Friday, July 5, 2024
Homeছোট গল্পচন্দন-মূর্তি - শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

চন্দন-মূর্তি – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

বৌদ্ধ ভিক্ষু বলিতে যে-চিত্রটি আমাদের মনে উদয় হয়, একালের সাধারণ বাঙালীর চেহারার সঙ্গে সে-চিত্রের মোটেই মিল নাই। অথচ, যাঁহার কথা আজ লিখিতে বসিয়াছি সেই ভিক্ষু অভিরাম যে কেবল জাতিতে বাঙালী ছিলেন তাহাই নয়, তাঁহার চেহারাও ছিল নিতান্তই বাঙালীর মতো।

আরম্ভেই বলিয়া রাখা ভাল যে ভিক্ষু অভিরামের আগাগোড়া জীবন-বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করা আমার অভিপ্রায় নয়, থাকিলেও তাহা সম্ভব হইত না। তাঁহার বংশ বা জাতি-পরিচয় কখনও শুনি নাই, তিনি বাঙালী হইয়া বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের গণ্ডীতে কি করিয়া গিয়া পড়িলেন সে ইতিহাসও আমার কাছে অজ্ঞাত রহিয়া গিয়াছে। কেবল এক বৎসরের আলাপে তাঁহার চরিত্রের যে-পরিচয়টি আমি পাইয়াছিলাম এবং একদিন অচিন্তনীয় অবস্থার মধ্যে পড়িয়া কিরূপে সেই পরিচয়ের বন্ধন চিরদিনের জন্য ছিন্ন হইয়া গেল, তাহাই সংক্ষেপে বাহুল্য বর্জন করিয়া পাঠকের সম্মুখে স্থাপন করিব। আমাদের দেশ ধর্মোম্মত্ততার মল্লভূমি, ধর্মের নামে মাথা ফাটাফাটি অনেক দেখিয়াছি। কিন্তু ভিক্ষু অভিরামের হৃদয়ে এই ধর্মানুরাগ যে বিচিত্র রূপ গ্রহণ করিয়াছিল তাহা পূর্বে কখনও দেখি নাই এবং পরে যে আর দেখিব সে সম্ভাবনাও অল্প।

ভিক্ষু অভিরামের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় ইম্পীরিয়াল লাইব্রেরিতে। বছর-চারেক আগেকার কথা, তখন আমি সবেমাত্র বৌদ্ধ যুগের ইতিহাস লইয়া নাড়াচাড়া আরম্ভ করিয়াছি। একখানা দুষ্প্রাপ্য বৌদ্ধ পুস্তক খুঁজিতে গিয়া দেখিলাম তিনি পূর্ব হইতে সেখানা দখল করিয়া বসিয়া আছেন।

ক্রমে তাঁহার সহিত আলাপ হইল। শীর্ণকায় মুণ্ডিতশির লোকটি, দেহের বস্ত্রাদি ঈষৎ পীতবর্ণ, বয়স বোধ করি চল্লিশের নীচেই। কথাবার্তা খুব মিষ্ট, হাসিটি শীর্ণ মুখে লাগিয়াই আছে; আমাদের দেশের সাধারণ উদাসী সম্প্রদায়ের মতো একটি নির্লিপ্ত অনাসক্ত ভাব। তবু তাঁহাকে সাধারণ বলিয়া অবহেলা করা যায় না। চোখের মধ্যে ভাল করিয়া দৃষ্টিপাত করিলেই বুঝিতে পারা যায়, একটা প্রবল দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা সদাসর্বদা সেখানে জ্বলিতেছে। জটা কৌপীন কিছুই নাই; তথাপি তাঁহাকে দেখিয়া রবীন্দ্রনাথের ‘পরশপাথরে’র সেই ক্ষ্যাপাকে মনে পড়িয়া যায়—

ওষ্ঠে অধরেতে চাপি অন্তরের দ্বার ঝাঁপি
রাত্রিদিন তীব্র জ্বালা জ্বেলে রাখে চোখে।
দুটো নেত্র সদা যেন নিশার খদ্যোত-হেন
উড়ে উড়ে খোঁজে কারে নিজের আলোকে।

বাঙালী বৌদ্ধ ভিক্ষু বর্তমান কালে থাকিতে পারে এ কল্পনা পূর্বে মনে স্থান পায় নাই, তাই প্রথম দর্শনেই তাঁহার প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়িয়াছিলাম। ক্রমশ আলাপ ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হইল। তিনি সময়ে অসময়ে আমার বাড়িতে আসিতে আরম্ভ করিলেন। বৌদ্ধ শাস্ত্রে তাঁহার জ্ঞান যেরূপ গভীর ছিল, বৌদ্ধ ইতিহাসে ততটা ছিল না। তাই বুদ্ধের জীবন সম্বন্ধে কোনও নূতন কথা জানিতে পারিলে তৎক্ষণাৎ আমাকে আসিয়া জানাইতেন। আমার ঐতিহাসিক গবেষণা সম্বন্ধেও তাঁহার ঔৎসুক্যের অন্ত ছিল না; ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্থির হইয়া বসিয়া আমার বক্তৃতা শুনিয়া যাইতেন, আর তাঁহার চোখে সেই খদ্যোত-আলোক জ্বলিতে থাকিত।

খাদ্যাদি বিষয়ে তাঁহার কোনও বিচার ছিল না। আমার বাড়িতে আসিলে গৃহিণী প্রায় ভক্তিভরে তাঁহাকে খাওয়াইতেন; তিনি নির্বিবাদে মাছ মাংস সবই গ্রহণ করিতেন। আমি একদিন প্রশ্ন করায় তিনি ক্ষীণ হাসিয়া বলিয়াছিলেন, ‘আমি ভিক্ষু, ভিক্ষাপাত্রে যে যা দেবে তাই আমাকে খেতে হবে, বাছ-বিচার করবার তো আমার অধিকার নেই। তথাগতের পাতে একদিন তাঁর এক শিষ্য শূকর-মাংস দিয়েছিল, তিনি তাও খেয়েছিলেন।’ ভিক্ষুর দুই চক্ষু সহসা জলে ভরিয়া গিয়াছিল।

প্রায় ছয়-সাত মাস কাটিয়া যাইবার পর একদিন তাঁহার প্রাণের অন্তরতম কথাটি জানিতে পরিলাম। আমার বাড়িতে বসিয়া বৌদ্ধ শিল্প আলোচনা হইতেছিল। ভিক্ষু অভিরাম বলিতেছিলেন, ‘ভারতে এবং ভারতের বাইরে কোটি কোটি বুদ্ধমূর্তি আছে। কিন্তু সবগুলিই তাঁর ভাব-মূর্তি। ভক্ত-শিল্পী যে-ভাবে ভগবান তথাগতকে কল্পনা করেছে, পাথর কেটে তাঁর সেই মূর্তিই গড়েছে। বুদ্ধের সত্যিকার আকৃতির সঙ্গে তাদের পরিচয় ছিল না।’

আমি বলিলাম, ‘আমার তো মনে হয়, ছিল। আপনি লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয় যে, সব বুদ্ধমূর্তিরই ছাঁচ প্রায় এক রকম। অবশ্য অল্পবিস্তর তফাৎ আছে, কিন্তু মোটের উপর একটা সাদৃশ্য পাওয়া যায়— কান বড়, মাথায় কোঁকড়া চুল, ভারী গড়ন— এগুলো সব মূর্তিতেই আছে। এর কারণ কি? নিশ্চয় তাঁর প্রকৃত চেহারা সম্বন্ধে শিল্পীদের জ্ঞান ছিল, নইলে কেবল কাল্পনিক মূর্তি হলে এতটা সাদৃশ্য আসতে পারত না। একটা বাস্তব মডেল তাদের ছিলই।’

গভীর মনঃসংযোগে আমার কথা শুনিয়া ভিক্ষু অভিরাম কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, তারপর ধীরে ধীরে বলিলেন, ‘কি জানি। বুদ্ধদেবের জীবিতকালে তাঁর মূর্তি গঠিত হয়নি, তখন ভাস্কর্যের প্রচলন ছিল না। বুদ্ধমূর্তির বহুল প্রচলন হয়েছে গুপ্ত-যুগ থেকে, খ্রীস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে, অর্থাৎ বুদ্ধ-নির্বাণের প্রায় সাত-শ’ বছর পরে। এই সাত-শ’ বছর ধরে তাঁর আকৃতির স্মৃতি মানুষ কি করে সঞ্জীবিত রেখেছিল? বৌদ্ধ শাস্ত্রেও তাঁর চেহারার এমন কোনও বর্ণনা নেই যা থেকে তাঁর একটা স্পষ্ট চিত্র আঁকা যেতে পারে। আপনি যে সাদৃশ্যের কথা বলছেন, সেটা সম্ভবত শিল্পের একটা কনভেনশ্যন— প্রথমে একজন প্রতিভাবান্‌ শিল্পী তাঁর ভাব-মূর্তি গড়েছিলেন, তারপর যুগপরম্পরায় সেই মূর্তিরই অনুকরণ হয়ে আসছে।’ ভিক্ষু একটি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন, ‘না— তাঁর সত্যিকার চেহারা মানুষ ভুলে গেছে। — টুটেনখামেন আমেন-হোটেপের শিলা-মূর্তি আছে, কিন্তু বোধিসত্ত্বের দিব্য দেহের প্রতিমূর্তি নেই।’

আমি বলিলাম, ‘হ্যাঁ, মানুষের স্মৃতির উপর যাদের কোনও দাবি নেই তারাই পাথরে নিজেদের প্রতিমূর্তি খোদাই করিয়ে রেখে গেছে, আর যাঁরা মহাপুরুষ তাঁরা কেবল মানুষের হৃদয়ের মধ্যে অমর হয়ে আছেন। এই দেখুন না, যীশুখ্রীস্টের প্রকৃত চেহারা যে কি রকম ছিল তা কেউ জানে না।’

তিনি বলিলেন, ‘ঠিক। অথচ কত হাজার হাজার লোক তাঁর গায়ের একটা জামা দেখবার জন্য প্রতি বৎসর তীর্থযাত্রা করছে। তারা যদি তাঁর প্রকৃত প্রতিমূর্তির সন্ধান পেত, কি করত বলুন দেখি। বোধ হয় আনন্দে পাগল হয়ে যেত।’

এই সময় তাঁহার চোখের দিকে আমার নজর পড়িল। ইংরাজীতে যাহাকে ফ্যানাটিক বলে, এ সেই তাহারই দৃষ্টি। যে উগ্র একাগ্রতা মানুষকে শহীদ করিয়া তোলে, তাঁহার চোখে সেই সর্বগ্রাসী তন্ময়তার আগুন জ্বলিতেছে। চক্ষু দুটি আমার পানে চাহিয়া আছে বটে, কিন্তু তাঁহার মন যেন আড়াই হাজার বৎসরের ঘন কুজ্ঝটিকা ভেদ করিয়া এক দিব্য পুরুষের জ্যোতির্ময় মূর্তি সন্ধান করিয়া ফিরিতেছে।

তিনি হঠাৎ বলিতে লাগিলেন, ‘ভগবান বুদ্ধের দন্ত কেশ নখ দেখেছি; কিছু দিনের জন্য এক অপরূপ আনন্দের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে ছিলুম। কিন্তু তবু তাতে মন ভরল না। কেমন ছিল তাঁর পূর্ণাবয়ব দেহ? কেমন ছিল তাঁর চোখের দৃষ্টি? তাঁর কণ্ঠের বাণী— যা শুনে একদিন রাজা সিংহাসন ছেড়ে পথে এসে দাঁড়িয়েছিল, গৃহস্থ-বধূ স্বামী-পুত্র ছেড়ে ভিক্ষুণী হয়েছিল— সেই কণ্ঠের অমৃতময় বাণী যদি একবার শুনতে পেতুম—’

দুর্দম আবেগে তাঁহার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হইয়া গেল। দেখিলাম, তাঁহার দেহ রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিয়াছে, অজ্ঞাতে দুই শীর্ণ গণ্ড বাহিয়া অশ্রুর ধারা গড়াইয়া পড়িতেছে। বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া গেলাম; এত অল্প কারণে এতখানি ভাবাবেশ কখনও সম্ভব মনে করি নাই। শুনিয়াছিলাম বটে, কৃষ্ণনাম শুনিবামাত্র কোনও কোনও বৈষ্ণবের দশা উপস্থিত হয়, বিশ্বাস করিতাম না; কিন্তু ভিক্ষুর এই অপূর্ব ভাবোন্মাদনা দেখিয়া আর তাহা অসম্ভব বোধ হইল না। ধর্মের এ-দিকটা কোনও দিন প্রত্যক্ষ করি নাই; আজ যেন হঠাৎ চোখ খুলিয়া গেল।

ভিক্ষু বাহ্যজ্ঞানশূন্যভাবে বলিতে লাগিলেন, ‘গৌতম! তথাগত! আমি অর্হত্ত্ব চাই না, নির্বাণ চাই না, — একবার তোমার স্বরূপ আমাকে দেখাও। যে-দেহে তুমি এই পৃথিবীতে বিচরণ করতে সেই দেব-দেহ আমাকে দেখাও। বুদ্ধ, তথাগত—’

বুঝিলাম বৌদ্ধ ধর্ম নয়, স্বয়ং সেই কালজয়ী মহাপুরুষ ভিক্ষু অভিরামকে উন্মাদ করিয়াছেন।

পা টিপিয়া টিপিয়া ঘর হইতে বাহির আসিলাম। এই আত্মহারা ব্যাকুলত বসিয়া দেখিতে পারিলাম না, মনে হইতে লাগিল যেন অপরাধ করিতেছি।


ধর্মোন্মত্ততা বস্তুটা সংক্রামক। আমার মধ্যেও বোধ হয় অজ্ঞাতসারে সঞ্চারিত হইয়াছিল। তাই উল্লিখিত ঘটনার কয়েক দিন পরে একদিন ফা-হিয়ানের ভ্রমণ-বৃত্তান্তের পাতা উল্টাইতে উল্টাইতে হঠাৎ এক জায়গায় আসিয়া দৃষ্টি আটকাইয়া গেল; আনন্দ ও উত্তেজনায় একেবারে লাফাইয়া উঠিলাম। ফা-হিয়ান পূর্বেও পড়িয়াছি, কিন্তু এ-জিনিস চোখে ঠেকে নাই কেন?

সেইদিন অপরাহ্ণে ভিক্ষু অভিরাম আসিলেন। উত্তেজনা দমন করিয়া বইখানা তাঁহার হাতে দিলাম। তিনি উৎসুকভাবে বলিলেন, ‘কি এ?’

‘পড়ে দেখুন’ বলিয়া একটা পাতা নির্দেশ করিয়া দিলাম। ভিক্ষু পড়িতে লাগিলেন, আমি তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলাম।

“বৈশালী হইতে দ্বাদশ শত পদ দক্ষিণে বৈশ্যাধিপতি সুদত্ত দক্ষিণাভিমুখী একটি বিহার নির্মাণ করিয়াছিলেন। বিহারের বামে ও দক্ষিণে স্বচ্ছ বারিপূর্ণ পুষ্করিণী বহু বৃক্ষ ও নানাবর্ণ পুষ্পে অপূর্ব শোভা ধারণ করে। ইহাই জেতবন-বিহার।

“বুদ্ধদেব যখন ত্রয়স্ত্রিংশ স্বর্গে গমন করিয়া তাঁহার মাতৃদেবীর হিতার্থে নব্বই দিবস ধর্মপ্রচার করিয়াছিলেন, তখন প্রসেনজিৎ তাঁহার দর্শনাভিলাষী হইয়া গোশীর্ষ চন্দনকাষ্ঠে তাঁহার এক মূর্তি প্রস্তুত করিয়া যে-স্থানে তিনি সাধারণত উপবেশন করিতেন তথায় স্থাপন করিলেন। বুদ্ধদেব স্বর্গ হইতে প্রত্যাগমন করিলে এই মূর্তি বুদ্ধদেবের সহিত সাক্ষাতের জন্য স্বস্থান পরিত্যাগ করিল। বুদ্ধদেব তখন মূর্তিকে কহিলেন, ‘তুমি স্বস্থানে প্রতিগমন কর; আমার নির্বাণ লাভ হইলে তুমি আমার চতুর্বর্গ শিষ্যের নিকটে আদর্শ হইবে।’ এই বলিলে মূর্তি প্রত্যাবর্তন করিল। এই মূর্তিই বুদ্ধদেবের সর্বাপেক্ষা প্রথম মূর্তি এবং ইহা দৃষ্টেই পরে অন্যান্য মূর্তি নির্মিত হইয়াছে।

“বুদ্ধ-নির্বাণের পরে এক সময় আগুন লাগিয়া জেতবন-বিহার ভস্মীভূত হয়। নরপতিগণ ও তাঁহাদের প্রজাবর্গ চন্দন-মূর্তি ধ্বংস হইয়াছে মনে করিয়া অত্যন্ত বিমর্ষ হন; কিন্তু চারি-পাঁচ দিন পরে পূর্বপার্শ্বস্থ ক্ষুদ্র বিহারের দ্বার উন্মুক্ত হইলে চন্দন-মূর্তি দৃষ্ট হইল। সকলে উৎফুল্ল হৃদয়ে একত্র হইয়া বিহার পুনর্নির্মাণে ব্রতী হইল। দ্বিতল নির্মিত হইলে তাহারা প্রতিমূর্তিকে পূর্বস্থানে স্থাপন করিল। …”

তন্দ্রামূঢ়ের ন্যায় চক্ষু পুস্তক হইতে তুলিয়া ভিক্ষু আমার পানে চাহিলেন, অস্পষ্ট স্খলিতস্বরে বলিলেন, ‘কোথায় সে মূর্তি?’

আমি বলিলাম, ‘জানি না। চন্দন-মূর্তির উল্লেখ আর কোথাও দেখেছি বলে তো স্মরণ হয় না।’

অতঃপর দীর্ঘকাল আবার দুইজনে চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম। এই ক্ষুদ্র তথ্যটি ভিক্ষুর অন্তরের অন্তস্তল পর্যন্ত নাড়া দিয়া আলোড়িত করিয়া তুলিয়াছে তাহা অনুমানে বুঝিতে পারিলাম। আমি বোধ হয় মনে মনে তাঁহার নিকট হইতে আনন্দের একটা প্রবল উচ্ছ্বাস প্রত্যাশা করিয়াছিলাম; এইভাবে অভাবিতের সম্মুখীন হইয়া তিনি কি বলিবেন কি করিবেন তাহা প্রত্যক্ষ করিবার কৌতূহলও ছিল। কিন্তু তিনি কিছুই করিলেন না; প্রায় আধা ঘণ্টা নিশ্চলভাবে বসিয়া থাকিয়া হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইলেন। চক্ষে সেই সদ্যনিদ্রোত্থিতের অভিভূত দৃষ্টি— কোনও দিকে দৃক্‌পাত করিলেন না, নিশির ডাক শুনিয়া ঘুমন্ত মানুষ যেমন শয্যা ছাড়িয়া একান্ত অবশে চলিয়া যায়, তেমনি ভাবে ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন।

তারপর তিন মাস আর তাঁহার সাক্ষাৎ পাইলাম না।

হঠাৎ পৌষের মাঝামাঝি একদিন তিনি মূর্তিমান ভূমিকম্পের মতো আসিয়া আমার স্থাবরতার পাকা ভিত এমনভাবে নাড়া দিয়া আল্‌গা করিয়া দিলেন যে তাহা পূর্বাহ্ণে অনুমান করাও কঠিন। অন্তত আমি যে কোনও দিন এমন একটা দুঃসাহসিক কার্যে ব্রতী হইয়া পড়িব তাহা সন্দেহ করিতেও আমার কুণ্ঠা বোধ হয়।

তিনি বলিলেন, ‘সন্ধান পেয়েছি।’

আমি সানন্দে তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিলাম, ‘আসুন— বসুন।’

তিনি বসিলেন না, উত্তেজিত স্বরে বলিতে লাগিলেন, ‘পেয়েছি বিভূতিবাবু, সে মূর্তি হারায়নি, এখনও আছে।’

‘সে কি, কোথায় পেলেন?’

‘পাইনি এখনও। প্রাচীন বৈশালীর ভগ্নাবশেষ যেখানে পড়ে আছে সেই ‘বেসাড়ে গিয়েছিলুম। জেতবন-বিহারের কিছুই নেই, কেবল ইট আর পাথরের স্তূপ। তবু তারই ভেতর থেকে আমি সন্ধান পেয়েছি— সে মূর্তি আছে।’

‘কি করে সন্ধান পেলেন?’

‘এক শিলালিপি থেকে। একটা ভাঙা মন্দির থেকে একটা পাথর খসে পড়েছিল— তারই উল্টো পিঠে এই লিপি খোদাই করা ছিল।’ এক খণ্ড কাগজ আমাকে দিয়া উত্তেজনা-অবরুদ্ধ স্বরে বলিতে লাগিলেন, ‘জেতবন-বিহার ধ্বংস হয়ে যাবার পর বোধ হয় তারই পাথর দিয়ে ঐ মন্দির তৈরি হয়েছিল; মন্দিরটাও পাঁচ-ছ-শ’ বছরের পুরনো, এখন তাতে কোনও বিগ্রহ নেই। — একটা বিরাট অশথ্‌ গাছ তাকে অজগরের মতো জড়িয়ে তার হাড়-পাঁজর গুঁড়ো করে দিচ্ছে— পাথরগুলো খসে খসে পড়ছে। তারই একটা পাথরে এই লিপি খোদাই করা ছিল।’

কাগজখানা তাঁর হাত হইতে লইয়া পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম; অনুমান দশম কি একাদশ শতাব্দীর প্রাকৃত ভাষায় লিখিত লিপি, ভিক্ষু অবিকল নকল করিয়া আনিয়াছেন।

পাঠোদ্ধার করিতে বিশেষ কষ্ট পাইতে হইল না। শিলালেখের অর্থ এইরূপ—

“হায় তথাগত! সদ্ধর্মের আজ মহা দুর্দিন উপস্থিত হইয়াছে। যে জেতবন-বিহারে তুমি পঞ্চবিংশ বর্ষ যাপন করিয়াছ তাহার আজ কি শোচনীয় দুর্দশা! গৃহিগণ আর তোমার শ্রমণদিগকে ভিক্ষা দান করে না; রাজগণ বিহারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ। পৃথিবীর প্রান্ত হইতে শিক্ষার্থিগণ আর বিনয়-ধর্ম-সূত্ত অধ্যয়নের জন্য বিহারে আগমন করে না। তথাগতের ধর্মের গৌরব-মহিমা অস্তমিত হইয়াছে।

“তদুপরি সম্প্রতি দারুণ ভয় উপস্থিত হইয়াছে। কিছুকাল যাবৎ চারিদিক হইতে জনশ্রুতি আসিতেছে, তুরুস্ক নামক এক অতি বর্বর জাতি রাষ্ট্রকে আক্রমণ করিয়াছে। ইহারা বিধর্মী ও অতিশয় নিষ্ঠুর; ভিক্ষু-শ্রমণ দেখিলেই নৃশংসভাবে হত্যা করিতেছে এবং বিহার-সঙ্ঘাদি লুণ্ঠন করিতেছে।

“এই সকল জনরব শুনিয়া ও তুরুস্কগণ কর্তৃক আক্রান্ত কয়েক জন মুমূর্ষু পলাতক শ্রমণকে দেখিয়া জেতবন-বিহারের মহাথের বুদ্ধরক্ষিত মহাশয় অতিশয় বিচলিত হইয়াছেন। তুরুস্কগণ এই দিকেই আসিতেছে, অবশ্যই বিহার আক্রমণ করিবে। বিহারের অধিবাসিগণ অহিংসধর্মী, অস্ত্রচালনায় অপারগ। বিহারে বহু অমূল্য রত্নাদি সঞ্চিত আছে; সর্বাপেক্ষা অমূল্য রত্ন আছে, গোশীর্ষ চন্দনকাষ্ঠে নির্মিত বুদ্ধমূর্তি— যাহা ভগবান তথাগতের জীবিতকালে প্রসেনজিৎ নির্মাণ করাইয়াছিলেন। তুরুস্কের আক্রমণ হইতে এ সকল কে রক্ষা করিবে?

“মহাথের বুদ্ধরক্ষিত তিন দিবস অহোরাত্র চিন্তা করিয়া উপায় স্থির করিয়াছেন। আগামী অমাবস্যার মধ্যযামে দশ জন শ্রমণ বিহারস্থ মণিরত্ন ও অমূল্য গ্রন্থ সকল সহ ভগবানের চন্দন-মূর্তি লইয়া প্রস্থান করিবে। বিহার হইতে বিংশ যোজন উত্তর হিমালয়ের সানু-নিষ্ঠ্যুত উপলা নদীর প্রস্রবণ মুখে এক দৈত্য-নির্মিত পাষাণ-স্তম্ভ আছে; এই গগনলেহী স্তম্ভের শীর্ষদেশে এক গোপন ভাণ্ডার আছে। কথিত আছে যে, অসুর-দেশীয় দৈত্যগণ দেবপ্রিয় ধর্মাশোকের কালে হিমালয়ের স্পন্দনশীল জঙ্ঘাপ্রদেশে ইহা নির্মাণ করিয়াছিল। শ্রমণগণ চন্দন-মূর্তি ও অন্যান্য মহার্ঘ বস্তু এই গুপ্ত স্থানে লইয়া গিয়া রক্ষা করিবে। পরে তুরুস্কের উৎপাত দূর হইলে তাহারা আবার উহা ফিরাইয়া আনিবে।

“যদি তুরুস্কের আক্রমণে বিহার ধ্বংস হয়, বিহারবাসী সকলে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, এই আশঙ্কায় মহাথের মহাশয়ের আজ্ঞাক্রমে পরবর্তীদিগের অবগতির জন্য অদ্য কৃষ্ণা-ত্রয়োদশীর দিবসে এই লিপি উৎকীর্ণ হইল। ভগবান বুদ্ধের ইচ্ছা পূর্ণ হউক।”

এইখানে লিপি শেষ হইয়াছে। লিপি পড়িতে পড়িতে আমার মনটাও অতীতের আবর্তে গিয়া পড়িয়াছিল; আট শত বৎসর পূর্বে জেতবন-বিহারের নিরীহ ভিক্ষুদের বিপদ-ছায়াচ্ছন্ন ত্রস্ত চঞ্চলতা যেন অস্পষ্টভাবে চোখের সম্মুখে দেখিতে পাইতেছিলাম; বিচক্ষণ প্রবীণ মহাস্থবির বুদ্ধরক্ষিতের গম্ভীর বিষণ্ণ মুখচ্ছবিও চোখের উপর ভাসিয়া উঠিতেছিল। ভারতের ভাগ্যবিপর্যয়ের একটা ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ যেন ঐ লিপির সাহায্যে আমি কয়েক মুহূর্তের জন্য চলচ্ছায়ার মতো প্রত্যক্ষ করিয়া লইলাম। দেশব্যাপী সন্ত্রাস! শান্তিপ্রিয় নির্বীর্য জাতির উপর সহসা দুরন্ত দুর্মদ বিদেশীর অভিযান! ‘তুরুস্ক! তুরুস্ক! ঐ তুরুস্ক আসিতেছে!’ ভীত কণ্ঠের সহস্র সমবেত আর্তনাদ আমার কর্ণে বাজিতে লাগিল।

তারপর চমক ভাঙিয়া গেল। দেখিলাম ভিক্ষু অভিরামের চোখে ক্ষুধিত উল্লাস। গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলাম, ‘মহাস্থবির বুদ্ধরক্ষিতের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে— কিন্তু কত বিলম্বে!’

তিনি প্রদীপ্তস্বরে বলিয়া উঠিলেন, ‘হোক বিলম্ব। তবু এখনও সময় অতীত হয়নি। আমি যাব বিভূতিবাবু। সেই অসুর-নির্মিত পাষাণ-স্তম্ভ খুঁজে বার করব। কিছু সন্ধানও পেয়েছি— উপলা নদীর বর্তমান নাম জানতে পেরেছি। — বিভূতিবাবু, দেড় হাজার বছর আগে চৈনিক পরিব্রাজক কোরিয়া থেকে যাত্রা শুরু করে গোবি মরুভূমি পার হয়ে দুস্তর হিমালয় লঙ্ঘন করে পদব্রজে ভারতভূমিতে আসতেন। কি জন্যে? কেবল বুদ্ধ তথাগতের জন্মভূমি দেখবার জন্যে! আর, আমাদের বিশ যোজনের মধ্যে ভগবান বুদ্ধের স্বরূপ-মূর্তি রয়েছে, জানতে পেরেও আমরা তা খুঁজে বার করতে পারব না?’

আমি বলিলাম, ‘নিশ্চয় পারবেন।’

ভিক্ষু তাঁহার বিদ্যুদ্ধহ্নিপূর্ণ চক্ষু আমার মুখের উপর স্থাপন করিয়া এক প্রচণ্ড প্রশ্ন করিয়া বসিলেন, ‘বিভূতিবাবু, আপনি আমার সঙ্গে যাবেন না?’

ক্ষণকালের জন্য হতবাক্‌ হইয়া গেলাম। আমি যাইব! কাজকর্ম ফেলিয়া পাহাড়ে-জঙ্গলে এই মায়ামৃগের অন্বেষণে আমি কোথায় যাইব।

ভিক্ষু স্পন্দিতস্বরে বলিলেন, ‘আট-শ’ বছরের মধ্যে সে দিব্যমূর্তি কেউ দেখেনি। ভগবান শাক্যসিংহ আট শতাব্দী ধরে সেই স্তম্ভশীর্ষে আমাদেরই প্রতীক্ষা করেছেন— আপনি যাবেন না?’

ভিক্ষুর কথার মধ্যে কি ছিল জানি না, কিন্তু মজ্জাগত বহির্বিমুখতা ও বাঙালী-সুলভ ঘরের টান যেন সঙ্গীতযন্ত্রের উচ্চ সপ্তকের তারের মতো সুরের অসহ্য স্পন্দনে ছিঁড়িয়া গেল। আমি উঠিয়া ভিক্ষুকের হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিলাম, ‘আমি যাব।’


এই আখ্যায়িকা যদি আমাদের হিমাচল-অভিযানের রোমাঞ্চকর কাহিনী হইত তাহা হইলে বোধ করি নানা বিচিত্র ঘটনার বর্ণনা করিয়া পাঠককে চমৎকৃত করিয়া দিতে পারিতাম। কিন্তু এ-গল্পের ক্ষুদ্র পরিসরে অবান্তর কথার স্থান নাই। দৈত্য-নির্মিত স্তম্ভ অন্বেষণের পরিসমাপ্তিটুকু বর্ণনা করিয়াই আমাকে নিবৃত্ত হইতে হইবে।

কলিকাতা হইতে যাত্রা শুরু করিবার দুই সপ্তাহ পরে একদিন অপরাহ্ণে যে ক্ষুদ্র জনপদটিতে পৌঁছিলাম তাহা মনুষ্য-লোকালয় হইতে এত ঊর্ধ্বে ও বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থিত যে হিমালয়-কুক্ষিস্থিত ঈগল পাখির বাসা বলিয়া ভ্রম হয়। তখনও বরফের এলাকায় আসিয়া পৌঁছাই নাই; কিন্তু সম্মুখেই হিমাদ্রির তুষারশুভ্র দেহ আকাশের একটা দিক্‌ আড়াল করিয়া রাখিয়াছে। আশেপাশে পিছনে চারিদিকেই নগ্ন পাহাড়, পায়ের তলায় পাহাড়ী কাঁকর ও উপলখণ্ড। এই উপলাকীর্ণ কঠিন ভূমি চিরিয়া তন্বী উপলা নদী খরধারে নিম্নাভিমুখে ছুটিয়া চলিয়াছে। আকাশে বাতাসে একটা জমাট শীতলতা।

আমরা তিন জন— আমি, ভিক্ষু অভিরাম ও একজন ভুটিয়া পদপ্রদর্শক— গ্রামের নিকটবর্তী হইতেই গ্রামের সমস্ত স্ত্রীপুরুষ বালকবালিকা আসিয়া ঘিরিয়া দাঁড়াইল। বহির্জগতের মানুষ এখানে কখনও আসে না; ইহারা সুবর্তুল চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া আমাদের নিরীক্ষণ করিতে লাগিল।

চেহারা দেখিয়া মনে হইল— ইহারা লেপ্‌চা কিংবা ভুটানী। আর্য রক্তের সংমিশ্রণও সামান্য আছে; দুই-একটা খড়্গের মতো তীক্ষ্ণ নাক চোখে পড়িল।

এইরূপ খড়্গ-নাসিক একজন প্রৌঢ়গোছের লোক আমাদের দিকে অগ্রসর হইয়া আসিয়া নিজ ভাষায় কি বলিল, বুঝিতে পারিলাম না। আমাদের ভুটানী সহচর বুঝাইয়া দিল, ইনি গ্রামের মোড়ল, আমরা কি জন্য আসিয়াছি জানিতে চাহেন।

আমরা সরলভাবে আমাদের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করিলাম। শুনিয়া লোকটির চোখে মুখে প্রথমে বিস্ময়, তারপর প্রবল কৌতূহল ফুটিয়া উঠিল। সে আমাদের আহ্বান করিয়া গ্রামে লইয়া চলিল।

মিছিল করিয়া আমরা অগ্রসর হইলাম। অগ্রে মোড়ল, তাহার পিছনে আমরা তিন জন ও সর্বশেষে গ্রামের আবালবৃদ্ধ নরনারী।

একটি কুটিরের মধ্যে লইয়া গিয়া মোড়ল আমাদের বসাইল, আমরা ক্লান্ত ও ক্ষুৎপীড়িত দেখিয়া আহার্য দ্রব্য আনিয়া অতিথিসৎকার করিল। অতঃপর তৃপ্ত ও বিশ্রান্ত হইয়া দোভাষী ভুটিয়া মারফৎ বাক্যালাপ আরম্ভ করিলাম। সূর্য তখন পাহাড়ের আড়ালে ঢাকা পড়িয়াছে; হিমালয়ের সুদীর্ঘ সন্ধ্যা যেন স্বচ্ছ বাতাসে অলক্ষিত কুঙ্কুমবৃষ্টি আরম্ভ করিয়াছে।

মোড়ল বলিল, গ্রাম হইতে চার ক্রোশ উত্তরে উপলা নদীর প্রপাত— ঐ প্রপাত হইতেই নদী আরম্ভ। ঐ স্থান অতিশয় দুর্গম ও দুরারোহ; উপলার অপর পারে প্রপাতের ঠিক মুখের উপর একটি স্তম্ভের মতো পর্বতশৃঙ্গ আছে, উহাই বুদ্ধস্তম্ভ নামে খ্যাত। গ্রামবাসীরা প্রতি পূর্ণিমার রাত্রে বুদ্ধস্তম্ভকে উদ্দেশ করিয়া পূজা দিয়া থাকে। কিন্তু সে স্থান দুরধিগম্য বলিয়া সেখানে কেহ যায় না, গ্রামের নিকটে উপলা নদীর স্রোতে পূজা ভাসাইয়া দেয়।

ভিক্ষু জিজ্ঞাসা করিলেন, উপলা পার হইয়া স্তম্ভের নিকটবর্তী হইবার পথ কোথায়? মোড়ল মাথা নাড়িয়া জানাইল, পথ আছে বটে, কিন্তু তাহা এত বিপজ্জনক যে সে-পথে কেহ পার হইতে সাহস করে না। উপলার প্রপাতের নীচেই একটি প্রাচীন লৌহ-শৃঙ্খলের ঝোলা বা দোদুল্যমান সেতু দুই তীরকে সংযুক্ত করিয়া রাখিয়াছে, কিন্তু তাহা কালক্রমে এত জীর্ণ হইয়া পড়িয়াছে যে তাহার উপর দিয়া মানুষ যাইতে পারে না। অথচ উহাই একমাত্র পথ।

আমাদের গন্তব্য স্থানে যে পৌঁছিয়াছি তাহাতে সন্দেহ ছিল না। তবু নিঃসংশয় হইবার অভিপ্রায়ে মোড়লকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ওই স্তম্ভে কি আছে তাহা কেহ বলিতে পারে কি না। মোড়ল বলিল, কি আছে তাহা কেহ চোখে দেখে নাই, কিন্তু স্মরণাতীত কাল হইতে একটা প্রবাদ চলিয়া আসিতেছে যে বুদ্ধদেব স্বয়ং সশরীরে এই স্তম্ভে অবস্থান করিতেছেন, তাঁহার দেহ হইতে নিরন্তর চন্দনের গন্ধ নির্গত হয়; — পাঁচ হাজার বৎসর পরে আবার মৈত্রেয়-রূপ ধারণ করিয়া তিনি এই স্থান হইতে বাহির হইবেন।

ভিক্ষু আমার পানে প্রোজ্জ্বল চক্ষু চাহিয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘বুদ্ধদেব সশরীরে এই স্তম্ভে আছেন, তাহার দেহ থেকে চন্দনের গন্ধ নির্গত হয়— প্রবাদের মানে বুঝতে পারছেন? যে-শ্রমণরা বুদ্ধমূর্তি এনেছিল, তারা সম্ভবত ফিরে যেতে পারেনি— এই গ্রামেই হয়তো থেকে গিয়েছিল—’

ভিক্ষুর কথা শেষ হইতে পাইল না। এই সময় আমাদের কুটির হঠাৎ একটা প্রবল ঝাঁকানি খাইয়া মড়মড় করিয়া উঠিল। আমরা মেঝের উপর বসিয়া ছিলাম, আমাদের নিম্নে মাটির ভিতর দিয়াও একটা কম্পন শিহরিয়া উঠিল। আমিও ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলাম। — ‘ভূমিকম্প!’

আমরা উঠিয়া দাঁড়াইতে দাঁড়াইতে ভূমিকম্পের স্পন্দন থামিয়া গিয়াছিল। মোড়ল নিশ্চিন্তমনে মেঝেয় বসিয়া ছিল, আমাদের ত্রাস দেখিয়া সে মৃদুহাস্যে জানাইল যে ভয়ের কোনও কারণ নাই; এরূপ ভূমিকম্প এখানে প্রত্যহ চার-পাঁচ বার হইয়া থাকে, এ দেশের নামই ভূমিকম্পের জন্মভূমি।

আমরা অবাক্‌ হইয়া তাহার মুখের দিকে তাকাইয়া রহিলাম। ভূমিকম্পের জন্মভূমি! এমন কথা তো কখনও শুনি নাই। — তখনও জানিতাম না কি ভীষণ দুর্দান্ত সন্তান প্রসব করিবার জন্য সে উদ্যত হইয়া আছে।

ভিক্ষু অভিরাম কিন্তু উত্তেজিত স্বরে বলিয়া উঠিলেন, ‘ঠিক! ঠিক! শিলালিপিতে যে এ কথার উল্লেখ আছে— মনে নেই?’

শিলালিপিতে ভূমিকম্পের উল্লেখ কোথায় আছে স্মরণ করিতে পারিলাম না। ভিক্ষু তখন ঝোলা হইতে শিলালেখের অনুলিপি বাহির করিয়া উল্লসিত স্বরে কহিলেন, ‘আর সন্দেহ নেই বিভূতিবাবু, আমরা ঠিক জায়গায় এসে পৌঁছেছি। — এই শুনুন।’ বলিয়া তিনি মূল প্রাকৃতে লিপির সেই অংশ পড়িয়া শুনাইলেন— কথিত আছে যে, অসুর-দেশীয় দৈত্যগণ দেবপ্রিয় ধর্মাশোকের কালে হিমালয়ের স্পন্দনশীল জঙ্ঘাপ্রদেশে ইহা নির্মাণ করিয়াছিল।

মনে পড়িয়া গেল। স্পন্দনশীল জঙ্ঘাপ্রদেশ কথাটাকে আমি নিরর্থক বাগাড়ম্বর মনে করিয়াছিলাম, উহার মধ্যে যে ভূমিকম্পের ইঙ্গিত নিহিত আছে তাহা ভাবি নাই। বলিলাম, ‘হ্যাঁ, আপনি ঠিক ধরেছেন, ও-কথাগুলো আমি ভাল করে লক্ষ্য করিনি। এ জায়গাটা বোধ হয় শিলঙের মতো ভূমিকম্পের রাজ্য—’

এই সময় মোড়লের দিকে নজর পড়িল। সে হঠাৎ ভয়ঙ্কর উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে, ক্ষুদ্র তির্যক চক্ষু জ্বলজ্বল করিয়া জ্বলিতেছে, ঠোঁট দুইটা যেন কি একটা বলিবার জন্য বিভক্ত হইয়া আছে। তারপর সে আমাদের ধাঁধা লাগাইয়া পরিষ্কার প্রাকৃত ভাষায় বলিয়া উঠিল, ‘শ্রবণ কর। সূর্য যে-সময় উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্রের দ্বিতীয় পাদে পদার্পণ করিবেন সেই সময় বুদ্ধস্তম্ভের রন্ধ্রপথে সূর্যালোক প্রবেশ করিয়া তথাগতের দিব্যদেহ আলোকিত করিবে, মন্ত্রবলে স্তম্ভের দ্বার খুলিয়া যাইবে। উপর্যুপরি তিন দিন এইরূপ হইবে, তারপর এক বৎসরের জন্য দ্বার বন্ধ হইয়া যাইবে। হে ভক্ত শ্রমণ, যদি বুদ্ধের অলৌকিক মুখচ্ছবি দেখিয়া নির্বাণের পথ সুগম করিতে চাও, এ কথা স্মরণ রাখিও।’ এক নিশ্বাসে এতখানি বলিয়া মোড়ল হাঁপাইতে লাগিল।

তীব্র বিস্ময়ে ভিক্ষু বলিলেন, ‘তুমি — তুমি প্রাকৃত ভাষা জান?’

মোড়ল বুঝিতে না পারিয়া মাথা নাড়িল।

তখন ভুটানী সহচরের সাহায্য লইতে হইল। দোভাষী-প্রমুখাৎ মোড়ল জানাইল, ইহা তাহাদের কৌলিক মন্ত্র; পুরুষপরম্পরায় ইহা তাহাদের কণ্ঠস্থ করিতে হয়, কিন্তু মন্ত্রের অর্থ কি তাহা সে জানে না। আজ ভিক্ষুকে ঐ ভাষায় কথা কহিতে শুনিয়া সে উত্তেজিত হইয়া উহা উচ্চারণ করিয়াছে।

আমরা পরস্পরের মুখের পানে তাকাইলাম।

ভিক্ষু মোড়লকে বলিলেন, ‘তোমার মন্ত্র আর একবার বল।’

মোড়ল দ্বিতীয় বার ধীরে ধীরে মন্ত্র আবৃত্তি করিল। ব্যাপারটা সমস্ত বুঝিতে পারিলাম। এ মন্ত্র নয়— বুদ্ধস্তম্ভে প্রবেশ করিবার নির্দেশ। বৎসরের মধ্যে তিন দিন সূর্যালোকের উত্তাপ রন্ধ্রপথে স্তম্ভের ভিতরে প্রবেশ করিয়া সম্ভবত কোনও যন্ত্রকে উত্তপ্ত করে, ফলে যন্ত্র-নিয়ন্ত্রিত দ্বার খুলিয়া যায়। প্রাচীন মিশর ও আসীরিয়ায় এইরূপ কলকব্জার সাহায্যে মন্দিরদ্বার খুলিয়া মন্দিরের ভণ্ড পূজারিগণ অনেক বুজ্‌রুকি দেখাইত— পুস্তকে পড়িয়াছি স্মরণ হইল। এই স্তম্ভের নির্মাতাও অসুর— অর্থাৎ আসীরীয় শিল্পী; সুতরাং অনুরূপ কলকব্জার দ্বারা উহার প্রবেশদ্বারের নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব নয়। যে-শ্রমণগণ বুদ্ধমূর্তি লইয়া এখানে আসিয়াছিল তাহারা নিশ্চয় এ রহস্য জানিত; পাছে ভবিষ্য বংশ ইহা ভুলিয়া যায় তাই এ মন্ত্র রচনা করিয়া রাখিয়া গিয়াছে।

কিন্তু মোড়ল এ মন্ত্র জানিল কিরূপে?

তাহার মুখখানা ভাল করিয়া দেখিলাম। মুখের আদল প্রধানত মঙ্গোলীয় ছাঁদের হইলেও নাসিকা, ভ্রূ ও চিবুকের গঠন আর্য-লক্ষণযুক্ত। শ্রমণগণ ফিরিয়া যাইতে পারে নাই; তাহাদের দশ জনের মধ্যে কাহারও হয়তো পদস্খলন হইয়াছিল। এই মোড়ল সেই ধর্মচ্যুত শ্রমণের অধস্তন পুরুষ— পূর্বপুরুষের ইতিহাস সব ভুলিয়া গিয়াছে, কেবল শূন্যগর্ভ কবচের মতো কৌলিক মন্ত্রটি কণ্ঠস্থ করিয়া রাখিয়াছে।

চমক ভাঙিয়া স্মরণ হইল বৎসরের মধ্যে মাত্র তিনটি দিন স্তম্ভের দ্বার খোলা থাকে, তারপর বন্ধ হইয়া যায়। সে তিন দিন কবে? কতদিন দ্বার খোলার প্রত্যাশায় বসিয়া থাকিতে হইবে?

ভিক্ষুকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্রের দ্বিতীয় পাদে সূর্য কবে পদার্পণ করবেন?’

ভিক্ষু ঝোলা হইতে পাঁজি বাহির করিলেন। প্রায় পনর মিনিট গভীর তন্ময়তার সহিত পাঁজি দেখিয়া মুখ তুলিলেন। দেখিলাম তাঁহার অধরোষ্ঠ কাঁপিতেছে, চক্ষু অশ্রুপূর্ণ। তিনি বলিলেন, ‘কাল পয়লা মাঘ; সূর্য উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্রের দ্বিতীয় পাদে পদার্পণ করবেন—। কি অলৌকিক সংঘটন! যদি তিন দিন পরে এসে পৌঁছতুম—’ তাঁহার কণ্ঠস্বর থরথর করিয়া কাঁপিয়া গেল, অস্ফুট বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলিলেন, ‘তথাগত!’

কী সর্বগ্রাসী আকাঙ্ক্ষা পরিপূর্ণতার উপান্তে আসিয়া প্রতীক্ষা করিতেছে, ভাবিয়া আমার দেহও কাঁটা দিয়া উঠিল। মনে মনে বলিলাম, ‘তথাগত, তোমার ভিক্ষুর মনস্কাম যেন ব্যর্থ না হয়।’


পরদিন প্রাতঃকালে আমরা স্তম্ভ-অভিমুখে যাত্রা করিলাম, মোড়ল স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া আমাদের সঙ্গে চলিল।

গ্রামের সীমানা পার হইয়াই পাহাড় ধাপে ধাপে উঠিতে আরম্ভ করিয়াছে। স্থানে স্থানে চড়াই এত দুরূহ যে হস্তপদের সাহায্যে অতি কষ্টে আরোহণ করিতে হয়। পদে পদে পা ফস্কাইয়া নিম্নে গড়াইয়া পড়িবার ভয়।

ভিক্ষুর মুখে কথা নাই; তাঁহার ক্ষীণ শরীরে শক্তিরও যেন সীমা নাই। সর্বাগ্রে তিনি চলিয়াছেন, আমরা তাঁহার পশ্চাতে কোনওক্রমে উঠিতেছি। তিনি যেন তাঁহার অদম্য উৎসাহের রজ্জু দিয়া আমাদের টানিয়া লইয়া চলিয়াছেন।

তবু পথে দু’-বার বিশ্রাম করিতে হইল। আমার সঙ্গে একটা বাইনোকুলার ছিল, তাহারই সাহায্যে চারিদিক পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিলাম। বহু নিম্নে ক্ষুদ্র গ্রামটি খেলাঘরের মতো দেখা যাইতেছে, আর চারিদিকে প্রাণহীন নিঃসঙ্গ পাহাড়।

অবশেষে পাঁচ ঘণ্টারও অধিক কাল হাড়ভাঙা চড়াই উত্তীর্ণ হইয়া আমাদের গন্তব্য স্থানে পৌঁছিলাম। কিছুপূর্ব হইতেই একটা চাপা গম্‌ গম্‌ শব্দ কানে আসিতেছিল— যেন বহুদূরে দুন্দুভি বাজিতেছে। মোড়ল বলিল, ‘উহাই উপলা নদীর প্রপাতের শব্দ।’

প্রপাতের কিনারায় গিয়া যখন দাঁড়াইলাম তখন সম্মুখের অপরূপ দৃশ্য যেন ক্ষণকালের জন্য আমাদের নিস্পন্দ করিয়া দিল। আমরা যেখানে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিলাম তাহার প্রায় পঞ্চাশ হাত ঊর্ধ্বে সংকীর্ণ প্রণালী-পথে উপলার ফেনকেশর জলরাশি উগ্র আবেগভরে শূন্যে লাফাইয়া পড়িয়াছে; তারপর রামধনুর মতো বঙ্কিম রেখায় দুই শত হাত নীচে পতিত হইয়া উচ্ছৃঙ্খল উন্মাদনায় তীব্র একটা আবর্ত সৃষ্টি করিয়া বহিয়া গিয়াছে। ফুটন্ত কটাহ হইতে যেমন বাষ্প উত্থিত হয়, তেমনই তাহার শিলাহত চূর্ণ শীকরকণা উঠিয়া আসিয়া আমাদের মুখে লাগিতেছে।

এখানে দুই তীরের মধ্যস্থিত খাদ প্রায় পঞ্চাশ গজ চওড়া— মনে হয় যেন পাহাড় এই স্থানে বিদীর্ণ হইয়া অবরুদ্ধ উপলার বহির্গমনের পথ মুক্ত করিয়া দিয়াছে। এই দুর্লঙ্ঘ খাদ পার হইবার জন্য বহুযুগ পূর্বে দুর্বল মানুষ যে ক্ষীণ সেতু নির্মাণ করিয়াছিল তাহা দেখিলে ভয় হয়। দুইটি লোহার শিকল— একটি উপরে, অন্যটি নীচে— সমান্তরালভাবে এ-তীর হইতে ও-তীরে চলিয়া গিয়াছে। ইহাই সেতু। গর্জমান প্রপাতের পটভূমিকার সম্মুখে এই শীর্ণ মরিচা-ধরা শিকল দুটি দেখিয়া মনে হয় যেন মাকড়সার তন্তুর চেয়েও ইহারা ভঙ্গুর, একটু জোরে বাতাস লাগিলেই ছিঁডিয়া দ্বিখণ্ডিত হইয়া যাইবে।

কিন্তু ওপারের কথা এখনও বলি নাই। ওপারের দৃশ্যের প্রকৃতি এপার হইতে সম্পূর্ণ পৃথক এবং এই ধাতুগত বিভিন্নতার জন্যই বোধ করি প্রকৃতিদেবী ইহাদের পৃথক করিয়া দিয়াছেন। ওপারে দৃষ্টি পড়িলে সহসা মনে হয় যেন অসংখ্য মর্মর-নির্মিত গম্বুজে স্থানটি পরিপূর্ণ। ছোট-বড়-মাঝারি বর্তুলাকৃতি শ্বেতপাথরের ঢিবি যত দূর দৃষ্টি যায় ইতস্তত ছড়ানো রহিয়াছে। যাঁহারা সারনাথের ধামেক স্তূপ দেখিয়াছেন তাঁহারা ইহাদের আকৃতি কতকটা অনুমান করিতে পরিবেন। এই প্রকৃতি-নির্মিত স্তূপগুলিকে পশ্চাতে রাখিয়া গভীর খাদের ঠিক কিনারায় একটি নিটোল সুন্দর স্তম্ভ মিনারের মতো ঋজুরেখায় ঊর্ধ্বে উঠিয়া গিয়াছে। দ্বিপ্রহরের সূর্যকিরণে তাহার পাষাণ গাত্র ঝকমক করিতেছে। দেখিয়া সন্দেহ হয়, ময়দানবের মতো কোন মায়াশিল্পীই বুঝি অতি যত্নে এই অভ্রভেদী দেব-স্তম্ভ নির্মাণ করিয়া রাখিয়া গিয়াছে।

পৃথিবীর শৈশবকালে প্রকৃতি যখন আপন মনে খেলাঘর তৈয়ার করিত, ইহা সেই সময়ের সৃষ্টি। হয়তো মানুষ-শিল্পীর হাতও ইহাতে কিছু আছে। বাইনোকুলার চোখে দিয়া ভাল করিয়া দেখিলাম, কিন্তু ইহার বহিরঙ্গে মানুষের হাতের চিহ্ন কিছু চোখে পড়িল না। স্তম্ভটা যে ফাঁপা তাহাও বাহির হইতে দেখিয়া বুঝিবার উপায় নাই; কেবল স্তম্ভের শীর্ষদেশে একটি ক্ষুদ্র রন্ধ চোখে পড়িল— রন্ধটি চতুষ্কোণ, বোধ করি দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে এক হাতের বেশি হইবে না। সূর্যকিরণ সেই পথে ভিতরে প্রবেশ করিতেছে। ইহাই নিশ্চয় মন্ত্রোক্ত রন্ধ্র।

মগ্ন হইয়া এই দৃশ্য দেখিতেছিলাম। এতক্ষণে পাশে দৃষ্টি পড়িতে দেখিলাম, ভিক্ষু ভূমির উপর সাষ্টাঙ্গে পড়িয়া বুদ্ধস্তম্ভকে প্রণাম করিতেছেন।

ভিক্ষু অভিরাম আমাদের নিষেধ শুনিলেন না, একাকী সেই শিকলের সেতু ধরিয়া ওপারে গেলেন। আমরা তিন জন এপারে রহিলাম। পদে পদে ভয় হইতে লাগিল, এবার বুঝি শিকল ছিঁড়িয়া গেল, কিন্তু ভিক্ষুর শরীর কৃশ ও লঘু, শিকল ছিঁড়িল না।

ওপারে পৌঁছিয়া ভিক্ষু হাত নাড়িয়া আমাদের আশ্বাস জানাইলেন, তারপর স্তম্ভের দিকে চলিলেন। স্তম্ভ একবার পরিক্রমণ করিয়া আবার হাত তুলিয়া চিৎকার করিয়া কি বলিলেন, প্রপাতের গর্জনে শুনিতে পাইলাম না। মনে হইল তিনি স্তম্ভের দ্বার খোলা পাইয়াছেন।

তারপর তিনি স্তম্ভের অন্তরালে চলিয়া গেলেন, আর তাঁহাকে দেখিতে পাইলাম না। চোখে বাইনোকুলার লাগাইয়া বসিয়া রহিলাম। মানসচক্ষে দেখিতে লাগিলাম, ভিক্ষু চক্রাকৃতি অন্ধকার সোপান বাহিয়া ধীরে ধীরে উঠিতেছেন; কম্পিত অধরা হইতে হয়তো অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারিত হইতেছে— তথাগত, তমসো মা জ্যোতির্গময়—

সেই গোশীর্ষ চন্দনকাষ্ঠের মূর্তি কি এখনও আছে? ভিক্ষু তাহা দেখিতে পাইবেন? আমি দেখিতে পাইলাম না; কিন্তু সেজন্য ক্ষোভ নাই। যদি সে-মূর্তি থাকে পরে লোকজন আনিয়া উহা উদ্ধার করিতে পারিব। দেশময় একটা মহা হুলস্থূল পড়িয়া যাইবে।

এইরূপ চিন্তায় দশ মিনিট কাটিল।

তারপর সব ওলট-পালট হইয়া গেল। হিমালয় যেন সহসা পাগল হইয়া গেল। মাটি টলিতে লাগিল; ভূগর্ভ হইতে একটা অবরুদ্ধ গোঙানি যেন মরণাহত দৈত্যের আর্তনাদের মতো বাহির হইয়া আসিতে লাগিল। শিকলের সেতু ছিঁড়িয়া গিয়া চাবুকের মতো দুই তীরে আছড়াইয়া পড়িল।

১লা মাঘের ভূমিকম্পের বর্ণনা আর দিব না। কেবল এইটুকুই জানাইবা যে ভারতবর্ষের সমতলভূমিতে যাঁহারা এই ভূমিকম্প প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, তাঁহারা সেই ভূমিকম্পের জন্মকেন্দ্রের অবস্থা কল্পনা করিতেও পরিবেন না।

আমরা মরি নাই কেন জানি না। বোধ করি পরমায়ু ছিল বলিয়াই মরি নাই। নৃত্যোন্মাদ মাটি— তাহারই উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া ছিলাম। চোখের সম্মুখে বুদ্ধস্তম্ভ বাত্যাবিপন্ন জাহাজের মাস্তুলের মতো দুলিতেছিল। চিন্তাহীন জড়বৎ মন লইয়া সেই দিকে তাকাইয়া ছিলাম।

মনের উপর সহসা চিন্তার ছায়া পড়িল—

ভিক্ষ! ভিক্ষুর কি হইবে?

ভূমিকম্পের বেগ একটু মন্দীভূত হইল। বোধ হইল যেন থামিয়া আসিতেছে। বাইনোকুলারটা হাতেই মুষ্টিবদ্ধ ছিল, তুলিয়া চোখে দিলাম। পলায়নের চেষ্টা বৃথা, তাই সে-চেষ্টা করিলাম না।

আবার দ্বিগুণ বেগে ভূমিকম্প আরম্ভ হইল; যেন ক্ষণিক শিথিলতার জন্য অনুতপ্ত হইয়া শতগুণ হিংস্র হইয়া উঠিয়াছে, এবার পৃথিবী ধ্বংস না করিয়া ছাড়িবে না।

কিন্তু ভিক্ষু—?

স্তম্ভ এতক্ষণ মাস্তুলের মতো দুলিতেছিল, আর সহ্য করিতে পারিল না; মূলের নিকট হইতে দ্বিখণ্ডিত হইয়া গেল। অতল খাদের প্রান্তে ক্ষণকালের জন্য টলমল করিল, তারপর মরণোন্মত্তের মতো খাদের মধ্যে ঝাঁপ দিল। গভীর নিম্নে একটা প্রকাণ্ড বাষ্পোচ্ছ্বাস উঠিয়া স্তম্ভকে আমার চক্ষু হইতে আড়াল করিয়া দিল।

স্তম্ভ যখন খাদের কিনারায় দ্বিধাভরে টলমল করিতেছিল, সেই সময় চকিতের ন্যায় ভিক্ষুকে দেখিতে পাইলাম। বাইনোকুলারটা অবশে চোখের সম্মুখে ধরিয়া রাখিয়াছিলাম। দেখিলাম, ভিক্ষু রন্ধ্রপথে দাঁড়াইয়া আছেন, তাঁহার মুখে রৌদ্র পড়িয়াছে। অনির্বচনীয় আনন্দে সে মুখ উদ্ভাসিত। চারিদিকে যে প্রলয়ঙ্কর ব্যাপার চলিয়াছে সেদিকে তাঁহার চেতনা নাই।

আর তাঁহাকে দেখিলাম না; মরণোন্মত্ত স্তম্ভ খাদে ঝাঁপাইয়া পড়িল।

একাকী গৃহে ফিরিয়া আসিয়াছি।

তারপর কয়েক বৎসর কাটিয়া গিয়াছে, কিন্তু এ কাহিনী কাহাকেও বলিতে পারি নাই। ভিক্ষুর কথা স্মরণ হইলেই মনটা অপরিসীম বেদনায় পীড়িত হইয়া উঠে।

তবু এই ভাবিয়া মনে সান্ত্বনা পাই যে, তাঁহার জীবনের চরম অভীপ্সা অপূর্ণ নাই। সেই স্তম্ভশীর্ষে তিনি তথাগতের কিরূপ নয়নাভিরাম মূর্তি দেখিয়াছিলেন জানি না, কিন্তু তাঁহার জীবনব্যাপী অনুসন্ধান সফল হইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। মৃত্যুমুহূর্তে তাঁহার মুখের উদ্ভাসিত আনন্দ আজও আমার চোখের সম্মুখে ভাসিতেছে।

২৮ আষাঢ় ১৩৪৩

Inspire Literature
Inspire Literaturehttps://www.inspireliterature.com
Read your favourite inspire literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments