাঁ। আজ বিকেলে তিস্তার চরে গিয়ে ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছে।

সে তো বুঝলাম, কিন্তু কি কথা হয়েছে?

উনি বলছিলেন, কিছু মানুষ পড়াশুনা করে বড় চাকরি করে, যাদের টাকা আছে তারা আরও টাকা বাড়িয়ে সেই লোকগুলোকে চাকর করে রাখে। দেশের নব্বইভাগ মানুষকে নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় কারো নেই। নিজের জন্যে যাঁরা পড়াশুনা করেন তাঁরা শ্রদ্ধেয় মানুষ কিন্তু চাকরির জন্যে যারা পড়তে চায় তারা দেশের মেরুদণ্ডটাকেই নড়বড়ে করে দিচ্ছে। এইসব কথা। অর্ক তৃপ্তির হাসি হাসল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, বাবা আমি থেকে যাই?

অনিমেষ বলল, তুই রাজনীতির কিছুই বুঝিস না। এসব এখন মাথায় ঢোকাস না।

অর্ক বলল, আমি রাজনীতির কিছু বুঝতে চাই না। আর আমি এখানে থাকবো মানেই পড়াশুনা ছেড়ে দিনরাত এসব করব তাই বা ভাবছ কেন? 1 অনিমেষ এবার শক্ত হল। তারপর বলল, প্রত্যেকটা জিনিসের একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। একটা গাছ মাটিতে পুঁতলেই তাতে ফুল ফোটে না। আর কুঁড়ি ধরা মানেই সেটাকে টেনে ফুল করা যায় না। তুই আগে পাশ কর। জীবনটাকে নিজের চোখে দ্যাখ। তারপর এসব বিবেচনা করবি।

হঠাৎ অর্ক জেদের গলায় কথা বলল, আমি জীবনটাকে কম দেখিনি।

মানে? তুই কি দেখেছিস? এইটুকুনি বয়সে কি দেখা যায়?

আমি তোমাকে সব কথা খুলে বলতে পারব না। তবে মানুষকে দেখলে বোঝা যায় না তার সত্যিকারের অবস্থা কি! যেসব নোংরা কাজ হয় তার অনেকটাই হয় পেটের জন্যে। আমি আমেরিকা রাশিয়ার কথা জানি না কিন্তু কলকাতায় তাই হয়। আমি ঠিক বললাম না বোধহয়। যত নোংরা কাজ হয় তা করে টাকা নেই বলে আর কেউ করে প্রচুর টাকা আছে বলে। এসব আমি নিজের চোখে দেখেছি।

তুই দেখেছিস! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না অর্ক।

কি ভাবো তোমরা আমাকে? ছেলেমানুষ, বাচ্চা ছেলে, অন্ধ? অর্কর গলায় ঝাঁঝ।

অনিমেষ তরল গলায় বলল, তুই তো সত্যি সত্যি বাচ্চা।

বাজে কথা বলো না! অর্ক কটকটে স্বরে বলে উঠতেই অনিমেষ মুখ তুলল।

অর্ক, এদিকে আয়। কনকনে ঠাণ্ডা গলায় নিজের নামটা শুনে অর্ক দরজার দিকে তাকাল। মাধবীলতা যে কখন ওখানে এসে দাঁড়িয়েছে সে টের পায়নি। গলা শুনে অনিমেষও অবাক হয়েছিল। ওদের কথাবার্তা কি নিঃশব্দে মাধবীলতা দরজায় দাঁড়িয়ে শুনেছিল! অর্ক বলল, কেন?

এদিকে আসতে বলছি।

মায়ের গলার স্বর এবার অর্কর কানে অস্বাভাবিক ঠেকল। সে কিছুটা গোঁয়ার ভঙ্গীতে অন্ধকার দরজায় দাঁড়ানো মাত্র ঠাস করে শব্দ হল। অর্ক কিছু বুঝবার আগেই তার ডান গালে আঘাত এল এবং বেশ জ্বলছিল। সেই সঙ্গে মাধবীলতার চাপা নিঃশ্বাস জড়ানো কণ্ঠস্বর, ছি ছি ছি। তোর লজ্জা ঘেন্না সব চলে গেল? তোকে আমি এইজন্যে পেটে ধরেছিলাম? মুখে মুখে তর্ক করছিস, কাকে ধমকাচ্ছিস তুই? কত বড় হয়েছিস যে ওইভাবে কথা বলতে পারিস? এখানে থাকতে চাও তুমি? সাপের পাঁচ পা দেখেছ? আরও বখাটে হয়ে যাওয়ার ইচ্ছে? গুণ্ডা, বদমাস, লোচ্চার! যা, ভেতরে যা!

অর্ক কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে বলল, তুমি আমায় মিছিমিছি মারলে। এসব গালাগাল না বুঝে দিয়েছ।

মাধবীলতার গলার স্বর ভাঙ্গতে ভাঙ্গতেও ভাঙ্গল না, ঠিক করেছি, আমি ঠিক করেছি। আর এইসময় আলো জ্বলে উঠল। ম্যাড়মেড়ে আলো যদিও তবু পরস্পরকে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। অর্ক দেখল মায়ের চোখ অন্যরকম দেখাচ্ছে। একটু বিস্ফারিত এবং জ্বলজ্বলে। এরকম অস্বাভাবিক চেহারা দেখে অর্ক বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেল। তারপর একবার অনিমেষের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ভেতরে চলে গেল।

পুরো ব্যাপারটাই অনিমেষের কাছে বোধগম্য হচ্ছিল না। হঠাৎ মাধবীলতা এত উত্তেজিত হয়ে অত বড় ছেলেকে চড় মারতে গেল কেন? বাজে কথা না বলতে বলা সত্যি অন্যায় কিন্তু ঠাট্টা করতে করতে অনেকসময় তো সে অর্ককে এরকম প্রশ্রয় দেয়। আর সেটা মাধবীলতার অজানা নয়। সে একটু রেগে উঠল মাধবীলতার ওপর। কয়েক পা এগিয়ে সে দরজার কাছে আসতেই দেখল ঘরটা ফাঁকা, মাধবীলতা নেই।

মন খুব তেতো হয়ে গেল অনিমেষের। বাইরে বেশ বৃষ্টি পড়ছে। আবার সে ফিরে গেল বারান্দার চেয়ারে। তারপর চুপচাপ বৃষ্টি দেখতে লাগল। এখন এই বাড়িটা একদম নিঝুম, বৃষ্টির শব্দ ছাড়া কোন আওয়াজ নেই। মাধবীলতার গলার স্বরটা সে কিছুতেই ভুলতে পারছিল না। একদম অচেনা।

.

নিঃশব্দে খাওয়াদাওয়া হয়ে গেল। অর্ক এবং অনিমেষ পাশাপাশি। মাধবীলতা যখন খাবার দিচ্ছিল তখন ছোটমা দাঁড়িয়ে। এই ব্যাপারটা আজ নতুন। অর্ক মাথা গুঁজে খেয়ে উঠে গেল। মাধবীলতা খাবার দিয়ে আর দাঁড়ায়নি। শেষ দিকে ছোটমা আর অনিমেষ ছাড়া সেখানে আর কেউ ছিল না। খাওয়া শেষ হলে ছোটমা চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে?

মানে? অনিমেষের কপালে ভাঁজ পড়ল।

কিছু হয়নি তো? ছোটমার গলায় সন্দেহ।

কি হবে, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কি ব্যাপারে জানতে চাইছ।

সন্ধ্যেবেলায় বউমা রান্নাঘরে একা বসে কাঁদছিল।

তাই নাকি! জিজ্ঞাসা করলে না কেন?

করেছিলাম। এড়িয়ে গেল। তোমাকে আমরা জোর করে আটকে রাখছি না তো?

অনিমেষ হাসল, আমি কি বাচ্চা ছেলে। না, এজন্যে কোন গোলমাল হয়নি।

কিন্তু খাওয়া দাওয়ার পর অনিমেষের স্পষ্ট বোধ হল গোলমালটা এই জন্যেই হয়েছে। অর্কর ওপর মাধবীলতার আক্রমণ সেই রাগেরই বহিঃপ্রকাশ। অর্ক ছোট ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ার আধঘন্টা বাদে মাধবীলতার দেখা পাওয়া গেল। অনিমেষ আলো নিবিয়ে দিয়ে খাটে হেলান দিয়ে খোলা জানলায় চোখ রেখেছিল। বাইরে বৃষ্টি এখন ঝমঝমিয়ে পড়ছে। জানলার ওপরে শেড থাকায় ঘরে ছাঁট আসছে না।

মাধবীলতা আলো জ্বাললো না। এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত ঘরের কোণে দাঁড় করানো পাটিটাকে মেঝেয় বিছিয়ে দিল। অনিমেষ এবার সজাগ হল, কি করছ?

দেখতে পাচ্ছ। না পেলে বল আলো জ্বেলে দিই। একদম নিস্পৃহ স্বর।

তুমি এই বৃষ্টিতে নিচে শোবে নাকি?

মাধবীলতা জবাব দিল না। খাট থেকে একটা বালিশ টেনে নিয়ে পাটির ওপর রাখল। অনিমেষ খাটের ধারে একটু এগিয়ে এল, তোমার কি হয়েছে? এরকম ব্যবহার করছ কেন? তখন খামোকা ছেলেটাকে মারলে। খাওয়ার সময় একটাও কথা বললে না। আবার এখন মাটিতে শুচ্ছ!

এসবের জন্যে তোমার কাছে জবাবদিহি করতে হবে নাকি!

অনিমেষের চোয়াল শক্ত হল। হঠাৎ মাথাটা গরম হয়ে গেল তার, নিশ্চয়ই।

কেন? হাসল মাধবীলতা। অন্ধকারে ছোট্ট শব্দ হল।

আমি তোমার স্বামী। সে অধিকার আমার আছে।

অধিকার! স্বামী! চমৎকার। মাধবীলতা এবার পাটির ওপর শুয়ে পড়ল আঁচলে শরীর মুড়ে। অন্ধকার সয়ে যাওয়ায় তার শরীরটাকে খুব ছোট দেখাচ্ছিল। মুহূর্তেই অনিমেষের পৃথিবী যেন টলে উঠল। এ কোন সুরে কথা বলছে মাধবীলতা। সে আবার বিহ্বল গলায় বলল, লতা, তুমি কি বলছ?

মাধবীলতা কোন উত্তর দিল না। অনিমেষের বুকের ভেতর তখন হাজার থাবার আঁচড় পড়ছে। সে সুস্থির হয়ে থাকতে পারল না। ক্রাচ ছাড়াই দুই হাতে খাটে ভর দিয়ে মেঝেয় নেমে পড়ল। তারপর শরীরটাকে প্রায় হামাগুড়ি দেবার মত করে মাধবীলতার কাছে নিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসল মাধবীলতা, কি আশ্চর্য! তুমি আমাকে একটু ঘুমুতেও দেবে না?

অনিমেষের গলা রুদ্ধ হয়ে এল, লতা, তুমি এরকম করছ কেন?

আমি কিছুই করছি না, দয়া করে আমাকে ঘুমুতে দাও।

তুমি এখানে শুয়েছ কেন?

ওপরে শুলে তোমার কি সুবিধে হবে?

লতা!

চিৎকার করো না। নাটক করার ইচ্ছে হলে পাশের ঘর থেকে ছেলেকে ডেকে দিচ্ছি তার সামনে করো। কি চাও তুমি?

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। হঠাৎ তুমি এরকম হয়ে গেলে কি করে?

হঠাৎ? চমৎকার।

আজ বিকেলেও তুমি আমার সঙ্গে স্বাভাবিক গলায় কথা বলেছ। তোমার সঙ্গে আমার কোন ঝগড়াঝাঁটি হয়নি। এমনকি এত বছর একসঙ্গে আছি কিন্তু কোনদিন তুমি আমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করোনি।

আঃ, অনিমেষ, প্লিজ! আর আমাকে কথা বলিও না। একটু চুপচাপ থাকতে দাও। আমি আর পারছি না, পারছি না। তারপর যেন ওর ঠোঁট অসাড় হয়ে গেল, এক সঙ্গে আছি! তিনটে শব্দে যেন রাজ্যের তিক্ততা মাখামাখি।

অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকাল। অন্ধকারে ওর মুখ ভাল করে বোঝা যাচ্ছে না। নাক এবং চিবুকের রেখাগুলো ছাড়া কোন অভিব্যক্তি চোখে পড়ছে না। কতবছর পর মাধবীলতা তাকে অনিমেষ বলে ডাকল? এবং এই প্রথম নিজের নামটাকে অত্যন্ত মন্দ শোনাল কানে। শেষ পর্যন্ত সরাসরি প্রশ্ন করল অনিমেষ, তুমি চাও না আমি এখানে থাকি?

আমি চাওয়ার কে?

তুমি আমার স্ত্রী।

না কি আমরা একসঙ্গে আছি, শুধু এইটুকু?

লতা! অনিমেষের গলা থেকে শব্দটা ছিটকে এল।

সত্যি কথা অনিমেষ, এটাই সত্যি কথা। আমি তোমার কে? যদি তুমি রোজগার করতে আর আমরা এইভাবে থাকতাম তাহলে লোকে আমায় তোমার রক্ষিতা বলত। আর তুমি যদি সুস্থ হতে, তোমাকে যদি ওই লাঠি দুটোয় ভর দিয়ে না চলতে হতো তাহলে বলত আমি ঠোঁট কামড়ালো মাধবীলতা। তারপর প্রাণপণে কান্না গেলার চেষ্টা করে বলল, আমি তোমার কেউ না, আমি তোমার কেউ না। আঃ ভগবান।

তুমি আমার কেউ না?

না। হঠাৎ মাধবীলতা সোজা হয়ে বসল। অন্ধকারেও ওর চোখ জ্বলছিল, কেউ হলে এক কথায় এখানে থাকতে চাইতে না।

এখানে আমার থাকার প্রয়োজন লতা।

এতদিন এই প্রয়োজনবোধটা কোথায় ছিল? কেন জেল থেকে বেরিয়ে প্রায় অপরিচিত এক বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলে? তখনই তো চলে আসতে পারতে এখানে? কেন বিকলাঙ্গদের হোমে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলে? কেন আমার সঙ্গে বস্তিতে এতবছর থেকেও এ বাড়িতে একটা চিঠি লিখতে পারোনি? আর এবার যখন আমি তোমাকে নিয়ে এলাম তখন কেন তুমি আসতে চাইছিলে না? তখন তো প্রয়োজন মনে হয়নি। কেন, জবাব দাও। মাধবীলতার প্রতিটি প্রশ্ন তীক্ষ্ণ থেকে তীর হচ্ছিল।

অনিমেষ চোখ বন্ধ করল। ওর মনে হচ্ছিল বাঁধের ফাটলটাকে এখনই যে কোন ভাবে বন্ধ করা দরকার। সে জবাব দিল, এখানকার এই অবস্থা আমি জানতাম না লতা। এখন পরিস্থিতি অনুযায়ী তো ব্যবস্থা নিতে হবে।

চুপ করো। এরকম সুবিধেবাদী কথা শুনলে গা ঘিনঘিন করে ওঠে।

বেশ। কিন্তু তুমি তো দেখতেই পাচ্ছ বাবা মারা যাওয়ার পর এ বাড়িতে একটা মানুষ নেই যে ওঁদের পাশে দাঁড়াবে। দুজন বিধবা আজ আমার মুখ চেয়ে রয়েছে। তাঁদের ফেলে আমি যাই কি করে?

আর আমি? আমি কি নিয়ে থাকব? সেটা ভেবেছ?

এইবার মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে যেন আঘাত করে সামাল দিতে চাইল অনিমেষ, লতা, এবার তুমি স্বার্থপর হচ্ছ!

স্বার্থপর? চমৎকার। মাধবীলতা হিংস্র বাঘিনীর মত ঘুরে বসল, কথাটা যখন উচ্চারণ করলে তখন তোমাকে জবাবদিহি দিতে হবে। কিসের আশায় আমি শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম? তুমি আন্দোলন করছ জেনেও আমি কেন তোমাকে শরীর দিয়েছিলাম। যে কোন দিন পুলিস তোমাকে মেরে ফেলবে জেনেও আমি! কেন?

আমাকে ভালবাসতে বলে।

কেন তোমার জন্যে আমি বিনা প্রতিবাদে লালবাজারে অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করেছিলাম? কেন তোমার বাচ্চাকে পেটে নিয়ে একা এই সমাজ আর লোভী মানুষগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলাম? বছরের পর বছর একা ওই বাচ্চাকে নিয়ে বস্তিতে কার জন্যে অপেক্ষা করেছি? কেন তোমাকে জেল থেকে আমি এনেছিলাম? কেন এতগুলো বছর তোমার মত পঙ্গু মানুষকে আমার পক্ষে যতটা সম্ভব তারও বেশী দিয়ে মাথায় করে রেখেছিলাম? কি স্বার্থপরতা ছিল তাতে?

অনিমেষ মুখ ফিরিয়ে নিল। তার জবাব দেওয়ার কিছু নেই।

সবাই বলত মাধবীলতার মত মেয়ে হয় না। তুমি নিজেকে নিঃশেষ করে দাও, প্রতিদানে কিছু চেও না, তোমার মত মেয়ে হবে না। এই প্রশংসা শুনতে শুনতে আমার সমস্ত মন বিদ্রোহ করল। তুমি ঠাট্টা করেছ নিজেকে কষ্ট দিয়ে আমি নাকি আনন্দ পাই। একবারও ভাবোনি কেন আমি এসব করেছি, কার মুখ চেয়ে। জবাব দাও?

সবই সত্যি। কিন্তু তুমি শক্ত সমর্থ। তার ওপর খোকা তোমার সঙ্গে থাকছে। কিন্তু এদের কথা ভাবো। অনিমেষের গলায় অনুনয়।

কি ভাববো? না। আমি আর ভাববো না। এত বছর তো অনেক দিলাম। এবার আমার চাই। তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে। মাধবীলতার গলায় এবার কর্তৃত্বের সুর। মুখের চামড়া টানটান।

তুমি মিছিমিছি জেদ করছ। একটু খোলা মনে ব্যাপারটা ভাবো, প্লিজ।

কি ভাববো? তুমি আমাকে কি পেয়েছ? সর্বংসহা। সারা জীবন আমার ওপর অত্যাচার করে যাবে আর আমি সেসব মুখ বুজে সইব? তুমি আমাকে কি দিয়েছ আজ পর্যন্ত?

অনিমেষ ক্রমশ অসহায় হয়ে পড়ছিল। আজকের মাধবীলতাকে কোনদিন যেন সে দ্যাখেনি। অসহায়তা থেকে অনিমেষের বুকে একটা উত্তেজনা জন্ম নিল। সে শক্ত গলায় বলল, এসব কথা এখন শোনাচ্ছ কেন? তোমার মনে আছে, যেদিন তুমি আমায় জেলফেরত নিয়ে যেতে চেয়েছিলে সেদিন আমি আপত্তি করেছিলাম!

হ্যাঁ করেছিলে। আমি সেটাকে সঙ্কোচ বলে ভেবেছিলাম। তুমি কোন কাজ না করে আমার সঙ্গে থাকতে চাওনি, তাই বিনয় বলে মনে করেছিলাম। আমি তোমার জন্যে জীবন দিতে পারি যখন তখন ওই সঙ্কোচ বা বিনয়কে আমল দেব কেন? কিন্তু এতগুলো বছর একসঙ্গে থেকেও তুমি আমাকে বুঝতে পারলে না? আজ সত্যি আফসোস হচ্ছে আফসোস হচ্ছে অনিমেষ। সত্যি কথা বললাম।

আমাকে ভালবেসেছো বলে আফসোস হচ্ছে?

না। ভালবাসা ইলেকট্রিকের সুইচ নয় যে ইচ্ছে মতন নেবানো কিংবা জ্বালানো যায়। আমার আফসোস হচ্ছে এই ভেবে ভগবান কেন তোমাকে দুটো চোখ দিলেন না, এত অন্ধ তুমি!

লতা, আমি তোমাকে অন্যরকম ভেবেছিলাম।

কি রকম? যার কোন সাড় নেই, সব বোঝা চাপিয়ে দিলে যে মুখ বুজে বইবে, একটুও প্রতিবাদ করবে না? আর পাঁচজনে কি মহৎ বলে হাততালি দেবে, সেইরকম? খুব ছোট হয়ে যাচ্ছি অনিমেষ, কিন্তু আজ ছোট হতে ভাল লাগছে। আমরা মেয়েরা বড় বেশী উদার হই বলে তোমরা পুরুষেরা চিরকাল বেঁচে যাও। তুমি কি কিছু বুঝতে পারছ?

না।

তা পারবে না জানতাম। আচ্ছা অনিমেষ, আমি একটা মেয়ে। আমার শরীরে যৌবন আছে, লোকে বলত আমি সুন্দরী। এই আমি এতগুলো বছর তোমার সঙ্গে এক ঘরে থাকলাম অথচ আমার কালরাত্রি ঘুচলো না, ঘুচবে না। তুমি কখনও ভেবেছ সে কথা?

লতা তুমি একটা সাধারণ মেয়ের মত কথা বলছ। একটা দেহসর্বস্ব মেয়ের মনের কথা তোমার মুখে মানায় না।

সাধারণ মেয়ে? অনিমেষ আমিও তো সাধারণ মেয়ে। আমি অসাধারণ হবার ভান করতে করতে কখন! কিন্তু আমার শরীর? সে তো মাঝে মাঝেই বিদ্রোহ করত? কেন আমি জোর করে মুখ ফিরিয়ে রাখতাম? অনিমেষ, তুমি আমাকে এতগুলো বছরে কদিন জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছ?

অনিমেষ কথা বলতে পারল না। মাধবীলতা অন্ধকারে যেন নিজের মনেই হাসল, স্বার্থপর বলছিলে না একটু আগে? যৌবনের শুরুতেই শুধু তোমাকে একবার চোখে দেখব বলে একা মেয়ে শান্তিনিকেতনে ছুটে গিয়েছিলাম। শুধু তোমার পাশে একটা দিন থাকতে পারব, তোমার কাজের ফাঁকে দুটো কথা বলার সুযোগ পাব। আমার আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তখন একা হোস্টেলে থাকি। তুমি, সেই রাত্রে আমায় গ্রহণ করে জিজ্ঞাসা করেছিলে আমি কিছু মনে করেছি কিনা? অবাক হয়েছিলাম, জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন? আসলে উত্তেজনায় তুমি আমার শরীর ভোগ করেই অপরাধ বোধে পীড়িত হয়েছিলে। কিন্তু সেই মুহূর্তটায় আমি আমার ভালবাসাকে সাজিয়েছিলাম। সত্যিই ছেলেমানুষ ছিলাম। মেয়েদের শৈশব বড় দেরিতে কাটে। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আমার শরীরে অর্ক এসে গেছে। অথচ তুমি একবারও খোঁজ করছ না। তোমার দেশ-উদ্ধার–বিপ্লব করে যাচ্ছ নিশ্চিন্তে। আর একটা মেয়ের শরীরে যে বীজ দিয়ে এলে তার পরিণতি নিয়ে চিন্তাও করলে না। আর আমি কি বোকার মতন সেই বীজটাকে তিল তিল করে বাঁচাবার চেষ্টা করলাম। হোস্টেল ছাড়তে হল। এর বাড়ি তার বাড়ি করে আমি একা মেয়ে কলকাতা শহরে হাবুডুবু খেতে খেতে তোমার অর্ককে নিয়ে তোমার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কই, আমি তো তখন অ্যাবরশন করাতে পারিনি। একটা কুমারী মেয়ের পক্ষে সেইটেই স্বাভাবিক ছিল। আমি কি ঝুঁকি নিয়েছিলাম! কুন্তী তো কর্ণকে জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল, আমি অর্ককে তো–। মাধবীলতা হাঁপাতে লাগল। তারপর একসময় নিঃশ্বাস চেপে বলল, এই সমাজ তখন অর্ককে বাস্টার্ড বলতে পারত। যে জানে সে বোধহয় তাই বলবে। আমার আর জোর করার গলা রইল না। আমি স্বার্থপর? স্বার্থপরতার সংজ্ঞা কি জানি না।

ছিঃ। অনিমেষ চিৎকার করে উঠল, তোমার লজ্জা করল না একটুও?

কেন? লজ্জা করবে কেন মাধবীলতা যেন অনেক দূর থেকে কথা বলছে।

তুমি অর্ককে বাস্টার্ড বলছ! বলতে পারলে?

আমি বলিনি। লোকে বললে জবাব দিতে পারব না।

কেন? আমি, আমি ওর বাবা না?

সে বিষয়েও সন্দেহ হচ্ছে নাকি?

এত ছোট ভেব না। কিন্তু আমার সামনে ও কথা উচ্চারণ করলে কি করে?

অনিমেষ, তোমার ক্ষণিক আনন্দের জের মেটাতে অর্ক আমার শরীরে এসেছিল। কিন্তু তুমি তো ওর বাবা কখনও হওনি। কি করেছ তুমি ওর জন্যে? একটি মেয়ে তার সন্তানকে দশ মাস শরীরে লালন করে জন্ম দেয়। একজন পুরুষ বাবা হয় তার আচরণের মাধ্যমে।

ওঃ, চুপ করো। আমি সহ্য করতে পারছি না।

কিন্তু এটাই বাস্তব। আজ যখন আমরা পেঁয়াজের খোসা ছাড়াচ্ছি তখন জানি শেষে কিছুই থাকবে না, তবু এটাই সত্যি। অনিমেষ ওঠো, আমাকে একটু শুতে দাও।

বাইরে তখনই বিদ্যুৎ চমকালো। অনিমেষের মনে হল তার সামনে একটা পাথরের মূর্তি বসে আছে। বিপর্যস্ত অনিমেষ বলতে পারল, লতা, আমার অপরাধ আমি বুঝতে পেরেছি।

কি বুঝেছ?

আমার এখানে থাকতে চাওয়া উচিত হয়নি।

না। সেটা তোমার অপরাধ নয়।

তা হলে? তাহলে তুমি এরকম করছ কেন?

আমি তো কিছুই করছি না। অনিমেষ, এদের কষ্ট এদের একাকিত্ব আমি বুঝি। এ বাড়ি নিয়ে মামলা হচ্ছে, একটাও পুরুষমানুষ এদের পাশে নেই। এরা তোমার অত্যন্ত আপনজন। তোমার পক্ষে এঁদের কাছে কিছুদিনের জন্যে হলেও থাকা একান্ত প্রয়োজন। এটুকু বুঝি।

তা হলে? আমি তো তাই করেছি। অনিমেষ অবাক হয়ে গেল।

হঠাৎ মাধবীলতার মুখ অনিমেষের দিকে ঘুরে এল, তুমি ওঁদের বলতে গিয়েছিলে কলকাতায় যাওয়ার কথা। ওখানে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একবার তো আমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারতে! আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব কিনা এই চিন্তা একবারও তোমার মাথায় এল না?

অনিমেষ এতক্ষণে যেন পায়ের তলায় মাটি পেল। সে নিচু গলায় বলল, আমার অন্যায় হয়ে গেছে লতা।

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, না। তুমি ঠিক করেছ। এসব আমার পাওনা।

কিন্তু এত সামান্য ব্যাপার নিয়ে তুমি এরকম করলে!

সামান্য? তোমার কাছে হয়তো সামান্য, লোকে শুনলে বলবে যে মাধবীলতা এত এত আত্মত্যাগ করেছে এইটুকুনিতে তার- আসলে এসব উপেক্ষা করে চোখ বন্ধ করে আমার চলে যাওয়া উচিত ছিল উদারতা দেখিয়ে। কিন্তু জানো, অন্যের হাতের ছোঁড়া বর্শার আঘাত যে মুখ বুজে সহ্য করতে পারে সে প্রিয়জনের ছোট্ট কাঁটা বেঁধানোতে পাগল হয়ে যায়। এ তুমি বুঝবে না। যাও, আমায় একটু একা থাকতে দাও।

তুমি আমায় ভুল বুঝছ লতা।

না। একটুও না। শুধু তোমার কাছে একটা শেষ অনুরোধ আছে। কলকাতায় নিয়ে গেলে আমি হয়তো অর্ককে আর বাঁচাতে পারব না। ঈশ্বরপুকুর লেনের ওই বস্তি ওকে গ্রাস করে নেবে। এখানে এই কয়দিনে ওর চেহারায় ব্যবহারে যে পরিবর্তন এসেছে সেটা আগে দেখিনি। তুমি তোমার কাছে অর্ককে রেখে দাও। আমি নিশ্চিন্ত হই।

তুমি ওখানে একা থাকবে?

তাই তো ছিলাম। একটা একুশ বাইশ বছরের মেয়ে যদি একা থাকতে পারে তো। এখন তো বুড়ি হতে চললাম। তোমার জিনিস তোমার কাছে রইল।

লতা, এরকম করে বলো না। আমি সহ্য করতে পারছি না।

আমিও না। কিন্তু এবার বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়াও অনিমেষ।

হঠাৎ অনিমেষ দুহাতে মাধবীলতাকে জড়িয়ে ধরল। তার সবল হাত মাধবীলতার শরীরকে বুকের মধ্যে পিষে ফেলতে চাইল, না, আমি তোমাকে ছেড়ে দেব না। আমি তোমার সঙ্গে যাব।

মাধবীলতা স্থির হয়ে রইল যতক্ষণ না অনিমেষের হাত শিথিল হয়। তারপর ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে বলল, এখন আর তা হয় না অনিমেষ।

ঠিক সেইসময় খুট করে একটা শব্দ হল। বাইরের বৃষ্টি ততক্ষণে থেমে গেছে। ওরা দুজনেই মুখ ফেরাল। পাশের ঘরের দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। আবছা অন্ধকারে অর্কর শরীরটাকে রহস্যময় মনে হচ্ছিল।

৪০. হঠাৎ একটা কনকনে ঢেউ

হঠাৎ একটা কনকনে ঢেউ যেন এই ঘরে আছড়ে পড়ল। মাধবীলতা এবং অনিমেষ এখন অসাড়, ওদের চোখ দরজার দিকে। রাত এখন কত কে জানে। দরজায় অর্ক দাঁড়িয়ে, ওর মুখচোখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, সে ওদের দেখছে। অনিমেষ খুব দুর্বল বোধ করছিল। অর্ক যে সব শুনেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু মাধবীলতার ওপর প্রচণ্ড ক্রোধ ছাড়া তার অন্য কোন অনুভূতি এল না। খামোকা চিৎকার চেঁচামেচি করে সে ছেলেটাকে। রাগ বাড়ছে অথচ সে। প্রকাশ করতে পারছে না।

মাধবীলতার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠেছিল। অর্ক যে পাশের ঘরে জেগে আছে তা তার মাথায় আসেনি। আসলে নিজেকে এমন ছিন্নভিন্ন লাগছিল যে অনিমেষ কথা শুরু করা মাত্র উন্মুক্ত হয়ে পড়েছিল। সেই মুহূর্তে অন্য কোন ভাবনা কাজ করেনি। নিজের কাছে যেটা সত্যি, চূড়ান্ত সত্যি, যাকে এতদিনে অনেক চেষ্টায় চাপা দিতে চেয়েছিল, আজ হঠাৎ! এখন আর কিছুতেই কিছু এসে যায় না। যা স্বাভাবিক তাই মেনে নেওয়া ভাল। এইটুকু ভাবতে পেয়ে সে ক্রমশ সহজ হয়ে এল। কিন্তু কথা বলতে গিয়ে বুঝতে পারল তার গলা কাঁপছে, কি রে ঘুমোসনি?

অর্ক অন্ধকার ঘরটায় এতক্ষণে দুটো শরীরকে আলাদা করে চিনতে পেরেছে। কয়েকটা কালো থাবা এতক্ষণ তার বুকের ভেতরটা আঁচড়াচ্ছিল, মাথার ভেতরে একটা গনগনে উনুন উত্তাপ ছড়াচ্ছিল। বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে তার ঘুম প্রায় এসে গিয়েছিল। এইসময় একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর তার কানে গেল। গলাটা মেয়েদের এবং তারপরেই বুঝতে পারল ওটা মায়ের। মা কখনও এই গলায় কথা বলে না। খুব অবাক হয়েছিল অর্ক। মায়ের কি শরীর খারাপ করল? সে চটপট বিছানা থেকে নেমে এসেছিল। কারো একটা কিছু হয়েছে এ রকম বোধই তার মনে কাজ করছিল। দরজার কাছে পৌঁছে সে বাবার গলা শুনতে পেয়েছিল। খুব অনুনয়ের ভঙ্গীতে বাবা মাকে বোঝাচ্ছিল। এবং তার পরেই মা কাটা কাটা গলায় কথা বলল। এই মুহূর্তে অর্ক আবিষ্কার করল কোন বিপদে পড়েনি, বাবার সঙ্গে কথা বলছে মাত্র। কিন্তু এরকম গলায় সে ওদের কোনদিন কথা বলতে শোনেনি। তারপরেই তার খেয়াল হল মা বাবা তো স্বামী-স্ত্রী। কেমন যেন লজ্জা পাচ্ছিল সে। কিন্তু সেইসঙ্গে তার খেয়াল হল আজ অবধি কখনও বাবা মাকে স্বামী-স্ত্রীর মত কথা বলতে শোনেনি। ওরা যখনই গল্প করেছে কিংবা ঝগড়া সেটা বন্ধুর মতই করেছে। অর্কর উপস্থিতি কখনই ওদের তেমন অসুবিধে করেনি। স্বামী এবং স্ত্রী যা যা করে বলে সে জেনেছে তার কোন কিছুই এত বছরে এক ঘরে থেকে বাবা মাকে করতে দ্যাখেনি। মায়ের সঙ্গে বাবার সম্পর্ক তার থেকে বিন্দুমাত্র আলাদা ছিল না। সেইটে আজ হঠাৎ পাল্টে গেল কি করে? মা এইরকম নিষ্ঠুর গলায় কথা বলছেই বা কেন? অর্কর কৌতূহল হল। তার আশঙ্কা হল ঝগড়ার বিষয়বস্তু সে নয় তো? তাকে নিয়ে মায়ের সবসময় দুশ্চিন্তা। হয়তো আজ বিকেলে তিস্তার চরে যাওয়া নিয়ে মা রাগারাগি করছে বাবার ওপরে। কিংবা তখন সে এখানে থাকতে চেয়েছিল বলে মা তাকে চড় মেরেছে। সেই প্রসঙ্গেই হয়তো এই ঝগড়া! অর্ক দরজার জোড়ায় কান পাতল। এতক্ষণ বৃষ্টির জন্যেই বোধহয়, যে কথাগুলো ঝাঁপসা ছিল তা পরিষ্কার হল! শুনতে শুনতে অর্কর মনে হচ্ছিল মা ঠিক বলছে। হঠাৎ এই প্রথম সে মাকে অন্য চোখে দেখতে পেল। মা সারা জীবন তাদের জন্যে করে গেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে মা বলছে যা করেছে সব বাবার মুখ চেয়ে। তার কথা কিছু বলছে না। এক ধরনের ঈর্ষা বোধ করলেও সে বুঝতে পারছিল মা অন্যায় বলছে না। মা আর পাঁচটা বিবাহিতা মহিলার মতন জীবনে কিছুই পায়নি। অথচ এতদিন এটাই তাদের চোখে স্বাভাবিক ছিল। আজ মা এসব কথা বলছে বাবা এখানে থেকে যেতে চায় বলেই! সে থাকতে চেয়েছিল বলে মা চড় মেরেছিল। বাবাকে সেরকম করা সম্ভব নয় বলেই এসব কথা বলছে। অর্ক কান পাতল। এবং তখনই একটা গরম সিসে ছিটকে এল তার কানে। বাস্টার্ড। বাস্টার্ড মানে কি? স্পষ্ট না হলেও সে অনুমান করতে পারল। বাবা। এবং মায়ের বিয়েই হয়নি? বাবা এবং মা অবিবাহিত অবস্থায় এতকাল একসঙ্গে ছিল। শান্তিনিকেতনে বাবা একদিন মাকে ভোগ করেছে বলে সে এসেছে পৃথিবীতে! অর্কর সমস্ত শরীর জ্বলতে লাগল। বাবা চিৎকার করল কিন্তু কথাটাকে অস্বীকার করতে পারছে না। মা শুধু বাবাকে ভালবেসেছিল বলেই তাকে লালন করেছে। অর্কর মাথার ভেতরটা গুলিয়ে যাচ্ছিল। চোখ বন্ধ করতেই সে সেই দৃশ্যটাকে দেখতে পেল। খাটের ওপর একটা রুগ্ন বিকলাঙ্গ মানুষ বসে আছে। মা দরজায় দাঁড়িয়ে তাকে নরম গলায় বলছে, তোমার বাবা। সেই প্রথম সে বাবাকে দেখেছিল। তার আগে শুধুই মা, আর মায়ের কাছে গল্প শুনেছে বাবা জেলে আছে। আর তখনই মাধবীলতা অনিমেষকে বলছিল অর্কর দায়িত্ব নিতে, সে একাই কলকাতায় ফিরে যেতে চায়।

অর্ক কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। মা বলল, পাঁচজনে জানলে তাকে বাস্টার্ড বলবে। অর্থাৎ অবিবাহিত মানুষদের সন্তানকে লোকে বাস্টার্ড বলে! মোক্ষবুড়ি প্রায়ই একটা গালাগাল দিত, বেজম্মা। যার জন্মের কোন ঠিক নেই। কথাটার মানে এতদিন খুব স্পষ্ট ছিল না। অর্ক আর পারল না। তার শরীরে এখন যেন এক ফোঁটা রক্ত নেই। কাঁপা হাতে দরজাটা খুলল সে। একটু একটু করে কপাট আলাদা হতে সে অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখতে পেল না। তার কয়েক মুহূর্ত বাদে মায়ের গলা শুনতে পেল, কি রে, ঘুমোসনি?

অর্ক জবাব দিল না। সে কেন দরজা খুলেছে একথা বুঝিয়ে বলার ভাষা তার মনে আসছিল না। সে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল দুটো মানুষের দিকে। অন্ধকার আচমকা যেন পাতলা হয়ে যাচ্ছে ওই ঘরে।

মাধবীলতা খুব দ্রুত নিজেকে ফিরে পেল। এ ঘরের কথাবার্তা যে ছেলের কানে পৌঁছেছে তাতে তার সন্দেহ ছিল না। সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, কি হয়েছে, কথা বলছিস না কেন?

এইবার অর্ক যেন নড়ে উঠল, সে নিস্তেজ গলায় প্রশ্ন করল, এতক্ষণ তুমি যা বললে তা সত্যি?

সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল অনিমেষ, কি বলেছে ও? কিছুই বলেনি। আর যদি কিছু কথা হয়ে থাকে তা আমাদের মধ্যে হয়েছে, তোর সে কথা শোনার কোন প্রয়োজন নেই। যা, শুয়ে পড়।

অর্ক সেই একই স্বরে বলল, কিন্তু আমি যে শুনেছি। বা অনিমেষ এবার খুব দুর্বল হয়ে পড়ল। সে দেখল মাধবীলতা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের মাঝখানে। এখন আর কোন ফিকিরেই এই ভাঙ্গা বাঁধ জোড়া দেওয়া যাবে না। অথচ কিছু একটা করা উচিত! কিন্তু সেটা কি তা তার মাথায় আসছিল না। এই সময় মাধবীলতা বলল, কি শুনেছিস?

তোমার সঙ্গে বাবার কখনও বিয়ে হয়নি?

মাধবীলতা চোখ বন্ধ করল। তার সমস্ত শরীর যেন এই মুহূর্তেই খরা। আশ্চর্য, চোখে একফোঁটা জল আসছে না। এই সত্য, চূড়ান্ত সত্যটির মুখোমুখি হতে হবে একদিন তা কি তার জানা ছিল না? ছিল, কিন্তু কখনই তাকে পরোয়া করেনি। তাহলে আজ কেন গরম হাওয়ার হলকা ছাড়া বুকের ভেতরে কিছুই অবশিষ্ট নেই। সে পায়ে পায়ে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অন্ধকারের শরীরে কেউ যেন কাঁচা দুধ গুলে দিয়েছে। ফলে একটা মোলায়েম আলো পড়েছে ভেজা গাছের পাতায়, আকাশের গায়ে। ওপাশে বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া সুপুরি গাছগুলো অদ্ভুত মায়াময় হয়ে উঠেছে। এখন রাতের ঠিক-দুপুর পার হওয়া সময়।

তোমার সঙ্গে বাবার কখনও বিয়ে হয়নি? অর্কর গলাটা একটু জোরে।, মাধবীলতা ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, না। সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষ চেঁচিয়ে উঠল, এসব তুমি কি বলছ ওর কাছে? তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে?

আজকে ওর সত্যিটা শোনা উচিত। যথেষ্ট বড় হয়ে গেছে তোমার ছেলে। শোন, তোর বাবার সঙ্গে আমার আইনের কিংবা ধর্মের বিয়ে হয়নি। সেটা করার কোন প্রয়োজন আমি বোধ করিনি। মাধবীলতা মুখ ফেরাচ্ছিল না।

কেন? সবাই তো তাই করে, এটাই নিয়ম।

তুই বুঝবি না। আমি মনে করি আইনের চেয়ে বিশ্বাস অনেক বড়। সেই বিশ্বাস যতদিন থাকবে ততদিন আমরা স্বামী স্ত্রী। খোকা, এই প্রশ্ন পৃথিবীর অন্য কেউ করলে আমি জবাব দিতাম না। কিন্তু তোর জানা উচিত।

অর্ক বলল, তুমি বাবাকে ভালবাসতে, বিশ্বাস করতে, তাই বিয়ে করোনি। কিন্তু আমি কি দোষ করেছি?

তুই নিজেকে দোষী ভাবছিস কেন?

নিশ্চয়ই। যদ্দিন তোমাদের বিশ্বাস ছিল তদ্দিন আমি তোমাদের ছেলে ছিলাম। এখন আমার পরিচয় কি হবে?

মাধবীলতা বলল, আমি তোকে পেটে ধরেছিলাম। জন্মাবার পর তুই আমাকেই প্রথম চোখ মেলে দেখেছিলি। আমি তোকে যা যা চিনিয়েছি তুই তাই চিনেছিস। এটা তো কখনই মিথ্যে হতে পারে না। তুই আমার ছেলে।

অন্ধকারে অর্কর গলায় সামান্য হাসির ছিটে মিশল, তাহলে আমাকে রেখে যাচ্ছ কেন এখানে? কি পরিচয়ে থাকব আমি?

তুই তোর বাবার কাছে থাকবি।

কি করে বুঝব উনি আমার বাবা?

খোকা! চাপা গলায় গর্জে উঠল মাধবীলতা।

চেঁচিও না মা, আমার প্রশ্নটা যে মিথ্যে তা প্রমাণ কর।

মাধবীলতার মনে হল ছেলের এই কণ্ঠস্বর আগে কখনও শোনেনি। আচমকা যেন সে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। অথচ এখন কথা বলা দরকার। যখন শুরু হয়েছে তখন খোলাখুলি সব বলা ভাল। কিন্তু সেইসময় অনিমেষ চাপা গলায় বলে উঠল, তোর কোন অধিকার নেই মাকে অপমান করার।

আমি মাকে অপমান করছি না। মা নিজে বলুক তুমি আমার বাবা।

এটা কি নতুন কথা, তুই প্রথম শুনলি?

কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব? তোমরা বিয়ে করোনি।

বিয়ে? বিয়ে বলতে কি বুঝিস তুই? শুধু মন্ত্রপাঠ আর কাগজে সই করলেই বিয়ে হয়? আমার সমস্ত নিশ্চয়তা ছেড়ে এই মানুষটার জন্যে আমি কষ্ট সহ্য করেছি কি জন্যে? সেটা বিয়ের চেয়ে কম? মাধবীলতা হাঁপাচ্ছিল।

তাহলে আজ তুমি ছেড়ে চলে যাচ্ছ কেন?

এবার মাধবীলতা ঠোঁটে ঠোঁট চাপল। সে কেন যাচ্ছে তা বোঝাবে কি করে! অর্ক মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল আবার, তুমি কি ওঁকে ভালবাস না?

নিশ্চয়ই বাসি।

তবে?

তুই বুঝবি না, এ বোঝার বয়স তোর হয়নি। শুধু এটুকু জেনে রাখ, আমি আজ প্রথম নিজেকে খুব–। মাধবীলতার গলার স্বর ডুবে যাচ্ছিল। কোনরকমে সে বলতে পারল, অপমান বুকে নিয়ে একসঙ্গে থাকা যায় না।

কিছুক্ষণ এই ঘরে কোন শব্দ নেই। তিনটে মানুষ যেন নিঃশ্বাস দিয়ে পরস্পরকে জানবার চেষ্টা করছিল। শেষ পর্যন্ত অনিমেষ ক্রাচ নিয়ে উঠে দাঁড়াল, লতা, কি সামান্য কারণে তুমি, তোমরা আমাকে ভুল বুঝলে। যাক, যা ভাল বোঝ তাই করো। তারপর ধীরে ধীরে দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে গেল।

অর্ক এবার মাধবীলতার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। মাধবীলতা তখন জানলার দিকে ফিরে দাঁড়িয়েছে, তার চিবুক বুকের ওপর। বাইরের জানলায় তখন ছিমছাম আকাশ। হঠাৎ অর্কর মনে হল তার এত চিন্তা করার কি আছে? জ্ঞান হবার পর সে মাকেই দেখেছে, মায়ের চেষ্টায় একটু একটু করে বড় হয়েছে। বাবার কাছ থেকে কতকগুলো গল্প ছাড়া সে কিছুই পায়নি। বাবা যদি মাকে বঞ্চিত করে থাকে সে নিজেও কিছু কম হয়নি। আজ যদি পৃথিবীর মানুষ তাকে বেজন্মা বলে তাতে সে কি আর বেশী হারাবে? কোন অধিকতর সম্মান পেত যদি তার বাবা মা আইনসম্মত বিবাহিত হত? কিস্যু না। কিন্তু মাকে ছেড়ে তার পক্ষে এ বাড়িতে থাকা অসম্ভব। এই মানুষটা তার বাবার কাছে কিছুই পায়নি, সেই ঋণ তার শোধ করা উচিত। অর্ক মাধবীলতার হাত আঁকড়ে ধরল, মা, আমি তোমার সঙ্গে কলকাতায় ফিরব।

মাধবীলতা কেঁপে উঠল, না।

না বলো না। তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না।

বোকামি করিস না খোকা। এই বাড়ি তোর, এখানকার পরিবেশ তোকে মানুষ করবে।

তুমি কাছে না থাকলে আমার মানুষ হওয়ার দরকার নেই মা। কি হবে মানুষ হয়ে। চারপাশে তাকিয়ে দ্যাখো, কত লোক মানুষ হয়েছে। কি করছে তারা? তুমি জানো না আমি অনেককে চিনি যাঁরা খুব শিক্ষিত এবং বড়লোক, সমাজের চোখে তাঁরা মানুষ হয়েছেন কিন্তু তাঁদের কথা ভেবে। আমার বমি পেয়েছিল। মানুষ হওয়ার নিয়মটা বোধহয় খারাপ হয়ে গেছে মা। অর্ক কেটে কেটে কথাগুলো উচ্চারণ করছিল। মাধবীলতা অবাক হয়ে তাকাল। এই ছেলে, এক রাত্রে এতটা পাল্টে গেল? আজ বিকেলেই না সে ওকে চড় মেরেছে! কিন্তু তবু একটা অভিমান তার বুকের দেওয়ালে মাথা ঠুকছিল। সেই মুহূর্তে অর্ক তাকে জড়িয়ে ধরল, মা, আমাকে ছেড়ে যেও না।

মাধবীলতা বুঝতে পারছিল না তার কি করা উচিত। কিন্তু তার বাঁধ ভাঙ্গছিল। এই ছেলেকে সে শরীরে ধারণ করেছিল, বড় করেছিল। যতক্ষণ এ তাকে ত্যাগ করে না যায় সে ছাড়বে কেন?

একটু হাওয়া বইলেই গাছগুলো থেকে টুপ টুপ করে জল ঝরছে। ঘাসগুলো চপচপে ভিজে। অথচ আকাশের কোনায় একফালি চাঁদউপুড় হয়ে রয়েছে। কোথাও মেঘের চিহ্নমাত্র নেই। অনিমেষ এবার ঠাণ্ডা আবিষ্কার করল। সিরসির করছে শরীর। ভেজা ঘাসে পা থাকায় ঠাণ্ডাটা আরও জোরদার হয়েছে। সে মুখ ফিরিয়ে বারান্দাটার দিকে তাকাল। বাড়িটা অন্ধকার।

কি থেকে কি হয়ে গেল। এত সামান্য ব্যাপার নিয়ে মাধবীলতা এমন কাণ্ড করবে সে ভাবতে পারেনি। মেয়েটার অভিমানবোধ এত বেশি তা সে আঁচ করতে পারেনি। ছোটমা আর পিসীমার কাছে অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে সে স্বীকার করেছিল এখানে থেকে যাবে। তখন মনে হয়েছিল পরে : মাধবীলতাকে বুঝিয়ে বললেই চলবে। কিন্তু! হঠাৎ তার মনে হলো মাধবীলতা কি তার কাছ থেকে নিষ্কৃতি চাইছিলো? এতদিন ধরে বোঝা টেনে টেনে ও কি হাঁপিয়ে উঠেছিল? তাই সামান্য একটা ঘটনাকে আঁকড়ে ধরে এইভাবে নিজেকে সরিয়ে নিতে চাইছে? এইরকম একটা বিপরীত চিন্তা করতে পেরে অনিমেষের ভাল লাগল। কিন্তু তারপরেই মনে হল কেন করল মাধবীলতা? এই। বাড়িতে তাকে জোর করে সে-ই নিয়ে এসেছে। এই বাড়ির বউ-এর সম্মান সে নিজেই আদায় করে নিয়েছে। এখন আর তার কি অভিযোগ থাকতে পারে? হিসাব মেলাতে পারছিল না অনিমেষ। কিন্তু অর্ক? অর্কর কাছে তো তাকে ধূলিসাৎ করে দিল মাধবীলতা। ওই ছেলের সামনে এত কথা বলার কি দরকার ছিল? অর্ক যখন উদ্ধত গলায় প্রশ্ন করছিল তখন তার উত্তর যুগিয়ে গিয়েছে মাধবীলতা। সেটা তাকেই অপমান করা নয়? এবং তখনই তার মনে পড়ল সে জেল থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে বসে বিয়ের কথা বলতেই মাধবীলতা জানিয়েছিল আনুষ্ঠানিক বিয়ে ওর কাছে তখন অসম্মানের হবে। তাহলে তার অন্যায় কোথায়? অনিমেষ ছটফট করতে লাগল।

ক্রাচে ভর দিয়ে সে গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মাধবীলতা কলকাতায় চলে যাবে। এই যাওয়া যে চূড়ান্ত যাওয়া তাতে কোন সন্দেহ নেই। সে কি মাধবীলতাকে ছেড়ে থাকতে পারবে? ব্যাপারটা চিন্তা করতেই অনিমেষের বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠল। এত বছর একসঙ্গে থেকে, যে মেয়েটা তার জন্যে নিজের জীবন নিংড়ে দিল তাকে চোখের ওপর দেখে দেখে! অনিমেষ মাথা নাড়ল। সে কি করে পারবে? দু’চারমাস আলাদা থাকা যায় কিন্তু চিরকাল? অনিমেষ চোখ। বন্ধ করল। এবং তখনই তার জেলখানার দিনগুলো মনে পড়ল। তখন তো সে একটু একটু করে মাধবীলতাকে ভুলতে পেরেছিল। এমন কি তাকে এড়াতে মুক্তি পাওয়ামাত্র সে অন্য লোকের বাড়িতে উঠতে পেরেছিল। স্বৰ্গছেঁড়াকে একসময় তার প্রাণের চেয়ে বেশী মনে হত। সেই বাতাবি। লেবুর গাছ, মাঠ, চা-গাছ আর আংরাভাসা নদীকে ছেড়ে কোনদিন থাকতে পারবে না বলে মনে হত তখন। কিন্তু একসময় জলপাইগুড়িতে থাকতেই সব ফিকে হয়ে গেল। তার নিজের মা, মাধুরী? যার গায়ের গন্ধ নাকে না এলে ঘুম আসতো না তাকে ছেড়ে সে জলপাইগুড়িতে এসেছিল। আর সেই মা মারা যাওয়ার পর রোজ রাতে আকাশের একটি বিশেষ তারার দিকে তাকিয়ে থাকত। মা বলেছিল মন খারাপ হলেই যেন সে তারাটার দিকে তাকায় তাহলে মন ভাল হয়ে যাবে। হায়, কতকাল, সে কতকাল কে জানে, মন ভাল করার জন্য তারাটার দিকে তাকাতে হয়নি। আর এখন তো সে কিছুতেই হাজার তারার মধ্যে বিশেষ তারাটাকে খুঁজে পাবে না। কলকাতায় চলে যাওয়ার পর এক এক করে হেমলতা আর সরিৎশেখর তার কাছে নিষ্প্রভ হয়ে যাননি? নাহলে জেল থেকে বেরিয়েও এত বছর সে এখানকার মানুষগুলোর খবর না নিয়ে থাকল কি করে? বাবার অসুস্থতার খবর পেয়েও সে তো ছুটে আসেনি? অনিমেষ অন্ধকারে নিজেকে অভিযোগ করল, তুমি স্বার্থপর, তোমার মনে ভালবাসা নেই অনিমেষ। নাহলে লালবাজারে গর্ভবতী মাধবীলতার ওপর অত্যাচার দেখার পরও তোমার একবারও মনে হয়নি মেয়েটা কেমন আছে? অতএব আজ যদি মাধবীলতা চলে যায় তাহলে দুদিন বাদে তুমি নিশ্চয়ই এতগুলো ঘটনার মত এটাকেও ভুলে যাবে। অনিমেষ ঝুলন্ত চাঁদের দিকে তাকাল। আমি কি মানুষ নই? তাহলে আমার এমন হয় কেন? কোন কিছুকে আঁকড়ে ধরে চিরকাল থাকতে পারি না কেন? অদ্ভুত একটা যন্ত্রণা বুকের মধ্যে পাক খেতে লাগল ওর। অথচ এমন তো কথা ছিল না। এরকম নিরক্ত হয়ে বেঁচে থেকে লাভ কি! সে আবার বাড়িটার দিকে তাকাল। সরিৎশেখর কত ভালবেসে এই বাড়ি তৈরি করেছিলেন। এর প্রত্যেকটা ইটের গায়ে তাঁর স্পর্শ লেগে আছে। আজ তিনি নেই অথচ বাড়িটা। একটা কিছু রেখে যাওয়া দরকার। কিন্তু কিছুই সে রেখে যেতে পারল না। সাধারণ মানুষ তাদের সন্তানদের মধ্যে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে যেতে পারে। অর্ক তার সম্পর্কে কি ধারণা নিয়ে পৃথিবীতে থাকবে?

ধীরে ধীরে অনিমেষ গেট খুলল। ঝিম ধরে আছে চারধার। মৃত নগরীর মত মনে হচ্ছে। অনিমেষ পায়ে পায়ে গলি দিয়ে বড় রাস্তায় চলে এল। রাস্তায় একটা কুকুর পর্যন্ত নেই। এখন কত রাত কে জানে। ডানদিকের রাস্তাটা চলে গেছে শহরের দিকে। বাঁদিকটা মুখ থুবড়েছে বাঁধের। গায়ে। সেদিকে হাঁটতে শুরু করল অনিমেষ। আশ্চর্য, এখন তার কোমর বা থাইতে কোন ব্যথা নেই। বেশ স্বচ্ছন্দ লাগছে। অথচ কলকাতায় থাকতে এতটা সে ভাবতেও পারত না। অনিমেষের মুখে হাসি ফুটে উঠল। নিজেকে ছাড়া অন্য কিছু সে বোধহয় কোনকালেই ভাবতে শিখবে না।

এই সময় পাশে ভোঁস ভোঁস শব্দ হতেই সে থমকে দাঁড়াল। রাস্তার ধারে একটা সাদা গরু মুখ তুলে তাকে দেখছে। গরুটা ছাড়া এবং নিঃসঙ্গ। এর মালিক হয়তো খবর রাখে না কিংবা ফাঁক পেয়ে পালিয়েছে। দুটো বড় বড় চোখে সে এখন অনিমেষের দিকে তাকিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল তার দিকে। অনিমেষ চেষ্টা করল দ্রুত এগিয়ে যেতে। গরুটা তাকে ছুঁস মারলে তার কিছুই করার থাকবে না। কিন্তু গরুটাও যেন বেশ মজা পেয়ে গেছে। নিশ্চিন্তে তার পিছনে চলে আসছে ওটা। দ্রুত চলার জন্যে বাঁধের ওপর উঠে বেদম হয়ে পড়ল অনিমেষ। তারপর একটা ক্রাচ কোনরকমে শূন্যে তুলে নাড়তেই গরুটা দাঁড়িয়ে পড়ল। অথচ ফিরে যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। অনিমেষ বুঝল সে চলা শুরু করলেই ওটা পিছু নেবে। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিল অনিমেষ। বাঁধের ঢালু পথ দিয়ে নামতে নামতে ও অন্ধকার মাখা তিস্তার চরে দোতলা কাঠের বাড়িটাকে আবছা দেখতে পেল। গরুটা এবার হুড়মুড়িয়ে নামছে। অনিমেষ শক্ত হয়ে দাঁড়াল। প্রায় দৌড়েই তার শরীরের পাশ দিয়ে চরে নেমে গেল গরুটা। নেমে মুখ ফিরিয়ে তাকে দেখে হাম্বা স্বরে চিৎকার করে উঠল। অনিমেষ শুনল চরের কোন প্রান্ত থেকে আর একটা গরু গলা তুলে জানান দিল ওকে। এবার নিশ্চিন্ত প্রাণীটি সেই শব্দ লক্ষ্য করে রওনা দিল বালি মাড়িয়ে। অনিমেষ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে সেই যাওয়া দেখল। একে কি বলে? টান, না ভালবাসা? সে ঠোঁট কামড়াল।

বালির ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। ক্রাচ দুটো বারবার গেঁথে যাচ্ছে বালিতে। টেনে তুলে হাঁটতে গিয়ে এবার থাই-এর টনটনানি শুরু হল। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই চরের দিকে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে যাচ্ছিল। সেই বিশাল নদী কোথাও নেই। এই চরে যেন নতুন একটা উপনিবেশ গড়ে উঠেছে। জুলিয়েন বলেছিল কাঠের দোতলা বাড়ির কথা। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়নি তখন কিন্তু এখন তো চোখের ওপরই দেখতে পাচ্ছে। তার কৈশোরে এখানে রাত কাটানোর। কথা কেউ চিন্তাও করতে পারত না। শীতকালের সেই রহস্যময় কাশ গাছ আর পক্ষীরাজ। ট্যাক্সিগুলো আর বর্ষায় কেউটের মত ফুঁসে ওঠা ঢেউগুলোর ছবি চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। পৃথিবীটা কি দ্রুত পাল্টে যায়। কি দ্রুত!

কাঠের দোতলা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে দম নিল অনিমেষ। এবং তখনই তার চোখে পড়ল দোতলার একটা ঘরের ফাঁক দিয়ে আলো বেরুচ্ছে। এই বিশাল চরে ঢলে পড়া রাতের শরীরে ফালি চাঁদ যা করতে পারেনি ওই চেরা আলো তার থেকে অনেক বেশি প্রাণের স্পর্শ দিচ্ছে। এত রাত্রে কেউ নিশ্চয়ই জেগে আছে ওখানে। এই চরের মানুষদের আর্থিক সঙ্গতি যা তাতে সারারাত কেরোসিন পোড়াবার বিলাসিতা কেউ করবে না।

অনিমেষ এবার কাঠের সিঁড়িটাকে লক্ষ্য করল। স্বৰ্গছেঁড়ার ফরেস্ট কোয়াটার্সের মত গোটা আটেক কাঠের মোটা বিমের ওপর দোতলাটা দাঁড়িয়ে। পাশ দিয়ে এক-রেলিং দেওয়া সিঁড়ি ওপরে উঠে গেছে। অনিমেষ কোনরকমে ক্রাচে ভর দিয়ে সিঁড়ি ভাঙ্গতে লাগল লাফিয়ে। একটু বেসামাল হলেই নিচে গড়িয়ে পড়তে হবে। কিন্তু অদ্ভুত জেদ চেপে গেল তার। সামান্য সিঁড়িটা ভাঙ্গতে দীর্ঘসময় লাগল তার। কিন্তু ওপরের বারান্দায় ক্ৰাচটা আওয়াজ করতেই চিৎকার ভেসে এল, কে? আর সঙ্গে সঙ্গে ঘরের আলো নিবে গেল।

অনিমেষের তখন কথা বলার অবস্থা ছিল না। বুকের খাঁচাটা হাপরের মত কাঁপছে। মুখ হাঁ, চোখ বিস্ফারিত। এইসময় দরজাটা খুলে গেল। আর একটা লোক সন্তর্পণে মুখ বের করে তাকে দেখল। অনিমেষ আর দাঁড়াতে পারছিল না। তবু কোনরকমে ক্ৰাচটাকে আঁকড়ে ধরে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করছিল।

এবার লোকটি চাপা গলায় ঘরের দিকে তাকিয়ে কিছু বলে বারান্দায় এসে চ্যালেঞ্জের ভঙ্গীতে জিজ্ঞাসা করল, কে আপনি? কি চান?

অনিমেষ হাত তুলল কোনমতে, বলতে চাইল একটু দাঁড়ান। ততক্ষণে আরো কয়েকজন বাইরে বেরিয়ে এসেছে। তাদের মধ্যে থেকে একজন ছুটে এল কাছে, আরে অনিমেষ! কি ব্যাপার,হঠাৎ এখানে, এইসময়? বিকেলে তো কিছু বলেননি আমাকে?

অনিমেষ মাথা নাড়ল। তারপর জুলিয়েনের দিকে তাকিয়ে কোনরকমে বলতে পারল, আমি এলাম!

৪১. ভোর বেলায় অনিমেষ ফিরে এল

ভোর বেলায় অনিমেষ ফিরে এল বাড়িতে। আজ জুলিয়েনের ওখানে খুব জরুরী আলোচনা ছিল। ডুয়ার্সের বিভিন্ন প্রান্তের কয়েকজন মানুষ উপস্থিত ছিলেন। অনিমেষ যখন জানাল যে সে জলপাইগুড়িতে পাকাঁপাকি থেকে যাচ্ছে তখন জুলিয়েনের আগ্রহে আলোচনায় অংশ নিতে অনুরোধ জানাল সবাই।

এখানে এসে অনিমেষ কয়েকটি তথ্য জানল। পুলিস এখনও ওদের ওপর লক্ষ্য রাখছে। বামফ্রন্ট চাইছে না তারা সক্রিয় হোক। আন্দোলনের সময় যারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে পা বাড়িয়েছিল তাদের অনেকেই এখন ছিটকে গেছে নানান দিকে। ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে অনেক দলে বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে সবাই। বেশীরভাগই বসে গিয়েছে এবং বাকিদের মধ্যে মিলনের সম্ভাবনা প্রায় অসম্ভব। অথচ দেশে এখন বিপরীত হাওয়া গোপনে বইছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামফ্রন্ট জিতেছে কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় তাদের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। যদিও সংগঠনশক্তি এবং জনসাধারণের ওপর প্রভাব বামফ্রন্টের এখনও অম্লান তবু আর একটি জিনিস চোখে পড়ছে। বিভিন্ন কলেজের ছাত্র ইউনিয়ন হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে বামফ্রন্ট সমর্থনপুষ্ট সংস্থার। সেখানে ছাত্র পরিষদ বিজয়ী হয়ে চলেছে। অর্থাৎ, দেশের শিক্ষিত যুবকরা বামফ্রন্টের বদলে ছাত্র পরিষদ তথা কংগ্রেসকে সমর্থন করছে। একথা ঠিক যখন কংগ্রেস ক্ষমতায় শক্ত হয়ে বসেছিল তখন কলেজগুলোয় ছাত্র ফেডারেশনের আধিপত্য ছিল। তার পরিণতিতেই এক সময় কংগ্রেসকে নিবার্চনে গো-হারা হতে হয়েছে। বর্তমানে কংগ্রেসের ওপরতলার নেতাদের চেহারা এবং চরিত্র দেখে জনসাধারণের উৎসাহিত হবার কোন কারণ নেই। তা সত্ত্বেও ছাত্র ইউনিয়নগুলো ছাত্র পরিষদের দখলে চলে যাচ্ছে। এটা থেকেই বোঝা যায় দেশে বামফ্রন্ট বিরোধী চোরাস্রোত বইছে। অতএব এটাই উপযুক্ত সময় মানুষকে সঙ্গী করার। এ একজন মানুষ, একটি গ্রাম। একজন মানুষ যদি একটি গ্রামের মানুষকে স্পষ্টভাবে বোঝাতে পারে ক্যুনিজমের আসল সংজ্ঞা এবং তার প্রয়োগে কি সাফল্য আসে তাহলে সত্তরে যা সম্ভব হয়নি তা আসতে বাধ্য। কাল সারারাত জুলিয়েন এই সংক্রান্ত পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা শুনল। প্রথমে তার মনে হয়েছিল, যারা একসময় সশস্ত্র বিপ্লবের কথা ভাবত, বন্দুকের নলকেই শক্তির উৎস বলে জানতো তাদের চিন্তাধারায় কত পরিবর্তন হয়েছে! কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার এই পরিবর্তনটাকে ভাল লেগে গেল। ভোর বেলায় বাড়ি ফেরার সময় অনিমেষ খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। যেন অনেকদিন বেকার হয়ে থাকার পর একটা মনের মত কাজ পেয়ে গেছে সে এরকম বোধ হচ্ছিল। পঙ্গু, পরনির্ভর জীবন থেকে মুক্তির একটা পথ দেখতে পেয়ে সে খুশি হল। জুলিয়েনের সঙ্গে কাজ করলে তার শারীরিক অসুবিধেগুলো বাধা হয়ে দাঁড়াবে না এটাই বড় কথা। আলোচনায় এমন বুঁদ হয়েছিল অনিমেষ যে কিছুক্ষণ তার মাথায় একটু আগের ঘটনা নিষ্ক্রিয় হয়েছিল। মাধবীলতা চলে যাবে, অর্ক তার জন্মবৃত্তান্ত জেনে গেছে, এই ভয়াবহ সত্য বাড়ি ফেরার পথে তার মাথায় ফিরে এল। ঘোলাটে অন্ধকার মাখা তিস্তার চরের শেষে দাঁড়িয়ে অনিমেষের বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠল। কিন্তু যে কষ্টটা প্রথম রাত্রে বুকের মধ্যে আহত হয়ে ছটফট করছিল তার সাড় যেন অনেকটা কমে এসেছিল। অনিমেষ ধীরে ধীরে যখন বাড়ির কাছে পৌঁছাল তখন আকাশের কোণে লালচে ছোপ লেগেছে।

সারাটা রাত নিঘুমে কেটেছিল মাধবীলতার। প্রায়ই সমস্ত শরীর থরথরিয়ে কাঁপছিল এবং সেই সঙ্গে বমি। মায়ের এই অবস্থা দেখে অর্ক ভীষণ নাভার্স হয়ে পড়েছিল। মাধবীলতা মাথা নেড়েছিল, তুই শুয়ে পড়, আমাকে একটু একা থাকতে দে। দুহাতে মুখ ঢেকে মাধবীলতা বসে ছিল।

রাতটা কখন বরফের মত ধীরে ধীরে গলে গেল ওরা কেউ টের পায়নি। ঘুমুতে পারেনি অর্ক। প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছিল তার অথচ কি করা উচিত তাও বুঝে উঠতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত কেমন থিতিয়ে গেল সে। ছোটঘরে শুয়ে শুয়ে জীবনে প্রথমবার আবিষ্কার করল দুচোখে ঘুম আজ স্বাভাবিকভাবে নেমে এল না। চোখের দুটো পাতা যে কখনও কখনও শুকনো হয় এই প্রথম সে টের পেল।

গেটের বাঁধন খুলে বাগানে পা দেওয়ামাত্র অনিমেষ দেখতে পেল বারান্দার কোণে কেউ দাঁড়িয়ে। তার প্রথমে মনে হয়েছিল মাধবীলতার কথা। এক লহমায় মনের মধ্যে প্রতিরোধশক্তি জন্মাতেই সে ভুলটা বুঝতে পারল। সাদা কাপড়ে মোড়া শরীরটা ধীরে ধীরে বাগানে নেমে এল। টগর গাছের বিরাট ঝোঁপটার পাশে এসে বলল, অনি, তোমার সঙ্গে কথা আছে।

অনিমেষ ছোটমার মুখের দিকে তাকাল। সাদাটে কপাল, গাল এবং টেপা ঠোঁটে এখন ছোটমাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। ছোটমা একবার আড়চোখে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন, তোমাকে আমি যে অনুরোধ করব তা রাখবে?

অনুরোধ? অনিমেষ কিছুই বুঝতে পারছিল না। এই ভোরে ছোটমা এভাবে অপেক্ষা করবেন, গাছের আড়ালে এসে তাকে অনুরোধ জানাবেন নরম গলায়, কেন?

হ্যাঁ।

তুমি, তুমি ওদের সঙ্গে কলকাতায় ফিরে যাও।

ফিরে যাব?

হ্যাঁ। আমি চাই তুমি ফিরে যাও।

অনিমেষ হতভম্ব হয়ে গেল এবার। আজ বিকেলে যাঁরা তাকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেছিল, যাঁদের অসহায় অবস্থা দেখে সে থেকে যেতে চেয়েছে তাঁদেরই একজন তাকে চলে যেতে বলছে। এবং তৎক্ষণাৎ মনে হল কাল রাত্রে মাধবীলতার সঙ্গে তার যে কথা হয়েছে সেগুলো নিশ্চয়ই ছোটমার কানে গিয়েছে। না, সেসব কথা মাধবীলতা নিশ্চয়ই ছোটমাকে সাতসকালে বলতে যায়নি, ছোটমাই আড়াল থেকে শুনেছেন! একটু বিরক্তি এল মনে, আড়িপাতা সে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। কিন্তু তারপরেই যে কথাটা ভেবে সে সংযত হল তা ছোটমার দিকে তাকিয়েই। মানুষ কখন এমন উদার হতে পারে?

ছোটমা স্পষ্ট গলায় বললেন, তোমার চলে যাওয়া উচিত।

কেন?

কারণ তুমি জানো। কাউকে দুঃখ দিয়ে জীবনে সুখী হওয়া যায় না।

কাউকে দুঃখ দিচ্ছি তা জানলে কি করে?

ছেলেমানুষী করো না। এই বাড়িতে রাত্রে নিচু গলায় কথা না বললে সব ঘরে শব্দ পৌঁছায়। ছোটমা মুখ নামালেন।

অনিমেষ মাথা নাড়ল। হ্যাঁ, তাই। এই বাড়ির এটাই ত্রুটি। রাত বাড়লে শব্দ গম গম করে। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, তুমি সব শুনেছ?

হ্যাঁ। আমি সারারাত ঘুমুতে পারিনি। মেয়েটা তোমাকে সত্যিই ভালবাসে। ওকে আর কষ্ট দিও না।

কিন্তু আমি তো কোন অন্যায় করিনি। আমি এখানে থাকতে চেয়েছি। এতে তার কোন আপত্তি নেই শুধু আগেভাগে অনুমতি নিইনি বলে। এত সামান্য কারণে কেউ যদি অপমানিত বোধ করে তাহলে একসঙ্গে থাকা খুব মুশকিল ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।

সামান্য কারণ? অনি, তুমি জীবনে বোধহয় অনেক অভিজ্ঞতা পেয়েছ কিন্তু মেয়েদের মন বোঝনি। যা তোমার কাছে সামান্য মনে হচ্ছে একটি মেয়ে তার জন্যে জীবন দিয়ে দিতে পারে।

কিন্তু আমি চলে গেলে তোমাদের কি হবে?

কিছু একটা হবে! এতদিন যখন সে কথা ভাবোনি আজ নতুন করে তা নাইবা ভাবলে।

তাহলে তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছ?

ছোটমা সহসা মুখ তুললেন। তাঁর শুকনো মুখে কিছু একটা চলকে উঠল। অনিমেষ দেখল, কোত্থেকে একটা চোরা জলের স্রোত চোখের পাতায় টৈটুম্বুর হয়ে উঠল। ছোটমা বললেন, তুমি কখনও কাউকে ভালবেসেছ অনিমেষ? বাসনি। কিন্তু তোমার কি ভাগ্য, শুধু ভালবাসা পেয়েই গেলে তাই তার দাম বুঝতে পারলে না। পারলে আজ আমাকে এই প্রশ্ন করতে না। আমার দিকে তাকিয়ে দ্যাখো, আমি জীবনে কি পেয়েছি?

অনিমেষ ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, আমি জানি।

কিছুই জানো না তুমি। ছিটকে বেরুলো শব্দগুলো, তোমার বাবার সঙ্গে চিরকাল ভাসুর-ভাদ্রবউ হয়ে রয়ে গেছি, তা তুমি জানো? তুমি চলে যাও, দয়া করে চলে যাও। ছোটমা বেরিয়ে আসা কান্নাটাকে গিলতে গিলতে বাগান ডিঙ্গিয়ে ছোট বাড়ির খিড়কি দরজার দিকে দ্রুত পায়ে চলে গেলেন। অনিমেষ অসাড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার মাথার প্রতিটি কোষ যেন নিষ্ক্রিয়, দৃষ্টিশক্তি ঝাঁপসা। অনেক অনেক বছর আগের একটি দৃশ্য আজ হঠাৎ ছিটকে উঠে এল সামনে। স্বৰ্গছেঁড়ায় পাশ করার পর দেখা করতে গিয়েছে তরুণ অনিমেষ। কলকাতার কলেজে পড়তে যাওয়া স্থির। ছোটমা ছিলেন চা বাগানের এক বিয়েবাড়িতে। তাঁর পাশাপাশি বেরিয়ে এসেছিল সে। বিরাট মাঠ ডিঙ্গিয়ে, স্বর্ণচাঁপার গাছের নিচ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ ছোটমা তার হাতে একটা সোনার আংটি পরিয়ে দিয়েছিলেন। আংটির ওপর লেখা ছিল, অ। সেদিন সেই প্রাপ্তিতে শিহরিত হয়েছিল সে। ছোটমার মাথায় মাথায় তখন। ছোটমা বলেছিলেন অ শব্দটার মানে না।

আজ এই কচি কলাপাতা রঙের রোদ যখন সুপুরি গাছের মাথা থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ার উপক্রম করছে তখন অনিমেষের মনে হল তার জীবনের সব কিছুই না হয়ে গেল। সেই আংটিটাকে কোথায় ফেলেছে আজ আর মনে নেই। হয়তো আন্দোলনের সময়, কিংবা জেলে, এখন আর স্মৃতিতে নেই কোথায় সেটা হারিয়েছে। কিন্তু একটা বিশাল না তার সামনে ঈশ্বর কুঁদে দিয়েছেন নির্মম হাতে।

কে ওখানে? অ্যাঁ, কে ওটা?

অনিমেষ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল হেমলতা বাগানে। পায়ে শিশির কিংবা কাঁটা থেকে বাঁচবার জন্যে যে ছেঁড়া কাপড়ের জুতো সেটা বোধহয় সরিশেখরের ফেলে যাওয়া। ডান হাতে বাঁকানো লাঠি আর বাঁ হাতে ফুলের সাজি। গন্ধরাজ গাছের সামনে দাঁড়িয়ে এদিকে মুখ করে চোখ পিটপিট করছেন। অনিমেষ বলল, আমি।

অ, অনি। কখন উঠেছিস? তারপর ফোকলা মুখে একগাল হেসে বললেন, স্কুলে পড়তে দাদু তোকে কাকভোরে বিছানা থেকে ডেকে তুলতো, মনে আছে? তুই যেতেই চাইতিস না। তা এই সাতসকালে উঠে বাগানে কি করছিস? কথা বলতে বলতে হেমলতা লাঠি উচিয়ে গন্ধরাজের মগডালটাকে নিচে নামিয়ে একটা ফুল ছিঁড়ে সাজিতে রাখলেন।

অনিমেষ বলল, ঘুম আসছিল না তাই।

নিশ্চয়ই বায়ু হয়েছে পেটে। আমার তো বাবা জলপাইগুড়িতে এসে একদিনও অম্বল ছাড়া গেল। এমন বিচ্ছিরি জল স্বৰ্গছেঁড়াতে ছিল না। বাবাকে বলতাম বাড়ি বানাবার আর জায়গা পেলেন না? কাশী বৃন্দাবন না হোক দেওঘরে বাড়ি করলে শরীরটা নষ্ট হতো না। কি হল বাড়ি করে, কদিন পরে দেখবি রাস্তার লোক দখল করে নেবে এসব। হেমলতা মুখ বিকৃত করলেন, সকালে উঠে আর পারি না। হাঁটু কনকন করে আর চোঁয়া চেঁকুর ওঠে। চোখেও দেখি না ভাল করে, এই যে তুই দাঁড়িয়েছিলি আমি চিনতেই পারিনি। তুই তো অনেক ঘুরেছিস, সব জায়গায় মেয়েরা দেরিতে মরে রে?

অনিমেষ হাসল। সকাল বেলায় এই প্রথম তার একটু হালকা লাগল। তারপর ক্রাচে ভর দিয়ে সে হেমলতার কাছে এগিয়ে এল। হেমলতা বললেন, দেখিস, ছুঁয়ে ফেলিস না আবার।

অনিমেষ বলল, দিনরাত মরার কথা বল অথচ এই বাতিকগুলো গেল না।

হেমলতা বললেন, তুই এসব বুঝবি কি! নাস্তিক কোথাকার। যারা মানুষ খুন করে তাদের কোন বোধ থাকে না।

বোধ শব্দটি হেমলতার মুখে অদ্ভুত শোনাল অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আমি মানুষ খুন করেছি তা কে বলল?

শুনেছি, সব শুনেছি। তবে তোর বউটা খুব ভাল। বড় ভাল মেয়ে। এই সাতসকালে উনুন ধরিয়ে চা করতে বসে গেছে। তা হ্যাঁরে, মেয়েটার কলকাতায় একা থাকতে অসুবিধে হবে না তো?

অনিমেষের কপালে ভাঁজ পড়ল। কাল রাত্রের ওই কথাবার্তার পর মাধবীলতা আজ সকালে উনুন ধরিয়ে চা করছে? তাহলে কি গতরাত্রের ঘটনা শুধু উত্তেজনার ফসল? আজ সকালে সেটা কমে যেতেই, অনিমেষ আরও হালকা হল। শুধু অর্কর কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেল এই যা। ভালই হল, যা সত্যি তা ছেলেটার জানা উচিত।

কি রে হাঁ করে আকাশের দিকে চেয়ে আছিস কেন?

হেমলতার গলা শুনে অনিমেষের সংবিৎ ফিরল, অসুবিধে হবে কিনা তা ওকে জিজ্ঞাসা করলে হতো না?

জিজ্ঞাসা করেছিলাম। বলল, মোটেই হবে না। ছেলে বড় হয়েছে এখন আর কোন চিন্তা নেই। কিন্তু তুই ওর জন্যে একটা চাকরির খোঁজ কর এখানে।

কখন জিজ্ঞাসা করেছিলে?

এই তো একটু আগে।

অনিমেষ গম্ভীর হয়ে গেল। মাধবীলতা যেন ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে বিদ্ধ করতে চাইছে। এই সময় হেমলতা প্রফুল্ল মনে বললেন, তুই এ বাড়িতে থাকবি জানলে পরিতোষ মাথার চুল ছিড়বে। ভেবেছিল তোরা চলে গেলেই এসে হাজির হবে। খবরদার ওর কাঁদুনিতে কান দিবি না।

অনিমেষ অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ল, আচ্ছা পিসীমা, আমি যদি এখানে না থাকি তাহলে তোমার খুব অসুবিধে হবে?

হেমলতা যেন চমকে উঠলেন, ওমা, একি কথা! তুই যে বললি থাকবি!

অনিমেষ দেখল হেমলতার মুখ পলকেই শুকিয়ে আমসি হয়ে গিয়েছে। কি অসহায় দেখাচ্ছে ওঁকে। সে হাসবার চেষ্টা করল, বলেছিলাম, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমি এখানে থাকি তা অনেকে চায় না।

হেমলতা যেন ঘোরের মধ্যে অনিমেষের পাশে এসে দাঁড়ালেন। ছোঁওয়াছুঁয়ির বিচার ভুল হয়ে গেল তাঁর। অনিমেষের কনুই-এ হাত রেখে অসহায় গলায় বললেন, অন্য লোক যাই বলুক তুই। আমার জন্যে থাক অনিবাবা। আমি তো কখনও তোর কাছ থেকে কিছু চাইনি। বেশীদিন বাঁচবো না রে, প্রায়ই মনে হয় এই শরীরটা থেকে আমি বেরিয়ে যাচ্ছি, দেরি নেই আর। ততদিন তুই কাছে থাক।

অনিমেষ হেমলতার শীর্ণ মুখের কুঁচকে যাওয়া চামড়ায় জলের ফোঁটা গড়িয়ে যেতে দেখল। অনিবাবা শব্দটা যেন হঠাৎ তার দুটো পাকে দীর্ঘতর করে মাটির অনেক গভীরে প্রোথিত করে গেল। হেমলতার ব্যাকুল দৃষ্টির সামনে সে মাথা নাড়ল, থাকব।

হেমলতার যেন বিশ্বাস হল না, ঠিক বলছিস? একবার ভাল মুখে বল।

অনিমেষ হেসে ফেলল, বললাম তো থাকব।

চা।

বারান্দায় কখন মাধবীলতা এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি ওরা। অনিমেষ দেখল মাধবীলতার হাতের কাপ থেকে ধোঁয়া উড়ছে। হেমলতা ততক্ষণে আবার সহজ হয়ে গিয়েছেন। বললেন, ওমা, ওখান থেকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছ কেন? ওকে না হাঁটিয়ে এখানে এসে দিয়ে যাও না। বাগানে দাঁড়িয়ে খাক।

মাধবীলতা সিঁড়ি ভেঙ্গে অনিমেষের হাতে যখন কাপ ধরিয়ে দিল তখন হেমলতা বললেন, তোমার বেশীদিন কলকাতায় থাকা চলবে না। এখানে যদি চাকরি হয় তাহলে চটপট চলে আসবে। বুঝলে?

মাধবীলতা কোন উত্তর না দিয়ে ফিরে গিয়ে সিঁড়িতে উঠে দাঁড়াল। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে অনিমেষের মনে হচ্ছিল এই মেয়েকে সে চেনে না। ওর বুকের ভেতর একটা বল যেন আচমকা ড্রপ খেতে খেতে গড়িয়ে যাচ্ছিল। চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার কথা খেয়ালে নেই, অনিমেষ প্রচণ্ড চেষ্টায় নিজেকে সামলাচ্ছিল। মাধবীলতা যেন একটু ইতস্তত করল তারপর নিচু গলায় হেমলতাকে। বলল, পিসীমা, আজকে আমরা চলে যাব।

হেমলতা আঁতকে উঠলেন, ওমা, আজকেই?

হ্যাঁ। দিনের ট্রেন তো রোজ রোজ ছাড়ে না। তাছাড়া রাত্রের ট্রেনে রিজার্ভেশন না থাকলে ওঠা মুশকিল। আমার ছুটি আর একদম নেই। মাধবীলতার কণ্ঠস্বর খুবই বিনীত এবং অসহায় শোনাচ্ছিল।

দিনের ট্রেন কটায়। তোমাদের তো শিলিগুড়িতে যেতে হবে। হেমলতা অনিমেষের দিকে তাকালেন, হ্যাঁ রে, এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে?

অনিমেষ কিছু বলল না। তার কথা বলতে ভয় করছিল। হঠাৎ যেন বুকের ভেতরটা কালবৈশাখীতে ছেয়ে গেছে। সে মুখ ফিরিয়ে নিল।

মাধবীলতা বলল, আমি খোকাকে পাঠাচ্ছি স্টেশনে। যদি এখান থেকে টিকিট পাওয়া যায় তো ভাল নইলে কখন ট্রেন ছাড়বে জেনে আসবে। কথাগুলো কার উদ্দেশ্যে বলা বোঝা গেল না। কিন্তু আর দাঁড়াল না মাধবীলতা, ধীরে ধীরে বারান্দা পেরিয়ে ভেতরে চলে গেল।

হেমলতা ফুল তুলতে লাগলেন নিজের মনে। অনিমেষ সিঁড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে বারান্দায় উঠে এসে চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিল। মুখ হাত ধোওয়া হয়নি, কাল সারারাত না ঘুমিয়ে এখন ঝিম ঝিম করছে সমস্ত শরীর। অথচ চোখের পাতায় ঘুমের চিহ্নমাত্র নেই। এখন রোদ নেমে এসেছে ঘাসে। শিশির দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে। এই ভোরবেলায় একটা কাক গেটের ওপর বসে প্রাণপণে চিৎকার করে যাচ্ছে। অনিমেষের ইচ্ছে করছিল এক দৌড়ে মাধবীলতার কাছে যায়, তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলে, যেতে দেব না তোমাকে। এই মুহূর্তে অনেক যুক্তি তর্ক ছাড়িয়ে শুধু এটুকুই মনে হচ্ছে মাধবীলতাকে যেতে দেওয়া উচিত হবে না।

ঠিক তখনই ভেতর থেকে অর্ক বেরিয়ে এল। বাইরে যাওয়ার পোশাক পরনে। চুপচাপ নেমে গেল বারান্দা দিয়ে। তারপর গেট খুলে এমুখো হল বন্ধ করতে। অনিমেষ দেখল ছেলের ঠোঁট শক্ত। উড়ে যাওয়া কাকটার দিকেও নজর করল না। অর্ক যে তার সঙ্গে কথা বলছে না লক্ষ্য করে অনিমেষ অসহায়ের মত জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাচ্ছিস?

অর্ক যেন এরকম প্রশ্নের জন্যে তৈরি ছিল। চোখ না তুলে জবাব দিল, স্টেশনে।

তারপর তার শরীরটা আড়ালে চলে গেল। অনিমেষ পাথরের মত বসেছিল। ভীষণ নির্জীব মনে হচ্ছিল নিজেকে। দুহাতে মুখ ঢাকল সে। এবং সেই অবস্থায় নিজের শরীরের সমস্ত কম্পনকে সে সংযত করতে চাইল। কেউ যদি চলে যেতে চায় তাহলে সে কেন খামোকা বাধা দেবে? যা সহজ যা স্বাভাবিক তাই মেনে নেওয়া ভাল। শোক আঁকড়ে যারা বসে থাকে তাদের মানুষ বলে।

দুটো ক্রাচ বগলে নিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। তারপর বড় ঘর পেরিয়ে সে শোওয়ার ঘরে এল। মাধবীলতা নেই। তোয়ালে এবং ব্রাশ নিয়ে সে বাথরুমে চলে এল। মহীতোষ মারা যাওয়ার পর এদিকের বাথরুমটা তারা ব্যবহার করছে। ফলে আর ওঠানামা কিংবা ভেতরের বাগান পার হওয়া করতে হচ্ছে না তাকে। মুখে হাতে জল দিতে শরীরটায় স্বস্তি এল। এখন আর এক কাপ চা পেলে ভাল হত। কিন্তু কে দেবে?

নিজের ঘরে ফিরে এসে অনিমেষ খাটে বসল। তারপর লক্ষ্য করল জিনিসপত্র এর মধ্যেই গোছানো হয়ে গেছে। সেদিকে তাকিয়ে ক্রমশ নিজেকে উদাস করে ফেলছিল সে। আর তার পরেই মাধবীলতা ঘরে এল। এসে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি আর এক কাপ চা খাবে?

হ্যাঁ বলতে গিয়ে অনিমেষ মাথা নাড়ল, দরকার নেই।

আমরা যে সুটকেসটা এনেছি, ওটাই নিয়ে যেতে হচ্ছে।

ঠিক আছে। আমার তো লাগছে না এখন। অনিমেষ খুব নিস্পৃহ ভঙ্গীতে বলল।

মাধবীলতা জিনিসপত্র ঠিকঠাক করতে করতে নিচু গলায় বলল, আমাদের যা লাগবে সেটুকু নিয়ে বাকিটা ওই টেবিলে রেখে গেলাম।

অনিমেষ বুঝতে পারেনি প্রথমটা, জিজ্ঞাসা করল, কি?

যে টাকাটা এনেছিলাম তার কিছুটা এখনও রয়ে গেছে।

ও। অনিমেষ হাসল, ওটা তুমি নিয়ে যাও। আমার দরকার হবে না। মাধবীলতা একটু স্থির হল, তারপর বলল, ঠিক আছে।

অনিমেষ বলল, জানি না কখন ট্রেন তবে মনে হচ্ছে কে যেন বলেছিল দুপুরের দিকে ছাড়ে, রাত্রেই হাওড়া পৌঁছে যায়। সাবধানে যেও।

মাধবীলতা কোন জবাব দিল না। অনিমেষের ব্যবহৃত তোয়ালেটা নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে! অনিমেষ শুয়ে পড়ল এবার। এতক্ষণ তারা এই ঘরে কিছু অর্থহীন কথা বলেছে এটা স্পষ্ট। অথচ এই কথাগুলো না বললে আবহাওয়াটা আরও ভারী হয়ে যেত। চোখ বন্ধ করল অনিমেষ।

না, সে কিছুতেই হারবে না। মাধবীলতা যদি সত্যি সত্যি ওই মানসিকতায় পৌঁছে যায় তাহলে সে নিশ্চয়ই অভিনয় করতে পারবে। অনিমেষের শরীরে একটা কনকনে স্রোত উঠে আসছিল। সে সেটাকে চাপা দেবার জন্যেই বোধহয়, উপুড় হয়ে শুলো।

সরিৎশেখরের সেই সাধের বাড়ির চারপাশে যে ফুল আর ফলের গাছ তার ডালে বসে তখন নানানরকম পাখি নিজেদের সুরে ডেকে যাচ্ছে। মৃদু হাওয়ায় দোল খাচ্ছে গাছের ডালগুলো।

.

ট্রেনটা ছাড়বে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে সকাল সাড়ে দশটায়। টিকিট পাওয়া যাবে সেখান থেকেই। জলপাইগুড়ি থেকে সাড়ে আটটার ট্রেন না ধরলে মুশকিলে পড়তে হবে। কারণ সব বাস নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে যায় না।

অর্ক এসে এই সব খবর দিল যখন তখন আর হাতে বেশী সময় নেই। মাধবীলতার স্নান হয়ে গিয়েছিল। হেমলতা এবং ছোটমা বড় ঘরে এসে দাঁড়িয়েছেন। ছোটমাকে এখন অত্যন্ত নির্লিপ্ত দেখাচ্ছে। কথা বলছেন হেমলতা। অনর্গল বক বক করে যাচ্ছেন। সাবধানে থাকতে হবে, ছেলে যাতে মন দিয়ে পড়াশুনা করে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ছুটিছাটা হলেই যেন চলে আসে আর প্রত্যেক সপ্তাহে মনে করে চিঠি যেন দেয় মাধবীলতা।

অর্ক রিকশা ডাকতে গিয়েছে। ওরা তিনজন বারান্দায় দাঁড়িয়ে। একটু পেছনে অনিমেষ, মাধবীলতার পেছনে। এত চেনা এত জানা অথচ আজ কিছু করার নেই। হেমলতা আফসোস করছিলেন, একটু আগে জানলে ওদের ট্রেনে খাওয়ার ব্যবস্থা বাড়ি থেকেই করে দিতে পারতেন। মাধবীলতা কোন কথা বলছিল না। হঠাৎ ছোটমা মাধবীলতাকে ডাকল, শোন, তোমার সঙ্গে কথা আছে।

মাধবীলতা অবাক চোখে তাকাল। তারপর ছোটমাকে অনুসরণ করে ভেতরের ঘরে গিয়ে বলল, বলুন।

ছোটমা ওর চোখে চোখ রেখে বললেন, আমি অনিমেষকে চলে যেতে বলেছিলাম।

মাধবীলতা বুঝতে পারছিল না ছোটমা কি বলতে চাইছেন। সে নিচু গলায় বলল, ও এখানে থাকলে আপনাদের সুবিধে হবে।

ছোটমা এবার মাধবীলতার হাত ধরলেন, তুমি ওর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করো না। মানুষমাত্রেই ভুল বোঝাবুঝি হয়। তাছাড়া অনিমেষ চিরকালই এইরকম, কেমন শেকড়ছাড়া। তুমি ভুল বুঝো না।

মাধবীলতা কোন কথা বলল না।

ছোটমা আবার বললেন, তুমি ওর জন্যে এত করেছ, আর একটু করতে পারবে না?

এই সময় হেমলতা বাইরে থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন, রিকশা এসে গিয়েছে।

মাধবীলতা চট করে ছোটমাকে প্রণাম করে বাইরে চলে এল। তারপর নিচু হয়ে হেমলতাকে প্রণাম করতেই তিনি ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন, বাড়ির বউ হয়ে তুমি মা দূরে দূরে রইলে!

অর্ক জিনিসপত্র রিকশায় তুলে বলল, আর সময় নেই মা।

অনিমেষ যে কখন বাগানে নেমে এসেছে সে নিজেই জানে না। অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল, তুই একটা রিকশা ডেকে এনেছিস?

অর্ক মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। মাধবীলতা অন্যরকম স্বরে বলল, সবাইকে প্রণাম কর খোকা।

৪২. অর্কর প্রণাম করা শেষ হলে

অর্কর প্রণাম করা শেষ হলে মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল,আর একটা রিকশার কি দরকার? প্রশ্নটা অনিমেষের মুখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে নয়।

অনিমেষ বলল, আমি ভেবেছিলাম স্টেশনে যাব।

সঙ্গে সঙ্গে হেমলতা বারান্দা থেকে বলে উঠলেন, না, না, খোঁড়া মানুষ, রিকশায় ওঠাওঠি করে অদূর যেতে হবে না।

মাধবীলতা এবার অনিমেষের দিকে তাকাল। এই সময় ছোটমা বললেন, গেলে কিন্তু ভাল হত। ওরা এখানকার পথ-ঘাট চেনে না ভাল করে। অনি তো রিকশায় এর আগেও উঠেছে।

মাধবীলতা অর্ককে বলল, তুই এগিয়ে যা। আর একটা রিকশা ডাক।

অর্কর যে ব্যবস্থাটা মনঃপূত হল না তা বোঝা গেল, কিন্তু খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে মা। যদি ট্রেন না পাও–।

মাধবীলতা আস্তে করে বলল, ঠিক আছে।

গায়ে একটা জামা গলিয়ে অনিমেষ গেট ছাড়িয়ে রিকশার কাছে এসে বলল, আমায় একটু ধরো তো ভাই।

রিকশাঅলা ক্রাচ দুটো টেনে নিচ্ছিল, মাধবীলতা পিছন থেকে বলল, ওভাবে নয়, তুমি ওর পেছনটা ধর।

রিকশায় বসে অনিমেষ বলল, এই ওঠার ব্যাপারটা যদি পারতাম তাহলে কোন অসুবিধে থাকত না আমার।

মাধবীলতা বারান্দার দিকে মুখ করে বলল, এলাম। দুটো গলা প্রায় একই সঙ্গে উচ্চারণ করল, এসো।

মাধবীলতা আর দাঁড়াল না। এবং অনিমেষকে খানিকটা অবাক করে এগিয়ে গেল অর্ককে অনুসরণ করে। রিকশায় অনিমেষ একা বসে, পায়ের তলায় ওদের জিনিসপত্র। অনিমেষ লক্ষ্য করল আজ মাধবীলতার মাথায় সেই অর্থে ঘোমটা নেই। আঁচলটা খোঁপার ওপর কোনক্রমে রয়ে গেছে মাত্র। অনিমেষের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল মাধবীলতাকে ডাকে। তার পাশে পর্যাপ্ত জায়গা আছে অতএব হেঁটে যাওয়ার কোন মানে হয় না। কিন্তু সেই মুহূর্তেই অর্ক দূর থেকে চেঁচাল, মা, রিকশা পেয়ে গেছি!

অতএব দুটো রিকশা পর পর ছুটল স্টেশনে। কিছুটা অভিমান, কিছুটা অপমান বোধ আবার কিছুটা ক্রোধ অনিমেষকে পীড়িত করছিল। তার মনে হচ্ছিল মাধবীলতাকে একা পেলে সে বুঝিয়ে সুঝিয়ে হয় তো নরম করতে পারত কিন্তু অর্কর জন্যেই সেটা সম্ভব হচ্ছে না। কাল রাত্রের পর থেকে ছেলেটা এমন ব্যবহার করছে যা অন্য সময় হলে সহ্য করত না অনিমেষ। আর এখন, নিজেকে এমন অসহায় লাগছে যে- অনিমেষ মাথা নাড়ল। না, এখন কোন ঝগড়াঝাঁটির সময় নয়। যা স্বাভাবিক তাকে সহজভাবে মেনে নেওয়াই ভাল।

মালপত্র প্লাটফর্মে নামিয়ে অর্ক টিকিট কাটতে গেল। বেশ ভিড় প্লাটফর্মে। অফিসযাত্রীরা উপচে পড়ছে। জলপাইগুড়ি থেকে শিলিগুড়ি ডেইলি প্যাসেঞ্জারি চালু হয়েছে খুব। শেষ পর্যন্ত অনিমেষ বলে ফেলল, তুমি এমন নিষ্ঠুর হয়ো না।

মাধবীলতা অন্যমনস্ক হয়ে মানুষ দেখছিল। এবার চমকে মুখ ফেরাতেই অনিমেষ ওর চোখ দেখতে পেল। মাধবীলতা কিছু বলতে গেল কিন্তু হঠাৎ ওর ঠোঁট কেঁপে উঠল আর দুই চোখের কোণে চোরা জল বাসা বাঁধল। অনিমেষের খুব ইচ্ছে করছিল ওই জল মুছিয়ে দেয়। কতদিন, কতদিন মাধবীলতাকে জড়িয়ে ধরে আদর করেনি। কতদিন আকণ্ঠ চুম্বন করেনি! ওই শরীরে মুখ ডুবিয়ে নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ অনুভব করেনি! আর এখন, এই স্টেশনে দাঁড়িয়ে এই সব ইচ্ছেগুলো একসঙ্গে অনিমেষের মনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঠিক এখনই একটি বিস্ময়সূচক শব্দ উচ্চারিত হল পাশ থেকে, অনিমেষ না?

অনিমেষ মুখ ফিরিয়ে দেখল।

কি রে শালা চিনতে পারছিস না? কবে এসেছিস গুরু? আই বাপ, তোর পায়ে কি হল? ওহহ, বুঝেছি।

চেহারাটা একটুও বদলায়নি। অথচ প্রায় বাইশ বছর পার হয়ে গেছে এর মধ্যে। সেই কোঁকড়া চুলের কায়দা, ভেঙেচুরে দাঁড়ানো আর ঠোঁটে বদমায়েসী হাসি ঝুলিয়ে মন্টু হাসছে। জলপাইগুড়ি শহরে অনিমেষের স্কুল জীবনে যে কজন বন্ধু ছিল মন্টু তার অন্যতম। যাবতীয় জ্ঞানবৃক্ষের ফল সে খেয়েছিল এর মারফৎ। অনিমেষের ওকে দেখে অবশ্যই খুশি হওয়া উচিত ছিল কিন্তু এই সময়টায় সে কাউকেই সহ্য করতে পারছিল না। তবু হাসতে হল, কেমন আছিস?

ফাইন! মন্টু চেঁচিয়ে উঠল, এটা কি জেলে হয়েছে? আঙ্গুল নেড়ে অনিমেষের পা দেখাল মন্টু।

ফালতু। কোন মানে হয় না। তোকে কে মাথার দিব্যি দিয়েছিল নকশাল হতে? কি লাভ হল বল? যাক, কবে এসেছিস?

কিছুদিন হল।

বাঃ, এসে একবার দেখাও করিসনি! আমার বউকে মাইরি তোর সেই গল্পটা করতাম। বিরাম করের বউটা তোকে। হো হো করে হেসে উঠল মন্টু। অনিমেষ দেখল এই বয়সেও মন্টুর মধ্যে তরল ভাবটা অটুট থেকে গিয়েছে। ওকে চাপা দেওয়ার জন্যে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, স্টেশনে কেন? কোথাও যাচ্ছিস নাকি?মরিকায় ফিরে

মন্টু খুব কায়দা করে দাঁড়াল। এই বয়সে সেটা খুব বেমানান দেখাচ্ছে। পনের ষোল বছরে দেবানন্দকে যে নকল করত সে চল্লিশ পেরিয়েও তা ধরে রেখেছে। হয়তো অভ্যেস হয়ে গিয়েছে, যা করছে নিজের অজান্তেই করছে। তবে মোটা হয়ে গেলেও ভুড়ি হয়নি বলে বাঁচোয়া। মন্টু একটা হাত পেটের ওপর রাখল, এই ধান্দায় রোজ স্টেশনে আসতে হয়। তোদের মত রাজনীতি করলে আর দেখতে হতো না। রোজ সকালের ট্রেন ধরে এন জে পি যাই আবার সন্ধ্যের ট্রেনে ফিরে আসি। আজকে শালা লেট করছে খুব। একটু বিরক্ত চোখে মন্টু হলদিবাড়ির দিকে তাকাল।

তুই কোথায় কাজ করছিস? কোন ডিপার্টমেন্টে? কি কি

রেলে। ইণ্ডিয়ান রেইলওয়ে। তুই কোথায় যাচ্ছিস?

আমি যাচ্ছি না।

এই সময় অর্ক একটু বিব্রত ভঙ্গীতে এসে দাঁড়াল, মা, রিজার্ভেশন ছাড়া এরা টিকিট ইস্যু করে না। আমি এন জে পি পর্যন্ত টিকিট করেছি। অনেকে বলছে এই ট্রেনে গেলে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ধরা যাবে না।

মন্টু মাথা নাড়ল, কে বলেছে ভাই? গুজবে কান দিও না। বোধ হয় একদিন মাত্র ওরকম ঘটনা ঘটেছিল। এরা কে রে অনিমেষ?

মাধবীলতা ততক্ষণে সামলে নিয়েছে। লোকটাকে তার বিন্দুমাত্র পছন্দ হয়নি। যে বয়সে যা মানায় তা না হলে বড় দৃষ্টিকটু দেখায়। এখন প্রশ্নটা শুনে সে অনিমেষকে দেখল। অনিমেষ বলল, বউ আর ছেলে।

তাই নাকি? মন্টু উৎফুল্ল হল, নমস্কার, নমস্কার। আমার নাম মন্টু, অনিমেষের সঙ্গে পড়তাম। কোথায় চললেন?

মাধবীলতা যতটা সম্ভব সহজ ভঙ্গীতে বলল, কলকাতায়।

টিকিটের কথা শুনছিলাম, রিজার্ভেশন নেই?

মাধবীলতা মাথা নাড়ল। মন্টু হাত নাড়ল, কোই ফিকির নেহি। যখন পরিচয় হয়ে গেল তখন ও দায়িত্ব আমার। কাঞ্চনজঙ্ঘায় আপনাদের বসিয়ে তবে আমি ছুটি নেব। কিন্তু হারে, তোর এত বড় ছেলে কি করে হল? বিয়ে করেছিস কবে?

অনিমেষ অস্বস্তিটা এড়াবার জন্যে পাল্টা প্রশ্ন করল, কেন, তুই তো বউ-এর কথা বলছিস, ছেলে মেয়ে নেই?

সেটাই তো ভাবছি। আমার মেয়ের বয়স দশ। তোমার বয়স কত হে, কুড়ি? প্রশ্নটা সরাসরি অর্ককে।

হঠাৎ অর্কর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। সে মন্টুর দিকে তাকিয়ে বলল, বয়স জেনে আপনার কি হবে? প্রশ্নটা কানে যাওয়া মাত্র অনিমেষ অবাক হয়ে তাকাল। মাধবীলতাও মুখ তুলে ছেলেকে দেখল। মন্টু কিন্তু মোটেই অপ্রস্তুত হয়নি, খুব পার্সোনালিটি আছে তোর ছেলের, ভাল ভাল। যাক, ট্রেনটা এসে গিয়েছে।

দূরে শব্দ হচ্ছিল বটে কিন্তু তার আগে আকাশের গায়ে কালো ধোঁওয়া সবার চোখে পড়ল। প্লাটফর্মে হুড়মুড় করে মানুষজন ছোটাছুটি করছে। মন্টু মাধবীলতাকে বলল, ব্যস্ত হবার দরকার নেই। জেনারেল কম্পার্টমেন্টে আপনারা উঠতে পারবেন না। সবাই উঠুক তার পর আমরা গার্ডের গাড়িতে উঠব।

অনিমেষ বলল, গার্ডের গাড়িতে উঠতে দেবে?

মন্টু কাঁধ নাচাল, ডোন্ট ফরগেট, আমি রেলের লোক।

ট্রেনটা প্লাটফর্মে দাঁড়ানো মাত্র ঝড় বয়ে গেল। ছুটোছুটি ধাক্কাধাক্কির শেষে গোটা প্লাটফর্মটা ট্রেনের গায়ে ঝুলে পড়ল। মন্টুর নির্দেশে ওরা গার্ডের কামরার কাছে চলে এল। সেখানেও কিছু লোক উঠেছে কিন্তু তবু স্বস্তিকর।

মন্টু গার্ডের সঙ্গে কথা বলে অর্ককে ইঙ্গিত করল জিনিসপত্র তুলতে। সেগুলো নিয়ে অর্ক ওপরে উঠলে অনিমেষ চাপা গলায় মাধবীলতাকে বলল, চিঠি দিলে উত্তর দেবে তো?

মাধবীলতা আবার তাকাল। তার পর বলল, কি দরকার!

অনিমেষ প্রচণ্ড আবেগ নিয়ে জবাব দিল, দরকার আছে, আমি তোমাকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছি না। ছোটখাটো ত্রুটিকে এত বড় করে দেখো না। আমরা পরস্পরকে ছাড়া অসহায় হয়ে পড়ব। আমি এখানে রইলাম। তুমি যদি না পার তাহলে ডেকো। আর পিসীমা যদ্দিন বেঁচে আছেন তদ্দিন আমাকে না পার ওঁকে চিঠি লিখো। অন্তত এরা জানুক আমাদের সম্পর্ক অটুট।

তোমার কথাবার্তা পরস্পর বিরোধী হয়ে যাচ্ছে।

সেটা অনিমেষ নিজেও বুঝছিল। কিন্তু এই দ্রুত গলে যাওয়া সময়টায় সে যে করেই হোক মাধবীলতাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছিল। এই সময় অর্ক ডাকল, মা, তাড়াতাড়ি উঠে এস, গাড়ি ছাড়ছে।

মাধবীলতা মুখ তুলল, চলি, সাবধানে থেকো।

তুমি কিছুই বললে না!

কি বলব!

এই সময় ঠং ঠুং শব্দ উঠল। ঘণ্টা বাজছে ট্রেন ছাড়ার নির্দেশ দিয়ে।

তুমি এইভাবে চলে যাবে?

আমাকে তো যেতেই হবে। যাওয়াটা এর চাইতে আর কিভাবে সহজ হত!

মাধবীলতা ধীরে ধীরে ওপরে উঠতেই ঝরঝরে ট্রেনটা ছেড়ে দিল। জানলা দিয়ে মুখ বাড়াল মন্টু, তুই চিন্তা করিস না, ওদের আমি কাঞ্চনজঙ্ঘায় বসিয়ে দেব।

অনিমেষ উন্মুখ হয়ে কম্পার্টমেন্টের দরজার দিকে তাকাল। না, মাধবীলতাকে আর দেখা গেল।, এমন কি অর্কও জানলায় এল না। দু’তিন পা এগিয়েও সে ওদের দেখতে পাচ্ছিল না। ট্রেনটা গতি বাড়িয়ে প্লাটফর্ম ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে। সামনের আকাশটা ধোঁওয়ায় কালো। হঠাৎ অনিমেষের বুকের ভেতর থেকে আর একটা দৃশ্য উঠে এল। তখন সন্ধ্যেবেলা। সে ট্রেনের দরজায়। সরিশেখর চলন্ত ট্রেনের পাশাপাশি লাঠি দুলিয়ে হাঁটছেন। ধীরে ধীরে গভীর অন্ধকার তাঁকে গ্রাস। করে নিল। অনেক দূরে একটি আলোকিত স্টেশনকে রেখে সে অন্ধকারে ডুবে গেল।

আজ, অনেক অনেকদিন বাদে প্লাটফর্মের শেষ প্রান্তে এসে অনিমেষ কেঁদে ফেলল। এই প্রথম, নিজেকে প্রচণ্ড নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছিল।

.

মন্টুর কল্যাণে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে চমৎকার জায়গা পেয়ে গেল ওরা। আসাম থেকে আসা একটা ট্রেন দেরি করায় কাঞ্চনজঙ্ঘা সময়ে ছাড়েনি। বিশেষ ঋতু ছাড়া এই ট্রেনে তেমন ভিড় হয় না। কিন্তু ওভারব্রিজ পেরিয়ে টিকিট কিনে আনা, রিজার্ভেশন পাওয়ার জন্যে যা ঝামেলা তা মন্টুই করে দিয়ে জানলার পাশে ওদের জায়গা করে দিয়ে বলল, এবার আমি চলি।

মাধবীলতা বলল, আপনি অনেক করলেন!

আরে এ সব তো নস্যি। আপনি জানেন না অনিমেষ আর আমি ছেলেবেলায় কি-রকম বন্ধু ছিলাম। এখন তো আপনি জলপাইগুড়ির বউ হয়েছেন, নিশ্চয়ই আবার দেখা হবে।

লোকটার চেহারা এবং ব্যবহারের চাপল্যের সঙ্গে আসল লোকটাকে ঠিক মেলানো যায় না। মাধবীলতা নিঃশ্বাস ফেলল, অনিমেষের মুখে মন্টু সম্পর্কিত অনেক ঘটনা সে শুনেছে। বেপরোয়া দুঃসাহসী ছেলে। কিন্তু এখন সে এমন ভঙ্গী করে ছিল যেন মন্টু মামটা প্রথম শুনছে। একমাত্র মানুষই পারে নিজের দুটো চেহারাকে আলাদা রাখতে।

রোদ মাথায় নিয়ে ট্রেনটা ছাড়ল। অর্ক জানলার পাশে। ছেলে যে সকাল থেকেই অত্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া কথা বলছে না সেটা লক্ষ্য করেছিল মাধবীলতা। তার নিজেরও কথা বলতে একটুও ইচ্ছে করছে না। সে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিল। কি হল, এই জীবনটায় কিছুই হল না। কেন এত কষ্ট করা, কেন নিজেকে নিংড়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা? কোন মানে হয় না। এ দেশে মেয়েদের উচিত যা স্বাভাবিক সেই স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়া। এখানে ব্যতিক্রম হওয়ার চেষ্টা মানে পরিণামে নিঃসঙ্গতা, বুকভরা নিঃস্বতা। মাধবীলতার সমস্ত শরীরে কাঁপুনি এল। যেন একটা ঢেউ এসে তাকে শূন্যে তুলে দূরে ছুঁড়ে দিচ্ছে এবং পরক্ষণেই আর একটা ঢেউ সেখান থেকে তুলে আরও দূরে ছুঁড়ে দিচ্ছে। আর সে ঠিক একটা জড়পদার্থের মত সেই ঢেউ-এর কাছে আত্মসমর্পণ করে চলেছে। নিজের শরীরের কিংবা মনের এই অস্থিরতার বিরুদ্ধে সে জোর করে শক্ত হতে, চাইল। পরিণতি নেতিবাচক হলেই কাজটা ভুল হয়ে যাবে? না, কোন ভুল করেনি সে। সারা জীবনে যা করেছে নিজে জেনে শুনে করেছে। একটা জীবন আর কত বড়? যাকে সে ভালবেসেছিল তাকে তো দশ বছর নিবিড় করে পেয়েছে। তাই বা ক’জন পায়? এটাই তার জয়। নয়? গত রাত্রে তো সে নিজে মরেও যেতে পারত!

ঢেউটা যেন সামান্য জোর হারালো কিন্তু মাধবীলতা বুঝতে পারছিল এটা স্তোকমাত্র। তার শরীর ভারী হয়ে আসছিল এবং মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল। কাল রাত্রে সে কি খুব সামান্য কারণে। পাগল হয়ে গিয়েছিল? যেটাকে তখন অপমান বলে মনে হয়েছিল সেটা কি সত্যি অপমান? এতটা ক্রোধ প্রকাশ না করলেও কি চলতো? অনিমেষ তাকে কোনরকম কটু কথা শোনায়নি। বারংবার আত্মসমর্পণ করার চেষ্টা করেছে। দৃশ্যটা মনে পড়া মাত্র ওর শরীরে জ্বলুনি ফিরে এল। একটা পুরুষ মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়েও যদি আত্মসমর্পণ করে তাহলে– বরং তখন যদি অনিমেষ বলতো সে ঠিক কাজ করেছে, যা করেছে ভাল মনে করে করেছে এবং মাধবীলতাকে তাই মেনে নিতে হবে তাহলে হয়তো সে নিজে আত্মসমর্পণ করত। সে কি মনে মনে চাইছিল না অনিমেষ সত্যিকারের পুরুষ। মানুষ হয়ে উঠুক? যাক, যা হবার তা হয়েছে। এখন সে কি করবে? কলকাতায় সে আর অর্ক। তার সারা দিন রাত কাটাবে কি করে? মাধবীলতা হেসে ফেলল নিজের মনে যদিও তার কোন ছায়া। ঠোঁটে পড়ল না। অনিমেষ থাকতে তার কিভাবে দিন কাটতো? সারা বছরে কদিন ভালবাসার কথা বলতো তারা? কদিন সুন্দর জিনিস দেখতে বের হতো দু’জনে? মাধবীলতা মাথা নাড়ল। একটা মেয়ের জন্ম শুধু একটি পুরুষের কাছে নতজানু হবার জন্যে এ কখনই হতে পারে না। এখন সে যা। স্বাভাবিক তাই করবে। একমাত্র অর্ক ছাড়া কারো কাছে দায়বদ্ধ নয় সে। মাধবীলতার চোখের কোল ভিজছিল। অনেক কষ্টে সে নিজেকে সংযত করল। এতসব ভাবনা চিন্তা তাকে অনেকটা ঢেউ-এর বিরুদ্ধে হেঁটে আসতে সাহায্য করলেও হঠাৎ আর একটা চোরা স্রোত আচমকা পায়ের তলার বালি সরাল। এতদিনের সব পরিশ্রম এবং মন সে নিজের হাতেই নিঃশেষ করে এল? এক। ঝটকায় মাধবীলতা সোজা হয়ে বসল। না, সে ঠিক করেছে। অনিমেষ ছাড়া তার জীবনে অন্য কোন পুরুষের অস্তিত্ব নেই, তাই বলে সে অনিমেষের ক্রীতদাস হয়ে থাকতে পারে না।

খানা চাহিয়ে?

প্রশ্নটা শুনে অর্ক মুখ ফেরাল। মাধবীলতা তখন চোখ খুলেছে। কিন্তু খুব শক্ত এবং কিঞ্চিত ফোলা লাগছে মুখ। অর্ক লোকটাকে জিজ্ঞাসা করল, কি খাবার?

ফিস চিকেন আউর আণ্ডা রাইস।

কত দাম? লোকটা উত্তর দেবার আগে মাধবীলতা বলল, একটা মাছভাত আর, তোমরা নিরামিষ দাও না?

লোকটা মাথা নাড়ল, হ, ভেজ মিলেগা।

তাহলে আমাকে নিরামিষ দিও।

একটা কাগজে অর্ডার লিখে নিয়ে লোকটা চলে যেতে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, তুমি নিরামিষ খাচ্ছ কেন?

মাধবীলতা মাথাটা আবার হেলিয়ে দিল, ট্রেনে মাছ মাংস খেতে ভাল লাগে না।

অর্ক মুখ ফিরিয়ে নিল। মায়ের কাছে কত টাকা আছে তা তার জানা নেই। স্টেশনে অনেককে পুরি তরকারি খেতে দেখেছে সে, তাই খেয়ে নিলে হত। মাছ-ভাতের দাম কত কে জানে! সে বাইরে তাকাল। প্রখর রোদের মধ্যে মাঠ ঘাট জঙ্গল পিছনে ছুটে ছুটে যাচ্ছে। আকাশে একটুকরো সাদা মেঘ পর্যন্ত নেই। এরকম ঝলসানো রোদে তাকিয়ে সুখ নেই। ওদের ঠিক উল্টো দিকে একটি মহিলা শিশুকোলে বসে ছিলেন। তার পাশে বেশ বয়স্ক পুরুষ। বাচ্চাটা নিঃশব্দে পড়ে রয়েছে। এরা কি মা বাবা আর ছেলে? লোকটাকে বউটার স্বামী বলে মনে হয় না কিন্তু কথাবার্তায় অন্যকিছু কল্পনা করা যায় না। সে ট্রেনের অন্য যাত্রীদের দিকে তাকাল। এই ট্রেনে শোওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। মাঝখান দিয়ে প্যাসেজ রয়েছে এ কামরা ও কামরায় যাওয়ার। তাই যাত্রীদের হাঁটাচলার বিরাম নেই। অর্ক আবার মায়ের দিকে তাকাল। পাথরের মত মুখ, চোখ বন্ধ এবং কি ভীষণ সাদা দেখাচ্ছে। এই চেহারায় সে কোনদিন মাকে দ্যাখেনি। মা নিরামিষ খেতে চাইল। কেন? মা কি নিজেকে বিধবা ভাবছে? শব্দটা মনে আসতেই সে ঠোঁট কামড়াল। তোমার বাবার নাম কি? না, আর সে অনিমেষ মিত্র বলতে পারবে না। এই পৃথিবীতে তার কোন আইনসম্মত বাবা নেই। চমৎকার! এতদিন ধরে যাকে সে বাবা বলে ভেবেছিল এবং জেনেছিল আজ বলা হল তিনি তার জন্মদাতা মাত্র, বাবা নন। আর এ ব্যাপারে তার কিছু করার নেই। যদি বলা হত তিনি তার জন্মদাতাও নন তাহলেও তার করার কিছু ছিল না। কিন্তু মায়ের অস্তিত্ব তো অস্বীকার করা যাবে না। এইটেই পরম সত্যি। তার জন্মাবার পর কয়েক বছর মা দু’দিক আগলে ছিল। এই কয় বছর একজন বাবার ভূমিকা নিয়ে ছিলেন এখন আর নেই। অন্তত আইনের চোখে নেই। শুধু আইনের চোখে, তার নিজের কাছে? আজ যদি সে ঝুমকির সঙ্গে বাস করে এবং সন্তান হয় তাহলে তাদের সবাই মেনে নেবে?

আবার ক্ষরণ শুরু হল অর্কর। এই সময় সামনের বউটা নাকিসুরে কিছু বলে উঠতেই লোকটা চাপা গলায় ধমকালো, চোপ! কথা বলবে না একদম।

অর্ক লোকটার দিকে তাকাল। রোগা পটকা শরীর কিন্তু তেজ খুব। বাচ্চাটা যদি ওর হয় তাহলে সে জানল না তার মাকে ধমক খেতে হচ্ছে। সে হঠাৎ মাধবীলতার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, তোমার মন খুব খারাপ, না?

মাধবীলতা যেন সামান্য চমকালো। তার পর চোখ না খুলে বলল, কই, না তো।

তোমাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে।

কাল রাত্রে ঘুম হয়নি তাই হয়তো।

তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? মাধবীলতা সামান্য সময় নিল, বল।

তোমরা বিয়ে করোনি কেন?

মাধবীলতার চিবুক বুকের ওপর নেমে আসছিল কিন্তু সে কোনক্রমে সোজা হল, সে অনেক কথা, তুই ঠিক বুঝবি না।

তুমি আমাকে ছেলেমানুষ ভেবো না।

এবার মাধবীলতা অর্কর দিকে তাকাল। এবং অত্যন্ত দ্রুত সে মন ঠিক করে নিল। না, আর লুকোছাপা করে কোন লাভ নেই। অর্ক সত্যিই বড় হয়ে গিয়েছে! বাকি জীবনটা যদি একসঙ্গে থাকতে হয় তাহলে আর ওর সঙ্গে আড়াল রাখার কোন মানে হয় না। সে যেন নিজের সঙ্গে কথা বলল, তখন ওর রাজনীতি আমাদের বিয়ে করার সময় দেয়নি। যখন সময় হল তখন তুই এসে গেছিস। মা হওয়ার পর, তোকে নিয়ে অত কষ্ট করার পর নতুন করে বিয়ে করতে চাইনি আমি।

কেন?

আমি ভেবেছিলাম দু’জন মানুষের মনের বন্ধন বিয়ের চেয়ে বড়।

সেটা কি ভুল?

তা জানি না।

কিন্তু তোমরা বিবাহিত হলে আমি জানতাম উনি আমার বাবা। এখন তুমি বলছ বলে আমি জানছি। তাই না?

কি বলতে চাইছিস তুই? মাধবীলতার গলার স্বরে ধার এল।

কাল রাত্রে তোমরা আমাকে বাস্টার্ড বলেছিলে!

মাধবীলতা চট করে অর্কর হাত ধরল, খোকা!

অর্ক মাথা নাড়ল, না মা, তার জন্যে আমি তোমাকে দোষ দিচ্ছি না। মোক্ষবুড়ি দুনিয়াসুদ্ধ লোককে বেজন্মা বলে গালাগাল দিত। তাতে কার কি এসে যায়। তবে কি জানো, এক পুরুষের ভুলের দায় পরের পুরুষের ওপর চেপে বসে। বাস্টার্ড মানে তো বেজন্মা?

মাধবীলতা দিশেহারা হয়ে পড়ছিল। ও বুঝতে পারছিল এ ছেলে ভীষণ পাল্টে গিয়েছে। এমন। ভঙ্গীতে এত ভারী কথা তার চেনা অর্ক কখনও বলত না। কিন্তু সে প্রাণপণে চাইছিল পরিস্থিতির সামাল দিতে। এখনই যদি অর্ককে না ফেরানো যায় তাহলে পরে আর কিছুই করার থাকবে না। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, তুই আমার ছেলে।

অর্ক দেখল সামনের লোকটা মাধবীলতার দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু তারা যে গলায় কথা বলছে তাতে ওর কানে নিশ্চয়ই পোঁছাচ্ছে না। ট্রেনের চাকার শব্দ অনেকটা আড়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে বলল, কিন্তু আমার বাবা–।

মাধবীলতা যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে বলল, বেজন্মা মানে যাদের কোন শেকড় নেই, কারো কাছে কোন দায় নেই। কোনরকম ন্যায় নীতি বা মূল্যবোধ ছাড়া মানুষকে বেজন্মা বলে। তারা খুব ভীষণ, তুই কি তাই?

অর্ক চমকে উঠে মাধবীলতার দিকে তাকাল। যাদের বাবা মায়ের ঠিক নেই তাদের তো কারো কাছে দায় থাকে না। বাপ মায়ের স্নেহ যে পায়নি তার মনে কারো প্রতি টান আসার কথা নয়। শেকড়হীন হয়ে সে বেঁচে থাকে। নীতিবোধ কিংবা মূল্যবোধ তার কাছে ফালতু। মা যে সংজ্ঞা বলল সেই সংজ্ঞার সত্যতা তার কাছে স্পষ্ট হল।

আর তখনই গাদা গাদা মুখ তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। খুরকি কিলা, কোয়া বিল থেকে শুরু করে শ্মশানের সেই মাস্তানটা। কিংবা ন্যাড়া। কারো কোন দায় নেই কারো কাছে। শুধু এরা? নুকু ঘোষ কিংবা বিলাস সোম? তাদের কি দায় আছে সমাজের কাছে? কোন নীতিবোধে তারা বিশ্বাস করে? কিলা খুরকি যেমন নিজের লাভটুকু গোছাবার জন্যে খুর চালায় পেটো ছোঁড়ে ওরাও তেমন নিজের পজিশন রাখার ধান্দায় ঘুরে বেড়ায়। এমন কি সতীশদা, সতীশদাও যখন প্রতিবাদ করে ধমক খায় তখন মুখ বুজে সহ্য করে। তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেনের মানুষগুলো আজ সমস্ত কলকাতায় ছড়িয়ে গেছে। এই জলপাইগুড়ি শহরটাও তার ছোঁওয়া থেকে বাঁচতে পারেনি। নুকু ঘোষ, সতীশদা আর বিলাস সোমরা তাদের ব্যবহার করছে স্বার্থ নিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে সেই ছেলেটার মুখ ভাসল যে ট্রামে ঊর্মিমালাকে বেইজ্জত করতে চেয়েছিল। অর্ক মাথা নাড়ল, ঠিক বলেছ মা, ঠিক। তার পর মুখ তুলে কামরার লোকগুলোকে দেখল। ওর নিজের বয়সী ছেলেগুলোর চুল, পোশাক, চাহনি যেন সব একরকম। মায়ের সংজ্ঞায় বাস্টার্ডরা যেমন হয়।

৪৩. দুপুর থেকেই আকাশটা পিচকালো

দুপুর থেকেই আকাশটা পিচকালো, একটুও হাওয়া নেই। দূরের জিনিস দেখার মত আলো নেই পৃথিবীতে। থম ধরে আছে চারধার। অনিমেষ এই বিশাল বাড়িটায় ছটফট করছিল। আজ দুপুরে নিরামিষ খাওয়া হয়েছে। সে ব্যাপারে তার কোন অসুবিধে নেই। কিন্তু তারপরেই দমবন্ধ করা নির্জনতা। সামান্য শব্দ হলেই এই বাড়ির ভেতরে সেটা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ফিরে আসে। ঘরের মধ্যে বসে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছিল বলে সে বাড়ির পেছন দিকটায় এসে দাঁড়াল। এদিকের দরজাটা বড় একটা ভোলা হয় না। বিরাট আম গাছের নিচে এখন হাঁটুসমান আগাছা। অন্ধকারমাখা ছায়া দিনদুপুরে সেখানে নেতিয়ে। সেদিকে তাকিয়ে অনিমেষের বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল। মনে হচ্ছিল পৃথিবীতে তার আর কেউ নেই। অন্তহীন অন্ধকারে সে একা। এই গাছপালা এই মেঘ এই ছায়ামাখা দিন, এগুলোরও জড়িয়ে মিশিয়ে যে অস্তিত্ব এবং মুহূতাঁরচনার ভূমিকা আছে সেটা তার নেই। ব্যাপারটা নিয়ে অনিমেষ আর ভাবতেই পারছিল না। তার মস্তিষ্ক অসাড় এবং শরীর স্থির হয়ে ছিল। এখন চোখ বন্ধ করলেই সে মাধবীলতার মুখ দেখতে পায়। অথচ আশ্চর্য, অর্ক তাকে টানছে না! ক’দিনে অর্কর মুখ তার তেমন মনে আসেনি। যতবারই নিজের কথা ভেবেছে ততবার মাধবীলতা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

অনিমেষ কিছুতেই বুঝে উঠতে পারল না কেন মাধবীলতা এরকম ব্যবহার করেছে। যে কারণ দেখিয়ে সব ছেড়ে ছুঁড়ে চলে গেল সেটা কি আদৌ কোন কারণ? অনিমেষের স্বভাবচরিত্র তো তার চেয়ে আর কেউ ভাল জানে না। হয়তো সে বোঝার মত তার কাঁধে চেপেছিল কিন্তু ওই কারণে সেই বোঝা ছুঁড়ে ফেলার কি যুক্তি থাকতে পারে? তার কেবলই মনে হচ্ছিল, অন্য কোন কারণ আছে যা সে জানে না। ৪ মাধবীলতা চলে যাওয়ার পর কটা দিন বেশ কেটে গেল। সে তো দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারল শুয়ে বসে। খুব প্রয়োজন ছাড়া ছোটমা তার সঙ্গে কথা বলেন না। কি দ্রুত নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন এবং এখন নিজেকে নিয়েই থাকেন। হেমলতা ঠাকুরঘর এবং রান্নাঘর করে যে সময়টুকু কোনক্রমে পান সেটুকু অনিমেষের কাছে এসে খরচ করেন। প্রায় ধরা বাঁধা সেই কথাগুলো। প্রথমে কিছুক্ষণ সরিৎশেখরের বিরুদ্ধে নালিশ। তিনি যেসব অবিবেচক সিদ্ধান্ত নিয়ে মারা গিয়েছেন তার বিরুদ্ধে জেহাদ। তারপর ঈশ্বরকে কোতল করেন তিনি। রাজ্যের অভিযোগ জড়ো করে বলেন ভগবানকে পেলে তিনি দেখিয়ে দিতেন মজা এই যন্ত্রণা দেবার জন্যে। তারপরেই ওঁর সুর পাল্টে যায়। মাধবীলতার প্রশংসায় চলে আসেন তিনি। অমন ভাল মেয়ে নাকি হয় না। কি সুন্দর বউ। এই এক কথা শুনতে শুনতে অনিমেষ ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। অথচ মুখে কিছু বলার উপায় নেই। যাওয়ার আগের রাত্রে মাধবীলতার সঙ্গে তার যেসব কথা হয়েছে তা চিরকাল এদের কাছে লুকিয়ে রাখতে হবে।

দরজা বন্ধ করে অনিমেষ আবার বাড়ির ভেতরে ফিরে এল। তারপর জামা পাল্টে ভেতরের বারান্দায় গিয়ে ডাকল, পিসীমা, পিসীমা।

হেমলতা সাড়া দিলেন না। এটাও ওঁর একটা অভ্যেস। ইদানীং মাঝে মাঝে তিনি নীরব হয়ে থাকেন। যেন বোবামানুষ। তখন দশটা প্রশ্ন করলেও সাড়া পাওয়া যায় না। আবার কথা বলতে শুরু করলে থামতে চান না। তৃতীয়বার ডাকার পর ছোটমা বেরিয়ে এলেন। ছোটমা এখন পুরোনো বাড়িটায় শুচ্ছেন। বোধহয় পিসীমার কাছাকাছি থাকার প্রয়াস। এই নতুন বড় বাড়িটায় অনিমেষ একা।

অনিমেষ ছোটমার মুখের দিকে তাকিয়ে থিতিয়ে গেল। খুব সাদা এবং রোগা দেখাচ্ছে মুখ। কাপড়ে সামান্য রঙ নেই। এত সাদা সহ্য করা যায় না। ছোটমাকে কদিন থেকেই তো দেখছে, কিন্তু এমন নিঃসঙ্গ এবং সিরসিরে অনুভূতি আর কখনও হয়নি। শরীরে মেদ নেই তো বটেই যেন মাংসও ঝরে গেছে।

কিছু বলছ?

হ্যাঁ। আমি একটু বেরুচ্ছি। দরজাটা বন্ধ করে দিতে হবে।

ছোটমা আকাশের দিকে তাকালেন, এইসময় কেউ বের হয়?

ঠিক আছে। অনিমেষ যেন আর আলোচনায় যেতে চাইল না।

ছাতাটা নিয়ে যাও।

ছাতা ধরার জন্যে আমার কোন হাত নেই। অনিমেষ হাসল। তারপর বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এল। গেট খুলে গলিতে পা দিয়ে তার মনে হল এখন কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। নেহাতই বাড়িতে ভাল লাগছিল না বলেই সে বেরিয়েছে। জুলিয়েন দিন দুয়েক আগে মালবাজারে গিয়েছে। ক’দিন থেকে নাকি শহরে একটা চাপা উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। জুলিয়েনদের ডেরাটার ওপর নাকি পুলিসের নজর পড়েছে। সোনার দোকানে ডাকাতির ব্যাপারটাকে কেন্দ্র করেই এই উত্তেজনা। শহরের মানুষের বিশ্বাস এরকম দিনদুপুরে ডাকাতি নাকি সাধারণ ডাকাতদের কর্ম নয়। খবরের কাগজে যেসব নকশালদের কথা পাওয়া যায় এ তাদেরই কীর্তি। জুলিয়েন বলেছিল, দেখুন আমরা কিরকম নাম কিনেছি, কেউ কোন গুণ্ডামি ডাকাতি করলেই দোষটা আমাদের ওপর সরাসরি চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। নকশাল মানেই যেন ডাকাত। সাবধানের মার নেই তাই জুলিয়েনের ছেলেরা ওই কাঠের বাড়িতে বা নদীর চরে এখন থাকছে না। এ ব্যাপারে অনিমেষ অবশ্য জুলিয়েনকে সতর্ক করেছিল। দিন তিনেক আগে থানা থেকে লোক এসেছিল এখানে। অনেক পুলিস দেখেছে। অনিমেষ, কিন্তু এরকম নিরীহ, এবং ভদ্র পুলিস কখনও চোখে পড়েনি। মাস ছয়েক বাকি আছে। ভদ্রলোকের অবসর নেবার। ধুতি পাঞ্জাবি পরে টাক মাথার মানুষটি সেদিন বিকেলে বাড়িতে এসে বললেন, এই বাড়িতে মাধবীলতা মিত্র থাকেন?

অনিমেষ বারান্দার চেয়ারে বসেছিল। মাধবীলতার নাম শুনে চমকে উঠেছিল। তখনও পৌঁছানোর সংবাদ আসার সময় হয়নি। সে একটু দুর্বল গলায় জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি?

আমি? আমি মশাই পুলিসে চাকরি করি। অবনী রায়।

পুলিসের লোকের মাধবীলতাকে কি দরকার ভাবতে গিয়েই ওই ডাকাতির কথাটা মনে পড়ল। মাধবীলতা বলেছিল পুলিস হয়তো ওর খোঁজে এখানে আসতে পারে। তা এতদিনে কেউ যখন কোন খোঁজ খবর করেনি তখন ধরে নেওয়া গিয়েছিল ওটা চাপা পড়ে গিয়েছে। মফস্বলে ডাকাতির তদন্ত কতটা করা হয় তাতে সন্দেহ আছে। অনিমেষ নিশ্চিন্ত ছিল মাধবীলতার তেমন কিছুই হারায়নি। আংটিটা ফেরত এসেছে এবং ছোটমার গয়নার জন্যে ন্যায্যমূল্যের বেশী টাকা পাওয়া গিয়েছে। অতএব এই ডাকাতি নিয়ে কোন চিন্তা মাথায় ঠাঁই পায়নি। মাধবীলতারা চলে যাওয়ার পর সে চমকে উঠেছিল। জামার পকেটে একটা ভারী সোনার হার অনিমেষ আবিষ্কার করেছিল। এই হার তার মায়ের, মহীতোষ নতুন বউএর মুখ দেখেছিলেন সেদিন ওই হার দিয়ে। মাধবীলতা যাওয়ার আগে সেটা তার পকেটে রেখে দিয়ে গেছে নিঃশব্দে। অনিমেষ অবাক হয়নি। এটাই মাধবীলতার স্বভাব। কিন্তু হারখানার কথা এ’বাড়ির দুই মহিলাকে বলতে পারেনি অনিমেষ। সেইসময় তার মনে হয়েছিল আর একটা কথা। গয়না বন্ধক রাখবার সময় মাধবীলতা ওই দামী হারটা নিয়ে যায়নি। মহীতোষের আশীর্বাদী গয়না কিংবা অনিমেষের মায়ের স্মৃতিটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিল। একবারও মুখে পর্যন্ত ওই গয়নার কথা তোলেনি। যাওয়ার সময় সেটাই সে রেখে গেল অনিমেষের পকেটে। আগের রাত্রে যে সম্পর্কটাকে নিষ্ঠুর হাতে ছিন্ন করল পরের সকালে সে বিরাট অনাসক্তি দেখাল। সারাটা দিন অনিমেষ মুহ্যমান ছিল। শেষ পর্যন্ত সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, অন্য কোন মেয়ে হলে এটা ভাবার এবং সমীহ করার বিষয় হত, কিন্তু মাধবীলতা যা তাই করেছে।

পুলিসের লোক, যার নাম অবনী রায়, দাঁড়িয়েছিলেন। অনিমেষ উঠল না। দুটো হাত জড়ো করে বলল, বসুন।

অবনী রায় বসলেন। তারপর চারপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এটা তো সরিৎশেখরবাবুর বাড়ি। খুব একরোখা মানুষ ছিলেন। মাধবীলতা মিত্র তাঁর কে হন?

আমার স্ত্রী। আমি ওঁর নাতি।

আপনি? আপনি সরিৎবাবুর নাতি? নকশাল?

লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসি পেল অনিমেষের। সে বলল, ভয় পাচ্ছেন কেন? আমার দুটো পা তো আপনারা নিয়ে নিয়েছেন।

অ্যা। অবনী অনিমেষের পায়ের দিকে তাকাল, কি করে হল?

কি করে হল আপনারা জানেন না। নকশাল আমলে আপনি নিজে কটা মানুষ খুন করেছেন হিসাব রেখেছেন?

আমি? খুন? নেভার। পুলিসে চাকরি করি তাই বলে খুনী হব কেন?

ভদ্রলোকে এ চাকরি করে না মশাই, কি করে যে এতকাল ম্যানেজ করে এসেছি তা ঈশ্বরই জানেন। আর কটা মাস, তারপর। কিন্তু রিটায়ার্ড হলে আর এক জ্বালা। দুই মেয়ের এখনও বিয়ে হয়নি।

কেন, পয়সা জমাননি? প্রচুর ঘুষ পেতেন তো!

ওই তো! ঘুষ নিতে পারিনি। চাকরিতে ঢোকার সময় মা বলেছিলেন অসৎ হবি না। সেটাই মেনে এসেছি। আরে তাই আমার প্রমোশন হল না। আমার বস বলতেন, অবনী একটু রাগতে শেখ। পুরুষমানুষ না রাগলে বীর্যবান হয় না। যাক, এসব ব্যক্তিগত কথাবার্তা। আপনার স্ত্রীকে ডাকুন।

অবনী তার হাতের ফাঁইলটা খুললেন।

কি ব্যাপার বলুন তো?

ওই গয়নার দোকানে ডাকাতির ব্যাপারে ওঁকে থানায় যেতে হবে।

কেন?

বাঃ, এনকুয়ারি হবে না? কত টাকার ইনসুরেন্স ছিল জানেন?

তার সঙ্গে ওর কি সম্পর্ক?

উনি ডাকাতির সময় ওই স্পটে ছিলেন। পুলিস ওঁর কাছে একটা স্টেটমেন্ট নিয়েছে। উনি নাকি একটা কানপাশা খুইয়েছেন। সেইসব ব্যাপার আর কি? অবনী রায় হাসতে গিয়ে গম্ভীর হলেন, আচ্ছা, সেসময় ওঁর সঙ্গে যে ছেলেটি ছিল সে কে?

আমাদের ছেলে, অর্ক।

অর্ক! পার্টি করে?

দূর! ও তো শিশু। পনের ষোল বছর বয়স।

না মশাই, কারেক্ট এজটা আপনি জানেন না।

বাঃ, চমৎকার আমি বাবা হয়ে জানব না?

বাবাদের হিসাবে ভুল থাকে। এই তো, আমি আমার বড় মেয়ের বয়স অ্যাদ্দিন জানতাম বত্রিশ। পঁচিশে বিয়ে করেছিলাম, ছাব্বিশে হয়েছিল। গত সপ্তাহে স্ত্রী কোত্থেকে কুষ্ঠী করিয়ে আনলেন ছাব্বিশ। আমার হিসাব নাকি ভুল। খবরদার কাউকে যেন এসব না বলে বেড়াই। আপনি জানেন আপনার ছেলে একা তিনটে মাস্তানকে ঠেঙিয়েছে?

কি বললেন?

ওই তো। কিছুই জানেন না। আপনার দোষ নেই, আমিও জানি না। আমার মেয়েরা কোথায় কি করছে সব খবর রাখতে পারলে তো অ্যাদ্দিনে প্রমোশন পেতাম গোটা চারেক। কিন্তু মজার ব্যাপার দেখুন, ওই ছেলের সম্পর্কে আমার ফাঁইলে এইসব খবর আছে কিন্তু ও যে বিখ্যাত নকশাল নেতা অনিমেষ মিত্রের ছেলে সেটা কোথাও বলা নেই। মিসেস মিত্রকে ডাকুন।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, ওরা এখানে নেই। কলকাতায় চলে গিয়েছে।

সে কি মশাই। তদন্ত চলাকালীন সাক্ষী স্থানত্যাগ করে কি করে? শাস্তি হয়ে যাবে। কবে গেল? অবনী রায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।

আপনারা কি ওদের এখানে থাকতে বলেছিলেন?

নিশ্চয়ই বলা হয়েছিল।

আমার মনে হয় বলা হয়নি।

কি মুশকিল! ওঁদের কলকাতার ঠিকানাটা কি?

কি ব্যাপার বলুন তো? ওদের খুব প্রয়োজন?

দেখুন এসব কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। ডাকাতিটা স্বাভাবিক ডাকাতি বলে পুলিস মনে করছে না। নকশাল বলে একটা গুজব উঠেছে। আপনার ছেলের যেরকম চেহারা আর বয়স তাতে ওর পক্ষে নকশাল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তারপর যখন জানা যাবে যে অর্ক নকশালের ছেলে তখন বিশ্বাসটা আরও শক্ত হবে। তখন যে এরকম ধারণা হবে না, অর্ক ওই ডাকাতির সঙ্গে জড়িত ছিল, তা কে বলতে পারে!

কিন্তু আমার স্ত্রী ওদের বাধা দিয়েছিল।

তাই নাকি? সেটা তো এই রিপোর্টে লেখা নেই।

বাঃ, শেষ ডাকাত বের হবার সময় মাধবীলতা বাধা দিয়েছিল বলেই ওরা অনেক গয়না আর টাকা নিয়ে যেতে পারেনি। অর্ক যদি ওদের দলের লোক হবে তবে সে কেন ডাকাতের হাত ধরতে যাবে!

অনিমেষের কথা শুনে অবনী রায় হাঁ হয়ে গেলেন। তারপর রিপোর্টটা আদ্যোপান্ত পড়ে বললেন, যাচ্চলে, এসব ঘটনার কথা কিসসু লেখা নেই। দাঁড়ান, আপনি আগাগোড়া সব বলে যান তো আর একবার, আমি লিখে নিই।

অনিমেষের বলা শেষ হলে অবনী রায় কলম বন্ধ করলেন, ঠিক আছে, আমি রিপোর্টটা দিচ্ছি। কিন্তু ওঁকে পেলে ভাল হত। উনি জলপাইগুড়িতে আছেন জানলে সন্দেহটা কমত। কলকাতার ঠিকানাটা কি?

তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেন। অবশ্য কথা আছে বাড়ি বদলাবার তবু ওই ঠিকানায় মনে হয় কদিন থাকবে।

আপনি গেলেন না কেন?

আমি। অনিমেষ সোজা হয়ে বসল, গেলাম না!

অবনী রায় কি বুঝলেন তিনিই জানেন। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সত্যি কথা বলুন তো, আপনারা এই ডাকাতির সঙ্গে জড়িত কি না!

অনিমেষ হেসে ফেলল, পাগল!

অবনী রায় মাথা নাড়লেন, ঠিক আছে। আপনার স্টেটমেন্টটা আমি ভেরিফাই করছি। যদি সত্যি হয় তাহলে আমি আপনার পক্ষে আছি।

অনিমেষ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, আমার পক্ষে?

হ্যাঁ! চাকরি তো শেষ হয়ে এল। বাকি দিনগুলো সৎ থাকি। তারপর বারান্দা থেকে নেমে গেটের কাছে পৌঁছে বললেন, আমি আপনাদের পাড়াতেই উঠে এসেছি। দেখা হবে।

কোথায়? অনিমেষ ক্রাচদুটো টেনে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল।

করলা নদীর ধারে, ব্রিজটার ডান হাতে যে একতলা বাড়ি সেটাই এখন আমার আস্তানা। নমস্কার।

সেদিন অনিমেষ অনেকক্ষণ আবিষ্ট হয়েছিল। অবনী রায়ের চেহারা এবং ব্যবহার পরিচিত পুলিসদের মত নয়। তারপরেই তার মনে হয়েছিল সমস্ত ঘটনাটা মাধবীলতাকে লিখে দেওয়া দরকার। জলপাইগুড়িতে সে নিশ্চয়ই ফিরতে চাইবে না। কিন্তু আইন তাকে বাধ্য করতে পারে ফিরে আসতে। কিন্তু এভাবে সে ফিরে আসুক অনিমেষ কখনই চায় না। যদি অবনী রায়ের কোন হাত থাকে তাহলে তাঁকে অনুরোধ করলে নিশ্চয়ই রাখবেন। অনিমেষের ধারণা ছিল না অবনী রায় কিভাবে তার স্টেটমেন্ট যাচাই করবেন। কিন্তু হঠাৎ তার মনে হল মাধবীলতা কোন চিঠি না দেওয়া পর্যন্ত সে যেচে কিছু লিখবে না। কে জানে, হয়তো মাধবীলতা ভাববে অনিমেষ তাকে অকারণ ভয় দেখাচ্ছে।

আজ এই মেঘের দুপুরে টাউন ক্লাব মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে অনিমেষের মনে হল অবনী রায় সেই যে গেছেন আর এ’মুখো হননি। হাতে যখন কোন কাজ নেই, কারো সঙ্গে দেখা করার কথা মনে। পড়ছে না তখন একবার গিয়ে অবনী রায়ের খোঁজ করলে কেমন হয়! করলা নদীর ধার পর্যন্ত হেঁটে যেতে তার কোন অসুবিধে হবে না। অবনীবাবুকে যদি বুঝিয়ে বলা যায়-! অনিমেষের মনে হল মাধবীলতাকে কোন ব্যাপারে না জড়াতে দেওয়া তার কর্তব্য।

করলা নদীর দুপাশে যে ঘরবাড়ি অনিমেষ কৈশোরে দেখে গিয়েছিল এখন তার তেমন পরিবর্তন হয়নি। ছবিটা একই আছে শুধু এদিকটায় কিছু নতুন বাড়ি তৈরি হলেও সেগুলোর চেহারা এখন পুরোনোদের মতন। হয়ত প্রতি বছর নদীর জল ওদের ধুয়ে দিয়ে যায়। অনিমেষ অবনী রায়ের। বাড়িটাকে অনুমান করতে পারল। রাস্তায় একটাও মানুষ নেই। মেঘগুলো যেন আরও নিচে নেমে এসেছে। ছায়া আরও ঘন এবং তাতে অন্ধকার মিশেছে। বন্ধ বাড়ির দরজার কড়া নাড়ল অনিমেষ।

এরকম নির্জন দুপুরে এরা সবাই দরজা জানলা বন্ধ করে আছে সেটাই খুব অবাক হওয়ার মত ঘটনা। একটা পচা গন্ধ আসছে পাশের নদীর শরীর থেকে। অনিমেষ দ্বিতীয়বার কড়া নাড়তে দরজাটা খুলল। ঘরের ভেতরটা বেশ অন্ধকার তবু অনিমেষের অনুমান করতে অসুবিধা হল না মহিলা যুবতী। গলাটা বেশ কর্কশ, কি চাই? কাকে চাই?

অবনী রায়ের বাড়ি এটা?

হ্যাঁ। আপনি কে? বিন্দুমাত্র ভদ্রতাবোধ নেই, একদম চাঁচাছোলা প্রশ্ন কোন যুবতী করতে পারে তা অনিমেষের ধারণায় ছিল না। সে নিরীহ গলায় বলল, আমার নাম অনিমেষ।

বাবার সঙ্গে কি দরকার?

অনিমেষ সামান্য ইতস্তত করে বলল, উনি জানেন।

তাহলে ঘুরে আসুন। দরজাটা প্রায় বন্ধ হচ্ছিল।

অনিমেষ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, উনি বাড়িতে নেই?

আছে। একঘণ্টার আগে দেখা হবে না। স্নানটান করছে।

ও। অনিমেষ দ্বিধায় পড়ল। এই মেঘ মাথায় নিয়ে সে কোথায় যাবে! তাহলে আবার পরে কখনো আসতে হয়। এইসময় ভেতর থেকে দ্বিতীয় নারীকণ্ঠ ভেসে এল, দিদি, জেনে নে কি দরকার!

করলাম তো, বলল বাবা জানে। আচ্ছা, আপনি বসতে পারেন। ল্যাংড়া মানুষ আবার কোথায় ঘুরবেন। সুস্থ মানুষ হলে বসতে দিতাম না। দরজাটা হাট করে খুলে গেল। অনিমেষের অস্বস্তি আরও বাড়ল। এ গলায় এমনভাবে কোন মেয়ে কথা বলতে পারে? কিন্তু মেয়েটি এমন ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে যে চলে যেতে সঙ্কোচ হল। অনিমেষ ভেতরে ঢুকল। সাধারণ সাজানো ঘর। চেয়ারে বসে সে আবার মেয়েটিকে দেখল। অত্যন্ত স্বাস্থ্যবতী, মুখটা মেদবহুল, যৌবন একটু বাড়াবাড়ি রকমের। ওপাশে যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে সে ঠিক এর বিপরীত। রোগা, বড্ড রোগা কিন্তু মুখটি মিষ্টি।

বলুন কি দরকার? জেরা করার মত প্রশ্নের ধরন। পুলিসের মেয়ে হিসেবে একে চমৎকার মানায়। অনিমেষের রোখ চেপে গেল। সে কিছুতেই একে আসার কারণটা বলবে না। তার বদলে জিজ্ঞাসা করল, সুস্থ মানুষদের অপছন্দ করেন?

হ্যাঁ। জোয়ান সুস্থ মানুষ বজ্জাত হয়।

অনিমেষ ঢোক গিলল। এ কিরকম কথাবার্তা। দ্বিতীয় মেয়েটি বলল, এই দিদি! এসব বলিস না।

চুপ কর তুই। যা সত্যি তা বলতে মায়া রায়ের জিভ কাঁপে না।

অনিমেষ সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গীতে বলল, সবাই কি একরকম?

সব্বাই। মেয়েদের কাছে এক ধান্দায় আসে, সেটা ফুরিয়ে গেলেই হাওয়া হয়ে যায়। পাঁচ পাঁচবার এই অভিজ্ঞতা আমার। আপনি খোঁড়া না হলে কিছুতেই ঘরে ঢুকতে দিতাম না। ব্যাটাছেলে দেখলেই আমার মাথায় রক্ত চড়ে যায়।

অনিমেষ মুখ নিচু করল। তারপর বলল, এটা ঠিক নয়। সবাই কি একরকম হয়? আপনার বাবাকে ডেকে দিন।

বললাম তো বাবার কলে লাগবে আধঘণ্টা, খেতে আধঘণ্টা। এইজন্যেই তো বাবার প্রমোশন হল না। মা বলে, তুমি যা নিড়বিড়ে তোমার কিছু হবে না। মায়া নাম্নী মেয়েটি শেষ করা মাত্র ছোটটি দরজা থেকে বলল, এই দিদি তোকে মা ডাকছে।

ডাকুক। কি জন্যে ডাকছে জানি। সত্যি কথা সব সময় বলব! মেয়েটি এক রোখা ভঙ্গীতে একটা চেয়ারে বসতেই ভেতরের দরজায় অবনী রায় এসে দাঁড়ালেন, আরে আপনি! কি সৌভাগ্য! আমার এই পাগল মেয়েটা কি বলছে?

মায়া সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, কি? আমি পাগল? তা তো বলবেই। গলায় কাঁটা হয়ে আছি তো। দেব একদিন ওই করলায় ঝাঁপ তখন বুঝবে।

অনিমেষ সোজা হয়ে বসল, আপনাকে বিব্রত করতে এলাম।

না না কিছুমাত্র না। আমিই আজ আপনার কাছে যেতাম। একটা সুখবর আছে। আপনার স্ত্রী এবং ছেলেকে এই কেস থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওদের আর দরকার হবে না। অবনী রায় হাসতে লাগলেন।

কি রকম?

ওই আপনার স্টেটমেন্টটাই হেল্প করল। দোকানের কর্মচারী সুনীতকে বলতে সে স্বীকার করল ঘটনাটা সত্যি। তার মালিক গয়না আর টাকার কথা স্রেফ চেপে গিয়েছে। আপনারা সত্যি কথা বলে দিতে পারেন সাক্ষী হলে এটা জানার পর মালিক তদ্বির করে সাক্ষী হিসেবে আপনাদের নাম কাটিয়ে দিল। ডাকাত তো ধরা পড়বে না মনে হচ্ছে, আপনারা আর জড়ালেন না। অবশ্য আমাকে একটু ভয় দেখাতে হয়েছিল। অবনী রায় হাসলেন।

অনিমেষ নমস্কার করল, আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।

কিছু না। মানুষ যদি মানুষের মত আচরণ না করে তবে কেন আর জন্মানো! কই মা, একটু চা করো, উনি প্রথম এলেন।

অনিমেষ কিছু বলার আগেই মনে হল বাজ পড়ল। টিনের ছাদে ঝমঝম শব্দ শুরু হল। আকাশটা যেন মুহূর্তেই ধসে পড়ল মাটিতে। এত শব্দ অনিমেষ কোনদিন শোনেনি। মায়া উঠল, এই বৃষ্টিতে যেতে পারবে না বলে চা করছি। তারপর অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বলল, জানেন, আজ বন্যা হবে। সব ব্যাটাছেলেগুলো যদি বন্যায় ডুবে মরত। তারপর মুখ ফিরিয়ে ভেতরে চলে গেল।

অবনী রায় এবার কাঁচুমাচু হলেন, আপনি কিছু মনে করবেন না।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, না, না, ঠিক আছে। সে দেখল দ্বিতীয় মেয়েটিও ভেতরে চলে গিয়েছে।

অবনী রায় চেয়ারটা টেনে আনলেন অনিমেষের কাছে, এই হল আমার মেয়ে। বড় মেয়ে। মাথাটা ঠিক নেই।

বুঝতে পেরেছি।

কিন্তু বিয়ে দিতে পারছি না। কবে কোন ছেলে এসে কি করে গেছে আর মেয়ে তাই ধরে বসে আছে। পাত্রপক্ষ এলে এইসব কথা বলে। এরপর আর কেউ বিয়ে করতে চায়!

অবনী রায়ের মুখ দুমড়ে গেল।

অনিমেষ কি বলবে বুঝতে পারল না। হঠাৎ অবনী রায় বলল, আপনি কি ভগবানে বিশ্বাস করেন?

একথা কেন?

নকশালরা তো ওসব মানে না।

কি জানি। বলুন।

আমি বিশ্বাস করি। জীবনে কখনও কোন অন্যায় করিনি। আমার ভাগ্যে এমন হবে কেন? হতে পারে না। এই মেয়ে ভাল হয়ে যাবে। যাবে না, বলুন?

নিশ্চয়ই যাবে।

অবনী রায় ইতস্তত করলেন, আপনি একটু বসুন, আমি আসছি।

অনিমেষ বলল, বৃষ্টি না ধরলে-

আরে ঠিক আছে। আমি দুটো খেয়ে নিই।

অবনী রায় চলে গেলে চুপচাপ বসেছিল অনিমেষ। মেয়েটির ওপর তার একটুও রাগ হয়নি। বরং কেমন যেন কষ্ট হচ্ছে। আজ মাধবীলতা কি তার সম্পর্কে একই কথা বলতে পারে? সে প্রয়োজনে ওকে ব্যবহার করেছে এখন প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে বলে-। অনিমেষ দুহাতে মুখ ঢাকল। এই মেয়েটির যা যন্ত্রণা তা তো মাধবীলতারও হতে পারে। হঠাৎ অনিমেষের নিজেকে নতুন করে অপরাধী বলে মনে হতে লাগল। যেন এই মেয়েটির এমন আচরণের জন্যে সে-ও দায়ী।

আপনার চা।

অনিমেষ হাত সরিয়ে দেখল ছোট মেয়েটি চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। অনিমেষ কাপটা নিতেই মেয়েটি বলল, মা বলেছে আপনি যেন কিছু মনে না করেন। দিদিটা ওইরকম।

না না না ঠিক আছে। তোমার দিদি কোথায়?

জল দেখছে।

তুমি দাঁড়াও। অনিমেষ দু’চুমুকে চা-টা খেয়ে নিল। তারপর ক্রাচ নিয়ে উঠে দাঁড়াল, আমাকে ওখানে নিয়ে চল।

আপনি যাবেন? মেয়েটি অবাক হল

তোমাদের অসুবিধা হবে?

না, না। আসুন।

ভেতরের বারান্দায় পৌঁছে অনিমেষ নদীটাকে দেখতে পেল। বড় বড় জলের ফোঁটা পড়ছে নদীর ওপরে। সাদা হয়ে আছে পৃথিবীটা। মেয়েটি তাকে বারান্দার কোণে নিয়ে যেতে সে মায়াকে দেখতে পেল। অবনী রায় বোধহয় পাশের রান্নাঘরে। তাঁর স্ত্রী বোধহয় পরিবেশন করতে করতে। মুখ বাড়িয়ে অনিমেষকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন।

বারান্দাটা এল-প্যাটার্নের। অনিমেষ মায়ার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। মেয়েটা উবু হয়ে বসে জলের দিকে তাকিয়ে। শব্দ শুনে সে মুখ ফেরালো। অনিমেষ হাসল, ভাই, আমি যাচ্ছি।

আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন? ও, চা দিলাম বলে?

না, অত বকেছ তাই।

আমাকে তুমি বলছেন কেন?

বাঃ, তুমি আমার বোন। তোমাকে তুমি বলব না?

মায়া মুখ ফেরাল। তারপর অদ্ভুত গলায় বলল, জল বাড়ছে। ঠিক বন্যা হবে। আমি জানি।

এই বন্যার জলে তোমার দাদা ভেসে যাক তুমি চাও?

আমি আপনার কথা বলিনি।

ও তাই বল। তাহলে যাই।

আপনার মাথা খারাপ? এই বৃষ্টিতে যাবেন কি করে?

খোঁড়া মানুষ, জল বাড়লে ডুবে যাব।

মোটেই না। এখন যাওয়া চলবে না। কি ভাবেন আপনারা? মেয়েদের আপনারা কি ভাবেন অ্যাঁ? চলুন, আপনাকে বসতে হবে। মায়া উঠে দাঁড়াল। অনিমেষ মাথা নাড়ল, তাহলে রাগটাকে কমাতে হবে। ঠিক আছে?

৪৪. খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে অর্ক

খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে অর্ক ছাদের দিকে তাকিয়েছিল। টালিগুলোর মাঝখানে এক ফুটি কাঁচ যার ভেতর দিয়ে ঘরে আলো আসছে। কাঁচটা খোলা, বাইরের কিছুই দেখা যায় না কিন্তু আলো আসে। জন্মাবধি এই ঘরে বাস করে সে অনেকবার ওপরের দিকে তাকিয়েছে কিন্তু কাঁচটাকে নতুনভাবে চোখে পড়ল আজ। এই বস্তি যারা বানিয়েছিল তারাও চেয়েছিল এখানে একটু আলো আসুক।

জলপাইগুড়ি থেকে আসার পর কলকাতাকে তার খুব খারাপ লাগছে। এত চিৎকার, শব্দ আর চারপাশের চেহারা বিকট মনে হচ্ছে। ওখানে তো কিছুই করার ছিল না কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই সেই ঘুঘুর ডাক, গাছপালা আর চুপচাপ বাড়িটাকে অনুভব করতে পারে সে। সঙ্গে সঙ্গে মন খারাপ হয়ে যায়, কিছুই ভাল লাগে না।

অথচ তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেন একই রকম রয়েছে। সেই চিৎকার, চেঁচামেচি, হল্লা, খিস্তির ফোয়ারার একটুও কমতি নেই। এসে অবধি নেহাত প্রয়োজন ছাড়া ঘর ছেড়ে বের হয় না অর্ক। মোটামুটি স্থির হয়েছে সে এক্সটার্নাল হিসেবে পরীক্ষা দেবে। পড়ার বইগুলোকে তার এখন খুব একটা খারাপ লাগছে না। যে বিষয়গুলো এতদিন অবোধ্য মনে হত সেগুলো ফিরে আসার পর বেশ সরল সরল বলে মনে হচ্ছে। ফিরে আসার পর মাকে একদম অচেনা মনে হচ্ছে তার। সারাদিন গুম হয়ে থাকে, কথা বললে তবে উত্তর পাওয়া যায়। হঠাৎ যেন অত্যন্ত অন্যমনস্ক হয়ে। গেছে মা। চেহারাটা দিনকে দিন ভেঙ্গে পড়ছে। চোখ গর্তে বসেছে। মাঝ রাত্রে মা বিছানায় শুয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে। অর্ক ঘুম ভেঙ্গে কাঠ হয়ে শুনেছে সেই কান্না। অনেকবার মনে হয়েছে উঠে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু তখনি বুঝতে পারে সেটা অনুচিত কাজ হবে। মা জানে সে ঘুমিয়ে আছে। এই কান্নাটা বাবার জন্যে কিংবা মায়ের নিজের জন্যেও হতে পারে। সে যে জেনেছে তা জানালে মায়ের লজ্জা বাড়বে ছাড়া কমবে না। অতএব চুপচাপ প্রতিরাত্রে অর্ককে সেটা সহ্য করে যেতে হচ্ছে!

অর্ক বোঝে বাবা মাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। অথচ চলে আসার আগের রাত্রে মা স্পষ্ট জানিয়ে এসেছিল যে তাদের মধ্যে আর কোন সম্পর্ক নেই। সেই সময় মায়ের গলা ছিল তীব্র, কথা বলার। ভঙ্গীতে ছিল জেদ। আর এখন যে মা রাত্রে একা একা কাঁদে সেই মা অত্যন্ত অসহায়, ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাওয়া মানুষ। অথচ সকালে উঠেই যেন একটা পাথরের মূর্তি স্কুলে চলে যায়। দুপুরে। বাড়ি ফিরে আসে মড়ার মত। এ সবের কারণ বাবা-। অর্ক অনেকবার ভেবেছে আর বাবা বলবে না। কিন্তু অভ্যেস এমন যে না চাইলেও বাবা শব্দ মনে চলে আসছে। এতগুলো বছর যে মানুষটা এই ঘরে ছিল, ফিরে আসার পর সে আর নেই, নিশ্চয়ই খুব ফাঁকা ফাঁকা মনে হয়। কিন্তু অর্ক নিজে আর কোন টান বোধ করে না। মানুষটা না থাকায় সে কোন অভাব অনুভব করছে না। কিন্তু মা করছে। এই রহস্য অর্ক বুঝতে পারে না। যার সঙ্গে মা নিজে উদ্যোগী হয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করে এল তার জন্যেই কেঁদে মরবে কেন?

হঠাৎ কথাটা মনে পড়ে যাওয়ায় অর্ক লাফিয়ে উঠল। বিকেলে পড়াতে যাওয়ার আগে মা বলে গিয়েছিল, পরমহংসকাকুকে যদি পারিস একটা খবর দিস। প্রায় ফুরিয়ে আসছে বিকেল। পরমহংসকাকুর কথা মনে হতেই আর একটা মুখ মনে এল। কতদিন দেখা হয়নি। কে জানে, ঊর্মিমালার মনে হয় কি না! কিন্তু এখন এই বিকেলে ওই মুখ মনে পড়া মাত্র অর্কর অন্য রকম অনুভূতি হল। ঊর্মিমালার সঙ্গে জলপাইগুড়ির শান্ত নির্জন বাড়িটার অদ্ভুত মিল আছে।

আজকাল দরজায় দুটো তালা দেওয়া হয়। দুটো তালা পরস্পরকে আঁকড়ে থাকে, দুটো চাবি দুজনের কাছে। অর্ক সেজেগুঁজে গলিতে পা দিল। ন্যাড়াদের ঘরের সামনে এসে সে অবাক হয়ে অনুপমাকে দেখল। নতুন বউ-এর মত সেজে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে অনুপমা। ওকে দেখে ফিক করে হাসল, তোরা দেশে গিয়েছিলি না?

অর্ক মাথা নাড়ল। অনুপমা বলল, এসে অবধি দেখছি ঘরে বসে আছিস। তোর বাবা আসেনি?

অর্ক মাথা নাড়ল আবার। অনুপমাকে একদম অন্যরকম লাগছে। খলবল করে কথা বলছে, একটুও আড়ষ্টতা নেই। বেশ মোটা হয়েছে, চামড়ায় চাকচিক্য এসেছে। অনুপমা বুকের শাড়ি টানল, আমি দুদিনের জন্যে এসেছি। হাজার হোক বাবা ভাই বোন, কিন্তু ও ছাড়তেই চায় না। চোখমুখ ঘুরিয়ে কথাগুলো বলতেই অর্ক পা বাড়াল। অনুপমার এত সাজগোজ ওই ঘরে-যে মানাচ্ছে না এটা বোধ হয় ও জানে না। অর্কর মনে হল অনুপমা মেয়েটা ভাল নইলে এই অভাবের। ঘরে আবার ফিরে আসবে কেন?

গলির মুখে এসে দাঁড়াল সে। এক কোনায় মালের বস্তার মত পড়ে আছে মোক্ষবুড়ি। যেদিন তারা জলপাইগুড়ি থেকে এল সেদিনও চোখে পড়েছিল। মোক্ষবুড়ি আজকাল মুখ তুলে দ্যাখে না। দুই হাঁটুর ওপর চিবুক রেখে দিনরাত চোখ বন্ধ করে থাকে। কে এল কে গেল জানার যেন দরকার নেই আর। কারও প্রতি টান নেই, কোন দায় নেই, সংজ্ঞাটা মনে পড়তেই অর্ক কেঁপে উঠল। বেজন্মা! মোক্ষবুড়ি রেগে গেলেই বীভৎস স্বরে ওই শব্দটা উচ্চারণ করত। এখন মোক্ষবুড়ির কি সেই অবস্থা? সঙ্গে সঙ্গে সে মাথা নাড়ল। মোক্ষবুড়ি এখন সন্ন্যাসীদের মত, একমাত্র ঈশ্বরের কাছে দায়বদ্ধ। মুখ ফিরিয়ে সে আবার মোক্ষবুড়িকে দেখল। কোনরকম সুখ দুঃখের বাইরে, কিছুই যেন আর স্পর্শ করে না।

ঈশ্বরপুকুর লেন জমজমাট। নিমুর চায়ের দোকানের সামনে বেশ ভিড়। তারস্বরে রেডিও বাজছে। শিবমন্দিরের রকের দিকে তাকাতেই অর্ক বিলুকে দেখতে পেল। একা একা উবু হয়ে বসে সিগারেট খাচ্ছে। ওকে দেখেই সে লাফিয়ে উঠল, আরে তুমি? আও আও।

অর্ক মাথা নাড়ল, এখন না, একটু কাজ আছে।

আরে ইয়ার, কাজ তো জিন্দেগীভর থাকবে। দুমিনিট বসে যাও। কতদিন পরে তোমাকে দেখলাম। তুমি যে ফিরে এসেছ তা আমি জানিই না।

অনুরোধ এড়াতে পারল না অর্ক। ইতস্তত ভাবটা কাটিয়ে রকে বসল। পকেটে দুটো আঙ্গুল ঢুকিয়ে সন্তর্পণে একটা সিগারেট বের করে বিলু সামনে ধরল, নাও গুরু।

অর্ক মাথা নাড়ল, না। ভাল লাগছে না।

কি ব্যাপার? মনে হচ্ছে খুব পাল্টে গিয়েছ। দেশে কোন নটঘট করে এসেছ নাকি? এইস্যা দেওয়ানা বন গিয়া?

অর্ক হেসে ফেলল। বিলু বেশ হিন্দী ডায়লগ দিচ্ছে। সে জিজ্ঞাসা করল, পাড়ার খবর কি? সব ঠিকঠাক আছে?

হাত নাড়ল বিলু, পাড়ার খবর আমাকে জিজ্ঞাসা করো না। এসব ধান্দায় আমি নেই। আমি তো পাড়ায় থাকা ছেড়ে দিয়েছি বলতে গেলে। এর জন্যে কিছুটা দায়ী তুমি!

আমি?

হ্যাঁ। খুরকি কিলা মারা যাওয়ার পর কত করে বললাম তোমাকে এক নম্বর হয়ে যেতে তখন শুনলে না। শালা সেদিনের ফড়িং আজকে বাজ হয়ে হোক্কড় মারছে। কি রোয়াব! খুরকি কিলা থাকতে যে শালাকে খুঁজে পাওয়া যেত না সেই শালা আজ পাড়ার টপ রংবাজ। মুখ বিকৃত করল বিলু।

কে? কার কথা বলছিস?

ওই যে! নিমুর চায়ের দোকান থেকে নামছে।

অর্ক দেখল কোয়াকে। কোয়া তাহলে ঈশ্বরপুকুর কন্ট্রোল করছে। এই কদিনে কোয়ার জামাকাপড় পাল্টে গিয়েছে। সাফারি স্যুট পরেছে কোয়া, পায়ে নর্থস্টার। হাঁটার ভঙ্গীটাও অন্য রকম। দুজন চামচে রয়েছে পেছনে। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাচ্ছিল কোয়া এমন সময় একটা ট্যাক্সি ওদের পেছনে এসে হর্ন দিল। কোয়ার একটা চামচে হাত বাড়িয়ে ইশারা করল পাশ কাটিয়ে যেতে। ড্রাইভারটা কোন প্রতিবাদ করল না, গাড়ি সামান্য পিছিয়ে নিয়ে ফুটপাথের ধার ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। কোয়ারা মাঝ রাস্তা থেকে এক চুলও নড়ল না। বিলু বলল, দেখলে গুরু কাণ্ডটা। এইসব করছে আর পাবলিকের কাছে ইমেজ বেড়ে যাচ্ছে। কেউ ওর মুখের ওপর কথা। বলতে সাহস পায় না আজকাল। এই জন্যেই পাড়ায় আসি না।

এই সময় কোয়া শিবমন্দিরের দিকে তাকাল। সঙ্গে তার সিগারেটটা ঠোঁটের বাঁ কোণ থেকে ডান কোণে চলে এল। তারপর হেলতে দুলতে এগিয়ে এল সামনে, আরে বিলু, কেমন আছিস?

চলছে। বিলু গম্ভীর মুখে জবাব দিল।

আরে এ অক্ক না? ছিপারুস্তম! শুনলাম তোরা কোঠা বাড়িতে উঠে যাচ্ছিস! সেই আবার বস্তিতেই ফিরে আসতে হল? হ্যাঁ হ্যাঁ করে হাসল কোয়া।

অর্কর মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছিল। সে নিজেকে সংযত করতে চেষ্টা করল। এর সঙ্গে ঝামেলা বাধিয়ে কি লাভ। কোয়া মুখের সামনে হাত নাড়ল, কিরে, বোবা হয়ে গেলি নাকি?

অর্ক কোয়ার দিকে তাকাল, কোয়া, ভদ্রলোকের মত কথা বল।

ভদ্দরলোক? শালা, কোই হারামি বলতে পারে কে ভদ্রলোক? ভদ্রলোক শেখাতে এসেছে আমাকে? আর একবার বল তোর বাপের বিয়ে দেখিয়ে দেব। উত্তেজনায় কোয়া জামার আস্তিন গোটাতে চাইল কিন্তু মোটা কাপড়ের স্যুটে ভাঁজ পড়ল না।

অর্ক কোয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। সেই চোখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে কোয়া বলল, তুই আমাকে একদিন পৌঁছিয়েছিলি মনে আছে। আমি সেকথা জিন্দেগীতে ভুলব না। শোন, এ পাড়ায় থাকতে হলে তোকে আমার আণ্ডারে থাকতে হবে। নইলে কোন বাবা তোকে বাঁচাতে পারবে না। এই সব চামচিকে নিয়ে দল গড়লে কোন লাভ হবে না বলে দিলাম। হাত বাড়িয়ে বিলুকে দেখিয়ে দিল কোয়া।

অর্ক উঠে দাঁড়াল। তুই আমাকে চিনিস কোয়া। আমি নিজে থেকে কোন ঝামেলায় যেতে চাই না। তুই যদি নিজের ভাল চাস তাহলে আমাকে ঘাঁটাবি না। আর আবার বলছি, যদি আমার সঙ্গে ভবিষ্যতে কথা বলতে চাস তাহলে ভদ্রভাবে কথা বলবি।

কোয়া কি বুঝল সে-ই জানে। অর্কর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল দুবার। তারপর চামচের দিকে তাকিয়ে বলল, লেখা হয়ে গেল। এ শালা ভোগে যাচ্ছে। তারপর আবার দলবল নিয়ে ফিরে গেল নিমূর চায়ের দোকানে। ও চলে যাওয়া মাত্র বিলু বলল, শালা এখন থেকেই মাল খাবে। আজকাল নিমুর দোকানে বসেই বাংলু টানে কোয়া।

যাঃ, নিমূর চায়ের দোকানে মদ বিক্রি হয়?

হয় না খায়। আটটায় দোকান বন্ধ হয়ে গেলে একদিন গিয়ে দেখো।

অর্ক অন্যমনস্ক গলায় বলল, আশ্চর্য! কেউ কোন প্রতিবাদ করে না।

প্রতিবাদ? কোন শালার ঘাড়ে কটা মাথা আছে! তবে তুমি গুরু ওকে অল্পে ছেড়ে দিলে। যদি টাইট দিতে চাও তাহলে আমি তোমার সঙ্গে আছি।

অর্ক কিছু না বলে রক থেকে নেমে দাঁড়াল, চলি রে, কাজ আছে। বিলুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে সোজা হাঁটতে লাগল। এর মধ্যেই সন্ধ্যে নেমেছে। রাস্তায় আলো জ্বলছে। অর্ক ট্রামে চেপে সোজা শোভাবাজারে চলে এল। স্টপেজে পা দিয়েই ওর খেয়াল হল সেই ছেলেগুলোর কথা। আশ্চর্য; আজকে আর বিন্দুমাত্র ভয় করছে না। হয়তো পরমহংস আলাপ করিয়ে দেবার জন্যেই কিংবা এতদিন পার হয়ে যাওয়ার জন্যে সেই বোধটা আর ধারালো নেই। পরমহংসের ঠিকানা খুঁজে পেতে সময় লাগল না। বাড়িটা যে একান্নবর্তী এবংপুরোনো তা সামনে দাঁড়ালেই বোঝা যায়। প্রচুর লোক গুলতানি করছে। একজন প্রৌঢ়কে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, এখানে পরমহংসবাবু থাকেন?

হ্যাঁ। এখন নেই। অফিসে গিয়েছে। চটপট জবাব দিয়ে লোকটা সঙ্গীর সঙ্গে কথা বলতে লাগল, যাই বল না কেন ডন ইজ ডন। তোমাদের গাওস্করের সঙ্গে মূর্খ ছাড়া কেউ তাঁর তুলনা করবেন না। সে খেলা এই ছোঁকরা পাবে কোথায়!

সঙ্গীটি বলল, আপনি ডনের খেলা দেখেছেন?

নিশ্চয়ই। না দেখলে আর ক্রিকেট ছেড়ে দিই?

তার মানে?

এটাও বুঝলে না! নস্যি দাও। হ্যাঁ, তোমাকে যদি কেউ রাবড়ি খাওয়ায় তারপর আর বাতাস্য খেতে চাইবে? এও অনেকটা ওই রকম। ডনের খেলা দেখার পর অন্যের খেলা দেখতে গেলে ওই রকম মনে হবে। আর বল করতে লারউড। এইসব মাশাল ফাশাল তো তার কাছে শিশু। তাও তো কত কায়দা হয়েছে। মাথায় হেলমেট পরো, হাতে বুকে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা, মুখ আড়াল করে খোকাবাবু ব্যাট ধরলেন। ডনের সময় খালি একটা ব্যাট নিয়ে দেড়শ মাইল স্পীডের বল ফেস করতে হতো। গাওস্কর পারবে? ক্যালেণ্ডার হয়ে যেত অ্যাদ্দিনে। দু’আঙ্গুলের নস্যিটাকে সশব্দে নাকে চালান করে দিলেন ভদ্রলোক। অর্ক দাঁড়িয়েছিল। ভদ্রলোক যে গতিতে কথা বলে যাচ্ছিলেন তাতে সে সুযোগ পাচ্ছিল না কিছু বলার। নস্যি নেওয়ার ফাঁকে সে জিজ্ঞাসা করল, উনি কখন ফিরবেন?

ভদ্রলোকের যেন সংবিৎ এল, কে?

পরমহংসবাবু।

ও, ডু য়ু নো হু ইজ হি? জানো না? আমার ছোট ভাই। দাদা হয়ে তার ওপর খবরদারি করব আমাদের বংশে সে রেওয়াজ নেই। তার ইচ্ছেমতন সে আসবে ইচ্ছেমতন যাবে। আমি জানতে যাব কেন? হাঁ করে একটু বাতাস নিলেন ভদ্রলোক, বোধ হয় নস্যিতে নাকের ফুটো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

অর্ক বলল, বেশ। তাহলে বলবেন বেলগাছিয়া থেকে অর্ক এসেছিলো।

মনে থাকলে ববলব। ভদ্রলোক ঘুরে দাঁড়ালেন, হ্যাঁ যা বলছিলাম। মহম্মদ নিসারের নাম শুনেছ? বিরাট।

অর্ক আর দাঁড়াল না। লোকটার ওপর খুব চটে যাচ্ছিল সে। সমানে জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর মানুষের ওপর অথচ নিজের ভাই-এর খোঁজখবর রাখে না। এখন পরমহংস কাকু ফিরে এলে এই খবর পেলে হয়। লোকটার গলা শুনলে মনে হয় ঠিক ভুলে যাবে। ট্রামরাস্তার কাছে এসে অর্কর মনে হল ভুল হয়ে গেছে। পরমহংসকাকার বাড়ির কোন মহিলাকে বলে এলে ভাল হত। কিন্তু এখন আর ফিরে যাওয়া যায় না।

অর্ক ঠিক করল ওখানেই সে অপেক্ষা করবে। বাড়িতে যাওয়ার পথ যখন এটাই তখন পরমহংসকাকুর দেখা সে এখানেই পাবে।

ট্রামগুলো আসছে আর চলে যাচ্ছে। বেশ ভিড় এখন ফুটপাথে। একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত পা ব্যথা হয়ে যাচ্ছিল অর্কর। মাস্তানগুলোর কাউকেই এখন নজরে পড়ছে না। অর্ক একবার ভাবল সামনের দোকানটায় ঢুকে চা খেলে কেমন হয়? তার পকেটে যে পয়সা আছে ফেরার ট্রাম। ভাড়া দিয়েও তিরিশটা বেঁচে থাকবে। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল জলপাইগুড়িতে খাওয়াদাওয়ার বেশ আরাম ছিল! মত পাল্টালো সে, সামনের সিগারেটের দোকান থেকে একটা সিগারেট কিনে ধরালো। নিয়মিত অভ্যেস না থাকায় অস্বস্তি হচ্ছিল, ধোঁয়াটাকে গিলছিল না তাই। হঠাৎ তার মনে এল এটা বেকার। ফালতু পয়সা নষ্ট হল। মায়ের পয়সায় সিগারেট খাওয়ার কোন অধিকার তার নেই। ফেলে দিতে গিয়েও সামলে নিল সে। এখন এটা ফেলে দিলেও পয়সাটা ফেরত আসবে না।

আর এই সময় জুলিয়েনের কথা মনে পড়ল অর্কর। খুব সুন্দর কথা বলে মানুষটা। শুধু অপচয় হয়ে যাচ্ছে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দেশটা। কংগ্রেস সি পি এম কেউ এই দেশের রোগ সারাতে পারবে না যদি দেশের মানুষ না সজাগ হয়। জুলিয়েনের সব কথা অর্ক সেদিন বুঝতে পারেনি। কিন্তু একটা কথা তার মনে লেগে আছে। আমরা তো কখনো আমাদের পাশের মানুষটার সমস্যা বুঝতে চাই না।

চিৎপুরে দাঁড়িয়ে অর্ক মাথা নাড়ল। কথাটা সত্যি। আমরা সব সময় নিজেদের কথাই ভাবি। কেউ অন্য কারো সমস্যার কথা চিন্তা করি না। কংগ্রেস যদি কোন ভাল কাজ করতে যায় তাহলে সি পি এম এসে তার পাশে দাঁড়াবে?কক্ষনোনা। আবার সি পি এম-এর বেলাতেও তাই। এত মানুষ সামনে দিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকের কত রকম সমস্যা আছে। অথচ কেউ সে খবর জানে না, জানতে চায় না। জুলিয়েন বলেছিল, অর্ক এখন থেকেই সচেতন হও। বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে আলোচনা কর, দেখবে চোখ খুলে যাবে। এই দেশে তোমাদের থাকতে হবে, তাই দেশটাকে নিজের হাতে গড়ে নাও।

হাতে সিগারেটের আগুনের ছাঁকা লাগতেই অর্ক সেটাকে ছুঁড়ে ফেলল। না, এখনও পরমহংসকাকার দেখা নেই। এমনওতো হতে পারে পরমহংসকাকা আজ রাত্রে বাড়িই ফিরল না, সে খামোকা আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে। অর্ক হাঁটতে লাগল। তার মনে হল সিগারেট কিনতে গিয়ে সে পয়সাটা বাজে খরচ করেছে। অতএব তার হেঁটে বাড়ি ফিরে ট্রামের ভাড়াটা বাঁচানো উচিত। কতদূর আর হবে, বড় জোর দেড়-দু মাইল।

রাজবল্লভপাড়ার কাছে এসে অর্ক ভাবল গলি দিয়ে চলে যাবে। পাতাল রেল-এর জন্যে বড় রাস্তা দিয়ে হাঁটা মুশকিল। গলিতে ঢুকতেই ওর বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। নিজের চোখকে। যেন সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। উল্টো দিক দিয়ে ঊর্মিমালা আসছে। পরনে শালোয়ার পাঞ্জাবি, একটা বই বুকের কাছে ভাঁজ করা হাতে, হাসতে হাসতে কথা বলছে। ওর পাশে ছিপছিপে লম্বা একটা ছেলে, চশমা পরা। বছর কুড়ি বয়স হবে তার। ছেলেটিও হাসছে সমানে। ওদের দেখামাত্র অর্কর বুক আনটান করতে লাগল। এত রাত্রে ঊর্মিমালা এখানে কি করছে ওই ছেলেটার সঙ্গে? কে ছেলেটা? ঊর্মিমালার সঙ্গে ওর কি সম্পর্ক! যত দেখছে তত এক রকম তেতো স্বাদ মনে ছড়িয়ে পড়ছে। অর্কর মনে হল এখনি তার সামনে থেকে সরে পড়া উচিত। ঊর্মিমালার মুখোমুখি না হওয়াই ভাল। কিন্তু এখানে কোন আড়াল নেই। আচমকা পিছু ফিরলে ওর নজরে পড়ে যাবে সে। অতএব যা হবার সামনাসামনি হোক। যদি পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চায় ঊর্মিমালা তো যাক। রাস্তার দিকে মুখ করে অর্ক হাঁটছিল। এবং তখনই সে ঊর্মিমালার গলা শুনতে পেল। মিষ্টি সুরেলা গলা, আরে, আপনি এখানে?

অর্ক মুখ তুলল। ঊর্মিমালা সুন্দর চোখে তাকে দেখছে, ঠোঁটে আন্তরিক হাসি। ওর পাশে দাঁড়িয়ে ছেলেটি একটু অবাক চোখে তাকিয়ে। অর্ক কথা বলতে গিয়ে দেখল নিজের গলার স্বর অচেনা লাগছে, এই এদিকে একটু এসেছিলাম। ভাল?

এদিকে মানে? আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন?

না না। অর্ক থেমে গেল। ও বুঝতে পারছিল না কি ভাবে কথা বলবে।

বাঃ, আমি মাকে বলছি। আপনি এদিকে এসেও আমাদের বাড়িতে যাননি।

গেলে তো দেখা পেতাম না।

না গেলে জানতেন কি করে? আজকে আমাদের একটা ফাংশন ছিল তাই বেরিয়েছিলাম। এই যে এসো তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। এর নাম অর্ক মিত্র আর এ হল সুমন দত্ত। আমার বন্ধু।

শেষ শব্দটা শোনা মাত্র অর্ক শক্ত হল। বন্ধু! বন্ধু মানে প্রেমিক? তাহলে ঊর্মিমালার প্রেমিক আছে? ও দেখল সুমন দুই হাত জড়ো করে তাকে নমস্কার করছে। অর্ক সেটা ফিরিয়ে দিল। সুমন বলল, আমি আপনার কথা শুনেছি। মাসীমা আপনার কথা খুব বলেন।

মাসীমা?

আমার মা। ঊর্মিমালা হাসলো। রাগে শরীর জ্বলে গেল হাসিটা দেখে। শালার তাহলে নিয়মিত ওই বাড়িতে যাতায়াত আছে। এই সময় ঊর্মিমালা বলল, আপনাকে খুব গম্ভীর দেখাচ্ছে। কি হয়েছে?

কিচ্ছু না। আমি যাই।

সুমন বলে উঠল, সে কি? আপনার সঙ্গে বাই চান্স আলাপ হয়ে গেল এখনই যাবেন কি? চলুন কোথাও বসে চা খাই।

অর্ক আবার ঊর্মিমালার দিকে তাকাল, আমি চা খাই না।

ঊর্মিমালা বলল, তাহলে আপনি আমাদের সঙ্গে চলুন। হেঁটে না গিয়ে ট্রামে ফিরে যাবেন।

না, আমার হাঁটতে ভাল লাগে।

এই সময় সুমন পকেট হাতড়ালো। তারপর বলল, তোমরা ফয়সালা করে নাও, আমি সিগারেট কিনে আনি।

সুমন চলে গেলে ঊর্মিমালা বলল, কি ব্যাপার বলুন তো? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি কি রাগ করেছেন?

সত্যি কথাটা বলতে গিয়েও চেপে গেল অর্ক, বাঃ, রাগ করব কেন? বন্ধুর সঙ্গে বেশ তো বেড়ানো হচ্ছে।

বেড়াচ্ছি না, বাড়ি ফিরছি। আপনিও তো আমার বন্ধু, তাহলে এমন করে বলছেন কেন? ঊর্মিমালার মুখে অন্ধকার এল।

একটা মেয়ের কতগুলো বন্ধু হয়?

মানে?

মেয়েদের একজনের বেশী বন্ধু থাকা উচিত নয়।

ওমা, কে বলল?

আমার তাই মনে হয়।

ভুল মনে হয়। সুমনকে আমি ক্লাশ ওয়ান থেকে চিনি। ও আমার চেয়ে বয়সে বড় হলেও বন্ধু। আমার বাবাও আমার বন্ধু। আপনি ঠিক ভাবছেন না।

হঠাৎ অর্ক প্রশ্নটা করে ফেলল, সুমনকে তুমি ভালবাস?

হ্যাঁ। বন্ধুকে না ভালবাসলে বন্ধু হয় কি করে!

না, না। তারও বেশী?

এবার ঠোঁট কামড়াল ঊর্মিমালা। এবং তখনই সুমন সিগারেট নিয়ে এসে দাঁড়াল সামনে, কি হল? বসা হবে কোথাও?

ঊর্মিমালা তাকে বলল, না, থাক, আজ আমার বেশ দেরি হয়ে গেছে।

সুমন বলল, যাচ্চলে! এতক্ষণে মনে পড়ল! ঠিক আছে, আপনার সঙ্গে পরে আড্ডা মারা যাবে, কেমন, চলি।

ওরা যাওয়ার জন্যে পথ বাড়াতেই ঊর্মিমালা মুখ ফেরাল, মাসীমাকে আমার কথা বলবেন। আপনারা আমাদের পাড়ায় কবে উঠে আসছেন?

জানি না।

ঊর্মিমালা হাসল, আপনি আমাকে শেষ যে প্রশ্নটা করেছিলেন তার উত্তর একটাই, না। এলাম।

ওদের চলে যেতে দেখল অর্ক। বাঁক ঘোরার আগে একবারও ঊর্মিমালা মুখ ফিরিয়ে তাকে দেখল না। হঠাৎ নিজের ওপর তার খুব রাগ হয়ে গেল। ঊর্মিমালা তাকে হারিয়ে গেল, আর একবার।

৪৫. দরজাটা ভেজানোই ছিল

দরজাটা ভেজানোই ছিল। এখন রাত বেশী নয়। অন্যমনস্ক অর্ক দরজা ঠেলতে দেখল ঘরের আলো নেবানো। সে একটু অবাক হয়ে ডাকল, মা।

আলো জ্বাল। মাধবীলতা যেন নিঃশ্বাস চেপে উচ্চারণ করল। গলার স্বরটা অস্বাভাবিক ঠেকতেই অর্ক দ্রুত ঘরে ঢুকে আলো জ্বাললো। মেঝেতে বিছানা পেতে শুয়ে আছে মাধবীলতা। মুখ লাল, ঠোঁট ফ্যাকাশে। আলো জ্বলতেই চোখ বন্ধ করল সে। একটা হাত পেট খামচে ধরেছে। দৌড়ে এল অর্ক, কি হয়েছে মা?

কিছু না। আজ আমি রান্না করতে পারছি না। ওখানে টাকা আছে, তুই কিছু কিনে খেয়ে নে। মাধবীলতার মুখ দেখে অর্ক বুঝতে পারল মা যন্ত্রণা চাপছে। সে মাথার পাশে বসে কপালে হাত রাখতেই চমকে উঠল। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। সে বিহ্বল গলায় বলল, তোমার জ্বর এসেছে?

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, ও কিছু নয়, আমাকে একটু শুয়ে থাকতে দে।

তোমার পেটে কিছু হয়েছে?

ব্যথা করছে। শুয়ে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে। তারপর একটা হাত বাড়িয়ে অর্ককে আঁকড়ে ধরল মাধবীলতা। অর্ক দেখল তার বাজুতে মায়ের আঙ্গুলগুলো চেপে বসেছে। শক্ত হয়ে যেন ব্যথাটাকে সামলাতে চাইছে মা। সঙ্গে সঙ্গে অর্ক অসহায়ের মত চারপাশে তাকাল। জ্ঞান হবার পর থেকেই সে মাকে একরকম দেখে আসছে। কোন বড় অসুখে কখনও পড়েনি মাধবীলতা। এইভাবে যন্ত্রণায় কাতর হতে মাকে সে কখনো দ্যাখেনি। মাথার ভেতরটা ঘুরে গেল অর্কর। মা ছাড়া পৃথিবীতে তার কেউ নেই। হাতটা ছাড়িয়ে লাফিয়ে উঠল সে। তারপর দরজার দিকে যেতে যেতে বলল, তুমি শুয়ে থাকো, আমি এখনই আসছি।

কোথায় যাচ্ছিস? মাধবীলতা কোনক্রমে জিজ্ঞাসা করল।

ডাক্তার ডাকতে।

না। চিৎকার করে উঠল মাধবীলতা, আমার কিছুই হয়নি। ডাক্তার ডাকতে হবে না। শেষ কথাটা বলতে বলতে মুখ বিকৃত হয়ে গেল তার।

এখন কোন কথা বলবে না। আমি যা বলব তাই তোমাকে শুনতে হবে।

মাধবীলতা চোখ মেলে তাকাতেই অর্ক আড়ষ্ট হল। দুফোঁটা জল চিক চিক করছে চোখের কোণে। অর্ক আর দাঁড়াল না। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে গলিতে পা দিতেই মনে হল মাকে একা রেখে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না। কিছু ভাবতে না পেরে সে অনুপমাদের ভেজানো দরজায় হাত দিতেই দেখল মেঝেতে অনুপমা উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। অনুপমার পায়ের কাপড় হাঁটুর ওপর ওঠা। দৃশ্যটা চোখের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই আর দাঁড়াল না অর্ক। এক দৌড়ে ঈশ্বরপুকুর লেনে চলে এল সে।

ডাক্তারের চেম্বারে বেজায় ভিড়। কিন্তু ডাক্তার নেই। তিনি কোথায় গিয়েছেন কেউ বলতে পারছে না। কম্পাউণ্ডার জানাল, কলে গিয়েছেন। ছটফট করতে লাগল অর্ক। এপাড়ায় আর একজন ডাক্তার আছেন। তিনি বসেন ট্রাম লাইনের ধারে। যত দেরি হচ্ছিল তত অধীর হচ্ছিল অর্ক। মায়ের যেন কিছু না হয়ে যায় ভগবান। ট্রাম লাইনের ধারেই যাবে ঠিক করল সে।

কিন্তু রাস্তায় নামতেই সে ডাক্তারবাবুকে দেখতে পেল। হন হন করে হেঁটে আসছেন। পেছনে ঝুমকি। অনেক ফর্সা অনেক ঝকঝকে চেহারা হয়েছে ঝুমকির কিন্তু সেদিকে তাকানোর সময় ছিল না অর্কর। ও এগিয়ে গিয়ে রাস্তা আটকে দাঁড়াল, ডাক্তারবাবু, আপনাকে এখনই আমাদের বাড়িতে যেতে হবে। আমার মার ভীষণ অসুখ।

ডাক্তার যেন অসহায় হয়ে মাথা নাড়লেন, কোন বাড়ি? ওহো, তোমাদের বাড়িতে তো আমি গিয়েছি। কিন্তু এখন তো হবে না, রাত্রে ফেরার সময় যাব।

অর্ক বলল, না, মা খুব কষ্ট পাচ্ছে, আপনি একবার চলুন।

কি হয়েছেটা কি?

খুব জ্বর আর পেটে ব্যথা।

এই সময় ঝুমকি কথা বলল, ডাক্তারবাবু।

হ্যাঁ। তোমার বাবার ওষুধ-টা তুমি কম্পাউণ্ডারবাবুকে আমার নাম করে বলল, তিনি দিয়ে দেবেন। আমি এক্ষুনি এর বাড়ি থেকে ঘুরে আসছি। চলো। ডাক্তারবাবু আবার পেছন ফিরতে অর্ক ঝুমকির দিকে তাকাতেই সে হেসে বলল, ভালো?

অর্ক উত্তর না দিয়ে ডাক্তারবাবুর সঙ্গ নিল। শুনছে মায়ের অসুখ, ডাক্তার নিয়ে যাচ্ছে তবু জিজ্ঞাসা করছে ভালো? হাঁটতে হাঁটতে অর্কর মনে হল ঝুমকি এখনও পাকাপাকি মিস ডি হয়নি। মিস ডি হলে তো আর এই বস্তিতে থাকার কথা নয়। তবে চেহারা পাল্টে গিয়েছে। এখন মহিলা মহিলা মনে হয় ওকে।

দরজা ঠেলে অর্ক বলল, আসুন।

ঘরে আলোটা জ্বলছিল। মাধবীলতা হাতের কনুইতে চোখ আড়াল করে শুয়েছিল। শব্দ হতে চোখ মেলে ডাক্তারবাবুকে দেখে বলল, কি অন্যায় বলুন তো, মিছিমিছি আপনাকে ডেকে আনল।

ডাক্তারবাবু ব্যাগটাকে নামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে?

পেট ব্যথা করছিল। বললাম শুয়ে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে।

কথা শেষ করতে না দিয়ে কপালে হাত দিলেন ডাক্তারবাবু, চমৎকার জ্বর বাধিয়েছেন। কদ্দিন থেকে হচ্ছে?

মাধবীলতা এবার জবাব দিল না। ডাক্তারবাবু এবার পেটে হাত দিলেন। বিশেষ জায়গায় স্পর্শমাত্র আর্তনাদ করে উঠল মাধবীলতা। অর্ক লক্ষ্য করল ডাক্তারের মুখ কালো হয়ে গেল। মিনিট দশেক ধরে নানান পরীক্ষা করে ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, প্রথম কবে পেইন অনুভব করেছেন?

মাধবীলতা একটু ইতস্তত করছিল, ডাক্তারবাবু আবার বললেন, লুকিয়ে কোন লাভ হবে না। এ জিনিস একদিনে হয়নি। আপনারা যে কেন চেপে থাকেন তা আমি আজো বুঝতে পারি না। সেই শেষ পর্যন্ত তো জানতে দিতেই হয়। পেটেরটা তো বুঝলাম, বুকেরটা কি করে ঘটালেন?

বুকের?

নিঃশ্বাস নিতে গেলে খচ করে লাগছে তো?

হ্যাঁ।

চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন। আমি ওষুধ দেব, ভাল ঘুম আসবে। ডাক্তারবাবু ব্যাগ তুলে নিয়ে অর্ককে ডাকলেন, এসো।

বাইরে বেরিয়ে ডাক্তারবাবু বললেন, তোমার বাবাকে ডাকো, ওঁর সঙ্গে কথা আছে।

অর্কর চোয়াল শক্ত হল, উনি এখন এখানে নেই।

আঃ! এখন ওঁকে ভীষণ দরকার।

আপনি আমাকে বলুন।

ডাক্তারবাবু অর্কর দিকে তাকালেন, শোন, তোমার মায়ের অসুখটা খুব সামান্য নয়। এক্সরে না করিয়ে আমার কিছু বলা উচিত নয়। আমি তোমাকে সাজেস্ট করব ইমিডিয়েটলি হসপিটালে নিয়ে যেতে।

হসপিটাল? হতভম্ব হয়ে গেল অর্ক

হ্যাঁ। ওর লিভার আর ফুসফুস, দুটোই একসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আর এটা অনেকদিন ধরেই হচ্ছে, উনি তোমাদের জানাননি। তুমি আমার সঙ্গে এসো। আমি ওষুধ দিচ্ছি, রাত্রে ঘুমুবে, ব্যথাটাও কমবে। কিন্তু এটা নেহাতই টেম্পোরারি রিলিফ। তুমি আমার চিঠি নিয়ে হসপিটালে যেও কোন অসুবিধে হবে না। কথা শেষ করে ডাক্তার হাঁটতে শুরু করলেন। অর্কর ভেতর তখন তোলপাড় হচ্ছিল। মায়ের যে খুব বড় একটা অসুখ হয়েছে এটা স্পষ্ট। সে কাতর গলায় জিজ্ঞাসা করল, ডাক্তারবাবু, মা ভাল হয়ে যাবে তো?

ভাল হবেন না কেন? অসুখ আছে আবার তার ওষুধও আছে। বাড়িতে যে সেবাযত্ন করা দরকার, যে ওষুধপথ্য প্রয়োজন তা তোমার একার পক্ষে সম্ভব নয় বলেই আমি ওঁকে হসপিটালে নিয়ে যেতে বলছি। তবে এসব কথা যেন ওকে বলো না।

কিন্তু হসপিটালে তো চিকিৎসা হয় না।

কে বলল? ডাক্তারবাবু ঘুরে দাঁড়ালেন।

সবাই বলে। আমার মাকে আপনি বাঁচিয়ে দিন ডাক্তারবাবু।

সবাই বলে স্কুলে পড়াশুনা হয় না। তবু শিশুদের আমরা সেখানে পাঠাই। তাদের অনেকেই ভাল রেজাল্ট করে বের হয়। অতএব অন্যলোক কি বলল সেকথায় কান দিয়ে লাভ নেই। তোমার মাকে বাঁচাতে হলে হসপিটালে নিয়ে যাবে।

ঈশ্বরপুকুরে পা দিয়ে ডাক্তারবাবু বললেন, তোমার মায়ের যে প্রায়ই জ্বর আসতো, পেট ব্যথা করত, তোমরা জানতে না?

না। জলপাইগুড়িতে আমরা বেশ কিছুদিন ছিলাম। তখন যদি।

না না এ অন্তত মাস কয়েক ধরে চলছে। চেম্বারের ভিড় যেন ডাক্তারবাবুকে দেখে স্বস্তি পেল। চেয়ারে বসে একটা কাগজে তিনটে ওষুধের নাম লিখে কম্পাউণ্ডারকে বললেন, ওকে এখনি দিয়ে দাও। কেসটা ভাল নয়। তারপর আর একটা চিঠি লিখে বললেন, এটা নিয়ে কাল সকালেই চলে যাবে। মাকে ভর্তি না করে অন্য কাজ নয়। ওই ওষুধগুলো এখনই খাইয়ে দাও। সারা রাতে আর বিরক্ত করার দরকার নেই।

অর্কর মনে পড়ল ডাক্তারবাবুকে ফি দেওয়া হয়নি। মায়ের কাছে টাকা চাইতে হবে। সে বলল, ডাক্তারবাবু আপনার টাকাটা নিয়ে আসি।

চোখ তুলে দেখলেন ভদ্রলোক, হ্যাঁ দিতে তো হবেই। তবে কাল দিলেই হবে। হসপিটাল থেকে ফিরে এসে দেখা করবে আমার সঙ্গে।

ডাক্তারবাবু এবার অন্য রোগীদের দেখতে আরম্ভ করলে অর্ক সরে আসতেই ঝুমকি বলল, কার কি হয়েছে?

আমার মায়ের, জ্বর আর পেটে ব্যথা।

হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলল?

হ্যাঁ। ঝুমকির সঙ্গে কথা বলতে একটুও ইচ্ছে করছিল না অর্কর। কিন্তু কেউ যদি গায়ে পড়ে প্রশ্ন করে জবাব না দিয়েও থাকা যায় না।

খুব জ্বর?

হ্যাঁ।

তোমার বাবা তো এখানে নেই!

কে বলল? অবাক হল অর্ক।

আমি জানি।

এই সময় কম্পাউণ্ডার এসে ঝুমকিকে ওষুধ দিতে সে বলল, বাবার খুব টান বেড়েছে। চলি। অর্ক লক্ষ্য করল ঝুমকির উপস্থিতি অন্য সবার নজর কেড়েছে। সবাই টেরিয়ে টেরিয়ে ওকে দেখছিল। বছর খানেক আগেও বোধহয় এরকম হতো না। এই সময় কম্পাউণ্ডার ডাকতেই অর্ক এগিয়ে গেল।

ওষুধ নিয়ে রাস্তায় নামতেই অর্কর শীতবোধ হল। সমস্ত শরীর সিরসির করছে। মাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। মা যদি আর ফিরে না আসে? না, অসম্ভব, সে প্রায় দৌড়েই গলিতে ঢুকল।

দরজা ঠেলতেই অর্ক অবাক হয়ে গেল। মাধবীলতা স্টোভ জ্বালিয়েছে। অর্ক আঁতকে উঠল, তুমি কি করছ?

সাদা মুখে মাধবীলতা হাসল, খেতে হবে তো।

তুমি ওঠো।

কি আশ্চর্য! আমার এখন ভাল লাগছে। আমি তোকে ডিমটা করে দিচ্ছি।

তোমার ভাল লাগছে?

হ্যাঁ। দ্যাখ, মনে হচ্ছে জ্বরটাও কম। তুই মিছিমিছি ডাক্তার ডাকতে গেলি। ডাক্তারকে টাকা দিয়েছিস? কথা বলতে বলতে মাধবীলতা চোখ বন্ধ করল।

অর্ক দ্রুত পায়ে মায়ের কাছে চলে গেল। তারপর দু-হাতে মাধবীলতাকে জোর করে দাঁড় করাল, আমি তোমার কোন কথা শুনতে চাই না, তোমাকে এখন শুয়ে থাকতে হবে। তুমি এই শরীর নিয়ে রান্না করছ?

মাধবীলতা বাধা দিতে চেষ্টা করেও পারল না। ছেলের শরীরের শক্তির কাছে সে খুবই দুর্বল হয়ে পড়ল। আর অর্ক অবাক হয়ে দেখল মায়ের শরীর কি হালকা, একরত্তি ওজন নেই যেন। সে মাধবীলতাকে খাটের কাছে নিয়ে এসে বলল, তুমি ওপরে শোও।

দ্রুত মাথা নাড়ল মাধবীলতা, না!

শুধু অসম্মতি নয়, অর্কর মনে হল শব্দটা উচ্চারণের সময় মা যেন আরও বেশি কিছু বলতে চাইল। সে জোর করল না। মেঝেতেই আবার শুয়ে পড়ল মাধবীলতা। শুয়ে বলল, শরীরটা বড় দুর্বল হয়ে গেছে রে।

অর্ক পকেট থেকে ওষুধগুলো বের করে এক গ্লাস জল বাড়িয়ে ধরল, এগুলো খেয়ে নাও। তারপর চুপটি করে শুয়ে থাকো।

মাধবীলতা হাসল, বাবাঃ, তুই এমন ভঙ্গীতে কথা বলছিস যেন আমাকেই পেটে ধরেছিস। আমাকে এই ট্যাবলেট খেতে হবে?

হ্যাঁ। অ্যাদ্দিন তো নিজে না খেয়ে শুধু আমাদের খাইয়ে এসেছ এখন আমি যা বলব তাই তোমাকে শুনতে হবে।

এসব তোকে কে বলল?

ডাক্তারবাবু।

বাজে কথা। আমি তোদের সঙ্গে দু’বেলা খেতাম না? মাধবীলতা ওষুধ খেলে অর্ক তার বিছানাটা ঠিক করে দিল। তারপর মাধবীলতার মাথার পাশে বসে কপালে হাত রাখল। জ্বর আছে। তবে সামান্য কম। মায়ের শরীরের স্পর্শ পাওয়া মাত্র আবার কেঁপে উঠল অর্ক। কাল সকালে মাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবেই। নাহলে নাকি বাঁচানো যাবে না। অর্ক মাধবীলতার শরীরের দিকে তাকাল। মাকে বাঁচাতেই হবে, যে করেই হোক।

কিন্তু এই মুহূর্তে, যখন মাধবীলতা চোখ বন্ধ করে রয়েছে, তখন তাকে হাসপাতালের কথা বলতে গিয়েও সামলে নিল অর্ক। মা নিশ্চয়ই হাসপাতালে যেতে চাইবে না। অথচ ডাক্তারবাবু বলেছেন হাসপাতালে না নিয়ে গেলে মা বাঁচবে না। যা করার কাল সকালেই করা যাবে। এখন মা ঘুমুক।

এই সময় অর্কর চোখ খাটের দিকে গেল। এবং তখনই পরিষ্কার হয়ে গেল কেন মাধবীলতা ওখানে শুতে চায়নি। খাটটা ছিল বাবার দখলে। সঙ্গে সঙ্গে অর্কর মনে হল মায়ের এইসব অসুখের জন্যে দায়ী একটি মানুষ। কিন্তু আশ্চর্য, সেই মানুষটার জন্যে মা কষ্ট পেয়ে যাচ্ছে। সে নিচু গলায় বলল, মা, তোমার শরীর তো ঠিক নেই, জলপাইগুড়িতে চিঠি দেব?

মাধবীলতা কোন কথা বলল না। শুধু নিঃশব্দে তার মাথাটা না বলল।

অর্ক দেখল মায়ের বন্ধ দুই চোখের কোণে আচমকা জল ফুটে উঠল। সে সেই জলটার দিকে স্থির হয়ে চেয়ে রইল। এক ফোঁটা টলটলে জল শরীর ঘেঁকে বেরিয়ে এসেছে। কেটে গেলে রক্ত পড়ে, পুড়ে গেলে ফোস্কা হয়, কিন্তু কষ্ট হলে চোখে জল আসে কেন? তাহলে মনের সঙ্গে শরীরের অবশ্যই যোগাযোগ আছে। মন খারাপ হলে শরীরও খারাপ হবে। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে মায়ের শরীরের এইসব কষ্ট বাবারই দেওয়া।

হঠাৎ অর্কর খেয়াল হল মাধবীলতা জেগে নেই। ঠোঁটদুটো সামান্য ফাঁক হয়ে থাকায় দাঁতের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বুক নামছে নিঃশ্বাসের তালে তালে, নামছে উঠছে। সমস্ত শরীর থেকে একটা চাপা উত্তাপ বের হচ্ছে। পরম মায়ায় অর্ক মায়ের গালে কপালে চিবুকে হাত বোলালো। বুকের ভেতর একটা ভয় এখন তির তির করে বাড়ছে। অর্ক চোখের কোণদুটো আঙুলে মুছিয়ে দিতে গিয়ে থমকে গেল। তারপর ধীরে ধীরে নিচু হয়ে নিজের ঠোঁটদুটো মায়ের দুই চোখের কোণে আলতো করে চুঁইয়ে জলকণা মুছিয়ে দিল। মাধবীলতা তার কিছুই টের পেল না। ওষুধের কল্যাণে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে সে।

কতক্ষণ ওভাবে বসেছিল অর্ক জানে না। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্রমশ যেন একটা নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিল। দরজায় শব্দ হতে সে চেতনায় ফিরল। খুব সন্তর্পণে কেউ দরজাটা খুলছে, কিন্তু আওয়াজটাকে এড়াতে পারছে না। অর্ক সোজা হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কে?

এই সময় মুখটা দেখতে পেল সে, কেমন আছে এখন?

অর্ক যতটা অবাক তার চেয়ে বেশি গম্ভীর হয়ে গেল, ভাল।

ঝুমকিকে সে এখানে কিছুতেই আশা করেনি। অথচ ঝুমকি এখন ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। এতক্ষণে সে মাধবীলতার শায়িত শরীরটাকে দেখতে পেয়েছে। এক পা এগিয়ে এসে চাপা গলায় বলল, ঘুমুচ্ছেন?

অর্ক মাথা নাড়ল। সে বুঝতে পারছিল না কি করবে। ঝুমকিকে এই ঘরে দেখলে নিশ্চয়ই মা খুশি হবে না। তাছাড়া ঝুমকি যে জীবনযাপন করে সেটা শুনলে! ঝুমকি জিজ্ঞাসা করল, জ্বর কত?

জানি না!

থার্মামিটার নেই?

না।

ঝুমকি মাধবীলতার পাশে বসে মাথায় আলতো কবে হাত রেখে বলল, উঃ, বেশ জ্বর। মাথায় জলপটি দিতে হবে। আমাকে একটা কাপড় জলে ভিজিয়ে দাও।

অর্ক মাধবীলতার জ্বরতপ্ত ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকাল। সে বুঝতে পারছিল ঝুমকি আসায় তার অসহায় ভাবটা ক্রমশ কেটে যাচ্ছে। একা মাকে কিভাবে সেবা করা যায় তা সে বুঝে উঠতে পারছিল না। তবু সঙ্কোচে বলল, থাক, আমি দিচ্ছি।

সরো তো! এসব ছেলেদের কাজ নয়।

তোমার বাবার তো অসুখ!

এখন টান কমেছে, ঘুমুচ্ছে। কাল সকালের আগে উঠবে না। এরকম মাঝে মাঝেই হয়! তুমি একটা বাটিতে জল আর ছোট কাপড় এনে দাও। হাতপাখা আছে? ঝুমকি ঘরের চারপাশে তাকাল। তার পরে উঠে খাটের ওপর থেকে পাখা নিয়ে এসে অর্ককে সরে যেতে ইঙ্গিত করল।

একটা বাটিতে জল আর ছেঁড়া পরিষ্কার ন্যাকড়া এনে দিল অর্ক। ঝুমকি পরিপাটি করে কপালে জাপটি দিয়ে নরম হাওয়া করতে লাগল। দৃশ্যটা দেখতে দেখতে অর্কর সেই দৃশ্যটা মনে পড়ে গেল। মিস ডি, ক্যাবারের পোশাকে নাচছে। এখন এই ঝুমকিকে দেখে সেটা কিছুতেই বিশ্বাস করা যায় না, মেলানো যায় না।

ঝুমকির মুখ ঝুঁকে পড়েছে মাধবীলতার ওপর, এক হাতে পাখা চালাচ্ছে, অন্য হাতে কাপড়টা পাল্টে দিচ্ছে।

শেষপর্যন্ত একসময় অর্ক বলল, এবার আমাকে দাও।

ঝুমকি মাথা তুলল, খেয়েছ?

অর্ক হাসল, সময় পাইনি।

বাড়িতে রান্না হয়নি?

না

তাহলে বাইরে থেকে খেয়ে এসো, ততক্ষণ আমি এখানে আছি।

অর্কর এই মুহূর্তে একটুও খিদে পাচ্ছিল না। তাছাড়া ঝুমকিকে একা রেখে তার যাওয়াটাও ভাল দেখায় না। যে কোন মুহূর্তে মায়ের ঘুম ভেঙে যেতে পারে। সেসময় সে না থাকলে–! তাছাড়া আর একটা ব্যাপার সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না। হঠাৎ ঝুমকি কেন এল তাদের ঘরে? শুধু মায়ের অসুখের খবর পেয়ে তার এখানে আসার কি এমন গরজ পড়ল! শেষ যখন দেখা হয়েছিল তখন ঝুমকির সঙ্গে এমন কিছু ভাল সম্পর্ক ছিল না, তাহলে? ওর মনে হচ্ছিল ঝুমকির এই আসার পেছনে নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য আছে। তাছাড়া এসময় ওর পাড়ায় থাকার কথা নয়। না হয় আজ বাবার অসুখ তাই বের হয়নি কিন্তু তাহলে তো বাবার কাছেই থাকা উচিত ছিল। অর্ক কোন কূল পাচ্ছিল না

এই সময় ঝুমকি বলল, ডাক্তার তোমার মাকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছে, না?

অর্ক বলল, কি জানি!

নিশ্চয়ই দিয়েছে। এটা স্বাভাবিক ঘুম না। তাড়াতাড়ি খেয়ে এসো, আমি এখানে সারা রাত থাকব নাকি? প্রশ্নটা করে ঝুমকি ঠোঁট টিপে হাসল।

এইবার অর্কর মনে হল ঝুমকি এই ঘরে আছে জানলে মা হয়তো রাগ করবে কিন্তু বস্তির অন্য মানুষের জিভ টসটসে হয়ে উঠবে। অতএব যত তাড়াতাড়ি ওকে এখান থেকে সরানো যায় ততই ভাল। সে বলল, তুমি যাও, আমি বসছি।

ঝুমকি মাথা নাড়ল, উঁহু, না খেয়ে এলে আমি এখান থেকে উঠবই না।

অর্ক অসহায় ভঙ্গীতে বলল, কি আশ্চর্য!

কিছুই আশ্চর্যের নয়। আমাদের বাড়িতেও সন্ধ্যেবেলায় রান্না হয়নি। তুমি খেয়ে আসবার সময় আমার জন্যে একটা হাফ পাউণ্ড রুটি নিয়ে এস। মা-মেয়েতে হয়ে যাবে। পয়সা নাও। ব্লাউজের ভেতর আঙ্গুল ঢুকিয়ে একটা ব্যাগ বের করে বারো আনা পয়সা দিল ঝুমকি।

অর্কর আর কোন উপায় রইল না। সে পয়সাটা তুলে নিয়ে আচমকা জিজ্ঞাসা করল, তুমি আজকাল সন্ধ্যেবেলায় বের হও না?

ঝুমকি মুখ তুলে তাকাল। ওর মুখে যে ছায়া খেলে গেল সেটা অর্কর নজরে পড়ল। তারপর স্পষ্ট গলায় বলল, যাই। তবে আমার আর নাচা হবে না।

কেন?

আমি পারলাম না।

অর্ক আর দাঁড়াল না। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে সে বাইরে বেরিয়ে এল। এখন যে এত রাত হয়ে গেছে তা সে টের পায়নি। এমনকি তিন নম্বর পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। নিমুর দোকান বন্ধ। শুধু একটা পানের দোকান ছাড়া কিছুই ভোলা নেই। হাঁটতে হাঁটতে ট্রাম রাস্তায় চলে এল অর্ক। তারপর দুটো হাফ পাউণ্ড রুটি কিনে আবার ফিরে আসছিল তিন নম্বরে। আর এই সময় সে কোয়াকে দেখতে পেল। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কোয়া চিৎকার করছে। ওর দুটো পা মাটিতে সমানভাবে স্থির থাকছে না, শরীরটা বারংবার হেলে পড়ছে সামনে। কোয়ার সামনে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধা। বারংবার তিনি কোয়াকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন কিন্তু কোয়া তাঁকে ঠেলে ফেলে দিচ্ছে। এবং সেইসঙ্গে চলছে অশ্রাব্য গালাগালি। বৃদ্ধা যে কোয়ার মা তা বুঝতে দেরি হল না এবং সেই মাকেই কোয়া একনাগাড়ে খিস্তি করে যাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখার জন্যে এত রাত্রেও বেশ কিছু লোক জমে গিয়েছে। যাওয়ার সময় এদের এখানে দ্যাখেনি সে। এর মধ্যেই এত কাণ্ড ঘটে গেছে। অর্ককে দেখতে পাওয়া মাত্র কোয়া সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করল, এই যে ভদ্দরনোক, শালা ভদ্দরনোকের বাচ্চা! শালা তোর মাকে—।

সঙ্গে সঙ্গে অর্কর মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। রুটি দুটোকে পাশের রকে রেখে সে ছুটে গেল কোয়ার দিকে। তারপর পাগলের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। মিনিট দেড়েক বেধড়ক পেটালো সে কোয়াকে। ততক্ষণে আরও লোক জমেছে কিন্তু কেউ কোন কথা বলছে না। রাস্তায় উপুড় হয়ে পড়েছিল কোয়া। অর্ক এবার বৃদ্ধার দিকে তাকাল, আমি আপনার ছেলেকে মেরে ফেলতাম। ও আমার মাকে অপমান করেছে আপনি নিজের কানে শুনেছেন।

বৃদ্ধা পাথরের মত দাঁড়িয়ে ছেলের মার খাওয়া দেখছিলেন। এবার বললেন, তুমি ঠিক করেছ বাবা।

অর্কর মাথায় আগুন জ্বলছিল। সে কোয়াকে আবার টেনে তুলল, অনেক সহ্য করেছি। এই ঈশ্বরপুকুরে যে শালা মাল খেয়ে মাতলামি করবে আর খিস্তি দেবে তাকে আমরা পুঁতে ফেলব। তোর মনে থাকবে? তুই মাস্তান হচ্ছিস হয়ে যা, কিন্তু মাতলামি আর খিস্তি করা চলবে না।

সেই অবস্থায় কোয়া জিজ্ঞাসা করল, কেউ মাতলামি করবে না?

না। কাউকে আমি মাতলামি করতে দেব না।

ঠিক হ্যায়। আমি তোর সঙ্গে আছি। মালের ঠেকগুলো সব আমাকে কলা দেখাচ্ছে। সবকটাকে তুলে দিতে হবে। কোয়া টলছিল।

অর্ক বলল, আমি কালকে তোর সঙ্গে কথা বলব। তারপর রুটিদুটো তুলে নিয়ে পা বাড়াল বাড়ির দিকে। তার শরীর ঘিন ঘিন করছিল। সে হাঁটতে হাঁটতে ঠিক করল একটা দল গড়বে। এই ঈশ্বরপুকুর থেকে মাল খেয়ে মাতলামি করা বন্ধ করতেই হরে। তারপরেই খেয়াল হল কোয়া নাকি এখন খুব বড় মাস্তান। অথচ অমন মার খেয়েও সে প্রতিবাদ করল না। কি ব্যাপার?

ঘরে ঢুকে অর্ক দেখল ঝুমকি ঢুলছে। তার হাত থেকে পাখা পড়ে গিয়েছে, মাথাটা ঝুঁকে পড়েছে বুকের ওপর। মাধবীলতা এখনও অসাড়ে ঘুমুচ্ছে। অর্ক ডাকল, এই ঝুমকি, বাড়ি যা।

ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়ল ঝুমকি। তারপর লজ্জিত ভঙ্গীতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। অর্ক তার পিছু ডাকল, তোর রুটি।

৪৬. তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেনে

তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেনের একটা বিশেষ সুবিধে, আপদে বিপদে গাড়ি পেতে অসুবিধে হয় না। বিশেষ করে সকালের দিকটায়। ভোরে এখানে গাড়ি ধোওয়া হয় লাইন দিয়ে। প্রাইভেট গাড়ির ড্রাইভাররা নিমুর দোকানে চা খেতে খেতে সে কাজ তদারকি করে। পরিষ্কার গাড়ি নিয়ে তারা ডিউটি করতে যায় বাবুদের বাড়িতে। অতএব সাতসকালে নির্মলের গাড়িটা পেয়ে গেল অর্ক। তিন নম্বরের কেউ অসুস্থ, হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে কিন্তু গাড়ি পাওয়া যাবে না, এ হয় না।

সারা রাত ঠায় জেগে কাটিয়েছে অর্ক। মাধবীলতার মুখে মাঝে মাঝে যন্ত্রণার ছাপ ফুটেছে, শরীর বেঁকেছে, আবার ঘুমে তলিয়ে গেছে। কিন্তু ভোরের দিকে আবার চেতনায় ফিরে এল সে। এবং তখন থেকেই একটা গোঙানি বেরিয়ে আসছে ওর সমস্ত শরীর ঘেঁচে। দুহাতে পেট খামচে ধরে সমানে ককিয়ে যাচ্ছে মাধবীলতা। অর্ক ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, মা, খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার মা!

মাধবীলতা একবার চোখ মেলে ছেলের দিকে তাকিয়েছিল। ঘোলাটে চোখ। দাঁতে দাঁত। কথা বলতে পারেনি সে। আবার চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বোঝা যায় প্রাণপণে সে যন্ত্রণাটাকে দমাতে চাইছে। লড়াই করার শক্তিটাকে তখনও জিইয়ে রেখেছে। মায়ের শরীরটা যেন ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। অর্ক আর অপেক্ষা করেনি। এক ছুটে সে বেরিয়ে এসেছিল নিমুর দোকানের সামনে। তখনও ভাল করে সকাল হয়নি কিন্তু রাতও নেই। নিমুকে ঘটনাটা বলতে নির্মল এগিয়ে এল চায়ের গ্লাস হাতে, কোন হাসপাতালে যাবে? আর জি কর?

অর্ক ঘাড় নাড়তেই সে বলল, নিয়ে এস। তারপর চিৎকার করে যে গাড়ি ধুচ্ছিল তাকে সে নির্দেশ দিল, এখন জল ঢালিস না। হাসপাতাল থেকে ফিরে এলে ওসব হবে।

নির্মলকে এর আগে দেখেছে অর্ক। তিন নম্বরের পেছন দিকটায় থাকে। কথা হয়নি কখনও। নির্মল বলল, তোমার মা হেঁটে আসতে পারবে?

অর্ক মাথা নাড়ল, কোলে করে নিয়ে আসতে হবে।

চল। চায়ের গ্লাস নামিয়ে রেখে নির্মল অর্কর সঙ্গী হল, কদিন থেকে হচ্ছে? গলিতে পা দিতেই অর্কর নজরে পড়ল মোক্ষবুড়ি প্রায় হামাগুড়ি দিতে দিতে এগিয়ে আসছে গলির মুখে। সে নিচু গলায় জবাব দিল, কাল থেকে। ডাক্তারবাবু বললেন আজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে।

লিখে দিয়েছে সে কথা?

হ্যাঁ।

তাহলে ভাল। নইলে আজকাল ভর্তির ব্যাপারে নানান ফ্যাচাঙ। নির্মল বলল।

মায়ের শরীর এত হালকা তা আগে আন্দাজ ছিল না। পাঁজা কোলা করে অর্ক সহজেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে পারল, নির্মলের সাহায্য দরকার হল না। দরজায় তালা দিয়ে দিল নির্মল। বস্তির দু-একজন মানুষ তখন সবে জেগেছে। মাধবীলতা বাইরে বেরিয়ে আসতেই চোখ খুলল। তারপর কোনমতে জিজ্ঞাসা করল, কোথায়?

অর্ক হাঁটতে হাঁটতে বলল, চুপ করে থাকো।

গাড়ির কাছে পৌঁছাতেই কিন্তু ভিড়টা জমে গেল। দু-একজনের বদলে ততক্ষণে দশ বারো জন ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। নির্মল গাড়ির দরজাটা খুলে দিয়ে হাত লাগাল। সবাই ঝুঁকে পড়ে মাধবীলতাকে দেখছে। নিমুর দোকানে যারা চা খাচ্ছিল তারাও নেমে এসেছে। কিন্তু কারো মুখে কোন শব্দ নেই। মায়ের মাথাটা কোলে নিয়ে অর্ক পেছনে বসতেই নির্মল দরজা বন্ধ করে ড্রাইভারের আসনে বসতে গেল। আর তখনি মোক্ষবুড়ির ভাঙ্গা গলা ছিটকে এল, কে গেল?

সবকটা মানুষ অবাক হয়ে পেছন ফিরে তাকাল! মায়ের মাথা কোলে নিয়ে অর্ক জানলা দিয়ে দেখল মোক্ষবুড়ি উবু হয়ে বসে অন্ধচোখে দেখতে চেষ্টা করছে শূন্যে হাত নেড়ে, কে গেল, কাকে নিয়ে গেল? বল না তোমরা?

কেউ পাশ দিয়ে গেলে মোক্ষবুড়ি বলত, কে যায়? কিন্তু এখন এই মুহূর্তে কে গেল প্রশ্নটা যে মানে বোঝাল তাতে শিউরে উঠল অর্ক। কেউ একজন জবাব দিল, অর্কর মা হাসপাতালে যাচ্ছে, অসুখ।

অ হাসপাতালে! কার মা?

অর্কর।

অ্যাাঁ। মাস্টারনি? মাস্টারনিও হাসপাতালে চলল। বলতে বলতে বুড়ি ডুকরে উঠল, আমাকে ছোঁবে না রে। এই গুখেগোর ব্যাটা, অ্যাই ঢ্যামনা, সবাইকে নিচ্ছিস আমাকে নিবি না কেন? ও মাস্টারনি তুমি গেলে আমাকে খেতে দেবে কে? এই যে অ্যাদ্দিন ছিলে না কেউ কি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে আমি কি খেয়ে আছি!

শুরু করে কান্না ধরতেই নির্মল গাড়ি ছেড়ে বলল, যত অযাত্রা। শালা বুড়িটা মরেও না।

অর্ক পাথরের মত বসেছিল। ওর চোখের ওপর চট করে হেমলতার মুখ ভেসে উঠল। মহীতোষ মারা যাওয়ার সময় হেমলতা ঠিক এই গলায় ভগবানের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। ভাষাটা আলাদা কিন্তু ভাবটা একই। সে দুহাতে মাধবীলতাকে জড়িয়ে ধরতেই শুনতে পেল, কি হল?

মাধবীলতা চোখ মেলেছে, যেন চেতনা পরিষ্কার হচ্ছে, জিজ্ঞাসা করল, তুই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিস?

অর্ক কান্না চাপতে নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। কথা বলতে গেলে কি হবে সে যেন অনুমান করতে পারছিল। মাধবীলতার হাত ছেলের কনুই স্পর্শ করল, তুই অমন করছিস কেন? হাসপাতালে তো মানুষ রোগ সারাতেই যায়!

কথাগুলো এখন অনেক স্পষ্ট।

গাড়িটা খুব জোরে চালাচ্ছে না নির্মল। কিন্তু বাইরের পৃথিবীটা যেন ছায়ার মত চোখের অগোচরে থেকে যাচ্ছিল অর্কর। কোনরকমে কান্নাটাকে গিলে সে অভিযোগ করল, অসুখটা তুমি ইচ্ছে করে বাধিয়েছ।

ইচ্ছে করে? মাধবীলতা হাসবার চেষ্টা করল, না বাধালে তোর এত সেবা পেতাম? তুই আমার কত ভাল ছেলে। বলতে বলতে তার চোখ বন্ধ হল আবার। অর্ক বুঝল মায়ের যন্ত্রণাটা ফিরে আসছে ঢেউ-এর মত। সমস্ত শরীর কুঁকড়ে উঠছে। দুটো হাত দিয়ে পেট খিমচে ধরেছে মাধবীলতা। অর্ক এবার হু হু করে কেঁদে ফেলল, নিঃশব্দে।

গাড়িটা থামিয়ে ঘুরে এল নির্মল, অ্যাই, তুমি ছেলেমানুষ নাকি? ওঁকে নামাতে হবে। দাঁড়াও, আমি একটা স্ট্রেচার নিয়ে আসি।

অর্ক চোখ মুছল। আবার গোঙানি আরম্ভ হয়েছে মাধবীলতার। অর্কর কোলে মাথাটা এপাশ ওপাশ করছে। হাসপাতালের চত্বরে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি। এইসময় নির্মল দুজন লোককে নিয়ে ফিরে এল। লোকগুলো পেশাদার হাতে মাধবীলতাকে স্ট্রেচারে শুইয়ে ভেতরে নিয়ে যেতে নির্মল বলল, চল ভর্তির কাজগুলো সেরে নিই।

নির্মলের যে এই হাসপাতালে কিঞ্চিৎ জানাশোনা আছে সেটা বোঝা গেল। ডাক্তারবাবুর চিঠিতে যতটা না কাজ হতো নির্মলের তদ্বিরে তার চেয়ে অনেক দ্রুত হল। আর জি কর। হাসপাতালে একটা বিছানা পেয়ে গেল মাধবীলতা। নির্মলকে ডিউটিতে যেতে হবে বলে সে কিছুক্ষণ বাদেই গাড়ি নিয়ে ফিরে গেল। অর্ক দাঁড়িয়েছিল বারান্দায়। ডাক্তারবাবু দেখেশুনে বলবেন কোন ওষুধপত্র লাগবে কিনা।

বাড়ি থেকে বেরুবার সময় অর্ক যা টাকা সামনে পেয়েছিল তাই তুলে নিয়ে এসেছিল। ওষুধ কেনার জন্যে কত টাকা লাগবে তা সে অনুমান করতে পারছে না। সে চারপাশে তাকিয়ে দেখছিল। এর আগে বিলাস সোমের সময়ে যে অবস্থায় সে হাসপাতালটাকে দেখে গিয়েছে এখনও সেই অবস্থায় রয়েছে। নটার আগে ডাক্তারবাবু রাউণ্ডে বের হবেন না। ততক্ষণ কিছুই করার নেই! সে ধীরে ধীরে নিচে নেমে এল। এবং তখনই তার মনে হল এই পৃথিবীতে সে একা। আজ দিনে কিংবা রাত্রে তাকে শাসন অথবা ভালবাসার মত মানুষ কেউ ধারে কাছে নেই। কারো সঙ্গে পরামর্শ কিংবা কারো কাছে একটু সাহায্য আশা করা যাবে না। এইসময় তার মনে পড়ল পরমহংসকে। কাল সন্ধ্যায় খবর দিয়ে এসেছিল, সে খবর পেয়েছে কিনা কে জানে। কিন্তু এই মানুষটির ওপর আর কতটা নির্ভর করা যায়? শেষ পর্যন্ত একটা একরোখা ভাব জোর করে টেনে আনল অর্ক। যা হবার তা হবে, সে তো আর বাচ্চা ছেলে নয়। মাকে যেমন করেই হোক সারিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এবং তখনই সে জলপাইগুড়ি প্রসঙ্গটি মন থেকে সরাসরি বাদ দিয়ে দিল। যে মানুষটার জন্যে মায়ের এই অবস্থা তাকে খবর দেওয়ার কোন কারণ নেই।

হাসপাতালের এক কোণে ছোটখাটো ভিড়। সেখানে চা বিক্রি হচ্ছে। কাল রাত্রে পাঁউরুটিটা খাওয়া হয়নি। খিদেটা হঠাই টের পেয়ে অর্ক এগিয়ে গেল। চায়ের গ্লাস হাতে নিয়ে সে একটা সিগারেট কিনল। তারপর পাশের একটা বারান্দায় আরাম করে বসল।

সিগারেট খেতে তার এমনিতে ভাল লাগে না কিন্তু এখন বেশ লাগল। দেখতে দেখতে অতবড় সিগারেটটা শেষ হয়ে যাচ্ছিল। খুব সাবধানে টান দিচ্ছিল অর্ক যাতে ছাইটা না ভাঙ্গে। আগুনটা যত নেমে আসছে তত সিগারেটের চেহারা পাল্টে যাচ্ছে। হালকা ছাইটা লম্বা হয়ে একটু বেঁকে আছে। দুই আঙ্গুলে সেটাকে ধরে রেখেছিল অর্ক। শেষের দিকে আর টান দিতে সে ভরসা পাচ্ছিল না। এখন একটু নড়াচড়া হলে ছাইটা নির্ঘাৎ পড়ে যাবে। অথচ এখন ধোঁয়া টানতেও ইচ্ছে করছে। অর্ক সাবধানে ওটাকে ঠোঁটের কাছে নিয়ে আসতেই ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়ল এতক্ষণের বাঁচানো ছাই। নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে সে ছুঁড়ে ফেলল সিগারেটটা, আর টানল না।

পারলে না ভাই??

অর্ক মুখ ফিরিয়ে দেখল একটু পাকা দাড়ি শুড্যা ওর দিকে তাকিয়ে কুতকুতে হাসছে। এবার এগিয়ে এল লোকটা, হয় না, দুকূল রাখা যায় না। ছাইটা হল গিয়ে তোমার স্মৃতি আর আগুনটা হল বর্তমান। তা কি উদ্দেশ্যে আগমন তব, বলে ফেল।

অর্ক দেখল খুবই সাধারণ জামাকাপড় লোকটার পরনে। কথাবার্তায় কেমন যেন রহস্য, একটু যাত্রা যাত্রা ধরন আছে। সে পরিষ্কার জিজ্ঞাসা করল, আপনি কে?

লোকটা হাসল। সামান্য হাত বোলানো দাড়িতে। তারপর বলল, মুশকিল আসান। সব মুশকিলের আসান করি আমি। শুধু এই হাসপাতালের মুশকিলগুলো কিন্তু। আছে তোমার কোন মুশকিল, বলে ফেল, আসান করে দিচ্ছি। তবে হ্যাঁ, যদি বল কারো প্রাণ ফিরিয়ে দিতে হবে, পারব না। যদি বল কাউকে মারতে হবে, পারব। কিছু বুঝলে? কি বুঝলে?

আমি কিছুই বুঝলাম না।

লোকটা বলল, একটা সিগারেট দাও বুঝিয়ে দিচ্ছি।

অর্ক মাথা নাড়ল, আমার কাছে সিগারেট নেই।

ছোট চোখে লোকটা যেন অর্ককে জরিপ করল। তারপর বলল, সাবাস। আমার ব্যবসাক্ষেত্র হল এই হাসপাতাল। মানুষ এখানে রোজ আসছে বিপদে পড়ে। কিন্তু এলেই তো আর কাজ হয় না, আমি সেই কাজগুলো করিয়ে দিয়ে দুটো পয়সা পকেটে পুরি। তোমার কি কেস? কাউকে ভর্তি করতে হবে? কেবিন চাই? এক্সরে করাতে হবে? পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এক্ষুনি দরকার। সব এই শমার হাতে। পনের বছর ধরে লাইন ঠিক রেখে চলছি ভাই। শুধু ওষুধ পাচারটা করি না কিন্তু দুনম্বর ওষুধের ব্যবস্থাটা করে দিই।

দুনম্বর ওষুধ?

বুঝলে না? ধরো তোমাকে ওরা একটা প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিল। একশ টাকার ওষুধ বাইরে থেকে কিনে আনতে হবে। তুমি আমাকে ষাট টাকা দাও, ওগুলো এই হাসপাতালেই পাওয়া যাবে। এবার বুঝলে? না, চা সিগারেট ছাড়া এত কথা হয় না। লোকটা পাকা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে পাশ ফিরছিল কিন্তু অর্ক তাকে ডাকল। সে বুঝতে পারছিল লোকটা একটা দালাল, হয়তো চারশো বিশ কিন্তু ওর বলার ধরনটা তার ভাল লাগছিল। একটা সিগারেট কিনে এনে লোকটার হাতে দিয়ে বলল, আমার কাছে দেশলাই নেই।

আমিও রাখি না বলে দড়ি থেকে ধরিয়ে বলল, এই হাসপাতালের গেট পেরিয়ে এলে আমি আর নিজের পয়সায় কিছু খাই না। তা সমস্যাটা কি?

অর্ক ইতস্তত করে বলে ফেলল, আমার মায়ের খুব অসুখ পেটে যন্ত্রণা হচ্ছে। এইমাত্র এখানে ভর্তি করেছি।

বেড পেয়েছে?

মনে হয় পেয়েছে। ভেতরে নিয়ে গেল ওরা।

নিয়ে গেলেই যে পাবে তার কোন মানে নেই। মেঝেতে ফেলে রাখতে পারে। নটার ডাক্তার আসার আগে টেসে যেতে পারে। আহা, ওভাবে তাকিও না। বাড়িতে তোমার মা কিন্তু এখানে তো পেশেন্ট। কেসটা নেব?

অর্ক কি বলবে বুঝতে পারছিল না। নির্মল যেভাবে ব্যবস্থা করে গেল তাতে মনে হচ্ছিল এখন আর কোন অসুবিধে নেই। কিন্তু এই লোকটার কথা শুনে সব গুলিয়ে যাচ্ছে। সে অসহায় গলায় বলল, দেখুন, আমার কাছে বেশী পয়সা নেই। আপনি যা ভাল মনে করেন তাই করুন।

পেশেন্টের নাম কি?

মাধবীলতা। নামটা বলে অর্ক আবার উচ্চারণ করল, মাধবীলতা দেবী।

এখানে দাঁড়াও, আমি ঘুরে আসছি। সিগারেট খেতে খেতে লোকটা বারান্দায় উঠে গেল। অর্ক দেখল সেখানে দাঁড়িয়ে গাঁজা টানার ভঙ্গীতে দুই টানে পুরো সিগারেট শেষ করে সে ভেতরে ঢুকে গেল স্বচ্ছন্দে। অথচ এখন ভিজিটার্সদের ভেতরে যেতে দেওয়া হয় না। লোকটাকে কেউ আটকাল না।

বেলা যত বাড়ছে হাসপাতালে মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ পরে লোকটাকে দেখতে পেল সে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইশারা করে তাকে ডাকলে। কাছে যেতেই তাকে বলল, মাটিতে ফেলে রেখেছিল, ফ্রি বেড নেই। পেয়িং বেড নেবে তো ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

অর্ক ঘাড় নাড়ল। সে জানেনা পেয়িং বেডে কত টাকা লাগে, কিন্তু মা মাটিতে পড়ে আছে এটা সে ভাবতে পারছিল না। ঘণ্টাখানেক বাদে লোকটা আবার ফিরে এল, যাক, ব্যবস্থা হয়েছে। কেস মনে হচ্ছে ভাল না। সন্ধ্যের আগে চিন্তা করার কোন মানে হয় না। তার আগে তোমাকে আর দরকার হবে না। এখন আমার সঙ্গে অফিসে এসো, বাবু ডাকছে।

এগারটা নাগাদ হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এল অর্ক। মাধবীলতা পেয়িং বেডে ভর্তি হয়েছে। ডাক্তার তাকে দেখেছেন। কিন্তু দেখে তিনি কি বুঝেছেন তা সে জানতে পারেনি। লোকটা তাকে বলেছিল, তুমি গরীব মানুষ, তোমার কাছে বেশী নেবো না। তবে এ লাইনে বিনিপয়সায় কোন কাজ করতে নেই। তুমি তাই আমাকে পাঁচটা টাকা দাও,আমি তোমার মায়েব ওপর নজর রাখব। হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল লোকটা। অর্ক না দিয়ে পারেনি। এতক্ষণে তার বিশ্বাস হচ্ছিল মায়ের জন্য লোকটা অনেক করেছে।

হাঁটতে হাঁটতে অর্কর মন তেতো হয়ে উঠল। শালা এই হল হাসপাতাল? একটা লোক অসুস্থ হয়ে এলে তার যত্ন হবে না যদি না সে বড় লোক হয় কিংবা তার কোন দালাল না থাকে? এটা নাকি গণতান্ত্রিক দেশ! সকলের সমান অধিকার আছে? বিলাস সোম যে আরামে এখানে থাকতো তার মা সেই আরাম পাবে না কেন? কেন ওরা ভিখিরির মত মেঝেতে ফেলে রেখেছিল? অর্কর মনে হচ্ছিল তার হাতে যদি ক্ষমতা আসতো তাহলে এরকমটা হতে দিত না। যারা পার্টি করে তারা এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না কেন?

বাসস্ট্যাণ্ডে এসে অর্ক অসহায় চোখে তাকাল। এত ভিড় যে দরজা পর্যন্ত খোলা যাচ্ছে না। অফিসে ছুটছে মানুষেরা মনুষ্যত্ব হারিয়ে ছাগলরাও বোধ হয় এর চেয়ে আরামে যায়। এরকম দৃশ্য দেখতে অর্ক অভ্যস্ত, কিন্তু আজ যেন নতুন করে এটা চোখে পড়ল। এই যে জন্তুর মত যাওয়া আসা তাতে কারো কোন ক্ষোভ নেই। সবাই এটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছে। অর্কর ইচ্ছে করছিল বাসটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সবাইকে বলে ওভাবে যাবেন না! প্রতিবাদ করুন। সবাই মিলে প্রতিবাদ করলে ওরা আমাদের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেবেই। কিন্তু অর্ক কিছুই করতে পারল না। ঝুলন্ত মানুষগুলোকে প্রায় উড়ে যেতে দেখল সে। আর তখনই তার মনে হল ‘ওরা’ বলতে সে কাদের কথা ভাবছে? যারা সরকার চালায়? তাদের তো সাধারণ মানুষই ভোট দিয়ে পাঠায়? খারাপ কাজ করলে সাধারণ মানুষই তাদের বাতিল করে অন্য দলকে সমর্থন করে। তবু অবস্থার হেরফের হয় না কেন? তাহলে কি সাধারণ মানুষ যদ্দিন সরকার তৈরি করছে তদ্দিন এরকম কষ্ট আর অবিচার চলবে?

ঠিক সেই সময় চোখের ওপর কাণ্ডটা ঘটল। খালপাড় থেকে একটা মালবোঝাই লরি আসছিল। পুলের কাছে যে ট্রাফিক পুলিসটা দাঁড়িয়েছিল সে লরিটাকে আটকালো। প্রচণ্ড তর্কাতর্কি হচ্ছে ড্রাইভার আর পুলিসটার মধ্যে। দুপাশের গাড়িঘোড়া রাস্তা বন্ধ থাকায় দাঁড়িয়ে গেছে। অফিসযাত্রীরা বেশ অসহিষ্ণু গলায় চেঁচাচ্ছে। পুলিসটা হাত বাড়িয়েই আছে। কোনদিকে ভূক্ষেপ নেই তার। শেষ পর্যন্ত ড্রাইভার একটা আধুলি ছুঁড়ে দিতে পুলিস লরি ছেড়ে দিল। আধুলিটা পিচের রাস্তায় গড়িয়ে এদিকে চলে আসছিল। পুলিস দৌড়ে আসছে ওটাকে ধরবার জন্য। বাসযাত্রীরা এবার হো হো করে হাসল, শালা মাল নেবার জন্য জ্যাম করালো।

চকিতে অর্ক এগিয়ে গেল। আধুলিটা মুঠোয় নিয়ে সে পুলিসটার দিকে কটমটে চোখে তাকাল। পুলিস সেটা একদম লক্ষ্য না করে নিঃশব্দে হাত বাড়াল তার দিকে। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কি চাই?

হামারা পয়সা।

ওটা তোমার পয়সা?

হ্যাঁ। হামলোকো মিলতা হ্যায়।

হঠাৎ অর্কর মাথা গরম হয়ে উঠল, মারব শালা এক থাপ্পড়। সবার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুষ নিচ্ছে আবার বলছে মিলতা হ্যায়।

পুলিসটা যেন থতমত হয়ে গেল। একবার হলদে দাঁত বের করে হাসবার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত হন হন করে ফিরে গেল ডানলপের বাক্সের ওপর। তারপরে সদর্পে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে লাগল সে। কিন্তু অর্ক দেখল লোকটা তাকে আড়চোখে লক্ষ্য করছে। ওকে দেখিয়ে অর্ক একটা ভিখিরি বুড়িকে ডেকে আধুলিটা তুলে দিল তার হাতে। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে এল শ্যামবাজারের মোড়ে।

এতক্ষণে তার উত্তেজনা কমে এসেছিল। ভীষণ অবসাদ লাগছিল এখন। পেটের ভেতরটা কনকন করছে কিন্তু খিদে বোধটুকু পর্যন্ত হচ্ছে না। অর্ক ভেবে পাচ্ছিল না কোথায় যাওয়া যায়! তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেনে ফিরে যেতে একটুও ইচ্ছে করছিল না তার। একা ওই ঘরে থাকা অসম্ভব।

মায়ের চিকিৎসার জন্য টাকা দরকার। ওর কাছে এখন গোটা পঞ্চাশেক পড়ে আছে। ভোরে মাকে নিয়ে আসার সময় এটাই এনেছিল সে। ঘরে মায়ের জমানো টাকা কিছু আছে কিনা জানা নেই। অবশ্য জলপাইগুড়ি থেকে ঘুরে আসার পর মায়ের হাতে টাকা না থাকাই স্বাভাবিক। কোথায় টাকার জন্য যাওয়া যায়? প্রথমেই মনে পড়ল তার মাধবীলতার স্কুলের কথা। সেখানে গিয়ে মায়ের অসুস্থতার খবর দেওয়া দরকার। দিলে নিশ্চয়ই কিছু টাকার ব্যবস্থা হবে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল খবর দেওয়া এক কথা আর টাকা চাওয়া–সেটা সম্মানের হবে কি? ওরা ভাবতে পারে যে এমন ছেলে যে মায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারে না। অবশ্য মায়ের যদি চিকিৎসা বাবদ কোন টাকা স্কুল থেকে পাওনা হয় তাহলে আলাদা কথা। এই ব্যাপারটা সে কিছুই জানে না। তবে খবরটা দিতে হবে।

এছাড়া আর কোত্থেকে টাকা পাওয়া যাবে? পরমহংসের মুখ মনে পড়ল তার। মায়ের অসুখের খবর পেলে পরমহংসকাকু নিশ্চয়ই কিছু সাহায্য করবে। এছাড়া? হঠাৎ তার মনে বিলাস সোমের মুখটা ভেসে এল। লোকটা বড়লোক। গিয়ে দাঁড়ালে কি ফিরিয়ে দেবে? তাছাড়া সে লোকটার দুর্বলতা জানে। ধৎ, ওটা একদম চারশো বিশি কারঝর হবে। নিজের মনে মাথা নাড়ল সে।

স্কুল থেকে বেরিয়ে অর্ক কিছুক্ষণ আচ্ছন্ন হয়ে রইল। মাকে যে এরা এতটা ভালবাসেন তা সে অনুমান করতে পারেনি। হেডমিসট্রেসকে খবরটা দেওয়ামাত্র হইচই পড়ে গেল যেন। অন্য টিচাররা ছুটে এলেন। এতক্ষণ ধরে অর্ককে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে জেনে নিয়েছেন ওঁরা মাধবীলতা কেমন আছে। কি হয়েছে তা স্পষ্ট করে না বলতে পারলেও উপসর্গ জেনে এক একজন এক একটা রোগের নাম করেছে। বিকেলে কখন গেলে দেখতে পাওয়া যাবে জেনে নিল সবাই। সৌদামিনী বললেন, তোমার বাবা তো অশক্ত মানুষ, তাঁর পক্ষে ছুটোছুটি করা বোধহয় সম্ভব হবে না। তুমি দেখবে যেন তোমার মায়ের কোন অযত্ন না হয়। আমরা আছি যখন যা দরকার হবে বলবে। জেনে রেখো, পৃথিবীতে মায়ের সেবা করার চেয়ে পুণ্য আর কিছুতেই নেই। তারপর কিছু মনে পড়ায় জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের কাছে টাকা পয়সা আছে তো!

আর একজন টিচার তখন বললেন, এব্যাপারে মিস্টার মিত্রের সঙ্গে আলোচনা করাই ভাল।

সৌদামিনী ঘাড় নাড়লেন, ঠিক। তোমার বাবার সঙ্গে কিভাবে দেখা হবে? উনি কি বিকেলে হাসপাতালে আসবেন?

অর্ক একটু ইতস্তত করল। মা কি বলেছে এদের তা সে বুঝতে পারছে না। কিন্তু সত্যি কথাটা লুকিয়ে কোন লাভ নেই। এরাই একমাত্র মায়ের প্রকৃত বন্ধু। সে নিচু গলায় বলল, উনি এখন জলপাইগুড়িতে।

সৌদামিনীর কপালে ভাঁজ পড়ল, তাই নাকি? তাঁকে খবরটা জানিয়েছ? জানাওনি! ইমিডিয়েটলি একটা টেলিগ্রাম করে দাও। ঠিক আছে, বিকেলে আমি গিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে যা করার করব।

স্কুল থেকে বেরিয়ে আচ্ছন্নভাবটা কেটে গেলে অর্কর একটু হালকা লাগল। যাক, মায়ের চিকিৎসার কোন ত্রুটি হবে না। কিন্তু তাই বলে সে কিছুতেই জলপাইগুড়িতে টেলিগ্রাম করতে পারবে না। মা নিজেও চায়নি তার অসুস্থতার কথা অন্য কেউ জানুক।

শরীরটায় কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। স্নানটান করে একটু শুলে হয়তো ভাল লাগবে ভেবে অর্ক ঈশ্বর পুকুরে ফিরে এল। এখন ভর দুপুর। নির্জন গলি দিয়ে অর্ক বাড়িতে ঢুকল। অনুদের দরজায় তালা ঝুলছে। দরজা খুলে সে খাটের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়তেই গা গুলিয়ে উঠল। মুখ তেতো হয়ে যাচ্ছে। এখন তার আর খিদে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ শোওয়ার পর তার আর উঠতে ইচ্ছে করছিল না। অবসাদ থেকে কখন যে ঘুম এসে যাচ্ছে তা সে টের পেল না।

হঠাৎ কপালে একটা শীতল নরম স্পর্শ পেতেই চমকে উঠে বসল অর্ক। ঝুমকি জিজ্ঞাসা করল, কি হল?

তুমি কখন এলে? অর্ক বিস্মিত হয়ে ভেজানো দরজার দিকে তাকাল।

এই তো। মা কেমন আছে?

ভাল। তুমি যাও।

যাবই তো। আমি কি থাকতে এসেছি? ভাত খাবে?

না আমি কিস্যু খাব না। তুমি চটপট চলে যাও নইলে বস্তির লোকে নানান কথা বলবে।

বলুক। তুমি ভাত খেলে আমি রেঁধে দিতে পারি।

তুমি রাঁধতে যাবে কেন?

এবার যেন লজ্জা পেল ঝুমকি। তারপর নিচু গলায় মুখ নামিয়ে বলল, আমি খুব খারাপ মেয়ে তাই বলে আমার কিছু ইচ্ছে করতে নেই?

অর্ক হতভম্ব হয়ে বলল, যাচ্চলে!

৪৭. বিকেলে হাসপাতালে মাধবীলতা

বিকেলে হাসপাতালে মাধবীলতার স্কুলের টিচার্সরা এসেছিলেন। তাঁরা দেখলেন মাধবীলতা ঘোরের মধ্যে রয়েছে। নার্স কথা বলতে নিষেধ করেছিল। মাঝে মাঝে দাঁতে দাঁতে শব্দ হচ্ছে। এবং তখনই অস্ফুটে কিছু যন্ত্রণার শব্দ উচ্চারণ। হঠাৎ যদিও বা চোখ খুলেছে কিন্তু দৃষ্টিতে কাউকে ধরতে পারেনি। যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা অসহায় চোখে দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারেননি।

অর্ক এসেছিল চারটের সময়। মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল টিচার্সরা না আসা পর্যন্ত। নার্স তাকে জানিয়েছে যে ডাক্তারবাবু ওর খোঁজ করেছেন এবং আজই ভিজিটিং আওয়ার্সের পর যেন সে দেখা করে। নার্স আরও জানিয়েছে, পেশেন্টের অবস্থা ভাল নয়। কিন্তু কি হয়েছে তার বিশদে গেলেন না মহিলা। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল খুব বেশী কথা কোনকালেই বলেন না।

শেষ পর্যন্ত হেডমিস্ট্রেস সৌদামিনী সেনগুপ্তা ইঙ্গিত করে সবাইকে বাইরে নিয়ে এলেন। অর্কর ইচ্ছে করছিল না মায়ের পাশ থেকে উঠে যেতে। এই কয়েক ঘণ্টায় মাধবীলতাকে যেন অন্যরকম দেখাচ্ছে। ভীষণ ফ্যাকাশে এবং বয়সের তুলনায় যেন অনেক ছেলেমানুষ। শরীরটাকে গুটিয়ে ছোট করে এমনভাবে শুয়ে আছে যে সেই মাধবীলতা বলে চেনা মুশকিল। খুব কষ্ট হচ্ছিল অর্কর। তার ইচ্ছে করছিল মাকে একবার ডাকে, ডেকে জিজ্ঞাসা করে কি প্রয়োজন! এইসময় নীপা মিত্র এসে দাঁড়াল তার পাশে, তোমাকে বড়দি ডাকছেন।

অর্ক খানিকটা অবাক হল। সে ওইভাবে তাকাতে নীপা বলল, তুমি আমাকে চেন না। তোমার মা আমাকে খুব ভালবাসে। আমায় নীপা, বলে একটু ইতস্তত করল নীপা। সম্পর্কে তাকে মাসী বলতে বলা উচিত। কিন্তু এতবড় ছেলের মাসী তার ঠিক পছন্দ হচ্ছিল না। সে কথাটা শেষ করল, আমায় নীপাদি বলল।

নীপার সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে আসতেই দেখল টিচার্সরা এক জায়গায় জড়ো হয়ে আছেন। সৌদামিনী তাকে দেখে এগিয়ে এলেন, কোন ডাক্তার দেখছে?

ডাক্তার এস কে দত্তগুপ্ত।

দত্তগুপ্ত। এস কে, এস কে মানে সুধীর? সৌদামিনীর চোখ দুটো ছোট হল।

জানি না।

এসো তো আমার সঙ্গে। অফিসটা কোথায়? হন হন করে সৌদামিনী চললো অফিসরুমে। বাধ্য হয়ে অর্ককে সঙ্গী হতে হল। সৌদামিনীর হাঁটার ভঙ্গীতেই বোঝা যায় তিনি কাউকে বড় একটা কেয়ার করেন না। জেরা করে সৌদামিনী আবিষ্কার করলেন তাঁর ধারণাই ঠিক। এস কে দত্তগুপ্ত তাঁর পরিচিত সুধীর। হেসে বললেন, বদ্যি ডাক্তারকে বদ্যি হয়ে চিনবো না! যাক সুধীর যখন দেখছে তখন আর কোন চিন্তা নেই। আমি তাকে বলে দিচ্ছি। সে কোথায়?

জানা গেল ডাক্তার তখন শ্যামবাজারের এক নার্সিং হোমে অপারেশন করছেন। নার্সিং হোমের নাম্বার নিয়ে সৌদামিনী পাবলিক টেলিফোনে জানিয়ে দিলেন, ডাক্তারকে যেন খবর দেওয়া হয় তিনি হাসপাতালে অপেক্ষা করছেন। রিসিভার নামিয়ে রেখে তিনি টিচার্সদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, বুঝতেই পারছ কেস ভাল নয়। তবে ভরসা এই যে একজন চেনা ডাক্তারের হাতে ও আছে। তা তোমরা আর এখানে দাঁড়িয়ে কি করবে! সংসার টংসার আছে, তোমরা বাড়ি চলে যাও।

নীপা মিত্র হাসল, ওসব বালাই তো আমার নেই বড়দি, আমি থেকে যাই। সৌদামিনী সেটা অনুমোদন করতে অন্য টিচার্সরা সুপ্রিয়া করের গাড়িতে ফিরে গেলেন। এবার সৌদামিনী অর্কর দিকে তাকালেন, তোমার মায়ের এই ব্যাপারটা প্রায়ই হত, না?

অর্ক মাথা নাড়ল, আমি বুঝতে পারিনি কখনও।

চমৎকার ছেলে তো। দ্যাখো নীপা, মা অসুস্থ কিনা তা ছেলে খোঁজ রাখা দরকার বলে মনে করে না। সৌদামিনী ঠোঁট ওল্টালেন।

নীপা বলল, ওভাবে বলছেন কেন? ওর মা যদি চেপে থাকে তাহলে ও জানবে কি করে। চিরকাল তো মুখ বুজে সহ্য করে গেল।

রাবিশ! সব শরৎচন্দ্রের নায়িকা হয়ে জন্মেছে। ওই লোকটা এইদিকে তাকিয়ে অমন করছে কেন? সৌদামিনীর গলায় সন্দেহ।

অর্ক দেখল সকালের সেই লোকটা দূরে দাঁড়িয়ে তাকে ইশারা করছে। সে বলল, এই লোকটার খুব ক্ষমতা আছে। সকালে মাকে ভরতি করতে সাহায্য করেছিল। কোন দরকার হলেই বলতে বলেছে।

নীপা মিত্র জিজ্ঞাসা করল, এখানে কাজ করে?

না। এই ওর পেশা।

দালাল। সৌদামিনী মাথা নাড়লেন, এদের থেকে দূরে থাকতে হয়। দালালদের কখনও প্রশ্রয় দেবে না। হ্যাঁ, মাধবীলতা কি বাড়িতে টাকা পয়সা রেখেছে?

খুব বেশী নেই, মানে আমি পঞ্চাশ টাকা পেয়েছি।

মাত্তর! ঠিক আছে, ওর খরচ আমি দিচ্ছি আপাতত। পরে হিসাব করা যাবে। একটা বসার জায়গা দ্যাখো তো, এভাবে বকের মত দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না।

সন্ধ্যে হব হব এই সময় ডাক্তার সুধীর দত্তগুপ্ত এলেন। সৌদামিনীর তাঁকে কজা করতে বেশী সময় লাগল না। সুধীর বললেন, আপনি? কি ব্যাপার? আমি তো খবর পেয়ে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

আপনাদের হাতে তো মহাপাপ না করলে কেউ পড়ে না! শুনুন। আমার স্কুলের একটি টিচার খুব অসুস্থ হয়ে আজ ভর্তি হয়েছে। শুনলাম আপনার হাতে রয়েছে। আমি চাই ও সেরে উঠে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরুক।

সৌদামিনী সুস্পষ্ট হুকুম জারি করলেন।

কি নাম বলুন তো? কি কেস? আজ ভর্তি হয়েছে?

মাধবীলতা মিত্র। সৌদামিনী জানালেন।

অর্ক শুনছিল। উপাধিটা শোনা মাত্র সে ভাবল প্রতিবাদ করবে। এইসময় ডাক্তার মাথা নেড়ে বললেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। দাঁড়ান দেখছি।

অর্ক বলল, আপনি আমাকে দেখা করতে বলেছিলেন। নার্স তাই বলল, আমার মায়ের কথা উনি বলছেন। আজ সকালে ভর্তি হয়েছেন। পেটে খুব যন্ত্রণা।

এবার সুধীর ডাক্তার চিনতে পারলেন, ওহো! তারপর গম্ভীর মুখে সৌদামিনীকে বললেন, আপনার স্কুলে পড়ান মহিলা! মাইনেপত্র দেন না নাকি?

মানে?

ভদ্রমহিলা একদম রক্তশূন্য। নিয়মিত খাওয়া-দাওয়া করেননি। পেটে কিছু একটা বাধিয়েছেন। আজ দুপুরে এক্সরে করা হয়েছে। রিপোর্টটা দেখে আমাকে ঠিক করতে হবে অপারেশন করতে হবে কিনা। কিন্তু লক্ষণ তাই বলছে। আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। আমি হাতের কাজগুলো শেষ করে কথা বলছি।

এক ঘণ্টা পরে জানা গেল মাধবীলতার পেপটিক আলসার হয়েছে। অবস্থা খুবই খারাপের দিকে এবং অবিলম্বে অপারেশন করা দরকার। কিন্তু এরকম অ্যানিমিয়া পেশেন্টকে অপারেশন টেবিলে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে বেশ ঝুঁকি রয়েছে। সুধীর দত্তগুপ্ত বললেন, এটাকে আত্মহত্যার কেস ছাড়া আর কি বলব। জেনে শুনে নিজেকে শেষ করা হয়েছে। ওঁকে বাঁচাতে গেলে ঝুঁকি নিতেই হবে।

নীপা মিত্র বলল, আপনি অপারেশন করুন। যা দরকার আমরা করব।

ডাক্তার বললেন, মিস্টার মিত্র কোথায়?

এরা কিছু বলার আগেই অর্ক জানাল, উনি বাইরে আছেন। যা বলার আমাকে বলুন। আমিই এখন ওর সব।

কথাটা বলতে পেরে অর্কর মন হঠাৎ খুশিতে ভরে গেল। ডাক্তার একবার ওর দিকে তাকালে, ঠিক আছে।

অপারেশন হবে ছত্রিশ ঘণ্টা পরে। এ বাবদ যা যা লাগবে সব জেনে নিলেন সৌদামিনী। এদিন আর কিছুই করার ছিল না। ওরা যখন হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসছে তখন অর্কর চোখে পড়ল পরমহংস হন্তদন্ত হয়ে ঢুকছে। ওকে দেখেই প্রায় ছুটে এল সে, কি হয়েছে?

মায়ের খুব অসুখ। অপারেশন করতে হবে।

সেকি! কি হয়েছে? পরমহংস হতভম্ব।

পেপটিক আলসার। খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।

কি আশ্চর্য! এসব কবে হল? আমি তো কিছুই জানি না।

আমিও জানতাম টানতাম, না। কালই ধরা পড়ল।

অনিমেষ কোথায়? সে আসেনি?

না।

কেন?

দাদু মারা গেছেন। তাই সেখানেই থেকে যেতে হয়েছে।

দাদু শব্দটা উচ্চারণ করার মোটেই ইচ্ছে ছিল না অর্কর। কিন্তু এখানে সবার সামনে অন্য কিছু বলার কথা মাথায় আসল না। পরমহংস বলল, কি আশ্চর্য! আমি তো কিছুই জানি না। তুমি যে কাল গিয়েছিলে সে খবর আজ সকালে পেলাম। অফিস থেকে ছুটে আসছি। তোমার পাশের ঘরের একটা মেয়ে বলল যে তোমরা হাসপাতালে এসেছ। অনিমেষকে খবর দেওয়া হয়েছে?

অর্ক কথা না বলে মাথা নাড়ল।

সৌদামিনী এতক্ষণ একটাও কথা বলেননি। কিন্তু পরমহংসকে একটু বিস্ময়ের চোখেই দেখছিলেন। বেঁটে মোটা শরীর নিয়ে পরমহংস ছটফট করছে। অর্ক এবার পরিচয় করিয়ে দিল, পরমহংস কাকু, এঁরা আমার মায়ের স্কুলের টিচার আর ইনিও। বলতে হল না অর্ককে, পইংস হাতজোড় করে শেষ করে দিল, ওর মা এবং বিশেষ করে বাবার সহপাঠী, বন্ধু। কি অবস্থা মাধবীলতার?

সৌদামিনী বললেন, অপারেশন হবে। এখন অবশ্য দেখা করে কোন লাভ নেই। ঘুমের ওষুধ দিয়ে রেখেছে।

শেষের কথাটার ইঙ্গিত পরমহংস যেন ধরতেই পারল না, না, না। আমি দেখা করতে যাচ্ছিও না। কিন্তু অপারেশন যাতে যত্ন নিয়ে করে তার ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের এক ডাক্তার বন্ধু বোধহয় এই হাসপাতালেই বা সৌদামিনী হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন, ওসব দরকার হবে না। আমার পরিচিত ডাক্তারের কাছেই ও পড়েছে। চিকিৎসার জন্যে যা লাগবে তা আপাতত আমরা দিচ্ছি। আপনারা একটু হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন। নীপা, চল, শ্যামবাজার পর্যন্ত একসঙ্গে যাই। ও হ্যাঁ, কাল যদি কোন প্রয়োজন হয় তাহলে স্কুলে দেখা করো। আমি বিকেলে আসব।

নীপা মাথা নাড়ল। সৌদামিনী এগিয়ে গিয়েছিলেন। নীপা অর্ককে বলল, ভয় পেয়ো না, মা সেরে উঠবেই। কিন্তু তুমি এখন একা থাকবে কি করে?

অর্ক হাসল, কেন? আমি কি ছেলেমানুষ?

নীপা অর্কর মুখের দিকে তাকাল। তারপর চলে যাওয়ার আগে বলল, যদি কখনও কোন প্রয়োজন হয় তাহলে আমার কাছে চলে এস। বাইশের এক মুকুন্দ দাস লেনে আমি থাকি। চলি।

পরমহংস ওঁদের চলে যাওয়া দেখছিল। এবার বলল, অপারেশন ছত্রিশ ঘণ্টা পরে হবে কেন?

জানি না।

ডাক্তারের সঙ্গে একবার কথা বলতে পারলে ভাল হত। তুমি যাবে একবার আমার সঙ্গে।

আমরা তো এইমাত্র কথা বললাম। উনি পরশু অপারেশন করবেন বলে দিয়েছেন।

কেস কিরকম, কিছু বলল? প্রশ্নটা করার সময় পরমহংসর গলা নেমে এল।

ভাল নয়। অর্ক মুখ নামাল।

পরমহংস অর্কর সঙ্গে বেরিয়ে এল ট্রাম রাস্তায়। কতগুলো জিনিসের কথা অর্কর একদম খেয়ালে ছিল না। ভোরে যখন সে মাধবীলতাকে ভর্তি করতে এসেছিল তখন প্রায় খালি হাতেই এসেছিল। বিকেলে হাসপাতালে গিয়ে একটা তোয়ালে সাবান ইত্যাদি দেখতে পেয়েছে। সৌদামিনী একজন পরিচারিকার ব্যবস্থা করেছেন। এসব তার মাথায় ছিল না। পরমহংস ট্রাম রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করতেই তার খেয়াল হল, সৌদামিনীরাই এসব করেছেন।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা শ্যামবাজারের মোড়ে চলে এল। পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, খিদে পেয়েছে তোমার?

অর্ক বলল, না, থাক। সত্যি ওর খিদে বোধটুকুই হচ্ছিল না।

থাকবে কেন? এস। প্রায় জোর করে ওকে নিয়ে পাঞ্জাবীর কষা মাংসের দোকানে ঢুকল পরমহংস। প্রচণ্ড ভিড় দোকানটায়। তার মধ্যে জায়গা করে নিয়ে বসে খাবারের অর্ডার দিয়ে পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, তোমার মায়ের সেন্স আছে তো?

বুঝতে পারছি না। এখন বোধহয় ওরা ওষুধ দিয়েছে।

এরকম একটা অসুখ হচ্ছে তোমরা কেউ টের পাওনি?

না।

পরমহংস মাথা নাড়ল, জলপাইগুড়ির খবর বল।

অর্ক পরমহংসর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি খবর?

পরমহংস কি বুঝল সেই জানে! এই সময় খাবারের প্লেট দিয়ে যেতে সে এগিয়ে দিল, খেয়ে নাও।

অনেককাল আগে চাঁদার পয়সায় এই দোকানে অর্ক আর বিলু কষা মাংস আর রুটি খেয়েছিল। আজকের মেনু অবিকল তাই। কিন্তু এখন খেতে একদম ভাল লাগছে না। অথচ মুখে দেওয়ার পর সে বুঝল তার খিদে আছে। বয়দের চিৎকার, চারপাশে খাওয়ার শব্দ, মাংসের তীব্র গন্ধ এবং পরমহংসর উপস্থিতি সব মিলিয়ে খিদে সত্ত্বেও অর্ককে নিস্পৃহ করে দিচ্ছিল। কোনরকমে খাওয়া শেষ করে সে বাইরে আসতেই বিলুকে দেখতে পেল। পরমহংস তখন বেসিনে হাত ধুচ্ছিল। বিলু। খুব সেজেগুঁজে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচমাথার মোড়ে। চোখাচোখি হতেই বিলু মুখ ফিরিয়ে নিল। অর্ক এক পা এগিয়ে থেমে গেল। বিলু যেন তাকে দেখেও দেখছে না। তার মানে এখন চিনতে চাইছে না বিলু। অর্ক অবাক হয়ে লক্ষ্য করছিল। মানুষজনের ক্রমাগত যাওয়া আসায় বিলুকে নজরে রাখা মুশকিল। এই সময় পরমহংস টুথপিক ঠোঁটে চেপে বেরিয়ে এল, শোন, তোমাকে আজ আর বেলগাছিয়ায় ফিরতে হবে না। আমার ওখানে চল।

কেন?

পরমহংস থতমত হয়ে গেল, কেন মানে? তুমি একা থাকবে কি করে?

থাকতে পারব।

বোকামি করো না, চল।

আমি বোকামি করছি না। বলতে বলতে অর্কর খেয়ালে এসে গেল, হাসপাতালে মায়ের ঠিকানা দেওয়া আছে। যদি কোন দরকার হয় তাহলে ওরা ওখানেই খবর দেবে। আমি না থাকলে জানতেও পারব না।

যুক্তি অস্বীকার করতে পারল না পরমহংস। যদিও তার ইচ্ছে ছিল না অর্ক একা থাকুক। সে বলল, তাহলে বাড়ি চলে যাও। আমি কাল সকাল দশটায় হাসপাতালে যাব। তখন দেখা হবে। তোমার কাছে টাকা আছে?

অর্ক মাথা নাড়ল, আছে।

পরমহংস এবার অর্কর কাঁধে হাত রাখল, ভয় পেয়েছো? তোমার মা ভাল হয়ে উঠবেই। চলি। পরমহংসর শরীর ভূপেন বোসঅ্যাভিন্যর দিকে মিলিয়ে যেতে অর্ক হেসে ফেলল। সমান। সমান অথবা দৈর্ঘ্যে বড় মানুষ কাঁধে হাত রাখলে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গী হয়, হয়তো পাওয়া যায় কিন্তু অত খাটো মানুষ যদি উচিয়ে হাত রাখে তাহলে–! সে এবার চট করে বিলুর দিকে তাকাল। বিলু ফুটপাথ ঘেঁষে আরও একটু সরে গেছে।

অর্ক এগিয়ে গেল। বিলু তাকে লুকোতে চাইছে অথচ জায়গাটা ছেড়ে যেতে পারছে না। কারণটা জানতেই হবে। সে বিলুর সামনে এসে দাঁড়াতেই বিলু মাথা নাড়ল, সরে যাও কথা বলো না।

কেন? বিলুর মুখভঙ্গী দেখে অর্কর হাসি পাচ্ছিল।

একজন আসবে!

কে?

তুমি চিনবে না গুরু। অনেক টাকার ধাক্কা। পরে কথা বলব। এখন সরে যাও। বলতে বলতে বিলু দু’পা এগিয়ে গেল, যেন অর্ককে এড়াতে চাইল। আর তখনি একটা ট্যাক্সি উল্টো ফুটপাথে এসে দাঁড়াতেই বিলু ছুটে গেল সেদিকে। অর্ক দেখল ট্যাক্সিতে বসে থাকা আরও দুজন লোকের সঙ্গে বিলু চলে গেল শিয়ালদার দিকে। বিলুর হাবভাব, ট্যাক্সিটার নিঃশব্দে আসা এবং দ্রুত চলে যাওয়া, অর্কর বিশ্বাস হল বিলু খুব বড় অপরাধের মধ্যে জড়িয়ে পড়ছে। অনেক টাকার ব্যাপার যখন তখন দায়টা কম নয় নিশ্চয়ই। বিলুর জন্যে খারাপ লাগছিল অর্কর। ও যে একটা অপরাধের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে তাতে সন্দেহ নেই। এবং এই অপরাধের ধরন পাড়ার মাস্তানির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা জাতের তাতে সন্দেহ নেই।

অর্কর কিছুই ভাল লাগছিল না। সন্ধ্যেটা পেরিয়ে গেছে। সে মোহনলাল স্ট্রীট দিয়ে এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে দেশবন্ধু পার্কে এসে গেল। গেটের মুখটায় বেশ জমজমাট। বিশাল মাঠটা অন্ধকার আলোয় মাখামাখি। অর্ক মাঠটা পেরিয়ে একধারে বসল। ঘাসের ওপর অজস্র বাদামের খোলা আর মাথার ওপর অগুনতি তারা। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ শরীরে কাঁপুনি এল তার। এই পৃথিবীতে যদি সে একা হয়ে যায়? মা এখন হাসপাতালে, অপারেশনের পর যদি আর না বাঁচে? যাকে এতকাল বাবা বলে জানতো তাকে আর এখন বাবা বলে সে ভাবতেই পারছে না কেন? এতকালের সম্পর্ক, কাছে থাকা, সব এক রাত্রে ভেঙ্গে যেতে পারে? জলপাইগুড়ি থেকে আসার সময় সে মায়ের নির্দেশে সবাইকে প্রণাম করেছিল শুধু বাবাকে ছাড়া। ব্যাপারটা নিশ্চয়ই মা লক্ষ্য করেছে কিন্তু কিছু বলেনি। মা কি বাবাকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলেছে? অর্ক ভাবতে পারছিল না। তার মনে হচ্ছিল মায়ের যেমন সে এবং বাবা ছাড়া পৃথিবীতে কেউ নেই তেমনি মা এবং সে ছাড়া বাবারও কোন আপন মানুষ নেই। তাহলে?

একটা কাঠি কুড়িয়ে অন্যমনস্ক অর্ক মাটি খুঁড়ছিল। এইসময় তার খেয়াল হল সে একা নেই। খানিক দূরে অনেকেই জোড়ায় জোড়ায় বসে ছিল কিন্তু আরও দুজন খুব কাছেই কখন বসেছে। অন্ধকারে তাদের মুখ চোখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু মেয়েটির উচ্ছ্বসিত হাসি তাকে চমকে দিল। আর তারপরেই কাণ্ডটা ঘটল। তিনটে মানুষ অন্ধকার কুঁড়ে সেখানে উদয় হল। তাদের একজনের হাতে টর্চ। একজন টিটকিরি দিয়ে বলে উঠল, বাঃ, চমৎকার, ব্লাউজের বোতাম এর মধ্যেই খুলে ফেলেছেন? একেবারে প্রদর্শনী! উঠুন বুক ঢাকুন। থানায় যেতে হবে আপনাদের।

ছেলেটি কুঁকড়ে উঠল, কেন? আমরা কি করেছি?

কি করেছ? প্রকাশ্যে অশ্লীলতা করার অপরাধে তোমাদের থানায় যেতে হবে।

ছেলেটি কাকুতি মিনতি করছিল। অর্ক লক্ষ্য করল মেয়েটি কোন কথা বলছে না। হঠাৎ সে সোজা হয়ে বসল। মেয়েটি অনু না? অনুপমা! বিস্ময় বাড়ল ছেলেটিকে দেখে। সেই হকার ছেলেটি যাকে অনু বিয়ে করেছে। ওরা তো স্বামী-স্ত্রী, কিন্তু এখানে কেন? অর্ক এক লাফে উঠে দাঁড়াতেই টর্চ হাতে লোকটা ছেলেটিকে খিঁচিয়ে উঠল, ফুর্তি মারার আগে খেয়াল ছিল না, পরের বউকে ভাগিয়ে নিয়ে এসে মজা লুটছ?

ছেলেটির গলায় প্রতিবাদ করার চেষ্টা, এ পরের বউ না!

ফের মিথ্যে কথা, চল। ছেলেটির হাত খপ করে ধরল টর্চওয়ালা।

অর্ক এর মধ্যে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিসগুলো ওকে দেখে দাঁত বের করে হাসল, সব বৃন্দাবন করে ছেড়েছে।

ওদের ছেড়ে দিন। অর্ক পুলিসদের দিকে তাকিয়ে হাসল।

ছেড়ে দেব, কেন?

ওরা স্বামী-স্ত্রী।

আপনি এদের চেনেন?

চিনি।

এই সময় একটা পুলিস বলে উঠল, এ শালা নিশ্চয়ই সাকরেদ।

অর্ক আবার হাসল, ওসব বলে কোন লাভ হবে না। আপনারা ওদের থানায় নিয়ে যেতে চান, চলুন, আমিও যাচ্ছি। এরা যে স্বামী-স্ত্রী তা প্রমাণ করতে কোন অসুবিধে হবে না। আপনারা কেস চান তো অন্য জায়গায় দেখুন।

আপনি থানায় যাবেন?

হ্যাঁ। ডি সি নর্থ আমার মেলোমশাই।

এবার পুলিসগুলোর মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। একজন বলল, যাঃ শালা। এদের ধরতে অন্য কেস হাতছাড়া হয়ে গেল। ঠিক আছে, আপনি যখন বলছেন এরা স্বামী-স্ত্রী তখন, তবে যা করছিলেন তা কিন্তু বেআইনী।

অর্ক দেখল দূরের একটা ঝোপ লক্ষ্য করে ছুটে যাচ্ছে পুলিসগুলো। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি অর্কর হাত চেপে ধরল, আপনি আমাদের চেনেন?

অর্ক মাথা নাড়ল, চিনি। কিন্তু ডি সি নর্থ আমার কেউ হন না, মিথ্যে বলেছি। না বললে ওরা আপনাদের নিয়ে ঝামেলা করত। কথাগুলো বলতে বলতে অর্ক অনুপমার দিকে তাকাচ্ছিল। অনুপমা যে তাকে চিনেছে বোঝা যাচ্ছে কারণ তার মুখ মাটির দিকে নামানো।

ছেলেটি অবাক হয়ে বলল, কি করে চিনলেন?

আমি ওর পাশের ঘরে থাকি। কিন্তু এখানে আর আপনাদের দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক নয়। চলে যান।

ছেলেটি অনুপমার দিকে তাকাল। তারপর বলল, আপনিও চলুন না, ওই গেটটা পর্যন্ত গেলেই চলবে।

মিথ্যে কথাটা বলার পর থেকেই অর্কর অস্বস্তি হচ্ছিল। কোন কিছু চিন্তা না করে ও তখন পুলিসগুলোকে ভোলাতে মিথ্যে বলেছে। খুব বড় ওপরওয়ালার নাম শুনতে। ওরা দমে যায় সেটা হাতে হাতে প্রমাণ হল। বিলু ঠিকই বলেছিল। কিন্তু হঠাৎ যদি পুলিসগুলো ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করে মেলোমশাই-এর নাম কি তাহলে সে বলতে পারবে না। অর্কর অস্বস্তির সঙ্গে ভয় মিশল। সে ছেলেটির সঙ্গে গেটের দিকে পা বাড়াল। পেছনে চুপচাপ অনুপমা।

হাঁটতে হাঁটতে অর্কর মন খিঁচিয়ে উঠল। এরা আর জায়গা পেল না ওসব করার। বিয়ে করেছে তবু মাঠের অন্ধকারে এসে পুলিসকে কথা বলার সুযোগ দিচ্ছে। এদের সমর্থনে এগিয়ে যাওয়াই ভুল হয়েছে। তখন পুলিসগুলো এমন গলায় ধমকাচ্ছিল আর অনুপমার মুখের চেহারা যেভাবে চুপসে গিয়েছিল যে সে চুপচাপ বসে থাকতে পারেনি। এখন মনে হচ্ছে সে একটা অন্যায়কে সমর্থন করেছে। প্রকাশ্যে ওসব করা নিশ্চয়ই জঘন্য ব্যাপার নোংরামি। এসব নিয়ে যত ভাবছিল তত উত্তেজিত হচ্ছিল। এই সময় ছেলেটি বলল, সিগারেট খাবেন?

কথাটা অর্ককে আরও উস্কে দিল। সে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞাসা করল, ঘুষ দিচ্ছেন?

ঘুষ? মানে?

বোঝেন না? ন্যাকা! না?

বিশ্বাস করুন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

এখানে কি করতে এসেছিলেন? এই মাঠের অন্ধকারে?

ছেলেটা এবার যেন দমে গেল। সে পলকে অনুপমাকে দেখে নিল। অনুপমার মুখ পাথর, অন্যদিকে ফেরানো। ছেলেটি বলল, আমরা গল্প করছিলাম। আসলে কোন রেস্টুরেন্টে বেশীক্ষণ বসা যায় না, পয়সা খরচ হয়, তাই মাঠে বসেছিলাম।

শুধু বসেছিলেন? তাহলে পুলিসগুলো আপনাদের কাছে গেল কেন?

ছেলেটি এবার উত্তেজিত হল, ওরা যা বলেছে তার সবটা সত্যি কথা নয়। ওরা বাড়িয়ে বলেছে।

অর্ক মাথা নাড়ল, আপনারা স্বামী-স্ত্রী। এখানে এসে।

এবার ছেলেটি যেন চট করে নিবে গেল। তারপর নিচু গলায় বলল, আপনি নিশ্চয়ই জানেন অনু ওর বাবার কাছে আছে।

জানি। কদিনের জন্যে।

কদিনের জন্যে নয়, আমরা একটাই ঘরে পাঁচজনে থাকি। বউ নিয়ে আলাদা শোওয়া তো দুরের কথা একটু গল্প করার সুযোগ পর্যন্ত আমাদের নেই। বাবার কাছে এলেও ওই একই অবস্থা। আলাদা যে ঘর নেব তাও ম্যানেজ করে উঠতে পারছি না। বিশ্বাস করুন, বিয়ে করেও আমরা ঠিক স্বামী-স্ত্রীর মত নেই।

কথাটা শুনে অর্ক এবার অনুপমার মুখের দিকে তাকাল। অনুপমা এতক্ষণে স্পষ্ট চোখে তাকে দেখছে। একটুও সঙ্কোচ কিংবা লজ্জা অথবা অপরাধবোধ নেই।

অর্ক আর দাঁড়াল না। একটা কথা না বলে সে গেট পেরিয়ে একা একা হন হন করে হাঁটতে লাগল। এই প্রথম তার মনে হল পুলিসটার কাছে মিথ্যে কথা বলে সে অন্যায় করেনি। কিন্তু কি অবস্থা, স্বামী-স্ত্রীকে ঘরের ভিড় থেকে বেরিয়ে আসতে হয় মাঠের নির্জনে। এদের জন্যে একটা কষ্ট বুকে মুখ তুলতেই সে দাঁড়িয়ে গেল আচমকা। বাবা এবং মাকে জ্ঞান হবার পর থেকে সে কোনদিন কাছাকাছি দ্যাখেনি। তাদের ওই ছোট্ট একটা ঘরে সে একাই কি ভিড় হয়ে ব্যবধান তৈরি করেছিল?

৪৮. বেলগাছিয়ার ট্রাম ডিপোর কাছে

বেলগাছিয়ার ট্রাম ডিপোর কাছে পৌঁছেই অর্ক বুঝতে পারল হাওয়া খারাপ। মোড়ের দোকানপাট বন্ধ। ঈশ্বরপুকুর লেন অন্ধকারে ঢাকা! চারপাশে একটা থমথমে ভাব। শুধু জনা পাঁচেক মানুষ ফুটপাথের একপাশে জড় হয়ে মৃদু গলায় কথা বলছে। লোকগুলোর চেহারা দেখেই বোঝা যায় সারাদিন খেটেখুটে বাড়ি ফিরছে। ঝামেলার মুখোমুখি হয়ে বিপর্যস্ত। এরা এখন ঘরে ঢুকে পেটে কিছু দিয়ে শুয়ে পড়তে পারলে বেঁচে যায়। কিন্তু গলিতে পা দেওয়ার সামর্থ্য কারো নেই। খাঁচায় পোরা জন্তুর মত শুধু পিটপিটিয়ে তাকাচ্ছে।

ঠিক সেইসময় যেন দেওয়ালি শুরু হয়ে গেল, ঈশ্বরপুকুর লেনে বোম পড়ছে। একটার শব্দ না মেলাতেই আর একটা। সঙ্গে সঙ্গে ফুটপাথের লোকগুলো সরে গেল খানিকটা তফাতে। অর্ক ভেবে পাচ্ছিল না আজকের গোলমালটা কি নিয়ে। খুরকি কিলা চলে যাওয়ার পর ঈশ্বরপুকুরে মাস্তান বলতে একমাত্র কোয়া। তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের কথা সেদিন কোয়া বলছিল বটে কিন্তু তারা তো ঠিক মাস্তান নয়। অর্ক অন্ধকার গলিটার দিকে তাকাল। ওখানে ঢুকলে অজান্তেই আক্রান্ত হতে হবে। যারা ছুঁড়ছে তারাও জানবে না কাকে ছুঁড়ল। খোঁজ নেওয়া দরকার। এইসময় অর্ক রিকশাঅলাটাকে দেখতে পেল। জ্ঞান হওয়া ইস্তক একে ঈশ্বরপুকুরে রিকশা চালাতে দেখেছে।

বুড়ো লোকটা রিকশা তুলে দিয়ে একটা বন্ধ দোকানের খাঁজে উবু হয়ে বসেছিল! দ্রুত পা চালিয়ে তার কাছে পৌঁছতেই লোকটা ভীতুচোখে তাকাল। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে ভেতরে?

ঈশ্বরপুকুরকে শ্মশান করে দেবে বলেছে ওরা।

কারা?

লোকটা অর্কর মুখের দিকে তাকিয়ে নীরব হল। অর্ক আবার জিজ্ঞাসা করল, কারা?

কয়লা।

চমকে উঠল অর্ক। কয়লা নিজেকে বলে শেরকে শো। তার আধিপত্য রেললাইন এলাকায়। সমস্ত ওয়াগন ব্রেকার ওর চামচে। সাধারণত কোন পাড়ার দখল নেবার চেষ্টা করেনি কয়লা। দুটো রিভলভার কোমরে গুঁজে হাঁটে কয়লা। সঙ্গে বডি গার্ডও থাকে। প্রচণ্ড ক্ষমতাবান মাস্তান কয়লা। ওপর মহলেও খুব খাতির আছে। কিন্তু এই লোকটিকে কখনও চোখে দ্যাখেনি অর্ক। নানারকম গল্প শুনেছে। ঈশ্বরপুকুর লেন কয়লার আওতায় নয় যদিও রেললাইন খুব কাছে। তবে এটুকু জানে খুরকির সঙ্গে ওয়াগনের ব্যাপারে কয়লার যোগাযোগ ছিল। সেই সুবাদেই খুরকির রোয়াবি বেড়ে গিয়েছিল অত। সেই কয়লা ঈশ্বরপুকুরে এসেছে শ্মশান করতে। কেন? অর্ক রিকশাঅলাকে জিজ্ঞাসা করল, কতজন আছে ওরা।

অনেক। একটা গাড়িও আছে।

এইসময় গলির মধ্যে হৈ হৈ উঠল। রিকশাঅলাটা দোকানের খাঁজে যেন আরো সেঁধিয়ে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, বসে পড়ো। অর্ক দেখল যে লোকগুলো গলিতে ঢুকবে বলে দাঁড়িয়েছিল তারা দৌড়ে যাচ্ছে পাকপাড়ার দিকে। নিশ্চয়ই কয়লারা ফিরে আসছে এবং এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক কাজ হবে না। অর্ক চট করে দোকানের পেছনে চলে এল। এবং তখনই ঈশ্বরপুকুর থেকে বেরিয়ে এল জনা বারো ছেলে। দু’তিনজনের হাতে খোলা সোর্ড, পেটোর ঝোলা, দুটো রিভলভারও চোখে পড়ল। উত্তেজিত ছেলেগুলো মুখে বিকট শব্দ করতে করতে রেললাইনের দিকে চলে যাওয়ার পর অর্ক আবার সামনে ফিরে এল। চিৎকার মিলিয়ে যাওয়ার পর নিস্তব্ধ হয়ে গেছে চারধার। যে ঈশ্বর পুকুর রাত দুটোর আগে ঘুমোয় না দশটায় তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু ছুটে যাওয়া দলটার মধ্যে কয়লাকে আলাদা করতে পারেনি অর্ক! সে রিকশাঅলাকে জিজ্ঞাসা করল, কয়লা কোনটা?

রিকশাঅলা দমবন্ধ করে পড়ে ছিল। এবার যেন খানিকটা সাহস পেল, কেউ না

কেউ না মানে? অর্ক অবাক হল, এই তো বললে কয়লা এসেছে।

এসেছে কিন্তু যায়নি। কয়লা খোলা গাড়িতে করে গিয়েছিল। গাড়িটা তো আসেনি।

অর্ক মাথা নাড়ল। সত্যি তো, কোন গাড়ি তো দলটার সঙ্গে বেরিয়ে আসেনি। কিন্তু দল চলে গেলে কয়লা একা থাকবে ঈশ্বরপুকুরে? এত সাহস? অর্ক দেখল বেশ দূরে সেই লোকগুলো আবার ফিরে এসে উঁকি দিচ্ছে এদিকে। সে হাত উঁচু করে তাদের ডাকলো। লোকগুলো যেন তাকেই সন্দেহের চোখে দেখছে। সে এবার গলা তুলে চেঁচাল, কতক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকবেন? চলে আসুন, একসঙ্গে পাড়ায় ঢোকা যাক।

এ সত্ত্বেও কোন প্রতিক্রিয়া হল বলে অর্কর মনে হল না। এক পা এগোনো দূরের কথা কেউ কোন শব্দ পর্যন্ত করছে না। অর্ক বুঝতে পারছিল বেশ কিছু মানুষ একসঙ্গে গেলে খানিকটা সুবিধে হবে। সে নির্জন রাস্তায় এগিয়ে গেল। লোকগুলো ওকে পুরোপুরি সন্দেহ করছে না কারণ সে যখন প্রথম এল কেউ কেউ তাকে দেখেছে। কাছাকাছি হয়ে অর্ক বলল, চলুন, আমরা একসঙ্গে যাই।

ইতস্তত করে একজন বলল, না ভাই, আমরা পাবলিক ঝামেলার মধ্যে আমরা নেই।

ওরা সবাই চলে গেছে। এখন আর ঝামেলা নেই। আমি তিন নম্বরে থাকি। আমাকে আপনাদের কেউ চেনেন? অর্কর প্রশ্নের উত্তরে দুজন মাথা নাড়ল। একজন আর একজনকে জিজ্ঞাসা করল, যাবেন? দ্বিতীয়জন উত্তর দিল, ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করি ভাই, মরে গেলে ওরা সবাই পথে বসবে। তার চেয়ে গলিটা স্বাভাবিক হোক তখন না হয় ধীরেসুস্থে যাওয়া যাবে, কি বলেন?

কথাটা প্রত্যেকের বেশ মনের মত বুঝতে পেরে অর্ক বলল, কিন্তু ওরা পাড়ায় হামলা করেছে। সেটা তো আপনার বাড়িতেও হতে পারে। তাছাড়া যে কোন মুহূর্তে ওরা ফিরে আসতে পারে। তখন বাঁচতে পারবেন? তার চেয়ে নিজের পাড়ায় যাওয়াটা তো নিরাপদ। আমরা অনেকে একসঙ্গে গেলে কেউ ঝামেলা করতে সাহস পাবে না। অর্ক কথাগুলো বলে বুঝল এটা খুব কাজের হল না। এইসময় একটা গাড়ির আওয়াজ হতেই লোকগুলো দৌড় শুরু করল। অর্ক লক্ষ্য করল, গাড়িটা গলি থেকে নয় উল্টোদিক থেকে আসছে। ওটা যে পুলিসের ভ্যান সেটা বুঝে অর্ক রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াল। ছুটন্ত লোকগুলো দেখে ভ্যানটা মুখ ঘুরিয়ে তাদের দিকে ধাওয়া করল। লোকগুলো প্রাণভয়ে ছুটছে। ফাঁকা রাস্তায় দৃশ্যটা সিনেমার মত দেখতে পাচ্ছিল অর্ক। ভ্যান থেকে লাফিয়ে নামল জনা আটেক পুলিস। লাঠি হাতে তারা ছুটে গেল লোকগুলোর দিকে। ওই দুর্বল নিরক্ত মানুষগুলোকে ধরতে সামান্য সময় লাগল না। একই সঙ্গে হাঁউমাউ শব্দ আর চিৎকার শুনল অর্ক। আমাদের ধরছেন কেন? আমরা কিছু করিনি। আমরা পাবলিক।

একটা পুলিস বাজখাঁই গলায় চেঁচালো, শালা পাবলিকের-করি। অশ্লীল শব্দটা রাত্রের নিস্তব্ধতা ভেঙে থিকথিক করতে লাগল। লোকগুলোকে টেনে হিঁচড়ে ভ্যানে তোলা হয়ে যাওয়ার পর সেটা আবার ফিরে গেল! অর্ক অবাক হতে গিয়ে হেসে ফেলল। যাচ্চলে! ওরা কাঁদের ধরে নিয়ে গেল? লোকগুলোর অবস্থা দেখে হাসি পাচ্ছিল তার! পাবলিক কেন ঝামেলায় থাকবে? ভালই হল, রাতটায় ওদের কোন ঝুঁকির মধ্যে যেতে হচ্ছে না। অবশ্য পুলিসরা যদি না প্যাঁদায়। টি আবার চারধার চুপচাপ। হঠাৎ অর্কর মনে হল সে নিজে কি করছে? গলিতে ঢোকার সাহস না থাকায় সে কতগুলো ভীতু মানুষকে নিয়ে দল গড়তে চেয়েছিল। বিপদ এলে সেটা অন্যদের মধ্যে ভাগ করে দেবার কৌশল করেছিল। তার মানে, নিজের পাড়ার চেনা চৌহদ্দির মধ্যে পা বাড়ানোর ক্ষমতা তার লোপ পেয়েছে। অর্ক মাথা নাড়ল। তারপর একরোখা ভঙ্গীতে হাঁটতে লাগল ঈশ্বর পুকুরের দিকে। গলির মুখে দাঁড়িয়ে সে অন্ধকারে সামান্য আলো দেখতে পেল না। গলিতে ঢুকে সে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। এবং তাতেই অন্ধকার ক্রমশ হালকা হয়ে গেল চোখের সামনে। গলিতে এখনও বারুদের গন্ধ আছে। অর্ক সতর্ক হয়ে হাঁটছিল রাস্তার ধার ঘেঁষে। অন্যদিন এইসময় ধার ঘেঁষে প্রচুর লোক পড়ে থাকে, আজ কেউ নেই। নিঃশব্দে সে হেঁটে এল তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুরের সামনে। এবং তখনই সে মানুষের অস্তিত্ব টের পেল। তিন নম্বরের সবক’টা দোকানপাট বন্ধ। নিমুর চায়ের দোকানের সামনে ছোটখাটো ভিড়। কিন্তু কেউ কোন কথা বলছে না। এবং এখানেই বারুদের গন্ধ বেশি।

অর্ককে আসতে দেখে ভিড়টা পাতলা হতে হতে আবার রয়ে গেল। ভিড়টার দিকে এগিয়ে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল অর্ক। গলির মুখে চিৎ হয়ে পড়ে আছে মোক্ষবুড়ি। দুটো হাত মুঠো করে দুপাশে লোটানো। ময়লা কাপড়ের স্তূপ রক্তাক্ত। আধো অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে ওর মুখের কিছুটা অংশ উড়ে গেছে। কঙ্কালের মত শরীরটা এলিয়ে আছে মাটিতে। ভিড়টা ওকে ঘিরেই।

কোন প্রশ্ন করার দরকার হল না। মোক্ষবুড়ির প্রাণহীন শরীরটার দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠল। অর্ক। কিন্তু ভিড়টা বাড়ছে অথচ কোন কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। মোক্ষবুড়ির জন্যে কেউ কাঁদবার নেই। অর্ককে দেখে ন্যাড়া কাছে এল, মোক্ষবুড়ি ভোগে চলে গেল। হাসল ন্যাড়া, কোয়াদা খুব জোর বেঁচে গিয়েছে।

কি হয়েছিল? অর্ক শীতল গলায় জিজ্ঞাসা করল।

তুমি জানো না?

না। আমি এইমাত্র এসেছি।

বিলুদাকে খুঁজতে এসেছিল কয়লা। না পেয়ে পাড়া জ্বালিয়ে দেবে বলেছিল। কোয়াদা তখন মাল খেয়ে এখানে দাঁড়িয়ে কয়লার একটা ছেলেকে খিস্তি করতে সে পেটো ছুঁড়েছিল। কোয়াদার গায়ে লাগেনি কিন্তু মোক্ষবুড়ি ভোগে গেল। ন্যাড়া আবার হাসল!

কোয়া কোথায়?

হাওয়া হয়ে গিয়েছে। তিন নম্বরের পেছনের দিকটায় ইঙ্গিত করল ন্যাড়া।

বিলুকে খুঁজছিল কেন ওরা?

বিলুদা নাকি দারোগাবাবু হয়েছে।

দারোগাবাবু?

হাঁস ডিম দেয় আর দারোগাবাবু সেই ডিম খায়। তারপর নিচু গলায় বলল, কয়লা এখনও পাড়ায় আছে।

কোথায়?

নুকু ঘোষের বাড়িতে। বডি গার্ড নিয়ে। ওব চামচেরা চলে গিয়েছে।

এইসময় দুটো হেডলাইট ঈশ্বরপুকুরকে আলোকিত করল। ইঞ্জিনের শব্দ হওয়ামাত্র মানুষগুলো গলির মধ্যে পিলপিল করে ঢুকে যাচ্ছিল। অর্কর হাত ধরে টানল ন্যাড়া, কেটে পড়, পুলিস আসছে।

কি করে বুঝলি? জিজ্ঞাসা করতেই পুলিসের ভ্যানটা এসে দাঁড়াল তিন নম্বরের সামনে। টপাটপ লাফিয়ে নামল কিছু পুলিস লাঠি এবং বন্দুক হাতে। দুজন অফিসার খোলা রিভলভাব নিয়ে চেঁচিয়ে বলল, কি হয়েছে এখানে? কেউ পালাবেন না, বলুন, কি হয়েছে?

এবার তিন নম্বরের লোকগুলো থিতিয়ে গেল। তারপর একটু একটু সাহসী হয়ে এগিয়ে এল তারা। হাঁউমাউ করে সকলে মিলে কয়লার অত্যাচারের কথা বলতে লাগল। সেটা স্পষ্ট না হওয়ায় কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। জনতা আঙ্গুল দিয়ে মোক্ষবুড়ির মৃতদেহ দেখাচ্ছিল পুলিসদের। একজন অফিসার টর্চের আলো ফেলল মোক্ষবুড়ির ওপর, এটা কে?, জনতা চেঁচালো একসঙ্গে, মোক্ষবুড়ি!

এ কি করে ইনভলভড হল? বুড়ি মেয়েছেলেরাও অ্যাকশন করে নাকি?

ও এখানে বসোছল স্যার, কোয়াকে যে পেটো ছুঁড়েছিল সেটা ওর গায়ে লেগেছে।

আই সি! হোয়ার ইজ কোয়া! তাকে আমার চাই। বলুন, বলুন কোথায় কোয়া?

জানি না স্যার। কোয়া পালিয়ে গেছে।

অফিসার জনতার দিকে তাকালেন তারপর দুজন কনস্টেবলকে বললেন মোক্ষবুড়ির শরীরটাকে ভ্যানে তুলে নিতে। এইসময় ঈশ্বরপুকুরের আলো জ্বলে উঠল। অর্ক দেখল উল্টোদিকে দোতলা বাড়িগুলোর জানলা ঈষৎ ফাঁক করে ভদ্রলোকেরা এই দৃশ্য দেখছেন নিজেদেব অস্তিত্ব না জানিয়ে। অফিসারটি আবার রিভলভার উঁচিয়ে চিৎকার করলেন, কোয়াকে আমাদের হাতে তুলে দিন। ওর জন্যেই এই বুড়ি মরেছে। নইলে এই বস্তির কাউকে আমি ছাড়ব না! জনতা নীরবে এই হুমকি। শূনল। অর্ক বুঝতে পারছিল না কোয়ার কি দোষ, কেন তাকে গুলিস অফিসার চাইছে।

কিন্তু সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল অফিসারটির কাছে, কোয়াকে কি দরকার?

অফিসার অর্কর দিকে লোক চোখে তাকালেন, তুমি কে?

আমি এখানে থাকি। কোয়া তো আজ কোন অন্যায় করেনি। যারা গুণ্ডামি করতে এসেছিল সে তাদের গালাগাল দিয়েছিল। এরাই বোমা ছুঁড়েছে বলে মোক্ষবুড়ি মারা গিয়েছে। এতে কোয়ার অন্যায় কোথায়? সরাসরি প্রশ্ন করল অর্ক।

ন্যায় অন্যায়ের জ্ঞান তোমার কাছে নেব না। ওর নামে অনেক অ্যালিগেশন আছে।

কিন্তু যারা অন্যায় করেছে তাদের আপনারা ধরছেন না কেন?

কারা অন্যায় করেছে থোকা? ব্যঙ্গ ঝরল অফিসারের গলায়।

কয়লা দলবল নিয়ে পাড়া জ্বালাতে এসেছিল। ওরাই মোক্ষবুড়িকে খুন করেছে।

কে কয়লা?

অর্ক অবাক হয়ে গেল। পুলিস অফিসার কয়লার নাম শোনেনি? সে তাকিয়ে দেখল বস্তির সমস্ত মানুষ তার দিকে বেশ সম্ভ্রমের চোখে তাকিয়ে আছে। অর্কর উত্তেজনা বাড়ল, কে কয়লা তা আপনি জানেন না?

পুলিস অফিসার কাঁধ ঝাঁকালেন। তারপর হাতের বিভলভারটা নাচিয়ে বললেন, এই ছোঁকরা, নিজের কাজ কর গিয়ে। যা, ভাগ।

অর্ক গলা তুলল, চমৎকার। একঘণ্টা ধরে এখানে হামলা হল, মানুষ মরল আর আপনারা চুপ করে বসেছিলেন, আসার দরকার মনে করেননি। এখন যখন সব থেমে গিয়েছে তখন উল্টে চোখ রাঙাচ্ছেন। কোথায় ছিলেন আপনারা এতক্ষণ?

মেরে বদনা পাল্টে দেব হারামজাদা। যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা? আমার কাজের কৈফিয়ৎ তোমাকে দেব বাঞ্চোত? তারপর জনতার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি কোন কথা শুনতে চাই না। কোয়াকে আমার চাই।

অফিসারকে ভ্যানের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে অর্ক কাছে গেল, আপনি কয়লাকে অ্যালেস্ট করবেন না? সে এখানে এসে দলবল নিয়ে হামলা করে গেল সেটা দেখবেন না?

কয়লা? কয়লা কোথায়?

ওদিকে, নকু ঘোষের বাড়িতে।

হঠাৎ মুখ চোখ পাল্টে গেল অফিসারের, অ্যাই, তোর নাম কি রে?

তোর বলছেন কেন? ভালভাবে কথা বলতে শেখেননি?

এরকম প্রশ্ন যেন স্বপ্নেও ভাবেননি অফিসার। তাঁর হুঁশ ফেরার আগেই অর্ক জবাব দিল, অর্ক মিত্র।

নেতা হবার সাধ হয়েছে না? জন্মের মত সাধ ঘুচিয়ে দেব বদমাশ। এক লাফে যেন জায়গাটা অতিক্রম করতে চাইলেন অফিসার। বিপদ বুঝতে পারল অর্ক। কিন্তু একটা জেদ এবং ক্রোধ তাকে খাড়া দাঁড় করিয়ে রাখল। এইসময় একটি লোক ছুটে এল অফিসারের দিকে, প্লিজ, ওকে মারবেন না। শান্ত হোন।

অর্ক অবাক হয়ে দেখল সতীশদা অফিসারের সামনে দাঁড়িয়ে। অফিসার যেন সতীশদাকে চিনতে পারলেন, ও আমাকে অপমান করেছে। এইটুকুনি ছেলে কিন্তু কি ব্যবহার? নো নো, আমাকে বাধা দেবেন না। সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়ার সময় আপনারা ইন্টারফেয়ার করবেন না। আই উইল টিচ হিম এ গুড লেশন।

দুপাশে দু’হাত বাড়িয়ে সতীশদা বললেন, আমি আপনাকে রিকোয়েস্ট করছি আপনি শান্ত হোন। ছেলেটি মোটেই সমাজবিরোধী নয়। তাছাড়া ও যেসব অভিযোগ করেছে সেগুলো সাধারণ মানুষের মনের কথা।

আপনি এসব বোঝাবেন না সতীশবাবু। আমি ওকে অ্যারেস্ট করছি।

অ্যারেস্ট করবেন? ওর অপরাধ?

আমাকে অপমান করেছে, কর্তব্য করতে বাধা দিয়েছে।

আপনি বাজে কথা বলছেন?

আচ্ছা! নিশ্চয়ই আপনার স্বার্থ আছে! কিন্তু আমি আপনার সঙ্গে এত কথা বলছিই বা কেন? যদি প্রয়োজন মনে করেন থানায় আসবেন।

সতীশদা একবার অর্কর দিকে তাকালেন। তারপর অফিসারকে নিচুগলায় বললেন, ওকে অ্যারেস্ট করলে আপনার অসুবিধে হবে অফিসার।

তার মানে?

কিছুদিন আগে মিনিস্টার এসেছিলেন এখানে। ওর বাবা মিনিস্টারের বন্ধু। আমাকে খোঁজ খবর নিতে বলেছিলেন। আপনি গায়ের জোরে অ্যারেস্ট করলে আমি এখনি তা মিনিস্টারকে জানাবো। সতীশদাকে অন্যরকম দেখাচ্ছিল।

সতীশদার চোখে চোখ রেখে অফিসার যেন কিছু পড়তে পারলেন, কিন্তু ওকে সাবধান করে দেবেন। একজন সরকারী অফিসারের সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় সেটা শেখা উচিত।

কথা শেষ করেই অফিসার ভ্যানে ফিরে গেলেন। ওদের চোখের সামনে ভ্যানটা পিছু ফিরে মুখ পাল্টে ঈশ্বরপুকুর থেকে বেরিয়ে গেল।

এবার সতীশদা অর্কর দিকে তাকালেন, তোমার সাহস আছে। কিন্তু সাহসী হলেই সবসময় কাজ হয় না। সময় এবং পরিস্থিতি বুঝে এগোতে হয়।

এতক্ষণ অর্ক চুপচাপ সমস্ত ব্যাপারটা দেখছিল। সতীশদা যে অফিসারকে মন্ত্রীর ভয় দেখিয়ে থামালো সেটাও কান এড়ায়নি। তার মনে পড়ল আজ সন্ধ্যায় সে একজন সাধারণ পুলিসকে ডি সি নর্থের নাম করে ভয় পাইয়েছিল। সেটা যে এত দ্রুত তার ক্ষেত্রেও ফিরে আসবে! সতীশদা কথা শেষ করতেই অর্ক বলল, লোকটা বদমাশ।

হতে পারে। কিন্তু ওইভাবে বলা ঠিক হয়নি।

কেন?

তোমাকে ও অ্যারেস্ট করতে পারত, প্রচণ্ড মারত। তুমি কিছুই করতে পারতে না।

কিন্তু আপনি এসব সমর্থন করছেন? ওরা কোয়াকে বোমা মারতে গিয়ে মোক্ষবুড়িকে মেরে ফেলল। খুন করল ওরা আর পুলিস কোয়াকে ধরতে চাইছে। কোয়ার কি দোষ?

সতীশদা মাথা নাড়লেন, কিন্তু কোয়া তো ধোওয়া তুলসীপাতা নয়।

তা হতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে তো কোন অন্যায় করেনি। তাছাড়া কয়লারা ঈশ্বরপুকুরে ঢুকে একটা খুন করল, অত্যাচার করল, অনেক পরে পুলিস এসে আমাদের ছেলেকেই গ্রেপ্তার করতে চাইল অথচ আপনি কিছু বলছেন না! অর্ককে খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। এবং এইসব কথাবার্তার মধ্যে তিন নম্বরের সাধারণ মানুষ যে উপচে পড়েছে তা সে লক্ষ্য করেনি।

সতীশদা বললেন, কিছু বলব না তাই বা জানলে কি করে? আমরা পার্টি থেকে অ্যাকশন নেব। পুলিসের কাছে কৈফিয়ৎ চাইব।

অর্ক বলল, আর তার মধ্যে কয়লাদের মত গুণ্ডারা এসে একটার পর একটা খুন করে যাক আর আপনারা চেয়ে চেয়ে তাই দেখবেন।

এবার সতীশদার কণ্ঠে উত্তেজনা এল, তুমি কি বলছ তা জানো না!

জানি সতীশদা। আমি রাজনীতি বুঝি না কিন্তু আপনাকে আমার ভাল লাগে। কয়লারা মোক্ষবুড়িকে খুন করেছে আর পুলিস কিছু বলছে না এটা মেনে নিতে পারি না। আপনি আমাদের সঙ্গে আসুন, আমরা সবাই মিলে প্রতিবাদ করি। অর্কর কথা শেষ হওয়ামাত্র তিন নম্বরের সমস্ত মানুষের গলা থেকে সমর্থনসূচক শব্দ বেরিয়ে এল। সতীশদা এবার অস্বস্তিতে পড়লেন। তারপর অর্কর কাঁধে হাত রেখে বললেন, আমার পক্ষে ব্যক্তিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। দলের নির্দেশ নিতে হবে।

আপনি এর মধ্যে দলকে টানছেন কেন?

কারণ আমি চব্বিশঘণ্টার রাজনীতি করি। আমি মনে করি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা ও আনুগত্য ছাড়া একটি মানুষ পূর্ণতা পায় না। যাহোক, এ ব্যাপারে তোমরা একটা কাজ করতে পারো। এ পাড়ার নাগরিক কমিটির মিটিং যাতে তাড়াতাড়ি ডাকা হয় সে ব্যবস্থা করতে পারি। সেখানে তোমরা বক্তব্য রাখতে পারো। নাগরিক কমিটি পল্লীর শৃঙ্খলা রাখতে অরাজনৈতিকভাবে কাজ করতে পারে।

কিন্তু সতীশদার কথা শেষ হওয়ামাত্র একজন চিৎকার করে উঠল, ওখানে তো মাথাভারী লোক গিয়েছেন, তাঁরা কোনদিন আসেন না। পাড়ার কটা লোক নাগরিক কমিটির খবর রাখে বলুন?

সতীশদা বললেন, আপনাদের কমিটি আপনারা যদি খবর না রাখেন।

না আমাদের কমিটি নয়। আপনারা ক্ষমতায় এসেছেন এত বছর, নাগরিক কমিটি তৈরি হয়েছে কিন্তু সেই কমিটি কোন কাজ করে না, নামেই রয়েছে। সাধারণ মানুষ তাদের খবর জানেই না। ছেলেটি এসব বলেই জুড়ে দিল, একথা বলছি বলে ভাববেন না আমি কংগ্রেস করি। সমালোচনা করলেই তো চক্রান্তের গন্ধ পান। ও সতীশদা মাথা নাড়লেন, তুমি প্রতিক্রিয়াশীল সংবাদপত্রের ভাষায় কথা বলছ সুবল! তোমাকে আমি অনেকবার বলেছি দলের ভেতরে এসে এসব কথা বল। শরীরে আঁচ না লাগিয়ে যারা ফলভোগ করে তাদের সুবিধেবাদী বলা হয়।

অর্ক দেখছিল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছে তারা। সে বলল, ওসব আমি বুঝি না সতীশদা। তিন নম্বরে আমরা পশুদের মত আছি। এখানে দিনদুপুরে মাস্তানি হয়, অশ্রাব্য খিস্তির বন্যা বয়ে যায়, মাতলামি চলে দিন রাত আর আপনাদের নাগরিক কমিটি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোয়। কি, ঠিক বলছি?

সতীশদা মাথা নাড়লেন, অনেকটাই ঠিক।

কেন এমন হবে? কেন আপনারা রাজনীতি করেন সাধারণ মানুষের কাছে না গিয়ে! সতীশদা, শুধু বড় বড় শব্দ দিয়ে কদ্দিন মানুষকে বোঝানো যায়? না, সতীশদা, আমি এসব বুঝতে পারি না। কয়লা অন্যায় করে শাস্তি পাবে না কেন? অর্ক কথাগুলো বলামাত্র সমস্ত মানুষ হৈ চৈ করতে শুরু করল। সবাই উত্তেজিত।

সতীশদা চিৎকার করলেন, তোমরা কি করতে চাও?

আমরা কয়লার শাস্তি চাই।

সতীশদা চিৎকার করলেন, কিন্তু শাস্তি দেবে আদালত। আমরা আইন হাতে নিতে পারি না। অর্ক, তুমি এদের উত্তেজিত করছ। ভুল করছ। এতে এদেরই ক্ষতি হবে।

কেউ একজন চেঁচালো, কয়লা নুকু ঘোষের বাড়িতে বসে মাল খাচ্ছে। নুকুর বাড়ি জ্বালিয়ে দাও। হঠাৎই মানুষগুলো পাল্টে গেল। যারা এতক্ষণ বোমের ভয়ে সিটিয়ে ছিল ঘরে তারা উত্তেজনায় রাস্তায় ছোটাছুটি করতে লাগল। সতীশদা কিংবা অর্ক চেষ্টা করেও সামলাতে পারল না তাদের। সবার লক্ষ্য নুকু ঘোষের বাড়ি।

বাড়িটার সামনে একটা জিপ দাঁড়িয়ে। তিন নম্বরের মানুষের টানে আশেপাশের একটা বিরাট। জনতা এই মাঝরাত্রে নেমে এসেছে পথে। অর্ককে নিয়ে সতীশদা কোনরকমে ভিড়ের সামনে চলে এলেন। সতীশদা চিৎকার করলেন, আপনারা এমন কিছু করবেন না যাতে আইন বিঘ্নিত হয়।

কিন্তু অর্ক সতীশকে বলল, সতীশদা, আপনি আড়ালে চলে যান। নইলে নুকু ঘোষ বলবে। আপনার পার্টি ওর বাড়ি ঘেরাও করেছে। আপনি সাধারণ নাগরিক হিসেবে পিছনে থাকুন।

কিন্তু পাড়ায় কোন গোলমাল হলে আমাকে জবাবদিহি দিতে হবে।

সে নাহয় দেবেন। এখন সামনে থাকবেন না।

সুবল বলল, ঠিক কথা। এটা আমাদের ননপলিটিক্যাল মুভমেন্ট।

মানুষেরা চিৎকার করছে কয়লার নাম ধরে, নুকু ঘোষের পিণ্ডি চটকে। দু-একটা ঢিল ছিটকে গেছে বাড়ির দিকে। এইসময় দরজা খুলে গেল। নুকু ঘোষ বেরিয়ে এল টালমাটাল পায়ে, কি ব্যাপার? এখানে কি হচ্ছে? জনতা দেখে লোকটার মুখ চুপসে গেলেও সামলে নিল।

কয়লাকে চাই। বের করে দিন কয়লাকে। জনতা একসঙ্গে বলে উঠল।

কয়লা! কেন তাকে কি দরকার? নুকু ঘোষের গলার স্বর জড়ানো।

সুবল উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে, কয়লা তিন নম্বরে হামলা করে একজনকে খুন করেছে। আপনি তাকে আশ্রয় দিয়েছেন। ওকে বের করে দিন আমাদের হাতে।

নুকু ঘোষ চিৎকার করল, বের করে দিন! যেন বাবার সম্পত্তি! কে তোদের লেলিয়েছে? অ্যা, কে লেলিয়েছে?

সঙ্গে সঙ্গে জনতা ফুঁসে উঠল। উন্মত্ত ঢেউ আছড়ে পড়ল নুকু ঘোষের ওপর। নুকুর লোকেরা তাকে টেনে নিয়ে গেল ভেতরে। তারপর দরজা বন্ধ করে দিল। ততক্ষণে কয়লার গাড়িতে আগুন জ্বলেছে। জনতা এবার নুকুর বাড়িতে সে আগুন ছড়াতে চাইল। অর্ক এক লাফে বারান্দায় উঠল। তারপর দু হাত ওপরে তুলে চিৎকার করল, আপনারা শুনুন। মাথা ঠাণ্ডা রাখুন। আমরা কয়লাকে চাই। নুকু ঘোষের বাড়ি ঘিরে রাখুন কিন্তু কেউ ভেতরে ঢুকবেন না। যতক্ষণ নুকু কয়লাকে বের না করে দেয় ততক্ষণ আমরা এখান থেকে নড়ব না।

সুবল বলল, ঠিক কথা। আজ সারা রাত আমরা ঘেরাও করে থাকব। আপনারা সবাই বসে পড়ুন। গুণ্ডাটাকে চাই-ই চাই।

জনতা তখনও অশান্ত ঘোড়ার মত ছটফট করছিল।

৪৯. শেষ পর্যন্ত পুলিসের ভ্যান ফিরে এল

শেষ পর্যন্ত পুলিসের ভ্যান ফিরে এল। অর্ক দেখল সেই অফিসারটি দলে নেই। ভ্যানের আগে একটি জিপও রয়েছে। তাতে জাঁদরেল চেহারার কিছু অফিসার। ভ্যান থেকে নেমে সাধারণ চেহারার পুলিসগুলো যখন লাইন দিয়ে হুকুমের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে তখন জিপে আসা অফিসারদের একজন জনতার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে? এখানে এত ভিড় কেন?

অর্ক খুব অবাক হয়ে গেল। যেন এরা কিছুই জানেন না। এতক্ষণ ঘুমুচ্ছিলেন, হঠাৎ আকাশ থেকে টুপ করে কেউ এঁদের এখানে নামিয়ে দিয়ে গেছে। ঈশ্বরপুকুরে সন্ধ্যে থেকে এত কাণ্ড ঘটে গেল, একটি নিরপরাধ মানুষ খুন হল অথচ এঁর মুখ দেখলে মনে হবে ইনি কিছুই জানেন না। তাছাড়া ঈশ্বরপুকুরের এত ভেতরে কেউ খবর না পেয়ে বেড়াতে আসবে না!

সেই সঙ্গে আর একটি জিনিস অর্কর চোখে পড়ল। এতক্ষণ অন্যায় অপরাধের বিরুদ্ধে ঈশ্বর পুকুরের জনতা ফুঁসছিল। নুকু ঘোষের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে কয়লাকে ছিঁড়ে ফেলার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। অনেক কষ্টে তাদের সামলে রাখতে হচ্ছিল। সেই মানুষগুলোর চেহারা এখন পাল্টে গিয়েছে। পুলিসদের দেখা মাত্রই প্রত্যেকে যেন একটা করে মুখোশ পরে ফেলেছে এবং সব মুখোশের আদল এক। এই মিইয়ে যাওয়া ভীতু মানুষদের দেখলে কল্পনাই করা যায় না খানিক আগে এরাই তড়পাচ্ছিল। শুধু সাদা পোশাকই ওদের এমন পাল্টে দিল? এইসব পুলিস তো সাধারণ মানুষের ভাই দাদা কিংবা বাবা। অথচ সাধারণ মানুষ এদের দেখলেই ভয় পায়। কেন?

অফিসার আবার বললেন, আমার কথা কানে যাচ্ছে না?

অর্ক সুবলের দিকে তাকাল। তারপর বারান্দা থেকে দ্রুত নেমে এল জিপের সামনে। জনতাই তাকে পথ করে দিল। অফিসার কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালেন। অর্ক বলল, আমার নাম অর্ক মিত্র। তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুরে থাকি। আপনি জানেন না এখানে কি হয়েছে, কেন এত ভিড়?

অফিসার নির্বোধের মত মাথা নাড়লেন। কিন্তু বোঝা গেল ওটা ওঁর ভান। প্রকৃত বুদ্ধিমান ছাড়া নির্বোধের অভিনয় করা বেশ শক্ত। অর্ক বুঝল কিছু করার উপায় নেই। সে যতটা সম্ভব সংক্ষেপে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বলল, আমরা দোষীর শাস্তি চাই তাই এই বাড়ি ঘেরাও করে আছি।

বেশ কথা। তাই বলে নিশ্চয়ই আইন নিজের হাতে নিতে চাও না!

না। তাহলে তো এতক্ষণে অন্যরকম হয়ে যেত।

কোন্ পার্টি এটা অগানাইজ করছে?

পার্টি? এই বিক্ষোভের সঙ্গে রাজনীতির কোন সম্পর্ক নেই।

তাই নাকি? সোনার পাথরবাটিও হয় তাহলে। হঠাৎ অফিসারের গলার স্বর পাল্টে গেল, প্যাক আপ! চলে যান, যে যার বাড়িতে চলে যান। রাস্তা পরিষ্কার করে দিন।

জনতা নড়বড়ে হল। কিন্তু তাদের মধ্যে থেকে কেউ একজন চেঁচাল, মোক্ষবুড়ির খুনী কে? কয়লা কয়লা। ব্যস সঙ্গে সঙ্গে জনতার চরিত্র পাল্টে গেল। হঠাৎ মুখোশগুলো অন্য চেহারা নিয়ে নিল। সমস্বরে চিৎকার উঠল, খুনী কয়লার বিচার চাই।

পুলিস অফিসার তাঁর সঙ্গীর সঙ্গে আলোচনা করলেন। তারপর চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করলেন, কয়লা খুন করেছে তার প্রমাণ আছে?

হাজারটা গলায় এক জবাব এল, কয়লা খুন করেছে।

সঙ্গে সঙ্গে পুলিস অফিসার বললেন, ব্যস, তাহলে তো মিটেই গেল। আমি কয়লাকে গ্রেপ্তার করছি। আপনারা শান্ত হয়ে আমাদের কর্তব্য করতে দিন।

অফিসারের হুকুম হওয়ামাত্র পুলিসগুলো নুকু ঘোষের বাড়ির দরজা পর্যন্ত লাইন দিয়ে দাঁড়াল। জনতাকে সামান্য দূরে সরিয়ে দিল তারা। ভ্যান এবং জিপটাকে ঘুরিয়ে নেওয়ার পর অফিসার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে দরজায় আঘাত করলেন, দরজা খুলুন।

তিনবার ধাক্কা দেওয়ার পর একটি চাকর গোছের লোককে নিয়ে নুকু ঘোষ দরজা খুলে এসে দাঁড়ালেন, কি চাই?

অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি নুকু ঘোষ?

তাই তো জানি।

এটা আপনার বাড়ি?

অন্য কারও কিনা তা জানি না।

আপনার বাড়িতে কয়লা এসেছে, তাকে বের করে দিন।

কয়লা? ও নামের কাউকে আমি চিনি না।

কয়লা আপনার বাড়িতে আসেনি?

নুকু ঘোষ সবেগে মাথা নাড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে দূরে দাঁড়ানো জনতা চিৎকার করে উঠল, এসেছে, কয়লা এসেছে।

অফিসার আবার বললেন, আপনি মিথ্যে কথা বলছেন নুকুবাবু।

মোটই না। কয়লা বলে কাউকে আমি চিনি না। আমার বাড়িতে একজন অতিথি এসেছেন, তার নাম শ্রীনবকুমার দত্ত।

তাকেই নিয়ে আসুন।

তাই বলুন। এতক্ষণ কি কয়লা কয়লা করে ধমকাচ্ছিলেন? এই যা, নববাবুকে আসতে বল। পুলিস সাহেব এসেছেন। দিন এমন চিরকাল যাবে না। বদল দিন আসবেই। শালা আমার বাড়িতে হামলা, গাড়িটাও পোড়ানো হয়েছে। বেশ বেশ। সব ভোলা থাকছে। কিন্তু অর্গানাইজ করল কে? কোন শালা। চাকরটাকে হুকুম দিয়ে নিজের মনেই বিড়বিড় করছিল নুকু ঘোষ। এইসময় দরজায় কয়লা তার দুজন অনুচর নিয়ে এসে দাঁড়াল। নুকু ঘোষ বলল, এই যে ভাই নব, জনতা চাইছে তোমাকে গ্রেপ্তার, এরা তাই এসেছেন। জনতার সেবক! মুখ বেঁকালেন নুকু ঘোষ। কয়লা অফিসারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ওয়ারেন্ট আছে?

সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার শুরু হল। ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ কেউ ঢিল ছুঁড়ল এদিকে। হঠাৎ অফিসার কয়লার হাত ধরে টানল, কথা বাড়াবেন না। চলে আসুন।

পুলিস দিয়ে ঘিরে কয়লা এবং তার দুই সঙ্গীকে ভ্যানে তোলা হল। অর্ক এই প্রথম কয়লাকে দেখল। পরনে ছাই রঙা সাফারি! গায়ের রঙ মোটেই কয়লার মত নয়। চেহারাতে কোন আহামরি বৈশিষ্ট্য নেই। তবু এই লোকটার ভয়ে বেলগাছিয়া থেকে লেকটাউন আর শ্যামবাজার কাঁপে। অনেকদিন আগে বিলু তাকে বলেছিল, কোলকাতা শহরটা গোটা পাঁচেক মাস্তান ভাগ করে নিয়েছে। তারা শের কা শের। পুলিস বলো আর পার্টি বল কেউ ওদের গায়ে হাত দিতে পারে না। কয়লা হল সেরকম একজন।

কয়লাকে যখন ভ্যানে ভোলা হচ্ছিল তখন আর একটা জিনিস অর্কর চোখ এড়ায়নি। সেটা হল, কয়লা ভয় পেয়েছে। ওর চোখে বিস্ময় এবং ভয় একসঙ্গে ফুটে উঠেছিল। যেন ভ্যানের ভেতরে উঠে নিশ্চিন্ত হল সে।

পুলিস ভ্যানের পেছন পেছন জনতা ঈশ্বরপুকুর ধরে ট্রাম রাস্তা অবধি বেরিয়ে এল। অর্ক মানুষগুলোকে দেখছিল। কয়লা ধরা পড়েছে দেখে এখন আহ্লাদে আটখানা। ব্যাপারটা যেন স্বপ্নের বাইরে ছিল। কয়লার মত মাস্তানকে পুলিসের ভ্যানে মুখ লুকিয়ে যেতে হচ্ছে, এইটুকুই যেন বিরাট পাওয়া।

সতীশদা দাঁড়িয়ে ছিল তিন নম্বরের সামনে। অর্ককে দেখে বলল, আশা করি কিছুদিন পাড়া ঠাণ্ডা থাকবে। তবে তোমরা যে এভাবে অর্গানাইজ করতে পারবে ভাবিনি।

অর্ক বলল, অর্গানাইজ কে করেছে? সবাই তো রেগে গিয়ে জড়ো হল। কিন্তু তাতে কি লাভ হয়েছে জানি না।

সতীশ হাসল, একথা তোমার কেন মনে হচ্ছে?

অর্ক মাথা নাড়ল, সব যেন কেমন সাজানো বানানো। প্রথমে যে পুলিস এসেছিল সে কোয়াকে খোঁজ করল কিন্তু কয়লার কথা শুনতেই চাইল না। পরের দলটা যেন ওই ঘটনা জানেই না। আমার মনে হচ্ছে নুকু ঘোষরাই টেলিফোন করে পুলিস আনিয়েছে যাতে কয়লা ভালভাবে গলি থেকে বেরিয়ে যেতে পারে ভ্যানে চেপে! অথচ পাবলিক এসব বুঝল না।

সতীশদা অর্ককে দেখল। আশেপাশে কেউ নেই যার কানে কথাগুলো যেতে পারে। ছেলেটার বুদ্ধি তাকে চমৎকৃত করেছে বোঝা যাচ্ছিল। তার মনে পড়ল এই ছেলেকে বলা সত্ত্বেও পার্টি অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। অথচ একে পেলে দলের উপকার হত। সতীশদা বলল, অর্ক, কাল বিকেলে একবার অফিসে এসো, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।

কাল বিকেল? সঙ্গে সঙ্গে অর্ক বাস্তবে ফিরে এল। সে মাথা নাড়ল, না সতীশদা, কাল বিকেলে আমার সময় হবে না। এটি

সতীশের কপালে ভাঁজ পড়ল। ছেলেটার ওপর ওর বাবার প্রভাব মনে হচ্ছে প্রচণ্ড! তবু সে সরল মুখে জিজ্ঞাসা করল, কেন?

আমার মা খুব অসুস্থ। হাসপাতালে আছে! কাল অপারেশন হতে পারে।

সেকি! কি হয়েছে। ওঁর?

আলসার। অবস্থা ভাল নয়।

কোন হাসপাতাল?

ও। সতীশদা দু’মুহূর্ত চিন্তা করল, বেশ, কোন প্রয়োজন থাকলে আমাকে বলো। এখন তুমি বাড়ি ফিরে যাও। বিশ্রাম নাও।

অর্ক হাসবার চেষ্টা করল, আচ্ছা সতীশদা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?

বল।

আপনারা সি পি এম করেন, সরকার আপনাদের হাতে, মানুষের উপকার করার কথা বলেন। আপনারা ইচ্ছে করলে এসব বন্ধ করতে পারেন না?

কি সব? সতীশদা অবাক হয়ে তাকাল।

এই গুণ্ডাবাজি। আমাদের ঈশ্বরপুকুরে চোলাই মদ বিক্রি হয় তিন-চার জায়গায়, সেগুলো খেয়ে প্রকাশ্যে মাতলামি চলে খিস্তিখেউড় হয়। পাঁচ-ছয়জন ছেলে শুধু মুখের জোরে আর ছুরি দেখিয়ে মাস্তানি করে যায়। এদের আপনারা একদিনেই থামিয়ে দিতে পারেন না?

পারি।

তাহলে থামাচ্ছেন না কেন?

এর উত্তরটা আমার জানা নেই। কিংবা বলতে পারো আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ যদি এদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয় তাহলে তাদের আমরা সমর্থন করব। আবার এমনও হতে পারে, আমরা এত বড় বড় ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত যে এইসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না। যেন নিজেকেই প্রবোধ দিচ্ছে সতীশদা এমন মনে হচ্ছিল। এবং এর মধ্যে যে বিরাট ফাঁকি রয়ে গেছে তা বুঝতে অসুবিধে হল না অর্কর। সতীশদা অর্কর কাঁধে হাত রাখল, আমি নিজেও সন্তুষ্ট নই অর্ক। কিছু কিছু ব্যাপারে প্রতিবাদ করেছি বলে দলের নেতারা আমাকে খুব ভাল চোখে দেখছেন না। কিন্তু একটা কথা কি জানো, তুমি একা এই দেশে কিছুই করতে পারবে না। দেশ কেন বলছি, এই পাড়াতে কোন ভাল জিনিস তোমার একার পক্ষে করা অসম্ভব। তোমার পেছনে একটা দল চাই, একটা সংগঠিত বাজনৈতিক শক্তি চাই। সি পি এমের কিছু কিছু ত্রুটি আছে। আমরা আমাদের বিরুদ্ধে কোন সমালোচনা সহ্য করতে পারি না। মানছি। কিন্তু ভারতবর্ষে আমরাই হলাম একমাত্র দল যারা একটা নির্দিষ্ট আদর্শে বিশ্বাস করি। সাধারণ মানুষের বাঁচার লড়াইটাকে জোরদার করতে বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মসূচীমত এগোতে চাই। সুতরাং কিছু করতে হলে এই দলে তোমাকে আসতেই হবে! নদীতে তোমার একটা নৌকো দরকার হবে! ফুটো বা পলকা। নৌকোর চেয়ে মজবুত নৌকোতেই চড়া বাস্তবসম্মত কাজ। আর নৌকো ছাড়া নদী পার হতে গেলে তোমাকে একা সাঁতরে যেতে হবে। সেটা কতদিন সম্ভব? চারধারে অজস্র হাঙর।

.

রাত্রে একদম ঘুমুতে পারল না অর্ক। আজ বিকেল এবং রাত্রের উত্তেজনা তাকে মাধবীলতার কাছ থেকে অনেকটা দূরে সরিয়ে রেখেছিল! এখন একা হতেই সেই সব ভাবনা আবার ফিরে এল। বস্তিব এই ছোট্ট ঘরে আজ মা নেই। মা যদি আর ফিরে না আসে? মোক্ষবুড়ি বলত হাসপাতালে। গেলে আর ফিরবে না। ফালতু কথা, কোন যুক্তি নেই। কিন্তু এখন যেন সেটাই বুকের মধ্যে সিরসির করতে লাগল। জলপাইগুড়িতে একটা খবর দেবে? নিজের মনেই মাথা নাড়ল অর্ক। না। মা চায়নি। মা যা চায়নি তা সে করবে না।

অর্ক বিছানা থেকে উঠল। তারপর বাক্সগুলো হাতড়াতে লাগল। মা যেখানে যেখানে টাকা রাখে সেগুলোয় খোঁজ নেবার পর তার হাতে দুশো কুড়ি টাকা জমা হল। এই হল তার সম্পত্তি। এই টাকায় মাকে সারাতে হবে। অবশ্য মায়ের স্কুলের টিচার্সরা বলেছেন তাঁরা খরচ দেবেন। কিন্তু সে কি করবে? অর্কর মনে হচ্ছিল সে যদি আরও দশটা বছর আগে জন্মাতো, যদি- সে মাথা নাড়ল। কি হতো তাতে? কিছুই হতো না। বি এ এম এ পাশ করে দেড় হাজার টাকা মাইনের চাকরি করত। দুবেলা পেট ভরে খেত। বিয়ে করত। সুখী সুখী ভান করে জীবনটা কাটিয়ে দিত। কিংবা সতীশদার মত এমন রাজনীতি করত যেটা না করলে তার কোন উপায় থাকত না। চারপাশের মানুষেরা সকালে ঘুম থেকে ওঠে আবার রাত্তিরে ঘুমুতে যায়। এর মধ্যে যা যা করে তার একদিনের সঙ্গে আর একদিনের কোন পার্থক্য নেই। রোজ বাজার করে, রোজ ভিড় ঠেলে অফিসে যায়, রোজ অফিস ফেল করে। এর মধ্যে একটার পর একটা দিন কখন ফুরিয়ে যায় খেয়ালও করে না। তারপর বুড়ো হয়, মরেও যায়। এইভাবে বেঁচে থাকার কি মানে? মাকে সরাসরি প্রশ্ন করেছিল সে একদিন। আশ্চর্য; মা-ও জবাব দেয়নি। আবার ওইভাবে যারা বেঁচে আছে, এই বি এ এম এ পাশ করে চাকরি পেয়ে বিয়ে-থা করে তাদেরও সামর্থ্য অনুযায়ী ইচ্ছে করতে হয়। প্রত্যেকের নিজস্ব চৌহদ্দি তৈরি হয়ে যায় আর তার মধ্যেই মুখ বুজে থাকে। আবার যারা ওসব পাশফাস করে না, রকবাজি গুণ্ডামিতে যৌবনের শুরু করে তারা মাঝেমধ্যে এদের চেয়ে ভাল থাকে আবার খারাপও। কিন্তু ওই নিয়মবদ্ধ লোকগুলো এদের ভয় পায়। এই যেমন কয়লাকে দেখলে জিভ শুকিয়ে যায় তিন-চারটে এম এ পাশ ভদ্রলোকের। মুখ নামিয়ে চলে যাবে তারা। আড়ালে যতই গালাগালি করুক সামনে স্বর বের হবে না।

মা যদি চলে যায় তাহলে সে কি পরিচয় নিয়ে থাকবে? অর্ক আলো নেবালো। মা বলেছিল ভালবাসা থেকে যে বিশ্বাস তা বিয়ের নিয়মের থেকে অনেক বড়। শুধু সেই বিশ্বাসকে অপমান না করার জন্যে মা পরে বিয়ে করেনি। কিন্তু যখন মা সম্পর্ক ভেঙ্গে এল তখন সেই বিশ্বাসটায় অবশ্যই চিড় ধরেছিল। তাই যদি হয় তার জন্ম ভাঁওতা থেকে, বিশ্বাস থেকে নয়। আইন নেই, বিশ্বাস নেই, পৃথিবীতে তার আসাটাই যখন ক্ষণিকের উন্মাদনায় তখন আগামীকালের অস্তিত্বের জন্যে সে কেন এত ভাবছে? মা তো ভাবেনি অর্কর কি হবে? অর্ক কি করবে? তাহলে তার ভাবার কি আছে। বরং একটা দিক থেকে সুবিধেই হল, তার কোন সামাজিক বন্ধন নেই। কোন লৌকিক চক্ষুলজ্জা নেই। সে যেমন ইচ্ছে তেমনভাবে পৃথিবীতে চলে ফিরে বেড়াবে! মা না থাকলে কোন নিয়মের পরোয়া করবে না।

অর্ক ঘুমুতে পারল না। তার মাথার ভেতরটা ভীষণ হালকা লাগছিল। অথচ ঘুম আসছে না। ওর মনে হল মাকে একবার দেখলে হত। একবার যদি মায়ের মুখ দেখতে পারত তাহলে হয়তো আরাম হতো। যতদিন মা বেঁচে আছে ততদিন অনেক কিছু না থাকলেও একটা ছোট্ট আরাম বেঁচে থাকে। সেই আরামটার জন্যে সে লালায়িত হল। এখন মাঝ রাত পার হতে চলেছে। এই সময় হাসপাতালের দরজা নিশ্চয়ই বন্ধ। কিন্তু তার মন মানছিল না। হেঁটে গেলে মিনিট পনেরর মধ্যে হাসপাতালের দরজায় পৌঁছে যাওয়া যায়। অর্ক ছটফট করল। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে এল বাইরে। কোথাও কোন শব্দ নেই। তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেন এখন ভীষণ শান্ত। দরজায় তালা। দিয়ে সে গলিতে পা রাখতেই চমকে উঠল। বুকের ভেতর এমনভাবে হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠেছিল যে সহজ হতে সময় লাগল। না, এটা শুধুই একটা বস্তা। উনুনের কারখানার সামনে ছায়ায় মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু অভ্যস্ত দৃশ্যের মত সে প্রথমে ওটাকেই মোক্ষবুড়ি বলে ভেবেছিল। মোক্ষবুড়ি এখন কোথায়! কি সুন্দর বেঁচে গেল শেষ পর্যন্ত। ওর এই মরে যাওয়াতে আর একটুও খারাপ লাগছে না। এইভাবে পড়ে থাকা, ঘষটে ঘষটে সেঁটে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া বেশ আরামের।

গলির মুখে দাঁড়িয়ে আছে কেউ। ঠিক মুখে নয় নিমুর দোকানের আড়াল ঘেঁষে দুজন মানুষকে অনভ্যস্ত চোখে দেখল সে। তার উপস্থিতি ওরা টের পায়নি। নিমুর দোকানের পাশে একটা ছোট্ট রক অনেকটা আড়াল নিয়ে রয়ে গেছে। ওখানে নিমু জলের ড্রাম রাখে দিনের বেলায়। রাত্রে সেটা তুলে রাখে দোকানে। এখন নিমূর ঝাঁপ বন্ধ। ঈশ্বরপুকুরে একটি প্রাণীও হাঁটছে না। কিন্তু দুটো মানুষ যে পরস্পরের কাছাকাছি এসেই ছিটকে সরে যাচ্ছে সেটা স্পষ্ট। যে সরছে সে মেয়ে। অর্ক আধা-অন্ধকারে তাদের ঠাওর করতে পারছিল না। তবে এমন প্রকাশ্যে এসব কাজ করার জন্যে ওরা এত সুন্দর সময় বেছে নিয়েছে যে অন্যদিকে তাকানোর ব্যাপারে পুরুষটি নিস্পৃহ ছিল। মেয়েটি কিন্তু তাকে সজাগ কয়ছে আবার কাছেও এগিয়ে যাচ্ছে। পুরুষটি তখন বেশ উন্মত্ত। ওই ছোট্ট রকে সে মেয়েটিকে শুইয়ে দিতে চাইছে। মেয়েটির ব্যবহারে বোঝা যাচ্ছিল চূড়ান্ত কিছুতে সে নারাজ।

অর্ক যে ঠিক গলির মুখে দাঁড়িয়েছে সেদিকে ওদের লক্ষ্য নেই। এবং এক পা এগোতেই অর্ক এদের চিনতে পারল। পেরে চমকে উঠল। লোকটার বয়স পঞ্চাশ তো হবেই। বিড়ি বাঁধে দিনরাত ঝুঁকে ঝুঁকে। সংসার নেই। তিন নম্বরের একটা চিলতে ঘরে থাকে। আর মেয়ে বলে যাকে ভাবছিল তার বয়স কমসে কম পঁয়তাল্লিশ কিন্তু দেখলে আরও বেশী মনে হয়! রোগা, শরীরে সামান্য মাংস নেই, গাল ভাঙা, কিন্তু মুখ-চোখে খুব ঢঙ আছে। অনেকগুলো বাচ্চা আছে বউটার! বউটার স্বামী মাতাল, কপোরেশনে কাজ করে।

রেগে যেতে গিয়েও অর্ক হেসে ফেলল। এই মানুষ দুটোর জন্যে পৃথিবীতে কোন ভাল জিনিস অপেক্ষা করে নেই। সারা দিনরাত শুয়ে হতাশ আর একই অভাবের মধ্যে দম বন্ধ করে বেঁচে থাকা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। হিসেব মতন এদের যৌবন গিয়েছে। অথচ এখন দেখলে মনে হবে দুটো সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত বিশ্বচরাচর ভুলে পরস্পরের সান্নিধ্য পেতে ব্যগ্র। তার মানে সমস্ত একঘেয়েমির মধ্যেও মানুষ কখনও কখনও একটু সুখ খুঁজে নিতে পারে। সেটা বৈধ হোক কিংবা অবৈধ।

অর্ক চোখ ফিরিয়ে নিল। বউটি বোধহয় নিজের কাছে হেরে যাচ্ছে। কারণ লোকটি তাকে কোলের ওপর বসিয়ে জড়িয়ে ধরেছে। ছোট্ট রকের ভেতর সেঁধিয়ে যাওয়ায় ওরা এখন চোখের আড়ালে চলে গেছে অনেকটা। অর্ক স্বস্তি পেল। এতক্ষণ সে পা বাড়াতে পারছিল না। রাস্তায় নামলেই ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় ছিল। ওকে দেখলে ওদের যতটা না লজ্জা তার চেয়ে ওর নিজের যেন বেশী অস্বস্তি। কয়েক পা হাঁটতে না হাঁটতেই একটা গলা শুনতে পেল সে।

লোকটা আসছে। দুটো হাত দুদিকে বাড়ানো। অকথ্য শব্দ ছিটকে ছিটকে উঠছে মুখ থেকে। পরনে একটা ময়লা ধুতি আর শার্ট। বেঁটেখাটো, লিকলিকে চেহারা, যতটা না বয়স তার চেয়ে অনেক বুড়ো দেখাচ্ছে। এতটা রাস্তা যে কিভাবে হেঁটে এল সেটাই বিস্ময়কর। আকণ্ঠ মদ্যপান করে এখন বিশ্বচরাচরের উদ্দেশে যে শব্দ ব্যবহার করছে তা সঞ্চয় করা সহজসাধ্য নয়। রাত্রির এই নির্জনে সেই সব জড়ানো শব্দগুলো ঈশ্বরপুকুরের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে কিন্তু কেউ কোন প্রতিবাদ করছে না।

অর্কর শরীরে জ্বলুনি শুরু হল। একে মাতাল তার ওপর খিস্তি তার কাছে অসহ্য মনে হচ্ছিল। এদের কাছ থেকেই অনুপ্রাণিত হয় অল্পবয়সী মাস্তানরা। সে এগিয়ে যাওয়ার আগেই ঘটনাটা ঘটে গেল। তীরের মত ছুটে এল বউটা। এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটার ওপর। সারাদিন খাইনি, ঘরে একফোঁটা দানা নেই আর তুমি রাত শেষ করে মদ গিলে ফিরলে! আঃ, মরণও হয় না আমার! হেই ভগবান, গলায় দড়ি দিয়ে টেনে নাও না কেন? ছি ছি ছি।

আক্রান্ত হওয়ামাত্র লোকটার চেহারা পাল্টে গেল। টান টান হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে করতে সে বউটাকে দেখল, অ্যাই, এখানে কি করছিলি? ঘরের বউ রাস্তায় কেন অ্যাাঁ?

সঙ্গে সঙ্গে বউটা চেঁচালো, মুখ খসে যাবে সন্দেহ করলে। ঝাঁটা মার ঝাঁটা মার অমন পুরুষের মুখে। বউ বাচ্চাকে দ্যাখে না আবার তেজ কি! ওরে, আমি রোজ না দাঁড়িয়ে থাকলে পথ দেখিয়ে ঘরে নিয়ে যেত কে? ৯ অর্ক বউটার দিকে তাকাতে পারছিল না। হাড়জিরজিরে শরীরটা এখন বীভৎস হয়ে উঠেছে। মুখের চেহারা আহত শেয়ালের মত। চোয়াল দুটো বারংবার ওঠানামা করছে। এই মুখ এবং আচবণের সঙ্গে একটু আগে দেখা দৃশ্যের কোন মিল নেই। কল্পনাতেও কাছাকাছি আসে না। এই বউটা ওই শরীর এবং বয়সে অত প্রেম পায় কোত্থেকে? এবং এত দ্রুত সেটা মিলিয়ে দিতেও পারে কোন ক্ষমতায়? কিন্তু অর্কর জন্যে আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। লোকটি আর একটি অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ করে হাত চালাতে বউটি ছিটকে পড়ল ফুটপাথে। লোকটা তখন চেঁচাচ্ছে, কি! যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা? আমি মাল খাই বেশ করি। তোর বাপের পয়সায় খাই! তুই এখানে এত রাত্রে কি করিস আমি জানি না? আমার সঙ্গে শুতে গেলে তোর ঘেন্না করে অ্যাাঁ? আমারও করে। শুনে রাখ।

অর্কর মাথার পোকাটা নড়ে উঠল। সে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, মারলেন কেন?

কে শালা তুমি? নদের চাঁদ! মায়ের বয়সী বউ-এর সঙ্গে পেরেম করছ? হাত ঘুরিয়ে লোকটা কথা বলতেই অর্ক নিজেকে সামলাতে পারল না। বেধড়ক মারতেই লোকটা ককিয়ে উঠল। তারপর হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল। এইবার বউটা ফুটপাথে উঠে বসে চিৎকার শুরু করল, ওরে বাবা রে, মেরে ফেলল রে।

অর্ক চেঁচালো, চুপ করুন। একটু আগে যা করেছেন আমি দেখেছি।

সঙ্গে সঙ্গে বউটা মুখ বন্ধ করে সুড়সুড় করে গলির ভেতরে ঢুকে গেল। আর লোকটা কান্না থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, দেখেছ, তুমি দেখেছ?

অর্ক ওর জামার কলার ধরে টেনে তুলল, আপনি মাল খেয়ে আসেন কেন রোজ? কেন এভাবে খিস্তি করেন?

তোমার বাবার কি? আমি বেশ করি।

সঙ্গে সঙ্গে চড় মারল অর্ক, এবার মাল খেয়ে এলে জ্যান্ত পুঁতে ফেলব। নিজের বউ বাচ্চা খেতে পায় না, বউ অন্যের সঙ্গে প্রেম করছে আর আপনি মাল খেয়ে পাড়াটাকে নরক করে মাঝরাত্রে ফিরছেন। আপনাদের কাছ থেকে আমরা এইসব শিখব, না?

জ্ঞান মারিও না জ্ঞান মারিও না। মাল না খেলে আমার কোন উপায় নেই। আমি মরে যাব। স্রেফ মরে যাব।

এটা কিভাবে বেঁচে আছেন?

আছি। যা মাইনে পাই আমি মাল না খেলে তাতে কুড়ি দিন চলে দশ দিন উপোস। মাল খেলে দশ দিন যাবে কুড়ি দিন উপোস। আমি তাই মাল খাই। দশ দিন যারা উপোস করতে পারে তারা কুড়ি দিন পারবে।

কত টাকা মাইনে পান আপনি?

কেটেকুটে দুশো টাকা।

এ তো অনেক টাকা।

অনেক টাকা? হ্যাঁ হ্যাঁ। কি নাম বাবা তোমার? ঠিক আছে, দিয়ে দেব তোমার হাতে দুশো টাকা, সারামাস ওদের ভাত খাওয়াতে পারবে? যদি পার তাহলে আমি মদ খাওয়া ছেড়ে দেব। দেব দেব দেব। তিন সত্যি করলাম। অনেক টাকা! তাহলে হিজড়েও মা হয়ে যাবে। দুহাতে আকাশ ধরে লোকটা গলিতে ঢুকে গেল পাখির মত।

৫০. সারাটা রাত হাসপাতালের বারান্দায়

সারাটা রাত হাসপাতালের বারান্দায় কেটেছে এবং কি আশ্চর্য, ভোরের দিকে বসেই বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিল অর্ক। হঠাৎসংবিৎ ফিরতেই সে উঠে দাঁড়াল। কাল রাত্তিরে অনেক চেষ্টা করেও সে মায়ের কাছে পৌঁছতে পারেনি। কড়া নিয়মকানুনগুলোকে সে মানতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু তিন নম্বরের ঘরে বসে যা হয়নি এখানে এসে তা হয়েছিল। মনের ছটফটানিটা কমেছিল। এই বিশাল বাড়ির একটা ঘরের বিছানায় মাধবীলতা শুয়ে আছে আর সে তারই কাছাকাছি বারান্দায়–এটাই যেন অনেকটা আরামের মনে হয়েছিল। মা এখন হাতের মধ্যেই, এই বোধ তাকে নিশ্চিত করেছিল। একটা মানুষের জন্যে আর একটা মানুষের বুকের মধ্যে এই যে একধরনের আঁচড়কাটা শুরু হয় এবং তার একটা মানানসই সান্ত্বনায় না আসা অবধি যে উপশম হয় না তাকে কি বলে? অর্ক যেন এসবই বুঝতে পারছে। এইভাবে সে ভাবতে পারত না আগে, বড্ড তাড়াতাড়ি সে অন্য মানুষের চেয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে। আর কি আশ্চর্য, নিজেকে বড় ভাবতে ভাল লাগছে তার।

ভাঁড়ের চা হাতে নিয়ে সে হাসপাতালটাকে দেখছিল। চারধারে কেমন ঢিলে ঢিলে ভাব। অথচ এর মধ্যেই কিছু মানুষ আউটডোরের সামনে জড় হয়েছে। সেই লোকটা কোথায়? যে সব মুশকিল আসান করে দেয় এই হাসপাতালে! অর্ক তাকে দেখতে পেল না।

শরীর থেকে বিচ্ছিরি গন্ধ বের হচ্ছে। জামাকাপড় বেশ ময়লা। আজকাল ঠিকঠাক কাঁচাকুচি হয় না। নিজের দিকে তাকিয়ে শরীর গুলিয়ে উঠল। এত ময়লা পোশাকে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে? অর্ক বসার জায়গা পাচ্ছিল না। এখন স্বচ্ছন্দে বারান্দায় বসতে পারল। অনেক লোক এখানে বসে আছে এবং তাদের পোশাক ও চেহারা দেখলে বোঝা যায় যে কোনরকম মানসিক খুঁতখুঁতুনি নেই। যে-কোন পরিবেশেই এরা হাঁটু গেড়ে বসে ভবিতব্যের জন্যে অপেক্ষা করতে পারে।

সকালবেলায় হাসপাতালের ভেতরটা অন্যরকম দেখায়। টাটকা ওষুধের গন্ধ এবং একটা অগোছালো ঘরোয়া ভাব বেশ টের পাওয়া যায় ভেতরে ঢুকলে। এমনকি রুগীদের চেহারাও স্বাভাবিক দেখায়। অর্ক মাধবীলতার কাছে যাওয়ার অনুমতি যখন পেল তখন রুগীদের ছিমছাম করে দেওয়া হয়েছে। মায়ের বিছানার সামনে গিয়ে অর্কর হৃৎপিণ্ড যেন লাফিয়ে উঠল। মাধবীলতা বালিশে পিঠ দিয়ে আধো-শোওয়া হয়ে আছে। ওকে দেখামাত্রই মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে পড়ল মুখে। অর্ক মুগ্ধ চোখে মায়ের দিকে তাকিয়েছিল। মুখের চামড়া সাদা, সমস্ত দেহে ক্লান্তি এটে বসেছে অথচ মুখখানায় একটু হাসি প্রতিমার মত সৌন্দর্য এনেছে। ছেলে দাঁড়িয়ে আছে দেখে মাধবীলতা চোখ ছোট করল, কি হল, আয়!

অর্ক পায়ে শক্তি পাচ্ছিল না। মাকে দেখা মাত্র তার সব দুশ্চিন্তা যেন মুহূর্তেই উধাও হয়ে গিয়েছে কিন্তু অদ্ভুত একটা অবসাদ তাকে গ্রাস করল। তার মা যদি এত ভাল তাহলে সে বাস্টার্ড হয় কি করে? কেন তার কোন মূল্যবোধ থাকবে না? সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে কেউ প্রতিবাদ করল, কে বলেছে তা নেই? না থাকলে মাকে দেখামাত্র বুকের ভেতরটা এমন টনটন করবে কেন? এমন আনন্দিত হবে কেন? হঠাৎ সে আবিষ্কার করল কেউ বাস্টার্ড হয়ে জন্মায় না, জন্মাবার পর তার আচরণ তাকে বাস্টার্ড করে তোলে।

মাধবীলতার বিস্ময় বাড়ছিল। সে আবার ডাকল, কি রে?

এবার অর্ক কাছে এল। এবং কাছে আসবার সময় সে আবেগের শিকার হল। তার গলার স্বর কেঁপে উঠল, কেমন আছ?

আমি ভাল আছি। দ্যাখ না আমার কোন ব্যথা নেই। সকাল থেকে নার্সকে দু’বার বললাম আমায় ছেড়ে দিতে কিন্তু শুনতেই চাইছে না। কি জ্বালা! মাধবীলতা হাসল এবং তারপরেই গম্ভীর হল, কিন্তু তোর কি হয়েছে?

অর্ক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, আমার আবার কি হবে?

আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিস এর মধ্যে? ছি ছি। মাধবীলতা ঠোঁট কামড়াল।

অর্ক হতভম্ব হয়ে নিজের দিকে তাকাল। মাকে দেখতে এসে যে আক্রান্ত হতে হবে তা কল্পনা, করেনি সে। লজ্জিত ভঙ্গীতে অর্ক বলল, জামাপ্যান্টের কথা বলছ? ময়লা হয়ে গেছে, না?

ময়লা? ওগুলো কোন ভদ্রলোক গায়ে দিতে পারে? কাল সারা দিন স্নান করিসনি? চুল আঁচড়াসনি? ইস, কি চেহারা হয়েছে তোর? মাধবীলতা ছেলের কাঁধে হাত দিল। বিছানার পাশের টুলটায় ততক্ষণে বসেছে অর্ক।

ছেড়ে দাও তো আমার কথা! অর্ক মাথা নাড়ল।

কেন, ছাড়ব কে? দুদিন আমি না থাকলে যদি তোমার এই অবস্থা হয় তাহলে লোকে বলবে কি? মায়ের আদরে ছেলে এতকাল খোকা হয়ে ছিল!

বেশ ছিলাম তো ছিলাম।

কাল কোথায় খেয়েছিলি?

অর্ক এবার হেসে ফেলল, আমি কি এখনও ছেলেমানুষ আছি যে এসব প্রশ্ন করছ? ঠিক আছে, বিকেলে যখন আসব তখন দেখবে কি ফিটফাট।

মাধবীলতা ছেলের গালে হাত রাখল। অর্কর মুখে এখন লাল-কালোয় মেশানো লোম যা আর কিছুদিনের মধ্যেই দাড়ির চেহারা নেবে। যদিও এখন তা খুবই নরম এবং সুন্দর দেখায় তবু আঙ্গুলের ডগা মাধবীলতাকে মনে করিয়ে দিল ছেলে বড় হয়েছে।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কাল রাত্রে ঘুমিয়েছিলি?

বা রে, ঘুমাবো না কেন?

আমাকে এখান থেকে কবে ছাড়বে খোঁজ নে তো! আর ভাল লাগছে না। শরীরে যখন কোন অসুবিধে নেই তখন এখানে খামোকা পড়ে থাকব কেন? আর কিইবা এমন হয়েছিল যে সাততাড়াতাড়ি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে এলি?

তুমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে।

ও কিছু নয়, অম্বল টম্বল থেকে এসব হয়।

তোমাকে এরা কিছু বলেনি?

না তো।

অর্ক অস্বস্তিতে পড়ল। মাকে সব কথা খুলে বলা ঠিক হবে কিনা কে জানে। অসুস্থ মানুষকে নাকি অসুখের বিবরণ জানাতে নেই। মাধবীলতা ছেলের হাত ধরল, কি হয়েছে আমার? কি বলেছে এরা?

তুমি এতকাল খুব অনিয়ম করেছ, খাওয়া দাওয়া করোনি। তোমার পেটে বেশ বড় ঘা হয়েছে। আজকালের মধ্যে অপারেশন করবে। অপারেশন না করলে তুমি বাঁচবে না। কিন্তু তোমার শরীরে রক্ত এত কম যে–। অর্ক চুপ করে গেল।

মাধবীলতা অর্কর হাতটা মুঠোয় ধরেছিল। এবার সেটাকে ছেড়ে হাসল, তুই ওরকম মুখ করে কথা বলছিস কেন? আমি কি মরে গেছি?

অর্ক বলল, তুমি সত্যিই অদ্ভুত। আমাদের খাইয়েছ আর নিজে খাওনি? শরীরের রক্ত কমে গেছে সেকথা তুমি জানতে না?

মাধবীলতা চোখ বন্ধ করল, বাংলাদেশের কটা মেয়ের শরীরে ঠিকঠাক রক্ত আছে। তারপর চোখ খুলে বলল, যাক এসব কথা। কিন্তু তুই একা এসব ঝামেলা সামলাবি কি করে? তার চেয়ে হোমিওপ্যাথি করালে ভাল হত।

শক্ত মুখে অর্ক বলল, কি করলে ভাল হত তা তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আর আমি একা হব কেন? তোমার স্কুলের টিচার্সরা এসেছিলেন, পরমহংসকাকু আছে। দেখো কোন অসুবিধে হবে না।

টিচার্সরা এসেছিল? কে কে?

অর্ক বিশদ ব্যাখ্যা করল। সৌদামিনীর পরিচিত ডাক্তার অতএব কোন ভয় নেই। টাকা পয়সা যা লাগে তা ওঁরাই দেবেন। মাধবীলতার এসব নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাতে হবে না। মাধবীলতা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি যখন এখানে পড়ে থাকব তখন তোর চলবে কি করে?

তুই কার কাছে থাকবি? কি খাবি?

আমি আমার কাছেই থাকব। আর কোলকাতায় সব খাবার পাওয়া যায়

মাধবীলতা ঠোঁট দাঁতে চাপল, আমার সুটকেসটা খুলে দেখবি বাঁ দিকের কোনায় কিছু টাকা আছে। দুশো টাকার মত। ওটা নিয়ে সাবধানে খরচ করবি। বাড়িতে স্টোভে ফুটিয়ে নিতে যদি পারিস তাহলে সবচেয়ে ভাল হয়। হোটেলের রান্না তোর সহ্য হবে না। আর খুব সাবধানে থাকবি। পাড়ার কোন ঝামেলার মধ্যে যাবি না।

আচ্ছা। অর্ক মাথা নাড়ল।

আর হ্যাঁ, পড়াশুনা কর। এখন তো কোন ঝামেলা রইল না। সকাল বিকেল আমাকে দেখতে আসা ছাড়া অফুরন্ত সময় পাচ্ছিস। মন দিয়ে পড়াশুনা কর যাতে আমি সবাইকে বলতে পারি স্কুলে না গিয়েও আমার ছেলে ভালভাবে পাশ করেছে। আমি তোর পরীক্ষা দেবার সব ব্যবস্থা করে এসেছি।

তুমি বলছ যখন তখন আমি পড়ব, পরীক্ষা দেব।

তুই নিজের ভেতর থেকে কোন তাগিদ পাস না, না?

না মা। টাকা রোজগার করার জন্যে যদি পড়াশুনা করতে হয় তাহলে সেটা না করেও উপার্জন করা যায়। হ্যাঁ, বড় চাকরি পাওয়া যায় না একথা ঠিক কিন্তু চাকরি যারা করে তারা আর কত রোজগার করে?

চাকরি ছাড়া আর কি করে উপার্জন করবি? ব্যবসা করে? তার জন্যে টাকার দরকার। এছাড়া আছে গুণ্ডামি আর ডাকাতি? নিশ্চয়ই শেষদুটো করবি বলছিস না?

কি করব আমি জানি না। তবে তুমি নিশ্চিন্ত হও এবার আমি পরীক্ষা দেব। আমি এমন কাজ করব না যাতে তুমি দুঃখ পাও।

সত্যি? মাধবীলতা উদ্ভাসিত হল।

হ্যাঁ। কিন্তু মা, তুমি তাড়াতাড়ি সেরে ওঠো। তোমাকে ছাড়া আমার একটুও ভাল লাগে না। আমার কোন বন্ধু নেই, কোন আত্মীয় নেই। অর্কর জিভ আড়ষ্ট হয়ে গেল। মাধবীলতার দুচোখের কোলে টলটলে জল, চোখের পাতা বন্ধ হতেই গাল ভিজিয়ে গড়িয়ে পড়ল নিচে।

আর তখনই গম্ভীর গলা শুনতে পেল অর্ক, কি ব্যাপার কান্নাকাটি কেন?

মুখ ফিরিয়ে সে পরমহংসকে দেখল, দেখে টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। পরমহংসর উপস্থিতি মাধবীলতাকেও সচেতন করেছিল। কারণ সে চট করে চোখের জল মুছে ফেলে হাসবার চেষ্টা করল, কেমন আছো?

পরমহংস হাঁ হয়ে গেল, যাঃ বাবা। হাসপাতালের বিছানায় নিজে শুয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করছ কেমন আছি? চমৎকার। তা ম্যাডাম, এই রোগটা তো পাকামি না করলে হয় না। খুব স্যাক্রিফাইস করেছ না? এখন বোঝ ঠ্যালা। সব রিপোর্ট এসে গিয়েছে? শেষ প্রশ্নটা অর্কর উদ্দেশে।

অর্কর গলা ধরেছিল, আমি জানি না।

তার দিকে তাকিয়ে পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, ডাক্তার খোঁজ নিতে আসেনি?

এবার মাধবীলতা জবাব দিল, সব দেখাশোনা হয়েছে। নার্স বলেছে তোমাদের অফিসে খোঁজ খবর নিতে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কিন্তু ভাঙ্গতে চাইল না।

পরমহংস চিন্তিত হল, সকালে ডাক্তার বসে নাকি! তুমি বসো অর্ক, আমি দেখে আসি। মাধবীলতা বলল, ঠিক আছে, ওসব পরে হবে। তোমরা এমন করছ যেন আমি মরতে বসেছি। আমি তো এখন ভাল আছি। কোন অসুবিধে নেই। খোকা, তুই কিন্তু ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করবি আমাকে আজ ছেড়ে দেবে কিনা। এখানে আর মোটেই ভাল লাগছে না।

ঠিক এইসময় ওরা সৌদামিনীকে দেখতে পেল। অর্ক একটু অবাক হল, সকালবেলায় সৌদামিনীর আসার কথা ছিল না। তাঁর ভারী শরীর নিয়ে তিনি দ্রুত পায়ে কাছে হেঁটে এসে বললেন, বাঃ, বেশ তো উঠে বসেছ। তা তলে তলে এরকম একটা রোগ বাধিয়ে বসে আছ টের পাওনি?

কি রোগ? মাধবীলতা হাসবার চেষ্টা করল। ওকে এখন সঙ্কুচিত দেখাচ্ছিল।

ন্যাকা, জানো না কি রোগ? শোন, আজ সকালে ডাক্তারের সঙ্গে কথা হল। অপারেশন ছাড়া কোন উপায় নেই। এসব ব্যাপার নিয়ে একটুও চিন্তা করো না, সুধীরের হাত খুব ভাল। কথা বলতে বলতে ঝোলা থেকে একটা ছোট তোয়ালে চিরুনি পাউডারের কৌটো আর সাবান বের করলেন সৌদামিনী। ওগুলোকে পাশের ঘোট আলমারিতে রেখে বললেন, শুধু আমাদের ভরসায় থাকলে তো চলবে না, স্বামীকে খবর দিয়েছ?

অর্ক চট করে মায়ের মুখ দেখল। চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে মাধবীলতার। তারপরেই ঠোঁটের কোণে ভাঁজ পড়ল তার, একটু যেন হাসল, আমার তাহলে অপারেশন হচ্ছেই।

হ্যাঁ হচ্ছে। এইটে মাথার নিচে রাখবে। না, মাথার নিচে থাকলে তো চলবে না। আমি আবার লালসুতা আনতে ভুলে গেলাম। আচ্ছা এখন জামার মধ্যে রাখো তো। ধরো, মাথায় ছুঁইয়ে নাও।ছোট্ট বেলপাতায় মোড়া একটা ফুল সন্তর্পণে এগিয়ে দিলেন সৌদামিনী মাধবীলতার হাতে।

মাধবীলতা সেটাকে ধরে বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করল, এটা কি?

ইয়ার্কি মেরো না। বাঙালির মেয়ে হয়ে চিনতে পারছ না, না? খুব জাগ্রত কালী, সঙ্গে থাকলে কোন অমঙ্গল হবে না। সুধীরের হাত যদিও ভাল তবু সাবধানের মার নেই। অপারেশনের সময় ওটাকে সঙ্গে রাখবে। আমি চলি।

মাধবীলতা যেন সাপ দেখছে। সৌদামিনীর চরিত্র এবং চেহারা যেন হঠাৎ বদলে গেছে তার কাছে। সে জিজ্ঞাসা করল, এসব আপনি বিশ্বাস করেন?

যা বলছি তাই করো। আমি কি করি না করি তাতে তোমার কি দরকার? হ্যাঁ, আপনার নাম কি যেন?

পরমহংস

এরকম নাম কারো হয় নাকি? পরমহংস, মানে–।

বক। চুপচাপ একপায়ে জলার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। হাসল পরমহংস।

উস্। রসবোধ আছে দেখছি। আপনি আসুন আমার সঙ্গে। অফিসে গিয়ে খোঁজখবর নিই। রক্ত লাগবে বলল সুধীর। আসুন।

সৌদামিনী হাঁটা শুরু করতেই পরমহংস মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে হাসল, তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে ওঠো। আমরা আছি, কোন চিন্তা নেই। আর হ্যাঁ, কাল রাত্রে আমি অনিমেষকে টেলিগ্রাম করে দিয়েছি।

ওরা চলে গেলে অর্ক চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। শেষ কথাটা শোনার পর মায়ের মুখের চেহারা হঠাৎ পাল্টে গেল। রক্তশূন্য, সাদা কাগজের মত দেখাচ্ছে এখন। কেমন নিথর হয়ে শুয়ে রয়েছে। দুটো চোখ বন্ধ। এমন কি সে যে পাশে দাঁড়িয়ে আছে সেটাও খেয়ালে নেই। অর্ক টুলটা টেনে নিয়ে বসল। তারপর খুব নিচু গলায় ডাকল, মা!

মাধবীলতা চোখ খুলল না, খোকা, আমি যদি আর ফিরে না যাই তোর খুব কষ্ট হবে, না? কি করি বল তো?

অর্কর সারা শরীরে কাঁপুনি এল। সে কোন কথা বলতে পারল না।

কিছুক্ষণ আবার চুপচাপ। শেষপর্যন্ত মাধবীলতাই বলল, না, আমি মরব না। মেয়েরা এত সহজে মরে না। মরলে তো সব ফুরিয়ে গেল। তুই ভাবিস না থোকা।

এইসময় দুজন নার্সকে নিয়ে একজন হাউস সার্জেন এগিয়ে আসতেই অর্ক উঠে দাঁড়াল। হাউস সার্জেন জিজ্ঞাসা করলেন, কি খবর, কেমন আছেন? আরে, আবার কান্নাকাটি কেন? ব্যথা লাগছে?

মাধবীলতা নীরবে মাথা নাড়ল কিন্তু চোখের জল মোছার চেষ্টা করল না।

অর্ক দেখল একজন নার্স তাকে ইশারা করছে চলে যাওয়ার জন্যে। মায়ের কাছ থেকে উঠে যেতে তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করছিল না। এইসময় মাধবীলতা বলল, খোকা, একটা কাজ করতে পারবি?

বল। অর্ক ঠোঁট টিপল।

একটা টেলিগ্রাম করে দে এখনই, ব্যস্ত হয়ে আসার দরকার নেই, আমি ভাল আছি।

মাধবীলতার গলার স্বরে ডাক্তারও চমকে তাকালেন। অর্কর খুব ইচ্ছে করছিল মাকে জড়িয়ে ধরতে। ওর মনে হচ্ছিল এই শেষবার মাকে সে সুস্থ মানুষের মত দেখতে পাচ্ছে। আজ যদি অপারেশন হয় এবং–। ও আর কিছু ভাবতে পারছিল না। কিন্তু কি আশ্চর্য, ও বেশ সহজেই মায়ের কাছ থেকে একটু একটু করে দূরে সরে এল। লম্বা বারান্দা দিয়ে আচ্ছন্নের মত হাঁটতে লাগল অর্ক। প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে মাধবীলতার সঙ্গে দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে তার।

.

যা করবার সব পরমহংসই করল। সৌদামিনী হুকুম দিয়ে স্কুলে চলে গিয়েছিলেন। বারোটা নাগাদ হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাবে?

স্নান করব। অর্ক জবাব দিল, আমার কিছুই ভাল লাগছে না।

পরমহংস ওর কাঁধে হাত দিল। তারপর খুব সান্ত্বনা দেবার গলায় বলল, মন শক্ত করো। তোমার মা ভাল হয়ে যাবে।

অর্ক কোন কথা বলল না। পরমহংস রাস্তাটা দেখল, সকাল থেকেই তো এখানে বসে আছ, খাওয়া দাওয়া করেছ?

আমার খেতে ভাল লাগছে না।

কি পাগলামি করছ! তুমি আমার ওখানে চল। স্নান করে খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে একসঙ্গে ফিরব। পরমহংস প্রায় হুকুমের গলায় বলল।

অর্ক মাথা নাড়ল, না, এই জামাপ্যান্ট খুব ময়লা হয়ে গিয়েছে। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি বাড়িতে যাচ্ছি।

পরমহংস ওর দিকে তাকাল। সত্যি খুব নোংরা দেখাচ্ছে অর্কর পোশাক। সে জিজ্ঞাসা করল, খাবে কোথায়?

অর্ক হেসে ফেলল, আমি দোকানে খেয়ে নেব। চলি। তারপর ব্রিজের দিকে হাঁটতে লাগল। কয়েক পা গিয়ে অর্কর কথাটা মনে পড়তেই ঘুরে দাঁড়াল। সে দেখল পরমহংস তখনও সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে তার যাওয়া দেখছে। সে চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি সত্যি কাল টেলিগ্রাম করেছিলেন?

টেলিগ্রাম, ও হ্যাঁ। কাল রাত্রে করেছি। মনে হয় আজ সকালেই পেয়ে গেছে। কেন?

মা বলেছেন আর একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে ওঁকে আসতে নিষেধ করতে।

পরমহংস খুব অবাক হয়ে গেল, সে কি! কেন? এইসময় তো অনিমেষের আসা উচিত।

আমি জানি না। কথাটা বলে অর্ক আর অপেক্ষা করল না। হন হন করে ব্রিজের ওপর দিয়ে হাঁটতে লাগল। ওর মনে হচ্ছিল একটা দায়িত্ব মাথার ওপর থেকে নেমে গেল। মায়ের অনুরোধ রাখতে তাকে টেলিগ্রাম করতেই হত।

মা ভাল আছে এই মিথ্যে কথাটা সে লিখতে পারত না। অতএব যে প্রথম টেলিগ্রামটা পাঠিয়েছিল তার ওপর দায়িত্বটা দিয়ে সে হালকা হয়ে গেল।

বেলগাছিয়ার মুখটায় আসতেই অর্কর জিভে একটা তেতো স্বাদ উঠে এল। পিত্তি পড়ে গেলে এমনটা হয় নাকি? ঠিক তখনই তিনটে ছেলে রাস্তার উল্টোদিক থেকে পায়ে পায়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল। তিনজনের চেহারা এবং মুখভঙ্গী দেখে অর্কর বুঝতে বাকি রইল না এরা কোন জাতের। কিন্তু অর্ক বিস্মিত হচ্ছিল এই ভেবে যে তার ওপর এদের রাগ কেন?

তোর নাম কি বে? অক্ক?

অর্ক সতর্ক চোখে দেখল একজনের হাত গেঞ্জির মধ্যে ঢোকানো। সেখানে যে-কোন যন্তর থাকতে পারে। সে বুঝতে পারছিল রাস্তার দুধার থেকে লোকজন সরে যাচ্ছে নিঃশব্দে। এই তিনটেই যে পেশাদারী খুনী তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। কি করা যায় ভেবে পাচ্ছিল না অর্ক। তবে এদের সঙ্গে লড়াই করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। সে নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, কেন অর্ককে কি দরকার?

ছেলেটার মুখ বেঁকে গেল, কিমা বানাবো। শালা কয়লাদার–। এইটুকু বলেই সামনে নিল ছেলেটা। তারপর মুখে বিকট চিৎকার করে ছুটে এল অর্কর দিকে। অর্ক শুধু ওর নড়াচড়ার আরম্ভটুকু দেখতে পেয়েই দৌড় শুরু করেছিল। ওদের তিনজনের ফাঁক দিয়ে যে অর্ক দৌড়াবে এটা বোধহয় মাথায় আসেনি কারণ তিনটে ছেলেই একটু থিতিয়ে গিয়ে ওর পিছু নিল। তিনজনেই উৎকট শব্দ করছে ছোটার সময়। যেন একটা মুরগির পিছু নিয়েছে তিনটে খ্যাঁকশেয়াল এরকম ভঙ্গী তিনজনের। অর্ক ঈশ্বরপুকুরের মুখে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। মৃত্যুভয় মানুষের গতি বাড়িয়ে দেয়। অর্ক মরিয়া হয়ে ছুটছিল বলে ব্যবধান বাড়ছিল। এইসময় ছেলেটা অদ্ভুত কায়দায় শূন্যে হাত ঘোরালো ছুটতে ছুটতে। আর তীব্রগতিতে রোদ চলকে যেটা ভেসে গেল সামনে সেটা বিদ্ধ হল অর্কর বাঁ কনুইয়ের সামান্য ওপরে। সঙ্গে সঙ্গে অর্ক স্থির হয়ে গেল। প্রচণ্ড ব্যথা এবং সেইসঙ্গে বেরিয়ে আসা রক্ত তার চিন্তাশক্তিকে অবশ করে দিলেও সে আবার দৌড় শুরু করল ওই অবস্থায়।

রক্ত বোধহয় মানুষের চেতনাকে খুব জলদি জাগিয়ে দেয়। একটা ছেলেকে তিনজনে মিলে ধাওয়া করে ছুরি মেরেছে এই দৃশ্য চোখের ওপর দেখে কিছু মানুষ চিৎকার করে উঠল। সেই চিৎকার অনুসরণকারীদের পায়ের জোর কমাল। অর্ক তখন ঈশ্বরপুকুরে পৌঁছে গেছে। গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা ছেলে অর্ককে ওই অবস্থায় দেখতে পেয়ে সামনে এসে দাঁড়াতেই ওরা থেমে গেল। একজন চিৎকার করে উঠল, যা শালা, খুব বেঁচে গেলি। কয়লাদার গায়ে হাত? সাবধান করে দিচ্ছি, তিনদিনে ঈশ্বরপুকুর জ্বালিয়ে শ্মশান করে দেব।

কথাটা শেষ হওয়ামাত্রই একটা অন্যরকম প্রতিক্রিয়া হল। বিস্মিত এবং স্থবির জনতা যেন হঠাই জেগে উঠে তেড়ে গেল ছেলে তিনটের দিকে। তিনজন এরকমটা হবে আশা করেনি। ওরা পালাবার চেষ্টা করল। দুজন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে সীমানা ছাড়ালেও একজন শেষপর্যন্ত ধরা পড়ল।

এর মধ্যে ঈশ্বরপুকুরে খবরটা ছড়িয়ে পড়েছে। অর্ককে কয়লার লোক ছুরি মেরেছে শুধু এই খবরটাই তিন নম্বরের মানুষগুলোকে উত্তেজিত করল। ধরাপড়া ছেলেটিকে প্রায় আধমরা করে তিন নম্বরের সামনে ফেলে রাখা হয়েছে। তাকে ঘিরে উৎসুক মানুষের ভিড়। চারধারে উত্তেজিত আলোচনা।

ছুরিটা অর্কর বাঁ হাতের মাংসে বিদ্ধ হয়েছিল। হাড়ে লাগেনি। ঈশ্বরপুকুরের ডাক্তারবাবু সেটাকে বের করে বললেন, হাসপাতালে নিয়ে গেলে ভাল হত। আমি ব্যাণ্ডেজ করে দিচ্ছি আপাতত। কিন্তু হাসপাতালে দেখিয়ে নেওয়া দরকার।

কিন্তু ঈশ্বরপুকুরে উত্তেজনা বেড়ে চলল। কেউ কেউ চাইছে অর্ধমৃত ছেলেটিকে শেষ করে দিতে। সতীশদা আর সুবল জনতাকে সামলে রাখার চেষ্টা করছে। অর্কর খুব দুর্বল লাগছিল। তার হাত খুব ব্যথা করছে, পেটে কেমন যেন অস্বস্তি। কিন্তু তার একটুও রাগ হচ্ছিল না। সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বেরিয়ে এসে কেমন যেন ফাঁকা লাগছিল।

সুবল জিজ্ঞাসা করল, কি করা যায় বলুন তো?

অর্ক বলল, আমরা প্রতিবাদ করব।

কিভাবে?

আমাদের এলাকা থেকে সমস্ত সমাজবিরোধীদের বের করে দিয়ে।

কিন্তু তা কি সম্ভব? এপাড়া থেকে বেরিয়ে পাশের পাড়ায় তারা আশ্রয় নেবে।

পাশের পাড়ার মানুষ যদি তাদের বের করে দেয় তাহলে তারা কোথায় যাবে? সতীশদা, আপনি শুধু বলুন কোনরকম দলবাজি ছাড়া আমরা এই কাজটা করতে পারি কিনা। অর্ক সতীশদাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করল।

সতীশ একমুহূর্ত ভাবল। তারপর মাথা নাড়ল, ঠিক আছে। তবে মনে রাখা দরকার সি পি এম যেমন নয়, কংগ্রেস বা অন্য কোন দলের আন্দোলন নয়, এ এলাকার শান্তিপূর্ণ মানুষের আন্দোলন। এতে আমি অন্যায় কিছু দেখছি না।

সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার উঠল, সমাজবিরোধীর কালো হাত ভেঙ্গে দোও। কয়লা গুণ্ডা নিপাত যাক।

অর্ক বলল, কিন্তু সতীশদা, এভাবে হবে না। আপনারা একটা শান্তিকমিটি তৈরি করুন এলাকার সমস্ত মানুষকে নিয়ে। শান্তিকমিটি যা বলবে আমরা তাই শুনব।

এই সময় খবর এল দুটো পুলিসের ভ্যান ঈশ্বরপুকুরের মুখে এগিয়ে এসেছে।

৫১. কাঁধ টনটন করছে

কাঁধ টনটন করছে, ছুরিটা যদিও বেশী ঢোকেনি কিন্তু রক্ত বেরিয়েছে অনেকটা। ইনজেকশন এবং ওষুধের দৌলতে তাকে আর হাসপাতালে যেতে হবে না ধরে নিয়েছে অর্ক। তখন রক্ত দেখে ডাক্তারবাবু হাসপাতালের কথা বললেও অর্কর মনে হয়েছে ক্ষতটা তেমন মারাত্মক নয়। যদিও ব্যথা আছে, জায়গাটা আড়ষ্ট হয়ে আছে কিন্তু নিজের অসুবিধে তো বোঝা যায়।

আজ ঈশ্বরপুকুর উত্তাল। কয়েকশ মানুষ পুলিসের ভ্যান ঘেরাও করে রেখেছিল। সমাজবিরোধীদের এলাকা থেকে দূর করতেই হবে। পুলিসকে কথা দিতে হবে যাতে তারা সমাজবিরোধীদের মদত না দেয়। ছোট অফিসারদের কথায় কাজ হয়নি, লালবাজার থেকে বড় অফিসাররা এসে সেইরকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাওয়ার পর ওই অর্ধমৃত ছেলেটিকে ওদের হাতে তুলে দেওয়া হল। এর মধ্যে একটা শান্তি কমিটি ঠিক হয়ে গেছে। যারাই সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে তারাই শান্তি কমিটির সদস্য। এলাকার শিক্ষিত বিশিষ্ট ভদ্রজন যাঁরা এতকাল গোলমাল হলেই জানলা বন্ধ করে দিতেন তাঁরাও নেমে এসেছেন পথে। তবে পুলিস চলে যাওয়ার পর একটা বিরাট দল নিয়ে গেল অর্ককে থানায়। ডায়েরি করতে হবে। প্রকাশ্যে হত্যার ষড়যন্ত্র। আজকে থানার চেহারা অন্যরকম। এত মানুষকে দেখে অফিসারদের সেই গা-ছাড়া ঔদাসীন্য নেই। অভিযোগে লেখা হল, সম্প্রতি ঈশ্বরপুকুর এলাকায় সমাজবিরোধীদের কাজকর্ম বেড়ে গিয়েছিল। কয়লা ওই এলাকায় সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল এক শ্রেণীর পুলিসের সাহায্যে। গতরাত্রে কয়লা দলবল নিয়ে ঈশ্বরপুকুরে হামলা করে। তার প্রতিবাদ করায় কয়লার অনুচররা অর্ককে ছুরি মেরেছে। এই আঘাত প্রাণহানি ঘটাতে পারত।

থানার অফিসার একটু ইতস্তত করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল অভিযোগ লিপিবদ্ধ করতে কোন আপত্তি নেই, শুধু পুলিসের কথা উল্লেখ না করলেই হয়। কিন্তু সুবলরা কিছুতেই অন্য কথা বলতে চাওয়ায় ওইভাবেই ডায়েরি করা হল।

অর্কর শরীর ভাল লাগছিল না। কাঁধের ব্যথা এবং ক্লান্তি তার খিদেটাকেও চাপা দিয়েছিল। এবং আশ্চর্য, একটি ছুরির আঘাত তাকে রাতারাতি নায়ক তৈরি করে ফেলেছে যেটা তার পছন্দ হচ্ছে না। সে একটু বিশ্রাম চাইছিল। থানা থেকে বেরিয়ে অর্ক সোজা ঈশ্বরপুকুরে চলে এল।

কিন্তু ব্যাপারটা ওখানেই থেমে থাকল না। ঈশ্বরপুকুরের মানুষের সঙ্গে বেলগাছিয়ার সাধারণ মানুষ মিলিত হয়ে গেল। তারপর সেই ক্ষুব্ধ মিছিল গিয়ে আছড়ে পড়ল পাশের পল্লীতে। কয়লার দোতলা বাড়িটি মুহূর্তেই লুষ্ঠিত হয়ে গেল। এতদিনের আক্রোশ মিটিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়ে জনতা পাগল হয়ে গেল। কয়লার স্ত্রী এবং বাবা মাকে করুণা করে বলা হল অবিলম্বে পাড়া ছেড়ে যেতে। তারপর জনতা খুঁজতে লাগল কয়লার চামচেদের। যারা এতকাল ওয়াগন লুঠ করার সঙ্গী ছিল, যারা তোলা তুলত কয়লার হয়ে, ছুরি এবং বোমার ভয়ে যাদের বিরুদ্ধে কেউ টু শব্দ করার। সাহস করত না এখন তাদের খুঁজে বের করার জন্যে সবাই মরিয়া হয়ে গেল। ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে ঈশ্বরপুকুর এবং তার আশে পাশের এলাকা থেকে সমাজবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত মানুষগুলো হয় পালিয়ে গেল দত্তবাগান কিংবা শ্যামবাজার এলাকায়।

অর্ক এসব জানতো না। ঘন্টা দেড়েক নিঃঝুম পড়ে থেকে মনে হল মাথাটা পরিষ্কার হয়েছে। ঘরটা এখন নোংরা, অগোছালো। অর্ক চারপাশে তাকাল। একটুও ইচ্ছে করছে না উঠে পরিষ্কার করতে। আর তখনই খিদেটা ফিরে এল। এখন দুপুর শেষ হতে চলেছে। ঘরে কোন খাবার আছে বলে মনে পড়ছে না। মুখে একটা বিশ্রী তেতো স্বাদ।

অসহায় চোখে অর্ক তাকাচ্ছিল কিন্তু যেন কিছুই তার চোখে পড়ছিল না। কোথা থেকে কি হয়ে গেল। আজ যদি মায়ের অপারেশন হয় তাহলে তার অনেক কাজ বেড়ে যাবে। কিন্তু ঘাড় যেমন টনটন করছে সে যে কিছু করতে পারবে এমন মনে হয় না। তাছাড়া এই ব্যাণ্ডেজ নিয়ে মায়ের সামনে যাওয়াও যাবে না। যতই শার্টের নিচে চাপা থাক মা ঠিক বুঝতে পারবে। যে রক্ত শরীর থেকে বেরিয়ে গেল সেটা মায়ের জন্যে রাখতে পারল না সে। অর্কর শরীরে কাঁপুনি এল। নিজেকে ছিন্নভিন্ন নিঃস্ব মনে হচ্ছে।

রান্নার বাসন যেখানে চাপা দেওয়া থাকে সেখানে উঠে এল অর্ক। ওগুলো এখনও নোংরা, ধোয়া হয়নি সময়মত। কৌটোগুলো খুলতে খুলতে অর্কর মুখে হাসি ফুটল। নিমকিগুলো একটু কালচে হয়ে গেছে। কবে কখন মা করে রেখেছিল জলখাবারের জন্যে। একটু গন্ধ হয়ে গেছে, ঠাণ্ডা তেলের চিমসে গন্ধ, কিন্তু অর্ক তৃপ্তির সঙ্গে খেতে গিয়ে আবিষ্কার করল এতে খিদেটা বেড়ে যাচ্ছে। ঘরে চাল আছে, স্টোভে তেলও আছে। এক হাতে বালতিটা ঝুলিয়ে বেরিয়ে আসতেই সে অনুপমাকে দেখতে পেল। ওদের ঘরের দরজায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে। ওকে দেখতে পেয়ে অনুপমা জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছ?

অর্ক বলল, ঠিক আছি। বালতি নিয়ে কি করবে?

জল আনবো।

দাও, আমাকে দাও। আমি এনে দিচ্ছি।

কেন? আমিই পারব।

থাক। আর একটু হলেই তো প্রাণ যেত। দেখি বালতিটা। প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেল অনুপমা। অর্ক আকাশের দিকে তাকাল। তামাটে আকাশে দুটো চিল পাক খাচ্ছে। রোদের তেজ নরম হতে চলেছে। কটা বাজল কে জানে। নিমকি খাওয়ার পর মুখটা আরও বিশ্রী লাগছে। যে কাঁধে ছুরি লেগেছিল সেদিকটা সামান্য নাড়াতে চেষ্টা করল। না তেমন লাগছে না। লাগলে ভাল হত। একটা কষ্ট অনেকসময় আর একটা কষ্টকে ঢেকে দেয়। ব্যথাটা বাড়লে খিদেটা থাকতো না।

অনুপমা জল নিয়ে ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করল, কি হবে জল নিয়ে?

কিছু না। এমনি।

খেয়েছ?

অর্ক মাথা নাড়ল এমনভাবে যাতে দুইই বোঝায়। তারপর জলটা নিয়ে ঘরে ঢুকতে অনুপমা ফিরে গেল। স্টোভ জ্বেলে ভাত চাপিয়ে দিল অর্ক। ঘরে আর কিছুই নেই, সামান্য আলুও চোখে পড়ল না। স্টোভের শব্দ একধরনের তৃপ্তি এনে দিল মুহূর্তেই। কিছু একটা হচ্ছে এই ঘরে এই রকম বোধ এল ওই শব্দ থেকে।

আজ স্নান করা যাবে না। অথচ স্নান জরুরী ছিল। বিশ্রী গন্ধ বের হচ্ছে শরীর থেকে। কাঁধের ব্যাণ্ডেজে জল লাগলে ক্ষতি হবে। কিন্তু ওটাকে বাঁচিয়ে যদি কিছু করা যায়। অর্ক জামা কাপড় ছাড়ল। তারপর কোনরকমে কলতলা থেকে পরিষ্কার হয়ে এল। হাতে পায়ে এবং মাথায় সামান্য জল দিলে যে পবিত্র আরাম হয় তা যেন এমন করে কোনদিন টের পায় নি অর্ক।

পরিষ্কার জামাকাপড় পরে সে চেয়ারটায় বসল। এবং তখনই তার মনে হল আবার, পৃথিবীতে সে একা। এখন থেকে যা করবার তা তাকে একা একা করতে হবে। মা যাই বলুক পড়াশুনা করে সে কোনকালে চাকরি পাবে না। অথচ মাকে দেওয়া কথা রাখতে তাকে পরীক্ষা দিতে হবে। কিন্তু এভাবে যদি একটার পর একটা ঘটনায় সে জড়িয়ে পড়ে তাহলে পড়াশুনা করবে কখন। অপারেশনের পর তো মা অনেক দিন অসুস্থ হয়ে থাকবে। তখন তাদের চলবে কি করে। সে এই কদিনে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। আচমকা কেউ যেন তাকে টেনে বড় করে দিয়ে গেল। অতএব এখন থেকে তাকেই দায়িত্ব নিতে হবে যে। কিভাবে দায়িত্ব নেওয়া যায় তা সে জানে না। কিন্তু নিতে হবে এটা তো পরিষ্কার।

ঘরের বাতাস এখন পাল্টে গিয়েছে। চমৎকার ভেতো গন্ধ বের হচ্ছে সসপ্যান থেকে। ঢাকনাটা নড়ছে। ঠিক তখনই একটা চাপা গলায় নিজের নাম শুনতে পেল সে, অক্ক!

গলাটা চিনতে অসুবিধে হল না। সে ‘আয়’ বলতেই দরজা ঠেলে কোয়া যেন ছিটকে ঢুকে পড়ল। তার পেছনে বিলু। ঘরে ঢুকেই ওরা দরজা বন্ধ করে দিল।

অর্ক ওঠার সুযোগ পেল না, তার আগে কোয়া প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর পায়ের ওপর, গুরু আমাকে বাঁচাও। আমি সারা জিন্দেগী তোমার গোলাম হয়ে থাকব। গুরু, আমি কোন দোষ করিনি।

অর্ক পা সরাবার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। সে অস্বস্তিতে চিৎকার করল, কি হচ্ছে, পা ছাড়।

না গুরু, তুমি কথা দাও, ওরা আমাদের পেলে মেরে ফেলবে। ককিয়ে উঠল কোয়া। অর্ক দেখল ওর মুখে মৃত্যুভয় স্পষ্ট। কিন্তু বিলু কোন কথা বলছে না। ঠোঁট কামড়ে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

কারা মারবে?

পাড়ার লোক আমাদের খুঁজছে আবার কয়লার পার্টিও পেলে শেষ করে দেবে।

পাড়ার লোক তোদের খুঁজছে কেন?

আমাদের সমাজবিরোধীদের লিস্টে ঢুকিয়ে দিয়েছে। গুরু, তুমি বাঁচাও।

পা ছাড়।

কোয়া এবার সরে বসল। ওকে খুব ভীতু প্রাণীর মত মনে হচ্ছিল। অর্ক ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কাল থেকে কোথায় ছিলি?

গঙ্গার ধারে। আজকে সেখানে কয়লার ছেলেরা শেল্টার নিয়েছে তাই পালাতে হল। আমি মাইরি কসম খাচ্ছি, আর কখনও মাস্তানি করব না। আমি এই পাড়ায় ভদ্দলোকের মত থাকব। তুমি ওদের বলে দাও নাম কেটে দিতে।

কোয়া আবার ককিয়ে উঠল।

প্রথমে অর্ক ব্যাপারটা বুঝতে পারছিল না। কয়লাকে ভয় পাওয়ার কারণ থাকতে পারে কিন্তু পাড়ার লোকদের কোয়া এত ভয় পাচ্ছে কেন? পাড়ার লোকদের অভিযোগ কোয়ার বিরুদ্ধে। তাকে ছুরি মারার জন্যে কয়লার ছেলেরা দায়ী। কেয়া তো কখনই কয়লার চেলা হিসেবে পরিচিত নয়। কিন্তু কোয়া যা বলল তাতে চমৎকৃত হল অর্ক। প্রথমে আক্রোশটা ছিল কয়লা এবং তার ছেলেদের ওপর। তাদের সবাইকে পাড়া ছাড়া করার পর ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাড়ায় যারা মাস্তানি করত তাদেরও তাড়ানো হবে। যদি যেতে না চায় তাহলে গণধোলাই-এর ব্যবস্থা। সেই লিস্টে কোয়ার নাম আছে।

অর্ক চুপচাপ শুনল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, কাল রাত্রে একজন পুলিস অফিসার তাকে খুঁজছিল কেন?

আমাকে খুঁজছিল? কে? দত্ত সাহেব?

নাম জানি না। মোক্ষবুড়িকে মারার পর তোর নাম উঠল কেন?

আমি জানি না গুরু। তুমি বিশ্বাস করো, একজন দত্তসাহেব আমার কাছে হিস্যা চেয়েছিল। সে শালার আমার ওপর খাব আছে। কিন্তু আমি কোন বড় গোলমাল করিনি। তুমি তো আমাকে জানো, আমি তো খুরকি কিলার মত কাউকে জবাই করিনি। বল, করেছি?

অর্ক কি করবে বুঝতে পারছিল না। সে অন্যমনস্ক গলায় বলল, কিন্তু আমার কথা ওরা শুনতে চাইবে কেন?

কোয়া যেন আঁতকে উঠল, কি যে বল গুরু! তোমার কথা শুনবে না? তুমিই তো সব। তোমাকে ওরা সেক্রেটারি করেছে।

সেক্রেটারি? কিসের?

শান্তিকমিটির। মাইরি গুরু, কি করে সবাই এক কাট্টা হয়ে গেল কে জানে!

শান্তি কমিটি? অর্ক হোঁচট খেল। এর মধ্যে কখন শান্তি কমিটি গঠিত হল আর তাকে সম্পাদক করা হল তা সে নিজেই জানে না। নিশ্চয়ই সুবল নেতৃত্ব নিচ্ছে। সতীশদা কখনই সামনে আসবে না এরকম কথা একবার হয়েছিল। সতীশদা নেতৃত্বে থাকলেই আন্দোলনে রাজনীতির ছায়া পড়বে। এলাকার মানুষ কোন পাটি! ফেস্টুন ছাড়াই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এইটে সচরাচর হয় না। আজ অবধি কোন কারণে এরকম হয়েছে কি না অর্ক জানে না। জ্ঞান হবার পর থেকে তো কখনই দ্যাখেনি কংগ্রেস এবং সি পি এমের সমর্থকরা একসঙ্গে কাজ করছে। সেটা যখন হয়েছে তখন এলাকার পক্ষে মঙ্গলজনক বলতেই হবে। কিন্তু রাজনীতি নেই বলে সতীশদাদের বাদ দিয়েও হতে পারে না।

এই সময় সসপ্যানের ঢাকনাটা খানিকটা সরে গেল আর সোঁ করে বাষ্প ছিটকে উঠল। অর্ক এগিয়ে গিয়ে সেটাকে স্টোভ থেকে নামিয়ে দেখল জল প্রায় মরে এসেছে। এখন ফ্যান গালা প্রায় অসম্ভব। ওর মনে হল, এতে ভালই হয়েছে। শুধু ভাত খাওয়ার চেয়ে এই গলা ভাত তবু সহজে পেটে পাঠানো যেতে পারে। ঢাকনাটা নামিয়ে স্টোভ নিবিয়ে অর্ক মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তোরা খেয়েছিস?

কোয়া মাথা নাড়ল, না গুরু, তুমি খাও।

খেয়েছিস কিনা বল। ভাত বেশী আছে।

তাহলে একটু দাও। কাল রাত থেকে কিছু খাইনি।

কিন্তু শুধু ভাত, তরকারি টরকারি নেই।

কোয়া হাসল, গরম ভাত পাচ্ছি তাই বাপের ভাগ্যি আবার তরকারি।

অর্ক থালার দিকে হাত বাড়াতেই বিলু বলল, আমি খাব না।

ঘরে ঢোকার পর বিলু এই প্রথম কথা বলল। অর্কও এতক্ষণ ইচ্ছে করেই বিলুর দিকে তাকাচ্ছিল না। সেই থেকে দরজায় হেলান দিয়ে রয়েছে।

অর্ক স্বাভাবিক গলায় বলতে চাইল, কেন?

আমার খিদে নেই।

মিথ্যে কথা গুরু, ও সকাল থেকে আমার সঙ্গে ঘুরছে। কোয়া বলে উঠল।

অর্ক দেখল সসপ্যান থেকে বেশ ধোঁয়া উঠছে। এই অবস্থায় খাওয়া সম্ভব নয়। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তোর সঙ্গে কয়লার কি সম্পর্ক?

বিলুর চোখ ছোট হল, সম্পর্ক আছে তা কে বলল?

কয়লার ছেলেরা, কয়লা বলে গেছে।

এমন কিছু না, চিনতাম।

কোনদিন আমাকে বলিসনি তো।

বলার প্রয়োজন মনে করিনি।

আজ আমার কাছে এসেছিস কেন?

আমি আসতে চাইনি, কোয়া জোর করে নিয়ে এসেছে।

অর্ক ঠোঁট কামড়ালো, তুই পাড়ায় ফিরতে চাস না?

চাইলেই পাড়ার লোক আমাকে ফিরতে দেবে?

কেন দেবে না?

আমার সঙ্গে কয়লার সম্পর্ক ছিল।

বিলু এত স্পষ্ট এবং সরাসরি কথা বলছে যে অর্ক অবাক হচ্ছিল। এই সময় যে কেউ কয়লার সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করবে কিন্তু বিলু সেটা করছে না। গতকাল বিকেলে শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ে বিলুর হাবভাব এবং পালিয়ে যাওয়াটা এখন চোখের ওপর ভাসছে। বিলু কিছু অন্যায় করছিল সেটা তো তখনই মনে পড়েছিল।

অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু তুই তো কয়লার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিস।

ওটাকে বিশ্বাসঘাতকতা বলে না। আমি মন থেকে সায় দিতে পারিনি।

কি সেটা?

আমি বলতে পারব না। শোন, আমি কয়লার টানা মাল যারা কিনতে তাদের কাছে যেতাম ঠিক কত টাকা দিয়েছে সেটা জানবার জন্যে। তাতে যে বিক্রি করছে সে কয়লাকে ঢপ দিতে পারত না। এ ছাড়া কয়লার কিছু জিনিস আমি পাচার করেছি অন্য জায়গায়। বিলু একই রকম ভঙ্গীতে বলল।

অর্কর মনে পড়ল কাল রাত্রে বিলু সম্পর্কে ওদের অভিব্যক্তির কথা। সে বলল, কয়লা তোকে পেলে ছিঁড়ে খাবে।

আমি ভয় পাই না। জীবনে তো একবারই মরব।

কিন্তু তুই এইসব জঘন্য কাজ করেছিস তোর লজ্জা করে না?

লজ্জা? দ্যাখো গুরু, ওসব লজ্জা ফজ্জার কথা আমার কাছে বলল না। আমার বাড়িতে পাঁচটা খাওয়ার লোক। বাবা অসুস্থ, একটাও রোজগারের মানুষ নেই। সবাই আমার মুখ চেয়ে বসে আছে। আমার যা বিদ্যে কোন শালা আমাকে চাকরি দিতে পারে না। আমাকে ওদের বাঁচাতেই হবে। যে কোন নম্বরী কাজ করতে আমি তাই রাজি ছিলাম।

তাহলে বিশ্বাসঘাতকতা করলি কেন?

না আমি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। একটা মেয়েকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম শুধু।

মেয়েকে বাঁচাতে চেয়েছিলি? কাকে?

বলতে পারব না।

বাঁচাবার কি দরকার ছিল?

হয়তো ছিল না। আমি বাঁচালেও অন্য কেউ মারবে। তবু পারলাম না। তাই কয়লার খুব খার আমার ওপর। পালিয়ে গঙ্গার ধারে গিয়েছিলাম। ওখানে কোয়ার সঙ্গে দেখা হল। কোয়া বলল তোমার কাছে আসতে। আমি আসতে চাইনি, কিন্তু ও জোর করল। বলল এখানে এলে একটা ফয়সালা হবে।

অর্ক বুঝতে পারছিল না কি ফয়সালা সে করতে পারে। বিলুকে সমাজবিরোধী হিসেবে এলাকায় কেউ জানে না। বিলু কোয়া কিনা খুরকির মত পাড়ায় কখনও মাস্তানি করেনি। তাছাড়া কয়লা কাল রাত্রে বিলুর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে গিয়েছে। সেইটেই অবশ্য কাল হতে পারে। হয়তো এর মধ্যে কেউ কয়লার সঙ্গে বিলুর সম্পর্ক আবিষ্কার করে ফেলেছে। কিন্তু তা ছাড়া সে নিজে কি করে বিলুকে বাঁচাবে। কয়লাকে যে সাহায্য করেছে সে তো পরিষ্কার সমাজবিরোধী। না বিলুকে সাহায্য করার প্রশ্নই ওঠে না। অর্ক মুখে এসব কিছুই বলল না। তিনটে থালায় থকথকে ভাত ঢেলে বলল, খেয়ে নে। এখানে নুন আছে।

কোয়া যেন কথাটার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। চট করে নিজেরটা তুলে বিলুর দিকে তৃতীয়টা এগিয়ে দিল। বিলু কিছুটা ইতস্তত করে থালাটা নিল। ভাত খুবই কম। তিনজনের পক্ষে অতিরিক্ত কম। কিন্তু খেতে গিয়ে অর্ক বুঝল নিমকি তার উপকার করেছে। এতক্ষণে খিদে বোধটুকুই মেরে ফেলেছে। অথচ গরম ভাতের যে মায়াময় গন্ধ সেটা চমৎকার লাগলো। এমন করে শুধু নুন দিয়ে চটচটে ভাত সে আগে কখনও খায়নি।

কোয়া বলল, একটা ভাজা থাকলে দারুণ জমত।

নিমকি আছে, খাবি?

নিমকি? তাই দাও।

অর্ক অবশিষ্ট নিমকিটা বের করে দিতেই কোয়া সেটাকে বেগুন ভাজার মত ভাতের সঙ্গে চটকে খেয়ে নিল। অর্ক দুজনের দিকে তাকাল। বিলুরও যে প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। এই বিলুকে কোয়া পছন্দ করত না। কোয়াকেও বিলু ঈর্ষা করত। অথচ দুজনে এখন পাশাপাশি ভাত খাচ্ছে, একই বিপদে পড়ে পালিয়ে এসেছে একসঙ্গে। এটা আগে ভাবা যেত না।

খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলে অর্ক বিলুকে বলল, আমি তোকে কোন সাহায্য করতে পারব না বিলু। তোর সঙ্গে কয়লার সম্পর্ক ছিল, তুই থানায় যা।

থানায়? বিলু হাসল, এখনও পুলিস আমার সম্পর্কে জানে না। যেচে গলা বাড়িয়ে দেওয়ার পার্টি আমি নই।

তাহলে তোর যা ইচ্ছে তুই কর।

বিলু পকেটে হাত দিল। তারপর পাঁচটা একশ টাকার নোট বের করে অর্কর সামনে ধরল, এগুলো আমার মাকে দিয়ে দিতে পারবে?

তুই নিজেই দে না।

আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।

এখানে এলি কি করে তোরা?

পেছনের বস্তি দিয়ে। টাকাগুলো হাতে নিয়ে বিলু একটু ভাবল। তারপর দরজার দিকে এগোতে অর্ক তাকে ডাকল, বিলু।

বিলু মুখ ফেরাতেই অর্ক ইতস্তত করে বলল, আমি যদি পাড়ার লোকদের বলে রাজি করাই তাহলে তুই ওসব দু নম্বরী কাজ ছেড়ে দিবি?

বিলু হাসল, বলতে পারছি না। সত্যি কথা বলছি গুরু, আমাকে বাঁচতে হবে। আজ যারা তোমাদের সঙ্গে মাথা বাঁচাবার জন্যে আছে তাদের অনেকেই কাল আবার লাইনে ফিরে যাবে। মিথ্যে কথা বলে কি লাভ?

ঠিক আছে। কিন্তু সবাই যে একটা ভাল কাজের জন্যে একসঙ্গে হয়েছে এটা কম কথা নয়। তুই কয়লার সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখবি না, এলাকার মানুষের ক্ষতি হোক এমন কাজ করবি না, এই কথা দিতে হবে।

আমি এখনও কোন মানুষের ক্ষতি করিনি। আর কয়লা তো পেলে আমাকে ছিঁড়ে খাবে, সম্পর্ক রাখার কোন কথাই ওঠে না। বিলু মাথা নাড়ল।

এইসময় বাইরে অনেক লোকের গলা পাওয়া গেল। অর্ক দেখল কোয়ার মুখ শুকিয়ে গেছে, বিলুও খুব ভয় পেয়েছে। কেউ একজন ডাকল, অর্ক।

অর্ক চাপা গলায় বলল, তোরা খাটে উঠে বস। তারপর বিলুর পাশ দিয়ে এগিয়ে দরজা খুলতেই দেখল সুবল এবং আরও কয়েকজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে। সুবল জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছ?

অর্ক বলল, ভালই, মনে হচ্ছে আর কিছু হবে না।

তবু একবার হাসপাতালে গিয়ে দেখানো উচিত ছিল।

আমি তো বিকেলে হাসপাতালে যাবই, তখন নাহয় দেখাবো।

হ্যাঁ, শুনলাম তোমার মা অসুস্থ। অপারেশন হবে?

হ্যাঁ।

তুমি আজ সন্ধ্যেবেলায় আসতে পারবে?

কেন?

আমরা একটা শান্তি কমিটি তৈরি করেছি। তোমাকে এবং আমাকে যুগ্ম সম্পাদক করা হয়েছে।

তুমি অল্পবয়সীদের দেখবে আমি বয়স্কদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখব। এলাকার সমস্ত মানুষ আজ এগিয়ে এসেছে। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস পুলিসের একটা অংশ এখনও সমাজবিরোধীদের সাহায্য করছে। আমরা সমাজবিরোধীদের একটা লিস্ট করছি। ঠিক কি কি করতে চাই সে ব্যাপারে আজ আলোচনা হবে। সুবল জানালো।

অর্ক বলল, ঠিক আছে, যদি হাসপাতালে আমি না আটকে যাই তবে চলে আসব।

ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বলল, কিন্তু একা একা পাড়ার বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না। ওরা বদলা নিতে পারে।

অর্ক হাসল, কিন্তু আমাকে তো যেতেই হবে।

সুবল বলল, তা হলে আমরা কয়েকজন তোমার সঙ্গে যাব।

অর্ক মাথা নাড়ল, সেটা একবার হতে পারে কিন্তু রোজ তো সম্ভব নয়। তাছাড়া ওরা বদলা নিতে পারে এই ভয়ে পাড়ায় সবাই কদিন বসে থাকতে পারবে? এতে তো ওদেরও জোর বেড়ে যাবে। ওরা ভয় পেয়েছে কিন্তু আমরা ভয় পাব কেন?

আরও কিছুক্ষণ কথার পর সুবলরা যখন ফিরে যাচ্ছে তখন অর্ক বলল, আর একটা কথা। একসময় যারা পাড়ায় মাস্তানি করেছে কিংবা কোন অন্যায় কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল তাদের সম্পর্কে কঠোর হওয়ার আগে চিন্তা করা দরকার তারা কতটা খারাপ, আর ভাল হতে পারে কিনা?

মানে? সুবল অবাক হল।

কেউ কেউ তো পাল্টেও যেতে পারে।

সে দায়িত্ব কে নেবে?

আমি যাদের নাম বলব তাদের দায়িত্ব আমার।

সুবল একটু ভাবল, ঠিক আছে, সন্ধ্যেবেলায় এসো, লিস্ট ফাইন্যাল করার সময় আমরা আলোচনা করব। তবে কোন ঝুঁকি নেওয়া উচিত হবে না।

ওরা চলে যাওয়ার পর ঘরে ঢুকতেই দেখল কোয়া একটা ছুরি টেবিলের ওপর রেখে দিল। বিলু জিজ্ঞাসা করল, মাসীমার কি হয়েছে?

আলসার। তোরা এখানে থাকতে পারিস ইচ্ছে করলে। আমাকে এখনই হাসপাতালে যেতে হবে। বলা যায় না আজ বিকেলেই হয়তো অপারেশন হবে!

বিলু বলল, চলো আমরাও যাচ্ছি তোমার সঙ্গে।

তোরা যাবি মানে?

এখানে পাথরের মত বসে না থেকে ওখানে গেলে কোন কাজে লাগতে পারি। শালা, আমরা অবশ্য কোন কাজেই আসব না। মা ঠিকই বলতো, দুনিয়ার আবর্জনা। কিন্তু শরীরে এখনও রক্ত আছে। সেইটে তো দিতে পারি। শুনেছি অপারেশনে রক্ত লাগে। কিন্তু, মাসীমার শরীরে আমাদের রক্ত গেলে কাজ হবে? বিলু অর্কর মুখের দিকে তাকাল।

৫২. জরুরী মিটিং ছিল রাত্রে

জরুরী মিটিং ছিল রাত্রে।

জলপাইগুড়িতে হঠাৎ শীত জাঁকিয়ে পড়েছে। রোদ না ওঠার আগে বিছানা ছাড়ার কোন কথাই ওঠে না। এত বছর আবহাওয়ার সঙ্গে পরিচয় না থাকায় অনিমেষ আরও অলস হয়ে পড়েছিল। মাধবীলতারা যখন গেল তখন বাতাসে সবে ঠাণ্ডার আমেজ আর এই কয়দিনেই সেটা দাঁত নখ বের করে কামড়াতে আঁচড়াতে শুরু করেছে। অবশ্য এই বাড়িতে তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই। সময় যেন আটকে আছে। কারো বাইরে কোন কাজ নেই, খাও এবং ঘুমোও। সকাল দশটার আগে এই বাড়ির উনুনে আগুন জ্বলে না। হেমলতা অবশ্য একটু তাড়াতাড়ি ওঠেন। কিন্তু খাট থেকে নামেন না। সেখানে বসেই ঘণ্টাখানেক চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গুরুনাম করেন। আর তারপরেই তাঁর কথা বন্ধ হয়ে যায়। শরীরে চার পাঁচটা কাপড় চাপিয়ে বাগানে ঘুরে ঘুরে ফুল ভোলা হয়ে গেলে সেই যে ঠাকুর ঘরে ঢোকেন বেলা এগারটার আগে তাঁর সময় হয় না বের হবার।

ছোটমা ওঠেন দেরিতে। কিন্তু অনিমেষ মুখ ধুয়ে বারান্দার রোদে বসতে না বসতেই চা পেয়ে যায়। গরম চা আর এরারুট বিস্কুট। খানিক তফাতে আর একটা চেয়ারে বসে ছোটমা কথাবার্তা বলেন যেটুকু প্রয়োজন। বাড়ির মামলার ব্যাপারে উঁকিলের সঙ্গে দেখা করতে হবে কিনা, সেদিন বাজারে যাওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা, কথাবার্তা এই চৌহদ্দিতে ঘোরাফেরা করে। কদিন হল অনিমেষ লোক লাগিয়ে বাড়ির ভেতরের জমি অনেকটা কুপিয়েছে। এতদিন আগাছা আর বড় ঘাসে জায়গাটার চেহারা ছিল বুনো, এখন কালো মাটি বেরিয়ে পড়ায় চোখে অন্যরকম দেখাচ্ছে। ছোটমা ওই কোপানো মাটিটা নিয়ে বেশ মেতে রয়েছেন। এর মধ্যে লোক দিয়ে কপির চারা পুঁতে দেওয়া হয়েছে ছড়িয়ে। নিয়ম করে দুবেলা জল দেওয়া চলছে। অনিমেষ লক্ষ্য করেছে কচি চারাগুলোর দিকে তাকিয়ে ছোটমার মুখে বেশ বাৎসল্যভাব ফুটে ওঠে।

আজ সকালে কপি নিয়ে কথা বলতে বলতে হঠাৎ ছোটমা জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু মনে করো না, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব বলে কদিন থেকে ভাবছি।

বল। অনিমেষ ঠাওর করতে পারছিল না।

তোমার বউ গিয়ে অবধি পৌঁছ-সংবাদও দিল না কেন?

অনিমেষ অস্বস্তিতে পড়ল, দিয়েছে হয়তো, যা ডাকের গোলমাল।

তাই বলে চিঠি আসবে না এ কেমন কথা। বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল।

এসে যাবে।

ছোটমা আর কথা তোলেননি। কিন্তু কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে ছিল অনিমেষ। যত দিন যাচ্ছে একটা জেদ তার মধ্যে তিল তিল করে মাথা তুলছে। জেল ছেড়ে বের হবার পর কতগুলো বছরে সে কিভাবে বেঁচে ছিল? একটা কেন্নোর মত, মেরুদণ্ডহীন। যা কিছু গৌরব তা ছিনিয়ে নেবার জন্যে মাধবীলতা দিন রাত পরিশ্রম করে গিয়েছে। হয়তো অর্কর চোখে তার মা অনেক বিরাট, অনেক মহান। তাকে একটা খাঁচার মধ্যে আটকে রেখে মাধবীলতা হয়তো সুখী ছিল, আত্মপ্রসাদ লাভ করত কিন্তু সে দিন দিন ক্লীব থেকে ক্লীবতর হয়ে যাচ্ছিল। আজ যদি তার সঙ্গে সম্পর্ক না রাখতে চায় মাধবীলতা সে কেন হেদিয়ে মরবে। বরং এখানে এসে সে মানসিক দিক দিয়ে অনেক সুস্থ আছে। এখন মনে হয় অনেক কাজ করা যাবে। ঈশ্বরপুকুর লেনে থাকতে কাজ করতে চাওয়ার ইচ্ছেটাই লোপ পেয়ে গিয়েছিল।

অনিমেষ অবশ্য এখন অনেক সক্রিয়। সে ক্রাচ বগলে নিয়ে বাজারে যায়, উঁকিলের সঙ্গে দেখা করে, দরকার মত হেঁটে আসে চারপাশে। আর আছে জুলিয়েন! অনিমেষ এখনও নিজে সরাসরি জুলিয়েনের সঙ্গে কাজে নামেনি। কিন্তু আলোচনার সময় সে খবর পায়। ঠিকঠাক হাজির হয়, পরিকল্পনায় মতামত দেয়। দলের ছেলেরা যে তাকে গুরুত্ব দিচ্ছে এটা সে বুঝতে পারে, এবং বুঝে তার ভাল লাগে। নিজেকে আর খেলো বলে মনে হয় না। কিন্তু এসব সত্ত্বেও অনিমেষ একটি ব্যাপারে খুব অসহায় বোধ করে। মাধবীলতার ওপর নির্ভরতা তাকে টাকা পয়সার ব্যাপারে ভাবনা-চিন্তা থেকে বিরত রেখেছিল। এখন যত দিন যাচ্ছে সেটা প্রবল হচ্ছে। দুবেলা ডাল-ভাত খেয়ে শুয়ে থাকলে মহীতোষের রেখে যাওয়া টাকার সুদে হয়তো কোনরকমে চলে যায় কিন্তু এই বাড়ির কাছে নিজেকে মূল্যহীন বলে মনে হয়। কথাটা একদিন সে জুলিয়েনকে বলেছিল, কি করা যায় বলুন তো! এভাবে বসে বসে খেতে ইচ্ছে করছে না।

জুলিয়েন হেসেছিল, তাহলে মাঠে নেমে পড়ুন। জীবনের আদ্দেকের বেশি তো খরচ হয়ে গেল, আমার তো আরো বেশি। কিছুই করা হল না। বাকি সময়টায় কিছু করতে হলে বাড়ি ছেড়ে চলে আসুন। গ্রামে কাজ শুরু করে দিন কিংবা চা বাগানে চলে আসুন।

এই একটা ব্যাপারে সামান্য দ্বিধায় ছিল অনিমেষ। যে কারণে সে মাধবীলতার সঙ্গে কলকাতায়। ফিরে যায়নি সেই কারণে চটজলদি এই বাড়ি ছেড়ে যায় কি করে? দুজন প্রায় অশক্ত মানুষ তার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে কিছুই করছে না তবু নাকি এরা স্বস্তিতে আছে। এখন দিন রাতে হেমলতা হুটহাট করে বাড়ির ভেতরে মানুষ ঢুকতে দেখেন না। জলপাইগুড়ির সমস্ত চোর-ছ্যাঁচোড় বুঝি জেনে গেছে এই বাড়িতে অনিমেষ আছে। এক কথায়, এই বিশ্বাস এবং নির্ভরতাকে উড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে যেতে তার বিবেকে লাগছে। অবশ্য কাছাকাছি গ্রাম কিংবা চা বাগানে জুলিয়েনের কথামতন গেলে সে জলপাইগুড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারে। চাই কি সপ্তাহে একদিন এখানে এসে থাকতে পারে যা কলকাতায় গেলে সম্ভব ছিল না! অনিমেষ সেই কথাটা ছোটমায়ের কাছে তুলল, অনেকদিন তো হয়ে গেল এবার একটু নড়ে চড়ে বসি কি বল?

ছোটমা কথাটা বুঝতে না পেরে চোখ ছোট করে তাকালেন। অনিমেষ বুঝিয়ে বলল, চুপচাপ বসে আছি এতে তো আরও অকর্মণ্য হয়ে যাব।

ছোটমা জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি কোন কাজের খোঁজ পেয়েছ?

ঠিক চাকরি বাকরি নয় তবে ওইরকম আর কি!

কোথায়?

এখনও ফাইন্যাল হয়নি। একজন আমাকে বলেছে গ্রামে কাজ করতে যেতে। আমিও ভাবছি এভাবে বাড়িতে বসে খাওয়ার কোন মানে হয় না। এই বাজারে একটা মানুষ চুপচাপ বসে থাকবে সেটাও ভাল দেখায় না।

তোমার কি খুব অসুবিধে হচ্ছে?

ঠিক তা নয়। আমি তোমাকে বোঝাতে পারছি না বোধহয়।

বুঝেছি।

অনিমেষ দেখল ছোটমা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তার চোখ গেটের দিকে। সেখানে একটা ল্যাজঝোলা পাখি চুপচাপ বসে রয়েছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অনিমেষ বলল, আমি প্রত্যেক সপ্তাহে একদিন বাড়িতে আসব।

ছোটমা মুখ না ফিরিয়েই বললেন, যা ভাল বোঝ তাই করো। কিন্তু তোমার শরীর এত ধকল সইতে পারবে তো?

এখন তো আমি অনেক ভাল আছি। সিঁড়ি ভাঙ্গতে সামান্য অসুবিধে হয় আর উঁচু জায়গায় উঠতে পারি না। কিন্তু অনেকটা হাঁটতে পারি।

ভাল।

অনিমেষ বুঝতে পারছিল ছোটমা তার প্রস্তাবটাকে ঠিক মেনে নিতে পারছেন না আবার এমন ভান করছেন যে তাঁর কোন আপত্তি নেই! সে সামান্য হেসে বলল, তোমার কোন অসুবিধে হবে না।

ছোটমাও এবার হেসে ফেললেন। তারপর চলে যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়ালেন, দ্যাখো, আমি তোমাদের মত শিক্ষিত নই। কিন্তু একটা জিনিস বুঝেছি। জীবনের একটা সময় আসে যখন আর কিছুই চাইতে নেই। তখন সবই দিয়ে যাওয়ার সময়। আর, আর কেউ না জানুক আমার জীবনে এমন সময় কখনও আসেনি যখন আমি জোর গলায় চাইতে পেরেছি। এখন তো আর সে প্রশ্ন ওঠে না।

ছোটমা চলে যাওয়ার পর অনিমেষ অনেকক্ষণ চুপচাপ বসেছিল। কথাটা সত্যি ভীষণ সত্যি।

আর এই সত্যি কথাগুলো মেয়েরা সহজে বোঝে এবং বোঝায়। এটা সে বারে বারে দেখেছে। আর। সেইসময় নিজেদের মধ্যে অনেক পার্থক্য সত্ত্বেও মেয়েরা এক হয়ে যায়। তার মনে হল, মাধবীলতা এখানে থাকলে ওই একই কথা বলত। ছেলেদের বোধহয় মনের বয়স বাড়ে না। সেই একই ভাবপ্রবণতার শিকার হয়ে তারা সারা জীবন বেঁচে থাকে। আর মেয়েরা যখন ছাড়ে তখন আমূল বদলে যায়।

দুদিন আগে মন্টু এসেছিল। চল্লিশ পেরিয়ে গেছে অথচ ও সেই একই রকম থেকে গেছে। হৈ চৈ চিৎকার। স্কুল সামান্য ব্যাপার নিয়ে রসিকতা এবং শরীর নাচিয়ে হাসা, স্কুলের সেই মনটাকে ও এখনও লালন করছে। এই বারান্দায় বসে ও যতক্ষণ গল্প করেছে তার অনেকটাই মেয়েদের নিয়ে। বাল্যকাল থেকে মন্টু যাদের সঙ্গে প্রেম করেছে তারা এখন কে কোথায় আছে তারই বিশদ বিবরণ দিয়ে অদ্ভুত সুখ পাচ্ছিল। সেইসব মেয়েরা তাদের যৌবন এবং সৌন্দর্য হারিয়ে এখন কি করুণ হয়ে গেছে তার বর্ণনা দিয়ে যেন তৃপ্তি পাচ্ছিল মন্টু। তারপর হঠাৎই জিজ্ঞাসা করল, তোর ছেলেটা কিন্তু বুদ্ধিমান। প্রেম-ট্রেম করে? ও বুদ্ধিমান। প্রেম-ট্রেম করে?

অনিমেষ হেসে ফেলেছিল, কি জানি।

নিশ্চয়ই করে। ওই বয়সে আমরা তিস্তার চরে মেয়েদের স্নান করা দেখতে যেতাম, তোর মনে নেই। তুই তো শালা উর্বশীর প্রেমে খাবি খাচ্ছিলি।

কি আজেবাজে বকছিস!

অবিরাম করকে তোর মনে নেই।

অবিরাম নয় বিরাম, বিরাম কর।

ওই একই হল। কলকাতায় ওদের সঙ্গে তোর দেখা হয় না?

অনিমেষ ঘাড় নেড়েছিল, দেখছিস তো হাঁটা চলা করতে অসুবিধে হয়।

মন্টু বলল, এখানে একবার নাকি এসেছিল। ছোট চুল, খুব সিগারেট খায়। তোর বউটা মাইরি খুব গম্ভীর। কি করে প্রেম করলি?

হঠাৎ অনিমেষের মনে হল মন্টু চলে গেলে ভাল হয়। ঠিক এইরকম তরল কথাবার্তা তার সহ্য হচ্ছে না। চল্লিশ পেরিয়ে গেলেও মানুষের বয়স বাড়বে না? যা কিছু ভাবনা-চিন্তা আদি রসে আবদ্ধ থাকবে? কথা ঘোরাবার জন্যে সে জিজ্ঞাসা করল, তুই রোজ শিলিগুড়ি যাস?

হাঁ। না গেলে পয়সা আসবে কোত্থেকে! ঘুষের পয়সায় বাড়িটার চেহারা পাল্টে দিয়েছি। একদিন গিয়ে দেখে আসিস।

ঘুষের পয়সায় নিজের চেহারাটা পাল্টাতে পারিস না?

মানে? মন্টু প্রথম অবাক হয়েছিল।

এই যেমন, তুই নিজের চেহারা মেরামত করে বাইশ বছরে নিয়ে গেলি, পারিস না?

মন্টু হাসল, তা তো হয়ই। ষাট বছর বয়সে লোকে ভিয়েনায় গিয়ে চামড়া পাল্টে আসে, জানিস? আরে এসব করতে হলেও দু নম্বরী মাল চাই।

অতএব মন্টু ভাল আছে। ওর সঙ্গে যারা পড়াশুনা করত তারাও যে যার মত আছে। শুধু অনিমেষ বেকার, অকর্মণ্য। মন্টু যেন ওর ব্যাপারে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। বলে গেল একটা কিছু ব্যবস্থা সে করার চেষ্টা করবে! অনিমেষের মনে হয় মন্টু আর আসবে না। যদি ও নেহাতই গবেট না হয় তাহলে বুঝতে পেরেছে যে অনিমেষ এখন আর তাকে পছন্দ করছে না। মন্টুর একটা কথা মনে পড়ছে অনিমেষের, দ্যাখ, আমরা হলাম পাবলিক। আমরা রাজনীতির কিছুই বুঝি না। আমাদের অফিসে যে ইউনিয়ন জেতে আমি তাদেরই সাপোর্টার। গতবার কংগ্রেসী ছিলাম এবার সি পি এম। শালা, এ না করলে বাঁচা যাবে না।

কথাটা বোধহয় ভারতবর্ষের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে খুব লাগসই।

বিকেলে বেশ মেঘ করে এল। ঠাণ্ডাটাও জমেছে খুব। জলপাইগুড়িতে ইলেকট্রিক আলো প্রদীপের চেয়েও কমজোরী। তাও দুপুর থেকে নেই। সমস্ত বাড়িটার ওপরে একটা মরা ছায়া চেপে বসেছে অনেকক্ষণ। হেমলতা বিকেল তিনটেয় খেয়ে শুয়ে পড়েছেন। আজকাল তাঁর রাত অনেক বড়। অনিমেষ গেটের সামনে দাঁড়িয়েছিল। এইসময় পিয়ন এই পথে যায়। মাধবীলতা শেষপর্যন্ত চিঠি দিল না। কিন্তু তার মনে হত শেষপর্যন্ত একটা চিঠি না দিয়ে ও পারবে না। অর্ক যা জেনে গেছে তা ওর পক্ষে হয়তো খুবই কষ্টকর কিন্তু ছেলেটা তো পাল্টে যাচ্ছিল। অনেক কিছু সহজ চোখে দেখবার মত মন তৈরি হচ্ছিল। আকস্মিকতার আঘাত কমে গেলে ও কি নতুন করে ভাববে না? তাহলে ওর কাছ থেকেও একটা চিঠি পাবে অনিমেষ। এইসময়ে পিয়নের বদলে পরিতোষকে দেখতে পেল অনিমেষ। আরও বৃদ্ধ হয়েছেন পরিতোষ, লাঠিতে ভর রেখে কোনরকমে এগিয়ে আসছেন। অনিমেষকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছ? অনিমেষ মাথা নেড়ে ভাল বলল। লোকটাকে বেশ কিছুদিন বাদে দেখছে সে। ওধারে আদালতে মামলা দায়ের করেছে এধারে মুখে হাসি ঠিক ফুটিয়ে রেখেছে।

পরিতোষ কাছে এসে বললেন, বড় শীত পড়েছে হে, এত সহ্য হয় না।

যেন রোজ দেখা হচ্ছে, খুব প্রীতির সম্পর্ক ভঙ্গীটা এইরকম। অনিমেষ বলল, শীত যখন তখন বেরুলেন কেন?

না বেরিয়ে পারলাম না হে। তুমি কি চিরকাল এখানেই থেকে যাবে ভেবেছ?

দেখি।

তোমার ছেলেবউ চলে গেল বলেই কথাটা বললাম কিছু মনে করো না।

অনিমেষ বৃদ্ধের মুখের দিকে তাকাল, আপনি কেমন আছেন?

ভাল নয় বাবা, মোটেই ভাল নয়। পথটা ছাড়ো, দিদির সঙ্গে দেখা করব।

কেন আর জ্বালাতন করতে যাচ্ছেন। উনি ভাল নেই।

ভাল নেই? সে কি? কি হয়েছে? ছাড়ো ছাড়ো পথ।

অনিমেষ লক্ষ্য করল পরিতোষ ওর প্রথম মন্তব্যটাকে আমলই দিলেন না। যেন কিছুই বলেনি অনিমেষ এমন ভঙ্গীতে ভেতরে ঢুকে গেলেন। এরকম মানুষের একটাই সুবিধে কেউ বেশীক্ষণ ওদের সঙ্গে ঝগড়া করতে পারে না। পরিতোষ ভেতরে যাওয়ার পর অনিমেষ বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। চিঠি নিয়ে পিওন আজ এই পথে এলোই না। পরিতোষকে বাড়িতে রেখে সে। বেরিয়ে যেতে পারছিল না। সে দেখল ছোটমা বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন, অনিমেষ।

বল।

একবার ভেতরে গিয়ে দেখে এসো।

কি হয়েছে?

যাও না একবার।

সিঁড়ি ভাঙ্গার ঝামেলা এড়িয়ে অনিমেষ ক্রাচ নিয়ে বাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটতে লাগল। হেমলতার ঘরের পাশে একটা ছোট দরজা আছে সেইটে বিশেষ কায়দায় বাইরে থেকেও ভোলা যায়। এই কয়দিনে অনিমেষ কায়দাটা জেনে গেছে। ওই পথে গেলে তাকে ওঠা নামা করতে হবে না। ভেতরে ঢুকে অনিমেষ অবাক হল। হেমলতা কাঁদছেন। গোঙানির মত তাঁর কান্নাটা একটানা বাজছে। শুধু হেমলতা নয় আর একটা গলায় কান্না বাজছে। ওটা যে পরিতোষের তা অনুমানে বুঝল অনিমেষ। কিন্তু দুজনে একসঙ্গে কেন কাঁদবেন সেটাই সে ধরতে পারছিল না। এতদিন যে ভাইকে দুচোখে দেখতে পারেননি হেমলতা এখন কেন তার সামনে কাঁদবেন? অনিমেষের মনে হল ধূর্ত পরিতোষ নিশ্চয়ই কৌশল করছে। হেমলতাকে ভেজাতে পারলে মামলা জেতা তার পক্ষে সুবিধে হয়ে যায়।

কি করা যায় বুঝতে পারছিল না অনিমেষ। শেষপর্যন্ত সে এগিয়ে গেল। দরজা খোলা, খাটের ওপর বাবু হয়ে বসে হেমলতা কেঁদে যাচ্ছেন, তার নিচে মোড়ায় বসে পরিতোষ, তার গলাতেও কান্না। ওকে দেখে হেমলতা চেঁচিয়ে উঠলেন, ওরে অনি, দ্যাখ পরি কি কাণ্ড করেছে। আমার তো কেউ নেই। বাবা গেলেন, মহী গেল, প্রিয় কোথায় জানি না। এই আমাকে সব সম্পত্তি লিখে দিচ্ছে পরি। এ নিয়ে আমি কি করব? ঘাটের মড়া আমি কান্নাটা বাড়তেই পরিতোষের গলা তার সঙ্গে যোগ হল। কিন্তু সেইসঙ্গে শব্দগুলো জড়ানো ছিল, আমারও কেউ নেই। পৃথিবীতে পরের। মেয়ে কখনও আপন হয় না। সে যখন আমায় ছেড়ে চলে গেল তখন আমি কেন আর ছোট হই। আমি মামলা তুলে নিলাম দিদি, আমার যদি কিছু প্রাপ্য হয় সেটা তুমিই নিয়ে নাও।

হেমলতা পরিতোষের কাঁধে হাত রাখলেন, না রে ভাই, আমি আর বন্ধন চাই না। এখন চোখ বন্ধ করলেই আমি বাবাকে দেখতে পাই। বাবা সবসময় আমার পাশে আছেন। ওই দ্যাখ, বাবা তোর পেছনে দাঁড়িয়ে হাসছেন। বাবা, দেখুন, পরির কত পরিবর্তন হয়েছে। ও আর মামলা করবে না বলছে। পরিকে আপনি ক্ষমা করুন বাবা, ও ওর ভুল বুঝতে পেরেছে।

হেমলতার কথার ধরন এত আন্তরিক ছিল যে পরিতোষ চমকে উঠল। যেন সত্যিই সরিৎশেখরের অশরীরী আত্মা ঘরে ঘুরছে। চোখের জল মুছতে মুছতে পরিতোষ বেরিয়ে এল ঘর। ছেড়ে। তার হাতে একটা কাগজ, বাবা অনিমেষ, তোমার কাছে একটা ভিক্ষে আছে। আমার ছেলেবউ সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। তুমি আমাকে একটু থাকার জায়গা দেবে? আমি মামলা তুলে নিলাম।

পরিতোষের হাতের কাগজটা দুলছিল। অনিমেষ বলল, আমার ওপর দুজন এই বাড়িতে আছেন। তাঁরা যদি অনুমতি দেন।

বউমা তো কখনই অনুমতি দেবে না। সে আমাকে দেখতে পারে না।

তাহলে আমার কিছু বলার নেই।

অনিমেষ আর দাঁড়াল না। ব্যাপারটা তার নিজের কাছেই খুব খারাপ লাগছিল। পরিতোষ যদি সত্যি পরিত্যক্ত হন তাহলে সহানুভূতি আসেই। মামলা তুলে নিলে একটা বিরাট ঝামেলা থেকে বাঁচা যায়। কিন্তু এই বাড়িতে থাকলে ওঁকে খাওয়াবার দায়িত্ব যে এসে যায়! সেটা কম কথা নয়। কিন্তু পরিতোষকে যে বিশ্বাস করা মুশকিল। আজ একা এখানে ঘাঁটি গেড়ে কাল যে স্ত্রীপুত্রদের ডেকে আনবেন না তার নিশ্চয়তা কি! অতএব এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার ভার ছোটমার ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভাল।

.

জলপাইগুড়িতে সন্ধ্যেটা বড্ড চটজলদি রাত হয়ে যায়। এবং শীতের রাত মানেই হু হু ধারালো দাঁত চকচক করে। রাত্রের খাওয়া শেষ করে অনিমেষ কিছুক্ষণ নিজের ঘরে বসেছিল। ছোটমা পরিতোষের প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। এই নিয়ে হেমলতার সঙ্গে তাঁর মতান্তর হয়েছিল। হেমলতা হঠাৎ আজ তাঁর ভাই-এর ওপর দুর্বল হয়ে পড়েছেন। কিন্তু ছোটমার যুক্তির বিরুদ্ধে কিছুই বলতে পারেননি। হেমলতার যে চিন্তাশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। মৃত্যু যেন ওই মানুষটির চারপাশে বৃত্ত রচনা করে চুপচাপ অপেক্ষা করছে, আজকাল ওর দিকে তাকালেই এমন মনে হয়। ছোটমাও শেষপর্যন্ত ভেঙ্গে পড়েছিলেন, আমি কার জন্যে এসব করছি। এ কি আমার সম্পত্তি? শুধু তোমার দাদু বাবার কথা ভেবে লোকের কাছে অপ্রিয় হচ্ছি। এখন থেকে যা সিদ্ধান্ত তা তোমাকেই নিতে হবে। আমার ওপর সবকিছু চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। তুমিই এ বাড়ির উত্তরাধিকারী।

ঘরে বসে অনিমেষ উত্তরাধিকার শব্দটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল, কিছু রেখে গেলে তবেই পরের পুরুষ সেটি পায়। উত্তরাধিকারসূত্রে অর্জিত সম্পত্তি, স্থাবর কিংবা অস্থাবর, রক্ষা করাই কর্তব্য। কিন্তু আগের পুরুষ যদি কিছুই না রেখে যায়? যদি একটা বিরাট শূন্য ছাড়া অতীতের কাছ থেকে কিছুই না পাওয়া যায় তবে? এই বাড়ি-ঘর হয়তো খুব সাধারণ জিনিস। কিন্তু সরিশেখরের চারিত্রিক দৃঢ়তা, একটা গোপন অনুচ্চার ভালবাসা, মহীতোষের নীরব আত্মোৎসর্গ যা তিনি তাঁর বাবার জন্যে অকাতরে করে গেছেন, ছেলের জন্যে প্রতিদান না চেয়ে নিঃশেষ হয়েছেন, সেগুলোর মূল্য এর পরের পুরুষরা জানবে না। কারণ অনিমেষরা এগুলোর কিছুই ওদের দিয়ে যেতে পারছে না। অতএব অর্ক কোন অর্থেই কারো উত্তরাধিকারী নয়। এই শব্দটাই তাই স্থবির হয়ে যাবে একসময়।

দরজা ভেজিয়ে অনিমেষ বেরিয়ে এল বাইরে। ঠিক দশটায় ওদের মিলিত হবার কথা। এখন। চারপাশে গভীর অন্ধকার। ঘরের বাইরে আসতেই ঠাণ্ডাটা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল। অনিমেষের ছেলেবেলার কথা মনে পড়ল। এরকম চুপচাপ দরজা ভেজিয়ে গিয়ে সে রাতের সিনেমা দেখেছে সরিশেখরকে ফাঁকি দিয়ে। আজ ছোটমাকে জানিয়ে যাওয়া হল না। কারণ এত রাতে যাওয়ার জায়গাটা সম্পর্কে ছোটমার কৌতূহল হবেই।

রাস্তা ফাঁকা। ঠাণ্ডা হাওয়ায় হাড়ে কাঁপুনি আসছিল। বাঁধ পেরিয়ে বালির চরে এসে দাঁড়াতেই ওর মনে হল এটাকে আর বালির চর বলা যায় না। রীতিমতন ঘনবসতি হয়ে গেছে।

মোট দশজন মানুষ আলোচনায় বসেছিল। অনিমেষ পৌঁছানোমাত্র আলোচনা শুরু হল। উত্তরবাংলার গ্রামের মানুষদের নিজস্ব সমস্যা আছে। সেইসব সমস্যা নিয়ে প্রথম কাজ শুরু করতে হবে। যে গ্রামগুলোকে নির্বাচন করা হয়েছে প্রাথমিক কাজ শুরু করার জন্যে সেই গ্রামগুলোয় দলের ছেলে আছে। অতএব তাদের সাহায্য নিয়ে কাজ করতে কোন অসুবিধে হবে না। মোটামুটিভাবে এই ব্যাপারে নির্বাচনের দায়িত্ব দেওয়া হল জুলিয়েনের ওপর। তারপরেই আর একটি প্রস্তাব উঠল। উত্তরবাংলার চাবাগানগুলো আগেই করা যায়। এই চা বাগানগুলোর অধিকাংশ মানুষ বাঙালি নয়। এই দেশের মাটিতে তাদের একশ বছর আগে রাঁচি-হাজারিবাগ থেকে ধরে আনা হয়েছিল। এরা নিজেদের পশ্চিমবঙ্গীয় মনে করে না। অথচ নিজেদের আদিগ্রামে ফিরে গেলে এদের জায়গা হবে না। কারণ এই মানুষগুলো সংখ্যায় এত বছরে কয়েকশ গুণ বেড়ে গেছে। তাছাড়া চা-শিল্প ছাড়া আর কোন কাজ এরা জানে না। এই মানুষগুলো নিজেদের নানা কারণে অবহেলিত ভাবে। এখনও এদের মধ্যে তেমনভাবে শিক্ষা সম্প্রসারিত হয়নি। অতএব এই কয়েক লক্ষ মানুষকে একত্রিত করার বড় সুযোগ আছে। গ্রামে কাজ শুরু না করে তাই চাবাগানেই আন্দোলন প্রথম ছড়ানো উচিত।

কথাটা যেন বেশ উত্তেজনা ছড়ালো। চা বাগানগুলো যেহেতু জঙ্গুলে এলাকায় এবং প্রত্যেকের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন তাই অনেক সুবিধে পাওয়া যাবে।

অনিমেষ প্রথম প্রশ্ন করল, কিন্তু এটার অন্য দিক আছে। আমরা যা চাইছি তা না হয়ে যদি সাম্প্রদায়িক ব্যাপার হয়ে যায়? আমরা নিশ্চয়ই চাইবো না একটা মদেশিয়াল্যাণ্ড করার দাবি উঠুক।

আলোচনা যখন জোর কদমে চলছে তখন দরজায় শব্দ হল। তারপরেই একজন সন্ত্রস্ত গলায় জানালো বাঁধের ওপর অস্ত্র হাতে কিছু লোক জড়ো হয়েছে। মনে হচ্ছে তাদের লক্ষ্য এদিকেই। সঙ্গে সঙ্গে সভা ভেঙ্গে দেওয়া হল। সভ্যদের বলা হল আত্মগোপন করতে। তাড়াহুড়ো করে সবাই কাঠের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই চিৎকার শুনতে গেল। শখানেক মানুষ মশাল হাতে তিস্তার চর ঘিরে ছুটে আসছে। সদস্যরা যে যেদিকে পারল দৌড়ে গেল। জুলিয়েন অনিমেষকে বলল, এরা কারা বলুন তো?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, বুঝতে পারছি না।

জুলিয়েন বলল, পালান। তারপরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। কিন্তু এই বালির চরে অনিমেষ জানে তার পক্ষে জোরে হাঁটাও সম্ভব নয়। চারপাশে চিৎকার চেঁচামেচি চলছে। সে কিছুটা হেঁটে একটা বালির ঢিবির পাশে ক্রাচদুটো নিয়ে চুপচাপ বসে পড়ল।

.

চোখের ওপরে একটা নারকীয় ঘটনা ঘটে গেল। আধঘণ্টার মধ্যে কয়েকটি মানুষ বেধড়ক মার খেয়ে বালির চরে চিরজীবনের মত লুটিয়ে পড়ল। উত্তেজিত মানুষগুলো যেন ডাকাত ধরার মত নৃশংস হল। অনিমেষ বুঝতে পারছিল এরা সাধারণ মানুষ, নেহাতই সাধারণ মানুষ। বালিতে বসে থাকায় অনিমেষ এদের নজর এড়িয়ে গেল।

ভোরবেলায় অনিমেষ ফিরে এল বাড়িতে। কয়েকজন ডাকাতকে পাবলিক তিস্তার চরে ধরে ফেলেছে, অন্ধকার থাকতে থাকতে শহরে খবর ছড়িয়ে গেল। গেট খুলে সে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় এগোতেই দেখল ছোটমা দাঁড়িয়ে। ওকে দেখতে পেয়ে ছোটমা ছুটে এলেন, তুমি কেমন আছ?

ভাল।

একটা টেলিগ্রাম এসেছে মাঝ রাত্রে।

টেলিগ্রাম?

হ্যাঁ। কি হয়েছে? অনিমেষ আর ভাবতে পারছিল না।

৫৩. মাধবীলতার অপারেশন হয়ে গেল

মাধবীলতার অপারেশন হয়ে গেল। ডাক্তার দত্তগুপ্তের ইতস্তত ভাবটা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছিল। শরীরে যার রক্ত নেই তাকে অপারেশন করায় বড় ঝুঁকি। কিন্তু এ ছাড়া অন্য উপায় নেই। দ্বিতীয়ত মাধবীলতার শরীরে যে গ্রুপের রক্ত চলাচল করে সেই গ্রুপের রক্ত হাসপাতালে পাওয়া যাচ্ছিল না। একে অস্বস্তি ছিল তার ওপর স্বাভাবিক শ্রেণীর রক্ত না হওয়ায় অন্যরকম ইঙ্গিত দিচ্ছিল। ডাক্তারদেরও মনে বোধহয় সংস্কার খুব বেশী কাজ করে। শরীরে রক্ত না থাকাটা অস্বাভাবিক ব্যাপার নয় কিন্তু সেই পেশেন্টের রক্তের শ্রেণী অসাধারণ হবে কেন?

পরমহংস, সৌদামিনী যখন শহরের সমস্ত রক্তসংরক্ষণ কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন তখন অর্কর সঙ্গে মুশকিল-আসান লোকটার দেখা হয়ে গেল। পাকা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে এক ভদ্রলোককে সান্ত্বনা দিচ্ছিল সে, অল্পবয়সী স্ত্রী চলে গেছে বলে শোক করছেন। কেউ গেলে তো কষ্ট হবেই। কিন্তু ভেবে দেখুন উনি আপনার পঞ্চাশ পঞ্চান্ন বছরে চলে গেলেন! তখন তো আরও খারাপ হত। তাই না? একটা সিগারেট দিন।

ভদ্রলোকের অসাড় হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে মুখ তুলতেই লোকটা অর্ককে দেখতে পেল। অর্কর খেয়াল হল লোকটা বলেছিল এই হাসপাতালের যা কিছু মুশকিল ও আসান করে দিতে পারে, একমাত্র মৃতকে জীবিত করা ছাড়া। মায়ের জন্যে যে রক্ত দরকার সেটাও কি ও সংগ্রহ করে দিতে পারবে? যেখানে বড় ডাক্তারের প্রভাব কোন কাজে লাগছে না সেখানে এ কি করবে?

লোকটি সিগারেট ধরিয়ে এগিয়ে এল, কেমন আছে তোমার মা?

ভাল নয়। অপারেশন হবে।

কোন মুশকিল আছে?

অর্ক মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, মায়ের জন্য রক্ত দরকার। কিন্তু মায়ের গ্রুপের রক্ত পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ সময় বেশি নেই।

পাওয়া যাচ্ছে না বলে কোন কথা নেই। সবই পাওয়া যায়। কেসটা কি আমাকে নিতে হবে? লোকটা সিগারেটে জোরে জোরে টান দিতে লাগল।

আপনি পারবেন? অবিশ্বাসী চোখে তাকাল অর্ক।

বলেছি তো শুধু প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারি না। লোকটা হাসল, তবে যত রেয়ার গ্রুপ হবে তত দাম বাড়বে। এটা ভাই বাজারের নিয়ম।

আপনি আমার সঙ্গে একবার পরমহংস কাকুর কাছে চলুন।

কেন?

আমার কাছে বেশী টাকা নেই।

কোথায় থাকা হয়?

তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেন।

তাই? সেখানে তো জোর গোলমাল চলছে। মাস্তানদের প্যাঁদাচ্ছে।

মাস্তানরাও মারছে। অর্ক জামার বোতাম খুলে ব্যাণ্ডেজ দেখাল।

আরে বাব্বা! তুমিই নাকি?

আমিই নাকি মানে?

শুনলাম কয়লার চেলা একটা ছেলেকে ছুরি মেরেছিল বলে পাবলিক তাদের শুইয়ে দিয়েছে। তোমাকে ছুরি মেরেছিল? লোকটার চোখে বিস্ময়।

হ্যাঁ, তবে বেশি লাগেনি। হাসপাতাল থেকেও তাই বলল।

লোকটা যেন খুব বিমর্ষ হয়ে গেল। তারপর এক ঝটকা দিয়ে দ্বিধাটা কাটিয়ে উঠল। বিড় বিড় করে কিছু একটা হিসেব করে নিয়ে বলল, ওপারের জন্যে খানিকটা মাল জমা করে নিই। তোমার কাছে আর নাফা করব না। কি গ্রুপের ব্লাড লাগবে বল?

যে জিনিস সমস্ত শহর ঘুরেও পাওয়া যাচ্ছিল না সেটা পেতে মাত্র ঘণ্টাখানেক সময় লাগল। মুশকিল-আসানের সন্ধানে বেশ কিছু মানুষ আছে। তাদের এক একজনের রক্তের শ্রেণী আলাদা। হাসপাতালের যে রেট তার থেকে বেশি এদের দিতে হয়। একমাত্র মুশকিল-আসান খবর দিলেই এরা আসে রক্ত দিতে। ব্যাঙ্কে জমা পড়লে সেটা যাতে নির্দিষ্ট পেশেন্ট পায় সেই ব্যবস্থা মুশকিল-আসান করে দেয়। কিন্তু তার বদলে পেশেন্টকে সমপরিমাণ রক্ত দিতে হয়। এসব ব্যাপার করতে একটুও সময় লাগল না।

বিলু এবং কোয়া অর্কর সঙ্গে হাসপাতালে এসেছিল। পাড়ার মধ্যে দিয়ে ওদের বের করে আনার ঝুঁকি ছিল। যে পথে ওরা তিন নম্বরে ঢুকেছিল সেই পথ এর মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অর্ক যখন বড় রাস্তা দিয়ে ওদের সঙ্গে নিয়ে এসে ট্রাম ধরল তখন অনেকের চোখে বিস্ময় ছিল। কিন্তু শুধু অর্কর জন্যে কেউ মুখে কিছু বলেনি। বিকল্প রক্ত দেওয়ার যখন প্রয়োজন হল তখন বিলু এবং কোয়া এগিয়ে এল। অর্ক ভেবেছিল ওদের নিষেধ করবে। কিন্তু ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে পারল না। যেন খুব পবিত্র কাজ করছে এরকম মুখের ভাব ছিল ওদের মুখে।

অপারেশন শেষ করতে দশটা বেজে গেল। পরমহংস এবং সৌদামিনী তখনও বসে। স্কুলের টিচাররা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ফিরে গেছেন। নীপা মিত্র বলেছেন ভোরে আবার আসবেন। বলেছেন, আমি দক্ষিণেশ্বরে মানত করেছি, কোনও ভয় নেই, ঠিক ভাল হয়ে যাবে।

অর্কর দমবন্ধ হয়ে আসছিল। এই হাসপাতালে জীবন আর মৃত্যু এত কাছাকাছি বাস করে যে কোন আশা খুব জোর দিয়ে করা যায় না। তার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল অথচ কপালে ঘাম জমছিল। এবং হঠাই অর্কর মনে হল মা আর বাঁচবে না। এই হাসপাতাল থেকে মা আর ফিরে যাবে না। কথাটা ভাবা মাত্র ওর শরীরে প্রবল কাঁপুনি এল। অর্ক চেষ্টা করেও নিজেকে সুস্থির রাখতে পারছিল না।

বিলু আর কোয়া তার পাশে বসে ছিল। কাঁধে হাতের স্পর্শ পাওয়ায় অর্ক মুখ তুলতেই দেখল বিলুকে, কি হয়েছে?

অর্ক মাথা নাড়ল, কিছু না।

আর কি আশ্চর্য, কিছু না বলামাত্র তার শরীরটা স্থির হয়ে গেল। কিছু না ভাবলে কোন কিছুই গুরুত্বপূর্ণ হয় না। যে কোন সমস্যাকেই কিছু না বলে ধার কমিয়ে দেওয়া যায়।

দশটা নাগাদ খবরটা পাওয়া গেল। অপারেশন হয়ে গেছে। মাধবীলতার অবস্থা বাহাত্তর ঘণ্টা না কাটলে বলা যাবে না। এখন সে অচেতন। ডক্টর দত্তগুপ্ত সৌদামিনীকে বললেন, প্রচণ্ড সহ্য শক্তি মহিলার। ওঁর যা কেস তাতে বেঁচে ফেরার চান্স থার্টি পার্সেন্ট। কিন্তু, আশা করছি এ যাত্রায় বেঁচে যাবেন। আপনাদের তো এখন কিছু করার নেই। থেকে আর কি করবেন।

সৌদামিনী অর্কর দিকে এক পলক দেখে নিয়ে বললেন, একবার দেখে আসতে পারি ওকে?

মাথা খারাপ। এখন উনি ইনটেনসিভ কেয়ারে আছেন। প্রার্থনা করুন, ওঁর জন্যে প্রার্থনা করুন। আর কিছু বলার নেই।

পরমহংস সৌদামিনীকে একটা ট্যাক্সিতে পৌঁছে দেবে ঠিক হল। রাত এগারটা নাগাদ অর্ক বেরিয়ে এল হাসপাতাল থেকে। কোয়া এবং বিলু তার সঙ্গ ছাড়েনি। আলোয় লেখা গেটের নিচে দাঁড়িয়ে অর্ক আবার হাসপাতালটার দিকে তাকাল। ওরই একটা ঘরে মা অজ্ঞান হয়ে শুয়ে রয়েছে। এই মুহূর্তে পৃথিবীর কোন সমস্যা কারো অস্তিত্ব ওঁর অনুভবে নেই। এমন দুশ্চিন্তামুক্ত অবস্থায় মা বোধহয় অনেককাল থাকেনি।

কোয়া বলল, গুরু, খাবে না?

অর্ক মাথা নাড়ল, না। আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।

বিলু বলল, তুই মাইরি হেভি গিলে খেয়ে গেছ। ডাক্তার তো বলল কোন ভয় নেই। দরকার হলে আবার রক্ত দেব আমরা।

অর্ক ওর মুখের দিকে তাকাল, শুধু রক্ত দিয়ে কি কাউকে বাঁচানো যায়?

তাহলে? মানে আমরা তো আর কিছুই করতে পারি না।

ঠিক। আমাদের কিছুই করার নেই। চল।

বিলু কোয়ার দিকে তাকাল। তারপর নিচু গলায় বলল, আমরা যাব না।

কেন?

আমাদের আজকে পাড়ায় থাকা ঠিক হবে না। তুমি গিয়ে কথাবার্তা বল, তারপর।

অর্ক বিলুর ইতস্তত করার কারণ বুঝতে পারল না। সে মাথা নেড়ে জিজ্ঞাসা করল, তোরা আর কোথায় যাবি?

কোয়া বলল, দেখি কোন শ্মশানে গিয়ে শুয়ে পড়ব।

শ্মশানে?

হ্যাঁ। ফাস্টকেলাস জায়গা। কেউ কোন পাত্তা নেবে না। আমরা কাল সকালে হাসপাতালে আসব।

অর্ক আর কথা বাড়াল। একটা ট্রাম গুমটিতে ঢুকবে বলে আসছিল। সেটায় সে চড়ে বসল। ওঠার সময় আঘাতটার কথা খেয়াল ছিল না অর্কর, সামান্য চাড় লাগতেই টনটন করে উঠল সেটা। অর্ক চোখ বন্ধ করল। তার মনে হচ্ছিল নিশ্চয়ই ক্ষতের মুখ থেকে রক্ত বেরিয়েছে।

গলির মুখে তিনচারজন লোক দাঁড়িয়ে। তাদের হাতে লাঠি। অর্ক সন্দিগ্ধ চোখে সেদিকে তাকাতেই লোকগুলো হেসে ফেলল, আরে আমরা! আজ থেকে নাইট গার্ড পার্টি কাজ শুরু করেছে। ওই যে পুলিস ভ্যানও দাঁড়িয়ে আছে।

অর্ক এবার দেখতে পেল। গলির উল্টোদিকের অন্ধকারে একটা ভ্যান রয়েছে। কয়েকজন পুলিস তার পাশে অলস ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে।

তিন নম্বরের সামনে এসে অর্ক দেখল সমস্ত দোকানপাট বন্ধ। শুধু নির্মল ড্রাইভার শিবমন্দিরের রকে বসে বিড়ি খাচ্ছিল। ওকে দেখেই উঠে এল নির্মল, মা কেমন আছে?

অপারেশন হয়েছে। এখনও জ্ঞান ফেরেনি।

তাহলে ভাল হয়ে যাবে। সাধারণত অপারেশন টেবিলেই যা হবার হয়। শুনলাম ওরা নাকি তোমাকে ঝেড়েছে?

এমন কিছু নয়।

এবার শালাদের পাড়া থেকে হঠাতে হবে। পুরো পাবলিক জেগে গেছে। চল, ওরা সবাই অপেক্ষা করছে।

কারা?

সুবল, সতীশ, নিরঞ্জন।

তৃতীয় নামটা শুনে অবাক হলেও ভাল লাগল অর্কর। নিরঞ্জন কংগ্রেস করে। তবে নুকু ঘোষের মত পুরনো কংগ্রেসী নয়। নিরঞ্জন এবং সতীশদা একই সঙ্গে বসেছে এটাই অভিনব ব্যাপার। যদিও নিরঞ্জনদের অস্তিত্ব এ পাড়ায় নেই বললেই চলে তবে গত নির্বাচনে ওরাই তো বেশী ভোট পেয়েছে।

নির্মলের সঙ্গে অর্ক হেঁটে এল কপোরেশন স্কুল বাড়িতে। সেখানেই শান্তি কমিটির অফিস হয়েছে। ওকে দেখা মাত্র সুবল জিজ্ঞাসা করল, মা কেমন আছেন?

অর্ককে একই জবাব দিতে হল। ঘরে তখন ছয়সাতজন মানুষ। এত রাত্রেও এই এলাকার কয়েকজন বিশেষ ভদ্রলোককে দেখে অবাক হল অর্ক। এরা সাধারণত সাতে পাঁচে থাকেন না। নিজের নিজের স্বার্থ নিয়ে গা বাঁচিয়ে চলেন। অনেকক্ষণ ধরে অর্ককে ওরা সমস্ত ঘটনা বিশদভাবে জানাল। এলাকার তরুণদের সংগঠিত করার দায়িত্ব অর্কর ওপর। কোনরকম রাজনৈতিক মতামত ছাড়াই সবাই এলাকার শান্তি বজায় রাখার জন্যে কাজ করবে। এই জন্যে এলাকার সম্মানীয় মানুষদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সুবল এবং অর্ক তার যুগ্ম সম্পাদক। সুবল বলল, আমরা আমাদের এলাকা থেকে যে কোন রকমের সমাজবিরোধীদের সরিয়ে দিতে চাই। এ ব্যাপারে আমরা কোন নরমনীতি গ্রহণ করব না। সাধারণ মানুষ একবার যার দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছে তাকেই পুলিসের হাতে তুলে দিতে হবে। অবশ্য আমরা সক্রিয় হবার পর এই সব সমাজবিরোধীরা পাড়া ছেড়ে পালিয়েছে। এদের আর পাড়ার ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হবে না যতক্ষণ তারা আইনের কাছে মাথা না নোয়াচ্ছে। আমরা একটা লিস্ট করেছি। তুমি দেখতে পারো।

অর্ক লিস্টটা হাতে নিল। এই মুহূর্তে তার নিজের বয়স অভিজ্ঞতার কথা একটুও খেয়ালে আসছে না। নিজেকে যেন আচমকা খুব দায়িত্ববান বলে মনে হচ্ছে। এই মানুষগুলো তাকে যে গুরুত্ব দিচ্ছে সে যেন তার মর্যাদা রাখতে পূর্ণ সক্ষম। লিস্টে চোখ বোলাতে বোলাতে সে কোয়ার নাম দেখতে পেল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, এলাকায় ছুরি দেখিয়ে চাঁদা তোলা, অকারণে মানুষকে হুমকি দেওয়া, মদ্যপান করে এলাকার শান্তিভঙ্গ করে অশ্লীল শব্দ বলা ইত্যাদি ইত্যাদি। যেসব দোকানদার কোয়ার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের নামও পাশে রয়েছে। মোট সমাজবিরোধীর সংখ্যা একশ ছত্রিশ জন। এবং এই লিস্টে বিলুর নাম নেই।

অর্ক এক মুহূর্ত চিন্তা করে সতীশদার দিকে তাকাল, আমরা যদি সত্যি এই তালিকাটাকে গুরুত্ব দিতে চাই তাহলে আর একটা নাম লেখা উচিত।

কার নাম? সুবল জিজ্ঞাসা করল।

বিলু।

সতীশ চোখ বন্ধ করে ভাবল, বিলু, বিলু তো তোমার বন্ধু।

হ্যাঁ, আমি জানতাম না ও কয়লার হয়ে কাজ করছে। গতকাল যে হামলা হয় তার জন্যে বিলু কিছুটা দায়ী। কয়লার ধারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল।

তুমি এসব জানলে কি করে?

বিলুরা দুপুরে আমার কাছে এসেছিল।

সঙ্গে সঙ্গে ঘরে বসা একজন বলে উঠল, হ্যাঁ, সে কথা আমরা শুনেছি। আপনি ওদের পাড়া থেকে বের করে নিয়ে গেছেন। এটা অত্যন্ত অন্যায় ব্যাপার। যারা সমাজবিরোধী বলে পরিচিত তাদেরই যদি আমরা আশ্রয় দিই তাহলে এই ধরনের আন্দোলনের কোন যৌক্তিকতা থাকে না।

অর্ক মাথা নাড়ল। তখন আমি ঠিক কি করা উচিত ভেবে উঠতে পারছিলাম না। তাছাড়া আমি মনে করি বিলু সাধারণ মানুষের ক্ষতি করতে পারে না। সংসার চালাবার জন্যে লোভে পড়ে ও স্মাগলিং-এর ব্যবসায় ঢুকেছিল।

সতীশদা বললেন, তাহলে ওর নাম লিস্টে তুললে কেন?

কারণ ও কয়লার সঙ্গে কাজ করেছে। তবে থানা থেকে ঘুরে এলে ওর বিরুদ্ধে যেন শান্তিকমিটি কোন অ্যাকশন না নেয়।

সুবল বলল, না, আমার মনে হয় কারো বিরুদ্ধে আমরা জেদ ধরে থাকব না। এই কারো বলতে আমি সেইসব মাস্তানদের বোঝাচ্ছি যারা খুবই সাধারণ স্তরের। তবে এদের একবার থানা থেকে ঘুরে আসা উচিত। কিন্তু কয়লা এবং তার প্রধান সঙ্গীদের আমরা কিছুতেই ছেড়ে কথা বলব না।

মোটামুটি সিদ্ধান্ত সেইরকম হল। আজ সন্ধ্যায় শান্তি কমিটির নেতৃত্বে এই এলাকার চোলাই মদের আড্ডাগুলো তুলে দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার যে কটি আচ্ছা ছিল তার সবগুলোই পরিচালনা করত ঘরের মেয়েরা। পরিবারের ছেলেরা কোন রোজগার করে না, মেয়েরা মদ বোতলে করে বিক্রি করে। সন্ধ্যের পর তাদের ঘরের সামনেই আসর বসে যায়। এই মেয়েগুলো শরীরের ব্যাপারে যথেষ্ট আত্মমর্যাদাসম্পন্ন। এদের পরিবারের ছেলেদের বলা হয়েছে আবার মদ বিক্রি করলে পাড়া ছেড়ে চলে যেতে হবে।

সুবল বলল, মুশকিল হল পুলিসকে নিয়ে। কয়লার লোকদের উৎখাতের পর পুলিস সম্পর্কে আমরা নানান অভিযোগ পাচ্ছি। আজ সারাদিন ধরে এলাকার নিপীড়িত মানুষেরা এসে সেসব আমাদের দিয়ে গেছেন। এই এলাকা যে দুটো থানার মধ্যে পড়ে তার অফিসার এবং লালবাজারের একজন বড় অফিসারের প্রশ্রয় ছাড়া এই সমাজবিরোধী কাজকর্ম চলতে পারত না। আজকে অবশ্য পুলিস বলছে তারা আমাদের সাহায্য করবে। কিন্তু একই পুলিস ওদের সাহায্য করে আমাদের পাশে দাঁড়াবে এটা বিশ্বাস করা শক্ত। কারণ ওরা তো আমাদের কাছ থেকে কোন টাকা পাচ্ছে না। নিজেদের নির্ভরযোগ্য রোজগার বন্ধ হয়ে যাক সেটা ওদের কিছুতেই কাম্য হতে পারে না।

নিরঞ্জন এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল। এবার বলল, কথাটা ঠিক কিন্তু বিশ্বাস করা ছাড়া আমাদের আর কি উপায় আছে। যেমন আজ দুটো থানায় বলা হয়েছে সমাজবিরোধীরা আশেপাশের পাড়ায় আশ্রয় নিয়েছে। পুলিস যদি তল্লাশি করে তাদের খুঁজে পাবে। কিন্তু থানা দুটো থেকে কোন অ্যাকশন নেওয়া হয়নি।

আর একজন বলল, শুনেছি শ্যামবাজারের মোড়ের কাছে ওরা অপেক্ষা করেছে। এই এলাকার লোকজন দেখলেই মারবে।

সতীশদা বলল, দেখুন, ভয় পেলে ওরা পেয়ে বসবে। কিন্তু আমরা যদি এক থাকি, ওদের কেয়ার না করি, পাড়ায় ঢুকতে না দিই তাহলে উল্টে ওরাই ভয় পাবে। কিন্তু আমার কাছে খুব্বর আছে কয়লাকে কংগ্রেসকর্মী হিসেবে দাবি করে কংগ্রেসের নেতারা থানায় গিয়েছিলেন।

সঙ্গে সঙ্গে নিরঞ্জন বলল, বাজে কথা। নুকু ঘোষ সেই লাইনে চেষ্টা করেছিলেন। সমাজবিরোধীদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই এমন রাজনৈতিক পার্টি অন্তত ভারতবর্ষে নেই। কয়লা নিজের স্বার্থে আমাদের হয়ে যদি একসময় কাজ করে থাকে তাহলে সেই কাজটায় কোন অন্যায় ছিল না। কিন্তু তাই বলে আমরা এখন কয়লাকে পলিটিক্যাল শেল্টার কিছুতেই দিতে পারি না।

সতীশদা জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাদের নেতা থানায় যাননি?

যদি গিয়ে থাকেন অন্যায় করেছেন। তিনি নিজের দায়িত্বে গিয়েছেন দল তাঁকে পাঠায়নি। আমরা এটাকে সমর্থন করছি না। এই যে আমি শান্তি কমিটিতে আছি সেটাই তার প্রমাণ নয় কি? নিরঞ্জন স্পষ্ট গলায় বলল।

সতীশদা বললেন, এই কথাটা মনে রাখতে হবে। আমরা কোনরকম রাজনৈতিক মতামত ছাড়াই শান্তিকমিটি তৈরি করেছি। আমাদের কার্যকলাপে যেন সেই ধারা বজায় থাকে। আমরা যদি এলাকার মঙ্গল চাই তাহলে এই ঐক্য বজায় রাখতেই হবে।

সুবল বলল, কিন্তু আমাদের পরবর্তী কার্যকলাপ ঠিক করতে হবে। আমার মনে হয় পুলিস কমিশনারকে অনুরোধ করা উচিত যাতে তিনি এখানে আসেন। এখানে আমরা যতটা না ক্ষতিগ্রস্ত কয়লার এলাকায় মানুষকে তার থেকে অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়েছে। শুধু ঈশ্বরপুকুর নয় এই পুরো এলাকা জুড়ে শান্তি কমিটি কাজ করবে।

অর্ক আলোচনা শুনছিল। এর অনেকটা সে টুকরো টুকরো ভাবে আগে শুনেছে। একটা লোক কিভাবে শক্তি প্রয়োগ করে একটা অঞ্চলকে ক্রীতদাস করে রেখেছিল এবং তার ইচ্ছায় সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হত তা শুনলে মাথা ঠাণ্ডা রাখা যায় না।

রাত বাড়ছিল। অর্ক উঠে পড়ল। তার কাঁধের ব্যথা শুরু হয়েছে। মুখে তেতো স্বাদ। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে এখন। সুবল বলল, আমরা এখনই তোমাকে সক্রিয় হতে বলছি না। তোমার মা সুস্থ হয়ে উঠুন।

অর্ক মাথা নাড়ল তারপর নির্মলের সঙ্গে বেরিয়ে এল। নির্মল বলল, শালাকে সেদিনই খতম করা যেত যদি ওই পুলিস অফিসারটা না বাঁচাত।

অর্ক নিচু গলায় বলল, কিন্তু কথা হল আমরা এতদিন কি করছিলাম! আমাদের দাদারা এত অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করছিল কেন?

মাল্লু। মালুর লোভে সব শালা চুপ করে ছিল। এখন পাবলিক খেপেছে বলে সব্বাইকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। কিন্তু কয়লা যখন ছাড়া পাবে তখন কি হবে তাই ভাবছি। শালা তো বদলা নেবেই। আর উত্তেজনা কমে গেলে পাবলিক ভেডুয়া হয়ে যায়। তদ্দিনে শান্তিকমিটি থাকলে হয়। নির্মল চিন্তিত হল।

আগেই খারাপটা ভাবছেন কেন? কয়লাকে আমরা এই এলাকায় ঢুকতে দেব না। মানুষ যদি আবার ভুল করে তাহলে তাদেরই ঠকতে হবে।

রাস্তা ফাঁকা। মাঝে মাঝে শান্তিকমিটির সদস্যদের লাঠির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। হঠাৎ অর্ক সচকিত হল। জড়ানো গলায় চিৎকার ভেসে আসছে সামনে থেকে। ওরা তখন তিন নম্বরের সামনে এসে পড়েছিল। সেই মাতালটি আসছে। টলতে টলতে কোনরকমে শরীরটা নিয়ে চলে আসছে তিন নম্বরে। অর্ক দেখল ওর বউ ঠিক একই ভঙ্গীতে বস্তির গলিতে দাঁড়িয়ে আছে স্বামীর অপেক্ষায়।

এরকম একটা দিনেও লোকটা মদ খেয়ে ফিরতে পারল? অর্ক অবাক হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল বেধড়ক পিটিয়ে লোকটাকে জ্ঞানে ফিরিয়ে আনার দরকার। কিন্তু তার আগেই ঘটনাটা ঘটে গেল। লোকটির বউ অর্ককে দেখে ছুটে এল। দুহাত জড়ো করে বলল, তোমার পায়ে পড়ি ওকে কিছু বলল না। আমরা আজ সারাদিন খাইনি। আর পাচ্ছি না।

বলতে বলতে বউটা কেঁদে ফেলল। অর্ক নির্মলের দিকে তাকাল। এবং ঝপ করে ওর সমস্ত উত্তেজনা থিতিয়ে গিয়ে অদ্ভুত ক্লান্তি ফিরে এল। নির্মলের কাছ থেকে ইশারায় বিদায় নিয়ে অর্ক গলিতে ঢুকে পড়ল।

আর একটা রাত অভুক্ত কাটল অর্কর। অভুক্ত এবং নির্ঘুম।

ওর কানে একটা কথাই বারংবার বাজছিল, আমরা আজ সারাদিন খাইনি। ঘুম আসছিল না তার। একটা কথা হঠাৎ তার মাথার মধ্যে চলকে উঠল। কয়লাদের পাড়া থেকে মেরে তাড়ানো হয়েছে শান্তির জন্যে। শুধু শান্তিতে কি হবে যদি মানুষ অভুক্ত থাকে?

এই যে বউটা আর তার বাচ্চাগুলো না খেয়ে আছে তার জন্যে দায়ী কে? ওই মাতালটা? তাহলে মাতালটাও সমাজবিরোধী। আবার মাতালটির যে যুক্তি তাতে আর একজনকে সমাজবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। বাইরের সমাজবিরোধীদের চোখে পড়ে, ভেতরের সমাজবিরোধীরা তো আরও মারাত্মক, কিন্তু তাদের কথা কেউ ভাবে না কেন?

৫৪. সকালে একবার চোখ মেলেছিল অর্ক

সকালে একবার চোখ মেলেছিল অর্ক। ছায়া ছায়া অন্ধকার সামনে। একটা আলোর ফুলকি যেন দ্রুত এগিয়ে এসে মিলিয়ে গেল আচমকা। তারপর আর খেয়াল নেই। মাঝরাতে কখন যে তার জ্বর এসেছে জানে না।

কিন্তু সারা রাত ধরে সে মাধবীলতাকে দেখে গেছে। মাধবীলতা তার সেবা করছে। মাথা ধুইয়ে দিচ্ছে, হাত বোলাচ্ছে কপালে। মাকে সব সময় কাছাকাছি পেয়ে একধরনের আরাম ওকে পেয়ে বসেছিল। ভোরে চেতনাটা স্বচ্ছ হতে হতে আবার যখন হারিয়ে গেল তখন চমৎকার এক জগতে চলে এল সে। সেখানে কোন ছায়াজড়ানো অন্ধকার নেই, কোনও আলোর ফুলকি নেই। নিরুপদ্রব। একটা ঢিলে শান্তি।

দরজায় ধাক্কা বাড়তে লাগল। সেই সঙ্গে চিৎকার, নাম ধরে ডাকা। অর্ক চোখ খুলল। যেন লেপ সরিয়েই সূর্যর মুখ দেখা। মাথার ভেতরে ঢং করে কিছু একটা বাজল। কনুই-এ ভর দিয়ে সে উঠে বসতেই প্রথম টের পেল, তার জ্বর হয়েছে। এবং রাত্রে যে জ্বরটা বেশ ছিল সেটাও বোঝা যাচ্ছে। হাতের তেলো, আঙ্গুল কেমন অসাড়, মাথার ভেতরটা ভীষণ ভারী। শূন্য ঘরে একটা চাপা আলো ছেটানো। আর কেউ নেই। এবং তখনই তার খেয়াল হল মা হাসপাতালে এবং সেখানে তার সকালেই যাওয়ার কথা ছিল। বাইরে তখনও শব্দ হচ্ছে, তার নাম ধরে ডাকছে অনেকে। অর্ক চোখ বন্ধ করে জিজ্ঞাসা করল, কে?

কি হয়েছে তোমার? দরজা খুলছ না কেন?

অর্ক পরমহংসকাকুর গলা চিনতে পারল। পরমহংসকাকু এখানে কেন? মুহূর্তেই মাথার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেল। সে লাফিয়ে উঠতে গিয়ে দেখল শরীর টলে যাচ্ছে, কোন রকমে খাটটা ধরে নিজেকে সামলালো। পরমহংস এখন আবার ডাকছে, কি হয়েছে অর্ক, অর্ক?

অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালো সে। তারপর কোন রকমে দরজার কাছে পৌঁছে খিল নামিয়ে দিতেই মনে হল চোখ পুড়ে যাবে, বাইরে কড়া রোদ।

অন্তত আট নয়জন বাইরে দাঁড়িয়ে। পরমহংস ঘরে ঢুকে ওর দিকে তাকাল, কি হয়েছে তোমার? জ্বর? কপালে হাত দিয়ে পরমহংস গম্ভীর হয়ে গেল, হুঁ, বেশ জ্বর আছে দেখছি। এসো, শুয়ে পড়ো, দাঁড়িয়ে থেকো না।

অর্ক মাথা নাড়ল, আমার তেমন কিছু হয়নি।

সে তো দেখতেই পাচ্ছি। শোবে এসো।

নিতান্ত অনিচ্ছায় অর্ক খাটে ফিরে এল। ওর ইচ্ছে করছিল স্বাভাবিক ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে কথা বলতে। কিন্তু সেটা যে সম্ভব হচ্ছিল না। পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, কি করে জ্বরটা বাধালে?

অর্ক ফ্যাকাশে হাসল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, হাসপাতালে গিয়েছিলেন?

পরমহংস মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। তারপরেই ঘুরে দাঁড়িয়ে, আপনাদের একজন কেউ ডাক্তার ডেকে আনতে পারবেন?

অর্ক তাকিয়ে দেখল ন্যাড়া দরজায়। এখন চোখ সয়ে নিয়েছে অনেকটা। মাথাটাও সামান্য হালকা লাগছে। সে বলল, ডাক্তার ডাকার দরকার নেই। একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।

কিন্তু তোমার এটা হল কি করে? একটু আগে শুনলাম কারা নাকি তোমাকে ছুরি মেরেছে?

হ্যাঁ।

মায়ের যখন এই অবস্থা তখন তুমি ঝামেলার মধ্যে যাও কেন? পরমহংস বিরক্ত হল, ওই উণ্ডের জন্যে জ্বর আসেনি তো?

অর্ক কাঁধে হাত দিল। না, তেমন ব্যথা লাগছে না। গতকাল হাসপাতালেও বলেছিল ছুরিটা বেশী দূর ঢোকেনি। এখন একটা চিনচিনে অনুভূতি ছাড়া কিছু নেই।

অর্ক বলল, না, তার জন্যে কিছু হয়নি।

পরমহংস বলল, ঠিক আছে, তোমার কি কি অসুবিধে হচ্ছে বল আমি ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলছি। তোমার তাড়াতাড়ি সেরে ওঠা দরকার এখন।

কেন? অর্কর খেয়াল হল পরমহংস তার প্রশ্ন তখন এড়িয়ে গিয়েছে। মা কেমন আছে বলেনি।

বাঃ, তোমার মা অসুস্থ আর তুমি পড়ে থাকলে চলবে?

মা কেমন আছে? পরমহংসর চোখের দিকে তাকাল অর্ক।

এ সময় কেমন থাকে নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারো। কি কি অসুবিধে বোধ করছ বল, আমি ডাক্তারখানায় যাচ্ছি।

আমার জন্যে ব্যস্ত হবেন না। আমি ঠিক আছি।

অদ্ভুত ব্যাপার! কাল রাত্রে কিছু খেয়েছিলে?

না।

চমৎকার। ঠিক আছে, তুমি বিশ্রাম নাও। আজকে তোমাকে হাসপাতালে যেতে হবে না। তেমন দরকার হলে আমি খবর দেব। আমি তোমার ওষুধ আর খাবার এনে দিচ্ছি। দয়া করে সেগুলো খেয়ো।

পরমহংসকাকু, মা কেমন আছে সত্যি করে বলুন।

বললাম তো, এখনও কিছু বলতে পারল না। এই সব সেন্টিমেন্টাল আদর্শবতী মেয়েরা চিরকাল পৃথিবীতে সাফার করে যাবে। ঠিক আছে, ওদিকটা আমি দেখছি। তুমি এখন শুয়ে পড়।

খানিক বাদে পরমহংস কয়েকটা জ্বরের ট্যাবলেট আর খানিকটা খাবার কিনে দিয়ে বলে গেল বিকেলে আবার আসবে। অর্ক যেন একটুও না ভাবে এ সব ব্যাপার নিয়ে।

দরজা থেকে ভিড়টা সরে গেলেও ন্যাড়া ছিল পাশে। খাটে শুয়ে ন্যাড়ার দিকে তাকাল অর্ক। ছেলেটা খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছিল। কয়েক মাসের মধ্যেই নিজেকে মাস্তান করে নেবার জন্যে প্রাণপণে চেষ্টা চালাচ্ছিল। কিন্তু এখন ওকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে। একটু নিষ্প্রভ, ভেঙ্গে পড়া ভাব।

অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কি খবর?

পাড়াটা মাইরি পাল্টি খেয়ে গেছে।

মানে?

কেউ আর রোয়াব নিচ্ছে না।

তোর অসুবিধে হচ্ছে?

দূর, নিজেকে কেমন ধূর মনে হচ্ছে। অকুদা, তুমি আমার একটা উপকার করে দেবে?

কি উপকার?

আমাকে শান্তি কমিটির ভলেন্টার করে দাও।

কেন?

তাহলে কাজ করতে পারি।

ওদের গিয়ে বল।

ওরা আমাকে নেবে না। বলছে বাচ্চাদের দরকার নেই। শালা, আমি কি বাচ্চা? তুমিই বল?

অর্ক চোখ বন্ধ করল, আমি ভাল হই তারপরে দেখব।

ন্যাড়া একটু ইতস্তত করে বলল, বিড়ি খাবে?

অর্ক ঘাড় নাড়ল।

ন্যাড়া আবার বলল, কোয়াদা হাওয়া হয়ে গিয়ে আমাকে ডুবিয়ে দিল।

কেন?

কোয়াদাই তো পয়সা দিত আমাকে।

অর্ক আর কিছু বলল না। ন্যাড়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার জিজ্ঞাসা করল, তোমার শরীর খারাপ লাগছে?

কেন?

খাবারগুলো খাবে?

দেখি।

না খেলে আমাকে ডেকো। বলে ন্যাড়া বেরিয়ে গেল।

অর্ক চুপচাপ পড়ে রইল। ওর হঠাৎ মনে হল, ভারতবর্ষে তিন শ্রেণীর মানুষ ভালভাবে বেঁচে থাকে। এক, যাদের প্রচুর টাকা আছে, যা ইচ্ছে প্রয়োজনে কিনে নিতে পারে। দুই, যারা শিক্ষিত এবং শিক্ষাটাকে বুদ্ধিমানের মত ব্যবহার করে সমাজে ঠাঁই করে নিতে পেরেছে। তিন, কয়লার মত মাস্তানরা, যারা যে-কোন জায়গায় যেতে পারে, যাদের অনেকের প্রয়োজন হয়।

আজকের ন্যাড়া যাদের বিদ্যা নেই, অর্থ নেই তারা এই তৃতীয় পথটাকে বেছে নিতে চাইছে বেঁচে থাকার রাস্তাটা খুঁজে পাওয়ার জন্য। তাই একজন কয়লা চলে গেলে দশজন কয়লা তার জায়গা নেবে। মহাভারত না রামায়ণ কোথায় যেন গল্প আছে, একটা রাক্ষসের মাথা কাটামাত্র দশটা মাথা গজিয়ে উঠত। সেই রকম সমাজবিরোধীদের দূর করা সম্ভব নয়। এরা থেকেই যাবে। হঠাৎ তার মনে হল, যদি প্রথম দলটাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া যেত তাহলে বোধ হয় তৃতীয় দলটা আর জন্মাত না। কারণ, প্রথম দলের টাকার ওপর তৃতীয় দল এত রোয়াবি দেখিয়ে বেড়ায়।

.

ঘুম ভাঙ্গতেই অর্কর মনে পড়ল তার জ্বর হয়েছিল। এখন ভরদুপুর। সকালে ন্যাড়া চলে যাওয়ার পর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে জানে না। এখন প্রচণ্ড খিদে এবং অবসাদ, শরীরের উত্তাপ সাধারণ। এই সময় দরজায় শব্দ হতেই ও চোখ খুলল। পাল্লা একটু একটু করে উন্মুক্ত হয়েই বন্ধ হল। দরজায় দাঁড়িয়ে ঝুমকি। ঝুমকির মুখ চোখ এবং দাঁড়াবার ভঙ্গীতে এমন একটা চোর চোর ভাব যে অর্ক বিছানায় উঠে বসল।

তোমার জ্বর হয়েছে? ঝুমকির গলা কাঁপছে।

ও কিছু না। কি ব্যাপার?

তোমাকে দেখতে এলাম।

কেন?

বাঃ, কারো অসুখ করলে দেখতে আসব না? ঝুমকি আবার বন্ধ দরজার দিকে তাকাল। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে এল টেবিলটার দিকে, এ কী,এই সব খাবার পড়ে আছে কেন? খাওনি?

অর্ক মুখ ফিরিয়ে খাবারগুলো দেখতেই ওর খিদেটা প্রবলতর হল। কিন্তু তার আগে মুখ ধোওয়া দরকার। কাল দুপুরে বালতিতে জল আনা হয়েছিল। সেটার জন্যে অর্ক বিছানা থেকে নামতে যেতেই ঝুমকি হাঁ হাঁ করে ছুটে এল, ওমা, জ্বর গায়ে নামছ কেন?

জ্বর নেই এখন, মুখ ধোব।

দেখি কপালটা। হুম, জ্বর নেই কিন্তু ছ্যাঁক ছ্যাঁক করছে। তোমাকে নামতে হবে না আমি জল এনে দিচ্ছি। ওই বালতিতে জল আছে, না?

অর্ক হাত নাড়ল, আমি নিজেই নিতে পারব।

কয়েক পা হাঁটতে গিয়ে মাথার ভেতরটা যেন টলমলে হয়ে গেল। বালতি থেকে এক মগ জল নিয়ে দরজা খুলে বাইরে গিয়ে মুখ ধুচ্ছিল অর্ক। ওপাশ থেকে অনুপমা জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছ?

অর্ক ঘাড় নেড়ে ভাল বলল। তারপর ঘরে ফিরে আসতেই ঝুমকি ইশারা করতে লাগল দরজাটা বন্ধ করে দিতে। অর্ক অবাক হয়ে নীরবেই প্রশ্ন করল, কেন? কিন্তু ঝুমকি বারংবার বলায় তার হাত পাল্লা দুটো টেনে দিল।

এবার হাসি ফুটল ঝুমকির মুখে, আমি তো খারাপ মেয়ে, আমি যদি তোমার ঘরে আসি তাহলে লোকে বদনাম করবে তোমার।

অর্কর মনে পড়ল সেদিন এই রকম কথা বলেছিল সে ঝুমকিকে, আজ ও এটা ফিরিয়ে দিল। তবে কথাটা এরকম হয়েও ঠিক এ রকম ছিল না।

তাহলে এলে কেন?

না এসে পারলাম না।

কেন?

তোমার অসুখ হয়েছে শুনলাম, তাই।

এসেছ যখন তখন এত চোরের মত এলে কেন?

লোকে আমাকে নিয়ে খারাপ ভাবতে ভালবাসে। তুমি তো এখন হিরো, কয়লার লোক ছুরি মেরেছে, সমাজবিরোধী তাড়াচ্ছো, আমি এলে তোমার বদনাম হবে।

তুমি খারাপ মেয়ে হলে তোমাকেও তো তাড়াতে হয়।

তার মানে?

সমাজবিরোধী মানে শুধু গুণ্ডা বদমাস মাস্তান নয় সমাজের যারা ক্ষতি করে তারা সবাই। তুমি যদি খারাপ মেয়ে হও তাহলে তুমি নিশ্চয়ই সমাজের ক্ষতি করছ।

ঝুমকি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর বলল, যারা খারাপ মেয়েদের সঙ্গে খারাপ কাজ করতে যায়, তারা?

অর্ক মাথা নাড়ল, তারাও।

যারা ঘুষ নেয়?

ঘুষ? সঙ্গে সঙ্গে অর্কর চোখের সামনে সেদিনের সেই পুলিসটার চেহারা ভেসে উঠল। লোকটা তো প্রকাশ্যেই হাত বাড়িয়ে ঘুষ নেয়। যারা ঘুষ নেয় তারা যদি সমাজবিরোধী হয় তাহলে সেই পুলিসও সমাজবিরোধী। যে পুলিস অফিসার কয়লাকে আড়াল করতে চেয়েছিল সে-ও সমাজবিরোধী। এ পাড়ার মিত্তিরবাবু সরকারি অফিসে কেরানির কাজ করে নাকি বেশ ঘুষ নেন। তিনিও সমাজবিরোধীদের লিস্টে উঠে যাবেন। অর্কর মাথাটা অপরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সে মুখে বলল, হ্যাঁ।

কিন্তু আমি তো আর ক্যাবারে নাচতে যাই না। এক মাসের ওপর তৃষ্ণাদির ফ্ল্যাটে যাই নি। তবু আমি খারাপ মেয়ে হব?

এ সব বন্ধ করলে কেন?

অনেক পরে বুঝলাম আমার দ্বারা ক্যাবারে হবে না।

কেন?

সে তোমাকে বোঝাতে পারব না।

বাড়িতেই থাক?

না।

তাহলে?

ম্যাসেজ করি।

ম্যাসেজ?

হ্যাঁ। বড়লোকের বউদের। মাসে চারদিন গেলে একশ টাকা পাওয়া যায়। এইটে অবশ্য তৃষ্ণাদি শিখিয়ে দিয়েছে। আর এই লাইনে কাজ খুব।

অর্ক খাবারের প্যাকেটটা হাতে নিল, তুমি খাবে?

না।

আমার খিদে পেয়েছে, খাচ্ছি।

নিশ্চয়ই। ঝুমকি দরজার দিকে তাকাল, এবার আমি যাই।

অর্ক হাসল, এলেই বা কেন আর যাচ্ছই বা কেন?

থাকতে তো বলছ না। ঝুমকি মাথা নাড়ল, আমাকে এখন গড়িয়ায় যেতে হবে।

গড়িয়া? সে তো অনেক দূর।

হুঁ। সেখানে একটা বউকে ম্যাসেজ করতে হবে।

এসব কাজ কি ভালো?

ভালো? কারও শরীর টিপতে কি ভাল লাগে? কিন্তু বাড়িতে অভাব হাঁ করে বসে আছে। এখন আমি না যেতে চাইলে মা জোর করে পাঠায়। আচ্ছা, আমার শরীরটা কি খুব খারাপ?

মানে? অর্ক হতভম্ব হয়ে ঝুমকিকে দেখল। বেশ স্বাস্থ্যবতী মেয়ে।

এই শরীর দেখেও তো কেউ বলতে পারত, এসো মন্ত্র পড়ে বিয়ে করি তোমাকে। ফুর্তি লোটা ছাড়া আমাকে দেখে কেউ কিছু ভাবতে পারে না কেন?

তোমার বিয়ে করার খুব ইচ্ছে, না?

আমার মত মেয়ের বাঁচার তো কোন আশা নেই, ওই ইচ্ছেটুকু সম্বল।

কথাগুলো বলতে বলতে যেন সচেতন হল ঝুমকি। অর্কর মুখের দিকে ভাল করে তাকিয়ে বলল, তোমার কথাবার্তা আজকাল অন্যরকম হয়ে গেছে।

কি রকম?

কেমন বয়স্ক ভদ্রলোকের মতন। বস্তির রকের ছোঁড়াদের মত কথা আর বলো না। এত জলদি কিভাবে পাল্টালে গো?

গো শব্দটা শুনে অর্কর কেমন অস্বস্তি হল। ঝুমকির শব্দটায় যেন কিলবিলে কিছু মেশানো ছিল। সে বলল, তুমি এবার যাও, আমি ঘুমুবো।

ঘুম পাড়িয়ে দেব? চোখের কোণে হাসল ঝুমকি

এসব ইয়ার্কি আর ভাল লাগে না।

কি কি ইয়ার্কি ভাল লাগে?

কি আজে বাজে বকছ। আমাকে এখন একটু একা থাকতে দাও।

ঝুমকি মাথা নাড়ল। তারপর দরজার দিকে যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়াল, তুমি তো ভদ্রলোকের ছেলে, ভগবানের অভিশাপে এই বস্তিতে আছ। তোমার সঙ্গে আমার কোন মিল নেই। কিন্তু তুমি আমার উপকার করেছ, তাই দেখতে আসি।

অর্ক কোন উত্তর দিল না। ঝুমকির গলা যেন বদলে গেছে আচমকা। ঝুমকি এবার খুব নিচু স্বরে বলল, তুমি আমার একটা কথা রাখবে?

কি কথা?

বল রাখবে!

আশ্চর্য। কথাটা না শুনলে রাখব কিনা বলতে পারি?

কোন কোন সময় অত না ভাবলেও তো চলে।

বেশ বল, কি কথা।

আমি তোমাকে আর কখনও বিরক্ত করব না। আমি জানি এভাবে এলে তোমার খুব অস্বস্তি হয়। বেশ, কথা দিচ্ছি, আমি আর আসব না।

অর্ক বলল, কিন্তু আমাকে কি কথা রাখতে হবে?

ঝুমকি হঠাৎ চোখ বন্ধ করল। অর্কর মনে হল ওর শরীরটা কেঁপে উঠল যেন। তারপর সেই অবস্থায় মাথা নেড়ে বলল, না, কোন কথা রাখতে হবে না।

ঝুমকির নীরবে চলে যাওয়া অর্ককে খুব একটা নাড়ালো না। শুধু মনে হল, মেয়েটা অদ্ভুত। ওর খেয়াল হল, ঝুমকি ঘরে এসে একবারও মায়ের খবর নেয়নি। মাধবীলতা কেমন আছে এই প্রশ্নটা যেখানে খুব সামান্য চেনা মানুষ দেখা হলে করছে সেখানে ঝুমকি এ ব্যাপারে কোন কথাই জিজ্ঞাসা করল না। ও যেন সব সময় নিজেকে নিয়েই থাকে। ঝুমকির মুখ চোখ মনে করে অর্কর মনে। কেমন একটা অনুভব জন্ম নিল এই মুহূর্তে। আজকে মেয়েটা হাবেভাবে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছে সে ওকে ভালবাসে। বিলু যাকে বলে মহব্বত।

যাচ্চলে! মেয়েটা আর জায়গা পেল না। ও বোধহয় জানে না তার ঠিকঠাক বয়স কত। ঝুমকি নিঃসন্দেহে তার চেয়ে বয়সে বড়। আর এটা ভাবতেই ওর মনে ঊর্মিমালার মুখ ভেসে উঠল। ঊর্মিমালা যদি ঝুমকির মত ব্যবহার করত! অসম্ভব। ঊর্মিমালারা চিরকাল অন্য ছেলের সঙ্গে মাথা উঁচু করে হেঁটে যাবে।

ঊর্মিমালাকে সে চাইতে পারে না। কি আছে তার! বিদ্যে নেই, অর্থ নেই এবং জন্মটাই তো প্রহেলিকায় জড়ানো। অর্ক, তোমার বাবার নাম কি? কে তোমার বাবা? কার কাছে তুমি ঋণবদ্ধ? কার উত্তরাধিকারিত্ব নিয়ে তুমি পৃথিবীতে এসেছ? এই জন্মে তুমি তোমার পূর্বপুরুষের কাছে কি পেয়েছ? কি নিয়ে এগোবে?

কেউ তোমাকে কিছু দেয়নি। এই পৃথিবীতে তুমি না এলে কারো কোন ক্ষতি হতো না। বিন্দুমাত্র না। ঊর্মিমালারা তাই তোমাদের কাছ থেকে ক্রমশ দূরে সরে সরে যাবে। আর ওরা যত দূরে যাবে তত মিস ডি হতে চাওয়া বয়স্কা মেয়েরা এগিয়ে আসবে।

অর্ক চিৎকার করে উঠল, দূর শালা। কাউকে কেয়ার করি না আমি। কারো কাছে কিছু চাই না। যেন সামনে অনেক সুখহীন মানুষ দাঁড়িয়ে।

তারপর পড়ন্ত দুপুরে বেরিয়ে পড়ল সে রাস্তায়। ওর শরীরের তাপ তখন কমে এলেও কেমন একটা জ্বলুনিতে ছটফট করছিল সে।

একটা ঘোরের মধ্যে ঈশ্বরপুকুর লেন দিয়ে বেরিয়ে এল অর্ক। ঠিক মোড়ের মাথায় আসতেই ও চমকে উঠল। একটা লোক ক্রাচ বগলে নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। বাবা! বুকের মধ্যে ধক করে উঠতেই ও হেসে ফেলল। কে বাবা? কার বাবা? আমার কোন বাবা নেই।

লোকটা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়েই খেপে গেল, এই যে ভাই, হাসছ কেন? খোঁড়া বলে খুব হাসা হচ্ছে?

অর্ক মাথা নাড়ল, তারপর জিজ্ঞাসা করল, আপনার ছেলের নাম কি?

ছেলে? লোকটা হতভম্ব, আমি বিয়েই করিনি তো ছেলে আসবে কোত্থেকে!

৫৫. ট্রামে উঠেই মাথা গরম

ট্রামে উঠেই মাথা গরম হয়ে গেল অর্কর। চারজন লোক বসেছিল সামনে, কণ্ডাক্টর টিকিট চাইতেই তারা চোখ মটকে হাসল। কণ্ডাক্টর দ্বিতীয়বার চাইতেই একজন বলল, পরে দেব, বুঝতে পারছেন না?

কোথায় যাবেন?

এসপ্লানেড।

এক টাকা দিন। তবে চেকার উঠলে টিকিট কাটতে হবে।

এক টাকা কেন? ফিফটি ফিফটি করুন। আশি পয়সা। নামবার আগে দিয়ে যাব। লোকটা দাঁত বের করে হাসতে কণ্ডাক্টর সরে এল অর্কর সামনে, টিকিট!

অর্ক লোকটার দিকে তাকাল। বছর তিরিশের নিরীহ চেহারা। যে চারটে লোকের কাছ থেকে ও ফিরে এল তাদের বয়স চল্লিশের মধ্যে। কণ্ডাক্টর বিরক্ত গলায় বলল, কোথায় যাবেন?

অর্ক চোখে চোখ রাখল, ওদের কাছ থেকে টিকিট নিলেন না কেন? কেমন থতমত হয়ে গেল কণ্ডাক্টর। প্রশ্নটা বেশ জোরে হওয়ায় ট্রামের অন্য লোকগুলো এদিকে তাকিয়েছে। সেই চারজনও অনেকটা অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে অর্ককে দেখছে। শেষ পর্যন্ত কণ্ডাক্টর বলল, আপনার টিকিট করুন, ওসব নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই।

বেলগাছিয়া ব্রিজের ওপর দিয়ে হু হু করে ট্রাম ছুটছিল। এক্ষুনি আর জি কর এসে যাবে। অর্কর রাগ আরও বাড়ছিল, চমৎকার, আপনি প্রকাশ্যে পয়সা খাচ্ছেন, ট্রাম কোম্পানিকে ঠকাচ্ছেন আর কিছু বলা যাবে না?

এবার লোকটা প্রতিরোধ শক্তি হারিয়ে ফেলল। অর্ক অন্য যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে বলল, এই লোকটিকে চিনে রাখুন। এ সমাজবিরোধী। ঘুষ নিয়ে ট্রামের লোকসান বাড়াচ্ছে। আর ওই চারজনও তাই। ভদ্রলোকের চেহারা নিয়ে হাফ টিকিটে বেড়াতে যাচ্ছে।

সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে রব উঠল, ঠিক বলেছে। এই জন্যে টিকিটের দাম বাড়ে। এদের ধরে পুলিসের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। আরে মশাই, কাকে বলবেন? সবখানেই তো দুনম্বরী ব্যাপার। মরালিটি শব্দটা এখন উঠে গেছে। পঁয়ত্রিশ পয়সা এগিয়ে দিতেই কণ্ডাক্টর টিকিট ছিঁড়ে দিল। ওর মুখ শুকিয়ে গেছে। আর জি কর আসতেই কণ্ডাক্টর ফিরে গেল চারজনের কাছে, টিকিট দিন। আপনাদের জন্যে বেইজ্জত হতে হল।

ট্রাম থেকে নেমে পড়ল অর্ক। পাঁচটা সমাজবিরোধীকে নিয়ে এক নম্বর ট্রামটা এসপ্লানেডের দিকে চলে গেল। অর্ক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল সেই ট্রাফিক পুলিসটা আজ দাঁড়িয়ে নেই। আর একটা সমাজবিরোধী। তবে তার জায়গায় যে দাঁড়িয়ে তাকে দেখতে অনেকটা আগের লোকটার মতনই।

এখনও বোধ হয় ভিজিটিং আওয়ার্স শুরু হয়নি। কিন্তু এর মধ্যে চত্বরে বেশ ভিড় জমেছে। পিচের পথটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অর্ক বুঝতে পারল তার শরীরটা যতটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল বলে মনে হয়েছিল ততটা হয়নি। মাথার ভেতরে দপদপানি শুরু হয়েছে, গা গোলাচ্ছে, জিভে তিকুটে স্বাদ।

খানিকটা এগোতেই মাথাটা এমন ঘুরে গেল যে অর্ক হাসপাতালের বারান্দায় বসে পড়ল পা ঝুলিয়ে। তার এখন জ্বর নেই কিন্তু শরীরে সামান্য শক্তি অবশিষ্ট নেই। অর্ক অলস চোখে হাসপাতাল বাড়িটার দিকে তাকাল। এটাও তো একটা দু’নম্বরের আড়ত। তোমার ন্যায্য পাওনা তুমি পাবে না। অথচ ধরার লোক আর পকেটে টাকা থাকলে সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। আর এই হাসপাতালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অর্কর মনে বিলাস সোমের মুখটা ভেসে উঠল। লোকটা এক নম্বর না দুনম্বর ছিল সেটা বোঝা বড় গোলমেলে।

মিনিট দশেক বসে থাকার পর একটু আরাম হল। অর্ক খানিকটা এগোতেই কোয়া এবং বিলুকে দেখতে পেল। ওদের চেহারা একদিনেই বেশ জীর্ণ হয়েছে। দুজনে একটা সিঁড়িতে বসে ছিল। ওকে দেখেই তড়াক করে উঠে এল।

বিলু জিজ্ঞাসা করল, তোমার নাকি জ্বর হয়েছে খুব?

কে বলল?

ওই ন্যাটা লোকটা। তোমাদের বোধ হয় আত্মীয় হয়।

পরমহংস কাকুর সঠিক পরিচয় পেয়ে হাসল অর্ক। তারপর মাথা নাড়ল, ওঁকে দেখেছিস তোরা?

বিলু বলল, না। এ বেলায় দেখিনি। বারোটা একটা অবধি ছিল।

কেন? অর্ক বুঝতে পারল না অত বেলা পর্যন্ত পরমহংসকাকু কেন থাকবে?

তোমার মায়ের কেসটা বোধ হয় ভাল নয়।

সঙ্গে সঙ্গে অর্কর বুকের ভেতরটা অসাড় হয়ে গেল। সে সাদা চোখে হাসপাতাল বাড়ির দিকে তাকাল। ভিজিটিং আওয়ার্স শুরু হয়েছে। লোকজন ভেতরে ঢুকছে। মাকে কি বিছানায় আনা হয়েছে? অর্ক আর দাঁড়াল না। কোয়াদের সেখানেই রেখে ও হাসপাতালের বারান্দায় উঠে এল। গেটে যে দারোয়ানটা থাকে সে এর মধ্যেই বোধ হয় অর্ককে চিনে গিয়েছে। কারণ কখনই কোন প্রতিরোধের সামনে দাঁড়াতে হয়নি অর্ককে ঢোকার সময়ে। ওষুধের বিটকেল গন্ধে ডুবে ডুবে অর্ক মাধবীলতার বিছানার সামনে এসে অবাক হয়ে গেল। একটি বিশাল চেহারার মহিলা বাবু হয়ে বসে ছানা খাচ্ছেন।

অর্ক অসহায় চোখে তাকাল চারপাশে। দেখতে আসা মানুষেরা যেন মেলা বসিয়েছে চারধারে। কিন্তু মাধবীলতা নেই। তার মানে অপারেশনের পর মাধবীলতাকে আর বিছানায় ফিরিয়ে আনা হয়নি।

অর্ক বাইরে বেরিয়ে এল। গেটের বাইরে তখন পরমহংস আর সৌদামিনী দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে পরমহংস এগিয়ে গেল, তোমার শরীর এখন কেমন আছে?

ভাল। মা–?

পরমহংস আড়চোখে সৌদামিনীর দিকে তাকাল। সৌদামিনীর মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই। অর্কর বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল। সে আবার প্রশ্ন করল, মায়ের কি কিছু হয়েছে?

সৌদামিনী এবার কথা বললেন। ওঁর ঠোঁট সামান্য নড়লেও শব্দগুলো ঠিকঠাক বেরিয়ে এল, আমাদের এখন যে কোন পরিস্থিতির জন্যে তৈরি হতে হবে।

মানে?

এটা তো খুবই সরল। মেয়েটা সারাজীবনে তোমাদের জন্যে এত রক্ত দিয়েছে যে আজকে নিজের জন্যে লড়াই করার শক্তিটুকুও নেই।

হঠাৎ অর্কর মনে হল সৌদামিনী যেন আঙ্গুল তুলে বলছেন, তুমি এবং তোমরা মাধবীলতার মৃত্যুর জন্যে দায়ী হবে।

দুহাতে মুখ ঢাকল অর্ক। ওর সমস্ত শরীর কাঁপছিল। মা না থাকলে পৃথিবীটার চেহারা যে অন্যরকম হয়ে যাবে। কাঁধে হাত রাখল পরমহংস, ভেঙ্গে পড়ো না। ওকে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। বড় দুর্বল হয়ে পড়েছে। একবার সেন্স আসতেই অনিমেষের নাম ধরে ডেকেছিল।

অর্ক ঠোঁট কামড়ালো। সে জিজ্ঞাসা করল, ডাক্তারবাবু কি হাসপাতালে আছেন?

হ্যাঁ। মিসেস সেনগুপ্তা ওঁকে বাড়ি থেকে তুলে এনেছেন। এখন ওঁর হাসপাতালে আসার কথা নয়।

আমি ওঁর সঙ্গে দেখা করব।

অর্ক আর দাঁড়াল না। পথে কয়েকটা বাধা পেলেও ও একরোখা ভাব দেখিয়ে ডাক্তারের মুখোমুখি হয়ে গেল। ডাক্তার তখন নিজের ছোট্ট ঘরটিতে চোখ বন্ধ করে বসে ছিলেন। ভদ্রলোককে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল।

অর্ক সামনে দাঁড়াতেই ডাক্তার চোখ খুললেন, কি চাই?

আপনার সঙ্গে একটু কথা বলব।

এখানে কে আসতে দিল?

কেউ দেয়নি, আমি এসেছি। ডাক্তারবাবু, আমার মা বাঁচবে না?

কে তোমার মা?

মাধবীলতা, যার অপারেশন আপনি করেছেন।

ও। হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। ডাক্তারবাবু অর্ককে আর একবার দেখলেন, আমার পক্ষে যা করা সম্ভব আমি সব করেছি। এখন ভগবানই ভরসা।

মায়ের কি হয়েছে?

অনেক কিছু, তুমি বুঝবে না। তবে মোটামুটি জানো, ওঁর পেটে অনেকটা ঘা হয়ে গিয়েছিল। ওপেন করে আমি হতভম্ব হয়ে গেছি। এটা অনেকদিনের ব্যাপার। জেনেশুনে আত্মহত্যা করা হচ্ছিল। এ কথাগুলো বলতে বলতে ডাক্তারবাবুর যেন খেয়াল হল, তোমাকে সৌদামিনী সেনগুপ্তা কিছু বলেননি?

না। ডাক্তারবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন, তোমার বাবা এসেছেন?

বাবা?

হ্যাঁ, শুনলাম ওঁকে টেলিগ্রাম করা হয়েছে, এসেছেন?

অর্ক কথা বলল না কিন্তু শক্ত মুখে মাথা নাড়ল। ডাক্তার আবার জিজ্ঞাসা করলেন, হু ইজ অনি?

কেন?

যখনই সেন্স আসছে তখনই অনি শব্দটা ওর মুখে শোনা গেছে। তোমার নাম কি অনি?

অর্ক নিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আবার মাথা নাড়ল। খানিক আগে পরমহংসকাকু যখন ওই কথা বলেছিল ও বিশ্বাস করেনি। মা এখন বাবার কথা মনে করছে? পৃথিবীতে সবচেয়ে মায়ের কে আপন তা তো জানাই হয়ে গেল। তাহলে মা কেন চলে এল বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে? কেন তার পরিচয়ের ওপর কালি ছিটিয়ে দিল? যে মানুষটাকে খবর পাঠাতে নিষেধ করেছে বারংবার সেই মানুষের নাম ধরে ডাকছে চেতনা ফিরলেই?

মায়ের ওপর তীব্র অভিমান অর্কর মনে জন্ম নিল। মা তার কথা একবারও ভাবল না? এই সময় তো প্রিয়জনের মুখ মনে পড়ে, সে কি মায়ের প্রিয়জন নয়? অর্কর বুকের ভেতর যেন ভাঙ্গচুর চলছিল।

এই সময় আর একজন লোক ডাক্তারের সামনে দাঁড়াতেই তিনি নরম গলায় বললেন, মন শক্ত করো আর ভগবানকে ডাকো। তিনি আছেন বলেই পৃথিবীতে এখনও মির‍্যাকল ঘটে।

আমি একবার ওঁকে দেখতে পারি?

চোখ বড় হয়ে গেল ডাক্তারের, ইম্পসিবল।

একবার দেখব, একটুখানি। মাকে একবার দেখতে দিন।

ভেতরে যেতে দেব না আমি। বাইরে থেকে দেখতে পারো। একটা বেয়ারা গোছের লোককে ডেকে নির্দেশ দিতে সে অর্ককে নিয়ে গেল অনেকটা পথ হাঁটিয়ে বিশেষ ঘরের সামনে। তারপর বলল, ওই জানলা দিয়ে দেখুন।

জানলাটি কাঁচের। ভেতরটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ঘরের ভেতর গোটা চারেক খাটে অসুস্থ মানুষেরা শুয়ে আছে। তাদের মুখে নাকে হাতে নানারকমের নল আটকানো। কিন্তু কাউকেই আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না, প্রত্যেকটা শরীর সাদা চাঁদরের আড়ালে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। অসুস্থ মানুষদের চেহারা এক রকম হয়?

অর্ক চেষ্টা করেও মাধবীলতাকে খুঁজে বের করতে পারল না।

দুটো পা যেন ভীষণ ভারী, হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল অর্কর। ডাক্তার তো বলেই দিলেন তাঁর আর কিছুই করার নেই, এখন ভগবানই ভরসা। বিজ্ঞান কি কখনো ঈশ্বরকে বিশ্বাস করে? তাহলে এ কেমন ডাক্তার? ডাক্তার বললেন, পেট ওপেন করে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। মায়ের পেটের মধ্যে কি ছিল? যদি কিছু খারাপ হয়ে থাকে সেটা কি পাল্টানো যায় না? যদি তার পেটের যন্ত্রপাতি খুলে মায়ের পেটে লাগিয়ে দেওয়া যায়? অর্ক কেঁদে ফেলল। সে বুঝতে পারছিল যখন একজন ডাক্তার ঈশ্বরের ওপর নির্ভর করতে বলেন তখন বিজ্ঞানের করার কিছু থাকে না।

এবং তখনই তার মনে দ্বিতীয় চিন্তার উদয় হল। মা এই সময়েও অর্ক বলে ডাকেনি। মায়ের মনের কোথাও সে নেই। যাকে মানুষ প্রচণ্ড ভালবাসে একমাত্র তার কথাই এই মুহূর্তে মনে পড়ে। মায়ের সঙ্গে বাবার ঝগড়া, সম্পর্ক ত্যাগ–এসবই তাহলে বানানো। আসলে মা যাকে ভালবাসতো তাকেই ভালবেসে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে তো মা অন্যরকম শিখিয়েছিল। না, মা তাকে বাবার বিরুদ্ধে কোনদিন কোন কথা বলেনি। তার মন বিষাক্ত করার কোন চেষ্টা করেনি। কিন্তু সে তো বাবাকে মানতে পারেনি। তার চেতনায় মা এবং বাবা সেই রাত্রে যে নোংরা জল ছুঁড়ে দিয়েছিল তা থেকে তো সারাজীবন মুক্তি নেই। এই সময় ভেবেছিল মা এবং সে পরস্পর পরস্পরের আশ্রয়। আজ বোঝা গেল সবই ভুল। আর এই প্রথম অর্ক অনিমেষকে হিংসে করতে লাগল। এবং অকস্মাৎ একটা নির্লিপ্তি তাকে গ্রাস করল। অর্ক চোখের জল মুছল কিন্তু সবকিছু সাদা হয়ে রইল তার চারপাশে।

বারান্দায় আসতেই নীপা মিত্র তাকে জিজ্ঞাসা করল, ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল তোমার?

মাথা নাড়ল অর্ক, হ্যাঁ।

আমি বিশ্বাস করি না তোমার মা চলে যাবে।

কে বলেছে চলে যাবে?

নীপা মিত্র যেন হোঁচট খেল। তারপর অন্য রকম গলায় জিজ্ঞাসা করল, কেন, ডাক্তারবাবু তোমায় কিছু বলেনি?

সেরকম কিছু বলেননি। শুধু ভগবানকে ডাকতে বললেন।

হ্যাঁ। ভগবানকে ডাকলে সব হয়। তুমি আমার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে যাবে?

কেন?

নীপা মিত্র হতাশ চোখে তাকাল অর্কর দিকে। অর্কর ঠোঁটে তখন হাসি, মা বলেছে ভগবানের কোন বাড়ি নেই। দক্ষিণেশ্বরে গেলেই ভগবানকে পাওয়া যাবে না। আর মা তো ঠাকুর দেবতা–।

ঠিক সেই সময় সৌদামিনী এগিয়ে এলেন, অর্ক, এখন তো ঈশ্বরকে ডাকা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই।

অর্ক বলল, হ্যাঁ, তাই উনি দক্ষিণেশ্বরের কথা বলছিলেন।

সৌদামিনী নীপা মিত্রকে দেখলেন, এ ব্যাপারে আমি কারো ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত করতে চাই না। আমি শুধু ঈশ্বরকে ডাকার কথাই বলতে পারি।

পরমহংস উঠে এসেছিল কাছে। বলল, একবার ডক্টর চক্রবর্তীর কাছে গেলে হতো না? শুনেছি উনি নাকি এ ব্যাপারে কিছু কিছু সাফল্য পেয়েছেন।

সৌদামিনী বললেন, অ্যালাপাথি থেকে হোমিওপাথিতে শিফট করতে গেলে, দাঁড়ান, আগে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলি।

দূরে একটা রিকশা আসছিল। রিকশাকে ঘিরে বেশ ভিড় এগিয়ে আসছে আউটডোরের দিকে। রিকশার ওপরে একটি এলিয়ে পড়া মানুষকে ধরে বসে আছে নিমু চাঅলা। অর্ককে দেখামাত্র ঈশ্বরপুকুরের কয়েকজন উত্তেজিত অবস্থায় ছুটে এল। তারা জানাল, কয়লার ছেলেরা চোরাগোপ্তা আক্রমণ করছে। একটু আগে শ্যামবাজারের মোড়ে হরেন ড্রাইভারের ছেলেকে ধরে কুপিয়েছে। নিমু চাঅলা একজনকে নিয়ে ওই সময় শ্যামবাজারে গিয়েছিল বলে ওরা প্রাণে মারতে পারেনি। আজকের কয়লার বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হবে বদলা হিসেবে। এরা সবাই আজ আদালতে গিয়েছিল। সেখানে কয়লাকে বিচারকের সামনে উপস্থিত করা হয়েছিল। কয়লাকে দেখতে বিরাট জনতা উপচে পড়েছিল সেখানে। সবাই কয়লাকে ছিঁড়ে ফেলতে চায়। আজ কয়লা জামিন পায়নি। কয়লার বড় বড় সঙ্গীরা হয় ধরা পড়ছে নয় ধরা দিচ্ছে। ফেরার পথে ওরা দেখতে পায় নিমু চাঅলা আহতকে নিয়ে রিকশায় আসছে।

শুনতে শুনতে অর্কর মনে পড়ল কোয়া এবং বিলু এতক্ষণ এখানেই ছিল। গতকাল মায়ের জন্যে ওরা রক্ত দিয়েছে। প্রয়োজন হলে ওরা আজও রক্ত দেবে। কিন্তু সেই সঙ্গে ওরা জানতে এসেছিল অর্ক তাদের জন্যে কিছু করতে পেরেছে কিনা। যে সমাজবিরোধী একটু আগে ছুরি মেরেছে, যে সমাজবিরোধী ট্রামে টিকিট কাটে না বা ঘুষ নেয়, যে সমাজবিরোধী সাদা পাশাক পরে চৌমাথায় দাঁড়িয়ে লরির ড্রাইভারের কাছে ঘুষ খায় বিলু এবং কোয়া সেই সমাজবিরোধীদের সঙ্গে এক শ্রেণীতে পড়ে না। তবু ওদের জানানো দরকার শুদ্ধির জন্যে একবার থানায় যেতে হবে। একবার থানা থেকে না ঘুরে এলে পাড়ার মানুষ ওদের গ্রহণ করতে পারবে না। আহতকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু কোয়া এবং বিলুকে আশেপাশে কোথাও দেখতে পেল না অর্ক। এই ভিড় দেখেই বোধ হয় ওরা আড়ালে চলে গিয়েছে।

কিন্তু এসব ব্যাপারে আর উৎসাহ পাচ্ছিল না অর্ক। ভিড় সরে গেলে সৌদামিনী বললেন, তোমাদের পাড়াটা খুব খারাপ, কাগজে পড়লাম।

কাগজে লিখেছে?

হ্যাঁ। একজন সমাজবিরোধী নাকি দলবল নিয়ে খুব অত্যাচার করত। পাড়ার লোকরা একজোট হয়ে তাকে পুলিসের কাছে তুলে দিয়েছে।

পরমহংস বলল, আমি পড়েছি খবরটা। এই ধরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে অর্ক একজন নায়ক। ওর পিঠে বোধ হয় এখনও ব্যাণ্ডেজ আছে, ছুরির।

সৌদামিনী বললেন, সে কি! তুমি এসব ঝামেলায় আছ নাকি?

অর্ক কথা বলল না। এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে তার ভাল লাগছে না। সৌদামিনী আবার যোগ করলেন, তোমার মা এমন অসুস্থ আর তুমি ওসব করবে এটা ভাল নয়। উচিত নয়।

নোংরা জলে থাকব আর নোংরা গায়ে লাগলে পরিষ্কার করব না?

কথাটা শুনে তিনজনেই যেন চমকে উঠল। সৌদামিনী বললেন, আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না তোমরা অমন খারাপ পরিবেশে থাকতে কি করে? একটু বেশী ভাড়া দিলে ভদ্র পাড়ায় ঘর পাওয়া যায় নিশ্চয়ই।

ভদ্রপাড়ায় বুঝি সমাজবিরোধী থাকে না?

সৌদামিনীর মুখ কালো হয়ে গেল, মানে?

এই সময় পরমহংস নির্জীব হাসল, ঠিক বলেছ। নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায়? তারপর রুমালে মুখ মুছল।

কথাটা অর্কর মনে বাজল। সত্যি তো! একটা শহরে আগুন লাগলে সব মন্দির পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। কেউ সেগুলো বাঁচাতে পারবে না। কলকাতার এক অঞ্চলে সমাজবিরোধীরা মাথা চাড়া দিলে অন্য পাড়ায় শান্তি থাকতে পারে না। নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায়? সুন্দর কথা। এটা কি কোন কবিতার লাইন? হঠাৎ ঊর্মিমালার মুখ ভেসে এল মনে। এরকম লাইন বোধ হয় রবীন্দ্রনাথই লিখেছেন। অর্ক লাইনটা মনে করে রাখল।

এই সময় ডাক্তারবাবুকে দেখতে পেয়ে পরমহংস এবং সৌদামিনী তাঁকে ধরতে এগিয়ে গেলেন। অর্ক একবার সেদিকে তাকাল কিন্তু নড়ল না। নীপা মিত্র এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, জিজ্ঞাসা করল, ডাক্তারবাবু বেরিয়েছেন, কথা বলবে না?

আমি তো কথা বলেছি।

কি বললেন উনি? ক্যান্সার হয়নি তো?

ক্যান্সার? অর্কর সমস্ত শরীর শিথিল হয়ে গেল। মায়ের ক্যান্সার হলে সে কি করবে? ক্যান্সার হলে মানুষ বাঁচে না। শরীরের একটা জায়গায় ক্যান্সার হলে সেটি কেটে বাদ দিতে হয়। কিন্তু তার শেকড় অন্য জায়গায় মাথা তোলে। শেষ পর্যন্ত হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?

অর্ক সজোরে মাথা নাড়ল, না ক্যান্সারের কথা আমায় বলেনি! আপনাকে কে বলেছে মায়ের ক্যান্সার হয়েছে?

আমাকে কেউ বলেনি। খারাপ কথা প্রথমে মনে আসে বলে জিজ্ঞাসা করলাম।

এই সময় সৌদামিনীর উচ্ছ্বাস শোনা গেল। ছেলেমানুষের মত তিনি অতদূর থেকেই উত্তেজিত এবং আনন্দিত গলায় বলে উঠলেন, নীপা, ইটস নট দ্যাট, নট দ্যাট।

অর্ক দেখল ওঁরা ডাক্তারবাবুর সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছেন বারান্দা ধরে। নীপা মিত্র ছুটে গেল সেদিকে। কিন্তু অর্ক নেমে এল নিচে। না, মায়ের ক্যান্সার হয়নি। নট দ্যাট নট দ্যাট। আঃ। দুটো শব্দ একটা পাথরের পাহাড় গলিয়ে দিল। নগরে যদি আগুন না লাগে তাহলে দেবালয় কেন পুড়বে?

এবং তখনই তার দুই হাত মুঠো পাকাল। শরীর কাঁপতে লাগল। প্রাণপণে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে লাগল অর্ক। কারণ কাঁধে ঝোলা নিয়ে দুটো ক্রাচে ভর দিয়ে যে মানুষ দ্রুত এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে এই আলো অন্ধকারে তাকে চিনতে একটুও ভুল হয়নি।

৫৬. অর্ক একটুও নড়ল না

অর্ক একটুও নড়ল না, অনিমেষই দূরত্বটা অতিক্রম করল।

মুখোমুখি হতে অনিমেষকে খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিল। তার কাঁধে একটা ঝোলা, পোশাক মলিন এবং চেহারায় শ্রান্তির ছাপ স্পষ্ট। বোধ হয় কি কথা দিয়ে শুরু করবে ঠাহর করতে না পেরেই অনিমেষ বলল, যাক, তোকে পেয়ে বাঁচলাম। তোর মা কেমন আছে?

হঠাৎ অর্ক আবিষ্কার করল তার এরকম উত্তেজিত হওয়ার কোন কারণ নেই। অযথা রূঢ় কথা বলে কি লাভ! এই মানুষটিকে দেখা মাত্র তার শরীরে উত্তেজনা উথলে উঠেছে। মনে হয়েছে, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা ওই মানুষটিকে মৃত্যুর দরজায় নিয়ে গেছে এই লোকটি। এরই জন্যে আজ মায়ের ওই দশা! কিন্তু যেই অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, তোর মা কেমন আছে অমনি অর্ক নাড়া খেল। মায়ের এই অবস্থার জন্যে সে নিজেও তো সমানভাবে দায়ী। মাকে সে চিন্তিত করেছে, তার জন্যে এত বছর মা কম পরিশ্রম করেনি।

অনিমেষ ছেলেকে নিরুত্তর দেখে বোধ হয় আরও অস্বস্তিতে পড়েছিল। অসহায় গলায় জিজ্ঞাসা করল, কি রে কথা বলছিস না কেন?

অর্ক মুখ নামালো, আছে। তারপর সরাসরি জিজ্ঞাসা করল, তুমি এখানে কেন এলে?

কি বলছিস তুই? আমি আসব না? তোর মা হসপিটালে আর সেই খবর পেয়ে আমি সেখানে চুপ করে বসে থাকব?

এসে কি করবে? বরং তোমাকে নিয়েই তো নানান অসুবিধে।

অনিমেষ ছেলের দিকে তাকাল। তারপর আবেদনের গলায় জিজ্ঞাসা করল, তুই এমনভাবে কথা বলছিস কেন?

অর্ক নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। তারপর পেছন দিকে তাকিয়ে বলল, ওখানে পরমহংস কাকুরা আছেন। ওঁদের সঙ্গে কথা বল। আমি যাচ্ছি।

তুই কোথায় যাচ্ছিস?

কেন?

আমি শ্যামবাজারের মোড়ে শুনলাম ঈশ্বরপুকুরে খুব গোলমাল হচ্ছে।

কে বলল?

উনুনের কারখানার মালিক। তার কাছেই শুনলাম ও এই হাসপাতালে আছে। গোলমাল হচ্ছে যখন তখন পাড়ায় এখন যাস না।

অর্ক বুঝতে পারছিল না আবার কিসের গোলমাল হতে পারে ঈশ্বরপুকরে! কয়লার লোকজন নিশ্চয়ই হামলা করতে সাহস পাবে না। ব্যাপারটা কি দেখবার জন্য তো এখনই যেতে হয়।

সে মুখ ফিরিয়ে পরমহংস কিংবা সৌদামিনীকে বারান্দায় দেখতে পেল না। অথচ একটু আগে ওঁরা ওখানেই ছিলেন। অনেকটা ইচ্ছের বিরুদ্ধেই সে অনিমেষের পাশে হাঁটতে লাগল। ক্রাচে ভর রাখার দরুন কিংবা অন্য কারণেই হোক অর্ক অনিমেষের মাথার মাঝখানটা দেখতে পেল। পরিষ্কার হয়ে এসেছে চুল। চকচকে সাদা চামড়া দেখা যাচ্ছে। তার মানে সে লম্বা হয়ে গেছে কিংবা বাবা বেঁটে হয়েছে। মোট কথা, সে ওই মানুষটিকে ছাড়িয়ে গেছে। এরকমটা ভাবতে পারায় মন প্রফুল্ল হল অর্কর।

অনিমেষ আবার জিজ্ঞাসা করল, ওর কি হয়েছে?

অপারেশন। পেটে ঘা হয়েছিল। এখনও জ্ঞান ফেরেনি।

কিরকম ঘা?

তুমি কি খুব খারাপ কিছু ভেবেছ?

অর্ক! চেঁচিয়ে উঠল অনিমেষ, তুই কি ভেবেছিস?

কিছুই না। তোমার সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছে না। ওই যে পরমহংস কাকু আসছে। তোমরা কথা বল।

তুই কোথায় যাচ্ছিস?

কাজ আছে।

কি কাজ?

সব কি তোমাকে বলতে হবে?

তুই কিরকম পাল্টে গিয়েছিস!

পরমহংস অনিমেষকে দেখতে পেয়ে ছুটে এল, কখন এসেছ?

এইমাত্র। ও কেমন আছে?

কাল সকালের আগে বলা যাবে না। তবে আমরা যা ভয় পেয়েছিলাম তা নয়। মনে হচ্ছে বিপদ কাটিয়ে উঠবে।

কি ভয় পেয়েছিলে?

ক্যান্সার। কিন্তু তা নয়। বিরাট বোঝা নেমে গেল। তুমি এখন কোত্থেকে এলে? এ সময় কি ট্রেন আছে?

আট ঘণ্টা লেট করল। আন্দোলনের জন্য।

চল। কোথাও গিয়ে বসি। একা একা আসতে অসুবিধে হয়েছে? অর্কর এসব কথা ভাল লাগছিল না। সে পরমহংসকে বলল, আপনারা কথা বলুন, আমি চলি।

কোথায় যাচ্ছ? পরমহংস জিজ্ঞাসা করল।

পাড়ায়। ওখানে যখন গোলমাল হচ্ছে তখন বেশী রাত হলে না যাওয়াই ভাল। শেষ কথাটা যে অনিমেষের উদ্দেশ্যে তা বুঝতে অসুবিধে হল না। পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, তোমার উণ্ড কেমন আছে?

ভাল।

আজ ডাক্তারকে দেখিয়েছ?

না।

কি আশ্চর্য। এটাকে নেগলেক্ট করো না।

অনিমেষ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, কিসের উণ্ড?

অর্ককে সমাজবিরোধীরা ছুরি মেরেছিল।

সে কি। কেন?

অর্ক হাসল, ওরা কেন ছুরি মারে তা জানো না?

অনিমেষ তিক্ত গলায় বলল, তুই একটুও পাল্টালি না। এখনও সেই গুণ্ডামি করে যাচ্ছিস!

অর্কর মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছিল। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করল সে। তারপর মুখ বেঁকিয়ে বলল, যে সব সমাজবিরোধী সামনাসামনি ছুরি মারে তাদের ফেস করা যায়, কিন্তু যাদের ছুরি দেখা যায় না তারা আরও মারাত্মক।

অর্ক আর দাঁড়াল না। সে উত্তপ্ত হয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এল। অনিমেষকে সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছিল না। এই মানুষটাকে তার মা এমন ভালবাসে যে অবচেতনায় নাম ধরে ডেকে যাচ্ছে। হিংসেয় জ্বলছিল অর্ক।

.

সন্ধ্যে পার হয়ে গেলেই কাঁধে এক ধরনের টনটনানি শুরু হয়েছিল। ঠিক যে জায়গায় ছুরিটা বিধেছিল সেখানটায় যেন চিড়চিড় করছে মাঝে মাঝে। অর্কর ইচ্ছে করছিল একবার জামা খুলে ব্যাণ্ডেজ সরিয়ে ক্ষতটা কাউকে দেখায়। কিন্তু একটা অন্য ধরনের জেদে সে ইচ্ছেটাকে চেপে রাখছিল। তাছাড়া রাত এগারটা পর্যন্ত আজ নিঃশ্বাস ফেলার সময় ছিল না। একটার পর একটা কাজ এবং তার উত্তেজনা শরীরের কষ্ট ভুলিয়ে রাখার পক্ষে যথেষ্ট ছিল।

হরেন ড্রাইভারের ছেলেকে কয়লার লোক শ্যামবাজারে খুন করার চেষ্টা করেছে এই খবর পাড়ায়। আসা মাত্র মানুষ পাগল হয়ে গিয়েছিল। শান্তি কমিটি কোন ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই উত্তেজিত মানুষেরা ছুটে গিয়েছিল কয়লার বাড়িতে। গ্রেপ্তার হওয়ার পর কয়লার আত্মীয়রা বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সেই বাড়িটাকে আগুনে ঠেসে দিয়েও যেন শান্তি হয়নি মানুষের। তাদের শান্ত করতে প্রচুর পরিশ্রম হয়েছে শান্তি কমিটির। তারপর শুরু হয়েছে পুলিসের সঙ্গে ঘনঘন আলোচনা। স্বয়ং পুলিস কমিশনার এসেছিলেন পাড়ায়। তিনি আবেদন করেছেন আইন নিজের হাতে না নিতে। শান্তি কমিটি ঘুরে ঘুরে তাঁকে কয়লার অত্যাচারের নিদর্শন দেখিয়েছে। যে পুলিস অফিসার কয়লার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ দিয়েছে কমিশনারের কাছে। পুলিস কমিশনার আশ্বাস দিয়েছেন যে সমস্ত সমাজবিরোধী এখনও আশেপাশের পাড়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের গ্রেপ্তার করবেন।

আগামীকাল একটা শান্তি মিছিল বের হবে। এলাকার নির্বাচিত এম এল এ এবং বিরোধীদলের নেতা সেই মিছিলে থাকবেন। এই প্রথম একটি এলাকার মানুষ অরাজনৈতিকভাবে সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছে, তাদের মনোবল বাড়াবার জন্যে পশ্চিমবাংলার সাহিত্যিক অভিনেতা এবং বুদ্ধিজীবীদের কাছে আবেদন জানানো হবে। সমাজবিরোধীদের তালিকা শান্তি কমিটির পক্ষ থেকে পুলিস কমিশনারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। কোয়া এবং বিলুর নাম সেই তালিকায় রয়েছে।

দেখা গেল, একটা এলাকার মানুষকে সংগঠিত করতে প্রচুর কাজ করতে হয়। যাঁরা রাজনীতি করেন তাঁদের এক ধরনের নেশা থাকে। বর্তমান কিংবা ভবিষ্যতের দিকে না তাকিয়ে তাঁরা দলের জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু যাঁরা রাজনীতি করেন না, সুবিধেবাদী মধ্যবিত্তের সাইনবোর্ড যাঁদের কপালে টাঙানো তাঁরা সাধারণত সময় নষ্ট করতে রাজি হন না, বিশেষ করে যেখানে ব্যক্তিগত কোন লাভ নেই। কিন্তু এই ধারণার ব্যতিক্রম দেখা গেল এবার। সাধারণ মানুষ এমনকি বাড়ির মেয়েরা পর্যন্ত রাস্তায় নেমে এসেছেন সমাজবিরোধীদের রুখে দাঁড়াতে। তাঁদের অনেকেই এখন অফিসে যাচ্ছেন না ঝুঁকি থাকায় কিন্তু এলাকার ভেতরে যা কাজ করতে বলা হচ্ছে তা তাঁরা করছেন। এই মুহূর্তে কংগ্রেস কিংবা সি পি এম দলের কোন সক্রিয় অবস্থান নেই। রাত বারোটায় সুবলকে অর্ক বলল, আমার শরীর খুব খারাপ লাগছে। আমাকে আপনারা যে পদ দিয়েছেন তা থেকে বাদ দিন।

সুবল চোখ ছোট করল, সে কি! কেন?

আমি তো কিছুই করতে পারছি না। এইভাবে একটা পদ আঁকড়ে বসে না থেকে অন্য কাউকে দিলে সে আরও বেশী উৎসাহিত হবে।

করার দিন তো শেষ হয়ে যায়নি। তাছাড়া তুমি পদত্যাগ করেছ জানলে অনেকে ভাববে আমরা বিভক্ত হচ্ছি। ঠিক আছে, সবাইকে বলে দেখি।

.

রাত এখন সাড়ে বারোটা। অর্কর শরীরে প্রবল শীতভাব এল। শান্তি কমিটির অফিস থেকে তিন নম্বরে ফিরতে ওর খুব কষ্ট হচ্ছিল। এখন চারপাশে কোন শব্দ নেই। রকে কিংবা রাস্তায় কোন জটলা হচ্ছে না। এমন কি লাইট পোস্টের তলায় তাসের আড্ডাও জমেনি।

গলিতে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল অর্ক। অন্ধকার জমাট হয়ে রয়েছে যেখানে সেখানে মোক্ষবুড়ি বসতো। ওই রকম চুপচাপ অন্ধকারের মতন। অর্ক মাতালের মত হেঁটে এল অনুপমার ঘরের সামনে দিয়ে। তারপর পকেট থেকে চাবি বের করতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। দরজার গোড়ায় কেউ বসে আছে, অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কে?

আমি। এত দেরি হল তোর?

অর্ক চমকে উঠল। অনিমেষ এতক্ষণ বন্ধ তালার নিচে অপেক্ষা করছিল। ছেলেকে দেখে এবার ক্রাচ দুটো হাতড়ে ওঠার চেষ্টা করল।

তুমি এখানে বসে আছ?

দরজায় তালা থাকলে ঢুকব কি করে?

চটপট তালা খুলল অর্ক। তারপর আলো জ্বেলে নিজে খাটের ওপর বসে পড়ল। বসে খুব আরাম লাগল তার। কিন্তু একটা অপরাধবোধ যে তাকে গ্রাস করছে তা টের পেয়ে সে মরিয়া হয়ে নিজেকে পরিষ্কার করতে চাইছিল। সে ভেবেছিল পরমহংসকাকুর সঙ্গেই অনিমেষ চলে যাবে। মাধবীলতা এখানে নেই এবং তার সঙ্গে যখন আর সম্পর্ক নেই তখন ঈশ্বরপুকুরে অনিমেষ আসতে যাবেই বা কেন? হাসপাতালে অর্ক এমনটা ভেবেছিল। তারপর এতক্ষণ শান্তি কমিটির কাজে ব্যস্ত থাকায় এইসব ভাবনা তার মাথা থেকে একদম উধাও হয়ে গিয়েছিল। অর্ক আবিষ্কার করল, অনিমেষ তো দূরের কথা, মাধবীলতার কথাও সব সময় তার মনে ছিল না। অর্ক নিজেকে বোঝালো, অনিমেষের অপেক্ষা করার জন্যে সে দায়ী নয়।

অনিমেষ ঘরে ঢুকলে সে বলল, তুমি আসবে বললেই পারতে।

আর কোথায় যাব?

ভেবেছিলাম পরমহংসকাকুর কাছে যাবে।

কেন?

অর্ক অনিমেষের দিকে তাকাল কিন্তু কথাটাকে গিলে ফেলল। অনিমেষ এ ব্যাপারে আর কথা বলতে চাইল না। ছেলে যে তাকে পছন্দ করছে না সেটা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। সে ঘরটার দিকে তাকাল। চারধার ছন্নছাড়া, মেঝেয় সিগারেটের টুকরো পড়ে আছে। তার মানে অর্ক এখন ঘরে বসে সিগারেট খাচ্ছে। সে চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ঘরের ভেতর সিগারেট ফেলেছিস কেন?

অর্ক ঘাড় ঘুরিয়ে ওটাকে দেখতে পেল। তার মনে পড়ল কোয়া দুপুরে ওখানে বসে সিগারেট খাচ্ছিল। সে মাথা নেড়ে বলল, আমি ফেলিনি। কোয়ারা এসেছিল।

কোয়া? ওঃ, সেইসব রক্তবীজের দল!

রক্তবীজ মানে?

যাদের কোন পিছুটান নেই, দয়া মায়া ভালবাসা নেই। ইভিল স্পিরিট।

এদের তো তোমরাই জন্ম দিয়েছ।

আমরা? অনিমেষের বিরক্তি উড়ে গিয়ে বিস্ময় এল।

নিশ্চয়ই। ওরা আকাশ থেকে পড়েনি। তোমরা বোম নিয়ে পাড়ায় হামলা করতে, পুলিস মারতে। এরা সেইসব দেখেছে, দেখে শিখেছে।

ইডিয়ট। তুই কিসের সঙ্গে কার তুলনা করছিস? আমাদের একটা আদর্শ ছিল। আমরা ভারতবর্ষে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলাম। নকশালপন্থী ছেলেদের সঙ্গে বখাটে গুণ্ডাদের তুলনা করছিস?

তোমাদের তো সবাই গুণ্ডা বলেই ভাবত। সাধারণ মানুষের কি উপকার করেছ তোমরা? আমি অত বড় বড় বিদ্যে জানি না। মাও সে তুং কার্ল মার্কসের দোহাই দিয়ে তোমরা যা করেছ তাতে দেশের কোন উপকার হয়নি।

হয়তো। কিন্তু আমরা চেষ্টা করেছিলাম। তোদের মত গুণ্ডাবাজি করে সময় কাটাইনি। আমরা মানুষের ভাল চেয়েছিলাম।

তাই নাকি? তাহলে তোমাদের কথা উঠলেই সাধারণ মানুষ এখনও আঁতকে ওঠে কেন? কেন বলে বিভীষিকার দিন? আজকে আমাদের এলাকায় সমস্ত সাধারণ মানুষ একজোট হয়ে সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, তোমরা তো এটুকুও করতে পারোনি।

হ্যাঁ, আমি শুনলাম। এটা একটা সাময়িক উত্তেজনা।

হয়তো। কিন্তু তা থেকে অনেক সময় বড় কাজ হয়।

অনিমেষ যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। সেই অর্ক, এই সামান্য বয়সে তার সঙ্গে সমানে তর্ক করে যাচ্ছে বড়দের ভঙ্গীতে। সে ছেলের মুখের দিকে তাকাল ভাল করে। ওর দিকে তাকালে অবশ্য কেউ কুড়ির নিচে বলে ভাববে না। মুখে চোখে একটা পোড়খাওয়া ভাব এসেছে। ওই বয়সে সে যখন কলকাতায় এসেছিল পড়তে তখন অনেক সরলতা জড়ানো ছিল, মুখ দেখে বন্ধুরা বলত, অবোধ বালক! অনিমেষের মনে হল অর্ককে ছোট করে না দেখে খোলাখুলি আলোচনা করা বুদ্ধিমানের কাজ। ও কতটা বোঝে সে জানে না, খামোকা ছেলেমানুষ ভেবে এড়িয়ে যাওয়ার কোন মানে হয় না।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, এপাড়ার গুণ্ডারা শান্তি কমিটিতে নেই?

গুণ্ডা বলতে তুমি কাঁদের বোঝাচ্ছ?

লোকে যাদের গুণ্ডা ভাবে।

লোকে তো তোমাদেরও গুণ্ডা ভাবত।

অর্ক! অনিমেষ উত্তেজিত হল, বারবার অনধিকার চর্চা করবি না।

অর্কর ঠোঁটে হাসি খেলে গেল, তাহলে এই ঘরে ফিরে এলে কেন?

মানে? অনিমেষ হতভম্ভ। আমি তোর বাবা–।

সে কথা মা আমাকে না জানালে আমি জানতাম না। তুমি প্রমাণ করতে পার যে তুমি আমার বাবা?

অনিমেষ ক্রাচদুটো আঁকড়ে ধরল, তুই কি বলছিস!

ঠিকই বলছি। তুমি প্রমাণ করতে পার?

কেউ করতে পারে?

পারে। তার চারপাশের মানুষ আত্মীয়স্বজন এবং আরো অনেক কিছু প্রমাণ দেয় যে কে বাবা! আমার মায়ের সন্তান হয়েছিল কিন্তু তিনি বলেছেন বলেই জেনেছি তুমি আমার বাবা। তোমার কোন জোর নেই। একটু আগে অধিকারের কথা বললে না? তোমার কাছ থেকে আমি কিছুই পাইনি, তুমি আমাকে কিছুই দাওনি। অধিকার কি করে পাবে? কথাগুলো বলার সময় অর্ক তার কাঁধে হাত রেখেছিল। প্রচণ্ড টনটন করছে। শরীর গরম হয়ে উঠেছে কিন্তু জ্বরটা ফিরে আসেনি।

তোর মা কি কিছু বলেছে?

তুমি নিজেকে আরও ছোট করছ এই প্রশ্ন করে। মা হাসপাতালে ঘোরের মধ্যে তোমার নাম ধরে ডাকছে আর তুমি–। অর্ক ঠোঁট কামড়ালো।

মা হাসপাতালে ওই রকম অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তুই আমাকে খবর দিসনি কেন?

প্রথমত মা নিষেধ করেছিল আর আমারও ইচ্ছে হয়নি।

কেন?

তোমার জন্যেই মায়ের এই অবস্থা তাই। মাকেও তুমি কিছুই দাওনি। তোমার জন্যে মা একটু একটু করে নিজেকে শেষ করে ফেলেছে। সেই তোমাকে আমি মায়ের অসুস্থতার খবর দিতে যাব কেন?

তুই নিজে কি করছিস? সে অসুস্থ হয়ে পড়ে রইল আর তুই পাড়ায় সমাজবিরোধী তাড়াচ্ছিস, তাদের ছুরি খাচ্ছিস?

ঠিক করছি। আমি যদি একটা ভাল কাজ করি তাহলে মা খুশি হবে, মায়ের আয়ু বাড়বে তাতে। অর্ক চোখ বন্ধ করল।

অনিমেষ মাথার চুলে আঙ্গুল চালালো। তারপর ক্লান্ত গলায় বলল, আমি স্বীকার করছি তোকে কিছু দিতে পারিনি। সেটা আমার অক্ষমতা। কিন্তু আমরা বিবাহিত। তুই আমাদের সন্তান।

অর্ক চমকে মুখ তুলে তাকাল।

কথাটা শোন। আমরা পরস্পরকে ভালবেসেছিলাম। তোর মা সেই ভালবাসার জন্যে তার সব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করেছিল। আমার জগতে সে ছাড়া আর কারও অস্তিত্ব ছিল না। পৃথিবীতে এর চেয়ে বড় আর কোন আইন নেই। যেসব স্বামী স্ত্রী সই অথবা আগুন সাক্ষী রেখে বিয়ে করে তাদের দিকে তাকিয়ে দ্যাখ, নব্বইজনই পরস্পরের সঙ্গে বাধ্য হয়ে বাস করে। ভালবাসা তো দূরের কথা। ঘৃণা আর অশান্তি নিয়ে দিন কাটায়। তাদের সন্তান প্রয়োজনে আসে। সেই সন্তানদের পিতৃপরিচয় কি? কি পাচ্ছে তারা বাপমায়ের কাছে। তুই বল, কোন বিয়েটা বেশী জরুরী? কাঙালের মত তাকাল অনিমেষ।

তাহলে তুমি মাকে অপমান করলে কেন জলপাইগুড়িতে?

আমি অপমান করতে চাইনি। এত সামান্য কারণে ওর অভিমান আহত হবে আমি ভাবিনি। আমি যদি তাই চাইতাম তাহলে এই শরীরে একা ছুটে আসতাম না। সে যদি আমায় অস্বীকার করত তাহলে আমার নাম ধরে ডাকত না। আমার মনে যেটুকু দ্বন্দ্ব ছিল হাসপাতালে এসে তা মুছে গেছে। আমি সব কথা তোকে খুলে বললাম, এবার তোর যা বিবেচনা করবি।

অর্ক অনিমেষের দিকে তাকাল। ওর শরীরে কাঁটা দিচ্ছিল। ব্যথাটা পাক দিয়ে উঠছে। ওর মুখের চেহারা দেখে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে তোর?

কিছু না। আমি একটু শোব। কথাটা বলতে বলতে অর্ক উপুড় হয়ে পড়ল খাটে। আর তখনই অনিমেষ দেখল ওর পিঠে কালচে ছোপ। ক্রাচ নিয়ে সে কোন রকমে উঠে এল খাটে। তারপর নিঃশব্দে অর্কর জামা খুলে নিল সজোরে। ব্যাণ্ডেজটা চোখে পড়তেই চমকে উঠল। কালচে রক্তে ভিজে গেছে সেটা। অর্ককে জোর করে বসাল সে। তারপর ধীরে ধীরে ব্যাণ্ডেজটা খুলে নিতেই দেখল ক্ষতের মুখে পুঁজরক্ত জমেছে।

অনিমেষ ব্যাণ্ডেজের শুকনো অংশ দিয়ে সন্তর্পণে চাপ দিতে আরও কিছুটা পুঁজরক্ত বেরিয়ে এল। সেটাকে মুছিয়ে দিয়ে সে আবার অর্ককে শুইয়ে দিল, এবার তুই শুয়ে থাক। আমি ডাক্তারকে ডেকে আনছি।

অর্কর মনে হচ্ছিল তার পিঠের ব্যথাটা অনেক কমে এসেছে। বেশ আরাম লাগছে এখন।

৫৭. মাধবীলতাকে বিপদমুক্ত ঘোষণা

তিনদিন পরে মাধবীলতাকে বিপদমুক্ত ঘোষণা করা হল। ওকে আজ দুপুরে পেয়িংবেডে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন এটাকে ঈশ্বরের দয়া বলা যেতে পারে। পেশেন্টের অবস্থা এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছিল যেখানে শতকরা নব্বইভাগ মানুষ বাঁচে না। এখন সময় লাগবে সুস্থ হতে। এই অবস্থায় পেশেন্টকে বিরক্ত করা উচিত হবে না। অথবা অযথা ভিড় বা কোনরকম উত্তেজনা যাতে সৃষ্টি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ভিজিটার্সরা যেন পেশেন্টের সঙ্গে বেশী কথা না বলেন।

চারটের অনেক আগে থেকে ওরা ভিড় করেছিল। সৌদামিনী তার স্কুলের শিক্ষিকাদের আসতে নিষেধ করেছিলেন। এই কদিন মহিলা দুবেলা আসছেন, অনেকক্ষণ থাকছেন। ডাক্তারকে সক্রিয় রাখতে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছেন। অনিমেষ ওঁর সামনে দাঁড়াল, আপনার কাছে আমরা–।

এই রে! সৌদামিনী হাত নাড়লেন, আপনি আবার ওসব বলবেন নাকি! কৃতজ্ঞতা, ধন্যবাদ। ওয়ার্থলেশ ওয়ার্ডস। টেক ইট ইজি। মেয়েটা আমার সহকর্মী তাই এসেছি। আপনাদের কৃতার্থ করার বিন্দুমাত্র বাসনা আমার ছিল না। এখন ও ভালর দিকে তাই কাল থেকে আসব না। ও যদ্দিন না কমপ্লিট সুস্থ হচ্ছে তদ্দিন স্কুলে যেতে হবে না। আর এই হাসপাতালের খরচ আমরা দেখব। আর কিছু বলার আছে?

অনিমেষ অপ্রস্তুত। সে ম্লান হেসে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল।

সৌদামিনী বললেন, আপনি মশাই খুব ফাঁকি দিয়েছেন। বউ-এর অসুখ হল, হাসপাতালে এল, আর আপনি কোথায় বসে রইলেন।

পরমহংস কাছেই ছিল। বলল, এটা আকস্মিক ব্যাপার। ওর দোষ নেই।

সৌদামিনী কাঁধ নাচালেন, যার শেষ ভাল তার সব ভাল। এখন ওকে একটু যত্নে রাখবেন। পরিশ্রম করতে দেবেন না। আর নিজেরা না খেয়ে মেয়েটা যাতে খায় সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন। আপনার ছেলে জানে ওর মায়ের কথা?

না। একটু আগেই তো আমরা জানলাম। তবে জানে আজ জানা যাবে।

কেমন আছে ও?

ভাল। ডাক্তার তো বলেছে দিন চারেক একদম শুয়ে থাকতে।

সৌদামিনী চশমার কাঁচ মুছলেন, আমি আজকালকার ছেলেদের একদম বুঝতে পারলাম না। যার মা এমন অসুস্থ সে খামোকা আগ বাড়িয়ে ছুরি খেতে যাবে কেন?

অনিমেষ কোন উত্তর দিল না। পরমহংস একটা সিগারেট ধরাল। এই কদিন তারও অফিস কামাই হয়েছে। আজ এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে কাল থেকে মুক্তি। যেন একটা যুদ্ধ হচ্ছিল এতদিন। জয় ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর আর তার কিছুই করার নেই। হার হলেও যেমন কিছু করার থাকত না।

চারটের সময় ওরা প্রবেশাধিকার পেল। অনিমেষের বুকের মধ্যে অকস্মাৎ আলোড়ন সৃষ্টি হল। তাকে দেখে মাধবীলতার কি রকম অনুভূতি হবে? যদি ও আচমকা উত্তেজিত হয়ে ওঠে? ঘোরের মধ্যে নাম ধরে ডেকেছে ঠিকই কিন্তু চেতনায় এলে যদি তার অভিমান উগ্র হয়ে ওঠে। অনিমেষ মনস্থির করতে না পেরে পরমহংসকে বলল, তোমরা গিয়ে দেখে এসো। আমি প্রথমে যাব না।

পরমহংস কাঁধ ঝাঁকাল, ওপেন করতে ভয় পাচ্ছ? সেকেণ্ড ডাউন নামবে? ঠিক হ্যায়, অপেক্ষা করো।

সৌদামিনী এগিয়ে গিয়েছিলেন, কি হল আসুন। পরমহংস পা বাড়াতে সৌদামিনীর কপালে ভাঁজ পড়ল, কি হল, উনি আসবেন না?

আমরা ঘুরে এলে ও যাবে। স্বামী স্ত্রীতে একটু নিরিবিলিতে দেখা হওয়া ভাল। আর আমরা পেশেন্টকে বলব না যে তার স্বামী এসেছে। একটু সার প্রাইজ থাকা ভাল, বুঝলেন। পরমহংস বোঝাচ্ছিল।

সৌদামিনী কি বুঝলেন তিনি জানেন, মুখে বললেন, যত্তসব।

ভিজিটার্সরা লাইন দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে। অনিমেষ দেখছিল। সে নিজে কেন প্রথমেই যেতে পারল না? শুধুই কি মাধবীলতা উত্তেজিত হবে এই ভয়ে, না তার ভেতরে কোন অপরাধবোধ কাজ করছিল? অন্তত গত কয়েকদিনে অর্কর পাশে বসে থেকে তার প্রতিক্ষণ মনে হয়েছে এই জেনারেশনটার কাছে সে হেরে গেছে। যা নেহাতই আকাশকুসুম, যার সঙ্গে মাটির কোন যোগ নেই সেটা তো আকাশকুসুমই, আঁকড়ে ধরার জন্যে সে চোখ কান মন বন্ধ রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পেছনে না তাকিয়ে, যার জন্যে মাধবীলতাদের জীবন দিয়ে দাম দিতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ দায়িত্ব তার, অর্করা এখন অনেক বেশী বোঝে। ওই বয়সে সে নিজে এসব কথা চিন্তাও করতে পারত না। কিন্তু জীবনের রূঢ় দিকটা সম্পর্কে অর্করা যতটা জেনে ফেলেছে এবং তাই নিয়ে যেভাবে কথা বলে সেটা ওই বয়সে তার পক্ষে অকল্পনীয় ছিল।

অনিমেষ নিজের পোশাকের দিকে তাকাল। বেশ ময়লা হয়েছে। অন্তত এরকম ময়লা পোশাকে কোন রোগীর পাশে যাওয়া উচিত নয়। জলপাইগুড়ি থেকে আসার সময় সামনে যা পেয়েছে ঝোলায় ঢুকিয়ে নিয়ে চলে এসেছে। এখানে আসার পর কাঁচাকাচির বালাই ছিল না। এই কয়দিন খাওয়াদাওয়া সারতে হয়েছে দোকান থেকে কিনে এনে। দুদিন আগে বস্তির একটা মেয়ে এসেছিল দরজায়। অর্ক তখন ঘুমাচ্ছিল। অনিমেষের হাসপাতালে যাওয়ার সময় হয়নি। সকাল আটটা সাড়ে আটটা তখন। মেয়েটি জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন আছে ও? অনিমেষ তখন জলপাইগুড়িতে একটা চিঠি লেখার কথা ভাবছিল। মুখ ফিরিয়ে মেয়েটিকে দেখে সে অবাক। মেয়েটিকে সে আগে কখনও দ্যাখেনি। কিন্তু মনে হচ্ছিল বিবরণ শুনেছে। উনুনের কারখানায় আড্ডা মারার সময় অনেক গল্প কানে আসতো। ভদ্রতা করে ঘাড় নেড়েছিল সে, ভাল। তুমি কে?

আমি এখানেই থাকি।

ও! অনিমেষ মুখ ফিরিয়ে ভেবেছিল অর্কর তাহলে পরিচিতি বেশ বেড়েছে। অনেকেই খোঁজ নিতে আসেছ। বস্তির লোক তো বটেই, শান্তি কমিটি থেকেও দুবেলা জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছে কিছু প্রয়োজন আছে কি না। তবে কোন মেয়ে এই প্রথম এল। অনিমেষের খেয়াল হল মেয়েটি খবরটা জানার পরেও দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। সে জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবে?

মেয়েটি ইতস্তত করল। তারপর নরম গলায় বলল, আপনাদের খাওয়াদাওয়া?

অনিমেষ অবাক হল। তাদের খাওয়া দাওয়া নিয়ে মেয়েটি মাথা ঘামাচ্ছে কেন? সে বলল, বাইরে থেকে এনে খাচ্ছি। এ কথা জিজ্ঞাসা করছ কেন?

যদি বলেন আমি রেঁধে দিতে পারি।

কেন? তুমি রাঁধবে কেন?

এমনি।

তোমার নাম কি?

ঝুমকি। আপনার ছেলে আমাকে চেনে।

ও। না, না। রান্নার কোন দরকার নেই। তুমি যেতে পার। অনিমেষ রূঢ় গলায় কথাগুলো বলেছিল। এরকম গায়ে পড়া ভাব তার মোটেই ভাল লাগেনি। মেয়েটি মাথা নিচু করে চলে যাওয়ার পর অনিমেষ দেখল অর্ক তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে বিরক্ত হয়ে বলল, ওকে চিনিস?

নীরবে মাথা নাড়ল অর্ক, কথা বলল না।

কে? কোন ঘরে থাকে?

এখানেই থাকে। ওর ইচ্ছে ছিল ক্যাবারের ড্যান্সার হবার। হতে পারেনি।

হতভম্ব হয়ে পড়েছিল অনিমেষ, তুই জানলি কি করে?

জানি। চোখ বন্ধ করেছিল অর্ক।

অনিমেষ আর কোন প্রশ্ন করতে পারেনি। কিন্তু সে আর একবার হেরে গেল। তার মনে পড়ল, বাল্যে কিংবা কৈশোরে সে নিজে মহীতোষ কিংবা সরিৎশেখরকে কখনই বলতে পারত না একটা ক্যাবারে ড্যান্সারের সঙ্গে তার পরিচয় আছে। অথচ অর্কর গলা কাঁপল না। খুব সহজ ভঙ্গীতে খবরটা দিল। সামান্য অপরাধ বোধ নেই।

হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনিমেষ মনে মনে স্বীকার করল। আমরা যত আধুনিকতার কথা বলি, বিপ্লবের জিগির তুলি ঠিক ততটা যোগ্যতা এখনও অর্জন করিনি। এখনও মনের আড় ভাঙ্গেনি। অর্কর সহজভঙ্গীটা সে এখনও আয়ত্ত করতে পারেনি।

অর্কর ক্ষত খুব খারাপ অবস্থায় যেত যদি সেই রাত্রেই ডাক্তার ডেকে না আনা হত। বেশ কয়েকটা ইঞ্জেকশন আর ক্যাপসুল গিলতে হয়েছে তাকে। আজ সকালে দেখা গেছে ক্ষত শুকিয়ে গেছে। ব্যাণ্ডেজ খুলে নিয়ে ক্ষতর মুখ তুলল আর প্লাস্টারে চাপা দেওয়া হয়েছে। এসব করতে অনেক খরচ হয়ে গেল। এখন যে কি হবে কে জানে। অনিমেষ হেসে ফেলল। আমরা যত বড় বড় কথা বলি না কেন পকেটে টাকা না থাকলে সেসব এক সময় নিজেকেই গিলে ফেলতে হয়।

এই সময় পরমহংসর গলা শুনতে পেল অনিমেষ, ভাল আছে, কিন্তু ভীষণ দুর্বল। যা ঝড় গেল মেয়েটার ওপরে। তবে ভাই মাস্টারনি ওখানে গিয়েও দাবড়ে এসেছে। যাবে তো?

ততক্ষণে সৌদামিনী এসে পড়েছেন, যান, কি সারপ্রাইজ দেয়ার দিন। তবে এমন দেবেন না যাতে চোখ উল্টে যায়। আমি চলি। এখন তো রোজ আসার দরকার নেই। কাল বিকেলে নীপাকে পাঠিয়ে দেব। যদি কোন প্রয়োজন হয় তাহলে আমাকে জানাবেন। আপনি যাবেন?

প্রশ্নটা পরমহংসকে। সে সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নাড়ল, না না। আপনি এগোন। আমি অনিমেষের সঙ্গে ফিরব।

মহিলা চলে যেতে পরমহংস মুখ ফোলাল, ডেঞ্জারাস মহিলা রে। রোজ আমাকে সঙ্গে নিয়ে শ্যামবাজার পর্যন্ত যেতেন জ্ঞান দিতে দিতে।

কি জ্ঞান?

কেন পুরুষমানুষদের বিবাহ করা উচিত নয়। দে আর ওয়ার্থলেশ, একটা পুরুষমানুষের চেয়ে ওয়ার্থলেশ জীব নাকি পৃথিবীতে জন্মায়নি। মাথা নাড়ল পরমহংস।

একটা হিমেল বাতাস হাসপাতালের ওপর দিয়ে বয়ে গেল। কলকাতায় এখনও শীত পড়েনি কিন্তু তার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। অনিমেষ ক্রাচ নিয়ে এসেছিল। পরমহংস যে নির্দেশ দিয়েছে সেই মত চিনতে অসুবিধে হচ্ছিল না। কিন্তু সিঁড়ি ভাঙ্গতে গেলে প্রাণ বেরিয়ে যায়। আরও খারাপ লাগে সেই সময় যদি কেউ সাহায্যের কথা বলে। মনে একটা জেদ কাজ করে তখন, যত কষ্ট হোক আমি নিজে ওপরে উঠব কারো সাহায্য না নিয়ে।

লম্বা করিডোরে নানান মানুষের ভিড়। দেখতে দেখতে অনিমেষ সেই হলঘরটার সামনে দাঁড়াতেই একটি নার্স তার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকাল। হয়ত তার ক্রাচদুটোর জন্যেই এই কৌতূহল। অনিমেষ তাকে বিছানার নম্বর বলতেই মেয়েটি বলল, আসুন আমার সঙ্গে।

একদম কোণের দিকে একটি খাটে যে শুয়ে আছে সে কি মাধবীলতা? মেয়েটি মিষ্টি হেসে চলে যেতে অনিমেষ আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বুক অবধি সাদা চাদরে ঢাকা, কাগজের মত সাদা মুখ, চোখ বন্ধ। শরীরের আদল দেখলে মনে হবে চাঁদরের নিচে তেরো বছরের কিশোরী শুয়ে রয়েছে। অনিমেষের বুকের ভেতরটা যেন দুমড়ে গেল। মাধবীলতার মুখের সমস্ত সুস্থতা কেউ যেন খাবলে তুলে নিয়েছে। শুধু হাড়ের ওপর চামড়া টাঙানো। অনিমেষ ধীরে ধীরে ব্যবধান কমাল। বিছানার পাশে টুল রয়েছে। খুব সন্তর্পণে সে টুলটায় বসে ক্রাচদুটোকে বিছানায় ঠেস দিয়ে রাখল। মাধবীলতা তখনও জানে না কেউ তার পাশে এসে বসেছে। দুচোখ বন্ধ করে স্থির হয়ে শুয়ে রয়েছে। সে। অনিমেষের খুব ইচ্ছে করছিল হাত বাড়িয়ে ওর চিবুক কপাল স্পর্শ করে। তার পাশের বিছানা ঘিরে অনেক মানুষের ভিড়। তারা তাদের প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলছে। অনিমেষ চুপচাপ বসে রইল। মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শুধু ক্ষরণ হয়ে যাচ্ছিল তার ভেতরে। অদ্ভুত। এক আবেগে সমস্ত শরীর থরথরিয়ে কাঁপছে।

দুটো হাত দুপাশে নেতিয়ে রয়েছে। চাদরের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে রয়েছে সামান্য। এত সাদা হাতের তেলো আগে দ্যাখেনি অনিমেষ। অত্যন্ত লোভীর মত কিংবা কাঙালের মত সে ধীরে ধীরে মাধবীলতার আঙ্গুল স্পর্শ করল। আঙ্গুলগুলো কেঁপে উঠল সামান্য। অনিমেষ ধীরে ধীরে হাতটা নিজের দুহাতে তুলে নিল। শীতল হাত নিজের উত্তাপের মুঠোয় পূর্ণ মায়ায় ধরে রাখতে চাইল সে। আর তখনই ধীরে ধীরে চোখ মেলল মাধবীলতা। যেন অনেক, অনেক দূর থেকে তাকাচ্ছে সে। দৃষ্টি অস্বচ্ছ। যেন স্পষ্ট চোখে সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। অথচ প্রাণপণে লক্ষ্যবস্তুকে চিনতে চেষ্টা করছে। অনিমেষ বুঝতে পারল। পেরে কিছু বলতে গিয়ে আবিষ্কার করল তার গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। আচমকা গলায় স্বর আটকে গেছে। সে ঢোক গিলল। তারপর ধীরে ধীরে হাতখানা বিছানায় নামিয়ে দিতেই মাধবীলতার আঙ্গুল তার হাত আঁকড়ে ধরল। শরীরের সমস্ত আলোড়ন মুহূর্তেই স্থির দিঘির মত, অনিমেষ চোখে চোখ রাখল।

ঈশ্বর মানুষকে যা দেন তার অনেক বেশী কেড়ে নেন। হয়তো মানুষের অতটা পাওনা ছিল না, এবং কিছুকাল বাড়তি ভোগ করায় তাকে গুণাগার দিতে হয়। স্বাস্থ্য সৌন্দর্য সাদা কাগজের মত, যে কোন মুহূর্তে ঈশ্বরের ইচ্ছায় তাতে কালি ঢালা হতে পারে। কিন্তু মানুষের হাতে একটি ব্যাপারে ঈশ্বরের পরাজয় ঘটে যায়। সব ফিরিয়ে নিলেও একটি জিনিসে তিনি কিছুতেই হাত বসাতে পারেন না। সেটি হল মানুষের হাসি। সব হারিয়েও কোন কোন মানুষ সেই হাসির দ্যুতিতে তার হারানো রূপ ঢেকে দিতে পারে। চট করে সে উঠে আসতে পারে স্বমহিমায়।

এই মুহূর্তে মাধবীলতা তাই পারল। তার অসুস্থ পাণ্ডুর মুখে হঠাৎ ভোরের আলো খেলে গেল। অনিমেষের মনে হল অনেকদিন পর সে স্নিগ্ধ হল। এই হাসি এক লহমায় অনিমেষের সব অপরাধবোধ মুছিয়ে দিল। সে পরম মমতায় মাধবীলতার হাত আঁকড়ে ধরল।

বালিশে এবার গালের একপাশ চাপা। রুক্ষ চুল অগোছালো। স্থির চোখে তাকিয়ে মাধবীলতা ঠোঁট নাড়ল, কেমন আছ?

ঘাড় নেড়ে ভাল বলতে গিয়ে আড়ষ্ট হল অনিমেষ। এই প্রশ্নটা কার করা উচিত ছিল। মৃত্যুর অন্ধকার থেকে ফিরে এসে কেউ জিজ্ঞাসা করতে পারে পৃথিবীর মানুষ কেমন আছে? কিন্তু উত্তর দেওয়া দরকার। আমি ভাল আছি; তোমাকে অসুস্থ দেখে আমার ভাল থাকা কমেনি। কথাটা হয়তো অনেকটাই সত্যি কিন্তু এই মুহূর্তে বলা কি যায়?

কি হল। মাধবীলতার গলার স্বরে দুর্বলতা মাখানো।

অনিমেষ হাসার চেষ্টা করল। এই হাসিতে যেন অনেক উত্তর দেওয়া যায়। তারপর গাঢ় গলায় বলল, খুব কষ্ট হচ্ছে?

নিঃশব্দে ঘাড় নেড়ে না বলল মাধবীলতা। তার হাত তখনও অনিমেষকে আঁকড়ে আছে। চোখ জড়িয়ে রেখেছে অনিমেষের মুখ। তারপর আবার সেই এক প্রশ্ন, বললে না, কেমন আছ?

অনিমেষ এতটা ভাবেনি। সে এবার নিচু গলায় বলল, বোঝ না, কেমন থাকতে পারি! সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ হয়ে গেল। মুখের সব আলো নিবে গেল। যেন আচমকা আকাশের সব দরজা জানলা বন্ধ হয়ে গেল। অনিমেষ চোরের গলায় জিজ্ঞাসা করল, কি হল, লতা?

ততক্ষণে দুচোখ ছাপিয়ে জল গালে নেমেছে। মাধবীলতা ভেজা গলায় বলল, কিন্তু দোষ আমার।

কিসের দোষ, কি দোষ? অনিমেষের মাথায় এল না প্রথমে। সে আর একটু ঝুঁকে বলল, কেঁদো না। এখন কাঁদলে শরীর খারাপ করবে।

সাদা ঠোঁট কামড়ালো মাধবীলতা নিজেকে স্থির করতে, আমি তোমার কাছে বড্ড বেশী চেয়েছিলাম তাই ভগবান এমন শাস্তি দিলেন।

তুমি তো আমার কাছে কিছুই চাওনি লতা!

চেয়েছিলাম। তুমি জানো না!

তুমি আর কথা বলো না।

ঠিক আছে, কিছু হবে না। সে কোথায়?

অনিমেষ ইতস্তত করল, ওর শরীরটা খারাপ তাই আমি আসতে নিষেধ করেছি।

শরীর খারাপ? কি হয়েছে? চোখ খুলল মাধবীলতা এবং উদ্বেগের ছাপ খোদাই হয়ে গেল সারা মুখে।

এমন কিছু না, সামান্য জ্বরজারি।

ও! আমার জন্যে খুব করেছে ছেলেটা।

বাঃ। মায়ের জন্যে ছেলে করবে না?

সবাই করে?

মাধবীলতা আবার চুপ করে গেল। অনিমেষের অস্বস্তি হচ্ছিল। যে কোন কথা মাধবীলতা হঠাৎ এমন একটা জায়গায় এনে দাঁড় করিয়ে দেয় যে তার জবাব দেওয়া যায় না। কিংবা দিতে গেলে নিজেকে খুব খেলো মনে হয়। মাধবীলতা তার কাছে কি চেয়েছিল যা সে জানে না? টাকা পয়সা বা অন্য কিছু কোনদিন সে চায়নি। যদি ভালবাসার কথা ওঠে সে তো ওকে কম ভালবাসেনি। তাহলে?

কাঁদছ কেন?

অনিমেষ চমকে মুখ ফিরিয়ে দেখল অর্ক তার পেছনে দাঁড়িয়ে মাধবীলতাকে প্রশ্নটা করছে। মাধবীলতা চোখ খুলে ছেলেকে দেখে অবাক হয়ে গেল, কই, কাঁদছি কে বলল?

দ্রুত পায়ে অর্ক বিছানা-ঘুরে মাধবীলতার ওপাশে হাঁটু গেড়ে বসল। তারপর আঙ্গুলের ডগায় গালের ভেজা জায়গা মুছে নিল, চোখ থেকে জল বের হলে কান্না বলে।

তুই কেমন আছিস?

ভাল। আমি কখনও খারাপ থাকি না।

তোর নাকি জ্বর হয়েছিল?

ঠিক জ্বর নয়। তারপর অনিমেষের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুমি তো বলনি মাকে আজ দেখতে দেবে?

আমি জানতাম না; এখানে এসে শুনলাম। অনিমেষের বলতে ইচ্ছে করছিল যে অর্কর আজই আসা উচিত হয়নি। আর একদিন রেস্ট নেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু কথাটা সে বলতে পারল না।

দুহাতে মাধবীলতার গলা গাল জড়িয়ে ধরেছিল অর্ক, জানো, আমরা ভয় পেয়েছিলাম তুমি হয়তো বাঁচবে না।

মেয়েদের কি অত সহজে মরণ হয়!

কেন? মেয়েরা কি?

মাধবীলতা হাসল, পাগল! তোর চেহারা কি হয়েছে?

যা ব্বাবা! নিজের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো। ফ্রক পরলে ক্লাশ সিক্সের মেয়ে মনে হবে। ওঃ, আমার আজ কি ভাল লাগছে না! হঠাৎ মনে হল আজ তোমাকে দেখতে পাব। মনে হতেই চলে এলাম।

এই সময় নার্স এগিয়ে এল, ব্যাস। আজকের মত ছেড়ে দিন ওঁকে। আর কথা বলবেন না।

অর্ক উঠতে যাচ্ছিল। মাধবীলতা ওর হাত ধরল, আর একটু থাক না।

নার্স বলল, না, থাকলেই কথা বলবেন।

মাধবীলতা বলল, না, কথা বলব না। শুধু একটু বসে থাকুক।

ঠিক আছে। পাঁচ মিনিটের বেশী নয়।

নার্স চলে গেলে অর্ক আবার বসল। তারপর ধীরে ধীরে মাধবীলতার কপালে গালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। অনিমেষের কিছুই করার নেই। সে অপলক এই দৃশ্য দেখছিল। সে নিজে কখনও মাধবীলতার এত কাছে যেতে পারেনি।

পাঁচ মিনিট হয়ে গেলে অর্ক কথা বলল, তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে চল। তোমাকে না পেলে আমার কিচ্ছু ভাল লাগে না।

৫৮. কলকাতা শহরের বিখ্যাত ব্যক্তি

কলকাতা শহরের বিখ্যাত ব্যক্তিদের কাছে আমাদের আবেদন রাখা হয়েছিল শান্তি কমিটির পক্ষ থেকে। তাঁরা প্রত্যেকেই স্বীকার করেছেন এরকম উদ্যোগ মানুষের মনে অন্যায়ের সঙ্গে লড়বার শক্তি যোগাবে। সারা দেশ যেখানে পশুশক্তির কাছে মাথা নত করে থাকে সেখানে বেলগাছিয়ার মানুষ দেখিয়ে দিল সাধারণ মানুষ যখন একতাবদ্ধ হয় তখন কোন শক্তি তাদের দাবিয়ে রাখতে পারে না। একটি বিখ্যাত কাগজে লেখা হল, অন্যায়ের ছুরির যে কোন বাঁট নেই, যে মারে সেও রক্তাক্ত হয় তা এই ঘটনায় প্রমাণ হল। আর একটি কাগজ আর এক ধাপ এগিয়ে বলল, বেলগাছিয়া প্রমাণ করল সাধারণ মানুষ বিপ্লব করতে আগ্রহী।

শান্তি কমিটির তরফ থেকে কলকাতার বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, অভিনেতাদের কাছে আবেদন রাখা হল তাঁরা যদি সশরীরে এই উপলক্ষে আয়োজিত সভায় উপস্থিত হয়ে কিছু বলেন তাহলে এলাকার মানুষের মনের জোর আরও বাড়বে। কারণ এই মুহূর্তে পুলিস যদিও শান্তি কমিটির বিরোধিতা করছে না কিন্তু কয়লার সঙ্গীরা আশেপাশে এলাকায় এখনও সক্রিয়। কিছু কিছু ভয় দেখানোর ঘটনা ঘটছে। তাছাড়া এলাকার মানুষ যদি দেখে বিখ্যাত ব্যক্তিরা তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তাহলে আরো মনের জোর বাড়বে।

প্রত্যেকের সম্মতি নিয়ে সভা ডাকা হল। এলাকার মানুষের কাছে সে খবর মাইকের মাধ্যমে ঘুরে ঘুরে জানিয়ে দেওয়ায় সভা ভরে গেল। হাজার পাঁচেক মানুষ বিকেল হতেই পার্কে উপস্থিত। তাদের মধ্যে উৎসাহ বেশী মেয়েদের। যতটা না শোনার তার চেয়ে বেশী দেখার।

সকালে মাধবীলতাকে বলে এসেছিল যে সে বিকেলে আসবে না। শান্তি কমিটি থেকে তাকে কয়েকজন বিখ্যাত সাহিত্যিক এবং অভিনেতাকে নিয়ে আসবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই কদিনে মায়ের কাছে এসব ঘটনা বিস্তারিত বলেছে সে। মাধবীলতা অবাক হয়ে শুনেছে। ঈশ্বরপুকুরের লোক এখন অশ্লীল শব্দ শুনছে না, গুণ্ডামি হচ্ছে না এটা ভাবতে তার অসুবিধে হচ্ছিল। দুটো ঘটনা অর্ক ইচ্ছে করে চেপে গেছে। মোক্ষবুড়ির মারা যাওয়া আর তার নিজের ছুরি খাওয়া। মনে হয়েছিল এই ঘটনা দুটো বললে মাধবীলতা উত্তেজিত হতে পারে। খুব দ্রুত সেরে উঠছে মাধবীলতা। যদিও তার শরীর খুবই দুর্বল এবং নড়াচড়া করা সম্পূর্ণ নিষেধ। পরমহংস এখন রোজ আসে না। অর্কর প্রশ্নের উত্তরে বলেছিল, ক্রিকেট খেলেছ? যখন টিম ফলো অন খায় তখন এগার নম্বর ব্যাটসম্যান ঠকঠক করে কাঁপে। অ্যাদ্দিন আমার সেই অবস্থা ছিল। কিন্তু যখন তিরিশ রান তুললেই টিম জিতবে তখন সেই ব্যাটসম্যান হোটেলে ঘুমুতে পারে। আমার এখন সেই অবস্থা। বুঝলে? কি বুঝলে?

সৌদামিনীও থাকছেন না। মাঝে একদিন নীপা মিত্রের হাত দিয়ে মাধবীলতার মাইনে পাঠিয়ে দিয়েছেন। হাসপাতালে যা খরচ হবে তা স্কুল থেকেই দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।

ব্ৰজমাধব পালের গাড়ি পাওয়া গিয়েছিল। শান্তি কমিটিকে তিনি আজকের অতিথিদের নিয়ে আসার জন্যে গাড়িটি দিয়েছিলেন। অর্ক এবং আর একটি ছেলে চারটে নাগাদ বেরিয়ে পড়ল সেজেগুঁজে। সুবল ওদের বারংবার বলে দিয়েছিল বিনীত ব্যবহার করতে। কথাবার্তায় যেন সমীহভাব থাকে সব সময়। সাহিত্যিকদের সম্পর্কে অর্কর কোন ধারণাই ছিল না। যে দুজনকে তার নিয়ে আসার কথা তাদের কোন লেখা সে পড়েনি, নামও তেমন শুনেছে বলে মনে পড়ে না। মাধবীলতা নাম শুনে বড় বড় চোখে তাকিয়েছিল, তোর কি সৌভাগ্য! নাম শুনিসনি কি রে? কি অশিক্ষিত রে তুই? এঁরা দুজনেই তো এখনকার সবচেয়ে বড় লেখক। কিন্তু অভিনেতা-দুজনকে অর্ক জানে। ওদের আনতে হবে বলে সে কিঞ্চিৎ উত্তেজিত। দুজনের ছবি সিনেমার বিজ্ঞাপনে, হলের সামনে টাঙানো থাকে। কথা ছিল, আগে অভিনেতাদের তুলে আসবার সময় একটা কাগজের অফিস থেকে লেখকদের নিয়ে আসতে হবে।

নিউ আলিপুরে প্রথম অভিনেতার বাড়িতে গিয়ে হোঁচট খেল ওরা। তিনি বাড়িতে নেই। হঠাৎ শুটিং পড়ে যাওয়ায় বাইরে চলে গিয়েছেন। দ্বিতীয়জন থাকেন টালিগঞ্জে। বাড়িতেই ছিলেন। অর্ক বেল বাজাতে একটা চাকর দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করল, কাকে চাই?

নাম বলল অর্ক, বলুন, বেলগাছিয়া থেকে এসেছি। বাইরের ঘরে মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পর অভিনেতা এলেন। হাতে চুরুট। অর্ক উঠে দুহাত জড় করে নমস্কার করল। দারুণ ফসা লম্বা কিন্তু ছবিতে যা দেখায় তার চেয়ে বয়স বেশী। কিন্তু অর্ক খুব নার্ভাস হয়ে যাচ্ছিল। এত বড় মানুষের সামনে সে দাঁড়াবে ভাবাই যায় না।

অভিনেতা বললেন, কোত্থেকে আসা হয়েছে ভাই?

বেলগাছিয়া। আমাদের ওখানে আপনি যাবেন কথা আছে।

কথা? অভিনেতা চুরুটে টান দিলেন, কথা তো থাকেই। ভেরি নোবল পাপাস। সুন্দর উদ্যোগ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, হুঁ? রাশিয়াতে এরকম হয়েছিল। জারের সময়ে। তা তোমরা কি করেছ? দলবেঁধে মাস্তান সেঁদিয়েছ? কংগ্রেসী মাস্তান?

আপনি তো সব জানেন। পাড়ার সবাই আপনার মুখ থেকে কিছু শুনতে চায়। আমাদের হাতে বেশী সময় নেই, অনেক দূর যেতে হবে। অর্ক খুব বিনীত গলায় বলল।

কে কে যাচ্ছে?

অনেকেই যাবেন। অর্ক নামগুলো বলল।

সে কি? চ্যাটার্জী যাচ্ছে? ওকে বলেছ কেন? রিঅ্যাকশনারি, এসকেপিস্ট! তাছাড়া পাবলিক তো ওকে দেখতেই ভিড় করবে।

আমরা তো অভিনেতা হিসেবেই বলেছি।

অভিনেতা? ও আবার অভিনয় করতে শিখল কবে? মুখ দেখিয়ে পয়সা পায়। না না, ও গেলে আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।

কিন্তু আপনি না গেলে–।

দ্যাখো ভাই, আমি অভিনেতা, রাজনীতি করি না। তোমাদের এই ব্যাপারে নাক গলানো ঠিক নয়। এসে জানতে চাইলে সমর্থন করলাম। মুখে বলা এক কথা আর নিজে হাজির হয়ে বক্তৃতা দেওয়া অন্য কথা। স্ট্যাম্প পড়ে যাবে। তোমরা বিপ্লব ফিপ্লব করছ করো, আমরা তো আছিই। কথাগুলো বলেই ঘাড় ঘুরিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন অভিনেতা, কি বলছ? অ্যাঁ? ওহো ওষুধ খাওয়ার সময় হয়ে গেল। ঠিক আছে, চলি।

অর্ক স্থির জানে ভেতর থেকে কেউ ওঁকে ডাকেনি। ও অভিনেতার নিষ্ক্রমণ দেখল। তারপর চাপা গলায় বলল, শালা!

অর্কর সঙ্গী বলল, কি হবে এখন?

বাঁ দিকের দেওয়ালে সাজানো রয়েছে অনেক কিছু। এখন ঘরে কেউ নেই। অর্ক হাত বাড়িয়ে একটা মূর্তি তুলে নিল। বিখ্যাত পত্রিকা থেকে অভিনয়ের জন্য পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয়েছিল। সেটাকে তুলে অর্ক সোজা বাইরে বেরিয়ে আসতেই চাকরকে দরজায় দেখা গেল।

এই যে, ওটা কি নিয়ে যাচ্ছেন? ছুটে এল চাকর।

অর্করা ততক্ষণে গাড়িতে উঠে বসেছে। সেটা চালু হতে শূন্যে ছুঁড়ে দিল অর্ক মূর্তিটাকে। সুদৃশ্য পালিশকরা অ্যাবস্ট্রাক্ট মূর্তিটা মাটিতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।

সারাটা পথ ওরা কোন কথা বলল না। অর্কর মনে হচ্ছিল এই লোকটাকে যদি কয়লার সঙ্গে প্যাঁদানো যেত তাহলে মনে সুখ হতো। শালা দুনম্বরী! খবরের কাগজের অফিসে এসে সে আরও অবাক। নিচের রিসেপসনে তাকে আটকেছিল প্রথমে। অনেক বলাবলির পর সে ওপরে ওঠার ছাড়পত্র পেয়েছিল। একটি ঘরে চার-পাঁচজন মানুষ গল্প করছিলেন। অর্ক নাম বলতে দুজন বিখ্যাত লেখককে চিনিয়ে দিল একজন। অর্ক নমস্কার করে বলল, আমি বেলগাছিয়া থেকে এসেছি। চলুন।

মোটাসোটা স্বাস্থ্যবান বৃদ্ধ বললেন, এখন তো যেতে পারব না ভাই। রবীন্দ্রসদনে আমার একটা সভা আছে ঠিক ছটায়। সেটা সেরে চলে যাবো। সাতটা নাগাদ পৌঁছে যাবো।

আমি কি ততক্ষণ অপেক্ষা করব?

না না। কোন দরকার নেই। এটা জনগণের নবজাগরণের ব্যাপার। এখানে না গিয়ে পারি? রবীন্দ্রসদনটা অ্যাভয়েড করতে পারছি না, আমার এক বান্ধবী খুব ধরেছে। চিন্তা করো না।

অর্ক দ্বিতীয়জনের দিকে তাকাল। তিনি পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে এগিয়ে ধরলেন, এটা নিয়ে যান।

অর্ক কাগজটা নিয়ে দেখল তাতে চার লাইনে লেখা রয়েছে যে বেলগাছিয়ার জনগণের অসীম সাহসিক কাজের জন্যে লেখক গর্বিত। তিনি মনে করেন সমস্ত ভারতবর্ষ এই ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হবে।

অর্ক মুখ তুললো, আপনি যাবেন না?

নীরবে মাথা নাড়লেন লেখক, না।

কিন্তু আমরা সবাই আশা করে আছি।

মোটেই না। ওখানে সবাই ভিড় করবে ফিল্ম স্টার দেখতে। নিজেদের খুব ফেক মনে হয় ওসব জায়গায় গেলে। এই কাগজটা মাইকে পড়ে দিও।

কিন্তু আপনি যাবেন বলেছিলেন!

যাবো বলেছিলাম বলে কি জোর করে ধরে নিয়ে যাবে? তোমরা দেখছি সমাজবিরোধী তাড়াতে গিয়ে নিজেরাই তাদের ফলো করছ।

টেবিলের অন্য প্রান্ত থেকে আর একজন বললেন, এসব ঝামেলায় জড়ানোর কি দরকার। কাল দেখবেন ওই মাস্তান আপনার বাড়িতে বোম মেরে গেল। কলকাতার মাস্তানরা পুলিসের চেয়েও ইউনাইটেড।

না না। ওকথা বলো না। প্রতিবাদ নিশ্চয়ই করব। তবে কিনা এক একজনের প্রতিবাদের মাধ্যম তার সুবিধে অনুযায়ী। আমি যদি একটা প্রবন্ধ লিখি অনেক বেশী লোক পড়বে, পড়ে অনুপ্রাণিত হবে। বুঝেছ?

গাড়িতে এসে অর্ক সঙ্গীর দিকে তাকাল। এখন ওরা কি করবে? খালি গাড়ি নিয়ে ফিরে যাওয়া মানে নিজেদের অপদার্থতা প্রমাণ করা, সঙ্গীর এরকম বক্তব্য ছিল। সে চাইছিল রবীন্দ্রসদনের সামনে অপেক্ষা করে প্রথম লেখককে সঙ্গে নিয়ে ফিরতে। কিন্তু অর্ক বলল, এরা কেউ যাবে না। সবাই নিজেদের বাঁচাতে চায়। মুখে বড় বড় কথা বলবে কিন্তু কাজের বেলায় এগোবে না।

গাড়ি নিয়ে পাড়ায় ফিরে এল অর্ক। পার্কে সভার আয়োজন হয়েছে। কয়েক হাজার মানুষ বক্তৃতা শুনতে এসেছে। গাড়ি ছেড়ে দিয়ে অর্ক মঞ্চের পেছনে আসতেই সুবল উত্তেজিত হয়ে এগিয়ে এল, ওঁরা এসেছেন?

মাথা নাড়ল অর্ক, না।

ঘটনাগুলো খুলে বলল সে। চুল ছিঁড়তে লাগল সুবল। আরও দুটো দল গিয়েছিল বিখ্যাত মানুষদের নিয়ে আসতে। তারাও ব্যর্থ হয়ে ফিরেছে। বেশীর ভাগই বাড়িতে নেই, কেউ কেউ অসুস্থ। অর্ক দেখল চারজন মানুষ এসেছেন তালিকা অনুযায়ী। এদের কেউ আনতে যাননি। বয়স্ক এবং খুব কম পরিচিত মানুষ।

এখন এই ব্যগ্র জনতাকে কি বলবে ওরা? শান্তি কমিটি ঘোষিত মানুষদের আনতে পারেনি। কলকাতার বিখাত মানুষরা শান্তি কমিটির সঙ্গে নেই? কিছু দুর্বল মানুষ তো সঙ্গে সঙ্গে ভেঙ্গে পড়বে। এত বড় একটা হাস্যকর অবস্থা বিরোধীরা কাজে লাগাবে। কি করা যায় ঠিক করতে পারছিল না কেউ। সতীশদা বলল, আমরা বক্তৃতা শুরু করি তারপরে দেখা যাবে। যে চারজন এসেছেন তাঁরাও কিছু বলুন। আসলে পলিটিক্যাল বেস না থাকলে কোন আন্দোলন সফল হতে পারে না।

সুবল বলল, এ ধরনের কথা বলবেন না। তাহলে আমরা যেটুকু এগিয়েছি সেটা ভেস্তে যাবে।

সতীশদা সামান্য উত্তেজিত হল, আমি তোমাকে নিষেধ করেছিলাম সভা করতে। আমি মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদীদের স্বরূপ জানি।

সুবল মাথা নাড়ল, ঠিক আছে। এই মানুষগুলো আমাদের সঙ্গে মিথ্যাচার করেছেন। ওঁরা যা বলেছেন তা সভায় বললে মানুষ আরো ঘাবড়ে যাবে। অতএব আমাদের মিথ্যে কথা বলতে হবে। এছাড়া কোন উপায় নেই।

কি মিথ্যে?

আমি বলব যাঁদের আসার কথা ছিল, এখানে আসতে যাঁরা খুব আগ্রহী ছিলেন তাঁদের প্রত্যেকের বাড়িতে কয়লার সমর্থক মাস্তানরা গিয়ে শাসিয়ে এসেছে এই সভায় এলে ফল খারাপ হবে। ফলে তাঁরা এখানে আসতে সাহস পাচ্ছেন না। কয়লা গ্রেপ্তার হয়েছে কিন্তু তার সঙ্গীরা যে এখনও আমাদের ক্ষতি করতে চাইছে এই ঘটনা থেকেই প্রমাণ হয়। অতএব এলাকার সমস্ত মানুষকে আরও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে যাতে ওরা অনুপ্রবেশ না করতে পারে। এইভাবে জনতাকে উত্তেজিত করা ছাড়া কোন উপায় নেই।

অর্ক চুপচাপ শুনছিল। এবার বাধা দিল, কিন্তু এটা তো মিথ্যে কথা।

হয়তো মিথ্যে আবার সবটাই তো মিথ্যে নয়। ওঁরা আসেননি এই ভয়ে যদি কখনো ওঁদের বিপদ হয়। কেউ শাসায়নি সত্যি কিন্তু না শাসাতেই তো ওঁরা ভয় পেয়েছেন। সুবল চলে গেল সামনে।

অর্ক সতীশদাকে বলল, আপনি যাননি। আমি ওঁদের কাছে গিয়েছিলাম। ওঁরা যে আসবেন বলে কথা দিয়েছিলেন তাই আমার মনে হয়নি। এদের মুখাশ খুলে দেওয়ার বদলে বাঁচানো হচ্ছে। এটা ঠিক কি?

সতীশদা বলল, উত্তেজিত হয় না অর্ক। তোমার বয়স কম। সুবল বোধ হয় ঠিক কাজ করছে। অন্তত আজকের সন্ধ্যায় এছাড়া কোন উপায় নেই।

সভার কাজ শুরু হল। প্রথমেই সুবল এলাকার মানুষদের জানাল কি পরিস্থিতিতে এলাকার হয়ে নিমন্ত্রিতরা আসতে পারেননি। কয়লার বন্ধুরা কতখানি সক্রিয় হয়েছে তার বিস্তারিত বর্ণনা শোনাল। এমন কি টালিগঞ্জ থেকে একজন মানুষ বেলগাছিয়ায় যাতে না আসেন তার ব্যবস্থা করেছে ওরা। কাল্পনিক কাহিনী শেষ হওয়ামাত্র জনতা উত্তেজিত হল। আর কেউ প্রশ্ন করল না। কেন বিখ্যাত মানুষেরা এলেন না। কিন্তু সভার আয়তন ধীরে ধীরে কমতে শুরু করল।

রাত সাড়ে আটটায় সব শেষ। সুবলকে খুব বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। অর্ক তাকে ডাকল, আমরা এখন কি করব?

কি করব মানে?

শান্তি কমিটির কাজ কি হবে?

পাড়ায় যাতে শান্তি বজায় থাকে তার দিকে নজর রাখব।

কিন্তু সেটা কতদিন সম্ভব?

সতীশদা এগিয়ে এল, তুমি কি বলতে চাইছ?

অর্ক বলল, আজকেই একটা বিরাট মিথ্যে কথা বলে জনসাধারণকে শান্ত করতে হল। কিন্তু একদিন তো সত্যি কথাটা লোকে জানবেই।

আমি তো বলেছি পুরো মিথ্যে বলিনি। এ নিয়ে তুমি ভেবো না।

অর্ক আর কথা বাড়াল। ওর মনে আজ এই মুহূর্তে অনেকগুলো প্রশ্ন এসেছিল। যখন সমাজবিরোধীদের ঠাণ্ডা করার প্রশ্ন উঠছে তখন শান্তি কমিটি একযোগে কাজ করতে পারছে। কিন্তু কদিন বাদে যখন রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের প্রয়োজনে আলাদা সভা করবে তখন? ধরা যাক একটা ইলেকশন এল। সতীশদারা তখন শান্তি কমিটির সহকর্মী কংগ্রেসীদের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে বাধ্য হবে। উল্টো দিক থেকেও তাই হবে। সে সময় শান্তি বজায় রাখবে কারা? ইলেকশনের সময় যেসব ছেলে বাইরে থেকে কাজ করতে আসে পাটির হয়ে তারা কারা? তাছাড়া শান্তি কমিটি থাকলে এলাকার ওপর পার্টির জোর কমে যাবে। এটা কতদিন পার্টি চাইবে। আজকের সভায় নির্বাচিত এম এল এ এবং বিরোধী সদস্য এসেছিলেন। পাশাপাশি বসে কথা বলেছেন হাসিমুখে। কি কদিন সম্ভব হবে এই সম্পর্ক রাখা। = চারজন বিখ্যাত মানুষ যে দুনম্বরী আচরণ প্রকাশ্যে করতে পারলেন তা দেখে মনে মনে মুষড়ে পড়ছিল অর্ক। পার্ক থেকে বেরিয়ে সে চুপচাপ হেঁটে আসছিল অন্ধকার পথ দিয়ে। জায়গাটা নির্জন। কিছুক্ষণ হাঁটার পর তার খেয়াল হল একটা ট্যাক্সি খুব ধীরে তার পেছন পেছন আসছে। এদিক দিয়ে ঘন ঘন গাড়ি গেলেও মানুষের চলাচল কম। অর্ক বিপদের গন্ধ পেয়ে সতর্ক হবার চেষ্টা করামাত্র ট্যাক্সিটা পাশে এসে দাঁড়াল। অর্ক অবাক হয়ে দেখল বিলু মুখ বের করে জিজ্ঞাসা কল, গুরু, তোমাকে কদিন থেকে খুঁজছি, কিছুতেই পাচ্ছি না।

অর্কর নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হল; সে দেখল গাড়িতে কোয়া ছাড়াও আর একজন বসে আছে যাকে সে চেনে না। সে নিচু গলায় জিজ্ঞাসা বরল, কেন?

বিলু জিজ্ঞাসা করল, আমার নাম নাকি লিস্টে ছিল না, তুমি ঢুকিয়েছ?

অর্ক শক্ত হল, হ্যাঁ।

কেন গুরু? আমাকে এমন বাঁশ দিলে কেন?

দুদিন বাদে এরা জানতেই পারতো।

এখন আমরা কি করব? মাল তো ফুরিয়ে আসছে।

থানায় যা। সারেণ্ডার কর।

কোয়া এবার কথা বলল, আমি তোকে বললাম এছাড়া উপায় নেই।

তারপর? বেরিয়ে এলে তুমি ব্যবস্থা করবে? পাড়ায় কোন অসুবিধে হবে না?

না।

ঠিক হ্যায়। বিলু নির্দেশ দিতে ট্যাক্সিটা চলে গেল। আর অর্কর মন খারাপ হয়ে গেল। ছেলেগুলো তাকে বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু সে এদের দেখেই প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়েছিল। মন কখনই কোন কিছুকে ভালভাবে নিতে পারে না কেন? তারপরেই তার মাথায় দ্বিতীয় চিন্তার উদয় হল। বিলু এবং কোয়া সমাজবিরোধী বলে চিহ্নিত। পাড়ার লোক ওদের পেলে ছেড়ে দেবে না। তা সত্ত্বেও ওরা ঝুঁকি নিয়ে এখানে এসেছে তার সঙ্গে কথা বলতে। শান্তি কমিটির কেউ সেটা দেখলে যদি ভুল বোঝে? যদি মনে করে তার সঙ্গে এদের গোপন যোগাযোগ আছে! সঙ্গে সঙ্গে একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব ওর মনে এল। যতক্ষণ সে নিজে অন্যায় করছে না ততক্ষণ এসব নিয়ে চিন্তা করার কোন মানে হয় না।

ঈশ্বরপুকুরে ঢুকেই ন্যাড়ার দেখা পেল সে। ন্যাড়া বিড়ি টানছিল। ওকে দেখে বলল, যাঃ শালা, সব বিলা হয়ে গেল।

কেন?

ফিলিম স্টার এল না?

তাই দেখতে গিয়েছিলি?

আবার কি? শান্তি কমিটি হেভি ঢপ দিল।

ওরা আসেনি শান্তি কমিটি কি করবে?

হঠাৎ ন্যাড়া কাছে সরে এল, জানো অক্কদা! কয়লাকে তো তোমরা তাড়ালে। ওদিকে ওয়াগনের কারবার কিন্তু থেমে নেই।

থেমে নেই মানে?

গ্যালিফ স্ট্রীটের কচুয়া তো কয়লার ভয়ে এতদিন এদিকে আসতে পারেনি এখন লাইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। এতদিন বেলগাছিয়ার ছেলেরা কাজকর্ম পেত এখন গ্যালিফ স্ট্রীটের ছেলেরা পাচ্ছে। কাজ চাইতে গেলে বলে, যাঃ ফট। শান্তি কমিটি মারাগে যা।

তুই গিয়েছিলি নাকি?

সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল ন্যাড়া, না না। আমি শুনেছি।

অর্ক ন্যাড়াকে ছেড়ে তিন নম্বরের সামনে চলে এল। তার মাথার ভেতরটা ক্রমশ অসুস্থ হয়ে আসছিল। কয়লা নেই কিন্তু আর একটা কয়লা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। যতদিন মানুষের অভাব থাকবে তদ্দিন এসব থাকবেই। হাজারটা শান্তি কমিটি তৈরি করে দূর করা যাবে না।

গলিতে ঢুকতেই ডাক শুনতে পেয়ে মুখ ফেরাল অর্ক। সেই শীর্ণ প্রৌঢ় এগিয়ে এল তার সামনে, তোমার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি বাবা।

আমার জন্যে?

হ্যাঁ। দ্যাখো আজ মদ খাইনি। সন্ধ্যে থেকে বসে বসে এখানে দাঁড়ালাম। শুনেছিলাম তুমি পার্কের মিটিং-এ গেছ। বাড়ি ফিরবার সময় ধরব বলে অপেক্ষা করছিলাম। প্রৌঢ় হাসল।

কিছু দরকার আপনার?

কেন? তোমার তো মনে থাকার কথা। এই নাও দুশো টাকা। তোমার হাতে তুলে দিলাম। আমার মাস মাইনে। ওদের যদি পুরো মাস পেট ভরিয়ে রাখো তাহলে কথা দিচ্ছি আর মদ ছোঁব না। নাও, টাকাটা ধরো।

৫৯. একটি অভিনব কাণ্ড আরম্ভ হল

তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেনে একটি অভিনব কাণ্ড আরম্ভ হল। ব্যাপারটা যে এইরকম পর্যায়ে পৌঁছাবে তা অর্ক কখনও চিন্তা করেনি। সেদিন টাকাটা নিতে চায়নি সে। মনে হয়েছিল লোকটা মতলববাজ। নাহলে এইভাবে টাকা দেবার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকে? নিশ্চয়ই অন্য কোন ধান্দা আছে।

সে বলেছিল, যদি আমি ওই টাকায় সারা মাস আপনার পরিবারকে খাওয়াতে পারি তাহলে আপনিও পারবেন।

না, আমি পারছি না। তুমি যখন বলেছ পারবে তখন তোমাকে পারতে হবে। নইলে বস্তির সবার সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাইতে হবে আমাকে মারার জন্যে। বলতে হবে তুমি অন্যায় করেছ।

আমি কোন অন্যায় করিনি। আপনি মদ খেয়ে খিস্তি করছিলেন। আমি যা করেছি তা ঠিক করেছি।

তাহলে যা বলেছ তা ঠিকভাবে পালন কর।

আপনার মতলবটা কি খুলে বলুন তো?

কোন মতলব নেই। তুমি যা বলেছ তাই করো। আমি আর মদ্যপান করব না কথা দিচ্ছি।

ঠিক আছে। আপনি আপাতত টাকাটা রাখুন। আমি কাল সকালে আপনার সঙ্গে কথা বলব। আমার মা হাসপাতালে। এখন আমি কিছু ভাবতে পারছি না।

সে কথা বললে অবশ্য কিছু বলার থাকে না। তবে আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু তোমাকে টাকাটা নিতেই হবে। নইলে আমি ছাড়বো না। তুমি আমাকে প্রকাশ্যে অপমান করেছ। গুণ্ডা তাড়ালেই কি সব হয় বাবা, আমাদের পেটের ওপর যে গুণ্ডামি হয় সেটা বন্ধ করো আগে তবে বুঝি!

ঘরে ঢুকে অর্ক দেখেছিল অনিমেষ শুয়ে আছে। ওকে দেখে বলল, তোদের মিটিং কেমন হল?

হল। অর্কর মন স্থির ছিল না।

অনিমেষ ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে?

কিছু না।

গোলমাল হয়েছে?

না। জানো বাবা, বিখ্যাত মানুষের কাজ আর কথা সব সময় এক হয় না। যাঁরা আজকে আসবেন বলে কথা দিয়েছিলেন তাঁরা কি সুন্দর কেটে পড়লেন। তাঁদের অপরাধ ঢাকতে শান্তি কমিটিকে একগাদা মিথ্যেকথা বলতে হল।

তুই কাদের আনতে গিয়েছিলি?

অর্ক নামগুলো বলল। এমন কি সেই চিত্রাভিনেতার সঙ্গে তার বাক্যালাপ পরিণামে মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা, কিছুই বাদ দিল না। শুনতে শুনতে অনিমেষ উত্তেজিত হয়ে উঠল, আরে কি আশ্চর্য। এতগুলো বছর হয়ে গেল তবু লোকটা একটুও পাল্টায়নি।

অর্ক জিজ্ঞাসা করল, তুমি চেনো ওঁকে?

দুদিন দেখেছিলাম। য়ুনিভার্সিটিতে ভিয়েতনামের ওপর একটা অনুষ্ঠানে তাঁর দল নাটক করেছিল। উনি করেননি। কারণ আমরা ওঁর জন্যে পয়সা দিতে পারিনি। অথচ সেদিন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে তিনি জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছিলেন। একগাদা মিথ্যে কথা। সারাটা জীবন লোকটা ভাঁওতা দিয়ে কাটিয়ে গেল? আশ্চর্য!

রাত্রে খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে পড়ার পরও ঘুম এল না। অর্কর মাথার মধ্যে শুধু বুড়োর কথাগুলো পাক খাচ্ছিল। গুণ্ডা তাড়ালেই কি সব হয় বাবা, আমাদের পেটের ওপর যে গুণ্ডামি সেটা বন্ধ করো আগে তবে বুঝি! চোখ বন্ধ করলেই যেন শীর্ণ হাতের মুঠোয় ধরা টাকাগুলো সামনে চলে আসছিল। শেষ পর্যন্ত উঠে বসেছিল অর্ক। সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করেছিল, ঘুমোসনি?

তুমি জেগে আছ?

তোর মায়ের কথা ভাবছিলাম। চেহারাটা কেমন যেন পাল্টে গিয়েছে, না?

অর্ক বাবার দিকে তাকাল। অন্ধকারে বাবার মুখ দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ তার মনে অন্যরকম অনুভূতি এল। কেমন একটা কষ্ট, বাবার জন্যে একধরনের মমতা যা তার কোনকালে কখনও মনে আসেনি। জলপাইগুড়ি থেকে আসার পর আজ এই মুহূর্তে অর্কর মনে অনিমেষ সম্পর্কে আর কোন ক্ষোভ রইল না। সে কোন জবাব দিল না। অনিমেষ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিঃশ্বাস ফেলল, জীবনটা মিছিমিছি খরচ হয়ে গেল। তারপরেই সে যেন সচেতন হল, তুই ঘুমোসনি কেন?

অর্ক কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর ধীরে ধীরে ঘটনাটা খুলে বলল। সব শুনে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, তুই কি করবি ভেবেছিস?

বুঝতে পারছি না। লোকটা যেন আমাকে জব্দ করতে চাইছে।

তুই জব্দ হবি কেন?

কি করব আমি?

তুই চ্যালেঞ্জটা অ্যাকসেপ্ট কর। অনিমেষ উত্তেজিত হয়ে উঠে বসল, বিখ্যাত ব্যক্তিরা যেসব থিওরি দিয়ে গেছেন সেসব বাস্তবে সম্ভব হয় কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা যাক। কিন্তু একটা ফ্যামিলি নয়। এই বস্তিতে ওইরকম আয়ের পরিবারগুলো একত্রিত করে এই পরীক্ষা চালাতে হবে। অর্ক, আমি তোর সঙ্গে আছি।

কিন্তু বাবা, অন্য সবাই রাজি হবে কেন?

হবে। কারণ প্রত্যেক মানুষ একটা রিলিফ চায়।

সেই রাত্রে অনেকক্ষণ ওদের কথা হয়েছিল। অন্ধকার ঘরে পিতা এবং পুত্র পরস্পরের মুখ দেখতে পায়নি কিন্তু উত্তেজনার স্পর্শ পেয়েছিল। বাবাকে এতটা উৎসাহিত হতে অর্ক কখনও দ্যাখেনি।

পরের দিন সকালে দ্বিতীয় ব্যক্তিটি স্বেচ্ছায় এগিয়ে এলেন। দরজায় দাঁড়িয়েছিল হরিপদ। বউ মারা যাওয়ার পর লোকটার দেখাই পাওয়া যেত না। এখন ন্যাড়াই যেন অনেক বেশী সাবালক হয়ে গেছে। অনুপমা আসে যায়। দরজায় দাঁড়িয়ে হরিপদ তার প্রায় মিনমিনে গলায় বলল, একটু কথা আছে।

অর্ক তাকাল। খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি নিয়ে লোটা ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে। এই পৃথিবীতে যেন মানুষটার জোর করে বলার কিছু নেই। সে দাঁড়াতেই হরিপদ এগিয়ে এল, সত্য মিথ্যে জানি না, তুমি নাকি দুশো টাকা দিলে একটা পরিবারকে সারা মাস খাওয়াবে। শুনলাম কিন্তু বিশ্বাস হল না। সত্যি?

অর্ক মাথা নাড়ল, অনেকটা তাই। তবে পরিবার বলতে যদি একশজন মানুষ হয় তাহলে পারব

আমার তো বেশী লোক নেই। সে চলে গেছে। অনু তো এখন শ্বশুরবাড়িতে, থাকার মধ্যে আমি আর ওরা তিনজন। খুব বেশী হবে?

না। অর্ক মাথা নেড়েছিল।

তাহলে বাবা তুমি আমাকে উদ্ধার করে। আমি আর বোঝা টানতে পারছি না। যে কদিন আছি তোমার ওপর দায়িত্ব দিলাম। কিন্তু একটা কথা, তুমি আগ বাড়িয়ে দায়িত্ব নেবে কেন?

কেন বলুন তো?

সেটাই তো বুঝতে পারছি না। এতে কি তোমার কোন লাভ হবে? আমি নিজে দুশো টাকায় ওদের মুখ বন্ধ করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি–তুমি কি করে তা থেকে লাভ করবে? আমার মাথায় ঢুকছে না।

থাক। অর্ক হেসে ফেলল, এ নিয়ে চিন্তা করে কি হবে। আমি লাভ করলে তো আপনার আপত্তি নেই!

না আপত্তি কিসের! শুধু ওরা যেন দুবেলা পেট ভরে খেতে পায়।

আমি এখনই আপনাকে কথা দিচ্ছি না। তবে পেট ভরে খাওয়া মানে খুব সাধারণ খাওয়া। এই নিয়ে কারো কোন নালিশ করা চলবে না। আসলে যাঁদের পুরো মাস খাওয়া জোটে না তাঁরাই আসতে পারেন।

বুঝেছি, বুঝেছি। আমি বলছি না তুমি পোলাও কালিয়া খাওয়াবে। দুবেলা পেট ভরলেই হল।

খবরটা যেন তিন নম্বরে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। সবাই অর্ককে জিজ্ঞাসা করছে কথাটা সত্যি কিনা। দেখা যাচ্ছিল বেশীরভাগ পরিবার যেন নিজেদের কাঁধ থেকে দায়িত্ব নামিয়ে দিতে পারলে বাঁচে। আবার উল্টো সন্দেহের কথাও কানে আসছিল। হাসপাতালে যাওয়ার আগে অর্ক শান্তি কমিটির অফিসে গেল। কয়লার বিরুদ্ধে এলাকার বাসিন্দাদের পক্ষে কয়েকটি মামলা করা। হয়েছে। সেই মামলার খরচ চালানোর জন্যে চাঁদা তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সুবল সতীশদা সে ব্যাপারে ব্যস্ত। একটু ফাঁক পেলে অর্ক ওদের কাছে কথাটা তুলল।

সুবল বলল, তুমি ক্ষেপেছ? সাধ করে এসব ঝামেলায় কেউ জড়ায়? দুদিন বাদে সবাই বদনাম দেবে। তাছাড়া অন্যের হাতে টাকা তুলে দিলেই মানুষের মনে বাবুয়ানা এসে যায়। তখন দেখবে হুকুম করবে।

অর্ক বলল, কিন্তু যদি করা যায় তাহলে মানুষগুলোর সত্যিকারের উপকার হতো। এদিকের সমাজবিরোধীরা তিন নম্বরের অভাবকে কাজে লাগায়। যদি পেট-ভরা খাবার পায় তাহলে–।

বোকার মত কথা বলল না। আমরা মানুষের ব্যক্তিগত সমস্যায় নাক ঢোকাতে চাই না। তাছাড়া দুশো টাকায় চারজন মানুষকে তুমি কিভাবে খাওয়াবে যদি তারা সেটা নিজেরা না পারে!

অর্ক বলল, আমি কালকে হিসেব করেছি। সেটা সম্ভব। অনেক মানুষ একসঙ্গে খেলে সেটা সম্ভব। আর তার ওপরে যদি বাইরের সাহায্য পাওয়া যায় তাহলে তো কথাই নেই।

কিন্তু আলটিমেট লাভ কি হবে?

সবাই যদি একত্রিত হয়, একটা পরিবারের মত সম্পর্ক হবে। এখন যেসব কাজ করা সম্ভব নয় তখন সেটা সহজ হবে।

সুবল বলল, আকাশকুসুম কল্পনা।

এইবার সতীশদা কথা বলল, অর্ক, তোমার মাথায় কমিউনের চিন্তা কে ঢোকাল? তার জন্যে একটা রাজনৈতিক শিক্ষা প্রয়োজন।

অর্ক উঠে দাঁড়াল, যদি বাইরের গুণ্ডামি রুখতে আমরা কোন রাজনৈতিক শিক্ষা ছাড়া এক হতে পারি তাহলে পেটের খিদে মেটাতেও এক হতে পারব। দেখি কি করা যায়!

সুবল বলেছিল, অর্ক, এটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। শান্তি কমিটিকে এর সঙ্গে জড়িও না। এতবড় একটা ব্যাপার সামলাতে আমরা নাস্তানাবুদ হচ্ছি।

এইসব কথা শুনে অর্কর জেদ আরও বেড়ে গেল। ওরা যদি যুক্তি দিয়ে তাকে বোঝাতো সে মেনে নিত। কিন্তু শুধুই সমালোচনা, ঝামেলা এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে উপদেশ–এগুলো শুনলেই মনে অন্য রকম প্রতিক্রিয়া হয়।

হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে তার জন্যে অন্য বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। গেটের কাছে বিলু দাঁড়িয়ে, একা।

অর্ক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, থানায় যাসনি?

হাসল বিলু, গিয়েছিলাম। শালারা আমাকে পছন্দ করল না।

মানে?

মানে আবার কি? বলল, শান্তি কমিটির লিস্টে যদিও আমার নাম আছে কিন্তু কোন ঠিকঠাক অভিযোগ নেই। একরাত হাজতে রেখে বলল, যা শালা, শান্তি কমিটির সঙ্গে বোঝাপড়া করে নে।

কোয়া?

ওকে ধরেছে। খুব আদর করছে। গুরু, আমি কয়লার সঙ্গে কদিন মাল টানার ব্যবসা করেছি, গুণ্ডামি তো করিনি। এখন কি হবে?

যা তাহলে শান্তি কমিটির কাছে। গিয়ে বল।

আমি একা পাড়ায় ঢুকতে সাহস পাচ্ছি না।

অর্ক বিলুর দিকে তাকাল, তুই সত্যি থানায় গিয়েছিলি তো?

চোখ কপালে তুলল বিলু, আই বাপ! আমি কি মিথ্যেকথা বলছি? তুমি আমার সঙ্গে থানায় চল তাহলে।

ঠিক আছে। তুই আমার সঙ্গে পাড়ায় চল।

ফেরার পথে অর্ক বিলুকে ঘটনাটা বলল। তার মাথায় যে জেদ চেপেছে সেই কথাও। বিলু বলল, কাজটা ভাল, কিন্তু মুনাফা?

কিসের মুনাফা?

মাল আসবে এ থেকে?

ভ্যাট। আমি চাইছি তিন নম্বরের গরীব মানুষগুলো দুবেলা পেট ভরে খেয়ে বাঁচুক। তাহলেই পরিবেশটা পাল্টে যাবে। এর পরে আমরা তিন নম্বরের বেকার ছেলেদের নিয়ে আরও কিছু করতে পারি।

বিলু হাল ছেড়ে দিল, আমি আর পারছি না। ক’দিন চোরের মত ঘুরে ঘুরে পাগলা হয়ে গেছি। ঠিক আছে, এখন তুমি যা বলবে আমি তাই করব। এতে তো পাড়ায় থাকা যাবে।

বিলুকে নিয়ে শান্তি কমিটির সঙ্গে অর্কর একটু ঝামেলা হল। যতক্ষণ না বিলু সমাজবিরোধী নয় বলে প্রমাণিত হচ্ছে ততক্ষণ তাকে পাড়ায় ঢুকতে দিতে শান্তিকমিটি চায়নি। অর্ক বলেছিল, ও যে সমাজবিরোধী সেটা প্রমাণ করুন আগে। পুলিস যখন বলেছে কোন কেস নেই তখন আমরা কি করতে পারি। তাছাড়া এ ব্যাপারে যা শাস্তি পাওয়ার ও পেয়েছে।

শেষ পর্যন্ত ঠিক হল, বিলুর সমস্ত দায়িত্ব অর্কর। ভবিষ্যতে যদি বিলু কোন কাজ করে তবে তার জন্যে অর্ক দায়ী থাকবে। বিলুকে দিয়ে অর্ক প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিল, অন্তত মাসখানেক সে অন্য কোন ধান্দায় যাবে না। অর্ক যা বলবে তা শুনতে হবে।

কিন্তু এর মধ্যেই তিন নম্বরে একটা আলোড়ন উঠেছে। অর্ককে প্রতিনিয়ত নানান প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে। অনিমেষের সঙ্গে কথা বলে অর্ক শেষ পর্যন্ত পা বাড়াল। তিন নম্বরের মাঝখানে যে জলের কল আছে তার পাশে খানিকটা খোলা জায়গায় মেয়েরা গল্প করত। সেই জায়গাটিকে নির্বাচন করা হল। ঈশ্বরপুকুর লেনের একমাত্র ডেকোরেটরের দোকান থেকে ত্রিপল ভাড়া করে আনা হল। সেই সঙ্গে বড় বড় হাঁড়ি কড়াই। ঠিক হল, মাসকাবারে ভাড়া দেওয়া হবে। ছ’টি পরিবার এগিয়ে এসেছিল অর্কর কাছে। তাদের কাছে মাথাপিছু পঞ্চাশ টাকা করে নেওয়া হল। বিলুকে ক্যাশের ভার দিল অর্ক। প্রথমে দ্বিধা এবং নিরাসক্তি কাজ করলেও হঠাৎই যেন খুব উৎসাহিত হয়ে পড়েছে বিলু। চিৎকার চেঁচামেচি করে খাটছে, খাটাচ্ছে। ন্যাড়াকে সঙ্গে পাওয়া গেল। বিলু আসার পর ন্যাড়া সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে। কিন্তু রান্নার লোক নিয়ে সমস্যা হল। ন্যাড়া এবং অর্কর বাড়িতে কোন মহিলা নেই এই মুহূর্তে যে রান্না করতে পারে। অন্য চারটি পরিবারের মেয়েরা এত লোকের রান্না করতে রাজি নয়। তারা নানা রকম বাহানা করতে লাগল। রান্নার মেনু কি হবে তা নিয়েও মতবিরোধ শুরু হল। শেষ পর্যন্ত অর্ক বলল, আমার হাতে যখন আপনারা টাকা দিয়েছেন তখন আমি যা বলব তা আপনাদের শুনতে হবে। এই টাকায় যা খাওয়ানো সম্ভব তাই ব্যবস্থা করা হবে। আপনারা অভুক্ত থাকবেন না এই কথা ছিল। এর বেশী কিছু চাইলে সম্ভব নয়।

অসন্তোষ চলছিল। যদিও মুখ ফুটে কেউ কিছু বলছিল না। অর্কর মুখের দিকে সেই মাতাল বুড়ো পিটপিটিয়ে তাকায়, ভাবখানা, কি হে কেটে পড়বে নাকি? তাহলে আমি কিন্তু ছাড়ব না।

অর্কর লোকটাকে দেখলেই জেদ বেড়ে যায়। সে ঠিক করল যেমন করেই হোক একটা মাস অন্তত চালাতে হবে। কিন্তু রাঁধবে কে?

সেদিন বিকেলে হাসপাতালে শুয়ে মাধবীলতা হেসে বলল, আমার হাতের রান্না যদিও খুব খারাপ তবু একবার চেষ্টা করতে পারি।

অর্ক আঁতকে উঠল, তুমি রাঁধবে? মাথা খারাপ।

কেন? আমি তো ভাল হয়ে গিয়েছি।

কথাটা অর্ধসত্য। মাধবীলতার এখন তেমন কোন অসুবিধে না থাকলেও শরীর প্রচণ্ড দুর্বল। এখনও সাদাটে ভাব রয়েছে। সেলাই কাটা হয়েছে। ডাক্তার অবশ্য কিছুদিন রেখে দিতে চাইছেন কিন্তু মাধবীলতা ছটফট করছে বাড়িতে ফিরবার জন্যে।

হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পথে অর্ক দেখল ঝুমকি আসছে। সেই দিনের পর এই প্রথম ঝুমকিকে দেখল সে। তাকে দেখে ঝুমকি এমন ভঙ্গীতে ট্রামের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল যাতে বোঝা যায় এড়াতে চাইছে। অর্ক খানিকটা দৌড়ে ওকে ধরে ফেলল, কি ব্যাপার?

কিসের কি ব্যাপার?

আমাকে দেখে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছিল কেন?

আমার কি দরকার পড়েছে এড়িয়ে যাওয়ার?

কি ব্যাপার বলো তো, রাগ করেছ?

আমার রাগের আর কি দাম আছে?

বুঝেছি। যাচ্ছ কোথায়?

যেখানে ইচ্ছে!

এত সেজেগুঁজে?

আমাদের সাজ না দেখলে তো কেউ পকেটে হাত দেবে না।

মানে?

মানে বোঝার মত যথেষ্ট বয়স হয়েছে। ছেড়ে দাও পথ, আমি যাব।

তুমি সেই ক্যাবারে ড্যান্সারের কাছে যাচ্ছ?

হ্যাঁ।

কেন? তুমি তো ছেড়ে দিয়েছ সেসব।

আমি কোনদিন ড্যান্সার হতে পারব না। কিন্তু আমাদের পেট তো এই কথা শুনবে না। কদিন ধরে বাড়িতে বসে বসে আর সহ্য করতে পারছি না।

তাই শরীর বিক্রি করতে বেরিয়ে পড়লে?

নইলে এই শরীরটাকে দড়িতে ঝোলাতে হয়।

ঘেন্না করে না তোমার?

হঠাৎ ঝুমকির মুখ শক্ত হয়ে গেল, অন্য কেউ হলে আমি জবাব দিতাম। তোমার বাবাও তো আমাকে ঘেন্না করেন, তাই না। আমার হাতের রান্না খেতে তাঁর আপত্তি। শোন, এছাড়া আমার কোন উপায় নেই।

অর্ক হতভম্ব হয়ে গেল। তার পর সে মাথা নাড়ল, তোমার যাওয়া চলবে না।

ঝুমকি হাসল, গায়ের জোরে? এখনই সমাজবিরোধী বলে চেঁচাব নাকি?

সমাজবিরোধী? অর্ক হেসে ফেলল, ভাল বলেছ। কে সমাজবিরোধী নয় সেটাই বোঝা মুশকিল। গায়ের জোর খাটাবো তেমন জোরও নেই। কিন্তু তুমি না গেলে আমার ভাল লাগতো। তুমি নষ্ট হয়ে যাবে।

তবু তো বেঁচে থাকব। বাঁচাতে পারব। আমি দুদিন কিছু খাইনি।

হঠাৎ অর্কর মাথায় একটা চিন্তা পাক খেয়ে গেল। সে গাঢ় গলায় বলল, আমি যা বলব তা তুমি শুনবে?

কি?

তুমি আমার সঙ্গে ফিরে চল।

তারপর?

আমার সঙ্গে কাজ করো।

কি কাজ?

আমি যা বলব তাই। তুমি আমাকে সাহায্য করবে না?

তাতে আমার কি লাভ?

অর্ক বলল, বুঝিয়ে বলছি। তুমি আমার সঙ্গে ফিরবে?

ঝুমকির ইতস্তত ভাবটা যাচ্ছিল না। একটা ট্রামকে চলে যেতে দেখল সে। তারপর যেন অনিচ্ছায় অর্কর সঙ্গে হাঁটতে লাগল। অর্ক সেটা লক্ষ্য করল, তুমি কি খুব বড়লোক হতে চাও?

কে বলেছে! আমি স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে চাই।

তুমি নিশ্চয়ই শুনেছ আমরা তিন নম্বরে কি করতে যাচ্ছি?

শুনেছি। কিন্তু সেই টাকাটা দেবার সামর্থ্য আমার নেই।

তোমার কাছে টাকা চেয়েছে কে?

মানে?

তুমি রান্নার ভারটা নাও।

রান্না?

হ্যাঁ, সেদিন আমাদের দুজনের ভাত রাঁধতে চেয়েছিলে আজ এই বড় দায়িত্বটা তোমাকে নিতে হবে।

এত লোকের রান্না আমি রাঁধতে পারব?

তুমি একা থাকবে না। তুমি এগিয়ে এলে অন্য মেয়েরাও আসবে। তোমার ওপর ভার থাকলে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারি।

কিন্তু?

তোমাদের খাওয়াবার দায়িত্ব আমাদের। তোমরা তো তিনজন?

ঝুমকি হাসল, অন্য কেউ হলে না বলতাম। কিন্তু এতে কি আমাদের অভাব মিটবে। নাহয় খালিপেটে থাকতে হল না।

সেটা তো কম কথা নয়। পেট ভর্তি থাকলে অন্য কাজের কথা চিন্তা করতে অসুবিধে হয় না। কি, রাজি? ঝুমকি মুখ তুলে তাকাল। তার রঙকরা মুখটা হঠাৎ যেন স্বাভাবিক হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। সে বলল, হ্যাঁ।

৬০. কলতলায় মানুষের ভিড়

সকাল থেকেই তিন নম্বরের কলতলায় মানুষের ভিড়; যেন বিয়ে বাড়ির আবহাওয়া। বড়রা মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে, বাচ্চারা নড়ছে না। বিলু মাটি আর ইট সাজিয়ে উনুন করেছে। বেশ মজবুত। তাতে আগুন দিয়ে হাঁড়ি বসানো হয়েছে। তরিতরকারি কাটা হচ্ছে অর্কদের ঘরের সামনে। রান্নার নেতৃত্ব ঝুমকির। সকাল থেকে সে কোমরে আঁচল জড়িয়ে লেগে গেছে কাজে। চারধারে এখন হইচই। অর্ক খানিক আগে অনিমেষের সঙ্গে বেরিয়ে গেছে।

একটা ছোট খাতায় হিসেব লিখছিল বিলু। রোজ যা যা কেনা হচ্ছে তা লিখে রাখতে হবে যাতে কেউ অপবাদ না দিতে পারে। ব্যাপারটার অভিনবত্ব তাকে উত্তেজিত করছে। দিনের হিসেব যোগ করার পর সে ঠোঁট কামড়ালো। যদিও আজ বেশ কিছু জিনিস বেশী আনা হয়েছে কিন্তু একে তিরিশ দিয়ে গুণ করলে যা হয় তা থেকে জমা টাকার পরিমাণ অনেক কম। বিলুর মাথায় ঢুকছিল না কিভাবে তিরিশ দিন চালানো যাবে। সে তাকিয়ে দেখল চারপাশে পিকনিকের আবহাওয়া। সে ন্যাড়াকে ডাকল, ন্যাড়া, এখান থেকে ভিড় হঠা।

হঠালেই শালারা হঠবে? অক্কদা বলেছে খিস্তি না করতে।

খিস্তি করতে তোকে বলেছি আমি?

খিস্তি না করলে এরা শুনবে না।

ঠিক আছে। কিন্তু খাওয়ার সময় যেন বাইরের লোক না বসে যায়। যারা যারা মেম্বার শুধু তারাই বসবে খেতে। নাহলে আমরা ফতুর হয়ে যাব।

ন্যাড়া কি একটা ভাবল। তারপর হন হন করে চলে গেল বড় রাস্তার দিকে। বিলু লক্ষ্য করল ছোঁকরার হাবভাবে বেশ হিম্মত-হিম্মত ভাব এসে গেছে। শরীরে বড় না হয়েও বড়দের যথার্থ অনুকরণ করে ফেলেছে ও। কিন্তু শান্তি কমিটির কাজের জন্যে এখন একটু চাপা। শুধু ও নয়, এই এলাকায় যত উঠতি মাস্তান সবাই এখন সমঝে চলছে। বিলু এসে এর মধ্যেই খবর পেয়েছে দিশী মালের চেনা ঠেকগুলো এখন বন্ধ। কিন্তু গোপনে যে বিক্রি হচ্ছে না তা নয়। তবে রাস্তায় কেউ মাতলামি করতে সাহস পাচ্ছে না। এইটে কতদিন চলবে কে জানে।

বিলু একটা সিগারেট ধরালো। আজকাল সে বয়স্কদের দেখলে সিগারেট লুকোয় না। তার ধারণা, সিগারেট খেলে কোন অন্যায় হয় না। তিন নম্বরের ছেলেরা মাল খেয়ে খিস্তি করলে বড়রা আদর করে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যায় যখন তখন সিগারেটে কোন দোষ হতে পারে না। ধোঁওয়া ছাড়তে ছাড়তে বিলু কলতলায় এসে দাঁড়াল। দুটো ইটের ওপর দাঁড়িয়ে কুমকি খুন্তি নাড়ছে। এই ঠাণ্ডা আবহাওয়াতেও মেয়েটার কপালে ঘাম জমেছে, মুখ চকচক করছে। এখন ওর শরীরে একফোঁটা রঙ নেই। বিলু চোখ ছোট করল। অর্কটার এলেম আছে। ঝুমকি যে লাইনের মেয়ে তা জানতে বাকি নেই। ক্যাবারে ড্যান্স শেখে, আয়ার কাজ করে, এসব বাজে কথা। মেয়েরা পয়স নিয়ে শুয়ে পড়ে। খুরকির সঙ্গে এককালে খুব মহব্বত ছিল। তারপরে কি কারণে সেটা ফুটে গেল তা জানা নেই। কিন্তু এই মেয়েকে দেখে কেউ ভাবতে পারবে না লে লে বাবু পঞ্চাশ টাকা। মাস্তান হঠাও, মালের ঠেক হঠাও কিন্তু রাণ্ডী হঠাও বলে কেউ চেঁচাল না।

কিন্তু এই মেয়েকে দেখলে কোন শালা রাণ্ডী বলবে? এই সময় ঝুমকি মুখ তুলে তাকাতেই বিলু হাসল। ঝুমকি খুন্তি নাড়তে নাড়তে মুখ নামিয়ে আবার ফিরে তাকাল। সেই দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে হাসি মুছে গেল বিলুর। বেশ অপরাধী ভাব ফুটে উঠল মুখে। সেইসঙ্গে ভয়। ওর মনে হল ঝুমকি যেন একটু আগে ভাবা কথাগুলো বুঝে ফেলেছে।

বিলু নিজেকে গালাগালি দিন। শালা, এই সব ভাবতে যাওয়ার কি দরকার ছিল। পুরোনো অভ্যেস। আঠার মত লেগে থাকে। ঝুমকি যদি অর্ককে বলে দেয়! সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে গালাগাল দিল সে। মেয়েটাকে কিছুই বলেনি, অতএব তার বিরুদ্ধে বলবার কিছুই নেই। স্রেফ কল্পনা করে সে ব্যাপারটা তৈরি করে নিচ্ছে। বিলু এগিয়ে গেল কয়েক পা, এই ঝুমকি, কিছু দরকার আছে? গলা তুলে প্রশ্ন করল সে।

ঝুমকি মাথা নেড়ে না বলল। তারপর সেখান থেকেই জিজ্ঞাসা করল, তুই আমায় দেখে হাসছিলি কেন রে? খুব বিচ্ছিরি হাসি।

বিলু থিতিয়ে গেল, হাসছিলাম কোথায়। অবশ্য তোকে দেখতে যেরকম অদ্ভুত লাগছে তাতে হেসে পারাও যায় না।

ঝুমকি বলল, কাজ নেই কোন? নিজের কাজে যা না।

এতগুলো লোকের সামনে ঝুমকির এভাবে কথা বলা মোটেই ভাল লাগল না বিলুর। কিন্তু সে চুপচাপ সরে এল সামনে থেকে। তারপর আবার হিসেবে চোখ রাখল। তার মনে হল অর্ক ঝুমকিকে বেশী খাতির করছে। ওদের তিনজনকে বিনি পয়সায় খাওয়ানোর কি দরকার ছিল। তার বদলে ঝুমকি দুবেলা রান্না করে দেবে, এটা সমান হল? একটা ঠাকুর রাখলে অনেক কম খরচ হতো।

অন্যমনস্ক হয়ে বিলু গলির মুখে চলে এসেছিল। সেখানে নির্মল ড্রাইভার দাঁড়িয়ে। বিলুকে দেখে সে জিজ্ঞাসা করল, তোদের চাঁদা কত রে?

কিসের চাঁদা?

বারোয়ারি খাওয়ার!

মাথা পিছু পঞ্চাশ টাকা।

কি কি খাওয়াবি?

মাছ মাংস পোলাও কালিয়া।

ভ্যাট! সত্যি কথা বল না।

পঞ্চাশ টাকায় কি খাওয়া যায় জানো না?

নির্মল মাথা নাড়ল। তারপর নিচু গলায় শুধালো, এটা কি শান্তি কমিটির পয়সায়?

না।

মাইরি কেমন যেন গোলমাল মনে হচ্ছে। ডালমে শালা কালা হ্যায়।

এই সময় একটা ট্যাক্সিকে ঈশ্বরপুকুর দিয়ে আসতে দেখা গেল। বিলুর নজরে এল অর্ক জানলা দিয়ে হাত নাড়ছে। ট্যাক্সিটা এসে দাঁড়াতেই অর্ক দরজা খুলে নামল, এই বিলু, একটা চেয়ার আনতে পারবি?

চেয়ার কি হবে?

মাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিয়েছে। চেয়ারে বসিয়ে নিয়ে যাব।

বিলু উঁকি মেরে দেখল ট্যাক্সির পেছনে মাধবীলতা হেলান দিয়ে বসেছিল, কথাটা শোনামাত্র সোজা হওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল, এইনা, আমি হেঁটে যাব। চেয়ার আমার দরকার নেই। ট্যাক্সির পেছন থেকে পরমহংস আর অনিমেষ নামছিল। বিলু সঙ্গে সঙ্গে দৌড় দিল। অর্কদের ঘরের চাবি যাওয়ার সময় তাকে দিয়ে গিয়েছিল। চটপট তালা খুলে সে চেয়ারটাকে মাথার ওপর তুলে দৌড়ে চলে এল গলির মুখে।

মাধবীলতা তখন নামতে চাইছে কিন্তু অর্ক কিছুতেই নামতে দেবে না। ট্যাক্সিটাকে ঘিরে বেশ ভিড় জমে গেছে। মাস্টারনির চেহারার অবস্থা দেখে সবাই খুব অবাক। বিলু চেয়ারটা দরজার সামনে রেখে বলল, মাসীমা এখন আপনাকে মাটিতে পা দিতে দেব না। নইলে যে রক্ত দিয়েছিলাম সেটা জল হয়ে যাবে।

মাধবীলতা অবাক হয়ে বিলুর দিকে তাকাতে অর্ক বলল, ও তোমার অপারেশনের সময় রক্ত দিয়েছিল। ও আর কোয়া।

কোয়া? সে কোথায়?

থানায়।

মুহূর্তেই মাধবীলতার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। অর্ক সেটা লক্ষ্য করে বলল, সে অনেক ব্যাপার, তোমাকে পরে বলব। এসো, আমাকে ধরে নামো।

খুব সাবধানে মাধবীলতাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে চেয়ারে বসানো হল। তারপর অর্ক আর বিলু দুপাশ থেকে তাকে তুলে নিল ওপরে। পেছনে পিল পিল করে বাচ্চারা আসছে। মাধবীলতা লজ্জায় যেন মরে যাচ্ছিল।

একেবারে বিছানা পেতে মাকে শুইয়ে দিয়ে অর্ক বলল, এবার আমি যাচ্ছি, ওদিকে অনেক কাজ পড়ে আছে।

মাধবীলতা ঘাড় নাড়ল। এটুকু আসতেই সে বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিল। পরমহংস অর্ককে জিজ্ঞাসা করল, ওই যে দেখলাম রান্না হচ্ছে, ওটা কি তোমার ব্যবস্থায়?

আমরা সকলে মিলে করছি।

দারুণ ব্যাপার তো। প্রত্যেকে কো-অপারেট করছে?

নিশ্চয়ই। প্রত্যেকের প্রয়োজন মিটবে যেখানে সেখানে তো করবেই। বিলুকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, সব ঠিক আছে?

বিলকুল। কিন্তু গুরু, আমার জান তো খতম হয়ে যাচ্ছে।

কেন? খুব খাটতে হয়েছে?

দূর? খাটনিতে আমি ভয় পাই নাকি? বিলু পকেট থেকে হিসেবের কাগজটা বের করে দেখাল, কুড়ি থেকে বাইশ দিন চলবে। ম্যাক্সিমাম পঁচিশ দিন। তারপর? এই পাবলিক তো ছিঁড়ে খাবে আমাদের।

অর্ক হিসেবটা দেখল। সে কিছুই ভেবে উঠতে পারছিল না। কিন্তু এখন এই সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে বসে পড়লে আর কাজ হবে না। সে বলল, ঠিক আছে। এখনও তো পঁচিশ দিন বাকি, এর মধ্যে ভেবে ঠিক করব।

বিলু বলল, তুমি মাইরি ঝুমকিদের যদি ফোটে না খেতে দিতে তাহলে হয়তো এটা ম্যানেজ করা যেত। একজন খাটছে তিনজন খাচ্ছে।

অর্ক বিলুর দিকে তাকাল। কথাটা নেহাত মিথ্যে নয়। কিন্তু সে যখন একবার ঝুমকিকে কথা দিয়ে ফেলেছে তখন আর না বলা যায় না। সে বলল, রান্না করার তো লোক পাওয়া যাচ্ছিল না। এ মাসটা যাক, সামনের মাস থেকে দেখা যাবে।

এই সময় ন্যাড়াকে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখা গেল, বিলুদা। মিল গিয়া!

বিলু অবাক হয়ে তাকাল, কি?

পকেট থেকে গোটা পঞ্চাশেক চাকতি বের করল ন্যাড়া। চাকতির গায়ে নম্বর দেওয়া। সেগুলো বিলুর হাতে দিয়ে সে বলল, যারা খাবে তাদের এগুলো দিয়ে দাও। যখন খেতে আসবে এগুলো আমাদের দিলে তবেই খাবার পাবে। আবার খাওয়ার পর ফেরত দিয়ে যাবে। তাহলে আর ফালতু লোক ঢুকতে পারবে না।

অর্ক অবাক হয়ে বিলুকে জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার?

বিলু হাসল, একেই ফাণ্ড কম তারপর যদি ফালতু লোক খেতে আসে তাই ন্যাড়া এই মতলব বের করেছে। খারাপ না, কি বল?

অর্ক মাথা নাড়ল, দূর। তিন নম্বরের সবাইকে আমরা চিনি। তাছাড়া টাকা দিয়ে সবাই যেখানে খাচ্ছে তখন বিনি পয়সায় কেউ খেতে আসবে কেন? এখানকার মানুষ এত ছোট হবে না।

ন্যাড়া বলল, না না। এখানে সব হতে পারে, বিশ্বাস নেই।

অর্ক বলল, হলে দেখা যাবে।

.

কিন্তু গোলমাল হল না। দশটা থেকে খাওয়া শুরু হল। বারোজন পাশাপাশি বসে খাচ্ছে। আর সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে তিন নম্বরের লোক তাদের খাওয়া দেখছে। এ নিয়ে হাসাহাসি করছিল কেউ কেউ। কিন্তু বাচ্চাগুলোর চোখের দিকে তাকিয়ে অর্কর মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। একটা লোভী ক্ষুধার্ত ছাপ ফুটে উঠেছে ওদের দৃষ্টিতে। তৃপ্তি করে খেল মানুষগুলো। রান্না নাকি চমৎকার হয়েছে। ঝুমকি নিজে পরিবেশন করছিল। প্রথম ব্যাচ হয়ে যাওয়ার পর সে এগিয়ে এল অর্কর কাছে,

তুমি খুশি?

অর্ক চমকে উঠল। তারপর নীরবে মাথা নাড়ল, খুব পরিশ্রম হয়েছে?

এ কিছু না। কাজ করতে গিয়ে কিন্তু আমার খুব ভাল লেগেছে। এতগুলো মানুষকে রান্না করে খাওয়ানোর মধ্যে বেশ তৃপ্তি আছে। ঘাম-ঘাম মুখে ঝুমকি হাসল।

অর্কর খেয়াল হল। সে ঝুমকিকে বলল, এসো আমার সঙ্গে।

ঝুমকি বলল, কোথায়?

আমি যেখানে বলব সেখানে যেতে আপত্তি আছে?

নিশ্চয়ই। আমি কি ফ্যালনা?

না। খুব দামী।

কথাটা শোনামাত্র ঝুমকি মুখ নামাল। অর্ক বুঝল, কথাটা বলা খুব অন্যায় হয়ে গেছে। সে পরিবেশটাকে সহজ করার জন্যে বলল, আরে আমি তোমাকে আমার মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইছিলাম।

ঝুমকি অবাক হল। তারপর বলল, পরিচয় তো আছেই।

সেটা মায়ের নিশ্চয়ই মনে নেই। এসো এসো।

কেন? ঝুমকি যেন দ্বিধায় পড়েছে।

কেন মানে? আমার মা কি খুব খারাপ?

ঝুমকি এবার হেসে ফেলল। তারপর আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে অর্কর পেছনে হাঁটতে লাগল। যাওয়ার আগে অর্ক ন্যাড়াকে চেঁচিয়ে বলল, পরের ব্যাচ রেডি কর।

ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে অর্ক বলল, মা, এর নাম ঝুমকি। এর ওপর রান্নার ভার। মাধবীলতা উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু পরমহংস বাধা দিল, আরে, তুমি উঠছ কেন?

কিছু হবে না।

হলে কিছু করার থাকবে না। আজ সারাদিন অনেক ধকল গেছে। শুয়ে থাকো।

অনিমেষ মেয়েটিকে দেখছিল। এই মেয়েই সেদিন তাদের রান্না করে দিতে চেয়েছিল। অর্ক বলেছিল এ নাকি ক্যাবারে নাচিয়ে হতে চায়। শরীরের গড়ন ভাল কিন্তু ওই রঙ আর মুখ নিয়ে কি করে ওরকম শখ হয় ভাবা যায় না। অর্ক যখন তাকে বলেছিল ও-ই বারোয়ারি রান্না রাঁধবে তখন অবাক হয়েছিল অনিমেষ। যেন তার হিসেবে কিছুতেই মিলছিল না। পরে ভেবেছে, কি অবস্থায় পড়লে একটা নিম্ন আয়ের বাঙালি মেয়ে ক্যাবারে নাচতে চায়, অর্থ উপার্জন করার জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠে। এর জন্যে ওকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, সামাজিক অবস্থাই ওকে এরকম ভাবতে বাধ্য করেছিল। আবার ওই মেয়ে অর্কর কথায় একটি পরিশ্রমসাধ্য কাজে রাজি হল যা থেকে কোন বাড়তি আর্থিক সাহায্য পাবে না। সবটাই রহস্যময়। এমনও হতে পারে মেয়েটা অর্কর প্রেমে পড়েছে। এখন যেটা করছে সেটা ওই মানসিকতা থেকেই। কথাটা মনে হতে সে হেসে ফেলেছিল। ছেলেকে সে যতটা জানে তাতে এসব ব্যাপার গোপনে রাখার ধাত ওর নেই।

অনিমেষ ঝুমকিকে বলল, এসো, ঘরে এসো।

ঝুমকি ইতস্তত করছিল। ঘরের ভেতর তিনজন মানুষ। এক বস্তীতে থেকেও সে কোনদিন এইভাবে আসেনি। মুখ না তুলে ঝুমকি বলল, থাক, আমি পরে আসব।

মাধবীলতা বলল, এসো না।

এবার ঝুমকি এড়াতে পারল না। পায়ে পায়ে খাটের পাশে এসে দাঁড়াতেই পরমহংস উঠে পড়ল, আমি আজ চলি। পরে দেখা হবে।

এখনই চলে যাবে? মাধবীলতা তাকাল।

এখনই কি? সকাল থেকে তো আছি। আর হ্যাঁ, তোমাদের জন্যে তাহলে আবার ফ্ল্যাট দেখতে বের হই নতুন করে, কি বল?

এবার অনিমেষ মাথা নাড়ল, দ্যাখো পাও কিনা।

পরমহংস বলল, এই সব ঝামেলা থেকে একটা লাভ হল কিন্তু।

কি? অনিমেষ উঠে দাঁড়াল ক্রাচ টেনে।

তুমি এখন সচল হয়েছ। যেভাবে জলপাইগুড়ি থেকে একা চলে এলে, দুবেলা হাসপাতাল করছ তা তো আগে কল্পনা করা যেত না। এখনও মাঝে মাঝে আমার ওখানে আসতে পারো, আড্ডা দেওয়া যাবে। চলি।

পরমহংসকে এগিয়ে দিতে গেল অনিমেষ। মাধবীলতা ঝুমকিকে এবার বলল, বসো, দাঁড়িয়ে রইলে কেন? ওই চেয়ারটায় বসো। ঘরদোর যা করে রেখেছে এরা–।

না না, ঠিক আছে।

তোমার নাম ঝুমকি?

হুঁ।

কোনদিকে থাকো?

ভেতরের দিকে?

আজ কি বেঁধেছ?

খিচুড়ি, বেগুন ভাজা আর তরকারি।

বাঃ। কিন্তু একা দুবেলা রাঁধতে হলে তোমার শরীর খারাপ হয়ে যাবে না?

না, এ তো কিছু না।

তবু প্রয়োজন হলে আমাকে বলল। আমি তরকারি কেটে দিতে পারি।

আপনার শরীর তো খুব খারাপ।

এখন আমি ভাল হয়ে গেছি।

ঝুমকি অর্কর দিকে তাকাল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, উনি কি খাবেন?

মাধবীলতা হাসল, কেন, তোমার রান্না খাবো।

অর্ক বলল, ওটা বাবার ওপর ছেড়ে দাও। বাবা তো ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে এসেছে। জানো মা, ঝুমকি কাজ খুঁজে না পেয়ে ক্যাবারে ড্যান্সার হতে চেয়েছিল।

সে কি? মাধবীলতা অবাক হয়ে গেল।

আর তখনই দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল ঝুমকি। তার সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছিল। শব্দটাকে সে প্রাণপণে চাপতে চাইলেও পারছিল না। মাধবীলতা কিছুক্ষণ স্থির চোখে তাকে দেখে আস্তে আস্তে উঠে বসল। তারপর হাত বাড়িয়ে ঝুমকির বাহু ধরল, এদিকে এস। ঝুমকি পাথরের মত তখনও দাঁড়িয়ে, শুধু শরীর কাঁপছে।

মাধবীলতা বলল, তুই এখান থেকে যা, এর সঙ্গে আমার কথা আছে।

অর্ক হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। ঝুমকি যে কেঁদে উঠবে তা সে কল্পনা করতে পারেনি। এরকম অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়তে হবে কে জানতো। মায়ের কথা শোনামাত্র সে বেরিয়ে এল ঘর ছেড়ে। তার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। এইভাবে কথাটা না বললেই হতো। সে ঝুমকিকে আঘাত দিতে চায়নি। সরলভাবে মাকে কথাটা জানিয়ে বোঝাতে চেয়েছিল ঝুমকি এক সময় ভুল করেছিল এখন সামলে নিয়েছে।

তিন নম্বরে বারোয়ারি খাওয়া হচ্ছে। এর ফলে স্বল্প আয়ের মানুষদের খুব উপকার হচ্ছে। এই খবরটা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। দুপুরবেলায় সতীশদা এল খোঁজ নিতে।

তুমি তাহলে আরম্ভ করলে?

হ্যাঁ।

পারবে শেষ পর্যন্ত।

দেখি

বেশ। যদি আমার কোন সাহায্য দরকার থাকে বলে।

আচ্ছা।

তুমি কি শান্তি কমিটিতে যাবে না?

কে বলল যাবো না? আসলে এই ব্যাপারটা সামলে আর সময় পাচ্ছি না। তবে কোন জরুরী দরকার থাকলে, আপনি বলবেন নিশ্চয়ই যাবো।

তুমি আমাদের পার্টি অফিসে আসবে না?

পার্টি অফিস?

তোমার সঙ্গে আমার সেই রকম কথা হয়েছিল।

আমি এখনও ভাবিনি।

ভাবো।

এখন শান্তি কমিটি কাজ করছে। এই সময়ে পৃথক করে আপনারা পার্টির কাজ করবেন?

শান্তি কমিটি একটা সাময়িক ব্যাপার। শান্তি কমিটি কাজ করছে। রাজনৈতিক ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা। পার্টি এবং শান্তি কমিটির তাছাড়া পাড়ার সামাজিক সমস্যা নিয়ে কাজের ক্ষেত্র তাই সম্পূর্ণ পৃথক। তাই না?

.

সতীশদার কথা মাথায় ঢুকছিল না অর্কর। কংগ্রেস এবং সি পি এম যদি এখন সক্রিয় হয়ে কাজ শুরু করে তাহলে শান্তি কমিটি ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য। সেক্ষেত্রে আবার সমাজবিরোধীরা প্রশ্রয় পাবে। তারা এসে পার্টির ছায়ায় আশ্রয় নেবে। অর্কর মনে হচ্ছিল সতীশদারা পার্টির কথা যতটা চিন্তা করেন সমাজের কথা ততটা না। সতীশদারা হয়তো সেই অর্থে সমাজবিরোধী নন কিন্তু সমাজ-এর বন্ধু বলেও মনে হয় না।

কিন্তু এইসব চিন্তা নিয়ে মগ্ন থাকার সময় ছিল না অর্কর। তিন নম্বরের অনেক পরিবার থেকে ক্রমাগত চাপ আসছিল। মোটামুটি দুবেলা যাদের খাবার জোটে তারাও এই বারোয়ারি ব্যবস্থায় যোগ দিতে চাইছিল। এর ফলে এখনই কিছু অর্থ যদিও পাওয়া যাবে কিন্তু ঝুঁকিটা বেড়ে যাবে অনেক। অথচ কাউকে না বলতে অনেক অসুবিধে আছে।

অনিমেষের সঙ্গে কথা বলে অর্ক একটা সিদ্ধান্তে এল। তিন নম্বরের যেসব পরিবার এই ব্যবস্থায় যোগ দিতে চায় তাদের সক্রিয় অংশ নিতে হবে। অন্তত প্রত্যেক পরিবার থেকে একজনকে এগিয়ে আসতে হবে কাজে।

খুব দ্রুত যে কয়টি পরিবর্তন দেখা দিল তা হল, বস্তির পরিবেশ অনেকটা পাল্টে গিয়েছে। এখন আর দিনরাত সেই খিস্তি খেউড় শোনা যায় না। মাতলামিটা সম্পূর্ণ বন্ধ। তাছাড়া প্রত্যেকের পরিবারের সঙ্গে বেশ ভাই ভাই এবং বন্ধুর সম্পর্ক তৈরি হতে চলেছে।

অর্ক বুঝতে পারছিল তিন নম্বরের এই সব পরিবার তার ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছে। এই ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। যে করেই হোক।

৬১. সেই অভাবনীয় কাণ্ডটি

তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেনে সেই অভাবনীয় কাণ্ডটি ঘটে গেল। মোট বাহান্নটি পরিবারের মধ্যে পঞ্চাশটি পরিবার এখন একত্রিত হয়েছে। দুটি পরিবার অপেক্ষাকৃত সচ্ছল। বস্তিতে থেকেও তারা চিরকাল নিজেদের আলাদা করে রেখেছিল, এবারও রাখল। পঞ্চাশটি পরিবারের মোট সংখ্যা, প্রাপ্তবয়স্ক দুশো বারো, শিশু একশ তিনজন।

শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্করা একই রকম খাবার খাবে না, পরিমাণেও পার্থক্য থাকবে। সুতরাং দেয় চাঁদা কখনই এক হতে পারে না। বিলু এটা মানতে পারছিল না। কিন্তু অর্ক নরম হল। একটা তিনবছরের বাচ্চার জন্যে সমান টাকা চাওয়া অন্যায় হবে বলে মনে হচ্ছিল। সেই জন্যে ঠিক হল দশ বছরের নিচে তিরিশ টাকা দিতে হবে।

দশজনের একটি কমিটি ঠিক করা হল। বিলু ক্যাশিয়ার। এই দশজন সমস্ত কিছু তদারকি করবে। দুজন রান্নার ঠাকুর রাখা হল যারা ঝুমকির তত্ত্বাবধানে কাজ করবে। প্রায় যজ্ঞবাড়ির মত ব্যবস্থা। কিন্তু কদিন চালু হতে সেটাও সহজ হয়ে দাঁড়াল। বিলু ফাঁক পেলেই অর্ককে হিসেবটা শোনাতো। মাসের শেষ কটা দিন না খাওয়াতে পারলে তিন নম্বরের লোক চামড়া ছাড়িয়ে নেবে। অর্ক কূল পাচ্ছিল না।

কিন্তু এই পঞ্চাশটি পরিবারে কতগুলো পরিবর্তন স্পষ্ট ধরা পড়ল। মেয়েরা কাজ কমে যাওয়ায় সংসারের দিকে মন দিতে পারল। তাদের বাচ্চারা বেশি সহানুভূতি এবং যত্ন পাওয়ায় নিয়ন্ত্রিত হল। তিন নম্বরে বেশ শান্তিপূর্ণ আবহাওয়া বিরাজ করতে লাগল।

মাধবীলতা এখন ধীরে ধীরে হাঁটাচলা করতে পারে। যদিও তাকে বেশ বয়স্কা দেখায় কিন্তু উৎসাহ দ্রুত সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছে। মাঝে মাঝে সে বারোয়ারি রান্নার জায়গায় চলে এসে ঝুমকিকে পরামর্শ দেয়। এই বস্তির মেয়েরাও মাধবীলতাকে আপনজন ভাবতে শুরু করেছে। এতবছর একসঙ্গে এই বস্তিতে থেকেও মাধবীলতার সঙ্গে তাদের কোন সংযোগ গড়ে ওঠেনি। চিরকাল তারা ওকে ঈর্ষার চোখে দেখায় একটা দূরত্ব থেকেই গিয়েছিল। কিন্তু এখন সেই বাঁধটা যেন হঠাৎ সরে গেল। একসঙ্গে খাওয়ার সুবাদে মানুষগুলো কাছাকাছি এসে গেল।

পড়াশুনা আরম্ভ করলেও অর্ক মন বসাতে পারছিল না। সব সময় মাথার মধ্যে বিলুর হিসেবটা কিলবিল করছিল। এখন তিন নম্বরের সবাই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। যার যা সমস্যা হয় সোজা চলে আসে অর্কর কাছে। দেখা যাচ্ছে অর্কর সিদ্ধান্ত মেনে নিচ্ছে সবাই। এমনকি ন্যাড়ারও পরিবর্তন ঘটে গেছে। কাজের ভার পেয়ে ছেলেটা আন্তরিকতার সঙ্গে খেটে যাচ্ছে। কাছাকাছি বাজার থেকে জিনিস না কিনে দূর থেকে আনলে সস্তা হয় আবিষ্কার করে ন্যাড়া সেই দায়িত্ব নিয়েছে। অনিমেষও এই ব্যাপারে উৎসাহী। এতগুলো মানুষের পেট ভরাবার কাজে সে ছেলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তিন নম্বরের বয়স্করা তার কাছে মনের কথা খুলে বলে। মাঝে মাঝে অনিমেষের মনে হয় ঠিক এই রকম একটা কিছু তারা চেয়েছিল। এই রকম বললে অবশ্য ঠিক বলা হয় না, এর কাছাকাছি একটা ব্যবস্থা। না এদেশে হবে না বলে মনে হয়েছিল। অসম অর্থনীতির একত্রীকরণ অনেক দুরের কথা কিন্তু সমআর্থিক অবস্থার মানুষেরাও যে একই ছাদের তলায় এল এটাই বা কম কথা কি! হয়তো এরা সংখ্যায় নগণ্য, বিশাল ভারতবর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে কোন হিসেবেই আসে না কিন্তু তবু এর একটা আলাদা মূল্য আছে। জুলিয়েনরা বোধ হয় এই রকম চেয়েছিল। গ্রামে গ্রামে মানুষদের একত্রিত করতে, তাদের আর্থিক সামাজিক এবং মানসিক গঠনে সামঞ্জস্য এলে বর্তমান কাঠামোর বিরুদ্ধে পা ফেলার সংকল্প ভাল কিন্তু তা বাস্তবায়িত হতে নানান বাধা। অনিমেষ কিছুতেই ভাবতে পারে না কি করে অর্ক এই রকম একটা পরিকল্পনা নিল। প্রথমে তো সে তার সঙ্গে কোন আলোচনা করেনি। শুধু একটা মাতাল লোকের সঙ্গে ঝগড়া করে এতবড় একটা ব্যাপার করা কম কথা নয়। তারপরে অনিমেষ অর্কর সঙ্গে অনেক আলোচনা করেছে। এখন তো সে নিজেই জড়িয়ে পড়েছে এই কর্মকাণ্ডে।

দিন আটেক বাদে অর্ক কথাটা তুলল। তখন দুপুর। এই সময় বারোয়ারি রান্নার কাজকর্ম বন্ধ থাকে। সমস্যা শুনে অনিমেষ বলল, এটা আগে ভাবিসনি?

ভেবেছিলাম। কিন্তু মনে হয়েছিল যাহোক কিছু করে ম্যানেজ হয়ে যাবে। প্রথমে অল্প লোক ছিল তাই কেয়ার করিনি। কিন্তু যত লোক বাড়ছে তত সব উল্টোপাল্টা হয়ে যাচ্ছে। কি করি বলল তো? সবাইকে খুলে বলব?

অনিমেষ বলল, তোদের উচিত ছিল খরচ কমানো। পেটভরে খাওয়া নিয়ে কথা। দুটো পদ করার কোন দরকার ছিল না।

অর্ক হাসল, তাতে বদনাম হতো। প্রথম থেকে রটে যেত আমরা পয়সা মারছি।

অনিমেষ বলল, তাহলে?

অর্ক শুয়ে পড়ল পাটিতে, সবাইকে জানানো ছাড়া কোন উপায় নেই। যদি প্রত্যেকে বাড়তি টাকা দেয় তাহলে চলবে নইলে–!

অনিমেষ ছেলের দিকে তাকাল। কথাটা অর্ক খুব সহজ ভঙ্গীতে বলছে না। এবং এটা বলতেও যে ভাল লাগছে না তা বুঝতে অসুবিধে হল না। কিন্তু সে কোন কূল পাচ্ছিল না। এই সময় মাধবীলতা কথা বলল। চুপচাপ শুয়ে বই পড়ছিল সে। এবার বইটাকে মুড়ে রেখে ডাকল, খোকা।

বল।

তুই হেরে যাবি?

কি করব বল? আমার তো নিজের টাকা নেই যে সবাইকে খাওয়াব।

একটা কিছু রাস্তা বের কর।

অর্ক উঠে বসল, জানো মা, আমরা তো টাকার চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছি। আজ বিলু বলল ও টাকার ব্যবস্থা করে আনতে পারে যদি আগের কাজটা মাসে দু’তিনদিন করে। অর্ক হাসল শব্দ করে।

আগের কাজ?

স্মাগলিং। কয়লার সঙ্গে যেটা করত।

ছিঃ।

আরে তুমি ক্ষেপেছ? কিন্তু ব্যাপারটা দ্যাখো, ও আজ সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। পাগলের মত এটা নিয়ে পড়ে রয়েছে। টাকার যখন ভীষণ দরকার তখন ও মরিয়া হয়ে এটা করতে চাইল। কারণ ওই একটা পথ ছাড়া অন্য পথ আর ওর জানা নেই। অর্ক অনিমেষের দিকে তাকাল, এই ভাবে কজন বলবে?

মাধবীলতা বলল, তোদের সামনে কি কোন পথ খোলা নেই।

অর্ক মাথা নাড়ল, বুঝতে পারছি না।

তার আগে বল তো তুই এই ব্যাপারে ঝাঁপালি কেন? শুধু একটা মাতালের সঙ্গে ঝগড়া করে এতগুলো লোকের দায়িত্ব নিয়ে নিলি?

অর্ক স্বীকার করল, প্রথমে আমার মনে হয়েছিল এই রকম করলে লোকগুলো হয়তো একটু আরামে থাকবে। তুমি বলতে না, তিনজনের রান্নায় চারজনের হয়ে যায়! তাই ভেবেছিলাম অনেকগুলো পরিবার একসঙ্গে এলে খরচ কমে যাবে।

শুধু তাই?

তার মানে?

এই লোকগুলোকে যখন এক হাঁড়িতে এনেছিস তখন অন্য ব্যাপারগুলো ভুলে থাকলি কি করে? এতে প্রত্যেকের নাহয় পেট ভরে খাওয়া জুটলো কিন্তু আর্থিক অবস্থা তো যা ছিল তাই রয়ে গেল। তোরা কেন বাচ্চাগুলোকে পড়াবার জন্যে একটা নাইট স্কুল চালু করলি না? যে টাকা হাতে এসেছিল সেটা তো একদিনে খরচ হচ্ছে না। যারা বেকার তাদের দিয়ে এখন কিছু কিছু ব্যবসা করলি না কেন যাতে তাদেরও উপকার হয় তাদের ফাণ্ডে কিছু জমা পড়ে। আমি বলছি প্রত্যেকটা পরিবারকে যদি আর্থিক ব্যাপারে পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলতে পারতিস তাহলে অনেক বেশী উপকার করা হতো, তোদেরও সমস্যা আসতো না। কথাগুলো একটানা বলে মাধবীলতা দম নেবার জন্যে থামল। অনিমেষ চমকে উঠেছিল। মাধবীলতা যা বলছে সেটা করতে পারলে দারুণ ব্যাপার হবে। এতদিন ধরে যেসব থিওরির কথা সে পড়ে আসছে এটি তারই চমৎকার ব্যাখ্যা।

অর্ক উঠে দাঁড়াল, মা, সত্যি তুমি ভাল।

মানে? মাধবীলতার কপালে ভাঁজ পড়ল।

অর্ক কয়েকপা এগিয়ে আচমকা মাধবীলতাকে চুমু খেল। ছেলের এ ধরনের আদরের জন্যে প্রস্তুত ছিল না মাধবীলতা। হাতের চেটো দিয়ে কপাল মুছতে মুছতে বলল, ইস, থুতু মাখিয়ে দিলি।

ততক্ষণে দরজায় চলে গেছে অর্ক। মুখ ফিরিয়ে বলল, অনভ্যাস। কতকাল যে তোমাকে চুমু খাইনি তা ভেবেছ?

ছেলে বেরিয়ে গেলেও মাধবীলতার মুখের রক্তাভা কমল না। অর্ক কোন অন্যায় করেনি কিন্তু মনে মনে সে খুব লজ্জিত হয়ে পড়েছিল। সে জানে অনিমেষ তার দিকে তাকিয়ে আছে। এটাই তাকে আরও লজ্জিত করছে। তাছাড়া অত বড় ছেলে যে এমন কাণ্ড করবে তা সে আঁচ করতে পারেনি।

এই সময় অনিমেষ বলল, হাত পা নাড়ো।

কেন? মাধবীলতার কাছে নিজের গলার স্বরই অপরিচিত শোনাল।

শরীরের সব রক্ত এখন মুখে জমেছে। অনিমেষ তরল গলায় জানাল।

যাঃ।

লজ্জা পেলে তোমাকে এখনও সুন্দর দেখায়।

থাক হয়েছে।

হয়নি। এই মুহূর্তে তোমাকে দেখে একটা স্মৃতি মনে এল।

কি? মাধবীলতা চেষ্টা করছিল গম্ভীর হতে।

তোমাকে আমি যেদিন প্রথম চুমু খেয়েছিলাম সেদিন এরকম মুখ হয়েছিল তোমার। অবিকল এই রকম। অনিমেষ নিঃশ্বাস ফেলল।

কি আজেবাজে বকছ? ছেলের সঙ্গে নিজের তুলনা করতে বাধছে না?

তুলনা কারো সঙ্গে করছি না। আমি শুধু লজ্জাটা যে এক তাই বলছি।

যত বাজে কথা! ওইসব পুরোনো দিনের ছবি ভেবে কি লাভ?

দিনগুলো কি সত্যি খুব পুরোনো?

মাধবীলতা এবার পাশ ফিরে শুলো, তুমি কিন্তু এবার সত্যি সত্যি সত্যি নিজের ছেলেকে হিংসে করছ?

হিংসে করছি না। নিজেকে বড্ড বেশি অপদার্থ মনে হচ্ছে।

তার মানে?

আমি তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারব না। অনিমেষ হাসল।

মাধবীলতা চোখ বন্ধ করল। তারপর নিচু গলায় বলল, তাই ভাল।

অনিমেষ এই ভঙ্গীটা পছন্দ করল না। আজকাল মাধবীলতা যেন সব ব্যাপারেই হঠাৎ নির্লিপ্ত হয়ে যায়। অনিমেষের এই ব্যাপারটা একদম ভাল লাগে না। অসুখের পর থেকেই মাধবীলতা যেন উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। শুধু অর্কর সঙ্গে কথা বলার সময়ে ওকে স্বাভাবিক দেখায়। অথচ অনিমেষের সঙ্গে মাধবীলতা কখনই খারাপ ব্যবহার করে না। প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে নানান কথাবার্তা হয়। কিন্তু তার মধ্যেই হঠাৎ যে সে অন্যমনস্ক হয়ে যায় সেটা লক্ষ্য করেছে অনিমেষ।

মাধবীলতার ভঙ্গীটা ভাল লাগছিল না। জলপাইগুড়ি থেকে ফিরে আসার পর অনেক কথা হলেও একটা অদৃশ্য দূরত্ব যেন থেকেই গেছে। অনিমেষ উঠে দাঁড়াল। ক্রাচদুটো শব্দ করতেই মাধবীলতা চোখ খুলল। চোখাচোখি হতে অনিমেষ স্থির হয়ে গেল। তার বুকের ভেতর টনটন করছিল। সে এগিয়ে এল খাটের কাছে। মাধবীলতা নড়ল না একটুও। সেই একই ভঙ্গীতে চেয়ে আছে অনিমেষের মুখের দিকে। কাঁপা হাত রাখল অনিমেষ মাধবীলতার কপালে। কথা বলতে চাইল কিন্তু পারল না। তার গলার কাছে যেন কিছু আটকে গেল অকস্মাৎ। মাধবীলতা প্রথমে স্থির হয়ে ছিল। তারপর ওর একটা হাত ধীরে ধীরে অনিমেষের হাতটাকে স্পর্শ করল। তারপর বলল, তুমি আমাকে ভুল বুঝো না।

না! অনিমেষ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে চট করে হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল, তুমি বিশ্রাম নাও, আমি আসছি।

.

তিন নম্বরের পঞ্চাশটি পরিবারে বেকার যুবকের সংখ্যা তিরিশটি। এরা চাকরির খোঁজ যতটা না করে তার অনেক বেশী আড্ডা মেরে কাটায়। এদের মধ্যে মাত্র পাঁচজন স্কুল ফাঁইন্যাল পাশ করেছে।

সেদিন সন্ধ্যায় তাদের নিয়ে বসেছিল অর্ক। এদের অনেকের বয়স ওর চেয়ে ঢের বেশী হলেও এখন সবাই অর্ককে বেশ সমীহের চোখে দেখছে। তাদের কাছে প্রস্তাবটা রাখল অর্ক। স্রেফ বেকার বসে না থেকে কিছু আয় করতে হবে। কমিটি প্রত্যেককে দিনে দশ টাকা করে দেবে। সেই টাকায় বড়বাজার থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে এনে বিক্রি করলে অন্তত পাঁচ টাকা লাভ হবে। লাভের শতকরা বিশ ভাগ কমিটির কাছে জমা দিতে হবে মূল টাকার সুদ বাবদ। কমিটি সেই টাকা তিন নম্বরের পরিবারের জন্যেই ব্যয় করবে।

তিন নম্বরের বয়স্ক মানুষরাও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। ব্যাপারটা তাঁদেরও খুব উৎসাহিত করেছিল। ছেলেগুলো বেকার বসে গেজিয়ে সময় নষ্ট না করে কিছু রোজগার করুক তাতে পরিবারের লাভ হয়। তাঁদের মধ্যে একজন প্রস্তাব দিলেন, এমন অনেক জায়গায় অফিসপাড়া আছে যেখানে টিফিনের সময় কোন খাবার পাওয়া যায় না। কমিটির পয়সায় যদি ছেলেরা খাবার বানিয়ে সেসব জায়গায় গিয়ে বিক্রি করে তাহলে প্রচুর লাভ হতে পারে। ব্যাপারটা অর্কর খুব পছন্দ হল। সে এই নিয়ে সবার মতামত চাইল। কিন্তু দেখা গেল তিরিশজনের মধ্যে একুশজন এই রকম ব্যবসায়ের ব্যাপারে উৎসাহী হয়েছে। বাকি নজন নানান টালবাহানা করতে লাগল। অর্ক বুঝল এদের জোর দিয়ে কোন লাভ হবে না। অনভ্যাস এবং বেকার বসে থেকে এদের মনে জং ধরে গেছে। আর একুশজন যে সম্মতি জানিয়েছে এইটেই অনেক কথা। এরা সক্রিয় হলে হয়তো নজন শেষপর্যন্ত উৎসাহী হবে। ওই একুশজনের মধ্যে তিনজনকে নির্বাচিত করা হল ব্যবসাটা দেখার জন্যে। বলা হল, কমিটির ফাণ্ড যেহেতু বেশী নেই তাই প্রতিদিন টাকাটা ফেরত দেবার ব্যবস্থা রাখতে হবে।

তিন নম্বরে আর একটা ব্যবসা বারোয়ারিভাবে শুরু হল। বড়বাজার থেকে গোটা সুপুরি কিনে এনে মাপসই কেটে আবার ফেরত দিলে ভাল পয়সা পাওয়া যায়। এই কাজ দুপুরবেলায় মেয়েদের পক্ষে সম্ভব। কমিটি টাকা জমা রেখে সুপুরি এনে দিলে মেয়েরা কাজ শুরু করল। প্রথম প্রথম আয়টা চোখে দেখা না গেলেও পরে সেটা বোঝা গেল। পনের দিনের মাথায় নিশ্চিন্ত হল অর্ক। এইভাবে চললে কমিটির প্রাপ্য শেয়ার থেকে বাকি দিনগুলো চলে যাবে। যে আর্থিক গ্যাপটা ছিল তা মিটে যাবে। বিলু বলল, তোমার খুরে খুরে প্রণাম গুরু। এ শালা আমার মাথায় ঢোকেনি। সবাই কেমন ব্যবসা করতে লেগে গেছে। পঞ্চাশ টাকার খাবার তৈরি করে একশ টাকায় বিক্রি করছে।

অর্ক বলল, এটা আমার মাথাতেও আসেনি। মা বলায় বুদ্ধিটা এল।

কিন্তু আমি শালা বেকার রয়ে গেলাম। আমাকে একটা ব্যবসা করার ক্যাপিটাল দাও।

কি ব্যবসা?

আমি তো একটাই জানি। তুমি পঞ্চাশ দিলে তোমাকে পঁচিশ টাকা ডেইলি ফেরত দিয়েও আমার পঁচিশের বেশি থাকবে।

অর্ক অবাক হল, বাপ রে! এ কি ব্যবসা?

বিলু হাসল, দুটাকা পাঁচের টিকিট পাঁচ টাকা। বাকিটা পুলিসকে দিতে হবে।

মারব এক থাপ্পড়! এর পরে বলবি বিশ বোতল চুল্লু কিনে এনে ব্ল্যাকে বিক্রি করলে হেভি প্রফিট থাকবে। ওসব চলবে না।

কিন্তু আমাকে তো কিছু করতে হবে। সারাজীবন পরের খেটে তো চলবে না।

সে কথা তো আমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

তুমি তো রাত্রে পড়াশুনা করছ। পরীক্ষা দেবে। তোমার কথা আলাদা।

পরীক্ষা দেব মায়ের জন্যে। পাশ করলেও যা হবে না করলেও তাই।

বিলু হয়তো খুব সিরিয়াস ভঙ্গীতে কথাটা বলেনি কিন্তু ঝুমকি বলল।

সকাল বেলায় যখন ঠাকুররা ব্যস্ত তখন অর্ক দাঁড়িয়ে তাদের কাজ দেখছিল। ঝুমকি সরে এল কাছে, এভাবে কতদিন চলবে?

মানে?

এখানে যা করছি তার জন্যে দুবেলা খেতে দিচ্ছ। কিন্তু এভাবে চলবে?

কি বলতে চাইছ? অর্ক বুঝেও জিজ্ঞাসা করল।

আমাদের অন্যান্য খরচ আছে। ওষুধ তো রোজই দরকার। একটা কিছু না করলে–!

সুপুরি কাটছ না?

তাতে যা হচ্ছে জানো না? হাতখরচ চলবে, বাকিটা?

আমি একটু ভেবে দেখি। সবে তো এসব শুরু হয়েছে। কটা দিন অপেক্ষা করো। কথাটা শুনে ফিরে গেল ঝুমকি। কিন্তু অর্ক মনে মনে খুব অসহায় বোধ করল। এতগুলো পরিবারকে আর্থিক সাচ্ছল্য দেবার কোন উপায় তার জানা নেই। এটুকু করতেই চোখে অন্ধকার দেখতে হচ্ছে।

এই সময় বিলু এসে খবর দিল, গুরু শুনেছ কয়লা জামিন পেয়েছ।

জামিন?

হাঁ। খুব বড় উকিল জামিন পাইয়ে দিয়েছে। এই নিয়ে শান্তি কমিটিতে খুব গোলমাল শুরু হয়েছে। তুমি জানো না?

না তো। অনেকদিন ওমুখো হওয়ায় সময় পায়নি সে। বিলুকে জিজ্ঞাসা করল, শান্তি কমিটিতে গোলমাল হচ্ছে কেন?

জানি না, সতীশদারা বেরিয়ে এসেছে শান্তি কমিটি থেকে। শুনলাম ওরা নাকি একটা পৃথক শান্তি কমিটি গড়বে। আমার গুরু খুব ভয় করছে। কয়লা যদি এই সুযোগে বদলা নিতে চায় তাহলে আমি মারা পড়ব।

চুপ কর। মেঘ জমল না আর তুই বৃষ্টির ভয় পাচ্ছিস।

সেদিনই শান্তি কমিটির অফিসে গেল অর্ক। সুবল বসেছিল একা। অর্ককে দেখে বলল, শুনেছ সতীশদা কমিটিতে নেই।

কি ব্যাপার?

কয়লা জামিন পেয়েছে।

তাতে কি হয়েছে?

সতীশদার ধারণা কয়লার জামিনের পেছনে কংগ্রেসীদের হাত আছে। কারণ কয়লাকে এক সময় যুবনেতা বলা হয়েছিল। কমিটির কংগ্রেসী সদস্যরা সেকথা স্বীকার করছে না। সতীশদা অবশ্য বলেছে কমিটিতে নেই বলে যেন ভাবা না হয় যে ওরা আমাদের সব কাজের বিরোধিতা করবে। কিন্তু–। সুবলকে খুব অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল।

অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কয়লা কি ওর বাড়িতে ফিরে এসেছে?

না। পাড়ায় ঢোকা ওর পক্ষে মুশকিল হবে। তাছাড়া জামিনের শর্ত হল ও এই এলাকার তিনটে থানায় পা দিতে পারবে না। কিন্তু বিশ্বাস করা মুশকিল।

অর্ক বলল, আর যাই হোক তিন নম্বরে সমাজবিরোধীরা পাত্তা পাবে না। ওখানকার পঞ্চাশটা ফ্যামিলি এখন একটা ফ্যামিলিতে পরিণত হয়েছে।

সুবল বলল, তুমি অসাধ্য সাধন করেছ। তবে এর মধ্যে অনেকেই তোমার সম্পর্কে নানান কথা বলছে। তুমি নাকি মোটা লাভ করছ।

লাভ করছি! আমাকে কিভাবে চালাতে হচ্ছে তা সবাই জানে।

জানলেও প্রচার চালাতে দোষ কি। বাঙালি কখনো কেউ ভাল কাজ করলে সহ্য করবে না। তারা চাইবে সেটা ভেস্তে দিতে।

দিতে আসুক, আমরা প্রাণ থাকতে সেটা হতে দেব না।

সুবলকে খুব নিস্তেজ দেখাচ্ছিল। অর্ক বেরিয়ে এল সেখান থেকে। মোড়ের মাথায় তিনটে ছেলে দাঁড়িয়েছিল। একজন চাপা গলায় বলে উঠল, এই, অক্ক আসছে।

আসুক না। আমরা তো শান্তি কমিটির মেম্বার।

ওদের সামনে এসে অর্ক থমকে দাঁড়াল। এরা ঈশ্বরপুকুরের ছেলে নয়। একজন যেন সামান্য টলছে। দিনদুপুরে মাল খেয়েছে এরা। কয়লা গ্রেপ্তার হবার পর এই দৃশ্য এখানে দেখা যেত না। মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল ওর। তিনজনেই ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শেষ পর্যন্ত অর্ক নিজেকে সামলে নিল। খামোকা ঝামেলা করে লাভ নেই। সুবলের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে হবে। তবে ওর মনে হল কয়লার জামিন পাওয়ার সঙ্গে এই পরিবর্তনের সম্পর্ক আছে। শান্তি কমিটি যদি ভেতরে ভেতরে দুর্বল হয়ে পড়ে তাহলে এরকমটা ঘটবেই।

সতীশদা পার্টির অফিসে ছিল। ওকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, আরে, এসো এসো। আমি তোমার কথা ভাবছিলাম।

অর্ক দেখল ঘরে অন্তত সাতআটজন ছেলে বসে আছে। বেশ উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনা চলছিল সেটা বোঝা যাচ্ছে। সতীশদা যেন ওকে দেখে বেশ স্বস্তি পেল। অর্ক বলল, আপনার সঙ্গে কথা বলতে এলাম।

হ্যাঁ নিশ্চয়ই বসো। তারপর ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা কেউ উত্তেজিত হবে না। আমরা আজ সন্ধ্যেবেলায় পার্কে সভা করছি। নেতারা আসবেন। পার্টি যা সিদ্ধান্ত নেবে তাই করবে। ওরা প্ররোচনা করলেও তোমরা ফাঁদে পা দেবে না। এসো অর্ক। সতীশদা উঠে দাঁড়াতে অর্ক তাকে অনুসরণ করল।

কি ব্যাপার?

আপনি শান্তি কমিটি থেকে বেরিয়ে এসেছেন?

ঠিক বেরিয়ে নয়। সুবলের একার পক্ষে সামলানো সম্ভব নয়। কংগ্রেসী ছেলেরা এই সুযোগে নিজেদের শক্তি বাড়াবার চেষ্টা করছে, এটা কি করে হতে দেওয়া যায়? তাছাড়া কয়লা ছাড়া পাওয়া মাত্র কিছু কিছু ঘটনার কথা আমাদের কানে এসেছে। কয়লা নেই কিন্তু শান্তি কমিটির ছদ্মবেশে আর একটা কয়লা তৈরি হোক আমি চাই না। শান্তি কমিটির সদস্যরা যে সবাই সতীলক্ষ্মী এ ভাবার কোন কারণ নেই।

এসব তো আপনি ভেতরে থেকেও সংশোধন করতে পারতেন।

পারতাম না। কারণ বিপরীত মেরুর রাজনৈতিক ভাবনা নিয়ে পা বাড়ানো যায় না। তাছাড়া কপোরেশন ইলেকশন আসছে। ওরা যেভাবে কাজ গোছাচ্ছে তাতে আমরা অসুবিধেয় পড়ব। আমি সুবলকে বলেছি ওদের সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সব সময় শামিল হবো। যাক, তোমার খবর বল।

অর্ক লোকটার দিকে ভাল করে দেখল। এইসব সমস্যার কথা সে আগেই ভেবেছিল। সেটা মিলে গেল। সে বলল, এখন পাড়ায় শান্তি আছে, সেটা বজায় রাখুন।

নিশ্চয়ই। শুনলে তো, আমি ছেলেদের উত্তেজিত হতে নিষেধ করেছি। কয়লা পাড়ায় ঢুকতে চাইলে আমরা বাধা দেব। কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।

বলুন।

তুমি যেটা করছ সেটা খুব ভাল উদ্যোগ। তবে তোমার একার পক্ষে কতদিন চালানো সম্ভব হবে? তুমি যদি আমাদের সদস্যপদ নাও তাহলে অনেক সুবিধে হবে।

অর্ক মাথা নাড়ল, এখন তো কোন অসুবিধে হচ্ছে না।

হচ্ছে কিন্তু বলছ না। লোকে বলছে তুমি আর বিলু নাকি ঘি খাচ্ছ। আমি বিশ্বাস করি না কিন্তু লোকের মুখ চাপা দিতে হলে তোমাকে পার্টিতে আসতে হবে।

শুনলাম।

তোমার পার্টিতে আসতে অসুবিধে কি?

আমি ভেবে দেখিনি।

কথাটা অনেক দিন থেকে বলছ। এখন তিন নম্বরে সবকটা লোক তোমার কথা শুনে চলছে। তুমি আজ ওদের পার্কের মিটিং-এ আসতে বল।

পার্কের মিটিং-এ?

হ্যাঁ। কেন্দ্রীয় নেতারা আসছেন। আমরা সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখব। শান্তি কমিটি যাতে সঠিক পথে চলে তার দাবি জানাবো আর আগামী কর্পোরেশনে ইলেকশনের জন্যে প্রচার করব। তিন নম্বরে অন্তত শ দেড়েক মানুষ সব সময় টলমলো করে। তাদের রাজনৈতিক চিন্তাশক্তি খুব দুর্বল। তোমাকে দায়িত্ব নিতে হবে।

অর্ক বলল, এসব কথা ওদের বললে পারেন। কে যাবে বা না যাবে তা আমি বলার কে? আমি কি ওদের গার্জেন?

সতীশদা অর্কর কাঁধে হাত রাখল, এসব বলছ কেন? ওরা তোমার ওপর নির্ভর করে আছে। তুমি বললে কেউ না বলতে পারবে না।

আপনি কি আমাকে ব্যবহার করতে চান?

মানে? কি বলছ তুমি?

যা বলছি তা তো বুঝতেই পারছেন।

অর্ক। তুমি বাজে কথা বলছ। তুমি সমাজবিরোধীদের প্রশ্রয় দিচ্ছ। বিলু, ন্যাড়া সমাজবিরোধী। বিলুর নাম তো তুমিই লিস্টে ঢুকিয়েছিলে। এসব কথা আমার মুখ থেকে শুনলে পাবলিক তোমাকে ভাল চোখে দেখবে না।

অর্ক হাসল। ঠিক আছে সতীশদা। আপনি যা পারেন করুন। ভয় দেখিয়ে কেউ আমাকে কোন কাজ করাতে পারবে না। আমি এই রাজনীতির মধ্যে নেই।

৬২. মধ্যরাত্রে গোটা আটেক মোটর সাইকেল

মধ্যরাত্রে গোটা আটেক মোটর সাইকেল ঝড়ের মত উড়ে এল তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুরের সামনে, এসে থামল। এই রাত্রে ঈশ্বরপুকুরের ফুটপাথে কোন মানুষ ছিল না। যে যার নিজের বিছানায় ঘুমন্ত। লোকগুলো প্রথম দরজায় আঘাত করতেই ঘুমন্ত চোখে একজন বেরিয়ে এল, কে? কি চাই?

বিলু কোথায়? কোন বাড়িতে থাকে? একদম শব্দ করবি না। দেখছিস? লোকটার চোখ থেকে ঘুম উড়ে গেল। থর থর করে কাঁপছিল সে। তারপর তিন নম্বরের পিছন দিকটা হাত দিয়ে দেখিয়ে দিল।

দেখিয়ে দিবি চল। কোন শব্দ করবি না। তোর বউকে বলে যা না চেঁচাতে। নইলে তোকে আর ফেরত পাবে না।

লোকটা অসহায় চোখে ভেতর দিকে তাকাল। তারপর শ্লথ পায়ে হাঁটতে লাগল। আটজনের দলটার দুটো ভাগ হল। তিনজন রইল গলির মুখে। বাকি পাঁচজন হেঁটে এল লোকটিকে অনুসরণ করে। সরু গলির গোলকধাঁধায় বোধহয় লোকটির মানসিক শক্তি খানিকটা ফিরে আসছিল। অন্তত সে বুঝতে পারছিল বিলুর বাড়ি দেখিয়ে দেওয়া মানে ওর সর্বনাশ করা। বিলুর সর্বনাশ হলে তিন নম্বরের উপকার হবে না। কিন্তু এসব মনে হলেও সে কিছু করতে পারছিল না। তার পিছনে পাঁচজন অস্ত্রধারী। বিলুর দরজায় পৌঁছে লোকটা ইশারা করে চিনিয়ে দিতে হুকুম হল, ডাক ওকে।

লোকটা গলা খুলে ডাকতে গেল কিন্তু কোন স্বর বের হল না। পিছন থেকে চাপা গলায় ধমক খেতে সে আবার ডাকল, বিলু।

তিনবারের বার একটি মহিলা কণ্ঠ জড়ানো গলায় বলল, অ্যাই বিলু, দ্যাখ দেখি তোরে কে ডাকে। আর সময় পায় না ডাকার। সারাদিন বেগার খেটে ছেলেটা যে একটু, বিলু রে!

এরপর বিলুর গলা শোনা গেল, কে? কি দরকার?

লোকটা খোঁচা খেল কোমরে। সেই সঙ্গে ফিসফিসানি, আসতে বল।

একটু এসো।

দরজায় শব্দ হল। পাজামা পরা খালি গায়ে বিলু বেরিয়ে আসতেই ওরা ওকে টেনে আনল পথে। বিলু চিৎকার করতে যাচ্ছিল কিন্তু রিভলভারটাকে দেখে থমকে গেল। ওরা ওর হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল।

অর্ক কোথায়?

বিলু জবাব দিল না। ওরা লোকটিকে জিজ্ঞাসা করল, অক্ক কোথায় থাকে?

জানি না। হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল লোকটা এবার।

চুপ! অক্ক কোথায়?

ওই দিকে। লোকটা ঢোক গিলল।

ওদের নিয়ে দলটা অর্কদের বাড়ির দিকে এগোতেই বিলু চিৎকার করে উঠল, খবরদার অর্ক, বের হস না। শালারা—

বিলু ছুটে যাচ্ছিল। কিন্তু ওর পক্ষে বেশীদূর যাওয়া সম্ভব হল না। মধ্যরাত্রের নির্জনতা টুকরো করে গুলির শব্দ হল। লোকগুলো এবার প্রথমজনকে দ্রুত গলায় বলল, বল শালা কোথায় অর্ক থাকে?

লোকটা চোখের ওপর বিলুকে পড়ে যেতে দেখে পাথর হয়ে গিয়েছিল। কোনরকমে হাতটা তুলে একটা দরজা দেখিয়ে দিল। চারধারে তখন হৈ চৈ শুরু হয়েছে। কোয়া থানার হাজতে, মোক্ষবুড়ি নেই, বন্ধ দরজার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকগুলো। ততক্ষণে পিলপিল করে বেরিয়ে পড়েছে তিন নম্বরের লোক। আর্তনাদ করছে তারা।

গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল অর্কর। তড়াক করে উঠে বসতেই দেখল অনিমেষও উঠছে। সে জিজ্ঞাসা করল, গুলির শব্দ না?

হ্যাঁ। বিলুর গলা পেলাম যেন।

বিলু! অর্ক লাফিয়ে উঠল।

মাধবীলতারও ঘুম ভেঙ্গেছিল। জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাচ্ছিস?

যাব না? অর্ক ঘুরে প্রশ্ন করল।

যা। ছোট্ট শব্দটা মাধবীলতার ঠোঁট থেকে ঝরে পড়তেই অর্ক দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ল। তিন নম্বরের ওপর তখন অবিরাম বোমা বর্ষণ চলছে। তারপরেই পেট্রোল বোমা ফাটল পর পর কয়েকটা। দাউ দাউ করে আগুন ছড়িয়ে পড়ল টালির ছাদে। মানুষজন ভয়ে চিৎকার করছে কিন্তু কেউ এক পা এগিয়ে যাচ্ছে না।

গলির মুখে এসে অর্ক ওদের দেখতে পেল। আটজনে মোটরবাইকের দিকে ছুটে যাচ্ছে। তার পরেই সে বিলুর শরীরটাকে দেখতে পেল। মাটিতে উপুড় হয়ে বিলু পড়ে আছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে দেহ। দুটো হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। মাথায় আগুন জ্বলে উঠল তার। সাতটা মোটর বাইক যখন ইঞ্জিন চালু করে দৌড় শুরু করেছে তখন অষ্টমজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। লোকটা বোধ হয় এর জন্যে তৈরি ছিল না। অকস্মাৎ আঘাতে সে মোটর সাইকেল নিয়ে ছিটকে পড়ল রাস্তায়। চালু ইঞ্জিন গোঁ গোঁ করছিল। আঘাত লেগেছিল অর্কর কিন্তু তৎক্ষণাৎ সে উঠে দাঁড়াতেই লোকটা ছুরি বের করল। ঠিক তখনই গুলিটা ছুটে এল। ছুটন্ত বাইকগুলোর কেউ গুলি চালিয়েছে। অর্ক দেখল লোকটার হাত থেকে ছুরি খসে পড়ল আর ধীরে ধীরে ওর শরীরটা মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এল। অর্ক ছুরিটা তুলে নিয়ে চারপাশে তাকাল।

ধাবমান মোটরসাইকেল-ধারীদের আর দেখা যাচ্ছিল না। তিন নম্বরে আগুন জ্বলছে। টিউবওয়েল থেকে বালতি করে মানুষ সেই আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে। চারধারে পরিত্রাহি চিৎকার। অর্ক ছুটে এল বিলুর কাছে। ছুরিটাকে ফেলে দিয়ে সে ওকে উপুড় করে শুইয়ে দিতে বুঝল কিছুই করার নেই। ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল অর্ক। তারপর বিলুর বিস্ফারিত চোখ বন্ধ করে দিল আলতো করে। ততক্ষণে ভিড় জমে গেছে চারপাশে। আগুনের তাপ লাগছে গায়ে। কিন্তু তার মধ্যেই বিলুর মা আর্তনাদ করে আছড়ে পড়ল ছেলের বুকে। চারধারে কান্নার রব যখন তখন দমকল এল। আগুন নিভিয়ে ফেলার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল তিন নম্বরে।

কাঁধে হাতের স্পর্শ পেতে মুখ তুলে তাকাল অর্ক। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ওরা কারা?

জানি না। অর্কর গলায় কান্না পাক খেল।

কাউকে চিনতে পারলি না?

না।

ন্যাড়া বলল, শালারা বদলা নিতে এসেছিল।

তুমি চেন ওদের?

না। কিন্তু বিলুদাকে খুন করেছে যখন তখন বদলা নিতে এসেছিল।

অর্ক মাথা নাড়ল, ওরা ধরা পড়বেই। আমি ওদের একজনকে যেতে দিইনি। বিলুকে খুন করে ওদের ফিরে যেতে দিইনি।

দমকল আগুন নিভিয়ে ফেলার পরেই পুলিস এল। দু’গাড়ি পুলিস প্রকৃত ঘটনা জেনে দুটো মৃতদেহ নিয়ে ফিরে গেল।

সেই রাত্রে তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেনে শুধুই কান্না আর আর্তনাদ। যাদের ছেলে গেল তারা তো বটেই যাদের ঘর গেল তারাও অস্থির হচ্ছিল। ভোরবেলায় সুবল এল। অর্ক বসেছিল গলির মুখে অনেকের সঙ্গে। সুবলকে দেখামাত্র সে উঠে দাঁড়াল, কি দেখতে আসা হয়েছে?

সুবল মুখ নিচু করল, বিশ্বাস করো আমার মুখ দেখাবার উপায় নেই। কাল থেকে নাইট গার্ডের সংখ্যা কমে গিয়েছে। আমরা ভাবতেই পারিনি ওরা অ্যাটাক করবে।

কারা করেছে জানেন?

মনে হচ্ছে কয়লার লোক। বিলুর ওপর ওদের রাগ ছিল।

ওরা তো আমাকেও খুঁজেছিল।

তাই নাকি?

অর্ক সুবলের দিকে তাকাল। তারপর মাথা নাড়ল, যান আপনি, আর এখন এখানে এসে দয়া দেখাতে হবে না।

সুবল বলল, আমি বুঝতে পারছি তোমার মনের অবস্থা। আমি আজই শান্তিকমিটির মিটিং ডাকবো। সতীশদাকে অনুরোধ করব আসার জন্যে। দ্যাখো অর্ক, তোমাদের ওপর যে আক্রমণ হয়েছিল সেটা আমার ওপরও হতে পারে। তাই না?

সুবল চলে যাওয়ার পর পরই সতীশদা এল, কি আশ্চর্য। এইভাবে খুন করে যাবে ভাবতে পারিনি। আমি এইমাত্র খবরটা পেলাম।

কাল রাত্রে চিৎকার শোনেন নি?

না। ওরা বিলুকে খুঁজতে এসেছিল?

ঠিক বুঝতে পারছি না।

আমি তোমাকে বলেছিলাম বিলুর চরিত্র ভাল নয়।

বিলুর চরিত্র কিরকম সেটা আপনার চেয়ে আমি ঢের বেশী জানি সতীশদা। এ ব্যাপারে কথা বলবেন না।

তুমি উত্তেজিত হচ্ছ।

আমি শীতল হয়ে থাকব বলে আশা করছেন?

কারা এসেছিল চিনতে পেরেছ?

না।

যে ছেলেটিকে তুমি খুন করেছ তার আইডেন্টিফিকেশন।

আমি খুন করেছি?

না না এটা কোন অফেন্স নয়। মানুষ নিজের নিরাপত্তার জন্যে, আত্মরক্ষার জন্যে এটা করলে আইনের চোখে অপরাধ হয় না।

সতীশদা, আপনি যান। আমাদের ব্যাপারটা আমাদেরই বুঝতে দিন। যখন পারব না তখন না হয় আসবেন।

অর্ক। তুমি কিন্তু তিন নম্বর বস্তির মানুষদের আমাদের কাছ থেকে আলাদা করে দিচ্ছ। বিলুকে যদি প্রটেকশন না দিতে তাহলে এতগুলো মানুষ গৃহহারা হতো না। ব্যাপারটা ভেবে দ্যাখো।

সতীশদা চলে গেলে অর্ক সবাইকে ডাকল, আপনারা কি করবেন? বিলুকে ওরা খুন করে গেল। আমি জানি বিলু কোন অপরাধ করেনি। তবু খুন হল। ওরা আমাকেও খুন করত। আজ থেকে আমাদের এই বারোয়ারি সংসার চলবে কি চলবে না?

ন্যাড়ার বাবা বলল, কেন চলবে না বাবা?

আপনারা কি সবাই চান এটা চলুক?

সমস্ত মানুষ একই সঙ্গে উচ্চারণ করল, চাই, চাই।

বেশ। তাহলে যদি এমন হয় আমিও নেই তাহলে এটাকে বন্ধ করবেন না। আমার কেমন মনে হচ্ছে এটা চলুক তা কেউ কেউ চাইছে না। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। শুধু একটা অনুরোধ, আজ বিলু চলে গেল। অন্তত আজকের সকালটা আমরা রান্না খাবার খাব না। আজকের সকালে তিন নম্বরের উনুন জ্বলবে না। আপত্তি আছে কারো?

জনতা সমস্বরে জানাল, না, আপত্তি নেই।

অর্ক ঘরে ফিরে এল। মাধবীলতা দরজায় দাঁড়িয়েছিল। অর্ক দেখল ঘরের মেঝেতে বিলুর মা লুটিয়ে আছে। তার পাশেআরও তিনজন মহিলা। অর্ক মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে বলল, জানি না কারা চাইছে না, কিন্তু আমরা এসব করি সত্যি তারা পছন্দ করছে না।

মাধবীলতার রুগ্ন শরীরের দিকে তাকিয়ে অর্ক অবাক হয়ে গেল। মাধবীলতার ঠোঁটে হাসি, তুই ভয় পেয়েছিস খোকা?

না মা। ভয় পাইনি।

খবরদার। যেটা ভাল মনে করবি তাই করবি। কিন্তু কখনও ভয় পাবি না।

হঠাৎ অর্কর মনে একটা শিহরণ বয়ে গেল। সে দুপা এগিয়ে গিয়ে দুহাতে মাধবীলতাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। মাধবীলতা অবাক গলায় প্রশ্ন করল, তুই কাঁদছিস?

বিলুটা চলে গেল মা।

শক্ত হ। জীবনে অনেক কিছু চলে যাবে খোকা কিন্তু কখনও পিছনে তাকাবি না। কখনও খুঁড়িয়ে হাঁটবি না–। কথাটা বলতে গিয়ে আর্তনাদ করে উঠল মাধবীলতা, এ আমি কি বললাম।

অর্ক ধীরে ধীরে মাধবীলতাকে সামনে আনল। তার দুটো হাত তখন মাধবীলতার কাঁধে। সেই চোখে চোখ রেখে সে বলল, না মা, তুমি ঠিকই বলেছ।

.

বেলা এগারটার সময় তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেনে দুটো জিপ এসে দাঁড়াল। স্তব্ধ মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে পুলিস অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, অর্ক মিত্র কার নাম?

অর্ক বসেছিল চোখ বন্ধ করে। এবার উঠে দাঁড়াল, আমিই অর্ক। কেন?

অফিসার ইশারা করতে দুজন সেপাই এগিয়ে গিয়ে তার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল, তোমাকে অ্যারেস্ট করা হল।

অ্যারেস্ট? কেন?

খুনের চার্জে। তুমিকাল রাত্রে এখানে একটা খুন করেছ। ছুরির হাতলে যে ছাপ পাওয়া গেছে তার সঙ্গে তোমারটা মিলিয়ে দেখা হবে। নিজেকে খুব শের ভাবছিলে এইটুকু বয়সে, না? চল।

ততক্ষণে চারধারে হইচই পড়ে গেছে। কাতারে কাতারে মানুষ বেরিয়ে আসছে তিন নম্বরের ঘরগুলো থেকে। পুলিস অফিসার আর সময় নষ্ট করলেন না। অর্ককে টেনে হিঁচড়ে ভ্যানে তোলা হল। কেউ কেউ সামনে গিয়ে ভ্যান আটকাবার চেষ্টা করলেও তাদের সরিয়ে ফেলে বিজয়দর্পে অফিসার বন্দী নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

৬৩. গতরাত্রে আগুন যখন জ্বলেছিল

ঈশ্বরপুকুরে গতরাত্রে আগুন যখন জ্বলেছিল তখনও মানুষের বোধ হয় এতটা উত্তেজনা হয়নি। ন্যাড়া ছুটে গিয়েছিল অনিমেষের কাছে। অনিমেষ তখন উনুনের কারখানায় বসে বয়স্কদের সঙ্গে কথা বলছিল। ন্যাড়া গিয়ে চিৎকার করল, অক্কদাকে ধরে নিয়ে গেল।

ধরে নিয়ে গেল? অনিমেষ চমকে উঠল, কে ধরল?

পুলিস। কথাটা বলে ন্যাড়া ছুটে গেল ভেতরের দিকে।

অনিমেষ ক্রাচদুটো আঁকড়ে ধরল। তারপর তড়িঘড়ি চলে এল গলির মুখে। তখন ভ্যান আটকেছে তিন নম্বরের মানুষেরা। পুলিস অফিসার হুমকি দিচ্ছেন, সরে না গেলে ফলাফল খারাপ হবে। অনিমেষ ভ্যানের পাশে এসে জিজ্ঞাসা করল চেঁচিয়ে, ওকে ধরলেন কেন?

পুলিস অফিসার কোন জবাব দিল না। সেই সময় অর্ক তারের জানলার কাছে মুখ এনে বলল, বাবা, ওদের সরে যেতে বল।

বোধ হয় ওই কথাটা শুনতে পেয়েছিল মানুষগুলো। ভ্যানটা চলে গেল।

তিন নম্বরে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। রাগের মাথায় কেউ লাইট পোস্টের বাল্ব ভাঙ্গছে। সরকারি দুধের ডিপোর খাঁচা নিয়ে টানাটানি করছে কেউ। এই সময় সতীশদা ছুটে এল আবার। চিৎকার করে সে বলল, আপনারা শান্ত হন। পুলিসের এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই আমরা প্রতিবাদ করব। কিন্তু তারও একটা পদ্ধতি আছে। প্রথমে জানতে হবে কেন অর্ককে অ্যারেস্ট করা হল। যদি তার কোন যুক্তিযুক্ত কারণ না থাকে তাহলে নিশ্চয়ই আমরা আন্দোলনে নামব। কিন্তু এই প্রথম, সতীশদার কথার ওপর তিন নম্বরের মানুষ কথা বলল, কোন কথা শুনতে চাই না। অর্ককে ছেড়ে দিতে হবে। প্রায় অপমানিত হয়ে সতীশদা ফিরে গেল।

অনিমেষ বুঝতে পারছিল না সে কি করবে। অর্ককে কেন ধরে নিয়ে গেল তাই তার মাথায় ঢুকছিল না। অর্ক তো খুন করেনি। লোকটা মারা গেছে ওদেরই সঙ্গীর গুলিতে। অর্ক অবশ্য সবার সামনে বলেছে, আমি ওকে যেতে দিইনি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সে লোকটাকে খুন করেছে।

এই সময় মাধবীলতাকে দেখা গেল। ধীরে ধীরে সে গলির মুখে এসে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত মানুষগুলোকে দেখল। ওকে দেখা মাত্র মানুষগুলো চুপ করে গেল। মাধবীলতা অনিমেষকে বলল, ওরা এসে একটা ছেলেকে খুন করল, বাড়ি পোড়াল আর খোকাকে ধরে নিয়ে গেল। তুমি কি কিছুই বুঝতে পারছ না? আমি থানায় যাব।

থানায়? বেশ চল। অনিমেষ ওর পাশে এসে দাঁড়াল।

সঙ্গে সঙ্গে তিন নম্বরের মানুষ চিৎকার করে উঠল, আমরা থানায় যাব।

মাধবীলতা পা বাড়াতে অনিমেষ ইতস্তত করল, লতা, তুমি হেঁটে যেও না, আমি বরং একটা রিকশা ডাকি।

কেন? মাধবীলতা অবাক হয়ে মুখ তুলে তাকাতেই অনিমেষ চমকে উঠল। হঠাৎ, অনেক অনেক বছর পরে তার স্মৃতিতে একটা দৃশ্য চলকে উঠল। শান্তিনিকেতনে সেই রাত্রে ওই ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর সে যখন বলেছিল, লতা, কিছু মনে করো না, ঠিক তখন এই রকম ভঙ্গী ও গলায় মাধবীলতা প্রশ্ন করেছিল, কেন? খুব ছোট হয়ে গিয়েছিল সেদিন।

এই সময় আলুথালু বেশে ছুটে এল বিলুর মা, মাস্টারনি, আমি তোমার সঙ্গে যাব। আমি যাব।

আপনি? মাধবীলতা অবাক হয়ে গেল। একটু আগেও মহিলা শোকে পাথর হয়ে পড়েছিলেন। বিলুর মা বলল, হ্যাঁ। আমার ছেলেকে ওরা খেয়েছে। কিন্তু তোমার ছেলেকে খেতে দেব না। ও যে এই কদিনে আমাদের বাপ হয়ে গিয়েছে। বাপের বিপদে মেয়ে কি ঘরে থাকে?

তারপর ঈশ্বরপুকুর লেনে একটি অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখা গেল। আড়াই তিনশ মানুষ এগিয়ে যাচ্ছিল থানার দিকে। প্রথমে তিন নম্বরের সমস্ত শিশু এবং মহিলা। যে যা অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায় বেরিয়ে পড়েছে। তারপরে প্রত্যেকটি পুরুষ। কোন রকম রাজনৈতিক প্রচার কিংবা সংগঠন ছাড়াই মানুষগুলো নীরবে হেঁটে যাচ্ছিল। খবরটা তখন সমস্ত বেলগাছিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। একটি ছেলেকে মিথ্যে খুনের দায়ে গ্রেপ্তার করেছে পুলিস। ছেলেটা পঞ্চাশটি পরিবারকে দুর্দশা থেকে বাঁচিয়ে স্থিতিশীল করতে চলেছিল। সেইসব পরিবারের মেয়ে এবং শিশুরা বুঝেছিল এই ছেলে তাদের মানুষের মত বাঁচার সুযোগ করে দিচ্ছে। তাই আজ তারা বেরিয়ে পড়েছে প্রতিবাদ জানাতে। বেলগাছিয়ার কৌতূহলী মানুষেরাও নিজের অজান্তে ওই মিছিলে শামিল হল। কোন ফেস্টুন নেই, প্লাকার্ড নেই, শ্লোগান নেই এমনকি কোন পরিচিত নেতার তৃপ্ত মুখ মিছিলে নেই।

ট্রাম রাস্তায় পৌঁছানোর পর মাধবীলতার মাথায় যন্ত্রণা শুরু হল। ঘাম হচ্ছে খুব। শরীর সিরসির করছে। সে নিজেকে বোঝাল এটা সাময়িক দুর্বলতা। একনাগাড়ে শুয়ে থাকার জন্যে এমনটা হচ্ছে। মাধবীলতার পাশে যিনি হাঁটছেন সেই মহিলা বললেন, জানো মাস্টারনি, দুবেলা খাওয়া জুটতো না। ছেলেমেয়েগুলোকে কি দেব এই নিয়ে পাগল হয়েছিলাম। অর্ক আমাকে বাঁচিয়েছে। ওরা ওকে ধরে নিয়ে যাওয়া মানে আবার আমাকে মেরে ফেলা। ষড়যন্ত্র, ওরা আমাদের মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করেছে। এ হতে দেব না, কিছুতেই না।

কথাটা যেন অমৃতের কাজ করল। মাধবীলতার শরীর থেকে মুহূর্তেই সমস্ত ক্লান্তি উধাও হয়ে গেল। তার মনে হল, অর্ক এই মুহূর্তেই আর তার একার ছেলে নয়।

খবরটা আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। থানার সামনে জনাকুড়ি পুলিস লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে। তাদের ওই ভঙ্গী দেখে মিছিল যেন খেপে উঠল আচমকা। একসঙ্গে গর্জিত হল, মুক্তি চাই, অর্কর মুক্তি চাই।

একজন পুলিস অফিসার হুকুম দিতে সেপাইরা লাঠি ছড়িয়ে মিছিলটাকে আটকে দিল। লোকগুলো একটু ঘাবড়ে গিয়েছে মনে করে অফিসার চিৎকার করে বললেন, কেন এসেছেন আপনারা?

অর্কর মুক্তি চাই। জনতা চেঁচাল।

বিচার হবে তারপর মুক্তি। আপনারা একটা খুনীকে ছেড়ে দিতে বলছেন? দেশে কি আইন কানুন থাকবে না?

অর্ক খুনী নয়। জনতা জবাব দিল।

এই সময় আর একজন অফিসার বেরিয়ে এসে বললেন, জিজ্ঞাসা করো কোন পার্টি অর্গানাইজ করেছে ওদের।

প্রথম অফিসার রিলে করলেন, কোন পার্টির লোক আপনারা। নেতা কে?

অনিমেষ ক্রাচ নিয়ে এগিয়ে এল কর্ডনের সামনে, এটা অরাজনৈতিক মিছিল।

সি পি এমের কেউ আছেন?

না।

কংগ্রেসের কেউ?

না।

তাহলে এই মিছিল বেআইনি, আনঅথরাইজড। পাঁচ মিনিট সময় দিলাম আপনারা চলে যান। থানার সামনে একশ চুয়াল্লিশ ধারা জারি আছে।

অনিমেষ চিৎকার করল, না, অর্ককে না ছাড়লে আমি যাব না।

যাব না। যাব না। জনতা চিৎকার করল, মুক্তি চাই।

জনতা থানা ঘেরাও করল। তারা রাস্তায় বসে পড়ল। পুলিস অফিসার ভেবে পাচ্ছিলেন না তাঁরা কি করবেন প্রথমজন দ্বিতীয়জনকে বললেন, কি করা যায়। এরা এখনও শান্তিপূর্ণ। এদের ওপর লাঠিচার্জ করলে খবরের কাগজ ছেড়ে দেবে না। পলিটিক্যাল পার্টি হলে ওপর মহল থেকে একটা ব্যবস্থা করা যেত।

দ্বিতীয়জন বললেন, ঠিক আছে। লেট দেম স্টে। কতক্ষণ থাকতে পারে দেখা যাক। জোর করে ধরে নিয়ে এসেছে ওর বাপ মা। একটু বাদেই সব যে যার ধান্দায় কেটে পড়বে। পলিটিক্যাল মিছিলে এসে সব চিড়িয়াখানা দেখতে যায় হে। কত দেখলাম।

কিন্তু এবার হিসেবটা ভুল হল। দুপুর শেষ। বিকেলের ছায়া জমেছে। কিন্তু একটি মানুষও তার নিজের জায়গা ছেড়ে ওঠেনি। বরং যত বেলা বেড়েছে তত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। শান্তি কমিটি থেকে সুবল এসে অনিমেষের পাশে বসেছে। বসে বলেছে, ইটস প্রিপ্লানড। অর্ককে কারা ধরিয়ে দিয়েছে তা আমি জানি।

কারা?

যারা ভেবেছিল অর্ক থাকলে তিন নম্বরের কয়েকশ ভোট পেতে মুশকিল হবে। কত রকমের স্বার্থ থাকে মানুষের।

অর্ক ভোট দেবে কি? ওর তো ভোটের বয়সই হয়নি।

কিন্তু দেখছেন তো ওকে তিন নম্বরের মানুষ কি রকম ভালবাসে।

সন্ধ্যের একটু আগে একজন অফিসার এগিয়ে এলেন, আপনারা যদি কথা বলতে চান তাহলে একজন আসুন, এনি অফ ইউ।

অনিমেষ ক্রাচ দুটো টেনে উঠতে যাচ্ছিল, সুবল বাধা দিল, আপনি থাকুন। আমি কথা বলছি।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, না। আমাকে যেতে দাও।

কিন্তু সে দাঁড়াবার আগেই মাধবীলতা এগিয়ে গেছে। অনিমেষ বিস্ময়ে চিৎকার করল, লতা, তুমি যেও না। আমি যাচ্ছি।

কথাটা যেন মাধবীলতার কানে ঢুকল না। দৃঢ় পায়ে সে পুলিস অফিসারের সঙ্গে থানায় ঢুকল।

ও সি বসেছিলেন টেবিলের ওপারে। একজন মহিলা এসেছেন দেখে তিনি অবাক হয়ে অফিসারকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোন পুরুষ এল না?

আমি আসায় আপনার কোন অসুবিধে হচ্ছে?

ও সির মুখ বিকৃত হল, না। কি চাইছেন আপনারা? আমাদের কাজ করতে দিতে চান না? আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন? জানেন, আমি ইচ্ছে করলে পেঁদিয়ে বিষ ঝেড়ে দিতে পারি।

মাধবীলতা শান্ত গলায় বলল, ভদ্র ভাষায় কথা বলুন।

আই সি। ও সি ছোট চোখে দেখলেন, আপনি কে?

তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুরে থাকি।

তা তো বুঝলাম। অর্কর সঙ্গে কি সম্পর্ক?

মাধবীলতা চোখ বন্ধ করল। তারপর হেসে বলল, ও আমাদের আশা।

আশা মানে?

বেঁচে থাকার।

কি হেঁয়ালি করছেন? শুনুন, ওর বিরুদ্ধে দুটো চার্জ আছে। একটা ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন। ও যে ছুরি দিয়ে খুন করেছে তাতে ওর হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। তাছাড়া ওখানকার লোকই বলেছে সে ভিক্টিমের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

কিন্তু লোকটা তো গুলিতে মারা যায়।

গুলিটা কে ছুঁড়েছিল তা বোঝা যাচ্ছে না।

অর্ক রিভলভার পাবে কোথায়?

সেটা কে জানে?

মাধবীলতা ফুঁসে উঠল, এসব মিথ্যে কথা। ওরা এসে বিলুকে খুন করে গেল, ঘর পোড়াল তার কি অ্যাকশন নিয়েছেন?

চেষ্টা হচ্ছে। একজন সমাজবিরোধী যে কোন সময় খুন হতে পারে।

বিলু সমাজবিরোধী?

ইয়েস। প্রমাণ আছে। অর্ক ওকে শেল্টার দিয়েছিল।

দ্বিতীয় চার্জ কি?

আজ থেকে কিছুদিন আগে জলপাইগুড়ি শহরে একটা গহনার দোকানে ডাকাতি হয়। ওটা উগ্রপন্থী কিছু ছেলে অর্কর সাহায্যে করেছে।

মিথ্যে কথা। সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা।

প্রমাণ আছে। এসব আদালতে বিচার হবে। আপনারা চলে যান। থানার সামনেটা পরিষ্কার করে দিন।

আমি একবার অর্কর সঙ্গে কথা বলতে চাই।

ও সি মাধবীলতার মুখের দিকে তাকালেন। তারপর সেপাইকে ডেকে বললেন, একে দুমিনিটের জন্যে নিয়ে যাও আসামীর কাছে।

থানার হাজতে অর্ক বসেছিল। সেখানে আরও কিছু বন্দী। তাদের চেহারা দেখে বোঝা যায় চরিত্র কি ধরনের। মাধবীলতা এসে দাঁড়াতেই অর্ক উঠে এল, মা।

ওরা ষড়যন্ত্র করছে খোকা, তোর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।

জানি। কিন্তু আমি ভয় পাইনি।

ঠিক। একদম ভয় পাবি না। তুই হলি সূর্য। সূর্যের কোন ভয় নেই। আমি যদি নাও থাকি তুই এই কথাটা কখনও ভুলিস না।

মা!

আমি তোকে নিয়ে খুব ভয় পেতাম। পড়াশুনা করতিস না বলে মন খারাপ হত। আর আমার ভয় নেই খোকা। আমি জানি তোকে ওরা ধরে রাখতে পারবে না। রাহু কখনও সূর্যকে ঘিরে ফেলতে পারে না।

অর্ক বলল, মা, আমি যতদিন না ফিরছি ততদিন তুমি ওদের দেখো। লোকগুলো খুব কষ্ট পাচ্ছিল এত দিন। কিন্তু এখন যেন সবাই পাল্টে গিয়েছে।

দেখব। আমি তোর বাবার রাজনীতি থেকে অনেক দূরে ছিলাম, কখনও তার পাশে দাঁড়াইনি। মনে হত ওদের পথ ঠিক নয়। কিন্তু কোনদিন ওকে বাধা দিইনি। আজ কিন্তু তোর পাশে থাকব। একটাই তো জীবন, বাজে খরচ করাও যা না খরচ করাও তা। তোকে দেখে এটুকু বুঝেছি আমি।

অফিসার বললেন, চলুন। পাঁচ মিনিট হয়ে গেছে।

মাধবীলতা হাসল, খোকা দ্যাখ, কত সহজে পাঁচ মিনিট হয়ে গেল। আমরা কেউ সময়টাকে ধরে রাখতে পারি না। কিন্তু তুই তো একটা ধাক্কা দিলি, একটা দাগ কেটে গেলি পঞ্চাশটা পরিবারের মনে। আমি আশীর্বাদ করছি তুই জয়ী হবি।

হঠাৎ অর্ক কেঁদে ফেলল, মা এমন করে কথা বলো না। এভাবে কখনও তুমি আমায় বলোনি।

দূর বোকা! চোখের জল মোছ। মোছ। শক্ত হ। সোজা হয়ে দাঁড়া। বাঃ, এই তো চাই।

অফিসারের পাশাপাশি মাধবীলতা বেরিয়ে এল বাইরে। সে একবারও পেছন ফিরে তাকাল না। তার অনুভূতি বলছিল অর্কর মুক্তি নেই। ওরা ওকে অনেককালের জন্যে অন্ধকারে রেখে দেবে। কিন্তু সেজন্যে তার একটুও কষ্ট হচ্ছিল না। আজ ওই বন্দীশালায় সে একটা শক্ত মানুষকে দেখে এসেছে। মাধবীলতার শরীর টলছিল। চোখের সামনেটা ক্রমশ ঝাঁপসা। অজস্র মানুষের উদ্বিগ্ন মুখগুলো ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছিল।

কোন রকমে সোজা হয়ে সে বলল, আপনারা বাড়ি চলুন। অনেক কাজ বাকি আছে।

জনতা চেঁচাল, অর্কর মুক্তি চাই।

চোখ বন্ধ করে হাসল মাধবীলতা। তারপর বিড়বিড় করল নিজের মনে, অর্ক মানে কি ওরা জানে? সূর্যকে কি কেউ বন্দী করতে পারে?

অদ্ভুত শান্তি নিয়ে মাধবীলতার শরীর পৃথিবীর মাটির গায়ে নেমে আসছিল। যেমন করে পাখিরা টানটান ডানা মেলে বাসায় ফিরে আসে নিশ্চিন্তিতে।

(সমাপ্ত)

Inspire Literature
Inspire Literaturehttps://www.inspireliterature.com
Read your favourite inspire literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments